॥ ২ ॥
ঠাকুর নরোত্তম দাস একজন বৈষ্ণব পদকর্তা। প্রিয় প্রভুর উদ্দেশে তিনি অনেক ভক্তিগীতি রচনা করেছেন, নিজের বৈষ্ণবোচিত মনঃশুদ্ধির জন্য এবং সিদ্ধির জন্য প্রভুর কাছে অনেক প্রার্থনাও করেছেন। তাঁর একটি প্রার্থনা ছিল—‘দয়া কর, না করিহ মায়া’। অর্থাৎ মায়া যদি কর, তবে যেখানে পড়ে আছি, সেইখানেই পড়ে থাকব; ত্যাগ বৈরাগ্য আসবে না, চিত্তশুদ্ধি হবে না, ইন্দ্রিয়জয় হবে না, ইহকালেও তাঁকে পাওয়া হবে না। সত্য কথা বলতে কী, মানবজীবনের কোনও বড় পাওয়াই মায়া করে হয় না। যদি তিনি দয়া করেন, দয়া করে মনের বল বাড়িয়ে দেন, কৃচ্ছ্রসাধনের শক্তি দেন, তবেই সম্ভব তাঁকে পাওয়া, তবেই সম্ভব সাধনের সিদ্ধিলাভ।
বস্তুত রাত্রির অঘোর ঘুমে শায়িত একটি কিশোরের নিদ্রালুব্ধ মুখ দেখে আমি যদি তাকে আরও ঘুমোতে দিতাম, ছেলে পড়াশুনো করতে চায় না বলে আমি যদি তাকে বলতাম—পড়াশুনোয় বড় কষ্ট বাবা! দরকার নেই অমন পড়াশুনোয়। তুমি খেলা করো, টিভি দেখো, জীবনের যত মজা আছে সব লুটে নাও—তা হলে এইটা হত নরোত্তম দাস ঠাকুরের মতে মায়া করা। যদি এমন হত যে, আমার আদরের ছেলেটি বন্ধু হওয়া উচিত এমন অন্য একটি ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে তার মাথাটি ফাটিয়ে দিয়ে এসে আমায় বলত—বাবা! অমুক ছেলেটি মহা বদমাশ, তখন যদি বাবা হিসেবে আমি সেই ছেলেটিকে গিয়ে গালাগালি দিতাম, তার বাবামার কাছে গিয়ে নালিশ করতাম, তবে নরোত্তম দাস ঠাকুরের মতে সেটি মায়া করা।
পদকর্তার ‘মায়া’ শব্দটি বোঝাতে পেরেছি বলে মনে হয়, তবে তাঁর পদপংক্তিতে ‘দয়া’ কথাটি বড়ই কঠিন। বলা উচিত—এ প্রায় নির্দয়তার শামিল। মায়া ত্যাগ করে যে ছেলেকে পাঁচটার সময় ঘুম থেকে ওঠাচ্ছি, মায়া ত্যাগ করে যাকে অধ্যয়নের তপস্যায় বসাচ্ছি, মায়া ত্যাগ করে যাকে সামাজিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করছি, মায়া ত্যাগ করে যাকে কর্মযোগ, সদভ্যাস, সদব্যবহার শেখাচ্ছি, নরোত্তমের অভিপ্রায়—এইটাই আসল দয়া করা।
প্রত্যেক বাবামায়ের মধ্যেই পুত্র সম্বন্ধে এই মায়া এবং দয়ার বৃত্তি কাজ করতে থাকে। যে দম্পতি মায়া বজায় রেখেও সন্তানের মধ্যে শৃঙ্খলার অন্তর্জন্ম দিতে পারেন, তিনি আদর্শ দম্পতি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই জনক জননীর মধ্যে মায়ার ভাগই বেশি থাকে, আবার কখনও বা কারও মধ্যে শিক্ষাদানের আদর্শও বড় হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত শিক্ষা দিতে গিয়ে কোনও কোনও জনক জননী আবার সন্তানের সুকুমার বৃত্তিগুলিই নষ্ট করে ফেলেন। কিন্তু তবু কী জানেন—এই শেষোক্ত কোটির দম্পতিকে আমরা দোষ দিতে পারি না। তাঁদের মনের মধ্যে যে আদর্শের অতিরেক আছে, সে অতিরেকটুকু তাঁদের অজান্তেই সন্তানের মনের রাজ্যে বিপদ ডেকে আনে হয়তো। কিন্তু এইটুকু বাদ দিলেও তাঁদের আদর্শের ভাবনাটাকে অশ্রদ্ধা করতে পারি না মোটেই।
কিন্তু যাঁরা শুধু মায়ার তাড়নায় সমস্ত শৃঙ্খলার তাড়না অতিক্রম করেন, যাঁরা পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে জগতের সমস্ত শুভবুদ্ধিকে অতিক্রম করেন, যাঁরা পুত্রকন্যার স্বার্থ দেখতে গিয়ে পরার্থ অনুমান করতে পারেন না, তাঁদের সংজ্ঞাই হল ধৃতরাষ্ট্র। আমাদের ভাবনায় এখন ধৃতরাষ্ট্র কোনও কুরুকুলপতির নামমাত্র নয়, ধৃতরাষ্ট্র এক স্বার্থান্বেষী জনকের সংজ্ঞা। তর্ক যুক্তির বালাই না রেখে যখনই মানুষ আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে পুত্রের স্বার্থচিন্তায় ভাবিত হয়েছে, তখনই আমরা তাকে ধৃতরাষ্ট্র বলেছি। এই ধৃতরাষ্ট্র আমাদের মধ্যে আছেন শত শত, হাজার হাজার।
ঠিক এত সংখ্যায় আছেন বলেই আমার লেখনী আজ কম্পিত হচ্ছে। কেবলই ভাবছি—ধৃতরাষ্ট্রের বিচার হওয়া উচিত একটু অন্যভাবে। আজকে আমরা যারা একান্নবর্তী পরিবারগুলি খণ্ড বিখণ্ড করে দিয়ে প্রত্যেকে একেকটি দুর্ভাগ্যের পারিবারিক ‘ইউনিট’ তৈরি করেছি, তারা ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয় বুঝবেন খুব তাড়াতাড়ি। বস্তুত ধৃতরাষ্ট্রের ভালবাসার প্রকৃতিও অন্যের থেকে আলাদা। ধৃতরাষ্ট্র রাজা হননি বটে, কিন্তু রাজকীয় সুখভোগ, কর্তৃত্ব এবং স্বাধীনতা কোনও সময়েই তাঁর কম ছিল না। কিন্তু সব থাকা সত্ত্বেও এগুলি ‘অফিসিয়ালি’ তাঁর ভাগ্যে আসেনি এবং সে জন্য তাঁর ক্ষোভের অন্ত ছিল না। অবশেষে নিজের যখন হলই না, তখন ওই রাজ্যপাট, রাজসুখ অন্তত তাঁর ছেলের ভাগ্যে ‘অফিসিয়ালি’ জুটুক, সেটা তিনি চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য এমনই যে, ছেলের ভাগ্যেও ‘অফিসিয়ালি’ রাজ্য এল না। ধৃতরাষ্ট্রের চরম মানসিক দ্বন্দ্বের আরম্ভ এইখান থেকেই। যা তিনি চান, তা যখন নিয়মমতো অপ্রাপ্য রয়ে গেল, তখন নিয়ম-বহির্ভূতভাবে সেটা কী করে পাওয়া যায়—এই চরম দ্বন্দ্বেই তাঁর সমস্ত জীবন কেটে গেল এবং এই দ্বন্দ্বের চিরন্তন মাধ্যম হয়ে রইলেন তাঁর প্রিয় পুত্র দুর্যোধন।