৫০তম অধ্যায়
ভীমবিক্ৰমস্মরণে ধৃতরাষ্ট্রের ভয়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি যাঁহাদিগের নাম উল্লেখ করিলে, তাহারা সকলেই মহোৎসাহসম্পন্ন, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু একদিকে একাকী ভীমসেন ও অন্য দিকে ভূপতিসকল একত্র মিলিত হইলে তাঁহার তুল্যবল হইতে পারেন। যেমন পশুগণ ব্যাঘ্র ও সিংহ হইতে ভীত হয়, সেইরূপ আমি ক্ষমাগুণ পরাঙ্মুখ ক্ৰোধপর বৃকোদর হইতে অধিকতর ভীত হইয়াছি। আমি তাহার ভয়ে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া সমস্ত রাত্রি জাগরিত হইয়া থাকি। আমার সৈন্যের মধ্যে এমন একজনও নয়নগোচর হয় না যে, শত্রুসমতেজাঃ মহাবাহু ভীমসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়। তাহার ক্ষমা নাই, বৈরভাবের শেষ নাই ও পরিহাস নাই। সে উন্মত্ত ও কুটিল দৃষ্টি; তাহার গর্জ্জন ও বেগ অতি ভয়ঙ্কর; তাহার উৎসাহ অতি দৃঢ় ও বল অতি প্ৰচণ্ড; সে অবশ্যই দণ্ডপাণি যমের ন্যায়। গদাধর হইয়া গুরুতর আগ্রহসহকারে আমার হতভাগ্য পুত্ৰগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিবে। আমি দিব্যচক্ষে সমুদ্যত ব্ৰহ্মদণ্ডের ন্যায় তাহার অষ্টাস্র [আটটি কোণবিশিষ্ট] লৌহময় সুবর্ণমণ্ডিত ভয়ঙ্কর গদা অবলোকন করিতেছি। যেমন বলবান সিংহ মৃগযূথের মধ্যে বিচরণ করে, সেইরূপ ভীমসেন মদীয় সেনাগণের মধ্যে সঞ্চরণ করবে। সেই বহুভোজী ক্রুরবিক্রম বৃকোদার বাল্যকালেও বলপূর্ব্বক আমার পুত্ৰগণকে আক্রমণ করিত। তৎকালে আমার পুত্ৰগণ উহার সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে মাতঙ্গমদিতের ন্যায় নিম্পেষিত হইত। তাহার পরাক্রম স্মরণ করিয়া আমার হাদয় কম্পিত হইতেছে, আমার পুত্ৰগণও তাহার বাহুবলে অতিমাত্র ভীত হইয়াছে। সেই ভীমবিক্ৰম ভীমসেনই এই সুহৃদ্ভেদের [কুরুপাণ্ডব বিচ্ছেদের] কারণ। আমি যেন সম্মুখে দেখিতেছি যে ক্ৰোধোদীপিত ভীমসেন রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া মাতঙ্গ, তুরঙ্গ ও সেনাগণকে গ্ৰাস করিতেছে। সে অস্ত্ৰশিক্ষায় দ্রোণ ও অর্জ্জুনের ন্যায়, বেগে বায়ুর ন্যায় এবং ক্রোধে ত্ৰিলোচনের ন্যায়; কোন ব্যক্তি তাহাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সংহার করিতে সমর্থ হয়?
“হে সঞ্জয়! মনস্বী ভীমসেন যে বাল্যকালেই আমার পুত্ৰগণকে সংহার করে নাই, ইহাই আমার পরম লাভ। যে ভীম ভীমবল যক্ষ ও রাক্ষসগণকে বিনষ্ট করিয়াছিল। কোনো মনুষ্য কি তাহার রণবেগ সহ্য করিতে পারে? এক্ষণে আমার দুরাত্মা পুত্ৰগণ তাহাকে ক্লেশিত করিতেছে, অতএব এখনকার ত’ কথাই নাই; সে বাল্যকালেও কদাপি আমার বশীভূত হয় নাই; সে এমন নিষ্ঠুর ও কোপনস্বভাব যে, ভগ্ন হইবে, তথাপি নত হইবে না। সেই অপ্ৰতিমশৌৰ্য্যশালী তালবৃক্ষের ন্যায় উন্নত অর্জ্জুন অপেক্ষাও প্ৰদেশপরিমাণ দীর্ঘ, তুরঙ্গ অপেক্ষাও বেগবান, মাতঙ্গ অপেক্ষাও বলবান এবং সেই অস্পষ্টভাষী ভীমসেনের কুটিল দৃষ্টি ও ভ্রূকুটিরচনা [ভ্রূভঙ্গী] অবলোকন করিলে বোধ হয় যে, সে কিছুতেই ক্ষান্ত হইবার নহে। বাল্যকালে ব্যাসদেবের নিকট উহার রূপ ও তেজের বিষয় শ্রবণ করিয়াছি যে, ক্ষমাহীন, নিত্যক্ৰোধপরায়ণ, যোধপ্রধান ভীমসেন যুদ্ধে লৌহময় দণ্ডে রথ, হন্তী, মনুষ্য ও অশ্বগণকে সংহার করিবে। আমি প্রথমে প্রতিকূলাচরণপূর্ব্বক তাহাকে অবমানিত করিয়াছি; এক্ষণে আমার পুত্ৰগণ কি প্রকারে তাহার লৌহময়, সরল, স্থূল, সুপার্শ্ব, সুবৰ্ণভূষিত, ঘোরনাদ শতয়ী গদার আঘাত সহ্য করিবে? আমার মন্দমতি পুত্ৰগণ অপার, অগাধ, শবের ন্যায় বেগসম্পন্ন, দুৰ্গম ও দুর্ব্বদগাহ ভীমরূপ সমুদ্র পার হইতে অভিলাষী হইয়াছে। আমি উচ্চস্বরে নিবারণ করি, তথাপি সেই পণ্ডিতন্মান্য বালকগণ তাহা শ্রবণ করে না। পশ্চাৎ যে কি বিপৎপাত হইবে, তাহারা অবগত হইতেছে না। যাহারা নবরূপ অনুকের [যমের] সহিত যুদ্ধ করিতে গমন করিবে, তাহারা বিধাতাকর্ত্তৃক মৃত্যুর মুখে প্রেরিত হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। আমার পুত্ৰগণ কি প্রকারে ভীমনিক্ষিপ্ত চতুৰ্হস্ত ষড়স্র [ষট্কোণ] ওজস্বল [অত্যুজ্জ্বল] দুঃসহ শৈক্যের [শিকার ন্যায় পাশ-বন্ধনরজ্জু] বেগ সহ্য করিবে? সেই প্ৰজ্বলিত হুতাশনসদৃশ ভীমসেন যখন ঘূর্ণ্যমান গদাঘাতে হস্তগণের মস্তক বিদীর্ণ করিবে, সৃক্কদ্বয় [অধরওষ্ঠের প্রান্তদ্বয়] পুনঃ পুনঃ পরিলেহনপূর্ব্বক যখন উষ্মা ত্যাগ করবে, যখন ভীষণরবে বাণরগণকে [হস্তী] আক্রমণ করিবে: এবং সেই সকল প্ৰমত্ত মাতঙ্গ প্ৰতিগর্জ্জনপূর্ব্বক তাহার বিরুদ্ধে ধাবমান হইলে সে যখন স্যান্দনপথে [রথ] দণ্ডায়মান হইয়া তাহাদিগকে সংহার করিবে, তখন কি আমার পুত্ৰগণ তাহার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইবে?
“যখন মহাবাহু ভীমসেন আমার সেনাগণকে উন্মূলনপূর্ব্বক পথ প্রস্তুত করিয়া গদ্যহস্তে নৃত্য করিতে করিতে প্ৰলয়কাল উপস্থিত করিবে, যেমন মত্ত-মাতঙ্গ কুসুমিত দ্রুমরাজি বিমর্দ্দিত করে, সেইরূপ বৃকোদর সংগ্রামে প্রবেশপূর্ব্বক যখন আমার পুত্ৰগণের সেনাগণকে সংহার করিবে, যখন রথসমুদয় রথিহীন, সারথিবিহীন, অশ্বহীন ও ধ্বজহীন এবং রথী ও গজারোহীদিগকে উৎপীড়িত করিবে, যেমন জাহ্নবীবেগ তীরজাত তরুগণকে ভগ্ন করে, সেইরূপ ভীমসেন যখন আমার পুত্ৰগণের সেনাসমূহকে ছিন্নভিন্ন করিবে, তখন আমার পুত্র, ভৃত্য ও রাজগণকে ভীমভয়ে কাতর হইয়া দিগ্গিন্তে পলায়ন-কিরতে হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
“মগধদেশের অধীশ্বর ধীমান জরাসন্ধ বল ও প্রতাপে অখণ্ড ভূমণ্ডল বশীভূত করিয়াছিলেন; কুরুগণ ভীষ্মপ্রভাবে এবং অন্ধকবৃষ্ণিগণ নীতিপ্রভাবে যে তাঁহার বশবর্ত্তী হয়েন নাই, দৈবই তাহার কারণ। কিন্তু যে বীর রিক্তহস্তে ও বাসুদেবের সাহায্যে বলপূর্ব্বক সেই মহাবীর জরাসন্ধের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া তাহাকে সংহার করিয়াছে, তাহা অপেক্ষা অধিক বলকাৰ্য্য আর কি আছে? যেমন আশীবিষ দীর্ঘকালসঞ্চিত হলাহল পরিত্যাগ করে, সেইরূপ বৃকোদর আমার পুত্ৰগণের প্রতি বহুকালসঞ্চিত [উপচিত-সঞ্চিত] তেজ প্রদর্শন করিবে, সন্দেহ নাই। যেমন বজ্রাধর বজ্ৰদ্ধারা দানবগণকে নিপাতিত করিয়াছেন, সেইরূপ ভীমসেন গদাঘাতে আমার পুত্ৰগণকে উন্মুলিত করিবে। আমি যেন নিরীক্ষণ করিতেছি, দুর্ব্বিষহ, দুর্ব্বার, তীব্ৰবেগ, অতিতাম্রাক্ষ বৃকোদর আগমন করিতেছে। মহাবীর বৃকোদর যদি গদা, ধনু, রথ ও বর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া কেবল বাহুযুদ্ধ করে, তাহা হইলেও কাহার সাধ্য তাহার সম্মুখীন হয়? আমার ন্যায় ভীস্ম, দ্রোণাচাৰ্য্য এবং কৃপাচাৰ্য্যও ধীমান ভীমসেনের বীরত্ব অবগত আছেন। তথাপি তাঁহারা আৰ্য্যব্ৰতবোধেই [ক্ষত্রিয়পালনীয় অবশ্যানুষ্ঠেয় জ্ঞানে] সমরে স্ব স্ব সংহারবিধানের নিমিত্ত আমার পুত্ৰগণের সেনামুখে অবস্থান করিবেন। আমি যখন পাণ্ডবগণের জয়লাভ হইবে অবগত হইয়াও পুত্ৰগণকে নিবারণ করিতেছি না, তখন পুরুষের ভাগই সর্ব্বতোভাবে প্রবল, তাহাতে সন্দেহ নাই। মহাধনুৰ্দ্ধর ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ চিরপ্রথিত স্বৰ্গপথ আশ্রয় করিয়া পার্থিব যশ রক্ষাপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রাণত্যাগ করবেন। আমার পুত্ৰগণের সহিত ইহাদিগের যেরূপ সম্পর্ক পাণ্ডবগণের সহিতও সেইরূপ। পাণ্ডব ও ধার্ত্তরাষ্ট্র উভয়েই ভীষ্মের পৌত্র; উভয়েই দ্রোণ কৃপাচাৰ্য্যের শিষ্য; তন্মধ্যে এই স্থবিরত্রয়কে [বিশেষবৃদ্ধ] যৎকিঞ্চিৎ অভীষ্ট আশ্রয় প্রদত্ত হইয়াছে; ইঁহারা অবশ্যই তাহার নিষ্ক্রয় [প্রতিদান] করিবেন। শস্ত্রগ্রহণপূর্ব্বক রণক্ষেত্রে প্রাণপরিত্যাগ করা স্বধর্ম্মপরায়ণ ক্ষত্ৰিয়গণের সাতিশয় শ্রেয়স্কর। যাঁহারা পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধে গমন করিবেন, এক্ষণে আমি কেবল তাহাদিগের নিমিত্ত শোকাকুল হইতেছি। বিদুর যে ভয়ের বিষয় উচ্চস্বরে ব্যক্তি করিয়াছিল, এক্ষণে সেই ভয় সমুপস্থিত হইয়াছে।
“আমার বোধ হয়, জ্ঞান দুঃখকে বিনাশ করিতে পারে না; প্রত্যুত অধিকতর দুঃখ হইলে জ্ঞানই বিনষ্ট হইয়া থাকে। মূঢ় ব্যক্তিরা যে দুঃখের দশায় অধীর হইয়া উঠে, তাহা বিচিত্র নহে, লোকসংগ্রহদর্শী জীবন্মুক্ত ঋষিগণও দুঃখের সময় সুখ ও দুঃখের সময়ে দুঃখ অনুভব করিয়া থাকেন। অতএব আমি কি এই অবশ্যম্ভাবী পুত্র, পৌত্র, কলাত্র, মিত্র ও রাজ্যের উন্মুলন সহ্য করিতে পারি? আমি নিপুণরূপে চিন্তা করিয়া দেখিতেছি যে কৌরবগণ কালগ্ৰাসে নিপতিত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই; কেন না, দূতক্ৰীড়া অবধি তাহাদিগেরই পাপাচরণ প্রকাশিত হইতেছে। ঐশ্বৰ্য্যলুব্ধ মন্দগতি দুৰ্য্যোধনের লোভে এই সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছে। এই দ্রুতগামী কাল চক্রনেমির ন্যায় পৰ্য্যায়ক্রমে ক্ৰমে ক্ৰমে গমনাগমন করিতেছে; কেহই ইহার হস্ত হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ হয় না।
“হা! আমি কি করিব? কি প্রকার কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিব? কোথায় বা গমন করিব? এই হতভাগ্য কৌরবগণ অবশ্যই কালকবলে কবলিত হইবে। শতপুত্র বিনাশ হইলে আমি অবশ হইয়া কি প্রকারে স্ত্রীগণের রোদনধ্বনি শ্রবণ করিব? অতএব মৃত্যু আমাকে গ্ৰহণ করুন। যেমন প্রজ্বলিত হুতাশন নিদাঘকালে বায়ুর সাহায্যে কক্ষরাশি দাহ করে, সেইরূপ গদাহস্ত ভীমসেন অর্জ্জুনের সহিত নিশ্চয়ই আমার পুত্ৰগণকে সংহার করিবে।”