স্কুল থেকে টেলিফোন পেয়ে আব্বু আর আম্মু দুজনেই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, তাদের তিনজন ছেলেমেয়ে এই স্কুলে পড়ে, তাই প্রথমেই তাদের মনে হয়েছে যে তাদের কারও কিছু একটা হয়েছে। স্কুল থেকে বলা হল তার ছেলেমেয়ের কারও কিছু হয়নি, তাদের ডাকা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য কোনো কারণে। কারণটা কী টেলিফোনে তাদের বলা হয়নি, কিন্তু আব্বু বা আম্মু কারোই কারণটা অনুমান করতে কোনো সমস্যা হয়নি।
স্কুলে এসে প্রিন্সিপালের অফিসে ঢুকে দেখলেন তাদের অনুমান সত্যি। প্রিন্সিপাল তাদের দুইজনকে দেখে মুখটা কালো করে ফেললেন, তারপর হতাশভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগলেন। প্রিন্সিপাল সাইজে ছোট, ধড়ের ওপর মাথাটা সরাসরি বসানো এই বর্ণনাটা তাদের ছেলেমেয়ের কাছ থেকে অনেকবার শুনেছেন, আজকে নিজের চোখে দেখলেন।
আবু বললেন, “স্কুল থেকে আমাদের দুইজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। আপনারা গাব্বুর বাবা-মা?”
“জি।”
“বসেন।”
আব্বু আর আম্মু বসলেন। আব্বু কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে বললেন, “আপনি আমাদের কেন ডেকে পাঠিয়েছেন আমরা বিষয়টা একটু অনুমান করতে পারছি। বিষয়টা নিশ্চয়ই গাকে নিয়ে তার কোনো একটা এক্সপেরিমেন্ট”
প্রিন্সিপাল আব্বুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না, না। আপনাদের সবকিছু জানা দরকার। নিজের চোখে দেখা দরকার, নিজের কানে শোনা দরকার। বাবা-মায়েরা সবসময় ভাবে তাদের ছেলেমেয়েরা হচ্ছে ফিরেশতা, তারা কোনো ভুল করতে পারে না। তাদের ধারণা, আমরা শিক্ষকেরা তাদের ছেলেমেয়েদের ওপর অবিচার করি।”
আব্বু বললেন, “না, না। আমরা কখনোই সেটা ভাবি না।”
প্রিন্সিপাল গলা উঁচিয়ে বললেন, “ভাবেন। নিশ্চয়ই ভাবেন। সেই জন্যে আমি আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছি। নিজের চোখে দেখেন, নিজের কানে শোনেন আপনার ছেলে কী করেছে।”
আম্মু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে গাব্বু?”
প্রিন্সিপাল একটা কাগজ তুলে বললেন, “এই যে এখানে লেখা আছে। শুধু আজকের ঘটনা, এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়–ছয়টা ঘটনা। বলতে পারেন ছয়টা ক্রিমিনাল অফেন্স।”
আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “ক্রিমিনাল অফেন্স?”
“অবশ্যই। আপনার ছেলে যদি ছোট না হয়ে বড় হত তা হলে এতক্ষণে পুলিশ ধরে নিয়ে যেত।”
আম্মু খাবি খেলেন, “আমাদের গাব্বুকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেত?”
“আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। নিজের চোখে দেখেন, নিজের কানে শোনেন।” প্রিন্সিপাল স্যার তখন গলা উঁচিয়ে একজন মানুষকে ডেকে বললেন রওশন ম্যাডাম, তার ক্লাসের ছেলেমেয়ে আর গাকে ডেকে আনতে।
কিছুক্ষণের মাঝেই প্রথমে গাব্বু, তার ক্লাসের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে এবং সবার শেষে রওশন ম্যাডাম প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকলেন। রওশন ম্যাডাম একটা চেয়ারে বসলেন। গাব্বু এবং তার ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে এক কোনায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রিন্সিপাল স্যার গলা উঁচিয়ে বললেন, “গালু, তুমি মাঝখানে দাঁড়াও।”
গাব্বু মাঝখানে দাঁড়াল, সে তার বড় চশমার ভেতর দিয়ে ভয়ে ভয়ে একবার আব্বু-আম্মুর দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেলল।
আব্বু বললেন, “এই ছেলেমেয়েদের এখানে ডেকে আনার কোনো দরকার ছিল না। আপনার যা বলার কথা সোজাসুজি আমাদেরকে বলতে পারতেন।”
প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “না। আমি চাই সবাই শুনুক। জানুক। আমাদের কী সমস্যা হচ্ছে সেটা আপনারা সবাই জানেন।”
“আমি খুবই দুঃখিত যে আমার ছেলের কারণে আপনার স্কুলে সমস্যা হচ্ছে। আমি কথা দিচ্ছি আমি ব্যাপারটা দেখব।”
আম্মুও মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ। আমরা ব্যাপারটা দেখব।”
“সেটা পরের ব্যাপার। আগে দেখা যাক তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ রয়েছে।” প্রিন্সিপাল স্যার কাগজটা তার নাকের কাছে নিয়ে পড়লেন, “এক-দুই তিনজনকে সে ব্যথা দিয়েছে।”
আম্মু চমকে উঠলেন, “ব্যথা দিয়েছে?” আম্মু গাব্বুকে খুব ভালোভাবে জানেন, তাকে নিয়ে হাজার রকম যন্ত্রণা থাকতে পারে, কিন্তু সে কাউকে ব্যথা দিতে পারে সেটা তিনি কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারেন না। বললেন, “গাব্বু কাউকে ব্যথা দিতে পারে সেটা আমার বিশ্বাস হয় না।”
প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি নিজেই আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু, তুই কাউকে ব্যথা দিয়েছিস?”
গাব্বু দুর্বল গলায় বলল, “আম্মু, ব্যথা দিয়েছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে?”
“কী এক্সপেরিমেন্ট?”
গাব্বু এক্সপেরিমেন্টটা ব্যাখ্যা করল, কেন কীভাবে চিমটি দিয়েছে সেটা বোঝালো। সবকিছু শুনে আব্বু বলল, “তাই বলে তুই একজনকে ব্যথা দিবি?”
প্রিন্সিপাল স্যার মনে করিয়ে দিলেন, “একজনকে নয়। তিনজনকে। দুইজনকে চিমটি, একজনকে রুলার দিয়ে গুঁতো।”
গাব্বু নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। বোঝা গেল অভিযোগ সত্যি। প্রিন্সিপাল স্যার কাগজ দেখে বললেন, “দ্বিতীয় অভিযোগ অনেক গুরুতর। তুমি একটা মেয়ের মাথার চুল কেটে নিয়েছ?”
গাব্বু কোনো কথা বলল না। প্রিন্সিপাল স্যার ধমক দিয়ে বললেন, “কথা বল।”
গাব্বু তখন কথা বলল, “হাইগ্রোমিটার বানানোর জন্যে আমার লম্বা চুল দরকার। কেউ দিতে রাজি হয় না, তখন ফারিয়াকে অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়েছি।”
“আর তার মাথার চুল কেটে নিয়েছ?”
“সব না। অল্প কয়েকটা।”
“মোটেও অল্প কয়েকটা না, এক খাবলা চুল কেটে নিয়েছ। আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
গাব্বু একটা নিশ্বাস ফেলল, “যখন কাটছিলাম তখন নড়ে উঠল, তাই–”
“কার চুল কেটেছ? নাম কী?”
“ফারিয়া।”
“ফারিয়া কোথায়? সামনে এসো।”
ফারিয়া সামনে এসে দাঁড়াল। প্রিন্সিপাল স্যার হুংকার দিলেন, “তোমার মাথার কাটা চুল দেখাও।”
ফারিয়া ভয়ে ভয়ে তার মাথার চুল সরিয়ে দেখাল এক জায়গায় এক খাবলা চুল নেই। গাব্বু বলল, “ফারিয়া তুই চাইলে আমি তোর চুলগুলো তোকে দিয়ে দিতে পারি।”
ফারিয়া বলল, “আমি কাটা চুল দিয়ে এখন কী করব?”
প্রিন্সিপাল কাগজটা আবার তুললেন, “এর পরের অভিযোগটা আরও গুরুতর। গাব্বু ক্লাসের এক ছাত্রীকে এমন ভয় দেখিয়েছে যে মেয়েটা প্রায় মেন্টাল কেস হয়ে গেছে।”
আব্বু-আম্মু কথাটা শুনে এত অবাক হলেন যে বলার মতো না। তারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালেন।
প্রিন্সিপাল স্যার ডাকলেন, “যে মেয়েটিকে ভয় দেখিয়েছে সে কোথায়? সামনে এসো।”
রত্না দুই পা এগিয়ে গেল। প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “এবারে বল কী হয়েছে। কোনোকিছু বাদ দেবে না।”
রত্না কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিন্সিপাল স্যার হুংকার দিলেন, =!!”কী হল? কলাগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কথা বল।”
রত্না তখন শুরু করল, “ক্লাসের সবাই জানে আমি মাকড়সাকে খুব ভয় পাই। খু-উ-ব বেশি ভয় পাই। গাব্বু সেটা জানে। সকালবেলা এত বড় একটা মাকড়সা হাত দিয়ে ধরে আমার মুখের সামনে ধরেছে।”
প্রিন্সিপাল স্যারের চোখগুলো আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকে। রত্নাকে বললেন, “কী হয়েছে? থামলে কেন? বল। বলতে থাকো।”
রত্না বলল, “মাকড়সাটা যখন ধরেছে তখন আমি ভয়ে চিৎকার করছি। আর গাব্বু তখন বলছে তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার–”
গাব্বুর মুখ হঠাৎ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেরেছে! পেরেছে!”
প্রিন্সিপাল স্যার ভুরু কুঁচকে তাকালেন, “কী পেরেছে?”
“পাইয়ের মান দশমিকের পর নয় ঘর পর্যন্ত বলতে পেরেছে। আগে পারত না।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ?”
গাব্বু বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল, “রত্না অনেক বার বলেছে সে কিছু মনে রাখতে পারে না। চেষ্টা করলেও ভুলে যায়। আমি তখন তাকে বলেছি আমি তাকে মনে রাখা শিখিয়ে দেব, পাইয়ের মান নয় ঘর পর্যন্ত সে মনে রাখতে পারবে। এখন দেখেছেন স্যার সে নয় ঘর পর্যন্ত গড়গড় করে বলে গেল।”
প্রিন্সিপাল স্যার মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “তার সাথে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখানোর কী সম্পর্ক?”
গাব্বু অনেকটা লেকচার দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “মানুষ যখন ভয় পায় তখন ব্রেনের যে অংশটা কাজ করে তার নাম হচ্ছে এমিগডালা। ভয় পাওয়ার সময় যে ঘটনা ঘটে মানুষের ব্রেন সেটা খুব ভালো করে মনে রাখতে পারে। সেই জন্যে আমি রত্নাকে যখন পাইয়ের মানগুলো বলছিলাম তখন একইসাথে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখাচ্ছিলাম। এমিগডালা কাজ করেছে স্যার, রত্নার সব মনে আছে। সাকসেসফুল এক্সপেরিমেন্ট।”
প্রিন্সিপাল স্যার চোখ লাল করে বললেন, “তুমি বলতে চাও যে এত বড় একটা অন্যায় করেও তোমার ভেতরে কোনো অপরাধবোধ নেই?”
গাব্বু ইতস্তত করে বলল, “স্যার, এইটা একটা সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট ছিল স্যার। অন্যায় ছিল না স্যার।”
“অন্যায় ছিল না? তা হলে এই লিস্টের শেষ ঘটনাটা কী ছিল? যখন তুমি তোমার ক্লাসরুমের পর্দায় আগুন লাগিয়ে দিলে? সারা স্কুলে হইচই ছোটাছুটি কেলেঙ্কারি? আমি নিজে জানালা থেকে এই ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা উদ্ধার করেছি।” কথা শেষ করে প্রিন্সিপাল স্যার ড্রয়ার থেকে বড় একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে দেখালেন। প্রিন্সিপাল স্যার হুংকার দিলেন, “কী ছিল সেই ঘটনা?”
গাব্বু বলল, “এইটাও সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট। আর একটু অ্যাকসিডেন্ট।”
“কোনটা এক্সপেরিমেন্ট? কোনটা অ্যাকসিডেন্ট?”
গাব্বু তখন তার নিজের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করল কীভাবে কনভেক্স লেন্সের বিষয়টা দেখানোর জন্যে সে একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করিয়েছিল, আর সেটা ভুলে যাওয়ার কারণে কীভাবে লেন্সের উপর রোদ পড়ে আগুন জ্বলে গিয়েছিল। সে বার বার করে বলল সে মোটেও ইচ্ছে করে করেনি, আগুন জ্বলে যাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু না।
প্রিন্সিপাল স্যার এরকম সময়ে গাব্বুর আব্বু আর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা তো নিজের কানে শুনলেন, নিজের চোখে দেখলেন। এখন আপনারাই বলেন এরকম একজন ছেলেকে কী আমার স্কুলের ছাত্র হিসেবে রাখা সম্ভব? না কী রাখা উচিত?”
আব্বু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি খুবই দুঃখিত। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর কখনো এরকম হবে না।”
আম্মুও সায় দিলেন, বললেন, “হ্যাঁ। আমরা কথা দিচ্ছি।” প্রিন্সিপাল স্যার শীতল চোখে কিছুক্ষণ তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তার জন্যে খুব দেরি হয়ে গেছে। আমি আপনাদের ডেকেছি আপনাদের ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।”
আব্বু অবাক হয়ে বললেন, “নিয়ে যাওয়ার জন্যে!”
“হ্যাঁ। নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আমি অফিসে বলে রেখেছি তারা আপনার ছেলের জন্যে টিসি টাইপ করছে। টিসিসহ আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে যান।”
প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরে যারা ছিল সবাই একসাথে চমকে উঠল। রওশন ম্যাডাম ব্যস্ত হয়ে বললেন, “এটা আপনি কী বলছেন স্যার? টিসি দেবেন কেন? একটু বকা দিয়ে ছেড়ে দেন। গাব্বু খুব ব্রাইট। লেখাপড়াতে ভালো। শুধু সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে নিজে বিপদে পড়ে, অন্যদেরও বিপদে ফেলে দেয়। এ ছাড়া তার আর কোনো সমস্যা নেই। ওকে কোনোভাবেই টিসি দিয়ে একেবারে স্কুল থেকে বিদায় করে দেওয়া ঠিক হবে না স্যার।”
রওশন ম্যাডাম যখন কথা বলছিলেন তখন সব ছেলেমেয়ে তার কথার সাথে সাথে মাথা নাড়তে লাগল। গাবুর কাজকর্মের কারণে তাদের নানারকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় সত্যি, কিন্তু তার জন্যে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে সেটা তারা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
প্রিন্সিপাল স্যার রওশন ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিসেস রওশন, আপনি একটা খুব বড় জিনিস মিস করে যাচ্ছেন। আপনি তো নিজেই দেখলেন তার বিরুদ্ধে একটা দুইটা না, ছয়টা অভিযোগ। যারা অভিযোগ করেছে তারা সবাই এখানে হাজির, কোনোটাই মিথ্যা অভিযোগ না। সব সত্যি। একেবারে হাতেনাতে প্রমাণিত। অথচ আপনার এই ছাত্র সেগুলোর জন্যে দুঃখিত না। তার ভেতরে কোনো অনুশোচনা নেই। শুধু যে অনুশোচনা নেই তা নয়, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তার ভিতরে এক ধরনের আনন্দ। সে আনন্দে হাসছে। হাততালি দিচ্ছে। আপনি চিন্তা করতে পারেন? আমি যদি নিজের চোখে না দেখতাম তা হলে বিশ্বাসই করতাম না যে আমার স্কুলে এরকম একজন ছাত্র আছে।”
রওশন ম্যাডাম আবার চেষ্টা করলেন, বললেন, “স্যার, প্লীজ ব্যাপারটা একটু। অন্যভাবে দেখেন। হি ইজ ভেরি ক্রিয়েটিভ।”
রত্না, মিলি আর ফারিয়াও গলা মেলাল, বলল, “মাফ করে দেন স্যার। আমরা আর কখনো নালিশ করব না।”
লিটন বলল, “জি স্যার মাফ করে দেন।”
রবিন বলল, “গাব্বুর মনটা খুব ভালো স্যার। শুধু একটু পাগলা টাইপের।”
প্রিন্সিপাল মাথা নাড়লেন, বললেন, “নো। হি হ্যাঁজ টু গো। তাকে এই স্কুল থেকে বিদায় হতে হবে। এখন আর তাকে রাখা সম্ভব হবে না। এই ছেলেকে আমাদের স্কুলের প্রয়োজন নেই।”
রওশন ম্যাডাম বললেন, “প্লীজ স্যার। আরেকটা সুযোগ দেন। ওয়ান লাস্ট টাইম।”
প্রিন্সিপাল স্যার গর্জন করে উঠলেন, “ইম্পসিবল! হি ইজ আউট। স্কুল থেকে বিদায়।”
ঠিক এরকম সময় একজন পিয়ন ছুটতে ছুটতে এল, চাপা গলায় বলল, “স্যার! পুলিশ!”
প্রিন্সিপাল স্যার চমকে উঠলেন, “পুলিশ? পুলিশ কেন?”
পিয়ন মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না স্যার।”
প্রিন্সিপাল স্যার জানালা দিয়ে তাকালেন, দেখলেন সত্যি সত্যি তার অফিসের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন পুলিশ নামছে।
প্রিন্সিপাল স্যার পুলিশ দেখেই নার্ভাস হয়ে গেছেন। যদি নার্ভাস না হতেন তা হলে দেখতে পেতেন পুলিশের গাড়ির পেছনে একটা দামি গাড়ি। সেখান থেকে যারা নামছে তাদের সবাইকে না চিনলেও একজনকে ঠিকই চিনতেন, দেশের সবাই কয়েকদিনে তাকে চিনে গেছে।
মানুষটি হচ্ছে বিজ্ঞানী রিফাত হাসান।
.
১০.
রিফাত হাসান ভোরবেলাতেই খবর পেয়ে গেলেন ডাবল ব্রাঞ্চিং ডাটাতে পেয়ার প্রোডাকশান নেই এরকম কেসগুলো আলাদা করে তাদের ডাটা এনালাইসিসের সময় দশ ভাগের এক ভাগ করে ফেলা গেছে। যার অর্থ এখন তারা দ্রুত তাদের কাজ শেষ করতে পারবেন, ইউরোপের একটা গ্রুপের সাথে তাদের প্রতিযোগিতা, সেই গ্রুপকে তারা এখন হেসে খেলে হারিয়ে দেবেন। রিফাত হাসানের মনটা ভালো হয়ে গেল এবং ঠিক করলেন ফিরে যাওয়ার আগে গাব্বুর সাথে একবার দেখা করে যাবেন। আধপাগল এই বাচ্চা সায়েন্টিস্টের সাথে তার যদি দেখা না হত তা হলে ডাটা এনালাইসিসের এই চমকপ্রদ পদ্ধতিটার কথা তার মাথায় আসত না। তবে সমস্যা একটাই, গাব্বুর এই বিচিত্র নামটা ছাড়া তার আর কিছুই তিনি জানেন না।
রিফাত হাসান তখন তখনই ইউসুফকে ফোন করলেন এবং ইউসুফ তাকে বলল সে গাব্বুকে খুঁজে বের করে ফেলবে। নাস্তা করে রিফাত হাসান বিকালে একটা ঢাউস গাড়ি নিয়ে বের হলেন, সামনে পুলিশের গাড়ি, তারা বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। গাব্বুর সাথে যেখানে দেখা হয়েছে সেই মাঠের আশেপাশে দোকানপাট বাড়িঘরে পুলিশ কথা বলল, নানা জায়গায় ফোন করল এবং তারা গাব্বুর স্কুলের নাম বের করে ফেলল। স্কুলের নাম বের করার পর কাজ খুব সহজ, রিফাত হাসান আবিষ্কার করলেন কয়েক মিনিটের মাঝে তারা স্কুলে চলে এসেছেন।
রিফাত হাসান গাড়ি থেকে নামতেই বেঁটে এবং কালো মতোন একজন মানুষ তার দিকে ছুটে এল। মানুষটির গলা নেই, ধড়ের ওপর মাথাটা সরাসরি বসানো। রিফাত হাসান বুঝতে পারলেন তাকে দেখে এই মানুষটির ব্রেন শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে এবং চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছে না। মানুষটি তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আ-আ-আ আমি এই স্কুলের প্রিন্সিপাল। স্যার, আ-আ-আপনি-আ-আ-আ আপনি?”
রিফাত হাসান প্রিন্সিপাল স্যারকে সাহায্য করলেন, বললেন, “জি। আমি। আমি রিফাত হাসান।”
“জানি স্যার। আ-আ-আপনাকে পরিচয় দিতে হবে না। স্যার। আ-আ আপনাকে সবাই চিনে স্যার। আ-আ-আপনি স্যার আমাদের স্কুলে! কী সৌভাগ্য স্যার। স্যার, আমার কী সৌভাগ্য! আমার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কী সৌভাগ্য স্যার!”
“সৌভাগ্যের কোনো ব্যাপার নেই। আর সত্যি কথা বলতে কী, সৌভাগ্য যদি কারও হয় তা হলে সেটা আমার।”
প্রিন্সিপাল বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “স্যার স্যার আসেন স্যার। আসেন স্যার আমার অফিসে।”
রিফাত হাসান প্রিন্সিপালের পেছনে পেছনে তার অফিসে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “আমি আসলে আপনার স্কুলের একজন ছাত্রকে খুঁজতে এসেছি।”
প্রিন্সিপাল স্যার অবাক হয়ে গেলেন, “আমার স্কুলের ছাত্র?”
“জি। তার ভালো নাম জানি না। কোন ক্লাসে পড়ে সেটাও জানি না। তার নাম হচ্ছে গাব্বু। তার সাইজ এরকম–” রিফাত হাসান হাত দিয়ে গাব্বুর সাইজ দেখালেন।
প্রিন্সিপাল স্যারের মুখ শক্ত হয়ে গেল, “কী করেছে গাবু? কোনো সমস্যা স্যার?”
রিফাত হাসান জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, বললেন, “না, না! সমস্যা হবে কেন? হি ইজ ইনক্রেডিবল। আমি তাকে কংগ্রাচুলেট করতে এসেছি। গতকাল তার সাথে আমার দেখা হয়েছে, সে তখন আমাকে এমন একটা আইডিয়া দিয়েছে যেটা ব্যবহার করে আমি আমার এক্সপেরিমেন্টের ডাটা এনালাইসিসে রীতিমতো বিপ্লব করে ফেলেছি। আমি আজ চলে যাব, তাই ভাবলাম যাওয়ার আগে তার সাথে দেখা করে যাই। তাকে কি একটু খুঁজে দেওয়া যাবে?”
প্রিন্সিপালের অফিসে জড়সড়ো হয়ে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল। যখন পুলিশের গাড়ি করে লোকজন গাব্বুকে খোঁজ করতে এসেছে তখন তারা ধরেই নিয়েছিল গাব্বু আরও বড় ঝামেলায় পড়েছে। যখন দেখল গাব্বু ঝামেলায় পড়েনি, বরং উল্টো গাব্বু খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছে, তখন তাদের গলায় জোর ফিরে এল। তারা গাব্বুকে ধরে চিৎকার করে বলল, “এই যে! এই যে গাব্বু!”
রিফাত হাসান এবার গাব্বুকে দেখতে পেলেন, সাথে সাথে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুই হাত ওপরে তুলে বললেন, “হ্যালো ডক্টর গাব্বু! আওয়ার ফেমাস সায়েন্টিস্ট প্রফেসর গাবু! হাউ আর ইউ?”
গাব্বু বলল, “আপনি কি রাত দশটায় টেলিপ্যাথি করেছিলেন?”
রিফাত হাসান মুখে গাম্ভীর্য টেনে বললেন, “অবশ্যই করেছিলাম।”
“আমি আপনাকে যেভাবে শিখিয়েছিলাম সেইভাবে?”
“ইয়েস স্যার, সেইভাবে।”
“কোনো ম্যাসেজ কি পেয়েছিলেন?”
“উঁহু। তুমি?”
গাব্বু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, “আমিও পাই নাই। আপনি কি ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন?”
“পাঠিয়েছিলাম।”
গাব্বু গম্ভীর মুখে বলল, “আবার চেষ্টা করতে হবে।”
“অবশ্যই আবার চেষ্টা করতে হবে।” রিফাত হাসান তখন গলার স্বর পাল্টে বললেন, “প্রফেসর গাব্বু, আজকে আমি অন্য কাজে এসেছি। আজকে আমি তোমাকে বলতে এসেছি যে তোমার আইডিয়াটা অলরেডি কাজে লাগানো হয়েছে। চমৎকারভাবে কাজ করছে এবং ওয়ান্ডারফুল ফিজিক্স বের হচ্ছে।”
গাব্বু জানতে চাইল, “কোন আইডিয়াটা? টিকটিকির ডাবল লেজ?”
“না না। সেটা এখনো শুরু করি নাই। অন্য আইডিয়াটা, যেটা আছে সেটা খুঁজে যেটা নাই সেটা খোজা।”
“ও।” গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “টিকটিকির ডাবল লেজ থিওরিটাও কিন্তু ভালো। মনে হয় কাজ করবে।”
প্রিন্সিপালের ঘরে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে গাবুর সাথে প্রফেসর রিফাত হাসানের কথা শুনছিল। গাব্বু এমনভাবে প্রফেসর রিফাত হাসানের সাথে কথা বলছে যেন দুজন সমবয়সি বন্ধু। কী সহজ একটা ভঙ্গি, কী আশ্চর্য!
রিফাত হাসান এবারে ঘুরে অফিস ঘরের অন্যদের দিকে তাকালেন। একটু হাসার ভঙ্গি করে বললেন, “আপনারা নিশ্চয়ই স্কুলের টিচার?”
রওশন ম্যাডাম বললেন, “জি। আমি গাব্বুর টিচার।” তারপর গালুর আব্বু-আম্মুকে দেখিয়ে বললেন, “আর এঁরা হচ্ছেন স্যার বাবা-মা।”
রিফাত হাসান চোখ বড় বড় করে বললেন, “ওয়ান্ডারফুল! শুধু যে গাব্বুর সাথে দেখা হল তা না। গাব্বুর বাবা-মায়ের সাথেও দেখা হয়ে গেল! চমৎকার!”
আবু-আম্মু কী বলবেন বুঝতে না পেরে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আম্মু বললেন, “কাল গাব্বু আপনার কথা বলছিল।”
“আমিও সবাইকে গাব্বুর কথা বলেছি।” রিফাত হাসান আম্মুর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, “ইয়াং সায়েন্টিস্ট একটা ওয়ান্ডারফুল জিনিস, কিন্তু বাবা-মায়ের বারোটা বেজে যায়!”
আব্বুও গলা নামিয়ে বললেন, “আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন।”
“আমার বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। একটু সহ্য করেন।”
আম্মু হাসার চেষ্টা করলেন, “আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু শুধু আমরা করলে তো হয় না–অন্যেরা আছে।”
রিফাত হাসান অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ এবং হঠাৎ করে প্রিন্সিপালের রুমে, গাব্বু গাব্বুর বাবা-মা, গাব্বুর ক্লাস টিচার, ছাত্রছাত্রী কেন হাজির হয়েছে তার কারণটা অনুমান করে ফেললেন। তিনি গাব্বুর দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু, তোমার খবর কী?”
গাব্বু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “খবর ভালো না।”
“ভালো না? সে কী! কেন?”
“আমাকে টিসি দিয়ে–”
প্রিন্সিপাল স্যার গাব্বুকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না, মাঝখান থেকে গলা উঁচিয়ে বললেন, “স্যার বসেন। একটু চা খান।”
“না, না, চা খেতে হবে না। আমি গাব্বুর কথাটা শুনি। তার কী সমস্যা?”
প্রিন্সিপাল স্যার গলা উঁচিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “কোনো সমস্যা নাই স্যার। কোনো সমস্যা নাই। আমি থাকতে গাব্বুর এই স্কুলে কোনো সমস্যা হবে আপনি বিশ্বাস করেন?”
“অবশ্যই করি না।” রিফাত হাসান ব্যাপারটা নিয়ে আর অগ্রসর হলেন না। কোনো সমস্যা হয়ে থাকলেও সেটা যে মিটে যাবে কিংবা মিটে গেছে সেটা তিনি অনুমান করে ফেললেন। বললেন, “প্রিন্সিপাল সাহেব, গাব্বুর মতো এরকম ক্রিয়েটিভ ছেলে আপনার স্কুল থেকে বের হয়েছে সেটা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার। আমরা কী ঠিক করেছি জানেন?”
“জি স্যার।”
“আমি আমার ইউনিভার্সিটির সাথে কথা বলেছি। আমরা ঠিক করেছি, আপনার স্কুলে চমৎকার একটা ল্যাব করে দিব। একটা ওয়ার্কশপসহ। সবকিছু থাকবে। সম্ভব হলে ক্রিয়েটিভ ছেলেমেয়েদের জন্যে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করব।”
“থ্যাংক ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ স্যার।” প্রিন্সিপাল স্যার হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “আমরাও চেষ্টা করি স্যার। আমরাও উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। এই যে দেখেন আজকেই আমরা আলোচনা করছিলাম-” প্রিন্সিপাল স্যার টেবিল থেকে গাব্বুর দুষ্কর্মের তালিকা লেখা কাগজটা তুলে রিফাত হাসানকে দেখিয়ে বললেন, “এই যে দেখেন, আজকেই আমরা আলোচনা করছিলাম। গালু একদিনে ছয়টা বিজ্ঞানের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছে। অসাধারণ! আমরা কী ঠিক করেছি জানেন স্যার?”
“কী?”
“আমরা স্যার স্কুল থেকে গাব্রুকে একটা মেডেল দিব। ইয়াং সায়েন্টিস্ট মেডেল।”
রিফাত হাসান বললেন, “ভেরি গুড। চমৎকার।”
গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “তা হলে আমাকে আর টিসি দিবেন না স্যার! বলছিলেন যে টিসি দেবেন?”
রিফাত হাসান জানতে চাইলেন, “টিসি জিনিসটা কী?”
খুব একটা বড় রসিকতা হচ্ছে এরকম ভঙ্গি করে প্রিন্সিপাল হা হা করে হাসলেন, বললেন, “টিসি মানে অনেক কিছু হতে পারে স্যার। কারও জন্যে টিসি হচ্ছে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। মানে স্কুল থেকে বিদায়, আর কারও জন্যে টিসি মানে টেন্ডার কেয়ার। মানে আলাদা করে যত্ন। আমাদের গাব্বুর জন্যে টিসি মানে হচ্ছে টেন্ডার কেয়ার। সবসময় টেন্ডার কেয়ার।”
এইবার লিটন একটু এগিয়ে এল, বলল, “কিন্তু স্যার একটু আগে যে বলছিলেন–”
প্রিন্সিপাল স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহ্! চুপ করো দেখি। দেখছ না আমরা কথা বলছি? বড়দের মাঝে কথা বলবে না।”
মিলি বলল, “তা হলে গাব্বু আমাদের সাথে থাকবে?”
“অবশ্যই থাকবে। আমরা কি গাব্বুকে অন্য কোথাও যেতে দেব? দেব না।”
রিফাত হাসান এবার গাব্বুর বন্ধুদের দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই গাব্বুর সাথে পড়?”
সবাই মাথা নাড়ল। রিফাত হাসান বললেন, “আমার তো শুধু গাবুর সাথে পরিচয় হয়েছে, তোমাদের সাথে পরিচয় হলে হয়তো দেখতাম তোমরাও গাবুর মতো সায়েন্টিস্ট।”
লিটন মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমাদের ক্লাসে শুধু গাব্বু হচ্ছে সায়েন্টিস্ট।”
“অন্যরা? অন্যরাও নিশ্চয়ই কিছু না কিছু?”
লিটন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। এই যে রবিন, সে ফাটাফাটি ক্রিকেট খেলে। মিলি চোখ বন্ধ করে পরীক্ষা দিলেও ফার্স্ট হয়। ফারিয়া খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। রত্না কবিতা লিখতে পারে।”
“তুমি?”
“আমি কিছু পারি না।”
রত্না বলল, “পারে। একসাথে দশটা হাম বার্গার খেতে পারে।”
লিটন রত্নার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল, আশেপাশে স্যার-ম্যাডামরা আছেন তাই আর কিছু বলল না।
রিফাত হাসান বললেন, “সায়েন্টিস্টদের জীবন খুব কঠিন। তারা একটু অন্যরকম হয় তো, তাই তাদের বন্ধু বেশি হয় না। আমাদের গাব্বু তো খুব লাকি তার এতগুলো বন্ধু!”
ফারিয়া বলল, “জি স্যার, আমরা সবসময় গাব্বুকে সাহায্য করি। সে হাইড্রোমিটার না কী একটা মেশিন বানাবে–”
গাব্বু ঠিক করে দিল, “হাইব্রো না হাইগ্রোমিটার।”
“ওই একই কথা। হাইগ্রোমিটার বানানোর জন্যে লম্বা চুল দরকার। তাই আমাকে বলেছে, আমি সাথে সাথে তাকে এতগুলো চুল দিয়ে দিয়েছি। এই যে দেখেন–” ফারিয়া তার মাথার চুল সরিয়ে দেখাল সেখানে এক খাবলা চুল নেই।
রিফাত হাসান চমৎকৃত হলেন, বললেন, “অসাধারণ! বিজ্ঞানের জন্যে এরকম স্যাক্রিফাইস খুব বেশি নাই।”
মিলি বলল, “গাব্বু নার্ভ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছে, কাউকে চিমটি দেওয়া দরকার, তখন আমরা সবাই আমাদের হাতে চিমটি দিতে দিয়েছি।” মিলি দেখাল, “এই যে এইখানে চিমটি দিয়েছিল। লাল হয়েছিল।”
রিফাত হাসান কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, তাই জোরে জোরে মাথা নাড়লেন। রত্না বলল, “কিন্তু স্যার গাব্বু কারও কথা শোনে না। তাকে একটু বলে দেবেন সে যেন আমার কথা একটু শোনে।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“স্যার আমার মাকড়সা খুব ভয় করে–”
“তাই না কি? আমারও মাকড়সা খুব ভয় করে। এর একটা নামও আছে, আরকোনোফোবিয়া।”
“জি স্যার। কিন্তু সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে গাব্বু এই এত বড় একটা মাকড়সা ধরে আমাকে ভয় দেখিয়েছে।” কথাটা বলতে গিয়েই রত্না একটু শিউরে উঠল।
“তাই না কি?” রিফাত হাসান গাব্বুর দিকে তাকালেন, “সত্যি?”
“কিন্তু এক্সপেরিমেন্টটা কাজ করেছে।”
“কাজ করলেও বন্ধুদের ভয় দেখিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে না। বন্ধু সায়েন্স থেকেও ইম্পরট্যান্ট। যার বন্ধু নেই তার কিছু নেই। ঠিক আছে?”
গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
প্রিন্সিপাল স্যার পাশে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছিলেন। এত বড় এত বিখ্যাত একজন মানুষ। যিনি প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সাথে চা-নাস্তা খান তিনি কি না এইরকম ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে মাকড়সা নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। একটু কাশির মতো শব্দ করে বলেই ফেললেন, “স্যার–”
“জি।”
“আপনি আমাদের স্কুলে এসেছেন এত বড় একটা ব্যাপার, আমাদের সব টিচারদের সাথে যদি একটু চা খেতেন—”
রিফাত হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “আসলে আমার একটু তাড়া আছে। দুপুরে প্লেন ধরতে হবে তো–”
রওশন ম্যাডাম বললেন, “তা হলে স্যার, আপনি একটু বারান্দায় দাঁড়ান, আমরা স্কুলের সব ছেলেমেয়েকে ডাকি। তারা নিজের চোখে আপনাকে একটু দেখুক।”
“লেখাপড়ার ক্ষতি করে আমাকে দেখবে?”
“জি স্যার। একটু লেখাপড়ার ক্ষতি হলেও হাজার গুণ বেশি লাভ হবে।”
রিফাত হাসান হাসলেন, বললেন, “ঠিক আছে!”
.
মিনিট দশেক পর স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভিড় ঠেলে রিফাত হাসান যখন তার গাড়িতে উঠছেন তখন গাবুকে ডাকলেন। বললেন, “আমি যাচ্ছি। যোগাযোগ রেখো।”
“ঠিক আছে।”
“শুধু টেলিপ্যাথির উপর ভরসা না করে ই-মেইল করা যেতে পারে।”
“ঠিক আছে।”
গাব্বু কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। রিফাত হাসান জিজ্ঞেস করলেন, গাব্বু, “তুমি কিছু বলবে?”
“জি।”
“বল।”
“আমার আপুর খুব ইচ্ছা সে আপনার সাথে একটা ছবি তুলবে আর একটা অটোগ্রাফ নেবে!”
“কোথায় তোমার আপু? ডাকো।”
ইউসুফ চাপা গলায় বলল, “স্যার দেরি হয়ে যাবে।”
রিফাত হাসান বললেন, “হোক!”
টুনির সাথে ছবি তোলার পর আরও অনেকের সাথে ছবি তুলতে হল, আরও অনেককে অটোগ্রাফ দিতে হল। অন্য কেউ হলে ফ্লাইট মিস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, গাব্বু জানে রিফাত হাসানের সেই ভয় নেই। দরকার হলে এয়াপোর্টে তার জন্যে প্লেন দাঁড়িয়ে থাকবে।
.
পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজাতে বাজাতে রিফাত হাসানের গাড়িটাকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর টুনি গাব্বুর কাছে ছুটে এল, তারপর সবার সামনে তাকে চেপে ধরে তার দুই গালে ধ্যাবড়া করে চুমু খেল। গাব্বু অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বলল, “আপু, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। তুমি এরকম করলে আমি কখনো তোমাকে নিয়ে ছবি তোলার কথা বলতাম না। তুমি জান মানুষের মুখের লালায় কত ব্যাক্টেরিয়া থাকে?”
গাব্বুর কথা শুনে টুনি গাব্বুকে আরও জোরে চেপে ধরে আরও জোরে তার গালে ধ্যাবড়া করে চুমু খেল।
কী একটা লজ্জার ব্যাপার। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।