৯-১৩. সারা দিন বর্ষার পর

সারা দিন বর্ষার পর বাতাস বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

সমুদ্রের ধারে কিছু মানুষ রয়েছে আজ। এক জায়গায় পাঁচ-ছ’জন যুবক-যুবতীর একটি দল গান গাইছে এক সঙ্গে। এরা নতুন এসেছে মনে হয়।

আমি হাঁটছি খুব আস্তে আস্তে। কাল চলে যাব ঠিক করে ফেলার পর আজ সমুদ্রকে নতুন করে ভাল লাগছে যেন। কাল সকালে অন্তত দুতিন ঘণ্টা স্নান করতে হবে।

ঠিক চন্দ্রার মতো একটি নারীকে আমি দু’বার দেখেছি এই বেলাভূমিতে। সে কি আমার চোখের ভুল? দু’বারই যুবতীটি মিলিয়ে গেছে আমার চোখের সামনে থেকে। মিলিয়ে গেছে মানে অদৃশ্য হয়ে যায়নি, মেয়েটি রক্তমাংসের জীবন্ত নিশ্চিত, কিন্তু আমি তার মুখ দেখতে পাইনি ভাল করে। চন্দ্রার সঙ্গে এমনই মিল যে আমি ভয় পেয়ে গেছি।

রবীনবাবু আর প্রতিমার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়, কিন্তু এই ব্যাপারটা আমি খুলে বলতে পারিনি। ব্যাখ্যা করতে পারব না যে! প্রত্যেকেরই কিছু কিছু গোপন কথা থাকে।

সুনেত্রা বলে গেল, সে রবীনবাবু সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। রবীনবাবু যে চন্দ্রাকে আগে থেকে চিনতেন, সেকথা আমাকে জানাননি। সম্ভবত প্রতিমাও জানেন না।

দূরে দেখা যাচ্ছে আলোকোজ্জল হোটেলটি।

আজও এক জায়গায় বাঁধা আছে দুতিনটে নৌকো। এখান থেকেই একটা নৌকোয় চন্দ্রা মিলিয়ে গেছে সমুদ্রে। তার পরেও আর একটা নৌকোয় আমি বসে থাকতে দেখেছিলাম চন্দ্রার মতো এক রহস্যময়ী নারীকে। এটাই আমাকে সব চেয়ে অস্বস্তিতে ফেলেছে।

দুপুরবেলা লাল ছাতা মাথায় যে-মেয়েটি হেঁটে গেল, তাকে কি শুধু আমি একাই দেখেছি? যাঃ, এটা হতেই পারে না। এ-সব আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না, এ-রকম অভিজ্ঞতাও আমার আগে কখনও হয়নি।

দু’জন বয়স্ক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে করতে যাচ্ছেন। এঁদের আগে দেখিনি। এরা বোধহয় চন্দ্রার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা কিছুই জানেন না।

পুলিশ শেষ পর্যন্ত পল্লবকে অ্যারেস্ট করল? পল্লবের সঙ্গেই চন্দ্রার শেষ দেখা হয়েছিল, চন্দ্রার সঙ্গে পল্লবের আগে থেকেই কিছু একটা সম্পর্ক ছিল। সুতরাং পল্লবের ওপর প্রথম খানিকটা সন্দেহ পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণত খুনের গল্পে দেখা যায়, প্রথমে যার ওপর সন্দেহ হয়, পাঠক বা যাকে খুনি বলে ধরে নেয়, সে আসলে নির্দোষ। ঘটনা হঠাৎ মোড় নেয় অন্য দিকে, আসল খুনি বেরিয়ে আসে।

এখানে পল্লবই যদি শেষ পর্যন্ত ভিলেন হয়, তাহলে ব্যাপারটা বড় সাদামাটা হয়ে যাবে। রবীনবাবু চন্দ্রাকে আগে থেকে চিনতেন, সেটা তার স্ত্রীর কাছেও গোপন করে গেছেন। সেই জন্যই কি চন্দ্রার কেসটা নিয়ে রবীনবাবু এতখানি ইনভলভড হয়ে পড়েছেন?

উলটো দিক থেকে হেঁটে আসছেন প্রতিমা আর তাঁর মেয়ে। প্রতিমার হাতে একটা টর্চ।

প্রতিমা দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, বৃষ্টির পর আজ আকাশটা কী সুন্দর হয়েছে দেখেছেন? আজ জ্যোত্সাও উঠেছে তাড়াতাড়ি।

আমি এতক্ষণ ভাল করে আকাশ দেখিনি, অন্য এলেবেলে বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলাম। একটু হেসে বললাম, কাল আমি চলে যাব, তাই আমার জন্য এত সুন্দর জ্যোত্সা ফুটেছে।

প্রতিমা বললেন, কালই যাবেন কেন, আর দু’এক দিন থাকুন। অন্তত শনিবার পর্যন্ত। হ্যাঁ হ্যাঁ, শনিবার পর্যন্ত থেকে যান।

কেন, শনিবার স্পেশাল কিছু আছে?

আমার মেয়ের জন্মদিন। এখানেই সেলিব্রেট করব। আপনি থাকলে ভাল লাগবে।

আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নেড়ে বললাম, যদি না থাকি, আগে থেকেই হ্যাপি বার্থ ডে জানিয়ে রাখছি।

মেয়েটির হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। এখানে কোথায় ফুলের দোকান, আমি দেখিনি। প্রতিমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ফুলগুলো কিনলেন?

প্রতিমা বললেন, না, কিনিনি। ’পেরলস’ নামে যে বাড়িটা আছে, সেখানে টবে অনেকরকম ফুল হয়েছে। ওই বাড়ির এক মহিলা নিজে থেকেই দিলেন। আচ্ছা, আজকে আকাশের জ্যোৎস্না আর এই রজনীগন্ধা, এই নিয়ে কোন গানটা মনে পড়ে বলুন তো?

কেউ জিজ্ঞেস করলে তক্ষুনি কোনও গান বা কবিতা আমার মনে পড়ে না। ধাঁধার উত্তর দিতে আমি সবসময় ফেল করি। টিভির কুইজ প্রোগ্রামে অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা যখন শক্ত শক্ত প্রশ্নের উত্তর চটাস চটাস করে উত্তর দেয়, তখন তাদের প্রতি আমার বেশ শ্রদ্ধা হয়।

আমি চুপ করে আছি দেখে প্রতিমা বললেন, পারছেন না? আপনাকে একটা ক্লু দিচ্ছি। গানটা ‘উদয়ের পথে’ ফিল্মে ছিল।

আমার চোখ কপালে উঠল। উদয়ের পথে’ তো আমার প্রায় হামাগুড়ি বয়সের ছবি। সে-ছবি আমি দেখিনি, নাম শুনেছি মাত্র। প্রতিমাই-বা সেই সিনেমা দেখলেন কী করে!

ছোট মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠল।

প্রতিমা বললেন, ওকে আমি এইমাত্র শেখালাম। খুকু, দু’লাইন শুনিয়ে দে তো।

মেয়েটি গেয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উঠলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো, চাঁদের হাসি…।

আমি বললাম, বাঃ, আপনার মেয়েরও তো বেশ ভাল গানের গলা।

প্রতিমা বললেন, আমাদের ওখানে একটু পরে চলে আসুন না। বারান্দায় বসে আড্ডা দেওয়া যাবে। ও কোথা থেকে একটা ভাল হুইস্কি জোগাড় করে এনেছে।

আমাকে যে পাম বিচ হোটেলে সিনেমা ইউনিট নেমন্তন্ন করেছে, সেটা বলতে গিয়েও চেপে গেলাম। বোঝাই যাচ্ছে, ওরা রবীন-প্রতিমাকে ডাকেনি। প্রতিমা অবশ্য নেমন্তন্ন পেলেও নিতেন না।

বললাম, দেখি, ওই দিকে এক জনের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে।

প্রতিমা বললেন, হ্যাঁ, ঘুরে আসুন, একটু পরে আসুন। রবীনও কোথায় যেন বেরিয়েছে, খানিকক্ষণের মধ্যে ফিরবে নিশ্চয়ই।

প্রতিমা আবার এগিয়ে গেলেন মেয়েকে নিয়ে।

এই পরিবারটি বেশ চমৎকার। স্বামীটি ভদ্র, শিক্ষিত। প্রতিমাও বিদূষী এবং মোটামুটি সুন্দরীই বলা যায়। মেয়েটিও বেশ ভাল হয়েছে, পড়াশুনোর দিকে খুব ঝোঁক। ওঁদের ছেলেও বেশ ব্রাইট শুনেছি।

সবাই এঁদের একটি আদর্শ, সুখী পরিবারই মনে করবে। কিন্তু প্রতিমার কোনও একটা গুরুতর অসুখ আছে, বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। রবীনবাবু ফিল্মের অভিনেত্রীদের সঙ্গে গোপনে ঘোরাঘুরি করেন। এই সব গোপন ব্যাপারগুলো না জানলেই ভাল হত।

চন্দ্রা যে-দিন অদৃশ্য হয়ে যায়, সে-দিনও আকাশে জ্যোত্সা ফিনকি দিচ্ছিল। চন্দ্রার স্বভাবটিও ছিল খুব রোমান্টিক ধরনের, সাহিত্যবোধ ছিল, কবিতা পড়েছে অনেক, সেই সব টানেই ও দেখা করতে গিয়েছিল আমার সঙ্গে। চন্দ্রা ফিল্ম লাইনে না এসে লেখিকা হবার চেষ্টা করল না কেন? তাহলে ওকে আমরা হারাতাম না।

.

১০.

 পাম বিচ হোটেলের ভেতর দিয়ে দুটি লম্বা টানা বারান্দা। মাঝখানের চত্বরে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। এখানেই চেয়ার পেতে বসেছে অনেকে।

বারান্দায় দাঁড়িয়েই আমার প্রথমে মনে হল, চন্দ্রা থাকলে সেই ছুটে এসে আমাকে কোথাও বসাত। এই ইউনিটের লোকজনের মধ্যে একমাত্র চন্দ্রার সঙ্গেই আমার বেশি আলাপ পরিচয় হয়েছিল। অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীর অনেকেই লেখকদের বিশেষ পাত্তাই দেয় না।

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবশ্য বিশেষ দেখা যাচ্ছেনা এখানে। অচেনা লোকজনই বেশি। সন্তোষ মজুমদারকেও দেখতে পাচ্ছিনা, কেউ আমাকে অভ্যর্থনা করল না, আমার বেশ বোকা বোকা লাগতে লাগল। এখানে না এলেই ভাল হত। এখনই সরে পড়লে কেমন হয়?

আবার ধরা পড়ে গেলাম সুগত মজুমদারের হাতে। সে একটু দূর থেকে দু’হাত বাড়িয়ে এসে বলল, এই যে দাদা, আসুন, কোথায় বসবেন? ওই বারান্দার কোণটায় চলুন না, ওখানে দারুণ হাওয়া।

এখন সুগতকে আমার তেমন অপছন্দ হল না। আমাদের দুজনেরই কলম নিয়ে কারবার, এই মিলটা তো আছে, সুতরাং আমরা দুজনে পাশাপাশি বসতে পারি।

বারান্দার কোণে একটা চেয়ারে আমাকে বসিয়ে সুগত এক দৌড়ে গিয়ে আমার জন্য এক গেলাস হুইস্কি আনতে গেল। আমি চোখ বুলিয়ে দেখলাম, অর্জুন মহাপাত্র কিংবা এখানকার পুলিশের লোকজন কেউই এখনও আসেননি। তবে একজন ভদ্রলোককে ঘিরে অনেকে খাতির করছে, তার মুখের চাপা অহঙ্কারের ভাব দেখে মনে হয় কোনও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। কে যেন বলছিল, ওড়িশার হোম সেক্রেটারির গোপালপুরে বেড়াতে আসার কথা আছে।

সুগত ফিরে এসে বলল, দাদা, আর একটু বসুন। সিগারেট জোগাড় করে আনি। আমার প্যাকেটটা ভুলে ফেলে এসেছি।

আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমার কাছে যথেষ্ট সিগারেট আছে। বোসো। তবে তোমাকে একটা কথা আগেই বলে রাখছি সুগত, তুমি জীবন যে-রকম’-এর প্রসঙ্গ আমার কাছে একদম তুলবে না।

সুগত এক গাল হেসে বলল, দুপুরবেলা আপনি অত রেগে গেলেন, বুঝতে পারিনি, আপনি ওই ব্যাপারে এত টাচি। না না, ওই প্রসঙ্গ আর তুলব না। কেয়া চক্রবর্তীর তো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, আর এখানে চন্দ্রার কেসটা তো স্পষ্ট মার্ডার।

আমি ভুরু তুলে বললাম, তাই নাকি! স্পষ্ট?

সুগত মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে বলল, চন্দ্রা সাঁতার জানত না। কেউ তাকে নৌকোসুদ্ধু জলে ঠেলে দিয়েছে।

নৌকো বাঁধা থাকে বালির অর্ধেকটা ওপরে।

 জোয়ারের সময় জল বেড়ে যায়।

তা জানি। কিন্তু সমুদ্র তো হঠাৎ গভীর হয় না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে হাঁটুজল, বুকজল থাকে, সাঁতার না জেনেও কেউ নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়ে বেঁচে যেতে পারে।

কেউ যদি আগেই চন্দ্রাকে গলা মুচড়ে মেরে তারপর নৌকো সুষ্ঠু ঠেলে দেয়?

সেটা আগে প্রমাণ করতে হবে তো!

পুলিশ অলরেডি প্রুভ করে ফেলেছে।

 তাই নাকি?

পল্লবদত্তকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে ভুবনেশ্বরে পাঠিয়ে দিয়েছে জানেন না?

ওর নামে চার্জ এনেছে?

ইয়েস। মার্ডার চার্জ। আমি রিলায়েবল সোর্স থেকে জেনে এসেছি।

আমি সুগতর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সাংবাদিকদের অধিকাংশ খবরই বিশ্বাসযোগ্য হয়। না। অনেক সাংবাদিক একেবারে স্পটে গিয়ে যে-সব খবর বার করে আনে, সেগুলো আসলে অর্ধেক গুজব। পল্লব খানিকটা ফুর্তিবাজ ধরনের, বেশি মদ খায়, নারীঘটিত দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু তাকে খুনি বলে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। মানুষ চিনতে কি আমার এত ভুল হয়?

সঙ্গে সঙ্গে সুনেত্রার রাগী মুখটা মনে পড়ল। সে রবীনবাবু সম্পর্কে এখন কুৎসা ছড়াবে। পল্লব দত্তের তো যা হবার তা হবেই, এখন রবীনবাবুর জীবনেও নেমে আসবে অশান্তি। প্রতিমা কীভাবে গ্রহণ করবেন তার স্বামীর নামে ওই অভিযোগ?

আমার মনটা বেশ দমে গেল।

হোটেলের বাইরে ডান পাশটায় কিছু গাছপালার মধ্যে তীব্র আলো জ্বলছে, শোনা যাচ্ছে অনেকগুলি কণ্ঠস্বর। অন্যমনস্ক ভাবে সে-দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী হচ্ছে?

সুগত বলল, ওখানে শুটিঙের জন্য সেট পড়েছে। আজ হোল নাইট শুটিং হবে। সন্তোষবাবু তো বললেন, তিন দিনের মধ্যে আউটডোরের কাজ শেষ করে ফেলবেন।

এত তাড়াতাড়ি?

এরপর স্টুডিয়োতে কিছু কাজ আছে। আজ রাত্তিরে আপনি থাকবেন নাকি শুটিঙে?

আমি দু’দিকে মাথা নাড়ালাম।

বাগানের দিক থেকে বারান্দায় উঠে এলেন সন্তোষ মজুমদার। আমাকে এখানে আসার জন্য অত ঝুলোঝুলি করেছিলেন বিকেলবেলা বাড়িতে গিয়ে, এখন আমাকে দেখতেই পেলেন না। চিন্তিত মুখে চলে গেলেন সামনের দিকে। পরিচালকদের অনেক কিছু সামলাতে হয়, তাদের মাথায় সব সময দুশ্চিন্তার বোঝা।

সুগত বলল, এ ছবি সুপার হিট হবেই।

সে কী! তুমি আগে থেকেই কী করে বুঝলে?

ছবি যতই রদ্দি হোক, কত লাখ টাকার পাবলিসিটি পেয়ে গেল, বুঝছেন না? কলকাতার সমস্ত ডেইলি পেপারে ফার্স্ট পেজ রিপোর্ট বেরিয়েছে। চার লাস্ট ছবি বহু পাবলিক দেখতে আসবে। চন্দ্রা মার্ডারড হয়ে সন্তোষ মজুমদারের কিন্তু উপকারই করে গেল।

অনেক সাংবাদিক এই ধরনের সিনিক্যাল কথা বলে স্মার্ট হবার চেষ্টা করে। আমি কোনও মন্তব্য করলাম না।

সুগত আবার বলল, বাংলা ফিল্মে নায়িকার খুব অভাব। চন্দ্রার অনেক স্কোপ ছিল। আর দু’এক বছরের মধ্যে ওর হিরোইন হবার খুব চান্স ছিল। চন্দ্রা এ পর্যন্ত ঠিক ভাল রোল পায়নি। বেচারাকে নেগলেকট করা হচ্ছিল। কেন জানেন? ফিল্ম লাইনের লোকজনদের সঙ্গে চন্দ্রা যে ঠিক মতো মিশতে পারত না। বেশি লেখাপড়া জানা মেয়ে, সেটাই ওর ডিসকোয়ালিফিকেশান। পল্লব-ফল্লবের মতো বাজে টাইপের লোকরা জ্বালাতন করত ওকে। আমি চন্দ্রার জন্য গৌতম ঘোষকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম, যদি নেকস্ট ছবিতে নেয়।

হোটলের প্রবেশপথে শোনা গেল অনেকগুলো পায়ের শব্দ। একসঙ্গে সাত-আট জনের একটি দল ঢুকল। প্রথমে চোখে পড়ে দীর্ঘকায় অর্জুন মহাপাত্রকে। সঙ্গে ইউনিফর্ম পরা আরও দুজন অফিসার। তাদের পাশে রবীনবাবু এবং তার পেছনে পল্লব দত্ত।

হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই, পল্লবকে সঙ্গে করে এনেছেন ওঁরা। সুগতর খবর ভুল। এর মধ্যে পল্লবকে ভুবনেশ্বর নিয়ে যাওয়া, আবার সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

পল্লবের হাতে হাতকড়াও নেই, কেউ তাকে ধরেও রাখেনি। বরং তার মুখখানিতে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও তাতে খানিকটা খুশির ভাবও ঝিলিক দিচ্ছে।

আমি সুগতকে বললাম, ওই তো পল্লব ফিরে এসেছে।

সুগত চোখ বড় বড় করে, ফিরে এসেছে? বলেই এক লাফ দিয়ে চলে গেল সে-দিকে। কী জানি, আগের খবরটা এর আগেই সে তার পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছে কিনা!

আমি দূর থেকে দেখতে লাগলাম, অর্জুন মহাপাত্র প্রথমে বড় সরকারি কর্মচারীটির কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বললেন, অনেকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ওঁদের। একটু পরে ওঁরা দু’জন শুধু সন্তোষ মজুমদারকে নিয়ে চলে গেলেন আড়ালে।

বোঝাই যাচ্ছে যে ওখানে কোনও জরুরি কথাবার্তা চলছে।

উলটো দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সুনেত্রা। সে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পল্লবের দিকে। কিন্তু নিজে থেকে এগিয়ে আসছে না। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পল্লব একবার সুনেত্রার দিকে হাত তুলল।

মিনিট পাঁচেক বাদে রবীনবাবু আমাকে দেখতে পেয়ে আমার পাশে এসে বসলেন। এক জন বেয়ারা ট্রে-তে ড্রিঙ্কস সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, রবীনবাবু এক গেলাস বিয়ার তুলে নিয়ে এক চুমুকেই শেষ করলেন অর্ধেকটা।

তারপর খানিকটা হাঁপ ছেড়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, নতুন ডেভেলপমেন্ট কী হয়েছে, আপনি আন্দাজ করতে পেরেছেন?

আমি দু’দিকে মাথা নেড়ে বললাম, না। পল্লবকে ছেড়ে দিয়েছে দেখছি।

শুধু ছেড়ে দেয়নি। পল্লবের ওপর থেকে সব সন্দেহও চলে গেছে। হি ইজ অ্যাবসলিউটলি অ্যাবাভ বোর্ড।

কী করে সেটা প্রমাণ হল?

চন্দ্রার সঙ্গে পল্লবের দেখা হবার পরেও আর এক জন চন্দ্রাকে জীবিত অবস্থায় দেখেছে।

 সত্যি? সেটা এত দিন জানা যায়নি? কে দেখেছে?

রবীনবাবু চেয়ারটা আরও কাছে টেনে এনে বললেন, সেই লোকটিকে আমি খুঁজে বার করেছি। কিন্তু সেই ক্রেডিটটা আমি নিতে চাই না। ওড়িশা পুলিশের ওপর এই কেসের দায়িত্ব, তারাই সলভ করেছে, এটাই সবাই জানবে। আমি শুধু লোকটাকে নিয়ে অর্জুন মহাপাত্রের সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলাম, এবার আপনি জেরা করুন, ইটস ইয়োর বেবি।

লোকটি কে?

পল্লবকেই এখানকার পুলিশ মার্ডারার বলে ধরে নিচ্ছে দেখে আমার খটকা লেগেছিল। চন্দ্রার সঙ্গে পল্লবের ঝগড়াঝাটি হলেও ঝট করে সে তাকে খুন করবে কেন? খুনের মোটিভ আরও অনেক গভীর হয় সাধারণত। সেই জন্যই আমার মনে হল সামথিং মাস্ট বি ডান। পল্লব নিজেই স্বীকার করেছে যে, চন্দ্রাকে সে নৌকোর ওপর বসে থাকতে দেখেছিল।

সে নিজে স্বীকার না করলে হয়তো একথাটা কেউ জানতেই পারত না।

মোস্ট প্রোবাবলি তাই হত। ফিল্ম ইউনিটের প্রত্যেককে, বিভিন্ন হোটেলের বোর্ডারদের, আপনাকে এবং আমাকেও পুলিশ এরপর জেরা করেছে যে আর কেউ সেই রাত্রে চন্দ্রাকে দেখেছিল কি না। কেউ দেখেনি কিংবা স্বীকার করেনি, তাই তো?

এ পর্যন্ত তাই ছিল।

আমরা পুলিশরা অত্যন্ত দায়সারা ভাবে কাজ করি। আরও অনেককে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। একটা নৌকোয় চন্দ্রা উধাও হয়েছে, নৌকো নিয়ে যাদের কাজকারবার।

নৌকোর মালিক কিছুই জানে না বলেছে। নৌকোটা ভাড়া দেওয়া হত, সেই নৌকোটাও তো এখনও উদ্ধার হয়নি।

পল্লবকে ওরা অ্যারেস্ট করছে দেখে আমার মনে হল, আর একটা খোঁজ করা দরকার। এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা জেলেদের বস্তি আছে, চলে গেলাম সেখানে।

অত দূরের লোক এখানকার ঘটনা কী করে জানবে? সন্ধের পর জেলেরা তো কেউ এ-দিকে আসে না।

অনেক সময় ইমপ্রোববল জায়গা থেকেও মূল্যবান খবর পাওয়া যায়। আমি জেলেদের বস্তিতে গিয়ে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট জনকে ইন্টারোগেট করেছি। নিজের দায়িত্বে। এর মধ্যে এদের ভাষা খানিকটা শিখে নিয়েছি। সেটা কাজে লেগে গেল। ওই জেলেরা তেলেগু আর ওড়িয়া মিশিয়ে একটা বিচিত্র ভাষা বলে। চেষ্টা করলে বোঝা যায়।

সেখানে এক জনকে পেলেন?

জানেন বোধহয় যে, এই জেলেরা খুব ভোরে, সূর্যোদয়ের আগেই সমুদ্রে ভেসে পড়ে। অনেক দূরে চলে যায়। ফেরে সন্ধের সময়। কারুর কারুর ফিরতে রাত হয়ে যায়। আমি ওদের বস্তিতে গিয়ে দেখলাম, অধিকাংশ পুরুষমানুষই জাল আর নৌকো নিয়ে বেরিয়ে গেছে। রয়েছে শুধু মেয়েরা আর বাচ্চারা, আর কিছু বৃদ্ধ। অনেকগুলো বাড়ি ঘোরার পর এক বাড়িতে এক জনকে পাওয়া গেল, সে-ও প্রায় বৃদ্ধই, তবে কাজের ক্ষমতা আছে, এখনও মাছ ধরতে যায়। কিন্তু আজ সে যায়নি, তার খুব জ্বর। তার গায়ে হাত দিয়ে দেখি, অন্তত আড়াই-তিন ডিগ্রি জ্বর হবেই। একেই বলে লাকি ব্রেক। লোকটার যদি আজ জ্বর না হত, তাহলে আমার সব পরিশ্রম ব্যর্থ হত!

আমি আর উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারছি না। রবীনবাবু সবিস্তারে কাহিনিটি বলতে শুরু করেছেন, আসল কথাটা এখনও জানা যাচ্ছে না। আমি ওঁর হাত চেপে জিজ্ঞেস করলাম, সেই লোকটা কী দেখেছে?

রবীনবাবু আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, এই লোকটি সেই রাতে মাছ ধরে একটু দেরি করে ফিরছিল। ওর সঙ্গে আর এক জনও ছিল। দ্বিতীয় লোকটির দেখা আমি পাইনি, সে আজ সমুদ্রে গেছে। এরা ফেরবার সময় দেখেছে, পরিষ্কার চাঁদের আলো ছিল, তটরেখা থেকে বেশ খানিকটা দূরে সমুদ্রে একটা নৌকো ভাসছে, তাতে বসে আছে একটি মেয়ে, সে দাঁড় নিয়ে বাইছে আর গুন গুন করে গান গাইছে। একটু দূরে গেলে আর ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায় না, তাই ওরা গানটাও স্পষ্ট শুনেছে।

আমি অবিশ্বাস ও উত্তেজনার সঙ্গে প্রায় চেঁচিয়ে বললাম, ওরা চন্দ্রাকে দেখতে পেয়েছিল? তবু তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি কেন?

রবীনবাবু বললেন, সে-চিন্তাও ওদের মাথায় আসেনি। ওদের নৌকোটা চন্দ্রার নৌকোর খুব কাছ দিয়ে এসেছে, ইন ফ্যাক্ট আমি চন্দ্রার একটা ছবি দেখাতে লোকটি মোটামুটি চিনতেও পারল। সে বলল, সব ভদ্রলোকদের মেয়েদের একই রকম দেখতে লাগে, নৌকোর মেয়েছেলেটির এই রকমই চেহারা। পাশ দিয়ে আসবার সময় চন্দ্রা ওদের কাছে কোনও সাহায্য চায়নি, সুতরাং ওরা আর মাথা ঘামাবে কেন? এ-রকম কেউ কেউ তো নৌকো নিয়ে বেড়াতে যায়।

একথা ওরা এত দিন পুলিশকে জানায়নি কেন?

জানায়নি, তার কারণ ওদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। ওরা আগ বাড়িয়ে বলতে আসবে কেন? ওদের এই দেখার যে কোনও গুরুত্ব আছে, তা-ও ওরা জানে না। তাছাড়া এই সব গরিব লোক এমনিতেই পুলিশকে ভয় পায়, নিজের থেকে পুলিশের কাছে এসে এরা কক্ষনও কিছু বলে না।

চন্দ্রাকে ওরা জীবিত দেখেছে। চন্দ্রার হাতে দাঁড় ছিল, অর্থাৎ চন্দ্রা ইচ্ছে করে নৌকো নিয়ে গেছে। এগজাক্টলি! এই বৃদ্ধ জেলেটিই তার অকাট্য প্রমাণ দিয়েছে।

চন্দ্রা সাঁতার জানত না, সে ওভাবে ঝুঁকি নিয়ে গেল কেন?

সে খুব রোম্যান্টিক মেয়ে, সাহসও ছিল যথেষ্ট। তাছাড়া খুব রাগ কিংবা অভিমান হলে তার কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকত না। জেদের বশে সে এমন অনেক কিছু করে ফেলতে পারত! গোপালপুরের সমুদ্র এমনিতে ঠাণ্ডা, পুরীর মতো এখানে বড় বড় ঢেউ ওঠেনা, ব্রেকার নেই, তাই দেখলে ভয় লাগে না। অনেক দূর পর্যন্ত এমনিতেই যাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ স্রোতের টান আসে। এই সমুদ্রে বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে এর আগেও দু-চার জন ডুবে গেছে। কোনও কারণে হয়তো চন্দ্রার প্রচণ্ড অভিমান হয়েছিল, তাই সে একা একা– ।

আমি চুপ করে মাথা নিচু করে রইলাম। সিগারেটটা বিস্বাদ লাগছে। রবীনবাবু আমার চেয়ে বেশি চিনতেন চন্দ্রাকে, তিনি ওর চরিত্র ভাল বুঝবেন।

আরও একটা চিন্তা আমার মাথায় এসে গেল। রবীনবাবু জেলেদের বস্তিতে গিয়ে অত পরিশ্রম করলেন কেন? নিতান্ত কৌতূহল? পল্লব ধরা পড়ার পরই তিনি বেশি উদ্যমী হয়ে উঠলেন। তার নিজেরও কিছু স্বার্থ ছিল এতে। সুনেত্রা কি রবীনবাবুকেও শাসিয়ে গেছে সামনাসামনি?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সঙ্গে এর মধ্যে সুনেত্রার দেখা হয়েছিল?

রবীনবাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, সুনেত্রা? না তো! হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। এই প্রশ্নটা আমার করা উচিত হয়নি। সামলে নেবার জন্য একটু মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে আমি বললাম, সুনেত্রারও দৃঢ় ধারণা ছিল, চন্দ্রা ইচ্ছে করেই নৌকো নিয়ে ভেসে গেছে। এর আগেও চন্দ্রা এ-রকম হঠকারী কাজ দু-একবার করতে গিয়ে কোনও ক্রমে বেঁচে গেছে। আজ বিকেলেই সুনেত্রা এই কথা বলে গেছে আমাকে।

রবীনবাবু বললেন, না, সুনেত্রার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। এটা আমারই নিজস্ব হানচ কিংবা ইনটিউশন বলতে পারেন। আজ দুপুরেই হঠাৎ আমার ধারণা হল, জেলেদের বস্তিতে গেলে একটা কিছু পাবই।

লোকটি কোনও কারণে মিথ্যে বলছে না?

শুধু শুধু মিথ্যে কথা বলবে কেন? এরা এমনিতেই মিথ্যে খুব কম বলে, কিছু একটা বানিয়ে গল্প বলার ক্ষমতাই নেই। মাছ ধরা আর দুবেলা পেট ভরে খাওয়া ছাড়া আর কোনও চিন্তাই এদের মাথায় আসে না। এই বুড়োটির নাম ধরণীধর, খুবই নিরীহ ধরনের মানুষ। থানায় গিয়ে অর্জুন মহাপাত্রদের সামনে সে একই কথা বলেছে। এর সঙ্গে যে লোকটি ছিল, সে ফিরে আসবার পর আলাদা ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করেও ঠিক এক ঘটনা পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহের অবকাশই নেই।

দূরে দেখা গেল অর্জুন মহাপাত্র, সন্তোষ মজুমদার ও অন্য ব্যক্তিটি কী সব পরামর্শ করে ফিরে এলেন। সন্তোষ মজুমদারের মুখে বেশ একটা উৎফুল্ল ভাব।

অর্জুন মহাপাত্র একটা উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে। তারপর হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, সাইলেন্স! সাইলেন্স!

সব গুঞ্জন থেমে গেল, সকলে ফিরে তাকাল সেই সুঠাম, সুপ্রতিভ পুলিশ অফিসারটির দিকে।

অর্জুন মহাপাত্র বললেন, প্লিজ গিভ মি পেশেন্ট হিয়ারিং ফর আ ফিউ মিনিটস। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন, ইউ হ্যাভ অ্যান ইমপর্টান্ট অ্যানাউন্সমেন্ট টু মেক…।

.

১১.

অনেক দিন আগে আমি একটা ফাঁকা বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলাম। তখন আমার ছাত্রজীবন চলছে। সব কিছুই যুক্তি দিয়ে বিচার করি। রাজনীতি থেকে প্রেম-ভালবাসা, সব কিছুর মধ্যেই যুক্তি খুঁজি। যাবতীয় সংস্কারকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিই।

বাড়ির সবাই দেওঘর বেড়াতে গিয়েছিলেন, আমি একা ছিলাম বাড়ি পাহারা দেবার জন্য। সামনেই আমার পরীক্ষা ছিল।

আমার নিজস্ব ঘরটি ছিল এক তলায়, রাস্তার পাশে। চোর-ডাকাত সম্পর্কে আমার মনে একটু একটু ভয়ের ভাব ছিল, ভূত-টুতের ভয় কখনও পাইনি। বিছানার পাশে একটা ভোজালি রাখতাম তখন।

এক দিন অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনো করে ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। তখন কত রাত তা জানি না, ঘর অন্ধকার, আমার ডান পাশের জানলার একটা পাল্লা খোলা, একটা পাল্লা ভ্যাজানো। সেখান থেকে শব্দ হচ্ছে, ঠক ঠক ঠক। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ঠিক তিনবার ওই রকম শব্দ।

ঝিম ঝিম করছে রাত, রাস্তায় আর কোনও শব্দ নেই, তখন যে-কোনও শব্দই বেশ জোর মনে হয়। তবে হাওয়ার শব্দ নয়, কেউ ওই শব্দটা করছে বিশেষ কারণে।

প্রথমেই মনে হল, চোর!

কিন্তু চোর এমন শব্দ করে আমাকে জাগাবার চেষ্টা করবে কেন? কিংবা সে দেখতে চাইছে, আমি জেগে আছি কিনা!

ছিঁচকে চোর হলে ধমক দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়াই উচিত। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি তীব্র গলায় বললাম, কে? কে ওখানে?

শব্দটা কিন্তু থামল না। কেউ সাড়া দিল না। আবার স্পষ্ট শোনা গেল, ঠক ঠক ঠক ঠক ঠকঠক!

জানলার খোলা পাল্লাটা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ আমার সারা গায়ে শিহরণ হল। কীসের এই ডাক?

আমি নিজের চক্ষু রগড়ে ভাল করে ঘুমকে তাড়ালাম ও ভয় ভাঙালাম। আমি আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না। ভূত-প্রেত নিয়ে চমৎকার গল্প হয়, কিন্তু বাস্তবে ওসব কিছু নেই। মৃত্যুর পর মানুষ আবার শরীর ধারণ করে আঙুল ঠোকার মতো ঠক ঠক শব্দ করতে পারে না। অসম্ভব!

উঠে গিয়ে তক্ষুনি জানলার ধারে গিয়ে দেখার বদলে আমি শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, শব্দটা কীসের হতে পারে? আমার যুক্তিবাদী মন কিছুতেই হেরে যেতে রাজি নয়।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল, টিকটিকি।

এবার উঠে গিয়ে বন্ধ পাল্লাটা খুলে ফেললাম এক টানে। যা ভেবেছি, ঠিক তাই। একটা বেশ গাবদা গোছের টিকটিকি একটা বড়সড় মথকামড়ে ধরেছে। মথটা তখনও মরেনি, ডানা ঝাপটাচ্ছে। টিকটিকিটা মাথা ঠুকে ঠুকে মথটাকে মারবার চেষ্টা করছে। তাতেই অবিকল আঙুল ঠোকার শব্দ।

সে রাতে আমি অদ্ভুত একটা আনন্দ পেয়েছিলাম। কত লোক রাত্তিরবেলা কলাগাছ কিংবা বেলগাছ দেখে ভয় পায়। কত লোক নিশুতি রাতে অলৌকিক পায়ের শব্দ শোনে। আসলে এ-সবই সামান্য ব্যাপার। একটু চিন্তা করলেই সহজ সমাধান পাওয়া যায়।

কিন্তু এক-এক সময় যুক্তিবোধ আমাকে ছেড়ে যায়। যুক্তি প্রয়োগ করার আগেই চোখ এবং কানকে চমকপ্রদ ভাবে বিশ্বাস করে বসি। হয়ত কোনও কোনও জায়গায়, যুক্তির বদলে বিশ্বাস করে নেবার জন্য মনটা আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে।

ঠিক সেই রকমই একটা ঘটনা আচমকা ঘটে গেল এই পাম বিচ হোটেলে, এত লোকজনের মাঝখানে। আমার বুক কাঁপিয়ে দিল শুধু না, আমার কণ্ঠরোধ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

অর্জুন মহাপাত্রের ঘোষণার পর উপস্থিত জনমণ্ডলীর মধ্যে বেশ একটা আনন্দের সাড়া পড়ে গিয়েছিল।

চন্দ্রার মৃত্যু এখন পুরনো হয়ে গেছে। তার জন্য শোক করার অবকাশ এখানে কারুর নেই। চন্দ্রার বাবা ও বোনের কথা অবশ্য আলাদা, কিন্তু তারা এখানে আসেননি। অন্য সবাই একটা চাপা আশঙ্কা ও অস্বস্তিতে ভুগছিল। পল্লবকে অ্যারেস্ট করেছিল পুলিশ, সেই সূত্র ধরে আরও কাকে কাকে হয়রানি করবে তার ঠিক নেই। সকলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে শুটিঙের ক্ষতি করা হচ্ছিল। এই সব কিছুর জন্যই দায়ী চন্দ্রা। চন্দ্রার বাবাও পুলিশের কাছে নানা অভিযোগ করেছিলেন ফিল্ম ইউনিটের নামে। মামলা করার ভয় দেখিয়েছেন।

এখন সব কিছু চুকে বুকে গেছে। চন্দ্রা নিজেই বোকার মতো একা একা সমুদ্রে নৌকো বাইতে গিয়েছিল। তার ফলে সে ডুবে মরেছে। এতে অন্য কারুর দায়িত্ব নেই। সবাই এখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। এই কদিন একটা থমথমে আরহাওয়া ছিল, এখন এখানে বইছে মুক্তির হাওয়া। বেশ কোলাহলের মধ্যে পানাহার চলছে।

এরই মধ্যে আরও একটা খবর পাওয়া গেল যে, ডুবুরিরা উদ্ধার করেছে নৌকোটা। সেটা একটা ডুবো পাথরের খাঁজে আটকে ছিল। চন্দ্রার বডি অবশ্য পাওয়া যায়নি, তবে ডুবুরিরা আশা রাখে, তারা কালকের মধ্যে পেয়ে যাবে ঠিক।

আমি অবশ্য মনে মনে চাইছিলাম, চন্দ্রার শরীরটা যেন পাওয়া না যায়। তার পচা-গলা-বীভৎস দেহটা দেখে আর কী লাভ হবে? বরং তা হাঙর ও মাছেদের খাদ্য হোক।

সারা দুপুর-বিকেল রবীনবাবু অনেক পরিশ্রম করেছেন বলে বেশ খানিকটা বিয়ার পান করে ফেললেন। তাঁর মুখটা লালচে হয়ে গেছে। তিনি অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার, কিছু দিন আগেও এক জেলার এস পি ছিলেন, এখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডি আই জি, অপরাধ ও খুন-জখম সম্পর্কে তার যথেষ্টই অভিজ্ঞতা থাকার কথা। তবু তিনি চন্দ্রার মতো একজন অল্পখ্যাত অভিনেত্রীর ব্যাপার নিয়ে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন মনে হচ্ছে।

সুগত এসে আবার যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে। সে নানা রকম বকবক করে যাচ্ছে, সবসময়ই একটা না-একটা কিছু পিলে চমকানো খবর তার বানানো চাই-ই। যেমন এইমাত্র সে জানাল যে, সন্তোষ মজুমদারের এই ফিল্মটির গল্প আলফ্রেড হিচককের একটা সিনেমা থেকে হুবহু টোকা। চন্দ্রা যে-ভূমিকাটা করছিল, সেটা অরিজিন্যাল ছবিতে ছিল অড্রি হেপবার্নের।

রবীনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হলিউডের সব ছবিই তার নখদর্পণে। অড্রি হেপবার্ন যে হিচককের কোনও ছবিতেই অভিনয় করেনি, সেটা রবীনবাবুর চোখ দেখেই বোঝা গেল।

তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবার আমি বাড়ি যাই। প্রতিমাকে কিছু বলে আসিনি। লেটেস্ট ডেভেলাপমেন্ট শুনলে সে চমকে যাবে, খুশিই হবে।

খুশি শব্দটা আমার কানে লাগল। এখানে এই শব্দটা কি মানায়?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, খুশি হবেন কেন!

রবীনবাবু বুদ্ধিমান ব্যক্তি। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে বললেন, না, মানে চন্দ্রার এ-রকম পরিণতি খুবই স্যাড। তবে মিস্ট্রিটা সলভড হয়ে গেল, এটা সকলের পক্ষেই একটা গ্রেট রিলিফ, তাই না?

সুগত বলল, সব কিছুই সলভড হয়ে গেছে, কী করে বললেন? চন্দ্রা যদি সুইসাইড করেও থাকে, তাহলেও সুইসাইডে ইনভেস্টিগেট করাও একটা ক্রাইম। কেউ যদি চন্দ্রার মনে খুব জোর আঘাত দিয়ে থাকে, তার ফলে যদি চন্দ্রা আত্মহত্যা করতে চায়, তাহলে যে আঘাত দিয়েছে, সে দায়ী হবে না? তরুণী বধূরা নিজেরাই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগালে শাশুড়ি আর দেওরকে ধরা হয় কেন?

রবীনবাবু বললেন, এখন আর এসব কথা শুনতে ভাল লাগছে না। আমি এবার যাই।

আমিও রবীনবাবুর সঙ্গে উঠে পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু সুগত আমার হাত চেপে ধরল জোর করে। ঈষৎ নেশাগ্রস্ত গলায় বলল, আপনার জন্য তো এখানে বাড়িতে আপনার বউ অপেক্ষা করে বসে নেই, আপনার এত তাড়া কীসের?

মাতালদের সঙ্গে জোরাজুরি করা মুশকিল, আমাকে আর একটু বসতেই হল।

এরপর সুগত একে একে পাঁচ জনের নামে ছড়াতে লাগল সন্দেহের বীজ। তারা প্রত্যেকেই চন্দ্রার মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত হতে পারে, তারা প্রত্যেকেই কোনও না-কোনও সময়ে চন্দ্রার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। এই ছবির অন্যতম প্রোডিউসার নাকি সরাসরি বলে দিয়েছিল, চন্দ্রা একবার অন্তত তার শয্যাসঙ্গিনী না হলে চন্দ্রার বড় রোল পাবার কোনও আশা নেই। সন্তোষ মজুমদারও চন্দ্রাকে বলেছিল, তুই একবার মাত্র প্রোডিউসারের ভাগ্নের সঙ্গে শুবি, তাতে এত আপত্তি কীসের? এতে কি তোর শরীরে কোনও দাগ পড়বে?

সিনেমার কাগজে অভিনেত্রীদের নিয়ে এ-রকম গালগল্প প্রায় প্রত্যেক সংখ্যাতেই থাকে। আমি মন দিয়ে সুগতর কথা শুনছিলামই না। তাকিয়ে ছিলাম সমুদ্রের দিকে।

সুগত নিজের বুক চাপড়ে বলল, চন্দ্রাকে সব সময় কে বাঁচাত জানেন? এই আমি! এই শালা সুগত মজুমদার। চন্দ্রা আমাকে খুব বিশ্বাস করত। যে-কোনও বিপদ-আপদে ছুটে আসত আমার কাছে, তা জানেন? এবারই আমার পোঁছোতে দেরি হয়ে গেল…।

মাতালদের নিয়ে এই এক মুশকিল, যত নেশা বাড়ে, ততই তারা আমি আমি শুরু করে। পৃথিবীর সব কিছুই যেন সেই আমিকে কেন্দ্র করে ঘোরে!

আমি বাথরুমে যাবার নাম করে উঠে পড়ার চিন্তা করছি, এমন সময় সেই কাণ্ডটি ঘটল।

বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা খালি চেয়ার পড়ে ছিল। অনেকক্ষণ থেকেই সেটা খালি দেখছি। হঠাৎ চোখের একটি পলক ফেলতেই দেখলাম, সেখানে একটি নারীমূর্তি বসে আছে। এক মুহূর্ত আগেও চেয়ারটা খালি ছিল, কী করে সেখানে এক জন এসে বসে পড়ল?

চন্দ্রা! এবার আমি তার মুখও দেখতে পাচ্ছি। সেই চেহারা, সেই চোখ। না, কোনও ভুল নেই।

আমার শরীর অসাড় হয়ে গেল, আমার গলার কাছে যেন দম আটকে এল। চন্দ্রা যদি রক্তমাংসের শরীর নিয়ে ফিরে আসে, তাহলে আমার আনন্দে চিৎকার করে ওঠার কথা। কিন্তু আমার কণ্ঠ দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না!

আমার যুক্তিবোধ নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমি নিজের চোখে চন্দ্রাকে দেখছি, ভয় পাচ্ছি, অথচ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না।

সুগত অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, সে লক্ষ্য করছে না কিছুই। আমি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছি চন্দ্রার দিকে। তার সমস্ত চুল খোলা, আগে সব সময় এ-রকম খোলা চুলেই তাকে দেখেছি, তার গাড় নীল রঙের শাড়িটাও যেন আমার চেনা।

এক সময় আমি অতি কষ্টে সুগতকে একটা ঠ্যালা মেরে ফ্যাসফেসে গলায় বললাম, সুগত, ও কে?

সুগত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, কার কথা বলছেন?

এবার আমার সর্বাঙ্গে ঝাঁকুনি লাগল। শুধু আমিই একা দেখব, আর কেউ দেখতে পাবে না?

আমি বলালম, ওই যে, চেয়ারে বসে আছে, দেখো, দেখো।

সুগত এবার বারান্দার প্রান্ত দেখে হেসে উঠে বলল, ওকে চেনেন না? ও তো বিশাখা। আপনার সঙ্গে আলাপ নেই?

আমি নিজে স্পষ্ট দেখছি চন্দ্রাকে, আর সুগত বলছে ওর নাম বিশাখা! এ আবার কী-রকম ধাঁধা? , আমার চোখে কি এত ভুল হতে পারে?

সুগত চেঁচিয়ে ডাকল, এই বিশাখা, বিশাখা, একবার এ-দিকে এসো তো।

মেয়েটি ডাক শুনে মুখ ফেরাল, উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে এল আমাদের দিকে। তখনও আমি চন্দ্রাকেই দেখছি। আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছে! আশেপাশের সব কিছুই যেন অলীক। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

মেয়েটি কাছে আসবার পর সুগত একটা চেয়ার টেনে বলল, বোসো। বিশাখা তুমি সুনীলদাকে চেনোনা?

মেয়েটি পাতলা করে হেসে বলল, হ্যাঁ, খুব ভালই চিনি।

আমার সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় চন্দ্রা ঠিক এই কথাই বলেছিল।

সুগত আবার বলল, সুনীলদা, বিশাখাকে কলকাতা থেকে আনানো হয়েছে। ও চন্দ্রার ভূমিকায় বাকি অংশটার শুটিং চালিয়ে দেবে। বিশাখা খুব ভাল অ্যাকট্রেস! তবে বড্ড মুডি। এক-এক সময় আমাদের চিনতেই পারে না। এই বিশাখা, তুমি এরই মধ্যে মেক আপ নিয়ে বসে আছ, এক্ষুনি শুটিং শুরু হবে নাকি?

মেয়েটি বলল, একটু বাদেই। আমাকে দিয়েই প্রথম শট নেবে।

তক্ষুনি সব কিছু জলের মতো সরল হয়ে গেল। চন্দ্রার বদলে তার অসমাপ্ত ভূমিকাটুকু চালিয়ে দেবার জন্য বেছে বেছে অন্য একটি অভিনেত্রীকে নিয়ে আসা হয়েছে। মোটামুটি চন্দ্রার সঙ্গে চেহারার মিল আছে, শরীরের গড়ন, মুখের ভাব অনেকটা এক রকম। সিনেমায় এরকম ডাবলের ব্যবহার তো প্রায়ই হয়। ভাল করে মেক আপ দিলে ধরতে পারা শক্ত।

এ-ও সেই টিকটিকির ব্যাপার। কিন্তু আমি আগেই বুঝতে পারিনি কেন? আমার মন প্রস্তুত ছিল না। এমনি এক মুহূর্তের মধ্যে চেয়ারে এসে ওর বসাটাও আমার মনে হয়েছিল অস্বাভাবিক, অলৌকিক! খালি চেয়ারে হঠাৎ একটি মেয়ে এসে বসতে পারে না?

জ্বর ছেড়ে যাবার মতো আমার শরীরে ঘাম ফুটে উঠছে বিন্দু বিন্দু। এই মেয়েটিকেই আমি বৃষ্টির মধ্যে লাল ছাতা মাথায় হেঁটে যেতে দেখেছিলাম। একেই দেখেছিলাম, সন্ধের আবছা আলোয় একটা নৌকোর ওপর বসে থাকতে।

চন্দ্রা একটা নৌকো নিয়ে হারিয়ে গেছে, তা কিমবিশাখা জানে না? তবু সে সন্ধেবেলা একা একটা নৌকোয় বসে ছিল কেন? বেশি বেশি সাহস দেখাতে?

মুখখানা পেইন্ট করা, ভুরু দু’টি গভীর ভাবে আঁকা, গালে লালচে আভা, বিশাখা আমার দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আমি অস্বস্তি কাটাতে পারছি না। নিজের কাছেই নিজের পরাজয়ে খুব ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।

বিশাখা জিজ্ঞেস করল, এই গল্পটা বুঝি আপনার লেখা? জানতাম না তো!

আমি আস্তে আস্তে বললাম, না, আমার লেখা নয়।

সুগত বলল, অরিজিন্যাল গল্পটা কার লেখা, ভগবান জানেন! বাংলা স্টোরিটা হিচককের ফিল্ম দেখে মেরে তিন জনে বানিয়েছে। নাম থাকবে সন্তোষ মজুমদারের। আজকাল পরিচালকরা একই সঙ্গে কাহিনি, চিত্রনাট্য, সঙ্গীত, রূপসজ্জা, পাবলিসিটি, সব কিছুর ক্রেডিট নেয়। সব্বাই সত্যজিৎ রায়ের এঁটো কলাপাতা! হে-হে-হে-হে!

বিশাখা বলল, ডায়ালগগুলো কে লিখেছে? আমারটা একটু বদলানো দরকার। আমি ঠিক মুড আনতে পারছি না। আচ্ছা সুনীলদা, আমার একটা ডায়ালগ শুনবেন? ‘দুঃখী মানুষদের সব সময় দুর্বল ভেবো না। দুঃখীদের অভিমান তোমার মতো অত্যাচারীদের এক সময় পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে!’ এখানে অভিমান কথাটা কি ঠিক খাটে? ক্রোধ হওয়া উচিত না? আর যদি অভিমান রাখতেই হয়, তাহলে পুড়িয়ে ছারখারের বদলে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে বললে ভাল শোনায় না?

একটু আগেই আমার একটা বিরাট ভুল ভেঙেছে, আমি এখন স্বাভাবিক হতে পারিনি, এই সব ব্যাপারে মতামত দেবার ইচ্ছেও হল না আমার। শুকনো গলায় বললাম, আগেরটাও চলে যেতে পারে।

বিশাখা তবু ছেলেমানুষি সুরে বলল, না, আপনি ঠিক করে বলুন, অভিমান, না ক্রোধ, কোনটা এখানে ঠিক হবে?

তুমি আমাকে চিনলে কী করে, বিশাখা?

বাঃ, আপনাকে দেখেছি তো কতবার! কবি সম্মেলনে আপনার কবিতা পাঠ শুনেছি। আমিও অনেক জায়গায় কবিতা আবৃত্তি করি। এক দিন শিশির মঞ্চের একটা অনুষ্ঠানে আপনার সঙ্গে আমারও ছিল। কিন্তু আপনি গোড়ার দিকে নিজেরটা পাঠ করেই চলে গেলেন, আমাদেরগুলো শুনলেন না। সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিল।

সুগত বলল, অভিমান না রাগ?

বিশাখা বলল, সুনীলদার সঙ্গে কি আমার পরিচয় ছিল যে অভিমান হবে? যখন তখন মানুষের রাগই হয়। অভিমান অনেক গভীর।

সুগত বলল, মেয়েদের কোনটা রাগ আর কোনটা অভিমান বোঝা মুশকিল। আমার ওপর যেন কক্ষন অভিমান কোরো না। তোমার নাম সন্তোষবাবুর কাছে কে সাজেস্ট করেছে জানো? এই আমি! চন্দ্রার বদলে ওরা কাকে নেবে, কাকে নেবে ভাবছিল, আমি সন্তোষবাবুকে বললাম, বিশাখাকে নিন। খুব ট্যালেন্টেড অ্যাকট্রেস, গলাখানা ভাল, মেকআপ দিলে চেহারাটাও উতরে যাবে।

বিশাখা বলল, এই, উতরে যাবে মানে?

সুগত বলল, আই মিন, চন্দ্রার সঙ্গে অনেকটা মিলে যাবে। আমার কথা শুনেই তো ওরা ডিসিশান নিল। এরা আমার মতামতের মূল্য দেয়, বুঝলে?

সুগত আবার আমি, আমি শুরু করেছে। এবার উঠতেই হয়।

 বিশাখার দিকে তাকিয়ে বললাম, এক দিন তোমার আবৃত্তি নিশ্চয়ই শুনব। আজ চলি।

 বিশাখা দারুণ অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, চলে যাচ্ছেন? শুটিং দেখবেন না?

হেসে বললাম, না, শুটিং দেখা আর হবে না। আমার একটা অন্য কাজ আছে।

বিশাখা অনুনয়ের সুরে বলল, একটুক্ষণ থাকুন, প্লিজ একটু দেখে যান।

সুগত ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, জোর করে ধরে রাখো। কিস্যু কাজ নেই, সুনীলদা কেটে পড়ার তালে আছে। এখন গিয়ে রবীনবাবুর সঙ্গে আড্ডা মারবে।

বিশাখা সচকিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, রবীনবাবু মানে যিনি একটু আগে এখানে বসেছিলেন? পুলিশের ডি আই জি?

তুমি তাকেও চেনো নাকি?

খানিকটা রহস্যের ভঙ্গিতে ঠোঁট মুচড়ে হেসে বিশাখা বলল, হ্যাঁ, ভালই চিনি। উনি অবশ্য এখানে আমাকে একবার দেখেও না চেনার ভান করলেন।

রবীনবাবু পুলিশ অফিসার হলেও ফিল্ম সম্পর্কে খুব উৎসাহী। বাংলা ফিল্মের অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি চন্দ্রা আর বিশাখাকে আগে থেকেই চেনেন।

আমার দিকে ঘুরে বিশাখা বলল, আপনি কিন্তু আজ পালাতে পারবেন না, একটুখানি থাকতেই হবে।

কিছুতেই এড়ানো গেল না, আমাকে বসে যেতেই হল।

অর্জুন মহাপাত্র সদলবলে চলে গেলেন একটু আগেই। অন্যান্য অতিথিরাও বিদায় নিচ্ছেন। সন্তোষ মজুমদার আমাদের সঙ্গে এসে বসলেন একটু। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, আজ থেকে আবার নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারব। ওয়েদারটাও কী-রকম ফাইন হয়ে গেছে দেখুন। আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে না।

একটু বাদে এক জন এসে খবর দিল, লাইটিং রেডি। এখুনি শুটিং শুরু হবে।

রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। এখনও শুটিং দেখার জন্য বেশ কিছু মানুষ ভিড় করেছে। তাদের সরিয়ে রাখা হয়েছে একটা দড়ির রেখার বাইরে। আমাকে একটা চেয়ার পেতে দেওয়া হল তার উলটো দিকে।

বিশাখাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে একটা গাছের সঙ্গে। শুধুশায়া আর ব্লাউজ পরা। শাড়িটা খসে পড়ে আছে পায়ের কাছে। শুধু শায়া-ব্লাউজ পরা অনেক মেয়েকেই দেখা যায় ফিল্মে, কিন্তু শাড়িটা খুলে পায়ের কাছে রেখে দেওয়ায় একটা অতিরিক্ত সাজেশান এসেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ভিলেন, হাতে তার একটা চাবুক। তাকে বড্ড বেশি ভিলেন দেখতে। মনে হয় গত শতাব্দীর কোনও ডাকাতের সর্দার। বিশাখা হচ্ছে নায়িকার বোন, ভিলেন তাকে ধরে এনে নায়ককে ব্ল্যাকমেইল করবে। এই দৃশ্যেই কোনও এক সময় বীরের মতো উপস্থিত হবে নায়ক। তারপর ফাইটিং সিন।

যদি আলফ্রেড হিচককের কোনও ছবি থেকে গল্পটা মারা হয়ে থাকে, তবু যারা বাংলায় তার রূপান্তর ঘটিয়েছে, তাদের উর্বর মস্তিষ্কের প্রশংসা করতেই হয়। এ-রকম একটা রগরগে দৃশ্য কল্পনা করা হিচককের অসাধ্য ছিল!

চন্দ্রার এটাই ছিল টপসিন, সে আর সুযোগ পেল না।

 চন্দ্রার মতোই বিশাখাও পড়াশুনো করা মেয়ে মনে হল। সাহিত্যরুচি আছে। সংলাপের ভুল শব্দ ব্যবহার নিয়ে সে খুঁত খুঁত করে। অথচ এই সব মেয়েরই কী সব বিশ্রী, কুরুচিপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়।

সভোষ মজুমদার মাথায় একটা সাদা রঙের টুপি পরেছেন। এটা বিদেশি পরিচালকদের অনুকরণ। তিনি ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন চারদিকে। দু-তিনবার ক্যামেরায় লুক থ্রু করলেন। এক জনকে ডেকে বলে দিলেন বিশাখার মেক আপটা সামান্য বদলে দিতে। খোলা চুল পিঠ থেকে সরিয়ে আনা হল বুকের ওপর।

এদের কৃতিত্ব আছে, বিশাখাকে এখন অবিকল চন্দ্রার মতো দেখাচ্ছে।

এক সময় সন্তোষ মজুমদার একটা সাদা রঙের চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়ালেন। নাটকীয় ভঙ্গিতে ডান হাত উঁচু করে চিৎকার করে বললেন, টেকিং! সাইলেন্স! সাইলেন্স! স্টার্ট সাউন্ড!

উত্তর এল, রানিং।

 সন্তোষ মজুমদার আবার সজোরে বললেন, ক্যামেরা!

এক জন ক্ল্যাপস্টিক দিয়ে বলে গেল, সিন ফর্টি নাইন, টেক ওয়ান!

ক্যামেরা প্যান করে এসে ফোকাস করল বিশাখার মুখের ওপর। বিশাখা ক্লান্ত চোখ মেলে আস্তে আস্তে তাকাল সামনে। তারপর মুহূর্তের পর মুহূর্ত চুপ। সন্তোষ মজুমদার ঠোঁট নাড়ছেন, অর্থাৎ তিনি ডায়ালগ শুরু করতে বলছেন।

বিশাখা কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগল, আমি তোমাদের চিনেছি। আমি তোমাদের সবাইকে চিনেছি। আমার দরজা বন্ধ ছিল–।

সন্তোষ মজুমদার প্রায় আর্তনাদের মতো বলে উঠলেন, কাট! কাট!

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ক্যামেরা। সন্তোষ মজুমদার চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসে বললেন, কী হল? এটা কোন সিনের ডায়ালগ? এখানে তো এই ডায়ালগ ছিল না।

এক জন সহকারী পরিচালক চিত্রনাট্যের ফাইল নিয়ে ছুটে এল। ফরফর করে পাতা উলটে সে বলল, এ ডায়ালগ অনেক আগের সিনের, চন্দ্রাই করে গেছে। বিশাখাকে আমি এইসিনের ডায়ালগ দিয়েছি, কতক্ষণ ধরে মুখস্থ করলাম।

বিশাখা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

 সন্তোষ মজুমদার তাকে এক ধমক দিতেই সে বলল, ভুল বলেছি?

সহকারী পরিচালকটি বলল, ভুল মানে? একেবারে উলটো-পালটা ডাবিঙের সময় লিপ মিলবে না।

বিশাখা এবার লজ্জায় জিভ কেটে বলল, ও মা, কী করে ভুল হল? আমার কক্ষনও মুখস্থ ভুল হয় না।

চিত্রনাট্য দেখে আবার সংলাপ ঝালিয়ে নিল বিশাখা।

সবাই ফিরে গেল যে যার জায়গায়। ভিলেন একবার শপাং করল চাবুকটা। সন্তোষ মজুমদার আবার চেয়ারে উঠে হাত তুলে বললেন, সবাই রেডি? টেকনাম্বার টু। স্টার্ট সাউন্ড!

ক্যামেরা ঘুরে এসে বিশাখার মুখের সামনে স্থির হয়েছে, বিশাখা ভিলেনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর বলল, আমি..আমি..আমি…আমি…আমি…

রীতিমতো তোতলাচ্ছে বিশাখা, আমি শব্দটা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছে না। সন্তোষ মজুমদারের চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। শুধু শুধু ফিল্মের ফুটেজ খেয়ে যাচ্ছে। তিনি এক সময় গর্জন করে উঠলেন, কাট! কাট!

এবার তিনি চেয়ার ছেড়ে বিশাখার থুতনিতে একটা খোঁচা মেরে বললেন, এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে? ভ্যালুয়েবল টাইম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বিশাখা তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

সহকারী পরিচালক আবার ছুটে এসে বলল, আমি কোথায় পেলে? আরম্ভটাই ভুল করলে। আরম্ভটা হবে, দুঃখী মানুষদের দুর্বল মনে কোরো না…।

বিশাখা বলল, কী যে হল, কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুতেই মনে আসছে না।

সন্তোষ মজুমদার রাগে হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন।

আমি ভেবেছিলাম, বিশাখা হয়তো সংলাপ একটু আধটু বদলে দেবে, অভিমানের জায়গায় ক্রোধ চালিয়ে দেবে। কিন্তু সে কোনও কথাই বলতে পারছে না, এটি সত্যি আশ্চর্য ব্যাপার। খুব নবিস অভিনেত্রীরাও এ-রকম করেনা। বিশাখাকে তো বেশ সপ্রতিভই মনে হয়েছিল।

বিশাখা সলজ্জ ভাবে একবার আমার দিকে তাকাল।

সন্তোষ মজুমদার আর একটা চেয়ার টেনে আমার পাশে এসে বললেন, নিন, একটা সিগারেট খান। আপনি এই প্রথম শুটিং দেখতে এলেন, অথচ কীরকম ধ্যাড়াচ্ছে বলুন তো। এটা একটা ভাইটাল সিন!

পাশ থেকে এক জন হোমরা-চোমরা ধরনের লোক ফিস ফিস করে বললেন, মেয়েটার ডায়লগ অফ করে দিন না!

সন্তোষ মজুমদার বললেন, দাঁড়ান না, আর একটু দেখতে দিন না। শুধু একতরফা ভিলেন কথা বলে গেলে আর চাবুক হাঁকড়ালে জমে কখনও? মেয়েদের গলার আওয়াজেই একটা অন্য রকম আপিল থাকে।

হোমরা-চোমরা ব্যক্তিটি ঠোঁট ওলটালেন। তারপর বিড় বিড় করে বললেন, আর তিন দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। একেই তো উটকো ঝঞ্ঝাটে অনেকটা সময় চলে গেল।

সন্তোষ মজুমদার আর কিছুনা বলে সিগারেট টানতে লাগলেন।

সহকারী পরিচালকটি পাখি পড়াবার মতো করে বিশাখাকে সংলাপ মুখস্থ করাচ্ছে। বিশাখা খুব মনসংযোগ করে, চোখ বুজে দু’বার করে উচ্চারণ করছে প্রতিটি বাক্য। দূরের দর্শকরা অধীর হয়ে উঠেছে খানিকটা। শুটিং একেবারে জমলেই না এখনও পর্যন্ত। ভিলেনের তর্জন-গর্জন দেখলে তারা মজা পেত খানিকটা। কিন্তু সে বেচারা শুধু একটু চাবুক নাড়ানো ছাড়া আর কোনও সুযোগই পায়নি।

অবশ্য অধিকাংশ শুটিংই এ-রকম। একই শট দু-তিনবার এন জি হয়, বার বার একই জিনিস দেখতে হয়। তবে, এ-রকম পার্ট ভুলে যাওয়া সত্যিই অভিনব।

এখনও আকাশে বেশ জ্যোৎস্না আছে, ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোট মেঘ আনাগোনা করছে চাঁদের ওপর দিয়ে।

সন্তোষ মজুমদার খানিকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, সিনটা ডিফিকাল্ট, তা ঠিকই। মেয়ে চরিত্রটা তো ভ্যাম্প নয়, ভদ্রঘরের মেয়ে। তার শাড়ি খুলে ফেলা হয়েছে বটে, কিন্তু কথা বলবে কান্না কোন্না গলায়। চন্দ্রা এই জায়গাটা একেবারেই পারছিল না। সে যে-দিন ডিসঅ্যাপিয়ার করে, সে-দিন দুপুরেও এই সিনটা দু-একবার চেষ্টা করা হয়েছিল। চন্দ্রার ঠিক এক্সপ্রেশান ফুটছিল না বলে প্রোডিউসাররা চেয়েছিল, সিনটায় চন্দ্রার ডায়ালগ সব বাদ দিয়ে দিতে। ওর শুধু বডিটা ইউজ করা হবে। কিন্তু এই মেয়েটা, বিশাখা, এ ভাল অভিনয় করে। এর না পারার কোনও কারণ নেই। এই বিশাখা স্মার্ট মেয়ে, সাঁতার আর অন্যান্য দু-একটা স্পোর্টসে মেডেল পেয়েছে, আবৃত্তি ভাল করে। চন্দ্রার চেয়েও অনেক সুপিরিয়ার অ্যাকট্রেস, আমি সিওর ছিলাম ও ভাল করবে।

এতক্ষণ বাদে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে চন্দ্রার বদলে আগেই বিশাখাকে নেননি কেন?

সন্তোষ মজুমদার অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। তারপর বলনে, ফিল্ম লাইনের সব ব্যাপার আপনি বুঝবে না। কাস্টিঙের সময় অনেক কিছু কনসিডার করতে হয়। চন্দ্রা এখনও ঠিক প্রফেশনাল নয়, আই মিন, ছিল না। আর বিশাখা একটা স্টেজে নিয়মিত অভিনয় করে। শনি-রবিবার ডেট দিতে পারে না। ঠিক এই সময় অবশ্য ওদের নাটকটা বন্ধ আছে, আমরা লাকি…।

একটু থেমে সন্তোষ মজুমদার আবার বললেন, বিশাখা যে এ-রকম ভাবে সময় নষ্ট করবে, তা আমি কল্পনাই করতে পারিনি।

সহকারী পরিচালকটি বলে উঠল, এবার ঠিক আছে সন্তোষদা! আরম্ভ করুন।

 সন্তোষ মজুমদার আবার চলে গেলেন ক্যামেরার কাছে। লাইটিঙের সামান্য পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়ে চেঁচালেন, টেকিং! স্টার্ট সাউন্ড! ক্যামেরা!

আগের মতো আবার শুরু হল। ভিলেনটি একবাবের বদলে তিনবাব শপাং শপাং করল চাবুক। ক্যামেরা বিশাখার মুখের ক্লোজ আপ ধরে আছে।

চোখ খুলে তাকাল বিশাখা, ভিলেনের বদলে পবিচালকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটি যেন বেশি উজ্জ্বল। বেশ কয়েকটি মুহূর্ত কেটে গেল, তা-ও সে কোনও শব্দ উচ্চারণ করছে না।

সন্তোষ মজুমদার অস্থির ভাবে বলে উঠলেন, কী হল বিশাখা, ডায়ালগ দাও! ডায়ালগ! সুজিতের দিকে তাকাও।

বিশাখা তবু চেয়ে রইল পরিচালকের দিকে। তার দৃষ্টিতে কোনও ভাষা নেই।

 সন্তোষ মজুমদার আবার আদেশ দিলেন, বিশাখা, ডায়ালগ! ডায়ালগ বিশাখা তবু চুপ।

সন্তোষ মজুমদার বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, দুর ছাই! এ যে কলাগাছের অধম! কাট। লাইটস অফ!

তীব্র আলোগুলো হঠাৎ নিভে যেতেই বিশাখা ভেঙে পড়ল কান্নার ঝাপটায়। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, আমি পারছি না। আমি পারছি না। কিছুতেই আমার মনে আসছে না।

.

১২.

 পরদিন বিকেলে আমার ফিরে যাওয়া হল না।

কারণটা এমনই অকিঞ্চিৎকর যে কাউকে বোঝানো যাবেনা।

সকালবেলা সুগত এসে বলল, সুনীলদা, আপনি আজই কলকাতায় ব্যাক করছেন? চলুন, এক সঙ্গে যাওয়া যাবে। আমারও আর এখানে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। চন্দ্রার ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল। মি. অর্জুন মহাপাত্রও আজ যাচ্ছেন, ওঁর গাড়িতে আপনি গেলে আমিও বেরহামপুর পর্যন্ত লিফট নেব। কলকাতায় আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।

অর্জুন মহাপাত্রের গাড়িতে আমি যাব না, সেটা আগেই ঠিক করেছিলাম। কিন্তু সুগতকে এড়ানো যায় কী করে? ট্রেনের সারাটা রাস্তা সুগতের সাহচর্যে কাটানো আমার কাছে তেমন আকর্ষণীয় মনে হলনা। একটু বেশি কথা বললেও সুগত ছেলেটি খারাপ নয়। কিন্তু ট্রেনে আমি চুপচাপ বই পড়তে ভালবাসি, সুগত সে সুযোগ আমাকে দেবে না।

সুতরাং ওকে বললাম, আজ আর ফেরা হবে না ভাই। আমার শরীরটা ঠিক ভাল লাগছেনা। জ্বর জ্বর লাগছে, আর একটা দিন দেখে যাই।

সুগত চলে গেল। আমাকেও মিথ্যে কথার ফলভোগ করতে হল। অনেক সময় মিথ্যে অজুহাতটা হঠাৎ সত্যি হয়ে যায়। দুপুরের দিকে আমার সত্যি সত্যি জ্বর এল। সেই সঙ্গে পাতলা সর্দি।

টকটক করে দু’পেগ ব্র্যান্ডি মেরে দিয়ে শুয়ে রইলাম বিছানায়। এটাই সর্দি জ্বরের আমার নিজস্ব ওষুধ। এর পরে দুপুরটা টানা ঘুম দিতে পারলে জ্বর-টর ছেড়ে যেতে বাধ্য।

কিন্তু ঘুম এলনা। এ-বই সে বইয়ের পাতা ওলটাই, কোনওটাতেই মন বসেনা। বিকেলের দিকে রবীনবাবু দেখা করতে এলে আমি খুশিই হলাম বেশ। কারুর সঙ্গে একটু কথা বলতেই মন চাইছিল। রবীনবাবু এসেই বললেন, এদের শুটিং তো একেবারে গড়বড় হবার জোগাড়। শুনেছেন কিছু?

 আমি অবাক হয়ে বললাম, না তো! আবার কী গণ্ডগোল হল?

রবীনবাবু বললেন, প্রথম কথা, বিশাখা এমন সব উলটো-পালটা কাণ্ড করছে, যা একেবারে অবিশ্বাস্য। সে কান্নার জায়গায় হাসছে, হাসির জায়গায় কাঁদছে। মাঝে মাঝে এমন সব ডায়ালগ দিচ্ছে, যা শুনলে পিলে চমকে যায়। এই ছবিতে তা একেবারেই বেমানান। সবই যেন অভিমানের কথা।

আমি বললাম, বিশাখা বোধহয় এই ফিল্মের রোলটা সিরিয়াসলি নেয়নি। একেই তো এলেবেলে পার্ট, তা-ও অন্যের ডাবল। ওর কেন উৎসাহ থাকবে বলুন!

রবীনবাবু বললেন, তা নয়, তা নয়। যত ছোটই পার্ট হোক, তবু সিরিয়াসলি নিতে হয়। বিশাখা যেন নিজেই বুঝতে পারছে না, কেন তার এত ভুল হচ্ছে! আরও কী কী হচ্ছে শুনুন। সুনেত্রা হঠাৎ আছাড় খেয়ে পা মচকেছে। সন্তোষবাবুর গলা বসে গেছে ঠাণ্ডায়, এমনই বসে গেছে যে চিঁ চিঁ করে কী যে বলছেন, বোঝাই যাচ্ছে না। এরা এন এফ ডি সি থেকে নতুন ক্যামেরা নিয়ে এসেছে, খুব চমৎকার কাজ হচ্ছিল, কিন্তু তার লেন্সে ফাঙ্গাস দেখা দিয়েছে, ছবি ক্লিয়ার আসছে না। হঠাৎ যেন শনির দৃষ্টি পড়েছে এই ইউনিটটার ওপর। সন্তোষবাবু নাকি প্যাক আপ করে কালই ফিরে যাবেন ভাবছেন। এ যাত্রায় আর শুটিং কমপ্লিট হবে না।

এ সংবাদ শুনে আমার কোনও দুঃখ হল না। এই ফিল্মের শুটিং নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।

রবীনবাবু বললেন, আমার স্ত্রীর ধারণা, এই ফিল্মের দলটির ওপর চন্দ্রার অভিশাপ লেগেছে।

আমি সামান্য হেসে বললাম, অভিশাপ আবার কী? প্রতিমা এই সব বিশ্বাস করেন বুঝি? ওঁর কথাবার্তা শুনে আগে তো মনে হয়নি।

প্রতিমার কতকগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত ধারণা আছে। প্রতিমার মতে, কোনও মানুষের অকালমৃত্যুর একটা সাইকিক এফেক্ট আশেপাশের কিছু মানুষের ওপর পড়েই। সেটাকেই অনেকে বলে, এক জনের আত্মা আর একজনের ওপর ভর করে। আত্মায় বিশ্বাস না করলেও এ-রকম কিছু কিছু ব্যাপার সত্যিই ঘটে। চন্দ্রা এই ফিল্ম-টা কমপ্লিট করতে পারল না, তার জায়গায় এসেছে বিশাখা। কিন্তু চন্দ্রার অতৃপ্তিই তাকে পদে পদে বাধা দিচ্ছে। নইলে বিশাখার মতো মেয়ে এ-রকম ভুল করবে কেন? এ সম্পর্কে আপনার কী মত?

বুল শিট! মৃত মানুষের অতৃপ্তি হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় না। পৃথিবীতে কত মানুষ মরছে, তাদের জায়গায় অন্য মানুষ রিপ্লেসড হচ্ছে, প্রফেশনাল জগতে এ-রকম অনবরত চলছে। মনে করুন, একটা পত্রিকায় আমার ধারাবাহিক উপন্যাস চলছে, সেটা শেষ হবার আগেই যদি আমি মারা যাই, পত্রিকার সম্পাদক চুপ করে বসে থাকবেন? পরের সংখ্যা থেকেই নতুন একজনের উপন্যাস শুরু হবে। পরে যে লিখবে, তার কি কোনও গিলটি ফিলিং হবে? নাকি, আমার অতৃপ্ত আত্মা তাকে ভয় দেখাবে?

তাহলে বিশাখা এ-রকম ফেইল করছে কেন?

বিশাখা সিম্পলি নার্ভাস! সে পারছে না।

আপনি বিশাখাকে আগে দেখেননি। চন্দ্রার তুলনায় বিশাখা অনেক টাফ, প্র্যাকটিক্যাল। সে নিয়মিত স্টেজে অভিনয় করে। তার এ-রকম নার্ভাসনেস বিশ্বাসই করা যায় না।

বিশাখা মিসকাস্টিং হয়েছে। এই প্যানপেনে ভূমিকা, বাজে সংলাপ তার মুখ দিয়ে ঠিক মতো বেরুচ্ছে না।

ইউনিটের অন্য লোকজনদেরও এ-রকম দুর্ঘটনা ঘটছে কেন বলুন? সবই কাকতালীয়।

দেখুন, কারুর সর্দিতে গলা বসে যাওয়া কিংবা ক্যামেরার লেন্সে ফাঙ্গাস পড়ার জন্যও যদি কোনও মৃত আত্মাকে দায়ী করা হয়, তাহলে আমার বলবার কিছু নেই।

আপনি যাই বলুন, কাল সন্ধের পর এখানকার বাতাসে আমি যেন মাঝে মাঝেই চন্দ্রার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। আমি নিজে এসব ঠিক বিশ্বাস করি না, তবু এ-রকম একটা ফিলিং হচ্ছে ঠিকই। মেয়েটা এমন ভাবে জীবনটা নষ্ট করল। কতটা দুঃখ তার বুকে জমে ছিল…।

আমি চুপ করে সিগারেট টানতে লাগলাম। জ্বরের মুখে সিগারেটের ধোঁয়া বিস্বাদ লাগছে। তবু অভ্যেসবশে টেনে যাচ্ছি।

একটু থেকে থেকে রবীনবাবু আবার বললেন, চন্দ্রার প্রবলেমটা কী ছিল জানেন? বলা যায়, আইডেনটিটি ক্রাইসিস। চন্দ্রার ট্যালেন্ট ছিল, কিন্তু ও ঠিক নিজের ক্ষেত্রটা বেছে নিতে পারেনি। পড়াশুনোয় ভাল ছিল, অধ্যাপনার লাইনে গেলে নাম করতে পারত। গানের গলাও ছিল বেশ সুরেলা, ঠিকমতো চর্চা করলে গায়িকাও হতে পারত নিশ্চয়ই। একটু চেষ্টা করলেই বিদেশে চলে যেতে পারত অনায়াসে। কিন্তু ওর রূপের জন্যই, ওকে যেন জোর করে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল সিনেমা লাইনে। এইসব মেয়ে, যে-কোনও লাইনেই টপে যেতে না পারলে খুব কষ্ট পায়। যোগ্যতা আছে, অথচ যেতে পারছে না।

আমি বললাম, পড়াশুনোয় ভাল, গানের গলা আছে, চেহারাও সুন্দর, এইসব গুণগুলো থাকলে তো অভিনয়েও সাকসেসফুল হতে পারে। সেটা পারল না কেন চন্দ্রা? ঠিকমতো সুযোগ পায়নি বলে?

রবীনবাবু বললেন, ঠিক তা নয়। ফিল্ম লাইনে ও নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে পারেনি। ফিল্মের জগতটা এখন মেল ডমিনেটেড, এটা তো মানবেন? চন্দ্রা কোনও পুরুষকেই সহ্য করতে পারত না।

আমি বেশ বিস্ময়ের দৃষ্টি দিতেই রবীনবাবু বললেন, তার মানে কিন্তু এই নয় যে, চন্দ্রার খুব বেশি মরাল স্ক্রপুলস ছিল। আধুনিক মেয়ে একা একা অনেক জায়গায় ঘুরছে, শুটিং-এর সময়েও তো অভিভাবকদের কক্ষনও সঙ্গে আনত না। এমনিতে পুরুষদের সঙ্গে মিশত, হাসি-ঠাট্টা করত, সে-সব ঠিক ছিল, কিন্তু কেউ একটু ঘনিষ্ঠতা করলেই গুটিয়ে নিত নিজেকে। ফিল্মেও ওর প্রেমের অভিনয় এই জন্যই কাঠ কাঠ মনে হত। আবেগ নেই, নিষ্প্রাণ। চন্দ্রা এক-এক সময় বলেও ফেলত, কোনও পুরুষই তার যোগ্য নয়। সে যাদের দেখেছে, তারা কেউই যথার্থ পুরুষ নয়।

আমি হেসে বললাম, অর্থাৎ তার জীবনের প্রিন্স চার্মিংকে সে খুঁজে পায়নি।

রবীনবাবু বললেন, অনেকটা তাই! তার এই সূক্ষ্ম অবজ্ঞা সিনেমা লাইনের পুরুষেরা ঠিক বুঝে যেত, তারা অপমানিত বোধ করত, সেই জন্য তারা চন্দ্রাকেও বেশি ওপরে উঠতে দিতে চায়নি।

আপনি চন্দ্রাকে খুব ভালভাবে স্টাডি করেছেন, তাইনা?

হ্যাঁ।

আমরা দু’জনের দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলাম এক ধরনের সম্মতিতে। একে বলা যায় জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট। চন্দ্রার সঙ্গে রবীনবাবুর কত দিনের পরিচয় এবং কতখানি ঘনিষ্ঠতা, সে-বিষয়ে আর প্রশ্ন তোলা চলবে না।

রবীনবাবু চলে যাবার একটু পরেই প্রতিমা এলেন ওর খোঁজ নিতে। স্বামীটি এখানে নেই শুনে উনি চলে যাবার জন্য উদ্যত হয়েও ফিরে তাকালেন। মেয়েরা এ-সব ঠিক বুঝতে পারে।

রবীনবাবুকে আমার জ্বরের কথা বলিনি, উনিও কিছু জিজ্ঞেস করেননি। কিন্তু প্রতিমা ভুরু তুলে বললেন, আপনার শরীর খারাপ নাকি? চোখ দুটো ছল ছল করছে।

কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে বললেন, বেশ জ্বর দেখছি। ডাক্তার দেখিয়েছেন?

আমি বললাম, এক দিনের জ্বরে কেউ ডাক্তার দেখায় নাকি? ও কিছুনা।

কিছু ওষুধ খেয়েছেন? খাননি নিশ্চয়ই। আমি ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি, আমার কাছে সব সময় থাকে।

 আমার নিজস্ব ওষুধের কথা উল্লেখ না করে বললাম, আমি যখন তখন অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ খাই না। আমার ঠিক বিশ্বাস নেই। কিছু লাগবে না।

রবীনবাবুর কিন্তু খুব অসুখের বাতিক। আপনি এই কথা বলছেন, আর রবীনের একটু জ্বর হলেই পাঁচ-সাতটা ওষুধ খেয়ে নেয়।

আমার বিনা ওষুধেই সেরে যায়।

শুয়ে থাকুন তাহলে, বিশ্রাম নিন। আপনার রাত্তিরের খাবারটা এখানে পাঠিয়ে দিতে বলব?

আমি উত্তর না দিয়ে প্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। অসুখের কথা যখন উঠছেই, তখন এই সুযোগে আমার একটা কৌতূহল মিটিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

আপনার কিছু একটা অসুখ আছে শুনেছি? কী অসুখ?

প্রতিমা সহজে হাসেন না। এখন তার সারা মুখখানাই হাসিতে ভরে গেল। তিনি বললেন, যদি বলি আমার অসুখটা হচ্ছে পাগলামি, তাহলে বিশ্বাস করবেন?

সব মানুষই তো একটু একটু পাগল।

কিন্তু আমি এক-এক সময় সীমানা ছাড়িয়ে যাই। কিছুতেই যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে পারি না। খিটখিটে হয়ে যাই, সন্দেহ বাতিক দেখা দেয়। রবীনকে তখন জ্বালাতন করি। এখানে আসবার আগে দু’মাস আমাকে নার্সিংহোমে থাকতে হয়েছিল।

আপনাকে তো আমার পারফেক্টলি নর্মাল বলে মনে হয়। একটু বেশি নর্মাল। কথাবার্তার মধ্যে সব সময় ব্যালান্স থাকে।

সেটাই বোধহয় খারাপ। এক-এক সময় ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় জীবনটাই অর্থহীন। ঠিক দু’রকম ফিলিং হয়, জানেন। মনে হয়, আমার যা যা প্রাপ্য তা পাইনি। রবীন আমাকে ঠকাচ্ছে। আমার ছেলে মেয়েরাও আমাকে ভালবাসার অভিনয় করে। আমার মনে হয়, পৃথিবীর অনেকের চেয়েই আমি বেশি পেয়েছি। সেই জন্য অনেকে আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। আমার সুখ কেউ কেড়ে নিতে চাইছে। তখন ইচ্ছে হয়, খুব ইচ্ছে হয়–

হঠাৎ থেকে গিয়ে তিনি জানলা দিয়ে চেয়ে রইলেন সমুদ্রের দিকে।

আমি বললাম, মাঝে মাঝে প্রত্যেক মানুষের মনেই এ-রকম নানা রকম প্রশ্ন আসে। অদ্ভুত ফিলিং হয়। অকারণে দারুণ নৈরাশ্য বুকে চেপে ধরে, আবার এ-সব কেটেও যায়। তাই না?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে প্রতিমা আপন মনে বললেন, ওই যে চন্দ্রা বলে মেয়েটি, ইচ্ছে করে সমুদ্রে ভেসে গেল, কতখানি অভিমান নিয়ে আত্মহত্যা করল, এক-এক সময় মনে হয়, ওর দীর্ঘশ্বাস, ওর অভিশাপ আমারও গায়ে লাগছে। আমার চামড়া ঝলসে দিচ্ছে। দেখুন, দেখুন, আমার চামড়ায় কী-রকম ফোস্কা পড়েছে, আজই!

আমি আর কোনও কথা খুঁজে পেলাম না।

প্রথম পরিচয়ের সময় এই দম্পতিটিকে আমার বেশ আদর্শ মনে হয়েছিল। এখন দেখছি, এরা দু’জনেই আমার অভিজ্ঞতার বাইরের মানুষ। প্রতিমা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। অনেক লেখাপড়া শিখেছেন অথচ উনি বিশ্বাস করেন, ওঁর চামড়ায় ফোস্কা পড়েছে কোনও অশরীরীর দীর্ঘশ্বাসে। এটা কি ওঁর পাগলামি, না উনি আগে থেকেই জানতেন যে, চন্দ্রার সঙ্গে ওঁর স্বামী বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল?

রবীনবাবুও যেন কিছু একটা অপরাধবোধে ভুগছেন। উনিও বাতাসে চন্দ্রার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনছেন। এটা পাগলামি নয়, স্রেফ সংস্কার। বাতাসে কারুর দীর্ঘশ্বাস একমাত্র কবিতার মধ্যেই ভেসে বেড়াতে পারে।

চন্দ্রার মৃত্যুর পরদিন সন্ধ্যায় নৌকোয় পা ঝুলিয়ে বসা একটি মেয়েকে আমি দেখেছিলাম। মেয়েটি এক সময় কুয়াশায় মিলিয়ে গেল। প্রথমে আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম, তা ঠিক। আমার বদলে যদি রবীনবাবু দেখতেন ওই দৃশ্য?

চন্দ্রার জায়গায় বিশাখা এসেছে, দু’জনের চেহারায় মিল আছে। কিন্তু সেদিন কি ওই নৌকোয় বিশাখা বসেছিল? দুপুরবেলা বৃষ্টির মধ্যে লাল ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল বিশাখা? এসব কথা বিশাখাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।

না, বিশাখা নয়, আমি জানি, সে কে!

.

১৩.

 রাত এখন ক’টা? আমার ঘুম ভেঙে গেল কেন? কে যেন আমাকে ডাকছে।

আমার যে জ্বর হয়েছিল, তা মনেই পড়ল না। শরীরে কোনও অস্বস্তি বেদনার অনুভূতি নেই। তবু আমি জেগে উঠলাম হঠাৎ। ঠিক আগের মুহূর্তেই কেউ যেন আমার নাম ধরে ডেকেছে, এখন কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

বিছানা ছেড়ে উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার সেই ডাক শোনার চেষ্টা করলাম। সব দিক চুপচাপ। তবু স্পষ্ট অনুভূতি হচ্ছে, কেউ ডেকেছে, কেউ আমাকে জাগাতে চেয়েছে। কিংবা আমি নিজেই নিজেকে ডেকেছি?

জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম। চাঁদ দেখা যাচ্ছে না, তবে অল্প জ্যোৎস্না আছে। বাতাসের গন্ধে মনে হয়, এখন মধ্যরাতের কম নয়। বেলাভূমি সম্পূর্ণ বিজন, আজও ঢেউয়ের মাথায় দেখা যাচ্ছে ফসফরাসের মালা।

জামাটা গলিয়ে নিয়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। বালির বাঁধটা দিয়ে স্লিপ খাবার মতো গড়িয়ে নামলাম নিচে। এবার ডান দিকে, না বাঁ-দিকে যাব?

ডান দিকে। কোনাকুনি জলের দিকে। আজ বাতাস খুব কম, তাই ঢেউয়ের শব্দ তেমন শোনা যাচ্ছে না। আলো জ্বলছে না রাস্তার ধারের একটা বাড়িতেও। অনেকেই দরজা-জানলা সব খোলা রেখে ঘুমোয়। চুরি-ডাকাতির ভয় গোপালপুরে প্রায় নেই বললেই চলে।

আকাশে মেঘ নেই, অনেক তারা। গত দুদিন এই সমুদ্রে একটা জাহাজও দেখা যায়নি। আজকের রাতটা ভারি সুন্দর। সুন্দরের একটা প্রগাঢ় আলিঙ্গন আমি অনুভব করছি সর্বাঙ্গে।

জলের ধার ঘেঁষে বসে আছে একটি রমণীমূর্তি। তার নীল শাড়ির রঙ মিশে গেছে রাত্রিতে। আঁচল উড়ছে। পিঠের ওপর খোলা চুল। আমার পায়ের কিংবা নিশ্বাসের শব্দ শুনেও সে মুখ ফেরাল না।

তাকে দেখে আমি একটুও চমকালাম না, কিংবা অবাক হলাম না। আমি জানতাম, সে এখানে থাকবে। সে-ই তো আমাকে ডেকেছে।

একটু দূরত্ব রেখে আমিও বসলাম ভিজে বালির ওপর। আর একটা সিগারেট ধরালাম। দেশলাইয়ের আগুন একটু যেন ছ্যাঁকা দিল রাত্রির গায়ে।

নারীটি একবার তাকাল আমার দিকে। জ্যোৎস্নায় ঝক ঝক করছে তার চোখ। আমি মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ, কেয়া?

আমি বললাম, তোমার হাসিটি ঠিক আগের মতোই আছে। আমি জানতাম, তুমি ঠিক ফিরে আসবে।

আপনি জানতেন? কী করে জানলেন?

আমি জানতাম। কারণ আমি যে খুব তীব্রভাবে চেয়েছি। আমি চেয়েছি, তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে এসো। আমার সেই চাওয়াটাই তোমাকে তৈরি করেছে। তুমি অলীক, তুমি মায়া, তবু তুমি এখন বাস্তব।

নারীমূর্তিটি আবার খুব ছেলেমানুষের মতো হাসতে লাগল।

আমিও হেসে বললাম, সেদিন তুমি নৌকোয় একা একা পা ঝুলিয়ে বসেছিলে, আমি তখন–

অবজ্ঞা করে চলে গেলে, তাই না? মানুষ কীরকম বোকা হয় দেখে নিজেই কল্পনা দিয়ে একটা মূর্তি গড়ে, আবার নিজেই সে তাকে চিনতে পারে না।

আপনি আমাকে তৈরি করেছেন? ভারি মজা তো।

মানুষের যখন কোনও প্রিয়জনের মৃত্যু হয়, মানুষ মনে মনে তার কথাই ভাবে, খুব গভীর ভাবে ভাবতে ভাবতে তাকে সশরীরে দেখতে পায় এক-এক সময়। কিন্তু তখন সেই প্রিয়জনকে দেখেই আবার মানুষ ভয় পায়। আমারও যে এই দুর্বলতা হয়েছে, তা আমি নিজেই এত দিন টের পাইনি।

আপনি বুঝি কেয়ার কথা খুব ভাবেন? খুব দুঃখ পেয়েছিলেন?

মাঝখানে অনেক দিন ভুলে ছিলাম, তা ঠিক। চন্দ্রাকে প্রথম দেখেও বুঝতে পারিনি, তার সঙ্গে কেয়ার এতখানি মিল। চেহারার মিল, হাঁটার ভঙ্গি, হাসি, অনেকটাই কেয়ার মতো। চন্দ্রা যখন জলের তলায় চলে গেল, তার পরেই এই মিলগুলো চোখে পড়ল। তারপর থেকে, আমি মনে মনে শুধু তোমার কথাই ভেবেছি, কেয়া। বৃষ্টির মধ্যে দুপুরবেলা লাল ছাতা মাথায় দিয়ে তুমিই তো যাচ্ছিলে, তাইনা? তখনও চন্দ্রার হঠাৎ ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তুমিও যে ফিরে আসতে পারো সেটা আমার মাথায় ঢোকেনি।

ওগো লেখকমশাই, আপনি যে বললেন, আমি অলীক, মায়া। আমার হাতটা ছুঁয়ে দেখেন তো। আমি রক্তমাংসের মানুষ।

নারীটি তার একটি হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, আমি একটু ঝুঁকে ছুঁলাম। সেই হাত জীবন্ত রক্তস্রোতে উষ্ণ।

তাতে একটুও বিচলিত না হয়ে আমি বললাম, শুধু অলীকে কি সাধ মেটে? আমি তো চেয়েছি, তুমি রক্তমাংসেও ফিরে আসবে।

মেয়েটি সুর করে বলে উঠল, এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে, অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে, জয়হীন চেষ্টার সঙ্গীত, আশাহীন কর্মের উদ্যম, হেরিতেছি শান্তিময় শূন্য পরিণাম…। আঃ, কী ভাল লাগে জলের ধারে একা বসে থাকতে।

তুমি কি কেয়া নও? তুমি চন্দ্রা?

এই যে বললেন, আপনি আমাকে তৈরি করেছেন? আপনি কাকে তৈরি করেছেন, তা নিজেই জানেন না?

চন্দ্রার কথা ভাবতে গিয়ে কেয়ার কথা মনে পড়ে গেল। চন্দ্রা ফিরে আসুক, তা-ও আমি চেয়েছি। নিশ্চয়ই চেয়েছি। চন্দ্রার মতো মেয়েই-বা কেন হারিয়ে যাবে? কেয়া, তোমার কী হয়েছিল? তুমি কি ইচ্ছে করে সুন্দরবনের নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলে?

ও-সব কথা এখন ছাড়ুন তো! সমুদ্রকে দেখুন। সমুদ্রকে আপনার জীবন্ত মনে হয় না?

জীবন্ত তো বটেই। কে বলেছে, সমুদ্র জীবন্ত নয়! আকাশও জীবন্ত।

আমি আকাশ নিয়ে অত মাথা ঘামাই না। সমুদ্রকে আমার কি মনে হয় জানেন? ঠিক যেন এক বিশাল পুরুষ। জলে যখন নামি, বড় বড় ঢেউয়ের ঝাপটা যখন গায়ে লাগে, ঠিক যেন মনে হয় এক দুর্দান্ত প্রেমিক, অমন স্পর্শ আর কোনও প্রেমিক দিতে পারে না। সেই জন্যই একবার স্নানে নামলে আমার আর ইচ্ছেই করে না জল ছেড়ে উঠতে।

তুমি মানুষের চেয়েও জলকে এত ভালবাসো?

এ-কথাতেও বিষাদের সুর নেই, নারীটি সব কথাই বলছে হাসতে হাসতে। আমি যে-হাতখানা ধরে আছি, সেইহাতে এখনও খেলা করছে প্রাণচাঞ্চল্য। কিছুক্ষণের জন্য আমি দিশাহারা হয়ে গেলাম।

সেই রমণীর পায়ে এসে লাগছে ঢেউ। শাড়ি ও শায়া একটুখানি তুলে সে দু’পায়ের পাতা দিয়ে চাপড় মারছে জলে। সাদা ফেনা যেন রুপোর মলের মতো অলঙ্কার হয়ে যাচ্ছে।

সে আপন মনে বললো, রাত্তিরবেলা, আর কোনও শব্দ নেই, দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে সমুদ্র, এই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, কে কীসে সার্থক হল কিংবা না হল, তাতে কিছুই আসে যায় না।

আমি বললাম, তাহলে জলের গভীরে ডুবে যাবারও কোনও মানে হয় না। এটা জীবন নিয়ে বড্ড বেশি বিলাসিতা। একটি মেয়ে সমুদ্রে একা একা নৌকোয় দাঁড় বাইতে বাইতে গান করছে আপন মনে, এটা দৃশ্য হিসেবে সুন্দর। কিন্তু তারপর একেবারে হারিয়ে যাওয়াটা অসুন্দর। ক্ষমার অযোগ্য। চলন্ত স্টিমার থেকে নদীতে ঝাঁপ দেওয়াটাও।

আমার কথা অগ্রাহ্য করে সে বলল, মানুষের আলিঙ্গনের মধ্যেও ভেজাল থাকে, কিন্তু একা একা জলের সঙ্গে খেলা করা, আঃ, কী আরাম!

হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, আমি এখন জলে নেমে স্নান করব।

চমকে উঠে বললাম, এত রাতে?

রাত্তিরেই তো ভাল। দিন আর রাত্তিরের মধ্যে মেয়েরা রাত্তিরটাই বেশি পছন্দ করে, জানেন না? আপনিও স্নান করবেন? আসুন না।

আমি? না।

কেন? ভয় পাচ্ছেন।

 ভয়ের কী আছে? আমি সাঁতার মোটামুটি ভালই জানি। কিন্তু সমুদ্র তো তোমার প্রেমিক, আমার কেউ না!

মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে সে বলল, আপনি রেগে যাচ্ছেন সমুদ্রের ওপর? নাকি হিংসে হচ্ছে। তাহলে আপনি ফিরে যান।

আমি আর অপেক্ষা করলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। আমি নিজে যাকে তৈরি করেছি, তারও মুখের কথাগুলো আমার বসানো নয়। কাল্পনিক মূর্তিরও একটা আলাদা সত্তা থাকে। সে ইচ্ছেমতো চলে। সে আমাকে আঘাত দিতেও পারে। সে বলল, আমি সমুদ্রকে ঈর্ষা করি।

বাড়ির কাছাকাছি চলে এসে আমার যেন ঘোর ভাঙল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

একটা খটকা লেগেছে। এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বললাম আমি? কেয়া, না চন্দ্রা? কিংবা, যে-উষ্ণ হাতখানি আমি ধরেছিলাম, সেই হাতখানি বিশাখার?

নাঃ, এখন আবার ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *