3 of 3

৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১

৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১

প্রতি বৃহস্পতিবারে পাগলা বাবার আস্তানায় মিলাদ-মাহফিল হয়। এখানে আজ সকাল থেকে পাগলা বাবা রুমী, আলতাফ মাহমুদ, মামুন মাহমুদ, আবদুল মজিদ, শামসুল হক, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর–সকলের জন্য কোরান খতম শুরু করিয়েছেন। মিলাদের জন্য দশ সের অমূতি এনেছি। অন্যরাও ওই রকম পরিমাণ মিষ্টান্ন এনেছে। বাদ আছর মিলাদের সময় প্রচুর লোক হয়। পেছনদিকে বিরাট একটা বেড়ার ঘর আছে–নামাজের জন্য জামাতঘর, সেইখানে পাগলা বাবা নিজে মিলাদ পড়ান। মেয়েরা এদিককার পাকা ঘরে বারান্দায় বসে। বাবা আমাদের সবাইকে বলেছেন তিনি। জায়নামাজে বসে খাস দেলে ধ্যান করে জেনেছেন রুমী, আলতাফ, মামুন–ওরা সবাই বেঁচে আছে। তিনি শিগগিরই ওদের সবাইকে বের করে আনবেন। আমাদের শুধু একটুখানি ধৈর্য ধরতে হবে, আল্লার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, পাগলা বাবার ওপর ভরসা রাখতে হবে।

পাগলাপীরের কথামতই চলছি। সেই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন যে যা বলছে তাই করে চলেছি। একজন বললেন, রুমীর নামে একটা খাসি কোরবানি দাও–জানের সদকা। তাই দিলাম। পরশুদিন একটা খাসি কিনে এনে বাড়িতে কোরবানি দেওয়া হল। আকবরের বাবা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে খাসিটা নিজের হাতে জবাই করলেন। কিছু গোশত ফকিরদের বিলানো হল, বাকিটা এতিমখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। ঐদিন দুপুরের পর পাগলা বাবার আস্তানায় খতমের দোয়া ও মোনাজাত করা হল রুমীর জন্য। বাবার নির্দেশে সাত সের অমৃতি নিয়ে গিয়েছিলাম। দুসের আলাদা করে বাবা দোয়া পড়ে দম করে দিয়েছিলেন পাড়ায় বিলোবার জন্য।

ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং করপোরেশনের জি. এম. আমিনুর রহমান সাহেব নিয়মিত পাগলাপীরের কাছে যান। তিনি শরীফ, ফকির এবং মিনিভাইয়ের বন্ধু। ওঁকে ধরে গতকাল পাগলা বাবাকে বাসায় আনিয়েছিলাম। বাবা বাড়িতে এসে দোতলায় রুমীর ঘরে গিয়ে দুরাকাত নামাজ পড়লেন, সালাম ফিরিয়ে খানিকক্ষণ চোখ বুজে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন রইলেন। তারপর বললেন, একটুও ঘাবড়াসনে। সে ভালো আছে। শিগগিরই তাকে বের করে আনব।

মিলাদের পর বেশির ভাগ লোক চলে গেছেন। আমরাও যাবার উদ্যোগ করতে পাগলা বাবা বসতে বললেন। অনেকক্ষণ বসে রইলাম। আরো লোকজন চলে গেলে বাবা আমাকে আর শরীফকে ডাকলেন, বললেন, রুমীকে বের করে আনার একটা ব্যবস্থা তিনি করেছেন। জামাতঘরে একজন পাঞ্জাবি সার্জেন্টকে বসিয়ে রেখেছেন। এর সঙ্গে তিনি আগেই কথাবার্তা বলে নিয়েছেন। সার্জেন্টটি খবর বের করেছে রুমীকে কোথায় রাখা হয়েছে। আমরা দুজন যদি তাকে গাড়িতে উঠিয়ে এখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যাই, তাহলে সে রুমীকে বের করে আমাদের গাড়িতে তুলে দেবে। কথাটা অন্য কাউকে যেন না বলি। কারণ সকলের জন্য এরকম বিশেষ ব্যবস্থা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। রুমীর জন্যই তিনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই গোপন ব্যবস্থাটা করেছেন।

ব্যাপারটা এতই অপ্রত্যাশিত এবং অবিশ্বাস্য যে শোনামাত্র আমাদের তাক লেগে গেল। সম্বিত ফিরে পেয়ে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হল–আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলাম, যাবো, এক্ষুণি যাবো। শরীফের প্রতিক্রিয়া হল সম্পূর্ণ উল্টো। সে বলল, এক্ষুণি যাওয়া সম্ভব নয়। একটু অসুবিধে আছে। কাল আপনাকে জানাব। শরীফের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, যাতে আমি আর কোন কথা না বলে চুপ করে গেলাম।

বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতেই শরীফ আমাকে বোেঝাল–এভাবে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া খুব বিপজ্জনক। ওখানে ঢোকার পর খানসেনারা আমাদের দুজনকে মেরে গাড়িটা গুম করে দিলে আমাদের আত্মীয়বন্ধুরা কোনকালেও খুঁজে বের করতে পারবে নাআমাদের কি হল।