৯. সুজিত একলা ঘরে

সুজিত একলা ঘরে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তখনও রঞ্জনের কথাগুলিই তার মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছিল। এক সময়ে তার খেয়াল হল, সকাল থেকে এক বারও সুনয়নীকে দেখা হয়নি। সে বাড়ির ভিতরে গেল, আস্তে আস্তে সুনয়নীর ঘরের দরজায় গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, ভুজঙ্গভূষণ সুনয়নীর দুটি অসাড় হাত নিজের বুকের উপর তুলে নিয়ে, সুনয়নীর মুখের সামনে ঝুঁকে আছেন। বলছেন,নয়ন, আমার গল্পগুলো তা হলে তুমিই শুনো, কেমন? তুমি তো আমাকে বিশ্বাস কর, অ্যাঁ? চিরকালই করে এসেছ। ওরা বড় সত্যি-মিথ্যের যাচাই করে, কিন্তু আমরা তা করব না। আমরা ইচ্ছে করলে কোনও সময় রাজা-রানি হব, কোনও সময় খুঁটেকুড়ানির মেয়ে-জামাই হব, কী বলো?…বাঃ, লক্ষ্মী সোনা আমার!…ওকী ওকী, আবার রাগ কেন নয়ন? মদ খেতে যাব না? আচ্ছা যাব না। ঘরে নিয়ে এসে তোমার সামনে বসে খাব, কেমন? লক্ষ্মী-লক্ষী আমার! আবার চোখে জল কেন? আঃ, ছি নয়ন, অমন করে কাঁদিস না, দেখিস একদিন সব দুর্ভাগ্য কেটে যাবে।

সুজিত চুম্বনের শব্দ পেল। দরজার পাশ থেকে সে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে সরে এল। মুখে তার হাসি, কিন্তু চোখ দুটি কখন ভিজে উঠেছে, টের পায়নি। সে শুধু উচ্চারণ করল, ভালবাসা, ভালবাসা।…

সুজিত আবার বাইরের ঘরে এল, এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে বারান্দা দিয়ে ঘুরে নিজের ঘরে গিয়ে, বিছানায় এলিয়ে পড়ল। তার ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।

একটু বোধ হয় তন্দ্রা মতোই এসে পড়েছিল। কলিং বেল বেজে ওঠার শব্দ সে পেয়েছিল। মনে মনে ভেবেছে, এর মধ্যেই আবার শিবেন বোধ হয় ফিরে এল। কিন্তু সে মুখ তোলেনি, চোখ খোলেনি, একভাবেই পড়েছিল। একটু পরেই তার ঘরের দরজার সামনে পায়ের শব্দ পেয়ে, মুখ ফিরিয়ে তাকাল, এবং তাকিয়েই তার হৃদস্পন্দন যেন সহসা স্তব্ধ হয়ে গেল। শরীর নিশ্চল মৃতবৎ মনে হল। প্রথমে মনে হল, সে স্বপ্ন দেখছে, এখনও সে নিদ্রিত। নইলে, তার সামনেই সুনীতাকে সে দেখছে কেমন করে? সুনীতার চোখের সঙ্গে তার চোখের দৃষ্টি এমন স্থির অপলক ভাবে মিলছে কেমন করে? দরজার সামনে যেন এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নেরই দ্যুতি, যৌবনের এক দুঃসহ বিজলি ঝলক স্থির নিশ্চল। রক্তাম্বরী, বিম্বেষ্ঠা, বক্ষে ও সর্বাঙ্গে নিটুট স্বাস্থ্য এক নিপুণ শিল্প হয়ে উঠেছে। যে শিল্পের মধ্যে একটা ঔদ্ধত্য, বক্ষের জীবনকলি দিয়ে বিশ্বসংসারকে বিদ্ধ যাতনায় চকিত করছে। কিন্তু চোখ, সেই চোখ, যার মধ্যে অসহায় বিভ্রান্তি মাথা কুটছে।

সুজিত আস্তে আস্তে উঠে বসল। বসতেই, বারান্দার জানালা দিয়ে তার লক্ষ পড়ল, দীপু দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার সে সুনীতার দিকে ফিরে তাকাল। এবার চোখে পড়ল সুনীতার হাতে সুনীতারই মুখের সেই স্কেচ। সুনীতাও এক বার স্কেচটা দেখল, আবার চোখ তুলে তাকাল এবং সহসা তার দুই চোখ ঈষৎ ছোট হয়ে এল, নাসারন্ধ্র কিঞ্চিৎ স্ফীত হল, এবং একটি বিচিত্র আলো যেন বিচ্ছুরিত হল চোখ থেকে। সুজিত উঠে দাঁড়াল। সুনীতা ঘরের মধ্যে দু পা এগিয়ে এল। বলল, চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?

সুজিত প্রায় অস্ফুটে উচ্চারণ করল, সুনীতা!

সুনীতা ঈষৎ ঘাড় বাঁকাল। বলল, মনে আছে দেখছি।

 সুজিত সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ভুলে যাব মনে করেছিলেন?

সুনীতা বলল, অসম্ভব কী! আমিই বরং আপনাকে একেবারে ভুলতে পারছিলাম না। আমি তারই জবাব নিতে এসেছি আজ।

সুজিত বলল, কীসের জবাব?

–সে দিন যা বলেছিলেন, যে কথা আমাকে আর কেউ কখনও বলেনি।

সুজিত যেন হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেল। বলল, বসুন আপনি। মানে… কোথায় যে বসতে দিই, এ ঘরে আবার চেয়ার-টেয়ার সে রকম কিছু

সুনীতা খাটের ওপর বসে পড়ল। বলল, দেখলেন, কোথায় বসা যায়।

সুজিত হাসল। বলল, ওতে বসতে আপনার অসুবিধে হবে না?

সুনীতা খাটের ধারে রেলিং-এ হেলান দিয়ে ভাল করে বসে বলল, তবে সুবিধে করেই বসলাম। বলে হেসে উঠল। আবার বলল, কিন্তু অমন করে অত কী দেখছেন বলুন তো?

সুজিত বলল, দেখছি, মনে হচ্ছে, যেন আপনাকে অনেক দিন থেকে চিনি।

সুনীতা কয়েক মুহূর্ত সুজিতের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। চোখের পাতা নামাল, বলল, সত্যি?

সুজিত বলল, সত্যি। কিন্তু আপনি যেন তাতে কিছু মনে করবেন না। আমার এরকম হঠাৎ হঠাৎ এক-এক জনকে দেখলে মনে হয়।

সুনীতা জিজ্ঞেস করল, কেন মনে হয়?

 –আমি তা বুঝতে পারি না।

দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল ওরা। এবং সহসা যেন কেউ-ই কারুর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারল না। সুনীতা সহসা যেন একটু আরক্ত হল। ওর চোখের পাতা নত হল। বলল, আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছিলাম সেদিন।

–শুনেছি।

 সুনীতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কার কাছে?

–প্রিয়নাথ দাশ আর

প্রিয়নাথ দাশ? ও আজ সকালে যখন এসেছিল?

–হ্যাঁ। কার কাছে শুনলেন?

 –কেন, দীপুর মুখে। দীপু যে আজ সকালেই আমার কাছে ছুটে গেল এই পোর্ট্রেট নিয়ে।

সুনীতা হাতে তুলে স্কেচটা দেখাল। আবার ওরা কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। সুনীতার চোখে যেন চকিত আলোর বহু বিচিত্রের লীলা চলেছে, অথচ স্থির। সুজিতের চোখ স্নিগ্ধ উজ্জ্বল, যেন এক গভীর বিস্ময়ে, সুদুরে নিবদ্ধ এবং প্রশান্ত। সুজিত বলল, দীপু আজ সকালে ওটা আপনার কাছে নিয়ে গেছল?

জবাব এল দরজার বাইরে থেকে, হ্যাঁ।

সুজিত ফিরে তাকিয়ে দেখল, দীপু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, চৌকাঠ খুঁটছে। বলল, আপনি তো আবার মিছে কথা বলতে পারেন না, ভাবছেন দীপুটা মিথ্যেবাদী। কিন্তু আমি যদি তখন বলতাম, ওটা আমার কাছে রয়েছে, তা হলে ওরা ঠিক নিয়ে নিত।

 সুনীতা বলে উঠল, তুই ঠিক করেছিস দীপু।

সুজিত দীপুর দিক থেকে সুনীতার প্রতি ফিরল। দীপু বলল, আপনারা কথা বলুন সুনীতাদি, আমি একবার মাকে দেখে আসছি।

দীপু চলে গেল। সুনীতা জিজ্ঞেস করল, আপনি বুঝি মিথ্যে কথা বলতে পারেন না?

সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, না, আমার বুক ধড়ফড় করে।

 সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপরে হঠাৎ থেমে বলল, সত্যি?

 সুজিত বলল, সত্যি না বললে যে আবার সেই মিথ্যেই বলা হবে।

সুনীতা আবার হেসে উঠল। হাসি থামলে সুজিতের দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ, তখন প্রিয়নাথ দাশ আর কার কথা যেন বলতে যাচ্ছিলেন?

রঞ্জন।

রঞ্জন? রঞ্জনও এসেছিল আজ?

 সুনীতার চোখে-মুখে উত্তেজনার রক্তাভা লাগল। সুজিত বলল, হ্যাঁ, রঞ্জন এসেছিল।

-কী বলল?

–শিবেনকে বলতে এসেছিল, সে যেন আপনাকে বিয়ে করার চেষ্টা না করে। মুহূর্তেই সুনীতার চেহারা যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। ট্রেনে দেখা সেই তীব্র উত্তেজনা, তীক্ষ্ণ বিদ্রুপে, দুঃসহ ঘৃণায় যেন দপদপিয়ে উঠল। এবং পরমুহূর্তেই হাসিতে ফেটে পড়ল। সে হাসি অনেকক্ষণ ধরে বাজতে লাগল। সুজিতের মনে হল, এ হাসি স্বাভাবিক নয়, যেন হিস্টিরিয়ার অভিব্যক্তি। তার ইচ্ছা হল সুনীতাকে জোর করে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে থামিয়ে দেয়। শান্ত হতে বলে। সে যেন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে, এ হাসির মধ্যে কোথাও এক বিন্দু সুখ নেই, আনন্দ নেই, একটা দুঃসহ ঘৃণা ও ব্যথা ঝরে পড়ছে। এ হাসি হাসতে সুনীতার কষ্ট হচ্ছে, অথচ এ হাসি আপনা থেকেই ওর ভিতর থেকে বিষের মতো উপচে পড়ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না সুজিত। একটি মেয়ের প্রাণান্তকর কষ্ট যেন তাকে অসহায় হয়ে দেখতে হচ্ছে।

আস্তে আস্তে হাসির বেগ কিঞ্চিৎ প্রশমিত হলে, সুনীতা বলল, আপনি তো তা হলে আমার বিষয় সবই শুনেছেন।

সুজিত বলল, তা কিছু কিছু শুনেছি

জবাব শুনে সুনীতা আবার শার্সিভাঙা ঝনঝন শব্দে হেসে উঠল। তারপরে হঠাৎ থামল, যেন কেউ ওর গলা টিপে হাসি থামিয়ে দিল। বলল, কিছু কিছু মানে কী! আমার কী পরিচয়, আমাকে লোকে কী চোখে দ্যাখে, আমি কী চরিত্রের মেয়ে, সবই শুনেছেন আশা করি।

সুজিত বলল, মোটামুটি।

সুনীতা এক মুহূর্ত তাকিয়ে, সহসা ঈষৎ চোখ কোঁচকাল, ঠোঁটের কোণে বক্রতা দেখা দিল। বলল, মোটামুটি মানে, এই ধরুন আমি এক জন মস্ত বড়লোকের

সুজিত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আপনি প্রিয়নাথ দাশের আশ্রিতা।

–আশ্রিতা? ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেই, সুনীতা আবার হেসে উঠল। বলল, খারাপ কথাকেও ভদ্র ভাষায় আপনি বলতে পারেন দেখছি।

সুজিত বলল, আমি যা সত্যি বলে জানি, তাই বললাম।

সুনীতা উচ্চারণ করল, যা সত্যি বলে জানেনা…সুজিতের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে আবার বলল, আর আমি যে নষ্ট ভ্রষ্ট পুরুষদের সঙ্গে হোটেলে ক্যাবারেয় ঘুরে বেড়াই, সে খবর জানেন না?

সুজিত বলল, শুনেছি, আপনি যা যা বললেন, সবই শুনেছি। কিছু কিছু কথা তো সেদিন আমি ট্রেনেই শুনেছিলাম, কিন্তু, তার মধ্যে আপনাকে চিনতে আমি ভুল করিনি।

সুনীতা আত্মগতভাবে নিচু স্বরে উচ্চারণ করল, আমাকে চিনতে।…

সহসা যেন সুনীতা চমকে উঠে বলল, হ্যাঁ, আপনি কেন আমাকে সেদিন ও কথা বলেছিলেন? আমার মধ্যে আপনি কোথায় খুঁজে পেলেন একজন অসহায় আর দুঃখীকে, আমাকে বলুন।

সুজিত বলল, আমি তা ব্যাখ্যা করতে পারি না, কিন্তু আমি যেন তাই দেখেছিলাম, এবং এখনও তাই দেখছি।

সুজিতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিল সুনীতা। সুজিত আবার বলল, সত্যি বলতে কী জানেন, এ যেন অনেকটা নিজেকেই দেখার মতো।

সুনীতা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। বলল, নিজেকে দেখার মতো?

সুজিত অনেকটা অবুঝ শিশুর মতো ঘাড় নাড়ল। এবং দুজনেই পরস্পরের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল।

সুনীতা বিস্ময়-বিমূঢ় নিচু স্বরে বলল, আমি আপনার কথা যেন ঠিক বুঝতে পারছি না। বোঝবার মনটা যেন আমার ক্ষয়ে গেছে মনে হয়।…

তারপর গলার স্বর একটু তুলে বলল, সেদিন ট্রেন থেকে নেমে তারপর আপনাকে অনেক খুঁজেছি, আমি যেন কেমন হয়ে গেছলাম আপনার কথা শুনে। কারণ আমি নিজেও জানি না। আমি অসহায় দুঃখী, আপনার কথা শোনার পর থেকেই ভয়ংকর অস্বস্তি হচ্ছিল, আর বারেবারেই মনে হতে লাগল, লোকটা কে? কে, কে? এমনকী, এ কথাও মনে হয়েছিল, সারাটা রাত্রিই গাড়িতে ভুল দেখেছি, আসলে আমি আর প্রিয়নাথ দাশ ছাড়া কোনও লোক ছিল না। মনে হয়েছিল, সমস্তটাই একটা ভৌতিক ব্যাপার। আমার কাছে যারাই এর মধ্যে এসেছে, তাদেরই বলেছি, সেই লোকটিকে আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, ভীষণ। কিন্তু সে লোকটা বোধ হয় আসলে লোক নয়, একটা বাতাসের বুকে ছায়া।…তারপরে আজ যখন দীপু এই স্কেচটা নিয়ে গেল আমার কাছে, বুকটা ধক করে উঠল। ও বলল, সুজিতদা এঁকেছে, মন থেকে। কে সুজিতদা? হঠাৎ যেন মনটা বলল, সে-ই কি? সেই লোক, যাকে আমি শেষ মুহূর্তে আয়নায় দেখেছিলাম? তৎক্ষণাৎ ওর সঙ্গে ছুটে চলে এসেছি।

সুজিতের মুখে ওর সরল হাসিটি শিশুর মতো ফুটে উঠল। বলল, হ্যাঁ, আমি সে-ই!

সুনীতা স্কেচ-এর দিকে একবার দেখে বলল, কিন্তু একি সত্যি মন থেকেই আঁকা? শুধু স্মৃতি থেকে?

সুজিত বলল, তা ছাড়া আর তো কোনও উপায় ছিল না।

–কিন্তু কী করে সম্ভব? কী করে, আমার জানতে ইচ্ছে করছে।

 সুজিত এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হল। তারপরে হেসে বলল, আপনি যেমন আমাকে খুঁজছিলেন, বোধ হয় আমিও তেমনি মনে মনে আপনাকে খুঁজছিলাম।

খুঁজছিলেন?

–হ্যাঁ, আর খুঁজে পেয়েছিলাম, কাগজের ওপরেই তা দেখতে পাচ্ছেন।

সুজিত যেন খুশিতে হেসে উঠল। সুনীতা জিজ্ঞেস করল, কেন খুঁজছিলেন?

সুজিত বলল, বুঝতে পারছিলাম না। মনটা কী রকম হচ্ছিল। আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, জানেন।

–কেন?

সুজিত তার অপরিণত মস্তিষ্ক, চিকিৎসা, বর্তমান অবস্থা, এবং অতীতের দুই-একটি কথা, সংক্ষিপ্তে সবই বলল।

সুনীতা যেন গভীর অভিনিবেশে সমস্ত কথা শুনল। তারপরে বলল, ও, আপনি পিতৃমাতৃহীন?

 সুজিত বলল, হ্যাঁ, কিন্তু পরম ভাগ্য, আমি ভাল লোকের আশ্রয় একটা পেয়েছিলাম।

এমন সময়ে কলিং বেল-এর শব্দ পাওয়া গেল। সুজিত বলে উঠল, শিবেনবাবু এলেন বোধ হয়।

সঙ্গে সঙ্গে সুনীতারও যেন সহসা পরিবর্তন হল। বলল, হ্যাঁ। শিবেনকে আপনার কেমন মনে হয়?

সুজিত বলল, এত চট করে কি বলা যায়।

–ওরা আজ কী বলাবলি করছিল?

–আপনার বিয়ের কথা। প্রিয়নাথবাবু আর বীরেন্দ্রবাবুর বোধ হয় ইচ্ছা, শিবেনের সঙ্গেই আপনার বিয়ে হয়।

সুনীতার ঠোঁট বেঁকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু রঞ্জনের সঙ্গে আপনার আলাপ হল কেমন করে?

দরজা খুলতে গিয়েই ওকে আমি চিনতে পারলাম, তাই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও আপনাকে ভালবাসে নাকি?

সুনীতা নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সুজিতের দিকে। সুজিত আবার বলল, রঞ্জন বলল, সে তা জানে না, মোটের ওপর আপনাকে ওর চাই।

সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই অস্বাভাবিক, বিদ্রূপ আর ঘৃণা-মিশ্রিত তীব্র তীক্ষ্ণ হাসি।

সুজিত বলে উঠল, কিন্তু আপনি বুঝি আটাশে মার্চ আপনার কথা দেবেন বলে জানিয়েছেন?

সুনীতা উচ্ছ্বসিত হাসির মধ্যেই বলল, সে কথাও জানেন? সেদিন আপনিও আসবেন, আপনাকে আমি নিমন্ত্রণ করছি।

–কিন্তু আটাশে মার্চেই কেন?

বাঃ, সেদিন যে একটা শুভদিন, হিন্দু মতে সেদিন যে পাকা দেখার দিন। পাঁজি দেখেন না?

বলতে বলতেই সুনীতা হাসির বেগে চৌচির হল এবং উঠে দাঁড়াল। বলল, হতে পারি খারাপ মেয়ে, ওরা আমাকে ছাড়বে না যখন, একটা দিন-ক্ষণ তো দেখতেই হবে।

সুজিত বলল, খারাপ আপনাকে কে বলেছে?

সুনীতার হাসি থামল। বলল, সবাই। যারা আমাকে চায়, তারা খারাপ জেনেই তো আমার চারপাশে ভিড় করেছে। একমাত্র তো আপনাকেই দেখলাম, যে আমাকে, আমাকে অন্যরকম দেখেছে।

বলে আবার একটু হাসল সুনীতা। এবং দুপা দরজার দিকে এগুতে গিয়ে সুজিতের সামনেই দাঁড়াল।

সুজিত বলল, একটা কথা বলব?

-বলুন।

–আপনার দরকার একটু শান্তি, একটু ভালবাসা।

–ভালবাসা?

 সুনীতা পুনর্বার অজস্র হাসিতে ফেটে পড়ল, বলল, এই সমাজে, এই যুগে, আর আমার মতো একটা রূপসী আর বেওয়ারিশ মেয়ে, সমাজে যার দুর্নামে কান পাতা যায় না, তাকে আপনি শান্তি আর ভালবাসার কথা

সেই হিস্টিরিয়াব্যাধির মতোই হাসতে হাসতে প্রায় সুজিতের শরীরের কাছে এলিয়ে পড়ল সুনীতা। আবার বলল, এই সমাজে যে মেয়েদের ভাল আশ্রয় আছে, তাদেরই বা কজনের জীবনে ওই বস্তু দুটো আছে? আপনি এই যুগের কিছুই জানেন না, ছেলে হয়েও এ যুগের পুরুষদের আপনি মোটেই চেনেন না।

সুজিতের হাসির মধ্যে একটি করুণ ব্যথা ফুটে উঠল। বলল, তা হয়তো হবে। যুগের কথা আমি জানি না। আপনি আসার আগে, আমি এমন একটা আশ্চর্য অপরূপ দৃশ্য দেখেছি, মনে হল তার সঙ্গে যেন যুগের কোনও সম্পর্ক নেই, যেন সকল যুগের উর্ধ্বে। দেখে আমার মনটা কেমন করছিল, আনন্দে আরআর–ঠিক কী বলব, আমার যেন মনে হয় সত্যিকারের আনন্দের মধ্যে একটা ব্যথাও আছে, ব্যথার আনন্দ, সেইরকম, একটা সুখের ব্যথায়, আমি যেন কী রকম হয়ে গেছলাম, তাই অমনি করে বুক চেপে পড়ে ছিলাম।

সুনীতা জিজ্ঞেস করল, কী সেই দৃশ্য?

 সুজিত বলল, আমি দেখলাম, যাঁদের বয়স হয়ে গেছে, যৌবন আর নেই, এরকম এক দম্পতিকে। স্বামী প্রায় বৃদ্ধ, স্ত্রীও তাই; তার ওপরে স্ত্রী সম্পূর্ণ রুগ্ন, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, শুধু চোখের ভিতর দিয়েই কথা বলতে পারেন। আমি দেখলাম, সেই স্ত্রীকে বুকের কাছে ধরে স্বামীটি কী গভীর স্নেহে তাঁকে আদর করছেন, চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছেন, তুই বলে সম্বোধন করছেন, নিজের দুর্ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চাইছেন, আর স্ত্রীকে চুমো খাচ্ছে। আমি দেখলাম, স্বামীটির চোখে জল, স্ত্রীর চোখেও, কিন্তু গভীর বিশ্বাস ও শান্তিতে, দু জনের চোখেই আশ্চর্য মিষ্টি হাসি।

সুনীতা সহসা রুদ্ধ গলায় বলে উঠল, আমাকে গল্প বলছেন?

না, গল্প নয় সুনীতা, আমি দেখলাম, অসহ্য দুর্ভোগের মধ্যেও অবিশ্বাস্য সুন্দর ঘটনা।

সুনীতা চকিতে এক বার সুজিতের চোখের দিকে তাকাল, তারপর যেন রুদ্ধশ্বাস ব্যাকুলতায় ছটফট করে উঠল। ফিসফিস স্বরে উচ্চারণ করল, কিন্তু এ গল্প গল্পই শুধু। এ আমি শুনে কী করব, কী করব! সুজিত, এ সব নেই, এ সব নেই। তুমি ভয়ংকর সরল বলে এ সব বিশ্বাস করেছ। তুমি আলাদা মানুষ।

সুনীতা থামল, মুখ তুলল, ঘন সান্নিধ্যে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দেখল। পরমুহূর্তেই সুনীতা সহসা এগিয়ে দরজার বাইরে চলে গেল। থমকে দাঁড়াল এক বার। মুখ ফিরিয়ে তাকাল। স্কেচটা ওর হাতেই ছিল। নিচু স্বরেই বলল, সুজিত, তুমি কোথা থেকে এলে বুঝতে পারছি না। তুমি যা বলছ, সে সব বোঝবার মন বোধ হয় আমার নষ্ট হয়ে গেছে।

বলতে বলতেই একটি চকিত যন্ত্রণার ছায়া পড়ল ওর মুখে। বলল, আশা করি, আবার তোমাকে দেখতে পাব। যাচ্ছি।

বলে সুনীতা যেন ছুটে চলে গেল। সুজিত তাড়াতাড়ি ওকে অনুসরণ করল। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নেমেও ওকে আর ধরতে পারল না। ও ততক্ষণে গিয়ে ওর গাড়িতে বসেছে। বসা মাত্রই ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দিল। সুজিত দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়িটা বেঁকে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তেই সুনীতার একটা হাত উঠল তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

সুজিত কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে, বিষণ্ণভাবে হাসল। দরজা বন্ধ করে নত মস্তকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। শেষ ধাপে উঠে চমকে তাকিয়ে দেখল, সামনেই দীপু দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দৃষ্টিতে বিরক্তি ও বিদ্রুপের আভাস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর মধ্যেও একটা দুর্বিনীতের ভঙ্গি। কিন্তু সে হঠাৎ কোনও কথা বলল না।

সুজিত বলল, তোমার দাদা এসেছেন?

না। স্পষ্ট গম্ভীর জবাব দিল সে।

 তবে কলিং বেল বাজাচ্ছিল কে?

একইভাবে জবাব দিল দীপু, পিয়ন এসেছিল।

–ও! কিন্তু তুমি আমার দিকে ওরকম করে দেখছ কেন? কী হয়েছে?

-কিছু না। বলেই কপালের চুল সরাবার জন্যে মাথাটা একবার ঝাঁকাল। সুজিত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দীপু হঠাৎ বলে উঠল, আপনারও তা হলে সুনীতাদিকে ভাল লেগেছে?

সুজিত ফিরে বলল, মানে?

–মানে জানি না। বলে সে বাড়ির ভিতরে চলে গেল হনহন করে।

সুজিত এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে, হেসে উঠে বলল, পাগল।