০৯.
পরের দিন সন্ধের মুখে লোচন এসে কানে-কানে কথা বলার মতন করে কিছু বলল কিকিরাকে। কিকিরা তারাপদদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। খানিকটা আগে চন্দন আর তারাপদকে নিয়ে ঘোড়া-সাহেবের কুঠি ঘুরে এসেছেন। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন খানিকটা। লোচনের কথায় ব্যর্থ হয়ে বললেন, “কই, কোথায়? তাকে নিয়ে এসো।”
লোচন মাথা নেড়ে বলল, “ইখানে আসবেক নাই, বাবু। খেপাকে নকুল ধরে রেখেছে।”
কিকিরা বললেন, “বেশ, চলো৷” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন, “তোমার শশিপদ। চলো, দেখে আসবে চলো।”
বাড়ির বাইরে ঠাকুর-দালানের পেছন দিকে একটা ঘরে নকুল শশিপদকে ধরে বেঁধে বসিয়ে রেখেছে। ঘরে আলো নেই। চারদিকে গাছপালা, ডোবা; মস্ত একটা তেঁতুল গাছ সামনে।
কিকিরা আসতেই নকুল দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল।
”পেলে কোথায়, নকুল?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“কাছকেই ছিল। সাহানা ঠাকুরের বাড়ির কাছে খেপা ঘুরঘুর করছিল।” কিকিরা ঘরের মধ্যে তাকালেন। অন্ধকার। ঘুপচি ঘর। বাইরে চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। কাল কোজাগরী পূর্ণিমা।
কিকিরা বললেন, “অন্ধকারে তো ঠাওর করতে পারছি না। বাইরে আনো হে, নকুল। শশি-ওঝাকে দেখি।”
“আজ্ঞা, যদি ছুট দেয়?”
“দেবে না। তুমি আছ না?” বলে কিকিরা শশিপদকে বাইরে ডাকলেন।
শশিপদ বাইরে এল। বাইরে এসে দেখল সবাইকে। তারাপদকেও। তারপর হাত জোড় করে নমস্কার করল।
কিকিরা চাঁদের আলোয় যতটা পারেন খুঁটিয়ে দেখলেন শশিপদকে। তারপর বললেন, “দাওয়ায় দু-দণ্ড বসা যাক, শশিপদ; কী বলো?”
বলার সঙ্গে-সঙ্গে বসে পড়ল শশিপদ। ওর চোখে কেমন যেন ঝিমুনিভাব।
কিকিরাও বসলেন। তারাপদ আর চন্দন দাঁড়িয়ে থাকল। লোচন সামান্য তফাতে। নকুল একপাশে দাঁড়িয়ে।
কিকিরা যেন শশিপদকে খানিকটা ভরসা দেবার জন্যে বলেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি, শশিপদ। আমি তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম। দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব বলে।”
শশিপদ কথার জবার দিল না, হাত জোড় করে আবার নমস্কার করল কিকিরাকে। তারাপদ আর চন্দন হাসল।
সন্দেহ হল কিকিরার।”তুমি কি কিছু খেয়েছ?”
“আজ্ঞা। আফিম।”
“তা বেশ করেছ।…আচ্ছা শশিপদ, তুমি নাকি সাপের মস্ত ওঝা?”।
“আমি লিজে কী বুলব?” শশিপদ নিজের কান মলে আবার নমস্কার করল।
“তা অবশ্য ঠিক। নিজের গুণ গাইতে নেই। …তা শশিপদ, তোমায় দু-একটা পুরনো কথা জিজ্ঞেস করব। বলবে?”
শশিপদ ঘাড় তুলে দেখল চারপাশ। তারপর আঙুল তুলে নকুলদের দেখাল। বলল, “উয়াদের কাছে রা কাড়ব না। বড় নিরদয়, যেতে বলুন কেনে উদের।”
কিকিরা নকুল-লোচনদের চলে যেতে বললেন। শশিপদ বায়না ধরল, তারাপদরাও সরে যাক।
অগত্যা ওরা সরে গেল।
কিকিরা বললেন, “এবার বলো?”
“আজ্ঞা করুন।”
“আমি করব? বেশ, তাহলে আমার প্রথম কথা, তুমি আমায় সত্যি করে বলো, ফকিরবাবুর ছোটকাকাকে তুমি চিনতে?”
শশিপদ মুখ তুলে তাকাল। বলল, “বিলক্ষণ চিনতাম।” শশিপদর ঝিমনো গলা যেন হঠাৎ ধাতে এল। অবাক হলেন কিকিরা।
“তিনি কি সাপের কামড়ে মারা গিয়েছেন?”
“না আজ্ঞা,” মাথা নাড়ল শশিপদ।
”তুমি কি তাঁর ওঝাগিরি করেছিলে?”
কপালে দুহাত জোড় করে ঠেকাল শশিপদ।”ভগবান যাঁকে বাঁচান কর্তা, তাঁর আয়ু লয় হয় না। আমি ছোটবাবুর কাছে ছিলাম। বিষধর তাঁকে কামড়াইছিল বটে, কিন্তু তিনি বিষ খেয়ে লিলেন।”
কিকিরা অকারণ তর্ক করলেন না। ফকিরের ছোটকাকার বিষ হজম করার ক্ষমতা থাক বা না থাক, তাতে কিছু আসে-যায় না। আসল কথা, ফকিরের কাকা সাপের কামড়ে মারা যায়নি।
কিকিরা বললেন, “তবে যে এরা জানে, ছোটকাকা মারা গেছেন সাপের কামড়ে?”
শশিপদ এবার সোজা হয়ে বসল। তাকাল কিকিরার দিকে। বলল, “ছোট মুখে বড় কথা হয় কর্তা। যদি শোনেন তো বলি।”
“শুনব বলেই তো তোমায় খুঁজছি, শশিপদ।”
সামান্য চুপ করে থেকে শশিপদ বলল, “ই সংসার বড় পাপের জায়গা। কর্তা। ধন-দৌলত হল গিয়ে সব্বনেশে। ছোটবাবু মারা যান নাই, বাবু। উ সব হল গিয়ে রটনা।”
কিকিরা বললেন, “আমার তাই মনে হয়েছিল শশিপদ। ছোটবাবু যদি সত্যিই মারা যেতেন, তবে কেউ-না-কেউ তাঁকে দেখত। অত বড় ঘরের ছেলে, করুন না কেন ধর্মকর্ম, সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়ান না যেখানে খুশি, তা বলে তিনি মারা যাবার পর কেউ কোনো খবর দেবে না, দেখবে না মানুষটাকে–এ হয় নাকি?”
শশিপদ বলল, “ভাইদের হাত থেকে বাঁচতে বাবু রটনা করেছিলেন।”
“এত বড় মিথ্যে রটনা কেউ করে? অকারণে?”
“জানি না, কর্তা!”
“বেশ, তোমায় জানতে হবে না। জানলেও তুমি বলবে না। একটা কথা বলল, ছোটবাবু এখনো বেঁচে?”
শশিপদ ঘাড় হেলাল। ”কোথায় আছেন তিনি?”
“জানি না। “
“তুমি আবার মিথ্যে কথা বলছ! …আমি বলছি, ওই যে, সাধুবাবু এই গাঁয়ে এসেছিলেন, তিনিই ছোটবাবু!”
শশিপদ কিকিরাকে দেখল। হাসল যেন, বলল, “যা ভাবেন। আমি জানি না।”
কিকিরা বুঝতে পারলেন, আফিংখোর শশিপদ খুব সহজ মানুষ নয়। বললেন, “তুমি আমায় ভুল বুঝছ, শশিপদ। আমার কোনো স্বার্থ নেই। ফকিরবাবু আমার বন্ধু। আমি বিশুর জন্যে এসেছি। ফকিরবাবু বড় কষ্টে আছেন।”
শশিপদ যেন হাসিখুশি মুখ করল; বলল, “তা জানি বাবু। …একটা কথা বুঝতে লারি। ফকিরবাবু আপনার বন্ধু, কিন্তুক উ মিছা কথা বলে কেন?”
কিকিরা অবাক হবার ভান করে বললেন, “মিছে কথা? কিসের মিছে কথা?”
“আপনি জানেন বটে।”
“না শশিপদ, আমি জানি না।”
একটু ভাবল শশিপদ, বলল, “ফকিরের বেটাকে সে লিজে সাধুবাবার কাছে পাঠাইছিল!”
“নিজে গিয়েছিল, শুনেছি।”
“সব্বৈব মিছা, সব্বৈব মিছা”–শশিপদ জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “ফকির লিজে তার বেটাকে পাঠাইছিল। সাধুবাবার কাছে পাঠাইছিল, কত। কেন পাঠাইছিল?”
“কেন?”
“আপনি জেনে লেবেন। ফকির আপনার বন্ধু বটে।”
“তুমি বলবে না?”
“না।”
কিকিরা কিছু যেন ভাবলেন। পরে বললেন, “তুমি অমূল্যের লোক?”
“সে আপনি যা ভাবেন, কতা।”
কিকিরা এবার অধৈর্য, বিরক্ত হলেন। শশিপদ বড় একগুঁয়ে, জেদি। ভয় দেখিয়ে ওকে বাগে আনা যাবে না। লোভ দেখিয়েও নয়।
কিকিরা বললেন, “তা হলে তোমায় একটা কথা বলি, শশিপদ! তোমার সাধুবাবা কোথায় আছেন আমি জানি না। কিন্তু কেন তিনি এখানে এসেছিলেন, আমি জানি। যে-ঘর থেকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ঘরের সব খবর আমি জেনেছি। একটা কথা তুমি জেনে রেখো, কুঠিবাড়ির মধ্যে যা আছে, আমি কাল-পরশুর মধ্যে তা বার করে আনব। আমার সঙ্গে যে নতুন বাবুটিকে দেখলে, উনি কলকাতার পুলিশের লোক। ওঁকে আনিয়েছি। অমূল্যকে বলো, ওর যদি ক্ষমতা থাকে–আমাদের সঙ্গে কুঠিবাড়িতে দেখা করতে। ফয়সালা সেখানেই হবে। …যাও, তুমি যাও।”
শশিপদ এবার কেমন হতভম্ব হয়ে বসে থাকল খানিক। কিকিরাকে দেখল। তারপর উঠে দাঁড়াল। দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করল কিকিরাকে। কোনো কথা না বলে চলে গেল।
ঘরে এসে কিকিরা সব বললেন তারাপদদের।
চন্দন বলল, “এই কাঁচা কাজটা করলেন কেন, কিকিরা? একেবারে আলটিমেটাম দিয়ে দিলেন?”
“উপায় ছিল না।”
“কিন্তু কুঠিবাড়িতে কী আছে, আপনি জানেন না।”
“জানি না বলেই তো ধাপ্পা দিলাম।”
“ধাপ্পায় যদি কাজ না হয়?”
“না হলে আর কী করব! …তবে আমি যা যা সন্দেহ করেছিলাম, তার অনেকগুলোই মিলে গেল।”
“যেমন?”
“যেমন ধরো প্রথম হল, ফকির সব কথা বলছে না। দুই হল, ফকিরের ছোটকাকা বেঁচে আছেন। তিন হল, কুঠিবাড়ি নিয়ে সমস্ত গণ্ডগোল বেধেছে। সাধুবাবা এখানে আসার পর, কাজেই ওই কুঠিতে এমন-কিছু আছে, যার কথা সাধুবাবা ছাড়া অন্য কেউ জানে না…।”
কথার মধ্যে তারাপদ বলল, “আপনার কথা থেকে মনে হচ্ছে, ফকির আর অমূল্য দুই তরফই সাধুবাবাকে চোখে-চোখে রেখেছিল।”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“চিনতে পেরেছিল বলে।”
“কাকা বলে চিনতে পেরেছিল?”
“অবশ্যই।”
“তা হলে বাড়িতে আনল না কেন?”
“জানি না। হয়ত আনতে চায়নি।”
চন্দন বলল, “আপনার বন্ধু ফকিরই আপনাকে ঠকাল, কিকিরা।”
কিকিরা বললেন, “আমি এই ব্যাপারটায় বড় অবাক হয়ে গিয়েছি, চন্দন। ফকির কেন এমন করবে? …যাক গে, কালই এর একটা হেস্তনেস্ত করব, না হয় পরশু।“