০২. মশা

মশা

পদচারী বিজ্ঞানী কনভেনশনে অনিক লুম্বার সাথে পরিচয় হবার পর আমি একদিন তার বাসায় বেড়াতে গেলাম। কেউ যেন মনে না করে আমি খুব মিশুক মানুষ, আর কারো সাথে পরিচয় হলেই মিষ্টির বাক্স নিয়ে তার বাসায় বেড়াতে যাই। আমি কখনোই কারো বাসায় বেড়াতে যাই না, কারণ কোথাও গেলে কী নিয়ে কথা বলতে হয় আমি সেটা জানি না। আগে যখন পত্রিকা পড়তাম তখন দেশে-বিদেশে কী হচ্ছে তার হালকা মতন একটা ধারণা ছিল, পত্রিকা পড়া ছেড়ে দেবার পর এখন কোথায় কী হচ্ছে সে সম্পর্কে একেবারে কোনো ধারণা নেই। দেশের সেরা মাস্তান কি গাল কাটা বন্ধুর নাকি নাক ভাঙা জব্বর, সেটাও আমি আজকাল জানি না। কোন নায়ক ভালো মারপিট করে, কোন নায়িকা সবচেয়ে মোটা, কোন গায়কের গলা সবচেয়ে মিষ্টি, কোন কবির কবিতা ফাটাফাটি, এমনকি কোন মন্ত্রী সবচেয়ে বড় চোর সেটাও আমি জানি না। কাজেই লোকজনের সাথে বসে কথাবার্তা বলতে আমার খুব ঝামেলা হয়। কেউ হাসির কৌতুক বললেও বেশিরভাগ সময়ে সেটা বুঝতে পারি না, যদিবা বুঝতে পারি তা হলে ঠিক কোথায় হাসতে হবে সেটা ধরতে পারি না, ভুল জায়গায় হেসে ফেলি! সেজন্য আমি মানুষজন এড়িয়ে চলি, তবে অনিক লম্বার কথা আলাদা। কেন জানি মনে হচ্ছে আমার এই মানুষটার বাসায় যাওয়া দরকার। মানুষটা অন্য দশজন মানুষের মতো না।

বাসা খুঁজে বের করে দরজায় শব্দ করতেই অনিক লুম্বা দরজা খুলে দিল। আমার কথা মনে আছে কিনা কে জানে, তাই নতুন করে পরিচয় দিতে যাচ্ছিলাম। অনিক লুম্বা তার আগেই চোখ বড় বড় করে বলল, আরে! জাফর ইকবাল সাহেব! কী সৌভাগ্য!

আমি চোখ ছোট ছোট করে অনিক লুম্বার দিকে তাকিয়ে সে ঠাট্টা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম, এর আগে কেউ আমাকে দেখাটা সৌভাগ্য বলে মনে করে নি। বরং উল্টোটা হয়েছে—দেখা মাত্রই কেমন জানি মুষড়ে পড়েছে। তবে অনিক লুম্বাকে দেখে মনে হল মানুষটা আমাকে দেখে আসলেই খুশি হয়েছে। আমার হাত ধরে জোরে জোরে ঝাকাতে আঁকাতে বলল, কী আশ্চর্য! আমি ঠিক, আপনার কথাই ভাবছিলাম।

যারা আমার কাছে টাকাপয়সা পায় তারা ছাড়া অন্য কেউ আমার কথা ভাবতে পারে আমি চিন্তা করতে পারি না। অবাক হয়ে বললাম, আমার কথা ভাবছিলেন?

হ্যাঁ।

কেন?

বসে বসে চিঠিপত্র লিখছিলাম। চিঠির শেষে নিজের নামের জায়গায় কুতুব আলী মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন নাফছি জাহাঙ্গীর না লিখে লিখছি অনিক লুম্বা! কী সহজ। কী আনন্দ। আপনার জন্যেই তো হল।

সেটা তো আপনি নিজেই করতে পারতেন!

কিন্তু করি নাই। ক্যা হয় নাই। অনিক লুম্বা আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে বলল, ভেতরে আসেন। বসেন।

আমি না হয়ে অন্য যে কোনো মানুষ হলে ভাবত ঘরে বসার জায়গা নাই। সোফার উপরে বইপ-খাতা-কলম এবং বালিশ। একটা চেয়ারের ওপর স্থূপ হয়ে থাকা কাপড়, শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি এবং আন্ডারওয়্যার। টেবিলে নানারকম যন্ত্রপাতি, প্লেটে উচ্ছিষ্ট খাবার, পেপসির বোতল। ঘরের দেওয়ালে কয়েকটা পোস্টার টেপ দিয়ে লাগানো। কয়েকটা শেলফ, শেলফে অনেক বই এবং নানারকম কাগজপত্র। ঘরের মেঝেতে জুতো, স্যান্ডেল, খালি চিপসের প্যাকেট, কলম, পেন্সিল, নাট-বল্ট এবং নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। দেওয়ালে কটকটে একটা লাইট। আমি একেবারে লিখে দিতে পারি অন্য যে কোনো মানুষ এই ঘরে এলে স্বলত, ইস! এই মানুষটা কী নোংরা, ঘরবাড়ি কী অগোছালো ছি! কিন্তু আমার একবারও সেটা মনে হল না—আমার মনে হল আমি যেন একেবারে নিজের ঘরে এসে ঢুকেছি। ঘরের নানা জায়গায় এই যন্ত্রপাতিগুলো ছুড়ানো-ছিটানো না থাকলে এটা একেবারে আমার ঘর হতে পারত। সোফার কম্বল বালিশ একটু সরিয়ে আমি সাবধানে বসে পড়লাম, লক্ষ রাখলাম কোনো কাগজপত্র যেন এতটুকু নড়চড় না হয়। যারা খুব গোছানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ তাদের ধারণা অগোছালো মানুষের সবকিছু এলোমেলো, কিন্তু এটা সত্যি না। আমি একেবারে লিখে দিতে পারি এই ঘরের ছড়ানো-ছিটানো কাগজগুলো কোনটা কী সেটা অনিক লুম্বা জানে, আমি যদি একটু উনিশ-বিশ করে দেই তাহলে সে আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না। আমরা যারা অগোছালো আর নোংরা মানুষ সবকিছুতেই আমাদের একটা সিস্টেম আছে, সাধারণ মানুষ সেটা জানে না।

অনিক লুম্বা জিজ্ঞেস করল, কী খাবেন? চা, কফি?

আমি মাথা নাড়লাম, না, কোনোটাই খাব না।

অনিক লুম্বা তখন হা হা করে হাসতে লাগল। আমি বললাম, কী হল, হাসছেন কেন?

হাসছি চিন্তা করে যদি আপনি বলতেন যে চা না হলে কফি খাবেন, তা হলে আমি কী করতাম? আমার বাসায় চা আর কফি কোনোটাই নাই!।

মানুষটাকে যতই দেখছি ততই আমার পছন্দ হয়ে যাচ্ছে। আমি সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসে বললাম, আমি যে হঠাৎ করে চলে এসেছি তাতে আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?

আপনি না হয়ে যদি অন্য কেউ হত তা হলে অসুবিধে হত। কী নিয়ে কথা বলতাম সেটা চিন্তা করেই পেতাম না।

আমি সোজা হয়ে বসলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আমার সাথে আপনার কথা বলতে কোনো অসুবিধে হবে না?

মনে হয় হবে না।

কেন?

কারণটা খুব সহজ। অনিক লুম্বা আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার দুপায়ে দূরকম মোজা। যে মানুষ দুপায়ে দুরকম মোজা পরে কোথাও বেড়াতে চলে আসে তার সাথে আমার খাতির হওয়ার কথা!

আমি অবাক হয়ে বললাম কেন?

এই যে এই জন্যে বলে সে তার প্যান্টটা ওপরে তুলল এবং আমি হতবাক হয়ে দেখলাম তার দুই পায়ে দুই রকম মোজা। ডান পায়ে লাল রঙের বাম পায়ে হলুদ চেক চেক। অনিক লুম্বা বলল, আমি অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি, কাউকে বোঝাতে পারি নাই যে দুপায়ে এক রকম মোজা পরার পিছনে কোনো যুক্তি নেই। আপনি একমাত্র মানুষ যে নিজে থেকে আমার যুক্তি বিশ্বাস করেন।

আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, শুধু মোজা নয়, আপনার সাথে আমার আরো মিল আছে।

অনিক লুম্বা অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কী রকম মিল?

আমার বাসা ঠিক একই রকম। সোফাতে বালিশ-কম্বল। চেয়ারে কাপড়-জামা। ফ্লোরে সব দরকারি কাগজপত্র।

কী আশ্চর্য! অনিক লুম্বা হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, আচ্ছা একটা জিনিস বলেন দেখি?

কী জিনিস?

মানুষ যখন গল্পগুজব করার সময় জোকস বলে আপনি সেগুলো ধরতে পারেন?

বেশিরভাগ সময় ধরতে পারি না।

অনিক লুম্বা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছেন আমাদের দুজনের মাঝে অনেক মিল।

তার কী কী খেতে ভালো লাগে সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন ঘরের ভেতর থেকে হঠাৎ গুঞ্জনের মতো শব্দ হল। শব্দটা হঠাৎ বাড়তে বাড়তে প্রায় প্লেনের ইঞ্জিনের মতো বিকট শব্দ করতে থাকে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কিসের শব্দ?

অনিক লুম্বা মাথা নেড়ে বলল, মশা।

মশী! আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা আবার কী রকম মশা? একেবারে প্লেনের ইঞ্জিনের মতো শব্দ!

অনেক মশা। আমি মশার চাষ করি তো।

মশার চাষ? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, মশার আবার চাষ করা যায় নাকি?

করা যাবে না কেন? মানুষ যদি সবজির চাষ করতে পারে, মাছের চাষ করতে পারে। তা হলে মশার চাষ করতে পারবে না কেন?

আমি দুর্বলভাবে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলাম, সবক্রি আর মাছ তো মানুষ খেতে পারে। মশা কি খেতে পারে?

ছোট মানুষ অবুঝের মতো কথা বললে বড়রা যেভাবে হাসে অনিক লম্বা অনেকটা সেভাবে হাসল, বলল, শুধু খাবার জন্যে চাষ করতে হয় কে বলেছে? গবেষণা করার জনেও চাষ করতে হয়। আপনার গলায় ইনফেকশন হলে গলা থেকে জীবাণু নিয়ে সেটা নিয়ে কালচার করে না সেটা কী? সেটা হচ্ছে জীবাণুর চাষ।

আমি তখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, জীবাণুর চাষের ব্যাপারটা না হয় বুঝতে পারলাম অসুখবিসুখ হয়েছে কিনা দেখে। মশার চাষ দিয়ে কী দেখবেন?

অনিক লুম্বা মাথা নেড়ে বলল, আমাদের দেশে মশা একটা মহাসমস্যা, সেই সমসা কীভাবে মেটানো যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করার জন্যে দরকার মশা। অনেক মশা, লক্ষ লক্ষ মশা।

আপনার কাছে লক্ষ লক্ষ মশা আছে?

আছে। শুনলেন না শব্দ? হঠাৎ করে যখন সেগুলো উড়তে থাকে তখন পাখার শব্দ শুনে মনে হয় প্লেন উড়ছে।

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, দেখাবেন একটু? দেখবেন? অনিক লুম্বা দাঁড়িয়ে বলল, আসেন। ভেতরে আসেন।

আমি অনিক লুম্বার সাথে ভেতরে গেলাম। বাইরের ঘরটাই যথেষ্ট অগোছালো কিন্তু ভেতরে গিয়ে মনে হল সেখানে সাইক্লোন বা টাইফুন হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেখানে কোনটা কী বোঝার কোনো উপায় নেই। মাঝামাঝি একটা হলঘরের মতো, সেখানে একমাথা উঁচু একটা কাচের ঘর। আট-দশ ফুট চওড়া এবং নিচে পানি। দূর থেকে মনে হচ্ছিল ভেতরে ধোয়া পাক খাচ্ছে, কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম সেগুলো ধোয়া নয়—মশা। একসাথে কেউ কোনো দিন এত মশা দেখেছে বলে মনে হয় না। কাচের ঘরের ভেতরে লক্ষ লক্ষ নয়—নিশ্চয়ই কোটি কোটি মশা! ছোট একটা মশাকে দেখে কেউ কখনো ভয় পায় না কিন্তু এই কাচের ঘরে কোটি কোটি শশা দেখে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমি শুয়ে শুয়ে বললাম, যদি কাচের ঘর ভেঙে মশা বের হয়ে যায় তখন কী হবে?

অনিক লুম্বা মেঝে থেকে একটা বিশাল হাতুড়ি তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন, ভাঙার চেষ্টা করেন।

আমি আঁতকে উঠে বললাম, সর্বনাশ! ভেঙে গেলে উপায় আছে? সারা ঢাকা শহর মশায় অন্ধকার হয়ে যাবে!

অনিক লুম্বা হাসল, বলল, ভাঙবে না। এটা সাধারণ কাচ না। এর নাম প্রেক্সি গ্লাস। কাচের বাবা।

তারপরেও আমি সাহস পেলাম না। তখন অনিক লুম্বা নিজেই হাতুড়ি দিয়ে এক ঘা দিল। কাচের ঘরের কিছুই হল না সত্যি কিন্তু ভেতরের মশাগুলো যা খেপে উঠল সে আর বলার মতো না, মনে হল পুরো ঘরটাই উড়িয়ে নিয়ে যাবে! কাচের ঘরের সমস্ত মশা একসাথে উড়তে শুরু করল। প্রচণ্ড শব্দ শুনে মনে হল একটা ফাইটার প্লেন কোনোভাবে ঘরে ঢুকে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত মশার চাষ করছেন কেমন করে?

মশার শব্দে অনিক লুম্বা কিছু শুনল না, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আবার জিজ্ঞেস করতে হল। অনিক লুম্বাও উত্তর দিল চিৎকার করে, নিচে পানিতে মশা ডিম পাড়ে। সেখান থেকে লার্ভা বের হয়, সেখান থেকে মশা। চব্বিশ ঘণ্টা এদের খাবার দেওয়া হয়। মশা বড় হওয়ার জন্যে একেবারে সঠিক তাপমাত্রা, সঠিক হিউমিডিটির ব্যবস্থা আছে।

আমি বললাম, মশাগুলোর উচিত শাস্তি হচ্ছে।

অনিক লুম্বা অবাক হয়ে বলল, উচিত শাস্তি?

হ্যাঁ। কাচের ঘরের ভেতরে আটকা পড়ে আছে, কাউকে কামড়াতে পারছে না–এটা শাস্তি হল না?

অনিক লুম্বা হা হা করে হেসে বলল, না না। আপনি যেভাবে ভাবছেন সেভাবে মশার শাস্তি মোটেই হচ্ছে না।

তার মানে? এরা এখনো মানুষকে কামড়াচ্ছে?

একটা মশা মানুষকে কেন কামড়ায় জানেন?

এটা আবার একটা প্রশ্ন হল নাকি! আমি বললাম, অবশ্যই জানি। মশা মানুষকে কামড়ায় তাদেরকে জ্বালাতন করার জন্যে। কষ্ট দেবার জনো। অত্যাচার করার জন্যে।

উহুঁ। অনিক লুম্বা মাথা নাড়ল, বলল, মশা মানুষকে কামড়ায় বংশবৃদ্ধি করার জন্যে। মহিলা মশার ডিম পাড়ার জন্যে রক্তের দরকার সেই জন্যে তারা মানুষকে কামড়ে একটু রক্ত নিয়ে নেয়।

সত্যি?

হ্যাঁ। কাজেই যখন একটা মশা আপনাকে কামড় দেবে আপনি বুঝে নেবেন সেটা মশা নয়, সেটা হচ্ছে মশি।

মশি?

হ্যাঁ। মানে মহিলা মশা।

আমি তখনো ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে আপনি বলতে চান মশা আর মশিদের মাঝে মশারা কামড়ায় না, কামড়ায় শুধু মশি?

হ্যাঁ।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমার ধারণা ছিল পুরুষ থেকে মহিলারা মিষ্টি স্বভাবের হয়। কামড়াকামড়ি যা করার সেগুলো পুরুষরাই বেশি করে!।

না না না। অনিক লুম্বা মাথা নাড়ল, এটা মোটেও কামড়াকামড়ি নয়। মহিলা মশারা যখন আপনাকে কামড় দেয় তখন সেটা তার নিজের জন্যে না। সেটা সে করে তার সন্তানদের জন্যে। মশার কামড় খুব মহৎ একটি বিষয়। সন্তানদের জন্যে মায়ের ভালবাসার বিষয়।

সর্বনাশ! আমি বললাম, ব্যাপারটা গোপন রাখা দরকার।

অনিক লুম্বা অবাক হয়ে বলল, কেন?

দেশের পাগল-ছাগল কবি-সাহিত্যিকেরা এটা জানতে পারলে উপায় আছে? কবিতা লিখে ফেলবে না মশার ওপর!

হে মশা
সন্তানের জন্যে
তোমার ভালবাসা

অনিক লুম্বা আমার কবিতা শুনে হি হি করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি। মহিলা মশারা যেন ঠিক করে বাচ্চাকাচ্চা দিতে পারে সেই জন্যে আমাকে এই কাচের ঘরে রক্ত সাপ্লাই দিতে হয়।

সুর্বনাশ! আমি আঁতকে উঠে বললাম, বুলেন কী আপনি? কার রক্ত দেন এখানে?

অনিক লুম্বা আমাকে শান্ত করে বলল, না, না, আপনার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। এখানে আমি মানুষের রক্ত দেই না। কসাইখানা থেকে গরু-মহিষের রক্ত নিয়ে এসে সেটা দিই। খুব কায়দা করে দিতে হয়, না হলে খেতে চায় না।

গরু-মহিষের রক্ত খায় মশা? আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেন্স করলাম, মানুষের রক্তের স্বাদ একবার পেয়ে গেলে তখন কি আর গরু-মহিষের রক্ত খেতে চাবে?

আসলে মশার সবচেয়ে পছন্দ মহিষের রক্ত। তারপর গরু, তারপর মানুষ।

তাই নাকি? মশার চোখে আমরা মহিষ এবং গরু থেকেও অধম?

অনিক লুম্বা হাসল, বলল, ঠিকই বলেছেন। মশাই ঠিক বুঝেছে। আমরা আসলেই মহিষ এবং গরু থেকে অধম।

কাচের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ কোটি মশাকে কিলবিল কিলবিল করতে দেখে এক সময় আমার কেমন জানি গা গুলাতে শুরু করল। আমি বললাম, অনেক মশা দেখা হল। এখন যাই।

চলেন। বলে অনিক লুম্বা ঘরের লাইট নিবিয়ে আমাকে নিয়ে বের হয়ে এল।

বের হয়ে আসতে আসতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখনো একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না।

কোনটা বুঝতে পারলেন না?

মশার চাষ করছেন বুঝতে পারলাম, কিন্তু গবেষণাটা কী?

খুব সহজ। অনিক লুম্বা মুখ গম্ভীর করে বলল, রক্ত ছাড়া অন্য কিছু খেয়ে মহিলা মশারা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে কিনা।

তাতে লাভ?

বুঝতে পারছেন না। তখন মশারা আর মানুষকে কামড়াবে না। সেই অন্য কিছু খেয়েই খুশি থাকবে। মশা যদি মানুষকে না কামড়ায় তা হলে তাদের ম্যালেরিয়া ফাইলেরিয়া ডেঙ্গু এই রোগও হবে না।

অনিক লুম্বার বুদ্ধি শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। বললাম, মশা যদি মানুষকে না কামড়ায় তা হলে মানুষ মশা নিয়ে বিরক্ত হবে না।

ঠিকই বলেছেন।

জোনাকি পোকা কিংবা প্রজাপতি এগুলোকে নিয়ে মানুষ কত কবিতা লিখেছে, তখন মশা নিয়েও কবিতা লিখবে।

অনিক লুম্বা ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি লিখবে?

অবশ্যই লিখবে। জীবনানন্দ না মরণানন্দ নামে একজন কবি আছে সে লাশকাটা ঘরের উপরে কবিতা লিখে ফেলেছে, সেই তুলনায় মশা তো অনেক সম্মানজনক জিনিস।

অনিক লুম্বা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছেন।

আমি বললাম, কবিদের কোনো মাথার ঠিক আছে নাকি? হয়তো লিখে ফেলবে—

হে মশা
তোমার পাখার পিনপিন শব্দে
আমার চোখে আর ঘুম আসে না!

আমার কবিতা শুনে অনিক লুম্বা আবার হি হি করে হাসল। দুজনে মিলে আমরা কবিদের পাগলামি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম। আমাদের দুইজনের কারোই যে কবি হয়ে জন্ম হয় নাই সেটা চিন্তা করে দুজনেই নিজেদের ভাগ্যকে শাবাশ দিলাম। তারপর সাহিত্যিকদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম। তারপর শিল্পী এবং গায়কদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম। তারপর উকিল আর ব্যবসায়ীদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম। অনিক লুম্বা বিজ্ঞানী আর আমি নিষ্কর্মা বেকার, তাই শুধু বিজ্ঞানী আর নিষ্কর্মা বেকার মানুষদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম না। অনিক লুম্বা তখন কয়েকটা চিপসের প্যাকেট আর এক লিটারের পেপসির বোতল নিয়ে এল। দুইজনে বসে চিপস আর পেপসি খেয়ে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা মারলাম।

আমি যখন চলে আসি তখন অনিক লুম্বা আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, জাফর ইকবাল, যখন ইচ্ছা চলে এস দুইজন আডডা মারব।

আমি বললাম, আসব অনিক আসব। তুমি দেখো কালকেই চলে আসব। খুব একটা উঁচু দরের রসিকতা করেছি এইরকম ভঙ্গি করে আমরা দুইজন তখন হা হা করে হাসতে শুরু করলাম।

বাসায় আসার সময় হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম অনিক সুস্বার সাথে আমার নিশ্চয়ই এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আমরা দুইজন খেয়াল না করেই একজন আরেকজনকে নাম ধরে ডাকছি, তুমি করে সম্বােধন করছি! কী আশ্চর্য ঘটনা, আমার মতো নীরস নিষ্কর্মা ভোতা টাইপের মানুষের একজন বন্ধু হয়ে গেছে? আর সেই বন্ধু হেজিপেজি কোনো মানুষ নয় রীতিমতো একজন বিজ্ঞানী?

 

অনিককে বলেছিলাম পরের দিনই তার বাসায় যাব কিন্তু আসলে তার বাসায় আমার যাওয়া হল দুদিন পর। সেদিন হয়তো আমার যাওয়া হত না কিন্তু অনিক দুপুরে ফোন করে বলল আমি যেন অবশ্য অবশ্যই তার বাসায় যাই, খুব জরুরি দরকার। তাই বিকেলে অন্য একটা কাজ থাকলেও সেটা ফেলে আমি অনিকের বাসায় হাজির হলাম।

অনিক ছোট ছোট টেস্টটিউবে ঝাঁজালো গন্ধের কী এক তরল পদার্থ ঢালাচালি করছিল, আমাকে দেখে মনে হল একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

বলল, তুমি এসে গেছ? চমৎকার!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? কী হয়েছে?

একজন আমার সাথে দেখা করতে আসবে—আমি একা একা তার সাথে কথা বলতে চাই না।

কেন?

সে আমার মশার গবেষণা কিনতে চায়।

মশার গবেষণা কিনতে চায়? আমি অবাক হয়ে বললাম, গবেষণা কি কোরবানির গরু-মানুষ এটা আবার কেনে কী করে? আর এই লোক খবর পেল কেমন করে যে তুমি মশা নিয়ে গবেষণা কর?

পদচারী বিজ্ঞানী কনভেনশনের কথা মনে নাই? মনে হয় সেখানে আমার মুখে শুনেছে। আমি কাউকে কাউকে বলেছিলাম।

কন্তু দিয়ে গবেষণা কিনবে?

সেটা তো জানি না। সেজন্যেই তোমাকে ডেকেছি। টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলতে পারবে না?

আমি মাথা চুলকালাম, বললাম, আসলে সেটা আমি একেবারেই পারি না।

কেন? তুমি বাজার কর না? মাছ কেন না?

ইয়ে–কিনি। কিন্তু—

কিন্তু কী?

যেমন মনে কর গত সপ্তাহে মাছ কিনতে গিয়েছি, পাবদা মাছ, আমার কাছে চেয়েছে এক শ বিশ টাকা, আমি কিনেছি এক শ ত্রিশ টাকায়।

দশ টাকা বেশি দিয়েছ!

হ্যাঁ।

কেন?

মাছওয়ালা তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে এমন একটা দুঃখের কাহিনী বলল যে আমার চোখে পানি এসে যাবার অবস্থা। দশ টাকা বেশি দিয়ে ফেলেছি।

অনিক মাথা নেড়ে বলল, ও, আচ্ছা।

আমি লিখে দিতে পারি অনিক না হয়ে অন্য যে কেউ হলে আমার এই বোকামির কথা শুনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসা শুরু করত। অনিক শুধু যে হাসল না তা না, আমার যুক্তিটা এক কথায় মেনেও নিল। একেই বলে প্রাণের বন্ধু।

আমি বললাম, কাজেই আমি টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলতে পারব না, আমি বললে তোমার মনে হয় সাত থেকে ক্ষতিই হবে বেশি।

হলে হোক। আমি তো আর বিক্রি করার জন্যে গবেষণা করি না। আমি গবেষণা করি মনের আনন্দ আনো।

তা ঠিক। আমিও মাথা নাড়লাম, মনের আনন্দের সাথে সাথে যদি একটু টাকাপয়সা আসে খারাপ কী?

সেটা অবশ্য তুমি ভুল বলো নাই।

অনিক তার টেস্টটিউব নিয়ে আবার ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মশা নিয়ে গবেষণার কী অবস্থা? মহিলা মশারা খেতে পছন্দ করে এরকম কিছু কি এখনো খুঁজে বের কবে?

উঁহু। কাটা সোজা না।

লেবুর শরবত দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছ?

লেবুর শরবত? অনিক অবাক হয়ে বলল, লেবুর শরবত কেন?

আমি মাথা চুলকে বললাম, তা জানি না। আমার কাছে মনে হল মহিলা মশারা হয়তো লেবুর শরবত খেতে পছন্দ করবে।

অনিক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা শুনে বোঝা যায় তোমার ভেতরে কোনো বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা নাই। বৈজ্ঞানিক চিন্তা থাকলে যুক্তিতর্ক দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। এমনি এমনি তখন কেউ কোনো একটা কথা বলে না।

আমি বললাম, ধুরঃ যুক্তিফুক্তি আমার ভালো লাগে না। যখন যেটা মনে হয় আমি সেটাই করে ফেলি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, সেদিন মতিঝিলে যাব, যে বাসটা এসেছে সেটা ভাঙাচোরা দেখে পছন্দ হল না। চকচকে একটা বাস দেখে উঠে পড়লাম, বাসটা আমাকে মিরপুর বারো নম্বরে নামিয়ে দিল।

কিন্তু, কিন্তু–অনিক ঠিক বুঝতে পারল না কী বলবে। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার না মতিঝিলে যাবার কথা?

আমি বললাম, কপালে না থাকলে যাব কেমন করে?

হাজার হলেও অনিক বিজ্ঞানী মানুষ, তার কাজ-কারবারই হচ্ছে যুক্তিতর্ক নিয়ে, কাজেই আমার সাথে একটা তর্ক শুরু করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। মনে হয় মশার গবেষণা কেনার মানুষটা চলে এসেছে।

অনিক দরজা খুলে দিতেই মানুষটা এসে চুকল। মোষ্টাসোটা নাদুসনুদুস মানুষ, চেহারায় একটা তেলতেলে ভাব। ঠোটের উপর সরু গোঁফ। সরু গাফ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। গোঁফ রাখতে চাইলে সেটা রাখা উচিত বঙ্গবন্ধুর মতো, তার মাঝে একটা ব্যক্তিত্ব আছে। মানুষটা সুট-টাই পরে আছে, চোখে চশমা, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। গায়ের রং ফরসা, ফরসার মাঝে কেমন যেন অসুস্থ অসুস্থ ভাব। হঠাৎ হঠাৎ এক ধরনের তেলাপোকা দেখা যায় যেগুলো সাদা রঙের, দেখতে অনেকটা সেরকম, দেখে কেমন যেন ঘেন্না ঘেন্না লাগে।

মানুষটা অনিকের দিকে তাকিয়ে তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে বলল, কী খবর বিজ্ঞানী সাহেব? কেমন আছেন?

অনিক বলল, ভালো। আসেন, ভেতরে আসেন।

মানুষটা ভেতরে এসে ভুরু কুঁচকে চারদিকে তাকাল। অনিক বেচারী ঘরষ্টা পরিষ্কার করার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। যারা নোংরা এবং অগোছালো মানুষ তারা ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার চেষ্টা করলে সেটা দেখতে আরো বদখত দেখায়। মানুষটা ঘরটার ওপর চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকাল এবং আমাকে দেখে মুখটা কেমন যেন কুঁচকে ফেলল। তাকে দেখে মনে হল সে যেন আমাকে দেখছে না, একটা ধাড়ি চিকাকে দেখছে। অনিক তখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে বলল, এ আমার বিশেষ বন্ধু। নাম জাফর ইকবাল।

ও। মানুষটা কিছুক্ষণ আমাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, আমার নাম আক্কাস আকন্দ।

আমি মনে মনে বললাম, বাটা বুড়া ভাম কোথাকার। তোমার নাম হওয়া উচিত খোক্কস আকন্দ। আর মুখে বললাম, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম আকন্দ সাহেব।

খোক্কস আকন্দ তখন কেমন জানি দুলে দুলে গিয়ে সোফায় বসে আবার তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে দেখতে লাগল।

অনিক জিজ্ঞেস করল, আমার বাসা পেতে কোনো ঝামেলা হয়েছে আকন্দ সাহেব?

নাহ। বাস পেতে কোনো ঝামেলা হয় নাই। তবে আকন্দ সাহেব নাক দিয়ে ঘেঁত করে একটা শব্দ করে বলল, বাসায় আসতে একটু ঝামেলা হয়েছে।

অনিক একটু থতমত খেয়ে বলল, কী রকম ঝামেলা?

বাসার গলি খুব চিকন। আমার গাড়ি ঢোকানো গেল না। সেই মোড়ে পার্ক করে ব্রেখে হেঁটে হেঁটে আসতে হয়েছে।

ব্যাটার ফুটানি দেখে মরে যাই। একবার ইচ্ছা হল বলি, তোমারে আসতে বলেছে কে? কিন্তু কিছু বললাম না।

অনিক বলল, চা কফি কিছু খাবেন?

খোক্কস আকন্দ বলল, না। আমি চা কফি সাধারণত খাই না। যেটা সাধারণত খাই সেটা আপনি খাওয়াতে পারবেন না! বলে খোক্কস আকন্দ কেমন যেন দুলে দুলে হাসতে লাগল। ভাব দেখে মনে হল সে বুঝি খুব একটা রসিকতা করে ফেলেছে।

অনিক একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, এখন আমিও জানি তার বাসায় চা কিংবা কফি কোনোটাই নাই। খোস আকন্দ একসময় হাসি থামিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, এখন কাজের কথায় আসা যাক বিজ্ঞানী সাহেব, কী বলেন?

অনিক অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বলল, ঠিক আছে।

আপনি বলেছেন, আপনি মশা মারার একটা ওষুধ বানাচ্ছেন।

অনিক মাথা নেড়ে বলল, না, আমি সেটা বলি নাই, আমি বলেছি মশার সমস্যা দূর করে দেবার একটা সিস্টেম দাঁড় করাচ্ছি।

খোকস আকশ বলল, একই কথা! মশাকে না মেরে মশার সমস্যা দূর করবেন কেমন করে?

অনিক বলল, মশা একটা সমস্যা কারণ মশা কামড়ায়। আর মশা কামড়ায় বলেই মানুষের অসুখবিসুখ হয়। আমি গবেষণা করছি যেন মশা আর মানুষকে না কামড়ায়।

না কামড়ায়? খোক্কস আকন্দ তার খোলা ধরনের চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, মশা মানুষকে কামড়াবে না?

না। সেটাই বের করার চেষ্টা করছি।

খোক্কস অক বলল, আমরা কেমন করে বুঝব যে আপনি ঠিক ঠিক গবেষণা করছেন? মশা আসলেই কামড়াচ্ছে না?

অনিক দাঁড়িয়ে বলল, আসেন, আপনাকে দেখাই। ভেতরে আসেন।

অনিক খোলা আকন্দকে ভেতরে নিয়ে গেল, মশার ঘরের সামনে গিয়ে লাইট জ্বালাতেই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মশা ভনভন শব্দ করে উড়তে শুরু করল। খোক্কস আকন্দ মুখ হাঁ করে এই বিচিত্র দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল। অনিক মশার শব্দ ছাপিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, এখন যদি কেউ এই ঘরে ঢোকে তা হলে মশা এক মিনিটের মাঝে তার রক্ত শুষে খেয়ে ফেলবে। খালি মানুষটার ছোবড়া পড়ে থাকবে।

খোস আকন্দ একবার মুখ বন্ধ করে আবার খুলে বলল, ছোবড়া?

হ্যাঁ। ছোবড়া। অনিক মাথা নেড়ে বলল, আর যদি ঠিক ঠিক গবেষণা করে মশাকে অন্য কিছু খাওয়ানো শেখাতে পারি তা হলে যে কোনো মানুষ এর ভেতরে বসে থাকতে পারবে, মশা তাকে কামড়াবে না!

খোক্কস আকন্দ অনেকক্ষণ মশার ঘরের ভেতর লক্ষ লক্ষ কিলবিলে মশার দিকে ভাকিয়ে রইল। তারপর আবার বসার ঘরে এসে বসল। কিছুক্ষণ অনিকের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এটা আবিষ্কার করতে আপনার কতদিন লাগবে?

আবিষ্কারের কথা কেউ বলতে পারে না। কালকেও হতে পারে আবার এক বছরও লাগতে পারে।

খোক্কস আকন্দ তার মুখে তেলতেলে হাসিটা ফুটিয়ে বলল, যদি আপনার এই আবিষ্কারটা হয়ে যায় তা হলে আমি সেটা কিনে নেব।

অনিক বলল, কিনে নেবেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকা দিয়ে কিনবেন?

খোক্কস আকন্দ কেমন যেন বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, এইখানে টাকার পরিমাণটা কোনো ইস্যু না। কেনার সিদ্ধান্তটা হচ্ছে ইস্যু।

অনিক আমাকে খবর দিয়ে এনেছে এই লোকের সাথে কথাবার্তা বলার জন্যে, আমি তো চুপ করে বসে থাকতে পারি না, জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ঠিক কী জিনিসটা কিনবেন?

সবকিছু। গবেষণার ফল। মশার ঘর। মশা। মশার বাচ্চাকাচ্চা।

কেন কিনবেন?

খোক্কস আকন্দ হা হা করে হাসতে শুরু করল, একটু পরে হাসি থামিয়ে বলল, আমার কাজ হচ্ছে এক জায়গা থেকে একটা জিনিস কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করা।

অনিক জিজ্ঞেস করল, এটা আপনি কার কাছে বিক্রি করবেন?

সেটা শুনে আপনি কী করবেন? আপনি বিজ্ঞানী মানুষ বিজ্ঞানের আবিষ্কার করবেন। আমি ব্যবসায়ী মানুষ আমি সেটা দিয়ে ব্যবসা করব।

আমি বললাম, কিন্তু কত টাকা দিয়ে কিনবেন বললেন না?

খোক্কস আকন্দ বলল, আপনি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। এই আবিষ্কার যত টাকা দিয়ে কেনা উচিত ঠিক তত টাকা দিয়ে কিনব।

অনিক আমাকে ডেকে এনেছে কথাবার্তা বলার জন্যে কাজেই আমি চেষ্টা করলাম ব্যবসায়িক কথা বলার জন্যে। বললাম, আপনি মশার ঘর আর মশাও কিনবেন?

হ্যাঁ।

একটা মশার জন্যে আপনি কত দেবেন?

খোক্কস আকন্দ চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল, বলল, একটা মশার জন্যে?

হ্যাঁ। এতগুলো মশা তো আর এমনি এমনি দেওয়া যাবে না। রীতিমতো চাষ করে এই মশা তৈরি হয়েছে। কী পুরুষ্টু এক একটা মশা দেখছেন? কত করে দেবেন?

খোক্কস আকন্দ চোখ ছোট করে বলল, আপনি কত করে চাচ্ছেন?

আমি কত বলা যায় অনুমান করার জন্যে অনিকের দিকে তাকালাম কিন্তু অনিক হাত নেড়ে বলল, এসব আলোচনা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আগে আমার গবেষণা শেষ হোক।

খোক্কস আকন্দ বলল, ঠিক আছে। তারপর সে তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তা হলে উঠি। অনিক আবার ভদ্রতা করে বলল, চা কফি কিছু খেলেন না!

আপনার আবিষ্কার শেষ হোক। তখন শুধু চা কফি না, আরো অনেক কিছু খাব। বলে সে এমনভাবে অনিকের দিকে তাকাল যে আমার মনে হল যেন সে তাকে আস্ত গিলে খেয়ে ফেলবে।

আমার মানুষটাকে একেবারেই পছন্দ হল না, এখান থেকে বিদায় হলে বাঁচি! দরজার কাছে পঁড়িয়ে খোক্কস আকন্দ আবার ঘুরে অনিকের দিকে তাকাল, বলল, আমি যদি আমার দুজন অফিসারকে আপনার এই সেটআপ দেখার জন্যে পাঠাই আপনার আপত্তি আছে?

আমার ইচ্ছে ইল বলি, অবশ্যই আপত্তি আছে। কিন্তু অনিক মাথা নেড়ে বলল, না,, আপত্তি থাকবে কেন?

আমি মুখ ভোতা করে বললাম, আপনার অফিসাররা কেন আসবেন?

খোক্কস আকন্দ বলল, দেখার জন্যে। শুধু দেখার জন্যে!

খোক্কস আকন্দ বের হয়ে যাবার পর দরজা বন্ধ করে অনিক ফিরে আসতেই আমি বললাম, অনিক তোমাকে আমি সাবধান করে দিই। এই মানুষ থেকে এক শ মাইল দূরে থাকতে হবে।

অনিক অবাক হয়ে বলল, এক শ মাইল দূরে থাকতে হবে কেন? আমার তো আক্কাস আকন্দ সাহেবকে বেশ পছন্দই হল।

আক্কাস আকন্দ নয়। খোক্কস আক।

খোক্কস আকন্দ?

হ্যাঁ। রাক্ষসের ভাই খোক্কস। তোমার রক্ত-মাংস চুষে খাবে, তারপর তোমার চামড়া দিয়ে ড়ুগড়ুগি বাজাবে।

অনিক আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে বলল, কী আশ্চর্য! এই ভদ্রলোককে তুমি দশ মিনিট দেখে কিনা সন্দেই অথচ তার সম্পর্কে কত খারাপ খারাপ কথা বলে ফেললে!

আমি খারাপ কথা বলি নাই। সত্যি কথা বলেছি। এই লোক মহাধুরন্ধর। মহাডেঞ্জারাস। মহাবদমাইশ।

অনিক বলল, না, না জাফর ইকবাল, একজন মানুষ সম্পর্কে এরকম কথা বলার কোনো যুক্তি নেই। যুক্তি ছাড়া কথা বলা ঠিক না। যুক্তি ছাড়া কথা বলা অবৈজ্ঞানিক।

আমি রেগেমেগে বললাম, তুমি বিজ্ঞানী মানুষ ইচ্ছে হলে তুমি বৈজ্ঞানিক কথা বলো। আমার এত বৈজ্ঞানিক কথা বলার দরকার নাই।

অনিক বলল, আরে, আরে! তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?

আমি চিৎকার করে পা দাপিয়ে বললাম, আমি মোটেই রাগি নাই। কথা নাই বার্তা নাই আমি কেন রাগ? কার ওপর রাগব? এই বলে আমি রেগেমেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।

 

দুদিন পর আমি আবার অনিকের সাথে দেখা করতে গেলাম। এর আগের দিন আমি রেগেমেগে বের হয়ে গিয়েছিলাম বলে একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিল, অনিক সেটা নিয়ে আমার ওপর রেগে আছে কিনা কে জানে। দরজায় শব্দ করার সাথে সাথে অনিক দরজা খুলল, আমাকে দেখে কেমন যেন ঠাণ্ডা গলায় বলল, ও তুমি? আস, ভেতরে আস।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। আজকে ঘরদোর আগের মতন, অগোছালো এবং নোল্লা। টেবিলের ওপর একটা ফাইল, সেখানে কিছু কাগজপত্র। অনিক ফাইলটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এইটা কী?

অলিক দুর্বল গলায় বলল, কিছু না।

আমি বললাম, কিছু না মানে? আমি স্পষ্ট দেখছি এক শ টাকার স্ট্যাম্পের ওপর কী কী লেখা তুমি মামলা করছ নাকি?

না, না। মামলা করব কেন?

তা হলে স্ট্যাম্পের ওপর এতসব লেখালেখি করার তোমার দরকার কী পড়ল? অনিক আমার কড়া চোখ থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আমতা-আমতা করে বলল, না, মানে আক্কাস আকন্দের লোকজন এসেছিল তো, তারা আমার সাথে একটা কন্ট্রাক্ট করে গেছে। সেই কন্ট্রাক্টটা একটু দেখছিলাম।

আমি আঁতকে উঠে বললাম, এর মাঝে তুমি কন্ট্রাক্ট সাইন করে ফেলেছ? তুমি দেখি আমার থেকে বেকুব।।

এবারে অনিক রেগে উঠে বলল, এর মাঝে তুমি বেকুবিব কী দেখলে?

কন্ট্রাক্টে কী লেখা আছে? কত টাকায় তুমি তোমার আবিষ্কার বিক্রি করে দিলে?

টাকার পরিমাণ লেখা হয় নাই। অনিক মুখ শক্ত করে বলল, আবিষ্কারটা হওয়ার পর আক্কাস আকন্দ সেটা কিনে নেবে সেটাই লেখা হয়েছে।

আমি অনিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তা হলে তুমি এরকম মনমরা হয়ে বসে আছ কেন?

আমি মোটেও মনমরা হয়ে বসে নাই। বলে অনিক আরো মনমরা হয়ে গেল।

আমি বললাম, আমার কাছে লুকানোর চেষ্টা করছ কেন? সত্যি কথাটা বলে ফেল কী হয়েছে।

কিছু হয় নাই। শুধু—

শুধু কী?

অনিক দুর্বল গলায় বলল, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না।

কী বুঝতে পারছ না?

এই কন্ট্রাক্ট সাইন করার পর আক্কাস আকন্দের লোকগুলো আমাকে একটা পানির বোতল, এক কেজি গুড় আর আধ কেজি লবণ দিয়ে গেল কেন?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কী দিয়ে গেল?

এক বোতল পানি, এক কেজি গুড় আর আধ কেজি লবণ। অনিক মাথা চুলকে বলল, আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কেন, তখন বলল, কন্ট্রাক্টে নাকি এটা দেওয়ার কথা লেখা আছে। কিন্তু কাক্টে কোথাও সেটা খুঁজে পেলাম না।

দেখি কন্ট্রাক্টটা।

অনিক কেমন যেন অনিচ্ছা নিয়ে আমাকে কন্ট্রাক্টটা ধরিয়ে দিল। সেটা দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম। এই মোটা কাগজের বান্ডিল কমপক্ষে চল্লিশ পৃষ্ঠা, পড়ে শেষ করতে একবেলা লেগে যাবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত মোটা?

অনিক মাথা চুলকে বলল, হ্যাঁ, আমিও বুঝতে পারলাম না এত মোটা কেন।

কী লেখা এখানে, দেখি তো বলে আমি সেই বিশাল দলিল পড়ার চেষ্টা করলাম, ছোট ছোট অক্ষরে লেখা শুরু হয়েছে এভাবে :

কুতুব আলী মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন নাছি জাহাঙ্গীর ওরফে অনিক লুম্বা সাং ১৪২ ঘটিমাছি লেন ঢাকার সহিত আকন্দ গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী আক্কাস আকন্দের আইন কৌঁসুলির পক্ষে কেরামত মাওলা এসোসিয়েটসের আইনজীবী মাওলাবক্স কর্তক প্রস্তাবনামা প্রস্তুত নিমিত্তে প্রাথমিক অঙ্গীকারনামায় যথাক্রমে প্রথম পক্ষ, দ্বিতীয় পক্ষ এবং তৃতীয় পক্ষ হিসেবে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ অথবা তাহাদের দেওয়া কর্তৃত্বনামায় উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তিবর্গকে ওকালতনামা দেওয়া সাপেক্ষ অঙ্গীকারনামায় সুষ্ঠু প্রস্তাবনার পক্ষে দ্বিতীয় পক্ষের আইনগত কৌঁসুলি অতীয় পক্ষের সহিত প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষের অঙ্গীকারনামায় চতুর্থ অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশে বর্ণিত শর্তাবলি সাপেক্ষে প্রথম পক্ষের সহিত কর্তৃত্ব প্রস্তুতের তালিকা বর্ণিত হইল।

আমি আমার জীবনে এর আগে এতবড় একটা বাক্য পড়ি নি। বাক্যটা পরপর পাঁচবার পড়েও এর অর্থ বোঝা দূরে থাকুক কী বলতে চেয়েছে বুঝতে পারলাম না। তখন বাক্যটা একবার উল্টাদিক থেকে পড়লাম আরেকবার আরবি ভাষার মতো ডানদিক থেকে বামদিকে পড়লাম। তারপরও কিছু বুঝতে পারলাম না, উপর থেকে নিচে পড়ে দেখব কিনা ভাবলাম কিন্তু ততক্ষণে টনটন করে আমার মাথাব্যথা করতে শুরু করেছে তাই আর সাহস করলাম না। আমি কাগজের বান্ডিলটা অনিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, প্রথম বাক্যটা পড়েই মাথা ধরে গেছে, পুরো চল্লিশ পৃষ্ঠা পড়লে ব্রেনের রগ নির্ঘাত ছিঁড়ে যাবে।

পড়ার দরকার কী! অনিক পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, বলেই তো দিয়েছে এখানে কী লেখা। আমার আবিষ্কারটা শেষ হবার পর সেটা কিনে নেবে। শুধু–অনিক ইতস্তত করে থেমে গেল।

শুধু কী?

এক বোতল পানি, এক কেজি গুড় আর আধ কেজি লবণের ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

তোমাকে দিয়েছে খাবারের স্যালাইন বানিয়ে খাওয়ার জন্যে। মনে নাই এক গ্লাস পানিতে একমুঠি গুড়, আর এক চিমটি লবণ দিয়ে খাবার স্যালাইন বানাতে হয়।

হ্যাঁ। অনিক মাথা নেড়ে বলল, সেটা তো বানায় যখন মানুষের ডায়রিয়া হয় তখন। এখানে কার ডায়রিয়া হয়েছে?

আমি বললাম, এখনো হয় নাই। কিন্তু হবে।

কার হবে?

নিশ্চয়ই তোমার হবে। অনিক ভয় পেয়ে বলল, কেন? আমার কেন হবে?

সেটা এখনো জানি না। কিন্তু মানুষ যখন ভয় পেয়ে যায় তখন তার ডায়রিয়া হয়। তুমিও নিশ্চয়ই ভয় পাবে।

অনিকের মুখটা শুকিয়ে গেল। আমি বললাম, মনে নাই, আমি তোমাকে বলেছিলাম খোক্কস আকন্দ তোমার রক্ত মাংস চুষে খাবে, তোমার চামড়া দিয়ে ড়ুগড়ুগি বাজাবে! তুমি দেখ, আমার কথা যদি সত্য না হয়।

আমার কথা শুনে অনিকের মুখটা আরো শুকিয়ে গেল।

 

এরপর বেশ কয়েক দিন কেটে গেল, অনিকের বাসায় প্রতিদিন না গেলেও আমি টেলিফোনে প্রত্যেক দিনই খোঁজ নিয়েছি। আমি একেবারে নিশ্চিত ছিলাম যে খোক্কস আকন্দ তার লোকজন পাঠিয়ে অনিকের কিছু একটা করে ফেলবে, কিন্তু সেরকম কিছু হল না। একদিন দুইদিন করে মাসখানেক কেটে যাবার পর আমার মনে হতে লাগল যে আমি হয়তো শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছিলাম। খোক্কস আকন্দ মানুষটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম সে হয়তো তত খারাপ না, তাকে খোক্কস না ডেকে আক্কাস ডাকা যায় কিনা সেটাও আমি চিন্তা করে দেখতে শুরু করলাম।

এদিকে অনিক তার গবেষণা চালিয়ে গেল, মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল তার গবেষণা খুব ভালো হচ্ছে। আবার দুদিন পরে মনে হতে লাগল পুরো গবেষণা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। আমি অনিকের ধৈর্য দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। তার জায়গায় হলে আমি মনে হয়। এতদিনে মশার ঘর ভেঙেচুরে আগুন জ্বালিয়ে দিতাম। কিন্তু অনিক সেরকম কিছু করল না, আলকাতরা থেকে শুরু করে রসগোল্লার রস, ডাবের পানি থেকে শুরু করে মাদার গাছের কষ কোনো কিছুই সে বাকি রাখল না, সবকিছু দিয়ে পরীক্ষা করে ফেলল। একসময় যখনক মনে হল পৃথিবীর আর কিছুই পরীক্ষা করার বাকি নেই, এখন ভেউভেউ করে কান্নাকাটি করে চোখের পানি ফেলার সময়, আর সেই চোখের পানিটাই শুধু পরীক্ষা করা বাকি আছে তখন হঠাৎ করে অনিকের গবেষণার ফল পাওয়া গেল। একদিন বিকালবেল অনিক আমাকে ফোন করে চিৎকার করতে লাগল, ইউরেকা ইউরেকা।

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, তুমি কাপড়-জামা পরে আছ তো?

অনিক বলল, কাপড়-জামা পরে থাকব না কেন?

আমি বললাম, মনে নাই, আর্কিমিডিস কাপড়-জামা খুলে ন্যাংটো হয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে রাস্তাঘাটে চিৎকার করছিল?

অনিক হা হা করে হেসে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ আমারও মনে হচ্ছে সেটা করে। ফেলি। পুরো ন্যাংটো না হলেও অন্তত একটা লুঙ্গি মালকেঁচা করে পরে রাস্তাঘাটে ছোটাছুটি করি। পিচকারি দিয়ে সবার ওপরে রঙ ফেলতে থাকি।

আমি বললাম, খবরদার! ওরকম কিছু করতে যেও না। পাবলিক ধরে যা একটা মার দেবে, তখন একটা কিলও কিন্তু মাটিতে পড়বে না।

তা অবিশ্যি তুমি ভুল বলে নাই।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন বলো তুমি আবিষ্কারটা কী করলে? মহিলা মশারা রক্তের বদলে অন্য কিছু খেতে রাজি হয়েছে?

হয় নাই মানে? সাংঘাতিকভাবে হয়েছে।

সেটা কী জিনিস?

অনিক বলল, সেটা একটা জিনিস না। অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন জিনিস মিশাতে হয়েছে। সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে ইথাইল অ্যালকোহল। সেটাতেই অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে। তার সাথে মনো সোডিয়াম গ্লুকোমেট, সোডিয়াম বাই কার্বনেট আর

আমি বাধা দিয়ে বললাম, এগুলো আমাকে বলে লাভ নাই। এইসব ক্যামিকেল কোনটা কী আমি কিছু জানি না। কোনো দিন দেখি নাই, নাম শুনি নাই।

অনিক হা হা করে হেসে বলল, শুনেছ। শুনেছ। অবশ্যই নাম শুনেছ। সব্বাই ইথাইল অ্যালকোহলের নাম শুনেছে। এইটার গন্ধেই মহিলা মশারা পাগল হয়ে যায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ইথাইল অ্যালকোহল হচ্ছে–

আমি বললাম, থাক, থাক। টেলিফোনে বলে লাভ নাই। আমি চলে আসি, তুমি বরং সামনাসামনি দেখাও।

অনিক জিব দিয়ে চটাস করে শব্দ করে বলল, সেটাই ভালো। এত বড় একটা আবিষ্কার করলাম, কাউকে দেখানোর জন্যে হাত পা চোখ মাথা চুল নখ সবকিছু নিশপিশ নিশপিশ করছে।

আমি বললাম, বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা, তুমি আর একটু ধৈর্য ধর, আমি এক্ষুনি চলে আসছি।

আমার অনিকের বাসায় যেতে আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগল, গিয়ে দেখি সেখানে দুই জন সুট পরা মানুষ বসে আছে। একজন মোটা আরেকজন চিকন। একজন ফরসা আরেকজন রীতিমতো কালো। একজ্জনের মাথায় চকচকে টাক অন্যজনের মাথায় ঘন চুল। একজনের গোফ অন্যজনের দাড়ি। কিন্তু কী একটা বিষয়ে দুইজনের মিল আছে, দেখলেই মনে হয় দুইজন আসলে একইরকম। আমাকে দেখে অনিক শুকনো গলায় বলল, জাফর ইকবাল, এই দেখ, আক্কাস আকন্দ সাহেবের দুই এটর্নি চলে এসেছেন।

দুই এটর্নি? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, কেন?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

মোটা, ফরসা, মাথায় টাক এবং গোঁফওয়ালা মানুষটা বলল, কেন? না বোঝার কী আছে? মনে নেই আপনি আমাদের সাথে কন্ট্রাক্ট সাইন করলেন যে গবেষণাটা বিক্রি করবেন?

চিকন, কালো, মাথায় চুল এবং ঘন দাড়িওয়ালা মানুষটা বলল, আমরা এখন বিক্রির কাজটা শেষ করতে এসেছি।।

অনিক বলল, কিন্তু কিন্তু— মোটা মানুষ বলল, কিন্তু কী?

আপনি কেমন করে বুঝতে পারলেন আমার আবিষ্কার হয়ে গেছে? এটা তো আমি জাফর ইকবাল ছাড়া আর কাউকে বলি নি।

চিকন মানুষ চোখ লাল করে বলল, আমরা সেটা সন্দেহ করেছিলাম যে আপনি আপনার আবিষ্কারের কথা গোপন রাখতে পারেন।

মোটা বলল, কন্ট্রাক্টের একুশ পাতায় স্পষ্ট লেখা আছে আবিষ্কারের দুই মিনিট একত্রিশ সেকেন্ডের ভেতরে আপনি আমাদের ফোন করে জানাবেন।

চিকন বলল, আপনি জানান নাই। সেইটা কন্ট্রাক্টের বরখেলাপ

মোটা বলল, তের পাতার এগার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপনার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক]।

অনিক চোখ কপালে তুলে বলল, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। আমার বিরুদ্ধে?

মোটা বলল, আমরা বুদ্ধি করে আপনার টেলিফোনে আড়ি পেতেছিলাম বলে কোনোমতে খশর পেয়েছি।

অনিক রেগে আগুন হয়ে বলল, আপনাদের এত বড় সাহস আমার টেলিফোনে আড়ি পাতেন?

চিকন বলল, কী আশ্চর্য! কন্ট্রাক্টের এগার পাতার নয় অনুচ্ছেদের তৃতীয় প্যারাগ্রাফে স্পষ্ট লেখা আছে আপনি আমাদের আড়ি পাতার অনুমতি দিয়েছেন।

মোটা বলল, আড়ি পাতার জন্যে যত খরচ হয়েছে সেটা আপনার গবেষণার মূল্য থেকে কেটে নেওয়া হবে।

আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। আমি মেঝে থেকে একটা লোহার রড় তুলে হুংকার দিয়ে বললাম, তবেরে বজ্জাত বদমাইশ বেশরমের দল। আজ তাদের একদিন কি আমার একদিন। যদি আমি পিটিয়ে তোদের তক্তা না বানাই, ঠ্যাং ভেঙে লুলা না করে দেই, মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে না ফেলি তা হলে আমার নাম জাফর ইকবাল না।

আমার এই দুংকার শুনে মোটা এবং চিকন এতটুকু ভয় পেল বলে মনে হল না। মোটা পকেট থেকে একটা ছোট ক্যামেরা বের করে ঘ্যাঁচ ঘাঁচি করে আমার ছবি তুলতে লাগল, চিকন একটা ছোট ক্যাসেট প্লেয়ার বের করে আমার হুংকার রেকর্ড করতে শুরু করে দিল।

আমি বললাম, বের হ এখান থেকে, বেজন্মার দল।

মোটা বলল, ঠাণ্ডা মাথায় খুন কার অপচেষ্টা। সব প্রমাণ আছে। ক্যামেরায় ছবি। ক্যাসেটে কথা। চৌদ্দ বছর জেল।

চিকন বলল, তার সাথে মানহানির মামলা জুড়ে দেব। স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ক্রোক করে নেব।

মোটা বলল, মামলা চলবে দুই বছর। সব খরচপাতি আপনার।

চিকন বলল, অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করতে হবে। তা হলে চুয়ান্ন ধারায় ফেলা যাবে–

আমি আরেকটু হলে লোহার রড দিয়ে মেরেই বসেছিলাম, অনিক কোনোভাবে আমাকে থামাল। ফিসফিস করে বলল, সাবধান জাফর ইকবাল, এরা খুব ডেঞ্জারাস। তোমার বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে। হাত থেকে রড ফেলে শান্ত হয়ে বস। ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।

আমি রাজি হচ্ছিলাম না, অনিক কষ্ট করে আমাকে শান্ত করে বসাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী চান?

মোটা তার মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে বলল, এই তো ভালো মানুষের মতো কথা! রাগারাগি করে কোনো কাজ হয় না।

চিকন বলল, আমরা এসেছি কন্ট্রাক্টের লেখা অনুযায়ী আপনার আবিষ্কার, মশার ঘর, মশা, মশার বাচ্চাকাচ্চা সবকিছু কিনে নিতে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, সবকিছু আপনারা কত দিয়ে কিনবেন?

মোটা বলল, হিসাব না করে তো বলতে পারব না।

আমি বললাম, করেন হিসাব।

তখন মোটা আর চিকন মিলে হিসাব করতে লাগল। কাগজের মাঝে অনেক সংখ্যা লিখে সেটা যোণ-বিয়োগ করতে লাগল, পকেট থেকে ক্যালকুলেটর বের করে সেটা দিয়ে হিসাব করে শেষ পর্যন্ত মোটা বলল, আপনার পুরো গবেষণা, মশার ঘর, মশা, তার বাচ্চাকাচ্চা সবকিছু কিনতে আপনাকে দিতে হবে সাত শ চল্লিশ টাকা।

অনিক অবাক হয়ে বলল, সাত শ চল্লিশ টাকা?

হ্যাঁ। চিকন আঙুল দিয়ে অনিককে দেখিয়ে বলল, আপনি দেবেন।

অনিক তখনো তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার বলল, আমি দেব?

মোটা বলল, হ্যাঁ। কন্ট্রাক্টের উনত্রিশ পৃষ্ঠার ছয় অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লেখা আছে এই আবিষ্কারের জন্যে আপনাকে আটাশ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। আটাশ দিন পার হবার পর প্রত্যেক দিন আপনার জরিমানা সাত হাজার একুশ টাকা করে।

অনিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না, কোনোমতে বলল, আমার জরিমানা?

চিকন বলল, আপনার কপাল ভালো। এই আবিষ্কার করতে যদি আপনার আরো মাসখানেক লেগে যেত তা হলে আপনার এই বাসা আমাদের ক্রোক করে নিতে হত।

অনিক কিছুক্ষণ ঘোলা চোখে মানুষ দুইজনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর কেমন জানি ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, শুধু একটা জিনিস বলবেন?

মোটা বলল, কী জিনিস?

আমি আমার বাসায় বসে, আমার ল্যাবরেটরিতে আমার সময় আমার মতো করে গবেষণা করছি, আপনারা আমাকে জরিমানা করার কে?

চিকন চোখ কপালে তুলে বলল, কী আশ্চর্য! আপনার পুরো গবেষণাটার অর্থায়ন করেছি আমরা। সবরকম ক্যামিকেল সাপ্লাই দিয়েছি আমরা?

ক্যামিকেল সাপ্লাই দিয়েছেন আপনারা?

হ্যাঁ। এই দেখেন সাতাশ পৃষ্ঠায় আপনার সিগনেচার। আপনি প্রথম কনসাইনমেন্ট বুঝে নিয়েছেন। দুই লিটার একুয়া। এক হাজার গ্রাম সুকরোস আর পাঁচ শ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড।

মোটা গরম হয়ে বলল, আপনি কি এটা অস্বীকার করতে পারেন?

অনিক কোনো কথা না বলে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, একুয়া মানে হচ্ছে পানি, সুকরোস মানে গুড় আর সোডিয়াম ক্লোরাইড মানে লবণ। এখন বুঝেছ, কেন দিয়েছিল?

আমি আবার লোহার রডটা নিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। অনিক অনেক কষ্ট করে আমাকে থামাল।

ঘণ্টাখানেকের মাঝে অনিকের বাসায় আক্কাস আকন্দ্রে লোকজনে গিজগিজ করতে লাগল। তারা অনিকের গবেষণার কাগজপত্র, মশার ঘর, মশা, মশার বাচ্চাকাচ্চা সবকিছু নিয়ে যেতে শুরু করল। বিশ্বাল একটা ট্রাকে করে যখন সবকিছু তুলে নিয়ে চলে গেল তখন বাজে রাত এগারটা চল্লিশ মিনিট। মোটা এবং চিকন হিসাব করে দেখেছে তারা অনিকের কাছে সাত শ চল্লিশ টাকা পায়। অনিকের কাছে ছিল দুই শ টাকা আমি ধার দিলাম চল্লিশ টাকা। বাকি পঁচশ টাকার জন্যে তারা অনিকের বসার ঘরের দেয়াল থেকে তার দেয়ালঘড়িটা খুলে নিয়ে চলে গেল।

সবাই যখন চলে গেল তখন আমি বললাম, অনিক এখন আমার কথা বিশ্বাস হল?

অনিক ভাঙা গলায় বলল, কোন কথা?

পোর আকন্দ তোমার রক্ত-মাংস চুষে খাবে আর চামড়া দিয়ে ড়ুগড়ুগি বাজাবে?

অনিক মাথা নাড়ল। আমি বললাম, আজকে তোমার রক্ত-মাংস চুষে খেল। আর দুই একদিনের মাঝেই দেখবে তোমার চামড়া দিয়ে ড়ুগড়ুগি বাজানো শুরু করেছে।

 

সত্যি সত্যি অনিকের চামড়া দিয়ে ড়ুগড়ুগি বাজানোর ব্যবস্থা হল–এক সপ্তাহ পরে দেখলাম সব পত্রিকায় বড় বড় করে খবর ছাপা হয়েছে, মশা নিয়ন্ত্রণে যুগান্তকারী আবিষ্কার : আক্কাস আকন্দের নেতৃত্বে নতুন সম্ভাবনা। নিচে ছোট ছোট করে লেখা আক্কাস আকন্দের ল্যাবরেটরিতে তার গবেষকরা কীভাবে দীর্ঘদিন রিসার্চ করে মশা নিয়ন্ত্রণের যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছে। এই আবিষ্কার চুরি করার জন্য কীভাবে দুই দিগভ্রান্তু যুবক অপচেষ্টা করেছিল। এবং কীভাবে তার সুযোগ্য আইনবিদরা সেই অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে এবং এখন সেই আবিষ্কারের কথা কীভাবে দেশবাসীকে জানানোর জন্যে আক্কাস আকন্দের ল্যাটেরিতে একটা সংব্বাদ সম্মেলন করা হবে সেটা বিস্তারিতভাবে লেখা আছে। সেই সংবাদ সন্মেলনে সাংবাদিকদের সাথে সাথে উৎসাহী ছাত্র-শিক্ষক এবং আমজনতাকে আহ্বান জানানো হয়েছে। খবরটা পড়ে অনিক কেমন যেন মিইয়ে গেল। অনেকক্ষণ গুম মেরে থেকে শেষে যোগ করে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি যাব।

আমি বললাম, কী বলছ?

আমি বলেছি যে আমি যাব।

আর্মি রেগেমেগে বললাম, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? তুমি দেখেছ খবরে লিখেছে দুইজন দিগ্‌ভ্রান্ত যুবক এই আবিষ্কার চুরি করার অপচেষ্টা করেছিল?

দেখেছি।

তার মানে বুঝতে পারছ?

পারছি।

কী বুঝতে পারছ?

বুঝতে পারছি যে আমি গেলে আমাকে ধরিয়ে দেবে। অন্য সাংবাদিকদের বলবে এই সেই দিগভ্রান্ত যুবক।

আমি বললাম, তা হলে?

তবু আমি যাব। অনিক মুখ গোঁজ করে বলল, বদমাইশগুলো কী করে আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।

তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। পরের দিন সব পত্রিকায় তোমার ছবি ছাপা হবে, নিচে লেখা হবে, এই সেই দিগভ্রান্ত যুবক যে যুগান্তকারী আবিষ্কার চুরি করার অপচেষ্টা করেছিল।

অনিক ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, হোক।

আমি বললাম, তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সবাই বলবে এই সেই গবেষণা চোরা।

অনিক বলল, বলুক। আমি বললাম, বাড়িওয়ালা তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।

অনিক বলল, দিক।

এই এলাকায় কারো বাড়িতে চুরি হলে পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। ব্রিমান্ডে নিয়ে ইলেকট্রিক শক দেবে।

অনিক বলল, দিক।

আমি বললাম, কয়দিন আগে তুমি আমাকে বুঝিয়েছ সব কথাবার্তা কাজকর্ম হবে যুক্তিপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক। এখন তুমি নিজে এরকম অযৌক্তিক কথা বলছ কেন? এরকম অবৈজ্ঞানিক কাজ করতে চাইছ কেন?

অনিক ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বিজ্ঞানের খেতা পুড়ি। অনিকের মুখ থেকে এরকম একটা কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম অবস্থা খুব জটিল। এখন তার সাথে ঝগড়া করে লাভ নাই। আমার বুকের ভেঁতর তখন দুঃখ দুঃখ একটা ভাব ভুটভুট করতে থাকে। আমি বললাম, ভাই অনিক।।

অনিক একটু অবাক হয়ে বলল, কী হল?

আমি যাব তোমার সাথে।

তুমিও যাবে?

হ্যাঁ। গিয়ে আমি যদি আক্কাস আকন্দের টুটি চেপে না ধরি, লাথি মেরে যদি তার সব এটর্নিদের হাঁটুর মালাই চাকি ফাটিয়ে না দিই তা হলে আমার নাম জাফর ইকবাল না।

আমার কথা শুনে অনিক কেমন যেন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।

 

পরের রোববার পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে আমি আর অনিক গুলশানের এক বিশাল দালানের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে বড় পোস্টার, মশা নিয়ন্ত্রণের যুগান্তকারী আবিষ্কার, সেখানে আক্কাস আকন্দের ছবি, শিকারির বেশে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে বন্দুক, সেই বন্দুক থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, তার পায়ের কাছে একটা বিদঘুটে রাক্ষসের মতো মশা চিত হয়ে মরে পড়ে আছে। দালানের সামনে মানুষের ভিড়, সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে এসেছে, টেলিভিশন চ্যানেলের লোকেরা টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। প্রাক্কাস আকন্দের লোকেরা লাল রঙের ব্লেজার পরে ছোটাছুটি করছে। অনেক মানুষের ভিড়ের মাঝে আমি আর অনিকও ঢুকে পড়লাম। কেউ আমাদের লক্ষ করল না।

বড় একটা হলঘরের মাঝখানে অনিকের কাচঘর বসানো হয়েছে। ভেতরে লাখ লাখ মশা। মাঝে মাঝেই মশাগুলো খেপে উঠে গুঞ্জন করছে। তখন মনে হয় ঘরের মাঝে একটা জেট প্লেনের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠছে। ফটোসাংবাদিকরা ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কাচঘরের ছবি তুলছে। টেলিভিশন চ্যানেলের লোকজন ঘাড়ে ক্যামেরা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। সাধারণ দর্শকরাও এসেছে অনেক, তাদের কথাবার্তায় সারা ঘর সরগরম। আমি গোপনে পকেটে দুইটা পচা টম্যাটো নিয়ে এসেছি, ঠিক করেছি আক্কাস আকন্দ আসামাত্র তার দিকে ছুড়ে মারব, তারপর যা থাকে কপালে তাই হবে। আমি মাঝে মাঝে চোখের কোনা দিয়ে অনিককে দেখছি, দেখে মনে হয় মরা মানুষের মুখ, তার মুখের দিকে তাকানো যায় না।

হঠাৎ করে ঘরের কথাবার্তা কমে এল। আমি তাকিয়ে দেখি খুব ব্যস্ততার ভান করে আক্কাস আকন্দের দুই এটর্নি মোটা-ফরসা-টাক-মাথা-গোঁফ আর চিকন-কালো-চুল এবং দাড়ি হনহন করে এগিয়ে আসছে। কাচঘরের সামনে দুইজন দাঁড়াল এবং সাথে সাথে ক্লিক ক্লিক করে সাংবাদিকরা তাদের ছবি তুলতে লাগল।

মোটা হাত তুলে সবাইকে চুপ করার ইঙ্গিত করতেই সবাই কথা বন্ধ করে চুপ হয়ে গেল। মোটা বলল, আমার প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা এবং সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের সবাইকে জানাই সাদর আমন্ত্রণ। আজ আপনারা এখানে এসেছেন এক ঐতিহাসিক ঘটনার সন্ধিক্ষণে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর মানুষ দুঃখ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রোগ, শোক এবং দারিদ্র্যের সাথে যে জিনিসটির সাথে যুদ্ধ করে এসেছে সেটা হচ্ছে মশী। হ্যাঁ, মশা হচ্ছে মানবতার শত্রু। সভার শর। দেশের সুখ ও সমৃদ্ধির শক্ত।

মোটা এই সময় থামল এবং চিকন কথা বলতে শুরু করল, গলা কাপিয়ে বলল, সেই ভয়ংকর শত্রুকে আমরা পরাভূত করেছি। আপনাদের ধারণী হতে পারে এই কাচঘরে আইকে রাখা লাখ লাখ মশা বুঝি ভয়ংকর কোনো প্রাণী, সুযোগ পেলেই বুঝি আপনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনাকে কামড়ে আপনার রক্ত শুষে নেবে! কিন্তু সেটি সত্যি নয়। মহামান্য আক্কাস আকন্দের সুযোগ্য নেতৃত্বে আমাদের হাউজের বিজ্ঞানীরা এই ভয়ংকর মশাকে এক নিরীহ পতঙ্গে পরিণত করে দিয়েছে। তারা আপনাকে কামড়াবে না, তারা আপনার রক্ত শুষে নেবে না।

চিকন দম নেবার জন্য থামল, তখন মোটা আবার যেই ধরল, বলল, আমি জানি আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। আপনারা ভাবছেন এটা কেমন করে সম্ভব? কিন্তু আপনাদের এটা দেখাব। এই কাচের ঘরে লাখ লাখ মশা। এরা হয়তো ম্যালেরিয়া-ফাইলেরিয়া বা ডের জীবাণু বহন করছে। কেউ যদি এর ভেতরে ঢোকে তা হলে লাখ লাখ মশা এক মুহূর্তে তার সব রক্ত শুষে নিতে পারে কিন্তু আমি আপনাদের বলছি তারা নেবে না।

চিকন এবারে থামল, তখন মোটা বলল, আছেন আপনাদের কেউ যে এর ভেতরে ঢুকবেন? কারো সাহস আছে?

উপস্থিত সাংবাদিক দর্শক কেউ সাহস দেখাল না। মোটা হা হা করে হেসে বলল, আমি জানি আপনাদের কেউ সেই সাহস করবেন না। তার প্রয়োজনও নেই, কারণ এই কাচঘরে লাখ লাখ শশার ভেতরে ঢুকবেন আকন্দ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মহামান্য আক্কাস আকন্দ স্বয়ং।

মোটা নাটকীয়ভাবে কথা শেষ করতেই প্রথমে চিকন, তার সাথে সাথে লাল ব্লেজার পরা আক্কাস আকন্দের লোকজন এবং তাদের দেখাদেখি সাংবাদিক-দর্শকরা হাততালি দিতে শুরু করল।

ঠিক তখন আমরা দেখতে পেলাম হলঘরের অন্য মাথা থেকে আক্কাস আকন্দ হেঁটে হেঁটে আসছে। হাঁটার ভঙ্গিটা একটু অন্যরকম, মনে হয় টলতে টলতে আসছে, পাশেই একজন মাঝে মাঝে তাকে ধরে ফেলছে। একটু কাছে আসতেই দেখলাম তার চোখ ঢুলুঢুলু এবং মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি, শুধু নেশাগ্রস্ত মানুষেরা এভাবে হাসে। আমি পচা টম্যাটো দুইটা শক্ত করে ধরে রেখে সঁতের ফাঁক দিয়ে বললাম, দেখছ? শালা পুরোপুরি মাতাল!

অনিক কেমন যেন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, বলল, কী বললে?

বলেছি বেটা দিনদুপুরে মদ খেয়ে এসেছে?

অনিক হঠাৎ আঁতকে উঠে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে প্রু করল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, সর্বনাশ!

ঘরের সবাই ঘুরে অনিকের দিকে তাকাল। সারা ঘরে একটা কথা নাই। আক্কাস আকন্দ একটা হেঁচকি তুলে জড়িত গলায় বলল, এই মক্কেলন্ডারে এখানে কে এনেছে?

মোটা চিৎকার করে বলল, ভলান্টিয়ার। একে বের করে দাও।

চিকন ততক্ষণে আমাকে দেখে ফেলেছে, সে খনখনে গলায় বলল, সাথে তার পার্টনারও আছে, তাকেও বের কর।

অনিক দুই হাত তুলে চিৎকার করে বলল, দাঁড়ান দাঁড়ান, আমার কথা শোনেন—

কিন্তু কেউ অনিকের কথা শুনতে রাজি হল না, ফটোসাংবাদিকরা ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কিছু ছবি তুলে ফেলল এবং তার মাঝে লাল ব্লেজার পরা লোকজন এসে আমাদের দুইজনকে গোল করে ঘিরে নিয়ে বের করে নিতে লাগল। আমি দুই হাতে দুইটা পচা টম্যাটো শুধু শুধু ধরে রাখলাম, আক্কাস আকন্দের দিকে ছুড়তে পারলাম না।

অনিক তখনো ষাড়ের মতো চেঁচাচ্ছে এবং আক্কাস আকন্দের লোকজন আমাদের দুইজনকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তার মাঝে দেখলাম কাচঘরের বাইরে একটা দরজা খোলা হল। আক্কাস আকন্দ সেখানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ভেতরে দ্বিতীয় দরজাটা খুলতেই সে লাখ লাখ মশার মাঝে হাজির হবে। অনিক পাগলের মতো চিৎকার করছে, তার মাঝে আক্কাস আকন্দ দ্বিতীয় দরজাটা খুলে ফেলেছে।

তারপর যে ঘটনাটি ঘটল আমি আমার জীবনে কখনো সেরকম ঘটনা ঘটতে দেখি নি। হঠাৎ করে লাখ লাখ মশা একসাথে আক্কাস আকন্দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল—আমরা তার গগনবিদারী চিৎকার শুনতে পেলাম। দেখলাম মশাগুলো কামড়ে তাকে তুলে ফেলেছে, শূন্যে সে লুটোপুটি খাচ্ছে, মশার আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। তাকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে কালো কম্বল গায়ে দেওয়া একটা ভালুক। বিকট চিৎকার করতে করতে সে হাত পা ছুড়তে থাকে, তার মাঝে মশার ভয়ংকর গুঞ্জন সব মিলিয়ে একটা নারকীয় পরিবেশ। কাচঘরের ভেতরে মশাগুলো তাকে নাচিয়ে বেড়ায় এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে, ফুটবলের মতো ছুড়ে দেয়। ছাদে ঠেসে ধরে ঝপাং করে পানিতে ফেলে দিয়ে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে থাকে। আক্কাস আকন্দের লোকজন কী করবে বুঝতে না পেরে দরজা খোলার চেষ্টা করতে থাকে এবং হঠাৎ করে সব মশা কাচঘর থেকে ভয়ংকর গর্জন করে ছুটে বের হয়ে আসতে থাকে।

সাংবাদিক-দর্শকরা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিল না কী হচ্ছে। এক দুইজন একটু ছবিও তুলেছিল কিন্তু যেই মুহূর্তে খোলা দরজা দিয়ে বন্যার পানির মতো কালো কুচকুচে মশার সমুত্ত্ব বের হতে শুরু করল তখন সবাই প্রাণের ভয়ে ছুটতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে যা একটা হুঁটোপুটি শুরু হল সেটা বলার মতো নয়। আমি দেখলাম মশার দল আক্কাস আকন্দকে কামড়ে ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছে, সিড়ি দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে গেল তারপর রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিল। মানুষজন প্রাণের ভয়ে ছুটছে। আমিও ছুটছিলাম, অনিক আমার হাত ধরে থামাল, বলল, থাম। দৌড়ানোর দরকার নেই।

কী বলো দরকার নেই! খোক্কস আকন্দের অবস্থাটা দেখেছ?

হ্যাঁ। বেটা মদ খেয়ে এসেছে সেই জন্যে! তুমি কি মদ খেয়েছ?

মদ?

হ্যাঁ। ইথাইল অ্যালকোহল হচ্ছে মদ। এই মশা রক্ত না খেয়ে এখন মদ খাওয়া শিখেছে। আক্কালের রক্তে ইথাইল অ্যালকোহল, সেজন্যে ওকে ধরেছে।

আমি বললাম, আমাকে ধরবে না?

না। তুমি যদি ইথাইল অ্যালকোহল—সোজা বাংলায় মদ খেয়ে না থাক তা হলে তোমাকে ধরবে না।

আমি বললাম, আমি মদ খেতে যাব কোন দুঃখে?

তা হলে তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখ।

আমি তখন দেখলাম কালো মেঘের মতো লাখ লাখ মশা একসাথে ছুটে যাচ্ছে। সেটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। না জানি এখন কোন মদ খাওয়া মানুষকে ধরবে। আমি বুকের ভেতর থেকে একটা নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মশাগুলো তখন দক্ষিণ দিকে উড়ে যাচ্ছে, দেখে মনে হল একটা মেঘ বুঝি ভেসে যাচ্ছে।

 

পরদিন খবরের কাগজে খুব বড় বড় করে আক্কাস আকন্দের খবরটা ছাপা হয়েছিল। তার শরীরের ছিবড়েটা তখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তাকে নাকি দশ বোতল রক্ত দিতে হয়েছে। এতগুলো সাংবাদিককে ডেকে এনে এরকম ভাওতাবাজি করার জন্যে সাংবাদিকতা খুব খেপে পত্রিকাগুলোতে একেবারে যাচ্ছেতাইভাবে আক্কাস আকন্দকে গালাগাল করেছে। শুধু যে গালাগাল করেছে তা না, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নাকি এতগুলো মশা শহরে ছেড়ে দেবার জন্যে আক্কাস আকন্দের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে দেবে। বাছাধনের মাত্রাটা বেজে যাবে তখন।

পত্রিকায় বড় বড় খবর নিয়ে সবাই যখন মাথা ঘামাচ্ছে তখন ভেতরের পাতার একটা খবর কেউ সেভাবে খেয়াল করে নি। এক রগচটা কাঠমোল্লা একটা গির্জা ঘেরাও করার জন্যে তার দলবল নিয়ে রওনা দিয়েছিল, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে যখন সবাইকে উসকে দেবার জন্য গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছে তখন হঠাৎ কোথা থেকে হাজার হাজার মশা এসে তাকে আক্রমণ করেছে। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে সেই রগচটা কাঠমোল্লা।

এত মানুষ থাকতে তাকেই কেন মশা আক্রমণ করল কেউ সেটা বুঝতে পারছে না। বুঝতে পেরেছি খালি আমি আর অনিক!