৩২তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠির-শোকোচ্ছ্বাসে পুনঃ ব্যাস-উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! নারদের বাক্যাবসানে ধর্ম্মতত্ত্বজ্ঞ মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন শোকসন্তপ্ত রাজা যুধিষ্ঠিরকে মৌনাবলম্বন করিতে দেখিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! প্রজাপালন করাই ভূপতিদিগের সনাতন ধর্ম্ম। ধর্ম্মের অনুবর্তী হওয়া মনুষ্যের নিতান্ত আবশ্যক। অতএব তুমি ধৰ্ম্মানুসারে পিতৃপিতামহোপভুক্ত রাজ্য গ্রহণ কর। বেদে তপস্যা ব্রাহ্মণগণেরই প্রধান ধর্ম্ম বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে; অতএব তপস্যা করাই ব্রাহ্মণের কৰ্ত্তব্যকর্ম্ম। ক্ষত্রিয়েরা সমস্ত ধৰ্ম্মের রক্ষকরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছেন। যে ব্যক্তি বিষয়নিরত হইয়া শাসন অতিক্রম করে, তাহাকে সমুচিত দণ্ড প্রদান করা ক্ষত্রিয়ের অবশ্য কর্ত্তব্য। কি ভৃত্য, কি পুত্র, কি তপস্বী, যে কেহ হউক না কেন, মোহবশতঃ নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিলে রাজা অবশ্যই তাহাকে শাসন বা বিনাশ করিবেন। যে রাজা ইহার অন্যথাচরণ করেন, তাঁহাকে পাপভোগ করিতে হয়। যে ব্যক্তি ধর্ম্ম বিনষ্ট হইতে দেখিয়া উহার রক্ষা না করে, সেই ব্যক্তিই ধর্ম্মহন্তা। তুমি ধর্ম্মহন্তা কৌরবগণকে সবংশে নিপাতিত করিয়াছ, তন্নিবন্ধন তোমার শোক করিবার আবশ্যক কি? বধাদিগের বধ, ধর্ম্মানুসারে প্রজাগণের রক্ষা ও সৎপাত্রে ধনদানই ত’ রাজার ধর্ম্ম।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! আপনি যাহা কহিলেন, সে বিষয়ে আমার কোন সংশয়ই নাই। আপনি সমুদয় ধৰ্ম্মই অবগত আছেন। এক্ষণে আমি রাজ্যলোভে অনেক অবধ্য লোকের প্রাণ সংহার করিয়াছি বলিয়াই শোকে আমার হৃদয় বিদীর্ণ ও দেহ দগ্ধ হইতেছে।”
তখন বেদব্যাস কহিলেন, “মহারাজ! কৰ্ম্মের কৰ্ত্তা কে, ঈশ্বর পুরুষ? আর লোকে যে ফল ভোগ করে, তাহা কি কৰ্ম্ম হইতে সমুৎপন্ন, না অকস্মাৎ সমুপস্থিত হয়? যদি ঈশ্বর সমুদয় কার্য্যের কৰ্ত্তা হয়েন, তাহা হইলে পুরুষেরা ঈশ্বরের নিয়োগানুসারেই শুভ বা অশুভ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, সুতরাং ঈশ্বরকেই তাহার ফল ভোগ করিতে হইবে। যদি কোন ব্যক্তি অরণ্যমধ্যে কুঠারদ্বারা বৃক্ষচ্ছেদন করে, তাহা হইলে মনুষ্যকে বৃক্ষচ্ছেদনজনিত পাপগ্রস্ত হইতে হয়; কুঠার কখনই ঐ পাপে লিপ্ত হয় না। যদি বল, কুঠার অচেতন পদার্থ, উহার ত’ পাপভোগের সম্ভাবনা নাই; সুতরাং কুঠারব্যবহারকারী মনুষ্যকেই পাপভোগ করিতে হয়। তাহা হইলে কুঠারনির্ম্মাণকৰ্ত্তার বৃক্ষচ্ছেদনের পাপে লিপ্ত হওয়া উচিত। কেন না, যদি সে কুঠার নির্ম্মাণ না করিত, তাহা হইলে ছেদনকর্তা কখনই বৃক্ষচ্ছেদনে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিত না; কিন্তু শস্ত্রপ্রহারকর্ত্তা স্বকাৰ্য্যসাধনাৰ্থে বৃক্ষচ্ছেদনপূৰ্ব্বক পাপে লিপ্ত না হইয়া শস্ত্রনির্ম্মাণকর্ত্তা পাপভাগী হইবে, ইহা কোনক্রমেই যুক্তিসিদ্ধ নহে। অতএব যদি একজনের কৰ্ম্মফল অন্যকে ভোগ করিতে না হইল, তাহা হইলে মনুষ্য কি নিমিত্ত ঈশ্বরের অনুমতিক্রমে তাঁহার কাৰ্য্যসাধন করিয়া সেই কার্য্যের ফলভোগ করিবে? ঐ ফল ঈশ্বরেরই ভোগ করা উচিত। পক্ষান্তরে, যদি তুমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করিয়া পুরুষকেই কৰ্ম্মের কৰ্ত্তা বলিয়া স্থির কর, তাহা হইলে তুমি অহিতানুষ্ঠানপরতন্ত্র দুরাত্মা শত্রুগণকে বিনাশ করিয়া অতি উত্তম কাৰ্য্যই করিয়াছ; তাহার নিমিত্ত চিন্তার বিষয় কি? আর দেখ, অদৃষ্টকে অতিক্রম করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে; সুতরাং মনুষ্য অদৃষ্টপ্রভাবে কৰ্ম্ম করিয়া কি নিমিত্ত পাপভাগী হইবে? বিশেষতঃ যদি মৃত্যুকে মনুষ্যের নৈসর্গিক ধর্ম্ম বিবেচনা কর, তাহা হইলে কেহই কখন কাহারও বধজনিত পাপে লিপ্ত হয় নাই, হইবেও না। আর যদি তুমি শাস্ত্রযুক্তি অনুসারে লোকের পাপপুণ্যের অস্তিত্ব স্বীকার কর, তাহা হইলে রাজার পক্ষে যে দণ্ডবিধান অবশ্য কর্ত্তব্য, ইহা তোমাকে শাস্ত্র ও বিশুদ্ধ যুক্তির অনুমোদিত বলিয়া অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে। যাহা হউক, আমার মতে ইহলোকে শুভ ও অশুভ কৰ্ম্মসমুদয় প্রতিনিয়ত পরিভ্রমণ করিতেছে। যে ব্যক্তি যেরূপ কর্ম্মে হস্তক্ষেপ করে, তাঁহাকে তদনুরূপ ফলভোগ করিতে হয়, অতএব তুমি অশুভফলপ্রদ কার্য্যসকল পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সংসারযাত্রা-নিৰ্ব্বাহে প্রবৃত্ত হও; আর শোক করিও না। তুমি ক্ষত্রিয়; সুতরাং ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম নিন্দনীয় হইলেও তোমার উহাই অবলম্বন করা কর্ত্তব্য। আত্মপরিত্যাগ করা কদাপি বিধেয় নহে। মনুষ্য জীবিত থাকিলে অনায়াসে স্বীয় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে পারে, কিন্তু জীবন ত্যাগ করিলে কখনই উহাতে সমর্থ হয় না। অতএব জীবিত থাকিয়া প্রায়শ্চিত্ত করাই তোমার কর্ত্তব্য। যদি তুমি প্রায়শ্চিত্ত না করিয়া প্রাণত্যাগ কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তোমায় পরলোকে অনুতাপ করিতে হইবে।”