সপ্তবিংশ অধ্যায়
বিনতার দাসীত্বমুক্তির উপায় অনুসন্ধান
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, নাগগণ প্রচুর জলধারায় অভিষিক্ত হইয়া অতি প্রহৃষ্টমনে সুপর্ণ [গরুড়] পৃষ্ঠে আরোহণপূর্ব্বক সেই মকর সমূহের আকর-ভূমি, বিশ্বকর্ম্মবিরচিত রামণীয়কদ্বীপে উপনীত হইল; তথায় যাইয়া প্রথমতঃ অতি ভয়ঙ্কর লবণ-মহার্ণব অবলোকন করিল; পরে সেই দ্বীপের অন্তর্ব্বর্ত্তী পরমশোভাকর এক পবিত্র কাননে প্রবেশ করিয়া বিহার করিতে লাগিল। ঐ কানন সাগর-জলে নিরন্তর অভিষিক্ত হইতেছে; উহাতে বহুবিধ বিহঙ্গমগণ সর্ব্বদা মধুরস্বরে কলরব করিতেছে; বৃক্ষশ্রেণী নিরন্তর ফল-পুষ্পে সুশোভিত রহিয়াছে; ঘন-সন্নিবিষ্ট তরুরাজি, সুরম্য হর্ম্ম্য [অট্টালিকা] পদ্মাকর [যেখানে পদ্ম জন্মে] সরোবর ও স্বচ্ছসলিলপূর্ণ অলৌকিক হ্রদসমূহ সর্ব্বদা উহার অপূর্ব্ব শোভা সম্পাদন করিতেছে; তথায় সুগন্ধ সমীরণ অনুক্ষণ ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে; অত্যুন্নত চন্দন ও অন্যান্য বহুবিধ বৃক্ষগণ সতত বিরাজিত রহিয়াছে; ঐ সকল বৃক্ষ বায়ুবেগ-সহকারে বিকম্পিত হইয়া অবিরত পুষ্পবর্ষণ করিতেছে; মধুকরগণ মধুগন্ধে অন্ধ হইয়া মৃদু মধুরবে আগন্তুক ব্যক্তির মনোহরণ করিতেছে। ঐ উদ্যান গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাদিগের প্রীতিস্থান এবং উহা দেখিলে তদ্দণ্ডেই অন্তঃকরণে আনন্দের সঞ্চার হইয়া থাকে।
কদ্রুপুৎত্রেরা সেই কাননে কিয়ৎক্ষণ বিহার করিয়া মহাবল পরাক্রান্ত গরুড়কে কহিল, “দেখ, তুমি আমাদিগকে অন্য কোন নির্ম্মল জলসম্পন্ন সুরম্য দ্বীপে লইয়া চল। তুমি সমস্ত মনোহর স্থান অবশ্যই জান; কারণ, তুমি গগনে উড্ডীন হইলে কোন রমণীয় স্থান তোমার নয়নের অগোচর থাকে না।” গরুড় সর্পদিগের এইরূপ আদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া অতিবিষণ্ণমনে স্বীয় জননী-সন্নিধানে নিবেদন করিলেন, “মাতঃ! আমাকে কি কারণে সর্পগণের আদেশ প্রতিপালন করিতে হইবে, তাহা বল।” বিনতা কহিলেন, “বৎস! আমি দুরদৃষ্টক্রমে নাগগণের মায়াজালে পতিত ও পণে পরাজিত হইয়া সপত্নীর দাস্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছি।” গরুড় মাতৃসন্নিধানে এই কারণ শ্রবণ করিয়া অতিশয় পরিতাপ পাইলেন ও অনতিবিলম্বে সর্পগণের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, “হে নাগগণ! কোন্ বস্তু আহরণ বা কিরূপ পৌরুষ প্রকাশ করিলে আমরা দাসত্ব-শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইতে পারি, তাহা জানিতে ইচ্ছা করি।” তাহা শ্রবণ করিয়া সর্পেরা কহিল, “হে বিহঙ্গমরাজ! যদি তুমি পৌরুষ প্রকাশ করিয়া অমৃত আহরণ করিতে সমর্থ হও, তাহা হইলেই দাসত্ব হইতে মুক্ত হইতে পারিবে।”