যখন সুবেসাদিকে মুয়াজ্জিনের আজান
চুমো খেলো শহরের অট্রালিকার নিদ্রিত গালে,
ফুটপাতের ঠোঁটে, ল্যাম্পপোস্ট আর
দোকানপাটের নিঝুম সাইনবোর্ডের চিবুকে, বস্তির শীর্ণ শিশুর
শুকিয়ে যাওয়া ঘামের চিহ্নময় কপালে,
লেকের পানির নিথয়, পাখির নীড়ের স্নিগ্ধ নিটোল শান্তিতে,
তখন ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে
কয়েকটি কর্কশ অমাবস্যা ঢুকে পড়ল। অকস্মাৎ
স্বপ্নাদ্য হরিণের আর্তনাদে জেগে উঠে তিনি, প্রশস্তবক্ষ, দীর্ঘকায়,
সুকান্ত পুরুষ, যাঁর মাথায় ইতিহাসের জ্যোতি-বলয়,
এসে দাঁড়ালেন অসীম সাহসের প্রতিভূ।
কতিপয় কর্কশ অমাবস্যা, যাদের অন্ধকার থেকে
বেরিয়ে আসছিল পরিকল্পিত উন্মত্ততার বীভৎস জিভ,
তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিলো এক ঝাঁক দমকা বুলেট। ঈষৎ বিস্ময়-বিহ্বল,
অথচ স্থির, অটল নির্ভীক তিনি অমাবস্যার দিকে
আঙুল উঁচিয়ে ঢলে পড়লেন সিঁড়িতে। সেই মুহূর্তে
বাংলা মায়ের বুক বিদীর্ণ হলো; মেঘনা, পদ্মা, যমুনা, সুরমা,
আড়িয়াল খাঁ, ধরলা, ধলেশ্বরী, কুমার, কর্ণফুলি, বুড়িগঙ্গা এবং
মধুমতি তাজা রক্তে উঠল কানায় কানায়। বাংলায়
লহু-রাঙা ফোরাত বয়ে গেল, সীমারের নির্লোম বুক, শাণিত খঞ্জর,
ইমাম হোসেনের বিষণ্ণ মুখ আর কারবালা প্রান্তর ভেসে উঠল দৃষ্টিপথে!
আকাশের মেঘমালা, এই গাঙ্গের বদ্বীপের সকল গাছপালা,
হঠাৎ জেগে-ওঠা প্রতিটি পাখি,
হাওয়ায় কম্পিত ঘাসের ডগা, সকল ফুলের অন্তর
হয়ে গেল দিগন্ত-কাঁপানো মাতম;
বাংলাদেশ ধারণ করল মহররমের সিয়া বেশ।
সদর রাস্তায় একচক্ষু দানবের মতো ট্যাঙ্কের উলঙ্গ ঘর্ঘর
আজানের ধ্বনিকে ডুবিয়ে দিতে চাইল,
লাঞ্ছিত করল নিসর্গের প্রশান্ত সম্ভ্রমকে,
প্রত্যুষের থমথমে, ফ্যাকাশে মুখে লেগে রইল
নব পরিণীতার রক্তের ছোপ, যার হাতে
তার বুকের রক্তের মতেই টাটকা মেহেদির রঙ,
প্রত্যূষ মুখ লুকিয়ে ফেলতে চাইল
ভয়ার্ত বালক রাসেলের দিকে অমাবস্যাকে অগ্রসর হতে দেখে,
কতিপয়, অমাবস্যাকে হায়েনা-চোখে
মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখে
প্রত্যূষ থমকে দাঁড়াল, ধিক্কারের ভাষা স্তব্ধতায় হলো বিলীন।
স্মরণ করতে চাই না সেই সব পাশব হাতকে,
যেগুলো মারণাস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিল তাঁর বুক লক্ষ্য করে
যিনি দুঃখিনী বাংলা মায়ের মহান উদ্ধার;
আমাদের দৃষ্টির স্ফুলিঙ্গে ভস্মীভূত হোক সেসব হাত,
যেগুলো মেতেছিল নারী হত্যা আর শিশু হত্যায়,
আমাদের থুতুতে পচে যাক সেসব হাত,
যেগুলো তাঁকে মাটি-চাপা দিতে চেয়েছিল
জনস্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে, অথচ তিনি মধুমতি নদীর তীরে
গাছপালা, লতাগুল্মঘেরা টুঙ্গিপাড়ায়
দীঘল জমাট অশ্রুপুঞ্জের মতো সমাহিত হয়েও
দিগ্ধিজয়ী সম্রাটের ঔজ্জ্বল্য আর মহিমা নিয়ে
ফিরে এলেন নিজেরই ঘরে, জনগণের নিবিড় আলিঙ্গনে।
দেশের প্রতিটি শাপলা শালুক আর দোয়েল,
ফসল তরঙ্গ আর পল্লীপথ প্রণত তাঁর অপরূপ উদ্ভাসনে এবং
শ্রাবণের অবিরল জলধারা অপার বেদনায় জমাট বেঁধে
আদিগন্ত শোক দিবস হয়ে যায়।