কৌম শাসনযন্ত্র
কিন্তু আরম্ভের আগেও আরম্ভ আছে। পঞ্চম শতকেরও আগে, এমন কি মৌর্য কালেরও আগে প্রাচীন বাঙলার জনপদেরা সমাজবদ্ধ হইয়া বাস করিত, তাহাদের সমাজ ছিল, রাজা ছিল, রাষ্ট্রও ছিল। তাহারও আগে যখন রাজা ছিল না, কৌমসমাজ ছিল, ইতিহাসের সেই উষাকালে সেই সমাজেরও একটা শাসনপদ্ধতি ছিল। আজও তাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া লোপ পাইয়া যায় নাই। বাঙলার বিভিন্ন জেলায় সমাজের নিম্নতম স্তরে, অথবা পার্বত্য আরণ্য কোমদের মধ্যে, যেমন সাঁওতাল, গারো, রাজবংশী ইত্যাদির মধ্যে, তাহাদের পঞ্চায়েতী প্রথায়, তাহাদের দলপতি নির্বাচনে, সামাজিক দণ্ডবিধানে, নানা আচারানুষ্ঠানে, ভূমি ও শিকার স্থানের বিলি বন্দােবস্তে, উত্তরাধিকার-শাসনে এখনও সেই কৌম শাসনযন্ত্র ও পদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙলার বাহিরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেও এই ধরনের বিচিত্র কৌম শাসন-যন্ত্র ও পদ্ধতি আজও দেখিতে পাওয়া যায়, যদিও উন্নত অৰ্থনৈতিক সমাজ-পদ্ধতির ক্রমবর্ধমান চাপে আজ তাহা দ্রুত বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে। কিন্তু, স্মরণ রাখা প্রয়োজন, সুপ্রাচীন কাল হইতেই আর্য সমাজযন্ত্র ও পদ্ধতি ইহাদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হইয়াছে এবং কালে কালে ইহাদের অনেক রীতি-নিয়ম, বিন্যাস-ব্যবস্থা আত্মসাৎ করিয়া সমৃদ্ধ হইয়াছে। বাঙলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। প্রাচীন বাঙলার রাষ্ট্র-বিন্যাসের কথা বলিতে গেলে এই সব অস্পষ্ট স্বল্পজ্ঞাত কৌম শাসনযন্ত্র ও রাষ্ট্র-বিন্যাসের কথা একবার স্মরণ করিতেই হয়। কারণ, ঐতিহাসিক কালের বহুকীর্তিত এবং বহুজ্ঞাত রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্র-বিন্যাস, তথা সমাজ-বিন্যাসের বাহিরে অগণিত লোক কৌম সমাজ ও শাসন-ব্যবস্থার মধ্যে বাস করিত; আজও করে না এমন নয়। ইহাদের কথা ভুলিয়া গেলে ঐতিহাসিদের দায়িত্ব পালন করা হয় না।
বাঙলাদেশের শারীর-নৃতত্ত্বের আলোচনা কিছু কিছু হইয়াছে ও হইতেছে; কিন্তু সুপ্রাচীন কৌম সমাজ-বিন্যাসের গবেষণা বিশেষ কিছু হয় নাই বলিলেই চলে। গারো, কোচ, বহে, রাজবংশী, সাঁওতালদের সমাজশাসন সম্বন্ধে মোটামুটি তথ্য হয়তো আমাদের জানা আছে, কিন্তু হিন্দু সমাজের নিম্নতম স্তরে নানা শাসনগত সংস্কার এখনও সক্রয়; সেগুলির ঐতিহ্য-আলোচনা যথেষ্ট হয় নাই। এই সব কারণে বাঙলার সুপ্রাচীন কৌম সমাজ ও শাসন-বিন্যাস সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা কঠিন। মোটামুটি ভাবে এইটুকুই শুধু বলা চলে, আমাদের গ্রাম্য পঞ্চাযেতী শাসনযন্ত্র এই প্রাচীন কৌম সমাজের দান; পঞ্চায়েত কর্তৃক নির্বাচিত দলপতিই স্থানীয় কৌম শাসনযন্ত্রের নায়কত্ব করিতেন। মাতৃপ্রধান বা পিতৃপ্রধান কৌম ব্যবস্থানুযায়ী উত্তরাধিকার শাসন নিয়ন্ত্রিত হইত, এবং সামাজিক দণ্ডের ও নির্দেশের কর্তা ছিলেন। পঞ্চায়েতমণ্ডলী। কৌম সমাজ ও রাষ্ট্রবিন্যাসের বিবর্তন সম্বন্ধে অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি, এখানে আর তাহা পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই। শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট যে, আলেকজান্দারের ভারত-আক্রমণ ও অব্যবহিত পরবর্তী মৌর্যাধিকার কালের আগেই বাঙলাদেশে কৌমতন্ত্র নিঃসন্দেহে রাজতন্ত্রে বিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল, এবং অনুমান হয়, কিছু পরেই মৌর্য রাষ্ট্র-বিন্যাসের প্রাদেশিক রূপও এদেশে প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল।
বাঙলার এই রাজতন্ত্রের আদি পরিচয় মহাভারতের দুই একটি কাহিনীতে এবং সিংহলী দীপবংশ-মহাবংশ পুরাণের বিজয়সিংহের গল্পে প্রথম পাওয়া যাইতেছে। মহাভারতে পৌণ্ডক-বাসুদেব নামে পুণ্ড্রদের এক রাজার কথা; ভীম কর্তৃক এক পৌণ্ডাধিপের পরাজয়ের কথা; বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কর্বট, সুহ্ম প্রভৃতি কৌম রাজাদের কথা; দুর্যোধনসহায় এক বঙ্গরাজের কথা; রামায়ণে প্রাচীন বাঙলার কয়েকটি রাজবংশের কথা প্রভৃতি সমস্তই বাঙলার আদি রাজতন্ত্রের পরিচয় বহন করে। দীপবংশ-মহাবংশের বঙ্গ ও রাঢ়াধিপ সীহবাহুর কথা প্রভৃতি হইতে মনে হয়। খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক হইতেই বোধ হয় বাঙলার বিভিন্ন কৌমতন্ত্র রাজতন্ত্রে বিবর্তিত হইতেছিল; কিন্তু এই বিবর্তন যখনই হউক, তাহার পরও বহুদিন পর্যন্ত ঐতিহ্যে ও লোকস্মৃতিতে কৌমতন্ত্রের স্মৃতিই যে শুধু জাগরূক ছিল তাহা নয়, ইতস্তত তাহার কিছু কিছু অভ্যাস এবং ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল। সমগ্ৰ দেশ বোধ হয় এক সঙ্গে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই।