সকাল-সন্ধেতে এই এপ্রিলের গোডাতে এখানে এখনও ঠাণ্ডা। তবে এখন বেলা বেড়েছে। ঝকঝক কবছে রোদ। শীতের “শ”ও নেই।
জোবান্ডা বাংলোর হাতাতে সামনের দিকে খাদের পাশে একটি গোল ঘর করা আছে। চারদিক খোলা। মাথাতে ছাতার মতো ছাদ। নীচটা বেদীর মতো করে বাঁধানো। তার উপরে চেয়ার-টেবল পাতা।
এখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। ওরা ঐ ঘরটিতেই বসেছিল। চৌকিদারদের খবর দেওয়া হয়েছে। হারাধনের দশটি ছেলের আরও তিনটি আজ দুপুরে যাবে। মুরগীর ঝোল আর ভাত আজও হবে দুপুরে। রাতে খিচুড়ি। খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর আলু ভাজা।
হারিত বোতল-টোতলগুলোও বের করে আনল। জলের বোতলও। তারপর যে স্কচ এর বোতল থেকে চিকু গামহারকে পরশু রাতে দিয়েছিল এবং গত রাতেও, সেই বোতলটি এনে একটি পাতিয়ালা পেগ ঢালল নিজে।
চিকু বলল, আমি দিনের বেলাতে খাই না কিছু।
হারিত বলল, গামহারদা কি খাবেন?
না খেলেই হয়। খালি পেট। তাছাড়া বলেইছি তো আমার তেমন অভ্যেস নেই।
কিছু তো করার নেই। তাই…
হাবিত বলল।
আগে জানতাম, ‘নাই কাজ তো খই বাছ’। এখন দেখছি ‘কাজ নাই তো মদ খাই’। চিকু বলল, আমি রান্নাঘরে গিয়ে গামহারদা আর মেয়েদের জন্যে কিছু খাবার করে নিয়ে আসি। সকলেই ওমলেট খাবে তো?
ঝাঁঝি বলল, এতদিনে বুঝলাম চিকুদা, তোমাকে মেয়েরা এতো ভালবাসে কেন?
কেন?
আমি তো জানতাম রান্নাঘর মানেই মেয়েরা, তা তারা যত সফিস্টিকেটেড আর ওয়েলঅফফ্ই হোক না কেন? ঢেঁকিদের স্বর্গে গিয়েও ধান ভানতে হয়। তুমি সত্যিই ব্যতিক্রমী পুরুষ।
জারুল বলল, তোমরাই তো পুরুষদের মাথাটি খেয়েই ঝাঁঝি। আমি কী পারি না, যা চিকু পারে? আমিও গাড়ি চালিয়ে আসতে পারতাম চিকুকে পাশে বসিয়ে। আমি রান্না করতে জানতে পারি তো চিকু বা হারিই বা জানবে না কেন?
হারিতও খুব ভাল রান্না করতে পারে।
ঝাঁঝি বলল।
তাহলে হারিতদাও যাও। চিকুকে সাহায্য করে গিয়ে একটু।
তুই চুপ করতো।
চিকু বকে দিল জারুলকে।
তারপর ঝাঁঝি বলল, ও রাঁধে ভাল কিন্তু নিরুপায় হলেই রাঁধে কিংবা স্ট্যাগ-পার্টির পিকনিক-এ। ধারেকাছে মহিলারা থাকলে রান্নাঘরে ঢুকতে ওর পৌরুষে বাধে।
হারিত কথা না বলে পাতিয়ালা পেগ-এ একটি চুমুক দিয়েই সেটাকে ক্লাব-পেগে নামিয়ে আনল।
আপনি রান্না করতে পারেন, গামহারদা?
ঝাঁঝি জিজ্ঞেস করল গামহারকে।
গামহার লজ্জিত হয়ে বলল। পারি, মানে, ওমলেট আর চা করতে পারি। তাও ইলেকট্রিক স্টোভে। গ্যাস জ্বালতে পারি না আমি।
চিকু বলল, ওগো আমার নেকুপুষুমুনু দাদারে।
ঝাঁঝির গামহার-এর এই অকপট স্বীকারোক্তি খুব ভাল লাগল। আহা। তোমাকে রান্নাঘরে যেতেই হবে না। তুমি রান্নাঘরে যাবেই বা কেন? কোন দুঃখে।
মনে মনে বলল ও।
সিমলিপালে আসবার আগেই গামহার সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছিল, চিকু, জারুল আর কিছু হারিতেরও কাছে। সবই ভাল ভাল কথা। মানুষটি ভাল কী না বলতে পারবে না কিন্তু ভারী ছেলেমানুষ যে, তা বুঝেছে ঝাঁঝি। নিষ্পাপ। এমন ইনোসেন্ট পঞ্চাশোর্ব পুরুষ ও জীবনে দেখেনি। আজকালকার পনেরো বছরের ছেলেরাও গামহার-এর চেয়ে বেশি জানে। এক তাল কাদা হাতে পেলে সব মেয়েরই ইচ্ছে করে একটি সুন্টুনি-মুন্টুনি পুরুষ পুতুল বানাতে।
চিকু উঠে চলে যাওয়ার আগে, মুখ ঘুরিয়ে হারিতকে বলল, স্কচটা এনেছিলাম দাদার জন্যে। পুরো শেষ করে দিও না। তুমি তো রাম-এর পার্টি ভাই। গাল দেখলেই কি টিপতে ইচ্ছে করে।
ও সরি। সরি।
লজ্জিত হয়ে বলল হারিত।
ঝাঁঝিও উঠে পড়ল। বলল, যাই! চিকুদাকে একটু সাহায্য করি গিয়ে।
জারুল কিছু না বলে উঠে-যাওয়া ঝাঁঝির দিকে চেয়ে থাকল পেছন থেকে। হঠাৎই ওর মনে হলো ঝাঁঝির ফিগারটা যে এতো ভাল তা আগে খেয়াল করেনি। অন্য সব ব্যাপারেই চিকুর মতো ছেলে হয় না। কিন্তু এই একটা ব্যাপারেই তাকে বিশ্বাস করা যায় না। হনুমানে যেমন খেয়াল হলেই গাছের এ ডাল ছেড়ে অন্য ডালে ঝাপায় চিকুও তেমনি এক নারী ছেড়ে অন্য নারীতে। ওর জীবনে জারুল সম্ভবত চোদ্দ কী পনেরো নম্বর হবে। চিকুর যা বয়স, তা বিবেচনা করে বলা চলে যে, ওর সমবয়সী কোনো জেনুইন হনুমানও এতবার ডাল-বদল করেনি।
রান্নাঘরটাকে এখান থেকে দেখা যায়। তবে ভিতরটা অন্ধকার। তাছাড়া, চিকু তো জারুল-এর বিবাহিত স্বামী নয়! আইনের জোর, সমাজের জোর তো কিছু নেই। শুধুই ভালবাসার ভাললাগার জোর-এর বিনিসুতোর মালায় গাঁথা ওদের সম্পর্ক।
ভাবনাটা জারুলের মনে আসতেই, নিজেকে বকলো খুবই জারুল। জোর করে হয়ত কারোকে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই ধরে রাখাও যায় না, যদি ভালবাসা বা শ্রদ্ধা না থাকে একে অন্যের প্রতি। সে সম্পর্ক দাম্পত্যরই হোক কী উকিল-মক্কেলের। ও-ও তো ফ্যালনা নয়। পরনির্ভর নয়। ওকেও তো কম পুরুষ আজ অবধি শরীর-মনে প্রার্থনা করেনি। তবে তারও এই হীনম্মন্যতা কেন? ও তো সাধারণও নয়!
তারপরই ভাবল যে, এটা হীনম্মন্যতা নয়। এটা অধিকার হারানোর আশঙ্কা। ক্লিওপেট্রাও হয়তো সিজার-এর সম্বন্ধে এমন ভাবনাই ভাবতেন বা লায়লাও মজনু সম্পর্কে। একজন চিরন্তন নারী তো রয়েইছে তার মধ্যে, সে যতই আধুনিকা হোক না কেন! ‘লী’ বা ‘হফফ্ম্যান’-এর জিনস আর উইকএন্ডার বা প্যান্টালুন-এর পোশাক তার বহিরঙ্গর খোলনলচে পাল্টে দিয়ে থাকতে পারে, তার অন্তরঙ্গর নারীকে বদলাতে হয়ত আরও অনেক যুগের বাহারি ছেলেপনার প্রয়োজন হবে। অথবা, এমনও হতে পারে যে, ততদিনে নারীরা স্বমহিমাতে তাদের পুরনো মাতৃরূপে, জায়া-রূপে বা প্রেমিকা-রূপেই ফিরে আসবে তাদের শালীনতম পোশাক, শাড়ি পরে, যেমন ফিরে এসেছে অনন্ত আর বাজুবন্ধর মতো পুরনো গয়নার ফ্যাশান।
গামহার, সুন্দরী জারুল-এর দিকে চেয়ে ভাবছিল যে, টমবয় কাট-এ চুল কাটা, জিনস আব উইকএন্ডারের আটটি পকেটওয়ালা জামা পরা জারুলকে হয়তো একটিও পকেট না থাকা শাড়িতে, কোমরে চাবির গোছ ঝুলিয়ে, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ পরে, পায়ে আলতা দিয়ে, চোখে কাজল দিয়ে এর চেয়েও অনেক অনেকই বেশি সুন্দরী দেখাতো। হয়তো! হয়তো!
গামহার বলল, এই জোরান্ডা নামের ইতিবৃত্ত শুনলাম আসতে আসতে চিকুর কাছে। তোমরা কি জানো?
না তো! জোরান্ডা ইজ জোরান্ডা। বহুদিন থেকেই বহুজনার মুখেই শুনে আসছি। তার আবার ইতিবৃত্ত কি?
নবেন্দু বলল।
এই নবেন্দু ছেলেটাকে প্রথম দর্শনেই ভাল লাগেনি গামহার-এর। আজ সকালে চাহালাতে ওর প্রাণের বন্ধু হারিত ঝাঁঝির সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করল তা দেখেও ও হারিতকে কিছুই বলল না তা লক্ষ করে অবাক এবং দুঃখিত হয়েছিল গামহার। কে জানে! ও হয়ত ভুল। যেহেতু ওর মনে হয়েছে যে নবেন্দু ঝাঁঝিকে ভালবাসে এবং যেহেতু গামহার-এরও প্রথম দর্শন থেকেই ঝাঁঝিকে ভাল লাগতে শুরু করেছে সেই জন্যেই হয়ত ওর এত অপছন্দ হচ্ছে নবেন্দুকে। বেচারী নবেন্দু। কত কষ্ট করে প্রাণ বিপন্ন করে গাড়ি চালিয়ে ঝাঁঝিদের বিপদ শুনে দৌড়ে এসেছে এত দূরে নিজের কাজ নষ্ট করে।
একথা মনে হতেই মনে মনে খুব বকল গামহার নিজেকে। আসলে, গামহার কল্পনাতেও কারোকে কষ্ট দিতে চায় না। অন্যকে ভুল করে কষ্ট দিলে সে কই তার মনে দশগুণ হয়ে ফিরে আসে। তবে যেক্ষেত্রে ও কোনো মানুষকে খারাপ বলে জেনে নিশ্চিত হয়েছে সেই মানুষকে আঘাত দিতে ওর একটুও বাজে না। চাইনীজ দাশনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, “If you pay evil with good what do you pay good with?” অপর মানুষের খারাপত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে অবশ্য অনেকই সময় নেয় গামহার। পাছে ভুল করে, তাই।
গামহার বলল, জানেন নবেন্দুবাবু, পথে চিকু আমাকে আত্মদর্শন করালো।
আরে দাদা। সকলকেই যখন তুমি’ বলছেন তখন আমাকে আবার আপনি কেন? কী এমন অপরাধ করলাম আমি!
গামহার হেসে বলল, ঠিক আছে। তুমিই বলব।
তা আত্মদর্শনটা কীরকম?
গামহার ওদের বলল, বিস্তারিত।
হারিত বলল, অ্যাকসিডেন্ট হলো বলেই সব গোলমাল হয়ে গেল।
সব ভাল যার শেষ ভাল।
গামহার বলল।
বুঝলেন গামহারদা, আসলে কাল রাত অবধিও ঠিক বুঝতে পারিনি পরশু শেষ রাতে কী ঘটতে যাচ্ছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আজ ভোর থেকেই আমার হাত-পা ছেড়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছে। তখন থেকেই মেজাজটা বিগড়ে ছিল। ভয়টা আর শকটা এতো দেরি করে যে কখনও আসতে পারে, তা আমার জানাই ছিল না। কিছু মনে করবেন না গামহারদা, আপনার জন্যে আনা ভাল জিনিস আমি অভদ্রর মতো খেয়ে ফেললাম বলে।
তাতে কিছুই হয়নি। কিন্তু খালি পেটে কেন?
আর পেট! পেট তো এতক্ষণ লাশকাটা ঘরে ফর্দাফাঁই হয়ে যেত। পেটই থাকতো না, তার খালি আর ভর্তি। পুনর্জন্মটা সেলিব্রেট করব আজকে রাতে। দুপুরে মুরগীর ঝোল ভাত খেয়েই ঘুম লাগাব একটা। সেই জন্যেই জেনেশুনেই দিনমানেই মাতাল হচ্ছি।
তাই বল। আমি ভাবছিলাম, মাতাল হওয়ার জন্যে এত কষ্ট করে প্রাণ বিপন্ন করে এতদূরে আসা কেন? মাতাল তো কলকাতা শহরেই হওয়া যেত সহজেই, তোমার মহীন না কোন বন্ধুর বাড়িতে তাস খেলতে যেতে তুমি, সেখানেও।
হারিত বলল, এখনও তো ব্রেকফাস্টই হয়নি। তোড়জোড় সব শেষ হোক। দুপুরে খেতে খেতে তিনটে চারটে তো হবেই।
আমি ততক্ষণে বরং একটু ঘুরে ঘুরে দেখি জঙ্গল। জঙ্গলেই আমার নেশা একেবারে পুরো হয়ে গেছে। খাদ্য-পানীয় কিছুমাত্র না হলেও চলবে।
গামহার বলল।
একা যাবেন না দাদা। সেটা ঠিক হবে না। জঙ্গল সুন্দর যেমন, বিপজ্জনকও বটে। পিকু অথবা জারুল কারোকে সঙ্গে নিয়ে যান। হাতিতে তো যখন তখন ফুটবল খেলতেই পারে। তাছাড়া কখন ভাল্লুকে নাক খুবলে নেবে, কী শঙ্খচুড় সাপে দূর থেকে তেড়ে এসে মাথায় ছোবল মারবে বা বাঘ গালে থাপ্পড় কষাবে কে বলতে পারে। সেবা শুশ্রষা করার জন্যে। নিদেনপক্ষে একজন লোকও তো চাই!
নবেন্দু বলল।
বাঘই যদি গালে থাপ্পড় মারে, তো সেবা আর কারোকে করতে হবে না। ধড় থেকে মুন্ডুই আলাদা হয়ে যাবে। শুনেছি, শঙ্খচুড়ে ছোবল মারলে পাহাড়ের মতন হাতিও মরে যায়, আর মানুষ। আর ভালুকে যা করে, তা আমি নিজচোখেই একবার দেখেছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে তিলাইয়া ড্যামে বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে রজৌলির ঘাটের জঙ্গলে চডুভাতি করতে গিয়ে। সে দৃশ্য মনে করলে আমার অন্নপ্রাশনের ভাতই উঠে আসে।
তাহলে বাংলোর হাতাটাই একটু ভাল করে দেখি।
তা দেখুন। হারিত আর আমি একটু নিজেদের ভোলাই। আপনি আত্মদর্শন করে এলেন, আমরা আত্ম-বিস্মরণ করি।
নবেন্দু বলল।
গামহার উঠে গেলে হারিত বলল, চিকুর যত কাণ্ড। সঙ্গে এক বুড়ো ঢ্যামনা সাপ নিয়ে এসেছে। এই সব সাহিত্যিক-শিল্পী-গাইয়ে দেখলেই আজকাল রক্ত মাথায় চড়ে যায়। দুর্বুদ্ধিজীবী অ্যান্ড কোম্পানি।
তুই চিকুর ফোন পেয়ে কী ভেবেছিলি?
কী আর ভাবব। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল। পরশু রাতে রাশিদ খা’র গান শুনতে গেছিলাম জয়ন্তদার বাড়িতে।
ও।
মেঘমল্লার গাইল। তাড়াহুড়োতে গাইল বটে কারণ পণ্ডিত ভীমসেন যোশীজী অপেক্ষা করছিলেন তার পরে গাইবেন বলে। তবুও দুর্দান্ত গেয়েছিল। রাশিদের গলার কোনো তুলনা নেই। মেঘের মতো গলা। এমন গলাতেই মেঘমল্লার গাইতে হয়।
সামনে তো পুরো জীবন পড়েই আছে।
রাশিদ খাঁর গান শুনেই চলে এলি? যোশীজীকে শুনলি না?
আরে শুনলাম বইকি। তাই তো অত দেরি হলো। রাত দেড়টাতে বাড়ি ফিরেছি জয়ন্তদার বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া সেরে। বাড়ি ফিরে চান করলাম গরম জলে। নইলে ঘুম আসে না। তারপর শুতে শুতে প্রায় আড়াইটা। আর ঠিক ছটার সময়ে চিকুর ফোন। ভাল করে মুখ দেওয়ারও সময় পাইনি।
একটু চুপ করে থেকে বলল, বেচারা হরভজন! কাল ছুটি চেয়ে রেখেছিল অনেকদিন আগে থেকেই। ওর চাচেরা ভাইয়ের বাড়ি যাবে কী অনুষ্ঠানে নৈহাটিতে। সে তো সেজন্যে সাতসকালে উঠে চানটান করে তার কোয়ার্টারে ‘প্রীত ভইল মধু বনোঁয়া রামা, তোরা মোরা’ গাইতে গাইতে জামাকাপড় পরে ট্রেন ধরতে বেরোচ্ছিল। আমি গিয়ে প্রায় অ্যারেস্ট করে গাড়িতে ওঠালাম। বেচারা দুঃখে মরে যায় আর কী! কী করে ওকে মানাই? আমি তোদের দু’জনকেই মেরে দিলাম।
মেরে দিলি মানে?
মানে, মেরে দিলাম। হরভজনের দুঃখ লঘু করার জন্যে বললাম তোরা দুজনেই খতম হয়ে গেছিস মুখোমুখি ট্রাকের সঙ্গে ভিড়িয়ে।
হারিত বলল, সত্যি! কী করে বাঁচলাম বলতো? এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
আচ্ছা কাল এসব প্রসঙ্গ ওঠালি না কেন?
সত্যি কথা বলতে কি, সাহস পাইনি।
তাই?
সত্যি বলছি।
আর ঝাঁঝি। তোর গার্লফ্রেন্ড। কী মেয়ে মাইরি।
হারিত বলল।
কী মেয়ে? কেন? সী ইজ আ ভেরি ব্রেভ গার্ল। অন্য কেউ হলে তো এখনও হাপু্স নয়নে কেঁদেই যেত কী হতে পারত তা ভেবে। শী নেভার লুকস ব্যাক ইন লাইফ।
পাথরে তৈরি না প্লাটিনামে, কিছুই বুঝতে পারলাম না আজও।
ওড়িশাতে ঢুকে ভাল রাতে পড়ামাত্রই ঝাঁঝি বলেছিল, অ্যাকসিডেন্ট কিন্তু ভাল রাস্তাতেই হয়। ঘুমিয়ে পড়ো না।
আমি বলেছিলাম, তুমি গল্প করো। অথবা ঘুমোও। তোমার যা খুশি। ড্রাইভিং এর ব্যাপারে কারো কাছ থেকে কোনো জ্ঞান শুনতে আমার ভাল লাগে না।
ঝাঁঝি বলল, পাঁচ বছর বিয়ে হয়ে গেছে। ঝগড়া ছাড়া কথা নেই। দুটো কথার পরই তো ঝগড়া লেগে যাবে। চুপ করে থাকাই ভাল। আর গল্পই যদি করতে বলল, তো তোমার মায়ের নিন্দা করতে পারি।
আমি বললাম, চুপ করো।
যাকগে। আমি তবে ঘুমোলাম। ঘুম পেলে বোলো কিন্তু। ঘুম ঘুম পেলেও গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিও পথের পাশে।
বললাম, জ্ঞান দিও না। তুমি কি ড্রাইভিং জানো?
শিখিয়েছ কি, যে জানব। তোমার বাবা তো অনেক ঝেড়ে-বেছে পড়তি ঘর থেকে মেয়ে এনেছিলেন যাতে শত অত্যাচারেও মুখ বুজে থাকি। আমার বাবার তো গাড়ি ছিল না যে, শিখে আসব। তুমিও যা কেপ্পন। কতদিন বললাম যে, আমাকে একটা লাল ছোট মারুতি কিনে দাও। তা নয়। সব চাড্ডাকানটেন্টই কি তোমারই মতো কেন?
তারপর অ্যাকসিডেন্টটা কী করে হল তাই বল। তোদের বস্তাপচা পুরনো ঝগড়ার কথা শুনতে চাই না।
কী করে হলো, কখন হলো কিছুই বুঝলাম না’রে ব্রাদার। একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। তারপরই দেখলাম। গাড়িটার মুখটা ডানদিকে রাইট অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেছে আর পেছনটা ঠেকে রয়েছে একটা ইয়া-মোটা গাছে। তখন তো অন্ধকার। রাস্তার একপাশে যে জঙ্গলময় পাহাড়, অন্য পাশে ঝাঁটি জঙ্গলে ভরা মাঠ তাও জানি না।
ঝাঁঝি নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে গেছিল ভয়ে।
নবেন্দু জিজ্ঞেস করল।
অজ্ঞান? তাহলে আর বলছি কি? সে ফাস্ট সেন্টেন্স বলল, গেল আমার কাঁচের চুড়ি কটা।
আমি বললাম, আমার নতুন গাড়িটা! টোটাল লস। পাঁচ লাখ দিয়ে কেনা।
ও বলল, তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে গাড়িটা থেকে গিয়ে বউটা গেলেই ভাল হতো।
.
১০.
গামহার অবাক হয়ে জোবান্ডা বাংলোব বাঁদিকের গিরিখাদের পাশের বাঁশের বেড়ার সামনে দাঁড়িয়েছিল। কালোরও যে কত ছায়া হয় তা এই গিরিখাতের চারদিকের পাথরের দিকে চেয়ে একজন আর্টিস্টের চোখ দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করছিল। আড়াই তিন হাজার ফিট সোজা খাড়া নেমে গেছে খাদ,নীচে, সবদিকেই। তার চারদিকই এমন খাড়া যে, মানুষ তো দূরস্থান, পাখিরও পা বাখার জায়গা নেই। অশান্ত ঝরঝরানি শোনা যাচ্ছে জোরান্ডা ফলস এর। বহু নীচে গিয়ে পড়ছে সে জল। তবে প্রপাতের উৎসটি বাংলোর দিক থেকে ভাল দেখা যায় না। নীচে দহ মতো সৃষ্টি হয়ে রুপোলি ফিতের মতো একে-বেঁকে নদী হয়ে বয়ে গেছে গভীর অরণ্যের বুকে বুকে। একলা পাহাড়ী বাজ উড়ছে গিরিখাদের উপরে। তার ডানায় সাদা-কালো ডোরা। অন্যদিকে উড়ছে একদল শকুন। তারাও চক্রাকারে। অনেক উপরে। তাদের কাক বলে মনে হচ্ছে। নীচেব বনাবৃত গহ্বরের একই জায়গার উপরে তারা উড়ছে, গিরিখাদের গভীর তলের সামান্য উপরে।
এমন সময়ে একজন লোক এসে বলল, বাবু জলখিয়া খাইবাবু আসন্তু। সে বাবুমানে ডাকিস্তি।
চলো।
বলল, গামহার।
লোকটি নিশ্চয়ই চৌকিদারদের মধ্যেই একজন হবে। সম্ভবত জুনিয়র চৌকিদার। তাকেই জিজ্ঞেস করল গামহার, শকুনগুলো ওরকম করে উড়ছে কেন ওখানে?
গুট্টে হাতি মরিলানি।
কী করে মরল?
চোরা শিকারীরা মারল দাঁতের জন্যে।
তারা ধরা পড়েছে?
তারা কি ধরা পড়ে! এসব কথা ছোট মুখে মানায় না বাবু। আমার প্রাণও চলে যেতে পারে। এই খাদেই যদি আমাকে আপনি ঠেলে ফেলে দেন তাহলেই তো হলো। বন্দুকের গুলিও খরচ করতে হবে না। পরদিন শকুন উড়ছে দেখে কেউ ভাববে, কোনো জানোয়ার মেরেছে বুঝি নীচে বাঘ কি চিতাতে। এই বনপাহাড় বড় সাংঘাতিক জায়গা বাবু।
সাংঘাতিক বলছ কেন? এমন সুন্দর জায়গাকে।
সুন্দর মাত্রই তো বিপজ্জনক বাবু। তাছাড়া এখানে দেবদেবীর বাস। ভূতপ্রেতও কম থাকে না। রাত নামার আগে আগেই আমরা দুয়ার দিয়ে শুয়ে পড়ি। আপনারা দু’একদিনের জন্যে সখ করে বেড়াতে আসেন, আপনাদের ভাল লাগতেই পারে। কিন্তু যারা বারো মাস থাকে তারা সৌন্দর্যের কিছু দেখে না।
গামহার ভাবল, যাদের চোখ নেই, তারা দু’দিন থাকলেও দেখে না সারাজীবন থাকলেও না।
তা রান্নাবান্নার কি হবে আমাদের? তোমরা যদি অতো তাড়াতাড়ি চলে যাও!
পার্টি যতক্ষণ না খাবেন ততক্ষণ তো থাকতে হয়ই। দিনবেল্বে কিছি ভয় নান্তি কিন্তু রাতিবেল্ব্ব যেমিতি আপম্বমানে খাইবা-পীবা সারিবে, আম্মোমানে চঞ্চল পলাইবি।
তাই?
হঁ আইজ্ঞাঁ।
গামহার গিয়ে পৌঁছতেই চিকু বলল, কোথায় হারিয়ে গেছিলে? ছিনছিনারি দেখতে!
না না বাইরে যাইনি। হারিত আগেই সাবধান করে দিয়েছিল যে বাংলোর হাতার বাইরে পা ফেললেই নানা বিপদ। তোমার অথবা জারুলের সঙ্গে ছাড়া যেন না যাই এক পা-ও।
তাই? হারিতও তোমারই মতো প্রথমবার এলো সিমলিপালে। আর জঙ্গলের কথা ও জানেই বা কি? ড্যালহাউসি স্কোয়ার-থুরি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বি-বা-দী বাগের জঙ্গল ছাড়া!
আরে আজকাল কোনো ব্যাপারেই যে কেউ কিছু সত্যি জানে, সে নিজের সম্মানজ্ঞান আর অভিমান নিয়ে নিজের ঘরে বসে থাকে যারা কিছু জানে না তারাই দলে নাম লিখিয়ে নিজেদের ঢাক নিজেরা বাজায়। অজ্ঞরাই আজকাল সর্বজ্ঞ। আর সর্বজ্ঞরাই অজ্ঞ। এ হলো ঘোর কলি। বুঝলে কি না!
তা যা বলেছ।
নবেন্দু বলল।
চিকু বলল, একটু খেয়ে নাও। তারপর চলো, তোমাকে নিয়ে জঙ্গলে বেরোব জারুল আর আমি।
ঝাঁঝি বলল, আমাকে নেবে না জারুল?
ঊ্য আর ওয়েলকাম।
তোমরা কি কেউ যাবে?
নবেন্দু বলল, জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলেই কি আর জঙ্গল বেশি ভাল করে দেখা যাবে? এইখানে বসেই তো চমৎকার দেখা যাচ্ছে ‘প্যানোরোমিক ভিউ’। “আই অ্যাম দ্যা মনার্ক অফ অল আই সার্ভে।”
ওরা সকলে হেসে উঠল নবেন্দুর কথায়।
চিকু বলল, সরি গামহারদা। কিম্ভূত ব্রেকফাস্ট। ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কিট আর ডিমের ভুজিয়া।
আর চমৎকার লপচু চা-এর কথা বললে না!
ওই হলো।
শাড়ি পরে কি যেতে পারব জঙ্গলে? ঝাঁঝি বলল।
পারা তো উচিত। ভারতের নিবিড়তম জঙ্গলের আদিবাসীরা কেউই তো জিনস পরে বলে জানি না। এই সবই তোমাদের বাহানা। ধুতি-শাড়ি পরে নাকি অফিস করা যায় না। আগে রণপা চড়ে যে সব বাঙালি ডাকাতি করতো তারাও তো মালকোচা মারা ধুতিই পরতো, না কি? ভোম্বল সর্দার বা রঘু ডাকাতেরা গলফ-শু বা জিনস পরতো বলেও তো শুনিনি।
চলো, ডানদিকে যাই।
চলো।
কয়েকশ মিটার যাবার পরই লাল মাটির এবড়ো-খেবড়ো পথের উপরে একটি শুকনো খড় পড়ে আছে দেখা গেল। ঝাঁঝি আর গামহার আগে আগে যাচ্ছিল। পেছনে চিকু। চিকু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়াও।
ঝাঁঝি একটু আহত হলো। বন-জঙ্গল, চিকুর চেয়ে ও নিশ্চয়ই অনেকই কম জানে। কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়তে বলার পেছনে একটা আদেশের সুর ছিলো। তবু দাঁড়িয়ে পড়ে পেছনে তাকাল ওরা দুজনেই।
চিকু বলল, দাঁড়াও। সাপটা চলে যাক।
কোথায় সাপ? তোমাদের সামনেই। পথের উপরে।
সেকি! ওটা তো একটা খড়।
খড় আসবে কোথা থেকে? আশেপাশে কি খড়ের গাদা আছে? চারদিকে কাটা ক্ষেতে হেমন্তর ধান উঠে গেছে কি এই পাহাড়ে জঙ্গলে? পিছিয়ে এসো। ওটা দেখেই তোমাদের বোঝা উচিত ছিল যে ওটা খড়ের মতো দেখতে হলেও আসলে খড় নয়।
বলেই, চিকু পথপাশের একটা গাছ থেকে লাঠির মতো একটি শুকনো ডাল ভেঙে নিয়ে হাতে রাখল। তারপর একটা মুড়ি তুলে নিয়ে ঐ বস্তুটির কাছাকাছি ছুঁড়ে মারল। তাকে আহত করার জন্যে নয়, ভয় দেখাবারই জন্যে। মুহূর্তের মধ্যে খড়টি মোটা হয়ে গেল, প্রায় পুরুষের পায়ের বুড়ো আঙুলের সমান। এবং হাত দেড়েক দাঁড়িয়ে উঠল লেজ-এ ভর করে। তারপরই তার ফণা ছড়ালো। ফণাটি কম করে চিকুর হাতের পাতার সমান।
চিকু মরা গাছের ডালটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সাপটা এঁকেবেঁকে পথ পেরিয়ে ডানদিকে গিয়ে দুটি পাথরের মাঝখান দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল।
জারুল বলল, কী সাপ এটা? লাউডগার চেয়েও তো সরু মনে হয়, ফণা না-তোলা অবস্থাতে।
হ্যাঁ। দেখে রাখা ভাল করে। এর নাম কান্বখুন্টা।
কান্বখুন্টা মানে কি?
গামহার বলল, ঠিক জানি না। তবে মনে হয় কানখুসকি হবে। কান খোঁচাবার জিনিস।
এই সাপের মতো বিষধর সাপ ওড়িশার বনে-পাহাড়ে খুব কমই আছে। কামড়ালে, সঙ্গে সঙ্গেই পটল তুলতে হবে।
বলেই বলল, চলো, এগোই আমরা।
কী করে বোঝা যায় কোন সাপ বিষধর আর কোন সাপ নয়?
যে সাপেরা এঁকেবেঁকে চলে তারাই সচরাচর বিষাক্ত হয়। তবে এসব আমার চেয়ে জারুল ভাল জানে।
ওতো প্রাণীতত্ত্বরই ছাত্রী ছিল। ডক্টরেটও করেছে।
পথটি যেখানে ডানদিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে একটি মস্তবড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। তার কাণ্ডে অনেকগুলো ভাগ। যে-কোনোটার আড়ালেই কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা বসে স্বচ্ছন্দে প্রেম করতে পারে। করলে, সামনের দিক ছাড়া অন্য কোন দিক দিয়েই দেখা যাবে না তাদের। গাছটার ডালগুলো আশ্চর্য সমান্তরাল। দুপাশে দু’হাত সটান ছড়িয়ে দিয়েছে সে। হাত শুধু মাত্র দুটি নয়। কিছু দূর বাদে বাদে বিভিন্ন উচ্চতাতে দুদিকে দুটি করে ডাল সমান্তরালে ছড়িয়ে দিয়েছে সে। সেই ডালগুলি থেকে উপডাল যে বেরোয়নি তা নয়, তবে তারা খুব একটা বড় নয়। এখন গাছটি প্রায় পত্রশূন্য। সিঁদুরে লাল ফুলে ভরে আছে পত্রশূন্য ডালগুলি আর পথের উপরে এত সিঁদুরে-লাল ফুল পড়ে আছে যে মনে হয় গালিচা বিছানো আছে।
চিকু বলল, দ্যাখো গামহারদা। এই গাছেরই নাম হচ্ছে শিমুল। এ গাছ কলকাতাতেও অনেক আছে, এবং বসন্তে তাদের ডালে ডালে ফুল এমন করেই ফোটে, নীচেও ঝরে পড়ে, কিন্তু কলকাতার মানুষদের ফুল দেখার মন কই?
কলকাতাতে আছে না কি এই গাছ? সত্যি?
অনেকই আছে। এবারে দেখো। জানোতো, এই শিমুলের ফুল কোটরা হরিণেরা, মানে বার্কিং-ডিয়ারেরা খেতে খুব ভালবাসে। বেলা পড়লে সন্ধের আগে আগে এসে তারা খুব রেলিশ করে এই ফুল খায়।
এই Relish করা শব্দটির মানে জানো চিকু?
গামহার বলল।
কে না জানে! ক্লাস ফোর-এর ছেলেরাও জানে।
তোমাদের সময়ের ক্লাস ফোরের ছেলেরা হয়ত জানতো। এখনকার বাংলা-মিডিয়াম স্কুলের ছেলেরা জানে না সম্ভবত। আমাদের বাংলা মিডিয়াম স্কুলের মাস্টারমশাইই মানেটা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে মেয়েদের পেছনে শিস দিতে দিতে যেতে যেমন লাগে, তাকেই বলে রেলিশ করা।
চিকু আর ঝাঁঝি হেসে উঠল।
গামহার বলল, আচ্ছা চিকু, ব্রতীন বলছিল যে, তোমার নামও নাকি একটি গাছের নামে। চিকরাসি। সে গাছ তো এখনও দেখালে না।
চিকু হাসলো। বলল, সে গাছ দেখতে হলে আমার সঙ্গে একবার সময় করে পশ্চিমবঙ্গের বক্সার জঙ্গলে যেতে হবে।
তারপরে বলল, তোমরা কেউ জিম করবেট-এর লেখা পড়েছ?
আমি পড়েছি।
ঝাঁঝি বলল।
My India পড়েছ?
পড়েছি।
বেশ করেছ। তাঁর মতো বড় ভারত-প্রেমিক আজকের দেশ-নেতাদের মধ্যেও খুব কমই আছেন। তার ওই বইয়ে উত্তরপ্রদেশের ভাব্বার অঞ্চলের কথা তুমি নিশ্চয়ই পড়েছ।
পড়েছি বইকী।
বক্সার জঙ্গলও হচ্ছে ভাব্বার। পূর্ব-হিমালয়ের পাদদেশের। এইসব ভাব্বার অঞ্চলের নানা বিশেষত্ব আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে এই যে, সেই অঞ্চলের নদীগুলি ভূটান পাহাড় থেকে সমতলে নেমে কিছুদূর যাওয়ার পরেই অন্তঃসলিলা হয়ে গেছে। উপরে ধুধু বালি। অনেকই নীচে জল। বেশ কিছুদূর যাবার পরে আবার তাদের জলরাশি দৃশ্যমান হয়। যেখানে নদীগুলি উষর, সেখানের গাছেদের তাদের শিকড়গুলিকে বহুদূর অবধি নীচে নামিয়ে দিতে হয়। তাদের শিকড়গুলিকে বলে, Tap Roots. সুন্দরবনে আবার অন্য ব্যাপার। মানে, উল্টো ব্যাপার। চব্বিশ ঘণ্টায় চারবার জোয়ার ভাটার খেলা চলে সেখানে। তাই গাছেদের শিকড়েরা গাছের চারপাশে ঝোঁপের মতো হয়ে থাকে মাটিরই উপরে। ভাটির সময় যাতে যথেষ্ট হাওয়া ও রোদ পায়। সেই শিকড়দের বলে, Aerial Roots.
গামহার বলল, জানতে চাইলাম চিকরাসি গাছের কথা আর তুমি তো সাতকাণ্ড রামায়ণ শোনালে। আমরা কি বটানির ছাত্র?
ছিলে না। কিন্তু হতে ক্ষতি কি গামহারদা? শেখার কি কোনো সময়-অসময় আছে? যদি শেখার ইচ্ছেটা থাকে, তবে চিতায় ওঠার আগের মুহূর্ত অবধিও শিখে যেতে পারো। আমি তো তাই মনে করি। আর সত্যি বলতে কী, এইসব বিষয়ে যতই জানছি, যতই গভীরে যাচ্ছি, ততই দেখছি যে, কিছুই জানি না।
তারপর বলল, চিকরাসি গাছ তো ও অঞ্চলে হয় না। যে অঞ্চলের কথা বললাম সেই অঞ্চলেই হয়। তাই তোমাকে দেখাতে পারব না এখানে।
তোমার নাম দিল কে? অমন গাছের নামে?
আমার বড়মামা। তিনি আলিপুরদুয়ারের মস্ত ঠিকাদার ছিলেন। কাঠের ঠিকাদার।
মানে, বলতে কি পারি জঙ্গল-ধ্বংসকারী?
গামহার বলল।
না গামহারদা।
দৃঢ়তার সঙ্গে বলল চিকু।
তারপর বলল, ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত দেশে আইন-কানুন তবু কিছু ছিল। তখনও আমরা এমন একশ ভাগ স্বাধীন হয়ে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়ুল মারিনি। তখন জঙ্গলও যথেষ্ট ছিল এবং বনবিভাগও যথেষ্ট সজাগ ছিল। দেশে গিনিপিগের মতো মানুষ বাড়েনি। তখন গাছকর্তন আর বনসৃজনের মধ্যে এক সুষম সামঞ্জস্য ছিল। দেশের জনসংখ্যা যদি সীমিত রাখতে পারতাম আমরা, এত খিদে না থাকতো, এত অশিক্ষা, তবে আজ দেশের চেহারাই অন্যরকম হতে পারতো।
গুলি মারো দেশকে। জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে এসেছে, এখন জঙ্গল চেনাও। দেশের কথা নেতারা ভাবুন গে।
নেতারা তো আমাদেরই মধ্যে থেকে আসে গামহারদা! আমরা যদি সারমেয় হই তো আমাদের নেতা বড় বাঘ হবে কোত্থেকে? দেশকে গুলি মারলে আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পরে এই সিমলিপালের মতো বনেও কোনো গাছ আর থাকবে না গামহারদা। বন না থাকলে, আমরাও আর থাকবো না। তোমার আমার ঝাঁঝির মতো প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষেরই এ কথা হৃদয়ঙ্গম করার সময় এসেছে এবং যারা অশিক্ষিত তাদের প্রত্যেককে জএকথা ভাল করে বোঝাবারও সময় হয়েছে। দেশকে “গুলি মারার” চিন্তা কোনো প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের মনে আসা কিন্তু উচিত নয়।
সরি চিকু। আমার অন্যায় হয়েছে। তোমার আর জারুলের মতো প্রকৃতি-পাগল মানুষের আরও অনেকই প্রয়োজন এই মুহূর্তে।
প্রয়োজনটা বনের কারণে নয়, আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখারই কারণে গামহারদা।
গামহার ঠিক করলো আর কথা বলবে না। শুধু দেখবে দু’চোখ ভরে। এই আশ্চর্য সুন্দর বাসন্তী প্রকৃতির সব রং, রূপ, গন্ধ সে তার শিল্পীর চোখ দিয়ে নিংড়ে নেবে। আরও কিছুদুর গিয়ে পথটা যেখানে চড়াই-এর শেষে বেশ উঁচুতে পৌঁছেছে, সেখানে একটা বড় পাথরে ঝাঁঝিকে সামনে বসিয়ে ভাল করে দেখবে। পটভূমিতে থাকবে সেই আশ্চর্য কালো, আদিম অনন্ত গহ্বর। তার বুকের মধ্যে দিয়ে উৎসারিত-হওয়া জোরান্ডা ফলস, দূরের পাহাড়শ্রেণীর পর পাহাড়শ্রেণীর ছবি। সবুজের কত বিভিন্ন ছায়াতে আঁকা। আর সেই পটভূমিতে লাল, হলুদ, বেগুনি ও আরও কত মিশ্ররঙের বাহার। একলা বসে হেরো তোমার ছবি, এঁকেছি আজ বসন্তি রঙ দিয়া, খোঁপার ফুলে একটা মধুলোভী মৌমাছি ওই গুঞ্জরে বন্দিয়া।
নাঃ ছবিটা আঁকা শুরুই করা গেলো না।
গামহার বলল, মনে মনে।… বাগড়ার পর বাগড়া।
দেখতে দেখতে সেই উঁচু জায়গাটাতে পৌঁছে গেল ওরা আধঘণ্টার মধ্যে।
চিকু বলল, বসা যাক এখানে। কী বল গামহারদা? ঝাঁঝিরা বড় ধকল দিল এবারে আমাদের। কী বলো ঝাঁঝি? কলকাতা ফিরে একদিন ভাল করে খাদ্য-পানীয় হবে তো তোমাদের পুনর্জন্ম সেলিব্রেট করবার জন্যে?
আমি তো রোজগার করি না চিকুদা। তোমার ‘চাড্ডাকান্টেন্ট’ খাওয়াবে কিনা বলতে পারছি না। সে মহাকেপ্পন আছে।
তাই?
চিকু অপ্রতিভ হলো। কিন্তু ঝাঁঝি কথাটা বলল, Statement of Fact-এর মতো। একটুও অপ্রতিভ না হয়েই।
গামহার বলল, তাতে কী হলো। আমার বাড়িতে হবে পার্টি। নবেন্দুকেও ডাকব। সস্ত্রীক।
শুনলেন না আপনি? নবেন্দুর স্ত্রীর পেট তো কখনওই খালি থাকে না। সে সবসময়েই ফীজিকালি আনফিট, মেনটালি কীইড-আপ। আপনাদের ‘চাড্ডাকান্টেন্ট’-এর অধিকাংশ বন্ধুই ওরকম।
কিন্তু নবেন্দু তো মনে হলো….
গামহার বলল।
কী মনে হলো?
তোমার প্রতি যথেষ্টই দুর্বল।
তাই মনে হলো বুঝি? আমার তো মনে হচ্ছে আপনিও আমার প্রতি বিশেষ দুর্বল। এত দৌর্বল্য সামলানো কি আমার একার পক্ষে সম্ভব হবে? কলকাতাতে ফিরে দুর্বলদের সেবা-শুশ্রূষার জন্যে একটি নার্সিংহোম খুলতে হবে দেখছি।
চিকু ফিচিক করে হেসে গামহার-এর দিকে চেয়ে বলল, কেমন বুঝছ গামহারদা? ঝাঁঝিকে? এমন স্যাম্পল কি আগে পেয়েছ কখনও?
গামহার বলল, গলাটা একটু খাঁকরে নিয়ে, দ্যাখো চিকু, একজন আর্টিস্টের জীবনে কিছুই ফেলা যায় না। না। কোনো অভিজ্ঞতাই নয়। চুমু কিংবা লাথি সবই লেখকের বা শিল্পীর কোনো-না-কোনো কাজে লেগে যায়ই। আমি ঝাঁঝির কথাতে মনে করিনি কিছুই।
ঝাঁঝি মুখে কিছু না বলে স্থির চোখে গামহার-এর মুখের দিকে চেয়ে থাকল।
চিকু কথা ঘুরিয়ে বলল, গামহারদা তোমার মুখে রোদ পড়ছে। একটু পিছিয়ে বসো।
বলেই, কাঁধ থেকে রাক-স্যাকটা নামাল পাথরের উপরে।
এটা কি গাছ চিকু? যেটার নীচে আমরা বসে আছি?
এটা তিন্তিরি বৃক্ষ।
মানে?
ঝাঁঝি বলল, তেঁতুল। তিন্তির সংস্কৃত শব্দ। তাও জানেন না?
কী সুন্দর ছায়া দেখছ না? চিকু বলল।
তারপর বলল, নাও, বিয়ার খাও।
বিয়ার বয়ে এনেছো নিজে কাঁধে করে?
তা কী করি। পরের কাঁধ এখানে পাই কোথায়? এতো বড় নামী আর্টিস্টকে সঙ্গে করে এনেছি, খাতির তো একটু করতে হয়ই! ফিরে গিয়ে, এই জোরান্ডার একটি ছবি আমাকে এঁকে দিও তো গামহারদা।
দেব। কিন্তু স্যুরিয়ালিস্ট ছবি।
তুমি যা আঁকবে তাই নেব।
ঝাঁঝি, তুমি খাবে তো?
শ্যান্ডি করে খেলে ভাল হতো। চিকুদা, তোমার মতো আর গামহারদার মতো কম্পানির জন্যেই খাব। আমি এমনিতেও খাইনা। কিন্তু…
কোনো কিন্তু-টিন্তু নয়। এই গরম, শরীরকে খুবই ডি-হাইড্রেট করে। সন্ধে নামলেই দেখবে আবার কেমন শীত লাগবে।
জীবনে কখনও বোতল থেকে বিয়ার খাইনি। খারাপ মেয়েরা কি এমন করেই খায়?
হেসে ফেলল চিকু।
জানো, তুমি যদি আমার আগে মরো, তাহলে তোমার কঙ্কালটি আমি যাদুঘরে তিমিমাছের কঙ্কালের পাশে ঝুলিয়ে রাখব। তুমি সত্যি বিধাতার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। নাও। খুলে দিলাম তোমারটাও।
বলেই, বটল ওপেনার দিয়ে বিয়ারের বোতলটা খুলে দিল। গামহারকেও দিল। নিজেও নিল একটা। তারপর বলল, জঙ্গলে আর গ্লাস-টাস কোথায় পাওয়া যায়! হুইস্কির বোতল থেকেও খেয়ে অভ্যস্ত আমরা। এখানে কাট-গ্লাস এর গেলাস দেখবে কে বলো! ওসবের অধিকাংশই তো প্রয়োজনের জন্যে নয়, দেখাবারই জন্যে। আদিবাসীরা তো মহুয়া বা ঘড়িয়া খায় শালপাতার দোনাতে করে। তাতে কি তাদের নেশা কিছু কম হয় গামহারদা? বাহ্য আড়ম্বর ছাড়ার শিক্ষা তাদের কাছ থেকে দেখে যতখানি পেয়েছি ততখানি আর কোনো কিছু থেকেই পাইনি। বিয়ারে চুমুক দাও। হাওয়া চলতে শুরু করেছে বনে বনে এখন। সেই হাওয়ার সওয়ার হয়ে শুকনো পাতারই মতো পেরিয়ে যাও পাহাড়ের পর পাহাড়, সংস্কারের পর সংস্কার, দেখবে তোমার আবারও মায়ের গর্ভে ফিরে গিয়ে নতুন করে জন্মাতে ইচ্ছে করবে। তুমি যে এই দেশে জন্মেছে, এই দেশে বড় হয়েছ, সে জন্যে তোমার গর্ব হবে।
তারপর বলল, গর্ব যেমন হবে, দুঃখও হবে। এমন সুন্দর একটা দেশের অযোগ্য সন্তান আমরা, এ কথা বুঝতে পেরে।
ওরা সকলে চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। আর চুপ করতেই এই শেষ বসন্তের সকালের বন বাঙ্ময় হলো। কত ফিসফিস, কত কিস-কিস, কত ঝিরঝির, ঝর-ঝর। তারই মধ্যে উপত্যকা থেকে পাগলের মতো পিউ-কাঁহা ডাকতে লাগল, ক্রো-ফেজেন্ট ডাকতে লাগল পাহাড়ের উপরের ঘন বনের ছায়াছন্ন গভীর থেকে ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব করে।
ওটা কি পাখি?
রসভঙ্গ করে কথা বলল গামহার।
চিকু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইসারাতে বলল, পরে বলব।
পাহাড়ের উপর থেকে ময়ুরও ডেকে উঠল কেঁয়া-কেঁয়া করে। এই ডাকটা চেনে গামহার। কারণ সিংহীদের বাড়িতে এক জোড়া ময়ুর ছিল।
একটা বড় নীল কাঁচপোকা বুঁ-বুঁ-বুই করে উড়ে উড়ে ওদের মাথার উপরে ঘুরতে লাগল। আহা! গামহার বলল না বলে, ‘আমার বনে বনে ধরল মুকুল, বহে মনে মনে দক্ষিণ হাওয়া’। পথের লাল ধুলো-ওড়ানো দমক দমক হাওয়াতে মহুল ফুলের গন্ধ ভেসে আসতে লাগল আরও নানা ফুল-পাতার মিশ্র গন্ধের সঙ্গে। গামহার সামনের আদিগন্ত বিস্তৃত বাসন্তী প্রকৃতির ফ্রেমের দিকে চেয়ে সেই ফ্রেমের কেন্দ্রবিন্দুতে কালো পাথরের উপরে মেরুন জমির উপর ছোট ছোট সাদা বুটির শাড়িপরা ঝাঁঝিকে বসিয়ে আদিগন্ত রঙের দাঙ্গা-লাগা পাহাড় শ্রেণীর দিকে নিপে চেয়ে রইল আর চিকুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল ওর মন। বিয়ারের মুখখোলা বোতলের মধ্যে হাওয়া ঢুকে সিঁসি করে বাঁশি বাজতে লাগল নিচু-গ্রামে। কত কী বিস্ময়ই যে বাকি ছিল।
ভাবছিল, গামহার।
অথচ সব হাতের নাগালের মধ্যেই ছিল। সকলেই জানে যে, জীবন একটামাত্র। অথচ চিকুকে ছাড়া আর কারোকেই দেখল না যে, সমাজের মুখে থুথু দিয়ে সেই জীবনকে নিজের করতলগত করে তা নিয়ে রঙিন কর্বুর মাৰ্বল-এর মতো খেলতে। শুধুমাত্র এই কারণেই তার চেয়ে বয়সে অনেকই ছোট চিকুকে ও শ্রদ্ধা করে।
অনেকক্ষণ পরে কথা বলল চিকু।
কেমন লাগছে, গামহারদা?
গামহার হেসে বলল, চিত্ত আমার হারালো। নিজের ভাষায়, কিছু বলি, সে সাধ্য কি আমার? বিপদে পড়লেই তাই দাড়িওয়ালা বুড়োকে ধরি।
তারপর বলল, এবারে বলল, কী পাখি ডাকছিল ওটা? এখনও তো ডাকছেই পাহাড়ের গা থেকে।
ওটারই ইংরেজী নাম ক্রো-ফেজেন্ট। বাদামী আর কালো মস্ত বড় লেজওয়ালা পাখি। বাংলার গ্রামে-গ্রামেও দেখতে পাবে এ পাখি, যেখানেই গাছ-গাছালি এখনও আছে। ডাহুক আর এই পাখি, পান-পায়রা, জলপিপি এদের তো প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়। তবে এই পাখিটি জলের পাখি নয়, পান-পায়রা বা জল-পিপির মতো। ডাহুকও উভচর। এদের এখানকার নাম কুম্ভাটুয়া।
কী বললে?
কুম্ভাটুয়া। ওড়িয়াতে বলে।
কী সুন্দর নাম, না?
আর আমরা যে পাথরের মস্ত চাইটির উপরে বসে আছি, সেটি কী পাথর? জানো?
তুমি কি পাথরও চেনো?
আমি কিছুই চিনি-জানি না গামহারদা। তোমার মতো আর্টিস্ট তো নই যে হৃদয়ের কারবারী হব। তাই পাথর-টাথর চেনার চেষ্টা করি। তবে এই সবে জানতে আরম্ভ করেছি। কতরকম পাথর আছে। ল্যাটারাইট, গ্রানাইট, ব্যাসাল্ট, ভলকানিক, স্যান্ডস্টোন, মাৰ্বল, সিস্ট, লাইমস্টোন, স্লেটস। এই পাথরটি ল্যাটারাইট। জানব কী করে বলো? পড়াশুনো কি আর করেছি তেমন? আর এখন তো সফটওয়্যারের আর কম্প্যুটারের চক্করে পড়ে, নিজেই হার্ডওয়্যার হয়ে গেছি। রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারার ‘নমোঃ যন্ত্র নমোঃ যন্ত্র নমোঃ যন্ত্র নমোঃ’ করছি। তবে একটা সময় আসছে গামহারদা, শিগগিরই আসছে, যখন মানুষের মনুষ্যত্বকেই এই যন্ত্রের দুনিয়া গ্রাস করে ফেলবে।
হয়ত বলেছ ঠিকই চিকু, মানুষ চাপা পড়ে মরবে তার কৃতিত্ব আর অহমিকার ভারে। নিশ্চিত মরবে। তখন আমি-তুমি হয়ত বেঁচে থাকব না।
তাই তো বলি, গামহারদা, ঝাঁঝি, তোমাদের সকলকেই বলি, বাঁচো বাঁচো দারুণভাবে বাঁচো। প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচো। তুমি যেমন করে বাঁচতে চাও তোমার মতো করে। তেমন করে বাঁচো। ভয় কোরো না, দ্বিধা কোরো না।
সবকিছুই এখন যেমন সংখ্যাতে হচ্ছে মানুষের পরিচয়ও তেমন হয়ে যাবে একদিন হয়ত সংখ্যাতেই। রক্তকরবীর রাজার মতো কেউ সুপারকম্পুট্যারের ঘরে বসে চোখের আড়াল থেকে আমাদের চালাবে। গামহার ঘোয হবে হয়ত ১৭৩৭০০৫৪০০৮২ নং, ঝাঁঝি হয়ত হবে ৯৯৪৪৯৯৬৬২২।
আর তুমি?
ঈশ্বরই জানেন! আমি হয়ত হব ০০০০০০০০১। কে বলতে পারে? এই যন্ত্রদানব সবই গ্রাস করে ফেলবে। জনগণায়ন সম্পূর্ণ হবে। ব্যক্তি থাকবে না। ব্যক্তি-স্বাধীনতা থাকবে না আর।
তা হয়ত গ্রাস করে ফেলবে কিন্তু তারও পরে একটা সময় আসবে যখন মুক্তধারার ধনঞ্জয় বৈরাগীরই জয় হবে। ধনঞ্জয় বৈরাগী এই গান গাইতে গাইতে দিগন্তে মিলিয়ে যাবেন, ‘তোর শিকল আমায় বিকল করবে না। তোর মারে মরম মরবে না। তার আপন হাতের ছাড় চিঠি সেই যে / তোর মনের ভিতর রয়েছে এই যে, তোদের ধরা আমায় ধরবে না। তোর শিকল আমায় বিকল করবে না।’
এমন সময়ে একটা গাড়ির এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল।
চিকু বলল, ওই যে এসে গেল।
আমাদের সব আনন্দ মাটি হল। গামহার বলল।
ঝাঁঝিকে বলল চিকু, মুখে ঝগড়া করলে কী হয়। প্রেম তো দেখছি অতি গভীর। হারিত তো দেখছি তোমার বিরহ একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
হুঁ। ভাবছ তাই! আসলে দেখতে এসেছে তুমি বে-আক্কেলের মতো আমাকে একা গামহারদার সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছ, না সঙ্গে সঙ্গে থেকে পাহারা দিচ্ছ।
গামহার বলল, জারুলও তো তাই ভাবতে পারে। আমি চিকুর হাতে তোমাকে ছেড়েই দিলাম না পাহারায় আছি।
ভাবুন ভাবুন গামহারদা। যা খুশি ভাবুন। আমি আর জারুল তো বাঁধনহীন। আমাদের ভয় তো কিছুই নেই। তারও নেই, আমারও নেই। ভয় ঝাঁঝির, ভয় হারিতের, ভয় বছর-বিয়ানি হরিমতির স্বামী শ্ৰীমান নবেন্দুবাবুর।
গাড়িটা এসে গেল পেছনে লাল ধুলো, ঝরা-ফুল ঝরা-পাতা উড়িয়ে। পেছনে পেছনে ওদের তাড়া করে এলো একঝাক টিয়া। তারপর জলপাই-সবুজ মিগ-প্লেনেরই মতো নীলাকাশকে বিদ্ধ করে সকলের মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল গিরিখাতের গহ্বর পেরিয়ে অন্য কোনো গাঢ়তর সবুজ পাহাড়ের বুকের কোরকে।
গাড়ি থেকে নেমেই নবেন্দু বলল, হাউ মীন অফ উ্য অল! তোমরা আমাদের ফেলে বিয়ার খাচ্ছ? আর আমরা তোমাদের বিয়ার খাবার জন্যেই ডাকতে এলাম! একা একা খাব না বলে!
হাউ গ্রেশাস অফ ড্য!
ঝাঁঝি বলল।
তারপর যোগ করল, দো, ফর আ চেঞ্জ।
এত হট্টগোেল ভাল লাগছিল না গামহার-এর। বিয়ার খেতে খেতে ঝাঁঝির দিকে অপলকে চেয়ে থাকতে থাকতে ছবিটার কথা ভাবছিল। মনে মনে তার সদ্যরচিত কবিতাট আবৃত্তি করল :
যতবার আঁকলাম, মুছলাম তার চেয়ে বেশি।
চোখ চিবুক চুল সবই মিলল হুবহু,
মিলল না শুধু সেই ভাবনাটুকু?
কবে যেন চুরি হয়ে গেছে।
চিকু গামহারকে চমকে দিয়ে বলল, সকলে তো গাড়িতে আঁটব না।
আঁটব না কেন? একটু চাপাচাপি করে গেলেই হবে। মাত্র তো ছ’জনই আমরা। এতটুকু পথ। এ-ওর কোলে বসে গেলেই হবে।
‘যদি হয় সুজন তেঁতুলপাতায় নজন।‘
নবেন্দু বলল।
নবেন্দুর কোলে ঝাঁঝি বসলে চাড্ডাকান্টেট’ হারিতের আপত্তি হবে না তো?
হারিত সিগারেটের টুকরোটা জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলে বলল, বিন্দুমাত্রও নয়। কেউ যদি চিরদিনের জন্যেও নিয়ে যেতে চায়, তো তাকে একটি গাড়ি প্রেজেন্ট করব।
ঝাঁঝি বলল, তার আগে নিজের গাড়িটি রিপ্লেস করো। গাড়ির শোকে তো দু’চোখের পাতা এক করতেই পারছ না।
চিকু বলল, তার আগে হারিত তুমি গিয়ে সিগারেটের টুকরোটাকে ভাল করে নিভিয়ে দিয়ে এসো। তোমরা শিক্ষিত মানুষ হয়ে যদি এমন করো! তুমি কি জানো তোমার এই অবহেলাতে ছুঁড়ে ফেলা সিগারেটটির জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকার জঙ্গল পুড়ে যেতে পারত।
টাকাটার কথাই মনে হলো তোমার শুধু চিকু! আর সৌন্দর্য। কত জঙ্গল যে ধ্বংস হয়ে যেতো। ধ্বংস হতে আমাদের ভবিষ্যতের এক টুকরো।
জারুল বলল।
সৌন্দর্যের কথা? তোমার মতো সকলে যে সৌন্দর্য বোঝে না জারুল। তাই যা সকলে সহজে বোঝে তাইতো বললাম। টাকার অঙ্ক দিয়ে ক্ষতির পরিমাণ বোঝাতে হয়। এমন করে বোঝালে সকলের পক্ষেই বোধগম্য হয়। কী দুর্ভাগ্য!
নবেন্দু বলল, ফিলিম ডিরেকটরের মতো, চলো চলো, লেটস প্যাক-আপ। রান্না হয়ে যাবে আর একঘণ্টার মধ্যে। চলো তার আগে একটু বু-উ-জু হোক, মুখে স্বাদ হবে। তারপর ঘুমোব ভাল করে। আজ চাঁদনি রাত এখানেই সেলিব্রেট করতে হবে। ঝাঁঝির পুনর্জন্ম। খুব ড্রিঙ্ক করব আজকে।
গামহার বলল, শুধু ঝাঁঝিরই কেন? হারিতের নয় কেন? মনে হচ্ছে, হারিত ফওত হয়ে গেলে তুমি খুশি হতে নবেন্দু।
একি গামহার দা! আপনিও আমার পেছনে…
চিকু বলল, আমরা এখান থেকে যাব একটু বসন্ত-বন্দনার পরে।
তার মানে?
তার মানে গামহারদা এখানে এই শিলাসনে এসে আমাদের একটি বসন্তর গান শোনাবে।
কী গান?
নবেন্দু বলল, ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।’
চিকু বলল এক্সকিউজ মি, উইথ অল রেসপেক্টস টু রবীন্দ্রনাথ এই গানটি এত বেশি গাওয়া হয়ে গেছে যে ‘ক্লিশে’, হয়ে গেছে। তুমি বসন্ত-বন্দনার অন্য কোনো গান শোনাও আমাদের গামহারদা।
গামহার বলল, একটা গান মনে এল বটে কিন্তু গাইতে ভয় করছে।
কেন? কিসের ভয়?
এ গানটি দীপালিদির রেকর্ড আছে।
কোন দীপালি দি?
আরে দীপালি নাগ চৌধুরী।
ও। তিনি তো বহতই বড় গাইয়ে। সত্যি! আর কী সুরেলা গলা। আজকাল তো এত গাইয়ে উঠেছে কিন্তু পুরো সুর ক’জনের গলায় লাগে বলত? তবে আমাদের কারো সঙ্গেই তো আলাপ নেই দীপালিদির। উনি জানবেন কোত্থেকে, তুমি যদি ভুলও গাও। আর ভুল গাইলে আমাদের মধ্যেই বা কে এমন তালেবর আছে যে, সে ভুল ধরতে পারবে?
আচ্ছা! এই ‘তালেবর’ শব্দটির বুৎপত্তি কেউ জানো?
গামহার বলল।
হারিত বলল, আমি জানি।
কি?
তালের বড়া।
ওরা সকলেই একসঙ্গে হেসে উঠল।
তারপর চিকু বলল, সেটা কথা নয়। অদৃশ্য পাহারাদার তো একজন থাকেই সবসময়ে, সব জায়গায়।
সে কে?
বিবেক।
গুলি মাররা।
সেটাই তো মুশকিল। যাদের ঐ বস্তুটি আছে তাদের পক্ষে নিজে হাতে তাকে মারা বড়ই কঠিন।
নাঃ। বড় ভারী সব ডিসকাশন হচ্ছে। আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। গানটা যদি গাইতে হয় তবে গেয়ে ফেলুন গামহারদা। মিছে বেলা বাড়ছে। চানও হয়নি কারোরই।
আমাদের হয়ে গেছে। তোমরা করে নেবে।
গামহার একটু কেশে গলাটা ছাড়িয়ে নিয়ে ধরে দিল, ‘মধুবসন্ত আজি এল ফিরিয়া, অনুরাগ রঙে রঙিল হিয়া…।
চম্পক বনে আজি পীক কুহরে/চঞ্চল তনুমন পুলকে শিহরে/ভ্রমর ভ্রমরী সনে ফেরে গাহিয়া/মধুবসন্ত আজি এল ফিরিয়া।
অশোকের মঞ্জরী গুঞ্জরে বনে/পলাশের কুমকুম ঝরে ক্ষণে ক্ষণে/চন্দন তরুগণ গন্ধে উতলা/চন্দ্রিমা লয়ে বুকে নিশীথ উজলা/বনমৃগ ফেরে কারে খুঁজিয়া/এল ফিরিয়া/মধুবসন্ত আজি এল ফিরিয়া।’
আহা। আহা। করে উঠল সকলেই।
এটা কি বাহার?
নবেন্দু বলল।
না। এটা বসন্তু।
চিকু বলল, এই গানটা চাঁদ উঠলে জোরান্ডা বাংলোর ওই বসার জায়গাটার নীচে বসেই গাইতে গামহারদা। দিনমানে গেয়ে গানটার প্রতি অন্যায় করলে তুমি।
জারুল বলল, অধিকন্তু ন দোযায়ঃ। তাতে কি? রাতের বেলা আবার হবেখন।
নবেন্দু বলল, আবারও বলল, গামহারদা আপনি কি ঠিক জানেন যে এটা বসন্ত। বাহার নয়?
আমারও কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে।
হারিত বলল।
ঝাঁঝি সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করল হারিতকে। তুমি তো ‘চাড্ডাকান্টেন্ট’। গানের তো গ’ও জানো না। তোমারও কি বন্ধুর দেখাদেখি মাতব্বরী না করলেই চলছে না! অন্ধ এলেন ল্যাংড়াকে পথ দেখাতে। বাহারে আর বসন্ত্-এ কি কি পর্দা লাগে বলো তো?
আঃ। তুমি বড় পার্সোনাল অ্যাটাক করো ঝাঁঝি।
নবেন্দু বলল।
বাঃ। চাড্ডাকান্টেন্ট কি গামহারদাকে ইমপার্সোনাল অ্যাটাক করল?
চিকু মধ্যে পড়ে বলল, এসব থামাও, আমি একটা জেনুইন ইমপার্সোনাল গল্প বলছি। গল্পটাও জেনুইন এবং জেনুইনলি ইমপার্সোনাল। এই রাগ-রাগিনী সম্বন্ধেই।
কি? তাড়াতাড়ি বলো
হারিত বলল।
চিকু বলল, তুমি যখন ঝাঁঝিকে আদর করো তখনও কি এমন তাড়াতাড়ি করার ফরমান জারি করো নাকি?
ঝাঁঝি কথা না বলে অন্যদিকে চেয়ে রইল।
হারিত বলল, নষ্ট করার মতো অতো সময় থাকে না আমার হাতে কখনই।
চলো। ফিরে যেতে যেতে গাড়িতেই শুনব। তোমাদের তো চান হয়ে গেছে। আমাদের তো চান করতে হবে। আর দেরী করা ঠিক হবে না এখানে।
চলো।
নবেন্দু বলে, স্টিয়ারিং-এ গিয়ে বসলো।
বেশ করেছে কিন্তু “উনো” গাড়িগুলো। না?
চিকু বলল।
হ্যাঁ। বেশ জায়গা আছে।
চিকু বলল, গামহারদা তুমি সামনে বসো। আমরা চারজনে পেছনে চাপাচাপি করে বসে যাব।
নবেন্দু বলল, নো প্রবলেম। দুটি কাপল। যে যার বউকে চাপো।
নবেন্দু ওর ফিয়াট উনো গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিল। তারপর গিয়ারে ফেলে, গাড়িটাকে উৎরাইয়ে গড়িয়ে দিয়েই বলল, বলো চিকু। কী গল্প বলছিলে বলবে।
হ্যাঁ। লক্ষ্মৌতে এক রহিস বাঙালির বাড়িতে কলকাতা থেকে একজন নামী বাঙালি সরোদিয়া গেছেন বাজাতে। বাড়ির সামনের মস্ত লন-এ শ্রোতাদের গায়ে আতর আর গোলাপ জল ছিটিয়ে তো মেহফিল আরম্ভ হয়েছে। লক্ষ্মৌর তাবৎ বাঙালি-অবাঙালি সমঝদার আর রহিস আদমীরা সব শুনতে এসেছেন গান। পাহাড়ী সান্যাল, তখন ওখানে ছিলেন, কুমার প্রসাদ মুখোপাধ্যায়…
তিনি কে?
আরে ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে।
কেন? তুমি তার ‘কুদরত রঙ্গি-বিরঙ্গী’ পড়োনি নাকি? অমিয়নাথ সান্যালের ‘স্মৃতির অতলের’ পরে এমন সেন্স অফ হিউমার বড় একটা দেখিনি সাহিত্যে এই বিষয়ে।
সমঝদারী আর রহিসীর মধ্যে কি বিরোধ আছে কোনো?
গামহার বলল।
চিকু বলল, বিলক্ষণ আছে গামহারদা। সমঝদার হয়েও কেউ রহিস নাও হতে পারেন আবার রহিস হয়েও অধিকাংশই সমঝদার হন না। কিন্তু রহিসীর অনেক দায়-দায়িত্বও থাকে। সৎসঙ্গে, ভাল মেহফিলে নিমন্ত্রিত হলে তাদের দু-পাঁচলাখি শাল গায়ে চড়িয়ে সেইসব অকুস্থলে যেতেই হয়, কিছু বুঝুন আর নাই বুঝুন। যেতে হয়, নইলে রহিমীর বে ইজ্জৎ হয়।
বহত খুব।
বলল, গামহার।
এবার গল্পটা বলো।
তা উস্তাদ অথবা পণ্ডিত তো দু’ঘণ্টা বাজালেন। লাজোয়াব বাজনা।
কী রাগ বাজালেন? ঝাঁঝি জিজ্ঞেস করল।
বলছি। বলছি।
মুসাম্বির রস-এর সঙ্গে উদার হাতে জিন মিশিয়ে সকলকে দেওয়া হয়েছে বাজনার আগে এবং মধ্যেও। রুপোর তবকমোড়া পান, সঙ্গে ডমদা জর্দা। গৃহকর্তা যেহেতু বাঙালি, তাই কলকাতা থেকে তার শ্বশুরালয়ের কিছু মানুষও এসেছিলেন। তাদেরই মধ্যে গৃহকর্তার দুজন চাড্ডাকানটেন্ট শ্যালকের পুত্র এবং তাদের এক সতীর্থও ছিল। গান-বাজনার ব্যাপারে তাদের তেমন জ্ঞান ছিল না। প্রথম সারিতে বসে যে বিপুল উৎসাহে রথী-মহারথীদের সঙ্গে মাথা নেড়ে কেয়াবাত কেয়াবাত বলতে বলতে, আঙুল উঁচিয়ে তারা সম যেভাবে দেখাচ্ছিল তা দেখেই ঐ ধারণা হয়েছিল আমার।
বাজনা শেষ হতেই তো সাব্বাস! কেয়া বাত্ কেয়া বাত্! মশহুর বাজাইয়া, আপ কি উমর লম্বী হো; ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি সাধুবাদের ফুল উড়ছে চারদিকে। এমন সময়ে কলকাতার শালাবাবুর ছোঁড়ারা বাজিয়ের কাছে এসে বললো, কী যে বাজালেন দাদা। জুতো। জুতো। একেবারে জুতো।
বাজিয়ে তো লক্ষ্মৌ শহরে এসে এমন বদ্তমিজ ছেলে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না।
আবারো যখন তারিফের ফুলঝুরি ফুটতে শুরু করল, বিনয়ী শিল্পী তাতে আরও একটু সংকুচিত হয়ে গেলেন।
তখন কলকাতার সমঝদারদের মধ্যে একটি ছেলে বললে, পণ্ডিতজী এবারে একটু চন্দ্রকোষ শোনাবেন না আমাদের?
বাজিয়ে চমকে উঠলেন। তারপর কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বিনয়কে ফাটা-ফুটো শালের মতো ছুঁড়ে ফেলে বললেন, তাহলে এই পুরো দু’ঘণ্টা কি আমি আপনাদের অণ্ডকোষই বাজাচ্ছিলাম?
.
১১.
দুপুরে খেতে খেতে প্রায় চারটে বাজল। তারপর সকলেই শুয়ে পড়ল। রাতে চাঁদের আলোতে জঙ্গলের রূপ দেখবে। আজ সম্ভবত ত্রয়োদশী।
বাসন্তী পূর্ণিমাতে নাকি বনে পাহাড়ে ঠাণ্ডা থাকার জন্যে চাঁদের রূপ তত উপভোগ করা যায় না। কুয়াশাও থাকে নাকি। তাই চৈত্র বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠর পূর্ণিমাই নাকি সবচেয়ে সুন্দর লাগে জঙ্গল পাহাড়ে। সুন্দর লাগে বর্ষার পূর্ণিমাও যদি অবশ্য আকাশ পরিষ্কার থাকে। তখন আবার বনের অন্য রূপ। বর্ষণসিক্ত-বনের উপরে প্রতিসরিত জ্যোৎস্নাতে চোখ ধেঁধেঁ যায়। তবে সবচেয়ে মোহিনী রূপ কোজাগরী পূর্ণিমাতে। জারুল বলছিল।
নির্মেঘ চাঁদভাসি আকাশে অগণ্য তারাদের সঙ্গে কৃত্রিম উপগ্রহও দেখা যায় এই সব নির্মল পরিবেশের আকাশে। তারারই মতো। তারাদের চেয়ে অনেকই কাছে থাকাতে তাদের পরিক্রমাটা চোখে পড়ে। যদিও অতি ধীরগতিতে তারা পরিক্রমা করে যায় আমাদের এই ভালবাসার পৃথিবীকে।
খেতে খেতেই বাইরে মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। গামহার উৎকর্ণ হলো। চিকু বলল, ওরা বাথুরী সমাজের লোক। সমতল থেকে পায়ে হেঁটে এসেছে। পুজো দেবে কাল রাতে।
কীসের পুজো?
বড়াম দেব-এর। ওদের দেবতা। সারা বছর যেন ওরা বাঘ, ভাল্লুক, হাতি, সাপ, শম্বর, হরিণ, শুয়োর, খরগোস, টিয়া ও আরও অগণ্য পাখিদের হাত থেকে ওদের নিজেদের এবং ফসল রক্ষা করতে পারে, সেইজন্যে।
গামহার বলল, খেয়ে উঠে আমি ওদের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? আমি তো একটু-একটু ওড়িয়া বলতে পারি…।
চিকু হেসে বলল, হউ! মু জানিছি যে তমে টিক্কে টিক্কে ওড়িয়া কহু পারুচি।
গামহার বুঝলো যে নবেন্দু ভাল ওড়িয়া জানে। চিকু বলল, ওদের ব্যবসাতে অনেক ওড়িয়া প্লাম্বারদের সঙ্গেও কাজ করতে হয়। নবেন্দুর কান আছে, শিখে নিয়েছে ভাষাটা।
তা ঠিক। গান আর ভাষাতে কান খুব বড় ব্যাপার। কিন্তু তুমি যেটুকু ওড়িয়া কুমুদিনীর দৌলতে শিখেছিলে তাতে তো পুলিশ বশ হলো না। এরা কি বশ হবে? তোমাকে উদ্ধার করে আনতে আবারও অর্থদণ্ড লাগবে না তো? দেখো।
চিকু বলল।
গামহার লজ্জা পেল। তারপর বলল, পুলিশের কথা আলাদা। ওড়িয়াতে একটি দ্বিপদী আছে, “মাছু খাইবি ভাকুর, ঘইতা কইবি ডাইভর। মাছু খাইবি ইলিশী ঘইতা কইবি পুলিসী।”
ওরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করল, মানে কি হলো?
মানে হলো, যদি বোয়াল মাছ খেতে চাও তো ট্রাক ড্রাইভারকে বিয়ে কর। আর যদি ইলিশ মাছ খেতে চাও তো বিয়ে কর পুলিশকে। মানে আর কী! বিস্তর ঘুষ না খেলেই ইলিশ মাছ খাবে কী করে। তারপর বলল কুমুদিনীর কাছে শুনেছিলাম।
বলতেই, ঝাঁঝি বলল, কুমুদিনী কে?
জারুল বলল, ভয় নেই ঝাঁঝি, তোমার বা আমার। কুমুদিনী গামহারদার প্রথম যৌবনের ওড়িয়া প্রেমিকা যার সঙ্গে বিয়ে হয়নি গামহারদার। আমরা, যারা গামহারদার অ্যাডমায়রার, তারা আপাতত নির্বিঘ্ন।
বিয়ে হয়নি বলেই তো প্রেম উজ্জ্বল আছে।
গবগব করে হারিত বললো।
ঝাঁঝি বলল, আরে! কী কহিল কানু?
জারুলও হাসতে হাসতে বলল আরও ঠাট্টা করে বলল ‘চাড্ডাকান্টেন্ট।’ রস কি কম আছে হারিতের ঝাঁঝি? এ তো দেখছি মৌচাক। তুমিই ঠিকমতো কৌশল করে ধুঁয়ো দিয়ে মধু নিংড়োতে পারোনি দেখা যাচ্ছে।
তুমিই নিংড়ে নাও না ভাই। একটা খল-নোড়া দোব কি? সঙ্গে মকরধ্বজও আছে। সেই রস নিংড়ে চাড্ডাকান্টেন্টকে মকরধ্বজ দিয়ে মেড়ে খেয়ে ফেলল। নিপাতনে সিদ্ধ হবে।
খুব হাসাহাসি হলো একচোট।
গামহার-এর মনে হলো, হারিত ছেলেটা ভাল। রসিকও খুব। কিন্তু বহিরঙ্গে একটু বেরসিক। জারুল ঠিকই বলেছে। বহিরঙ্গে ও মৌচাক নয়, হর্স-চেস্টনাট। হাতুড়ি ছাড়া ভাঙা মুশকিল।
ওরা যখন খাওয়া-দাওয়ার পরে লম্বা ঘুম লাগাবে বলে শুলো তখন গামহার গুটিগুটি গেট পেরিয়ে বাংলোর হাতার বাইরে এসে দেখলো জঙ্গলের এখানে ওখানে প্লাসটিকের শিট, ত্রিপল, চাদর ইত্যাদি সুতলি দিয়ে গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে রাতে শোওয়ার বন্দোবস্ত করছে বাথুরী সমাজের লোকেরা। রান্না-বান্নার বন্দোবস্তও করছে পাথর-সাজিয়ে উনুন করে জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ-কুটো পাতা-পুতা কুড়িয়ে এনে।
ওদের একজনের সঙ্গে কথা বলতেই সে গামহারকে তাদের রাজার কাছে নিয়ে গেল। বাথুরী সমাজের রাজা। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, রোগা একজন সাধারণ মানুষ। পরনে একটি কোরা ধুতি। অর্ধেকটা নিম্নাঙ্গে পরা, অন্য অর্ধেকটা গায়ে জড়ানো। খালি পা। কোনো গুমোর নেই রাজা বলে।
তিনি একটা বড় পাথরের উপরে বসেছিলেন। তাঁর পাশে বসে গামহার তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। তার আগে, মাথা নিচু করে বিনয়ের সঙ্গে ‘নমস্কার আইজ্ঞাঁ’ বলে নমস্কারও করল।
পশ্চিমের আকাশে লালের ছোপ লেগেছে। পাহাড়ের পর পাহাড়ের প্রাচীর ঘেরা হাজার হাজার হাতির এবং অন্যসব জানোয়ারের বাসভূমি এই সিমলিপাল অভয়ারণ্যের পর্ণমোচী বনের পাতা-খসার দিনে চিকু তাকে যে কী এক উপঢৌকন দিল তার মূল্যায়ন করা গামহার-এর পক্ষে সম্ভব নয়। কলকাতাতেই চিকু আর জারুলের মুখে শুনেছিল যে, এই সিমলিপাল অভয়ারণ্যের বিস্তৃতি নাকি পৌনে তিনহাজার বর্গ কিমি। তার কতটুকুই বা তারা দেখল বা অন্য ভ্রমণার্থীরাও দেখতে পারেন। এই সমস্ত বনপাহাড়ই একসময়ে ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজার শিকারভূমি। অন্য কারো শিকার করার অনুমতি ছিল না এখানে। তবে রাজার নিজের অতিথিদের কথা আলাদা। সেইসব সৌভাগ্যবানেরাই হয়তো দেখে থাকবেন এই বিশাল পাহাড়বেষ্টিত বনরাজিনীলার আনাচ-কানাচ। বাইশশ থেকে প্রায় তিনহাজার ফিট উঁচু এখানের এই পাহাড়গুলি। মানে, সাতশ পঞ্চাশ মিটার থেকে প্রায় সাড়ে নশ মিটার পর্যন্ত। এখানকার বন-বাংলোগুলির নাম শুনলেই বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে মাদল বেজে ওঠে। আশ্চর্য! ভাবছিল, গামহার। দর্শনের আনন্দ, শ্রবণের আনন্দ, স্পর্শন, ঘর্ষণ সবকিছুরই আলাদা আলাদা আনন্দ আছে কিন্তু কোনো অদেখা জায়গার বা ব্যক্তির নাম কানে শুনলেই মন সেই জায়গা বা ব্যক্তি সম্বন্ধে একটা ধারণা গড়ে নেয়। কেন যে নেয়, কে জানে! যেমন ঝাঁঝিকে দেখার আগে ঝাঁঝির নাম শুনেই ও প্রেমে পড়েছিল। যেমন পড়েছিল, জোরান্ডার। গুড়গুড়িয়া, জোরান্ডা, ধুধুরুচম্ন, বড়াকামরা, আপার বড়াকামরা, জেনাবিল, গায়েরকাঁচা, বাছুরিচরা, ন-আনা, ভঞ্জবাসা, চাহালা আরও কত না বাংলো আছে। গুড়গুড়িয়া হয়েই ওদের ফিরে যাবার কথা। তার পাশেই খৈরী নদী, যে খৈরীর বালিতেই নাকি সিমলিপাল টাইগার প্রজেক্টের ফিল্ড ডিরেক্টর সরোজরাজ চৌধুরী কুড়িয়ে পেয়েছিলেন মাতৃহারা একটি ব্যাঘশাবক এবং যার নাম রেখেছিলেন খৈরী। পৃথিবীর নানা পত্র-পত্রিকাতে খৈরীর ছবি দেখেছে ও খবর পড়েছে আগে গামহার। খৈরী মারাও গেছে আজ বহুদিন হলো। তার পালিকা মাতা ও পালক পিতা চৌধুরীরাও আর বেঁচে নেই।
গামহার, রাজার কাছে বাথুরী সমাজের কথা জিজ্ঞেস করছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। রাজা তো নন, যেন আরণ্যকে পড়া রাজা দোবরু পান্না! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল গামহার-এর, চাপা উত্তেজনাতে।
রাজা বললেন, আলো একেবারে নিভে যাওয়ার আগে আগে পাহাড়চুড়োয় উঠে আমাদের সন্ধিপুজো করে আগমনী গান গাইতে হবে। কাল ভোরে পুজো শুরু হবে। তাই আজ সময় তার হাতে বেশি নেই।
গামহার বলল, যেটুকু আছে, তাই তার পক্ষে যথেষ্ট।
বেলা পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পরে পথ থেকে, মাঠ থেকে, বন থেকে, যে একরকমের গন্ধ আর ঝাঁঝ ওঠে ঠিক তেমনই গন্ধ আর ঝাঁঝ উঠতে লাগল বনের বুকের কোরক থেকে। তবে অন্য গন্ধ, অন্য ঝাঁঝ।
একটা মস্ত ঝাঁকড়া গাছের নীচে গামহার রাজার সঙ্গে বসেছিল।
গামহার জিজ্ঞেস করল, এটা কী গাছ?
কোনটা?
উপরে আঙুল দিয়ে দেখাল গামহার।
রাজা হেসে বললেন, এই ত কদম।
গামহার ভাবল ভাগ্যের একী পরিহাস। বারেবারেই তাকে বিধাতা শুধু কদম গাছতলাতেই কেন ঠেলে দিচ্ছেন একা একা? কদমতলে একা কি কারওই ভাল লাগে।
এমন সময়ে দেখা গেল ঝাঁঝি আসছে। তার পায়ে একটু দ্বিধা, একটু দ্বন্দ্ব আর তা এক বিশেষ ছন্দ দিয়েছে তার চলার ঋতিকে। হলুদ, লাল কালো, সবুজ বনের মধ্যে বিদায়ী সূর্যর কাঁচা সোনা রঙে বিধুর হয়ে যাওয়া লাল-পথ বেয়ে নবীন কুসুম পাতা-লাল শাড়ি পরে দীর্ঘাঙ্গী ঝাঁঝি এক এক পা করে এগিয়ে আসছে গামহার-এর দিকে। গামহার যেন যুগযুগান্ত ধরে এই ক্ষণটির জন্যেই অপেক্ষা করেছিল। তার ভিতরে ভিতরে যেন নিরুচ্চারে কিন্তু তীব্র অনুরণনে গেয়ে উঠলো একটি বহুশ্রুত, বঙ্গীত গান, “আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে/কার সন্ধানে ফিরি বনে বনে/আজি মুগ্ধ নীলাম্বর মাঝে একি চঞ্চল ক্রন্দন বাজে/সুদূর দিগন্তের সকরুণ সঙ্গীত লাগে মোর চিন্তায় কাজে–আমি খুঁজি কারে অন্তরে মনে/আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে।”
ঝাঁঝি কাছে এসে দাঁড়াতেই রাজা উঠে দাঁড়ালেন। গামহারও উঠে দাঁড়াল। গামহার পরিচয় করিয়ে দিতে যেতেই রাজা হেসে বললেন, জানি জানি, আপনার স্ত্রী।
গামহার মনে মনে বলল, আহা রাজা! তুমি শুধু বাথুরী সমাজেরই নয়, তুমি পৃথিবীর রাজা হও। তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
গামহার প্রচণ্ড আপত্তি দেখাতে যাচ্ছিল কিন্তু ঝাঁঝি হাসতে হাসতে হাত তুলে বাধা দিল।
বলল, স্বপ্নেই যখন পোলাউ রান্না হচ্ছে তখন ঘি ঢালতে কষী করছেন কেন?
গামহার ক্রমশই এই সাধারণ মেয়েটির অসাধারণ দুঃসাহসে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিল। কে জানে! আজ রাতে কী ঘটবে। এমন রাতে, এমন পরিবেশে যা-কিছুই ঘটা সম্ভব। যা, কলুষিত, চিৎকৃত, বুবুক্ষু, লোভী, রাজনৈতিক কলকাতাতে কখনওই ঘটা সম্ভব নয়। সম্ভব ছিল না। এখানে রাজা আছেন কিন্তু রাজনীতি নেই। ব্যক্তি আছে কিন্তু সমাজের শকুন চোখা নজর নেই তার উপরে। এখানে ব্যক্তি স্বরাট সম্রাট। পার্টি-চালিত যুথবদ্ধ জানোয়ার নয়। সে পতাকাবাহী, স্লোগান-সর্বস্ব, কৃত্রিম-স্বরের চালিত ROBOT নয়। প্রকৃতির মধ্যে সে পুরোদস্তুর একজন মানুষ, কোনোরকম বৈকল্য ও বিকৃতি ছাড়াই। অল্পে সুখী, একজন সহজ সাধারণ মানুষ। যেমন মানুষের জন্যেই ঈশ্বর এই সুন্দর পৃথিবী নিজে হাতে গড়ে দিয়েছিলেন একদিন।
এসো, বসো।
বলল, গামহার।
এমন করে বলল, যেন মনে হলো ওর এবং হয়ত ঝাঁঝিরও, যে, এই বাক্যবন্ধটি ঝাঁঝিকে বলবে বলেই ও এতগুলো বছর যেন জীবনের পথে হেঁটে এসেছে। তার এই আহ্বানের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। সৃষ্টির প্রথম থেকে পুরুষ, নারীকে যে আসঙ্গলিপ্সাতে আহ্বান করে এসেছে, রাধাকে কৃষ্ণ, জুলিয়েটকে রোমিও, লায়লাকে মজনু, থৈবীকে খাম্বা যেমন, তেমন করেই। এতে কোনোই ভুল ছিল না। ভান ছিল না।
গামহার-এর গা ঘেঁষে বসল ঝাঁঝি।
মেয়েরা তাদের পছন্দ-অপছন্দ ভারী তির্যকভাবে প্রকাশ করে। আর্টিস্ট বলেই তা জানে গামহার। তার শরীরের পারফুমের গন্ধ, এতখানি হেঁটে আসাজনিত তার মিষ্টি বগলতলির ঘামের গন্ধ, বেলা শেষের প্রকৃতির গায়ের গন্ধর সঙ্গে মিশে যখন গেল, ঠিক সেই সময়েই একঝাক টিয়া সেই গন্ধপুঞ্জ সঙ্গে করে নিয়ে উড়ে গেল ঝুমঝুমির মতো বাজাতে বাজাতে ডুবন্ত সূর্যের দিকে, একজন মানুষ আর এক মানুষীর নিবিড় নৈকট্যর খবর জানাতে। ওদের বিদ্যুৎগতি দেখে মনে হলো ওরা বুঝি অচিরে সেই লাল গোলকের মধ্যে ঢুকে গিয়ে একটু সবুজ ধার দেবে জ্বলন্ত মার্তণ্ডকে।
কহন্তু আইজ্ঞাঁ, রাজাবাবু। তাংকু নাম হেল্বা ঝাঁঝি। সে আপনংকু কথা শুনিবা পাঁই আসিলু এটি।
তারপরই খুশির আধিক্যে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পার্স বের করে পাঁচশ টাকা দিয়ে গামহার বলল, পূজা সারিলে পিলামানংকু নৃত্য-গীত করিবি মদ্দটদ্দ খাইবাকু পাঁই মু দেলি। খারাপ বাসিলু কি আপুনি রাজা?
না ম। খারাপ কাঁই বাসিবি? ভল্ব বাসিলু।
রাজা বললেন, যে খারাপ ভাবব কেন? ওরা সকলে খুবই খুশি হবে। তবে নাচগান সব আগামিকাল রাতে হবে। পুজোর পর। কিন্তু আমরা মদটদ খাই না। সে মহুয়া কী, হাড়িয়া কী, কী পানমৌরী বা সল্বপ রস। কিচ্ছি নাই।
আপনারা দেখে শিখুন।
ঝাঁঝি বলল।
হুঁ।
গামহার বলল।
তারপর বলল, আপনাদের এই বাথুরি সমাজ সম্বন্ধে কিছু বলুন রাজা।
হউ।
রাজা শুরু করলেন। রাজার নাম বৃন্দাবন মহাপাত্র।
মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে রাজার কাছে নানা ব্যাপারে নির্দেশ নিয়ে যাচ্ছিল।
রাজা বললেন, আমাদের দেবতার নাম বড়াম দেব। প্রতিবছরই পুজো হয় এই চৈত্র মাসেই। ঠিক কবে যে হবে তার ঠিক থাকে না আগে থেকে। তবে চৈত্রমাসের এগারো থেকে পনেরো তারিখের মধ্যেই হয় এই পুজো, ভাল তিথি-নক্ষত্র দেখে।
আপনাদের সমাজের মানুষেরা কি এই পাহাড়েই থাকেন?
না। পাহাড়ে থাকার তো অনেকই কষ্ট। তাছাড়া, সরকার আর বনবিভাগ এই অভয়ারণ্য আর বাঘ-প্রকল্পের মধ্যে মানুষ বাস করুক, তা চান না। আমরা না থাকলেও আদিবাসীদের মধ্যে অনেকেই আছে এখনও। বহুদিন আগে আমরাও এইসব পাহাড়েই থাকতাম। সমলিপাল পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে বাকুয়া নামের একটি জায়গা ছিল সেখানেই ছিল আমাদের বাস। আমাদের পূর্ব পুরুষেরাই সিমলিপালের এই আদিগন্ত পাহাড়শ্রেণীর রাজা ছিলেন। যাশীপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ খড়িয়া রাজা, দাশু খড়িয়াকে আমরা যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলাম। এখনও এই সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণীর মধ্যের বাটালি দুর্গের চুড়োতে রাজা দাশু খড়িয়ার মাথা অবিকৃতভাবে রাখা আছে। করোটি নয়, মাথা। তাছাড়াও, আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমনঘাটির যুদ্ধে গোন্দদেরও হারিয়েছিলেন। আমাদের এক পূর্বসূরী, তার নাম বীরবর, খরী নদী বেয়ে দুটি শিলাখণ্ডকে ভেসে যেতে দেখে দুটিকেই জল থেকে দুহাতে ওঠাতে যান। কিন্তু বাঁহাতের ধরা শিলাখণ্ডটি ভেসে যায় স্রোতে। ডানহাতের শিলাখণ্ডটিকে এনে রঘুনাথজী মঠ-এ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ অঞ্চলের সব মঠ-মন্দিরের মধ্যে এখনও রঘুনাথজীর মঠকেই সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়।
গামহার বলল, আমি নৃতত্ত্বর যা সামান্য জানি, তাতে জানি, আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের অধিকাংশ আদিবাসীর আদি বাসই ছিল দক্ষিণ ভারতে। ওঁরাও, গোন্দ, খারোঁয়ার, বাইগা ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাজা বলেন, তেমন কথাও শুনতে পাই আমরা বহু লেখাপড়া করা পণ্ডিতদের মুখে।
যেমন?
যেমন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা নাকি “দুধ” এর বাটুলিগড়ে থাকতেন তারপর দাক্ষিণাত্যের গোদাবরী নদীর রেখা ধরে তারা নাকি চলে যান। তা হতেও বা পারে। কিন্তু হাজার হাজার বছরের ইতিহাস দিয়ে আমরা করব কী। যে ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের ক্ষীণতম যোগসূত্রও আছে বলে মনে করি আমরা, তাকেই ইতিহাস বলে মানি। তাছাড়া এসব অ-বাথুরি পণ্ডিতদেরই কথা। আমরা তো আমাদের বাবা-ঠাকুরদাদের মুখে ওসব কথা শুনিনি কখনও।
আপনাদের ভাষা কি?
আলাদা ভাষা কিছু নেই। আমরা ওড়িয়াই বলি।
আপনারা কি গোন্দ বাইগাদের মতো আলাদা বস্তী করে থাকেন অরণ্যাঞ্চলে?
না। তাও থাকি না। আমাদের সঙ্গে নানা জাতের আদিবাসীরাই থাকে, যেমন, সাঁওতাল, গোন্দ, মুণ্ডা, সৌতি, ভূমিজ, ভুনিয়া ইত্যাদিরা।
আপনারা তো বারিপদা থেকে এসেছেন শুনলাম। বারিপদাই তো মূয়রভঞ্জের রাজধানী। আপনারা কি তাহলে ময়ূরভঞ্জেই থাকেন সকলে?
রাজা বললেন, না, তাও ঠিক নয়। আমরা নানা জায়গাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। যেমন কেওনঝড়গড়ের পাঁচপীর (করাঞ্জিয়া) আর কাপ্তিপদা উপজেলাতে, বালেশ্বর জেলার নীলগিরি উপজেলাতেও বাথুরিদের বসতি আছে।
আপনাদের কোনো দেবদেবী বা ধর্ম আছে কি আলাদা? নাকি আপনারা হিন্দুই?
আমরা তো হিন্দুই। বড়ামদেব একজন উপদেবতা, জগন্নাথ দেবই আমাদের প্রধান দেবতা। জাউ-রন্ধার এই গিরিখাতের গায়ে কোথাও জগন্নাথদেবেরও ঠাঁই আছে। তা না হলে, বহুবছর আগে এখানেই জগন্নাথ দেবের ভোগ রান্না হতো কেন?
জাউ মানে?
ওড়িয়াতে জাউ মানে তো ভাতই। জগন্নাথদেবের মন্দিরের প্রসাদ তো ভাতই, যাকে আমরা জাউ বলি। জাউ-রন্ধাই নাম এই জায়গাটার। ইংরেজদের জিভে তো অনেকই জড়তা ছিল। তাই ওরা জাউ-রন্ধাকে জোরান্ডা বলতো।
তারপরই রাজা বললেন, এবার আমাকে উঠতে হচ্ছে। কালকে যদি আসেন তাহলে অনেক গল্প হবে।
গামহারও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, কাল যে নাচ হবে সেই নাচের কি কোনো নাম আছে?
আছে বইকী। সে নাচের নাম ছাঙ্গু নৃত্য।
সঙ্গে বাজনা থাকবে না?
রাজার তাড়া ছিল। বললেন, বাজনা ছাড়া কি নাচ হয়? থাকবে বইকি! ছাঙ্গু, খঞ্জনী, মৃদঙ্গ, শঙ্খ, বাইকুন্ডল।
রাজা চলে গেলেন। ততক্ষণে শোভাযাত্রা করে পুরুষেরা এসে পড়েছে। রাজাকে সম্মুখভাবে নিয়ে তারা পাহাড় চড়তে লাগল।
যাবে ওদের পেছন পেছন? না কি বাংলোতে যাবে? হারিত যদি ঘুম ভেঙে তোমাকে দেখতে না পায়?
গামহার বলল।
ঝাঁঝি হাসল। বাঁকা হাসি। বলল, সে কি দুগ্ধপোষ্য শিশু, যে আমাকে না দেখতে পেয়ে কান্না জুড়ে দেবে?
দুগ্ধপোষ্য না হলেও পুরুষমানুষ মাত্রই আমৃত্যু স্তন্যপায়ী তো বটেই।
ভারী অসভ্য তো আপনি।
এমন জঙ্গলে এসেও যদি জংলীপনা না করি একটু, তবে কি শহরে করব?
সেটা ঠিকই বলেছেন কিন্তু। এখানে সব আদিমতা, আদিরসও স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এই অরণ্যর এক আশ্চর্য প্রভাব পড়ে সব মানুষেরই উপরে।
একে এককথায় কী বলা যেতে পারে?
গামহার একটু ভেবে বলল, আরণ্য।
বাঃ।
সত্যি! আগে যে কেন আসিনি। এবার থেকে চিকুদা অথবা জারুল যেখানেই যাবে, আমি সঙ্গে যাব। আমার তো কোনো পিছুটান নেই। আমি রুপোর দাঁড়ে-বসা, অন্ধকার উঠোনের কাকাতুয়া। দম বন্ধ হয়ে আসে।
পিছুটান তো আমারও নেই। সামনের টানও ছিল না কিছুই। সাম্প্রতিক অতীত থেকে মনে হচ্ছে, একটা সামনে-টান এর ইঙ্গিত মিলছে। শেষপর্যন্ত কী হয় তা অবশ্য এখনও বলা যাচ্ছে না।
মানে?
মানে সামনে যদি কেউ টানে, তবে তার সঙ্গেই ভেসে পড়ব আর কী। ভাবছি, জঙ্গলে এলে এরপর থেকে রঙ, তুলি, কাগজ সব নিয়ে আসব। তুমি কি আসবে আমার সঙ্গে?
আনবেন না গামহারদা।
কেন একথা বলছ?
আপনি তো সুরিয়্যালিস্ট আর্টিস্ট। এখানে রঙ-তুলিই যদি বয়ে আনবেন তাহলে আপনার সঙ্গে ওয়ার্ল্ড-লাইফ-ফোটোগ্রাফার জারুল-এর তফাৎ রইল কি? ক্যামেরা যা দেখতে পায় না, আপনার চোখ তো সেইটুকুই দেখবে।
ঠিকই বলেছে তুমি। চমৎকার বলেছ। এইসব ছবিকে মনের মধ্যে জলছবির মতো বসিয়ে নিয়ে ফিরে যেতে হবে। তারপর একটু ঘষে, একটু মেজে, একটু রহস্য যোগ করে। বাস্তব আর অবাস্তবের মিশেল দিয়ে নতুন সব সৃষ্টি করব আমি। ভাবছি জুনিপার এবার ফিরে এসে আমার নতুন ছবি গুলি দেখে কী যে বলবে। বলবে, তুমি নিজেকে নবীকৃত করেছ।
জুনিপার আপনাকে খুব ভালবাসে, না?
মিথ্যে বলব না। বাসে। কিন্তু ওদের ভালবাসাটা অন্যরকম ভালবাসা। তা নিয়ে তোমার বা আমার চিন্তিত হবার কিছু নেই।
তাই?
তাই।
তারপরে ঝাঁঝি বলল, তাই তো করা উচিত। নতুন সৃষ্টি যিনি না করতে পারেন তাকেও কি সৃষ্টিশীল বলা চলে?
আমরা এখন কোনদিকে যাব?
চলো, ওদের পিছু পিছুই যাই। দূর থেকে দেখব।
কিছুক্ষণ পরে সেই বাথুরীরা একটা পায়েচলা পথ দিয়ে পাহাড়ে উঠে জোরান্ডার কালো খাড়া পাথরে ঘেরা গিরিখাতের পাশের একটা উঁচু পাহাড়চুড়োতে গিয়ে নীচের গিরিখাতের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে করজোড়ে গান ধরল। গান তো নয়, যেন স্তোত্র, যেন উপনিষদের শ্লোক। কিন্তু ওড়িয়াতে।
‘পূর্ণরূপ পরমব্রহ্ম হে বড়াম ঠাকুর
অত্রাহি ভঞ্জন প্রভু জগত্তর ঈশ্বর।
নাহি রূপ নাহি বর্ণ অলংকার ঠাকুর,
তুম রূপ বর্ণিবাক নুহে মোর অন্তর’
ইত্যাদি…
গামহার বলল, এসো, এই পাথরটার উপরে বসি। আহা! কী অপূর্ব প্যানোরোমিক ভিউ। জাপান বা আমেরিকার কোনো নবতম ক্যামেরার প্যানোরোমিক বা ওয়াইডঅ্যাঙ্গল লেন্স দিয়েও এই ছবি তোলা যাবে না। এ শুধু মানুষের চোখই দেখতে পারে। আজ সন্ধেবেলার এই রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ ক্যামেরা কোথা থেকে পাবে? কোনদিন যদি পায়ও তবেও তা চোখের সমতুল কখনওই হবে না।
ওরা গানটি গেয়েই চলেছিল, সমবেত কণ্ঠে। গভীর আবেগের সঙ্গে। স্তব্ধ হয়ে শুনছিল ওরা দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
গামহার বলল, আমি একটি ব্রহ্মসঙ্গীত জানি তার সঙ্গে এই গানটির আশ্চর্য মিল আছে।
কী গান? আপনি ওদের ওই গানের মানে বুঝতে পারছেন?
কিছুটা পারছি বইকি। থ্যাঙ্কস টু কুমুদিনী। যে গানটির কথা বললাম, সেটি নিমাইচরণ মিত্রর লেখা, ‘কেন ভোলো মনে করো তারে, যে সৃজন পালন করেন এ সংসারে।‘ ব্রহ্মসঙ্গীত।
তারপর বলল, লেখা নিমাইচরণ মিত্রর বটে, কিন্তু এটি উপনিষদেরই একটি শ্লোকের হুবহু তর্জমা।
কোন উপনিষদ?
শ্বেতাওরপনিষৎ। উপনিষদ পড়েছ নাকি তুমি?
আমি তো দর্শনের ছাত্রী ছিলাম। সংস্কৃত ও বাংলাতেও এম এ করেছিলাম। এখন ধর্ষণের ছাত্রী।
বল কী? তিন তিনটে এম এ। নাঃ তোমাকে প্রণাম করতে হবে। একটু পরে করব।
যাই বলুন বাংলায় এম এ করলে কী হবে, আমার মাথা থেকে ‘আরণ্য’ শব্দটি বেরুতো না। আপনিই কি তৈরি করলেন শব্দটি?
গামহার হেসে বলল, ভালই বলেছ। আমি তো বি.কম, ফেল। তারপরে আর্ট স্কুল থেকে সাধারণভাবে পাশ করা ছেলে। শব্দ বানাব এমন যোগ্যতা কি আমার আছে? কলকাতাতে ফিরে অভিধান দেখো। ‘আরণ্য’ শব্দটি তো থাকা উচিত তাতে। এর আগে কোন বাঙালি কবি-সাহিত্যিক হয়তো ব্যবহার করেননি এই শব্দ। তাই হয়ত নতুন বলে মনে হচ্ছে তোমার।
ওরা গান শুরু করার আগে একটু যজ্ঞ মতো করেছিল। সম্ভবত বোমদেব-এর পুজোর আগের সন্ধিপুজো। তাতে শঙ্খ বেজেছিল বারেবারে। গান শেষ হলে ওরা সেই যজ্ঞের আগুন সযতনে পাথরে ঘিরে দিল যাতে আগুন ছড়িয়ে যেতে না পারে। তারপর শোভাযাত্রা করে নয়, দল ভেঙে একজন দু’জন করে নেমে যেতে লাগল পাহাড়চুড়ো থেকে।
রাজা গামহারদের দেখতে পেয়ে বললেন, পুরো অন্ধকার হয়ে গেলে এখানে না-থাকাই ভাল কিন্তু।
কেন বলুন তো? হাতি?
না, না, হাতি এই দু’দিন আসবে না। জোরান্ডার এই গিরিখাতে নানা রহস্য আছে। দেবতা যেমন আছেন অপদেবতাও আছে অনেক।
তাই? কিন্তু আজ তো অন্ধকার থাকবে না। ঐ দেখুন পুবাকাশে চাঁদ এখুনি উঠে পড়েছে আর সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের পিঠে স্থির দাঁড়িয়ে ছুটি চাইছে। নেমে যাবে এখনই। তারপরই তো ফুটফুট করবে জ্যোৎস্না।
রাজা একমুহূর্ত দাঁড়ালেন। বললেন, যে-ভয়ের কথা বলছি, চাঁদনি রাতেই সে ভয় বেশি।
বলে, রাজাও নেমে গেলেন।
ঝাঁঝি বলল, কী শুনলেন? বুঝলেন কিছু?
শুনলাম। কিন্তু বুঝলাম না। গিরিখাদের রহস্যের চেয়েও বেশি রহস্যময় মনে হচ্ছে রাজার কথা।
আমারও তাই মনে হয়। চাঁদনি রাতেই অপদেবতার ভয় বেশি।
কিন্তু উনি তো অপদেবতার কথা বললেন না শেষ বারে। অন্য কোনো ভয়ের কথা বললেন।
সেইটাই তো রহস্য।
আপনার একটা কার্ড কিন্তু আজ অবধি আমাকে দেননি গামহারদা।
কার্ড দিয়ে কী করবে। আমি অপদেবতা হয়ে হারিতের কাছ থেকে তো বটেই নবেন্দুর কাছ থেকেও তোমাকে ছিনিয়ে নেব। আসবে আমার কাছে? থাকবে? আমি গান গাইতে গাইতে ছবি আঁকব আর তুমি সঙ্গে সঙ্গে গাইবে।
আর সুন্দরী ফরাসিনী জুনিপার? সে যখন আসবে?
এলে আসবে।
তারপরে বলল, কেন? তুমিও কি হারিতেরই মতো নাকি? আমাকে তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবে না, যদি তেমন প্রয়োজন ঘটে? আমাদের ভালবাসার ক্ষমতা কি এতোই সীমিত যে, একজনকে দিয়েই তা ফুরিয়ে যাবে?
যাবে না। তবে কথাটা আমার বেলাও খাটবে তো?
অবশ্যই। তুমিও নবেন্দুর সঙ্গে আমাকে…
নবেন্দুর কথা বলবেন না। হরিমতি যার স্ত্রীর নাম, যে দশ লাখ টাকা পাবে বলে বছর বছর স্ত্রীকে গর্ভবতী করে, তেমন পুরুষের নামও আমার কাছে উচ্চারণ করবেন না গামহারদা। আমার রুচি বলে একটা ব্যাপার আছে। আশ্চর্য! এখনও আছে।
আমিও নবেন্দুকে অপছন্দ করি। মানে করেছি, প্রথম দর্শনের ক্ষণ থেকেই।
কেন বলুন তো?
প্রথমত কোনো পুরুষ বগল-দেখানো জামা পরলে আমার সমস্ত শরীর চিড়বিড় করে ওঠে। আর দ্বিতীয়ত ও তোমাকে ভালবাসে বলে।
খুব জোরে হেসে উঠল ঝাঁঝি। তারপরে বলল, আর মেয়েরা যদি…
যদি দেখবার মতো বগলতলি হয় তবে অবশ্যই দেখব। আমি আর্টিস্ট। কিন্তু কী দেখাবার আর কী দেখাবার নয়, এই সহজ বুদ্ধিটুকু যে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের নেই, সেই পুরুষ এবং স্ত্রীকে কি বলি?
ঝাঁঝি চুপ করে ছিল।
হঠাৎই বলল, এখন আর কথা বলবেন না, প্লিজ।
সামনে চেয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল ওরা দুজনেই। বিদায়ী সূর্যের শেষ আভা আর নবাগতা চাঁদের চাল-ধোওয়া সাদা আলোর মিশ্রণে যে এক ঐশী ঔজ্জ্বল্যর সৃষ্টি হয়েছিল সমস্ত অঞ্চল জুড়ে, তার বর্ণনা দেয়, অমন ভাষার জোর ওদের দুজনের কারোরই ছিল না। স্তব্ধ হয়ে সামনে চেয়েছিল ওরা। নির্বাক, নিস্পন্দ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যর অভিঘাত যে এমন মারাত্মক হতে পারে তা ওরা কাল রাত থেকেই বুঝছে কিন্তু এখনকার মতো সেই বোধ আগে তীব্র হয়নি।
গিরিখাতের অন্য প্রান্তে দাবানল লেগেছে পাহাড়ে। এই স্নিগ্ধ উজ্জ্বল আলোর মধ্যে অঙ্গার-লাল দাবানলের আলোর মালা জড়িয়ে-মড়িয়ে গেছে পাহাড়চুড়োয়। সেই ঘনকৃষ্ণ বৃক্ষহীন রুক্ষ গম্ভীর পাহাড়ই শুধু জানে, কার সঙ্গে মালা বদল করবে সে।
ঝাঁঝি স্বগতোক্তি করল, ওরা কি এখনও ঘুমোচ্ছে, না কি মদ খাচ্ছে? এই দুই কর্ম করতে এতদূরে কেন যে আসা! মহীনের বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারলেই তো যথেষ্ট।
সে কথা তো পরশু রাতে চিকুও বলছিল হারিতকে। তাই নয়?
হ্যাঁ।
হঠাই গামহার-এর গলাতে কাঠিন্য লাগল।
সে আদেশের সুরে বলল, শোনো ঝাঁঝি, তুমি এই সামনের পাথরটার আরেকটু উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ অনাবৃত করো।
অ্যাঁ?
অবিশ্বাস এবং আতঙ্ক-মিশ্রিত গলাতে বলল, ঝাঁঝি।
তারপর বলল, গামহারদা, আপনি কি পাগল?
পাগল নই। সেয়ানা-পাগলও নই। আমি আর্টিস্ট। এই ঐশী প্রকৃতির মাঝে আমি তোমাকে একবার পরিপূর্ণভাবে দেখতে চাই। তোমার নগ্নিকা মূর্তিকে।
আমার গায়ে আপনি আঙুল ছোঁওয়াবেন না?
না ঝাঁঝি। আমি আর্টিস্ট। শুধু চোখ ছোঁয়াব। রাজা বৃন্দাবন মহাপাত্রর ভাষায় বললে বলতে হয়, আমি যদি অপদেবতা হতাম ঝাঁঝি, তাহলে তোমাকে এই শিলাসনে গর্ভবতী করতে পারতাম। কিন্তু আমি যে আর্টিস্ট। আমি দেবতা। তোমাকে নিয়ে আবার আসব এখানে অন্য এক পূর্ণিমায়।
তুমি আমাকে একটি সন্তান দেবে গামহারদা? তুমি আমাকে ওই চাড্ডাকান্টেন্ট-এর হাত থেকে মুক্তি দেবে?
দেব।
তাহলে, তাড়াতাড়ি করো। আমার বয়স বেয়াল্লিশ।
ঝাঁঝি বলল।
পাগলি। আমার বয়স ছাপ্পান্ন। তাড়াতাড়িই করব।
ছেলে হলে কি নাম দেবে?
কদম।
আর মেয়ে হলে? কুসুম।
বাঃ।
এখন দেরী কোরো না। প্লিজ তাড়াতাড়ি করো। এসব জঞ্জাল খুলে ফেলল। ভারমুক্ত হও। জন্মদিনের পোশাকে ফেরো।
দু-মিনিটের মধ্যে ঝাঁঝি বিবস্ত্র হয়ে গামহারের দিকে পাশ ফিরে দাঁড়াল। বলল, আন্ডিও খুলতে হবে?
সবই খুলবে। তোমার নগ্নতার পূর্ণতা আমি এই দেবদুর্লভ মুহূর্তে তোমাকে দেখতে চাই।
হাল্কা মেরুন রঙা অ্যান্ডিটিও খুলে ফেলল ঝাঁঝি। কালো পাথরে পড়ে রইল।
ওর মনে হল, ঝাঁঝির নগ্নিকা রূপ যেন স্নিগ্ধ ফানুসের মতো চাঁদকেও হলুদ হারিয়ে দিল সৌন্দর্যে। তার অনাবৃত পিঠের পরে মেঘরাশির মতো কেশভার মেলে দিল। সামান্য নত স্তনদ্বয়। একজোড়া পরিযায়ী হাঁসের মতো, উড়ুউড়ু। তার জঘন যেন আষাঢ়ের কালো মেঘাচ্ছাদিত উপবন।
গামহার-এর মনে হলো, যেন সিমলিপাল পাহাড়শ্রেণীর বাটুলি দুর্গর উপরেই তারা দু’জনে দাঁড়িয়ে আছে, আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে। ও বাথুরিদের রাজা। আর ঝাঁঝি রানী।
চাঁদ ও সূর্যের সেই দো-আঁশলা আলো ধীরে ধীরে ঝাঁঝিকে উজ্জ্বলতর করে তুলতে লাগল। তারপর একসময়ে সূর্য অদৃশ্য হলো পাহাড়ের ওপারে। অদৃশ্য হলো তার সব চিহ্ন। তখন রাত রুপোঝুরি। ঝাঁঝির উরুমূলের মেঘের ছায়াতেও রুপোচুর লাগল। গামহার এগিয়ে গেল ঝাঁঝির দিকে। ঝাঁঝির চোখে রুপোলি আতঙ্ক দেখা দিল। কিন্তু গামহার দাঁড়িয়ে-থাকা ঝাঁঝির পায়ের কাছে জোড়াসনে বসে তার শরীর স্পর্শ না করে তাকে ভক্তিভরে প্রণাম করল। তারপর উবু হয়ে তার জড়ো-করা পায়ের পাতাতে সোহাগভরে চুমু খেল।
এ কী? একী! কী যে করেন আপনি!
এই তো!
এই তো মানে?
সৌন্দর্যকে পুজো করল শিল্পী, চিরন্তন নারীকে, চিরন্তন পুরুষ।
তারপর বলল, নাও, এবারে সব পরে নাও।
ঝাঁঝি বলল, গামহারা আমার বাবাও চিত্রী ছিলেন, কিন্তু মনে হয় আপনার মতো এতো বড় ছিলেন না। আপনি জাত শিল্পী। জীবনে আপনাকে অনেকদূর যেতে হবে কিন্তু।
আমি বজ্জাত শিল্পী। কোথাওই যাব না আমি। তোমার সামনে তোমার পায়ের কাছে। বসে শুধু তোমারই মুখের দিকে চেয়ে থাকব।
ঝাঁঝি তৈরি হয়ে বলল, চলুন।
গামহার বলল, তোমাদের পরম সৌন্দর্য তো তোমাদের নগ্নতাতেই। তবু অত যত্ন করে এত কিছু পরো যে কেন, তা তোমরাই জানো।
চলো, আমার হাত ধরো। আজ থেকে তোমাকে নিজেকে আর পথ দেখে চলতে হবে না।
আবার আমরা কবে আসব এখানে? ঘোর-লাগা গলাতে বলল, ঝাঁঝি।
শ্রাবণী পূর্ণিমাতে। যখন কদম ফুলে ছেয়ে যাবে পথ, এখন যেমন ছেয়েছে শিমুলে পলাশে। এখানে নয়, সেবারে যাব বাটুলি দুর্গে।
খুঁজে বের করতে হবে তো সে দুর্গ।
সে, আমি আগে এসে খুঁজে বের করে যাব। তোমাকে নিয়ে আসব পরে। বাটুলি দুর্গের মাথাতে একদিকে কদম আর একদিকে কুসুম গাছের পাহারাতে শ্রাবণী পূর্ণিমার রাতে তোমার গর্ভাধান করব।
বলেই বলল, খুশি তো তুমি? ঝাঁঝি?
খু-উ-ব। এতবছর কোথায় লুকিয়ে ছিলেন আপনি গামহারদা?
তুমিই বা কোথায় ছিলে? কতপথ হেঁটে এলাম একা একা।
সময়ে সব হয়। সময়কে সময় তো দিতেই হয় ঝাঁঝি। তুমি কি Walt Whitman পড়েছ? Leaves of Grass?
না।
তোমাকে আমি উপহার দেব।
“All truths wait in all things,
They neither hasten their own delivery nor resist it,
They do not need the obsteric forceps of the Surgeon.”
বাঃ।
ঝাঁঝি বলল, গামহারের হাতে হাত রেখে নামতে নামতে।
ঝাঁঝি বলল, এখন যদি হারিত কান্বখুণ্টা সাপ হয়ে পথে শুয়ে থাকে?
গামহার হাসল। বলল, হারিত ছেলে ভাল। তবে তোমার সঙ্গে মেলেনি এই যা। তুমি ওকে ছেড়ে এলে ওর হয়ত ভালই হবে। ও হরিমতিরই মতো কোনো বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে শ্বশুরের পয়সার জন্যে স্ত্রীকে বছর-বিয়োনি করবে।
আর নবেন্দু?
গামহার বলল।
এমন সুন্দর সন্ধেবেলাতে ওর নাম কোরো না। রাগ হয়ে যায়। ঝাঁঝি বলল।
আমার একটাই ভয়।
গামহার বলল।
কি?
হারিত ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস-এ নালিশ করে দেবে না তো আমার নামে।
খিলখিল করে হেসে উঠল ঝাঁঝি।
চাঁদের আলো, গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে এসে পথে পড়েছে। গামহারের মনে পড়ল, বিভূতিভূষণের আরণ্যকে পড়েছিল আলো-ছায়ার বুটিকাটা গালচের কথা। এতোবছর পরে তা প্রত্যক্ষ করে ভাললাগাতে ভরে উঠল। তারপর ও স্বগতোক্তি করল, কীওরোস্কীওরো।
কি বললেন?
কীওয়োস্কীওবো।
মানে কি?
তুমি কখনও রেমব্রান্টের এর ছবি দেখেছ?
প্রিন্ট দেখেছি।
ওরিজিনাল কি আমিই দেখেছি নাকি?
কেন এই প্রশ্ন?
ছবিতে আলোছায়ার ব্যবহারশৈলিকে বলে কীওরোস্কীওরো। বানানটা হচ্ছে Chiaroscuro, এতোদিন রেমব্রান্টকেই কীওয়োস্কীওয়োর মাস্টার বলে জানতাম। আজ জানলাম, তিনিও ছাত্ৰই। আসল মাস্টার প্রকৃতি। ঈশ্বর। চাহালা থেকে জৈারাভা আসতে আসতে সকালেই এই কথাটি আমার মনে হচ্ছিল। এই রাতে, সেই মনে হওয়াটা প্রত্যয়ে এসে পৌঁছল।
ওরা সমতলে নেমেই দেখল জোরান্ডা বাংলো থেকে হেডলাইট জ্বেলে দুটি গাড়িই বেরোচ্ছে।
পাছে ওরা ঘুরে মরে ওদেরই খোঁজে তাই গামহার তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে পথের মাঝখানে দাঁড়াল।
দুটি গাড়িই থেমে গেল।
পরস্ত্রীর সঙ্গে গেছিলে কোথায় চাঁদনী রাতের আড়ালে-আবডালে?
চিকু বলল।
জারুল হাসছিল।
বলল, যেমন ভ্যাবলা-ভ্যাবলা ভান করে থাকেন আসলে তেমন তো নন আপনি গামহারদা! এদিকে হারিত তো খাদে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল।
গামহার বলল, রাজা বললেন এখানে না কি অনেকই অপদেবতা আছেন। পাছে পরস্ত্রীকে তারা গর্ভবতী করে দেয়, তাই পাহারা দিচ্ছিলাম।
নবেন্দু বিদ্রুপের গলাতে বলল, গামহারদার বয়স হলে কী হয়, খুব শিভালরি আছে। রস তো আছেই।
যার স্ত্রীকে নিয়ে সে হারিয়ে গেছিল, সেই হারিত গাড়ি থেকে নেমেই এগিয়ে এল।
গামহার ভাবল, এই পড়ল বুঝি ঘুষি তার নাকে।
কিন্তু না। হারিত বলল, সেই জাপানী সানটোরি না পানটোরী হুইস্কিটা কী হল গামহারদা? আমাদের পুনর্জন্ম সেলিব্রেট করতে হবে না! সে জন্যেই আমাদের তোমাকে খুঁজতে বেরোতে হলো। তোমার ব্যাগের চাবিটা তো দিয়ে যাবে অন্তত যাবার আগে।
সরি, হারিত। চলো, এখুনি বের করে দিচ্ছি।
গামহার উঠল নবেন্দুর গাড়িতে আর ঝাঁঝি, চিকুর গাড়িতে।
গামহার ভাবছিল, হারিত শব্দর মানে অপহারিত। টাকার হিসাব, কম্পিউটার, আর মদ আর তাস তাকে অপহরণ করে নিয়েছে অনেকইদিন হলো। হারীত যার নাম সে তো হারবেই! এই আরণ্য কাকে হারায় আর কাকে জেতায় তা সেই শুধু জানে। আর হয়ত জানেন বাথুরীদের বোম ঠাকুর।