০৯.
খবরটা মুকুন্দই পাড়ার পুরনো বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিল।
নিতান্ত অপ্রত্যাশিত না হলেও খবরটা শুনে কণিকা চমকে উঠলেন। বললেন, এইতো পরশু দিনই আমার সঙ্গে গল্প করলেন। একদিনের মধ্যে হঠাৎ কী হলো?
মুকুন্দ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কাল সন্ধের পর আমি যখন ওঁর দুধ আর দুটো কলা দিতে গেলাম, তখন আমাকে শুধু বললেন, বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, তুই কলা দুটো তোর মেয়েকে দিস।
তাই নাকি? হ্যাঁ, বৌদি।
উনি দুধ খেয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আমারই সামনে উনি দুধ খেয়ে শুয়ে পড়লেন।
তারপর?
আজ সকালে সাড়ে নটা-দশটা পর্যন্ত ঠাকুমাকে বাইরে বেরুতে না দেখে ভিতরে গিয়ে দেখি, ওঁর শরীর লোহার মতো শক্ত!
তার মানে, ঘুমের মধ্যেই মাঝ রাত্তিরে মারা গেছে।
চক্ৰবেড়ের ডাঃ মিত্র বললেন, বোধহয় রাত দুটো থেকে চারটের মধ্যে মারা গেছেন।
ঐ বিনু বলে যে ছেলেটা ওঁর পাশের ঘরে থাকে….
মুকুন্দ ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে, ওর কথা আর বলবেন না বৌদি। ঠাকুমাদের বাড়িতে থেকেও ঠাকুমাকে কি যা তা বলতো, তা ভাবতে পারবেন না।
আমি জানি।
কণিকা মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ঠাকুমা আমার কাছেও অনেক দুঃখ করেছেন কিন্তু হতভাগা তো ওঁরই পাশের ঘরে থাকে।
ও আবার কী খবর নেবে? ঘরখানা দখল নেবে বলে ও তো দিনরাত্তির ঠাকুমার মৃত্যু কামনা করতো।
এবার কণিকা বললেন, যাই হোক মুকুন্দ, ঠাকুমার শেষ কাজ খুব ভালভাবে হওয়া চাই। খাট, ফুল, সেন্ট-টেন্ট কিনতে কত দেব বল?
ওসব কিনতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওসবের জন্য আর আপনাকে টাকা দিতে হবে না।
ওসব কেনার টাকা কে দিল?
আমি আর আমার বন্ধুবান্ধব-খদ্দেররা ও টাকা দিয়ে দিয়েছি।
কণিকা ওকে দাঁড় করিয়ে ভিতর থেকে আড়াইশ টাকা এনে ওর হাতে দিয়ে বললেন, শ্মশানঘাটের খরচের জন্য এই টাকাটা রাখো। তুমি যাও; আমি এখুনি আসছি।
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত কামিনীবালা প্রায় রাজমহিষীর মতো সেজেগুঁজে পালঙ্কে চড়ে যাট-সত্তর জন লোকের হরির ধ্বনি শুনতে শুনতে ভবানীপুরের বিখ্যাত গোলাপী বাড়ি থেকে চিরবিদায় নিলেন। তাছাড়া স্বামীর সোহাগবঞ্চিতা নিঃসন্তান এই নিঃস্ব বৃদ্ধার জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় জানালেন পাড়ার বউ-ঝি বুড়ো বুড়ির দল। সরকারবাড়ির আর কোনো কর্তা বা গিন্নির কপালে এই সৌভাগ্য জোটেনি।
.
কণিকা ও বাড়ি থেকে ফিরে আসতেই অঘোরনাথ বললেন, বুড়িকে রওনা করে দিয়ে এলে?
হ্যাঁ, ছোটকাকা।
জানলা দিয়ে দেখলাম, বুড়ি বেশ রাজরানীর মতোই গেলেন।
হ্যাঁ, সত্যিই রাজরানীর মতোই গেলেন।
কণিকা মুহূর্তের জন্য থেমে বললেন, শুধু এপাড়ার বাসিন্দারা না, এমনকি মুকুন্দর দোকানের অতি সাধারণ খদ্দেরদেরও দেখলাম, ঠাকুমার পায় ফুলমালা দিয়ে প্রণাম করল।
জানো ছোটমা, মানুষের সুকৃতি না থাকলে এই ভালবাসা পাওয়া যায় না। সব মানুষই চায়, একটু ভালভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে কিন্তু সে সৌভাগ্য কজনের হয়?
উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এই বুড়ি ছাড়া সরকারবাড়ির আর কারুর সে সৌভাগ্য হয়নি।
ও বড়ির আর সবাই বুঝি খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন?
কেউ কষ্ট পেয়ে, আবার কেউ বা এমন ভাবে মারা যান, যা বিশেষ সুখের বা, গৌরবের নয়।
ঠাকুমা একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, কে যেন জলে ডুবে মারা যান।
অঘোরনাথ একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, হ্যাঁ, ও বাড়ির মেজকর্তা।
উনি একটু থেমে বলেন, দেখ ছোটমা, ধর্মের ঢোল আপনি বাজে। আমরা অতি বুদ্ধিমানের দল লুকিয়ে-চুরিয়ে অন্যায় বা খারাপ কাজ করে মনে ভাবি কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না কিন্তু মজার কথা, একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হয়।
কণিকা কোন কথা না বলে ওঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
অঘোরনাথ বলে যান, সরকারবাড়ির বড়কর্তার যে রক্ষিতা ছিল, এ কথা সবাই জানতো। মাতাল-চরিত্রহীন বলে ছোটকর্তার খ্যাতি সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আর মেজকর্তকে সবাই জানতো, ব্যবসা বাণিজ্য টাকাকড়ি ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো ব্যাপারে ওঁর আগ্রহ নেই।
ঠাকুমার কাছে শুনেছি, ওর জন্যই বুঝি সরকারদের এত বিষয়-সম্পত্তি হয়।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ কিন্তু দুঃখের কথা কী জানো ছোটমা, প্রায় সব সম্পত্তিই উনি লোক ঠকিয়ে নিজেদের করে নেন।
লোক ঠকিয়ে?
হ্যাঁ।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, যারা বিপদে-আপদে পড়ে বিষয়-সম্পত্তি বন্ধক রেখে টাকা নিতেন, তারা কথামতো টাকা শোধ করতে না পারলেই উনি সে-সব সম্পত্তি নিয়ে নিতেন।
তাই নাকি?
মাত্র দুপাঁচ-দশ হাজার টাকা ধার দিয়ে কত মূল্যবান সম্পত্তি যে উনি আত্মসাৎ করেছেন, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
তা উনি জলে ডুবে মারা গেলেন কী ভাবে?
আমাদের সমাজে বিধবাদের তো দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। তাই মেয়েদের বিয়ে-থার ব্যাপারে বা ছেলেমেয়েদের অসুখ-বিসুখের জন্য বিধবারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপদে পড়ে সম্পত্তি বন্ধক রেখে মেজকর্তার কাছ থেকে টাকা নিতেন। ওঁদেরই মধ্যে একজন অল্পবয়সী বিধবাকে নিয়ে ফুর্তি করতে গিয়েই তো উনি নৌকো থেকে পড়ে গঙ্গায় ডুবে মারা যান।
এ রাম!
কণিকার বিস্ময় আর ঘৃণা দেখে অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, ছোটমা, আমাদের আশু মুখুজ্যেও অনেক টাকা আয় করেন। এই ভবানীপুরে উনি কি বিশাল বাড়ি বানান, তা তো দেখেছ।…
সত্যি, ভবানীপুরে ওর চাইতে বড় বাড়ি দেখিনি।
আশুবাবু বিদ্যা-বুদ্ধি পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন, উনি অসৎ উপায়ে একটি পয়সাও আয় করেননি। তাইতো তার প্রত্যেকটি ছেলে যেমন শিক্ষিত, সেইরকমই সম্মানিত হয়েছেন।
অঘোরনাথ মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আর সরকারবাড়ির কর্তাদের না ছিল শিক্ষা দীক্ষা, না ছিল সততা। মানুষ ঠকিয়ে জোচ্চুরি করে টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তি করেন বলেই ওঁরা যত রকমের নোংরামি করে টাকা ওড়াতে দ্বিধা করেননি।
কণিকা জিজ্ঞেস করেন, ও বাড়ির বড়কর্তা কী ভাবে মারা যান?
উনি যখন মারা যান, তখন আমি কলকাতায় ছিলাম না। তবে পুজোর সময় কলকাতায় এসে বন্ধু বান্ধবদের কাছে শুনি, উনি কোন খারাপ অসুখে মারা যান।
যা তা জায়গায় গেলে এইসব অসুখ তো হবেই।
শুধু তাই না ছোটমা। হাসপাতালে ওঁকে কেউ দেখতেও যেত না।
নিজের বউ-ছেলেও না?
না।
কেন? ওঁর চরিত্র ভাল ছিল না বলে?
শুধু তাই না; উনি ওঁর রক্ষিতাকে কালীঘাটের বাড়িটা লিখে দেন বলে…
কণিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, উনি ওঁর রক্ষিতাকে বাড়িও দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
একটু চুপ করে থাকার পর কণিকা জিজ্ঞেস করেন, আর ছোটকর্তা কীভাবে মারা যান?
উনি মদ খেয়েই মারা গেলেন।
উনি প্রায় না থেমেই বলেন, তবে ছোটমা, দত্তবাড়ির মেজবাবুর মৃত্যু আর ঐ মামলা মোকদ্দমার পর ছোটকর্তা বাড়িতে বসে দিনরাত্তির শুধু মদ খেতেন কিন্তু বাইরে কোথাও যেতেন না।
কণিকা একটু হেসে বলেন, বোধহয় ভয়েই কোথাও যেতেন না।
ভয় নিশ্চয়ই ছিল কিন্তু মেজবাবু আর বড়বাবুর ঐভাবে মৃত্যু হওয়ায় উনি খুবই আঘাত পেয়েছিলেন।
অঘোরনাথ একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, তবে ছোটমা, একটা কথা জেনে রেখো। সরকারবাড়ির এই চরিত্রহীন মাতাল ছোটবাবু কোনোদিন কারুর ক্ষতি করেননি, বরং বহু মানুষকে সাহায্য করেছেন।
ঠাকুমা তো কোনোদিন কিছু বলেননি।
তোমার শাশুড়ীর কাছে শুনেছি, উনি বাইরের লোকজনের কাছে শ্বশুরবাড়ির আলোচনা করা বিশেষ পছন্দ করতেন না।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই।
কণিকা একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন, সরকারবাড়ির এই দুরবস্থা হলো কেমন করে?
অঘোরনাথ একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, তুমি তো ইকনমিক্স নিয়ে পড়েছিলে। ল অফ ডিমিনিসিং রিটার্নের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে?
হ্যাঁ।
সরকারদের ঠিক তাই হয়েছিল।
উনি একটু থেমে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাগজের কালোবাজারি আর চুরি করে ওঁরা যে কত লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা আয় করেছিলেন, তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না।
কালোবাজারি করে আয় করতেন, তা বুঝলাম কিন্তু চুরি করতেন কী করে?
তখন কলকাতা ছাড়া আসাম ও বাংলাদেশের নানা জেলায় লাখ লাখ বৃটিশ আমেরিকান-কানাডিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান সৈন্য ছড়িয়ে ছিল। ওদের হাজার হাজার অফিসে কোটি কোটি টাকার কাগজ সাপ্লাই দিতেন আমাদের এই সরকাররা।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, প্রতেক প্যাকেটে পাঁচ শর জায়গায় চারশ শিট কাগজ সাপ্লাই দিয়ে কত টাকার কাগজ ওঁরা চুরি করতেন, তা ভাবতে পারো?
ধরা পড়তেন না?
কে ধরবে?
অঘোরনাথ ওঁর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, বিশ্বযুদ্ধ যে কী ভয়ানক ব্যাপার, তা তোমরা ঠিক বুঝবে না। যখনকার কথা বলছি, তখন হিটলারের জার্মানি প্রত্যেকদিন এক একটা দেশ দখল করে চলেছে; আর এদিকে জাপানিরা সিঙ্গাপুর-মালয় ইত্যাদি জয় করে ঝড়ের বেগে ভারতের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই ভয়ঙ্কর সময়ে কি আর্মি অফিসারদের কোনো জিনিসপত্রের হিসেব-নিকেশ নেবার সময় ছিল!
কণিকা অবাক হয়ে ওঁর কথা শোনেন।
এদিকে যুদ্ধের জন্য চাল-গম-চিনি থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড় লেখাপড়ার কাগজ সবই কন্ট্রোল কিন্তু কোনো ব্যসাদারই কন্ট্রোলের দামে কোনো জিনিস বিক্রি করে না। এই সরকাররা আট-দশ গুণ বেশি দামে কাগজ বিক্রি করে কত আয় করলেন, তা ভগবানই জানেন।
এত টাকা গেল কোথায়?
বৃদ্ধ অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি-হেসে বলেন, ছোটমা, তখন বাড়ির বড়কর্তা আর মেজকর্তা এমন বেহিসেবী ফুর্তি করা শুরু করলেন, যা আমি তোমাকে বলতে পারব না। সেই সঙ্গে সমান তালে বিলাসিতা আর অপব্যয়। তখন ওঁদের কতগুলো মোটরগাড়ি ছিল জান?
কণিকা চাপা কৌতুকের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করেন, কত?
সাতখানা।
সাতখানা গাড়ি ছিল?
হ্যাঁ ছোটমা, সাতখানা।
উনি মুহূর্তের জন্যে থেমে বলেন, তার মধ্যে তিনখানা ছিল প্যাকার্ড আর ক্রাইসলার।
দু-এক মিনিট চুপ করে থাকার পর কণিকা প্রশ্ন করেন, তখনও ওঁরা ব্যবসা-বাণিজের কাজকর্ম করতেন তো?
না, না; তখন ওঁদের ব্যবসা বাণিজ্য করার সময়ও ছিল না, মনও ছিল না।
তাহলে…
তত দিনে তো ওঁদের তিন ছেলেই বড়ো হয়ে গেছে। ওরাই তখন সবকিছু দেখাশুনা করত।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, ছেলেগুলোও তো এক একটা অবতার ছিল।
কেন? ওরাও কি বড়কর্তা-মেজকর্তার মতো চরিত্রহীন ছিল?
বড়কর্তার বড় ছেলেটির কোনো মেয়েছেলের রোগ ছিল বলে কোনদিন শুনিনি কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খিদিরপুর আর টালিগঞ্জে নিয়মিত রেস খেলত।
উনি না থেমেই একটু হেসে বলেন, শ্রীমান যথারীতি প্রত্যেকদিন রেসের মাঠে হাজার হাজার টাকা হেরে বন্ধুদের সঙ্গে বোতল নিয়ে বসত। রাত দেড়টা-দুটোর আগে কোনোদিন বাড়ি আসত না।
বাঃ! চমৎকার!
দাঁড়াও, দাঁড়াও, ছোটমা, এখনই কোনো মন্তব্য করো না। আরো আছে।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, রেসের মাঠে লাখ লাখ টাকা হারাবার পর শ্রীমান ঠিক করল, রেস জিততে হলে রেসের ঘোড়া কিনতে হবে।
তাতেও নিশ্চয় লাখ লাখ টাকা নষ্ট হলো?
সে আর বলতে!
আর বড়কর্তার ছোটছেলেটা কেমন ছিল?
উঃ! ও হতচ্ছাড়ার কথা মনে হলে এখনও আমার গা জ্বলে যায়।
কণিকা একটু হেসে বলেন, কেন?
অঘোরনাথ বলেন, এই হতচ্ছাড়া ধর্মতলা পাড়ার ফিরিঙ্গিদের একটা স্কুলে ক্লাস এইট-নাইন অবধি পড়েই নিজেকে সাহেব মনে করত। আর্মি অফিসে সাপ্লাই দেবার কাজে যাতায়াত করতে করতে অনেক আর্মি অফিসারের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হলো। সেই বন্ধুত্বের পরিণাম যে কী হয়েছিল, তা শুনলে তুমি স্তম্ভিত হয়ে যাবে।
কেন, কী হয়েছিল?
তখন ব্রিটিশ-আমেরিকান কানাডিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান আর্মি আর অফিসারদের মনোরঞ্জনের জন্য চৌরঙ্গিপাড়ায় দশ হাত অন্তর নাচ-গান আর মদ্যপানের আসর ছিল।
সত্যি?
কণিকা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ, ছোটমা, সত্যি।
উনি একটু থেমে বলেন, তখন চারদিকে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে প্রতিদিনই হাজার হাজার সৈন্য মারা যেত। তাই তো গভর্নমেন্ট আর্মির আনন্দের জন্য চৌরঙ্গি পাড়ায় শত শত বার-এর লাইসেন্স দেয়। এমনকি ফুটপাত ঘিরেও অনেক বার ছিল; আর এই সব বার-এ মেয়েরা নাচ দেখাত, গান গাইত।
কণিকা অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে শুনে যান।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, আর্মির সবাই জানত, যে-কোনো মুহূর্তে ওদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে এবং হয়তো মারা যাবে। তাইত যেমন আকণ্ঠ ড্রিঙ্ক করত, সেইরকমই ফুর্তি করত। বড়কর্তার ছোট ছেলে ওদেরই সঙ্গে সমানতালে ড্রিঙ্কও করত, ফুর্তিও করত।
সত্যিই স্তম্ভিত হবার মতো ব্যাপার।
এইটুকু শুনেই স্তম্ভিত হচ্ছ? এখন তো আসল ব্যাপারটাই বলিনি।
আবার কী আসল ব্যাপার?
বলছি, বলছি।
উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ঐ যুদ্ধের বাজারে কন্ট্রাক্টরি করে যোগীন ঘোষ বলে এক ভদ্রলোক প্রচুর পয়সা করেন। তারই মেয়ের সঙ্গে সরকারবাড়ির বড়কর্তার ছোট ছেলের বিয়ে হয়।
ঠাকুমা বলতেন, মেয়েটি দারুণ সুন্দরী ছিল।
হ্যাঁ, সত্যি খুব সুন্দরী ছিল।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, বিয়ের পর ঐ ছোকরা প্রায়ই বউকে নিয়ে ক্লাবে গিয়ে আর্মি অফিসারদের সঙ্গে ড্রিঙ্ক করত।
তারপর?
তারপর ঐ বউটিও ড্রিঙ্ক করা শুরু করল এবং শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হলো।
কী বলছেন আপনি? হ্যাঁ, ছোটমা, ঠিকই বলছি।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলনে, স্বামী-স্ত্রী বেরুত একসঙ্গে কিন্তু ফিরত আলাদা আলাদা।
তার মানে?
শ্রীমান নিজে বেহুঁশ মাতাল হয়ে ফিরত মাঝরাত্তিরের পর কিন্তু তখন ওর সঙ্গে বউ থাকত না। দুতিনজন আর্মি অফিসার আর্মির গাড়ি করে বউটিকে পৌঁছে দিত রাত দুটো তিনটের সময়।
কণিকা মুখ বিকৃতি করে বলেন, এ রাম! রাম!
ছোটমা, এ দৃশ্য সারা পাড়ার লোক মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে দেখেছে।
পাড়ার লোক কিছু বলত না?
অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, ছোটমা, তোমরা ঠিক বুঝবে না, তখন কী পরিস্থিতি ছিল।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তখন বহু জজ ব্যারিস্টার আর আই. সি. এস-এর মেয়ে বউরা পর্যন্ত আমেরিকান বা ব্রিটিশ আর্মি অফিসারদের সঙ্গে মেলোমেশা করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করতেন। তাইত…
কী বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, ছোটমা, ঠিকই বলছি।
দুএক মিনিট কেউই কোনো কথা বলেন না। তারপর কণিকা জিজ্ঞেস করেন, মেজকর্তার ছেলেটি কেমন ছিল?
মেজকর্তার ছেলেটির কোনো বদ নেশাও ছিল না, চরিত্রও খারাপ ছিল না; তবে যেমন আয়েসী, সেইরকমই স্ত্রৈণ ছিল।
কণিকা একটু হেসে বলেন, ওবাড়ির কেউ কি স্বাভাবিক ছিল না?
না, ছোটমা, কেউই স্বাভাবিক ছিল না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তা না হলে কি এই বিশাল সম্পত্তি আর এত টাকা এভাবে কবছরের মধ্যে শেষ হয়?
কবছরের মধ্যে মানে?
যুদ্ধ শেষ হবার বছর পাঁচেকের মধ্যেই সরকারদের সব শেষ হয়ে যায়।
মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে?
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, ছোটমা, ফুটো হাঁড়িতে ক্ষীর রাখলেও তা পড়ে যায়।
তা ঠিক, কিন্তু এত টাকা, এত সম্পত্তি পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ হলো কীভাবে?
একজন রেসুড়ে, একজন যেমন চালিয়াত সেইরকমই চরিত্রহীন-নেশাখোর আর একজন দিনরাত্তির বউকে নিয়েই ব্যস্ত। ওদের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখার সময় কোথায়?
উনি এক নিঃশ্বাসে বলে যান, মোসাহেব, দালাল আর কর্মচারীদের উপর সবকিছু ছেড়ে দিলে কি ব্যবসা বাণিজ্য চলে?
কণিকা চুপ করে থাকেন।
অঘোরনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, যুদ্ধের শেষের দিকে বড়কর্তা-মেজকর্তার ছেলেরা আলাদা হয়ে যায়। বড়কর্তার বড়ছেলে বেহালায় চলে গেল; ছোট ছেলে সাদার্ন অ্যাভিনিউতে তিনতলা প্রাসাদ তৈরি শুরু করে আর শেষ করতে পারল না।
মেজকর্তার ছেলে?
ও বিডন স্ট্রিটে শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়।
ব্যবসা-বাণিজ্যও ভাগাভাগি হয়?
সব বেহাত হয়ে যায়।
অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, ওরা তিন ভাই মাত্র তিন লাখ টকা নিয়ে ব্ৰেবোর্ন রোডের বাড়িটা কিষণলাল জালান বলে এক ভদ্রলোকের কাছে বন্ধক রাখে কিন্তু পাঁচ বছরের মধ্যে টাকা শোধ করতে না পারার জন্য বাড়িটা চলে যায়। আর কর্মচারীরা। ভাগ-যোগ করে সব ব্যবসা-বাণিজ্যও হাতিয়ে নেয়।
হাতিয়ে নেয় মানে?
দশ-বিশ হাজার টাকা নিয়ে এক এক ভাই এক এক জনকে একএকটা ব্যবসা লিখে। দিয়েছে।
উনি একটু থেমে একটু হেসে বলেন, পঞ্চাশ-বাহান্ন সালে আমি সরকার বাড়ির ছেলেদের সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে চড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।
বলেন কী?
হ্যাঁ, ছোটমা, ঠিকই বলছি।
উনি একটু থেমে বলেন, অধিকাংশ বাঙালি ব্যবসাদারই তো এইভাবে শেষ হয়ে গেছে।
.
একে কলকাতা শহর, তার উপর ভবানীপুরের ঐ জমজমাট বাড়ি ছেড়ে কাশী এসে প্রথম কারুরই বিশেষ ভাল লাগতো না। স্বামীকে সরাসরি কিছু না বললেও বড়বউ প্রায় প্রতিদিনই রাধাকে বলতেন, এইভাবে আনু আর টানুর সংসার করতে আমার একটুও ভাল লাগে না। ভবানীপুরের বাড়িতে কিভাবে যে সময় কেটে যেত, তা টেরই পেতাম না, আর এখানে?
বড়বউ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এখানে এক একটা দিন যেন এক একটা বছর!
রাধা একটু হেসে বলে, হ্যাঁ, বড়মা, ঠিক বলেছ। সব সময় ভবানীপুরের বাড়ির কথা মনে হয়।
হবেই তো!
উনি একটু থেমে বলেন, যে বাড়িতে পাঁচ ভাই, চারবউ, পাঁচটা ছেলেমেয়ে মিলিয়ে চোদ্দ জন ছাড়াও চাকর-দারোয়ন-কোচোয়ান মিলিয়ে আরো জনা দশেক লোক থাকতো, সে বাড়ি ছেড়ে এসে এখানে এভাবে বোবা হয়ে দিন কাটাতে কি কারুর ভাল লাগতে পারে?
তুমি জেঠুকে বলো না, আমরা ফিরে যাই।
তোর জেঠুকে বললেই যেন সে ফিরে যাবে!
বড়বউ একটু থেমে বলেন, তোর জেঠু সারা জীবনেও আর ওখানে ফিরে যাবে কি না খুব সন্দেহ আছে। একবার যখন বাড়িঘর ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে এসেছে, তখন আর ওসব ঝামেলায় ও যাবে না।
দুর্গাপদ মুখে কিছুই বলেন না। উনি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই দশাশ্বমেধ ঘাটে যান গঙ্গাস্নান করতে। তারপর একটু শাক-সবজি ফল-মূল কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে এসে একটু কিছু মুখে দিয়েই জঙ্গমবাড়ির ওদিকে ভবানীপুরের জগদীশ মিত্তিরের ভাই নরেশবাবুর বাড়ি যান।
আরে দুর্গাপদ, এসো, এসো।
গড়গড়ার নল মুখ থেকে বের করেই নরেশচন্দ্র হাসতে হাসতে বলেন, বুঝলে দুর্গাপদ, ভবানীপুরের লোক ছাড়া কাউকেই ঠিক আপন মনে হয় না।
ফরাস পাতা বিরাট তক্তাপোশের উপর একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসতে বসতে দুর্গাপদ একটু হেসে বলেন, আমারও তো ঐ এক রোগ! তাই তো এখানে এত জানাশুনো লোকজন থাকা সত্ত্বেও শুধু আপনার কাছেই ছুটে আসি।
তা কি আমি জানি না?
নরেশচন্দ্র একটু হেসে বলেন, বাবার কাছে শুনেছি, বড় জ্যেঠু কাশী আসছেন শুনলেই স্যার আশুতোষ পর্যন্ত এখানে এসে হাজির হতেন। আবার আশুবাবু আসার পরের দিনই ত্রিদিব বাঁড়ুজ্যে এখানে চলে আসতেন।
ওঁর কথা শুনে দুর্গাপদ একটু হাসেন। চুপ করে ওঁর কথা শোনেন।
ওরে বাপু, তুমি আর আমিও তো সেই ভবানীপুরের জন্মেছি, বড় হয়েছি। তুমি আম কাছে না এলে তুমিও শান্তি পাবে না, আমিও পাবো না।
ঠিক বলেছেন।
নরেশচন্দ্র গড়গড়ার নলে দু-একটা টান দিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, দ্যাখো দুর্গাপদ, সরকারী চাকরি করার সুবাদে চট্টগ্রাম থেকে বাঁকুড়া, দাজিলিং থেকে বসিরহাট পর্যন্ত ঘুরতে হয়ছে। তাছাড়া বেড়াবার নেশা ছিল বলে মানস সরোবর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু সত্যি বলছি, ভবানীপুরের মতো একটা পাড়া ভূ-ভারতে আর দেখিনি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, দুর্গাপদ, সত্যিই তাই।
উনি একটু থেমে বলেন, এলাহাবাদ-লক্ষ্ণৌ-দিল্লি-করাচী-মাদ্রাজ- শহরেও অনেক ভাল ভাল এলাকা আছে। সে সব এলাকায় অনেক ভাল ভাল লোক বাস করেন, কিন্তু একই পাড়ায় আশু মুখুজ্যে, সি.আর.দাশ, সুভাষ বোস বা শরৎ বোসের বাড়ি, একথা বাইরের লোক শুনে ঠিক বিশ্বাস করতে চায় না।
সত্যি, ভবানীপুর নিয়ে আমাদের যথেষ্ট গর্বের কারণ আছে।
নরেশচন্দ্র একটু গলা চড়িয়ে বলেন, আমাদের পাড়া নিয়ে গর্ব করার হাজার কারণ আছে।
উনি না থেমেই এক নিঃশ্বাসে বলে যান, এই একটা পাড়ায় দুজন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, দু-তিনজন ভাইস চ্যান্সেলার, দশ-বারোজন বিখ্যাত অধ্যাপক, দুর্গাদাস প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো অভিনেতা, অন্তত চার-পাঁচজন আই-সি-এস, বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ডাক্তার, হাইকোর্টের তিন-চারজন জজ, দশ-বারোজন বিখ্যাত ব্যারিস্টার…..
ওঁর কথার মাঝখানেই দুর্গাপদ বলেন, এতগুলো বিখ্যাত লোক এক পাড়ায় থাকেন, ভাবলেই মাথা ঘুরে যায়।
ওরে বাপু, তোমাদের মতো ব্যবসাদারই বা অন্য পাড়ায় কজন আছে?
কথাটা শুনে দুর্গাপদর খুবই ভাল লাগে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, আপনার মতো বিলেত ফেরত এঞ্জিনিয়ারই বা অন্য পাড়ায় কজন আছেন?
ওঁর কথা শুনে নরেশচন্দ্র হাসতে হাসতে বলেন, ওরে বাপু, বাপ-জ্যেঠার পয়সায় বিলেত গিয়ে কোনোমতে একটা তকমা যোগাড় করতে পেরেছিলাম বলে সাহেবদের ঠকিয়ে বেশ জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। শুধু ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাই জানে, আমি কত ভাল এঞ্জিনিয়ার।
কী যে বলেন আপনি?
দুর্গাপদ, সত্যি কথাই বলছি। বিলেত থেকে একটা সার্টিফিকেট এনেছি বলেই মনে কর না, আমি দারুণ ভাল এঞ্জিনিয়ার।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আমরা দুভাই যে মহাসুখে জীবন কাটিয়ে দিলাম, তাতে আমাদের বিশেষ কেরামতি নেই।
এবার উনি দুর্গাপদর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলেন, তুমি ভাবলে অবাক হবে, বাবার অঙ্কের বই আর জেঠুর ইতিহাস বই থেকে আমরা দুভাই বছরে অন্তত তিরিশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা পাই।
বলেন কী?
হ্যাঁ, দুর্গাপদ, বাপ-জেঠার বইয়ের টাকাতেই আমাদের বাড়ি-গাড়ি সবকিছু।
নরেশচন্দ্র একটু গর্বের হাসি হেসে বলেন, জ্যেঠার ইতিহাস বই তো এখানকার হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও পড়ান হয়।
সত্যি গর্বের কথা।
.
দুপুরবেলায় খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করার পর দুর্গাপদ প্রতিদিন বিকেলে রাধাকে নিয়ে গঙ্গায় নৌকো চড়ে ঘুরে বেড়ান বেশ কিছুক্ষণ।
দুর্গাপদ একটু হেসে রাধাকে জিজ্ঞেস করেন, কী বড়মা, এই গঙ্গায় নৌকো চড়ে ঘুরে বেড়াতে কেমন লাগে?
ভাল লাগে, তবে ভাইবোনরা নেই বলে তত ভাল নাগে না।
পুজোর ছুটিতে তো কলকাতা থেকে সবাই নিশ্চয়ই এখানে আসবে। তখন সব ভাইবোনদের নিয়ে..
সে তো অনেক দেরি।
হ্যাঁ, তা একটু দেরি আছে ঠিকই কিন্তু আমার সঙ্গে নৌকোয় চড়ে বেড়াতে তোমার ভাল লাগে না?
ভাল কেন লাগবে না কিন্তু ভাইবোনেরা থাকলে খুব মজা হয়।
রাধা মুহূর্তের জন্য থেমেই বলে, ভাইবোনদের ছেড়ে থাকতে আমার একটুও ভাল লাগে না। সব সময় মনে হয়, ছুটে ওদের কাছে চলে যাই।
দুর্গাপদ ডান হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, কিন্তু বড়মা, তুমি চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে নৌকোয় চড়ে বেড়াব?
আমি কি একলা একলা ভবানীপুর যেতে পারি? তুমি আর বড়মাও তো আমার সঙ্গে যাবে।
রাধা একটা হাত দিয়ে দুর্গাপদর মুখখানা নিজের দিকে ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করে, জ্যেঠুযাবে তো?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবো, তবে কিছুদিন পর।
.
দুর্গাপদ খুব ভাল করেই জানেন, বড়বউও এখানে এসে শান্তিতে নেই। থাকবেন কী করে? উনি যখন বউ হয়ে দত্তবাড়িতে আসেন, তখন ছোট দুই দেওর তো নেহতেই শিশু। গুরুপদকে তো উনি প্রায় নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করেন। তাছাড়া কালীপদ আর শ্যামাপদ তো ওঁর নিজের ভাইদের চাইতেও অনেক বেশি প্রিয়। সব চাইতে বড় কথা, নিজের ছেলেমেয়ে না হলেও দেওরদের ছেলেমেয়েরাই তো ওঁর প্রাণ, ওঁর এক একটা স্বপ্ন। এদের সবাইকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও থামেনি, থাকতে পারেন না।
দুর্গাপদ জানেন, ভাল না লাগলেও অনেক কাজ করতে হয় সংসারী মানুষকে। তাই তো যে সংসার, যে ব্যবসা-বাণিজ্য উনি প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন, সেসব ছেড়ে থাকতে কষ্ট হলেও নিজের মনকে মানিয়ে নিয়েছেন।
.
কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত চিঠিপত্রের লেনদেন আছে! আগে ভাইরা প্রায় প্রত্যেক চিঠিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেই দুর্গাপদ উত্তর দিতেন, তোমরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ। বহু বছর ধরিয়াই তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের সহিত জড়িত আছে। সুতরাং আমার স্থির বিশ্বাস, পরিস্থিতি অনুযায়ী তোমরা অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত লইবে। পদে পদে প্রবাসী গুরুজনের পরামর্শ লইয়া ব্যবসা পরিচালনা করা উচিত নয়, সম্ভবও নয়।
ভবানীপুরের বাড়ির সব খোঁজখবর জানিয়ে বড়বউএর কাছে হরদম সেজবউন বউ-এর চিঠি আসে। তবে ছোট দেওর-এর চিঠি এলেই বড়বউ-এর মন খারাপ হয়ে যায়। স্বামীকে শুনিয়ে উনি রাধাকে বলেন, নিজের পেটে ছেলেমেয়ে না ধরলেও তোর ছোটকাকাকেই তো আমি ছেলের মতো মানুষ করেছি। এই ছেলেটাকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে না শুলে আমিও ঘুমুতে পারতাম না, তোর ছোট কাকারও ঘুম আসতো না।
রাধা হাসতে হাসতে বলে, তুমি মাছের কাঁটা বেছে না দিলে তো ছোটকাকা এখনও খেতে পারে না।
বড়বউ একটু হেসে বলেন, আঠারো-বিশ বয়স পর্যন্ত আমি না খাইয়ে দিলে ওর পেটই ভরত না।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষগ্লভভাবে বলেন, ওর চিঠি পড়লেই মনে হয়, এখুনি ছুটে ভবানীপুরের বাড়িতে চলে যাই।
দুর্গাপদর কানে সব কথাই পৌঁছায় কিন্তু একটি কথাও বলেন না। তবে দু-চার দিন পর উনি বিকেলের চা খেতে বলেন, বড়বউ, তোমাকে দু-একটা কথা বলতাম।
হ্যাঁ, বল।
দেখো বড়বউ, আমাদের পরিবারের উপর লক্ষ্মীর আশীর্বাদ থাকলেও সরস্বতী মোটই সুপ্রসন্ন না। আমার ঠাকুর্দা দামোদর দত্ত কোনমতে পাঠশালার পাঠ শেষ করলেও মিডল স্কুলে একই ক্লাসে পরপর তিন বার ফেল করে পড়াশুনা ছেড়ে দেন। শুধু বুদ্ধি,পরিশ্রম আর নিষ্ঠার দ্বারা তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করে অনেক টাকাকড়ি বিষয় সম্পত্তি করেন।
উনি একটু থেমে বলেন, বাবার সব কথাই তো তুমি জানো। তাছাড়া আমরা পাঁচ ভাই যে কী মহাপণ্ডিত, তাও তুমি খুব ভাল করেই জানো।
বড়বউ রাধাকে পাশে নিয়ে চুপ করে ওঁর কথা শোনেন।
বুঝলে বড়বউ, থার্ড ক্লাসে তিন বছর কাটিয়েও যখন সেকেন্ড ক্লাসে উঠতে পারলাম না, তখন বাবার নির্দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজকর্ম দেখাশুনা শুরু করলাম। আমি তখন ঠিক যোল বছরের।
দুর্গাপদ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, তারপর আটত্রিশ বছর শুধু ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তি আর সংসার ছাড়া আর কোনো দিকে মন দিইনি। আমার উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সব ভাইরাই খুশি থেকেছে।
উনি একটু থামেন; কি যেন একটু চিন্তা করেন। তারপর বলেন, বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো হঠাৎ কালী আর মেজবউমা চলে যেতেই মনে হলো যদি কোনো কারণে আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমার তিনটে ভাই তো মহাবিপদে পড়বে। তাই ঠিক করলাম, আমি সুস্থ থাকতে থাকতেই ওদের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আমি দূরে চলে যাবো।
দুর্গাপদ একটু হেসে বললেন, বুঝলে বড়বউ, আমাকে কাছে পেলে ওরা কোনোদিনই ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তির দায়-দায়িত্ব নেবে না। তাছাড়া…..
উনি কথাটা না শেষ করেই নীরব হয়ে যান।
বড়বউ বললেন, তাছাড়া কী? কথাটা শেষ কর।
বলছিলাম, সে রকম দরকার হলে ভাইরাও আমার কাছে আসবে বা আমিও ওদের কাছে যাব কিন্তু দিবারাত্র ব্যবসা-বাণিজ্য বা বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে সত্যি আর ভাল লাগে না।
বড়বউ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, তুমি তো শুধু তোমার কথাই বললে কিন্তু আমিও তো একটা মানুষ! আমারও তো মন-প্রাণ ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিছু আছে। তার কি কোনো মূল্য নেই?
নিশ্চয়ই মূল্য আছে।
দুর্গাপদ একটু থেমে বলেন, কিন্তু বড়বউ, একটা বয়সে সংসারে যেমন জড়িয়ে পড়তে হয়, তেমনি একটা বয়সে সংসার থেকে মুক্তিও নিতে হয়। তা না হলে…
বড়বউ হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন, তুমি মুক্তি নিয়ে হিমালয়ে যাও কিন্তু আমাকে এভাবে শাস্তি দিও না। ভবানীপুরের ঐ সংসারই আমার কাশীগয়া-বৃন্দাবন।
এই ভাবেই প্রায় বছরখানেক কেটে যায়।
সেদিন নরেশবাবুর সঙ্গে গল্পগুজব করে দুর্গাপদ বাড়িতে পা দিতে না দিতেই রাধা লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, জ্যেঠু, ছোটকাকার খুব অসুখ। বড়মা খুব কাঁদছে।
উপরের বারান্দায় উঠতেই গগনের মা একটা ছোট্ট সাদা খাম দুর্গাপদর হাতে দিয়ে বলল, আপনি বেরিয়ে যাবার পরপরই এই তার এসেছে।
টেলিগ্রামের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়েই দুর্গাপদ আপনমনে অস্ফুট স্বরে বলেন, টাইফায়েড।
রাধা সঙ্গে সঙ্গে বলে, পাশের বাড়ির বড়কাকু এই টেলিগ্রাম পড়ে বললেন, ছোট, কাকার খুব অসুখ।
দুর্গাপদ ধীর পদক্ষেপে ঘরে ঢুকে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, বড়বউ, কান্নাকাটি করো না। ওঠো। আমরা আজই কলকাতা রওনা হব।
.
অঘোরনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দেখো ছোট মা, আমাদের পাড়ার অনেক পরিবারই নিছক ফুর্তি করে, বদমাইশি করে বা খামখেয়ালিপনার জন্য পথের ভিখিরি হয়ে গেছে কিন্তু দত্তদের সম্পর্কে এ ধরনের কথা কেউ বলতে পারবে না।
কণিকা বলেন, বনবিহারী দত্তর তো রক্ষিতা ছিল। তাছাড়া মেজবাবুও ত….
হ্যাঁ, ছোটমা, বনবিহারি দত্তর রক্ষিতা ছিল ঠিকই কিন্তু তার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের, কোনো ক্ষতি করেননি।…
কিন্তু মেজবাবু?
মেজবাবু অনেকগুলো টাকা নষ্ট করেছেন ঠিকই কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের আয় এক পয়সাও কমেনি।
তাহলে ওদের সবকিছু গেল কী ভাবে?
বলতে পার, আট আনা অদৃষ্টের জন্য আর আট আনা নিছক বোকামির বা রক্ষণশীলতার জন্যই ওরা শেষ হয়ে গেল।
কণিকা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, অদৃষ্টের জন্য মানে?
অঘোরনাথ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ছোটমা, আজকাল ম্যালেরিয়া কালাজর তো দুরের কথা, কলেরা-টাইফায়েড বা টি.বি হলেও কেউ মরে না কিন্তু চল্লিশের দশকেও অন্তত দশ-পনের লক্ষ বাঙালি প্রত্যেক বছর ম্যালেরিয়ায় মারা যেতো। কলেরা-টাইফায়েড-টি.বি.হলে তো কাউকেই বাঁচান যেতো না।
আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েরা এসব শুনলে বিশ্বাসই করতে পারবে না।
জানি।
উনি একটু থেমে বলেন, আমার মা মারা যান নিউমোনিয়ায় আর তোমার শ্বশুর মারা যান টাইফয়েডে কিন্তু আজকাল তো ঐসব অসুখে প্রায় কেউই মারা যায় না।
তা তো বটেই।
যাই হোক, দত্তবাড়ির ছোটবাবু মানে গুরুপদও মারা গেলেন টাইফয়েডে। কাশী থেকে বড়বাবু বড়বউ আসার আগেই কি মারা যান?
না, না, ওঁরা আসার পনের কুড়ি দিন পর মারা যান।
অঘোরনাথ মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ওঁকে বাঁচাবার জন্য তিন ভাই আর তিন বউ যে কি চেষ্টা করেছিলেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। নলিনী সেনগুপ্তর মতো বিখ্যাত ডাক্তার সকাল-বিকেল এসে দেখে যেতেন। একবার মনে হয়েছিল, ছেলেটা বোধহয় ভালই হয়ে গেল কিন্তু ঠিক তার দুদিনের মধ্যেই ছেলেটা চলে গেল।
বড়বউ নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়েছিলেন?
ঠিক দেড় মাস পর হার্টফেল করে উনিও মারা গেলেন।
বড়বউও মারা গেলেন?
হ্যাঁ, ছোটমা, উনি এই আঘাত সহ্য করতে না পেরেই চলে গেলেন! যে দেওরকে ঠিক নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছেন, ভালবেসেছেন তার মৃত্যু সহ্য করা কী সহজ ব্যাপার?
ইস! কি দুঃখের ব্যাপার!
বৃদ্ধ অঘোরনাথ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে যান, দত্তবাড়ির এই বড়বউকে আমরা মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করতাম। সত্যি কথা বলতে কি, উনি এই পাড়ার সব ছোট ছেলেমেয়েকেই নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন।
সরকারবাড়ির ঠাকুমার কাছেও ওঁর অনেক প্রশংসা শুনেছি।
যাঁরাই ওঁকে চিনতেন, জানতেন, তারাই ওঁর প্রশংসা করবেন।
উনি না থেমেই কণিকার দিকে তাকিয়ে বলেন, জানো ছোটমা, আমার মা ওঁকে প্রথম দেখে কী বলেছিলেন?
কণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকাতেই অঘোরনাথ বলেন, বিয়ের পরপরই মা একদিন বড়বাবু আর বড়বউকে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিলেন। সেদিন খাওয়া-দাওয়ার পর মা বড়বাবুকে বলেছিলেন, দুর্গা, তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি, তোমার এই বউ কিন্তু সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। এর মুখে যত দিন হাসি থাকবে, তত দিন তোমাদের সংসারে লক্ষ্মী বাঁধা থাকবে। আর এই বউমা যদি কোনো দুঃখ পায়, তাহলে বোধহয় তোমাদের মঙ্গল হবে না।
আমাদের ঠাকুমা এই কথা বলেছিলেন?
হ্যাঁ, ছোটমা, মা এই কথাই বলেছিলেন আর তা বর্ণে বর্ণে মিলে গেছে।
বড়বউ মারা যাবার পর ওদের কি হয়েছিল?
ওর মৃত্যুর পরই তো ওরা ধাপে ধাপে পড়তে শুরু করল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, ছোট মা, সত্যিই তাই।
.
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, সব গাছেরই হাজার হাজার শিকড় থাকে কিন্তু তার মধ্যে প্রধান শিকড়টাই গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখে, দাঁড় করিয়ে রাখে। সব সংসারেই এক একজন মানুষ থাকেন, যাঁকে কেন্দ্র করে সংসারের সুখ-শান্তি শ্রীবৃদ্ধি হয়। বড়বউ তো এইরকমই একজন ছিলেন।
দত্ত পরিবারের এই সব রোগ-শোক-মৃত্যুর পালা শুরু হবার আগে থেকেই বিশ্বের বাজারে নিদারুণ অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছিল কিন্তু তার গুরুত্ব বা ভবিষ্যৎ প্রভাব উপলব্ধির মতো বিদ্যা-বুদ্ধি ওদের কারুরই ছিল না। তখনও বিলেত থেকে জাহাজে সবকিছুই আসছে; দত্ত পরিবার সেসব বিক্রি করে লাভও করছে। তবে হ্যাঁ, এরই মধ্যে। দুএকটা কোম্পানি যন্ত্রপাতি পাঠাতে দেরি করছে বা তৈরি করা বন্ধ করে অন্য কিছু করছে। যে দুটি জার্মান কোম্পানি ইস্পাতের তৈরি যন্ত্রপাতি দত্তদের সাপ্লাই করতো, তারা তো সোজাসুজি জানিয়ে দিল, ওরা অন্য ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরিতে এতই ব্যস্ত যে ভারতবর্ষের এজেন্টদের অর্ডার নেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হলো। এদিকে বিলেত থেকে আসা সব যন্ত্রপাতির দাম বাড়তে শুরু করল। শুধু তাই নয়, প্রায় সব বিলিতি কোম্পানিই জানিয়ে দিল, অর্ডারের সঙ্গে অর্ধেক দাম পাঠাতে হবে; বাকি অর্ধেক জাহাজ থেকে মালপত্র ছাড়াবার আগেই দিতে হবে।
.
বিলেত থেকে এই চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই সেজবাবু আর ন’বাবু বেশ চিন্তায় পড়লেন।
শ্যামাপদ গম্ভীর হয়ে বললেন, এতদিন পর্যন্ত মালপত্র বিক্রি করে টাকাকড়ি হাতে পাবার তিন-চার মাস পরে আমরা ঐসব কোম্পানির পাওনা মিটিয়েছি বলেই আমরা এতগুলি কোম্পানির এজেন্সি চালাতে পেরেছি।
শিবপদ বললেন, তা আর জানি না! খুব ভাল করেই জানি।
কিন্তু এখন থেকে অর্ডারের সঙ্গে অর্ধেক টাকা পাঠাতে হলে তো আমাদের পক্ষে আগের মতো মালপত্র আনানোই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
দুএক মিনিট চিন্তাভাবনা করার পর ন’বাবু বললেন, একবার বড়দার সঙ্গে পরামর্শ করলে বোধহয় ভাল হয়।
সেজবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বড়দার সঙ্গে পরামর্শ করার কথা আমার অনেক আগেই মনে হয়েছে কিন্তু তিনি কি ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারে আর মাথা ঘামাবেন?
আমরা তো তাঁকে রোজ রোজ বিরক্ত করবো না।
শিবপদ একটু থেমে বলেন, এখন যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে, শুধু সেই ব্যাপারে তার মতামত জেনে নেব।
ঠিক আছে; আজ রাত্রেই আমি বড়দার সঙ্গে কথা বলব।
দুর্গাপদ প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত সবকিছু শোনার পর বললেন, আমাকে একটু ভাবতে দাও। দুএকদিন পর আমি তোমাদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলব।
পরের দিনই রাত্রিতে উনি দুভাইকে বললেন, কালই তোমরা মিঃ কেলি বা ব্রাউন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে খোঁজ নাও, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ম-কানুন কি সাময়িক ব্যাপার নাকি অনেকদিন চলবে।
বড়বাবু একটু থেমে বলেন, ব্যাপারটা সাময়িক হলে বিশেষ কোনো চিন্তার কারণ। নেই কিন্তু এই টাকাকড়ির কড়াকড়ি বা মালপত্র আসার ব্যাপারে খানিকটা অনিশ্চয়তা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে নিশ্চয়ই চিন্তার বিষয়।
সেজবাবু বললেন, আমি কালই ওঁদের সঙ্গে দেখা করে দেখি ওরা কি বলেন।
মিঃ কেলি সেদিনই জরুরি কাজে মাদ্রাজ রওনা হবেন বলে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন তাই শ্যামাপদ মিঃ ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করে সবকিছু খোলাখুলি জানতে চাইলেন।
মিঃ ব্রাউন হাতের সিগারেটটা ধরাতে গিয়েও না ধরিয়ে বললেন, মিঃ দাত্তা, তোমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের কোম্পানির কী সম্পর্ক, তা অত্যন্ত ভালভাবে জানি বলেই তোমাকে আমি ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, অবস্থা দিন দিনই খারাপ হবে।
স্যার, আপনিই বলুন, আমাদের কী করা উচিত।
মিঃ ব্রাউন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমাদের কোম্পানিগুলো যেমন অর্ধেক দাম অ্যাডভান্স নিচ্ছে, আপনারাও সেইরকম অ্যাডভান্স নিতে পারলে সব চাইতে ভাল হয়, কিন্তু গভর্নমেন্টের কোনো ডিপার্টমেন্টই তো অ্যাডভান্স দেবে না।
উনি একটু থেমে বলেন, এখানকার দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোও অ্যাডভান্স দেবে কি না তা আমি বলতে পারবো না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, পরিস্থিতি যখন বিশেষ ভাল না, তখন আপনারা যদি সব বিলেতি মালেরই দাম কিছু বাড়িয়ে দেন, তাহলে বোধহয় সকলে তা মেনে নিতে বাধ্য হবে।
শ্যামাপদ ধন্যবাদ জানিয়ে উঠতেই মিঃ ব্রাউন জিজ্ঞেস করলেন, হোয়ার ইজ বড়বাবু? উনি কী এখনও ভারানসীতে?
না, স্যার; উনি এখন এখানেই আছেন।
গুড!
মিঃ ব্রাউন মুহূর্তের জন্য থেমে বললেন, যদি অসুবিধা না হয়, তাহলে উনি যেন আমার সঙ্গে একদিন দেখা করেন।
না না স্যার, অসুবিধে কেন হবে? উনি নিশ্চয়ই দুএকদিনের মধ্যেই আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।
ব্রাউন সাহেব একটু হেসে বলেন, তুমি কি জানো, ডুগাপড়োকে আমি বন্ধু মনে করি?
শ্যামাপদ একগাল হেসে বলেন, খুব জানি স্যার!
.
দুদিন পর বড়বাবু ঘরে পা দিতেই মিঃ ব্রাউন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ওর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ডুগাপডো, তুমি এসেছো বলে আমি খুব খুশি।
ঘরের কোণের দুটি চেয়ারে পাশাপাশি বসে নানা কথাবর্তার পর মিঃ ব্রাউন গম্ভীর হয়ে বললেন, ডুগাপডো, তুমি আমাদের কোম্পানির ক্যালকাটা এজেন্ট হলেও তোমাকে আমি বন্ধু মনে করি বলেই দুএকটা কথা বলতে চাই।
উনি একটু থেমে বলেন, ডুগাপডো, আমি তোমাকে খোলাখুলি বলছি, ইউরোপের অবস্থা বিশেষ ভাল মনে হচ্ছে না। ফ্রান্স আর আমাদের ইংল্যান্ড মিউনিকে হিটলারের সঙ্গে চুক্তি সই করলেও কখন কী হয়, কিছু বলা যায় না।
বড়বাবু চুপ করে ওঁর কথা শোনেন।
সত্যি কথা বলতে কি দুবছর আগে মুসোলিনি হঠাৎ কাউকে তোয়াক্কা না করে ইথিওপিয়া দখল করে নেবার পর থেকেই ইউরোপের সব দেশই বেশ চিন্তায় পড়েছে।
মিঃ ব্রাউন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ডুগাপডো, একটা কথা আমি তোমাকে খুব গোপনে বলতে চাই যে বিলেতের কোনো কোম্পানিই আগের মতো মালপত্র পাঠাতে পারবে না। এই অবস্থা কত দিন চলবে, তা কেউ বলতে পারবে না।
এতক্ষণ চুপ করে এইসব কথা শোনার পর বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, নিছক বন্ধু হিসেবে বলুন, আমাদের কী করা উচিত।
বিলেত থেকে কম-বেশি যেরকমই মালপত্র আসুক না কেন, এজেন্সির কাজ চালিয়ে যাও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এখানেই ছোটখটো যন্ত্রপাতি তৈরি করা শুরু করে দাও।
ব্রাউন একটু থেমে বলেন, বিলেত থেকে এখনই যন্ত্রপাতি আনিয়ে চটপট একটা ফ্যাক্টরি চালু করে দাও। বেশি দেরি করলে এই সুযোগটুকুও বোধহয় থাকবে না।
.
দুর্গাপদ বাড়ি ফিরেই দুই ভাইকে ব্রাউন সাহেবের সব কথা বললেন। তারপর দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর উনি বললেন, কেন জানি না, ব্রাউন সাহেবের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হলো, বিলেত থেকে যন্ত্রপাতি আসা হয়তো হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে।
দুভাই প্রায় এক সঙ্গেই বললেন, তাহলে তো সর্বনাশ।
বড়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সত্যি সত্যিই যদি বিলেত থেকে যন্ত্রপাতি আসা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তো আমাদের আসল ব্যবসাটাই উঠে যাবে।
সেজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ, তা তো হবেই।
ন’বাবু বললেন, বড়দা, কারখানা করার ব্যাপারে আপনার কী মত?
বড়বাবু বললেন, সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে, কারখানার ব্যাপারে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শুধু টাকা থাকলেই তো কারখানা চালানো যায় না।
সেজবাবু বললেন, আমরা বরাবর বিলেত থেকে আমদানি করা যন্ত্রপাতি বিক্রি করেই আয় করেছি।
বড়বাবু সঙ্গে বললেন, ব্রিজ তৈরি করেও তো আমাদের কম আয় হয় না।
তা ঠিক কিন্তু সে কাজ তো অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিই।
কারখানাও তো আমরা অন্যদের দিয়ে চালিয়ে নিতে পারি।
বড়বাবু প্রায় না থেমেই বলেন, সমস্যাটা সেখানে না। আসল চিন্তার বিষয় হচ্ছে, কারখানায় কী তৈরি করা হবে, কারখানা চালাবার উপযুক্ত লোক কোথায় পাওয়া যাবে, কারখানায় তৈরি মালপত্র, কোথায় বিক্রি করা যাবে ইত্যাদি।
ন’বাবু বললেন, বড়দা, আমরা কী এইসব ঝামেলা সামলাতে পারব?
সব ব্যবসাতেই ঝামেলা আছে। তবে কারখানা চালাতে পারবে কি না তা তোমরাই ভেবে দেখ।
সেজবাবু একটু হেসে বলেন, বড়দা, আমরা এঞ্জিনিয়ারও না, বি. এ.-এম. এ পাসও করিনি। আমাদের দ্বারা কি কারখানা চালানো সম্ভব?
বড়বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ব্যাপারটা যে খুব সহজ না, তা আমি জানি কিন্তু তবু তোমরা ভেবে দেখে আমাকে জানিও।
.
১০.
অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, বুঝলে ছোটমা, ওরা ভাবনা চিন্তা আর এর-ওর সঙ্গে পরামর্শ করতে করতেই হিটলারের সৈন্যরা পোল্যান্ড আক্রমণ করেই দখল করে নিল।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই বললেন, সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেন আর ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেই শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
কণিকা প্রশ্ন করেন, সঙ্গে সঙ্গেই কি বিলেত থেকে এখানে যন্ত্রপাতি আসা বন্ধ হয়ে গেল?
খুব জরুরি জিনিসপত্র ছাড়া সবকিছু আসা বন্ধ হয়ে গেল।
দত্তদের ব্যবসার কী হলো?
যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দিকে ওরা ভালই ব্যবসা করেন।…
কী ভাবে?
গুদামে যেসব যন্ত্রপাতি ছিল, তা বেশ চড়া দামে বিক্রি করতেন। তাছাড়া জার্মানি নরওয়ে-ডেনমার্ক-নেদারল্যান্ড ইত্যাদি জয় করে ফ্রান্স আক্রমণ না করা পর্যন্ত বিলেত থেকে যে সামান্য যন্ত্রপাতিই আসুক না কেন, তাও বেশ চড়া দামে বিক্রি করে দত্তরা ভালই আয় করেন।
তারপর?
তারপর যুদ্ধ আরো ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলেত থেকে জাহাজ আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। কদাচিৎ কখনও এক-আধটা জাহাজ এলেও তাতে যন্ত্রপাতি কখনই আসত না।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, যুদ্ধ শুরু হবার বছর দেড়-দুই পর থেকেই দত্তদের এজেন্সির ব্যবসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল।
কণিকা বললেন, ওঁরা, তো ব্রিজও তৈরি করতেন।
হ্যাঁ, করতেন।
উনি একটু থেমে বলেন, যুদ্ধের প্রথম দিকে যুদ্ধে খরচ চালাবার জন্য গভর্নমেন্ট শুধু ব্রিজ তৈরি না, অনেক কাজই বন্ধ করে দেয়। তারপর জাপান যখন একটার পর একটা দেশ দখল করে বার্মা আর ভারতের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল, তখন গভর্নমেন্ট সৈন্য-সামন্ত গাড়ি-ঘোড়া ট্যাঙ্ক নিয়ে যাবার জন্য আসামের দিকে তড়িঘড়ি করে রাস্তাঘাট-ব্রিজ বা এয়ার ফিল্ড তৈরি শুরু করল।
অঘোরনাথ একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, হ্যাঁ, তখন হাজার হাজার নতুন কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গে ওঁরাও বেশ ভালই কাজ পেয়েছিলেন।
তারপর ওঁরা কী ব্যবসা করেন?
বলছি ছোটমা, সব বলছি।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ঐ যুদ্ধের বাজারেই ওরা মেজবাবুর মেয়ের বিয়ে দিলেন খুবই ধুমধাম করে। যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে বড়বাবু মারা গেলেন।
তারপর?
উনিশ শ পঁয়তাল্লিশ সালের মে মাসে জার্মানি আর আগস্ট মাসে জাপান আত্মসমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো ঠিকই কিন্তু সারা দেশের অবস্থা তখন খুবই খারাপ।
খারাপ মানে?
অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, ছোটমা, তখন তুমি নেহাতই শিশু ছিলে বলে কিছুই বুঝতে পারেনি।
উনি একটু থেমে বলেন, তখন টাকা দিয়েও চাল-ডাল-তেল-নুন-কাপড় চোপড় পাওয়া দুষ্কর ছিল। যুদ্ধ হঠাৎ থেমে যাওয়ায় লক্ষ লক্ষ লোক রাতারাতি বেকার হয়ে গেল। এককথায় তখন চারদিকেই হাহাকার অবস্থা।
কণিকা চুপ করে শুধু ওঁর কথা শোনেন।
অন্য দিকে রাজনীতিতেও তখন টালমাটাল অবস্থা। কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের জন্য যেসব কংগ্রেস নেতা আর কর্মীরা জেলে ছিলেন তারা জেল থেকে ছাড়া পেলেও মুসলিম লিগের দৌরাত্ম্যে যখন-তখন এখানে-ওখানে মারামারি কাটাকাটি লেগেই থাকত।
অঘোরনাথ একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, এদিকে দেশ স্বাধীনতার দিকে যতই এগুচ্ছে ততই মারামারি কাটাকাটি বাড়তে লাগল।
উনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলেন, বুঝলে ছোটমা, মুসলিম লিগের ডায়রেক্ট অ্যাকশানের দিন লিগের হাজার হাজার লাখ লাখ গুণ্ডারা মুড়ি-মুড়কির মতো হিন্দুদের খুন করল।
কণিকা গম্ভীর হয়ে বলেন, হ্যাঁ, বাবা-মার কাছে শুনেছি, তখন ঐ খুন-খারাপির জন্য আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে ওঁদের পালাতে হয়েছিল।
ছোটমা, তুমি শুনলে অবাক হবে, সারা শহরে যখন তাণ্ডব চলছে, তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী সাহেব পুলিশকে কিচ্ছু করতে দেননি। কদিন পর যখন হিন্দুরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করল, তখনই প্রথম পুলিশকে রাস্তায় দেখা গেল।
এসব আমরা ভাবতেই পারি না।
ছোটমা, তখন শুধু কলকাতায় না, বিহার আর নোয়াখালিতে যা ঘটেছিল, তা কোনো সভ্য দেশে ঘটে না।
তখন দত্তদের কী অবস্থা?
যুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে দেশ স্বাধীন হবার বছর খানেক বছর দেড়েক পর্যন্ত ওঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না বললেই হয়। এই সময়ই সেজবাবু আর ন’বাবু ওঁদের স্ট্রান্ড রোডের বিশাল গুদাম আর ক্যানিং স্ট্রিট-চীনাবাজার এলাকার দুটো অফিস জালানদের কাছে বিক্রি করে দেন।
তারপর কি ওঁরা আর ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি?
অঘোরনাথ একটু চাপা হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ, করেছিলেন বৈকি। তবে এমনি কোনো ব্যবসা না, ব্যাঙ্কের ব্যবসা।
কণিকা অবাক হয়ে বলেন, ব্যাঙ্কের ব্যবসা?
উনি আগের মতোই চাপা হাসি হেসে বলেন, হ্যাঁ, ছোটমা, ব্যাঙ্কের ব্যবসা।
ব্যাঙ্কের ব্যবসা মানে? তাহলে তোমাকে একটু খুলেইই বলি।
.
সেদিন রবিবার।
সাত সকালে বাড়ির সামনে বিরাট ফোর্ড গাড়িটাকে থামতে দেখেই সেজবউ স্বামীকে বললেন, হ্যাঁগো, তোমার কাছে বোধহয় কেউ এসেছেন।
কে আবার এলেন এই সাত সকালে?
ভদ্রলোককে ঠিক চিনতে পারলাম না।
সেজবউ একটু থেমে বললেন, তবে ভদ্রলোককে দেখে মনে হলো, বোধহয় রাধার বিয়েতে এসেছিলেন।
ঠিক সেই সময়ই মাখন এসে বলল, সেজবাবু, বিধু দত্ত আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
সেজবাবু অবাক হয়ে বললেন, বিধু দত্ত নিজে এসেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
শ্যামাপদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েই বলেন, বৈঠকখানায় বসিয়েছিস তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
পাখা খুলে দিয়েছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সেজবাবু নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েই মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে স্ত্রীকে বললেন, সেজবউ, চট করে ঠৈকখানায় চা-জলখাবার পাঠিয়ে দাও।
স্ত্রীর উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই উনি তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যান।
.
সেজবাবুকে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকতে দেখেই বিধু দত্ত এক গাল হেসে বলেন, এসো, শ্যামাপদ, এসো। টেলিফোন না করে এসে গেলাম বলে কী…..
সেজবাবুও একগাল হাসি হেসে বলেন, আপনি কেন কষ্ট করে এলেন আমাকেই তো ডেকে পাঠাতে পারতেন।
সেজবাবু পাশের সোফায় বসতেই বিধুবাবু বললেন, যে বাড়িতে ছোটবেলায় হরদম। এসেছি খেয়েছি, সেখানে এলে যে ভাল লাগে, তা কি জানো না?
কথাটা শুনে সেজবাবু একটু হাসেন।
বিধুবাবু বললেন, শিবপদ কি বাড়িতে আছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে।
তাহলে ওকেও ডাক দাও।
বিধুবাবুমুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তোমাদের দুজনের সঙ্গে একটু জরুরি পরামর্শ আছে।
বিধুবাবু চা-জলখাবার খেতে খেতে ন’বাবু হাজির হন।
দুপাঁচ মিনিট পারিবারিক কথাবার্তা বলার পর বিধুবাবু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, যুদ্ধে যত ক্ষয়-ক্ষতিই হোক, তোমরা নিশ্চই স্বীকার করবে, যুদ্ধের কৃপায় হাজার হার বাঙালি ব্যবসা করতে শিখেছে ও প্রায় সবাই বেশ ভাল টাকাই আয় করেছে।
সেজৰাবু বললেন, তা ঠিক।
শিবপদ একটু হেসে বলেন, আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবই তো একজোট হয়ে, যশোর এয়ারফোর্সে স্টেশনে নানা ধরনের কাজকর্ম করে রাজা হয়ে গেছে।
বিধুবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চই স্বীকার করবে, এইসব লোকজন যেভাবেই হোক আবার নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করবে।
সম্মতিতে দুভাই মাথা নাড়েন।
উনি বলে যান, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে এদের আরো টাকা লাগবে এবং ব্যাঙ্ক ছাড়া কেউই সে লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি টাকার যোগান দিতে পারবে না।
শ্যামাপদ বললেন, কিন্তু ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক কি ওদের সবাইকে টাকা দিতে রাজি হবে?
বিধুবাবু একটু হেসে সামনের গোল টেবিলে একটা চাটি মেরে বললেন, কখনোই দেবে না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক এইজন্যই ঠিক করেছি, আমরা কয়েকজন মিলে নতুন ব্যাঙ্ক খুলব।
শ্যামাপদ বললেন, যেমন ত্রিদিব লাহা কর্নওয়ালিশ ব্যাঙ্ক খুলেছেন, সেইরকম?
হ্যাঁ।
শিবপদ বললেন, এই কমাসের মধ্যেই তো ওরা বোধহয় সাত-আটটা ব্রাঞ্চ খুলে ফেলেছেন।
লোকে যদি টাকা রাখতে চায়, তাহলে ব্যাঙ্ক ব্রাঞ্চ খুলবে না কেন?
এবার উনি একটু হেসে বলেন, আমাদের নতুন ব্যাঙ্কে তোমরাও থাকবে। তোমরা ভাইই ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর হবে।
শ্যামাপদ আর শিবপদ একই সঙ্গে বলেন, আমরা?
বিধুবাবু বেশ জোরেই হাসতে হাসতে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমরা।
.
অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, বুঝলে ছোটমা, এই বিধুবাবু তখনকার দিনে এক স্মরণীয় ব্যক্তি ছিলেন।
ওর কথার ইঙ্গিত ঠিক বুঝতে না পেরে কণিকা জিজ্ঞেস করেন, স্মরণীয় ব্যক্তি ছিলেন মানে? উনি কি খুব বড়লোক, নাকি নাম করা পণ্ডিত মানুষ ছিলেন?
বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর হয়ে বলেন, দুঃখের কথা কি বলব ছোট মা, তেতাল্লিশের মন্বন্তরে আমাদের এই বাংলা দেশে যে পঞ্চাশ লাখ লোক না খেয়ে মারা যায়, তার মধ্যে অন্তত পনের-বিশ লাখ লোকের মৃত্যুর জন্য এই বিধুবাবু দায়ী ছিলেন।
কণিকা চমকে উঠেন, বলেন কী ছোটকাকা?
হ্যাঁ, ছোট মা, ঠিকই বলছি।
উনি মুহূর্তের জন্য থামতেই কণিকা জিজ্ঞেস করেন, ঐ তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে পঞ্চাশ লাখ মারা যায়? সে বছর কি দেশে ধান-চাল হয়নি?
ধান-চালের অভাবে তো সেবার দুর্ভিক্ষ হয়নি। সেবারের দুর্ভিক্ষ তো বিধুবাবুর মত কিছু ব্যবসাদার সৃষ্টি করেছিলেন।
বিধুবাবুদের জন্য দুর্ভিক্ষ হয়েছিল?
হ্যাঁ, ছোট মা, বিধুবাবুর মত কয়েকজন বিবেকহীন হৃদয়হীন স্বার্থপর লোভী ব্যবসাদারের জন্যই পঞ্চাশ লাখ লোক না খেয়ে মারা যায়।
অঘোরনাথ একটু থেমে কণিকার দিকে তাকিয়ে বলেন, জাপান একটা পর একটা দেশ দখল করে ভারতবর্ষের দিকে এগিয়ে আসতেই লক্ষ লক্ষ ইংরেজ-আমেরিকান অস্ট্রেলিয়ান সৈন কলকাতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বহু শহরে ছড়িয়ে পড়ল।
কণিকা কোন প্রশ্ন না করে অপলক দৃষ্টিতে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
বৃদ্ধ বলে যান, ঐ লক্ষ লক্ষ সৈন্যসামন্ত আর যুদ্ধের ব্যাপারে হাজার রকম কাজে নিযুক্ত লোকজনদের খাওয়াবার জন্য গভর্নমেন্ট বাজার থেকে চাল কেনা শুরু করল।
অঘোরনাথ একটা তুড়ি দিয়েই বলেন, ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম পাঁচ টাকা থেকে দশ টাকা, দশ টাকা থেকে বিশ টাকা, বিশ টাকা থেকে……
ওর কুথার মাঝখানেই কণিকা প্রশ্ন করেন, তখন কি এক কিলো চালের দাম পাঁচ টাকা ছিলো?
না, না, কিলো-টিলো না। যুদ্ধ শুরু হবার পরও চালের মণ পাঁচ টাকা ছিল।
কণিকা একটু হেসে বলেন, তখন চাল এত সস্তা ছিল? অঘোরনাথ একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, ছোট মা, তখন সব কিছুই সস্তা ছিল। সরষের তেল ছিল পাঁচ আনা সের। আমাদের এই ভবানীপুরের বাড়ি থেকে ট্যাক্সিতে হাওড়া স্টেশন যেতাম এক টাকা দু আনায় আর হাওড়া থেকে এলাহাবাদের ইন্টার ক্লাশের ভাড়া ছিল আট টাকা।
কণিকা হাসতে হাসতেই বলেন, এ তো রাম রাজত্বের কাহিনী শোনালেন।
আমি জানি ছোট মা, এসব তোমাদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকেই জিনিস-পত্তরের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করল।
উনি একটু থেমে বলেন, এখন তো তুমিই দশ টাকা দিয়ে এক কিলো চাল কিনছ কিন্তু তখন চালের মণ চল্লিশ টাকা হওয়ায় পঞ্চাশ লাখ লোককে না খেয়ে মরতে হয়েছিল।
বিধুবাবুও এর জন্য দায়ী?
এক শ বার দায়ী।
অঘোরনাথ বেশ জোরের সঙ্গেই কথাটা বলে একটু থামেন। তারপর আবার শুরু করেন, যুদ্ধ শুরু হবার আগে বার্মা থেকে চাল না আনলে আমাদের প্রয়োজন মিটত না কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই বার্মা থেকে চাল আসা বন্ধ হয়ে গেল। তবু দেশের ধান-চাল খেয়েই দেশের মানুষ কোনমতে বাঁচতে পারতো কিন্তু তখন ইংরেজদের কাছে যুদ্ধে লড়াই করাই সব চাইতে বড় ব্যাপার। দেশের লোক মরলো কি বাঁচলো, তাতে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অঘোরনাথ কয়েক মিনিট চুপ করে থাকেন।
তারপর আবার উনি বলেন, পাঞ্জাবের ইস্পাহানী সাহেবকে গভর্নমেন্টই বাংলাদেশের বাজার থেকে লক্ষ লক্ষ মণ চাল কেনার কনট্রাক্ট দিলেন। আর ইস্পাহানী এই দায়িত্ব যে তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দিলেন, তার একজন ছিলেন এই বিধু দত্ত।
অঘোরনাথ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বুঝলে ছোট মা, ঐ ইস্পাহানীর পরামর্শে এই বিধু দত্তরা বাজারের দরের চাইতে দু পাঁচ টাকা বেশি দাম দিয়ে রোজ হাজার হাজার মণ চাল কিনতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চালের দাম বাড়তে শুরু করল।
এই বিধু দত্ত কী ভবানীপুরেরই লোক?
না, না, ও কোন কালেই আমাদের পাড়ায় থাকেনি।
উনি একটু থেমে বলেন, শুনেছি, আগে বিধু দত্ত বারো টাকা ভাড়ায় কালীঘাটের একটা বাড়ির দুখানা ঘরে চারটি ছেলেমেয়ে ছাড়া মা আর বউকে নিয়ে থাকত।
তারপর কোথায় থাকতেন?
অঘোরনাথ একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, বিধু দত্ত সমস্ত উত্তর বাংলা–মানে দার্জিলিং, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রাজশাহি, দিনাজপুর, রংপুর, মালদা, জলপাইগুড়ি–এই আটটা জেলা থেকে চাল কেনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এক একটা জেলার লাভ দিয়ে উনি কলকাতায় এক একটা বাড়ি করেন বা কেনেন।
তার মানে ওর আটটা বাড়ি ছিল?
হ্যাঁ।
উনি একটু থেমে বলেন, তার মধ্যে কবীর রোড, সাদার্ন অ্যাভিনিউ বা আমির আলি অ্যাভিনিউয়ের বাড়িগুলো তো প্রাসাদের মত ছিল।
তার মানে উনি প্রচুর টাকা আয় করেছিলেন।
হ্যাঁ, দু তিন কোটি টাকা নিশ্চয়ই আয় করেছিলেন।
বৃদ্ধ মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলেন, আর কি জানো ছোট মা, এই পাপের টাকা আয় করার ফলও উনি হাতে হাতে পেয়েছিলেন।
কী ফল পেয়েছিলেন?
যে দিনই উনি দশ-বিশ লাখ টাকার চেক নিয়ে বাড়িতে এসেছেন, সেই সব দিনই ওর এক একটা সর্বনাশ হয়েছে।
তাই নাকি?
অঘোরনাথ গম্ভীর হয়ে বলেন, প্রথম দিন যেদিন উনি মোটা টাকার চেক পান, সেদিনই ওঁর স্ত্রী মারা যায়। মাস তিনেক পর আবার যেদিন দশ-বারো লাখ টাকার চেক পান, সেদিনই ওর মা আগুনে পুড়ে মারা যায়।
বলেন কী ছোটকাকা?
শুনলে তুমি অবাক হবে ছোট মা, কবীর রোডের বাড়ির গৃহপ্রবেশের দিনই তিন তলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে ওঁর ছোট ছেলে মারা যায়।
কণিকা একটু মুখ বিকৃতি করে বলেন, এতগুলো সর্বনাশের পরও বিধুবাবুর মাথা ঠিক ছিল?
বৃদ্ধ একটু মুখ বিকৃত করে বলেন, এই সর্বনাশের পর বিধু দত্ত বড়ছেলের বিয়ে দেবার জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে মেয়েটিকে ওর এত ভাল লেগে গেল যে ঐ মেয়েটিকে উনি নিজেই বিয়ে করেন।
এ রাম! রাম!
কণিকা একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, মেয়েটার বাড়ির লোকজন রাজি হল কীভাবে?
বিধু দত্তর বাড়ি-গাড়ি টাকাকড়ি দেখে বেচারীদের মাথা ঘুরে গিয়েছিল।
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর কণিকা জিজ্ঞেস করেন, বিধুবাবুর ছেলেমেয়েরা কেমন ছিল? উনি ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে-থা দিয়েছিলেন?
ঐ বাপের ছেলেমেয়ে কী ভাল হয়?
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, বিধুবাবুর চার পাঁচটা মোটর গাড়ি ছিল। হিন্দুস্থানী ড্রাইভার এই গাড়িগুলো চালাত। তখন কবীর রোডে কাননবালাও থাকতেন। উনি একটা প্যাকার্ড গাড়ি চড়তেন বলে বিধুবাবুও প্রায় লাখ খানেক টাকা দিয়ে একটা প্যাকার্ড গাড়ি কিনলেন।……
প্যাকার্ড কি খুব দামী গাড়ি ছিল?
হ্যাঁ, ছোট মা, খুবই দামী গাড়ি ছিল।
উনি একটু থেমে বলেন, তখন কলকাতা শহরে শুধু গভর্নর আর কাননবালাই প্যাকার্ড চড়তেন। ওদের পর বিধু দত্ত আর গোয়েঙ্কারা প্যাকার্ড কেনেন।
বিধুবাবুর ছেলেমেয়েদের কথা বলুন।
ওর মেয়ের কথাই বলব বলেই তো প্যাকার্ড গাড়ির কথা বলতে হল।
কণিকা একটু বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন, প্যাকার্ড গাড়ির সঙ্গে মেয়ের লেখাপড়া বা বিয়ে-থার কী সম্পর্ক?
অঘোরনাথ একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, বিধু দত্ত ঐ প্যাকার্ড গাড়ি চালাবার জন্য যে বাঙালি ছোকরাটাকে চাকরি দিয়েছিলেন, সে একদিন ঐ গাড়ি আর বিধু দত্তর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
হা ভগবান!
কিন্তু ছোট মা, তুমি শুনলে অবাক হবে, মেয়েটা ওকে বিয়ে করে সত্যি সুখী হয়েছিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, ওরা পালিয়ে যাবার মাস তিনেক পর একদিন ভোরবেলায় উঠে বিধু দত্ত দেখলেন, বাড়ির সামনে তার প্যাকার্ড গাড়িটা রাখা আছে। সামনের সিটের উপর মেয়ের লেখা দুচার লাইনের একটা চিঠি-বাবা, আমি আমার সিদ্ধান্তে ভুল করিনি। আমার স্বামীর অর্থ-প্রতিপত্তি না থাকলেও সে সৎ এবং পরিশ্রমী। আমি আমার স্বামীর কাছে যে মর্যাদা ও ভালবাসা পাচ্ছি, তা অনেকের কপালেই জোটে না।….
বিধু দত্তর ছেলেরা কী করতো?
ওর দুটি ছেলে দুটি অবতার ছিল। দুটোর কোনটাই ম্যাট্রিক পাস করতে না পারলেও গুণের শেষ ছিল না।
আচ্ছা ছোটকাকা, বিধু দত্ত সত্যি সত্যি ব্যাঙ্ক খুলেছিলেন?
হ্যাঁ, ছোট মা, ব্যাঙ্ক খুলেছিলেন।
সে ব্যাঙ্ক এখনও চলছে?
না, না, সে ব্যাঙ্ক করে উঠে গেছে।
উঠে গেছে?
হ্যাঁ।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, এই হতচ্ছাড়া বিধু দত্তর জন্য যে কত হাজার হাজার মধ্যবিত্ত আর ছোটখাটো ব্যবসাদারদের সর্বনাশ হয়েছিল, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, এই ব্যাঙ্কের জন্যই তো আমাদের এই দত্ত পরিবারকে বাড়ি থেকে পালাতে হয়েছিল।
কণিকা অবাক হয়ে বলেন, পালাতে হয়েছিল? কেন?
সে অনেক কথা!
.
মাস তিনেক ধরে আলাপ-আলোচনা শলা-পরামর্শের পর ঠিক হল, ব্যাঙ্কের নাম। হবে গ্রেট ক্যালকাটা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন। চেয়ারম্যান হলেন বিধুভূষণ দত্ত। ডিরেক্টর হলেন শ্যামাপদ দত্ত, শিবপদ দত্ত ছাড়াও বিধুবাবুর স্ত্রী শ্রীমতী পারুল দত্ত ও ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের ভূতপূর্ব চিফ ক্যাশিয়ার স্নেহময় সরকার।
বিধুবাবু বললেন, বুঝলে শ্যামাপদ, ব্যাঙ্কের কয়েক শ কর্মচারীকে ঠিক মত চালান আর লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার পাই পয়সা পর্যন্ত হিসেব-নিকেশ রাখা খুব সহজ ব্যাপার না।
শিবপদ একটু হেসে বলেন, তা আমরা খুব ভাল করেই জানি।
তাছাড়া আমাদের ব্যাঙ্কের ভিতরকার খবর-টবর যাতে অন্য ব্যাঙ্কে পৌঁছে না যায়, সেদিকেও যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হবে।
শ্যামাপদ বললেন, সে তো রাখতেই হবে। তা না হলে আমরা ব্যাঙ্ক চালাব কী করে?
এবার বিধুবাবু বললেন, শ্যামাপদ-শিবপদ, তোমাদের যদি মত থাকে, তাহলে বাইরের কাউকে জেনারেল ম্যানেজার না করে স্নেহময়বাবুকেই জেনারেল ম্যানেজার করলেই বোধহয় ভাল হয়।
প্রস্তাবটা শুনে স্নেহময়বাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন, আমাকে? রিটায়ার করার পর আবার…
শ্যামাপদ বললেন, স্নেহময়বাবু, আপনি জেনারেল ম্যানেজার হলে আমরা কত নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো, তা জানেন?
শিবপদ ওকে বললেন, আপনি ব্যাঙ্কের একজন প্রধান শেয়ার হোল্ডার আর ডিরেক্টর। ব্যাঙ্কের ব্যাপারে আপনার যে দরদ থাকবে, তা কি মাইনে করা লোকের কাছে। পাওয়া সম্ভব?
বিধুবাবু বলেন, ঠিক বলেছ শিবপদ।
শেষ পর্যন্ত স্নেহময়বাবু ওদের প্রস্তাব মেনে নেন।
এদিকে ঠিক হল, বিধুবাবু ও তার স্ত্রী দশ-দশ লাখ করে বিশ লাখ ও শ্যামাপদ শিবপদও বিশ লাখ বিনিয়োগ করবেন। এছাড়া স্নেহময়বাবু পঞ্চাশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করবেন; তবে তার অর্ধেক নগদে ও বাকি অর্ধেক মাসিক হাজার টাকার কিস্তিতে। হ্যাঁ, স্নেহময়বাবুর মাইনে ঠিক হল দুহাজার টাকা।
এরপর ওরা ঠিক করলেন, জনসাধারণের আস্থা অর্জনের জন্য প্রথমেই অত্যন্ত ভালভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে দশটি ব্রাঞ্চ খোলা হবে। তারপর প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে একটি করে নতুন ব্রাঞ্চ খোলা হবে।
বিধুবাবু স্নেহময়বাবুকে বললেন, মিঃ সরকার, এমন করে ব্যাঙ্ক চালাতে হবে যে প্রত্যেকটি লোক যেন স্বীকার করতে বাধ্য হয়, আমাদের ব্যাঙ্কের সঙ্গে বিলিতি ব্যাঙ্কের কোনো পার্থক্য নেই।
হ্যাঁ, আমিও ঠিক তাই চাই।
আর একটা কথা। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপা হবার আগে যেন এই ব্যাঙ্কের ব্যাপারে কেউ কিচ্ছু না জানতে পারে, সেদিকে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
অঘোরনাথ চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, তোমাকে কি বলব ছোট মা, ওদের ঐ ব্যাঙ্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার মানুষ সত্যি চমকে উঠল।
চমকে উঠল কেন?
তখন দুতিনটে বিলেতি ব্যাঙ্ক ছাড়া শুধু ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কই বিখ্যাত ছিল। যুদ্ধের বাজারে বেঙ্গল ব্যাঙ্ক, ভবানীপুর ব্যাঙ্ক, ক্যালকাটা ব্যাঙ্ক বা ঐ ধরনের যে ব্যাঙ্কগুলো। গজিয়ে উঠেছিল তারা মোটামুটি ভাল ব্যবসা করলেও দত্তদের ব্যাঙ্কের মত আধুনিকও ছিল না- বা একই সঙ্গে এতগুলো ব্রাঞ্চ খুলে ব্যবসাও শুরু করতে পারেনি।
ওদের ব্যাঙ্ক বুঝি খুব সুন্দর ছিল?
হ্যাঁ, ছোটমা, ওদের ব্যাঙ্কে গেলেই মনে হতো, কোনো বিলিতি ব্যাঙ্কে এসেছি।
উনি একটু থেমে বলেন, দুতিন মাসের মধ্যেই ঐ ব্যাঙ্কের এমন সুনাম হল যে হাজার হাজার লোক অন্য ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ওদের ব্যাঙ্কে রাখতে শুরু করল।…
কণিকা প্রশ্ন করেন, তাহলে ওদের ব্যাঙ্ক উঠে গেল কেন?
অঘোরনাথ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তখন ব্যাঙের ছাতার মত যতগুলো ব্যাঙ্ক গজিয়ে উঠেছিল, সেগুলো উঠে যায় এক দল লোকের জোচ্চুরি বদমাইশির জন্য।
জোচ্চুরি মানে?
বৃদ্ধ একটু হেসে বলে, বিধু দত্ত স্রেফ জোচ্চুরি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার জন্যই ব্যাঙ্ক খুলেছিল কিন্তু তিনি খুব ভাল করেই জানতেন, শ্যামাপদ-শিবপদ টাকা খাঁটিয়ে লাভ করার জন্যই বিশ লাখ টাকা এই ব্যবসায় ঢেলেছিল।
উনি একটু থেমে বলেন, তাই তো ব্যাঙ্ক একটু জমে উঠতেই বিধু আর ওর চেলা স্নেহময় সরকার ওদের দুভাইকে হাত করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন।
.
সাত সকালে সস্ত্রীক বিধু দত্ত ফিরপোর বিরাট দুটো কেক নিয়ে হাজির হতেই শ্যামাপদ আর শিবপদ অবাক।
বিধু দত্ত হাসতে হাসতে বললেন, গ্রেট ক্যালকাটা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের ডিরেক্টরদের বাড়িতে তো আর দশ-বিশ টাকার দানাদার হাতে করে আসতে পারি না!
ওর কথা শুনে দুভাই হো হো করে হেসে ওঠেন।
শ্যামাপদ চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলেন, এবার মনে হচ্ছে, আমরা সত্যি ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর হয়েছি।
বিধু দত্ত একটু হেসে বলেন, এ তো সবে কলির সন্ধে। এখন দিন দিনই বুঝতে পারবে, এই ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর হওয়া কত সম্মানের, কত ক্ষমতার।
শিবপদ শ্রীমতী দত্তকে উপরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতেই বিধুবাবু একটু চাপা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, ব্যাঙ্কের ব্যাপারে তোমরা খুশি তো?
শ্যামাপদ খুশির হাসি হেসে বলেন, আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি ব্যাঙ্ক এত ভাল চলবে।
কী হে শিবপদ, তোমার কী মনে হচ্ছে?
শিবপদ একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, আমার তো মনে হচ্ছে, বছর তিনেকের মধ্যেই আমরা আমাদের ইনভেস্ট করা টাকাটা উঠিয়ে নিতে পারব।
বিধুবাবু মুচকি হেসে বললেন, আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের বিশ লাখ টাকা দুবছরের মধ্যেই পেয়ে যাবে।
দুবছরের মধ্যে পেয়ে যাব?
হ্যাঁ, পেয়ে যাবে।
তার মানে বছরে দশ লাখ…
শ্যামাপদ ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, তার মানে মোটামুটি ভাবে মাসে মাসে প্রায় একাশি হাজার টাকা।
বিধুবাবু আলতো করে টেবিল চাপড়ে বলেন, আরে ওর চাইতে বেশিই তো তোমরা ডিরেক্টর হিসেবে পাবে। এর উপর শেয়ার হোল্ডার হিসেবে লাভ তো আছেই।
শিবপদ বলে, আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
বিধুবাবু একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের কটা গাড়ি?
তিনটে।
ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর হিসেবে ব্যাঙ্ক থেকেই তোমাদের দুটো গাড়ি পাবার কথা।
শ্যামাপদ বলেন, ব্যাঙ্কের গাড়ি পেলে ব্রাঞ্চগুলো একটু ঘুরে-ফিরে দেখার সুবিধে হয়।
শোনো শ্যামাপদ, ব্যাঙ্ক থেকেই তোমাদের দুটো গাড়ি কিনে দেওয়া হবে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তোমাদের গাড়ি তোমাদের কাছেই থাকবে। মাঝখান থেকে তোমরা দুটো গাড়ির জন্য লাখ খানেক টাকা পেয়ে যাবে আর গাড়ি দুটো চালাবার অন্য সব খরচও ব্যাঙ্ক দেবে।
শিবপদ খুশির হাসি হেসে জিজ্ঞেস করেন, দুজন ড্রাইভারের মাইনেও ব্যাঙ্ক দেবে?
একশবার দেবে।
বিধুবাবু একটু হেসে বলেন, ভুলে যেও না শিবপদ, আমরা ভাল টাকা আয় করব বলেই ব্যাঙ্কের ব্যবসা শুরু করেছি; ব্যাঙ্কের টাকাকড়ি বিলিয়ে দেবার জন্য আশ্রম খুলিনি।
শ্যামাপদ জিজ্ঞেস করেন, আপনি আর বৌদিও গাড়ির জন্য ব্যাঙ্ক থেকে টাকা…
সব ডিরেক্টরেরই সমান সুযোগ পাওয়া উচিত, তাই না?
উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমরা দুজনেও একই ভাবে। ব্যাঙ্ক থেকে লাখখানেক নেব।
না, না, আপত্তির কী আছে!
তাহলে কাল এগারটা নাগাদ তোমরা দুজনেই হেড অফিসে এসা। এই গাড়ির ব্যাপারটা তখনই মিটিয়ে ফেলা যাবে।
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
বিধুবাবু একটু হেসে বলেন, আমাদের দুজনের কাগজে তোমরা সই করবে আর তোমাদের কাগজে আমরা সই করব। ব্যস! তাহলেই কোন ঝামেলা থাকবে না।
শিবপদ বললেন, আমরা ডিরেক্টর হিসেবে তো এসব করতেই পারি, তাই না?
বিধুবাবু সামনের সেন্টার টেবিলের উপর একটা ঘুষি মেরে বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন, আমরা তিনজন ডিরেক্টর এক মত হলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারি।
ঠিক সেই সময় শ্রীমতী দত্ত উপর থেকে নেমে এসে ড্রইংরুমে পা দিয়েই স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা, আমরা টি ব্যাঙ্কের টাকায় বাইরে যেতে পারি?
বাইরে মানে?
বাইরে মানে দিল্লি- বোম্বে এলাহাবাদ-লক্ষ্ণৌ…
বিধুবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ব্যাঙ্কের কাজে যাচ্ছ বললেই ব্যাঙ্ক সব খরচ-পত্তর দিতে বাধ্য।
পারুল দেবী স্বামীর পাশে বসেই বললেন, তাহলে আমার একটা প্রস্তাব তোমাদের সাবাইকে মেনে নিতে হবে।
শ্যামাপদ সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, বৌদি, আপনার প্রস্তাব না মেনে নিলে ভবিষ্যতে আমাদের প্রস্তাবও তো আপনি মেনে নেবেন না।
না, তা না কিন্তু…
বিধুবাবু বললেন, আগে তোমার প্রস্তাবটাই তো বলো।
পারুল দেবী গম্ভীর হয়ে বললেন, কালই ন’ঠাকুরপোকে বাইরে যাবার জন্য দশ হাজার টাকা দেবার ব্যবস্থা করবে।
শিবপদ অবাক হয়ে বলেন, আমি ব্যাঙ্কের কাজে দিল্লি-বোম্বে গিয়ে কী করব?
বিধুবাবু বলেন, ওরে বাপু, শুধু ব্যাঙ্কের খাতায় লেখা থাকবে তুমি ব্যাঙ্কের কাজে যাচ্ছ।
পারুল দেবী বলেন, ন’ঠাকুরপো ওর স্ত্রী আর ছেলেদের নিয়ে ঘুরে আসার পর সেজ ঠাকুরপোরা বাইরে যাবেন। তারপর আমরা যাবো।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, কী, আমার প্রস্তাব পাস হলো তো?
ওরা তিনজনেই এক সঙ্গে হাসতে হাসতে বললেন, পাস।
.
অঘোরনাথ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ছোট মা, মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে বাঘ যেমন পাগল হয়ে ওঠে, সেইরকম পরের টাকায় ফুর্তি করার সুযোগ পেলেও মানুষ আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।
উনি একটু থেমে বলেন, ঐ হতচ্ছাড়া বিধু দত্তর পাল্লায় পড়ে সেজবাবুনবাবু পর্যন্ত দুহাতে না–দশ হাতে ব্যাঙ্কের টাকা ওড়াতে শুরু করলেন।
কণিকা জিজ্ঞেস করেন, কী ভাবে ওরা টাকা ওড়াতে শুরু করলেন? ব্যাঙ্কের টাকা কী যা-তা ভাবে খরচ করা যায়?
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, ছোট মা, তখনকার দিনে পান-বিড়ি বা মুদিখানার দোকান খোলার মত যে কেউ ব্যাঙ্কের ব্যবসা করতে পারত। তবে টাটা-বিড়লাদের মত পাকা ব্যবসাদাররা অন্য পাঁচটা ব্যবসার মত ব্যাঙ্কের ব্যবসাও ভাল ভাবে চালিয়ে লাখ লাখ কোটি-কোটি টাকা লাভ করত। আর বিধু দত্তদের মত বেইমানরা শুধু জোচ্চুরি করার জন্যই ব্যাঙ্ক খুলেছিল।
উনি একটু থেমে বলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর ব্যাঙ্কের এইসব জোচ্চুরি বন্ধ করার জন্যই নতুন আইন তৈরি হয়।
যাই হোক বিধু দত্তদের কথা বলুন।
বছর দুয়েকের মধ্যে ওদের ঐ ব্যাঙ্ক দার্জিলিং কুচবিহার-রাজশাহি থেকে চব্বিশ পরগনা-মেদিনীপুর আর চট্টগ্রাম-নোয়াখালি থেকে বর্ধমান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আর তার ফলে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ তাদের দুশ পাঁচশ বা হাজার দু হাজার টাকা এই ব্যাঙ্কে রাখায় বিধু দত্তদের হাতে কোটি কোটি টাকা এসে গেল।
অতগুলো ব্রাঞ্চ খুললে কোটি কোটি টাকা তো জমা পড়বেই।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, বিধু দত্ত প্রথমেই কী করলেন জানো?
কী?
শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টরদের প্রায় সব টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিলেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল লুটপাট।
লুটপাট মানে?
হাজার রকম ভাবে ওরা ব্যাঙ্কের টাকা ওড়াতে শুরু করলেন।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, বিধু দত্ত সেজবাবুনবাবুকে খুশি করার জন্য প্রথমেই ওদের দুই ছেলেকেও ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার করে দিলেন।
তখন সেজবাবুনবাবুর ছেলেরা কত বড় ছিল?
তখন ওদের বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে।
ও! তার মানে বেশ বড়?
হ্যাঁ।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, ওরা দুজনে ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার হবার পর ওদের হাব-ভাব চাল-চলন দেখে সারা পাড়ার লোক কী হাসাহাসি করত।
কেন?
উনি চাপা হাসি হেসেই বলেন, দত্তদের উপর মা লক্ষ্মীর অপার করুণা থাকলেও সরস্বতীর সঙ্গে ওদের কারুরই বিশেষ ভাল সম্পর্ক ছিল না। ওদের বাড়ি ছেলেরা চিরাচরিত নিয়মে পারিবারিক ব্যবসা চালাতে জানলেও ব্যাঙ্কের কেরানি হবারও যোগ্যতা ঐ দুই ছেলের ছিল না।
তাহলে ওরা কাজ করতেন কী করে?
বিধুবাবুর নির্দেশ মত স্নেহময় সরকার সব কাগজপত্র তৈরি করিয়ে শুধু ওদের দিয়ে সই করিয়ে নিতেন।
অঘোরনাথ হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, বিধু দত্ত ডজন ডজন আজেবাজে লোকের নামে আজগুবি সম্পত্তির মিথ্যা দলিল তৈরি করে ব্যাঙ্কে সেগুলো বন্ধক রেখে প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে।
বলেন কী?
হ্যাঁ, ছোট মা, ঠিকই বলছি।
উনি একটু থেমে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, পরবর্তীকালে গভর্নমেন্টের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে জানা যায় যে সেজবাবুনবাবুর দুই মুখ ছেলে ঐটাকা মঞ্জুর করেছিল।
সেজবাবু-নবাবুও ব্যাঙ্কের টাকা মেরেছিলেন?
না, না, ওরা চুরি-জোচ্চুরি করে টাকা মারেনি; তবে….
অঘোরনাথ কথা শেষ না করে থামতেই কণিকা জিজ্ঞেস করেন, তবে কী?
পরিচিত-অপরিচিত যারাই ওদের ধরাধরি করেছে, তাদেরই ওরা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার দিয়েছে। তাদের কেউই ব্যাঙ্কের টাকা শোধ দেয়নি।
এইভাবে যা তা ভাবে টাকা নেয়ার পর ব্যাঙ্ক চলত কী ভাবে?
ব্যাঙ্ক তো চলেনি।
চলেনি মানে?
হঠাৎ একদিন লোকজন নিজেদের গচ্ছিত টাকা তুলতে এসে দেখল, ব্যাঙ্ক টাকা দিতে পারছে না।
বলেন কী ছোটকাকা? ব্যাঙ্ক টাকা দিতে পারলো না?
না, না, দিতে পারলো না।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, ওদের ঐ ব্যাঙ্কের হেড অফিস ছিল আমাদের এই ভবানীপুরেই, আর সেখানেই থাকতে খদ্দেরদের বন্ধক দেওয়া সোনা-দানা ছাড়াও ব্যাঙ্কের বারো আনা টাকা। খদ্দেরদের টাকা দেওয়া যাবে না বুঝতে পেরেই বিধু দত্ত আর স্নেহময় সরকার একদিন মাঝরাত্তিরে হেড অফিসের আলমারি সিন্দুক থেকে সমস্ত সোনাদানা-টাকাকড়ি নিয়ে উধাও হয়ে যায়।
এ রাম! রাম!
কণিকা একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, ওদের পুলিশ ধরেনি?
বৃদ্ধ একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, বহু লোকজন ভবানীপুর থানায় গিয়েছিল কিন্তু তাদের বলা হল, ব্যাঙ্কের দুজন দারোয়ান আলমারি আর সিন্দুক ভেঙে সমস্ত সোনাদানা-টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়েছে বলে আগের দিন রাত্রেই বিধু দত্ত পুলিশের কাছে নালিশ করেছেন।
তারপর?
পুলিশ বলল, ওরা দারোয়ানদের খুঁজে পাচ্ছে না; তবে ধরার চেষ্টা করছে।
অঘোরনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ছোট মা, যেদিন ওদের ব্যাঙ্ক ফেল মারল, সেদিন এই দত্ত বাড়ির সামনে কি কাণ্ড হয়েছিল, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
কী হয়েছিল ছোট কাকা?
সেদিন হাজার হাজার মানুষ এই বাড়ির সামনে হাজির হয়ে তাদের টাকাকড়ি সোনাদানা ফিরিয়ে দেবার জন্য কী কাণ্ড করেছিল, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
উনি একটু থেমে বলেন, সর্বস্ব হারিয়ে এক দল বিধবা তো পাগলের মত কান্নাকাটি শুরু করলেন। আর ওদের ঐ কান্নাকাটি দেখে এক দল লোক তো দত্তদের অশ্রাব্য। গালাগালি দিতে দিতে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করল।
তখন সেজবাবু-নবাবু কী করলেন?
বিধু দত্ত আর সরকার মশাই পালিয়েছে জানতে পেরেই ভোর হতে না হতেই দুতিনটে ঝি-চাকরের উপর বাড়ির ভার দিয়ে সেজবাবুরা ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যান।
ওরা আবার ফিরল কবে?
না, ছোট মা, ওরা আর এই বাড়িতে কোনদিন ফিরে আসতে সাহস করেনি।
ওদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কী হল?
যুদ্ধ শুরু হবার দুএক বছর পর থেকেই তো ওদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই শুরু হল হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা। তার বছর খানেক পর দেশ স্বাধীন হলেও তখন দেশের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।
উনি একটু থেমে বলেন, মোটকথা কয়েক বছরের মধ্যেই ওদের সব ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠল।
তাহলে ওদের চলতো কী করে?
বনবিহারী দত্ত কি ছেলেদের জন্য কম বিষয়-সম্পত্তি টাকাকড়ি রেখে গিয়েছিলেন?
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তাছাড়া মেজবাবু সব উড়িয়ে দিলেও অন্য দুভাইয়ের ভাগের সবকিছু সেজবাবুনবাবু পান। সব মিলিয়ে তখন ওরা রীতিমত ধনী ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে সবই চলে যায়।
চলে যায় কেন?
তখন জানতে না পারলেও পরে জানা গিয়েছিল, সেজবাবুনবাবুরা ভবানীপুর থেকে পালিয়ে সোজা গিরিডি চলে যান। ওখানে থাকতে থাকতে ওর কলকাতার বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করতে শুরু করেন।
ওরা আবার নতুন করে কোনো ব্যবসা শুরু করলেন না কেন?
ছোটমা, আগে ওরা সাহেবদের তৈল মর্দন করেই ব্যবসা করতেন। দেশ স্বাধীন হবার পর নিজেদের বিদ্যা বুদ্ধির জোরে ব্যবসা করার ক্ষমতা ওদের ছিল না।
অঘোরনাথ একটু ভেবে বলেন, আমাদের এই ভবানীপুরেই কত ধনী বাঙালি ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের মধ্যে সরকারদের মত কিছু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল শুধু মদ মেয়ের জন্য দশ হাতে খরচ করে; দত্তদের মত পরিবাররা শেষ হয়ে গেল নিছক বোকামি আর দূরদর্শিতার অভাবে।
কণিকা একটু চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করেন, দত্তবাড়ির সেজবাবুনবাবুরা এখান থেকে পালিয়ে যাবার পর আপনার সঙ্গে ওদের আর দেখশুনা হয়নি?
হ্যাঁ, বেশ কয়েকবারই ওদের সঙ্গে আমাদের দেখাশুনা হয়েছে।
আমাদের সঙ্গে মানে?
মানে তোমার শ্বশুর-শাশুড়ী আর আমার সঙ্গে।
এই কলকাতাতেই দেখা হয়েছিল?
না, না, কলকাতায় না।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, ওরা এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার বছর তিনেক পর তোমার শ্বশুর-শাশুড়ী দিল্লিতে আমার কাছে আসার পথে সপ্তাহ খানেক নৈনীতালে ছিলেন। তখন ওরাও নৈনীতাল বেড়াতে গিয়েছিল বলে দাদা-বৌদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
কণিকা একটু হেসে বলেন, তার মানে ওরা বেশ ভালই ছিলেন?
ছোট মা, ঐ নৈনীতালেই সেজবাবু কথায় কথায় দাদাকে বলেছিলেন, স্টান্ড রোডের গুদামঘরগুলো বিক্রি করে ওরা আঠারো লাখ টাকা পেয়েছিলেন
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তখনকার দিনের আঠারো লাখ আজকের দিনে আঠারো কোটির সমান। ঐ টাকা দিয়ে ওরা বিহারেই দুতিনটে ব্যবসা শুরু করেও চালাতে পারেনি।
তারপর?
তারপর একটার পর একটা সম্পত্তি বিক্রি করে মহানন্দে জীবন কাটাতে কাটাতে একদিন সব শেষ হয়ে গেল।
সব শেষ হয়ে গেল?
হ্যাঁ, ছোট মা, মোটামুটি দশ বারো বছরের মধ্যে ওরা সব উড়িয়ে দিয়েছিল।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, তুমি ভাবতে পারো, বনবিহারী দত্তর নাতিকে আমি দেওঘরে মুদির দোকান চালাতে দেখেছি।
কণিকা অবাক হয়ে বলেন, শেষ পর্যন্ত দত্তদের এইরকম অবস্থা হয়েছিল?
বৃদ্ধ একটু হেসে বলেন, ছোট মা, বাপ-ঠাকুর্দার বিষয় সম্পত্তি রক্ষা করতে হলে যে বিদ্যা-বুদ্ধি-সংযম দরকার, তা কি ওদের ছিল?
উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, তুমি ভাবতে পারো, ঐ গোলাপী সরকারবাড়ির এক বউ এই পাড়ারই চার-পাঁচটা বাড়িতে রান্না করে নিজের পেট চালাতেন?
কী বলছেন ছোটকাকা?
হ্যাঁ, ছোট মা, ঠিকই বলছি। দেবী মিত্তিরের মত বিখ্যাত উকিলের ছেলে যদি সিনেমা হলের গেট কিপার হতে পারে, তাহলে সরকার বাড়ির বউ রাঁধুনীগিরি করলে তো আশ্চর্য হবার কোন কারণ নেই।
কণিকা মাথা নেড়ে বলেন, তা ঠিক।
যে সব পরিবার অনাচার-অবিচারব্যাভিচারে ভরে যায়, তাদের বিপর্যয় কে ঠেকাতে পারে?
হ্যাঁ, ছোটকাকা, ঠিকই বলেছেন। পুরনো বাড়িগুলো দেখেই বুঝতে পারি, এক কালে এদের কত ঐশ্বর্য ছিল। এই সব ফ্যামিলিতে মারাত্মক কিছু অন্যায় বা ভুল না করলে কি ওদের এই অবস্থা হয়?
দুচার মিনিট চুপ করে থাকার পর কণিকা জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা ছোট কাকা, ইংরেজ আমলের সব বাঙালি বড়লোকেদের কী এই রকম অবস্থা হয়েছিল?
না, না, সবার অবস্থা এ রকম হয়নি।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, যাদের বিচার বুদ্ধির বা বাস্তব জ্ঞান ছিল, তাদের অবস্থা কখনই দত্তদের বা সরকারদের মত হয়নি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছে বা অন্য কোনভাবে বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করেছে।
.
হঠাৎ সবকিছু বদলে গেল। যারা জেল খাটত, কয়েদ খাটত, নিত্য নৈমিত্তিক পুলিশের লাঠি-গুলি খেত, তারা রাজার গদিতে বসল; আর যারা দেড়শ-দুশ বছর ধরে রাজত্ব করেছে, তারা সবাই নিঃশব্দে জাহাজে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিল। যে লাল পাগড়িওলায়াদের দেখে সাধারণ মানুষের হৃদপিণ্ডের ওঠানামা হঠাৎ থমকে যেতো, সেই লালবাজারের লাল পাগড়িওয়ালারা পর্যন্ত সাধারণ মানুষদের ভক্তি শ্রদ্ধা করতে শুরু করল। হোয়াইটওয়ে লেডল আর হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসনের বিক্রি যত কমল, খাদি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ঠিক তত বাড়ল।
আরো, আরো কত কি হল। রোগে-শোকে না, মানুষেরই হাতে মানুষ মরল হাজার হাজার! মানুষের ঘরবাড়িতে মানুষই আগুন দিল। লাখ লাখ মানুষ এদিক থেকে ওদিকে গেল, ওদিক থেকে এগিয়ে এলো। লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে ভিখিরি হল; আবার ভাগ্যবান ভিখিরির দল খেয়াল খুশিমত ঘরবাড়ি দখল করে নিতেও দ্বিধা করল না। বাস্তুহারা বলে একটা নতুন সম্প্রদায় জন্ম নিল সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে শহরেনগরে।
আরো, আরো কত কি ঘটল। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের দালাল আদর্শহীন মনুষ্যত্বহীন হৃদয়হীন আই-সি-এস আর দালাল অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের দল হঠাৎ রাতারাতি দেশবাসীর সেবক ও দেশপ্রেমিক হবার জন্য রীতিমত হাস্যকর প্রতিযোগিতা শুরু করল।
দেশের এইসব অভাবনীয় পরিবর্তনের কথা ভেবে কুলকিনারা পান না নরোত্তম মল্লিক। আপনমনে বিভোর হয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করেন। ব্যবসা বাণিজ্য বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে কী করা উচিত, তাও বুঝতে পারেন না।
এইসব ভাবনা-চিন্তা করতে করতেই বেশ কয়েক মাস কেটে গেল।
.
সেদিন সকালে উঠেই নরোত্তম ভটচাজমশাইকে ডেকে পাঠালেন।…
ভটচাজমশাই ঘরে ঢুকেই বলেন, আমাকে কি কিছু বলবে?
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, শুধু বলব না, কিছু শুনতেও চাই।
ভটচাজমশাই বসতেই নরোত্তম বলেন, দেশের অবস্থা কী রকম মনে হচ্ছে?
নিশ্চয় ভাল না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, হাজার হোক রাজত্ব বদল হল। রাজত্ব বদল হলেই এই ধরনের অশান্তি বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চিরকালই ঘটেছে কিন্তু অনন্তকাল ধরে তো এইরকম পরিস্থিতি থাকবে না।
ভটচাজমশাই একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আমি কখনই বলছি না, দুচার মাসের মধ্যেই সারা দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে; তবে দুচার বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
নরোত্তম মাথা নেড়ে বলেন, বোধহয় আপনি ঠিকই বলছেন।
এবার উনি মুখ তুলে ভটচাজমশায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন আপনার মতে আমার এখন কী করা উচিত?
আমার মতামত না হয় পরে বলব। তুমি কী ভাবছ, সেটা আগে শুনি।
আমার আর ব্যবসা বাণিজ্য করার ইচ্ছা নেই।
কেন?
প্রথম কথা, আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাছাড়া যেসব কংগ্রেসিরা গদিতে বসেছে, তারা আমাকে একদমই পছন্দ করে না।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর যে বিলেতি কাপড়ের আমদানি বা ব্যবসা আর চলতে পারে না, তা আমি জানি কিন্তু সারা দেশে রেল চালাতে হলে এই গভর্নমেন্টকেও বিলেত থেকে কয়েক শকোটি টাকার যন্ত্রপাতি বা পার্টস আমদানী করতেই হবে।
হ্যাঁ, তা তো হবেই।
কিন্তু কংগ্রেস গভর্নমেন্ট কখনই আমাকে ঐ ব্যবসাও করতে দেবে না।
ভটচাজমশাই একটু হেসে বলেন, নরোত্তম, দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে জওহরলাল বা সর্দার প্যাটেল যখন কংগ্রেসিদের থানার দারোগা বা আই-সি-এসদের চেয়ারে বসাননি, তখন তোমার মত ব্যবসাদারদের যে ওরা লাইসেন্স-পা দেবে না, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, তবে হ্যাঁ,নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে ব্যবসা করতে হবে।
কিন্তু ভটচাজমশাই, এই বয়সে আমি আর নতুন করে কিছু করতে চাই না।
তুমি না পার, সুবল করবে।
ভটচাজমশাই মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সুবল তোমার মেজ ছেলের মত বি.এ. পাস করে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে না গেলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে।
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, আপনি সুবলকে একটু বেশি ভালবাসেন।
কথাটা ঠিক বললে না। তোমার নিটি ছেলেই অত্যন্ত ভাল। আমি ওদের তিনজনকেই যেমন পছন্দ করি, সেইরকমই স্নেহ করি। ওরাও আমাকে যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করে।
উনি একটু থেমে বলেন, তবে বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে সুবলকে যেভাবে কাজ করতে দেখছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, ও অত্যন্ত নির্ভরশীল ছেলে।
হ্যাঁ, তা ঠিক কিন্তু অন্য দুছেলে তো ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারে একদম আগ্রহী না।
তোমার সেজ ছেলে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসে নিশ্চয়ই লালাবাজারের অফিসে বসে ব্যবসা করবে না কিন্তু ছোট ছেলে পড়াশুনা শেষ করে কী করবে, তা এখনই বলা মুশকিল।
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর নরোত্তম বললেন, সুবল নিজের মত নতুন করে ব্যবসা করুক, তাতে আমার আপত্তি নেই। তবে আমি নিজে আর ব্যবসা বাণিজ্য করব না।
উনি একটু থেমে বলেন, আমাদের গুদামে কী কোনো কাপড়-চোপড় আছে?
না।
আমরা সব পেমেন্ট পেয়েছি?
না; বাজারে পঞ্চাশ-ষাট হাজারের মত পাওনা আছে।
রেল থেকে নতুন অর্ডার এসেছে কি?
না।
রেলের কাছে আমাদের কত পাওনা?
তা ন -দশ লাখ হবে।
সে টাকা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে?
সামনের মার্চের মধ্যে নিশ্চয়ই সব পেমেন্ট এসে যাবে।
কোন ব্যাঙ্কে কত আছে আর কোথায় কি দেবার বা পাবার আছে, তার একটা পুরো হিসেব আমাকে দেবেন তো!
হ্যাঁ, দুএকদিনের মধ্যেই দিয়ে দেব।
.
ঐ হিসেব-নিকেশ পাবার দুচারদিন পরই নরোত্তম ভটচাজমশাইকে বললেন, পুরো টাকাটা ছভাগ হবে। আমি, আমার দুই স্ত্রী আর তিন ছেলের নামে সমানভাবে ভাগ করে ছটা আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
ভটচাজমশাই মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, খুলে দেব।
কলকাতার কোন একটা সম্পত্তি বিক্রি করে আমি কাশীতে আর পুরীতে দুটো বাড়ি কিনতে চাই কিন্তু কোন সম্পত্তিটা বিক্রি করা ঠিক হবে, তা একটু ভেবেচিন্তে আমাকে বলবেন।
তুমি কি এখান থেকে চলে যেতে চাও?
পুরোপুরি না গেলেও বারো মাস এখানে পড়ে থাকতে চাই না।
নরোত্তম একটু থেমে বললেন, উকিলবাবুকে একটু দেখা করতে বলবেন।
হ্যাঁ, বলব।
দিনের পর দিন উকিলবাবুর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে উইলের খসড়া তৈরি হবার পর নরোত্তম হাইকোর্টের প্রবীণ ব্যারিস্টার নগেন রায়চৌধুরীকে বললেন, উইলটা যদি একটু দেখে দেন, তাহলে খুব ভাল হয়।
আপনি রবিবার সকালে এলেই আমি আমার মতামত জানিয়ে দেব।
রবিবার সকালে নরোত্তম ব্যারিস্টার সাহেবের চেম্বারে ঢুকতেই অমর রায়চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, মল্লিকমশাই, দারুণ উইল করেছেন। আপনার ছেলেরা তো দূরের কথা, নাতিরাও এইসব সম্পত্তি নষ্ট করতে পারবে না। আর বসতবাড়িটা দেবোত্তর করে খুব বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছেন।
এবার উনি হাসতে হাসতে বললেন, ব্যারিস্টারি করতে গিয়ে দেখছি, বাঙালি কেরামদের প্রায় সব ছেলেরাই বেচারাম হয় কিন্তু আপনার ছেলেদের সে দুর্নাম হবার রাস্তা আপনিই বন্ধ করে গেলেন।
উইল-পর্ব মেটার পর ভটচাজমশাই বললেন, নরোত্তম, এবার কি আমার ছুটি?
না, আরো একটা জরুরি কাজ আপনাকে করতে হবে।
আবার কী কাজ?
নরোত্তম একটু চাপা হাসি হেসে বলে, শুধু আপনি না, আমার দুই স্ত্রী ছাড়া মেয়ে জামাইও করুণাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন।
ভটচাজমশাই এক গাল হাসি হেসে বলেন, পছন্দ তো দুরের কথা, ওকে আমি ঠিক মায়ের মত শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি।
করুণা যদি বিধবা না হতো, তাহলে কি সুবলের সঙ্গে ওর বিয়ে হতে পারত?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
কিন্তু করুণা যে সম্পর্কে ওর মাসি হয়?
করুণার সঙ্গে তো ছোট মার প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই।
হ্যাঁ, তা ঠিক।
এবার নরোত্তম একে প্রশ্ন করেন, সুবল যদি আপনার ছেলে হতো, তাহলে কি এই বিধবা করুণার সঙ্গে তার বিয়ে দিতে পারতেন?
ভটচাজমশাই আবার এক গাল হাসি হেসে বলেন, করুণা আমার পুত্রবধু হলে আমি আবার প্রাণভরে মা বলে ডাকতে পারতাম।
যদি আমার দুই স্ত্রীর মত আদায় করতে পারেন, তাহলে আপনি সুবলের সঙ্গে করুণার বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
ওরা দুজনে তো অনেক দিন ধরেই এই বিয়ের কথা আমাকে বলছে কিন্তু সাহস করে……..
তাহলে আর কি! এবার উঠে-পড়ে লেগে যান।
.
কী ব্যাপার মল্লিকমশাই? হঠাৎ এতদিন পর…
সাবিত্রীর বিস্ময়মিশ্রিত কৌতুকে নরোত্তম কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে শুধু বললেন, ঘরে চল। তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই সাবিত্রী নরোত্তমের দুটো হাত ধরে প্রশ্ন করে, আগে বল, তুমি কেমন আছে। এর মধ্যে শরীর খারাপ হয়নি তো?
আমি ভালই আছি।
বড় বউ, ছোট বউ আর ছেলেমেয়েরা?
ওরাও ভাল আছে।
করুণা কেমন আছে? ও তোমাদের কাছেই আছে তো?
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, করুণা খুব ভাল আছে।
সাবিত্রী একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, খুব ভাল আছে মানে?
সুবলের সঙ্গে করুণার বিয়ে দিয়েছি।
আনন্দে-খুশিতে উত্তেজিত হয়ে সাবিত্রী এক গাল হেসে বলে, সত্যি সুবলের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ।
খুব ভাল কাজ করেছ মল্পিকমশাই।
সাবিত্রী উদাস দৃষ্টিতে বহু দূরের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এ সংসারে মেয়েদের দুঃখ-কষ্ট কেউ বুঝতে চায় না।
এবার ও ঘুরিয়ে নরোত্তমের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, তুমি যে ঐ হতভাগিনীকে নিজের পুত্রবধূ করেছ, তা জেনে খুব ভাল লাগছে।
নরোত্তম শুধু একটু হাসেন।
সাবিত্রী আবার বলে, বিধবার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে বলে আত্মীয়-স্বজনরা নিশ্চয়ই খুব নিন্দা করেছে?
হ্যাঁ, অনেকেই নিন্দা করেছে, অনেকই আসে নি।
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, তুই তো জানিস, আমি নিন্দা বা প্রশংসার পরোয়া করি না। আমি আমার কাজ করে যাই।
তা আর জানি না? খুব ভাল করেই জানি।
সাবিত্রী হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুমি বসো। আমি তোমার জলখাবার আনি।
না, না, কিছু আনতে হবে না।
নরোত্তম এক গাল হেসে বলেন, আজকাল বৌমা আমাকে এক পেট না খাইয়ে বাড়ি থেকে বেরুতেই দেয় না।
খুব ভাল করেছে।
সাবিত্রী একটু থেমে বলে, এবার বল কি জরুরি কথা বলবে।
হ্যাঁ, বলছি।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তি তিন ছেলে আর দুই বউকে দিয়ে আমি ছুটি নিলাম।
ছুটি নিলাম মানে?
মানে আমি আর ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তির ঝামেলায় নেই। এবার থেকে কাশী আর পুরীতেই বেশি সময় থাকব ঠিক করেছি।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, আমি কালই কাশী যাচ্ছি। কবে ফিরব ঠিক নেই। তাই তোকে একটা জিনিস দিতে এলাম।
কী দিতে এসেছ?
নরোত্তম সাবিত্রীর দুটো হাত ধরে বলেন, তুই আমাকে যে আনন্দ, যে শান্তি দিয়েছিস, তা আমি জীবনে ভুলব না। তাই কাশী যাবার আগে তোকে কিছু টাকা দিতে এসেছি।
সাবিত্রী চাপা হাসি হেসে বলে, কত টাকা?
মাত্র কুড়ি হাজার।
দাও।
সাবিত্রী টাকাটা হাতে নিয়েই বলে, এই টাকাটা করুণাকে দিয়ে বলবে, তার এক মাসি বিয়েতে আসতে পারেনি বলে আশীর্বাদী পাঠিয়েছে।
টাকাটা নবরাত্তমের হাতে দিয়ে ও বলে, আমাকে সত্যিই যদি কিছু দিতে চাও, তাহলে একটা কথা দাও।
বল, কী কথা দিতে হবে।
তুমি জীবনে আর কোনদিন আমার কাছে আসবে না। কেউ যেন বলতে না পারে, করুণার ঐ বুড়ো শ্বশুর বেশ্যাবাড়ি যায়। সাবিত্রী চোখের জল ফেলতে ফেলতেই নরোত্তমকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।