বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকায় আলোর অভাবে বারুদাটায় আবছা আলোছায়া যেন কি এক রহস্যে থমথম করছে। বারান্দায় কোন জনপ্রাণীকে দেখা গেল না।
কিরীটী মানিকের সঙ্গে পাশপাশি হেঁটে চলে।
পর পর সব ঘর। ঘরের দরজায় দরজায় সব পুঁতির পদা ঝুলছে।
তৃতীয় দ্বারপথে মানিক চাটুয্যেকে অনুসরণ করে পুঁতির পর্দা সরিয়ে কিরীটী একটা হলঘরের মতই প্রশস্ত ঘরে প্রবেশ করল। ঘরের মেঝেতে কার্পেট বিছানো। পুরনো আমলের ভারী দামী আসবাব। আর বিরাট একটা আরশি—সুদৃশ্য চওড়া সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো—ঘরের পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে একেবারে মুখখামুখি টাঙানো।
যে দরজা-পথে ওরা ঘরে প্রবেশ করেছিল সে দরজা ছাড়াও একটি পশ্চিমমুখী দরজা দেখা গেল ঘরে। তাতেও ঐ একই ধরনের পর্দা ঝুলছে। গোটাচারেক জানলা। সবই দক্ষিণমুখী। জানলাগুলো বন্ধই ছিল একটি বাদে।
কিরীটী প্রশ্ন করে, ডে বডি কোথায়?
ঐ পূব দিককার ঘরে, আসুন না।
কিরীটী মানিক চাটুয্যেকে অনুসরণ করে।
কয়েক পা অগ্রসর হয়েই সহসা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আরশির মসৃণ গাত্রে ওর নজর পড়তেই ও যেন নিজের অজ্ঞাতেই থমকে দাঁড়িয়ে যায় মুহূর্তের জন্য।
একটি নারীর মুখ চকিতে ভেসে উঠেছিল আরশির মসৃণ গাত্রে। বোরখায় আবৃত মুখখানা। কিন্তু মুহূর্তের জন্য বোরখা মুখের উপর থেকে অপসারিত হয়েছিল।
কি সুন্দর কি কমনীয় একখানি নারীর মুখ। টানা জ্ব। টানা টানা দুটি চোখ। আর সেই চোখের তারায় যেন একটা ভীতি একটা সংশয়।
কিরীটী থমকে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই আরশির গা থেকে সে মুখের প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে যায়। কিরীটীকে থামতে দেখে মানিক চাটুয্যে শুধাল, কি হল?
না—কিছু না—চলল।
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সহসা নারীকণ্ঠের একটি হাসির তরঙ্গ যেন সেই স্তব্ধ গৃহের দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়ল।
খিলখিল করে কে হাসছে। হাসির শব্দটা যেন হঠাৎ উঠে হঠাৎই আবার মিলিয়ে গেল।
মিলিয়ে গেল নবাব আলী আসগর সাহেবের জীর্ণ অট্টালিকার দেওয়ালে দেওয়ালে, যেন শুষে নিল সেই হাসির শব্দটা।
বাইরে ঝড়-বৃষ্টি তেমনি চলেছে। সোঁ সোঁ হাওয়ায় ঝাউগাছের কান্না তেমনি শোনা যায়।
কিরীটী মানিক চাটুয্যের দিকে তাকায় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।
মানিক চাটুয্যেও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই হাসির শব্দে।
কে হাসল যেন মনে হল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ শুনলাম, মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় মানিক চাটুয্যে, দেখব খোঁজ নিয়ে?
না থাক, চলো।
কিরীটী কথাটা বলে মানিক চাটুয্যেকে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করে।
কয়েক পা অগ্রসর হতেই দুজনে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
এই ঘরে—
মানিক চাটুয্যে বলে। চলল….
অন্যান্য ঘরের দরজার মত এ ঘরেও পুঁতির পর্দা ঝুলছিল সেই পুঁতির পর্দা সরিয়ে সেই দরজার কবাট ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।
বোঝা গেল দরজাটা ভেজানো ছিল মাত্র।
প্রথমে মানিক চাটুয্যে ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে যায় কিরীটী।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হচ্ছিল থেকে থেকে, সেই সঙ্গে মৃদু একটা টুং টুং শব্দ। ঘরের মধ্যে।
কিরীটী তাকিয়ে দেখল ঘরের একটা জানলা খোলা।
বাতাসের ঝাপটায় সেই জানলার কাঁচের পুরাতন পাল্লা দুটো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলছে তাতেই। হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটা এসে ঘরে ঢুকছে। মাথার উপর শিলিং থেকে ঝুলন্ত বিরাট ঝাড়বাতির বেলোয়ারী কাঁচগুলো হাওয়ায় পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টুং টুং শব্দ করছে, সঙ্গীতের একটা বিলম্বিত সুর যেন।
ঘরের মধ্যে ঝাপসা আলো। রহস্যময় একটা অস্পষ্টতা যেন।
হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হল সঙ্গে সঙ্গে কক্ষটা উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে উঠল। কিরীটী তাকিয়ে দেখল ঝড়ের মধ্যে ইলেকট্রিক বাল্বগুলো একসঙ্গে সব জ্বলে উঠেছে।
সুইচটা টিপে মানিক চাটুয্যেই আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রখর আলোয় ঘরটা যেন এতক্ষণে চোখের সামনে দেখা দিল।
কারো শয়ন বা বসবার ঘর নয় এটা। জলসাঘর। মেঝেতে পুরু গালিচা বিছানোবড় বড় তাকিয়া-তাতে রেশমী ঝালর দেওয়া—চারদিকে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ছড়ানো। সেতার সারেঙ্গী বীণা সরোদ তানপুরা বাঁয়া তবলা ইত্যাদি—আর তারই মাঝখানে একটি নারীদেহ এলিয়ে পড়ে আছে। শুধুমাত্র সুন্দর বললেই বোধ হয় সব বলা হয় না—অতুলনীয় সুন্দর—এবং শুধু সুন্দর নয়, যেন আশ্চর্য!
কিরীটীর মনে হয় এমনটি বুঝি আর সে ইতিপূর্বে দেখেনি।
বয়স কতই বা হবে কুড়ির বেশী হবে না। পরনে দামী রেশমের শালোয়ার ও কাঁচুলী, তার উপর একটি সুক্ষ্ম ওড়না—ডানদিকের বুকে একটা ছোরা আমূল বিদ্ধ।
কাঁচুলীটা রক্তে লাল হয়ে রয়েছে
কানে হীরের কণাভরণ। হাতে দুগাছি করে প্ল্যাটিনামের উপরে হীরের চুড়ি। পায়ে ও হাতের পাতায় মেহেদীর রঙ। মাথায় চুল বেণীবদ্ধতাতে একটি সোনাল ফিতে জড়ানো-এক পাশে বেণীটা সাপের মত এলিয়ে পড়ে আছে।
টানা ভ্রূ। নিমীলিত আঁখিপদ্ম। একটা হাত ছড়ানোঅন্য হাতটা দেহের সঙ্গে লেগে আছে।
ছোরার বাঁটটা সাদা কারুকার্য করা। তরুণীর বক্ষে যদি ছোরাটা আমূল না বিদ্ধ থাকত মনে হত বুঝি সে ঘুমিয়ে আছে।
কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে ভূলুষ্ঠিত প্রাণহীন দেহটার দিকে চেয়ে থাকে।