২৮তম অধ্যায়
অর্জ্জুনশরে সুশর্ম্মার ভাতৃগণ বিনাশ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহামতি মধুসূদন অর্জ্জুনের ইচ্ছানুসারে সুবর্ণভূষণমণ্ডিত, বায়ুবেগগামি অশ্বগণকে দ্রোণ-সৈন্যাভিমুখে সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় দ্রোণ-শরাভিতাপিত স্বীয় ভ্রাতৃগণের সাহায্যার্থ গমন করিতেছেন, এমন সময় মহাবীর সুশর্ম্মা ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে সংগ্রামার্থ তাহার পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় কৃষ্ণকে কহিলেন, হে শত্ৰুসূদন! ঐ দেখ, সুশৰ্ম্মা ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে যুদ্ধাৰ্থ আমাকে আহ্বান করিতেছে, আবার উত্তরদিকে সৈন্যগণ দ্রোণ-শরে বিদীর্ণ হইতেছে। এইরূপে সংশপ্তকগণ আমার চিত্তকে দোলায়মান করিয়াছে। এক্ষণে সংশপ্তকগণকে সংহার করি অথবা অরাতিশরাৰ্দিত আত্মীয়গণকে রক্ষা করি, এই উভয়ের কি কর্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া বল।’
মহামতি বাসুদেব অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণানন্তর ত্ৰিগৰ্ত্তাধিপতি সুশর্ম্মার অভিমুখে রথ সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন রণবিশারদ ধনঞ্জয় সাত বাণে সুশৰ্ম্মাকে বিদ্ধ করিয়া দুই ক্ষুর দ্বারা তাঁহার ধনু ও ধ্বজ ছেদনপূর্ব্বক ছয় বাণে তাঁহার ভ্রাতৃগণকে অশ্বগণ ও সারথি সমভিব্যাহারে শমন-সদনে প্রেরণ করিলেন। মহাবীর সুশৰ্ম্মা তদ্দর্শনে ক্রোধে অধীর হইয়া অর্জ্জুনের উপর ভীষণ ভুজঙ্গাকার অয়োময় শক্তি ও বাসুদেবের উপর তোমর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তিন শরে সুশর্ম্মার শক্তি ও তিন শরে তোমর ছেদন পূর্ব্বক শরনিকর দ্বারা তাঁহাকে বিমোহিত করিয়া শরজাল বর্ষণ করত গমন করিতে লাগিলেন। কৌরব সৈন্য মধ্যে কেহই তাঁহাকে নিবারিত করিতে পারিল না।
মহাবীর ধনঞ্জয় বাণ দ্বারা মহারথগণকে সংহার করত কক্ষরাশিদাহনদহনের ন্যায় গমন করিতে লাগিলেন। সৈন্যগণ অগ্নিস্পর্শ সদৃশ দারুণ অর্জ্জুনের বেগ সহ্য করিতে নিতান্ত অসমর্থ হইল। এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয় শরনিকর দ্বারা সৈন্যগণকে বিভ্রাবিত করিয়া গরুড়ের ন্যায় মহাবেগে ভগদত্তাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তৎকালে সমর বিজয়ী অর্জ্জুন দ্যূতদেবী দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের অপরাধ জনিত ক্ষত্রিয়বিনাশের নিমিত্ত নিষ্পাপ পাণ্ডবগণের ক্ষেমঙ্কর, শত্রুগণের অশ্রুবর্দ্ধন গাণ্ডীবশরাসন ধারণ করিয়াছিলেন। কৌরব সেনাগণ পার্থ-শরে বিক্ষোভিত হইয়া পর্ব্বত সংলগ্ন নৌকার ন্যায় বিপন্ন হইল।
অর্জ্জুন-ভগদত্ত যুদ্ধ
তখন ক্রূরমতি দশ সহস্র কৌরব সৈন্য জয় ও পরাজয়ে দৃঢ়নিশ্চয় হইয়া অক্ষুব্ধচিত্তে অর্জ্জুনকে আহ্বান করিতে লাগিল। সর্ব্বভারসহনক্ষম মহাবীর ধনঞ্জয় পদ্মবনপ্রবিষ্ট মাতঙ্গের ন্যায়-সেই সৈন্যগণের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাদিগকে মর্দ্দন করিতে লাগিলেন। কৌরব সৈন্যগণ অর্জ্জুন-শরে প্রমথিত হইলে মহাবীর ভগদত্ত ক্রোধভরে সেই হস্তী লইয়া ধনঞ্জয়াভিমুখে ধাবমান হইলেন। নরশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয় রথ দ্বারা তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। রথ ও নাগে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। মহাবীর ভগদত্ত ও ধনঞ্জয় সুসজ্জিত গজ ও রথে আরোহণ করিয়া সংগ্রামস্থলে বিচরণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভগদত্ত মেঘসঙ্কাশ হস্তীর উপর হইতে ইন্দ্রের ন্যায় ধনঞ্জয়ের উপর শরবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন। সমর বিশারদ অর্জ্জুন শরজাল দ্বারা অৰ্দ্ধ পথে ভগদত্তের শরনিকর নিবারণ করিয়া তাহার উপর বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবাহু প্রাজ্যোতিষেশ্বর অনায়াসে অর্জ্জুনের শরনিকর নিরাকৃত এবং তাঁহাকে ও কৃষ্ণকে অসংখ্য শরসমূহে বিদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে সংহার করিবার মানসে হস্তী সঞ্চালন করিলেন। মহামতি জনার্দ্দন ভগদত্তের হস্তীকে কালান্তক যমের ন্যায় আগমন করিতে দেখিয়া সত্বরে দক্ষিণ পার্শ্বস্থ করিলেন। মহারথ ধনঞ্জয় ঐ সুযোগে সেই হস্তী ও তাহার আরোহী ভগদত্তকে পশ্চাৎ হইতে বিনষ্ট করিতে পারিতেন; কিন্তু ধৰ্ম্ম স্মরণ করিয়া তাহা করিলেন না। তখন সেই মহাগজ অসংখ্য হস্তী রথ ও অশ্বের উপর আরোহণ করিয়া তৎসমুদায় বিনষ্ট করিতে লাগিল; তদ্দর্শনে অর্জ্জুনের ক্রোধের পরিসীমা রহিল না।