ভূমিদান এবং ক্রয়-বিক্রয়ের রীতি
ভূমি- ব্যবস্থাসম্পর্কিত যে-সব পট্টোলী প্রাচীন বাঙলায় এ-পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে, সেগুলিকে মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করা যায়। খ্ৰীষ্টাত্তর পঞ্চম হইতে অষ্টম শতক পর্যন্ত লিপিগুলি সমস্ত ভূমিদানি-বিক্রয় সম্বন্ধীয়; এই লিপিগুলিতে ভূমিদানি-বিক্রয় রীতির ক্রমও কম বেশি বিস্তৃতভাবে উল্লিখিত হইয়াছে। তাহার ফলে ভূমি-সম্পর্কিত দায় ও অধিকার, ভূমির প্রকারভেদ ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক প্রকার সংবাদ এই লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। এই রীতি-ক্রমের একটু পরিচয় এইখানে লওয়া যাইতে পারে। রাজাকর্তৃক ব্ৰাহ্মণকে কিংবা দেবতার উদ্দেশে ভূমি-দানের লিপি বা দলিল প্রাচীন ভারতে অজ্ঞাত নয়; কিন্তু প্ৰাচীন বাঙলার এই পর্বের লিপিগুলি ঠিক এই জাতীয় ব্ৰহ্মদেয় বা দেবোত্তর ভূমি-দানের পট্ট বা দলিল নয়। এই শাসনগুলি একটু বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করিলে প্রাচীন বাঙলার ভূমি-ব্যবস্থা সম্বন্ধে এমন সব সংবাদ পাওয়া যায় যাহা সাধারণত প্রাচীন ভারতের ভূমিদান-সম্পর্কিত শাসনগুলিতে বেশি দেখা যায় না।
প্রথমেই দেখিতেছি, ভূমি-ক্রয়েচ্ছু যিনি তিনি স্থানীয় রাজসরকারের কাছে আবেদন বিজ্ঞাপিত করিতেছেন। ক্রয়েচ্ছু একজনও হইতে পারেন, একজনের বেশিও হইতে পারেন, এবং একাধিক ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি একই সঙ্গে ক্ৰয়ের ইচ্ছা বিজ্ঞাপিত করিতে পারেন। যেমন বৈগ্রাম তাম্রপট্টোলীতে দেখা যায় একই সঙ্গে দুই ভাই, ভোয়িল ও ভাস্কর, একত্র রাজ্যসরকারের ভূমি-ক্রয়ের আবেদন জানাইতেছেন। পাহাড়পুর পট্টোলীতে দেখি, ব্ৰাহ্মণ নাথশৰ্মা ও তাহার স্ত্রী রামী একই সঙ্গে আবেদন উপস্থিত করিতেছেন। ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা সাধারণ গৃহস্থও হইতে পারেন, অথবা রাজসরকারের কর্মচারী বা তৎসম্পর্কিত ব্যক্তি বা অধিকরণের সভ্যও হইতে পারেন। ধনাইদহ তাম্রপট্টোলীতে দেখা যাইতেছে ভূমি-ক্রেতা হইতেছেন। একজন আয়ুক্তক বা রাজকর্মচারী; ৪নং দামোদরপুর তাম্রশাসনে উল্লিখিত নগরশ্রেষ্ঠী রিভুপাল স্থানীয় অধিষ্ঠানাধিকরণের একজন সভ্য; বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর পট্টোলীতে আবেদন-কর্তা হইতেছেন মহারাজ রুদ্রদত্ত, যিনি মহারাজ বৈন্যগুপ্তের পদদাস, তবে রুদ্রদত্ত মূল্য দিয়া ভূমি ক্রয় করিয়াছিলেন, না বিনামূল্যেই তাহা লাভ করিয়াছিলেন, স্পষ্ট করিয়া শাসনে বলা হয় নাই; ধর্মদিতে্যুর ১নং পট্টোলীতে ভূমি-ক্রেতার নাম বাটভোগ, যিনি ছিলেন সাধনিক, এবং এই উপাধি হইতে মনে হয় তিনি রাজকর্মচারী ছিলেন; গোপচন্দ্রের পট্টোলীতে ভূমি-ক্রেতা হইতেছেন বৎসপাল যিনি ছিলেন বারকমণ্ডলের বিষয়-ব্যাপারের কর্তা, রাষ্ট্রের বিনিযুক্তক (বারিক বিষয়-ব্যাপারায় বিনিযুক্তক বৎসপাল স্বামিনা), অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র-সম্পর্কিত ব্যক্তি; ত্রিপুরা জেলায় প্ৰাপ্ত লোকনাথের পট্টোলীতেও ব্ৰাহ্মণ মহাসামন্ত প্ৰদোষশর্মণ এই জাতীয় জনৈক রাষ্ট্রযন্ত্র-সম্পর্কিত ব্যক্তি, কিন্তু তিনি মূল্য দিয়া ভূমি লাভ করিয়াছিলেন কিনা তাহা শাসনে সুস্পষ্ট উল্লিখিত হয় নাই। রাজসরকল্প বলিতে সাধারণত যে অধিষ্ঠান বা বিষয়ে প্রস্তাবিত ভূমির অবস্থিতি সেই অধিষ্ঠানের আয়ুক্তক ও অধিষ্ঠানাধিকরণ, অথবা বিষয়ের বিষয়পতি ও বিষয়াধিকরণ এবং স্থানীয় প্রধান প্রধান লোকদের বুঝায়। দুই-একটি পট্টোলীতে মাঝে মাঝে ইহার অল্পবিস্তর ব্যতিক্রম যে নাই তাহা বলা চলে না, তবে তাহা খুব উল্লেখযোগ্য নয়, এই কারণে যে, সর্বত্রই ভূমির প্রকৃত অধিকারীর পক্ষে স্থানীয় প্রতিনিধিদের বিজ্ঞাপিত করাটাই ছিল সাধারণ নিয়ম। রাজসরকারের উল্লেখ-প্রসঙ্গে তদানীন্তন রাজার এবং ভুক্তিপতি বা উপরিকের নামও উল্লেখ করার রীতি প্রচলিত ছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শাসনের এই অংশে লিপির তারিখও দেওয়া হইয়াছে।
এই সাধারণ বিজ্ঞপ্তির পরেই দেখিতেছি, ভূমি-ক্রয়ের বিশেষ উদ্দেশ্যটি কী, তাহা আবেদন-কর্তা সাধারণত প্রথম পুরুষেই বিজ্ঞাপিত করিতেছেন, এবং তিনি যে, ক্ষেত্র, খিল, অথবা বাস্তুভূমির স্থানীয় প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মূল্য দিতে প্রস্তুত আছেন, তাহাও বলিতেছেন। দেখা যাইতেছে, সর্বত্রই ভুমি-ক্রয়ের প্রেরণা ক্রীত-ভূমি দেবীকার্য বা ধর্মাচরণোদেশে দানের ইচ্ছা।
তৃতীয় পর্বে পুস্তপাল বা দলিল-রক্ষকের বিবৃতি। ভূমি-ক্রয়েছু ব্যক্তির আবেদন রাজসরকারে পৌঁছিলেই রাজসরকার তাহা পুস্তপাল বা পুস্তপালদের দপ্তরে পাঠাইতেছেন; পুস্তপাল বা পুস্তপালেরা প্রস্তাবিত ভূমি আর কাহারও ভোগ্য কিনা, আর কাহারও অধিকারে আছে কি না, অন্য কেহ সেই ভূমি ক্রয়ের ইচ্ছা জানাইয়াছে কিনা, ভূমির মূল্য যথাযথ নির্ধারিত হইয়াছে কিনা, রাজসরকারের কোনও স্বার্থ তাহাতে আছে কিনা ইত্যাদি জ্ঞাতব্য তথ্য নির্ণয় করিতেছেন তাহার বা তাহাদের দপ্তরে রক্ষিত কাগজপত্র, শাসন ইত্যাদির সাহায্যে, এবং কোনও প্রকার আপত্তি না থাকিলে প্রস্তাবিত ভূমি বিক্রয়ের সম্মতি জানাইতেছেন। যে কয়েকটি শাসনের খবর আমরা জানি তাহার প্রত্যেকটিতে পুস্তপাল-দপ্তরের সম্মতিই বিজ্ঞাপিত হইয়াছে; এই কারণে অনুমান করা স্বাভাবিক যে, ব্যাপারটা নেহাৎই কার্যক্রমাগত। কিন্তু বোধহয়, এই অনুমান সর্বত্র সংগত নয়। ৫নং দামোদরপুর পট্টোলীতে বিষয়পতির সঙ্গে পুস্তপালের একটু বিরোধের (বিষয়পতিনা কশ্চিদ্বিরোধঃ) ইঙ্গিত যেন আছে! কী লইয়া বিরোধ বাধিয়াছিল তাহা সুস্পষ্ট করিয়া বলা হয় নাই; তবে অনুমান হয় যে, বিষয়পতির পক্ষ হইতে কোনও আপত্তি ভূছিল। যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত মহারাজাধিরাজের নিকট গিয়া বিষয়পতির আপত্তি টেকে নাই।
চতুর্থ পর্বে রাষ্ট্রের অনুমতি। যথানির্ধারিত মূল্য গ্রহণের পর রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে স্থানীয় রাজসরকার ক্রয়েছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ভূমি বিক্রয়ের অনুমতি দিতেছেন, এবং প্রস্তাবিত ভূমি যে-গ্রামে অবস্থিত সেই গ্রামের প্রধান প্রধান ব্যক্তি ও ব্রাহ্মণ-কুটুম্বদের ও রাজপুরুষদের সম্মুখে অনুযায়ী ভূমির মাপজোখ করিয়া বিক্ৰীত ভূমি ক্রয়েছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিদিগকে হস্তান্তরিত করিয়া দিতেছেন। কী শর্তে তাহা দিতেছেন, তাহাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হইতেছে। দেখা যাইতেছে প্রায় সর্বত্রই এই শর্ত অক্ষয়নীবীধর্মানুযায়ী।
পঞ্চম পর্বে ক্রেতার বা বিক্রেতার পক্ষ হইতে ক্ৰীত অথবা বিক্ৰীত ভূমি-দানের বিবৃতি। এই পর্বে ক্রেতা অথবা বিক্রেতা কাহাকে বা কাহাদের কী উদ্দেশ্যে, কোন শর্তে ক্ৰীত ভূমি দান করিতেছেন তাহা বলা হইতেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ক্রেতার পক্ষ হইতে বিক্রেতাও তাহা করিতেছেন।
ষষ্ঠ অথবা সর্বশেষ পর্বে এই জাতীয় দত্তভূমি রক্ষণাপহরণের পাপপুণ্যের বিবৃতি দেওয়া হইতেছে এবং শাস্ত্রোক্ত শ্লোকে তাহা সমাপ্ত হইতেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই পর্বে শাসনের তারিখ উল্লিখিত আছে। স্থানীয় রাজসরকারের শীলমোহরদ্বারা এইসব পট্টোলী নিয়মানুযায়ী পট্টীকৃত আধুনিক ভাষায় রেজিস্ট্রি করা হইত।
সমস্ত তাম্রশাসনেই যে সব-কটি পর্বের উল্লেখ একই ভাবে আছে, তাহা নয়। কোনও কোনও তাম্রপাট্ট সাব-কটি পর্বের বিস্তৃত উল্লেখ নাই, কোনও পর্বের আভাসমাত্র আছে, আবার কোথাও কোথাও একেবারে বাদও দেওয়া হইয়াছে। তাহা ছাড়া, কোনও কোনও ক্ষেত্রে জমিত মাপজোখ ও সীমানির্দেশ রাজসরকার হইতে না করিয়া গ্রামপ্রধানদের তাহা করিবার আদেশ দেওয়া হইয়াছে, যেমন পাহাড়পুর পট্টোলীতে। এইরূপ অল্পস্বল্প ব্যতিক্রম কোথাও কোথাও থাকা সত্ত্বেও মোটামুটি পট্টোলীগুলি একই ধরনের।
কিন্তু এই পঞ্চম হইতে অষ্টম শতক পর্যায়ে একেবারে অন্য ধরনের ভূমি-দানের পট্টোলীও যে নাই তাহা বলা চলে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর পট্টোলী (৬ষ্ঠ শতক), জয়নাগের বপ্লঘোষবাট পট্টলী (৭ম শতক), লোকনাথের ত্রিপুরা পট্টোলী (৭ম শতক), এবং দেবখড়গের আম্রফপুরের দুটি পট্টোলীর (৮ম শতক) উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইহাদের প্রত্যেকটিই ভূমি-দানের শাসন, দত্তভূমি ক্রয়ের কোনও উল্লেখই ইহাদের মধ্যে নাই; কাজেই পূর্বোক্ত শাসনগুলির ক্রমের সঙ্গে এই পট্টোলীগুলির তুলনা করা চলে না। বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর তাম্রপট্টোলীতে মহারাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত স্বয়ং কিছু ভূমি দান করিতেছেন মহাযানী সম্প্রদায়ের অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘকে; লোকনাথের ত্রিপুরা পট্টোলীতে রাজকর্মচারী ব্ৰাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশৰ্মণ এক অনন্তনারায়ণের মন্দির নির্মাণ ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য এবং তাহার দৈনন্দিন ব্যয়নির্বাহের জন্য মহারাজ লোকনাথের কাছে কিছু ভূমি প্রার্থনা করিতেছেন, এবং রাজা সেই ভূমিদান করিতেছেন। জয়নাগের বিপ্লঘোষবাট পট্টোলী ও দেবখড়গের আস্রফপুর পট্টোলী দুটিতে ভূমিদানের অনুরোধ বা প্রার্থনা কেহ জানাইতেছেন, এমন উল্লেখও নাই; রাজা নিজেই যথাক্রমে ভট্ট ব্ৰহ্মবীর স্বামী ও কোনও বৌদ্ধসংঘকে ভূমিদান করিতেছেন, এইটুকুই শুধু আমরা জানিতে পারিতেছি। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের নিধনপুর লিপিতে আর একটি প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাইতেছে। ভাস্করবর্মর জনৈক উর্ধর্বতন পুরুষ রাজা ভূতিবৰ্মণ একবার কয়েকজন ব্রাহ্মণকে প্রচুর ভূমিদান করিয়া দানকর্ম রাজসরকারে পট্টীকৃত করিয়া তাম্রপট্টগুলি ব্রাহ্মণদের হাতে অৰ্পণ করিয়াছিলেন। পরে কোনও সময়ে অগ্নিদাহে সেই তাম্রপট্টগুলি নষ্ট হইয়া যায়। তাহার ফলে ভূমির ভোগাধিকার লইয়া পাছে কোনও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, বোধহয় এই আশঙ্কাতেই সেই ব্ৰাহ্মণদের বংশধরেরা ভাস্করবর্মণের নিকট হইতে পুরাতন দানক্রিয়া নূতন করিয়া পট্টীকৃত করিয়া লন। ভাস্করবর্মণানুমোদিত তাম্রপট্টই বর্তমানে নিধনপুর পট্টোলী বলিয়া খ্যাত; কিন্তু মূলত এই ব্রহ্মদেয় ভূমি রাজা ভূতিবৰ্মার দান।
তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, আগে যে দানবিক্রয়-সম্পর্কিত পট্টোলীগুলির উল্লেখ করিয়াছি সেগুলি সদ্যোক্ত পট্টোলীগুলি হইতে বিভিন্ন। পূর্বোক্ত পট্টোলীগুলি প্রথমত ভূমি-ক্রয়বিক্রয়ের শাসন এবং দ্বিতীয়ত ভূমি-দানের শাসনও বটে। সদ্যোক্ত পট্টোলীগুলি শুধুই ভূমি দানের শাসন। ভূমি-ক্রয়ের শাসন কাহাকে বলেই বাৰ্হস্পত্য ধর্মশাস্ত্ৰে তাহার উল্লেখ আছে। বৃহস্পতি বলেন, ন্যায্য মূল্য দিয়া কোনও ব্যক্তি যখন কোনও বাস্তু, ক্ষেত্র অথবা অন্য কোনও প্রকার ভূমি-ক্রয় করেন এবং মূল্যের উল্লেখসমেত ক্রয়কার্যের একটি শাসন লিপিবদ্ধ করিয়া লন, তখনই সে শাসনকে বলা হয় ভূমি-ক্ৰয়ের শাসন। পূর্বোক্ত লিপিগুলি যে বৃহস্পতি-কথিত ভূমি-ক্রয়ের শাসন এ সম্বন্ধে তাহা হইলে কোনও সন্দেহ নাই। জার্মান পণ্ডিত য়লি (Jolly) মনে করেন, বৃহস্পতি খ্ৰীষ্টাত্তর ৬ষ্ঠ অথবা ৭ম শতকের লোক; যদি তাহা হয় তাহা হইলে বৃহস্পতি পূর্বোক্ত পট্টোলীগুলির প্রায় সমসাময়িক। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বাস্তু ও বাস্তু-বিক্রয় অধ্যায়ে সর্বপ্রকার ভূমি, ঘরবাড়ি, উদ্যান, পুষ্করিণী, হ্রদ, ক্ষেত্র ইত্যাদি বিক্রয়ের ক্রম ও রীতির উল্লেখ আছে; এই অধ্যায় হইতে আমরা জানিতে পাই, এই ধরনের ক্রয়-বিক্রয় কুটুম্ব, প্রতিবাসী এবং সম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্মুখে হওয়া উচিত, এবং যিনি সর্বোচ্চ মূল্য দিয়া ভূমি ডাকিয়া লইয়া ক্রয় করিতে রাজী হইবেন তাহার কাছেই প্রস্তাবিত ভূমি বিক্রয় করিতে হইবে। ভূমির মূল্যের উপর ক্রেতাকে রাজ সরকারে একটা করাও দিতে হইবে, এ কথাও কৌটিল্য বলিতেছেন। মূল্যের উপর কোনও প্রকার কারের উল্লেখ আমাদের লিপিগুলিতে নাই; ইহার কারণ সহজেই অনুমেয়। ক্রীত ভূমিমখণ্ডগুলি প্রায় সমস্তই ধর্মাচরণোদেশে দানের জন্য, এবং সেই হেতুই তাহা করারহিত। তবে, ভূমি-বিক্রয়ের ব্যাপারটা যে কুটুম্ব, প্রতিবাসী এবং সম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্মুখেই নিষ্পন্ন হইত। তাহার উল্লেখ প্রায় প্রত্যেক লিপিতেই পাওয়া যায়। কতকটা পূর্বোক্ত শাসনানুরূপ ভূমি-বিক্রয়ের অন্তত একটি পাথুরে প্রমাণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। এই লিপিটি নাসিকের একটি বৌদ্ধ-গুহার প্রাচীরে উৎকীর্ণ, এবং ইহার তারিখ খ্ৰীষ্টাত্তর দ্বিতীয় শতকের প্রথমার্ধ। ইহাতে উল্লেখ আছে যে, ক্ষত্রপ নহপানের জামাতা, দীনীকপুত্র উষবদান্ত জনৈক ব্ৰাহ্মণের নিকট হইতে ৪,০০০ কার্ষপণ মুদ্রায় কিছু ক্ষেত্রভূমি ক্রয় করিয়াছিলেন, তাহা গুহাবাসী ভিক্ষুসংঘকে দান করিয়াছিলেন। উষবদাত ভূমি ক্ৰয় করিয়াছিলেন জনৈক গৃহস্থের নিকট হইতে, রাজা বা রাষ্ট্রের নিকট হইতে নয়, কাজেই সে ক্ষেত্রে যে সুবিস্তৃত ক্রমের উল্লেখ প্রাচীন বাঙলার পূর্বোক্ত লিপিগুলিতে আছে তাহার কোনও প্রয়োজনই হয় নাই। আমাদের লিপিগুলিতে কিন্তু সাধারণভাবে একটি দৃষ্টান্তও পাইতেছি না যেখানে কোনও গৃহস্থ কোনও ভূমি। বিক্রয় করিতেছেন; সর্বত্রই যে ভূমি বিক্রীত হইতেছে, তাহা রাজা বা রাষ্ট্রকর্তৃকই হইতেছে। এ প্রশ্ন স্বভাবতই মনকে অধিকার করে, প্রাচীন বাঙলার সুদীর্ঘ কালের মধ্যে কোনও গৃহস্থই কি ভূমি বিক্রয় করেন নাই? সে অধিকার কি তাহার ছিল না? যদি করিয়া থাকেন, যদি সে-অধিকার থাকিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহা কী উপায়ে বিধিবদ্ধ হইত? সে বিক্রয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্বন্ধ কিরূপ ছিল? কৌটিল্যের ইঙ্গিতানুযায়ী ভূমির মূল্যের উপর রাজাকে বা রাষ্ট্রকে কিছু —ণামী দিতে হইত কি, না। রাষ্ট্র রাজস্ব লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিত? এইসব অত্যন্ত সংগত ও স্বাভাবিক প্রশ্নের কোনও উত্তর পাইবার সূত্রও লিপিগুলিতে আবিষ্কার করা যায় না।
এ-পর্যন্ত খ্রীষ্টোত্তর অষ্টম শতক পর্যন্ত লিপিগুলির কথাই বলিলাম। এইবার অষ্টম হইতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত লিপিগুলি একটু বিশ্লেষণ করা যাইতে পারে। প্রথমেই বলা যায়, যতগুলি শাসনের সংবাদ আমরা জানি, তাহার সাব-কটিই ভূমি-দানের শাসন, ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয়ের শাসন একটিও নয়। এই পর্বের শাসনগুলিকে সেইজন্য পূর্বোক্ত গুণাইঘর, বিপ্লঘোষবাট, লোকনাথ বা আম্রফপুর লিপিগুলির সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে, যদিও পাল ও সেন আমলের লিপিগুলি অনেকটা দীর্ঘায়িত। অন্য কারণেও এই পর্বের কোনও কোনও শাসনের সঙ্গে গুণাইঘর লিপি অথবা লোকনাথের লিপিটির কতকটা তুলনা করা চলে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধর্মপালের খালিমপুর লিপিটির উল্লেখ করা যাইতে পারে। মহাসামন্তাধিপতি শ্ৰীনারায়ণ বৰ্মা একটি নারায়ণ-মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; সেই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পূজার দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি যুবরাজ ত্ৰিভূবনপালকে দিয়া রাজার কাছে চারিটি গ্রাম প্রার্থনা করিয়াছিলেন, এবং প্রার্থনানুযায়ী রাজা তাহা দান করিয়াছিলেন। এই ধরনের দৃষ্টান্ত আরও দু-একটি উল্লেখ করা যাইতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ শাসনে এইরূপ প্রার্থনা বা অনুরোধের কোনও উল্লেখ নাই। রাজা যেন স্বেচ্ছায় ভূমি দান করিতেছেন, এই রকম ধারণা জন্মায়। অথবা, এমনও হইতে পারে, অনুরোধ বা প্রার্থনা করা হইয়াছিল, কিন্তু তাহা আর বাহুল্য অনুমানে উল্লিখিত হয় নাই। এই ধরনের লিপিগুলির সঙ্গে বিপ্লঘোষবাট ও আস্রফপুর লিপি দুইটির তুলনা করা যাইতে পারে। পাল-আমলে দেখা যায়, কোথাও কোথাও ভূমি দান করা হইতেছে কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে, যদিও ব্যক্তিগতভাবে ব্ৰাহ্মণকে ভূমি-দানের দৃষ্টান্তেরও অভাব নাই। কিন্তু, সেন-আমলে প্রায় সব দানই ব্যক্তিগত দান, এবং সেন-রাজাদের যে কয়টি ভূমি-দানের সংবাদ আমরা শাসনে পাই তাহার সাব-কয়টিই দান-গ্ৰহীতা হইতেছেন। ব্ৰাহ্মণ এবং দানের উপলক্ষ হইতেছে কোনও ধর্মানুষ্ঠানের আচরণ। এই ধরনের দান কতকটা ব্ৰাহ্মণ-দক্ষিণা জাতীয়, এবং এ-সব ক্ষেত্রে ভূমি-দান গ্রহণের কোনও অনুরোধ-জ্ঞাপনের প্রশ্নই উঠিতে পারে না। আমার তো মনে হয়, যে-সব ক্ষেত্রে কোনও ধর্ম-প্রতিষ্ঠানের জন্য ভূমি প্রয়োজন হইয়াছে, সেইখানেই প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা রাজাকে ভূমি দানের অনুরোধ জানাইয়াছেন, এবং রাজাও সেই অনুরোধ রক্ষা করিয়াছেন; গুণাইঘর, লোকনাথ ও খালিমপুর লিপির সাক্ষ্য এই অনুমানের দিকেই ইঙ্গিত করে। আর, যেখানে রাজা অথবা রাষ্ট্র নিজেই প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা, অথবা যেখানে পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত কোনও আয়তনের প্রয়োজন রাজা নিজেই অনুভব করিয়াছেন, অথবা রাষ্ট্র-কর্মচারীর বা জনপদ-প্রধানদের মুখ হইতে শুনিয়াছেন, সেখানে রাজা নিজেই স্বেচ্ছায় ভূমি দান করিয়াছেন, কোনও অনুরোধের অপেক্ষা বা অবসর সেখানে নাই। শেষোক্ত ক্ষেত্রে আমার এই অনুমানের সাক্ষ্য অষ্টম শতকের আস্রফপুর লিপি দুইটিতে আছে। ইহার সাক্ষ্য এই যে, রাজা দেবখড়গ নিজেই আচার্য সংঘমিত্রের বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রচুর ভূমি দান করিয়াছিলেন, কোনও অনুরোধের উল্লেখ সেখানে নাই। শ্ৰীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবদেবের লিপির সাক্ষ্যও একই প্রকারের।
এই পর্বের লিপিগুলিতে দেখিলাম, ভূমিদান করিতেছেন সর্বত্রই রাজা স্বয়ং, কিন্তু সপ্তম-অষ্টম শতকের আগেকার লিপিগুলিতে দেখিয়াছি, ধর্মপ্রতিষ্ঠানের ব্যয়নির্বাহের জন্য ভূমিদানি গৃহস্থ ব্যক্তিরাই করিতেছেন, এবং দানের পূর্বে সেই ভূমি মূল্য দিয়া রাজার নিকট হইতে কিনিয়া লইতেছেন। দু-চার ক্ষেত্রে রাজাও ভূমিদান করিতেছেন, কিন্তু তাহাও ক্রেতার পক্ষ হইতেই; তিনি শুধু দানকার্যের পুণ্যের যষ্ঠভাগ (ধৰ্মষড়ভাগং) লাভ করিতেছেন। এ প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, আগেকার পর্বে অর্থাৎ সপ্তম শতকের পূর্বে ধৰ্ম-প্রতিষ্ঠানের যত ভূমিদানি তাহা অধিকাংশ গৃহস্থ ব্যক্তিরাই করিতেছেন কেন, আর উত্তরপর্বে ভূমিদানি শুধু রাজাই করিতেছেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কি এই যে, ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিষ্ঠা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব আগে ব্যক্তিগতভাবে পুরজনপদবাসী গৃহস্থরাই করিতেন, এবং পরে ক্রমশ সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে রাজাই গ্রহণ করিয়াছিলেন? ব্যক্তিগতভাবে ব্রাহ্মণদের যে-সব ভূমিদান করা হইত, সে-সব দান সম্বন্ধে এ ধরনের কোনও প্রশ্নের বা উত্তরের অবকাশ নাই। এইরূপ ব্যক্তিগত দানের পরিচয় ঘাঘরাহাটি এবং বিপ্লঘোষবাট পট্টোলী দুইটিতে পাওয়া যায়। পাল ও সেন আমলের লিপিতে এই পরিচয় প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়।
গুপ্ত আমল হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলীতেই দেখা যায় পুস্তপাল (record-keeper) নামক জনৈক রাজপুরুষের উল্লেখ। কেন্দ্রীয় ভুক্তি-সরকারে যেমন, আহার এবং মণ্ডল-অধিষ্ঠানেও তেমনই পুস্তপাল-নামীয় একজন রাজপুরুষ নিযুক্ত থাকাই যেন ছিল। রীতি। পট্টোলীগুলি একটু অভিনিবেশে পাঠ করিলেই মনে হয়, ভূমি-সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্রের দপ্তরের মালিকই ছিলেন তিনি, এবং তাঁহার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য ছিল তাহার অধীন সমস্ত ভূমির সীমা, স্বত্ব, অধিকার বিভাগ, অর্থাৎ জরিপ সম্বন্ধীয় সমস্ত সংবাদ ও হিসাব সংগ্রহ করা এবং তাহা প্রস্তুত রাখা। খুবই সম্ভব, এইসব সংবাদ লিপিবদ্ধ থাকিত তালপাতায় ংবা ঐ জাতীয় কোনও বস্তুর উপর; আজ আর সে-সব দপ্তর উদ্ধারের কোনও উপায় নাই। জমি যখন দান-বিক্রয় করা হইত এবং রাজসরকারে পট্টীকৃত বা রেজেস্ট্রি করা হইত, কেবল তখনই প্রয়োজন হইত তাম্রশাসনের; তাহারই দুই-চারিটি ইতস্তত আমাদের হাতে আসিতেছে। পাল আমলে না হউক, অন্তত সেন রাজাদের আমলে কোনও না কোনও প্রকার পুঙ্খানুপুঙ্খ জমি-জরিপের বন্দোবস্ত ছিল এবং সমস্ত জমির সীমা, স্বত্ব, অধিকার, শস্যোৎপত্তির গড়পড়তা পরিমাণ, কর বা খাজনা ইত্যাদির পরিপূর্ণ সংবাদ পুস্তপালের দপ্তরে মজুত থাকিত, এ অনুমান প্রায় ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে। শুধু যে দত্ত ভূমি সম্বন্ধেই এই জরিপ করা হইত। তাহা মনে হয় না; রাজ্যের সমস্ত বাস্তু, ক্ষেত্র ও খিল এবং অন্যান্য ভূমিও এই ধরনের জরিপের অন্তৰ্গত ছিল, এই অনুমানও সহজেই করা চলে। সেন আমলের পট্টোলীগুলিতে জমি-সংক্রান্ত সংবাদ এমন সুসংবদ্ধ, সুনির্দিষ্ট ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেওয়া হইয়াছে যে, এই ধরনের জরিপের সম্ভাব্য অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করা কঠিন।