৯. সৈন্যদল

টম জীবনে কখনো কোনো সৈন্যদলকে এতো দ্রুত জমায়েত হতে দেখল। সৈন্যরা নিজেদের শিবির থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের কাছে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ওর অবশ্য অবাক হওয়া উচিত হয়নি, মনে হচ্ছে পাহাড়ি যোদ্ধা। ওরা রাতের বেলা এক হাতে তরবারি, আর বাম পাশে বল্লম রেখে ঘুমায়।

 হাবিলদার মোহিত আর ব্রিঞ্জোয়ান থেকে বাকি যারা এসেছিলো তারা প্রস্তুত হয়ে গেলো। ওদেরকে দেখে খুশি হলো টম। মোহিত মারাঠাদের থেকে ধার নিয়ে একটা তুলোর তৈরি বর্ম পরেছে গায়ে। পিঠে বন্দুক। কোমরে ছুরি আর তার সাথে গুলির বেল্ট। আর সবচে ভয়ংকর অস্ত্রটা ও নিয়েছে সেটা হচ্ছে একটা বল্লম। ওটার ধরার জায়গাটা হাতলের মতো, আর মাথা হাতের মুঠোর মতো।

মারাঠা সৈন্যদের দেখা গেলো একটা ছোট জগের মতো পাত্র একজনের হাত থেকে নিয়ে আর একজনকে দিচ্ছে। প্রথমে পাত্রটায় আঙুল ডুবিয়ে নিজেদের চেহারায় সেটা দিয়ে দাগ দিচ্ছে।

“কি করছে ওরা?” জানতে চাইলো টম।

“হলুদ মাখাচ্ছে, মোহিত ব্যাখ্যা করলো। ও নিজেও হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিজের গালে তিনটা সমান্তরাল হলুর রেখা এঁকে নিলো। দেবতাদের কাছে পবিত্র। এটা মাখার মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দিলাম। এখন আর আমাদের মরার ভয় পাওয়ার কারণ নেই, কারণ দেবতারাই এখন আমাদের রক্ষাকর্তা।”

ও টমকে পাত্রটা ধরিয়ে দিলো। টম হলুদ তরলটা আঙুলে মোহিতের মতো করে নিজের গালেও এঁকে নিয়ে, মনে মনে এই উপমহাদেশের অধিকর্তা যে দেবতাই হোক না কেনো, তার উদ্দেশ্য প্রার্থনা করে নিয়ে মৃত্যুকে ভয় পায় না-ব্যর্থতাকে পায়। সারাহ, অ্যাগনেস বা ফ্রান্সিস কাউকে হারাতে পারবে না ও।

যুদ্ধের বিশাল বিশাল হাতীগুলো সৈন্যদের মাঝে এসে দাঁড়ালে ফেলার শব্দ ছাড়া ওদের মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের হলো না। জানোয়ারগুলোর প্রশিক্ষণের নমুনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো।

শাহুজি সামনের হাতীটার পিঠ থেকে অনায়াসে পিছলে নেমে এসে পাশে দাঁড়ালেন।

“আক্রমণ শুরু করতে প্রস্তুত?”

 টম অবাক হলো। “আমিতো ভেবেছিলাম আপনি-”।

শাহুজি হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলেন ওকে। “এটা আপনার লড়াই। আপনি আমার সৈন্য চেয়েছিলেন। আমি সেটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যদি না আপনি এই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করতে চান।”

“এটাই একমাত্র উপায়।”

 “গোলার আঘাতে দেয়ালে যে ফাটল ধরেছে সেগুলো এখনো বেশি নিচু না,” শাহুজি সাবধান করে দিলেন। “আরো এক সপ্তাহ গেলে তারপর ওটা সহজেই পার হওয়া যেতো।”

“আমরা ওটা বেয়ে উঠে যাবো,” টম জোর দিয়ে বললো।

 শাহুজি মাথা ঝাঁকিয়ে ওনার পেছনের হাতীগুলোর দিকে ইশারা করলেন।

 “সেটাই যদি আপনার করণীয় হয়, তাহলে এটায় করেই যান।”

টম জানোয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কোনো সন্দেহ নেই ওটা দুর্দান্ত, ভীতি জাগানিয়া, এই জন্তু দেখলে শত্রুর মনে এমনিতেই ভয় ধরে যাবে। কিন্তু একই সাথে এটা খুবই বড়, আর সহজ একটা নিশানা। ওটায় উঠলে দুর্গের যে কোনো বন্দুকবাজ ওকে অনায়াসে পেড়ে ফেলতে পারবে।

শাহুজি ওর চিন্তা ধরতে পারলেন। “সবাইকে জানতে হবে যে ওদের সেনাপতি ওদের সাথেই আছেন,” নরম গলায় বললেন উনি। “যদি ওরা আপনাকে দেখতে না পায়, তাহলে ভাবতে পারে যে আপনি যুদ্ধ থেকে পালিয়েছেন। আর আপনি যদি যুদ্ধ না করেন, তাহলে ওরা কেনো করবে?”

নিচের উপসাগর থেকে আরো কয়েকটা কামানের গর্জন শোনা গেলো। টম নিজের শরীরে সৈন্যদলের প্রত্যেকের দৃষ্টি অনুভব করতে পারলো। এখন আর তর্কের সময় নেই।

“আপনি যতোটা ভাবছেন তার চাইতে নিরাপদ এটা,” শাহুজি বললেন। “শিকারের হাতী আর যুদ্ধের হাতী আলাদা।”

 মাহুত হাতীটাকে বসিয়ে দিতেই টম উঠে গেলো পিঠে। শাহুজির কথাটার মর্মার্থ ধরতে পারলে সাথে সাথেই। বাঘ শিকারে যেরকম নকশা কাটা হাওড়া ব্যবহার করা হয়েছিলো, সেগুলো আর নেই। এখানে আছে একটা বর্মাচ্ছাদিত বক্স। চারপাশে লোহার পাত। তার সামনে একটা হালকা কামান বসানো।

 মোহিত চড়লো ওর পিছনে, মাহুত বসলো বক্সের সামনে। নিচে তাকিয়ে টম দেখলো সৈন্যদলও ওদের পাশে হাঁটা শুরু করেছে। একদম সামনের সারির সৈন্যগুলো পুরো নগ্ন। ওদের সারা গায়ে ছাই মাখা, চুল ছিঁড়ে এলোমেলো করে রেখেছে। হাঁটার সময় মোচড় খেয়ে প্রায় লুটিয় পড়তে লাগলো মাটিতে। ছাই মাখা দেহটা দেখে মনে হতে লাগলো যেনো ধোয়া উড়ে যাচ্ছে রাতের আকাশে।

“এরা কারা?” মোহিতকে জিজ্ঞেস করলো টম।

“ঘোসিয়া,” জবাব দিলো হাবিলদার। “এরা হচ্ছে অস্পৃশ্য। ধ্বংসের দেবতা শিবের আরাধক। উন্মাদ কতগুলো, কিছুই ভয় করে না।”

ওদের গলায় একটা নিনাদ শোনা গেলো; এক পৈশাচিক কান্নার সুর, যা শুনে কপালে ঘাম জমে গেলো টমের। একটু পর ঘোশিয়ারা ওদের তরবারির ফলা দিয়ে বুক চাপড়াতে লাগলো।

“আংরিয়া আমাদের আসার শব্দ পেয়ে যাবে,” টম বিরক্ত হলো।

“আপনি ওদেরকে থামাতে পারবেন না, মোহিত বললো। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।”

 ওদের সামনের দল ততোক্ষণে গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসে শৈল অন্তরীপটা সংযোগকারী চিকন ভূমিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিচে উপসাগরের আগুনের আলো কমে এসেছে। ভৌতিক একটা আভা ছড়াচ্ছে ওগুলো থেকে। হাতীর পিঠ থেকে নিচে দেখতে পেলো টম। লড়াই জমে উঠেছে। একটা বড় গ্রাবকে দেখা গেলো অন্য জাহাজগুলো থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর একটায় আগুন ধরে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের নৌকাগুলো চোখে পড়লো না ওর-তবে পুরো পানি ভরে আছে ভাঙা কাঠের টুকরো আর মরা লাশে।

একটা মাস্কেটের গুলি এসে সামনের লোহার পাতে লাগতেই টুং করে ঘণ্টার মতো আওয়াজ হলো। টম শাপ শাপান্ত করতে করতে মাথা নিচু করে ফেললো। ওরা এর মধ্যেই ওদের নাগালের ভিতরে চলে এসেছে। আংরিয়ার লোকজন ঘুমাচ্ছিলো না। ওরা মারাঠাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত আত্মরক্ষা শুরু করেছে। ঐ সরু এক চিলতে জায়গা বরাবর সমানে গুলি করে যাচ্ছে, ওরা। মারাঠা সৈন্যদের মাঝে কামানের গোলা এসে পড়লো। টম, একজন ঘোশিয়াকে খেয়াল করলো, তখনও উন্মাদের মতো নেচেই যাচ্ছে। কামানের গোলা খেয়ে সে সোজা উড়ে গিয়ে পড়লো পিছনের লোকগুলোর ভিতরে। ওর সাথীরা তাতে না দমে, উল্টো গর্জন ছেড়ে সামনের দিকে দৌড় দিলো।

একটা কসাইখানা হয়ে গেলো সরু জায়গাটা। টমের চারপাশে মুড়ির মতো মরতে লাগলো মানুষ। একটা কামানের গোলা ওর হাতীর মাথার মাত্র কয়েক ফুট সামনে পড়লো। জানোয়ারটা কান ঝাড়া দিলো একবার, তারপর মাথা নিচু করে সামনে ধেয়ে গেলো। মাস্কেটের গুলি এসে লাগলো ওটার গায়ে, কিন্তু তেমন কোনো ক্ষতি হলো না। আফ্রিকার অভিজ্ঞতা থেকে টম জানে খুব কাছ থেকে গুলি করার পরেও, একটা গুলি শুধু হাতীর গায়ের ধুলো ঝাড়া বাদে আর কোনো ক্ষতিই করতে পারে না।

কিন্তু গুলি খাওয়ায় রেগে গেলো হাতীগুলো। সজোরে সামনে ধেয়ে গেলো ওগুলো। আর ওটার পিঠে হাওড়াটা বিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান একটা নৌকার মতো দুলতে লাগলো। হাতীর বিশাল একেকটা পদক্ষেপে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো হাওড়াটা। গতির চোটে টমের কানের পাশ দিয়ে শো শো করে বাতাস বইছে। সেই সাথে গুলির তোড়ে লোহার পাতে টুংটাং আওয়াজ চলছেই। টম যা ভেবেছিলো সেটাই হয়েছে, সবাই সহজেই ওকে নিশানা করতে পারছে। দস্যুরা জানে যে টম কোথায় আছে, কিন্তু জানোয়ারটার বিশাল আকৃতি ওর জন্যে একটা সুরক্ষার কাজ করছে। মারাঠারাও জানোয়ারটার পিছনে লুকিয়েছে। দেয়ালের উপরের দস্যুগুলোর, হাত থেকে হাতীটার দেহ সবার জন্যে একটা সুরক্ষা প্রাচীরের কাজ করছে। হাতীটা দেয়ালের কাছের কাঁটা ঝোঁপ মাড়িয়ে ছুটে গেলো, ফলে মাঝখান দিয়ে পথ হয়ে গেলো একটা।

হাতীটার গতি কমে এলো। টম বক্সের কিনারা দিয়ে ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে দেখলো ওরা ঠিক দেয়ালের সামনে চলে এসেছে। তবে তার জন্যে চড়া দামও দিতে হয়েছে। পুরো শৈল অন্তরীপটা জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ।

কামানগুলোর গর্জন থেমে গিয়েছে, কিন্তু মাস্কেটের গর্জন এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেয়ালের দস্যুগুলো এখন প্রায় সরাসরি হাতীটার উপরে। টম বক্স থেকে লাফিয়ে হাতীর গা বেয়ে পিছলে নেমে এলো। ডানে তাকিয়ে দেখে ফটক থেকে গজাল বেরিয়ে আছে। এতো লম্বা যে এই হাতীটার চাইতেও বড় জানোয়ারকে থামিয়ে দিতে পারবে। আর সামনে দেয়ালের যে অংশটা ভেঙেছে সেখানে পাথরের টুকরো স্তূপ হয়ে জমে আছে।

টমের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। পাহাড়ের মিনার থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো, যে ফাঁকটা হয়েছে সেটা দিয়ে বেয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু এখন এই গোলাগুলির মাঝে দাঁড়িয়ে পুরো পাহাড়ের মতো লাগছে দেয়ালটা। শাহুজির সতর্কবার্তা মনে পড়লো, আমার গোলন্দাজদের আরো এক সপ্তাহ লাগবে।

কিন্তু এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। দেয়ালের একটা অংশ টুকরো টুকরো না হয়ে, পুরোটা একসাথে ধ্বসে পড়েছে। নিচে পড়ে সুন্দর একটা আড়াল তৈরি করেছে সেটা। টম দৌড়ে গিয়ে ওটার পিছনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো।

পাশ দিয়ে সৈন্যরা দৌড়ে গেলো। ঘোশিয়ারা দেয়ালের কাছে যেতে গিয়ে ভয়ানকরকম আহত হতে লাগলো। কিন্তু তবুও দেখা গেলো লড়াইয়ের মানসিকতা একটুও কমছে না। বিড়ালের মতো করে লাফ দিয়ে পাথরের টুকরোগুলোর উপর উঠে দেয়ালের ভাঙা অংশটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

টমের লজ্জিত বোধ হলো। বাকিরা যেখানে ওর পরিবারের জন্যে প্রাণ দিচ্ছে সেখানে ও এভাবে চোরের মতো লুকিয়ে থাকতে পারে না। পাগলামি ভর করলো যেনো ওর উপর। ঘোশিয়াদের মতো ওর রক্তেও বান ডাকলো পাগলামি। দেয়ালের টুকরোটার পিছন থেকে লাফ দিয়ে উঠে সামনে ছুটে গেলো ও। পায়ের ধাক্কায় টুকরো পাথর ছিটকে যেতে লাগলো; মাস্কেটের গুলি ছুটতে লাগলো চারপাশে। কিন্তু ওর মাথার ভিতর যে গর্জন চলছে তার আড়ালে চাপা পড়ে গেলো গুলির আওয়াজ।

দেয়ালের মাথায় উঠতে হবে, ওর মাথার ভিতর শুধু এটাই ঘুরছে। প্রায় পৌঁছেই গেলো সেখানে। এই দুর্গম পাথরের স্তূপের ভেতর দিয়ে আর মাত্র কয়েকটা ধাপ

কিন্তু ও যে পাথরটার উপর পা ফেললো সেটা সরে গেলো জায়গা থেকে। তারপর একগাদা টুকরো পাথর সমেত ঢাল বেয়ে পিছলে গেলো নিচে। দড়াম করে আছড়ে পড়ে গেলো টম। ফুসফুস থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেলো যেনো। ধুলো আর পাথরের চূর্ণে ভরে গেলো মুখ।

তবে ঘোশিয়ারা ওদের কাজ ঠিকই করে গেলো। ভগবান শিবের সহায়তায় দেয়ালের মাথায় পৌঁছে গেলো ওরা। আর ওদের দেখে দস্যুরাও ভয় পেয়ে গেলো। ফলে দুর্গের দিকে থেকে আসা গুলির পরিমাণ কমলো কিছুটা। ঘোশিয়ারা দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিজয় নৃত্য করতে লাগলো, সেই সাথে সেই পৈশাচিক কান্না তো আছেই।

কিন্তু সাথে সাথেই আর একটা গুরুগম্ভীর শব্দ পাওয়া গেলো। কামানের গর্জন। আংরিয়া জানতো যে মারাঠারা দেয়ালের ভাঙা জায়গাটার মাথায় উঠতে পারবেই, ও তাই ঠিক তার পিছনেই একটা কামান বসিয়ে রেখেছিলো। গোলার ভিতর ছিলো মাস্কেটের গুলি ভরা। দেয়ালের মাথায় যে-ই উঠুক তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে ছিলো কামানগুলো।

টম এখনো নিচে কুঁকড়ে পড়ে আছে। আচমকা বজ্রপাতের মতো করে দেওয়ালের মাথায় ঝলসে উঠলো কামানের গোলাটা। দেয়ালের মাথার লোকগুলো মুহূর্তেই ভস্ম হয়ে গেলো ওর চোখের সামনে। টমের সারা শরীর শিউরে উঠলো তা দেখে। ওর আশে পাশে পোড়া মাংস আর টুকরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এসে পড়তে লাগলো।

 পা পিছলে না গেলে আমার অবস্থাও ওদের মতোই হতো। কিন্তু টমের এখন শুয়ে শুয়ে কৃতজ্ঞতা বোধ করার মতো সময় নেই। কামানে নতুন গোলা ভরার আগেই ওকে ওখানে পৌঁছাতে হবে।

 নিজের তরবারিটা তুলে নিয়ে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঢালটা বেয়ে সোজা উপর উঠতে লাগলো টম। পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে লাগলো ও। খুব দ্রুত, যাতে আগের বারের মতো পা পিছলে না যায়।

পাথরের স্তূপের ঢালের ঠিক নিচে একটা শোরগোল শোনা গেলো। প্রথমে একজন একটা শ্লোগান দিচ্ছে, তারপর বাকি সবাইও তাল দিচ্ছে। “হর! হর! মহাদেব!” ওর পিছনের লোকজন প্রথমে কামানের গোলার আওয়াজে ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তবে এখন আবার নতুন করে জড়ো হচ্ছে। টমের পিছু পিছু মারাঠাদের রণহুংকার ছাড়তে ছাড়তে ধেয়ে এলো ওরা। যাদের হাতের অস্ত্র পড়ে গিয়েছিলো, তারা হাতে পাথর তুলে নিয়ে ছুটে এলো। সামনে কোনো দস্যু পড়লে ওটা দিয়েই থেতলে দিতে লাগলো। সামনের কামানের। আশেপাশে যেসব দস্যু জড়ো হয়েছিলো, তাদেরকে হাতের বল্লম ছুঁড়ে মারা হলো। টম এক দৌড়ে ঢাল বেয়ে সোজা উপরে উঠে দেয়ালের ভাঙা অংশটায় গিয়ে থামলো। মোহিত ছিলো ওর এক পা পিছনেই। একজন দস্যু বেয়নেট হাতে দৌড়ে এলো, কিন্তু ও হাতের জৈত্রিটা দিয়ে এক বাড়িতে তার মাথাটা তরমুজের মতো ফাটিয়ে দিলো।

এক মুহূর্তের জন্যে ভাঙা দেয়ালটার উপরে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। ওদের দুই পাশে দুর্গের দুটো মিনার। সামনের চত্বরে অনেকগুলো মশাল আর বাতি জ্বলছে। টম ঠোঁট চাটলো, চেহারায় লেগে থাকা হলুদের তিক্ত স্বাদ এসে লাগলো জিহ্বায়।

তারপর ও আকাশের দিকে অস্ত্র তুলে জয়ধ্বনি করে উঠলো। সাথের লোকদের মতোই হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “হর! হর! মহাদেব! ঈশ্বর আমাদের সহায়।”

ওরা দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়েছে, এখন ওকে সারাহ আর অ্যাগনেসকে খুঁজে বের করতে হবে।

*

যুদ্ধের হট্টগোল পাথর বেয়ে নিচের কয়েদখানাতেও শোনা যাচ্ছে। কামানের গোলার প্রচণ্ড শব্দ বা গোলা আছড়ে পড়ার সময়কার গর্জন, দুটোই কয়েকগুণ বর্ধিত হয়ে ওদের কানে এসে লাগছে। সেগুলোর কাপনে ধুলো আর টুকরো পাথর খসে পড়ছে দেয়াল থেকে। ওদের মনে হতে লাগলো কোনো অতিকায় দানবের পেটের ভিতর আটকা পড়েছে যেনো।

অ্যাগনেস আর সারাহ একা বসে আছে। প্রহরীরা খানিক আগে এদের লিডিয়াকে নিয়ে গিয়েছে। প্রতি সন্ধ্যাতেই কাজটা করে ওরা। প্রথমবার যখন এরকম হলো, অ্যাগনেস সে রাত পুরোটা জেগে ছিলো। আর বসে বসে ভাবছিলো দস্যুরা না জানি ওর উপর কি অত্যাচারটাই না করছে। কিন্তু লিডিয়া ফিরে আসার পর দেখা গেলো ও অ্যাগনেসের দুশ্চিন্তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না এমনকি দেখে মনে হলো যে ও বরং খুশি-ই হয়েছে। এটা থেকে, লিডিয়ার নির্লজ্জ কিছু কথা বার্তা থেকে অ্যাগনেস ধারণা করে নিয়েছে যে দস্যুদের মাঝ থেকে একজন প্রেমিক জুটিয়ে নিয়েছে।

 এজন্যে ও লিডিয়াকে দোষ দেয় না। বেঁচে থাকার তাগিদে সবাই-ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অ্যাগনেস কখনোই এরকম কিছু করতো না কিন্তু তাই বলে ও নিজেকে পুরোপুরি ভাগ্যের হাতেও সপে দেয়নি। অন্ধকারে বসে বসে ও ছোট একটা লোহার কাঠি দিয়ে নিজের হাতকড়ার তালা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাথরের মধ্যে গাঁথা অবস্থায় পেয়েছে ওটা। হয়তো কোনো এককালে ওখানে কোনো আঙটা ছিলো, সেটারই ধ্বংসাবশেষ। প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছে. ওর ওটাকে দেয়াল থেকে খুলতে। চোখা মাথায় ঘষা খেয়ে বেশ কয়েকবার আঙুল কেটে রক্ত বেরিয়েছে কাজটা করতে হতো রাতে, যখন লিডিয়া চলে যেতো। কারণ ওর সামনে পড়লে ওর গোপন প্রেমিকের কাছে ফাস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।

 আজ ও কাজটা শেষ করতে পেরেছে। লিডিয়াও নেই, আর লোহার দরজাটার সামনে বসে থাকা প্রহরীরাও আজ চলে গিয়েছে। প্রথমে ও কারণ ভেবে পায়নি, তারপরেই কামানের গর্জন ভেসে এলো। আংরিয়া সম্ভবত ওদেরকে যুদ্ধ করতে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। তাতে ও ভিতরে নতুন এক উদ্যম অনুভব করছে। অ্যাগনেস জানে না যে, টম আর ফ্রান্সিস দেয়ালের বাইরেই আছে, এমনকি ঐ মুহূর্তেই টম বিশাল একটা হাতীতে করে দরজার দিকে ধেয়ে আসছে। ও শুধু জানে যে দুর্গে আক্রমণ হয়েছে।

প্রায় বিশ বছর একজন সৈনিকের ঘর করেছে অ্যাগনেস। ও খুব ভালোমতোই জানে যদি দুর্গের পতন হয়, আর আক্রমণকারীরা এসে দুজন অসহায় নারীকে এভাবে বন্দী অবস্থায় পায়, তাহলে কি হবে।

 ওর পাশেই সারাহ অস্ফুট গুঙিয়ে উঠে কাত হয়ে শুলো। ও এখন আর পাশ ফিরতে পারে না। ওর শুকিয়ে কাঠ হওয়া শরীর থেকে বেটপভাবে পেটটা ফুলে আছে। পেটের চামড়া এতো বেশি টানটান হয়ে আছে যে অ্যাগনেসের ভয় লাগে যে ফেটে যাবে যেকোনো সময়। বাচ্চা হওয়ার আর বেশি দেরি নেই। তাতে করে অ্যাগনেসের তাড়া আরো বেড়েছে। এই কয়েদখানায় যদি একটা বাচ্চা জন্ম নেয়, তাহলে এই দস্যুগুলো তাকে নিয়ে কি খেলা খেলবে সেটা অ্যাগনেস চিন্তা করতেও ভয় পাচ্ছে। নিজের আহত, প্রায় অবশ আঙুল দিয়ে ও লোহার ফালিটা হাতকড়ার ভিতরে খোঁচাতে লাগলো। প্রায় এক ঘণ্টা যাবত চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিক সেদিক সবদিকেই মুচড়িয়ে চেষ্টা করে দেখেছে। মাঝে মাঝে লোহার টুকরোটায় কিছু একটা আটকাচ্ছে, আর ওর মনে আশায় দুলে উঠছে। কিন্তু প্রতিবারই চাপ দিলে দেখা যাচ্ছে ওটা পিছলে সরে যাচ্ছে।

পাথরের ভিতর বেয়ে আসা শব্দের পরিমাণ আরও বাড়ছে। দেয়াল থেকে ঝুলি খসে পড়লো আরো খানিকটা। যুদ্ধ চরম অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে। মরিয়া হয়ে আবার ও লোহার টুকরোটা সজোরে চেপে ধরল তালার ফুটোয়। হাতের কাটা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়লো তালার গায়ে। এতোক্ষণ ও আঙুল ভাঙার ভয়ে বেশি চাপ দেওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু এখন আর কিছুর পরোয়া করলো না। দুর্বল বাহুর সব শক্তি আর এই কয়েক মাসের বন্দী জীবনের সমস্ত আক্রোশ জড়ো করে লোহার টুকরোটার উপর ঝুঁকে পড়লো বলা যায়।

 খুলে গেলো তালা। কড়াটা ঝট করে খুলে পড়ে গেলো নিচে। হাঁটুতে লেগে ছিলে গেলো চামড়া ও কড়াটার দিকে তাকিয়ে রইলো, এখনো ওর অন্য হাতটা থেকে ঝুলছে। এখনো ওর পুরো বিষয়টা বিশ্বাস হচ্ছে না। বিগত কয়েক মাসের মধ্যে প্রথম ও নিজের কবজিটা দেখতে পেলো। ঘষায় ঘষায় ওখানকার চামড়া ছুলে গিয়ে কালো হয়ে আছে। ধরলেই ব্যথা করে।

কোনোমতে নিজের পায়ের উপর উঠে দাঁড়ালো ও! সারাহ তখনও ঘুমিয়ে আছে, এখুনি ওকে জাগানোর প্রয়োজন নেই। অ্যাগনেস পা টিপে টিপে গুহা থেকে বেরিয়ে লোহার দরজাটার কাছে চলে এলো। ওটার পরেই সিঁড়ি। ওখানেও তালা মারা-তবে সিঁড়ির গোড়ায়, দেয়ালে এক গোছা চাবি ঝোলানো আছে। বাইরে গোলগুলি শুরু হওয়ায় তাড়াহুড়ায় প্রহরীরা ওটাকে খেয়াল করেনি।

অ্যাগনেস হাত বাড়িয়ে নাগাল পেলো না। তবে তখনও ওর ডান কবজিতে হাতকড়াটা বাধা। ও গরাদের ফাঁক দিয়ে হাতটা বের করে দিলো। তারপর কড়ার খোলা প্রান্তটা মাছ ধরার জাল ফেলার মতো করে চাবির গোছার দিকে ছুঁড়ে দিলো।

কড়াটা চাবির গোছার সামান্য নিচে ঠকাস করে দেয়ালে বাড়ি খেলো। সিঁড়ি জুড়ে প্রতিধ্বনি উঠলো শব্দটার। ও আবারও চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না।

 এতোক্ষণে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ শুনে ফেলেছে–কিন্তু তাতে ওর যেনো জেদ আরো চেপে বসলো। ও এবার সময় নিয়ে তাক করে ছুঁড়ে দিলো কড়াটা।

 এবার জায়গামতো লাগলো সেটা, আর গোছাটা দেয়াল থেকে খুলে শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলো। আবারও কড়াটা ব্যবহার করে ওটাকে টেনে কাছে। নিয়ে এলো অ্যাগনেস। তারপর সেটা তুলে নিয়ে চাবিটা তালায় লাগাতেই খুলে গেলো দরজা।

 এখন সারাহকে বের করতে হবে। কিন্তু সারাহের কাছে ফিরে যাওয়ার আগেই একটা গা শিউরানো কান্নার আওয়াজে ভরে গেলো পুরো গুহা। কান্নার আওয়াজটা সারাহের। অ্যাগনেস দৌড়ে গেলো সেদিকে।

সারাহ মেঝেতে শুয়ে আছে, ওর মস্ত পেটের গায়ে হাঁটু চেপে ধরা, দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর, যেনো একটা প্রচণ্ড বেদনা চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না সারাহ। আবারও প্রচণ্ড ব্যথায় ডুকরে উঠলো। মাথাটা মেঝেতে বাড়ি খেলো, ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। একটু পরে কেটে রক্ত বেরিয়ে আসলো।

 অ্যাগনেস জানে ব্যথাটা কিসের। বোম্বেতে, আর পরে বিশ্লোয়ানেও ও মহিলাদের প্রসব বেদনার সময় সাথে থেকেছে। ওর কাজ ছিলো ডাক্তারকে সহায়তা করা। ও মহিলাদের হাত ধরে থাকতো, মুখ মুছিয়ে দিতো, আর কানে কানে উৎসাহ মূলক কথা বলে সান্ত্বনা দিতো। প্রায়ই ও নবজাতককে খুশিতে ঝলমল করতে থাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে পেরেছে, আবার বেশ কয়েকবার পুরো কষ্টটাই বৃথা গিয়েছে।

পালানোর সব চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো ওর। এখন আর সারাহকে নাড়ানো সম্ভব না। ও টান দিয়ে সারাহের পোশাক খুলে ফেললো। একদম সব। তারপর সেটাকে নোংরা মেঝের উপর বিছিয়ে দিলো। সারাহ কাপড়টার উপর মোচড়াতে লাগলো। ওর নগ্ন দেহের পুরোটা জুড়ে ঘাম জমে আছে। এই হালকা আলোতেও চিকচিক করছে তা।

চিৎকারের হার দ্রুত হতে লাগলো। অ্যাগনেস প্রতিবার ব্যথার মাঝের সময়টা গুণতে লাগলো। প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু সারাহ এখনো ধাক্কা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত না-কিন্তু আর দেরিও করা সম্ভব না।

আরো কয়েকটা কামানের গর্জন ভেসে এলো পাথরের ভিতর দিয়ে। আর তারপরেই সিঁড়ি বেয়ে ছুটন্ত পদশব্দ নেমে আসতে শুনতে পেলো অ্যাগনেস।

*

“কি করবো আমরা?”

 ফ্রান্সিস একবার সামনের বেড়া আর একবার পিছনে ধেয়ে আসা নৌকাগুলোর দিকে তাকালো। কি করবে সেটা ভাবারও সময় নেই হাতে। দ্রুত কাছিয়ে আসছে বেড়াটা।

 “জাহাজের মুখ ঘোরাতে হবে,” মেরিডিউ বললো। “নইলে আমরাই ওদের কাজটা সহজ করে দিয়ে, নিজেরাই নিজেদেরকে ডুবিয়ে মারবো।”

“তাহলেতো আবার ঐ গ্রাবগুলোর মাঝে গিয়ে পড়তে হবে। ওরা আমাদেরকে বোমা মেরেই উড়িয়ে দেবে।”

 “ওদিকে গেলে ঝুঁকি আছে মানছি, কিন্তু সোজা গেলে মৃত্যু একেবারে নিশ্চিত।”

 ফ্রান্সিস উন্মাদের মতো চারপাশে তাকাতে লাগলো। তাতেই। আটকে গেলো বেড়ার শেষ মাথায়। এক প্রান্তে ওটা একটা ছোট্ট কেল্লায় গিয়ে মিশেছে। ওখান থেকে উপসাগরের শেষ প্রান্তটা পাহারা দেওয়া হয়। অপর প্রান্তে বেড়াটা সোজা দুর্গের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়েছে। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় ওখানে একটা ছোট জেটি দেখতে পেলো ফ্রান্সিস। ওটার পরেই পাহাড়ের গায়ে একটা দরজাও দেখা গেলো।

“জাহাজের মুখ বাম দিকে ঘোরান,” আদেশ দিলো ও।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মেরিডিউ জাহাজ ঘোরাতে আরম্ভ করে দিলো। কিন্তু মাথাটা ঘুরে যেতেই ফ্রান্সিস হুইলটা ধরে আবার আগের দিকে ঠেলে দিলো।

“জাহাজ পুরো ঘোরাতে হবে না,” ফ্রান্সিস বললো। “গাছের গুঁড়িগুলো যেখানে বাঁধা সেদিকের পাথর বরাবর চালান।”

“তাহলেতো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে জাহাজ।”

ফ্রান্সিসের চেহারায় ছিটগ্রস্ত মানুষের মতো একটা হাসি ফুটে উঠলো। ওর ভিতরের অনিশ্চয়তাটা আর নেই; ও জানে যে এটাই ওর একমাত্র সুযোগ।

“আমরা ডাঙায় নামবো।”

ওদের জাহাজটা আগুয়ান নৌকাগুলোর সামনে আড়াআড়ি হয়ে, উপসাগরের মোহনা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। একদম সহজ নিশানা। বন্দুকের গুলি এসে জাহাজের পাশে লাগতে লাগলো। পাশের খোল ভেঙে ছিটকে পড়লো পানিতে। গালিভাতের দস্যুরা যখন টের পেলো যে জাহাজটা বেড়ার ফাঁদে আটকে গিয়েছে, তখন ওদের দাঁড়ের গতি আরো বেড়ে গেলো। যারা আগে জাহাজে উঠতে পারবে তাদেরকে আংরিয়া অতিরিক্ত পুরষ্কার দেবে।

“জেটির কাছে যাওয়ার আগেই যদি ওরা আমদেরকে ধরে ফেলে?” মেরিডিউ জিজ্ঞেস করলো। “ভাটার টান কমে গিয়েছে। আমাদেরকে এখন ধরে ফেলা পানির মতোই সহজ।”

“তাহলে আমরা সাঁতার দেবো।”

মেরিডিউ নিজের কপালে একটা চাপড় মেরে দড়াদড়িগুলোর দিকে দৌড়ে গিয়ে ওখানের লোকজনকে নির্দেশনা দিতে লাগলো। ও ওদেরকে নতুন লক্ষ্যের দিকে পাল ধরে রাখার কাজ দিয়েছে। যদিও পালটাতে অনেকগুলো ফুটো হয়ে গিয়েছে, তারপরেও কাজ হচ্ছে যথেষ্ট। ফ্রান্সিস বাকিদেরকে জাহাজের ভাঙা অংশগুলো কেটে পানিতে ভাসিয়ে দিতে বলেছে। ও চাচ্ছে জাহাজ যতোটা সম্ভব। জোরে ছোটাতে, সামনের পাহাড়ের দিকে যতোটা সম্ভব এগিয়ে যেতে চায় ও।

 তবে এখন, আর এক দিক থেকে আক্রমণের শিকার হলো ওরা। জেটিতে থাকা দস্যুরা ওদেরকে আসতে দেখতে পেয়েছে, ফ্রান্সিসের উদ্দেশ্যও ধরতে পেরেছে। আগুনের আলোয় ফ্রান্সিস দেখতে পেলো আংরিয়ার লোকেরা সবাই হন্তদন্ত হয়ে, হাতের বল্লমগুলো দিয়ে কামানের মুখটা সোজা করার চেষ্টা করছে, যাতে জাহাজের দিকে গোলা ছুঁড়তে পারে। বাকিরা হাঁটু গেড়ে বসে বন্ধুক তাক করে ধরে আছে।

ফ্রান্সিস জাহাজের সামনের দুর্গ মতন জায়গাটার দিকে দৌড়ে গেলো। সামনের উঁচু আড়ালটার কারণে ওটায় মাস্কেটের গুলি ঢুকতে পারে না। দস্যুরা আবার পিস্তলে গুলি ভরার আগেই ও সবাইকেই ওটার পিছনে লুকিয়ে পড়তে বললো।

বিশাল কামানটার পিছনে লুকিয়ে ও সামনের ফাঁকা দিয়ে উঁকি দিলো। জেটির লোকজন কামানটা সুবিধামতো বসিয়ে ফেলেছে। এখন দ্রুত গোলা ভরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ যেনো একটা রাউন্ড ধরে খেলা ডুয়েল। দুই পক্ষই চেষ্টা করছে অন্যদলের আগেই গুলি করতে।

 গ্রাবটা থেকেই গোলা ছোঁড়া হলো প্রথমে। কামানগুলো গোলা ছুঁড়ে আঁকি দিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু সেই গর্জন ছাড়িয়ে আরো প্রচণ্ড একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। জাহাজটা সজোরে গিয়ে জেটিতে আছড়ে পড়েছে। পানির বেশি গভীরে ডুবে ছিলো না জাহাজটা, ফলে একদম ডাঙার কাছে চলে যেতে পেরেছে। ওটার সামনের দিকটা একদম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পাথরুের উপরে উঠে গেলো। ডেক-এর লোকজন সব আছড়ে পড়লো এদিক সেদিক। জাহাজের কামানগুলোও ছিটকে গিয়ে কাত হওয়া ডেক ধরে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। একটুর জন্যে ফ্রান্সিসের পা থেতলে গেলো না।

“ওঠো সবাই!” চিৎকার করে উঠলো ও। “আক্রমণ করো ওদেরকে!”

গ্রাবের সামনের দিকটা ভোতা করে নকশা করা হয়েছে যাতে অন্য নৌকা এতে ওঠানো যায়। এখন জায়গাটা সুন্দর একটা পাটাতনের মতো কাজ করলো। পাথরের উপর দিয়ে সোজা জেটি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে সেটা। ফ্রান্সিসের নেতৃত্বে মারাঠারা ওটা ধরে দৌড়ে গেলো। তারপর রণহুংকার ছাড়তে ছাড়তে ওটার শেষ মাথা থেকে লাফিয়ে নেমে, ঝাঁপিয়ে পড়লো দস্যুদের উপর।

কামানের সর্বশেষ গোলাটায় ভালোই কাজ হয়েছে। দস্যুদের কামানটা উল্টে পড়ে গিয়েছে। পাশে যারা ছিলো, তারা নিজেদের রক্তে গোসল হয়ে পড়ে আছে পাশে। বাকিদেরকে পেড়ে ফেলতে কোনো কষ্টই হলো না ফ্রান্সিসদের। ফ্রান্সিস একজনের বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দিলো। তারপর চারপাশে তাকিয়ে দেখে আর কোনো শত্রু জীবিত নেই।

জেটি এখন ওদের দখলে।

“এখন?” মেরিডিউ জানতে চাইলো। হাতের কুড়াল থেকে রক্ত মুছছে। ও পাথরে গাথা আঙটাগুলো দেখালো। ওখানেই গাছের গুঁড়িগুলো বাধা। “বেড়াটা কেটে দেবো?”

“খুব বেশি লাভ হবে না আর। পালানোর জন্যে আর কোনো জাহাজ তো নেই।”

একটা মাস্কেটের গুলি এসে লাগলো দেয়ালে। ওদেরকে ধাওয়া করে আসতে থাকা নৌকার বহরটা কাছিয়ে এসেছে। সামনের গালিভাতটাতো একেবারে ওদের ভাঙা জাহাজটার পাশেই চলে এসেছে। ওটার লোকজন লাফিয়ে জাহাজের ডেক-এ নেমে যেতে লাগলো, জেটিতে পৌঁছানোর জন্য ওটাকে একটা সেতুর মতো ব্যবহার করছে।

 জেটিতে লুকানোর আর কোনো জায়গা নেই। শুধু পাহাড়ের গায়ের ছোট দরজাটা ছাড়া।

 “দুর্গে চলো সবাই,” চেঁচিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস। আগে ও ওর সবগুলো লোককে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, সবার শেষে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। সাথে সাথে তিনটা গুলি এসে লাগলো কাঠের দরজাটায়।

দেয়ালের একটা খোপে একটা বাতি জ্বলছে। ওরা কয়জন আছে গুণে নিলো ফ্রান্সিস। কাটায় কাটায় বারোজন মারাঠা, সাথে ও নিজে আর মেরিডিউ। এর মাঝে অর্ধেক আহত। এক হাজার লোকের বাহিনির বিরুদ্ধে এই ক্ষুদ্র একটা দল!

বাইরে থেকে প্রচণ্ড ধাক্কায় দরজাটা কেঁপে উঠতে লাগলো।

“দরজাটা কিন্তু বেশিক্ষণ টিকবে না,” সাবধান করলো মেরিডিউ।

ফ্রান্সিস ওর পিস্তলে গুলি ভরে নিলো। “খোলা মাত্র ওদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হবে।”

“সম্ভবত অন্য কোনো রাস্তা আছে,” মেরিডিউ একটা কানে হাত দিয়ে শোন্তর চেষ্টা করতে করতে বললো। “উপরে বোমার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?আমার মনে হয় মিস্টার টম আমাদের দিক থেকে দস্যুদের দৃষ্টি সরাতে ফটকের দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছেন। কিন্তু ঐ দরজা খুলতে ওনাদের খবর হয়ে যাবে। আমরা যদি উপরে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতে পারি, তাহলে পুরো পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যাবে।”

ফ্রান্সিস কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালো। একটা খাঁড়া সিঁড়িপথ পাথরের ফাঁক দিয়ে দুর্গের উপরে উঠে গিয়েছে। ওখানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত সবাই-ই এখন উপরে যুদ্ধে ব্যস্ত।

আবারও কেঁপে উঠলো দরজাটা। কাঠ ভেদ করে একটা কুড়ালের মাথা দেখা গেলো। সেটা খুলে নিয়ে আবার চালানো হলো। ফুটোটাও বড় হতে লাগলো তাতে।

“তাহলে আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই।”

ফ্রান্সিস আর ওর লোকেরা দৌড়ে গেলো সেদিকে, হাতে পিস্তল। সামান্য দূর যাওয়ার পরেই দড়াম করে দরজাটা ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলো। অনেকগুলো মানুষ চিৎকার করতে করতে একসাথে ঢুকে পড়লো ভেতরে। ফ্রান্সিস গতি বাড়িয়ে দিলো, এক যোগে তিনটা করে সিঁড়ি ভাঙছে। সিঁড়ির প্রতিটা কোনায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেলো, ওদিকে কেউ আছে কিনা সেই পরোয়া করছে না।

ওরা একটা জায়গায় এসে পড়লো যেখানে সিঁড়িটা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। ডান দিকে একটা নেমে গিয়েছে নিচে, আর একটা উঠে গিয়েছে উপরে।

ফ্রান্সিস উপরে দেখালো। “এদিকে। এটা দিয়েই-”।

একটা গা শিউরানো চিৎকার ভেসে এলো নিচের সিঁড়িটা দিয়ে। ফ্রান্সিস থেমে গেলো।

“অন্যদিকে মন দেওয়ার সময় নেই,” মেরিডিউ চেঁচিয়ে উঠলো। পিছনে ওদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের আওয়াজ চলে এসেছে খুব কাছে।

আবারও ভেসে এলো চিৎকার-একজন মহিলা প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাচ্ছে বোঝা গেলো।

 “আপনারা ফটকের দিকে যান,” মেরিডিউকে বললো ফ্রান্সিস। “আমি আসছি।”

সাথে সাথেই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ও ডানের সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে নেমে গেলো। সবাইকে ছেড়ে আসার মতো কোনো ব্যাখ্যা ওর কাছে নেই। কিন্তু সারাহ আর অ্যাগনেস এখানেই কোথাও আছে, আর ও ওদেরকে এভাবে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারবে না।

 সিঁড়ির একদম গোড়ায় একটা লোহার দরজা দেখতে পেয়ে থেমে গেলো ফ্রান্সিস। দরজায় কোনো প্রহরী নেই। আর চাবিও তালার ভিতর ঢোকানো-তবে ভিতর থেকে। ও ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো দরজাটা।

নিয়মিত বিরতিতে চিৎকার চলছেই। যেনো কেউ একটা গরম ছুরি কারো পেটে ঢুকিয়ে একটু পরপর মোচড় দিচ্ছে।

 এক হাতে তরবারি আর এক হাতে পিস্তল নিয়ে ফ্রান্সিস যথাসম্ভব শব্দ না করে এগিয়ে গেলো সামনে। শব্দ অনুসরণ করে কয়েকটা পাথরের ঘর পার হয়ে এলো ও। একটু পরেই একটা বাঁকে এসে উপস্থিত হলো। শব্দের তীব্রতায় বোঝা গেলো এর পরের গুহাটা থেকেই আসছে চিৎকার। ও দেয়ালের গায়ে নিজেকে চেপে ধরলো, তারপর সোজা হয়ে আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো, হাতে উদ্যত পিস্তল।

কিন্তু যা দেখলো তাতে হতভম্ব হয়ে গেলো পুরোপুরি।

সারাহ চিত হয়ে শুয়ে আছে, পা দুদিকে ছড়ানো, পুরো শরীরটা ফ্রান্সিসের দিকে ফেরানো। গায়ে একটা সুতা পর্যন্ত নেই। অ্যাগনেস ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সারাহের মাথাটা নিজের মাথায় নিয়ে আদর করছে আর ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সারাহের চোখ খোলা কিন্তু ফ্রান্সিসের আগমন টের পেলো না ও। অ্যাগনেস সারাহের উপর পড়া ছায়াটা দেখতে পেয়ে চোখ তুলে তাকালো।

 “ফ্রান্সিস?” চমৎকৃত হলো অ্যাগনেস।

ফ্রান্সিস ওদের দিকে দৌড়ে গিয়ে অ্যাগনেসের পাশে বসে পড়লো। আবারও তীব্র যন্ত্রণার একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো সারাহের শরীর জুড়ে। আগেরটার চাইতে বেশি থাকলো এবার। অ্যাগনেস সারাহের কপালের ঘাম মুছিয়ে দিলো।

“ওনার কি-?” ফ্রান্সিস আর এক দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো। সারাহের নগ্ন শরীরের দিকে তাকাতে পারছে না। “কি হয়েছে? ওরা কি খুব অত্যাচার করেছে?”

এই দরম দুর্দশার মাঝেও অ্যাগনেস হেসে দিলো। “আরে বোকা, ওর বাচ্চা হচ্ছে। আর বেশি দেরি নেই।”

 “বাচ্চা?” ফ্রান্সিস হাঁ হয়ে গেলো। “কিন্তু কিভাবে?”

“ভয় পেয়ো না। দস্যুরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি। এটা টমেরই বাচ্চা, তোমার চাচাতো ভাই। মানে, যদি শেষ পর্যন্ত আজকের রাতটা পার করতে পারে।”

সারাহের চিৎকারের মাত্রা কমে ফোপানিতে পরিবর্তিত হলো। অ্যাগনেস ওর কাধ ধরে আস্তে আস্তে তুলে বসালো।

“ওকে ঘোরাতে সাহায্য করো দেখি,” অ্যাগনেস বললো। “বাচ্চা বের হতে সহজ হবে তাহলে।”

 ফ্রান্সিস হাই উইল্ডে ঘোড়া আর ভেড়ার বাচ্চা প্রসব দেখেছে। তাই বাচ্চা জন্মদান সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ না ও। কিন্তু এরকম একটা লড়াইয়ের মাঝে যে ওকে দাই-এর ভূমিকা পালন করতে হতে পারে তা ওর সুদূরতম কল্পনাতেও ছিলো না। ও হাতের অস্ত্রগুলো নামিয়ে রাখলো। তারপর অ্যাগনেস আর ও ধরাধরি করে সারাহকে চার হাত পায়ে বসিয়ে দিলো। প্রচণ্ড জোরে হাফাচ্ছে সারাহ।

উপরে আবার কামানের শব্দ পাওয়া গেলো। এতোক্ষণে ফ্রান্সিসের এই হুট করে আগমনের ব্যাপারটা খেয়াল হলো অ্যাগনেসের। “গোলা কি তোমরা মারছো নাকি? এখানে এলে কিভাবে? দুর্গ দখল করে ফেলেছো? টম কোথায়?”

“সত্যিটা হচ্ছে আমি জানি না যে কি হচ্ছে,” ফ্রান্সিস স্বীকার করলো। “আমি আংরিয়ার বন্দরের জাহাজগুলো ধ্বংস করতে এসেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে যাই। তারপর পালাতে গিয়ে পানির ধারের যে দরজাটা আছে ওটা দিয়ে উঠে এসেছি। আমার মনে হয় টম চাচা উপরে ফটকের দিক থেকে আক্রমণ করেছেন যাতে আমাদের দিক থেকে নজর সরে যায়। কিন্তু এখন ওখানে কি অবস্থা সেটা জানিনা।”

 সারাহ গুঙিয়ে উঠলো। এবার অন্যরকম একটা শব্দ। নিচু কিন্তু আগের গুলোর চাইতে বেশি স্পষ্ট, যেনো ও বিশাল একটা ওজন তোলার চেষ্টা করছে। অ্যাগনেস ওকে জড়িয়ে ধরলো।

“বাচ্চা হয়ে যাবে এখনি।”

*

রাতটা প্রচণ্ড অস্থিরতায় কাটলো ক্রিস্টোফারের। ফাঁদ পাতা শেষ, শুধু শিকার আটকা পড়ার অপেক্ষা। কিন্তু সব ঠিকমতো হবে কিনা সেই দুশ্চিন্তা ওকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। ও আংরিয়াকে বন্দরে আক্রমণের খবরটা দিয়েছে। দস্যুদেরকে এটা বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে শত্রুদেরকে ধোকা দেওয়াই ওর উদ্দেশ্য ছিলো। অবশ্য ও যে হীরা ভর্তি থলেটা পেয়েছে সেটার কথা চেপে গেলো বেমালুম। সেটা এখন ওর ঘরে একটা বেল্টের ভিতরে নিরাপদে সেলাই করে রেখে দেওয়া হয়েছে। টম কোর্টনী সম্পর্কেও কিছু বললো না। প্রতিশোধটা ও ব্যক্তিগত ভাবেই নেবে।

 ক্রিস্টোফার নিজে বন্দরের আক্রমণটায় নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আংরিয়া নিষেধ করলো। কারণ ধূর্ত দস্যুর মাথায় তখন এটা ঘুরছে যে ক্রিস্টোফার মারাঠাদের সাথে যে বেঈমানি করার কথা বলছে সেটা কি আসলে ওদের সাথে করবে কিনা শেষ পর্যন্ত। ও ক্রিস্টোফারকে দুর্গ ছেড়ে নড়তে নিষেধ করে দিলো। ক্রিস্টোফার উপসাগরটার দিকের দেয়ালে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে আর দুশ্চিন্তা করছে। যদি টম ওকে চিনে ফেলে? যদি ও ক্রিস্টোফারের বেঈমানির কথা বুঝে ফেলে? যদি ওরা না আসে? ও দেয়ালের উঁচু অংশটায় হেলান দিয়ে রাতের আধারে তাকিয়ে রইলো। হাতে নেপচুন তরবারিটা নাড়ছে। উরুমিটা ওর কোমরে শক্ত করে আটা। লিডিয়ার কথা ভাবলো ও, ওর ঘরে অপেক্ষা করছে। ওর কাছে গেলে অবশ্য এসব কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকা যাবে। কিন্তু সেসব পরে করলেও হবে। বিজয়ীর বেশে যখন ফিরবে তখন ওর সঙ্গ আরো মধুর মনে হবে।

প্রথম অগ্নিকুটা জ্বলে ওঠা মাত্র ও টের পেলো ওর পরিকল্পনা একদম ঠিকঠাক খেটে যাচ্ছে। দেয়ালের এখান থেকে ও দেখতে পেলো যে শত্রুদের নৌকাগুলো একেবার বন্দরের মাঝে আটকা পড়ে গিয়েছে। আংরিয়ার বাহিনি ঘিরে ফেলছে ওদেরকে। এখান থেকে আর পালানোর উপায় নেই।

কিন্তু ওরা এখনো জানে না যে কেন এভাবে ধরা খেলো। ও আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলো নৌকা একটা গ্রাবের গায়ে এসে ঠেকলো, তারপর আরোহীরা জাহাজটায় চড়ে বসে কোনোভাবে জাহাজটা দখল করে নিয়ে ছড়িয়ে থাকা অন্য জাহাজগুলোর ফাঁক দিয়ে চালানো শুরু করে দিলো। দস্যু গোলন্দাজদের এতো চেষ্টা সত্ত্বেও ওটা ডুবলো না বা একটা মাস্তুলও ভাঙলো না। বরং ওটাই যাওয়ার পথে অন্য কয়েকটা জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, সোজা পালানো শুরু করলো।

তবে পালাতে পারবে না। সবগুলো নৌকা উপসাগরে ঢোকার পরেই ক্রিস্টোফারের লোকেরা বেড়াটা আবার লাগিয়ে দিয়েছে। জাহাজটা যদি কোনোমতে এখান থেকে পালিয়ে যেতেও পারে, বেড়ার কাছে গিয়ে প্রজাপতি যেভাব জালে আটকায় সেভাবেই আটকে পড়বে।

জাহাজটার ধ্বংস দেখার আশায় তাকিয়ে থাকতেই আর একটা নতুন শব্দ কানে এলো ওর : চেঁচামেচি, আর্তচিৎকার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। সৈন্যদল ধেয়ে আসছে।

“হচ্ছেটা কি?”

অন্ধকার কুঁড়ে আংরিয়ার গলা হিসিয়ে উঠলো। ক্রিস্টোফার ওর উঠে আসার আওয়াজ পায়নি। ও ঘুরে গেলো, কিন্তু আংরিয়া একদম ওর পিছনেই চলে এসেছিলো। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ও ক্রিস্টোফারকে দুই হাতে ধরে আগের দিকে ফিরিয়ে দেয়ালের কিনার দিয়ে ঠেসে ধরলো। ওখানেই ঝুলে রইলো ক্রিস্টোফার। আংরিয়া ওর হাতটা ছেড়ে দিলেই সোজা নিচে গিয়ে পড়বে।

 “এসব কি তোর কাজ?” আংরিয়া জানতে চাইলো। “আমার লোকদের দুই ভাগে ভাগ করে ফেলার জন্যে কোনো চালাকি? যাতে আমার শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে?”

“না, প্রভু,” মিনতি করলো ক্রিস্টোফার। দেয়ালের উপর ভারসাম্য রাখতে গিয়ে বারবার পিছলে যাচ্ছে পা। নিচে পড়লে কতোদূর যাবে সেদিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না ওর। “আমি জানিও না-”

 “মারাঠারা আক্রমণ করছে। যখন আমাদের সমস্ত মনোযোগ বন্দরের দিকে, ওরা তখন দেয়ালের দিক থেকে আক্রমণ করছে।”

“আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে ওরা আক্রমণ করবে। আমাদের চরেরা ডাঙার দিকে দিয়ে আক্রমণের কোনো লক্ষণই দেখতে পায়নি ওদের মধ্যে।”

আংরিয়া ক্রিস্টোফারের চোখের দিকে তাকালো। যা-ই দেখে থাকুক তাতে ও ক্রিস্টোফারের কথাকেই সত্যি বলে ধরে নিলো। ওকে টেনে তুলে একটা কামানের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললো, “পূর্ব দেয়ালের দিকে যা। ফটক রক্ষার দায়িত্ব তোর। আর আমি বলে দিচ্ছি যে, কেউ যদি তোকে কাজে সামান্যতমও কোনো ত্রুটি করতে দেখে, তাহলে যেনো সাথে সাথে তোর কল্লা নামিয়ে দেয়।”

ক্রিস্টোফার দেয়াল ধরে দৌড়ে গিয়ে উত্তর-পূর্ব মিনারে যাওয়ার সিঁড়ি ধরে উঠে গেলো। নিচে যা দেখলো তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না ওর। পুরো শৈল অন্তরীপ একটা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। ওদের মাঝখানে আবার তিনটা বিশাল হাতীও আছে। দুর্গের কামানের গোলায় এর মধ্যেই আক্রমণকারীদের অনেকেই আহত নিহত হয়েছে। কিন্তু তাতেও ওরা এক বিন্ধু দমেনি। কয়েকজনকে দেখে মনে হলো উলঙ্গ। ক্রিস্টোফার ভাবলো মারাঠারা বোধহয় বন্দীদের সামনে দিয়েছে যাতে কামানের গোলার আঘাত ওদের উপর দিয়ে যায়।

ওরা দেয়ালের ভাঙা অংশটা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে। বুঝতে পারলো। ক্রিস্টোফার।

দুর্গে যারা যারা ছিলো তারা সবাই দুর্গের পূর্বে ছুটছে। ক্রিস্টোফার একজন গোলন্দাজ ক্যাপ্টেনকে দেখতে পেলো। “দেয়ালের ভাঙা জায়গা বরাবর দুটো কামান বসিয়ে দাও। আর ওগুলোর ভেতর মাস্কেটের গুলি আর টুকরো টাকরা যা যা পাও ভরে রাখো। যদি ওরা দেয়ালের উপর উঠেই পড়ে, তাহলে একেবারে গাছের ডালের পাখি মারার মতো ওদেরকে উড়িয়ে দিতে পারবে।”

 ক্রিস্টোফার জানে যে টম কোর্টনী-ই আছে এর পেছনে। ও অন্ধকারে ওকে খুঁজতে থাকলো। মাস্কেট আর কামানের গোলা ছোঁড়ার সময় যে আগুন বের হচ্ছে তার আলোয় চেহারাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। উনি কি আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন? নাকি চালাকি করে অন্য লোকদের দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবেন?

আক্রমণকারীরা এখন এতো কাছে চলে এসেছে যে দুর্গের কামানগুলো দিয়ে আর ওদের গায়ে লাগানো সম্ভব না। ক্রিস্টোফার গোলন্দাজদেরকে কামান ফেলে দেয়ালের বন্দুকবাজদের সাথে যোগ দিতে আদেশ দিলো। প্রকাণ্ড একটা গর্জন ভেসে এলো দেয়ালের ওদিক থেকে। কোনো মানুষ এই আঘাত সহ্য করতে পারবে বলে ও বিশ্বাস করে না। কিন্তু তবুও দেখা গেলো ওরা আসছেই। ধোয়ার ভিতর দিয়ে ক্রিস্টোফার দেখলো ওদের ধুলোয় ভরা দেহগুলো হামাগুড়ি দিয়ে ধ্বংসস্তূপের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে। ভাঙা পাথরের টুকরোগুলোর নিচে লুকাচ্ছে, আবার উঠে আসছে। বেশ কয়েকজন দস্যু মারা পড়লো তাতে, অন্যেরা গিয়ে জায়গা নিলো তাদের।

ওদেরকে থামাতে হবে। “গুলি থামিয়ে দাও,” ক্রিস্টোফার বললো। “ওদেরকে ভাবতে দাও যে ওরা বিজয়ী হয়েছে।”

আদেশটা দেয়াল জুড়ে পৌঁছে গেলো। মাস্কেটের গুলি বর্ষণ থেমে গেলো। ক্রিস্টোফার হাতের নেপচুন তরবারিটা তুলে ধরলো যাতে নিচে চত্বরের দস্যুরা ওটা দেখতে পায়। মারাঠারা এটাকে সুযোগ মনে করে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে শেষ কয়েক গজ পেরিয়ে দেয়ালের উপর উঠে এলো।

 “এখন!” চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। সাথে সাথে তরবারিটাও নামিয়ে আনলো। চত্বরের কামানগুলো একসাথে গর্জে উঠলো। একগাদা মাস্কেটের গুলি আর অসংখ্য ভাঙা ধাতুর টুকরো ছুটে গেলো সামনে। যারা এগিয়ে এসেছিলো তারা সাথে সাথে মাংসের দলায় পরিণত হলো।

দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা খালি হয়ে গেলো মুহূর্তেই। দস্যুরা উল্লাস করে উঠলো। বিজয় বুঝতে পেরে ওরা সবাই ভাঙা জায়গাটায় দৌড়ে গেলো ওদের সদ্য বিজিত প্রতিদ্বন্দীদের উপহাস করতে।

 “থামো,” চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। কিন্তু কেউ ওর কথা শুনতে পেলো না বা শুনলেও পাত্তা দিলো না। কয়েকজন মাস্কেট ফেলে দিয়ে তরবারি তুলে নিলো যাতে কাছ থেকে মারতে পারে।

ক্রিস্টোফারের মতো ওরাও ভেবেছিলো যে কামানের গোলাটা মারাঠাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা মিটিয়ে দেবে। তাছাড়া ধোয়া কেটে যাওয়ার পরে দেখা গেলো ঢালের নিচের লোকগুলোর বিহ্বল দশা তখনও কাটেনি। ওদের মাঝে একজন উঠে দাঁড়ালো, তারপর নিজে ভাঙা জায়গাটার দিকে দৌড় দিলো আর চিৎকার করে বাকিদেরকেও আক্রমণ করতে আদেশ দিতে লাগলো। বাকিরা সাথে সাথে উঠে এলো ওর পাশে। কারো হাতে কুড়াল, কারো হাতে বল্লম, একজনের হাতে একটা বিশাল জৈত্রি, মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো সেটাকে নাড়ছে।

দস্যুরা কোনো প্রতিরোধ আশা করেনি। অতিরিক্ত উৎসাহে ওরা একেবারে সোজা শত্রুদের মুখে পড়ে গেলো। এখন সেই সুযোগ গ্রহণ করলো মারাঠারা। ওরা দস্যুদের পা কেটে দিলো, ফলে ওরা ভাঙা পাথর বেয়ে নিচে পিছলে পড়তে লাগলো। যাদের হাতে অস্ত্র নেই তারা পাথর তুলে নিয়ে শত্রুদের মাথার ঘিলু বের করে দিতে লাগলো। দস্যুরা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো যে কি করবে।

 দ্বিতীয়বারের মতো মারাঠারা দেয়ালের ভাঙা জায়গাটায় উঠে এলো। আবারও ক্রিস্টোফার অপেক্ষা করতে লাগলো কামানের গোলার আঘাতে ওদের উড়ে যাওয়ার, কিন্তু এবার দেখা গেলো কামানের কাছে কেউ নেই। গোলন্দাজেরাও মারামারি করতে ছুটে যাওয়ায় কেউ কামানে গোলা ভরেনি।

ক্রিস্টোফার গালাগালির তুবড়ি ছোটালো। ভাঙা দেয়ালের উপর একজনকে দেখা গেলো বিজয়োল্লাসে নিজের ততবারি তুলে ধরেছে। অবয়বটা টম কোর্টনী বাদে আর কারো না। ক্রিস্টোফার একটা বন্দুক তুলে নিয়ে টম কোর্টনীর বুক বরাবর তাক করলো। কিন্তু ধোয়ার কারণে টম ওর আড়ালে চলে গেলো। ধোয়া কাটতেই দেখলো টম আর ওখানে নেই।

প্রচণ্ড রাগে অস্ত্রটা আছড়ে ফেললো ক্রিস্টোফার। ওর সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। ও জানে দস্যুরা কিভাবে লড়াই করে। যখন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, তখন ওরা অজেয়-কিন্তু একবার যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলেই ওদের নিয়ম শৃঙ্খলার আর কোন বালাই থাকে না। শেষ মুহূর্তের প্রতিরোধ বলে এদের মাঝে কিছু নেই। এরমধ্যেই ও দেখতে পেলো দস্যুরা চত্বর জুড়ে পালানো আরম্ভ করেছে। পিছনে ধাওয়া করছে মারাঠারা। দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে এখন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো এসে ঢুকছে ওরা। দুর্গের পতন ঘটে গিয়েছে।

পরাজয় আর রাগ দুটো অনুভুতিই একসাথে গ্রাস করলো ক্রিস্টোফারকে। টম কোর্টনী-ই এর জন্যে দায়ী। এখানে, বা ব্রিঞ্জোয়ানে সবখানেই। ওর জীবনের প্রতিটা বাকে-সেই মায়ের পেটে আসার পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেখানে যা কিছু ক্রিস্টোফার চেয়েছে তার সবকিছুই এই লোকটা ছিনিয়ে নিয়েছে। ওর জন্মদাতা পিতা টম কোর্টনী-ই হচ্ছে ওর জন্ম শত্রু।

কিন্তু পরাজিত হলেও এখনো ও চাইলে টমের বিজয়কে ভস্ম করে দিতে পারে। ও দেয়াল ধরে দৌড়ে গিয়ে দুর্গে ঢোকার দরজাটা দড়াম করে খুলে ভিতরে ঢুকে গেলো।

 শত্রুরা ঢোকার আগেই লুটপাট শুরু হয়ে গিয়েছে। হেরে যাওয়ায় দস্যুরা এখন একজন আর একজনের সাথে লেগেছে। নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করছে সবাই। পালাতে পারবে এই আশায়, ভাড়ার ঘরে ঢুকে বহন করতে পারবে এমন যা যা পাচ্ছে নিয়ে নিচ্ছে ওরা।

ক্রিস্টোফার ওসবের ধার ধারলো না। ও এই হৈ হট্টগোল পেরিয়ে একটা চরম নিষ্ঠুর উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চললো। দুই একজন দস্যু ওর হাতের তরবারিটা খেয়াল করে এগিয়ে এসে ওটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে চাইলো, কিন্তু ওর চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে গেলো সে চেষ্টা না করলেই ভালো করবে। বাকিরা লুটপাটে এতো ব্যস্ত ছিলো যে ওকে খেয়াল করলো না।

দস্যুরা দুর্গের ভিতরে ঢুকে যেতেই শোরগোল কমে এলো অনেকটা। ক্রিস্টোফার ওর গতি বাড়িয়ে দিলো, তারপর থেমে গেলো আচমকা। ছুটন্ত পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে। উপর থেকে না, নিচ থেকে আসছে। ও দেয়ালের পাশের একটা কুলুঙ্গিতে ঢুকে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়লো।

প্রায় ডজনখানেক লোক দৌড়ে উঠে গেলো। ওদের পোশাক দেখে বুঝলো যে এরা মারাঠা, তবে সবার সামনের লোকটা একজন ইংরেজ নাবিক। এক মুহূর্ত ক্রিস্টোফার ভাবলো ওটা টম নাকি। হয়তো ও আসলে দেয়ালের দিকে আসেইনি। ক্রিস্টোফারের হাত তরবারির হাতলে চেপে বসলো। ও শুধু হাতটা বাড়ালেই ইংরেজটার কল্লা পড়ে যেতো।

“তাড়াতাড়ি,” লোকটা ডাকলো। কণ্ঠ শুনে ক্রিস্টোফার স্বস্তি পেলো। টম না ওটা। ও ওদেরকে যেতে দিলো। একটু পরেই ওদের পদশব্দ মিলিয়ে গেলো উপরে।

ক্রিস্টোফার আবার নামতে শুরু করলো। একটু পরে ছোট একটা কক্ষে চলে এলো যেখানে রাস্তা দুই দিকে গিয়েছে। কিন্তু এবার সাথে সাথে আরো অনেকগুলো পদশব্দ পাওয়া গেলো। আর এখানে লুকানোরও কোনো জায়গা নেই। ও অস্ত্র তুলে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।

তবে ও এই লোকগুলোকে চেনে। আলোয় এসে দাঁড়াতেই ও দেখতে পেলো এরা সবাই আংরিয়ার লোক। বন্দরের আক্রমণের দায়িত্বে ছিলো সবাই।

এখানে ক্রিস্টোফারকে দেখতে পাবে বলে আশা করেনি ওরা। “টুপিওয়ালারা কই?” জানতে চাইলো ওরা। “আমরা ওদেরকে পানির দিকের দরজাটা দিয়ে ধাওয়া করে এসেছি। এদিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। ওরা।”

“দুর্গ পতন হয়েছে,” কর্কশ কণ্ঠে বললো ক্রিস্টোফার। “শত্রুরা ভিতরে ঢুকে পড়েছে।” ও দুজনের দিকে নির্দেশ করলো। “তুমি আর তুমি আমার জন্যে এখানে অপেক্ষা করো। আর বাকিরা পানির দরজার কাছে গিয়ে পালানোর জন্যে একটা নৌকার ব্যবস্থা করো। আমি একটু পরেই আসছি।”

বলেই ক্রিস্টোফার কয়েদখানায় নামার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো। নিচে নেমে খোলা দরজা দেখতে পেয়ে থমকে গেলো। চিৎকারের আওয়াজ পেলো ও, একজন মহিলা যেনো মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে। কোনো দস্যু কি এর মধ্যেই এখানে এসে নিজের কুমতলব হাসিল করা শুরু করে দিয়েছে? কিন্তু না, চিৎকার যেনো খুব নিয়মিত হচ্ছে। আর এর মাঝে খুব নরম সুরে কেউ কথা বলছে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা।

ও কোমর থেকে উরুমিটা খুলে নিলো। তারপর হাতের তালুতে পেঁচিয়ে সোজা সামনে এগিয়ে গুহার যেখান থেকে শব্দটা আসছে, সেখানে উপস্থিত হলো। কোনা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলো ও।

একজন পুরুষ আর মহিলা আর একজন মহিলার পাশে বসে আছে। সেই মহিলা উলঙ্গ অবস্থায় চার হাত পায়ে ভর দিয়ে আছে। মহিলা হাফাচ্ছে আর গোঙাচ্ছে। ওদের কেউই ক্রিস্টোফারের আগমন টের পেলো না। ক্রিস্টোফার হাসলো। এটাই হবে ওর চূড়ান্ত আঘাত-টম কোর্টনীর প্রতি ওর উপহার।

“কুত্তীটা বিয়াচ্ছে নাকি?” বলে উঠলো ক্রিস্টোফার।

ছেলেটা ঘুরে ক্রিস্টোফারকে দেখেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক যেমনটা ক্রিস্টোফার ভেবেছিলো। উরুমিটার ফলা ছুটে গেলো বাতাসে, আর ছেলেটার পায়ের মাংস কেটে দুই ভাগ করে দিলো। ছেলেটা আর্তনাদ করে পড়ে গেলো মাটিতে। জায়গাটা চেপে ধরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পায়ে শক্তি পেলো না।

“ফ্রান্সিস,” কেঁদে উঠলো অ্যাগনেস।

“ফ্রান্সিস?” ক্রিস্টোফার বললো এবার। ও নেপচুন তরবারিটা ছেলেটার বুখে গেঁথে দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু থেমে গেলো, নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না। “ফ্রান্সিস কোর্টনী?”

ফ্রান্সিস এক দলা থুতু ফেললো মেঝেতে তারপর মাথা ঝাঁকালো।

 “তোর পরিবারের কি হাল করি তা চেয়ে চেয়ে দেখবি এখন।”

*

টম ভাঙা দেয়ালটা থেকে লাফিয়ে নামলো। এপাশেও দেয়ালের ভাঙা টুকরো ঢাল তৈরি করেছে। ওগুলো বেয়ে নেমে এলো ও তরবারি তুলে ধরা, কিন্তু সেটা ব্যবহার করা লাগলোই না বলা চলে। দস্যুরা ওর সামনে থেকে যে যেভাবে পারলো ভেগে গেলো। পিছনেই মারাঠা বাহিনি হুড়মুড় করে ঢুকতে লাগলো ভিতরে। ঘোশিয়া সৈন্যগুলো খুনের উৎসবে লেগে গেলো যেনো। উলঙ্গ আর উন্মত্ত অবস্থায় খোদ শয়তানের রূপ ধরে মানুষ মারতে লাগলো ওরা। যাদের হাতে অস্ত্র আছে তারা সামনে যাকে পেলো তারই কল্লা নামিয়ে দিতে লাগলো; বাকিরা খালি হাতেই দেখা গেলো গলা টেনে ছিঁড়ে ফেলছে।

 এই কসাইখানার ভিতরেই কোথাও সারাহ আর অ্যাগনেস আছে। টম চত্বর থেকে যতো দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। মোহিত ও আগালো পাশেই। কয়েকজন দস্যু তখনও যুদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, জায়গায় জায়গায় তাই ছোট ছোট লড়াই চলছে। টম ওদেরকে পাত্তা না দিয়ে দুর্গের ভিতরে ঢুকে গেলো।

“ওরা বন্দীদেরকে কোথায় রাখতে পারে বলেন দেখি,” টম জিজ্ঞেস করলো মোহিতকে।

 মোহিত কাঁধ ঝাঁকালো। তারপর আচমকা সামনে দৌড়ে গিয়ে পলায়নরত এক দস্যুর কাধ চেপে ধরে, পা দিয়ে ল্যাং মেরে শুইয়ে দিলো মাটিতে। একই সাথে ছুরি বের করে চেপে ধরলো গলায়। ভারতীয় ভাষায় কিছু একটা চেঁচিয়ে বললো মোহিত।

দস্যুটা ওর দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে। তারপর হড়বড় করে কিছু একটা বললো। মোহিত ওকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

“কয়েদখানা হচ্ছে দুর্গের নিচের গুহাগুলোতে। দুর্গের ভিতরে উত্তর-পূর্ব দিকে নাকি নিচে নামার একটা সিঁড়ি আছে।”

ভিতরে ঢুকতে ওরা কোনো বাধার সম্মুখীন হলো না। পলায়নরত দস্যুরা ওদের দেখে এমনিতেই সামনে থেকে সরে যেতে লাগলো। ওরাও ওদেরকে পাত্তা দিলো না। দস্যুরা যুদ্ধ করার সমস্ত ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে; এখন শুধু লুণ্ঠন কার্যে ব্যস্ত। আর টমের ওদের কাছে কিছুর প্রয়োজনও নাই। একদম নিচে নেমে আসতেই দেখা গেলো একটা সিঁড়ি দুর্গের ভিত্তির মাঝে নেমে গিয়েছে। টম দ্রুত নেমে এলো নিচে।

নিচে নামতে নামতে ওর আশা বাড়তে লাগলো। সিঁড়ি যেনো শেষই হয় না। কিন্তু দস্যু বা আর কেউ দুর্গের এদিকটাতে এসেছে বলে মনে হচ্ছে না।

“আমরা মনে হয় সময়মতোই এসে পড়েছি,” মোহিতকে বললো টম।

কিন্তু টম জানে না যে বাস্তবতা ভিন্ন। ওরা সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে এলো। গোড়ায় একটা ছোট কক্ষ দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে আবার দুটো রাস্তা নেমে গিয়েছে দুদিকে। টম ভাবছিলো যে কোন সিঁড়িটা দিয়ে নামবে, সে কারণেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুজনকে খেয়লা করলো না। সিঁড়িতে পদশব্দ পেয়েই ওরা দুজন দরজার দুই পাশে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টম আর মোহিত দরজা দিয়ে ঢুকতেই, ভারী তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের উপর।

হতে পারে সৈন্য দুজন কোনো শব্দ করে ফেলেছিলো, বা একেবারে প্রবৃত্তির বশে ঠিক এক মুহূর্ত আগে টম টের পেয়ে গেলো যে আক্রমণ আসছে। আঘাতটা আটকানোর সময় পেলো না ও। শুধু মাথা নিচু করে মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সাথে টেনে নামিয়ে নিলো মোহিতকেও। তরবারির ফলা দুটো ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। এদিকে কোনো কিছুতে বাধা না পাওয়ায় দস্যু দুজন ভারসাম্য হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে ওদের গায়ের উপরেই এসে পড়লো। টম আর মোহিত ওদেরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে, তরবারির দুই খোঁচাতেই ঐ দুজনের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো।

টম দুটো সিঁড়ির দিকেই তাকিয়ে থাকলো। কোনটায় যাবো? “আপনি ডানটায় যান, আমি বায়েরটা খুঁজে দেখছি,” টম বললো।

দুজন দুই দিকে চলে গেলো ওরা। টম ঝড়ের বেগে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। প্রতিটা সেকেন্ড যেনো ওর উপর চেপে বসছে। উপরের ঐ দুজন লোক কোত্থেকে আসলো? আরো অনেকেই ছিলো নাকি? ওরা সারাহ আর অ্যাগনেসের কিছু করেনি তো? টমের বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো।

 সিঁড়ির গোড়ায় একটা লোহার দরজা। এটাই নিশ্চিত কয়েদখানা। টম একবার ভাবলো মোহিতকে ডেকে আনবে কিনা, কিন্তু তাতে মূল্যবান সময়ের অপচয় হবে ভেবে বাদ দিলো চিন্তাটা। আর তাছাড়া দরজাটা খোলাই আছে। গুহার ভিতরের দিক থেকে একটা মহিলার আর্তচিৎকার শুনতে পেলো ও। একটু পরেই একজন পুরুষ মানুষও আর্তনাদ করে উঠলো। সমস্ত কুচিন্তা আবার ফিরে এলো মাথার ভিতর। কোনো সতর্কতার ধার না ধরে ও সোজা দৌড় দিলো গুহার ভিতরের দিকে। একটু পরেই একটা বড়সড় কক্ষে এসে হাজির হলো টম।

 একবার তাকিয়েই সব বুঝে গেলো ও। ওর সুদূরতম আশা, আর ওর গভীরতম ভয়, দুটোই একই সাথে বাস্তব হয়ে ধরা দিলো সামনে। সারাহ নগ্ন অবস্থায় চার হাত পায়ে ভর দিয়ে চিৎকার করছে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে; অ্যাগনেস জবুথবু হয়ে বসে আছে পাশে; ফ্রান্সিস পায়ে একটা গভীর ক্ষত চেপে ধরে দেয়ালের গায়ে সেটে আছে। আর সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওদের সাথে বেঈমানি করা লোকটা। এক হাতে উদ্যত নেপচুন তরবারি, অন্য হাতে সেই চাবুকের মতো ফলাটা।

লোকটার পিঠে টমের দিকে–কিন্তু অ্যাগনেসের চেহারা ছিলো এদিকে। ফলে টমকে দেখে ওর চোখে মুখে যে স্বস্তির ছাপ পড়লো সেটা ও লুকাতে পারলো না। টম কিছু করার আগেই ক্রিস্টোফার অ্যাগনেসের চেহারার পরিবর্তন ধরতে পেরে ঘুরে গেলো পিছনে। বিকট এক হাসি ফুটে উঠলো ওর চেহারায়।

“টম কোর্টনী,” ইংরেজিতে বলে উঠলো ও। “আমি আশা করে ছিলাম যে আপনি শেষ দৃশ্যটা দেখতে সময়মতো হাজির হবেন।”

প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলো টম। হাতের তরবারিটা তুলে নিয়ে জ্যাভেলিনের মতো ছুঁড়ে দিলো। ঠিক যেভাবে টেমসের তীরে নেপচুন তরবারিটা ছুঁড়ে বিলির হৃৎপিণ্ড ফুড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মারাঠা তরবারি অনেক ভারী, ফলে ঠিকমতো ছুঁড়তে পারলো না। লক্ষ্যে পৌঁছার আগেই মাথাটা নিচু হয়ে গেলো, আর ক্রিস্টোফার উরুমি ছুঁড়ে ওটাকে নিজের দিক থেক সরিয়ে দিলো। ঝন করে মেঝেতে পড়ে পিছলে গেলো ওটা।

এখন অসহায় হয়ে গেলো টম। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এলো। উরুমির ফলাটা সাপের মতো একেবেকে আগালো ওর সাথে সাথে, পাথরের উপর সরসর শব্দ করছে। ঘরের অন্য শব্দটা করছে সারাহ, গোঙাচ্ছে।

 “আমি এই অস্ত্রটা ঠিক একজন চিত্রকরের আকার তুলির মতো ব্যবহার করতে পারি,” ক্রিস্টোফার বলে উঠলো। “আমি একটা একটা করে আপনার হাত পা কেটে নেবো। তারপর যখন আর আপনার কিছু করার থাকবে না তখন আপনি চেয়ে চেয়ে দেখবেন কিভাবে আমি আপনার বৌকে জবাই করি আর আপনার ছেলেকে আছড়ে ঘিলু বের করি।”

টম বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। “কেনো? আমি তোমাকে কি করেছি?”

 “জানেন না আপনি? অনুমান করেন দেখি?” ক্রিস্টোফার আরো এক পা এগিয়ে এলো। তারপর সারাহের দিকে ইশারা করলো, এখন ও দেয়াল চেপে ধরে শুধু হাঁটুতে ভর দিয়ে আছে। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে বাচ্চার মাথা দেখা যাচ্ছে। ক্রিস্টোফার টমের চেহারার অভিভূত অবস্থাটা দেখে হেসে দিলো।

“আপনি তো ঐ বাচ্চাটাকে বাঁচাতে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত, তাই না? আপনি এই অজেয় দুর্গে এতো কষ্ট করে এসে এটাকে ছিন্ন ভিন্ন করেছেন শুধু ওটাকে রক্ষা করার জন্যে। ইশ! কতো মহান আপনি! কতো বড় বীর!”

তবুও টম বুঝতে পারলো না।

“কিন্তু সব সময়তো আপনি এতোটা কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন না। নাকি ছিলেন?” চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললো ক্রিস্টোফার। “আমার মা-কে ভোগ করে তার পেটে বাচ্চা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু জানার পর ভাগতে দুইবার ভাবতে হয়নি আপনার। আপনি আমাকে ত্যাগ করেছেন, আর আপনার ভাইকে রেখে গিয়েছেন আমার মায়ের লজ্জাকে ঢাকতে।”

টম এতোক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ওর চেহারা দেখে ক্রিস্টোফারও টের পেলো সেটা। নিজের কৃতকর্মের জন্য একই সাথে টমের চেহারায় আতংক, ভয় আর লজ্জা খেলা করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ক্রিস্টোফার টের পেলো লিডিয়ার বলা প্রতিটা কথা-ই সত্যি। উরুমিটা ছোঁড়ার জন্যে ও হাত সোজা করলো, কোথায় মারবে সেটা চিন্তা করছে। প্রথমে ভাবলো টমের উরুতে ছুঁইয়ে ওর হ্যামস্ট্রিংটা দুই ভাগ করে দেবে। তারপর ধীরে সুস্থে একে, একে বাকি সব করতে পারবে।

 “কে তুমি?” জিজ্ঞেস করলো টম। ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছে; কথাটা ফিসফিসানির মতো শোনালো।

ক্রিস্টোফার ওর চোখের দিকে তাকালো। দুজনের চোখই হুবহু এক। যেনো আয়নার দিকে তাকিয়েছে ও।

“আমি আপনার ছেলে।”

 বলে উরুমি চালালো ক্রিস্টোফার।

কিন্তু কিছু একটা টেনে ধরলো ওকে পিছন থেকে। উরুমি নড়লো না। ফ্রান্সিস হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগিয়ে এসে ওটার মাথা চেপে ধরেছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে ফলাটা। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে ফ্রান্সিসের। যেখানে ধরেছে। সেখানে আঙুল কেটে রক্ত পড়ছে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়লো না ফলাটা।

প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে উঠে ক্রিস্টোফার উরুমিটা ছেড়ে দিয়ে নেপচুন তরবারিটা তুলে নিলো। এটাই ঠিক আছে। কোর্টনীদের তরবারি দিয়েই ও টমকে শেষ করবে। আর তরবারিটার উপর ওর উত্তরাধিকারটাও সুনিশ্চিত হবে।

কিন্তু ফ্রান্সিস যখন ক্রিস্টোফারকে আটকে রেখেছিলো তখন অ্যাগনেস নড়ে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠে যেখানে টমের তরবারিটা পড়েছিলো সেখানে গিয়ে তরবারিটা তুলে নিয়ে টমের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ক্রিস্টোফার ওকে নড়তে খেয়াল করলো। সাথে সাথে ও নেপচুন তরবারিটা চালালো কিন্তু অ্যাগনেস গড়িয়ে গুহার অন্যদিকে সরে গেলো। ক্রিস্টোফার আবার আক্রমণ করতে পারার আগেই টম ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর দিকে। রেগে মেগে সমস্ত শক্তি দিয়ে তরবারি চালালো টম, একদম শেষ মুহূর্তে কোনোমতে সরে গেলো ক্রিস্টোফার।

ক্রিস্টোফার ভাবলো ও যদি সারাহের কাছে পৌঁছে ওর গলায় তরবারি ধরতে পারে তাহলে টম আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু ফ্রান্সিস বিপদটা আঁচ করতে পারলো। ও মেঝে থেকে যতোটা পারলো সোজা হয়ে ক্রিস্টোফার আর সারাহের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

ক্রিস্টোফার চাইলে এক কোপে ফ্রান্সিসের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু সেটা করতে গেলে ওর পিঠ টমের দিকে ফিরে যেতো, টম আবার ওর দিকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। টমের আক্রমণ নিজের তরবারি দিয়ে ঠেকালো ক্রিস্টোফার, ঝন ঝন শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো সাড়া গুহা জুড়ে।

ওদের সবার বিরুদ্ধে ক্রিস্টোফার একা। ও খুব দ্রুত প্রতি আক্রমণ শুরু করলো। বহুল চর্চিত কয়েকটা আঘাত দিয়ে কোণঠাসা করে ফেললো টমকে। ক্রিস্টোফার এখনো প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে আছে, কিন্তু এখন অনেকগুলো বিপদ সামনে। দুর্গের পতন হয়েছে-কিছুক্ষণ পরেই লোকজন চলে আসবে এদিকে। ওকে পালাতে হবে দ্রুত।

টমকে ঠেলতে ঠেলতে সারাহের কাছে নিয়ে আসলো ও। এখন ক্রিস্টোফার আর দরজার মাঝে আর কিছুই নেই। ও আবার টমকে আক্রমণ করলো। একদম বই থেকে রপ্ত করা নিখুঁত সব আক্রমণ। আর ওর ধারণা মতোই টমও সহজেই ওগুলো আটকে দিলো। কিন্তু যেই টম উল্টো জবাব দিতে যাবে, তখনই ক্রিস্টোফার আচমকা পিছনে দিকে সরে গিয়ে, টম কিছু করার আগেই উল্টোদিকে ঘুরে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। একটু পরেই সিঁড়িতে হারিয়ে গেলো ওর পদশব্দ।

 সারাহ কেঁদে উঠলো, ওর গোঙ্গানিটা এখন একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে রূপ নিয়েছে। টম দৌড়ে গেলো ওর কাছে।

রক্ত আর তরল উগরে দিয়ে বাচ্চাটা অ্যাগনেসের পেতে রাখা হাতে এসে পড়লো।

“ছেলে হয়েছে আপনার।”

বাচ্চাটার চেহারাটা একজন বৃদ্ধের মতো কুঁচকে আছে, চোখ বন্ধ, নাড়ি তখনও মায়ের সাথে সংযুক্ত। গায়ের ত্বক অস্বাভাবিক নীল।

“ও কি…বেঁচে আছে?” টমের ভিতর এতো জোরে আবেগের ঝড় বইতে লাগলো যে অসুস্থ্য লেগে উঠলো ওর। এক মিনিট আগে, ও এমন এক শয়তানের বিরুদ্ধে লড়ছিলো, যে দানব কিনা ওর নিজেরই সৃষ্টি; এখন আবার সারাহের সাথে দেখা হলো, সেই সাথে বাবাও হলো। ওর মাথার ভিতর এতো বেশি চিন্তা ঘুরতে লাগলো মনে হলো যেনো মাথাটা ছিঁড়ে বের হয়ে যাবে সব।

 অ্যাগনেস বাচ্চাটার পিঠে একটা চাপড় দিতেই ওটা কাশি দিয় উঠলো। শ্লেম্মা বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। বাচ্চাটা অর্ধেক চোখ খুলে টমের দিকে কেমন ঢুলুঢুলু বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

“ওকে নিন, অ্যাগনেস আগ্রহ ভরে বললো। “আপনার ছেলে।”

অ্যাগনেস বাচ্চাটাকে টমের বাহুতে বসিয়ে দিলো। যদিও টমের সাহস হচ্ছিলো না ওকে ধরার। বাচ্চাটা এতো ছোট, ওজনটাও অনুভব করতে পারলো না ও। কিন্তু তবুও যেই মুহূর্তে ও নিজের ছেলেকে স্পর্শ করলো তখনি এমন একটা ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতা ওর ভিতরে উথলে উঠলো, যা এর আগে কখনোই অনুভব করেনি। ওর চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। এততক্ষণ ভরে যে আবেগের ঝড় বইছিলো, স্তিমিত হয়ে গেলো সেটা। ছেলের নিষ্পাপ চোখ দুটোয় যে নির্মল শান্তি তা শান্ত করে দিলো সব অস্থিরতাকে।

কিন্তু ওর কাজ এখনো শেষ হয়নি। ও দ্রুত বাচ্চাটাকে সারাহের বাড়িয়ে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলো।

“যাও,” সামান্য পরেই সারাহ বললো। সব ব্যথা এক নিমিষে চলে গিয়েছে ওর। এখন উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। ওর মাথার চুল পড়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে, চেহারা ভর্তি ঘাম, পা ভরা রক্ত। গায়ে একদম কিছুই নেই। বাচ্চার নাড়িটা তখনও ওর দুই পায়ের। ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে। কিন্তু তবুও ও এমন একটা আভায় জ্বলজ্বল করছে : যা টম আগে কখনোই দেখেনি। যেনো ভিতর থেকেই একটা নিশ্চয়তা ওকে জানিয়ে দিচ্ছে যে ওর একটা অংশ নতুন করে জন্ম গ্রহণ করেছে। টমের মনে হলো সারাহকে এর আগে কখনো এতোটা সুন্দর লাগেনি।

“তোমার আর আমাদের বাচ্চার পাশে থাকা উচিত আমার,” টম প্রতিবাদ করলো।

“আমরা এখানে নিরাপদ আছি,” সারাহ বললো। “কিন্তু তরবারিটা এখনো ঐ শয়তানটার দখলে-আর ও ওটা দিয়ে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। তোমাকে, আমাকে–আর ওকেও।” ও বাচ্চাটাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বাচ্চাটা সারাহের স্তনে নাক ঘষছে আর ছোট্ট ছোট্ট আঙুল দিয়ে ওর স্তনের বোটা খুঁজছে।

কারো দৌড়ে আসার শব্দ পাওয়া গেলো। টম ঘুরে গেলো। ও ভাবেনি যে ক্রিস্টোফার ফিরে আসবে আবার, কিন্তু দুর্গে এখনো অনেকেই আছে। এই লুটতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে যে কেউই ওদের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মোহিতকে আসতে দেখে শান্ত হলো ও। পিছনে আরো চারজন লোক।

“আমরা দস্যুদেরকে পানি পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছি,” হাবিলদার। জানালো। “ফেরার পথে আরেকটাকে পেয়েছিলাম কিন্তু সে পালিয়ে গিয়েছে।” বলে ও ভ্রু কুঁচকানো। “ঐ লোকটাই আমাদের সাথে বেঈমানি করেছে সম্ভবত। ওর হাতে একটা দারুণ সোনালি তরবারি দেখলাম।”

 “অনেক ধন্যবাদ,” টম লোকটার কাঁধ স্পর্শ করলো। “এখানে থাকুন। আর একটু খেয়াল রাখবেন আমার… “ আবারও বাচ্চাটার দিকে নজর যেতেই ওর কথা জড়িয়ে এলো। পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে এখন সে। “পরিবারের যেনো কিছু না হয়।”

“সাথে কাউকে দেবো?”

 টম মাথা নাড়লো। “আমি একাই করবো কাজটা।”

*

টম আবার দুর্গের উপর দিকে দৌড়ে গেলো। এবার আর অসতর্ক না, কান খাড়া করে রেখেছে কারো পদশব্দ শুনতে পায় কিনা সেই আশায়। তরবারি প্রস্তুত-কিন্তু ওর চিন্তার প্রায় পুরোটা জুড়েই আছে অন্য একটা জিনিস : বাচ্চাটা, এতো ছোট আর অসহায়, ঠিক একটা পালকের মতো পলকা।

আমি একজনের পিতা।

তুমি আগেও বাবা হয়েছিলে, একটা নিষ্ঠুর কণ্ঠ ভিতরে ডেকে উঠলো। একটু আগে দেখা দানবটা যে ওর ছেলে সেটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ক্রিস্টোফার, অ্যাগনেস, সারাহ আর বাচ্চাটাকে কি করতে চেয়েছিলো সেটা মনে আসতেই আবার ওর ভিতরটা শক্ত হয়ে গেলো।

আমার বাবা আমাকে বাধ্য করেছিলেন। হাল কোর্টনী যখন টমের সাথে ক্যারোলিনের মাখামাখির ব্যাপারটা টের পান, আর তার ফলে গাই আর টমের মাঝে গড়ে ওঠা তিক্ততার কথা জানতে পারেন, উনি সাথে সাথে গাই আর কোর্টনীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেন। ওদেরকে বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে, ক্যারোলিনের বাবার সহকারী হিসেবে গাই-এর জন্যে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তখন কেউই টের পায়নি যে ক্যারোলিনের পেটে বাচ্চা আছে। টম এমনকি বিদায়-ও জানাতে পারেনি ক্যারোলিনকে।

টম ব্যাপারটা জানতো না, কিন্তু ওর বাবা ইচ্ছাকৃতভাবে ওর কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছিলেন। যখন ক্যারোলিনের বাবা বাচ্চাটার কথা জানিয়ে হালকে চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠি উনি পড়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেন। বহু পরে উনি টমকে ব্যাপারটা জানান, ডোরিয়ান হারিয়ে যাওয়ার পরে যখন ওরা ইংল্যান্ডে ফিরছিলো তখন।

 আমারই উচিত ছিলো ক্যারোলিনকে বিয়ে করা। কিন্তু যতোই ভাবতে লাগলো, ততোই মনে হলো কাজটা ঠিক হতো না। তাহলে সারাহের সাথে বিয়ে হতো না। আর তাহলে সম্ভবতি কখনোই ডোরিয়ানকে উদ্ধার করতে পারতো না। এখন সারাহের গর্ভে ওর ছেলেটাও হতো না।

 ফ্রান্সিসকে দেখো, নিজেকে বললো টম। ব্ল্যাক বিলির ঔরসে জন্ম, জুয়াড়ি সৎ বাবার কাছে মানুষ হয়েছে, জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত সত্যিকার একজন কোর্টনী-ই হয়েছে, নিজের পরিবারের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। জন্ম পরিচয়েই একজন মানুষ মানুষ হয় না, মানুষ হয় সে নিজেকে যা তৈরি করে তাতে।

“মিস্টার কোর্টনী?”

টম উপরের তলায় পৌঁছে গিয়েছে। পরিচিত কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকালো ও, মেরিডিউ দাঁড়িয়ে আছে দরজা ধরে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তুমি বেঁচে আছো,” টম বললো। “কিন্তু কিভাবে?” .

“মাস্টার ফ্রান্সিস আমদেরকে উপরে ফটক খুলতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি, আপনিই আমাদের হয়ে কাজটা করে দিয়েছেন। আপনাকে খুঁজলাম এতোক্ষণ, না পেয়ে তাই আবার মাস্টার ফ্রান্সিসের কাছে যাচ্ছিলাম।”

“যাও।” মোহিত, সারাহ আর বাকিদের সাথে আছে। কিন্তু আরও কিছু লোক ওদের সুরক্ষায় থাকলে আরো ভালো হয়। তারপরই আর একটা চিন্তা মাথায় এলো। “এদিক দিয়ে সোনার পাত বসানো তরবারি হাতে কাউকে আসতে দেখেছো নাকি?”

মেরিডিউ মাথা নাড়লো। টম দুর্গের উত্তর-পূর্ব মিনারের উঠে যাওয়া আঁকাবাঁকা সিঁড়িটার দিকে তাকালো। “ও নিশ্চয়ই তাহলে উপরে গিয়েছে।”

 সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো টম। খুব প্যাচানো সিঁড়ি। দেয়াল জুড়ে ছোট ছোট জানালা। ওগুলো দিয়ে নিচের চত্বরের দুই এক ঝলক চোখে পড়ছে। সূর্য উঠছে। লড়াই শেষ। শাহুজির লোকেরা ফটক খুলে সব দখলে নিয়ে নিয়েছে। রাজাকে দেখা গেলো বিশাল একটা হাতীর পিঠে চড়ে চিৎকার করে লোকজনকে আদেশ দিচ্ছেন। বন্দীদেরকে জড়ো করা হচ্ছে এক জায়গায়। যুদ্ধের কান ফাটানো তর্জন গর্জনের পর এখন এই সূর্য ওঠার আগ মুহূর্তের নীলচে আলোয় সবকিছু অপার্থিব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে।

সিঁড়ির গায়ের একটা দরজায় পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো টম। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো ভিতরে কেউ আছে কিনা। একজন পুরুষ আর একজন মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেলো অন্য প্রান্তে। খুব তাড়াহুড়া করে দুজনে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে।

টম লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললো। ভিতরে ঢুকতেই একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে উঠে নিজের জামাটা বুকের সাথে চেপে ধরলো। মহিলা নগ্ন, তবে মাত্রই কাপড় পরা শুরু করেছিলো। এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও মহিলাকে চেনা চেনা লাগলো টমের। সামান্য পরেই নামটা মনে পড়লো ওর, লিডিয়া ফয়। তবে মুহূর্তেই ওর অস্তিত্ব মুছে গেলো টমের মাথা থেকে, কারণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কোমরে একটা ভারী বেল্ট বাঁধছে ক্রিস্টোফার।

টম ওর দিকে ধেয়ে গেলো। লিডিয়া চিৎকার দিয়ে উঠলো আবার। কিন্তু কালারিতে নিবিড় পরিচর্যা পাওয়ার কারণে মুহূর্তের ভগ্নাংশের মাঝে ক্রিস্টোফার নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলতে পারে। ও নেপচুন তরবারিটা তুলে নিয়ে একপাশে সরে গেলো। একই সাথে সেটা দিয়ে টমের তরবারিতে এতো জোরে বাড়ি দিলো যে, টমের হাত থেকে তরবারি প্রায় ছুটেই গেলো। টম ঘুরে সোজা হয়ে আবার তরবারি সোজা করে দাঁড়ালো।

ক্রিস্টোফার সামনে বাড়ার ভান করলো, তারপরেই ঘুরে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলো। ওর জন্যে নিচে নামা নিরাপদ না-কারণ টম যদি ওকে ধরে। ফেলে, তাহলে একটা লাথি মেরেই ওকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দিতে পারবে। তাতে ঘাড় ভেঙে মারা যেতে পারে ও। তাই ও উপরে উঠতে লাগলো। একদম সিঁড়ির মাথা পৌঁছে, ওখানকার ছোট দরজাটা কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলে দুর্গের ছাদে উঠে এলো। কিন্তু দরজাটা বন্ধ করার আগেই উঠে এলো টম।

এবার মিনারের ছাদে মুখোমুখি হলো দুজন। ক্রিস্টোফার দাঁতে দাঁত চাপলো। টম সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আর নিচে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই। এসপার নাহয় ওসপার কিছু একটা হবেই এখন।

 “আমাকে যদি মেরেই ফেলবেন, তাহলে আমাকে জন্ম না দেয়াটাই ভালো হতো না,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ক্রিস্টোফার। ভিতরে আক্রোশ দানা বাঁধছে। গাই-এর নিষ্ঠুরতা, ওর মায়ের নীরবতা, যাদেরকে যাদেরকে খুন করেছে-আর সবার আগে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা-সব চিন্তা মাথায় ঘুরছে ওর। বুঝতে পারছে না ওর কি ওনাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরা উচিত হবে, নাকি তরবারিটা বুকে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত হবে।

তৃতীয় নিয়মটা কি? অতীতের একটা কণ্ঠ ওর মাথায় ডেকে গেলো।

আত্ম নিয়ন্ত্রণ।

ক্রিস্টোফার জোর করে আবেগকে সরিয়ে রাখলো। শুধু হাতের তরবারিটা বাদে আর কিছুকেই ও অনুভব করতে চায় না।

“আমি তোমাকে মারতে চাই না,” টম বললো। ও মন থেকেই বলেছে কথাটা। দিগন্তে সূর্য উঠছে, ভোরের ঝিরিঝিরি বাতাস ওর কানে গুনগুন করে উড়ে যাচ্ছে। টম টের পাচ্ছে যে নতুন একটা দিন নতুন আশার বার্তা নিয়ে শুরু হচ্ছে। “তুমি যদি আসলেই আমার ছেলে হও। তাহলে তুমি যা-ই করে থাকো না কেন, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবো।”

‘আমাকে ক্ষমা করে দেবেন?” অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার। “আপনার তো হাঁটু মুড়ে বসে আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এই সব কিছুর জন্যে আপনি দায়ী। আপনি যদি আমার মাকে ছেড়ে না যেতেন…”

আবারও আবেগ ক্রিস্টোফারকে কাবু করে ফেলতে চাইলো। ও সেটাকে সরিয়ে দিলো আবার।

“আমি জানতামই না যে ক্যারোলিনের পেটে বাচ্চা ছিলো,” টম প্রতিবাদ করলো।

 “কারণ আপনি কোনো পরোয়া করতেন না।” বলতে বলতে ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড আক্রোশে তরবারি চালাতে লাগলো। টম সেটা আটকাতে গিয়ে ছাদের কিনারে চলে এলো। “মজা যা করার করে নিয়ে আপনি নিজের রাস্তায় ভেগে গিয়েছিলেন। যেনো সে একটা বন্দরের মাগী। আমার মা!”

“আমার কিছুই করার ছিলো না।” ক্রিস্টোফারের আঘাতগুলো ঠেকাতে ঠেকাতে বললো টম। কিন্তু হাতে এই অনভ্যস্ত অস্ত্রটা থাকায় ঠিকভাবে ঠেকাতে বা আক্রমণ করতে কোনোটাই পারছিলো না। আর এর বিপরীতে নেপচুন তরবারিটা যেনো বাতাসে নেচে বেড়াতে লাগলো।

 “আমি দুঃখিত,” টম বললো। এটাও ও একেবারে হৃদয়ের অকুস্থল থেকে বললো। ওর অবস্থান থেকে তাকালে ও স্পষ্ট দেখতে পায় ওদের জীবনটা কতো ঘটনা-দুর্ঘটনা, সেই সাথে অসংখ্য সুযোগ, সম্ভাবনা, সত্যি-মিথ্যে পেরিয়ে আজ এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। যদি ভাগ্যই ওদেরকে এখানে টেনে এনে থাকে তাহলে নিশ্চিত তা কোনো না কোনো প্রয়োজনেই এনেছে।

“এখানে কেন এসেছেন?” ক্রিস্টোফার জানতে চাইলো। “আমাকে পালাতে দিচ্ছেন না কেনো?”

 “তরবারিটার জন্যে,” সত্যিটাই বললো টম।

ক্রিস্টোফার শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ওটা। চেহারা দেখেই বোঝা গেলো জীবনেও মানবে না ও। “এটা আমার।”

টম ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তরবারিটার সোনালি ফলাটার দিকে তাকালো। ওটার বিশাল নীলাটায় সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। একটা নিখুঁত অস্ত্র। ওর বাবার কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার, কোর্টনী পরিবারের সম্মান।

কিন্তু নিজের ছেলের প্রতি ভালোবাসার কাছে একটা তরবারির আর কি দাম থাকতে পারে?

“রেখে দাও,” টম বললো। “যদি এটা দিয়ে আমরা আবার এক হতে পারি, তাহলে ওটা তোমারই থাক।”

ক্রিস্টোফার হাসলো। টম টের পেলো ওর ভিতর একই সাথে পরম একটা স্বস্তি আর স্নেহের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ক্রিস্টোফার যা-ই করে থাকুক, যে অশুভ কার্যকলাপই ওকে এখানে টেনে আনুক না কেনোটম ওকে ক্ষমা করার একষ্টা রাস্তা বের করেই ফেলবে।

টম দুই হাত সামনে বাড়িয়ে ডাকলো, “বাবা আমার।”

 “বাবা।”

ক্রিস্টোফার টমকে ওর দিকে দুই কদম এগিয়ে আসতে দিলো। তারপর তরবারিটা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবার।

ছাদের একদম কিনারে দাঁড়িয়ে থাকায় টমের পিছিয়ে যাওয়ার উপায় ছিলো না। কিন্তু ও পুরোপুরি অপ্রস্তুত-ও ছিলো না। ক্রিস্টোফারকে ক্ষমা করেছে ঠিক আছে, কিন্তু এখনো ওকে বিশ্বাস করা শুরু করেনি। ক্রিস্টোফারের চোখের হিংস্র দৃষ্টি ওর চোখ এড়ায়নি। ক্রিস্টোফার তরবারি নামিয়ে আনার এক সেকেন্ড আগেই ও খেয়াল করলো ব্যাপারটা। একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়িয়ে নিজের তরবারিটা উপরে তুলে ক্রিস্টোফারের তরবারি ডানপাশে সরিয়ে দিলো। দুটো তরবারি বাড়ি খেয়ে ঝনঝনিয়ে উঠলো। মিনারের উপরে এই নীরব জায়গায় আরো জোরালো শোনালো সেটা। ক্রিস্টোফার তরবারি তুলে আবার আক্রমণ করলো। আবার দুই ফলা একসাথে আটকে থাকলো কিছুক্ষণ। টম আর ক্রিস্টোফার দুজনই দুজনকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। পুরোপুরি শক্তির খেলা চলছে। কেউই তরবারি ছোটাতে সাহস করছে না, কারণ তাতে অন্যজন তরবারি চালানোর সুযোগ পেয়ে যাবে।

আচমকা ক্রিস্টোফার পিছন দিকে লাফিয়ে সরে গেলো, যাতে টম ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। টম সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, নিচে নামার সিঁড়ির মুখের চৌকো দরজাটায় পা প্রায় ঢুকেই গিয়েছিলো। ও পা সরিয়ে নিতে গিয়ে কাত হয়ে গেলো একপাশে। তারপর সেদিক দিয়ে নিচে পড়তে পড়তেও সামলে নিলো আবার। ক্রিস্টোফার লাথি চালালো সেদিকে। কিন্তু টম সাথে সাথে পিছিয়ে যাওয়ায় লাগলো না লাথিটা। টম মাটিতে শুয়ে পড়ে, সাথে সাথে পাশে গড়িয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো-একটুর জন্যে ক্রিস্টোফারের আঘাতটা ঠেকিয়ে দিতে পারলো ও। নিচু করে উরু বরাবর মেরেছিলো কোপটা।

এরপর দুজন দুজনকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো। ক্রিস্টোফার আক্রমণ করলো, টম ঠেকালো, কিন্তু কারো ভঙ্গিতেই কোনো তেজ নেই। মুখে মুখে তর্ক চলতে লাগলো, দুজনেই অপেক্ষা করছে একটা মোক্ষম সুযোগের।

ক্রিস্টোফারের মাথায় অবশ্য অন্য একটা চিন্তা চলছিলো। ওর বয়স মাত্র বিশ, আর সারা রাত কিছুই করেনি বলা চলে; আর টম চল্লিশ ছাড়িয়েছে–বিগত কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করছে ও। যতোই ক্রিস্টোফার ওকে কম আক্রমণ করে বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছে, ততোই ওর ভিতরের যুদ্ধের স্পৃহাটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। টম নিজেও টের পেলো যে ওর মনোবল কমে আসছে।

 ব্যাপারটা আরো ক্ষেপিয়ে দিলো ওকে। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে ও আক্রমণ চালালো, দুই হাতে ধরে আছে তরবারিটা। জোর করে সমস্ত শক্তি দুই হাতে জড় করে সমানে ক্রিস্টোফারের দিকে তরবারি চালাতে লাগলো।

কিন্তু ওর ইচ্ছাশক্তি ব্যাপক হলেও শরীরে কুলালো না। যতো জোরে ও চেষ্টা করলো, ওর হাত ততো ধীরে সাড়া দিতে লাগলো। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ও। ঘন ঘন এলোমেলো শ্বাস নিচ্ছে। ক্রিস্টোফার পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে পিছনে হেলে পড়ে টমের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিলো, ওর মুখে বিজয়ীর হাসি। ধীরে ধীরে টমকে তার শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেলতে দিচ্ছে। সব শেষে একটা কোবরার মতো করে ও আঘাত করবে।

 কিন্তু সময়টা ক্রিস্টোফারের পক্ষে নেই। চৌকো দরজাটা দিয়ে দুর্গের সিঁড়িতে লোকজনের চিৎকার শোনা গেলো। ইংরেজ কণ্ঠ-ফ্রান্সিস বা মেরিডিউ ওকে খুঁজতে আসছে।

“এসব পাগলামি বাদ দাও,” টম বললো। “তুমি জিততে পারবে না।”

 ক্রিস্টোফার ওর দিকে নিখাদ শয়তানের মতো একটা চাহনী দিলো। “হয়তো, কিন্তু আমি নিজের প্রতিশোধ তো নিতে পারবো।”

“তাতে কি লাভ হবে তোমার?”

ক্রিস্টোফার শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। উত্তর জানা নেই ওর। তারপর ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবার। তরবারি সোজা টমের বুক বরাবর ধরে রেখেছে। টম নিজের তরবারি দিয়ে ওটা সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে।

নেপচুন তরবারিটা টমের বাম কাঁধ ভেদ করে চলে গেলো। একই মুহূর্তে, টমের আঘাতটাও লাগলো। তবে সেটা টমের নিশানা মতো ক্রিস্টোফারের তরবারির ফলায় লাগলো না, লাগলো তরবারি ধরা হাতের কবজিতে। তরবারিটা ভারী, তার উপর টম সমস্ত শক্তি দিয়ে চালিয়েছিলো কোপটা। মাংস, পেশিতন্ত্র আর হাড় ভেদ করে ওপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো তরবারিটা।

 ক্রিস্টোফার আর্তনাদ করে উঠলো। নেপচুন তরবারিটা পড়ে গেলো ছাদের মেঝেতে। হাতলে ক্রিস্টোফারের কাটা হাতটা আটকে আছে। ক্রিস্টোফার পিছিয়ে গেলো, কবজি পেটের সাথে চেপে রেখেছে। রক্তপাত বন্ধ করতে চাচ্ছে। কিন্তু তবুও ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে।

টমেরও কাঁধ থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু ওর আঘাতটা মারাত্মক না। ও নেপচুন তরবারিটা পা দিয়ে চেপে ধরলো। কিন্তু তবুও ক্রিস্টোফার ভালো হাতটা দিয়ে ওটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।

“সব শেষ,” টম বললো।

ক্রিস্টোফার ছাদের কিনারে উঠে দাঁড়ালো। নিচে তাকাতেই মাথা ঘুরে উঠলো ওর; রক্তপাতের কারণে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। নিচে সবুজ দরিয়া পাথরের চারপাশ ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ছে।

“বিদায়, বাবা।”

 একদম শেষ মুহূর্তে টম বুঝতে পারলো ক্রিস্টোফার কি করতে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টোফারকে ধরতে গেলো ও, নিজের কি হবে সে খেয়লা ছিলো না। কিন্তু দেরি করে ফেললো। ক্রিস্টোফার বাতাসে ঝাঁপ দিয়ে নিচে পড়ে গেলো। টমের মনে হল যেনো অনন্তকাল ধরে ওকে পড়তেই দেখছে। তারপর একসময় নিচের ফেনিল সাগরে সামান্য আলোড়ন তুলে হারিয়ে গেলো পানির নিচে।

টম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ, ক্রিস্টোফার আবার ভেসে ওঠে কিনা সেটা দেখার আশায়। এতে উপর থেকে পড়ার পরেও কি বেঁচে থাকা সম্ভব? নাকি নিচে পাথরে লেগে ওর শরীরটা কি ভর্তা হয়ে গিয়েছে?

চিন্তাটা মাথায় আসতেই শিউরে উঠলো ও। রক্তে লড়াইয়ের উত্তাপ জমে গেলো মুহূর্তেই। কেনো যেনো বিজয় অনুভব করতে পারছে না ও, এক শোচনীয় পরাজয়ের অনুভূতি সারা দেহ জুড়ে।

আমার ছেলে, ভাবলো ও। আর আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। ঠিক যেভাবে বিলিকেও বাঁচাতে পারিনি।

চোখের কোনা দিয়ে নেপচুন তরবারিটাকে ঝিকিয়ে উঠতে দেখলো টম। হাতলে তখনও ক্রিস্টোফারের কাটা আঙুল মুঠো করে ধরে আছে। টম একটা একটা করে খুলে আনলো সেগুলো। এমনকি মরে গিয়েও ওগুলো তরবারিটা ছাড়তে রাজি না। দগদগে মাংস দেখে বমি পেলো ওর। কি করেছে সেটা দেখে আর সহ্য করতে পারছিলো না। তারপর কি মনে হতে তরবারিটাকে ছদের কিনারের দিকে ছুঁড়ে দিলো।

ও তরবারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সকালের রোদে ঝকমক করছে। একটুর জন্যে ক্রিস্টোফারের মতো ছাদ থেকে সমুদের গিয়ে পড়েনি। নীলাটা মিটিমিট করে জ্বলতে জ্বলতে যেনো ওকে ভেংচি কাটছে। তরবারিটা কি একজন মানুষের জীবনের চাইতেও মূল্যবান? ওর সন্তানের জীবনের চাইতেও?

কিন্তু আজ এক নতুন সূর্য উদিত হয়েছে, নতুন করে জীবনের সূচনা হয়েছে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে টমের সারাহকে বলা কয়েকটা কথা মনে পড়লো। “একজন মানুষের মানুষ হওয়ার পিছনে কি থাকে?” জানতে চেয়েছিলো টম। আর সারাহ জবাব দিয়েছিলো, “মানুষ যে গুণাবলিই পাক বা কারো কাছ থেকে যা কিছুই শিখুক-সে সবার চাইতে আলাদা একটা মানুষ হবে। তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো। সঠিক পথে না হাঁটলে সেটা তোমার দায় না।”

 ক্রিস্টোফার ওর নিজের রাস্তা বেছে নিয়েছিলো, ঠিক যেমন বহু বছর আগে নিয়েছিলো বিলি। একটা পরিবার হচ্ছে একটা জ্যান্ত আর অশান্ত জিনিসের মতো। আর অন্যসব জ্যান্ত জিনিসের মতোই, এটা কখনো নিজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। টম যা করেছে তা শুধু নিজেকে বাঁচাতে।

ও তরবারিটা তুলে নিয়ে নিচে নিজের পরিবারের কাছে ছুটে গেলো।

*

সারাহ আর অ্যাগনেস তখনও কয়েদখানাতেই আছে। এতোদিনের বন্দীদশা ছেড়ে আজ ওরা মুক্ত। কিন্তু আরো বেশি রক্তপাতের ভয়ে সারাহকে এখনই এখান থেকে সরাতে চায়নি অ্যাগনেস। টম ওদেরকে তাজা বাতাস আর পরিষ্কার কামরায় নিয়ে যেত চাচ্ছিলো, কিন্তু অ্যাগনেসের কথাটা যুক্তিযুক্ত হওয়ায় চুপ করে গেলো। আর এখন যেহেতু প্রতিটা দস্যুকেই ধরে আনা হয়েছে, তাই কয়েদখানাও অন্য যে কোনো জায়গার মতো নিরাপদ।

 অ্যানাও চলে এসেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে শাহুজির শিবিরে আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। সাথে করে খাবারও নিয়ে এসেছে। এসে ফ্রান্সিসের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। সারাহকেও কি একটা মলম লাগিয়ে দিয়েছে, জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য। এখন ও আর ফ্রান্সিস দুজন দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে একসাথে বসে আছে, অবাক চোখে বাচ্চাটাকে দেখছে। ওদের চেহারার ভাব দেখে, ওদের আলিঙ্গনের শক্তি দেখে টম বুঝলো যে ওর দাদা হতে খুব বেশি দিন লাগবে না।

আশেপাশের জীবন মৃত্যুর খেলার সবকিছু ভুলে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে, এখনো ওর নাড়ীটা কাটা হয়নি। অ্যাগনেসের পাশে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তপিণ্ডের সাথে তখনও আটকে আছে।

“এটা কেটে দিলে ভালো হতো না?” অনিশ্চিত সুরে জিজ্ঞেস করলো টম।

 “আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম,” অ্যাগনেস বললো।

টম নিজের বেল্টের নেপচুন তরবারিটায় হাত দিলো। কিন্তু এরকম পবিত্র একটা তরবারি বাচ্চা প্রসবের মতো অশুচি কাজে ব্যবহার বা এরকম একটা প্রাণঘাতী অস্ত্র একটা নিষ্পাপ বাচ্চার কাছে আনার কোনোটাতেই টমের ইচ্ছে করছিলো না।

কিন্তু বাচ্চাটা টমের উত্তরাধিকারি। তরবারিটা কোর্টনীদের ঐতিহ্য, আর একদিন এই ছোট্ট বাচ্চাটাই বড় হয়ে তরবারিটা চালাবে। টম প্রথমে ফলাটা মুছে একেবারে চকচকে বানিয়ে ফেললো। অ্যাগনেস দুই হাত দিয়ে চটচটে নাড়ীটা ধরে কোথায় কাটতে হবে দেখিয়ে দিলো। ধারালো প্রান্তটা এক টানে কেটে ফেললো সেটাকে। টম শেষ প্রান্তটা বেধে দিয়ে বাচ্চাটার কপালে চুমু খেলো। ও ভবিষ্যতে কি হবে? কেমন মানুষ হিসেবে বড় হবে ও?

তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো।

“কি নামে ডাকবো ওকে আমরা?” টম জিজ্ঞেস করলো।

সারাহ অ্যাগনেসের দিকে তাকালো। ওর বোন এই ভয়াবহ দীর্ঘ গর্ভধারণের সময়টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওর যত্ন নিয়েছে। নিজেও কতোটা যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গিয়েছে কিন্তু একটা বারের জন্যে অভিযোগ করেনি।

 “ওর নাম হচ্ছে জেমস,” সারাহ বললো। “ক্যাপ্টেন হিকসের নামানুসারে রাখলাম নামটা।”

অ্যাগনেসে চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। সারাহ সামনে ঝুঁকে এলো যাতে অ্যাগনেস নিজেকে সামলে নিতে পারে। ও বাচ্চাটার দিকে তাকালো। ছোট্ট পেটটা থেকে তখনও নাড়ির সামান্য অংশটা বেরিয়ে আছে।

“টম কোর্টনী,” ঢুলুঢুলু কণ্ঠে বললো সারাহ। “তুমি দেখি ছেলের নাড়িতে পাল খাটানোর গিট্টু মেরেছে।”

*

বোম্বের দুর্গটার ফটকের দারোয়ান সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে চিনলো না। টাক মাথা, গাড় বাদামি রঙের চামড়া দেখে মনে হতে পারে যে লোকটা একটা উচ্চ বর্ণের পার্সি। এরা কোম্পানির ব্যবসার উপর খেয়ে পরে বেঁচে থাকে। কিন্তু এর গায়ের পোশাক ইউরোপিয়ান। গায়ে চমৎকার কাপড়ের লাল রঙা কোট, পরনে সাদা ধবধবে পায়জামা। একটা হাত জামার হাতার ভিতরে ঢোকানো, তবে অন্যটা মুঠো পাকিয়ে আছে।

“মহামান্য গভর্নর কারো সাথে দেখা করেন না,” দারোয়ান জানালো।

“আমি গভর্নরের সাথে কথা বলতে আসিনি, আমার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

দারোয়ান হাঁ হয়ে গেলো। মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলো চেহারা। “মাস্টার ক্রিস্টোফার?”

“মিস্টার কোর্টনী।”

দারোয়ান তালা খুলতে হিমশিম খেয়ে গেলো। “অবশ্যই স্যার, আমরা আসলে ভেবেছিলাম…

“ভুল ভেবেছিলেন।”

দুই বছর আগে যে নধর কিশোর দুর্গ ছেড়েছিলো তার সাথে ক্রিস্টোফারকে এখন মেলানো অসম্ভব। এখন তার উপর ওর চেহারা রোদে পুড়ে কয়লা, চেহারা ভেঙে চুরে একাকার, একটা হাত নেই। ভিতরের চত্বরটা পেরিয়ে লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে গভর্নরের অফিসে উঠে এলো ও। এতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে যে দরজার প্রহরী ওকে আটকাতে ভুলে গেলো। দরজা পার হয়ে আসার পরে সম্বিত ফিরলো প্রহরীর। ক্রিস্টোফার প্রহরী বা পিছনে আগুয়ান চিৎকার কোনোটাকেই পাত্তা দিলো না। সোজা উপরের তলায় চলে এলো।

 “ক্রিস্টোফার কোর্টনী,” গাই-এর অফিসের বাইরের প্রহরীটাকে চিৎকার করে জানালো ও। “আমার বাবার সাথে দেখা করবো আমি। আটকালে তোকে আমি চাবুক মারার ব্যবস্থা করবো।”

দরজা খুলে যেতেই ক্রিস্টোফার ঢুকে গেলো বিশাল অফিসটায়। নতুন করে লাগানো জানালা থেকে রঙের গন্ধ আসছে; স্যার হাল কোর্টনীর ছবিটা কিছুটা বাঁকা হয়ে ঝুলছে। দেয়ালের কাঠের গায়ে পাউডারের দাগ দেখা গেলো, ওটার খুব কাছ থেকে পিস্তল ছুঁড়েছিলো কেউ।

করিডোরে হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে গাই নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিলো। ওই অবস্থাতেই ক্রিস্টোফারের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। ওর কলমের মাথা চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় কালি জমতে লাগলো নিচের খাতার উপর।

“তুমি কি…?” নিজে নিজে বিড়বিড় করলো গাই।

তারপরই সামলে নিলো নিজেকে। চোয়াল বন্ধ হয়ে চেহারা আবার শক্ত হয়ে গেলো। শীতল একটা হাসি হাসলো ও।

“উড়নচণ্ডী ছেলেটা বাড়ি ফিরেছে দেখি। হাহ! তোমার মা অন্তত এখন খুশি হবে।”

ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালো।

“তো?” ধমকের সুরে বললো গাই। “কি মনে করে এসেছো আবার? এখন কি তোমার নামে মেজবান দেবো নাকি?”

“ওসব লাগবে না। আমার নিজেরই অনেক টাকা আছে।”

ক্রিস্টোফার নিজের মুঠি খুলে একগাদা উজ্জ্বল ঝকমকে হীরে দেখালো। গাই ওটার দিকে এক নজর দেখে নাক সিটকালো।

“এসব পাথরের টুকরো দেখেই পটে যাবো ভেবেছো? তুমি হয়েছে। বড়লোক? ধন সম্পদ কি সেটাই তো বোঝো না।”

“রুথকে বিয়ে করার মতো টাকা পয়সা হয়েছে আমার।”

 “কে?”

“রুথ। কর্পোরাল রেড্ডির মেয়ে।”

এরপরেও গাই-এর এক মুহূর্ত লাগলো বুঝতে। তারপর মাথাটা পিছনে হেলিয়ে এতো জোরে হো হো করে হেসে উঠলো যে জানালার পর্দাগুলো পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। “রুথ রেডিড? এতোদিন পরেও তুমি ঐ মাগীটাকে মনে রেখেছো?”

“আমি ওকে বিয়ে করবো।”

 “আমার তা মনে হয় না।”

ক্রিস্টোফার হাতের ভিতর লুডুর ঘুটির মতো করে হীরাগুলো নাড়তে লাগলো। আমি এখন একজন ধনী লোক। আমাকে তুমি আটকাতে পারবে না।”

“আমি তোমাকে আটকাতেও চাই না,” খুশি উপচে পড়ছে গাই-এর চেহারায়। “তোমার বিয়েতে আমার দোয়া রইলো। কিন্তু সমস্যা একটাই-” বলতে বলতে আবার হাসিতে ভেঙে পড়লো ও। “তোমার পেয়ারি বিয়ে করে ফেলেছে।”

ক্রিস্টোফারের মনে হলো ওর পায়ের নিচে যেনো মাটি নেই। “কি?”

“তুমি যাওয়ার পরপরই ও বিয়ে করে ফেলে। জাহাজঘাটের এক কুলিকে। একটা বাচ্চাও আছে এখন। আমার বিশ্বাস সুখে শান্তিতেই আছে ওরা। যদিও…” বলে ও ক্রিস্টোফারের হাতের হীরা গুলির দিকে ইংগিত করলো। “এখন যদি এগুলো দেখে তাহলে এতো তাড়াহুড়ার জন্যে আফসোস করবে নিশ্চিত।”

ক্রিস্টোফার অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা মিথ্যা নিশ্চিত। গাই নিশ্চয়ই ওকে কষ্ট দিতে বানিয়ে বানিয়ে মজা করছে। রুথ কখনোই ওর সাথে ধোকাবাজি করবে না।

কিন্তু গাই-এর আনন্দ একদম খাঁটি। ক্রিস্টোফার ওর বাবার চোখের দিকে তাকালো। তাকিয়েই বুঝলো সে সত্যিটাই বলছে। আবারও জিতে গেলো গাই।

রাগে চোটে ও হীরাগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। মেঝেতে লাফিয়ে ঘরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো ওগুলো। লাফানো থামার আগেই ক্রিস্টোফার দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু ভাবতে পারছে না আর। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন, ও গাইকে এক হাত নেবে, কিন্তু আবারও নিজের বাবার কাছে পরাজিত হলো।

“দাঁড়াও।”

ক্রিস্টোফার যতো বড়ই হোক, ঠিক সেই ছোট বেলার মতো করেই গাই এর আদেশ ওর মগজের অভ্যন্তরে ভীতির সৃষ্টি করলো। দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথেই। ক্রিস্টোফার ঘুরলো। গাই ওর চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলো ওর দিকে। এক হাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দুজন এখন। দুজনেরই নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। যেনো মুখোমুখি দুই মুষ্টিযোদ্ধা।

“আমি জানি মেয়েটাকে খুব পছন্দ করতে তুমি,” গাই বললো। এক মুহূর্তের জন্যে গাইকে খুব অমায়িক একজন লোক মনে হলো। “কিন্তু ওকে আর আমাদের মাঝে আসতে দিও না। তুমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিজে বুনো ওল লাগিয়ে খেতে চেয়েছ, তা করতে গিয়ে আঘাত প্রত্যাঘাতও পেয়েছে ভালোই। এখন নিজের পরিবারের, নিজের জায়গায় ফিরে এসো।”

“আমি এখানে তোমার নীল কোট পরা চাকর হতে ফিরে আসিনি। আমি ওর চেয়ে অনেক ভালো কিছু পারি।”

গাই ওর আপাদমস্তক দেখল একবার। ওর ভিতর নতুন কিছু একটা আছে, যা আগে ছিলো না। কঠোর আর ভয়ঙ্করে মেশানো জিনিসটা।

“সেটাই মনে হচ্ছে,” ধূর্ত কণ্ঠে বললো গাই। “আমি তোমাকে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ দেবো। খবর পেয়েছি যে মাদ্রাজের গভর্নর নাকি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য না-সে নাকি আমাদের চিরশত্রু একজনকে সাহায্য করেছে। তুমিই ওর জায়গা নিতে পারো।”

ক্রিস্টোফার ঢোক গিললো। কোম্পানির তিনটা বিশাল প্রদেশের একটার গভর্নর হওয়াটা ওর বয়সী একজনের জন্যে অভূতপূর্ব এক সম্মানের বিষয়। আর গাই-এর দিক থেকে ওর উপর ভরসা করার পক্ষে বিশাল একটা প্রমাণ। যদিও জানে যে এর ফলে ও সারা জীবনের জন্যে গাই-এর কাছে বাধা থাকবে। আর সারাজীবন ও এটাই এড়াতে চেয়েছে।

“তোমার উপর কি আমি ভরসা করতে পারি?” গাই জানতে চাইলো।

প্রশ্নটা ঝুলে রইলো ওদের মাঝে। ক্রিস্টোফার গাই-এর চোখের দিকে তাকালো। কি বলা যায় ভাবছে : আমি জানি কেনো তুমি আমার সাথে এমন করতে। আমি জানি কেনো তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারোনি। তোমার ভাই তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছে সেটার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই, ওর জামার ডান হাতার নিচে ওর কাটা হাতটা কেঁপে উঠলো।

গাই তখনও উত্তরের অপেক্ষায় আছে। ওর আঙুলগুলো কোটের বোতামে খেলে বেড়াচ্ছে; গাই গাল ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে বাতাস বের করে দিলো। ক্রিস্টোফার বুঝলো গাই দুশ্চিন্তার মাঝে আছে। ক্রিস্টোফার কি করে না করে তা নিয়ে আসলেই সে দুশ্চিন্তা করে।

 ক্রিস্টোফারের চোখে পানি চলে এলো। ও মুখ ঘুরিয়ে নিলো যাতে গাই দেখতে না পায়। গাই ভাবলো ও বুঝি চলে যেতে চাচ্ছে। ও হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টোফারের জামার হাতা টেনে ধরলো। আচমকা টানে ক্রিস্টোফার থমকে দাঁড়ালো। আর গাই এসে পড়লো ওর উপরে।

ক্রিস্টোফার সোজা হয়ে দাঁড়ালো আবার। বাবা আর ছেলে মুখোমুখি দাঁড়ানো। নীল আর বাদামি চোখ জোড়ার মাঝে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব।

“তোমার উপর ভরসা করতে পারি তো?” গাই আবার বললো।

ক্রিস্টোফার অনেক কিছু বলতে পারতো, অনেকগুলো জবাব ওর জানা ছিলো, কিন্তু সেগুলোর কি আসলে কোনো দাম আছে?

“জ্বী, বাবা,” বললো ও।

*

ক্রিস্টোফার গাই-এর অফিস থেকে এমন হতবুদ্ধি অবস্থায় বেরিয়ে এলো যে বসার ঘরে বসে থাকা মেয়েটাকে-বা মেয়েটা ওর দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কোনোটাই খেয়াল হলো না। মেয়েটা নিজের পোশাকের বুকের দিকটা একটু নামিয়ে নিয়ে, গদি আটা চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর দিকে এগিয়ে এলো।

 “মিস্টার কোর্টনী?” ডাক দিলো মেয়েটা।

 ক্রিস্টোফার অবাক হয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। একটা যুবতী মেয়ে। ধারালো চেহারা, পূর্ণ স্তন ওর জামা ফুড়ে যেনো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। প্রথমে ওর চেহারার দিকে ঠিকমতো নজর যায়নি ক্রিস্টোফারের। মাথার টুপির নিচে পরিপাটি করে চুলগুলো আচড়ানো তার, লম্বা হাতার জামা পরার কারণে শেকলের দাগ-ও আর দেখা যাচ্ছে না। টিরাকোলার সেই বেহায়া প্রেমিকার সাথে এখন ওকে মেলানো প্রায় অসম্ভব।

তারপরেই প্রবল আতংকে ক্রিস্টোফার মেয়েটাকে চিনতে পারলো। আজ বিকেলেই দ্বিতীয়বারের মতো ওরা পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। মেয়েটা ওর সব গোপন খবর জানে। ও যদি ওর বাবাকে বলে দেয়, তাহলে গাই-এর অফিসে এতোক্ষণ যতো অগ্রগতি হয়েছে সবগুলো দরজা আবার বন্ধ হয়ে যাবে। আর সবচে বড় কথা আংরিয়াকে সহায়তার দায়ে কোম্পানি ওকে ফাঁসিতেও ঝুলাতে পারে।

“আমরা কি পরিচিত?” নরম সুরে বললো ও।

মেয়েটা ওর কাছে ঘেষে এলো। “আমার মনে হয় না আমাদের দেখা হয়েছে, বা হলেও এতে আগে যা আপনার মনে থাকার কথা না। আমার নাম লিডিয়া ফয়।”

ক্রিস্টোফার কিছু বললো না সাথে সাথে! সম্ভবত মেয়েটা ওর নীরবতা বিক্রি করতে ইচ্ছুক।

 “খবর পেলাম আপনি নাকি আপনার বাবার কাছে ফিরে এসেছেন,” বললো লিডিয়া। “আমি জানি আপনাদের পুনর্মিলনে এখানকার সবাই খুব খুশি হবে।”

ক্রিস্টোফার সতর্ক চোখে ওকে দেখতে লাগলো। চায় কি মেয়েটা? ও নিজের কোট এ হাত দিলো, ভিতরের ছুরিটার স্পর্শ পেলো হাতে।

“আমার মনে হয়, আর একটু নিরিবিলি কোথাও আলাপ করলে ভালো হবে,” ক্রিস্টোফার বললো।

“না না, তার দরকার হবে না,” লিডিয়া বললো। “আমাদের গোপন কিছুই বলার নেই। আমরা হচ্ছি দায়িত্ববান দুজন ইংরেজ, তাই না?”

 এতো নিষ্পাপ ভঙ্গিতে কথা বলছে লিডিয়া যে ক্রিস্টোফার মুগ্ধ হয়ে . গেলো। যেনো ওরা আসলেই কেউ কাউকে চেনে না, দেখেও নি আগে। কি খেলা খেলছে এ?

 “শুনেছিলাম আপনাকে নাকি দস্যুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো?” সাবধানে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

“এখন মুক্ত আমি।”

“নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে!”

লিডিয়ার চেহারা কালো হয়ে গেলো। “ভয়ংকর। যদিও…” বলে ও ইঙ্গিতময় একটা হাসি হাসলো। “একদম যে একঘেয়ে ছিলো তা বলবো না। তবে আমি নিশ্চিত যে আপনিও স্বীকার করবেন যে আমাদের আসলে অতীত আঁকড়ে ধরে থাকা উচিত না। বিশেষ করে ভবিষ্যতে যখন অপার সম্ভাবনার দুয়ার খোলা আছে।”

ওদের চোখাচোখি হলো-আর চোখে চোখেই বোঝাঁপড়াটা হয়ে গেলো দুজনের। লিডিয়া সামনে এগিয়ে ক্রিস্টোফারের গাল স্পর্শ করলো।

“আশা করি শিগগিরিই আমরা আরো বেশি পরিচিত হতে পারবো।”

*

ওখান থেকে প্রায় একশো মাইল দক্ষিণে টম ওর নতুন জাহজের সামনের ডেক-এ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে জাহাজের দড়াদড়ি। জাহাজটা আংরিয়ার বহরে ছিলো। ফ্রান্সিসের হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছে সে রাতে। শাহুজি ওটা টমকে দিয়ে দিয়েছেন, সাথে কয়েকজন জেলে আর মারাঠা স্বেচ্ছাসেবীও দিয়েছেন। আর কেস্ট্রেল-এর সর্বশেষ বেঁচে থাকা কু-রা তো আছেই। মেরিডিউকে পাল এর মাস্টার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদটা পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট ও।

“ওগুলো আমাদেরকে একটানে কেপ টাউনে নিয়ে যাবে,” মেরিডিউ বললো। “বা এরপরে যেখানেই যেতে চান, সেখানেই।”

উপসাগরের উপরে দুর্গে এখন শাহুজির পতাকা উড়ছে। পাশ দিয়ে যেসব জাহাজ যাচ্ছে তারা সবাই তার বিজয়ের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে। দুর্গে লুকানো সমস্ত গুপ্তধন খুঁজে বের করতে শাহুজির লোকদের প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে গেলো। এখনো ওগুলোর অনেকগুলো সাতারার মহলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বক্সে ভরা হচ্ছে। টমের জাহাজের খোলের ভিতরেও বেশ ভালো একটা পরিমাণ আছে। শাহুজি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দিয়েছেন সেসব।

 “শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এবারের অভিযানে লাভ-ই হলো, চাচা,” ফ্রান্সিস বললো। অ্যানার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও।

 “লাভের চাইতেও বেশি,” টম জবাব দিলো। সারাহের কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললো ও। জীবনে এর আগে এতোটা গর্ব আর ভালোবাসা অনুভব করেনি টম। “আমরা যা পেয়েছি, তা… অমূল্য।”

“আপনি কি থাকবেন-ই না?” ফ্রান্সিস বললো।

অ্যানা আর ফ্রান্সিস ভারতে থেকে যাবে ঠিক করেছে। অ্যানার বাবার ব্যবসা আর কুঠিগুলো আবার নতুন করে শুরু করবে। ঠিক করেছে কোচিনে বাড়ি বানাবে ওরা, ওটা হচ্ছে ওলন্দাজ উপনিবেশ। ওখানে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নাক গলাতে পারবে না। মোহিত যাবে ওদের সাথে।

“আমাদের জন্যে ভালো ভালো মাল জোগাড় করে রেখো,” টম বললো। “ধাগামী বর্ষার পরেই আসবো আমরা।”

“দস্যুদের কাছ থেকে বেঁচে বর্তে থাকতে পারলে হয়।”

ওটা আসলেই মারাত্মক ঝুঁকির। কিভাবে যেনো আংরিয়া টিরাকোলা থেকে পালিয়ে গিয়েছে। ওর আরো কয়েকটা দুর্গ আর আরো অনেকগুলো জাহাজ আছে; কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থেকে ও যে আবার মালাবার উপকূলে দস্যুগিরি করতে নামবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে আপাতত টম আশা করলো ও ডাঙাতেই লুকিয়ে থাকবে।

“লাকুইডিভা দ্বীপে যাবেন নাকি?” অ্যানা জিজ্ঞেস করলো। নাদুস নুদুস গাল আর উজ্জ্বল চোখে ওকে দেখতে বেশ লাগছে। “ও ওর জামার কোমর বড় করছে,” দুই রাত আগে সারাহ টমকে চুপিচুপি বলেছে। “আমার মনে হয় আমরা যখন ফিরে আসবো তখন জেমস একজন খেলার সাথী পেয়ে যাবে।” টমের মনে হলো ও এখনি অ্যানার পেটের ফোলা অবস্থাটা টের পাচ্ছে।

 “দেরি হয়ে যাবে,” টম বললো। “আমাদের আরো প্রায় এক বছর আগে ফেরার কথা ছিলো। ডোরিয়ান আমাদের জন্যে অপেক্ষা করেনি নিশ্চিত। কেপ টাউনে গিয়েই ওকে খুঁজে পাবো আশা করি।”

“ঈশ্বর সহায় হোক চাচা,” ফ্রান্সিস বললো। “আর আমার জন্যে যা যা করেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।”

টম ওর চুল এলোমেলো করে দিলো। “একজন কোর্টনী নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে নেয়।”

ওরা সবাই কোলাকুলি করে বিদায় নিলো। তারপর আবার কোলাকুলি করলো। একটা নৌকায় করে ডাঙ্গায় ফিরে গেলো ফ্রান্সিস আর অ্যানা। আর গ্রাবটা নোঙর তুলে সাগরের দিকে আগাতে লাগলো। টম সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই নতুন আসা লোকগুলো পাল তুলতে দৌড়ে গেলো। কয়েকদিনের মাঝেই ওরা দক্ষ নাবিকে পরিণত হবে।

সারাহ ওরা পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাতের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিলো।

 “আমি জানি তুমি কি ভাবছো, টম কোর্টিনী।”

 “কি?”

“ভাবছো এই জাহাজ আর এদের লোকজনকে কোথায় নিয়ে যাবে, আর একবার বাড়ি ফেরার পর কি কি মুনাফা-ই বা তুমি করতে পারবে।”

 টম মাথা নাড়লো। “মালপত্র সব বিক্রি করে-সব দেনা শোধ করার পরেও হাতে ভালোই টাকা পয়সা থেকে যাবে। আমি ভাবছি কেপ টাউনে একটা জায়গা কিনে সেখানে আমাদের জন্যে একটা বাড়ি বানাবো।”

 “ডাঙায় থাকা তোমার কাজ না,” সারাহ বললো। “কয়েক মাস পরেই আবার সাগরের ডাক শুনতে পাবে।”

টব বাচ্চাটার কথা ভাবলো, এখন ওদের কেবিনে একটা খাটে ঘুমিয়ে আছে, তার পাশেই নেপচুন তরবারিটা ঝোলানো। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এবার ব্যাপার স্যাপার একটু অন্যরকম হবে।”

সারাহ হেসে টমের বুকে মাথা ঠেকালো। হাতে হাত রেখে রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। পরিপূর্ণ তৃপ্ত দুজনেই। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়লো। জাহাজ সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, আর ওদের পিছনে মালাবার উপকূল আর ভারত উপমহাদেশ ধীরে ধীরে অন্ধকারের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস আগে জাহাজডুবি হয়ে ডাঙায় ওঠার পর থেকে ওদের জীবনে কি কি হয়েছে সেসব ভাবতে লাগলো টম।

“ভাবছি আমাদের মতো ডোরিয়ানের অভিযানও কি এতো রোমাঞ্চকর হয়েছে কিনা,” টমের কণ্ঠে মজাং।

সারাহ ওর গালে চুমু খেলো। “ওদেরটাও কম মজার হয়নি, দেখো।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *