আমার সত্তা শ্লোক হয়ে

তোমার আমার মধ্যে ক্রমাগত রচিত হচ্ছে মাইল মাইলব্যাপী
তৃষ্ণার্ত জিহ্বার মতো গা ছমছম প্রান্তর। অদূরে
অনেক ক্ষুধার্ত শকুন
অপেক্ষমাণ, আর আমি ওদের দৃষ্টি থেকে,
শবগন্ধী চঞ্চু থেকে নিজেকে আড়াল করে হাঁটছি
ভারি পা টেনে টেনে।
কোথাও এমন কোনো পাখি নেই,
যার গানে দিকগুলি মাধুর্যের আভায় হবে রঙিন,
নেই কোনো ঝরনা, যার ছলছলে হাসি
আমার ক্লান্ত তৃষ্ণার অন্ধকারকে
মুছে ফেলবে নিমেষে।
এখন আমি তোমার দিকে মুখ রেখে এই বেয়াড়া প্রান্তর
পেরুনোর জন্যে বিশ্রামের কোটর
তছনছ করে ফেলেছি,
আমার স্বস্তি ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছে এক দূরন্ত ঈগল,
তার ডানার ঝাপটা আমার নিত্যসঙ্গী।
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে
যার মধ্যে মেদুর অপরাহ্নে
অলৌকিককে গ্রীবা বাড়াতে দেখেছি,
যার মধ্যে শুনেছি সুন্দর ভবিষ্যতের নিঃশ্বাস,
যার কণ্ঠে শুনেছি মৃত্যু-ভোলানো উচ্চারণ?’
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে,
যার চোখ আমার প্রৌঢ়ত্বের অন্তরালে ধ্রুবতারা;
যার ওষ্ঠে সেই নদীর গান শুনি, যাকে আমি
দেখেছিলাম
অনেক আগে, সূর্যোদয় পেরিয়ে
গাছগাছালির ঘ্রাণ নিতে নিতে,
যার বুকের দ্যুতি কখনো আমাকে অন্ধ করে,
কখনোবা চক্ষুষ্মান, যার শরীরের প্রতিটি বাঁকে
সদ্য যুবার মতো মুখ রাখে আমার বাসনা?
এখন আমি আমার একাকিত্বের প্রবাসে
তলোয়ার মাছের মতো
নিয়ত সন্ধানী আর উদাস-নিষ্ঠুর।

মনে পড়ে
ঈষৎ উজ্জ্বল লাল বারান্দায় তুমি দাঁড়ানো-
আমি দেখছি তোমাকে, যেমন বয়স্ক বাজপাখি
চোখ তুলে চাঁদ। তুমি সেই মুহূর্তগুলিকে সাজালে
বিদেশী কবিতার পঙ্‌ক্তিমালায়;
সেই শব্দগুচ্ছে ছিল না কোনো বিদায়ী শ্লোকের বিচ্ছুরণ,
অথচ আমি বিচ্ছেদকে ডানা মেলতে দেখলাম
ঈষৎ উজ্জ্বল দীর্ঘ বারান্দায়
আমার অস্তিত্বে তোমার হাতের অন্তরঙ্গ তাপ সঞ্চয় করে
দৃষ্টিতে তুমিময় ছবি গেঁথে,
পথ চলি, ভালোবাসায় দেখি সত্যের মুখ।

দূর থেকে আমি হাত নাড়ি, তোমার স্মৃতির ভোরে বিভোর
এখন তোমার সান্নিধ্য থেকে নির্বাসিত আমি আর
অন্ধকার কুকুরের মতো
লেহন করছে আমাকে। মাঝে-মধ্যে এই রাত্রি
জন্মান্ধ গায়কের সুরে বেজে ওঠে
আমার শিরায় শিরায়, আশ্চর্য এক ফোয়ারা
আমার ভেতরে তরলিত মণিরত্ন ছড়াতে থাকে,
এবং তোমার অনেকানেক আসা-যাওয়া
স্মৃতির ঝোপঝাড়ে জোনাকি।
‘কখনো নয়, বিলুপ্তি, মনে-না-পড়া, ফিরব না’
ঝরে আমার চোখের পাতায়, স্বপ্নে তোমার শরীর
লতাগুল্মময়, পাতালে ভাসে,
আমাকে ছোঁয় তোমার কণ্ঠস্বর,
আমার সমগ্র সত্তা শ্লোক হয়ে জড়িয়ে যায়
তোমার কণ্ঠস্বরে, আমার হৃদয়
মরীচিকার মতো কাঁপে শূন্যতায়, রুক্ষ শূন্যতায়।