২. গভীর নির্জন পথের উলটো বাঁকে

গভীর নির্জন পথের উলটো বাঁকে

সত্যিকারের মনের মানুষকে যারা খোঁজে তারা নিশ্চয়ই প্রথমে খুঁজতে চায় সেই গভীর নির্জন পথ। কিন্তু আমি যখন মনের মানুষের পথসন্ধানী মানুষগুলিকে গ্রামে গ্রামে খুঁজে বেড়াতাম তখন আমার পথ ভরা থাকত অজস্র মানুষে। তারা পদে পদে সামনে এসে দাঁড়াত। বিপুল তাদের জিজ্ঞাসা এবং সবই ব্যক্তিগত। ‘আপনি কোথা থেকে আসছেন?’ ‘আপনি কার বাড়ি যাবেন?’ ‘আপনি যেসব কথা জানতে চাইছেন তা বলব কেন? তাতে আমাদের কী লাভ?’ ‘এ গাঁয়ে কেউ কি আপনাকে চেনে? তবে আপনারে বিশ্বাস করব কেনে?’ ‘জানেন, দু বছর আগে গরমেন্ট থেকে একটা লোক এয়েলো গাঁয়ে কটা ঢেঁকি আছে তাই গুনতে। গুনেগেঁথে তো চলে গেল, তার পরেই হল কঠিন ডাকাতি।’

কঠিন ডাকাতি? প্রথম দিন বিশেষণটা হজম করতে পারিনি। পরে দেখলাম মুর্শিদাবাদ জেলার বাগড়ী অঞ্চলে কঠিন শব্দটা সুন্দর বা ভয়ংকর অর্থে চলে। বেলডাঙার ইসানালি সেবারকার বিধ্বংসী বন্যার বিবরণ দিতে গিয়ে বললে: ‘বাবু আমাদের সব দিগরে এবারে হয়েছিল কঠিন বন্যা।’ কুমীরদহের শিবশেখরের বাড়িতে মচ্ছবের খিচুড়ি খেতে খেতে একজন বলে উঠলে আমাকে, ‘খুব কঠিন খিচুড়ি, না কি কহেন?’

কিন্তু সে কথা থাক। আপাতত কঠিন থেকে সরে আসি। হচ্ছিল গ্রামের মানুষের সন্দেহ বাতিকের কথা। তাদের এত যে প্রশ্ন, এত অবিশ্বাস, অথচ আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলেই অদ্ভুত নির্বিকার জবাব মিলবে।

সেবার যাচ্ছি সাতগেছিয়ার গ্রামের রাস্তা ধরে। দু পাশে আল-বাঁধা ভুঁই, মাঝখানে তৈরি-হয়ে-হাওয়া সরু পথ। শস্যের টাটকা ঘ্রাণ এবং গোবরের। পাঁচনি হাতে চাষা থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। মাঠের মাঝখানে অদ্ভুত এক গাছতলায় আখের রস জ্বাল হচ্ছে। প্রশ্নটা উঠল আমার স্ত্রীর মনে: ‘এটা কী গাছ?’ যে রস জ্বাল দিচ্ছিল তাকে জিজ্ঞেস করতেই আনমনে উদাসীন উত্তর এল: ‘ওই গাছটা? হ্যাঁগো তোমরা জান নাকিন কী গাছ ওটা?’ খ্যাখ্যা করে নিজেই খানিকটা হেসে বললে: ‘ওটা তাহলে কী-জানি গাছ কিংবা না-জানি গাছ।’ এর পরেই এক মর্মভেদী নগ্ন প্রশ্ন: ‘তা আপনাদের কোথা থেকে আসা হচ্ছে? কোথায় যাওয়া হবে? সঙ্গে কি আপনার নিজের পরিবার না আনখা মেয়েছেলে?’

অপমানিত স্ত্রীকে নিমেষে চোখের ভ্রূকুটিতে সামলে আমি ঠিকানা পেয়ে যাই এক নির্জন আখড়ার। ঠারেঠোরে আনখা মেয়েছেলের ইঙ্গিত বুঝতে আমার দেরি হয় না। আমার মনে পড়ে যায় অন্ধ এলা ফকিরের সতর্কবাণী: ‘বাবু, তুমি এ পথে নেমেছ, খুব আপ্ত-সাবধান থাকবা। এ লাইনে হরেক মানুষ। সব বাউল-বৈরাগী উদাসীন সেজে আছে। সবাই কি তাই? শোনো তুমি, শুনে রাখো। বৈরেগী পাঁচ রকম—চ্যাটান্তি, প্যাটান্তি, মালাটেপা, ওষুধবেচা আর অ্যালাখ্যাপা। কিছু বুঝলে?’

কী করে বুঝব? শহুরে সংস্কৃতির মার্জিত মানুষ। তার ওপরে মহাবিদ্যালয়ে পুঁথিপড়া জ্ঞানদান করে পোক্ত। আমার অসহায় মুখখানা অন্ধ এলা ফকির ভাগ্যিস দেখে নি। একটু তদগত হেসে এলা বলেছিল: ‘শোনো তোমাকে বুঝিয়ে দিই। বাউল-বৈরাগীর মধ্যে বেশির ভাগ প্যাটান্তি মানে পেটের ধান্দায় ভেক নিয়েছে। ভজন নেই, ভোজনে দড়। খাওয়া ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আর মালাটেপা মানে ভেতরে ঢুঁঢুঁ, শুধু চোখ বুজে তসবি মালা টিপছে। সাবধান। ওষুধবেচা বৈরাগী কেমন জান? কতকগুলো জড়িবুটি নিদেন-পথ্য জানে, ওই বেচে খায়। সাধনভজন জানে না। আর অ্যালাখ্যাপা মানে গেঁজেল। সাধনভজনের চেয়ে ছিলিমের দিকে ঝোঁক। সব ঊর্ধ্বচোখ অধোমুখ, হাসি-হাসি ভাব। এদের যতটা পারো এড়িয়ে চলবা।’

‘আর চ্যাটান্তি?’ আমি খেয়াল রেখেছি এলা ফকির প্রথমটা প্রথমে বলেনি।

এলা রুষে উঠল, ‘অশৈল কথাটা তুমি সেই উচ্চারণ করলে? ও কথাটা খারাপ। খুব খারাপ। শোনো তোমাকে বলি, ও কথাটার মানে যারা ধম্মের নামে মেয়েমানুষ ভোগ করে কেবল। বাবা, খুব সাবধানে থাকবা।’

: এত সব চিনব কী করে। দেখলেই তো বোঝা যায় না।

: সব বুঝবে। লক্ষণে ধরা পড়বে। তিনিই চিনিয়ে দেবেন। ওই যে খারাপ কথাটা বললে, ওদের আখড়ায় দেখবে শুধুই মেয়েছেলে, আনখা মেয়েছেলে। তাদের মুখগুলো দেখবে নিপাট ভালমানুষের পারা।

সেই আনখা মেয়েছেলে কথাটা এলা ফকিরের পর দ্বিতীয়বার শুনলাম এই সাতগেছিয়ার গ্রামে। সেদিন আর নয়। পরের রবিবার আবার হাজির হলাম। এবার একা। রস জ্বাল দেবার কারিগরই এবারে হদিশ দিলে: ‘সোজা দুখান মাঠ ভাঙলে পাবেন একখানা তেঁতুল গাছ। ওইটে নিশানা। বাস, ডান দিকে পোয়াটাক হাঁটলেই নদী। নদীর পরপারে আখড়া।’

ধারাগোলের নির্দেশ মেনে একেবারে সটান পৌঁছে যাই আখড়ার চত্বরে। তকতকে উঠোনে যত না গোলা পায়রা তত ছেলেমেয়ে। নানা বয়সী। সুনসান গ্রীষ্মের দুপুর। দক্ষিণ চরের আখড়ায় গরম বাতাস মারছে ঝাপট। আমি এদিক-ওদিক খানিক ঘুরে একটা একানে দাওয়ায় উঠে জানালা দিয়ে ঘরে উঁকি মেরেছি। সর্বনাশ, এ কী দৃশ্য? দেখি এক মাঝবয়সী মানুষের দুই হাঁটুতে বসে দুই নারী। লোকটির টেরিবাগানো দিব্যি বাবরি। সাদা মেরজাই সাদা ধুতি। মুখে নিশ্চয়ই গাঁজার বিড়ি। তাতে অগ্নিসংযোগ করবার জন্যে মধুর হাতাহাতি করছে তার দুই জানুর ওপর বসে দুই সেবাদাসী। মানুষটির আনন বহুদর্শী ঝুনো। ঠোঁটে হাসি। চোখ বন্ধ। বাপরে, এ যে কালীঘাটের জ্যান্ত পট! অনিবার্যভাবে এলা ফকিরের বলা সেই অশৈল শব্দটা মনে খেলে গেল। আর মনে পড়ল: ‘সাবধান, আপ্ত-সাবধান থাকবা।’

আর কি দাওয়ায় থাকতে আছে? একছুটে একেবারে বাগানে। সেখানে আবার আরেক আশ্চর্য। ভরা জ্যৈষ্ঠের অনেক আমগাছে ফলে আছে অজস্র আম, পুরুষ্ট নধর। সবুজ পাতা আর হলুদ আমের দোলাচল। অভিনব দৃশ্য বইকী, বিশেষত হালের গ্রাম বাংলায়। কেননা এখন ফাগুন চোতে আমের গুটি পুরুষ্টু হলেই ভেন্ডাররা গাছ ভেঙে সব কাঁচা আম চালান করে দেয়। অথচ এখানে বাবাজির আখড়ার বাগানে পাকা আম তো কেউ নেয় না।

আমার ঊধ্বচরী চাহনি দেখে এগিয়ে এল এক সেবাদাসী। বলল: পাকা আম দেখে অবাক হচ্ছ? এর মূলে আমাদের গুরুদেবের মহিমে। শোনবা সেই বিত্তান্ত? বছর পাঁচেক আগে আমাদের এই আখড়ার বাগানে এক ভেন্ডার এয়েলো আম চুরি করতে। তা আমাদের গুরু-ঠাকুরের মহিমে তো জানত না বেটা। যেই আমে হাত দিয়েছে অমনি হাত গেছে এটকে। তখন তালকানা পাখির মতো সারারাত ঝটর পটর ঝটর পটর।

: বুঝেছি। এবার গল্পের বাকিটুকু বলি। তারপর তো সারারাত সেই ঝটর পটর কিন্তু হাত আর ছাড়ে না। এদিকে তোমাদের গুরুঠাকুর ধ্যানবলে সবই জেনেছিলেন। সকাল হতে সকলকে ডেকে এনে মন্ত্রবলে চোরকে ছাড়ালেন। চোর বেটা গুরুর পা চেপে ধরে বললে: ‘তোমার মহিমে আগে বুঝিনি বাবাঠাকুর। তা হলে কি এই গুখোরি কাজ করি? আমাকে বাঁচান বাবা’। সেই থেকে এ বাগানের ফল-ফুলারিতে আর কেউ হাত দেয় না। কী ঠিক বলেছি না?

‘এক্কেবারে ঠিক’, বিস্মিত সেবাদাসী সম্রম নিয়ে এগিয়ে এসে আমাকে অনেকক্ষণ নিরিখ করে বলল: তুমি বাবা কোন গুরুঠাকুর? কেমন করে জানলে?

আমি বললাম: ঠিক এই গপ্পো আমি পাঁচটা আখড়ায় শুনেছি তো? ব্যাপার কী জান? ওই চোরটা ছিল সাজানো আর তোমাদের গুরুঠাকুর আসলে হলেন বাংলার জাতীয় পক্ষী। অর্থাৎ যাকে বলে ঘুঘু।

সেখান থেকে সুড়ৎ করে কেটে পড়ে আখড়া সংলগ্ন চায়ের দোকানে বসি এবং সংগ্রহ করি গুরুঠাকুরের উদাহরণীয় জীবনী। আখড়া সংলগ্ন গ্রামেই শ্রীমৎ-এর আদি বাস্তু। জাতে সদগোপ। বাপ ছিল নাংলা চাষা। বৃত্তি পাশ দিয়ে শ্রীমান ভিড়ে যান পাটুলীর এক সহজিয়া আখড়ায়। সেই থেকে সহজানন্দে আছেন। বাপ বিয়ে দিয়ে ঘরে টেনেছিল। বউ কেন যে গলায় দড়ি দিল কেউ জানে না। ইনি ততদিনে বৈরাগ্য নিয়ে এখানে থানা গড়েছেন। ভারতবর্ষ সেকুলার দেশ। এখানে সাধন-ভজনের কোনও বাধা নেই। ধর্ম আর কর্ম। তার পরে ধর্ম থেকে ধাম অর্থাৎ এই আখড়া, আর কর্ম থেকে কাম। এমন মান্যমান রাতস্মরণীয় ব্যক্তির কাহিনী অমৃত সমান। সে সব শুনতে শুনতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সাঁঝবাতি জ্বাললেন সেবাদাসীরা। একবার খড়ম পরে উঠোনে ঘুরে গেলেন শ্রীমৎ। আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি এক পরম পাপী আর তিনি এক মহান মিনি সাঁইবাবা।

কিন্তু আমার মনে এ কথা না এসে পারল না যে এত সেবাদাসী কোথা থেকে আসে। আগে ভাবিনি তবু জবাবটা সঙ্গে সঙ্গে মনে এল। এ পোড়া দেশে বৈধব্যেরও শেষ নেই, সেবাদাসীরও নেই কমতি। গ্রামদেশের গরিব গলগ্রহ নিঃসন্তান বিধবা কি কম? ভাসুর-দেওরের উটকো কামাগ্নি থেকে বাঁচতে কেমন করে এরা গুরুবরণ করে, জুটে যায় আখড়ায়, কারা তাদের টানে, ফুসলোয়, উপহার দেয় যৌনরোগ, সে সব কিছুর সামাজিক ইতিহাস কে লেখে? সঙ্গে সঙ্গে রুকুনপুরের মদনগোপালের মেলায় দেখা একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে মনে। সেবারে কিশোরদাস আর তার বউ রূপকুমারী ঘুরে ঘুরে বাউল গান গাইছিল। হঠাৎ ‘ও মাগো’ বলে পেট খামচে মাটিতে বসে পড়ে কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে লাগল রূপকুমারী। এমনি চটকদার রূপসী মেয়ে। ব্যথায় মুখখানা করুণ। ছুটে যেতে আমাকে বললে: বাবুগো, আর বাঁচবনি। না খেয়ে খেয়ে আমার পেটে গ্যাসটিক। যম যন্তন্না।

সেই রূপকুমারীকে আবার দেখি অগ্রদ্বীপের মেলায় কদম গাছতলায় ভিক্ষে চাইছে। কোটরাগত চোখ, মলিন চাহনি, রোগা, প্রেতের মতো চেহারা। একজন চেনা বৈরাগী কানে কানে বলল: বাবু, ঠিকই ধরেছেন। এ সেই রূপকুমারী। কী গান গাইত মনে আছে? রূপের কী চেকনাই বাহার ছিল? সব গেছে।

: কী হয়েছে ওর? কী রোগ?

ফিসফিস করে লোকটা বলল: খারাপ রোগ। কত বৈরেগী ওকে শুষে খেয়েছে জানেন? ও তো ঘরের বউ ছিল। বিধবা হতে কিশোরদাস ওকে ফুসলে বার করেছিল।

: এর কোনও প্রতিকার নেই?

: প্রতিকার আবার কী? এরা তো আপ্ত ইচ্ছায় এ পথে এসেছে। প্রথমে বোঝেনি। যখন বোঝে তখন সমাজে জায়গা কই আর। আপনাকে বলছি বাবু, এ আমি অনেক দেখলাম, বাউলবৈরেগীর যৌবন টেকে না। এদের মরণ গাঁজায় আর কামে।

আখড়া সংলগ্ন চা অলাও প্রায় একই কথা বলল, ‘এত যে দেখছেন সেবাদাসী তার মধ্যে ভক্তিমতী আর কজন? বেশির ভাগ আনখা মেয়েছেলে। কোথা থেকে জুটে যায়। সব উসকো আড়কাঠিতে নিয়ে আসে। আখড়া কে আখড়া এই বিত্তান্ত। নিজেরা সব নষ্ট হয়েছে, আবার এরাই গেরস্তের বউ ঝিদের ধম্মের নামে এখানে এনে নষ্ট করবে। এখানে বসে কত দেখলাম।’

: গ্রামের লোকেরা প্রতিবাদ করে না?

: অজ্ঞ মূর্খ সব চাষার বাস। তায় বেশির ভাগ মুসলমান। কী বলবে? ধম্ম নিয়ে কথা বললে রায়ট বেধে যাবে।

ফেরার পথে গ্রামের মুখে অন্ধকারে আমার মুখে ঝলসে উঠল তীব্র এক টর্চের আলো। ‘কে? কে যায়?’ এটাও গ্রাম দেশের রীতি। টর্চধারী যুবক আমার পরিচয় জানতে চাইল। তারপরে ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘ও, মহাপুরুষ দর্শনে গিয়েছিলেন?’

তবে যে চা অলা বলল প্রতিবাদ নেই। ভাল লাগল প্রতিবাদী যুবকের বিদ্রূপ। সে বলে চলল, ‘তা আপনাকে তো শিক্ষিত শহুরে লোক বলেই মনে হচ্ছে, এখানে কেন? দাদা কি একেবারে ফেঁসে গেছেন? তো মহাপুরুষ কত টাকা চাইল? দুশো না আড়াইশো?’

চমকে গিয়ে বলতেই হল, ‘মানে? উনি কি দীক্ষা দিতে অত টাকা নেন?’

ততক্ষণে আধোরহস্যের মায়া জাগিয়ে কোদালে-কুড়লে মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো একটু একটু দেখা দিচ্ছে। অচেনা যুবকটির মুখে লেখাপড়ার ছাপ স্পষ্ট। অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার কথা শুনে প্রথমে মনে হচ্ছিল ন্যাকা বোষ্টমের মতো। এখন বুঝেছি কিস্যু জানেন না মহাপুরুষ সম্পর্কে। জানেন না, ওটা একটা অ্যাবরশন সেন্টার?’

যেন মুখে একটা চাবুক পড়ল। এবারে বুঝলাম সাতগেছিয়ার পথে গুড়অলা কেন সেদিন আমার স্ত্রীকে মনে করেছিল আনখা মেয়েছেলে। ছেলেটি গড়গড় করে বলে গেল; গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরলে এমন অ্যাবরশন সেন্টার মাঝে মাঝে পাবেন। তবে বাইরে থেকে বোঝা শক্ত। ওপরে ধর্মের মোড়ক। নামগান কেত্তন হচ্ছে। মেলা মচ্ছব, দিবসী, পাব্বন সব চলছে। নাটের গুরু একজন আছেন। পতিহারার পতি ফিরে আসবে, অন্ধ পাবে দৃষ্টি, বোবায় কথা বলবে, বাঁজা মেয়ের সন্তান হবে, এ সব হচ্ছে প্রকাশ্য শ্লোগান। আসলে এ সব আখড়া সেমি-ব্রথেল। আর গ্রাম দেশে কোনও মেয়ে যদি হঠাৎ প্রেগন্যান্ট হয় তবে তাদের বাপ-মা এইসব আখড়ায় মাসখানেক রেখে যায়। গ্রামের লোকদের বলে, মেয়ে গেছে গুরুসেবা দিতে। তারপর মেয়ে দিব্যি খালাস হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। দু-একটা মরেও যায়। চরের বালি খুঁড়ে, ডেডবডি হাপিস করে দেবারও লোক আছে। থানা বহুদূরে। সেখানে নিয়ম করে গুরুঠাকুর প্রণামী পাঠান। সব ঠিকঠাক চলছে। এই তো আমাদের দেশ।

: আপনি কিছু করছেন না। কোনও প্রতিরোধ?

: তারই চেষ্টা চলছে। কঠিন। কঠিন কাজ। আপাতত একটা নাইট স্কুল খুলেছি। অনেক লোক শত্রুতা করে পেছনে লেগে গেছে এর মধ্যে। অঞ্চলপ্রধান বাধা দিচ্ছে। সেও তো গুরুঠাকুরের শিষ্য। কবে একদিন হয়তো আমায় গণধোলাই দিয়ে খতম করে আমার হাতে একটা পিস্তল ধরিয়ে দেবে। আপনারা খবরের কাগজে রসিয়ে পড়বেন: রাখালগাছি গ্রামে নদীর চরে সশস্ত্র যুবক গণধোলাইয়ে খতম।

ম্লান হাসি যুবকের মুখে। হঠাৎ বলল, ‘ভাল কথা। আপনি এই রাতে থাকবেন কোথা?’

: থেকে যাব কোথাও। অভ্যেস আছে।

: তা কি হয়? আমার ডেরা অবশ্য একটা আছে সেখানে থাকলে আপনার উটকো ঝামেলা হবে কাল সকালে। তার চেয়ে চলুন আপনাকে কালোসায়েবের বাড়ি নিয়ে যাই।

কালোসায়েব নামটা যত অদ্ভুত মানুষটা তার চেয়ে কম অদ্ভুত নয়। একটা মরা সোঁতার ওপরে বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো, তার ওপিঠে কালোসায়েবের বাড়ি। ভট ভট করে জেনারেটর চলছে। কালোসায়েবের বাড়ি আলোকিত। গ্রাম দেশে খুব অভিনব দৃশ্য বইকী! যুবক আমাকে কালোসায়েবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েই কেটে পড়ল ‘চলি দাদা, কাল সকালে আবার দেখা হবে।’

কালোসায়েব আসলে কালো নন, রীতিমতো গৌরবর্ণ শালপ্রাংশু পুরুষ। বয়স আন্দাজ ষাট বছর। খুবই অভিজাত ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা করে বসালেন একখানা সাবেকি ডিভানে। সুন্দর সাজানো ঘর, শ্বেত পাথরের গোল টেবিল, উনিশ শতকের রঙিন বিলিতি ছবি দেওয়ালে বাঁধানো, ঝাড়বাতির মধ্যে জেনারেটরের কল্যাণে ডুম জ্বলছে। চমৎকার। যেন উত্তর কলকাতার এক তস্য গলির সাবেক কলকাতাকে খুঁজে পাবার বিস্ময় আমার চোখে।

‘কালোসায়েব আমাকে বলে সব হিংসায়’ মানুষটি আমাকে বোঝাতে চান বিশদ করে, ‘আসলে আই হেট দিস ভিলেজ অ্যান্ড দোজ ভিলেজারস। দে আর ন্যারো মাইন্ডেড অ্যান্ড আনক্লিন। ওই সন্তোষ ছোকরা, যে আপনাকে আনল আর কী, ওর সঙ্গে আমার যেটুকু মেলামেশা, কথাবার্তা।’

: গ্রামে কি সবায়ের সঙ্গে মেলামেশা না করলে টেঁকা যায়? অত্যাচার করে না? ডাকাতি হয়নি?

: অ্যাটেমটেড বাট ফেলড। মশাই, আমার চার বোরের বন্দুক আছে তিনখানা। আমি, আমার গিন্নি আর আমার বউমা সব বন্দুকে ওস্তাদ। আমরা হলাম সেল্‌ফ সাফিসিয়েন্ট ফ্যামিলি। দাঁড়ান সব আপনাকে দেখাই। কিন্তু সব আগে চা জলখাবার।

কালোসায়েব উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে রাখা এক স্বনির্মিত দেশজ মডেলের টেলিফোন তুলে বোতাম টিপে শুরু করলেন সংলাপ: ‘হ্যালো, কে বউমা? হ্যাঁ, শুনেছ বোধ হয় গেস্ট এসেছেন একজন। হ্যাঁ, রাতে থাকবেন, খাবেন। হ্যাঁ, দোতালার দক্ষিণের ঘরটাই ভাল হবে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, এক্ষুনি জলখাবার পাঠাবে। লুচি বেগুনভাজা একটু ক্ষীর? নাইস। হ্যাঁ, তোমার শ্বশ্রুমাতাকে একটু এ ঘরে পাঠাও দেখি।’

একগাল প্রসন্ন হাসি। সফলতার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এসে দাঁড়ালেন গোলগাল এক কালো মধ্যবয়সী মহিলা। অদ্ভুত কনট্রাস্ট। একজন নির্মেদ খাড়া গৌরবর্ণ ছ ফুট পুরুষের পাশে স্থূলাঙ্গিনী, দারুণ বেঁটে, মিশকালো নারী। কিন্তু অপূর্ব সুখী একখানা স্থিরচিত্র যেন। কালোসায়েব সগর্বে বললেন: ‘খুব দুরন্ত ছিলাম। কুড়ি বছর বয়েসে বাড়ি থেকে পালাই জাহাজের খালাসি হয়ে। পরে মেকানিকের কাজ শিখি। সাতঘাটের জল খেয়ে বাড়ি এসে থিতু হয়ে তবে বিয়ে করি। বিয়েতে আমার একটাই শর্ত ছিল কেবল—মেয়ে যেন কালো আর বেঁটে হয়।’

: এমন অদ্ভুত শর্ত কেন?

: আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি, আমাদের দেশে কালো আর বেঁটে মেয়েদের বড় হেনস্থা। তারা যাবে কোথায়? কালো আর বেঁটে বলে ভাল বিয়ে হবে না? আমার ছেলের বিয়েও দিয়েছি কালো মেয়ের সঙ্গে। তো আপনাকে যা বলছিলাম। নেভির চাকরিতে অনেক টাকা রোজগার করেছিলাম তাই আর গোলামি করিনি কোনওদিন। ছিলাম জাহাজের মেকানিক। যন্ত্রপাতির দিকে খুব শখ। এ সব টেলিফোন জেনারেটর নিজে করেছি। চাষবাস করবার জন্যে নিজে ট্রাক্টর চালাই, ছেলে চালায়। কারুর ধার ধারি নে।।

: আপনাকে কালোসায়েব বলে কেন?

: কারণ আমার সব টিপটপ। বাড়িতে এই দেখছেন ধুতি আর বেনিয়ান। কিন্তু বাইরে বেরুলেই ট্রাউজার, ফুল স্লিভ শার্ট আর বুট। ওই সব লুঙ্গি, পাজামা, হাওয়াই চটি, হাওয়াই শার্ট আমার চলে না। ও সব সেকেন্ড ওয়ার্লড ওয়ারের পর এসেছে। আমি টেরিকটনও পরি না। সব কটন।

মজার মানুষটিকে ঘাঁটাতে বেশ লাগে। বলে বসি: গ্রাম থেকে কিছু কেনেন না?

‘কেন কিনব? জমিতে অঢেল সবজি তরকারি, পুকুরে মাছ। পোলট্রিতে ডিম। মাসে একবার পোস্তাবাজার থেকে সারা মাসের আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন-তেল-মশলা-চা- চিনি কিনে লালগোলার ট্রেনে চাপাই। তারপরে মুড়োগাছা স্টেশনে নামিয়ে নিই। তারপরে গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে সোজা এই রাখালগাছি। বাস।’

ইতিমধ্যে সুবাসিত চা আর জলখাবার পর্ব চুকেছে। মানুষটির দিকে তাকিয়ে বিস্ময় আর শেষ হয় না। ভদ্রলোক তাঁর মনের কথা বলার মতো লোক পান না বোধ হয়। তাই অনর্গল বলে চলেন, ‘এই গ্রাম নষ্ট হয়ে গেছে। রটন। সবসময় গমকল ভটভট করছে, ট্রানজিস্টার ক্যাঁ ক্যাঁ করছে, বাজার-হাটে কতকগুলো কুচ্ছিত মাছ বিক্রি হয়, জঘন্য সব নাম: তেলাপিয়া, সাইপিয়ন, গ্রাসকাপ। কপি, বেগুন মুলো খান কোনও টেস্ট নেই, সব বিষ ছড়ানো। বাজার করেন নিজে? শুনুন একটা টিপস দিই— বাজারে বেছে বেছে কানা বেগুন কিনবেন। ওতে কীটনাশক দেওয়া নেই। যে সব তরকারি দেখবেন চকচক করছে কক্ষনও কিনবেন না, সব ফসফেটে ভর্তি।’

এতক্ষণ মুখ সুড়সুড় করছিল, শেষপর্যন্ত বলেই ফেললাম: ‘মানুষজন আপনার সহ্য হয় না কেন?’

হো হো করে খানিক হাসলেন উচ্চকণ্ঠে আপন মনে। তারপর বললেন: ‘মানুষজন আপনি দেখতে পান আর? কোথাও আছে? সব আই. আর. এইট ভ্যারাইটি।’

: আই, আর, এইট? সে তো একরকম ধানের নাম! তাই না?

: প্রথমে ধানের বীজ ছিল। তারপরে সবজির আই. আর. এইট বেরিয়েছে। সবশেষে এখন মানুষের আই. আর. এইট দেশ ছেয়ে গেছে। উচ্চ ফলনশীল। দেখতে ভাল, ভেতরে ঢুঁঢুঁ। বিস্বাদ। অড লুকিং ব্যাড কারেকটার্স। চারিদিকে থিক থিক করছে আই. আর. এইট মানুষ। দেখেননি?

আমি বললাম: নিশ্চয়ই দেখেছি কিন্তু বুঝিনি। আপনি বোঝেন কী করে?

: কেন, লক্ষণ দেখে! এই তো আমার পাশের বাড়ির ছোকরা, নামের খুব জোর, সন্দীপন। গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু একখানা দরখাস্ত লিখতে পারে না। কী বুঝবেন? আই. আর. এইট গ্র্যাজুয়েট। ও পাড়ার নন্দ গোঁসাইয়ের মেয়ে ‘সংগীত প্রভাকর’। কিন্তু গান গাইতে বলুন, হয় বলবে সঙ্গে গানের খাতা আনিনি কিংবা হারমোনিয়ম কই? আই. আর. এইট গায়িকা। ওই বাড়িতে থাকে সতীশ বিশ্বেসের ছেলে সুবল। মাস্টার। কিন্তু আদ্ধেক দিন ইস্কুল যায় না, কী না পার্টি করে। ছাত্ররা আড়ালে প্যাঁক দেয়। অঞ্চল প্রধানকে দেখুন— চোর। পুলিশ ডাকুন কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এসেই ঘুষ খাবে তারপরে এসে বলবে মিউচুয়াল করে নিন। সব আই. আর. এইট। মেকি। ভুয়ো। সাইপিয়ন মাছের মতো। আর কী সব ভাষা। আগে ইতর ছোটলোকেরা কথায় কথায় যেমন শকার-বকার করত এখন লেখাপড়া জানা ছেলেরা সেইরকম ব্যাড মাউথ করে। শোনেননি?

: ব্যাড মাউথ?

: হ্যাঁ। মানে মুখ খারাপ।

: এত সব আই. আর, এইটের ভিড়ে আপনি টিঁকবেন কী করে? তা ছাড়া নতুন ছেলেমেয়ে যদি সমাজের হাল না ধরে দেশ কী করে এগোবে?

: এই নিয়ে তুমুল তর্ক বাধে আমার সঙ্গে সন্তোষের। একেবারে বাইশ ক্যারেট সোনা ওই ছোকরা। খুব আশাবাদী। ও বলে, সমাজ পালটাবে, মানুষ নাকি বদলে যাবে। আমি তো উলটোটাই দেখি, পালটানোটা দেখি না। সন্তোষের মতো ছেলে আর কটা? গাঁয়ে ঘুরুন। সব প্রিন্টেড টেরিকটনের বুকচেরা হাওয়াই শার্ট, লুঙ্গি আর হাওয়াই চটি। এ দেশের এই হল ন্যাশনাল ড্রেস। যেমন কুচ্ছিত সমাজ তেমনি ছোকরাদের ড্রেস। কিন্তু একটানা তো বকেই যাচ্ছি। আপনার কথা তো কিছু জানলাম না। ধুতি পাঞ্জাবি পরে সভ্যসমাজে ঘুরে বেড়ান, আপনি তো মশাই সোনামুগের মতো দুর্লভ ভ্যারাইটি।

সোনামুগের উপমাটা বেশ নতুন। ব্যাখ্যা চাইলাম। বললেন এ দেশে সোনামুগের বীজ নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। আর ফলে না। ‘সোনামুগের ডাল খেয়েছেন? এক বাড়িতে রান্না হলে সারা পাড়ায় বাস ছুটত তার। কী করে আর খাবেন? দেশটা ঘোড়ামুগে ভরে গেল। তা আপনি তো শিক্ষকতা করেন, সেখানে আই. আর. এইট নেই? থাকলেও অবিশ্যি আপনি চিনবেন না। যাই হোক আমাদের পাশের গ্রামে একটা ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুল হয়েছে, আশ্চর্য মশাই, যতদিন সায়েবরা ছিল তত দিন ইংলিশ মিডিয়াম ছিল না এত।’

: তা হলে হঠাৎ এত গজাল কেন? আপনার কী মত?

কালোসায়েব বললেন, ‘সেটাই তো স্বাভাবিক। এখন আমন ধানের চেয়ে জয়া-রত্নার কাটতি বেশি। রুই মিরগেলের চেয়ে বেশি চলে সিলভারকাপ। ইংলিশ মিডিয়াম তো ক্রসব্রিড ভ্যারাইটি, তেলাপিয়ার মতো এখন খুব চলবে।’

চমৎকার ঝকঝকে কথার মাঝখানে কোথায় যেন নৈরাশ্যবাদ বোনা আছে ভদ্রলোকের। তাই বিষয়ান্তরে নিয়ে যাবার জন্যে বললাম; ‘সবই তো আপনার খারাপ লাগে। কিন্তু আমি যে কাজটা করার জন্যে গ্রামে গ্রামে ঘুরি সেগুলো কিন্তু জেনুয়িন। আপনি জানেন আমি কোন কাজে ব্যস্ত?’

: সে খুব জানি। সন্তোষের কাছে শুনেছি।

কালোসায়েবের ভঙ্গিতে কেমন একটা ঔদাসীন্য আর অবজ্ঞা আমার চোখ এড়াল না। তাই খুঁচিয়ে তুললাম প্রসঙ্গটাকে আবার নতুন করে। জিজ্ঞেস করলাম: ‘আমার কাজটাও তা হলে আপনার পছন্দসই নয়। সেটাও কি আই. আর. এইট?’

: কাজটা জেনুয়িন। আপনি মানুষটাও সোনামুগ। কিন্তু যে গান খুঁজছেন তাতে অনেক ভেজাল।

: সে কী? কেন?

: তা হলে একটু বিশদ করে বলি। বাউল বৈরাগীরা আগে ছিল সাধক ভক্ত। এখন হয়েছে ব্যবসাদার। পথে ঘাটে মেলায় ট্রেনে কারা বাউল গান করে দেখেছেন? সব সাজানো বাউল।

বেশ চমকদার কথা। হ্যাঁ, কথাটা ঠিকও বটে। সত্যি সত্যিই নকল বাউলও আছে বইকী। ঘোষপাড়ার মেলায় দেখেছি। সাঁইবাবার মতো চুল, গেরুয়া আলখাল্লা আর মাখন জিনের প্যারালাল পরা যুবক বাউল গাইছে। গান শেষ হতেই আলখাল্লা খুলে ব্যানলনের লাল গেঞ্জি পরে আসরের কোণে বসে গঞ্জিকা সেবন করতে লাগল। ঠিক ঠিক। আমি কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি আই. আর. এইট বাউল বোঝেন কী করে?’

: প্রথমে আলখাল্লা থেকে।

: কী রকম?

: কেন দেখেননি? গেরুয়া রঙের টেরিকটন বেরিয়েছে।

: সে কী?

: হ্যাঁ। পরখ করে দেখবেন। আই. আর, এইট বাউল সবসময় গেরুয়া টেরিকটনের আলখাল্লা পরে। তার মানে কী? জেল্লাদার, টেঁকসই, অ্যাট্রাকটিভ। একটা কথা শুনেছেন? আগে বলত, ‘মন না রাঙায়ে বসন রাঙালি যোগী।’ আমি কথাটাকে ঘুরিয়ে বলি কি জানেন? বলি, ‘বাউল না হয়ে বাউল সাজলি ভোগী।’ কী, কেমন বানিয়েছি?

আমি বললাম, ‘বাঃ, বেশ বানিয়েছেন তো। সত্যিই পথে ঘাটে মেলায় যে সব শৌখিন বাউল দেখি তাদের প্রধান কাজ হল ভিক্ষে করা আর সেইজন্যেই তাদের ওই রকম পোশাক।’

‘আর অদ্ভুত সব উদ্ভট গান’ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কালোসাহেব বলেন।

‘উদ্ভট’ গান? আমি জিজ্ঞাসু হই।

‘হ্যাঁ, উদ্ভটই তো। শোনেননি? আচ্ছা দাঁড়ান, আমার হিসেবের খাতায় একটু টুকে রেখেছি খানিক। পেয়েছিলাম লালগোলার ট্রেনে এক টেরিকটন- বাউলের কাছে। এই, এই যে পেয়েছি। শুনুন গানের কথাগুলো:

মন যদি চড়বি রে সাইকেল।

আগে দে কোপনি এঁটে অকপটে সাচ্চা কর দেল।

ফুটপিনে দিয়ে পা

হপিং করে এগিয়ে যা,

পিনের পরে উঠে দাঁড়া

সামনে রাখ নজর কড়া

আগাগোড়া ঠিক রাখিস হ্যানডেল।

সিটের পরে বসে।

ব্যালান্স করবি কষে।

মূলমন্ত্রে কর প্যাডেল॥

কী বুঝলেন?’

: বুঝলাম যে এই গানটা হল টেরিকটন— বাউলের গাওয়া একখানা সাচ্চা আই, আর এইট গান, তাই তো?

একগাল হেসে বললেন কালোসায়েব, ‘অনেকটাই বলেছেন। তবু একটু বাকি। এ গানের লেখক কে? খোঁজ করলে দেখবেন ওটি রচনা কলকাতানিবাসী কোনও আই. আর এইট লোকগীতিকারের। সুর দিয়েছেন, “খ্যাপা” নামধারী কোনও সিনথেটিক ব্যক্তি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একখানা কোলাবোরোটিভ স্কিম যাকে বলে। তাহলেই বুঝছেন আপনার কাজটি বেশ কঠিন।’

: কেন কঠিন?

: কঠিন নয়? আপনাকে তো টেরিকটনের যুগে কটন খুঁজতে হবে। সে কি খুব সহজ?

রাতে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কোথা থেকে কোথায় না এসে পড়েছি। নিছক একটা শব্দের টানে খুলে গেল কত না জগৎ। ‘আনখা মেয়েছেলে’কথাটা টেনে নিয়ে গেল এক সহজিয়া আখড়ায়, সেটা নাকি আবার অ্যাবরশন সেন্টার। সেখান থেকে যদি বা পড়লাম সন্তোষের হাতে সে এনে ফেলল এক অদ্ভুত মানুষের কাছে। স্বচ্ছ চোখে যার কেবলই ধরা পড়ে সমাজ-কাঠামোর বিপ্রতীপ চেহারা আর ভণ্ডামি, স্ববিরোধ আর কৃত্রিমতা। আই. আর, এইট-কে এমন আশ্চর্য প্রতীক আর প্রতিমায় বাঁধা, এও কি কম অদ্ভুত? সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

হয়তো নতুন পরিবেশ বলে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙেছিল। সারা গা ঘামে জবজবে। উঠে বাড়ির বাগানে গিয়ে একটা আশশ্যাওড়া তুলে দাঁতন করছিলাম এমন সময় সন্তোষ এল। নির্মল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল: ‘কেমন ডেরা বলুন তো? কালোসায়েব আমাদের মানুষটা সোজা। শিরপ্যাঁচ নেই’। একটু থেমে বলল, ‘ভাল কথা। আপনি যে গ্রাম্য গান সংগ্রহ করেন কেমন গান সে সব? ধম্মে আমার ইন্টারেস্ট নেই। অন্য ধরনের গ্রাম্য গান আমার সন্ধানে আছে। নেবেন?’

‘সত্যি?’ আমি অবাক মানি। ‘আমি তো অনেকদিন থেকে অন্য গান খুঁজছি। আমি বিশ্বাস করি দেহতত্ত্ব, শব্দ-গান আর ফকিরি গানের বাইরে নিশ্চয়ই একটা অন্য গানের জগৎ আছে। কিন্তু কোথাও পাইনি। তোমার কাছে আছে? দেবে আমায়?’

সন্তোষ বলল, ‘আমার কাছে নেই, তবে আমার সন্ধানে আছে। যেতে হবে কড়েয়া গ্রামে। সাইকেল চড়তে পারেন? সেখানে এক অন্ধ গায়েন আছে। নাম দোয়াআলি। যদি কপাল ভাল থাকে তবে পেয়ে যেতেই পারি।’

আমি বললাম, ‘কেন? অন্ধ যাবে কোথায়?’

: ও তো বেশির ভাগ দিন সকালে বেরিয়ে যায় ভিক্ষেয়। বার্নিয়া, ধোপট এই-সব গ্রামে। ফেরে দিন গড়ালে, তারপরে খায়।

: সারাদিন ভিক্ষে করে তারপরে আবার রাঁধে?

না না, ওর বিবি আছে। সুরতন্নেছা। সে অন্ধ। আমরাই দুজনের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। বেশ আছে। মাঝে মাঝে রাতে ওদের আস্তানায় থাকি, গান শুনি। সে সব গান দারুণ। একেবারে অন্য রকম। চলুন চলুন দেরি করব না।

খুব তাড়াতাড়ি চা জলখাবার খেয়ে কালোসায়েবের বাড়ির সকলের কাছে বিদায় নিয়ে কড়েয়ার পথ ধরলাম। জ্যৈষ্ঠের সকাল। তখনও বাতাস তাতেনি। কত কী ফুলের পাতার গন্ধমাতাল সকাল পেরিয়ে গল্পে গল্পে আমরা পৌঁছলাম দোয়াআলির বাড়ি মানে কুঁড়েঘরে। কপাল ভাল। অন্ধ বসেছিল দাওয়ায়। বলে উঠল, ‘পায়ের শব্দে মনে হচ্ছে সন্তোষ। ঠিক কি না? সঙ্গে কে?’

পরিচয়পর্ব মিটতে দোয়াআলি বললে, ‘বাবু আমি গরিব, বড্ড গরিব। তবু এয়েছেন যখন কিছু খান। কিছুই নেই আমার। আছে কখানা তালগাছ। কটা তালশাঁস খান। দাও গো বাবুদের কটা তালশাঁস।’ দোয়াআলির বিবি সুরত আমার সর্বাঙ্গে তার অন্ধ চোখের মায়া বুলিয়ে বলল, ‘বোসো বাবাসকল। একটু জিরোও। ও মানুষটা অমনিধারা চিরকাল শুধু তালশাঁস কাউরে দিতে আছে? সঙ্গে এট্টু বাতাসা সেবা করুন আজ্ঞে।’

বেলাও বাড়ে। টুকটুক করে দু-চারজন গাঁয়ের লোক জমে। ‘গানের গন্ধ পেয়েছে সব’ দোয়াআলি সগর্বে বলে। তারপরে একতারা কাঁধে তুলে গেয়ে ওঠে:

আরে তানা না তানা না না

ওরে মুষ্টি ভিক্ষে করে আমি খেতে পাই নে উদরপুরে।

ও মন লয়ে ঝুলি মনের খেদে বেড়াই লোকের দ্বারে দ্বারে।

বাড়ি বাড়ি হাঁটব কত

ভূত খাটুনি খাটব কত

রোদে পুড়ে মরব কত

মনের দুঃখ কই কারে।

আমার ঘরেতে বোষ্টমী আছে

পণ-কাঠা চাল চিবিয়ে মারে।

তিনি দেবী আমি দেবা

বলেন আমায় ঠাকুরবাবা

আমি করি ঠাকুরসেবা

শুনে বড়ই রাগ ধরে।

তিনি সদাই বলে ‘খাব’ ‘খাব’

কোথায় পাব খাওয়াই তারে?

গান শুনে সুরতন্নেছা কৃত্রিম কোপ দেখিয়ে বললে, ‘সন্তোষ, তুমি এ গান বিশ্বেস করলে? আমি কোন সময়ে ‘খাব’ ‘খাব’ বলেছি। আমি পণ-কাঠা চাল চিবিয়ে মারি? পণ কাঠা চাল কোনওদিন চোখে দেখেছ ড্যাকরা কানা?’

দোয়াআলি হেসে বললে, ‘এ এক জ্ঞানছাড়া মাগীর পাল্লায় পড়েছি যাহোক। সন্তোষ, তুমি এ কোন এঁটুলি লাগিয়ে দিলে আমার আলাভোলা জীবনে। এর রসকষ নাই। গান বোঝে না। আরে কানী, এ গান কি আমার রচা? এ তো কুবির গোঁসাইয়ের রচনা।’

সন্তোষ বলল, ‘তোমাদের এই কানা বক আর শুকনো নদীর কাজিয়া আমি শুনতে চাই না। দোয়া, তুমি মানুষের গানের পরে এবারে ফলের গান একটা শোনাও।’

‘সবই তো মানুষের গান আজ্ঞে,’ দোয়াআলি বলে, ‘ফল তো খোদা মানুষের জন্যই বানিয়েছে। নইলে ফলের আর মূল্য কী? তবে হাঁ খোদর সবচেয়ে হেকমতি এই মানুষরূপ ফল বানানোতেই। শুনুন তবে—

গাছে ফল ধরালে বারএলাহি কুদরত তাহারি।

প্রথমে দুই গাছেতে এক ফল ধরায়

দ্যাখো না মক্কর ভাই–

সেই ফলের খাতিরেতে নানা প্রকার ফল তৈয়ার॥

এই পর্যন্ত গেয়ে দোয়াআলি বলল: সুলতান আছ নাকি? বাবুকে গানটার মানে বলে দাও দিনি।

সুলতান ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে বলল: বাবু, বারএলাহি হলেন কিনা আল্লা। কুদরত মানে ক্ষ্যামতা। দুই গাছ মানে আদম আর হেবা। মক্কর মানে কারিকুরি। আর ফল মানে মানুষ।

সন্তোষ বলল: তার মানে আল্লা তাঁর কারিকুরি আর সৃষ্টি ক্ষমতায় প্রথমে আদম আর হেবার সৃষ্টি করলেন। সেই দুজন হতে জন্মাল মানুষ। আর সেই মানুষের জন্য নানাপ্রকার ফল তৈরি হল। কেমন কিনা?

‘যথার্থ, যথার্থ’ দোয়াআলি বলে উঠল সোচ্ছ্বাসে, ‘শিক্ষিত লোকের জ্ঞানবুদ্ধি একেবারে পরিষ্কার। যাক, এবারে বাকিটুকু শুনুন ধীরে ধীরে। সুলতান তুমি বাবুর কাছে-ভিতে থাকো। মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দেব। শোনেন—

ধান্য গম আর কলাই তিলে

খুশি ভাই হই নারকেলে

আবার কতজনার পুলক তালে

আছে বেগুন ঝিঙের তরকারি।

পটল করলা আর টোপা কুল

টক রাঁধার আছে তেঁতুল

টকমিষ্টি লেবু মাকুল

সস্তার ডাল খেঁসারি।

মরিচ ধনে মৌরি জিরে

এই কয় ফলের মসলা হয়

কলা আইড়ি লাউ লালিম

শশা পেঁপে বেঁধে খায়।

আবার রাই সরষে তিসি গাঁজা

এই চারফলে তেল তৈয়ার।

আমার সামনে খুলে যায় এক স্পন্দমান মানুষের জগৎ। জীবন রস-সম্পৃক্ত এক ভোজন সচেতন সমাজের ছক। দোয়াআলি অবশ্য থেমে নেই। অনাবিল তার কণ্ঠ গেয়ে যাচ্ছে:

কদবেল আর খিরো জামির

পানিফল আর করঞ্চা

চালতা খেজুর খরমুজ ডালিম

লিচুর চাই খোসাবাছা।

কদু ভুরো গ্যামা মেরো

শেয়াল-ল্যাজা আদরকি।

মিহির দানা জাজির ভুট্টা

চেঁপের ফল হয় মোটামোটা।

কেলেজিরে হলুদ মেথি

জাম পোস্ত তোকমারি।

কাঁকরোল খায় ভর্তা করে

বৈঁচি ফল খায় যুবান তরে

খায় হরিতকী পানের পরে

চন্দনী হজমিকারী।

গান হলেই চলে। শ্রোতারা যতটা আবিষ্ট, দোয়াআলিও ততটা। কিন্তু আমার মনে হল এখানে আমার ভূমিকা কী? এই গ্রামীণ জগতে কি আমি খুবই বেমানান নই? সত্যিই তো এর মধ্যে কত ফল শস্যের নাম আমি জানি না। আমাদের শহুরে জীবন প্রকৃতই কত সম্বৃত কত সীমায়িত। আলাদা করে সব শস্য মনে রাখা বা তার ব্যবহারবিধি সম্পর্কে আমাদের চেতনা কি খুব সজাগ?

এর মধ্যে এক সময়ে ফলের গান শেষ হয়ে শুরু হয়ে গেছে লোহার গান, সেও কি কম বিচিত্র? সে গানের গোড়াতেই এক ধাক্কা:

বাঁশের দ্রব্য গঠন যত লোহা ভিন্ন নয়।

লোহার বাঁশ না কাটিলে

অমনি ঝাড়ে রয়।

সত্যিই এ কথাটা এমন করে কখনও ভাবিনি। লোহার প্রথম কাজ বাঁশ কাটা। সেই বাঁশ দিয়ে তবে খোড়ো চালের খুঁটি আর বাতা, গোরুর গাড়ির দেহ, মাচা, ছই। এমনই কত কী। দোয়াআলির গান লোহার হরেকরকম ব্যবহারকে বিশদ করে চলে:

লোহার গাছ কাটা দা কুড়লে

শাবল আর খোন্তার ফালে

চিচকে ছুঁচে নিড়েন কাচি

ডেড়ো কোদালে।

সুলতান পাশে দাঁড়িয়ে বলল: বাবুর বোধহয় বুঝতে একটু ধন্দ লাগছে। শোনেন তবে। চিচকে মানে পটল পোড়াবার শিক। গ্রামদেশে গরিব মানুষ তেল খেতে পায় না তাই পটল পুড়িয়ে খায় আজ্ঞে। কাচি মানে ধান বা গম কাটার যন্তর। এবারে শোনেন লোহার আরও কেরামতি—

সে হয় লাঙলের ফাল

পাসি আর গজাল।

বল্লম সড়কির ফলি বাঁশ বাটালি

উকো কেঁকো টেঁকো।

মাকু চাকু ছুরি বঁড়শি কাটারি।

সুলতান বলল: পাসি হল যেখানে লাঙলের ফাল আঁটা থাকে। কেঁকো হল মাছ মারার যন্তর। আবার শুনুন—

তুরপুন ঘুরপুন র‍্যাঁদা ঘিস্কাপ

নেহাই হাতুড়ি

বাউলহাতা কাজললতা

চোরের পায়ে বেড়ি

‘বাঃ বাঃ চমৎকার’ সন্তোষ বলে উঠল। ‘চোরের পায়ের বেড়ি পর্যন্ত? বাপ রে। কিন্তু বাউলহাতা কী গো? ওটা তো আমিও চিনলাম না’।

: বুঝলেন না? গাঁ-ঘরে বাউলহাতা দিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করে। কিন্তু ওদিকে গান যে বয়ে যায়, শোনেন—

সন্না আর বাণ বন্দুক কামান

ছেকল বিদের কাঠি কড়ার বাঁট

হাঁসকল ডোমানি হুলোগুলো বিদে বাওলে

ভোমর বাদারি।

সুলতান বললে: কী বাবু, আবার ধন্দ লাগে নাকি? তবে বুঝে নেন। হুলোগুলো থাকে ঢেঁকির মুগুরের মাথায়। ভোমর বলে মুচিরা যা দিয়ে জুতো সেলাই করে। আর বাদারি দিয়ে চামড়া ছেলে। নাও গো দোয়াআলি এবারে লোহার গান সাঙ্গ করো দিনি। এখনও পাখির গান বাকি। সেটা না হয় আমিই গাইব খুনি।

লোহার হন্দরেতে পাথর গুঁড়ো হয়

নরসুন খরসুন ক্ষুর কাঁচিতে কাটে চুল

নেটকা সারা জলুই পেরেক

ছাতার শিক আর শূল।

জাহাজে টাঙায়ে নোঙর দরিয়াতে রয়।

সুলতান বললে; বাবু, নরসুন মানে নরুন। আর খরসুন দিয়ে ঘোড়ার গা আঁচড়ানো হয়। কিন্তু এ গান এখন চলবে অনেকক্ষণ। আপনাদের এ গান ভাল লাগবে না।

আমি সন্তোষকে একপাশে ডেকে বললাম: তুমি এ সব গানে কী পাও? কোনও গভীর সংবাদ এ গানে কই?

সন্তোষ বলল: গ্রামীণ সমাজবদ্ধতা, বস্তুর ব্যবহার সম্পর্কে অভ্রান্ত জ্ঞান, ব্যাপক মানুষের প্রয়োজনের দিকটা কি খুব বাদ দেওয়া যায়। আপনি লক্ষ করেছেন যে আমাদের চেয়ে গ্রামের মানুষ গানটা অনেক বেশি এনজয় করছে। এর কারণ কী বলুন তো?

আমি বললাম: এর কারণ ওদের চেনাজানা জগতের পরিধি তো খুব ছোট। জীবনের চাপে রুজির ধান্দায় তো আরও ছোট হয়ে যায় দিনে দিনে। এ সব গানে তাদের ব্যাপ্ত জীবনের স্মৃতি ধরা আছে। আমরা যেমন বাপ-ঠাকুর্দার আমলের সমৃদ্ধির খবর জানতে ভালবাসি এও তেমনি, নয় কি?

: অনেকটাই হয়তো তাই। কিন্তু গ্রামীণ জীবনের আয়োজন শহরের চেয়ে অনেক বড় মাপে। তাদের কৌতুহল সবটা জানবার। যেমন শহরের মানুষ জানে ধান থেকে চাল হয়, ব্যাস। গ্রামের মানুষ প্রথমে ধানের বিছন নিয়ে ভাবে, তারপর জমি তৈরি, সার দেওয়া, ধানের মাদা তৈরি করা, তারপরে রোয়া, তারপরে ধানের ফলন, ধান পাকা, তাকে তুলে এনে গোলাজাত করা, তাকে সেদ্ধ করা, ভানা পর্যন্ত সবটা জানে। সব কটা স্তর তাদের কাছে সমান জরুরি। এর সঙ্গে আছে যন্তরপাতির ভূমিকা। লাঙল বিদে মই হেঁসো ঢেঁকি চালি সবকিছু বিষয়ে থাকতে হয় সতর্ক। যত্ন নিতে হয় বলদজোড়ার। তার খাদ্যের জন্যে ধানের খড় মজুত রাখতে হয়। বোধহয় গ্রামের গানে সেইজন্যে এত ডিটেইলস থাকে।

: একেই কি বলে অ্যাবানডেন্স? যাক গে, এবার শোনা যাক পাখির গান।

ততক্ষণে দোয়াআলি গান শেষ করে বিড়ি ধরিয়েছে। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে এবারে ধরল খুব লম্বা তান মেরে সুলতান:

আরে আরে আরে রে রে রে—

ফাঁদ না এড়ালে পাখি যাবি মরে রে

বিঘোরে রবি পড়ে।

আউল পাখি টিটি শালিক দোয়েল কোয়েল টাকসোনা

কালিময়না কাকাতুয়া ভীমরাজ টিয়ে চন্দনা।

পায়রা ঘু ঘু কাদাখোঁচা

হট্টিটি আর পাছানাচা।

ওই যে হলদে চড়ুই হাঁড়িচাঁচা ফাঁদেতে নেবে ধরে ॥

আমি সন্তোষকে বললাম, দেখলে তো গ্রাম্য গীতিকারের চিন্তার মৌলিকতা। পাখি সম্পর্কে গান লিখতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ল, ফাঁদ এড়াতে না পারলে পাখি বেঘোরে মরে তা হলে পাখিদের বাঁচার প্রথম বাধা মানুষের তৈরি-করা ফঁদ। যাক, এবারে গানের অন্য অংশ:

চিল ঠোক্কর রঙ্গিকাক হরমতী আর বাজপাখি

পাখিতে পাখি শিকার করে

আমি তা স্বচক্ষে দেখি।

সন্তোষ বললে, এবারে দেখুন আরেক কনট্রাডিকশন। পাখিতেই পাখি শিকার করে। বলতে গেলে এটা জীবজগতেরই কনট্রাডিকশন। মানুষই তো মানুষ মারে নানাভাবে। কিন্তু থাক ও সব কচকচি। আগে গানটা শুনি। ভাল লাগছে বেশ। বলুন?

হুদহুদ আর পরিওল শরবনে বাস সেজারু

শালবনে এক পাখি আছে নামটি তার শালতরু।

বউ কথা কও কোকিল ওই

শব্দ শুনে সুখী হই।

ফুলের মধু খায় যে সদাই কুচপাখি বলে তারে।

বাঁশপাতা মাছরাঙা পাখি পানকৌড়ি জলপিপি

উড়োবক ছিঁয়াছুড় কিস্তে চোরা এরাবগা মানিকজোড়া

সন্তোষ বলল: আপনি অ্যাবানডেন্সের কথা বলছিলেন না? নেচারস ওন অ্যাবানডেন্স। এখন শুধু গ্রামেই পাবেন এ সব। কত সব পাখি আমাদের দেশে। আর কি আছে এরকম পাখি? প্রায় একশো বছর আগে আর্জান শা এ গান লিখেছিলেন। মনে রাখবেন তখনও দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। বাতাস বিশুদ্ধ ছিল। জমি আর জলা এত হতশ্রী হয়নি। গাছে পাকা ফল থাকত। পাখিরা তো এ সবেই বাঁচে।

সুলতান গায় নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে:

মতিরাবাস বুলবুলি গগন আর ভেটকুল্লি

সংসারের শুক পাখি তুইথুলি আর মুইথুলি।

আবার কাঠঠোকরা কুকো পাখি

ময়ূর চড়াই আর বাবুই

আবাবিল করবটে ফিঙে গড়ুল খড়খণ্ডে ধুলো চটুই।

লালমোহন আর ধীরাজ পাখি

হংস সরাল চকাচকী

বেঙাবেঙি ধনেশ পাখির হাড় দেয় কোমরে ॥

গান এগিয়ে চলে আপন গতিতে। আমি ভাবলাম এ সব পাখি আর সত্যিই কি আছে? অকৃত্রিমভাবে? সন্তোষ বলল, ‘কী ভাবছেন?’

বললাম: কী জানি কেন আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল কালোসায়েবকে। এ সব পাখির মধ্যে আই. আর. এইট কোনও পাখি ঢুকে পড়েনি তো?

সন্তোষ হো হো করে হেসে উঠল।

ইতিমধ্যে গানের আসর আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে লাগল। বেলাও বাড়ছে। তা ছাড়া গান শুনলেই তো পেট ভরবে না। কাজের মানুষগুলো তাই যে যার কাজে গেল। কেবল একজন আমার কাছে এসে খুব নিচুস্বরে বলল, ‘বাবু, আপনাদের কথা সব শুনেছি। তাই বলছি এ গানও কিন্তুক খাঁটি গাঁয়ের মানুষের মনের গান নয়। সে গান শুনতে হলে আপনাকে একজনের কাছে যেতে হবে ও পাড়ায়। যাবেন?’

সন্তোষকে রেখে আমি একাই গেলাম। পৌঁছানো গেল একটা মেটে দাওয়ায়। সেখানে একজন মাঝবয়েসী খুব নিস্পৃহমুখে বসে আছে যেন কত তিতিবিরক্ত। তবে আমার সঙ্গীকে (যান নাম অরুণ) দেখে তার মুখে একটা চাপা হাসি খেলে গেল। অরুণ বলল: ‘চাঁদুদা, এ ভদ্রলোক খাঁটি গ্রামের গান খুঁজছেন। দোয়াআলি ওঁকে সেই কবেকার ফল পাখি লোহার গান শোনাচ্ছিল। আমি ওঁকে ধরে আনলাম। এখনকার একটা সত্যিকারের গ্রামের গান ওঁকে শুনিয়ে দেবেন নাকি?’

চাঁদুদা বললেন: ‘সত্যিমিথ্যে বলতে পারব না বাবু। আমাদের মামার বাড়ির অঞ্চলে অর্থাৎ নলদা, টুঙ্গী, শব্দনগর, পলাশীপাড়া, সায়েবনগরে চোত মাসের সংক্রান্তিতে ছেলেরা ‘বোলান’ বলে একরকম গান গায়। হালফিলের ঘটনা নিয়ে তাতে থাকে ‘রং পাঁচালি’ বলে একরকম জিনিস সেরকম একটা নমুনা শুনবেন কি? তাতে কিন্তু কোনও জ্ঞানের কথা নেই। তবে সত্যি কথা আছে। শুনুন তা হলে।’

চাঁদুদা এর পর সোজা তাকালেন আমার দিকে। বললেন: ‘গবরমেন্ট সব গ্রামে গ্রামে হেলথ সেন্টার করেছে জানেন তো? সেখানে অপারেশান হয়, যাতে মানুষ আর না জন্মায়। তাই নিয়ে একটা গান হল এইরকম:

আরে ওই মানুষ-কাটা কল উঠেছে ভাই

তোরা কে দামড়া হবি আয়।

দামড়া করার হেকিম আছে পলাশীপাড়ায়।’

যেন সপাং করে চাবুক পড়ল মুখে। জ্যৈষ্ঠের সেই আতপ্ত বেলায় আমি লজ্জায় মুখ নিচু করলাম।

*

মানুষের জীবনে কোন কারণে যে কার সংসর্গ ঘটে তা কে বলতে পারে? আমার নিজের যে জড়বুদ্ধি মেয়েটি আছে তাকে সুস্থ করবার জন্যে একসময় মরিয়া হয়ে কী না করেছি, কোথায় না গেছি। কলকাতার সবচেয়ে ভিজিটঅলা প্রথম শ্রেণীর স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ থেকে তৃতীয় শ্রেণীর গ্রাম্য হেকিম পর্যন্ত ধাওয়া করেছি। সেবার আমাদের শহরে একজন বাক্‌সিদ্ধ ফকির এসেছিল। ও-সবে একদম বিশ্বাস করি না। তবু স্ত্রীর অনুনয়ে আর প্রতিবন্ধী সন্তানের করুণ মর্মান্তিক মুখখানা দেখে ফকিরের কাছে না গিয়েও পারিনি। এ সব জায়গায় গেলে মানুষের অসহায়তা আর আধিব্যাধির দারুণ বিস্তার দেখলে চমকে যেতে হয়। ফকিরকে ঘিরে অন্তত শ’খানেক পুরুষ-নারীর ভিড়। বেশির ভাগই বাপ মা। সন্তানের আরোগ্যের প্রার্থনা তাদের। কী সজল তাদের ভাষা, কী সকাতর আবেদন! ‘বাবা, আমার ল্যাংড়া ছেলেটা হাঁটবে তো?’ ‘বাবা, আমার মেয়ের বাক্‌শক্তি দাও দোহাই’, ‘বাবা আমার ছেলেটার মাথা আর কি ভাল হবে না?’ ‘আমার মেয়ের মৃগীনাড়া কি সারবে না? ও বাবা।’

ফকির উদাসভঙ্গিতে বলেন: ‘তাঁর ইচ্ছেয় জগৎ চলে। আমি কী করতে পারি? সবই তাঁর নিজের হেকমৎ। আমি তাঁর নামে ওষুদ দিই। সারার হয় সারবে। তাঁর নাম কর। তাঁকে ভাবো।’

ওই প্রচণ্ড ভিড়ে আমি কী বলব? কোলে আমার নির্বোধ মেয়ে আপন মনে দোল খাচ্ছে। নেহাৎ কৃপা হল, ফকির তাকালেন আমার দিকে। জিজ্ঞাসা করলেন: ‘ফলটা কার? আপনার নিজের?’

যেন চমকে গেলাম। ফল? ফল শব্দের এমন ব্যঞ্জনা কখনও ভাবিনি। সন্তান কিনা ফল। কর্মফলও কি? সায় দিয়ে ঘাড় নাড়তে বললেন: ‘ছেলেটার কী রোগ?’

: ছেলে নয়, মেয়ে।

‘যে ছেলে সেই মেয়ে’ ফকির হাসলেন, ‘সব তাঁর সৃষ্টি। কেবল ছাঁচ আলাদা। কর্ম আলাদা। ভগমান ওকে বোধ দেয় নি। তাই না? আমার কাছে কিছু হবে না। তবে রানাবন্দের শ্যাওড়াতলা চেনেন? সেখানে আহাদ ফকিরের থান আছে। ভক্তি ভরে হত্যে দিলে এ সব রুগি ভাল হয়। আমি নিজে জানি।’

রানাবন্দ তো খুব দূরে নয়। আমাদের শহর থেকে সোজা বাস যায় সেখানে চাপড়া হয়ে। অসুখ বিসুখের জন্যে হত্যে না হয় পরে দেওয়া যাবে, আপাতত জায়গাটা দেখেই আসা যাক, এই মনে করে একদিন সকালে রওনা হওয়া গেল। পথে যেতে যেতে যাত্রীরাই অনেকটা জানিয়ে দিল। খুব নাকি জাগ্রত থান। ‘আহাদ ফকিরের নাম এ দিগরে কে না জানে বলুন? কার না মানসা পূরণ হয়নি কহেন?’ বললেন একজন। চাপড়া বি. ডি. ও অফিসের কর্মচারী যুবকটি পাশ থেকে বললেন: ‘আহাদ নামটা শোনা শোনা লাগছে যেন? ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেই একজন ফকির, যাকে মার্ডার করেছিল কারা, তাই না?’

মার্ডার? ফকির হত্যা? আমি নড়েচড়ে বসি।

রানাবন্দে এসে বাস থামল। এখানেই বাস যাত্রা শেষ। এখান থেকে ছোট একটা নদী পেরিয়ে ওপারে শ্যাওড়াতলা। পৌঁছতে পৌছতে বেলা দশটা। একটা নির্জন জায়গা, গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা। ছোট দু-একটা চালা, একটা বেদী। এখানেই আহাদ ফকির বেশির ভাগ বসতেন।

‘তবে বসতেন যখন তখন দু পায়ের পাতা হাত দিয়ে ঢেকে রাখতেন’, বললেন এক বৃদ্ধ ভক্ত।

: কেন? কেন?

: যাতে কোনও ভক্ত তাঁর পা ছুঁতে না পারে। প্রণামে তাঁর বড় আপত্তি ছিল।

: আপনি জানলেন কী করে?

: কী আশ্চর্য! আমি যে তাঁকে স্বচক্ষে ওই বেদীতে বসতে দেখেছি। এই আপনাকে যেমন দেখছি।

একজন এগিয়ে এসে বলল: ‘আহাদসোনাকে যাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন তাঁদের মধ্যে একজন ছামাদ আলী আরেকজন ওয়াছেফ আলী। ইনি ওয়াছেফ সাহেব।’

আমি অভিবাদন করে বলি: ‘আহাদ ফকির কি খুব পুরনো কালের নন?’

: খুব পুরনো কই আর? বাংলা ১৩৬৫ সনের ১০ই মাঘ তাঁর ইন্তেকাল হয়। তার মানে তেত্রিশ বছর আগে। আমি তখন জোয়ান।

এই ক বছরের মধ্যে কিংবদন্তি? খুব বড় জাগ্রত ফকির ছিলেন বোধহয়। কী আশ্চর্য, আহাদ সম্পর্কে কিছুই জানি না যে! কী ভাবে জানা যায়? ওয়াসেফ আলীকেই ধরতে হবে ভাবছি, এমন সময় বেদীর কাছে বসে গৌরকান্তি এক গায়ক গান ধরল। একজন আমার কানে কানে জানান দিল, ‘বাবু এ গাহক খুব নামী। এর নাম জহরালী। আমাদের পদ্মমালা-রানাবন্দের একেবারে একচেটিয়া গাহক।’ খোলা গলায় আন্তরিক সুর উঠল:

ঝকমারি করেছি আমি প্রেম করে কালার

হার হয়েছে বুড়ো মিনসে আমার গলার।

নবীন ছোকরা আমার স্বামী কোনওমতে নাইকো কমি

বুড়োর জন্য ছাড়লাম আমি অষ্ট অলংকার।

বুড়োর সঙ্গে প্রেম করে দিবানিশি নয়ন ঝরে

একবার এনে দেখাও তারে জুড়াক জীবন আমার।

দেখ দেখি সই আগবেড়ে আমার বুড়ো আসছে কতদূরে

আমি থাকতে আর পারি নে ঘরে চেয়ে আছি আশায় তার।

হে কালী দয়াল আমার বুড়োকে বেখো যত্ন করে

আমায় যেতে যেন না হয় ফিরি মুর্শিদ গো

সেই নবীন ছোকরার ঘরে॥

এমন অদ্ভুত বৈষ্ণব বিশ্বাসের গান কখনও শুনিনি। এখানে কালা মানে যদি হন কৃষ্ণ তা হলে সমস্ত গানে তাকে বুড়ো বলাটা খুব নতুন সন্দেহ নেই। গানটি সম্পর্কে কৌতুহল প্রকাশ করতে ওয়াসেফ বললেন—‘এ গানখানা আমাদের গুরু অর্থাৎ মহামান্য আহাদ শাহ প্রায়ই গাইতেন। তাঁর খুব পছন্দ ছিল গানখানা। আজ্ঞে না, কবে লিখা জানি না সঠিক।

কথায় কথায় জানা গেল এখানে এই শ্যাওড়াতলায় প্রতি বছর অম্বুবাচীতে একটা প্রকাণ্ড মহোৎসব হয়। যতলোক এখানে মানসিক করে তারা আসে। সকলের দেওয়া চাল ডাল তরকারিতে সারা দিনরাত অন্মমচ্ছব হয়। সমস্ত দিন চলে হাপু গান, শব্দ গান, ধুয়েজারী গান। সারারাত বসে ফকিরি গানের আসর। কীসের এত জনপ্রিয়তা? আহাদের কার্যকলাপ কেমন ছিল। আহাদ শাহ কি বাউল না দরবেশ?

এবারে ওয়াসেফ আলী বিশদ হলেন: ‘না বাবু, তিনি বাউল ছিলেন না। ছিলেন সুফিফকির। তাঁর জীবনকথা আমি যা জানি বলতে পারি।’

: বলুন তো৷

: পাশেই রানাবন্দ গাঁয়ে তাঁর জন্ম। বাবার নাম মাদারী, মার নাম অমেত্য। খুব গরিব মানুষ। পর পর সাতটা মেয়ে-সন্তান জন্মাতে সোয়ামী স্ত্রী আল্লার কাছে দোয়া মাঙলেন একটি পুত্র-সন্তানের জন্যে। মানসা করলেন সেই ছেলে জন্মালে তাকে আল্লার নামে উৎসর্গ করবেন। আল্লার ইচ্ছায় মানসা পূরণ হল। পুত্র-সন্তানের নাম রাখলেন আহাদ।

: আহাদ কথার মানে কী?

: আরবি ওয়াহেদুন শব্দ মানে এক। তার থেকেই আহাদ। যা হোক গরিব সংসারের অভাবী সন্তান আহাদ। পরের বাড়িতে রাখালি করতে লাগল। তবে আহাদ ছিলেন ছোট থেকেই বিনয়ী ধর্মভীরু উদাস স্বভাবের। তার পরে বয়স যখন আন্দাজ পনেরো-ষোলো তখন চন্দ্রকান্ত পরামানিকের বাড়ি কিনির কাজে লাগলেন।

আমি জানতে চাইলাম রাখালি আর কিষানিতে তফাত কী?

ওয়াসেফ আলী বললেন: ‘শহুরে মানুষ আপনারা বাবু। আমাদের গ্রামদেশে চাষবাস গোরুচরানো ছোটদের বলে রাখল আর বয়স্ক রাখালদের বলে কৃষাণ। তা ওই কিষানি করতে করতে আহাদ খবর পেলেন লোকমুখে যে বালিউড়ো-ভিটের গাঁয়ে আছেন এক পীর। বাস। সারাদিন কিষানি করেন আর সন্ধ্যা থেকে চলে যান পীরগুরুর কাছে। এদিকে বাবা মা জোর করে আহাদের বিয়ে দিলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে বাবা-মার ইন্তেকাল হল, সহধর্মিণীও গেলেন সর্পাঘাতে। সব বন্ধন গেল ঘুচে। আমার গুরু তখন এই শ্যাওড়াতলায় এসে আসন গাড়লেন, আশ্রম বানালেন। সারাজীবন কোথাও যাননি আর।

আমি বললাম: ‘প্রথম যেদিন শ্যাওড়াতলায় এলেন সেদিন থেকে আর কোনওদিন কোথাও যাননি এ কি আপনার শোনা কথা?’

: ছোটবেলা থেকে কথাটা শুনেছি, তা ছাড়া যতদিন জীবিত ছিলেন আমি তো স্বচক্ষে কোথাও যেতে দেখিনি। আর একটা আশ্চর্য জিনিস আমরা তাঁর শিষ্যরা দেখেছি। তাঁকে কেউ কখনও স্নান করতে, খেতে, বসন পালটাতে বা পায়খানা প্রস্রাব করতে যেতে দেখিনি। চোপর দিনরাত থেকেও লক্ষ রেখেছি। এমনকী… কথাটা কি বিশ্বাস করবেন?

: বলুন বলুন। শুনতে খুব ভাল লাগছে।

: আমার নিজের চোখে দেখা সেই বাংলা ১৩৪৫ সালে যেবার বন্যে হয়ে সব দিগর ডুবে গেল তখনও তিনি ওই গাছতলা পরিত্যাগ করেননি। চারিদিকে জল থই থই করছে। তার মাঝখানে তিনি কোমরে দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে বসে থাকলেন। শিষ্যরা একখানা কলার মাড় তৈরি করে তাঁকে উদ্ধার করতে এলে তিনি বললেন— ‘দয়াল আমারে ভাসতে দিয়েছেন। তাই ভাসছি। তোমরা বাড়ি যাও।’

সম্রমে হাতজোড় করে প্রণাম জানালেন ওয়াসেফ সেই বিদেহী ঐশীপুরুষের সম্মানে। তারপর বিগলিত স্বরে বললেন: ‘মহামান্যমান মানুষ ছিলেন তিনি। বাক্‌সিদ্ধ। যা বলতেন তাই হত। যে যা আন্তরিকভাবে মানসা করত ফলে যেত। তাঁর থানে এখনও হত্যে দিলে রোগ সারে। দেখুন কতজন পড়ে আছে।’

সত্যিই তাই। আহাদের বেদীর সামনে অনেক নারী-পুরুষ সাষ্টাঙ্গে পড়ে আছে। এর কি সবটাই মিথ না সত্যি কে বলবে? শান্ত ছায়াসুনিবিড় সেই আশ্রমের স্নিগ্ধ পরিবেশে খুব বড় নাস্তিকের মনেও দ্বিধা আসে। আমার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিগ্রস্ত পঙ্গু মেয়ের করুণ মুখ। দুর্বল মনকে শক্ত করে শেষ তৃণাশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলি: আপনি নিজে দেখেছেন কাউকে সারতে? নাম বলবেন তার?

‘বাবুর সন্দ কাটে নি’, ওয়াসেফ হেসে বলেন, ‘তা হলে আপনাকে দুবরাজের বিত্তান্ত বলতেই হয়। শোনেন। দুবরাজ ছিলেন আমার গুরুর প্রথম শিষ্যা। তাঁকে আমি দেখেছি অম্বুবাচীর ঘি-খিচুড়ির জন্যে ঘি নিতে আসতে।’

: দুবরাজের বাড়ি কোথায় ছিল?

: ওই বড় আন্দুলের কাছে নূতনগ্রাম-কেশবপোঁতায় ছিল তেনার ভিটে। খুব অল্প বয়সে বালিউড়ো-ভিটের গাঁয়ে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু শরীরে ঢোকে কুষ্ঠ ব্যাধি। সর্বাঙ্গ খসে পড়তে থাকে। সোয়ামীকে আবার বিয়ে করতে বলে চলে আসেন শ্যাওড়াতলার ফকিরের আস্তানায়। মাঝরাতে তার কান্না শুনে ছুটে আসেন গুরু। জিজ্ঞেস করেন ‘কে তুমি মা?’ সব শুনে বলেন ‘তাঁকে ডাকো যিনি দিলেন এই কালব্যাধি।’

: সত্যিই দুবরাজের কুষ্ঠ সেরে গেল?

: একদম সেরে গেল। আমার নিজের দেখা। এ আশ্রমে সবাই তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকত। এই তো সেদিন মারা গেলেন জননী। হ্যাঁ, সেও এক আশ্চর্য! আহাদ গেলেন ১৩৫৬ সনের ১০ই মাঘ আর দুবরাজ মা মাটি নিলেন ঠিক একবছর পরে ওই ১০ই মাঘ তারিখেই। আশ্চর্য নয়?

আশ্চর্য তো অনেক কিছুই। আণবিক যুগের বৈদ্যুতিন কৃৎকৌশলের মধ্যে আমাদের দেশের লৌকিক দেবীর পূজার ঘটা কিছুই কমেনি। বাউল ফকির দরবেশ গোঁসাইদের বার্ষিক মচ্ছবেও কিছুমাত্র ভাঁটা পড়েনি। প্রতি গ্রামে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুললেও দেখা যাবে একই রমরমায় চৈত্র মাসে শেতলা পুজো হচ্ছে, শ্রাবণে হচ্ছে মনসা পুজো। তফাতের মধ্যে কেবল ঝাঁপান গানের বদলে মাইকের তারস্বর চিৎকার আর মেলার নানারকম বিক্রয় দ্রব্যের মাঝখানে লাল শালু মোড়া একখানা বামপন্থী গ্রন্থবিপণি। গ্রাম্য দেবদেবী পুজোয় আরেকটা নতুনত্বের কথা বলেছিলেন ব্ৰহ্মাণীতলার সুদেব সেনশর্মা। বলেছিলেন—‘চিরকাল দেখেছি মশায় আমাদের এই মনসা পুজোয় ভোজ দেওয়া হয় পাকা কাঁঠালের কোয়া দিয়ে। তবে আজকাল মা মনসার মুখ বদল হচ্ছে। তিনি খাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের বাম্পার ক্রপ আনারস আর গঙ্গাসাগরের তরমুজ।’ এও কি কম আশ্চর্য?

শেষপর্যন্ত ওয়াসেফ আলীকে অনেকক্ষণ থেকে আটকে থাকা কথাটা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম: ‘আহাদ শাহকে মার্ডার করলে কে? কেনই বা? এর মধ্যে কি হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার আছে নাকি কিছু?’

: আরে না না। খানিকটা হিংসা দ্বেষ খানিকটা লোভ। এ কথাটা ঠিকই যে গুরুর নামডাক আর ক্রিয়াকলাপের খবর দূর দূর গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটাও সত্যি যে তাঁর কৃপায় রোগ সেরে যাচ্ছিল অনেকের। তার ফলে কী হল? এই আশ্রমের চার পাশে যত জমি আর বাগান দেখছেন এ সবই ভক্তজনেরা তাঁকে লিখে দিতে লাগল। সে সব কি নীচ মানুষের ঈর্ষা হিংসা জাগায়নি? কিন্তু তাতে তো একটা লোককে খুন হতে হয় না।

: তবে কি ওঁর ধর্মমত কাউকে চটিয়েছিল?

: না। তাও তো নয়। তাঁর ধর্মমত খুব উদার ছিল। এখনও এখানে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান অম্বুবাচীর মচ্ছবে একসঙ্গে খানা খায় পাশাপাশি বসে। আসবেন দেখবেন। তিনি বলতেন—‘হক-আল্লা বলো মুসলমান, হক-হরি বলো হিন্দু, হক-যিশু বললা খ্রিস্টান।’ এই কথা সর্বদাই বলতেন। হক মানে তো সত্য। সত্যকে তো সবাই চায়। আসলে আমি যা বুঝি, ও সব ধর্ম নয়, ঈর্ষা হিংসা নয়, তাঁকে মরতে হল একদল মানুষের অন্যায় লোভে।

: ব্যাপারটা একটু খুলেই বলুন।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওয়াসেফ বললেন: ‘সে আমাদের খুব দুঃখের ঘটনা। সেদিন সন্ধ্যার আগে ফকির সাহেব বিশেষ কারণে কিছু টাকা ভক্তদের দেন। তাদের মধ্যে কজন ভক্ত বোধহয় ভেবেছিল তাঁর কাছে অনেক টাকা আছে। রাতের বেলা তারা এসে ফকিরের কাছে সব টাকা চাইল। তিনি সবই দিলেন তবু তারা বলল, আরও টাকা দিতে হবে। তারা বাঁধল তাঁকে। তাদের বোধহয় চিনতে পেরেছিলেন গুরু। তাই বুকে ছুরি বসিয়ে দিল। ফকির বলেছিলেন অনুনয় করে, ‘আমাকে জানে মেরো না।’ তারা শুনল না।’

সজল চোখে ওয়াসেফ বললেন: ‘আমার কপাল, আমিই প্রথম তাঁকে দেখি। খুব ভোরবেলা। তখনও প্রাণ ছিল। রক্তের বন্যায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছেন। আমিই দড়াদড়ি খুলে দিই। সে রাতেই প্রাণ চলে গেল তাঁর। কিছুতেই, শত অনুনয়েও খুনিদের নাম বললেন না। ক্ষমা করলেন তাঁদের। তবে আল্লা তো তাদের ক্ষমা করেননি। উচিত বিচার হয়েছে।’

: কী রকম?

: সে কি আপনার বিশ্বাস হবে? তবে আমরা নিজে দেখেছি একজন লোক এই আশ্রমেই বক্তবমি করে মরল। কজন চুরি করা টাকা ফেরত দিয়ে আশ্রমের বেদীতে মাথা ঠুকে ঠুকে ক্ষমা চাইতে লাগল আকুল হয়ে। সূর্যাস্তের আগেই তারা ছটফট করে ম’ল। বাকি যে সব খুনি ছিল মাসখানেকের মধ্যে সবাই অপঘাতে শেষ হল। হঠাৎ হঠাৎ আশপাশের গাঁ-ঘরে কজন মরে গেল। আপদ চুল। সেই থেকে এই আশ্রমের নামডাক খুব ছড়িয়ে পড়ল। অম্বুবাচীর মেলায় ভক্ত ভক্ত্যাদের ভিড় বেড়েই চলল। এখন তো হাজার পঞ্চাশ লোক আসে।

জানতে ইচ্ছে হল আহাদ ফকির কত বছর বয়সে নিহত হয়েছিলেন? সে কি অকালে? তখন কি তিনি নিতান্ত নবীন?

ওয়াসেফ বললেন: ‘তাঁর জন্ম সাল ১২৪৬ সন, এন্তেকাল ১৩৫৬। তার মানে ১১০ বছর তিনি বেঁচেছিলেন।’

আমি বললাম: এমন একটা মানুষ মরে গেল। মামলা-মোকদ্দমা হল না?

: কাকে নিয়ে হবে? সাক্ষী তো ছিল না কেউ। তা ছাড়া ফকির তো কারুর নাম বলে যাননি। তবে খোদ খোদার আদালতে হয়ে গেছে বিচার। সে সব খুনি পাপীদের নাম কি আজ আর কেউ করছে? সবাই ভক্তিভরে আহাদের নামই করে, তাঁরই গুণ গায়। এই যে আপনি এতদূর থেকে এয়েছেন সে তো তাঁরই কথা শুনতে নাকি কহেন?

আমি দেখতে থাকি এই ঐশী জায়গা। সন্দিহান মন আমার সাড়া দেয় কই? আমার জড়বুদ্ধি মেয়ের জন্যে এখানে হত্যে দিলে সে সেরে উঠবে? ঘুচবে তার পঙ্গুত্ব? ফিরবে তার বোধ? কথা বলবে সে? আমাকে ডাকবে সে ‘বাবা’ বলে? সে ডাক যে তার মুখে আমি কখনও শুনিনি! হে আহাদ ফকির, আমাকে বিশ্বাস দাও। তোমাকে ভরসা করবার মতো বিশ্বাস। লোকায়ত জীবনে আমি কখনও অলৌকিক দেখিনি। দুবরাজের মতো আমি তোমাকে আকুল হয়ে ডাকতে পারিনা। ওয়াসেফের মতো অটল বিশ্বাস নেই আমার। দু চোখ কি বাষ্পচ্ছন্ন হয়ে আসে?

না মুহুর্তে যুক্তিবাদী মন শক্ত হয়ে ওঠে। বিশ শতকের শেষ দিকে দাঁড়িয়ে এ আমার কী সব উলটো ভাবনা। আমার বুদ্ধিজীবী মন ভাবতে থাকে আহাদের চমৎকার মিথটুকুর সারবস্তু নিয়ে। ভাবি, জীবনে যে-মানুষটি ছিল অনতিখ্যাত, এক অকারণ হনন তাঁকে করেছে লোককথার বিখ্যাত কেন্দ্রবিন্দু। আততায়ীদের সকলের মৃত্যুঘটনা তাঁকে দিয়েছে অলৌকিক কিংবদন্তির দুর্লভ অবিস্মরণীয়তা। এমনিই কি চলবে চিরকাল? পৃথিবী এগিয়ে চলবে এবং সভ্যতা। আণবিক যুগ তৈরি করবে অবিশ্বাস্য পৃথিবী, বৈদ্যুতিন কৃৎকৌশল রিমোট কনট্রোলে চালাবে যান্ত্রিক সমাজজীবন। আহাদদের গল্প তখনও থাকবে? বিশ্বাস করবে মানুষ সে সব?

হঠাৎ সমস্ত আশ্রমটা আমার সামনে বিস্ফোরিত হয়ে গেল। যেন অন্তহীন ব্যর্থ রিক্ত মানুষের নিস্ফল মাথাকোটা এখানে দারুণ শ্বাস ফেলছে। যেন আমার মেয়ের মতো ভারতের পাঁচ লক্ষ জড়বুদ্ধি সন্তান মুক্তি চাইছে অসহায় জীবন থেকে নিষ্ক্রমণের জন্যে। হতবাক আমার কাঁধে হাত রেখে বদ্ধ ওয়াসেফ বললেন: ‘আপনার কষ্ট আমি বুঝছি। আপনার মধ্যে ভক্তি নেই। আপনি কোনওদিন শান্তি পাবেন না।’

আমি অভিমান ভরে মাথা তুললাম আর মনে পড়ল সুফল সরকারের প্রত্যয়ভরা মুখখানা। সেইসঙ্গে তার তেজোদীপ্ত কথা: ‘এ দেশটার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ভক্তি। মানুষকে মাথা তুলতে দেয় না। আমার লড়াই এই নেতানো ভক্তির বিরুদ্ধে।’ কথাটা মনে পড়া মাত্রই আমি শ্যাওড়াতলা ত্যাগ করলাম খুব দ্রুত পায়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওয়াসেফ আর আহাদের বিশ্বাসী ভক্তের দল। আমি নদী পেরিয়ে সোজা বাসে উঠলাম। খানিকক্ষণের মধ্যে বাস ছেড়ে দিল। আমার মন রোমন্থন করতে চাইল সুফল সরকারের সঙ্গে প্রথম দেখার দিনটির ঘটনাগুলো।

জেলা কৃষি আধিকারিক নেমন্তন্ন করেছিলেন বার্ষিক পুরস্কার বিতরণের উৎসবে। জেলার সফল চাষিদের দেওয়া হবে শীল্ড আর কাপ। কেউ পাবে ভাল ফলনের জন্য, কেউ ভাল সাইজের জন্য, কেউ একই জমিতে একাধিক ফলনের জন্য। যদিও রুটিন প্রোগ্রাম তবু আমি সাধারণত এ সব সভায় যোগ দিই গ্রামের অন্য ধরনের মানুষ দেখার লোভে। গুরু-মন্ত্র কবচ-তাবিজ, আখড়া-শব্দগান-কিংবদন্তি-অন্ধবিশ্বাস, মেলা-মচ্ছব-বাউল-বৈরাগী-উদাসীনদের খুঁজতে গিয়ে গ্রাম-জীবনের অন্য বাঁকটাও দেখেছি বইকী। যে দিকটা ফলবান, যেদিকে অবিচার শোষণ, যে-মানুষ বঞ্চিত। আবার অগাধ ধানপাট, বিশাল জমিতে ট্রাক্টর চলছে, মাঠে মাঠে শ্যালো টিউবওয়েলের জলের কল্যাণে শস্যসম্ভারের শ্যামশ্রীও আমি অনেক দেখেছি। রবিফসলের সময় আমি গ্রামের মানুষকে পেট পুরে খেতে দেখিনি কি? সেই আমিই আবার দেখেছি গ্রামের মুদির দোকানে দেশলাই কাঠি খুচরো বিক্রি হতে কিংবা একটি মেয়ে মুদির দোকানে এসে একটা ছোট পুঁটলি নামিয়ে তিসির বিনিময়ে নিয়ে যাচ্ছে কেরোসিন তেল।

তবে গ্রামের পরিবেশে তাদের দেখা একরকম আর শহরের সম্মেলনে আরেক রকম। এই সব কৃষি আধিকারিকের সভায় একপাশে বেঞ্চিতে বসে থাকে কিছু চাষি। নিজেরা যাদের পরিচয় দেয় চাষাভুষো বলে, আকাশবাণী তাদের বলে চাষিভাই। এমন অনুষ্ঠান ইন্ডিয়ান নিউজ রিভিয়ুতে অনেক দেখেছি। সাধারণত হরিয়ানার সহাস্য পেশল পাগড়িপরা চাষিদের এ সব তথ্যচিত্রে দেখি। সেদিনকার পুরস্কার বিতরণ উৎসবে আমাদের ন্যুজ মলিন ক্লান্ত কৃষকদেরই দেখব জানতাম। কিন্তু সেই আশাহীন মানুষের ভিড়ে একজন খাড়া মানুষকে দেখে চমকে যাই। তিনিই সুফল সরকার, পরে জানতে পারি। এক জমিতে বহু ফসলের পুরস্কারের প্রাপক ছিলেন তিনি। সে কথা ঘোষণায় শুনি। কিন্তু তার আগে সুফলের একটা কথা আমাকে টানে।

টেবিলে পর পর সাজানো ট্রফি, অভিজ্ঞানপত্র আর সেভিংস সার্টিফিকেট। সভাপতি হিসাবে জেলাশাসক এসে গেছেন তাঁর রেডিমেড হাসি নিয়ে। পাশে তাঁর রোদ-চশমা পরা খরগোশের মতো তুলতুলে বউ। তাঁদের অতি-পরিকল্পিত সংসারের একতম শিশু সন্তানটি গ্যাজেবো পোশাক পরে ডি. এমের খাস আর্দালির কাঁধে চড়ে দন্তবিকশিত আননে সবাইকে কৃতার্থ করছে। ডি. এমের সামনে জেলা কৃষি আধিকারিক বিগলিত হেসে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যান্য সহ-আধিকারিকেরা নানা তদ্বির তদারকে ব্যস্ত। মঞ্চে নানাজাতীয় পোস্টার। প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী ও রাজ্য কৃষিমন্ত্রীর আশীর্বাণীমণ্ডিত স্যুভেনির একটা পাওয়া গেল যার সর্বাঙ্গে জেলার সমস্ত সার ও পাম্পসেটের দোকানের কিম্ভুত নামাবলী। একপাশে বেঞ্চিতে বসে নিমন্ত্রিত চাষিরা। এ উৎসব নাকি তাদের। পরনে তাদের বে-আন্দাজি মাড় দেওয়া ঠেটি ধুতি আর শার্ট। খড়ি-ওঠা বেঢপ শক্ত পায়ে ধুলোধূসর বুটের অনিচ্ছুক অবস্থান। কিন্তু রোদ-পড়া কালো মুখে সেই প্রার্থিত সাজানো হাসি যে নেই! সরকারি স্ট্রিনজেন্ট ফোটোগ্রাফার তাদের সামনে ক্যামেরা ধরেছে আর বলছে: কই, একটু হাসুন।

সঙ্গে সঙ্গে একসটেনশন অফিসাররা এসে বললেন: হাসুন হাসুন। আজকে আপনাদের কত আনন্দের দিন। কত প্রাইজ পাবেন। একটু হাসি হাসি মুখে তাকান এইদিকে।

ঠিক এই সময়ে উঠে দাঁড়ালেন সুফল সরকার। কালো রঙের খাটো মানুষ। মালকোঁচা-মারা ধুতি আর শার্ট পরনে। খুব তেজালো গলায় বললেন: ‘হাসিটা আসবে কোথেকে বলুন তো? ভোরবেলা বি. ডি. ও সায়েব গ্রাম থেকে ধরে এনেছেন। খিদেয় হাঁ হাঁ করছে সবাই। এ মশায় চাষার খিদে, জষ্টি মাসের খেতের মতো। ও আপনাদের চা-বিস্কুটের কম্মো নয়। পেট পুরে খাওয়ান আপনি হাসি ফুটবে। করছেনটা কী আপনারা? শুধু ব্যাজ লাগিয়ে ফুটুনি আর বড় বড় কথা।’

এই এক বাক্যবন্ধের স্পষ্টতায় ভাল লেগে গেল সুফল সরকারকে। চমৎকার সোজা লোক। আলাপ না করে উপায় আছে। আলাপের শেষে কথা আদায় করলেন তাঁর গ্রামে একদিন যেতেই হবে। শ্যামপুর।

মনে আছে দিন সাতেকের মধ্যেই গিয়েছিলাম। শীতকাল। বাসস্টপ থেকে নেমে শুরু হল হাঁটা। দুপাশে শস্যকীর্ণ মাঠ। ‘অবারিত’ আর ‘আদিগন্ত’ শব্দ দুটোর ঠিক মানে গ্রামে এলে তবে বোঝা যায়। পথের দুপাশে কদাচিৎ একটা-দুটো মেটে বাড়ি। আখ মাড়াই চলছে। ঘরের দাওয়ায় পাটকাঠিতে গোবর লাগিয়ে জ্বালানি রোদে শুকোচ্ছে।

‘কোথায় যাবেন? পথ-চলতি মানুষের জিজ্ঞাসা।

‘সুফল সরকারের বাড়ি।’

‘সোজা গিয়ে বাঁদিকে বাঁক নেবেন। মিনিট দশেক লাগবে। সুফলদা বাড়িতেই আছেন। এই তো কথা বলে এলাম।’ মানুষটির মুখে সুফল সম্পর্কে সন্ত্রমটুকু গোপন ছিল না।

খানিক পরেই পৌঁছে গেলাম। অনতিপ্রৌঢ় মানুষটা উঠোনে বসে খেজুরপাতার চ্যাটাই বুনছিলেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বসতে দিলেন একটা পালিশছাড়া কাঁঠাল কাঠের চেয়ারে। নিজে রইলেন দাঁড়িয়ে। তবে মানুষটা খুব ছটফটে। এই পা দিয়ে আঁচড় কাটছেন মাটিতে, এই খানিকটা এ পাশ ও পাশ করছেন। সারাক্ষণ চঞ্চল চোখদুটো ঘুরছে। খুব সতর্ক অথচ উৎসুক। খানিকক্ষণ দুপক্ষেই ধানাইপানাই আমড়াগাছি হল। অবশেষে এই শান্ত ছিমছাম গ্রাম সম্পর্কে সবচেয়ে রোচক প্রশ্নটা তুললাম: ‘কেমন আছেন এই গাঁয়ে? মনে তো হল বেশ ফসল হয়। মানুষজনও শান্তশিষ্ট পরিশ্রমী। মাঠে মহলায় সবাই খুব কর্মব্যস্ত। কিন্তু এই পরিবেশ কি সত্যি? পাটিবাজি নেই? ডাকাতি হয় না?’

খাড়া মানুষটা টান টান উত্তর দিলেন এক কথায়: ‘ডাকাতি হবে কেন? আমরা তো ঐক্যবদ্ধ।

খুব চমকে গেলাম। এতদিন গ্রামে ঘুরছি। সব জায়গাতেই এই ডাকাতি খুব সেনসিটিভ ইস্যু। সবাই মিইয়ে আছে আশঙ্কা আর সন্ত্রাসে। তাই জিজ্ঞেস করতেই হল; ‘তার মানে, আপনি বলছেন ঐক্যবদ্ধ গ্রামে ডাকাতি হয় না?

‘কী করে হবে?’ সুফল খুব তাত্ত্বিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘গ্রাম সমাজে সম-কাঠামো থাকলে অনৈক্য থাকে না। অসম সমাজ ডাকাত টেনে আনে। যে কোনও গ্রামে ডাকাতির ভেতরকার খবর নেবেন, দেখবেন সেই গ্রামের কোনও মানুষ নিশ্চয়ই ডাকাতদের মদত দেয়। এখানে তা হবে না।’

: কেন?

: এখানে আমরা পচিশ ঘর সাধারণ চাষি বাস করি। সবাই সাধারণ চাষি। ধান হয় সামান্য, সবজি বেশি। এই এখন যেমন জমিতে দেখবেন বেগুন টম্যাটো আর শিম। একজন চাষির জমি খুব বেশি পাঁচ বিঘে। এখানে ডাকাতিতে খরচ পোষাবে না। সামান্য চাষি দিনে গড়ে দশ-পনেরো টাকার সবজি বেচে। নিন একটু চা মুড়ি খান। একটা কালো রোগা মেয়ে চা দিল। সুফল বললেন: আমার বড় মেয়ে। পাশের দোগাছি গ্রামের হেলথ সেন্টারে কাজ করে। আজ রবিবার। ছুটি।

: তার মানে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন সব। ইস্কুল আছে?

একটু হেসে সুফল বললেন: ইস্কুল ছিল না। আমি করেছি। একটা জেদ থেকে।

: কী রকম?

: তখন এখানে কিছুই ছিল না। জঙ্গল ছিল আর জলা। আগে নাকি বাঘ থাকত। আশপাশের গাঁয়ের লোক বলে। এ কথাও বলে যে আমরা পুর্ববঙ্গের লোক বাঘের থেকেও নাকি সাংঘাতিক। যা হোক আমরা ফরিদপুরের এড়াকান্দি এলাকার নমঃশূদ্র। এ গ্রামের সবাই। দেশ ভাগ হতে আমরা একটা দল চলে এসে প্রথমে বসি বহিরগাছিতে। তখন বিশ ঘর মানুষ ছিলাম। সেখানে দশ বছর থেকেও শেষপর্যন্ত টিকতে পারলাম না।

: কেন? লোকাল মানুষের শত্রুতা?

: না না। বান বন্যা। বহিরগাছি গেছেন? খুব নিচু জায়গা। প্রত্যেক বছর ভরা ফসল ডুবে যেত। শেষপর্যন্ত খোঁজ পেয়ে এখানে এসে জঙ্গল কেটে বসত গড়ি। তা পঁচিশ বছর হয়ে গেল।

সংগ্রামী মানুষের একটা দৃপ্ত কাঠিন্য আর প্রত্যয়ের ঋজুতা সুফলের চোখে। অর্থ কীর্তি সচ্ছলতার বাইরে একটা আলাদা জীবন-রস থাকে কোনও কোনও মানুষের। যেন শেকড়ের মতো সেই ব্যক্তিত্ব চারপাশ থেকে রস টেনে তুমুলভাবে বেঁচে থাকে। এমন মানুষ এখনকার গ্রামে খুব কম। মুগ্ধ চোখে জানতে চাইলাম, ‘জেদের বশে ইস্কুল খোলার কথা কী যেন বলছিলেন?’

: হ্যাঁ, সে একটা ইতিহাস। জানেন তো এদেশে এসে প্রথম প্রথম পূর্ববঙ্গের মানুষদের অনেক বিদ্রুপ ব্যঙ্গ সইতে হয়েছে। তায় আমরা সিডিউলড কাস্ট! জানেন কি আমাদের এস সি আর এস টি, অর্থাৎ সিডিউলড কাস্ট আর সিডিউলড ট্রাইব নিয়ে এদেশে আমাদের কী বলে? বলে এস সি মানে সোনার চাঁদ আর আর, এস টি মানে সোনার টুকরো। একবার শিয়ালদহ স্টেশনে টিকিটের খুব লম্বা লাইন পড়েছে, আমিও দাঁড়িয়ে আছি সে লাইনে। হঠাৎ এক কোটপ্যান্ট-পরা গৌরবর্ণ ভদ্রলোক, নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ, বললেন ব্যঙ্গ করে, ‘এ কী? এত বড় লাইন? কেন? গবরমেন্ট এখনও সিডিউলড কাস্টের জন্যে আলাদা লাইনের সুবিধা দেয়নি?’ চুপচাপ এ সবও শুনেছি। পাশের দোগাছি গ্রামে বেশির ভাগ বর্ণহিন্দুর বাস, ব্রাহ্মণপ্রধান। ওরা আমাদের বলে ‘নমো’। খুব ঘেন্না করে। তা সেবার দোগাছিতে কী একটা কাজে গেছি। গরমকাল। দু দণ্ড একটা দিঘির ধারে বসে জিরুচ্ছি। বহু লোকজন ছেলেমেয়ে বাচ্চা-কাচ্চা চান করছে, দেখছি। হঠাৎ দেখি একটা ছেলে মাঝদিঘির অথৈ জলে খাবি খাচ্ছে।

: আপনি তুললেন?

: হ্যাঁ, পুববঙ্গের জলের মানুষ। আমার সামনে কেউ ডুবতে পারে? সাঁতরে গিয়ে ছেলেটাকে তুলে আনলাম। খুব জল খেয়েছিল। ঘুরপাক খাইয়ে জল বার করে দিয়ে বললাম ‘যাঃ বেঁচে গেলি।’ খবর পেয়ে খানিকগর ছেলেটার মা ঠাকুমা ছুটে এল। খোঁজ নিল কে বাঁচিয়েছে তাদের ছেলেকে। সবাই আমাকে দেখিয়ে দিল। বুড়ি বলল, ‘তুমি শ্যামপুরে থাক না?’ আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই তার নাতির নড়া ধরে বলল, ‘চল। জলে ডুব দে। তোকে নমোয় ছুঁয়েছে।’ কেউ প্রতিবাদ করল না। সবাই সায় দিল।

: বলেন কী?

: হ্যাঁ। সেদিন জেদ ধরল মনে। বুড়ি, শুধু তোমাকে নয়, তোমাদের দোগাছির সবাইকে আমি নমোর শক্তি দেখিয়ে দেব। তা দেখিয়ে দিয়েছি। এখন ও গ্রামে আমার খুব মান্যতা। সবাই তোয়াজ করে বলে সুফলবাবু আমাদের গর্ব।

: কীভাবে তা হল?

: গ্রামকে সংঘবদ্ধ করলাম। শহরে ছোটাছুটি করে নাইট স্কুল করলাম। এখন আমাদের গ্রামের সবাই প্রাথমিক পাশ। অন্তত চারটে গ্রাজুয়েট। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বিশজন ছেলে-মেয়ে। সবাইকে শিক্ষিত করব। সবাই এখানে এককাট্টা।

এতক্ষণে মানুষটার অহংকারের কারণ বুঝলাম। শুধু সুফল নয়, সফল। কিন্তু গ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে কী করে? এখনও পাটিবাজি ঢোকেনি? পশ্চিমবঙ্গের এমন গ্রাম তো দেখিনি যেখানে দলীয় রাজনীতির সংঘর্ষ নেই। পঞ্চায়েত তো আছে। ভোটও আছে। তবে? কথাটা আমাকে শেষপর্যন্ত জিজ্ঞেস করতেই হল।

সুফল বললেন: ‘এখানকার বেশির ভাগ গ্রামের রাজনীতি ব্যাপারটা অন্তঃসারশূন্য আর হুজুগে। একটা ঘটনা শুনবেন? ওই দোগাছির পাশের গ্রাম মূর্তিপুর। সেখানে দু ভাই সুকেশ আর জনার্দন মণ্ডল পৃথগন্ন হয়ে পাশাপাশি বাস করে। সামান্য জমি আছে চাষ-আবাদ করে। কোনওরকমে চলে যায়। দুজনেই সি পি এম করে। কারুরই অবশ্য রাজনৈতিক জ্ঞান নেই। তো মূর্তিপুরে সি পি এম আর এস পি-তে খুব রেষারেষি। দু দলই চেষ্টা করছে ক্যাডার বাড়াতে। একদিন সুকেশ আর জনার্দন দুজনেই যখন মাঠে তখন সুকেশের গোরু জনার্দনের বেড়া ভেঙে এসে উঠোনের ফসল খেয়ে গেছে। বেধে গেল দুই বউয়ে তুমুল ঝগড়া। তারপর তেতেপুড়ে জনার্দন বাড়ি ফিরতেই তার বউ তাকে সাতকাহন করে লাগাল। সঙ্গে চোখের জলের অস্ত্র। বাস, আগুন জ্বলে গেল জনার্দনের মাথায়…

‘খুন?’ আমি সচকিত হয়ে বললাম।

‘আরে না না, খুন নয়।’ জনার্দন বললে তবে রে, চললাম আমি আর এস পি অফিসে। আজ থেকে আর সি পি এম করব না। সত্যিই জনার্দন সেই থেকে খুব আর এস পি করে। সেই কোঁদলে মূর্তিপুরে ভোট ভাগ হয়ে গেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ও অঞ্চলে ফ্রন্ট হেরেছে। এই তো গাঁয়ের রাজনীতি।

শহরে থাকি। খবরের কাগজ পড়ে গ্রাম্য রাজনীতির খবর পাই। তাতে তো কোনওদিন এ সব খবর বেরোয় না। তাই অবাক লাগে খুব। তার চেয়েও সন্ত্রম আসে স্থিতধী সুফল সরকারের বিশ্লেষণে, ঘটনা সাজানোর বিন্যাসে। কিন্তু মানুষটার নিজের কথা জানা খুব শক্ত। প্রায় কিছুই বলেন না। খোঁচাতেই হয় কৌশলে। জিজ্ঞেস করি: ‘সারাদিন তো জমির কাজে কাটে আপনার। সন্ধের পর কী করেন? হরিনাম?’

খুব অবজ্ঞার সুরে উত্তর এল: ‘হরিনাম করে পাপী-তাপী। আমার ও সব বালাই নেই। পাপ তো কিছু করিনি। বিশ্বাসও নেই পাপপুণ্যে, ভক্তি নেই দেবদ্বিজে। মানুষকে বিশ্বাস করি। মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন? এ দেশটার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ভক্তি, মানুষকে মাথা তুলতে দেয় না। আমার লড়াই এই নেতানো ভক্তির বিরুদ্ধে।’

‘কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি’, আমি বললাম, ‘সন্ধের পর কী করেন বললেন না তো?’

: আমার একটা অসুখ আছে। সন্ধে হলেই সেই ব্যামোতে ধরে…

: কী ব্যামো? কতদিনের পুরনো?

: তা ধরুন যৌবনকাল থেকেই রোগটার বাড়াবাড়ি। হ্যাঁ তা বছর তিরিশ-চল্লিশ হল।

: হাঁপের টান?

: আজ্ঞে না, লেখাপড়ার ব্যামো। সন্ধ্যা হলেই হেরিকেন জ্বেলে বসি পড়ি। এই আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি আর ভাবছি কখন সন্ধ্যা হবে বসব বইখানা নিয়ে। যে বইখানা পড়ছি তার শেষটুকু জানার জন্যে মন আকুলি-বিকুলি করছে।

: কী সেই বইখানা?

: ইস্পাত’। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির লেখা। পড়েছেন?

মাথা নাড়লাম। কিন্তু বলতে পারলাম না কতখানি বিস্ময়ের ধাক্কা লাগল মনে। শুধু চমকিত নয়, যাকে বলে চমৎকৃত হওয়া। খুবই আশ্চর্য। একই দেশকাল পরিবেশভেদে এক একরকম বিশ্বাসের মানুষ তৈরি হয় কেমন করে? আজকে যখন খুব দূর থেকে ভাবি তখন মেলাতে কষ্ট হয় ওয়াসেক আলীর মতো সংস্কারাদ্ধ আর সুফল সরকারের মতো মুক্তমনা মানুষকে। খুব ঘনিষ্ঠ কালের মানুষ অথচ দুজনেই। এ কেমন করে হয়? বাউল-ফকিররা আমাকে প্রায়ই যে আপ্তজ্ঞানের কথা বলত এ কি তারই উদাহরণ? আমার তো পরিষ্কার মনে হয় একবারও ঈশ্বরকে না ডেকে সুফল আত্মজ্ঞানের চরমে পৌঁছেছেন। অথচ মনের মানুষের পথের উলটো বাঁকে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা।

সেদিন শেষবিকেলে সুফল সরকার আমার জীবনে যে বড় বিস্ময়ের ধাক্কা দিয়েছিলেন তার সমাপনটুকুও কম চমকপ্রদ নয়। তাঁকে স্বভাবতই প্রশ্ন করেছিলাম সেই অজপাড়াগাঁয়ে অস্ত্রোভস্কির পৃথিবী বিখ্যাত বইখানা কোথা থেকে পেলেন? গ্রামে কি লাইব্রেরি আছে?

সুফল সরকার হালকা হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে বললেন: ‘তা হলে আপনাকে কষ্ট করে উঠতে হবে আমার ঘরের দাওয়ার একটা কোণে।’

উঠতে হল। দাওয়ার এককোণে প্যাকিং বাক্সের কাঠে তৈরি একটা সাধারণ খোলা বুকসেলফ। তাতে গোটা পঁচিশেক সোভিয়েত আর চিনা বইয়ের বাংলা অনুবাদ বই খুব যত্ন করে সাজানো। কথায় কথায় জানালেন এ সব বই অন্তত দশবার পড়েছেন। পেয়েছেন বাঁচার মন্ত্র, সংগ্রামের রসদ। ক্লাস সিক্স অবধি বিদ্যে কর্ষিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্যভাবনা আর প্রগতি মন্ত্রে। ‘ইস্পাত’ বইটা হালে কিনেছেন শহরের বইমেলা থেকে।

এতক্ষণকার লুকিয়ে থাকা মানুষটা অনর্গলিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন একেবারে গর্বিত মুখরতায়। কী উদ্দীপ্ত সেই মুখভঙ্গি! ‘তেভাগা আন্দোলনের নাম জানেন? তারই ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ি হঠাৎ। সেই থেকে পড়ার নেশা। অবিশ্যি তখন কাজের চাপ খুব ছিল। সংগঠনের চাপ। তারপর দেশভাগ। কুটোর মতো ভেসে এসে প্রথমে বহিরগাছি, দশ বছর পরে এই শ্যামপুরে পাকা পত্তনি। তবু নতুন দেশে নতুন গ্রাম গড়া। সেও এক বড় সংগঠন। মানুষের সঠিক পথটা বোঝানো, সঠিক কাজটা করানো। এখন খানিকটা বিশ্রাম পাই। পরামর্শ দিই। নিজেও পড়ে পড়ে জানি অনেকটা।’

‘এ গ্রাম তাহলে আপনার কব্জায়?’ আমার জিজ্ঞাসা।

: কব্জা-টব্জায় বিশ্বাস করি না। যৌথ জীবন। সবাই খাটি, খাই। সবাইয়ের সুখে-দুঃখে সবাই দাঁড়াই। আমরা এককাট্টা।

মাঝে মাঝে ভাবি, সুফলরা কি এখনও এককাট্টা? রাজনীতির ফড়েরা এখনও সেখানে ঢোকেনি? শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের মানুষ কি সুফলের নেতৃত্ব এখনও মেনে চলেছে? কতবার ভেবেছি আরেক বার শ্যামপুর যাই। কিন্তু যাইনি। যদি তেমন আর না দেখি? মনের অতলে থাকুক একটা অমলিন বিশ্বাসের স্মৃতিচিত্র। কে আর শুদ্ধতাকে ভাঙতে চায়?

সাহেবধনী সম্প্রদায়ের সন্ধানে যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম তখন দুটো চিন্তা মাথায় ছিল। চাপড়ার বৃত্তিহুদা গ্রামে সাহেবধনীদের মূল গুরুপাট। সেখানে প্রতিদিন তাদের উপাস্য দীনদয়ালের ভোগরাগ সন্ধ্যা আরতি দেন মূল সেবাইত, আর প্রতি বৃহস্পতিবার দীনদয়ালকে দেওয়া হয় বিশেষ ভোগ ও পূজা। সেবাইত শরৎ পালকে আমি প্রথম চিন্তা থেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: ‘আপনি তো সাহেবধনীদের মূল ফকির। তা আপনাদের সাহেবধনী সম্প্রদায়ের যে অগণিত ভক্তশিষ্য চারিদিকে ছড়িয়ে আছে তাদের দীক্ষাশিক্ষা দেয় কে? সবাই আপনার কাছে আসে?’

শরৎ পাল বলেছিলেন: ‘না। আমাদের এই পাল বাড়ি থেকে দীনদয়ালের ঘরের সত্যনাম যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে যারা ভাল ভক্ত, মধ্যম রকম শিক্ষিত, ভাল বলতে-কইতে পারে তাদের আমরা বিশেষ অনুমতি দিই তাদের নিজ গ্রামে নিজ-বাস্তুতে দীনদয়ালের ‘আসন’ প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের বলা হয় ‘আসুনে ফকির’। তারা দীক্ষাদানের অধিকারী। সায়ংসন্ধ্যা দীনদয়ালের পুজো উপাসনা করে তারা। তারাই আমাদের শিষ্য বাড়ায়। অগ্রদ্বীপের যে মেলা বসে চৈত্র একাদশীতে, সেখানে আসুনে ফকিররা তাদের শিষ্য-শিষ্যা নিয়ে আসে। মচ্ছবের চাল-ডাল দেয়। আমাদের ঘরে খাজনা দেয়। আর আমরা তাদের দিই একটা করে মাদুর একটা করে হুঁকো।’

: ভারী অদ্ভুত নিয়ম তো? লোকধর্মের অনেক দেখা আমার অভিজ্ঞতাও রীতিমতো বিস্ময় মানে। জিজ্ঞেস করি: ‘তার মানে আসুনে ফকিররা আপনার কাছে দায়বদ্ধ আর সাধারণ শিষ্যরা আসুনে ফকিরদের কাছে দায়ী, এই তো? তা আসুনে ফকিরদের নাম-ঠিকানার একটা তালিকা আপনার কাছে আছে তো?’

: নিশ্চয়ই। আপনি অগ্রদ্বীপের মেলায় দেখেননি লালখেরোর খাতা নিয়ে গোমস্তা আসুনে ফকিরদের জরিমানা নেয়?

: জরিমানা?

: হ্যাঁ, আমাদের মতে খাজনাকে বলে জরিমানা। আমরা তাদের ঐহিক কর্তা যে।

: বাঃ চমৎকার সিসটেম। তা আপনাদের অনেক কিছু তো দেখা হল, এখন আমার দুটো আগ্রহ আছে। এক, একজন আসুনে ফকিরকে দেখা, আর দুই, একজন দীনদয়ালের খুব সাধারণ ভক্তকে কাছ থেকে দেখা। এই সাধারণ ভক্তকে আমি খুঁজে নেব যে-কোনও গাঁয়ে। কিন্তু একজন আসুনে ফকিরকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে গেলে তো আপনার মতামত দরকার। ঠিক কার কাছে গেলে ক্রিয়াকলাপ দেখা যাবে, কে সব ঠিকমতো বোঝাতে পারবে, সেটা আপনিই ভাল বুঝবেন। তা ছাড়া যদি একটা চিঠি লিখে দেন তো খুব সুবিধে হয়।

শরৎ পাল খুব চিন্তা করে জিজ্ঞেস করলেন, কীরকম আসুনে ফকির দেখবেন? হিন্দু না মুসলমান?’

আমি বললাম, ‘আমার ও সব তফাত নেই।’

শরৎ পাল একটু হেসে বললেন, ‘পুরুষ না নারী?’

এবারে চমকাতে হল। পুরুষ বা নারী দুজনেই দীক্ষাগুরু হতে পারেন নাকি সাহেবধনী মতে?

শরৎ পাল বললেন: ‘আমাদের ঘরে এককালে খুব নামকরা মহিলা ছিলেন জগতীমাতা, দিনুরতন দাসী, লক্ষ্মীটগর। তাঁদের অনেক শিষ্য ছিল। এখনও অনেক আছেন। ঠিক আছে, আপনাকে একটা খুব মজার জায়গায় পাঠাচ্ছি। চলে যান আকন্দবেড়়ে। চেনেন তো? সেখানে দর্জি ফকিরের বাড়ি যাবেন। তার ছেলের নাম কামাল হোসেন। খুব নামকরা লোক। সবাই চেনে। দর্জি ফকির ছিলেন আমাদের ঘরের খুব পুরনো আসুনে ফকির। এখনও আসন আছে। তবে কামাল ফকিরি নেয়নি। ভোগরাগ, নিত্য পূজা, দিবসী, মন্ত্রদীক্ষা সব করে হরিমতী। সে কিন্তু হিন্দু। কামাল তাকে দিদি বলে। দর্জি ফকিরকে হরিমতী ‘বাবা’ বলে ডেকেছিল। সেই থেকে ওই বাড়িতে থাকে। বিয়ে-থাওয়া করেনি। দীনদয়ালের খুব ভক্তিমতী সাধিকা।’

বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়ের ধাক্কা। বলেই ফেলি: ‘মুসলমান বাড়িতে হিন্দু মেয়ে বাস করে?’

শরৎ পাল আহত ভঙ্গিতে বলেন: ‘সব বুঝেও মাঝে মাঝে আপনার ঠিকে ভুল হয়ে যায় বড্ড। আমাদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান বিচার নেই। ওটা আপনাদের হিসাব।’

লজ্জিত হই। সত্যিই ভুল হয়ে যায় বারে বারে। সংস্কার বড় সাংঘাতিক। শরৎ পালের কাছে মার্জনা চেয়ে তাঁর কাছ থেকে একটা চিঠি লিখে নিয়ে বিদায় নিই সেদিনের মতো।

যাবার দিনক্ষণ মোটামুটি জানিয়ে আকন্দবেড়ের ঠিকানায় একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলাম কামাল হোসেনকে। তার ফল পাওয়া গেল হাতে নাতে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিল এক দিব্যি ছই-দেওয়া গোরুরগাড়ি। আকন্দবেড়়ের হাঁটা পথ ক্রোশ দুই তো বটেই। সেটা মালুম হল গাড়িতে যেতে যেতে। দারুণ গ্রীষ্মে গাড়োয়ান গাড়ি চালাতে কুল কুল করে ঘামছে। লোকটা মাঝে মাঝেই সম্রম নিয়ে আড়চোখে দেখছে আমাকে। ভাবছে বোধ হয় কামাল হোসেন হেন আলেম ব্যক্তি যাকে আনতে গো-গাড়ি পাঠায় না জানি তিনি কতবড় লায়েক ব্যক্তি! লোকটার জড়তা কাটাতে নানা খুচরো প্রশ্ন করি সেও হুঁ হাঁ দিয়ে পাশ কাটায় কিংবা অকারণে গোরুর সঙ্গে কথা বলে অবান্তর অব্যয় মিশিয়ে। এ তো ভারী মুশকিল। কাঁহাতক চুপ করে থাকা যায়। তাই একটা বিশদ কৌতূহল জ্ঞাপন করে বসি: ‘হ্যাঁ গো কত্তা, তোমাদের এই কামাল সায়েবের আব্বাজানকে তুমি দেখেছ? বাঃ তা আমার মনে একটা কথা খুব জেগেছে।’

গাড়োয়ান বলে, ‘কহেন’।

: আচ্ছা, মানুষটির নাম অমন অদ্ভুত কেন? দর্জি ফকির আবার কী নাম? মানুষটা দর্জিগিরিও করতেন আবার ফকিরিও করতেন নাকি?

: আজ্ঞে না। প্রথমে ছিলেন শুধুই দর্জি। খুব গরিব মানুষ। রুকুনপুরের নাম শুনেছেন বাবু? তা সেখানকার জমিদার একবার দর্জিকে ডেকে পাঠান তাঁর এক সাবেকি গদি সারাবার জন্যে। এ সব আমাদের শোনা কথা আজ্ঞে। সেই গদি একটা ঘোড়ার এক্কায় চড়িয়ে উনি তো এলেন আকন্দবেড়ের ভিটেয়। পরদিন গদি খুলে তো অবাক। তার মধ্যে সেলাইয়ের ফোকরের চারভিতে গদির চারধারে শুধু মোহর শুধু মোহর!

: সেকী! তারপর?

: উনি তো মাথায় করাঘাত করেন আর কাঁদেন, ‘আই আল্লা এ কী পরীক্ষা আমার।’ কাউকে বলতেও পারেন না। যদি ডাকাতি হয়? সে রাত কোনওরকমে কাটিয়ে গদি নিয়ে ফিরলেন। জমিদারবাবু সব শুনে তো থ। তিনি মোহরের কথা কিছু জানতেন না। তেনার বাপ-পিতামোর কাণ্ড আর কী!

এ যে দেখি গাঁয়ের মধ্যে খাঁটি আরব্যোপন্যাস। খাড়া হয়ে বসি কৌতূহলে। কী হয় কী হয়। গাড়োয়ান একটু দম নিয়ে বলে: ‘মোটমাট তিনশো আকবরি মোহর ছিল। মনের খুশে জমিদারবাবু দর্জিকে দিয়ে দিলেন একশো মোহর। কপাল খুলে গেল মানুষটার। মস্ত বড় দালানকোঠা দলিজ উঠল। খুব রমরমা। তেমনই বোলবোলাও। টাকার গরমে মানুষটার মাথাও গেল ঘুরে। মোহরের তাপ আর দাপ কি সোজা? মাথার গরমে কতদিনের লক্ষ্মীমন্ত বউকে দিলেন তালাক। সে হল আত্মঘাতী। কামাল তখন বালক। আসলে অন্য দিকে মন তখন মানুষটার। ফুরফুরে সুন্দরী সালেহা বিবিকে ঘরে আনলেন বেলডাঙা থেকে। এদিকে হঠাৎ এক রাতে সালেহা সুন্দরী বাকি মোহর আর চাচাতো ভাইকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। আর হবি তো হ, দিন সাতেকের মধ্যে অতবড় দালান-কোঠা হঠাৎ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সবাই বললে তালাক-খাওয়া লক্ষ্মীমন্ত বউয়ের অভিশাপে এমন হল। মানুষটা দিনকতক পাগল-পাগল হয়ে ঘুরে কার বুদ্ধিতে কে জানে পড়লেন হুদোর পাল বাড়িতে দীনদয়ালের চরণে। ব্যস মাথা ঠাণ্ডা। দীনদয়ালের কৃপায় জীবনে শান্তি এল আবার। ফকিরি নিলেন। বাড়িতে দীনদয়ালের আসন হল। সদাই গান করতেন। সেই থেকে নাম রটে গেল দর্জি ফকির।’

: তুমি দেখেছ দর্জি ফকিরকে?.

: হ্যাঁ, আবছা মনে আছে। তখন আমার বালক বয়স। ফকিরের ছিল এই সাদা দাড়ি। গান করতেন সদা সর্বদা, সেটা মনে পড়ে।

গল্পে গল্পে কখন আকন্দবেড়়ে এসে গেছে। হইহই করে অভ্যর্থনা করলেন কামাল হোসেন। বছর পঞ্চাশ বয়সের সমর্থ চেহারার মানুষ। লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। ‘আসুন আসুন, গরিবের কুঁড়ে ঘরে’ বলে হাতে গুঁজে দিলেন ফিল্টার কিংস। কুঁড়েঘর অবশ্য নয়, পাকাবাড়ি। বাড়ির পেছনবাগে ভটভট করে গমকল চলছে। ফিল্টার কিং-এ একটা মোক্ষম টান মেরে ছাড়লেন একরাশ আত্মতৃপ্তির ধোঁয়া। সেইসঙ্গে সংলাপ: ‘এ দিগরে গম পেষাই কল এই একটাই। স্টোর মালিকানা এই অধমের।’

মানুষটির দিকে ভাল করে চেয়ে দেখি এবারে। পেটা চেহারায় আসনাই রোশনাই প্রচুর। চোখে সূক্ষ্ম সুর্মার টান, মানানসই বাবরি। চারপাশে অযাচিত মোসায়েবের দল। হাবেভাবে বোঝা গেল কামাল সাহেব বেশ সম্পন্ন আর প্রতিষ্ঠাবান নেতা ব্যক্তি। এ গ্রামে সম্ভবত তাঁর কথাই শেষ কথা। এঁর বাবা ছিলেন সর্বত্যাগী ফকির, ভাবা যায়? কথা বলবার জন্যে, নিজেকে জাহির করতে মানুষটি বড়ই অস্থির। এ সব লোককে আমি ইচ্ছে করে খুব উসকে দিই। গলগল করে কথা বেরিয়ে আসে। তাঁর কথার ধরতাই মিলিয়ে এবারে বুদ্ধি করে বলি: ‘মনে হচ্ছে শুধু গমকল নয়, কামাল সাহেবের যেন অনেক কিছুই অদ্বিতীয় এ গ্রামে?’

: বেশক বেশক। গুণী লোক গুণীর আদর বোঝেন। গাঁয়ের একমাত্র রাজদূত বাইক অধমের বাড়িতে বাঁধা। দুখানা দোনলা বন্দুক। একমাত্র এই অধমের মেয়ে শহরের কলেজে পড়ে। গ্রামের সবেধন নীলমণি কোয়ক ডাক্তার আমি। ছেলে দ্বীনি আরবি পড়ে কলকাতা মাদ্রাসায়।।

হয়তো অদ্বিতীয়ের তালিকা আরও লম্বা। কিন্তু মাঝপথে বাধা পড়ল। একজন গেয়ো গরিব এসে বলল, ‘হেকিম ছাহেব, মেয়েটার দাস্ত তো হয়েই চলেছে, আমরক্ত। পেট মুচড়ে তেমনি বেদনা। যন্তরনায় মেয়ে আমার কোঁকাচ্ছে গো।’

‘হুম’ গম্ভীর আওয়াজ করলেন কোয়াক ডাক্তার, আপাতত হাকিম সাহেব। মুখটা চিন্তিত করে তুলে আমাকে হঠাৎ বললেন, ‘বুঝলেন তো কেসখানা? একেবারে কেরোসিন। ছটা এন্‌ট্রোস্টেপে কাজ হল না। তবে কি ইঞ্জেকশন দেব নাকি?’ মুখ ঘুরিয়ে লোকটিকে বললেন, ‘তুমি ঘরে যাও, আমি ভেবে দেখি।’ দুজনে এগোলাম। বাড়ির ঠিক পাশে, রাস্তার ওপরে রয়েছে একখানা দোকান। দোকানের এক অংশে বই খাতা পেন্সিল কলম কালি বিক্রি হচ্ছে, আরেকদিকে জমির সার, কীটনাশক, বীজ আর প্রে মেশিন। আমার এতদিনের গ্রাম পরিক্রমায় এমন সারবান দোকান কখনও দেখিনি। বিস্মিত কণ্ঠে বলতেই হয়: ‘এ দোকানও কি আপনার?’

‘একেবারে যথার্থ অনুমান করেছেন। এ দোকানটা আমারই। বেকার ভাইপোকে বসিয়ে দিয়েছি। দোকানের আইডিয়াটা কেমন বলুন তো? জীবনের সার শিক্ষা আর জমির সার সুফলা ইউরিয়া আমি একসঙ্গে বেচি। মানব জমিন আর খোদার জমিন দুয়েরই চাষ চলবে।’ কামাল হোসেন নিজের রসিকতায় নিজেই হাসেন হো হো করে। মোসায়েবরাও গোঁজামিল হাসির কোরাস তোলে।

আমি বেশ খানিকটা মজা পেয়ে বলি, ‘কামাল সাহেব, এইটুকু সময়ে আপনার এত রকম রূপ দেখলাম যে বুঝে উঠতে পারছি না আপনাকে কী বলে ডাকব। ডাক্তারবাবু, কামালভাই না মিস্টার হোসেন?

‘আরে আরে, দাঁড়ান দাঁড়ান। এখনও আপনি আমার কিছুই দেখেননি। তবে সমিস্যেটা ভাল ধরেছেন। এ গাঁয়ে বেশির ভাগ লোকজন আমাকে জানে দর্জি ফকিরের ছেলে কামাল বলে। আলেম সমাজে আমি ছায়েব। পেশেন্টরা বলে হাকিম সাহেব। কেউ কেউ বলে মাস্টার মশাই…

: মাস্টারিও করেন নাকি?

: আমি তিন রকমের মাস্টার। এক, প্রাইমারি ইস্কুলের হেড মাস্টার, দুই, আলকাপ গানের দলের মাস্টার…আর তিন নম্বর কী বলুন তো?

: এ ছাড়া তিন নম্বর মাস্টার আর কী হতে পারে?

: হুঁ হুঁ, এই দেখুন বাড়ির গায়ে বাঁধা লাল ডাকবাক্স। আমি পোস্টমাস্টারও যে। খাম পোস্টকার্ড বেচি।

বিস্মিত আমার আর একটা অনুমানাত্মক প্রশ্নও লক্ষ্যভেদ করে, ‘হাজী সাহেব কি রাজনীতিও করেন নাকি?’

উল্লসিত কণ্ঠে জবাব আসে, ‘অতি অবশ্য। আমি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। তাই একটু আধটু পার্টি করতে হয় বইকী। এখনকার দিনে পার্টি না করলে জমি জিরেত দোকান মাস্টারি পঞ্চায়েত সব ঠেকানো যায়? শহরের বিখ্যাত কমরেডরা মাঝে মাঝে এই গরিবের দলিজে পা রাখেন।’

: আপনার তা হলে এ গাঁয়ে কোনওই অসুবিধে নেই?

আকাশের দিকে হাত তুলে কামাল হোসেন বললেন, ‘সবই খোদাতাল্লার ইচ্ছা। আমি গ্রামের একজন আলেম মানুষ হবার জন্যে মসজিদ বানিয়ে দিয়েছি। ইমানদার মুসলমান সমাজের নেকনজর পাবার আশায় ছেলেকে ভর্তি করেছি মাদ্রাসায় আরবি পড়তে। সাধারণ গরিব-গুরবো মানুষকে বশ করেছি হেকিমি করে। গাঁয়ের কিনরা বেশির ভাগ আমার জমিতে অন্নদাস। বাউল বোরেগীরা মান্য করে দর্জি ফকিরের ছেলে বলে। হিন্দুরা আমাকে প্রোগেসিভ ভাবে কেননা মেয়েকে শহরে পাঠিয়েছি উচ্চশিক্ষায়। এস, ডি, ও, বি. ডি. ও, বাবুরা সমীহ করেন রাজনীতি করি বলে।’

‘কিন্তু যুবসমাজ? বেকাররা?’, আমার জিজ্ঞাসা।

: তাদের জন্য যে আলকাপের দল বানিয়েছি। কটাকে বেকারভাতা জুটিয়ে দিয়েছি। যাত্রাদল আনি শীতকালে।

: কিন্তু আপনি শরিয়ত মানেন?

: সামানা-সামনি সবই মানি। সবাইকে বলি ‘মসজিদে যাও’ নামাজ পড়ো’। কিন্তু আসলে কিছুই মানি না। কেন? মূলে যে দর্জি ফকিরের পয়দা করা মাল আমি—সেটা ভুলি কী করে? ঘরে আছেন আমার হরিমতী দিদি আর মহামান্য দীনদয়াল দীনবন্ধু গোপ্তবাবাজি। আসলে হিন্দু-মুসলমান বলে সত্যিই কি কিছু আছে? আপনি মানেন? একটা মজার ঘটনা শুনবেন?

: বলুন। আপনার সব কথাই বেশ মজার।

বেশ খানিকটা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে কামাল বললেন: ‘আমার এক ভাগনে আছে অপোগণ্ড। চাচাতো দিদি অল্প বয়সে মারা গেলে আমার ভাগনেটাকে আমিই এনে মানুষ করেছি। ভাল লেখাপড়া করল না। বাউন্ডুলে টাইপ। হরিমতী দিদির কাছে মানুষ। কোনও কাজে লেগে থাকতে পারে না। তবে সৎ। আমার বিবি ওকে খুব পছন্দ করে। তাকে কীসে কোন কাজে যে লাগাই ভেবে পাইনে। ছেলেটা কিন্তু বুদ্ধি ধরে। একদিন এসে বলে, ‘চাচা কিছু টাকা দেবে?’ কী করবি জিজ্ঞেস করতে বলে, ‘হোটেল খুলব।’ আপনি যেখানে বাস থেকে নামলেন ওখানে আজকাল মালদা বহরমপুর আর উত্তরবঙ্গের বাস থামে। ছোকরা খুলে দিলে এক হোটেল।’

: সে কী? মুসলমানের হোটেলে সাধারণ পাবলিক ভাত-ডাল খাচ্ছে?

‘আরে ছোঁড়ার প্যাঁচটা শুনুন। তার খোলে খোলে বুদ্ধি।’ ভাগনের বুদ্ধির তারিকে মামা হেসে বলেন, ‘আমাদের গাঁয়ে রাম চক্কোত্তি বলে একজন আছে। গৌরবর্ণ সুন্দর চেহারা। কিন্তু রাঙামুলো। গোমুখ্যু। তবে ভোজে-কাজে রাঁধে ভাল। আমার ভাগনে খোদাবক্স তাকে বললে, ‘রামকাকা চাকরি করবে?’ সে রাজি হয়ে গেল। ব্যস, ছোঁড়া বাস-রাস্তায় হোটেল খুলল। খালি গায়ে মোটা পৈতে পরে রাম চক্কোত্তি রাঁধে-বাড়ে খদ্দেরদের পরিবেশন করে।’

: আর খোদাবক্স? |

: পাকা শয়তান। সে ভালমানুষের মতো মুখ করে কাউন্টারে বসে টাকা পয়সা আদায় করে। মাছ মাংস সবজি কেনে। ছোকরা এত বড় বাঁদর যে হোটেলের নাম দিয়েছে বড় অদ্ভুত। ভাবতে পারেন? নাম দিয়েছে—‘খোদাবক্সের হিন্দু হোটেল’। খাসা চলছে। তাই আপনাকে বলছিলাম হিন্দু-মুসলমান বলে কিছু নেই। সব সাজানো।

এমন একটা দারুণ চোখ-কান-খোলা চালিয়াত মানুষ এতটা উদার হয় কী করে? আমার মনে ধন্দ জাগে। এ তো পাক্কা রিয়ালিস্ট, আচারে কম্যুনাল অথচ মনের মধ্যে এতটা স্বচ্ছ হয় কোন মন্ত্রে? এই কি তবে দীনদয়ালের ঘরের সত্যিকারের শিক্ষা? একটু যাচাই করতে লোভ জাগে। জিজ্ঞেস করে বসি, ‘মাস্টারমশাই থুড়ি হেকিমসাহেব, আপনার ছেলেমেয়ের নাম কী রেখেছেন?’

‘খুব ভাল কথা তুলেছেন। হরিমতী দিদি ওদের ডাকে গোপাল আর মীরা বলে। ওদের ইস্কুল কলেজের পোশাকি নাম মকবুল হোসেন আর রোকেয়া সুলতানা’, কামাল বলেন।

আমি ককিয়ে উঠি, ‘সে কী? মুসলমানি নাম কেন?’

: আরে রসুন রসুন। মাথা ঠাণ্ডা করুন আগে। খুব তো হিন্দুয়ানির বড়াই করেন, হিন্দুজাতি খুব উদার নাকি, তো একটা ধন্দের জবাব দেবেন কি মেহমান? এই যে আমি মানুষটা। এতক্ষণে আপনি তো অন্তত বুঝেছেন যে আমি ধর্ম মানি নে? ঘরে আমার হরিমতী দিদি, ভেতর ঘরে দর্জি ফকিরের দীনদয়াল, তবু আমি কেন মুসলমানি কেতা মেনে চলি? কারণ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে হবে যে! সমাজ বলে একটা জিনিস আছে মানেন?

: সমাজ মানি বইকী? আমাদের শহুরে সমাজের আঁটাআঁটি কমে আসছে। তবে গ্রামসমাজে নানা বন্ধন বা নিয়ম-কানুন আছে মানি।

কামাল প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আপনি কেমন যেন দায়সারা গোছের সাজানো কথা বলে যাচ্ছেন মহাশয়। শুনুন স্পষ্ট করে বলি। আমাদের গ্রাম-ঘরে লাভ ম্যারেজ ফ্যারেজ খুব একটা হয় না। এখানে ছেলেমেয়ের বাবা মা-ই বিয়ের পাকা বন্দোবস্ত করে। এবারে বলুন মকবুলকে কোন হিন্দুবাড়ি বিয়ে দেওয়া যাবে? সবাই তো জানে আমার ঘরে দীনদয়ালের আসন, হরিমতী দিদির বাস। সবাই এটা ভাল করেই জানে যে আমি পুরাণ-কুরান কোনওটাই অন্তর থেকে মানিনি। তবু কি আপনার ভাইপোর সঙ্গে আমার মীরার বিয়ে দেবেন? দেবেন না। অথচ মীরা আমার রূপসী আর গুণের মেয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ে। পণের টাকাও আমি অগাধ দিতে পারি। তবু হিন্দুরা তাকে নেবে না। তা হলে উদারতা উদারতা বলে চেঁচান কেন?’

কামাল হোসেনের কথা তো নয় যেন বুলেট। ঝাঁঝাঁ করে ওঠে মাথা। বিদ্ধ হয় একেবারে মর্মস্থলে। কী জবাব দেব? সত্যিই তো সমাজের ফ্রেম আমাদের অনড়, সংস্কার অতলস্পর্শী। শুধু গ্রামে কেন, শহরেও নয় কি? আমাদের কোনও ভাইপোই যদি হৃদয়ের উদারতায় ভালবেসে কোনও রোকেয়া খাতুনকে বিয়ে করতে চায়, আমরা কি প্রথমেই বাধা দেব না? যদি বা তার অতি স্বাধীনচিত্ততার বা ভাল চাকরির ব্যক্তিত্বের সুবাদে সে বিয়ে আমরা মেনে নিই তবুও কি কার্ডে ছাপাতে পারব রোকেয়ার নাম? তার বাবার সত্যিকারের পরিচয়? সত্যি এমন বিপদে কখনও পড়িনি। দুর্গতি তখনও বাকি ছিল। আমার চরম দুর্বল মুহূর্তে কামাল দিলেন আরেক মুষ্ট্যাঘাত। বললেন, ‘আপনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তো অধ্যাপক ছিলেন। আপনি তো আবার সাহেবধনীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তা আপনার একটা মেয়ে আছে শুনেছি। তার বিয়ে দিতে পারবেন কোনও মুসলমান ছেলের সঙ্গে? আচ্ছা আপনাকেও দিতে হবে না, সে যদি নিজেই বিয়ে করতে চায়? আপনার অধ্যাপিকা স্ত্রী সহজে রাজি হবেন? তিনি কি এই বলে মেয়েকে গাল দেবেন না যে ‘ছি ছি, কোন বাবার মেয়ে হয়ে তুই কী করলি? সমাজে কলেজে ছাত্রীদের কাছে আর আমি মুখ দেখাতে পারব?’ কী? বলবেন না এই কথা? বুকে হাত দিয়ে বলুন? কিন্তু মুসলমান সমাজ আমার ছেলে-মেয়েকে নেবে। আমি নাস্তিক বা উদারপন্থী জানলেও নেবে। সেই জন্য আমাকে আলেম সাজতে হয়। সবাইকে বলতে হয় নামাজ পড়ো। এর কারণ বোঝেন?’

: কী এর কারণ?

: এর কারণ, ভাল হোক মন্দ হোক আমাদের দেশের শরিয়তভিত্তিক মুসলমান সমাজ ধর্মের বাইরের আচরণকে খুব বেশি দাম দেয়। সমাজ শুধু দেখে, লোকটা নামাজ পড়ে কি না, মসজিদে যায় কি না, কলমা মানে কি না। যদি মানে, ভণ্ডামি করেও মানে, তবু তার সাত খুন মাপ। এই জন্যে আমি আচরণে মুসলমান। আমি বাবার মতো ফকিরি করলে কি সমাজে এত গণমান্য হতাম?

একেবারে ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের মতো একজন এই সময় বেরিয়ে এসে অসহায় আমাকে বাঁচালেন। হরিমতী দিদি। গেরুয়া আলখাল্লা। গলায় তসবী মালা। টকটকে গায়ের রং। সৌম্য চেহারা। দারুণ একটা হাসি মুখে নিয়ে বাড়ি থেকে বার হয়ে কামালকে ধমকালেন, ‘হ্যাঁরে খ্যাপা, শরিয়তে কোথায় লেখা আছে যে বাড়িতে মেহমান এলে তাকে খেতে বসতে না দিয়ে শুধু বকাঝকা করতে হয়? জ্ঞানহারার মতো চ্যাঁচাচ্ছিস? ওকে ঘরে আনবি নে?’

‘বেশক বেশক। চলুন চলুন। তসরিফ রাখিয়ে’, কামাল মুখ টিপে হাসলেন।

ঘরের ভেতরে বসিয়ে হরিমতী দিদি আমাকে পাখার বাতাস করতে লাগলেন ‘মুসলমান হলেই কি হয়? মেহমানের কদরদানী জানিস? সে জানত বাবা।’

কামাল আমার দিকে চোখ টিপে দিদিকে বলল, ‘এখন তোমার হিন্দু ভাইয়ের খিদ্‌মদ্‌গার করো। তার বহুত পরেশানি হয়েছে। মুসলমান ভাইটি চুলোয় যাক। তা হিন্দু ভাইয়ের জন্য সারা সকাল ধরে যে ক্ষীর রাবড়ি লুচি হল তা কি এই দুশমন ভাই পেতে পারে না? খাওয়া-দাওয়ায় কিন্তু হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই।’

‘বেরো এখান থেকে’ পাখার বাঁটের এক ঘা খেলেন কামাল।

‘তুই কি না খেয়ে ছাড়বি নাকি? লজ্জা করে না? গোপাল-মীরা বাড়ি নেই, খোদাবক্স খায়নি। তোর এত নোলা আসে কোত্থেকে?’

‘পালাই, ব্যাপার খারাপ’, বলে কামাল সত্যিই চললেন। যাবার ঠিক আগে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘একটু চারদিক ঘুরে আসি। পেশেন্টটাও দেখে আসি। জলখাবার খান। হরিমতী দিদির সঙ্গে কথাবার্তা বলুন। তাঁর সঙ্গেই তো আপনার আসল কারবার। দুপুরে খেয়ে উঠে আবার তর্ক হবে কেমন? আর হ্যাঁ, ভাল কথা, দিদির গান একটা শুনবেন তোয়াজ করে। দিদির আমার স্নেহ নেই, মায়া নেই, দরদ দুঃখ কিছু নেই। চেহারাও তো দেখছেন পেঁচির মতো, তাই আব্বাজান বিয়ে দিয়ে যেতে পারেনি। আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। তবে দিদির আমার গানের গলাটা বড় ভাল। ওই গানটা শোনায় বলে দুবেলা দু মুঠো খেতে পায়। নইলে কবে তেড়িয়ে দিতাম।’

‘ভাগ ভাগ’, হরিমতী দিদি হাসিমুখে এগিয়ে ভাইকে মারলেন এক ঘুঁষি। বললেন, ‘তোর পয়সা লবডঙ্কা। সব আমার বাবার। এই, তাড়াতাড়ি খেতে আসবি সোনা।’

এমন একটা মধুর পরিবেশে মনটা স্বভাবতই নরম হয়ে যায়। হরিমতী দিদির তৈরি ক্ষীর রাবড়ি লুচির স্নিগ্ধ স্বাদ সেই নরম মনে এমন একটা সুবাসিত উদ্যানের ব্যাপকতা আনে যে আমার সব দিকে তালগোল পাকিয়ে যায়। হরিমতী দিদি আমার মনের সেই উথাল-পাথাল বুঝে কাছে আসেন। স্নিগ্ধস্বরে বললেন, ‘সবই মানুষের লীলা। দীনদয়াল আমাকে কতই দেখালেন। নইলে আমার এই বাড়িতে ঠাঁই হয়? এ বাড়ি তো স্বর্গ। শুধু তো আমার পাগলা ভাইটিকে দেখলে। রসুই-ঘরে সুন্দরী বউবিটিকে এখনও তো দ্যাখোনি। সে তোমার জন্যে চালের রুটি, মুর্গির মাংস বানাচ্ছে। মীরা গোপালকে দেখলে না, একেবারে সোনার ছেলেমেয়ে। আর সবাইকে টেক্কা দিয়ে সেই শয়তান নচ্ছার খোদাবক্সটা। কে জানে ছোঁড়া আজ বাড়ি আসবে কিনা।’

আমি ভাবলাম দীনদয়াল আমাকেও বড় রকম দেখালেন না। মাধুর্যের এমন বর্ণময় ছবির চারপাশে মানবিকতার এমন পোক্ত ফ্রেম তো আগে কখনও দেখিনি। অনেকটা যেন আপ্লুত হয়েই বললাম, ‘দিদি, তোমার কথা শুনব আমি। তুমি কেমন করে এ বাড়ি এলে? কোথাকার লোক তুমি?’

স্নিগ্ধ লাজুক হেসে দিদি বলেন, ‘তুমি তো বৃত্তিহুদোর পালবাড়ি গেছ? সেখানেই আমার লালন-পালন। আমি ওদের “দোরধরা”। ওকি অমনধারা তাকিয়ে রইলে কেন? “দোরধরা” মানে বোঝ না?”

:না তো।

: শোনো বুঝিয়ে দিই তোমাকে। আমরা জাতে কুমোর। আমার বাবা-মা থাকত হুদো গাঁয়ের পাশে আড়ংসরষেতে। তাদের যখন কিছুতেই সন্তান হল না তখন পালবাড়িতে দীনদয়ালের কাছে সন্তানের জন্যে মান্‌সা করলে আমার জন্ম হয়। একেই বলে দোরধরা। ছোট থেকেই নাকি আমার ধম্মে মতিগতি। তাই বাবা-মা বিয়ে না দিয়ে পালবাড়িতে রেখে দেয়। তোমাকে যে শরৎ পাঠিয়েছে তার বাবা লালচাঁদ পালের কাছে আমার দীক্ষাশিক্ষা। আমি জন্মবৈরেগী। দীনদয়ালের চরণে পড়ে থাকি।

: এখানে এলে কী করে?

: কেন ফকির বাবার সঙ্গে। তুমি শোননি কামালের বাবা দর্জি ফকিরের ঘটনা? তার বিবি যখন পালাল, বাড়ি গেল পুড়ে তখন তো একেবারে উন্মাদ পাগল হয়ে গিয়েছিল। দীনদয়ালের কৃপায় সব ঠিক হয়। কিন্তু মানুষটা তো শেষপর্যন্ত ফকির হয়ে গেল। সংসার দেখে কে? দীনদয়ালের সেবাপুজো করে কে? কামালকে দেখে কে? ফকিরকে ‘বাবা’ বলে ডেকেছিলাম যে! বাবা তাই যখন বললে, ‘মা, তুই না গেলে আমি বাঁচব না’, তখন আসতে হল।

হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন দিদি। বললেন, ‘কতদিন হয়ে গেল মানুষটা মাটি নিয়েছে। আমাকে মায়ায় বেঁধে রেখে গেল। এই সোনার সংসারের মায়ায় বড় আটকে গেছি ভাই। বুড়ো হয়েছি। চলে গেলে খোদাবক্সকে কে দেখবে? দীনদয়ালের কী হবে সেবাপুজো? তাই ভাবি।’

খাওয়াদাওয়ার আগে ঠিক দুপুরে হরিমতী দিদি আমাকে নিয়ে গেলেন দীনদয়ালের ঘরে। ঠাণ্ডা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে একস্টা প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের একপাশে ছোট জলচৌকি। তাতে পাট করা বস্ত্র, তার ওপর কটা ফুল ছেটানো। ত্রিশূল ফকিরিদণ্ড আশাবাড়ি আর হুঁকো। পাল-বাড়ির কোনও গুরুর একজোড়া খড়ম। সামান্য দীন আয়োজন। দীনদয়াল সাহেবধনী তো মূর্তিধারী সাকার নন।

দিদি আসনে বসে নানা ক্রিয়াকলাপ করতে লাগলেন। ধূপের আকর্ষণী গন্ধে, প্রদীপের ঘি-পোড়া গন্ধে চন্দনের গন্ধে ঘরখানি উত্তাল। শান্ত নিরুদ্বেগ শীতল পরিবেশে দীনদয়ালের দিবসী পুজো ভোগরাগ চলল। হঠাৎ দিদি উঠে দাঁড়িয়ে চামর দোলাতে দোলাতে বললেন:

এসো গো ধেয়ানে বোসো গো আসনে

বরণ করি তোমাকে বজ্ৰভরনে।

চামর দুলাই তোমার সুখের কারণে।

জয় দীনবন্ধু দীননাথ।

মেঝেতে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন:

জয় দীনদয়াল অটলবিহারী করোয়াধারী।

দীনদয়াল সাহেবধনীর নামে একবার হরি হরি বলো

হরিবোল

আবার খানিকক্ষণ ধ্যানস্থ থেকে বললেন;

ক্লিং ক্লিং দীনদয়াল সাহেবধনী সহায়।

সাহেবধনী আল্লাধনী সহায়।

গুরু সত্য। চারিযুগ সত্য। চন্দ্রসূর্য সত্য।

খাকি সত্য। বাক সত্য। কাম সত্য। করণ সত্য।

গোঁসাই দরদী সাঁই

তোমা বই এ জগতে আমার কেহ নাই।

আমি ভাবতে লাগলাম কী বিচিত্র এই লৌকিক ধর্মের জগৎ। হরিবোল ধ্বনির সঙ্গে আল্লার নাম মিশে যাচ্ছে। কী অদম্য বিশ্বাসের জোরে গুরু সত্য আর কাম সত্য একই উচ্চারিত হচ্ছে। চারিযুগ চন্দ্রসূর্য সবই সত্য? সেই সঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণবের বীজমন্ত্র ক্লিং ক্লিং ধ্বনিও একাঙ্গ? কেমন করে হয়? যেমন করে এ ঘরের নির্জন প্রকোষ্ঠে মিলে যায় ধূপগন্ধের সঙ্গে চন্দনসুরভি আবার তার সঙ্গে প্রদীপের ঘিয়ের পোড়া গন্ধ? দীনদয়ালের এই শান্ত শীতল আধো-অন্ধকার নিরুদ্বেগ ঘরখানির সঙ্গে বাইরের দাবদাহ-ঘেরা গ্রীষ্ম প্রকৃতির কোনও মিল নেই অথচ। মিল নেই মানুষে মানুষেও। এ ঘরের বাইরে পা দিলেই আমি হিন্দু, কামাল হোসেন মুসলমান। সেখানে মকবুলের সঙ্গে আমার মেয়ের কোনওদিন মিলন হতে নেই।

যেন আমার স্বপ্নাচ্ছন্নতা ছিন্ন করতেই একসময় হঠাৎ শেষ হয়ে গেল দীনদয়ালের দিবসী পুজো। বাইরের-বারান্দায় এসে বসলাম ধ্বস্ত দুপুরে। চার দিক গরমের ভাপে দুঃসহ। হরিমতী দিদি বোধহয় অন্তর্যামীর মতো বুঝলেন আমার মনের তাপ আর অন্তর্বেদনা। খুব শান্তভাবে গায়ে হাত বুলিয়ে আমাকে বললেন, ‘তুমি বোসো এখানে দু দণ্ড। আমি তোমাকে একখানা গান শোনাই। শান্তি পাবে মনে।’

আশ্চর্য মধ্যসপ্তকে শুরু হল কণ্ঠবাদন:

রাম কি রহিম করিম কালুল্লা কালা

হরি হরি এক আত্মা জীবনদত্তা

এক চাঁদে জগৎ উজ্জ্বল।

আছে যার মনে যা সেই ভাবুকতা

হিন্দু কি যবনের বালা।

লক্ষ্মী আর দুর্গাকালী ফতেমা তারেই বলি

যার পুত্র হোসেন আলী মদিনায় করে খেলা

আর কার্তিক গণেশ কোলে করে

বসে আছেন মা কমলা।

হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিল একটা অদ্ভুত অনুভূতির ঝড়ে। কে লিখেছিলেন এমন গান? সে কি আজকের দিনটার কথা ভেবে? মা কমলার কোলে কার্তিক গণেশের মতোই কি হরিমতী দিদির কোলে বসে আছি আমি আর কামাল হোসেন? একই স্নেহে ভালবাসায় উত্তাল হয়ে? এ কোন মানবিক মনীষী এক শতাব্দীর আগের গ্রামে গেঁথে গিয়েছিল এমন গান? ততক্ষণে গানের শেষ অংশে পৌঁচেছেন দিদি গাঢ় উচ্চারণে:

কেউ বলে কৃষ্ণরাধা কেউ বলে আল্লাখোদা

থাকে না তেষ্টা ক্ষুধা

ঘুচে যায় জঠরজ্বালা।

মনে ভেবে দ্যাখো একই সকলে

পারো রে এক নামের মালা।

এক লয়ে ভাগলটি এক পানি একই মাটি

এক হাওয়া জেনো খাঁটি

একের কবল এই কলা ॥

আমি অপলক চেয়ে থাকি হরিমতী দিদির দিকে। তাঁর চোখে জল। সে কি আনন্দের না ভক্তির?

পাশাপাশি আমি আর কামাল হোসেন খেতে বসলাম। দিদি বসলেন সামনে একখানা হাতপাখা নিয়ে। পরিবেশন করতে লাগলেন কামালের বিবি। গাঁ-ঘরের লজ্জাশীলা মহিলার মতো ঘোমটা টানা দুখানা মায়ালি চোখের বিস্ময় ঘোমটার ফাঁকে ধরা পড়ছিল। উনুনের আঁচের মতো উজ্জ্বল রং গরমের তাপে ফেটে পড়তে চাইছে যেন। চমৎকার স্বাদু রান্না। কামাল বারবার খুব তারিফ জানালেন। খেয়ে উঠে ভেতরের শোবার ঘরের বিছানায় বসলাম দুজনে। কামাল সিগারেট ধরিয়ে তাঁর বিবিকে ডাকলেন। সসংকোচে ঢুকে একপাশে দাঁড়ালেন অবগুণ্ঠনবতী। কামাল উঠে দাঁড়িয়ে বিবির ঘোমটা খুলে দিয়ে বললেন, ‘জগতের আলো নুরজাঁহা। একদৌড়ে পালালেন বিবি তাঁর বিদ্যুৎ চোখের এক দারুণ দৃষ্টির বিপ্লব হেনে।।

হো হো করে প্রচণ্ড শব্দে হেসে কামাল বললেন, ‘সকালে আপনাকে বলা হয়নি, আমি আরও দুটো বিষয়ে অদ্বিতীয়। চারপাশের দশ-বিশখানা গাঁয়ের মধ্যে যত এলেমদার মুসলমান আছে তার মধ্যে একমাত্র আমার ঘরে দুটো নয় চারটে নয়, একখানা মাত্তর বিবি। আর দু নম্বর খবরটা হল আমাদের দুজনের বিয়ে ভাব-ভালবাসা করে।’

খুব তারিফ চোখে তাকালাম। তারপরে বললাম: ‘আপনার বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ নাকি তার কম?

: তা পঞ্চাশই ধরুন। কেন?

: ভাবছি কতদিন আগে এই ভাব ভালবাসাটা হয়েছিল। তখন আপনার কত বয়স?

: সেসব কি মনে আছে? তবে এক কথায় শুনবেন? তখন আমার অনুরাগের বয়স।

ঘরের চৌকাঠের ওপারে কি একটা কাচের ঝাড়বাতি ভাঙল মধুর শব্দ করে? আসলে খিল খিল হেসে পায়ের মল চুটকি বাজিয়ে দৌড় লাগালেন অনুরাগিণী।

উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে কামাল বললেন, ‘জীবনটা এমনই খুব সুন্দর। মানুষও তো আসলে আনন্দেই বাঁচতে চায়। কিন্তু আজ ঘর আর বার আলাদা হয়ে গেছে। এমন যে সুখীসুন্দর মানুষটা আমি, বাইরে গেলেই ভোল পালটাতে হবে। বাজে কথা, সাজানো কথা, মন-রাখা কথা কইতে হবে। অথচ আমার রক্তে দর্জি ফকিরের হক্‌ রয়েছে। সে মানুষটা কপটতা জানত না। মারফতি ফকির তো?’

আমি বললাম: ‘এই শরিয়ত মারফত অনেকবার শুনেছি। একটু খোলসা করে বলুন তো তার কী তফাত?’

হরিমতী দিদি ঘরে ঢুকতে আমার কথাটা শুনেছিলেন। বললেন: ‘ও কী বলবে? ও তো জ্ঞানছাড়া। আমি বুঝিয়ে দিই। শরিয়ত হল কিনা গাছের গুঁড়ি। যদি ফল ফুল পেতে চাও তবে কি গুঁড়িতে পাবে? উঠতে হবে গাছের ডালে। মারফত হল গাছের ডাল ফল ফুল। শরিয়ত থেকেই মারফত। কিন্তু মারফত কবুল হলে শরিয়তের দাম কী?’

আমি এবারে কামাল হোসেনকে বললাম: ‘আপনার মতো মাতব্বর মুসলমান ব্যক্তির ঘরে যে হরিমতী দিদির মতো একজন খোদ হিন্দু বাস করেন তাতে ‘আপনাদের সমাজে আলোড়ন হয় না?’

: সত্যিই হয় না যে তার একটা কারণ দীনদয়ালের নামে আমাদের এ দিগরে সবাই ভক্তিমান। আমার বাবার আমল থেকে আমাদের বাড়িতে দীনদয়ালের নামে কত মান্‌সা, কত সিদে, সে আপনি ধারণা করতে পারবেন না। চোত মাসে মচ্ছবের সময়ে আমার এক পয়সা খরচ করতে হয় না। গাঁয়ের সমস্ত মানুষ চাল ডাল আনাজ তরি-তরকারি নিজেরাই আনে, এনে অন্ন মচ্ছব করে। হিন্দুই বলুন আর মুসলমানই বলুন এখানকার সাধারণ মানুষ দীনদয়ালের নামে এককাট্টা। তার ওপরে আছে আমার বুড়ি হরিমতী আপা। সারা এলাকায় খুব খাতির। তার কথায় সবাই এক পায়ে খাড়া। আসলে সারাজীবনে একটা ব্যাপার কী দেখলাম জানেন? ভাল জিনিসের মার নেই। এই যে আমার এত দালানকোঠা বারামখানা, দোকান, গমকল, পোস্ট অফিস, হেকিমি, পার্টিবাজি তবু আমাকে লোকে ভয়ে ভক্তি করে। ভালবাসে না কেউ। ভোটে দাঁড়ালে কেন জিতি জানেন? ক্ষমতা আছে বলে? টাকা আছে বলে? ফক্কা। ভোটে জিতি স্রেফ দর্জি ফকিরের ছেলে বলে। ভোট দেয়, জানে হারলে দিদির মনে দুঃখ হবে। তা হলে এই যে আমার ভোটে জেতা সেকি আসলে জিত না হার?

দেখতে দেখতে বেলা গড়ায়। বিদায়লগ্ন এগিয়ে আসে। মনে ভাবি সাধারণ মানুষের মধ্যে দীনদয়ালের এত বড় যে আসন সে আমার এখনও দেখা হয়নি। আমি বৃত্তিহুদার পালবাড়িতে খোদ দীনদয়ালের আসন দেখেছি। আকন্দবেড়েতে দেখলাম আসুনে ফকিরের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সাধারণ মানুষ কেমন করে পেয়েছে দীনদয়ালকে তা আমার আজও দেখা হল না।

গোরুর গাড়ির ছইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ার আগে নূরজাঁহা দূর থেকে সালাম দিলেন নতনেত্রের সৌন্দর্য ছড়িয়ে। কামাল হোসেন বললেন, ‘আবার আসবেন অধীনের গরিবখানায়। আর বাস-রাস্তায় বাউণ্ডুলে খোদাবক্সের হিন্দু হোটেলে একটু ঢুঁ মেরে বলবেন তার ফুফু ক্ষীর আর গোস রুটি নিয়ে বসে আছে। সে হতভাগা যেন বাড়ি আসে।’

হরিমতী দিদি বললেন, ‘দীনদয়াল আবার যেন টানেন তোমায় এদিকে। কিন্তু তখন কি আমি বেঁচে থাকব? দীনদয়ালের পাট এ বাড়িতে আর কদিন? বুড়ো হয়েছি। আমিও মরব আর দীনদয়ালের পাটও উঠে যাবে।’

আমাদের দেশে কিছুকাল একটা নতুন কথার খুব চল হয়েছে। কথাটা হল ‘ফিল্ড ওয়ার্ক রিসার্চ’। এর একটা অদ্ভুত বাংলা হল ‘ক্ষেত্র গবেষণা’। সমাজবিদ্যা নৃতত্ত্ব কিংবা লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন যাঁরা তাঁদের কাছে এই ‘ক্ষেত্র গবেষণা’ একটা দারুণ অ্যাডভেঞ্চার। চলো অযোধ্যা পাহাড়ে, চলো কালীঘাটের পোটোপাড়ায়, চলো ঘোপাড়ায় সতী মা-র মেলায়। এ সব ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের একটা দল নিয়ে থাকেন একজন বা দুজন গম্ভীরদর্শন অধ্যাপক। অনেক সময় স্টাডি-টিমে বিদেশি-বিদেশিনীদেরও দেখা যায়। সবাইয়ের কাছে নোটবই আর ডট পেন থাকে। দলে অন্তত একটা ক্যামেরা আর টেপরেকর্ডার থাকেই।

এখানে একটা সত্যি বলতে আপত্তি নেই যে টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরার চল যখন ছিল না তখনই অবশ্য ভাল কিছু কাজ এদেশে হয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেন বা নির্মলকুমার বস, মনসুরউদ্দীন, যোগেশ রায় বিদ্যানিধি, দীনেশচন্দ্র সেন কিছুকাল আগেও যত কাজ করে গেছেন এখন তার ধারে কাছে কেই বা যেতে পেরেছেন? অক্ষয়কুমার দত্ত, উইলসন সাহেব কিংবা যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতো খুব পুরনো লোকের কথা তুললে তো আরও লজ্জা লাগে।

আসলে খুব সমারোহ করে গেলে অনেক সময় ঠিক ঠিক জিনিস আদায় হয় না। ক্যামেরা রেকর্ডার এ সব দেখলে গ্রামের সাধারণ লোক খুব গুটিয়ে যায়। কারুর এ সবে ঘোরতর আপত্তিও থাকে। ফলে কখনও তারা কিছু বলে না বা ইচ্ছে করে ভুলভাল বলে দেয়। বৃত্তিহুদার শরৎ পাল আমাকে একবার একজন লোক-সংস্কৃতিবিদের কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আরে তিনি মশায় সবকিছু প্রমাণ রাখতে চান ফটো তুলে। আমার অত প্রমাণ রাখার দায়টা কী বলুন তো?’ একবার এক গ্রাম্যগুরুর কথায় খুব মজা পেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার মতোই একজন এসেছিলেন সেবার। সঙ্গে এক মেয়েছেলে। তা সেই মেয়েছেলেটাকে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে বলে কিনা “দাঁড়ান ফটো তুলব।” বুঝুন আস্পর্ধা। আমি বলে কখনও নিজের পরিবারকে নিয়েই ফটো তুলি নি তো কোথাকার কোন মেয়েছেলে। ছিঃ।’

এইসব দেখেশুনে ‘ক্ষেত্র গবেষণা’-র ব্যাপারে আমি খুব সাবধান সতর্ক থাকি। একটা সুবিধে আমার এই যে আমার কোনও দল নেই। একেবারে নিরম্বু একা। বড়জোর সঙ্গ দেবার জন্য জুটিয়ে নিই একজন খুব শান্ত ধরনের ছাত্রকে। যাতায়াতের পথে গল্প হয়। তার দেখার সঙ্গে আমার দেখাটা ঝালিয়ে নেওয়া যায়। কম বয়সের সুবাদে সে গ্রামের ছেলে ছোকরাদের কাছ থেকে বাড়তি কিছু খবর আনতেও পারে। সবচেয়ে বড় কথা গ্রামদেশে একা একা চলাফেরার কতকগুলো অসুবিধাও আছে, যদি না সে গ্রামটার মানুষজনের সঙ্গে আগে থেকে চেনাজানা থাকে। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে ঈশ্বরচন্দ্রপুর যাবার সময় সঙ্গে নিয়েছিলাম মনোরঞ্জনকে। মূলত গ্রামের ছেলে। তার মানে কষ্টসহিষ্ণু, বেশ খানিকটা হাঁটতে পারে, মোটামুটি ডালভাতে সন্তুষ্ট। তা ছাড়া ‘বাথরুম কোথায়’, ‘স্নান করব কোনখানে’ বলে জ্বালাবে না। দিব্যি নদী বা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঈশ্বরচন্দ্রপুর খুব গরিবদের গ্রাম। সেখানে কামাল হোসেনের মতো দলিজ নেই।

ঈশ্বরচন্দ্রপুরে যার বাড়িতে আমরা উঠলাম তার নাম গণেশ পাড়ুই। গোয়াড়ির বাজারে সে চাঁপাকলা বেচে। সেই সুবাদেই আলাপ। আমি তার খদ্দের। তাকে সাহেবধনী বলে শনাক্ত করা অবশ্য নিতান্তই আমার কৃতিত্ব। একদিন তার কাছে খুব সুন্দর গাছে-পাকা কলা দেখে বলেছিলাম: ‘কী ব্যাপার, আজ তো কারবাইড পাকা নয়, এ যে গাছে পাকা!’

খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেছিল: ‘রোজ পাইকেরের কাছ থেকে কিনে এনে বেচি, আজ বাড়ির গাছের কাঁদি নামিয়ে এনেছি। সবই দীনদয়ালের কৃপা।’

দীনদয়ালের কৃপা? এই এক কোড ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে মানুষটাকে ধরে ফেলে বলি: ‘তুমি তা হলে হুদোর পালবাড়ির ঘরের শিষ্য? অগ্রদ্বীপ যাও, তাই না?’

কৃতাৰ্থ হেসে বলেছিল, ‘বাবুর তো তা হলে আমাদের ঘরের সবই জানা। একদিন আসুন আমাদের গ্রামে। ঈশ্বরচন্দ্রপুর, চেনেন তো? আমার নাম গণেশ পাড়ুই।’

গণেশ পাড়ুই মানুষটা খুবই গরিব। তবে নিঃসন্তান তাই হয়তো খুব অভাবী নয়। একখানা কুঁড়েঘর। তাতে বাঁশের মাচা। তাতেই শয্যা। ঘরের চত্বরে উনুন। রোদে ঝড়ে জলে সেখানেই কোনওরকমে দুটি ফুটিয়ে নেয় তার বউ। আজকে তার বাড়িতে উৎসব-বিশেষ। বউকে সে হেঁকে বলে: বাবুরা এয়েচেন। ডালটা এটু ঘন করে রাঁধো।’

ঈশ্বরচন্দ্রপুরে আমরা গবেষণার কাজে দু দিন দু রাত থাকব। তাই সব দিক বাঁচিয়ে সকালবেলা পৌঁছে গণেশের সম্মান রেখে সঙ্গে-আনা কিছু জিনিস নামিয়ে দিলাম ব্যাগ থেকে। আলু পেঁয়াজ ডিম চা চিনি গুঁড়ো দুধ পাঁউরুটি। ‘কিছু মনে করলে না তো?’ ‘সবই দীনদয়ালের খেলা, নইলে তিনি জানলেন কী করে যে আমার হাতে একটা পয়সাও নেই? অসুখ হয়ে দুদিন বাজারে যেতে পারি নি।’

সেদিন সারাদিন ধরে গ্রামের কাজ সেরে সন্ধে খানিকটা গড়িয়ে গেলে গণেশের বাড়ি ঢুকলাম। ততক্ষণে সে চাঙ্গা। চা মুড়ি খেয়ে উঠোনে বসেছি খেজুরপাটি বিছিয়ে। উঠোন থেকে ভাতের গন্ধ উঠছে। শুক্লপক্ষ চলছে বুঝি। আকাশে বেশ ভরাট চাঁদ। গণেশ একখানা একতারা এনে পিড়িং পিড়িং করতে লাগল। কী আর এমন গাইবে গণেশ। একখানা দুর্বোধ্য শহর-নাচানো ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ মার্কা গাইবে হয়তো। সে গান আবার থামবে তো? হঠাৎ গণেশ আমাকে চমকে দিয়ে গেয়ে উঠল:

আমি সুখের নাম শুনেছিলাম।

দেখি নাই তার রূপ কেমন।

আমার দুখনগরে বাটি পরিবার

দুঃখ রাজার বেটি

দুজনায় দুঃখে করি কালযাপন।

এ যে একেবারে আত্মজৈবনিক! এতখানি বিস্ময় আমার জন্যে দীনদয়াল রেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রপুরের সন্ধ্যায়! গণেশ গেয়ে চলে যেন গভীর সন্তাপে আত্মস্থ হয়ে:

মনে করি সুখের দেশে

সুখী হয়ে থাকব বসে

দুঃখু বেটা তাড়িয়ে এসে

কেশে ধরে করে শাসন।

দুখের বেলা দুই প্রহরে

দুখের অন্ন করি ভোজন।

দুখের শয্যা পেতে সন্ধ্যাকালে

দুঃখেতে করি শয়ন ॥

মনোরঞ্জন ভাবল গানটা বোধহয় এখানেই শেষ। তাই উচ্ছ্বাসে বলে উঠল; আহা, কী গান। আমি এক্ষুনি লিখে নেব। এ তো আমাদের সকলের গান। এটা লিখেছে কে? তুমি?

লম্বা জিভ কেটে গান থামিয়ে গণেশ বলল: এত বড় ভাবের গান আমি লিখতে পারি কখনও? অগ্রদ্বীপে ঈশুপ ফকিরের কাছে এ গান আমার শেখা। ভণিতে পাইনি, তবে গানের ভাবে মনে নেয় এ আমাদের যাদুবিন্দুর গান। বাকিটুকু শোনেন:

দুঃখু আমার মুক্তি গতি

দুঃখু আমার সঙ্গের সাথী

হৃদয়ে জ্বলে দুঃখের বাতি

দগ্ধ করে দিল জীবন।

আবার দুখের কথা রইল গাঁথা

করবে কে তা নিবারণ?

সত্যি বলতে কী, এমন একটা গান এ গ্রামে শুনতে পাব ভাবিনি। কোথায় যে কী মিলে যায়!

রাতে শোবার আগে গণেশ পাড়ুইয়ের সঙ্গে অনেক কথা হল। ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামে নাকি দীনদয়ালের একচেটিয়া ভক্ত। ‘বাবু, অগ্রদ্বীপের মেলায় আমাদের গ্রাম ঝেঁটিয়ে মানুষ যায়। সব দীনদয়ালের নামে মতিমান। এখানে মচ্ছব হয় ফাগুন মাসের দ্বিতীয়া তিথিতে। সামনের বার আসবেন বাবু সে সময়ে। ঈশুপ ফকিরের গান শোনাব। তাঁর গানে আমাদের খুব শান্তি হয়।’

পরদিন সকালে আমরা গিয়ে বসলাম ঈশ্বরচন্দ্রপুরের একপ্রান্তে জলাঙ্গী নদীর ধারে এক বটগাছতলার বাঁশের মাচায়। গ্রামদেশে গাছতলায় এমন বাঁশের মাচা থাকে, সেগুলো এজমালি। যার যখন দরকার বসে। আগের দিন এই মাচায় বসে অনেকক্ষণ ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রধান কাজ একেবারে সাধারণ পর্যায়ের সাহেবধনীদের নিয়ে। যারা দীনদয়ালকে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার ‘পঞ্চতত্ত্ব” অর্থাৎ চাল ডাল আর তিন রকম আনাজ দিয়ে খিচুড়ি পাকিয়ে নিবেদন করে। এরাই আসুনে ফকিরদের জরিমানা দেয়, সেবাপূজা করে। অগ্রদ্বীপে চরণ পালের থানে হত্যে দেয়। বলতে গেলে সাহেবধনীদের এরাই মূল জনশক্তি।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবলই আমার চোখ চলে যায় একজন শীর্ণ চেহারার মাঝবয়েসি লোকের দিকে। গতকাল থেকেই লোকটিকে একই জায়গায় দেখা যাচ্ছে। পরনে নীল লুঙ্গি আর ময়লা হেঁড়া গেঞ্জি। সারাদিন সামনের মাচায় নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে পা নাচায়। মুখখানা মলিন। চুলে অনেকদিন তেল পড়েনি। কোনও চাহিদা নেই, কোনও কৌতূহল নেই। চাহনিতে শুধুই শূন্যতা। কেউ হয়তো একটা বিড়ি দিল সেটাই টানল খানিকক্ষণ। যেন তাতেই খানিকটা সময় কেটে যাওয়ায় লোকটা খুব কৃতার্থ। সবাই ওকে খুব অবজ্ঞার সঙ্গে ‘পচা’ বলে উল্লেখ করে। যেন পচা লোকটা নিতান্ত উঞ্ছ উদ্‌বৃত্ত। জাতে নাকি দুলে। পচার গালে ভয়ানক এক আঁচড়ের দাগ। তাকে ডেকে সামনে বসানো গেল। খুব সংকুচিত ভঙ্গি তার। জিজ্ঞেস করলাম, ‘পচা তোমার গালে ওই মস্তবড় দাগটা কীসের?’

‘আজ্ঞে, ওটা হল বাঘের আঁচড়’, খুব নির্বিকার জবাব।

: কী করে হল?

: তা বিশ-পঁচিশ বছর আগে পাশের গাঁয়ের জঙ্গলে বাঘ এয়েলো। শিকারিবাবু মাচান বেঁধে বসেছিল। আমরা দুলে বাগদিরা চার দিক থেকে জঙ্গল ঘিরে ক্যানেস্তারা টিন বাজাচ্ছিলাম। আমাদের বলত বিটার। খুব হইচই-চেঁচামেচিতে বাঘটা গেল হপকে। এলোমেলো ছুটে শিকারির দিকে না গিয়ে পড়ল এসে আমাদের দলের সামনে। তারপর বাঘমহাশয় দিলেন এক ইয়া লক্ষ্য। আমাদের টপকে পেলিয়ে যাবার সময় আমার গালে লাগল তেনার এক মোক্ষম আঁচড়। তাতেই দগদগে ঘা হয়েলো। তেমনি পুঁজ রক্ত। সদরের হাসপাতালে দু-দুটো মাস থাকত হয়েলো। দীনদয়ালের কিরপায় জানে বাঁচলাম। তবে দাগটা থেকে গেল আজ্ঞে। এ গাঁয়ে তো তিনজন পচা আছে। ‘তবলা পচা’ কিনা তবলা বাজায়, ‘মুদি পচা’ দোকানি, আর আমাকে সবাই বলে ‘ঘা পচা’।

এত নিস্পৃহ মানুষ যে কথা এগোনো মুশকিল। আমাদের কাজ চলে। পাড়াগাঁর দুপুরও এগোয়। শেষ ফাগুনের রোদ চনমনে হয়। আমাদের পেছনেই ঘাট। লোকজন সামনের ধারে খানিক এসে দাঁড়ায়, শোনে আমাদের কথা, তারপরে কোমরে গোঁজা বাঁশের পাত্র থেকে সরষের তেল মাথায় গায়ে চাপড়াতে চাপড়াতে ঘাটে নামে। খানিকটা জল উথালপাতাল করে স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে সপসপ্‌ শব্দ তুলে বাড়ি যায়। খানিক পরে তিনটে-চারটে নাগাদ সেই স্নাতভুক্ত মানুষজন একে দুইয়ে এসে জমে আমাদের মাচার কাছে। দেখে আমাদের কার্যকলাপ। তখন তাদের দেহ তৈলচিকণ, পরনে কাচা ধুতির মালকোঁচা। মুখে জ্বলন্ত বিড়ির মাদক। কিন্তু লক্ষ রাখি যে পচা তার মাচা থেকে ওঠে না। তার মানে স্নান করে না, খায় না। বেলা গড়ায়। আমাদের সঙ্গে পাঁউরুটি ডিমসেদ্ধ কলা। সকালে ফ্যানভাতে খেয়ে এসেছি কেননা দুপুরে গণেশের বাড়ি ফিরব না। সে গোয়াড়ি বাজারে কলা বেচতে গেছে।

আমাদের টিফিন খাওয়ার সময় হতে পচাকে ডেকে বললাম: ‘পাঁউরুটি কলা ডিম খাবে?’

‘দ্যান’ খুব অচঞ্চল ভঙ্গিতে নিয়ে মাচায় গিয়ে বসে খেল খুব তাড়াতাড়ি। সামনের টিউবওয়েলে জল খেয়ে আবার বসে পা দোলাতে লাগল।

ব্যাপার দেখে মনোরঞ্জন তার মাচায় গিয়ে বসে নিচুস্বরে খানিক কথা বলল। সে নাকি এমন মানুষ বেশি দেখেনি। দীনদয়ালের ব্যাপারে পচার কাছে আমার কিছু তথ্য পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয়নি। লোকটা একেবারে বিশেষত্বহীন, একঘেয়ে। কথা বলতেও উৎসাহ পায় না। ঘণ্টাখানিক পরে এসে মনোরঞ্জন উত্তেজনা চেপে আমাকে বলল: ‘জানেন স্যার, পচার কোনও জমি নেই, ফিক্সড ইনকাম নেই। লেখাপড়া জানে না। একখানা কুঁড়েঘরে থাকে, তার উত্তরকোণের চালা ভেঙে গেছে। ‘এবারে চোতের শেষে যদি দীনদয়াল দেন তবে খড় জোগাড় করে চালার ওইখেলাটা ছাইব’ এই কথা বলল। স্যার ওকে দশটা টাকা দেবেন?’

‘দাঁড়াও দাঁড়াও আমি মনোরঞ্জনকে বোঝাতে চাই, ‘না হয় দেওয়া গেল। তাতে পার্মানেন্ট সলিউশন কি হবে? দশ টাকা ফুরোলে তারপর? এ গাঁয়ে পচা নামে তিনজন আছে, কিন্তু পচার মতো অভাবী লোক আছে অনেক।’ মনোরঞ্জনকে খানিকটা চাঙ্গা করবার জন্যে বললাম, ‘ডাকো ওকে। কিছু জিজ্ঞেস করি।’

খুব নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে সে সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলের নখ দিয়ে মাটিতে চিত্তির আঁকতে লাগল। এদিকে বিকেল শেষ হয়ে আসছে। আমি খুব সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ‘পচা, কাল আর আজ দুদিনই তুমি দুপুরে স্নান করলে না, বাড়ি গেলে না। কেন?’

: ছ্যান করলে খিদে পায় বড্ড। বাড়ি যাই না, খাব কী? বাচ্চারা খিদেয় কাঁদে, বউ গালমন্দ করে। সইতে পারি না। তাই পেলিয়ে পেলিয়ে বেড়াই।

: কটা ছেলেমেয়ে তোমার?

: দুটো। একটা ছেলে একটা মেয়ে।

মনের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের পোস্টার আর লোগো ভেসে ওঠে। হাসিমুখ বাবা-মা বালক আর বালিকার প্রতীকী ছবি। সঙ্গে শ্লোগান ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’। মনের বাষ্পচ্ছন্নতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করি: ছেলেমেয়ে ইস্কুল পড়ে?

: পাউরুটির লোভে যায়। টিফিনে পেলিয়ে আসে।

: আজ সকালে তোমরা সকলে কী খেয়েছ?

: আজ্ঞে দীনদয়াল আজকে আধবাটি গমচুর সেদ্ধ মাপিয়েছেন।

: সারাদিন বসে আছ। খিদে পায় না?

: খিদে মরে গিয়ে নাড়ি হেজে যায়। তখন আর খিদে থাকে না দীনদয়ালের কৃপায়।

: এখানে গ্রামে কোনও কাজ নেই?

: গাঁয়ের নাম ঈশ্বরচন্দ্রপুর। কিন্তুক ঈশ্বরের নেকনজর নেই। এখানে কিষানের কাজ জুটলে কটা টাকা পাওয়া যায়, নিদেন গম। তা কই? এ বছর বড্ড অজন্মা। দীনদয়ালের ইচ্ছেয় এবারে ক্ষেতে ধান নেই।

: বাইরে মজুর খাটতে গেলে পার?

: আশপাশের গাঁয়ে সেখানকার কিষান মুনিষই কাজ পায় না। পেত্যেকবার বারাসাতের দিকে ধান কাটতে যাই আমরা কজন। পাই কটা টাকা আর দিনেরাতে তিনবার ভরপেট খাওয়া। মাস দুইয়ের কাজ। যে কাঁচা টাকা জমে তাতে সোম্বচ্ছরের কাপড়-জামা কিনি, ছেলেমেয়েদের মিষ্টি কিনে দিই একদিন। অগ্রদ্বীপের মেলায় যাই জরিমানা দিতে। এবারে এখনও বারাসতের খবর আসে নি। উঠি বাবুদ্বয়, কথায় কথা বাড়ে।

মনোরন বলল: ‘এখন কোথায় যাবে?’

এতক্ষণ পর সারাদিনের শেষে সমস্ত মুখ ভরিয়ে হেসে ঘা-পচা বলল: ‘দেখছেন না বাবু, দীনদয়ালের কৃপায় আজকের দিনটা কেটে এয়েছে। আর এটুখানি পরে সন্ধে পিদিম জ্বলবে। আমি এবার মৌজ করে একডা ডুব দেব নদীতে। তারপরে একছুটে বাড়ি।’

: বাড়ি গিয়ে কী করবে?

‘পেরথমে খানিকটা ঝাঁটা-লাথি মুখখিস্তি করবে পরিবার’ লাজুক হাসল পচা, ‘তার কোনও দোষ নেই। সারাদিন বনে-বাদাড়ে কন্দ কচু খোঁজে, লোকে হেনস্থা করে। ছেলেমেয়ে দুটো কমনে থেকে আনে গেঁড়ি-গুগলি। হয়তো কার কাছ থেকে চেয়েচিন্তে বউ এনেছে এড্ডু চাল। ওই সব মিলিয়ে একটু পঞ্চতত্ত্ব সেবা হবে। দীনদয়াল যেমন দ্যান। সেই সেদ্ধ ঘ্যাঁট খানিক খেয়ে একটা তোফা ঘুম দেব। এক ঘুমে সকাল।’

: কাল সকালে কী হবে?

: তা জানেন দীনদয়াল। কিছু না হয় তো এই বাঁশের মাচান আছে। কোনওরকমে সন্ধে অবধি কাটিয়ে দিলেই হবে। যাই গা তুলি, জয় দীনদয়াল দীনবন্ধু।

অপসৃয়মাণ দিনের আলোর মতো পচা নেমে গেল নদীর ঘাটে। নেমে এল মনোরঞ্জনের থমথমে মুখের মতো সন্ধ্যা। আমি ভাবলাম, দীনদয়াল কোথায় থাকেন? হুদায় শরৎ পালের ভিটেয়, হরিমতী দিদির বিশ্বাসে না গণেশ বা পচার মতো মানুষের দুঃখের অতলে?

______

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *