[৬ জুন, ১৮৯৬ খ্রীঃ লণ্ডন হইতে ‘ব্রহ্মবাদিন্’২ পত্রিকার জন্য লিখিত।]
‘ব্রহ্মবাদিন্’—সম্পাদক মহাশয়,
আমাদের ‘ব্রহ্মবাদিনের’ পক্ষে কর্মের আদর্শ চিরকালই থাকিবে—‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন,’ কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কখনই নয়—তথাপি কোন অকপট কর্মীই খানিকটা জানাজানি এবং সমাদর লাভ না করিয়া কর্মক্ষেত্র হইতে বিদায় লইতে পারেন না।
আমাদের কার্যের আরম্ভ খুবই ভাল হইয়াছে, আর আমাদের বন্ধুগণ এই বিষয়ে যে দৃঢ় আন্তরিকতা দেখাইয়াছেন, শতমুখে তাহার প্রশংসা করিলেও পর্যাপ্ত বলা হইল বলিয়া বোধ হয় না। অকপট বিশ্বাস ও সৎ অভিসন্ধি নিশ্চয়ই জয়লাভ করিবে, আর এই দুই অস্ত্রে সজ্জিত হইয়া অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তিও নিশ্চয়ই সর্ববিঘ্ন পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে।
কপট অলৌকিক জ্ঞানাভিমানী ব্যক্তিগণ হইতে সর্বদা দূরে থাকিবে। অলৌকিক জ্ঞান হওয়া যে অসম্ভব—তাহা নয়, তবে বন্ধুগণ, তোমরা জানিবে যে, আমাদের এই জগতে যাহারা এরূপ জ্ঞানের দাবী করে, তাহাদের মধ্যে শতকরা নব্বই-জনের কাম-কাঞ্চন-যশঃস্পৃহারূপ গুপ্ত অভিসন্ধি আছে, আর বাকী দশজনের মধ্যে নয়জন লোকের দরকার দার্শনিকগণের অপেক্ষা চিকিৎসকগণের সতর্ক মনোযোগ।
আমাদের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন—চরিত্রগঠন, যাহাকে ‘প্রতিষ্ঠিত প্রজ্ঞা’ বলা যায়। ইহা যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির আবশ্যক, ব্যক্তির সমষ্টি সমাজেও তদ্রূপ। প্রত্যেক নূতন উদ্যম, এমন কি ধর্মপ্রচারের নূতন উদ্যমও জগৎ সন্দেহের চক্ষে দেখে বলিয়া বিরক্ত হইও না। তাহাদের অপরাধ কি? কতবার কত লোকে তাহাদিগকে প্রতারিত করিয়াছে! যতই সংসার কোন নূতন সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখে, অথবা উহার প্রতি কতকটা বৈরভাবাপন্ন হয়, ততই উহার পক্ষে মঙ্গল। যদি এই সম্প্রদায়ে প্রচারের উপযুক্ত কোন সত্য থাকে, যদি বাস্তবিক কোন অভাব-মোচনের জন্যই উহার জন্ম হইয়া থাকে, তবে শীঘ্রই নিন্দা প্রশংসায় এবং ঘৃণা প্রীতিতে পরিণত হয়। আজকাল লোকে ধর্মকে কোনরূপ সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-সাধনের উপায়রূপে গ্রহণ করে। এই বিষয়ে সাবধান থাকিবে। ধর্মের উদ্দেশ্য ধর্ম। যে ধর্ম কেবল সাংসারিক সুখের উপায়স্বরূপ, তাহা আর যাহাই হউক, ধর্ম নয়। আর অবাধে ইন্দিয়সুখভোগ ব্যতীত মনুষ্যজীবনের অপর কোন উদ্দেশ্য নাই—এ-কথা বলিলে ঈশ্বরের এবং মানুষের বিরুদ্ধে ঘোরতর অপরাধ করা হয়।
যে ব্যক্তিতে সত্য, পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থপরতা বর্তমান, স্বর্গে মর্ত্যে বা পাতালে এমন কোন শক্তি নাই যে, তাঁহাকে চাপিয়া মারিতে পারে। এইগুলি সম্বল থাকিলে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড বিপক্ষে দাঁড়াইলেও একলা এক ব্যক্তি সেই প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হইতে পারে।
সর্বোপরি আপস করিতে যাওয়া বিষয়ে সাবধান! আমার এই কথা বলিবার উদ্দেশ্য ইহা নয় যে, কাহারও সহিত বিরোধ করিতে হইবে; কিন্তু সুখেই হউক, দুঃখেই হউক, নিজের ভাব সর্বদা ধরিয়া থাকিতে হইবে, দল বাড়াইবার উদ্দেশ্যে তোমার মতগুলি অপরের নানারূপ খেয়ালের অনুযায়ী করিতে যাইও না। তোমার আত্মাই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের আশ্রয়, তোমার আবার অন্য আশ্রয়ের প্রয়োজন কি? সহিষ্ণুতা, প্রীতি ও দৃঢ়তার সহিত অপেক্ষা কর; যদি এখন কোন সাহায্যকারী না পাও, সময়ে পাইবে। তাড়াতাড়ির আবশ্যকতা কি? সমস্ত মহৎ কার্যেরই আরম্ভের সময় উহার প্রাণশক্তির অস্তিত্বই যেন ধরিতে পারা যায় না।
কে ভাবিয়াছিল যে, সুদূর বঙ্গীয় পল্লীগ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণতনয়ের জীবন ও উপদেশ এই কয়েক বৎসরের মধ্যে এমন দূরদেশে গিয়া পৌঁছিবে, যাহা আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্নেও কখনও ভাবেন নাই? আমি ভগবান্ রামকৃষ্ণের কথা বলিতেছি। শুনিয়াছ কি, অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার ‘নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী’ পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছেন এবং যদি উপযুক্ত উপাদান পান, তবে আনন্দের সহিত তাঁহার জীবনী ও উপদেশের আরও বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ-সম্বলিত একখানি গ্রন্থ লিখিতে প্রস্তুত আছেন! অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার একজন অসাধারণ ব্যক্তি। আমি কয়েক দিন পূর্বে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। প্রকৃতপক্ষে বলা উচিত, আমি তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করিতে গিয়াছিলাম। কারণ যে-কোন ব্যক্তি শ্রীরামকৃষ্ণকে ভালবাসেন—তিনি নারীই হউন, পুরুষই হউন, তিনি যে-কোন সম্প্রদায়-মত বা জাতিভুক্ত হউন না কেন—তাঁহাকে দর্শন করিতে যাওয়া আমি তীর্থযাত্রাতুল্য জ্ঞান করি। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’—আমার ভক্তেরা যাহারা ভক্ত, তাহারা আমার সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত। ইহা কি সত্য নয়?
কেশবচন্দ্র সেনের জীবনে হঠাৎ গুরুতর পরিবর্তন কি শক্তিতে সাধিত হইল, অধ্যাপক প্রথমে তাহাই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হন; তারপর হইতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও উপদেশের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হন এবং ঐগুলির চর্চা আরম্ভ করেন। আমি বলিলাম, ‘অধ্যাপক মহাশয়, আজকাল সহস্র সহস্র লোকে রামকৃষ্ণের পূজা করিতেছে।’ অধ্যাপক বলিলেন, ‘এরূপ ব্যক্তিকে লোকে পূজা করিবে না তো কাহাকে পূজা করিবে?’ অধ্যাপক যেন সহৃদয়তার মূর্তিবিশেষ। তিনি স্টার্ডি সাহেব ও আমাকে তাঁহার সহিত মধ্যাহ্ন-আহারের নিমন্ত্রণ করিলেন এবং আমাদিগকে অক্সফোর্ডের কতকগুলি কলেজ ও বোডলিয়ান পুস্তকাগার (Bodleian Library) দেখাইলেন। রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত আমাদিগকে পৌঁছাইয়া দিতে আসিলেন, আর আমাদিগকে এত যত্ন কেন করিতেছেন, জিজ্ঞাসা করিলে বলেন, ‘রামকৃষ্ণ পরমহংসের একজন শিষ্যের সহিত তো আর প্রতিদিন সাক্ষাৎ হয় না।’
তাঁহাকে দেখিয়া বাস্তবিক আমি নূতন দৃষ্টিলাভ করিয়াছি। সুন্দর-উদ্যানসমন্বিত সেই মনোরম ক্ষুদ্র গৃহ, সপ্ততিবর্ষবয়ঃক্রম সত্ত্বেও তাঁহার স্থির প্রসন্ন আনন, বালসুলভ মসৃণ ললাট, রজতশুভ্র কেশ, ঋষি-হৃদয়ের কোন নিভৃত অন্তরালে গভীর আধ্যাত্মিকতার খনির অস্তিত্বসূচক সেই মুখের প্রত্যেক রেখা, তাঁহার সমগ্র জীবনের (যে-জীবন প্রাচীন ভারতের ঋষিগণের চিন্তারাশির প্রতি সহানুভূতি-আকর্ষণ, উহার প্রতি লোকের বিরোধ ও ঘৃণা-অপনয়ন এবং অবশেষে শ্রদ্ধা-উৎপাদনরূপ দীর্ঘকালব্যাপী দুঃসাধ্য কার্যে ব্যাপৃত ছিল) সঙ্গিনী সেই উচ্চাশয়া সহধর্মিণী, তাঁহার সেই উদ্যানের তরুরাজি, পুষ্পনিচয়, তথাকার নিস্তব্ধ ভাব ও নির্মল আকাশ—এই সমুদয় মিলিয়া কল্পনায় আমাকে প্রাচীন ভারতের সেই গৌরবময় যুগে লইয়া গেলে—যখন আমাদের ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিগণ, এবং উচ্চাশয় বাণপ্রস্থিগণ বাস করিতেন—সেই অরুন্ধতী ও বলিষ্ঠাদির যুগে।
আমি তাঁহাকে ভাষাতত্ত্ববিদ্ বা পণ্ডিতরূপে দেখি নাই, দেখিলাম যেন কোন আত্মা দিন দিন ব্রহ্মের সহিত নিজের একত্ব অনুভব করিতেছে, যেন কোন হৃদয় অনন্তের সহিত এক হইবার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রসারিত হইতেছে। যেখানে অপরে শুষ্ক অবান্তর বিচাররূপ মরুতে দিশাহারা, সেখানে তিনি এক জীবনপ্রদ উৎসের সন্ধান পাইয়াছেন। তাঁহার হৃৎস্পন্দন প্রকৃতই উপনিষদের সেই ছন্দে ধ্বনিত হইতেছে, ‘তমেবৈকং জানথ আত্মানম্ অন্যা বাচো বিমুঞ্চথ’—সেই এক আত্মাকে জান, অন্য কথা ত্যাগ কর।
যদিও তিনি একজন পৃথিবী-আলোড়নকারী পণ্ডিত ও দার্শনিক, তথাপি তাঁহার পাণ্ডিত্য ও দর্শন তাঁহাকে ক্রমশঃ উচ্চ হইতে উচ্চে লইয়া গিয়া চৈতন্যসত্তার সাক্ষাৎকারে সমর্থ করিয়াছে, তাঁহার অপরা বিদ্যা বাস্তবিকই তাঁহাকে পরাবিদ্যালাভে সহায়তা করিয়াছে। ইহাই প্রকৃত বিদ্যা—বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্। জ্ঞান যদি আমাদিগকে সেই পরাৎপরের নিকট না লইয়া যায়, তবে জ্ঞানের সার্থকতা কি?
আর ভারতের উপর তাঁহার কী অনুরাগ! যদি আমার সে অনুরাগের শতাংশের একাংশও থাকিত, তাহা হইলে আমি ধন্য হইতাম। এই অসাধারণ মনস্বী পঞ্চাশ বা ততোধিক বৎসর ভারতীয় চিন্তারাজ্যে বাস ও বিচরণ করিয়াছেন, পরম আগ্রহ ও হৃদয়ের ভালবাসার সহিত সংস্কৃত সাহিত্যরূপ অনন্ত অরণ্যের আলো ও ছায়ার বিনিময় পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন, শেষে ঐ-সকল তাঁহার হৃদয়ে বসিয়া গিয়াছে এবং তাঁহার সমগ্র সত্তায় উহার রঙ ধরাইয়া দিয়াছে।
ম্যাক্সমূলার একজন ঘোর বৈদান্তিক। তিনি বাস্তবিকই বেদান্ত-রূপ রাগিণীর নানা স্বর-বিস্তারের ভিতর উহার প্রধান সুরটিকে ধরিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে, বেদান্ত সেই একমাত্র আলোক, যাহা পৃথিবীর সকল সম্প্রদায় ও মতকে আলোকিত করিতেছে, উহা সেই এক তত্ত্ব, সমুদয় ধর্মই যাহার কার্যে পরিণত রূপমাত্র। আর রামকৃষ্ণ পরমহংস কি ছিলেন? তিনি এই প্রাচীন তত্ত্বের প্রত্যক্ষ উদাহরণ, প্রাচীন ভারতের সাকার বিগ্রহ ও ভবিষ্যৎ ভারতের পূর্বাভাস—তাঁহার ভিতর দিয়াই সকল জাতি আধ্যাত্মিক আলোক লাভ করিবে। চলিত কথায় আছে, জহুরীই জহর চেনে। তাই বলি, ইহা বিস্ময়ের বিষয় না যে, ভারতীয় চিন্তাগগনে কোন নূতন নক্ষত্র উদিত হইলেই, ভারতবাসিগণ উহার মহত্ত্ব বুঝিবার পূর্বেই এই পাশ্চাত্য ঋষি উহার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং উহার বিষয়ে বিশেষ আলোচনা করেন!
আমি তাঁহাকে বলিয়াছিলাম, ‘আপনি কবে ভারতে আসিতেছেন? ভারতবাসীর পূর্বপুরুষগণের চিন্তারাশি আপনি যথার্থভাবে লোকের সমক্ষে প্রকাশ করিয়াছেন, সুতরাং ভারতের সকলেই আপনার শুভাগমনে আনন্দিত হইবে।’ বৃদ্ধ ঋষির মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, তাঁহার নয়নে এক বিন্দু অশ্রু যেন দেখা দিল, মাথা একটু নাড়িয়া ধীরে ধীরে এই কথাগুলি বলিলেন, ‘তাহা হইলে আমি আর ফিরিব না; আপনাদিগকে সেখানেই আমাকে চিতায় সমর্পণ করিতে হইবে।’ আর অধিক প্রশ্ন মানব-হৃদয়ের পবিত্র রহস্যপূর্ণ রাজ্যে অনধিকার প্রবেশের ন্যায় বোধ হইল। কে জানে, হয়তো কবি যাহা বলিয়াছিলেন, ইহা তাহাই—
‘তচ্চেতসা স্মরতি নূনমবোধপূর্বম্ ৷
ভাবস্থিরানি জননান্তরসৌহৃদানি ৷৷’
তিনি নিশ্চয়ই অজ্ঞাতসারে হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ পূর্বজন্মের বন্ধুত্বের কথা ভাবিতেছেন। তাঁহার জীবন জগতের পক্ষে পরম মঙ্গলস্বরূপ হইয়াছে। ঈশ্বর করুন, যেন বর্তমান শরীর ত্যাগ করিবার পূর্বে তাঁহার জীবনে বহু বর্ষ কাটিয়া যায়।