বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এরকম একটা গল্প শুনতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। বাড়ি ফেরার সময় অর্জুনের মনে হচ্ছিল একথা। বৃদ্ধ বিজনবিহারী পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও সোনার গয়নার লোভে লোভী হয়ে উঠেছেন, এটা তার ভাল লাগছিল না। সেই তুলনায় ওঁর বাবা পবনবিহারী অনেক বেশি নিলোভ মানুষ ছিলেন। তখন ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়নি। তিনি স্বচ্ছন্দে গয়নাগুলো তুলে নিয়ে আসতে পারতেন। অর্জুনের মনে হচ্ছিল এই ব্যাপারটায় কোনও রহস্য নেই। একজন মানুষের লোভ মেটানোর জন্য সে এগিয়ে যেতে পারে না। তিনদিন পরে একথাই বিজনবিহারীবাবুকে জানিয়ে দেবে ঠিক করল।
কিন্তু দুদিন বাদে ভোর চারটের সময় অর্জুনের ঘুম ভেঙে গেল তারস্বরে টেলিফোন বাজার শব্দে। এই সময় খুব বিপদে না পড়লে কেউ কাউকে টেলিফোন করে না। সে বিছানা থেকে উঠে ঘুম-ঘুম অবস্থাতেই রিসিভার তুলল, হ্যালো।
অর্জুন বলছ? খুব চাপা গলায় প্রশ্ন এল।
হ্যাঁ।
আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে অর্জুন। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। ভদ্রলোকের গলা কাঁপছিল।
আপনি কে কথা বলছেন?
আমি? ও, আমি বিজনবিহারী ঘোষ।
ও। কী হয়েছে আপনার?
কাল রাত্রে চিঠিটা চুরি হয়ে গিয়েছে।
চুরি হয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ। গতকাল দুপুরেও আমি ব্যাগ খুলে ওটাকে দেখেছিলাম। ঠিকই ছিল। আধ ঘণ্টা আগে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম আসছে না দেখে এটা-ওটা হাতড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ কী খেয়াল হতে ব্যাগটা খুলে দেখি ওর মধ্যে চিঠিটা নেই। বিজনবিহারীবাবুর গলায় প্রচণ্ড হতাশা।
আপনি অন্য কোথাও রাখেননি তো?
অন্য কোথাও? অসম্ভব। কেউ নামিয়ে না নিলে আমি বিছানা থেকে নামতেই পারি না। আমি নিজে কোথায় ওটা রাখব? তা ছাড়া আমার পরিষ্কার মনে আছে আমি কাল ব্যাগের ভেতর খামটাকে রেখে দিয়েছিলাম। অর্জুন, প্লিজ, তুমি আমাকে বাঁচাও। বৃদ্ধ চাপা গলায় বললেন।
আপনি বলছেন নিজে খাট থেকে নামতে পারেন না। তা হলে যে চিঠিটা সরাবে সে আপনার সামনেই আসবে। তা ছাড়া আপনার কাজের লোক সবসময় থাকে। সে বিশ্বাসী?
তাকে আমি নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি। বিজনবিহারীবাবু বললেন।
বেশ। এখন তো যাওয়ার কোনও কথাই ওঠে না। আমি সকালবেলায় একবার যাব।
কিন্তু তুমি কীভাবে আসবে?
বুঝতে পারলাম না।
আমি যে তোমাকে টেলিফোন করেছি, তা যেন আমার ছেলে জানতে না পারে। তুমি অন্য কোনও একটা অছিলা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়ো। প্লিজ। লাইন কেটে দিলেন ভদ্রলোক।
এত ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে আবার ঘুমের আশা করা যায় না। অর্জুন খানিকটা অপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ল। আজ বৃষ্টি নেই। আকাশ পরিষ্কার। জলপাইগুড়ি শহরে প্রাতঃভ্রমণকারীর সংখ্যা কম নয়। কদমতলার মোড়ে হারুদার চায়ের দোকানে বসে চা খেতে-খেতে সে এদের দেখতে লাগল।
হঠাৎ তার মনে হল বিজনবিহারী নিজেই কোনও রহস্য তৈরি করছেন না তো! হয়তো চিঠি ওঁর কাছেই আছে, অর্জুনকে জড়াবার জন্য এই গল্প শোনালেন। ওঁর মতো মানুষ সারাক্ষণ ব্যাগ নিয়ে শুয়ে থাকলে কারও ক্ষমতা নেই চিঠিটাকে চুরি করা। তা ছাড়া চিঠি চুরি যাবে তখনই, যখন কেউ জানতে পারবে ওটার ভেতর কী লেখা আছে। বিজনবিহারীবাবুর কথা অনুযায়ী যিনি লিখেছিলেন, যাঁকে লিখেছিলেন, তাঁরা দুজনেই মৃত। একমাত্র বিজনবিহারীবাবুই ব্যাপারটা জানেন। অতএব অন্য কেউ ওটা চুরি করতে যাবে কেন?
অর্জুন এসব কথা ভাবলেও যেটা উড়িয়ে দিতে পারছিল না সেটা হল বৃদ্ধের গলার স্বর। খুব বড় অভিনেতা না হলে ওই অসহায় অবস্থা গলায় ফোটানো সম্ভব হবে না।
এখন আলো ফুটে গিয়েছে, কিন্তু কারও বাড়িতে যাওয়ার সময় এটা নয়। অর্জুন দেখল জগুদা হেঁটে চলেছেন দ্রুত পায়ে। সে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে ওঁর সামনে দাঁড়াতেই জগুদা খুব অবাক, আরে তুমি! সাতসকালে এখানে কী করছ? তোমার তো মর্নিং-ওয়াকের অভ্যেস নেই।
ঘুম আসছিল না, তাই। কেমন আছেন?
আছি। আর তো বেশিদিন চাকরি নেই। তার মানে জীবনটাও বেশিদিন নেই।
যাঃ। এসব কী বলছেন?
না হে, এটাই সত্যি। কেটেস কীরকম পাচ্ছ?
মোটামুটি। আচ্ছা জগুদা, বিজনবিহারী ঘোষ সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
বিজনবিহারী? এক্স টি-প্লান্টার?
হ্যাঁ। শিল্পসমিতি পাড়ায় থাকেন।
হয়ে গেল বেড়ানো। হারুদা, দু কাপ চা। জগুদা হাঁক দিলেন। আমি এইমাত্র খেয়েছি।
আহা, ভোরে দু কাপ চা আরামসে খাওয়া যায়। যে-নামটা তুমি করলে, সেই নাম কেউ ভোরবেলায় উচ্চারণ করত না। বলত, দিনটা খারাপ যাবে। প্রচণ্ড কিপটে ছিলেন।
উনি তো এখনও বেঁচে আছেন?
আছেন, তবে শুনেছি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ওঁর সম্পর্কে কী জানতে চাও?
ওঁরা তো পূর্ববাংলা থেকে এসে চা বাগান তৈরি করেছেন?
জলপাইগুড়ির বেশিরভাগ মানুষই পূর্ববাংলা থেকে এসেছেন। একময় রাজশাহি, রংপুর জেলার মতো জলপাইগুড়িকেও পূর্ববাংলার সঙ্গে ধরা হত। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে হাম নামে এক সাহেব তিস্তা নদীর ধারে গাজোলডোবা বলে একটা জায়গায় প্রথম চা বাগান পত্তন করেন। প্রথম দিকে ইংরেজরা এই জেলার সব ভাল-ভাল জমি দখল করে নিয়ে একটার পর একটা চা বাগান তৈরি করেছেন। বাঙালিরা এল অনেক পরে। তবে রহিম বক্স জলঢাকার কাছে প্রথম বাঙালি হিসেবে যে চা বাগান পত্তন করেন, সেটা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। ভদ্রলোকের আদি বাড়ি ছিল নোয়াখালি জেলায়। কাছাকাছি সময়ে আর-একটি নাম পাওয়া যায়, তিনি বিহারীলাল গাঙ্গুলি। প্রথম যৌথ কোম্পানি হল মোগলকাটা চা বাগান। তবে রহিম বক্স, গোপাল ঘোষ, জয়চন্দ্র সান্যালরা যে কাজ শুরু করেছিলেন তাকে সার্থক করে তোলেন তারিণীপ্রসাদ রায় এবং মৌলবী মোশারফ হোসেন। এই বিজনবিহারীর বাবা গগনবিহারীও সেই সময় চা-শিল্পে যুক্ত হন। ওঁদের একাধিক বাগান ছিল। গগনবিহারী মারা যাওয়ার পর বিজনবিহারী হাল ধরেন। হারুদার দেওয়া চায়ে চুমুক দিলেন জগুদা, তখন জলপাইগুড়ি শহরের রমরমা অবস্থা। শিল্পপতিরা যেমন ভাল ব্যবসা বুঝতেন তেমনই শহরের মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে আসতেন। খেলাধুলো এবং সংস্কৃতি জগতে এঁদের অবদান ভোলার নয়। বিশেষ করে সত্যেন্দ্রপ্রসাদ রায় এবং বীরেন ঘোষ মশাইয়ের তো তুলনা হয় না। জলপাইগুড়ির প্রাণ। ছিলেন এঁরা। কিন্তু বিজনবিহারী শহরের জন্য কিছুই করেননি। নিতান্ত বাধ্য না হলে তিনি কোনও ভাল কাজের জন্য একটি পয়সাও খরচ করতেন না। ঠিক কিপটে বললে কম হবে, তিনি ছিলেন সঙ্কীর্ণমনা। আর ওঁর ছেলেরা তো বাগান তুলেই দিল। যা ছিল সব উড়িয়ে এখন কলসি গড়িয়ে খাচ্ছে। চা শেষ করে জগুদা যেন খেয়াল করলেন, তা এত লোক থাকতে তুমি হঠাৎ এই মানুষটির খবর নিচ্ছ কেন? কিছু হয়েছে?
অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। উনি একটা ব্যাপারে সাহায্য চাইছেন।
আইনসম্মত হলে কররা। তবে নিজের পারিশ্রমিক বুঝে নেবে।
অর্জুন হাসল। এখনও সে এই ব্যাপারটায় পেশাদার হতে পারেনি। অনেকেই কেস নিয়ে আসে। কাজটা হয়ে গেলে প্রশ্ন করে, কত দিতে হবে? অর্জুন, যা বলা উচিত তার চেয়ে অনেক কম বলে চক্ষুলজ্জার কারণে। আর প্রচণ্ড খাটুনির পরে যদি কাজটার সুরাহা না হয়, তা হলে পয়সা চাওয়াও যায় না, খাটুনিটাই বৃথা যায়। কিন্তু অন্য বৃত্তির মানুষ তা সত্ত্বেও নিজের দক্ষিণা নেন। মামলায় হেরে গেলেও উকিলকে টাকা দিতে হয়, ডাক্তার রোগ সারাতে
পারলেও ফি নিতে ছাড়েন না। তা ছাড়া আর-একটা সমস্যা আছে। তাকে এক-একসময় এক-একরকম কাজ করতে হয়। সব কাজের গুরুত্ব সমান নয়। তাই সবার কাছে এক দবে দক্ষিণা চাওযাও যায় না। তবে জগুদা যখন সতর্ক করলেন, তখন কথাটাকে সে নিশ্চয়ই মনে রাখবে। এবার আর বোকামি নয়।
সকাল নটা নাগাদ লাল বাইক চালিয়ে অর্জুন বিজনবিহারীবাবুর বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। দোতলায় চোখ তুলতেই সে লক্ষ করল, একটি আঠারো-উনিশ বছরেব মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছে। মেয়েটি বেশ ফরসা এবং ফরসা মেয়েদের দূর থেকে সুন্দরী বলেই মনে হয়। মেয়েটি নিশ্চয়ই বিজনবিহারীবাবুর নাতনি। সে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ওপর থেকে মেয়েটি সামান্য ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল,আপনি কাকে চান?
বিজনবিহারীবাবু আছেন?
উনি এখন বিশ্রাম করছেন। মেয়েটির মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল অর্জুন। মুখে ব্ৰনর দাগ থাকলেও দেখতে ভালই। অর্জুন বলল, আমার একটু দরকার ছিল।
আপনি ওখানে দাঁড়ান। মেয়েটি সরে গেল। অর্জুন সেই ভৃত্যটিকে কোথাও দেখতে পেল না। সকাল নটায় কেউ বিশ্রাম করছে বলে দেখা করবে না, কেউ শুনেছে কখনও? বিজনবিহারীবাবু বলেছিলেন যে, ওঁর সঙ্গে পরিচয় আছে অথবা উনি যে আসতে বলেছেন তা যেন কেউ জানতে না পারে।
কাকে চাইছেন ভাই?
প্রশ্ন শুনে অর্জুন দেখল মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক নেমে এসেছেন। এই সকালেও ওঁর পরনে পাটভাঙা পাজামা-পাঞ্জাবি। চেহারায় বিজনবিহারীবাবুর আদল আছে।
আমার নাম অর্জুন। আমি বিজনবিহারীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
প্রয়োজনটা কী জানতে পারি?
আপনি?
আমি ওঁর ছেলে। এই শহরে তো সবাই আমাদের চেনে? আপনি এখানে থাকেন না?
থাকি। কিন্তু চেনার সৌভাগ্য হয়নি।
আপনি কী করেন?
আমার কাজ সত্য-অনুসন্ধান করা। আমাকেও এই শহরে সবাই জানে।
ওহো। হ্যাঁ। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। জলপাইগুড়ির মতো ছোট্ট শহরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব বড় ধরনের। আসুন এই ঘরে, কথা বলি। আমি গগনবিহারী ঘোষ। বলতে বলতে পাশের একটি ঘরের দরজা খুলে ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
একটা শ্বেতপাথরের গোল টেবিল, চারপাশে চারটে চেয়ার। গগনবিহারী ইঙ্গিত করতেই অর্জুন চেশর টেনে বসল। গগনবিহারী বসে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী?
বাংলাদেশের ঢাকা শহরের একজন বিখ্যাত ব্যারিস্টার আমার ওপর ভরসা করছেন। তিনি কালীগঞ্জের নুটুবিহারী ঘোমশাই-এর যেসব বংশধর জলপাইগুড়িতে আছেন তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। পুলিশের মাধ্যমে খোঁজখবর নিতে চান না তিনি। নুটুবিহারী ঘোষের ছেলের নাম পবনবিহারী। তাঁর খোঁজ নিতে আমি আপনাদের কথা জানতে পারলাম। আপনার বাবা যখন এখনও জীবিত, তাই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আমি এসেছি। অর্জুন বেশ গুছিয়ে কথাগুলো বলল।
গগনবিহারীর মুখ-চোখ বদলে গেল। কয়েক মুহূর্তর জন্য বিস্ময় ফুটে উঠলেও নিজেকে ঠিক সামলে নিলেন তিনি, কী ব্যাপারে খোঁজখবর, বলুন তো?
বিশদ আমিও জানি না। উনি আমাকে লিখেছেন যে, লক্ষ লক্ষ টাকার বিষয়সম্পত্তির সুষ্ঠু ভাগ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে নুটুবিহারীর তরফের বংশধরদের অবস্থান জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমার নাম তিনি এক পরিচিতের মুখে শুনেছেন বলে অনুরোধটা করেছেন।
লক্ষ-লক্ষ টাকার বিষয়সম্পত্তি? বাংলাদেশে। ওসব তো এনিমিজ প্রপার্টি!
বোধহয়, না। আপনাদের আত্মীয়রা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসেনি অথবা সেসব সম্পত্তি জবরদখলও হয়ে যায়নি। অবশ্য আমার পক্ষেও এখান থেকে কিছু বলা সম্ভব নয়।
উনি কি আমাদের যেতে লিখেছেন? না। এখনও লেখেননি।
আপনার কি মনে হয় আমরা ওই সম্পত্তির ভাগ পাব?
সেরকমই তো ইঙ্গিত দেখছি।
কদিন থেকেই আমার ডান চোখটা নাচছিল। আসুন, আমার সঙ্গে ওপরে আসুন। বাবা তো হাঁটতে পারেন না। ওপরেই আছেন। গগনবিহারীর ভাবভঙ্গি একদম বদলে গেল। অর্জুনকে নিয়ে তিনি ওপরে উঠতেই মেয়েটিকে দেখা গেল। বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে বই পড়ছে। গগনবিহারী হাসিমুখে বললেন, টুকু, একে চিনিস? বিখ্যাত গোয়েন্দা। অর্জুন!
মেয়েটি উঠে দাঁড়াল, ও। আপনার কথা আমার বন্ধুরা খুব বলে। আপনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন না? একটা লাইটারের রহস্য সমাধান করেছিলেন?
ওই আর কি!
গগনবিহারী বললেন, বাঃ, স্টে ঘুরে আসা হয়ে গেছে? বাংলাদেশ তো নস্যি। আসুন, বাবা ওই ঘরে আছেন। বাবা, আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।
গগনবিহারী এগিয়ে যেতেই অর্জুন মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটির মুখ আচমকা পালটে গেল। গম্ভীর হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল সে।
বিজনবিহারীবাবু সত্যিকারের অভিনেতা। এমন মুখে তাকালেন, যেন এর আগে তিনি কখনও অর্জুনকে দেখেছেন বলে মনে হল না। বিছানার মাঝখানে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। বললেন, কী ব্যাপার?
গগনবিহারী বললেন, বাংলাদেশের বিষয়সম্পত্তি নিয়ে কিছু কথা বলতে এসেছেন। ওখানে নাকি লক্ষ লক্ষ টাকার প্রপার্টি পড়ে আছে, যার একটা অংশ আমাদেরও।
অর্জুন হাত তুলল, আমি কিন্তু এ কথা বলিনি। আমাকে জানানো হয়েছে। যে, ওই প্রপার্টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায় আপনাদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
ইনি কে? বিজনবিহারী প্রশ্নটা করতেই অর্জুনের মনে হল চিঠি চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা বানানো।
গগনবিহারী বললেন, এঁর নাম অর্জুন। এই শহরের একমাত্র প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। খুব নাম করেছেন। স্টেসেও গিয়েছেন। সবাই এঁকে চেনে।
বয়স দেখছি খুবই অল্প। তুমি বলছি, বোসো।
অর্জুন চেয়ারে বসল। এই সময় চাকরটি এক গ্লাস শরবত ট্রেতে নিয়ে ঢুকল। অর্জুনের দিকে তাকাতেই তার মুখে চেনা ছাপ ফুটে উঠল। অর্জুন মুখ ঘুরিয়ে নিতেই সে ট্রে বিছানায় বিজনবিহারীবাবুর সামনে নামিয়ে রেখে ঘর থেকে চলে গেল।
বিজনবিহারীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
আপনাদের কোনও আত্মীয়স্বজন এখনও বাংলাদেশে আছেন?
হ্যাঁ। আমার ঠাকুদার ভাইয়েরা আছেন বলে জানি।
শেষ কবে আপনি ওখানে গিয়েছেন?
ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর যাইনি। তাও ষাট বছর হয়ে গেল।
ওঁদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?
না। তবে আমার এক সম্পর্কিত ভাই বছর কুড়ি আগে এসেছিল অর্থসাহায্য নিতে, আমি দিইনি। একরাত ছিল সে। অবস্থা খারাপ না হলে কেউ সাহায্য চাইতে এতদূরে আসে না।
চা ব্যবসা আপনার বাবা শুরু করেছিলেন?
হ্যাঁ।
তিনি টাকা পেলেন কোথায়?
ঠাকুদার কাছ থেকে পেয়েছেন।
আপনাদের তো যৌথ পরিবার ছিল। ঠাকুর্দার অর্থে তো তাঁর ভাই দাবি করতে পারেন। কখনও মরেননি?
হ্যাঁ। করেছিলেন। বাবা সেসব পাইপয়সায় শোধ করে গিয়েছিলেন।
ও। তা আপনি এখনকার কোনও আত্মীয়ের নাম মনে করতে পারেন না, যাঁরা ওখানে থাকেন? একটু ভেবে বলুন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
ওই তো, যে ছেলেটি এসেছিল সাহায্য চাইতে, তার নাম মনে আছে। বিমানবিহারী। অবশ্য এখন তার বয়স আমার ছেলের সমান হবে।
আপনার বাবার নাম পবনবিহারী। তাঁর কয় ছেলে?
আমিই একমাত্র সন্তান।
আপনার ছেলে-মেয়ে?
দুজন ছিল। এখন একজন বলেই মনে করতে পারেন।
আর-একজন কি মারা গিয়েছেন?
না, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।
তিনি কোথায় আছেন?
আমি খবর রাখি না।
আপনার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে..।
আমি একটা উইল করেছিলাম কয়েক বছর আগে, তাতে তার নাম নেই।
গগনবিহারী মনোযোগ দিয়ে এসব কথা শুনছিলেন, হঠাৎ বললেন, অবশ্য দাদাকে বাবা এখনও আইনসম্মতভাবে ত্যাগ করেননি। আমি বলছি আদালতে গিয়ে …।
বিজনবিহারী মাথা নাড়লেন, তার কোনও প্রয়োজন হয় না। উইলে আমি যার নাম লিখব, সে-ই বিষয়সম্পত্তি পাবে। আর বিষয় বলতে রেখেছই বা
কী! সবই তো উড়িয়ে দিয়েছ।
অর্জুনের মনে হল, গগনবিহারী ইশারা করলেন এ-বিষয়ে কথা না বলতে। তিনি অর্জুনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে ওঁকে ভাল করে দেখার জন্য মুখ ফেরাতেই তিনি বললেন, আপনি বসুন, আমি একটু আসছি।
গগনবিহারীর চলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক। বিশেষ করে চিঠি চুরির সঙ্গে উনি যদি যুক্ত থাকেন তা হলে কখনওই অর্জুনকে একা তাঁর বাবার সঙ্গে রেখে যাবেন না। কথাবার্তা যা হচ্ছে, শুনতে চাইবেন। তিনি চলে গেলে অর্জুন বলল, আমার পক্ষে এই অভিনয় করা সম্ভব নয়।
আমার জন্য করো ভাই। এই বাড়িতে শত্ৰুবেষ্টিত হয়ে আছি।
শত্রু? এই ছেলেকেই তো সব কিছু দিয়ে যাচ্ছেন।
আমি এখনও যাচ্ছি না। যাওয়ার দেরি আছে অনেক। হ্যাঁ, একটা উইল করেছিলাম, এবার সেটাকেও পালটাতে চাই। কিন্তু চিঠিটা হাতছাড়া হওয়ার পর আমার মন ভেঙে গেছে। কুড়ি লক্ষ টাকার সম্পত্তি মাটির তলায় পড়ে আছে, আর এই হতভাগা সেগুলো ঠিক তুলে আনবে। বিজনবিহারী ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন।
আশ্চর্য! আপনি নিজে যদি ওগুলো পেতেন তা হলে পরে আপনার ছেলেই মালিক হত!
সে আমি ভেবে দেখতাম। এখন ও তো সব জেনে গেল …!
আপনি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছেন চিঠির কথা?
হ্যাঁ। বলেছিলাম আমার ব্যাগ থেকে একটা কাগজ খোয়া গিয়েছে। সে জানে কি না? বলল, আমার ব্যাগে এই জীবনে হাত দেয়নি।
এ-ঘরে আর কে-কে আসে?
পুত্রবধূ আসেন না। শ্বশুরের প্রতি তাঁর কোনও শ্রদ্ধাভক্তি নেই। টুকু, আমার নাতনি, আসে। সে একটি ছেলেকে পছন্দ করে। ছেলেটিকে আমি দেখিনি। তার মা বাবা ব্যাপারটা জানেন না। জানলে রেগে যাবেন। সেইজন্যই টুকু আমার সাহায্য চায়। স্বার্থ নিয়েই আসে।
ছেলেটি কী করে?
কদমতলায় একটা সাইকেল রিপেয়ারিংয়ের দোকান আছে। নাম কাজল। বলতে বলতে সচকিত হলেন, ওঃ, তুমি বড় আজেবাজে কথা বলছ! চিঠি চুরির সঙ্গে কাজলের কী সম্পর্ক?
আমার মনে হচ্ছে আপনার চিঠি চুরি যায়নি।
তার মানে? এবার যেভাবে চমকালেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে বিজনবিহারী অভিনয় করছেন না, আমি তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে এসব বলছি?
চিঠিটা যদি সত্যি চুরি গিয়ে থাকে, তা হলে আপনার বাড়ির সবাইকে আমার জেরা করা দরকার। অথচ আপনি চাইছেন ব্যাপারটা গোপনে থাকুক। এক্ষেত্রে আমি কী করতে পারি?
তাই বলে আমাকে বদনাম দেবে? প্রশ্ন করামাত্র বিজনবিহারী মুখ ফিরিয়ে নিতেই অর্জুন দেখল ওঁর ছেলে ঘরে ঢুকছেন। অর্জুন বলল, আপনাকে সন্দেহ করি না, বদনাম দেওয়ার প্রশ্ন নেই। আপনি প্রবীণ মানুষ। কিন্তু আমাকে অন্তত একটা প্রমাণ দেখান।
কী প্রমাণ দেখতে চাইছেন আপনি? এবার গগনবিহারী প্রশ্ন করতেই বিজনবিহারীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অর্জুন হাসল, আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, নুটুবিহারী ঘোষের সঙ্গে ওঁর অথবা ওঁর বাবার যে সম্পর্ক ভাল ছিল, তার কোনও প্রমাণ দিতে।
এই প্রমাণ কীভাবে দেওয়া যায়! ওঁরা তো অনেককাল মারা গিয়েছেন।
কাগজপত্র নেই? আপনাদের কিছু দান করে যাননি? আপনাদের মানে আপনার ঠাকুর্দা অথবা ওঁকে? যা থেকে বোঝা যাবে সম্পর্ক ভাল ছিল। অর্জুন বানিয়ে যাচ্ছিল প্রশ্নগুলো।
গগনবিহারী বললেন, এটা বাবা বলতে পারেন।
বিজনবিহারী ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। অর্জুনকে চাহনি দিয়ে তারিফ করলেন। তারপর বললেন, হা। চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়া ছিল। বাবা প্রতি সপ্তাহে ঠাকুদাকে চিঠি লিখতেন। উনিও সবার খোঁজ-খবর নিতেন। কিন্তু সেসব চিঠি এতই সাধারণ যে, বাবা জমিয়ে রাখার কথা ভাবেননি। আমিও না। বাবার যা কাগজপত্র, তা ওই আলমারিতে ছিল। সেদিন ভবাকে দিয়ে সব নামিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। ঠাকুদার চিঠি পেয়েছি বলে মনে হয় না।
সেটা খুব দরকার হবে। আরও ভাল কবে খুঁজে দেখুন। আজ আমি উঠি। অর্জুন উঠে দাঁড়াতেই গগনবিহারী হাঁ-হাঁ করে বাধা দিলেন, এবাড়িতে এসে একটু মিষ্টিমুখ না করে যাওয়া চলবে না। আমার মেয়ের ভাল বিয়ে হবে নাভাই।
অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি মিষ্টি একদম ভালবাসি না।
বিজনবিহারী বললেন, আমার নাতনিও মিষ্টি খেতে চায় না। তাতে তার ফিগার খারাপ হয়ে যাবে। তোমারও কি সেই এক চিন্তা?
না। অর্জুন দরজার দিকে এগোল, আবার হয়তো আপনার কাছে আসতে হবে।
বিছানায় বসেই বিজনবিহারী বললেন, ওই বিশ্রামের সময়টুকু বাদ দিয়ে এলে কথা হবে।
বারান্দায় বেরিয়ে গগনবিহারী ছাড়লেন না। এককাপ চা খেয়ে যেতেই হবে। অতএব পাশের ঘরে ঢুকতে হল অর্জুনকে। এটাই এঁদের বসার ঘর। কারণ কোনও খাট দেখা যাচ্ছে না। ঘরের মাঝখানে একটা সোফাসেট রয়েছে। অর্জুনকে বসিয়ে গগনবিহারী বেরিয়ে গেলেন। ঘরে কোনও ছবি নেই। জলপাইগুড়ির বড়লোকদের বাপ্লিতে এমনটা দেখা যায় না। আমার স্ত্রী, আরতি, একটু আগে এঁর কথা বলছিলাম অর্জুন।
অর্জুন নমস্কার করল। ভদ্রমহিলা হাতজোড় করলেন। বললেন, বসুন। কী খাবেন, চা, না কফি? আপনাদের এই শহরে ভাল কোল্ড ড্রিঙ্কস পাওয়া যায় না।
চা। অর্জুন বলতেই মহিলা বেরিয়ে গেলেন। সম্ভবত হুকুম করতে। কিন্তু অর্জুন বিস্মিত! জলপাইগুড়ি শহরের কোনও মহিলা এই সাতসকালে এত সেজেগুজে বাড়িতে বসে থাকেন বলে সে জানে না। ভদ্রমহিলা কি একাই কোথাও বের হচ্ছেন? চল্লিশের ওপর বয়স। কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত তিনি সাধারণ বাঙালি মহিলাদের থেকে নিজেকে আলাদা করে রেখেছেন।
গগনবিহারী সোফায় বসে বললেন, মুশকিল হল বাবার শরীর খারাপ হওয়ার পর থেকে সব কথা মনে থাকে না। বয়সও অনেক হল।
আরতি দেবী ফিরে এলেন। সোফায় বসে বললেন, কীরকম টাকা পাওয়া যাবে?
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কোন টাকার কথা বলছেন?
ওই যে, ও বলল বাংলাদেশে নাকি এখনও সম্পত্তির শেয়ার আছে। কথাগুলো বলতে বলতে আরতি দেবী স্বামীর দিকে তাকালেন।
অর্জুন বলল, আমি সে কথা একবারও বলিনি। সেখানে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেওয়ায় আপনাদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। কী হবে তা আমার জানা নেই।
আরতী দেবী কাঁধ নাচালেন, তাই বলুন। আমাকে এমনভাবে বলা হল। গগনবিহারী বললেন, শেয়ার না দিলে কেন খোঁজ-খবর করবে। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে একবার ঢাকায় গেলে হত!
আরতি দেবী মাথা নাড়লেন, কক্ষনো না।
না, মানে বেড়াতেও তো যাওয়া যেতে পারে।
আরতি দেবী বললেন, আমার বোনেরা ইউরোপ-আমেরিকায় বেড়াতে যায়। আমি কোথাও যেতে পারি না সেটা এক জিনিস, কিন্তু বিদেশ বলতে ঢাকায় যাচ্ছি তা আমি কাউকে বলতে পারব না। বলুন তো, ঢাকা কি একটা বেড়াতে যাওয়ার জায়গা হল?
অর্জুন বলল, আমি শুনেছি ঢাকা খুব আধুনিক শহর।
চা এল। সেটা খেয়ে অর্জুন উঠে পড়ল। ভদ্রমহিলা বারংবার অনুরোধ করলেন ওবাড়িতে যাওয়ার জন্য। বিয়ের পর জলপাইগুড়িতে এসে ভাল করে কথা বলার মানুষ পাননি তিনি। অর্জুন যখন বিলেত-আমেরিকায় গিয়েছে, তখন সেসব গল্প শোনা যেতে পারে।
গগনবাবু গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন। অর্জুন বাইক চালু করার সময় দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। বাড়ির সবাই তার সঙ্গে আলাপ করেছে। শুধু টুকু নামের মেয়েটি এড়িয়ে গেল! ওকে দেখে খুব লাজুক বলে মনে হয় না।
ব্যাপারটা নিয়ে অর্জুন মাথা ঘামানো ছেড়ে দিয়েছিল। ওর ক্রমশ বিশ্বাস হচ্ছিল, পুরো ব্যাপারটাই বিজনবিহারীবাবুর বানানো গল্প। সময় কাটাতে এমন একটা কাণ্ড তিনি করেছেন। যদিও তারপরেও কদিন হঠাৎ-হঠাৎ টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন কোনও হদিস পাওয়া গেল কি না, কিন্তু অর্জুন উৎসাহিত হয়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকেও ভাবতে হল।