নিশীতা পরবর্তী কয়েকদিন খোঁজখবর নিয়ে তিনটি ব্যাপারে নিশ্চিত হল। প্রথম ব্যাপারটি কব্জি কাটা দবিরকে নিয়ে–সে যেন বাতাসে উবে গিয়েছে। অপরাধের অন্ধকার জগতে উপস্থিতিটার গুরুত্ব খুব বেশি, সবাই যেহেতু সবাইকে খুন করে ফেলার চেষ্টা করে কাজেই কাউকে দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত দেখলেই ধরে নেওয়া হয় সে খুন হয়ে গেছে, তখন তার রাজত্ব খুব দ্রুত হাতছাড়া হয়ে যায়। কব্জি কাটা দবিরের বেলাতেও এটা ঘটেছে। তার এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদার বখরা, টেন্ডারের ভাগ সবকিছু তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তার এলাকায় এখন কানা বকুল নামে নতুন একজন মস্তানের আবির্ভাব হয়েছে। কব্জি কাটা দবিরকে নিয়ে কারো কোনো কৌতূহল নেই।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি সেই রহস্যময় আলোর রেখা নিয়ে–নিশীতা অসংখ্য মানুষের সাথে কথা বলেছে এবং সবার বক্তব্য মোটামুটি একরকম। রাত দুটোর একটু পর পশ্চিম আকাশ থেকে একটা আলোর রেখা ছুটে এসেছে। এটি বজ্রপাত নয়–বজ্রপাতের মতো আঁকাবাকা আলোর ঝলকানি ছিল না–আলোর রেখাঁটি ছিল একেবারে সরলরেখার মতো সোজা। আলোটি ছিল তীব্র এবং উজ্জল, এক পর্যায়ে পুরো এলাকা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের কিছু একটা হতে পারে বড় কোনো উল্কাপাত থেকে কিন্তু এত বড় উল্কা যদি পৃথিবীতে এসে আঘাত করে তার বিস্ফোরণে বিশাল জনপদ ভস্মীভূত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কোনো বড় বিস্ফোরণ ঘটে নি।
তৃতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে সত্যিকার অর্থে হতাশাব্যঞ্জক এ রকম কৌতূহলী একটা ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ঠিক কী ঘটেছে সেটা জানার জন্য কারো ভিতর কোনো কৌতূহল নেই। নিশীতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় বড় প্রফেসরদের শরণাপন্ন হয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি, তারা সবাই নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। আলোকরশ্মিটি মহাজাগতিক কোনো কিছু হতে পারে কি না জানতে চাইলে বড় বড় প্রফেসররা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়েছেন যেন তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র একজন বৃদ্ধ প্রফেসর তার কথা শুনে খিকখিক করে হেসে বললেন, রিয়াজ থাকলে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত।
রিয়াজ? নিশীতা জানতে চাইল, রিয়াজ কে?
আমার একজন ছাত্র। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ক্যালটেক থেকে এস্ট্রোফিজিক্সে পিএইচ.ডি. করে নাসার সাথে কিছুদিন কাজ করেছে। তার কাজকর্ম ছিল মহাজাগতিক প্রাণী নিয়ে। এত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিন্তু কাজ শুরু করল সায়েন্স ফিকশান নিয়ে! কী দুঃখের কথা।
নিশীতা নোট বইয়ে রিয়াজ সম্পর্কে তথ্যগুলো টুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, পুরো নাম কী রিয়াজের? কোথায় আছেন এখন?
পুরো নাম যতদূর মনে পড়ে রিয়াজ হাসান। এখন কোথায় আছে জানি না। যেখানে কাজ করত সেখানে ডিরেক্টরের সাথে ঝগড়া করে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল।
নিশীতা রিয়াজ হাসান সম্পর্কে যেটুকু সম্ভব তথ্য টুকে নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এল। এমনিতেই সে বাইরের বিজ্ঞানীদের কাছে লিখবে বলে ভেবেছিল, রিয়াজ হাসানকে খুঁজে পেলে সমস্যা অনেকটুকুই মিটে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে নিশীতা অনেক কষ্ট করে রিয়াজ হাসানের একটা ছবি যোগাড় করল। ছাত্র জীবনের ছবি–একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরের কয়েকদিন নিশীতা ইন্টারনেটে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল, পরিচিত সবার কাছে রিয়াজ হাসানের খোঁজ জানতে চেয়ে সে ই-মেইল পাঠিয়ে দিল। জার্নালে বের হওয়া পেপারগুলোতে সে রিয়াজ হাসানের নাম খোজার চেষ্টা করে। তার পুরোনো কর্মস্থলে তার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে।
পুরো এক সপ্তাহ অমানুষিক পরিশ্রম করেও রিয়াজ হাসান কোথায় আছে সে সম্পর্কে নিশীতা নতুন কিছুই জানতে পারল না। মানুষটি একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, নাসাতে কাজ করার সময় তথ্য পাঠানোর জন্য নতুন এক ধরনের এনকোডিং বের করেছিল, সেটি ব্যবহার করে ভিন্ন গ্যালাক্সিতে তথ্য পাঠানো যেতে পারে এটুকুই নতুন কিন্তু মানুষটি যেন একেবারে। বাতাসে উবে গেছে।
পরের সপ্তাহে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে একটি সেমিনার বিষয়ে লিখতে গিয়ে নিশীতার মোজাম্মেল হকের সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলতে হল। কাজের কথা শেষ করে মোজাম্মেল হক চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মহাজাগতিক প্রাণীর কী খবর?
নিশীতা হাসার চেষ্টা করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণীর খবর নেবার জন্য যে মানুষটি দরকার তার খবর পাচ্ছি না।
মোজাম্মেল হক ভুরু কুঁচকে বললেন, কে সেই মানুষ?
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে মোজাম্মেল হককে রিয়াজ হাসানের কথা বলল। মোজাম্মেল হক পুরোটুকু মন দিয়ে শুনে বললেন, তোমার বয়স কম তাই মানুষের ওপর বিশ্বাস খুব বেশি। আমার ধারণা এই মানুষটিকে খুঁজে পেলেও তোমার খুব একটা লাভ হবে না।
কিন্তু আগে খুঁজে তো পাই!
তুমি যে বর্ণনা দিলে তাতে মনে হল একটু খ্যাপা গোছের মানুষ। তার ওপর ডিরেক্টরের সাথে ঝগড়া করেছে। এই ধরনের মানুষেরা ঝগড়াঝাটি করে সাধারণত দেশে চলে আসে। দেশে এসে এরা একেবারে আলাদাভাবে থাকে–কারো সাথে মেশে না, কিছু করে না।
নিশীতা একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি বলছেন রিয়াজ হাসান এখন দেশে আছে?
তুমি যেহেতু দেশের বাইরে খুঁজে পাও নি আমার ধারণা দেশেই আছে। এক হিসেবে অবশ্য তা হলে খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন।
নিশীতা মাথা নাড়ল, না মোজাম্মেল ভাই। কঠিন নয়। দেশে থাকলে আমি তাকে খুঁজে বের করে ফেলব।
কীভাবে?
সোজা। এ রকম একজন মানুষ যদি দেশে থাকে তা হলে তার একমাত্র যে জিনিসটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ইন্টারনেট এ্যাকাউন্ট! দেশের আইএসপিগুলোর কাছে খোঁজ নিলেই বের হয়ে যাবে। আমি বের করে ফেলতে পারব।
মোজাম্মেল হক একটু সন্দেহের চোখে নিশীতার দিকে তাকালেন তার কথা ঠিক বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না।
.
নিশীতা কিন্তু সত্যি সত্যি দুদিনের মাঝে রিয়াজ হাসানকে খুঁজে বের করে ফেলল। তাকে শুরু করতে হয়েছিল একুশ জন রিয়াজ আহমেদকে দিয়ে–এক জন এক জন করে তাদের ছেঁটে ফেলে সত্যিকার রিয়াজ হাসানকে খুঁজে বের করতে হয়েছে।
রিয়াজ হাসানের বাসাটি সত্যি সত্যি তার চরিত্রের সাথে খাপ খেয়ে যায়। বাসার জায়গাটি বেশ বড় গাছগাছালিতে ভরা, কিন্তু সে তুলনায় বাসাটি খুব ছোট, বাইরে থেকে বাসাটি প্রায় দেখাই যায় না। নিশীতা যখন রিয়াজ হাসানের সাথে দেখা করতে এসেছে তখন সন্ধে পার হয়ে গেছে। গেট খুলে খোয়া বাঁধানো পথ দিয়ে হেঁটে বাসার দরজায় শব্দ করল, প্রথমে মনে হল ভিতরে কেউ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর খুট করে শব্দ হল এবং একজন মানুষ দরজা খুলে দাঁড়াল, নিশীতা দেখেই চিনতে পারল, মানুষটি রিয়াজ হাসান। তার কাছে যে ছবিটা রয়েছে তার সাথে অনেক মিল, মাথায় চুল এখনো এলোমেলো, মুখে এখনো এক ধরনের বিষণ্ণতা।
রিয়াজ হাসান নিশীতাকে দেখে একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। নিশীতা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, আপনি নিশ্চয়ই রিয়াজ হাসান।
মানুষটির মুখে বিস্ময়ের ছায়া পড়ে। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি রিয়াজ হাসান। আপনাকে চিনতে পারলাম না।
চিনতে পারার কথা নয়–আমি আপনাকে খুঁজে বের করেছি। আমার নাম নিশীতা। আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?
রিয়াজ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, বলল, আসুন।
নিশীতা ঘরের ভিতর ঢুকল, মানুষের বাসায় সাধারণত বাইরের মানুষ এলে বসানোর একটা জায়গা থাকে। এখানে সেরকম কিছু নেই। ঘরটিতে বসার জায়গা নেই–
অনেকগুলো টেবিল এবং সেখানে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। কয়েকটা নানা আকারের কম্পিউটার, সবগুলো খোলা, নানা ধরনের তার দিয়ে জুড়ে দেওয়া রয়েছে।
রিয়াজ একটা চেয়ারের ওপর স্থূপ করে রাখা কাগজপত্র এবং কিছু সার্কিট বোর্ড সরিয়ে নিশীতার বসার জন্য জায়গা করে দিয়ে বলল, বসুন।
নিশীতা ইতস্তত করে বলল, আপনি?
রিয়াজ হাসান চারদিকে একনজর তাকিয়ে অপরাধীর মতো বলল, আসলে আমার এখানে কেউ আসে না, তাই কাউকে বসানোর জায়গা নেই। আপনি বসুন–আমি ভিতর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আসি।
রিয়াজ চলে যাবার পর নিশীতা চেয়ারটাতে না বসে ঘরটিতে ইতস্তত হেঁটে বেড়ায়, খুব সতর্ক থাকতে হয় হঠাৎ করে কোনো কিছুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দেয়। ঘরের কোনায়। একটি মনিটর রাখা ছিল, তার সামনে যেতেই মনিটরটি হঠাৎ করে আলোকিত হয়ে ওঠে, সেখানে একজন মানুষের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় এবং মানুষটি পরিষ্কার গলায় বলল, কে? কে আপনি?
নিশীতা চমকে উঠে থেমে যায়। কম্পিউটারের মনিটর থেকে কেউ প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না সে ঠিক বুঝতে পারল না। নিশীতা ভালো করে মানুষটির প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাল, এটি সত্যিকার মানুষের মুখের ছবি নয়, কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, কম্পিউটার গেমগুলোতে যে ধরনের মানুষের চেহারা দেখা যায় অনেকটা সেরকম, তবে তার থেকে অনেক ভালো। মানুষটির চেহারায় ঠিক বয়স বোঝা যায় না–দশ বছরের বালক হতে পারে, বিশ বছরের যুবক হতে পারে আবার তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের প্রৌঢ়ও হতে পারে। মানুটির চেহারায় একটা সুনির্দিষ্ট অভিব্যক্তি রয়েছে প্রথমে ছিল কৌতূহল এবং নিশীতা দেখতে পেল অভিব্যক্তিটি এখন পুরোপুরি বিরক্তিতে পাল্টে গেছে। মানুষটি বিরক্ত গলার স্বরে বলল, কী হল? কথা বলছ না কেন?
নিশীতা কী করবে বুঝতে পারল না, তখন মনিটর থেকে মানুষের প্রতিচ্ছবিটি অত্যন্ত শক্ত গলায় ধমক দিয়ে বসল, একটা প্রশ্ন করছি সেটা কানে যায় না? কে তুমি?
নিশীতা থতমত খেয়ে বলল, আমি নিশীতা।
নিশীতা? সেটা আবার কী রকম নাম?
নিশীতা অবাক হয়ে মনিটরে মানুষের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রইল, সে এর আগে কখনো কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রামকে এ রকম স্পষ্ট ভাষায় কথোপকথন করতে শোনে নি। চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি সত্যি সত্যি আমার সাথে কথা বলছ?
মানুষটির মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে উঠল, সত্যি সত্যি নয়তো কি মিথ্যা কথা বলছি? তুমি দেখতে পাচ্ছ না?
তা দেখতে পাচ্ছি। খুবই বিচিত্র।
তুমি সত্যিই মনে কর এটা বিচিত্র?
নিশীতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন রিয়াজ হাসান একটা হালকা চেয়ার নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল, নিশীতাকে মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে হো হো করে হেসে উঠল, বলল, আপনাকে এপসিলন পাকড়াও করছে?
এপসিলন?
নিশীতার কথার উত্তরে মনিটর থেকে মানুষের প্রতিচ্ছবিটি বলল, কেন এপসিলন কি কারো নাম হতে পারে না?
নিশীতা একবার রিয়াজের দিকে আবার একবার মনিটরের দিকে তাকাল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। রিয়াজ ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় চেয়ারটা বসিয়ে বলল, এপসিলন আমার ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ কথোপকথন সফটওয়্যার।
নিশীতা কিছু বলার আগেই মনিটর থেকে মানুষটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কি বলতে চাও কথোপকথন সফটওয়্যার একটা ফ্যালনা জিনিস?
রিয়াজ গলা উঁচিয়ে বলল, ব্যস এপসিলন, অনেক হয়েছে। এখন চুপ কর।
কেন চুপ করব? আমি কি তোমার খাই না পরি?
বেয়াদব কোথাকার, তোমাকে আমি দেখাচ্ছি মজা বলে রিয়াজ হাসান একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাওয়ার কর্ডটা খুলে নিল।
সাথে সাথে মনিটরে মানুষটির চেহারা চুপসে ছোট হয়ে মিলিয়ে মনিটরটি অন্ধকার হয়ে গেল।
নিশীতা জিভ দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলল, আহা হা–কেন আপনি বেচারাকে টার্মিনেট করে দিলেন! বেশ তো কথা বলছিল।
আপনি চাইলে এর সাথে যত ইচ্ছে কথা বলতে পারেন কিন্তু সে চালু থাকলে আমি কিংবা আপনি কেউই কথা বলতে পারব না!
নিশীতা ঘরের মাঝামাঝি এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি ইংরেজিতে এ রকম কথোপকথন সফটওয়্যার দেখেছি, বাংলায় দেখি নি। কোথায় পেয়েছেন এটা?
কোথায় আবার পাব? আমি লিখেছি।
নিশীতা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে রিয়াজ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি লিখেছেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি কমিউনিকেশান্সের লোক।
রিয়াজ স্থির দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছেন মনে হচ্ছে।
নিশীতা মাথা নাড়ল, জি। নিয়ে এসেছি। আমি একজন সাংবাদিক–খোঁজ-খবর নেওয়াই আমার কাজ। আমার ধারণা আমি এখন আপনার সম্পর্কে যেটুকু জানি আপনি নিজেও ততটুকু জানেন না।
কী ব্যাপার? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
বলছি, কিন্তু তার আগে এপসিলন নিয়ে কয়েকটা কথা জেনে নিই। প্রথম প্রশ্ন, এর নাম এপসিলন কেন?
রিয়াজ হাসান একটু হেসে বলল, যদি এর নাম হত তেতাল্লিশ, আপনি তবুও জিজ্ঞেস করতেন এর নাম তেতাল্লিশ কেন! যদি এর নাম হত বকুল ফুল, আপনি জিজ্ঞেস করতেন কেন বকুল ফুল হল। যদি এর নাম হত ঝিনাইদহ
তার মানে বলতে চাইছেন নামটির সাথে সফটওয়্যারটির কোনো সম্পর্ক নেই?
রিয়াজ মাথা চুলকে বলল, একেবারে নেই তা নয়। যেদিন কোডিং শুরু করেছি সেদিন হঠাৎ টেলিভিশনে দেখি আমার এক ক্লাসফ্রেন্ডকে দেখাচ্ছে, সে প্রতিমন্ত্রী হয়ে গেছে! ইউনিভার্সিটিতে থাকার সময় তাকে আমরা ডাকতাম এপসিলন অর্থাৎ খুবই ছোট! সে এত তুচ্ছ ছিল যে তাকে এপসিলন ডাকাটাই বেশি। তাই প্রোগ্রামটা লিখতে গিয়ে এই নাম।
নিশীতা সব কিছু বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নেড়ে বলল, আপনার এপসিলন অসম্ভব স্মার্ট! যখন কথা বলে তখন মুখে অভিব্যক্তি দেখা যায়। এটি কীভাবে করেছেন? এর মাঝে কি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করেছেন?
রিয়াজ হাসান হো হো করে হেসে বলল, আপনি আমাকে কী ভেবেছেন? আমি প্রফেশনাল প্রোগ্রামার নই, একেবারেই এমেচার। সময় কাটানোর জন্য জোড়াতালি দিয়ে এটা দাঁড়া করিয়েছি। মুখের অভিব্যক্তিটি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করেছি। জানেন তো আজকাল প্রোগ্রামিং পানির মতো সোজা!
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু এপসিলন কী চমৎকার কথা বলল! একেবারে সত্যিকার মানুষের মতো।
রিয়াজ হাসান সকৌতুকে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখ টিপে হাসি চেপে বলল, আপনার তাই ধারণা?
হ্যাঁ। নিশীতা জোর গলায় বলল, একটু মেজাজী বা একটু বেয়াদপ হতে পারে কিন্তু খাঁটি মানুষের মতো কথা বলেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই!
আসলে আপনি মাত্র অল্প সময় কথা বলেছেন দেখে ধরতে পারেন নি–এটি আসলে একটি অত্যন্ত নির্বোধ প্রোগ্রাম।
নির্বোধ?
হ্যাঁ। আপনি যে কথাগুলো বলেন সেই কথাগুলো ব্যবহার করে একটা প্রশ্ন তৈরি করে। আপনার সব কথার উত্তর দেয় প্রশ্ন করে– প্রশ্নের উত্তর দেয় প্রশ্ন দিয়ে তাই আপনার মনে হয় এটা বুঝি বুদ্ধিমান!
নিশীতা চমৎকৃত হয়ে বলল, আমি ধরতে পারি নি।
এখন থেকে পারবেন। রিয়াজ মুখে খানিকটা গাম্ভীর্য এনে বলল, তবে এখানে হার্ডওয়্যারের কিছু কাজ আছে। একটা ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে কিছু ইমেজ প্রসেসিং হয়–
যার অর্থ এটি দেখতে পায়? ও
না–না–না—-এটাকে দেখতে পাওয়া বলে দেখা ব্যাপারটিকে অপমান করবেন না। বলেন ভিডিও ক্লিপকে প্রসেস করে। এ ছাড়া ভয়েস রিকগনিশান, ভয়েস সিনথেসিসের কিছু ভালো কাজ আছে। বেশিরভাগ হার্ডওয়্যারে, বুঝতেই পারছেন আমি হার্ডওয়্যারের মানুষ।
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি।
সেটাই শুনি আপনার কাছে। কতটুকু জানেন? কীভাবে জানেন? কেন জানেন?
আপনাকে আমি অনেকদিন থেকে খুঁজছি। সারা আমেরিকা খুঁজে আপনাকে পাই নি, তখন একজন বলল, আপনি নিশ্চয়ই দেশেই আছেন। দেশে খুঁজতেই সত্যি সত্যি পেয়ে গেলাম।
রিয়াজ হাসান অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, একটা ব্যাপারে আমি আপনার সাহায্য চাই।
কী ব্যাপার?
প্রায় তিন সপ্তাহ আগে আকাশ থেকে একটা নীল আলো নিচে নেমে এসেছে, যারা দেখেছে তারা বলেছে একেবারে সোজা নেমে এসেছে উল্কাপাতের মতো। কিন্তু কোনোরকম বিস্ফোরণ হয় নি।
রিয়াজ হাসান কোনো কথা না বলে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
আলোটা যেখানে নেমেছে তার কাছাকাছি জায়গায় একটা মানুষের ডেডবড়ি পাওয়া গেছে। মানুষটার পোস্টমর্টেম করেও কেউ বুঝতে পারে নি সে কেমন করে মারা গেছে। শরীরের ভিতরে এক ধরনের বিচিত্র ক্রিস্টাল, মনে হয় রক্তের এক ধরনের প্রসেসিং হয়েছে। মানুষটা আন্ডারওয়ার্ল্ডের, নাম কালা জব্বার। তার সাথে আরেকজন ছিল, তার নাম কব্জি কাটা দবির–সে বাতাসের মাঝে উবে গেছে। মানুষটা–
নীল আলোটা কবে নেমেছে?
তিন তারিখ। রাত দুটো পঁয়ত্রিশ মিনিটে।
আকাশের কোনদিক থেকে নেমেছে?
দক্ষিণ-পূর্ব থেকে সোজা নিচের দিকে।
রিয়াজ একটা কাগজে কী যেন লিখল, ছোট কয়েকটা সংখ্যা দিয়ে কিছু একটা হিসাব করল, তারপর হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে গেল।
নিশীতা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, আমার ধারণা মহাকাশ থেকে কোনো মহাকাশযান পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
রিয়াজ নিশীতার কথা শুনে হেসে ফেলল না বা হাসার চেষ্টাও করল না, এক দৃষ্টিতে একটা বিচিত্র ভঙ্গি করে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। নিশীতা অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বলল, আপনার কী মনে হয়? কোনো মহাজাগতিক প্রাণী কি এসেছে?
রিয়াজ কয়েক মুহূর্ত তার হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলল, সম্ভাব্য মহাজাগতিক প্রাণীদের তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যদি প্রথম স্তরের বুদ্ধিমত্তা হয়ে থাকে তা হলে আমাদের সভ্যতা কখনো তাকে দেখতে পাবে না। হয়তো তারা এখনই আছে, হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, হয়তো আমাদের দিয়ে একটা পরীক্ষা। করছে, আমরা জানতেও পারব না। মহাজাগতিক ঋীর সভ্যতা, বুদ্ধিমত্তা যদি তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্তরের হয় শুধু তা হলেই আমরা তারে দেখব।
তা হলে কি তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্তরের কিছু এসেছে?
বলা খুব মুশকিল। তবে, একটা ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন।
কী?
আপনার অনুমান যদি সত্যি হয়ে থাকে সেটি পৃথিবীতে গোপন থাকবে না।
গোপন থাকবে না?
না। আমি যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতাম তারা সারা পৃথিবীতে এই ধরনের ঘটনা খুঁজছে। আপনি যে ঘটনার বর্ণনা দিলেন সেটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তা হলে এই মুহূর্তে ঢাকায় আমার পুরোনো সব সহকর্মী হাজির হয়ে গেছে!
নিশীতা একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আমেরিকান সায়েন্টিস্টরা এখন ঢাকায় চলে এসেছে?
আমার তাই ধারণা।
কিন্তু আপনি আমাদের বাংলাদেশের সায়েন্টিস্ট। এ ব্যাপারে আপনি কিছু করবেন না?
রিয়াজ মাথা নাড়ল, বলল, না।
কেন নয়?
কারণ আমি ছেড়ে দিয়েছি। আমি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে আর কাজ করি না।
কেন করেন না?
সেটা অনেক দীর্ঘ ব্যাপার। বেশিরভাগই ব্যক্তিগত ব্যাপার। বলার মতো কিছু নয়।
নিশীতা কী বলবে কিছু বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কিন্তু এই মহাজাগতিক প্রাণী যদি আমাদের কোনো ক্ষতি করে? পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করে?
যদি তারা তৃতীয় স্তরের হয়ে থাকে তা হলে কিছু করার নেই। আমরা তাদের সামনে কিছু নই, তেলাপোকা কিংবা পিঁপড়ার মতো! আমাদের যদি দয়া করে বেঁচে থাকতে দেয় তা হলে বেঁচে থাকব। যদি চতুর্থ মাত্রার হয় তা হলে যোগাযোগের একটা ছোট সম্ভাবনা আছে–
আমরা কেমন করে বুঝব তারা কোন মাত্রার?
রিয়াজ এই প্রথম একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আপনাকে তার চেষ্টা করতে হবে। সেগুলো বিশ্লেষণ করার লোক আছে। সেটা করার জন্য কোনো কোনো মানুষকে বছরে এক শ থেকে দুই শ হাজার ডলার বেতন দেওয়া হয়। আমি আপনাকে বলেছি, সেই মানুষগুলো মনে হয় এর মাঝে এই দেশে চলে এসে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে! আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই।
নিশীতা অবাক হয়ে রিয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সত্যিই কিছু করবেন না?
রিয়াজ নরম গলায় বলল, আমি যেখানে কাজ করতাম সেই ল্যাবরেটরির বছরে বাজেট ছিল কয়েক বিলিয়ন ডলার। সেই ল্যাবরেটরি থেকেও সুযোগের অভাবে আমরা সবকিছু করতে পারতাম না। এখান থেকে আমি কী করব?
ইন্টারনেটে দেখেছি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য আপনার একটা কোডিং এলগরিদম আছে, সেটা ট্রান্সমিট করতে পারেন না?
রিয়াজ শব্দ করে হেসে বলল, তার জন্য বিশাল এ্যান্টেনা লাগবে, মেগাওয়াট পাওয়ার লাগবে। আমার বাসায় ডিশ এ্যান্টেনা দিয়ে তো সেটা করা যাবে না!
কেন? করলে কী হবে?
মহাজাগতিক প্রাণী যদি আমার বাসার ছাদে ঘোরাঘুরি করে তা হলে সেটা করা যায় কিন্তু দূর গ্যালাক্সিতে তো আর এটা দিয়ে খবর পাঠানো যাবে না?
নিশীতা একটু সামনে ঝুঁকে বলল, কিন্তু হয়তো এই মহাজাগতিক প্রাণী কাছাকাছিই আছে! ঢাকা শহরেই আছে।
না, নেই। পৃথিবীতে মহাজাগতিক প্রাণী সত্যি সত্যি চলে আসার সম্ভাবনা এত কম যে ধরে নিতে পারেন তার সম্ভাবনা শূন্য। আমরা তবু চোখ কান খোলা রাখি। আপনি যেটা বলছেন সেটার ব্যাপারে।
রিয়াজ হঠাৎ চুপ করে গেল। নিশীতা বলল, সেটার ব্যাপারে?
নাহ্। কিছু না।
রিয়াজ বলতে চাইছে না বলে নিশীতা জোর করল না। সে তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, আমি যদি মহাজাগতিক প্রাণী নিয়ে একটা স্টোরি করি আপনি একটা ইন্টারভিউ দেবেন?
ইন্টারভিউ? আমি?
হ্যাঁ।
রিয়াজ মাথা নাড়ল, বলল, না। সেটা একেবারেই ঠিক হবে না, মানুষ পাগল ভাববে। আর এসব ব্যাপার আসলে গোপনে করতে হয় সাধারণ মানুষের এগুলো জানা ঠিক নয়! তারা কখনোই এসব ব্যাপার ঠিকভাবে নিতে পারে না।
নিশীতা তর্ক করার জন্য কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, বলল, ঠিক আছে আপনাকে আমি জোর করব না। কিন্তু যদি আপনি মত পাল্টান আমাকে জানাবেন, প্লিজ।
ঠিক আছে, জানাব।
আমার টেলিফোন নম্বর দিয়ে যাচ্ছি। নিশীতা তার ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে রিয়াজের হাতে ধরিয়ে দিল। রিয়াজ অন্যমনস্কভাবে চোখ বুলিয়ে কার্ডটা তার শার্টের পকেটে রেখে দেয়। নিশীতা বুঝতে পারল নেহায়েত ভদ্রতা করে পকেটে রেখেছে, রিয়াজ নিজে থেকে তাকে টেলিফোন করবে না।
নিশীতা অবশ্য কল্পনা করে নি দুদিনের ভিতরেই সে রিয়াজের টেলিফোন পাবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে, সম্পূর্ণ বিচিত্র পরিবেশে।