১৬শ অধ্যায়
কৌরবপক্ষীয় বৃষসেনসহ পাণ্ডব-যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! বীৰ্য্যবান্ বৃষসেন আপনার সৈন্যগণকে ছিন্ন ভিন্ন নিরীক্ষণ করিয়া একাকী অস্ত্রমায়া প্রকটন পূর্ব্বক তাহাদিগকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। বৃষসেন-বিনির্মুক্ত শরনিকর মনুষ্য, অশ্ব, রথ ও হস্তিগণকে বিদীর্ণ করিয়া দশদিকে বিচরণ করিতে লাগিল। তাঁহার সহস্র সহস্র মহাবাণ গ্ৰীষ্মকালীন দিবাকরকিরণের ন্যায় প্রদীপ্ত হইয়া বিচরণ পূর্ব্বক রথী ও সাদিগণকে নিপীড়িত করিয়া বাতভগ্ন দ্রুমের ন্যায় সহসা ভূমিতলে নিপাতিত করিল। মহারথ বৃষসেন শত শত ও সহস্র সহস্র অশ্বদল, রথশ্রেণী ও গজযূথকেও নিপাতিত করিলেন।
বৃষসেনপ্রমুখ কৌরব পলায়ন
ভূপতিগণ বৃষসেনকে একাকী অভীতবৎ সংগ্রামে বিচরণ করিতে দেখিয়া, সকলে একত্র হইয়া তাঁহাকে চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিলেন। নকুলনন্দন শতানীক বৃষসেনের সম্মুখীন হইয়া মর্ম্মভেদী দশ নারাচে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। বৃষসেন শতানীকের শরাসন ও কেতু ছেদন করিয়া ফেলিলেন। দ্রৌপদীর অন্যান্য পুত্রগণ শতানীকের নিকটবর্তী হইবার বাসনায় গমন করিয়া শীঘ্র শর সমূহে বৃষসেনকে অদৃশ্য করিলেন। যেমন জলদজাল পর্ব্বতকে আবৃত করে, সেইরূপ অশ্বত্থামা প্রভৃতি রথিগণ নানাবিধ শরে মহারথ দ্রৌপদেয়গণকে শীঘ্র আচ্ছন্ন করিয়া ধাবমান হইলেন। পুত্রবৎসল পাণ্ডবগণ এবং পাঞ্চাল কৈকেয়, মৎস্য ও সৃঞ্জয়গণ ত্বরান্বিত ও উদ্যতায়ুধ হইয়া তাঁহাদিগকে গ্রহণ করিলেন। অনন্তর দানবগণের সহিত দেবগণের যুদ্ধের ন্যায় কৌরবগণের সহিত পাণ্ডবগণের ঘোরতর লোমহর্ষণ মহৎ যুদ্ধ হইতে লাগিল। পরস্পর কৃতাপরাধ বীর্য্যশালী পাণ্ডব ও কৌরবগণ ক্রুদ্ধ হইয়া পরস্পর অবলোকন করত এই রূপ যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। সেই সকল অমিততেজার শরীর রোষ বশত আকাশে যুদ্ধার্থী পক্ষী ও সর্পের শরীরের ন্যায় নয়নগোচর হইতে লাগিল। রণক্ষেত্র ভীম, কর্ণ, কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি দ্বারা প্রলয়কালীন সমুদিত সূৰ্য্যের ন্যায় দীপ্যমান হইল। দেবগণের সহিত দানবগণের সমরের ন্যায় পরস্পর প্রহারী মহাবলগণের সহিত মহাবলগণের তুমুল যুদ্ধ হইতে লাগিল। অনন্তর কৌরবপক্ষ মহারথগণ পলায়ন করিলেন। যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণ কৌরব সৈন্যগণকে বধ করিতে লাগিল।
দ্রোণাচার্য্য কৌরব সৈন্যগণকে ভগ্ন ও শত্রুগণ কর্ত্তৃক অতিমাত্ৰ ক্ষতবিক্ষত নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, হে শূরগণ! পলায়ন করিবার প্রয়োজন নাই। অনন্তর শোণাশ্ব দ্রোণাচাৰ্য্য চতুর্দ্দন্ত হস্তীর ন্যায় পাণ্ডব সৈন্যে প্রবেশ পূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিলে যুধিষ্ঠির কঙ্কপত্ৰশোভিত শরনিকরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। দ্রোণ সত্বরে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া তাঁহার প্রতি অবমান হইলেন। বেলা যেমন সমুদ্রকে ধারণ করে, পাঞ্চালগণের যশস্কর, চক্ররক্ষক কুমার সেই রূপ আগচ্ছমান দ্রোণকে ধারণ করিলেন। দ্বিজশ্রেষ্ঠ দ্রোণকে কুমার কর্ত্তৃক নিবারিত দেখিয়া সকলে সিংহনাদ ও সাধুবাদ করিতে লাগিল। মহাবল কুমার ক্রুদ্ধ হইয়া সায়ক দ্বারা দ্রোণাচার্যের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলেন এবং কৃতহস্ত হইয়া অবিশ্রান্তভাবে অনেক সহস্র শরে তাঁহাকে নিবারণ করিয়া মুহুর্মুহু সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।
পাঞ্চাল রাজকুমার বধ
আপনার সৈন্যগণের রক্ষাকর্তা দ্বিজশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচাৰ্য্য শোর্য্যশালী, আর্য্যব্রত, মন্ত্রে ও অস্ত্রে কৃতনিশ্চয়, চক্ৰরক্ষক কুমারকে বিনষ্ট করিলেন, সৈন্যগণের মধ্যস্থলে আগমন করিয়া সকল দিকে বিচরণ পূর্ব্বক দ্বাদশ বাণে শিখণ্ডীকে, বিংশতি বাণে উত্তমৌজাকে, পাঁচ বাণে নকুলকে, সাত বাণে সহদেবকে, দ্বাদশ বাণে যুধিষ্ঠিরকে, তিন তিন বাণে দ্রৌপদেয়দিগকে, পাঁচ বাণে সাত্যকিকে ও দশ শরে বিরাটকে বিদ্ধ করিয়া প্রাধান্যানুসারে অন্যান্য যোদ্ধাগণকে আক্রমণ পূর্ব্বক বিক্ষোভিত করিলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিবার বাসনায় তাঁহার অভিমুখীন হইলেন। যুগন্ধর মহারথ, জাত ক্রোধ, বাতোদ্ধৃত সাগর সদৃশ ভারদ্বাজকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য সন্নতপর্ব্ব শরনিকরে যুধিষ্ঠিরকে বিদ্ধ করিয়া ভল্লদ্বারা যুগন্ধরকে রথনীড় হইতে নিপাতিত করিলেন।
দ্রোণ-অর্জ্জুন যুদ্ধ – দ্রোণ কর্ত্তৃক ব্যাঘ্রদত্ত বধ
অনন্তর বিরাট, দ্রুপদ, কৈকেয়গণ, সাত্যকি, শিবি, পাঞ্চল্য ব্যাঘ্রদত্ত, বীৰ্য্যবান্ সিংহসেন ও অন্যান্য বহু বীর যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করিবার বাসনায় ভূরি ভূরি সায়ক নিক্ষেপ করত দ্রোণাচার্য্যের পথ রোধ করিলেন। পাঞ্চাল ব্যাঘ্রদত্ত পঞ্চাশৎ নিশিতসায়কে দ্রোণাচাৰ্য্যকে বিদ্ধ করিলে লোক সকল চীৎকার করিতে লাগিল। সিংহসেনও হৃষ্ট হইয়া সহসা অন্যান্য মহারথগণকে বিত্রাসিত করত দ্রোণাচাৰ্য্যকে বিদ্ধ করিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। অনন্তর বলবান দ্রোণাচার্য্য নয়নযুগল বিষ্ফারিত ও শরাসনজ্যা মার্জিত করিয়া সিংহনাদ সহকারে তাঁহাকে আক্রমণ পূর্ব্বক দুই ভল্ল দ্বারা তাঁহার ও ব্যাঘ্রদত্তের কুণ্ডলসনাথ মস্তক ছেদন করিলেন এবং শরসমূহে পাণ্ডবদিগের মহারথগণকে বিমর্দ্দিত করিয়া যুধিষ্ঠিরের রথ সমীপে অন্তকের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। যতব্রত দ্রোণাচাৰ্য্য সন্নিহিত হইলে যুধিষ্ঠিরের সৈন্য মধ্যে, রাজা নিহত হইলেন, এই মহাশব্দ সমুত্থিত হইল। আপনার সৈনিকগণ দ্রোণের বিক্রম অবলোকন করিয়া কহিতে লাগিল, আজি যুদ্ধে রাজা দুৰ্য্যোধন কৃতার্থ হইবেন; দ্রোণ চার্য্য এই মুহূর্তেই যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিয়া হৃষ্ট চিত্তে আমা দিগের ও দুর্য্যোধনের সমীপে আগমন করিবেন, তাহার সন্দেহ নাই।
কৌরব সৈন্যগণ এই রূপ জল্পনা করিতেছেন, এমন সময় মহারথ অর্জ্জুন শোণিত জল, রথাবৰ্ত্ত, শূরগণের অস্থি ও শরীরে আকীর্ণ প্রেতকূলাপহারী, শরজাল ফেনময় মহানদী প্রবর্ত্তিত ও রথঘোষে চতুর্দ্দিক্ নিনাদিত করত সেই ভয়ঙ্কর নদী উত্তীর্ণ হইয়া কৌরবগণকে বিদ্রাবিত করিয়া মহাবেগে আগমন করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন দ্রোণসৈন্যগণকে যেন মোহিত করিয়া শরজালে আচ্ছন্ন করত সহসা আক্রমণ করিলেন। যশস্বী ধনঞ্জয় এরূপ সত্বরে শর ক্ষেপ ও সন্ধান করিতে লাগিলেন যে, তাঁহার অবকাশ কাহারও নয়নগোচর হইল না। অনন্তর ধনঞ্জয়কৃত শরান্ধকারে না দিক্ না অন্তরিক্ষ, না স্বর্গ না মেদিনী, কিছুই আর দৃষ্টিগোচর হইল না; বোধ হইল, যেন সমুদায়ই বাণময় হইয়া গিয়াছে। এই সময় দিবাকর ধূলিপটলে সমাচ্ছন্ন ও অস্তমিত হইলেন; সুতরাং কে সুহৃৎ, কে মিত্র ইহা অবগত হইবার আর সামর্থ্য রহিল না।
অনন্তর দ্রোণ দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি সকলে অবহার করিলে অর্জ্জুন শত্রুগণকে ভীত ও যুদ্ধপরাঙ্মুখ জানিয়া স্বসৈন্যগণকে ক্রমে ক্রমে অবহার করিলেন। ঋষিগণ যেমন সূর্যের স্তব করেন, পাণ্ডব, সৃঞ্জয় ও পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হইয়া সেইরূপ মনোজ্ঞ বাক্যে তাহার স্তব করিতে লাগিলেন। এই রূপে ধনঞ্জয় বাসুদেবের সহিত শত্রুগণকে পরাজিত করিয়া হৃষ্ট চিত্তে সৈন্যগণের পশ্চাতে সারযুক্ত ইন্দ্রনীলমণী, সুবর্ণ, রৌপ্য, হীরক, প্রবাল ও স্ফটিকে খচিত রথে, নক্ষত্রখচিত আকাশস্থিত চন্দ্রমার ন্যায় শোভমান হইয়া স্ব শিবিরে গমন করিলেন।
দ্রোণাভিষেকপর্ব্ব সমাপ্ত