পরিশিষ্ট

চিত্রচোর – ৮

ডাক্তারের ঔষধালয় হইতে অনতিদূরে ব্যাঙ্ক। আমরা গিয়া দেখিলাম ব্যাঙ্কের দ্বার খুলিয়াছে। দ্বারের দুই পাশে বন্দুক-কিরিচধারী দুইজন সান্ত্রী পাহারা দিতেছে।

বড় একটি ঘর দুই ভাগে বিভক্ত, মাঝে কাঠ ও কাচের অনুচ্চ বেড়া। বেড়ার গায়ে সারি সারি জানালা। এই জানালা দিয়া জনসাধারণের সঙ্গে ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের লেন-দেন হইয়া থাকে।

ব্যোমকেশ একটি জানালার বাহিরে দাঁড়াইয়া চেক লিখিতেছে, দেখিলাম বেড়ার ভিতর দিকে ম্যানেজার অমরেশ রাহা দাঁড়াইয়া একজন কেরানীর সঙ্গে কথা কহিতেছেন। অমরেশবাবুও আমাদের দেখিতে পাইয়াছিলেন, তিনি স্মিতমুখে বাহিরে আসিলেন। বলিলেন, ‘নমস্কার। ভাগ্যে আপনাদের দেখে ফেললাম নইলে তো টাকা নিয়েই চলে যেতেন।’

অমরেশবাবুকে চায়ের পার্টির পর আর দেখি নাই। তিনি সেজন্য লজ্জিত; ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, ‘রোজই মনে করি আপনাদের বাড়িতে যাব, কিন্তু একটা না একটা কাজ পড়ে যায়। ব্যাঙ্কের চাকরি মানে অষ্টপ্রহরের গোলামি।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এমন গোলামিতে সুখ আছে। হরদম টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।’

অমরেশবাবু করুণ মুখভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘সুখ আর কৈ ব্যোমকেশবাবু। চিনির বলদ চিনির বোঝা বয়ে মরে, কিন্তু দিনের শেষে খায় সেই ঘাস জল।’

ব্যোমকেশ চেকের বদলে টাকা পকেটস্থ করিলে অমরেশবাবু বলিলেন, ‘চলুন, আজ যখন পেয়েছি আপনাকে সহজে ছাড়ব না। আমার আপিস-ঘরে বসে খানিক গল্প-সল্প করা যাক। আপনার প্রতিভার যে পরিচয় অজিতবাবুর লেখা থেকে পাওয়া যায়, তাতে আপনাকে পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আমাদের দেশে প্রতিভাবান মানুষের বড়ই অভাব।’

ভদ্রলোক শুধু যে ব্যোমকেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাহাই নয়, সাহিত্য-রসিকও বটে। সেদিন তাঁহার সহিত অধিক আলাপ করি নাই বলিয়া অনুতপ্ত হইলাম।

তিনি আমাদের ভিতরে লইয়া গেলেন। তাঁহার একটি নিজস্ব আপিস-ঘর আছে, তাহার দ্বার পর্যন্ত গিয়া তিনি বলিলেন, ‘না, এখানে নয়। চলুন, ওপরে যাই। এখানে গণ্ডগোল, কাজের হুড়োহুড়ি। ওপরে বেশ নিরিবিলি হবে।’

আপিস-ঘরের দরজা খোলা ছিল; ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, মামুলি টেবিল চেয়ার খাতাপত্র, কয়েকটা বড় বড় লোহার সিন্দুক ছাড়া আর কিছু নাই।

কাছেই সিঁড়ি। উপরে উঠিতে উঠিতে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ওপরতলাটা বুঝি আপনার কোয়ার্টার?’

‘হ্যাঁ। ব্যাঙ্কেরও সুবিধে।’

‘স্ত্রী-পুত্র পরিবার সব এখানেই থাকেন?’

‘স্ত্রী-পুত্র পরিবার আমার নেই ব্যোমকেশবাবু। ভগবান সুমতি দিয়েছিলেন, বিয়ে করিনি। একলা-মানুষ, তাই ভদ্রভাবে চলে যায়। বিয়ে করলে হাড়ির হাল হত।’

উপরতলাটি একজন লোকের পক্ষে বেশ সুপরিসর। তিন চারটি ঘর, সামনে উন্মুক্ত ছাদ। অমরেশবাবু আমাদের বসিবার ঘরে লইয়া গিয়া বসাইলেন। অনাড়ম্বর পরিচ্ছন্ন ঘর; দেওয়ালে ছবি নাই, মেঝেয় গালিচা নাই। এক পাশে একটি জাজিম-ঢাকা চৌকি, দুই-তিনটি আরাম-কেদারা, একটি বইয়ের আলমারি। নিতান্তই মামুলি ব্যাপার, কিন্তু বেশ তৃপ্তিদায়ক। গৃহস্বামী যে গোছালো স্বভাবের লোক তাহা বোঝা যায়।

‘বসুন, চা তৈরি করতে বলি।’ বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।

বইয়ের আলমারিটা আমাকে আকর্ষণ করিতেছিল, উঠিয়া গিয়া বইগুলি দেখিলাম। অধিকাংশ বই গল্প উপন্যাস, চলন্তিকা আছে, সঞ্চয়িতা আছে। আমার রচিত ব্যোমকেশের উপন্যাসগুলিও আছে দেখিয়া পুলকিত হইলাম।

ব্যোমকেশও আসিয়া জুটিল। সে একখানা বই টানিয়া লইয়া পাতা খুলিল; দেখিলাম বইখানা বাংলা ভাষায় নয়, ভারতবর্ষেরই অন্য কোনও প্রদেশের লিপি। অনেকটা হিন্দীর মতন, কিন্তু ঠিক হিন্দী নয়।

এই সময় অমরেশবাবু ফিরিয়া আসিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি গুজরাটী ভাষাও জানেন?’

অমরেশবাবু মুখে চট্‌কার শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘জানি আর কৈ? একসময় শেখবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ও আমার দ্বারা হল না। বাঙালীর ছেলে মাতৃভাষা শিখতেই গলদ্‌ঘর্ম হয়, তার ওপর ইংরিজি আছে। উপরন্তু যদি একটা তৃতীয় ভাষা শিখতে হয় তাহলে আর বাঙালীর শক্তিতে কুলোয় না। অথচ শিখতে পারলে আমার উপকার হত। ব্যাঙ্কের কাজে গুজরাটী ভাষা জানা থাকলে অনেক সুবিধা হয়।’

আমরা আবার আসিয়া বসিলাম। দুই-চারিটি একথা সেকথার পর ব্যোমকেশ বলিল, ‘ফাল্গুনী পাল মারা গেছে শুনেছেন বোধ হয়?’

অমরেশবাবু চেয়ার হইরে প্রায় লাফাইয়া উঠিলেন, ‘অ্যাঁ। ফাল্গুনী পাল মারা গেছে! কবে—কোথায়—কি করে মারা গেল?’

ব্যোমকেশ ফাল্গুনীর মৃত্যু-বিবরণ বলিল। শুনিয়া অমরেশবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘আহা বেচারা! বড় দুঃখে পড়েছিল। কাল আমার কাছে এসেছিল।’

এবার আমাদের বিস্মিত হইবার পালা। ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল, ‘কাল এসেছিল? কখন?’

অমরেশবাবু বলিলেন, ‘সকালবেলা। কাল রবিবার ছিল, ব্যাঙ্ক বন্ধ; সবে চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে বসেছি, ফাল্গুনী এসে হাজির, আমার ছবি এঁকেছে তাই দেখাতে এসেছিল—’

‘ও—’

চাকর তিন পেয়ালা চা দিয়া গেল। তক্‌মা-আঁটা চাকর, বুঝিলাম ব্যাঙ্কের পিওন; অবসরকালে বাড়ির কাজও করে। ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল অমরেশবাবু টাকা-পয়সার ব্যাপারে বিলক্ষণ হিসাবী।

ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় চামচ ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল, ‘ছবিখানা কিনলেন নাকি?’

অমরেশবাবু বিমর্ষ মুখভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘কিনতে হল। পাঁচ টাকা দিতে গেলাম কিছুতেই নিলে না, দশ টাকা আদায় করে ছাড়ল। এমন জানলে—’

ব্যোমকেশ চায়ে একটা চুমুক দিয়া বলিল, ‘মৃত চিত্রকরের শেষ ছবি দেখবার ইচ্ছে হচ্ছে।’

‘দেখুন না। ভালই এঁকেছে বোধ হয়। আমি অবশ্য ছবির কিছু বুঝি না—’

বইয়ের আলমারির নীচের দেরাজ হইতে একখণ্ড পুরু চতুষ্কোণ কাগজ আনিয়া তিনি আমাদের সম্মুখে ধরিলেন।

ফাল্গুনী ভাল ছবি আঁকিয়াছে; অমরেশবাবুর বিশেষত্বহীন চেহারা উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। ব্যোমকেশ চিত্রবিদ্যার একজন জহুরী, সে ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া ছবিটি দেখিতে লাগিল।

অমরেশবাবু আগে বেশ প্রফুল্লমুখে কথাবার্তা বলিতেছিলেন, কিন্তু ফাল্গুনীর মৃত্যু-সংবাদ শুনিবার পর কেমন যেন মুষড়াইয়া পড়িয়াছেন। প্রায় নীরবেই চা-পান শেষ হইল। পেয়ালা রাখিয়া অমরেশবাবু স্তিমিত স্বরে বলিলেন, ‘ফাল্গুনীর কথায় মনে পড়ল, সেদিন চায়ের পার্টিতে শুনেছিলাম পিক্‌নিকের ফটোখানা চুরি গেছে। মনে আছে? তার কোনও হদিস পাওয়া গেল কিনা কে জানে।’

ব্যোমকেশ মগ্ন হইয়া ছবি দেখিতেছিল, উত্তর দিল না। আমিও কিছু বলা উচিত কিনা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মত অমরেশবাবুর পানে চাহিয়া রহিলাম। অমরেশবাবু তখন নিজেই বলিলেন, ‘সামান্য ব্যাপার, তাই ও নিয়ে বোধ হয় কেউ মাথা ঘামায়নি।’

ব্যোমকেশ ছবি নামাইয়া রাখিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিল, ‘চমৎকার ছবি। লোকটা যদি বেঁচে থাকত, আমিও ওকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিতাম। অমরেশবাবু, ছবিখানা যত্ন করে রাখবেন। আজ ফাল্গুনী পালের নাম কেউ জানে না, কিন্তু একদিন আসবে যেদিন ওর আঁকা ছবি সোনার দরে বিক্রি হবে।’

অমরেশবাবু একটু প্রফুল্ল হইয়া বলিলেন, ‘তাই নাকি! তাহলে দশটা টাকা জলে পড়েনি? ছবিটা বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙানো চলবে?’

‘নিশ্চয়।’

অতঃপর আমরা গাত্রোত্থান করিলাম। অমরেশবাবু বলিলেন, ‘আবার দেখা হবে। বছর শেষ হতে চলল, আমাকে আবার নববর্ষের ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে হেড আপিসের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। এবার নববর্ষে দু’দিন ছুটি।’

‘দু’দিন ছুটি কেন?’

‘এবার একত্রিশে ডিসেম্বর রবিবার পড়েছে। শনিবার যদি অর্ধেক দিন ধরেন, তাহলে আড়াই দিন ছুটি পাওয়া যাবে। আপনারা এখনও কিছুদিন আছেন তো?’

‘২রা জানুয়ারি পর্যন্ত আছি বোধ হয়।’

‘আচ্ছা, নমস্কার।’

আমরা বাহির হইলাম। ব্যাঙ্কের ভিতর দিয়া নামিতে হইল না, বাড়ির পিছনদিকে একটা খিড়কি-সিঁড়ি ছিল, সেই পথে নামিয়া রাস্তায় আসিলাম। বাজারের মধ্য দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল সিগারেট ফুরাইয়াছে। বলিলাম, ‘এস, এক টিন সিগারেট কিনতে হবে।’

ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক ছিল, চমকিয়া উঠিল। বলিল, ‘আরে তাই তো! আমাকেও একটা জিনিস কিনতে হবে।’

একটা বড় মনিহারীর দোকানে ঢুকিলাম। আমি একদিকে সিগারেট কিনিতে গেলাম, ব্যোমকেশ অন্যদিকে গেল। আমি সিগারেট কিনিতে কিনিতে আড়চোখে দেখিলাম ব্যোমকেশ একটা দামী এসেন্সের শিশি কিনিয়া পকেটে পুরিল।

মনে মনে হাসিলাম। ইহারা কেন যে ঝগড়া করে, কেনই বা ভাব করে কিছু বুঝি না। দাম্পত্য-জীবন আমার কাছে একটা হাস্যকর প্রহেলিকা।

সেদিন দুপুরবেলা আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিবার জন্য বিছানায় লম্বা হইয়াছিলাম, ঘুম ভাঙিয়া দেখি বেলা সাড়ে তিনটা।

ব্যোমকেশের ঘর হইতে মৃদু জল্পনার শব্দ আসিতেছিল; উঁকি মারিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ চেয়ারে বসিয়াছে এবং সত্যবতী তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া দুই হাতে তাহার গলা জড়াইয়া কানে কানে কি সব বলিতেছে। দু’জনের মুখেই হাসি।

সরিয়া আসিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিলাম, ‘ওহে কপোত-কপোতী, তোমাদের কুজন-গুঞ্জন শেষ হতে যদি দেরি থাকে তাহলে না হয় আমিই চায়ের ব্যবস্থা করি।’

সত্যবতী সলজ্জভাবে মুখের খানিকটা আঁচলের আড়াল দিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল। খানিক পরে ব্যোমকেশ জ্বলন্ত সিগারেট হইতে ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বাহির হইল। অবাক হইয়া বলিলাম, ‘ব্যাপার কি! ইঞ্জিনের মত ধোঁয়া ছাড়ছ যে।’

ব্যোমকেশ একগাল হাসিয়া বলিল, ‘পার্‌মিশান পেয়ে গেছি। আজ থেকে যত ইচ্ছে।’

বুঝিলাম দাম্পত্য-জীবনে কেবল প্রেম থাকিলেই চলে না, কূটবুদ্ধিরও প্রয়োজন।