৫০তম অধ্যায়
ভীষ্মপরাক্রমদর্শনে যুধিষ্ঠিরের হতাশা
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ। সৈন্যগণ বিশ্রাম করিতে আরম্ভ করিলে দুৰ্য্যোধন হষ্টচিত্ত হইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীষ্মের ক্ৰোধ ও ভীষণ পরাক্রম দেখিয়া আপনার পরাজয়চিন্তায় নিতান্ত শোকার্ত্ত হইয়া সমুদয় ভ্রাতা ও ভূপতিগণসমভিব্যাহারে সত্বর কৃষ্ণের নিকট গমনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে বাসুদেব! দেখ, অনল যেমন তৃণরাশি দগ্ধ করে, তদ্রূপ ভীষণাপরাক্রম ভীষ্ম আমার সৈন্যগণকে দগ্ধ করিতেছেন; আমরা কিরূপে উহার সম্মুখীন হইব? আমার সৈন্যগণ ধনুৰ্দ্ধর মহাবলপরাক্রান্ত শান্তনুনন্দনকে দেখিয়া ও তাঁহার বাণে আহত হইয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করিতেছে। বরং ক্রুদ্ধ যম, বীজপাণি পুরন্দর, পাশহস্ত বরুণ ও গদাধারী কুবেরকে সংগ্রামে পরাজিত করা যায়, তথাপি মহাতেজাঃ মহারথ ভীষ্মকে কদাপি পরাজিত করা যায় না। অতএব আমি স্বীয় হীনবুদ্ধিপ্রভাবে [অল্প জ্ঞানহেতু] ভীষ্মরূপ অগাধ জলধিজলে নিমগ্ন হইলাম। হে গোবিন্দ! এই সমুদয় ভূপালগণকে ভীষ্মরূপ মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করা অপেক্ষা বনে গমনপূর্ব্বক জীবন অতিবাহিত করা আমার পক্ষে শ্ৰেয়ঃ। স্পষ্টই বোধ হইতেছে, মহাবীর ভীষ্ম আমার সেনাসমুদয় সংহার করিবেন। যেমন পতঙ্গ কালপ্রেরিত হইয়া প্ৰজ্বলিত হুতাশনে প্রবেশ করে, তদ্রূপ আমার সৈন্যগণ আত্মবিনাশের নিমিত্ত ভীষ্মের সমীপে গমন করিতেছে। হে বৃষ্ণিবংশাবতংস। আমি এককালে ক্ষয়প্রাপ্ত হইলাম; আমার মহাবলপরাক্রান্ত ভ্রাতারা বিপক্ষপক্ষের শরনিকরে নিতান্ত ব্যথিত হইতেছে। তাহারা অত্যন্ত সৌভ্রাত্ৰশালী; তিন্নিমিত্তই আমার অপরাধে রাজ্যভ্রষ্ট ও সুখচ্যুত হইয়াছে। হে কৃষ্ণ! সকলেই জীবনকে বহুজ্ঞান করিয়া থাকে; জীবন অতি দুর্লভ। আমি জীবিত-নির্বিশেষে [আজীবন] তপশ্চরণ করিব, তথাপি সমুদয় মিত্রবর্গের প্রাণবিনাশে কদাপি প্রবৃত্ত হইব না।
“ ‘মহাবলপরাক্রান্ত ভীষ্ম একাকী দিব্যাস্ত্রদ্বারা আমার বহুসহস্ৰ রথীকে সংহার করিবেন। অতএব হে মাধব! এক্ষণে কি কর্ত্তব্য, সত্বর তাহা স্থির করিয়া বল। মহাবীর অর্জ্জুনকে সমরে উদাসীনের ন্যায় বোধ হইতেছে। কেবল মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম অনুসরণপূর্ব্বক একাকী বাহুবীৰ্য্য প্রদর্শনপূর্ব্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া বীরঘাতিনী গদাদ্বারা গজ, অশ্ব, রথ ও পদাতির মধ্যে অতি দুষ্কর কাৰ্য্য করিতেছে। মহাবীর বৃকোদর অকপট যুদ্ধ করিয়া শতবৎসরে এই সমুদয় কৌরবসৈন্য নিঃশেষিত করিতে পারে। তোমার সখা ধনঞ্জয় অদ্বিতীয় অস্ত্রবেত্তা; কিন্তু সে আমাদিগকে ভীষ্ম ও দ্রোণের শরানলে দগ্ধ দেখিয়াও উপেক্ষা করিতেছে। বীরবরাগ্রগণ্য ভীষ্ম ও দ্রোণের দিব্যাস্ত্রসমুদয় বারংবার প্রযুক্ত হইয়া সমুদয় ক্ষত্ৰিয়গণকে দগ্ধ করিবে। ভীষ্মের যেরূপ পরাক্রম, তাহাতে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া অন্যান্য ভূপতিসমভিব্যাহারে আমাদিগকে এককালে উৎসন্ন করিবেন। অতএব হে যোগেশ্বর জনাৰ্দন! মেঘ যেমন দাবাগ্নি প্রশমিত করে, তদ্রূপ ভীষ্মকে সংহার করিতে পারে, এমন কোন মহারথের যদি অনুসন্ধান করিতে পার, তাহা হইলে তোমার প্রসাদে পাণ্ডবগণ হাতশত্রু ও স্বরাজ্যপ্রাপ্ত হইয়া বন্ধুবান্ধবগণসমভিব্যাহারে পরমহ্লাদে কালাতিপাত করে।”
যুধিষ্ঠিরের প্রতি কৃষ্ণের আশ্বস্তি
“মহামনাঃ যুধিষ্ঠির এই কথা বলিয়া শোকোপহতচিত্তের ন্যায় বহুক্ষণ অন্তর্ম্মনাঃ [বিমনা-উদ্বিগ্নচিত্ত] হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন। ভগবান কৃষ্ণ ধর্ম্মরাজকে নিতান্ত শোকার্ত্তা ও দুঃখোপহতচিত্ত দেখিয়া আহ্লাদজনক বাক্যে কহিতে লাগিলেন, “হে ভরতকুলপ্ৰদীপ৷ আপনি শোক করিবেন না; শোক করা আপনার উপযুক্ত নয়। আপনার ভ্রাতারা মহাবলপরাক্রান্ত ও ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য; আমি, মহারথ সাত্যকি, বিরাট, দ্রুপদ এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন আপনার প্রিয়কারী এবং সৈন্যসমেত অন্যান্য বহুসংখ্যক ভূপতিগণ আপনার প্রসাদাকাঙক্ষী ও ভক্ত। আপনার হিতচিকীর্ষু ও প্রিয়ানুষ্ঠাননিরত মহারথ ধৃষ্টদ্যুন্ন সৈনাপত্যকাৰ্য্যে [সেনাপতিপদে] নিযুক্ত হইয়াছেন। মহাবাহু শিখণ্ডী নিশ্চয়ই ভীষ্মকে সংহার করিবেন।”
ধৃষ্টদ্যুম্নের উৎসাহদান-ব্যূহরচনা
“মহারাজ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর তাঁহার সমক্ষে সভামধ্যে ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিলেন, “হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর, ক্রুদ্ধ হইও না। তুমি বাসুদেবসদৃশ প্রভাবসম্পন্ন; আমাদের সেনাপতিপদ গ্রহণ করিয়াছ। পূর্ব্বে কার্ত্তিকেয় যেমন দেবগণের সেনানায়ক হইয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি এক্ষণে পাণ্ডবগণের সেনানী হইয়াছ। অতএব এক্ষণে বলবিক্রমপ্রকাশপূর্ব্বক কৌরবগণকে সংহার কর। আমি, মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর, কৃষ্ণ, মাদ্রীনন্দনদ্বয়, দ্রৌপদীতনয়গণ ও অন্যান্য প্রধান প্রধান ভূপতিগণ, আমরা সকলেই তোমার অনুগমন করিব।”
“তখন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তত্রস্থ সমস্ত লোককে হৰ্ষিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, “ভগবান শম্ভু আমাকে দ্রোণান্তক করিয়া নির্ম্মাণ করিয়াছেন, আমি আজি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য ও জয়দ্ৰথ প্রভৃতি সমুদয় সমরদুর্ম্মদ বীরগণের সহিত সংগ্রাম করিব।” এইরূপে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন সমুদ্যত হইলে পর, যুদ্ধদুর্ম্মদ পাণ্ডবগণ উচ্চস্বরে চীৎকার করিতে লাগিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিলেন, “হে পাৰ্ষত! [পার্ষদ-পারিষদ] ক্ৰৌঞ্চারণ [ক্ৰৌঞ্চ অর্থ-বক। বকেরা আকাশে যেরূপ পংক্তিবদ্ধ হইয়া গমন করে, তদ্রূপ সৈন্যসজ্জা। সৈন্যসংখ্যানুসারে যথাসম্ভব পংক্তির অল্পতা বা আধিক্য হইবে] নামক ব্যূহদ্বারা সমুদয় শক্রকে নিবারণ করা যায়; পূর্ব্বে দেবাসুর যুদ্ধসময়ে মহামতি বৃহস্পতি পুরন্দরকে ঐ ব্যূহের কথা কহিয়াছিলেন। এক্ষণে আমরা সেই ব্যূহ নির্ম্মাণ করিব, কৌরবগণ ও অন্যান্য ভূপতিসমুদয় সেই অদৃষ্টপূর্ব্ব ব্যূহসন্দর্শন করিবেন।”
“মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া প্ৰভাতে ধনঞ্জয়াকে সর্ব্বসৈন্যের অগ্ৰে সন্নিবেশিত করিলেন। মহারথ অর্জ্জুনের কেতু ইন্দ্রের আদেশানুসারে বিশ্বকর্ম্মাকর্ত্তৃক বিনির্ম্মিত ও ইন্দ্ৰায়ুধসদৃশ পতাকাসমুদয়ে সমলঙ্কৃত হইয়াছিল। উহা আকাশগামী গন্ধর্ব্বপুরের ন্যায় নভোমণ্ডলে বিরাজিত হইতে লাগিল; দেখিলে বোধ হয়, যেন উহা নৃত্য করিতেছে। সূৰ্য্যসমীপে থাকিলে ব্ৰহ্মার যেরূপ শোভা হয়, সেই কেতুসমীপে থাকাতে অর্জ্জুনের ও অর্জ্জুনসমীপে থাকাতে সেই কেতুর তদ্রূপ শোভা হইল। মহারাজ দ্রুপদ বহুতর সৈন্যে পরিবৃত হইয়া পাণ্ডবসেনাগণের মস্তক এবং মহারাজ কুন্তিভোজ ও শৈব্য তাহার চক্ষু হইলেন। দশর্ণাধিপতি এবং প্রয়াগ, দাশেরক, অনূপক ও কিরাতগণ গ্ৰীবাদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির পটচ্চার, হুঞ্জ, পৌরবক ও নিষাদগণের সহিত পৃষ্ঠা হইলেন। মহাবীর ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রৌপদীতনয়গণ, অভিমন্যু, সাত্যকি এবং পিশাচ, দরদ, পৌণ্ড্রী, কুণ্ডীবিষ, মড়ক, লড়ক, তঙ্গণ, পরতঙ্গণ, বাহিক, তিত্তির, পাণ্ড্র, ঔড্র, শবর, তুম্বুর, বৎস ও নাকুল [নকুলপুত্র] পক্ষদ্বয়ে এবং নকুল ও সহদেব বামপাৰ্থে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। এই ব্যূহের উভয় পক্ষে অযুত, মস্তকে নিযুত, পৃষ্ঠে এক-অর্বুত বিংশতিসহস্র এবং গ্ৰীবায় একনিযুত সপ্ততিসহস্ৰ রথ সন্নিবেশিত হইল। ইহার চতুর্দ্দিকে পক্ষে [পার্শ্বে] ও পক্ষান্তে জ্বলন্ত পর্ব্বতের ন্যায় বারণগণ অবস্থান করিতে লাগিল। বিরাট কেকয়গণকে এবং কাশিরাজ ও শৈব্য তিন-অযুত রথ লইয়া সেই ব্যূহের জঘন [জঙ্ঘাদেশ] পালন করিতে লাগিলেন।
“হে মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এইরূপে সেই মহাব্যূহ নির্ম্মাণান্তর সৈন্যসমুদয়কে বর্ম্মিত [বর্ম্মদ্বারা আবৃত] করিয়া যুদ্ধার্থ সূর্য্যোদয় প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় বারণ ও রন্থসমুদয়ের উপর আদিত্যসঙ্কাশ নির্ম্মল বিপুল শ্বেতচ্ছত্ৰসকল শোভা পাইতে লাগিল।”