C/O স্যার – আবীর রায়চৌধুরী

C/O Sir – আবীর রায় চৌধুরী

আজ সকাল থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি। সাথে ,থেকে থেকেই চলছে মেঘের ডাকাডাকি। ছুটির দিন রবিবারে , এমন বৃষ্টি কজনের ভালো লাগে জানা নেই ,তবে সুগতর দারুণ লাগে!
ঘন কালো মেঘ ধীরেধীরে ফ্ল্যাটগুলির মাথার উপরে এসে সমস্তটাকে যেন গ্রাস করছে। সাত তলা উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বৃষ্টির ঝরে পরা দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত মাদকতা তৈরি হয়।বৃষ্টির ছাট আটকাতে কাঁচের উইন্ডো টা টেনে দেয় সে।


দুর থেকে চোখে পরা পান্থকলাগাছের পাতাগুলি যেমন , বৃষ্টি ও হাওয়ার দাপটে এলোমেলো হচ্ছে,সুগতর মনও আজ এমন কলাগাছের পাতাগুলির মতই বিক্ষিপ্ত হচ্ছে বারবার নানান চিন্তার দাপটে……..
উইন্ড চ্যামের টুংটাং আওয়াজ,পর্দা দোলা ,আর এই এই অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ও অবসর , সুগতর  কিছুক্ষণ চিন্তা বন্ধ করে দিয়ে ,তাকে অতীতের ফেলে আসা দিন গুলিতে ক্রমশ: নিয়ে আসছে….
সুগত রায় চৌধুরী ,পেশায় ইন্জিনিয়ার। এখন কাজের সুত্রে ব্যাঙ্গালোরে পোষ্টিং। বছর দুই তিন হল এই ফ্লাট টি কিনেছে। এখনও অবিবাহিত। বয়স এই ত্রিশ ছুঁই ছুঁই।


সুগত ভালো ছাত্র ও অধ্যবসায় থাকায় খুব তাড়াতাড়িই ভালো চাকরী , আবাসন সবকিছুর ব্যবস্থা করতে পেরেছে। সারাদিন তো কাজের মধ্যেই কেটে যায়, তবে ইদানিং সে লক্ষ্য করছে পুরোনো অতীতের কথা বা ফেলে আসা দিন গুলি যেন চিন্তা করতে ভালো লাগছে। কেন এমন হচ্ছে? কদিন আগেও তো এমন হতো না।


হয়ত বয়স বাড়ছে বলে! বয়স ও মনের এক অদ্ভুত খেলা চীরকাল চলে। যত বয়স বাড়ে মানুষ হতে থাকে একা , বিশেষত: মন হয়ে যায় একা। বন্ধুরা হয়ে যায়, সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত ,প্রিয়জনরাও একে একে মারা যেতে থাকে। মনের খোরাক মিটবে কি করে? যত বয়স বাড়ে মনের অ্যাডভেঞ্চার বা কিছু খোঁজাও বন্ধ হতে থাকে। জীবনের রহস্য আলগা হতে থাকলে, জীবন সম্পর্কীত কৌতুহল ফুরোতে থাকে। আসলে মন হল কিছুটা নদীর জলের মতন ,খুঁজে বেড়ায় তার চলার পথের ঢালু জমি ,এখন কোনও কিছু না পেয়ে সেই ফেলে আসা দিন গুলির চেনা পথেই একেঁবেঁকে বয়ে যেতে চাইছে। যদিও সুগতর কম না হলেও অনেক বয়স হয়নি ,এখনি শুরু হল এসব!!হয়ত  শুরুর বয়স সে পেয়ে গেছে…
কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সুগতর মনের বায়োস্কোপে একেবারে শুরুর দিন গুলি ভেসে ওঠে। সামনের কাঁচের উইন্ডো তে ব্যাঙ্গালোরের বর্ষনক্লান্ত ছবি যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে  যেতে থাকে ,তার বদলে,ফুটে উঠতে থাকে লালচে প্যান্ট ও সাদা জামা পরা অবস্থায় প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া । দশটাই ছুটির ঘন্টা বাজলেই ছুট্টে একসাথে বেড়িয়ে আসা,কে আগে বেড়োতে পারে সে জন্য তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দরজায় ব্যাগে ব্যাগে টক্কর…এরপর এক এক করে ক্লাস ,একরাশ কষ্ট বুকে রেখে হাইস্কুল, তারপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ,প্রথম চাকরি , প্রথম স্যালারী । পরপর চলতে থাকা স্মৃতি তে যুক্ত হয় প্রথম প্রেম ,সেই গোলাপী বিকেল বেলা,প্রথম হাতে হাত রাখা ও প্রথম দুটি ঠোঁটের মিশে যাওয়া এবং বান্ধবী বিপাশার  বাড়িতে কেউ না থাকার সুযোগে প্রথমবার সঙ্গমে মিলিত হওয়া ,এরপর গোলাপের শুকনো পাপড়ি ঝরার মতন যেমন সকলে ওর জীবন থেকে হারিয়ে যায় ,তেমনি বিপাশাও একদিন ঝরে পরল।
কিন্তু এসব কিছুই শুরু ও শেষ হয়েছিল ।সমাপতন ঘটেছিল ।বহুবার সে অনুভব করেছে উনিশে যাকে মনে ধরেছিল বা তার মন একদম পাগল করেছিল ,উনত্রিশে এসে তার সাথে কথা বলে এমন কিছুই আর মনে হয়নি, কেন যে তখন ওমন হয়েছিল, কে জানে।
কিন্তু এসব ভিন্ন কিছু একটা স্মৃতি রয়ে যায় মনে যেটি ছোট গল্পের মতন “শেষ হয়েও হইল না শেষ “। সুগত অনুভব করে কোন একটি ঘটনা যেন সে আস্বাদ নিতে শুরু করতেই শেষ হয়েছিল। গলায় কাঁটা ফুঁটলে যেমন বারবার কিছু খেলেও ,সেই কাঁটা জানান দেয় সে এখনও যায়নি ,সেইরকম ফিল্ করতে থাকে সুগত ও বারবার চেষ্টা করে কোথায় আটকাচ্ছে সে…
ধীরেধীরে মনে ফুটে ওঠে একটি হলদেটে দোতলা বাড়ি। এরপর এক এক করে ফুটে ওঠে সেই বাড়ির দোতলার ঘরে ওঠার সিঁড়ি ,বেশ ছোট ছোট সিঁড়ি ।হুমম মনে পড়ছে ক্লাস এলেভেন্ । ওই বাড়িটাই ছিল তখন একরাশ সুখের ঠিকানা। শতরঞ্চি পাতা অবস্থায় জনা সতেরো জন ওরা বসত । সামনে থাকত স্কুল ব্যাগ । কথা বলতে বলতে যখন সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ত তখনই ,একটি ধমক দরজার বাইরে থেকে আসত. ” বেশি উড়ো না এই বয়সে  ,পরে গিয়ে লাগবে ,বুঝলে”..
এরমই বলতে বলতে যিনি ঘরে প্রবেশ করতেন ,তিনি সুগতদের প্রিয় বাংলা স্যর। ভাল নাম রোহীত ব্যানার্জী।
তখনও কারো হাসি থামতো না,রতন বলে উঠত “স্যর আজকে খাওয়াবেন?”
“চোওওওওপ!!”
” যা যা পড়া দিয়েছি ,দেখে নে ..একটু পরেই টুইলভের ব্যাচ ঢুকে পরবে”…
রোহীত স্যর! ক্লাস টেন থেকে সুগতরা পড়ত ওনার কাছে । নির্ভেজাল আড্ডা ও পড়ার উচ্চকৌশল মিশিয়ে জমিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কোচিং।
স্যর গল্প বলতেন ,জানাতেন পৃথিবীর আশ্চর্য সব রহস্যের কথা ,। মুগ্ধ হয়ে থাকত সবাই ,তার সেই বলার ভঙ্গিমা তে। এরসাথে চলত ওই বয়সের সাথে মানানসই কিছু ইয়ার্কি । যেমন রুদ্রাণীর সৌম্য কে পছন্দ হয়, স্যর কোনওভাবে সেটা লক্ষ্য করেছিলেন বা জেনেছিলেন। একদিন বিয়ে টিয়ে নিয়ে কথা চলছিল ,স্যর হঠাৎ হেসে বললেন “রুদু তোমার জন্য কোনও সৌম্যকান্তি বর ই আছে,চিন্তা করো না”…
সবাই তো পারলে হাসতে হাসতে পেট ফাটিয়ে ফেলে ।আসলে স্যর কিন্তু ভীষন আধুনিক ছিলেন ,ওই মোটা ফ্রেমের চশলাওয়ালা বা মোটা গোঁফওয়ালা ছিলেন না ,হালকা ফ্রেমের চশমা পরতেন ,আর হাল্কা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ,ডেনিম জিন্স ও গোলগলা টি সার্ট পরতেন । বয়স এই এখন সুগতরই মতন ছিল ,ত্রিশ ছুঁইছুঁই।
সুগতদের ব্যাচে বেশ কিছু মেয়ে বেশ ক্রাস খেত স্যরের প্রতি । হওয়ারই কথা এতসুন্দর দেখতে স্যর ,তেমনি সুন্দর কথা বলেন ,প্রেমে পরাতো সহজাতই। স্যর কিন্তু সবই বুঝতেন , কিন্তু কোনওদিন লিমিট ক্রস করেন নি । স্যর রেলিশ্ করতেন আর হাসতেন ।
তবে দুটি বিষয়ে স্যর বেশ স্ট্রিক্ট ছিলেন ,পড়া না পারলে ভীষণ বকতেন আর একটা হল মাস পরলে মাইনে দিতে দেরী হলে চেয়ে নিতেন ,অনেকসময় বাড়িতেও চলে আসতেন । তবে তিনি বলতেন দেখ আমি লোভী নই ,তবে এটাই তো আমার রুজিরুটি ,তাই মাইনে মারার চেষ্টা করো না,তাহলে কিন্তু ছাড়ব না ।এটাও সত্যি ওই অতবড় বাড়িতে স্যর একায় থাকতেন। সুগতদের পড়ানোর বছর চার পাঁচ আগে স্যর বাবা ও মা কে হারান। আর আত্মীয়স্বজন কাউকে আসতে সুগতরা দেখেনি , খারাপ সময়ে সবাই দুরে চলে যায় ,হয়ত স্যরেরও তাই হয়েছিল। অথবা হয়ত শুধু টিউশন করেন ,চাকরী পাননি তাই সবার থেকে দূরে রাখতেন,বলা তো যায়না কে কিভাবে অকস্মাৎ অপমান করে দেয়। কিন্তু সুগত রা ছিল স্যরের সবচেয়ে আপনার জন,হয়ত স্যর জানতেন এরা ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় দিতে পারে ,সভ্য মানুষের অসভ্য দংশন নয় মানে বেকার টেকার বলে ডাকা আরকি!
যাই হোক এভাবেই খুশি খুশি তে চলছিল ক্লাস ইলেভেন ,সমস্ত পড়ার ক্লান্তি যেন, এখানে এসেই শেষ হতো।
সেদিনও মঙ্গলবার ,ঘুম থেকে উঠে সুগত ভেবে খুশি হয়,আজ সন্ধ্যায় রোহীত স্যরের ব্যাচ আছে!!
সমস্ত পড়া করে দুপুরে খেয়ে যখন ঘুমাবে ঠিক করেছে ,এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বাবা বললেন “সুগত, সর্বনাশ! হয়েছে !!”


“কি হয়েছে বাবা ?”


” তোদের রোহীত স্যর ,কাল গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল, আজ সকালে , হাসপাতালে মারা গেছে!!!
একমুহুর্তে সব যেন ওলটপালট হয়ে যায় ।কখন অজান্তেই কিশোর সুগতর চোখ বেয়ে নেমে আসে এক বিচ্ছেদের বেদনাঘন অশ্রু…..স্যর নেই ইইই!!!!


সন্ধ্যায়, বৃষ্টি মাথায় করে সবাই জড় হয় স্যরের বাড়ির সামনে ,একটি খাটে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় ঘুমিয়ে আছেন রোহীত স্যর।


অনেকেরই‌ সজল চোখ। সৌমেনের মা চোখে জল এনে বলে আহা! বাপ মা মরা ছেলে টা অযত্নেই চলে গেল । সুগতরা কোনও রকমে কান্না আটকে স্যরের পায়ে ফুল রেখে শেষ নমস্কার জানালো । ধীরেধীরে স্যর কে কাঁধে নিয়ে কিছুজন দুরে আরও দুরে, একবারেই অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। রোহীত স্যর এর ব্যচ শেষ না হতেই সমাপ্ত হল ।সুগতর মনে আছে সে মাসের টাকাটা দেওয়া হয়নি‌ এবং আর দেওয়া হলনা। কোথায় হারিয়ে গেলেন অতপ্রাণচঞ্চল স্যর?………

তারস্বরে বারবার কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে ,চেতনা ফিরে পেল সুগত। কোন চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল সে, চোখের সামনে পুনরায় ফুটে উঠেছে ব্যাঙ্গালোরের বৃষ্টিভেজা সকাল বেলা। চোখ রগড়ে দরজা খুলে দেখল লালচে ইউনিফর্ম পরিহিতা জ্যোমাটো গার্ল দাঁড়িয়ে।


“Sir your order”


হুমম !বলে খাবারের পার্সেলটা হাতে নিল সুগত।


Sir ,pls give us rate and bye sir”


হুমম ,ok ,বলে দরজা বন্ধ করে দেয় সুগত।


স্নান সেরে খেয়ে নিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে সে।


পরেরদিন “bloody khuni monday” শুরু ,মানে চাকরী করেন যারা তাদের কাছে সোমবার হল সবচেয়ে অশুভ একটি দিন , রবিবারের অবসর না কাটতেই চলে আসে।


শুরু হয় আবারও একই জীবন ,একই রেস্ ,নুতন প্রজেক্ট নূতন ডিলিংস্…হারিয়ে যেতে থাকে কোনও রবিবারে down the memory lane এ হাঁটা দিন গুলোর কথা।
অসংখ্য রবিবার আসে যায় ,সুগত কাজে আরও ব্যস্ত হতে থাকে ।
হঠাৎই একদিন ওয়েস্টবেঙ্গল এ কিছু কাজ করবার ফুরসৎ পায় সে।
“যাক বহুদিন পর , বেঙ্গল এ যাবো ” ভাবে সুগত। সেই মোতাবেক প্লেনের টিকিট রিজার্ভ করতে বসে সে । করতে করতে সুগত ভাবে ” আচ্ছা এবার একটু অন্যভাবে যাওয়া যাক না!.. ট্রেনে? না সেতো এখন বন্ধ ,ও না না খোলা আছে , কিন্তু.. ধুরর নিজেই ড্রাইভ করে যাব “


সোমবার এক ঝকঝকে দিনে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে ,সাদা চেক জামা ইন করে ,নিজের কালো সুইফট্ ডিজায়্যারটা নিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ড্রাইভে মানে সো লং ড্রাইভে বেরোলো সুগত। গুগল্ ম্যাপ ঠিক করে নিয়েছে , কয়েকটা হোটেলও বুক করে নিয়েছে ।
বেশ ভালোভাবেই গাড়ি চালিয়ে প্রায় দুহাজার কি‌.মি পথ অতিক্রম করে ,একবার গাড়ির চাকা পাল্টিয়ে ভুবনেশ্বর হয়ে যখন বাঙলায় যখন ঢুকল তখন দুপুর পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখনও অনেকটা পথের পর ওঁর বাড়ি । কোলকাতা থেকে বেশ দূরে , মফস্বলে ওঁর বাড়ি।
মাঝে একজায়গায় দাঁড় করিয়ে একটু চা খেয়ে নিতে নিতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল । কোনওরকমে গাঁড়িতে উঠে স্টার্ট দিল । ধীরে ধীরে দশটার কাছাকাছি তার মফস্বল পাড়া গাঁ এর কাছাকাছি সে পৌছালো। বৃষ্টি এখানেও বেশ চলছে । সাথে বিদ্যুৎ চমক ও বাজ ও পড়ছে ।
উইপার টা বেশ সজোরে চলতে চলতে যেভাবে বৃষ্টির জল মুছে দিচ্ছে ,তেমনভাবেই ছোটবেলার পাড়ার স্মৃতিগুলো আরও পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে সুগতর। মুখে একটা মিষ্টি হাসি এনে রিমঝিম গিরে সাওন” গান টা গাইতে গাইতে ওদের পাড়ার কাছাকাছি আসতেই ওর ইচ্ছে হল একটা সিগারেট খাওয়ার । চলন্ত অবস্থায় সিগারেট ধরাতে সবে যাবে,এমন সময় গাড়ির সামনে একটা কুকুর জাতীয় পশু চলে আসায় অতর্কিতে বসে ব্রেক কষতে চাই কিন্তু ,ঠিক মতো সামলাতে না পারায় গাড়িটা প্রচন্ড শব্দ করে ঘুরে গিয়ে অনেকটা এগিয়ে বেশ জোরে একটি বড় গাছে গিয়ে ধাক্কা দেয় ও থেমে যায় এবং সাথে সাথে একটি বড় হর্ণ বেজে ওঠে। এরপর সব ব্ল্যাকআউট!!!!!!!!!!
….মিনিট দশেক পর সুগত যখন চোখ খোলে তখন বোঝে তার মাথাটা স্টিয়ারিং এর ওপর রয়েছে আর বুকে বেশ! লেগেছে ।


চোখ রগড়ে গাড়ির আলো জ্বালিয়ে দেখল গাড়ির সামনে টা দুমড়েছে। তবে ওর বেক্তিগত চোট তেমন অনুভূত হলো  না।


বৃষ্টি টা এখন বেশ ধরেছে। গাড়ির কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে টা বেশ দেখা যাচ্ছে । ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ও ব্যাঙের কলতান শুরু হয়েছে। জায়গা টা ভালোভাবে ঠাওর করতে কাঁচ টা নামাতেই সুগত লক্ষ করে সে  একটি বাড়ির সামনে রয়েছে । আশেপাশে আর কোনও বাড়ি নেই। বাড়িটি দোতলা।দূরের একটি স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোতে এই জনাকীর্ণ  বাড়িটির দৈন্যদশা বেশ বোঝা যাচ্ছে । পলেস্তারা খসে পড়েছে , অশ্বত্থ এর চারা আরো আগাছা ঘিরে ধরেছে।
” আরে এটা তো রোহীত স্যর এর বাড়ি…


কি অবস্থা হয়েছে!!”…মনে মনে বলল সুগত।


এরপর গাড়ি থেকে নেমে সেই বাড়িটির দিকে এগিয়ে চলল সুগত ।


মাঠের জল কাদা পার করে যখন বাড়ির সামনে এল তখন আবার বৃষ্টি শুরু হল।
এ বাড়ির আনাচে কানাচে সবই সুগতর চেনা। এক দৌড়ে বাড়িটির রোয়াকে উঠে এল সে।
বুকের ব্যাথা টা এখনও আছে সুগতর ,একটু আড়মোড়া ভেঙে নিয়ে ,সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো । ধুমো গুলো গোল গোল করে ছাড়তে ছাড়তে সেই রবিবারের কথা গুলি ভাবতে লাগল । পনের ষোলো বছরে কি অবস্থা বাড়িটার । পলেস্তারা খোসে,হলুদ রং হারিয়ে একটি বিবর্ণ রূপ নিয়েছে । রোয়াকের আশপাশ দিয়ে ঘণ আগাছার জঙ্গল । সবচেয়ে বড় কথা আশেপাশে বাড়িও তেমন নেই ,ঠিক যেমন তখন ছিল । মফস্বল জন্যই হয়তো নেই , শহর হলে কবে আবাসনের জঙ্গলে ভরে যেত। এইসব সাঁতপাঁচ যখন যে ভাবছে ,তখনই মনে হল কোথাও দুর থেকে কিছু জনের কলরব শোনা যাচ্ছে। আশেপাশে তো তেমন বাড়ি নেই তাহলে?


বর্ষাকালের বাতাস নানা দিক থেকে বইছে ,ফলে কোন দিক থেকে আসছে ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না সুগত। রোয়াকের সিড়ি বেয়ে নেমে বাড়ির  উত্তর – পশ্চিমের  দিকে তাকাতেই মনে হল শব্দের জোর আরও বেড়ে গেছে । কিন্তু ওদিকে তো পুরো জঙ্গল। কিভাবে পার হয়ে ওখানে যাবে ? সিগারেট টা ফেলে দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওদিকে………


হঠাৎই একসাথে বেশ কয়েকজনের ” হা হা হা হা হা হা” এরম হাসির আওয়াজ পেয়ে সুগতর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল ।


সকৌতূহলে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় করে সেই আগাছার জঙ্গল ভেদ করে বাড়ির ভেতর কার দিকে আসতেই দেখল সেই টিনের দরজা টা ভেঙে পড়ে আছে ,সেটি পার করে উঠোণে এসে দাঁড়ালো । কামিনী ফুলের গন্ধে চারদিক ভরে আছে ,পা টিপে টিপে পিছল বাঁচিয়েই‌ সে উঠোনে এসছে।
নিঃঝুম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি টি। স্যর চলে যাওয়ার পর এভাবেই দাঁড়িয়ে । সাপখোপ ,ব্যাঙ আর মশার রাজত্ব হয়েছে ।

কিন্তু আওয়াজ আসছিল কোথা থেকে?


কিন্ত কিছুক্ষণ থেকেও  আর কোনও আওয়াজ সে পেলনা। নীচের ঘরগুলির দিকে টর্চ ফেলে দেখে নিয়ে ফিরে আসতে যাবে ,তখন আবারও সেই সমবেত হাসি শুনতে পেল , অল্পবয়সী কিশোর কিশোরী দেরই হাসি ।


চকিতে! উপরে তাকাতে সুগত দেখল দোতলার সিড়ি ও‌ লম্বা বারান্দার মাঝের তাদের পড়ানোর ঘরটা থেকে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে । আর মনে হচ্ছে এখানে থেকেই আওয়াজটা আসছে। উঠোন থেকেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। উঠতে গিয়ে পুরোণো অভ্যাসে  সুগতর মনে পরে সিড়ি গুলো ভীষণ খাঁড়া ও ছোট ,ফলে সাবধানে উঠতে থাকে ,যত ওঠে তত ওদের সমবেত কন্ঠস্বর স্পষ্ট হতে থাকে…
” রোজ কত কী ঘটে যাহা-তাহা —

এমন কেন সত্যি হয় না, আহা।

ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,

শুনত যারা অবাক হত সবে,

দাদা বলত, ……”

 “বীরপুরুষ পড়ছে ! কিন্তু এখানে এখন কারা পড়ছে ? আর যদি কেউ থাকে তাহলে এত জঙ্গল কেন?”…এসব প্রশ্ন ঘুরতে থাকে সুগতর মাথায় । সিড়ি পার করে যখন ওপরে ওঠে তখন আবার সব শান্ত । লম্বা বারান্দা ঘন অন্ধকার তবে ,সিড়ি ও বারান্দার মাঝের ঘরটি থেকে তখনও আলো আসছে । সুগত এগিয়ে দেখে ঘরটির কাঠের দরজা হাল্কা ভেজানো। আশপাশ এতটাই নির্জন যে সুগত নি্জের নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছিল । সিড়ি দিয়ে উঠতে হাফিয়ে গিয়েছিল।
ধীরে ধীরে সে দরজার কাছে গেল এরপর হাতটা দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে সে দেখল শতরঞ্চিতে বসে আছে ষোলো সতেরজন তরূণ তরূনী ।সবাই বইয়ের পাতায় নিমগ্ন । যেন ওকে কেউ দেখেয়নি ,জানেও না সুগত এসেছে ,এরা কারা? এবার  ওদের একটু ভাল ভাবে প্রতক্ষ করতে গিয়ে সুগতর পিঠ দিয়ে ঠান্ডা হিমস্রোত বইতে লাগলো।মনে হল সমস্ত দেহে যেন কারেন্ট বইছে।
সুগত দেখল যারা বসে আছে ,সবাই ওর চেনা.. সৌম্য ,শাওনি , রুদ্রাণী , নবনীতা , রিয়া ,সন্দীপ ,রতন ….এরাই তো ক্লাস ইলেভেনের ব্যাচ। আর সবচেয়ে অদ্ভুত হল এদের সকলের মধ্যে হাল্কা ছাইছাই রঙের জামা পরে ওদেরই বয়সী সুগত নিজেই বসে আছে । তারও মুখ বইয়ের পাতায় নিমগ্ন।
এরপর সবাই একলয়ে ধীরেধীরে সুগতর দিকে তাকালো !!


বিস্ফারিত চোখে ও অকস্মাৎ এই অভূতপূর্ব ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুগত চিৎকার করতে গিয়েও দেখল গলায় স্বর হারিয়ে ছে সে !!..


এমন সময় তীব্র বাজ পরার সাথে সাথে সুগত যেন চেতনা ফিরে পেল ও নিজেকে একটি অন্ধকার ঘরে আবিষ্কার করল।
তাহলে এতক্ষণ কি দেখল সে????

একটু ধাতস্থ হয়ে মোবাইলে জ্বালতে গিয়ে দেখল , চার্জের অভাবে সুইচড্ অফ হয়ে গেছে।
কোনওভাবে সেখান থেকে বেড়িয়ে সিড়ির দিকে সব পা বাড়িয়েছে তৎক্ষণাৎ শুনল তার অতিপরিচিত কন্ঠস্বর…

” সুগত আমার টাকাটা এনেছিস?”

পেছনে ফিরতে সুগতর মনেহল বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে , হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকানোয় সে দেখল ঘাড় বাঁকা রক্তাত্ব অবস্থায় স্বয়ং রোহীত স্যর দাঁড়িয়ে ,আর সেই রক্ত মাখা হাত টি সুগতর দিকে বাঁড়িয়ে দিয়েছে।ওরে বাবাগো…..বলে তারস্বরে চিৎকার করে কোনরকমে সিড়ি দিয়ে নেমে সুগত পালাতে থাকে। কিন্তু সহসা ঘটনায় সে বারংবার বেরোনোর পথ ভুল করতে থাকে ,শেষ পর্যন্ত পাঁচিল টপকে এক ছুটে গাড়ির সামনে এসে এক ঝটকায় গাড়ির দরজা খুলে দেখে তারই মতন সাদা চেক জামা পরে কেও স্টিয়ারিং এ মাথা গুঁজে রয়েছে।
” এএ কে আপনি ,সরুণ বলছি ” বলে সেই লোকের হাত ধরে টান মারতেই লোকটি পরে যায় ,…
স্টিট ল্যাম্পের আলোয় সুগত দেখে পরে যাওয়া মানুষ টি আর কেউ নয় ,সেটি তারই দেহ!!!!!!!!!
“এটা কি হচ্ছে আমার সাথে” বলে চিৎকার করে ওঠে সে।
এমন সময় রাস্তার ওপার থেকে সে শুনতে পায় ..
” বৃষ্টি তে ভিজিস না সুগত ,এদিকে আয়..
তোর কাছে থেকে মাইনা নেওয়া বা তোর মাইনা দেওয়া ,দুইয়েরই প্রয়োজন আমরা দুজনায় হারিয়েছি”…
সুগত লক্ষ্য করে দুরে ছাতা হাতে সেই ছোট্ট বেলার সৌম্যদর্শন রোহীত স্যর দাঁড়িয়ে। কোনও ‌বিকৃতী আর নেই…..

বৃষ্টি র দাপট আরও বেড়ে চলেছে। সুগত দৌড়ালো স্যর এর দিকে…….।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *