সদাশয় সরকার বাহাদুর
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম সচেতন পদক্ষেপ পড়ে বম্বে অঞ্চলে। মারাঠাদের সঙ্গে ইংরেজদের প্রায়ই গন্ডগোল বাধত, গুজরাটের রাজাদের সঙ্গেও শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। ফলে বম্বে প্রেসিডেন্সিতে আঠারো শতকের শেষে তীব্র আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। কোম্পানি প্রশাসকরা বম্বের পাট গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল, প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা বোঝাতে সফল হয় যে বম্বে বন্দরের ভবিষ্যৎ এখনও উজ্জ্বল যদি কোম্পানি কোনও ভাবে উপকূলের ছোট ছোট রাজ্যগুলির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারে। শেষে মালাবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং গুজরাট-সৌরাষ্ট্রের গুটিকয়েক রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করার পরে অবস্থা কিছুটা আয়ত্তে আসে। এদিকে বম্বেতে শুরু হয়ে গেছে চিনের সঙ্গে আফিম রপ্তানির ব্যাবসা। নেপোলীয়নিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে কার্পাস রপ্তানিও হুহু করে বাড়তে থাকল। তারপর আর বম্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
নেপোলীয়নিক যুদ্ধ ভারতে অ্যাংলো-ফরাসি দ্বন্দ্ব আবার উসকে দেয়। টিপু সুলতানের সঙ্গে মাইসোর যুদ্ধের সময় (১৭৯৯) ও ১৮০৩-এর দ্বিতীয় মারাঠা যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীগুলির নেতৃত্ব দেয় ফরাসি সেনাধ্যক্ষরা। ফরাসিদের দমন করার সাথে সাথেই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মারাঠাদের সঙ্গে একটা চূড়ান্ত বোঝাপড়া দরকার হয়ে উঠল। ১৮১৮-তে তৃতীয় মারাঠা যুদ্ধ শেষ হতে কোম্পানি ভারতে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল বলা যায়।
সমকালীন দৃষ্টিতে কোম্পানিরাজ ছিল ভারতের অন্যান্য স্বাধীন রাজ্যগুলির থেকে বেশ স্বতন্ত্র। জমিদার দমনে হেস্টিংস বিশেষ সফল না হলেও তাঁর উত্তরসূরিরা স্থানীয় মাতব্বরদের উপরে আধিপত্য খাটাতে পেরেছিল, এবং তার ফলস্বরূপ একই সঙ্গে রাজস্ব ও সামরিক ব্যবস্থা পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভারতীয় রাজারা যখন সামন্তদের জোগানো সৈন্যের উপরে নির্ভরশীল, কোম্পানি তাদের নিজের বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কোম্পানি সরকার চালাত অভিজ্ঞ আমলারা। ভারতীয় দরবারগুলির কেন্দ্রে ছিল গা-ভরা হিরে-জহরত আর রেশমের জামা পরে বসে থাকা রাজবংশজাত লোকজন। তাদের কতগুলো ফুঁটো জগন্নাথ। আর চালাকচতুররা পরস্পরের প্রতি ঘোর ঈর্ষাপরায়ণ। সুযোগ বুঝে গভর্নর রিচার্ড ওয়েলেসলি (কার্যকাল: ১৭৯৬-১৮০৫) সাম্রাজ্যবিস্তারের কাজ চালিয়ে গেলেন।
ইতিমধ্যে ব্যাবসার নেতৃত্ব অবশ্য কোম্পানির হাত থেকে সরে গিয়ে চলে এসেছে ব্যবসায়ীদের হাতে, যদিও এই প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা অনেকে কোম্পানির কাছের লোক বা পরোক্ষভাবে কোম্পানির মদতপুষ্ট।
বেসরকারি ব্যাবসা
১৭৫০ থেকে ১৮১০ সালের মধ্যে কোম্পানির ব্যবসায়ে আকাশপাতাল পরিবর্তন ঘটে যায়। ১৭০০-র দ্বিতীয় ভাগে চিন হয়ে ওঠে কোম্পানির ব্যাবসার প্রধান জায়গা। প্রথমে চা ছিল কাপড়ের ব্যাবসার তুলনায় গৌণ, কিন্তু ১৭২০ সালে কাপড়ের আমদানির উপর পার্লামেন্টারি বাধানিষেধ জারি হওয়ার পরে চা-র গুরুত্ব বাড়তে লাগল। যতদিন চিনের চা ও ভারতের কাপড় দুইয়েরই বিনিময় মাধ্যম ছিল স্পেনের রুপো, চিন-ভারত ব্যাবসা পরস্পরনির্ভর হয়নি, কিন্তু আমেরিকার স্বাধীনতার পরে রুপো দুর্মূল্য হয়ে উঠতে কোম্পানিকে চায়ের দাম মেটানোর অন্য উপায় খুঁজতে হয়। আঠারো শতকের শেষে বিহারের আফিম এই প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হল।
সাম্রাজ্যবিস্তার ও কূটনীতিতে জড়িয়ে গিয়ে ও ভারত শাসনের মুখ্য ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে কোম্পানির ব্যাবসাও পড়তে থাকে। কাপড়ের রপ্তানি অনেক দিন ধরেই বাড়েনি। ১৮০০ সালের পরে ও শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে তা দ্রুত কমতে থাকল। ওয়েলশ লেখক টমাস পেন্যান্ট ১৭৯৮ সালে লিখলেন, ‘লাভজনক যুদ্ধব্যাবসা অন্য সব ব্যাবসা মেরে ফেলার আগে তাঁতই ছিল লাভের উপায়।’ যুদ্ধব্যাবসার থেকেও মারাত্মক অবশ্য ছিল মেশিনে তৈরি সুতোর উৎপাদন বৃদ্ধি। ১৮১০–২০-র মধ্যে মেশিনে তৈরি সুতো ভারতে আমদানি হতে শুরু করে। মেশিনে তৈরি কাপড় তার কিছু পর থেকে। দুশো বছরের পুরনো কাপড় রপ্তানির ব্যাবসা এবার শেষ অবস্থায় পৌঁছল।
ভারতের উপকূলে নেপোলীয়নিক যুদ্ধ আমেরিকান সামুদ্রিক বাণিজ্যের সামনে বিরাট সুযোগ এনে দেয়, কারণ আমেরিকানরাই তখন একমাত্র নিরপেক্ষ মেরিন। যুদ্ধের শেষে যখন ফরাসি ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভেঙে দেওয়া হয় (ফরাসি কোম্পানি আগেও একবার ভেঙে পুনর্গঠিত হয়েছিল) আর অন্যদিকে ইংরেজ কোম্পানি ব্যাবসায় কোনওরকমে টিকে আছে, এশিয়ার পণ্য আটলান্টিক অঞ্চলে বিক্রি করার ব্যাপারে আমেরিকানরা অগ্রগণ্য হয়ে উঠল।
কোম্পানি ব্যাবসা থেকে পিছু হটতে দলে দলে ভাগ্যান্বেষী ইউরোপিয়ান ভারতে আসতে শুরু করে, যাদের আজকের ভাষায় বলা হবে ইকনমিক মাইগ্রেন্ট। ১৮০০ সাল নাগাদ বম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপিয়ান সম্প্রদায় যথেষ্ট বড় হয়ে উঠেছে। তাদের চাহিদা মেটাতে অনেক ইউরোপিয়ান জিনিস এইসব শহরে তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক ভারতীয়রাও তাদের সংস্পর্শে এসে ইউরোপিয়ান অভ্যাস গ্রহণ করছে। বিগত কয়েক দশকে যুদ্ধবিগ্রহের কারণে ইউরোপিয়ান ভাড়াটে সৈন্যদের বাজার গরম ছিল, মোটা মাইনের চাকরি নিয়ে অনেক ফরাসি, জার্মান, ডাচ, এমনকী, ব্রিটিশ সৈন্যও বুন্দেলখণ্ড ও মালোয়ার মারাঠারাজের বাহিনীতে, রঞ্জিত সিং-এর পাঞ্জাবে ও টিপু সুলতানের মাইসোর দরবারে কাজ করছিল। এইসব ইন্দো-ইউরোপিয়ান বাসিন্দাদের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে একদল বিদেশি কারিগর এসে ঘোড়ার গাড়ি, আসবাবপত্র, পালকি, কাঁটা-চামচ, ঘোড়ার জিন, বুটজুতো, শুকনো মাংস, বন্দুক ও পিস্তল, ঘড়ি ও রুপোর থালাবাটি ইত্যাদি বানানো শুরু করে।
এই কারিগরদের মধ্যে বিশিষ্ট একটি দল ছিল, যাদের এখন পরিচয় দেওয়া হয় কোম্পানি পেইন্টার নামে। এরা দেশি শিল্পের ধারায় শিক্ষিত ভারতীয় শিল্পী। প্রথমে দেশি রাজাদের দরবারে কাজকর্ম করত, পরে কোম্পানির কাছে বায়না পেয়ে ছবি আঁকতে শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় দৃশ্যাবলী এঁকে অফিসারদের বিক্রি করা। এরা ছাড়াও কিছু ভাগ্যান্বেষী ও প্রতিভাবান শিল্পী ব্রিটেনে ভারতীয় দৃশ্যসংবলিত ছবির বাজার
১৩৬
বাড়াতে সক্ষম হয়। সমসাময়িক ভারতীয় মিনিয়েচার ছবির পাশে ফেললে, বিদেশিদের আঁকা ছবিতে পাওয়া যায় একটা বিশেষ ভাব যেটা ওই সময়ের মুড বোঝার জন্যে বিশেষ উপযোগী। ভারতীয় ছবিতে বিষয়বস্তু গতানুগতিক (রাজরাজড়া, নৈসর্গিক দৃশ্য, পৌরাণিক কাহিনি)। কারিগরি মান খুবই উন্নত, বিশেষ করে রঙের ব্যবহার। কিন্তু কারিগরি দক্ষতার ব্যবহার একেবারে ধরাবাঁধা রাস্তায়। বিদেশিদের বিষয়বস্তু বিচিত্র, কারিগরির ব্যবহারও বিচিত্র, আর ছবিতে ঐতিহাসিক-রোমান্টিক ভাব ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা সুস্পষ্ট।
এই প্রভেদ বোঝার জন্য বেশ ভাল উদাহরণ ১৭৫৭ সালের পরে আঁকা নবাবি মুর্শিদাবাদের ছবি। ১৭৭০-এর কাছাকাছি নবাবের দরবারি শিল্পী আঁকলেন প্রাসাদের সামনে মেলার মাঠ, সেখানে হিন্দু-মুসলমান, পুরুষ- মেয়ে, গরিব-বড়লোক, ছোট-বড় সব প্রজারা— বলাবাহুল্য সবাই নবাবের স্নেহধন্য— জমায়েত হয়ে আনন্দে মশগুল। কল্পনা করা যায় একশো বছর আগেও দরবারি শিল্পী একই বিষয়ে এক ভাবেই ছবিটি আঁকতেন। একই সময়ে একই শহরে বসে উইলিয়াম হজেস আঁকলেন নবাবি মুর্শিদাবাদের ছবি যার বিষয়বস্তু ধ্বংসোন্মুখ বিশাল কাটারা মসজিদ, অস্তগামী সূর্যের পড়ন্ত আলোয় রক্তিম হয়ে আছে।
১৮১৩
১৭০০-র শেষদিকে বেশ কিছু ইংরেজ বণিক ও প্রতিষ্ঠান কোম্পানির এলাকায় ব্যাবসা করেছে। প্রায় প্রত্যেকেই ভারতীয়দের সঙ্গে পার্টনারশিপে আমদানি-রপ্তানি চালাচ্ছে। কোম্পানির উপর এরা নির্ভর করত লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে, আর লভ্যাংশ দেশে পাঠানোর ব্যাপারে। এই নির্ভরতার কারণে এরা ব্রিটিশরাজের সমর্থক হলেও কোম্পানির একচেটিয়া ব্যাবসার ঘোর বিরোধী।
এই বিরোধিতার পিছনে আর একটা কারণ দানা বাঁধছিল ব্রিটেনের ব্যবসায়িক জগতে। কিছু দিন ধরে ব্রিটেনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুটো দল তৈরি হচ্ছিল। একদিকে ছিল তারা, যাদের পিটার কেইন ও অ্যান্টনি হপকিন্স আখ্যা দিয়েছেন ‘জেন্টলম্যানলি ক্যাপিটালিস্ট’, অর্থাৎ টাকার বাজার সিটি অফ লন্ডনের প্রমুখ ব্যাঙ্কার ও রাজনীতিকরা। আর অন্যদিকে মফস্সল শহরের শিল্পোদ্যোগীরা। প্রথমোক্তরা কোম্পানির মালিকদের বেশ নিকট লোক। ইউরোপে বিপ্লব ও যুদ্ধ বাধলে এরা বিশেষ লাভবান হয় কারণ তখন টাকার বাজারের কেন্দ্র আমস্টারডাম থেকে লন্ডনে চলে আসে। আবার অন্যদিকে মফস্সলের ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়। ইন্দো- ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা নানাভাবে এই দ্বিতীয় দলের ঘরের লোক। এদের ব্যবসায়ী স্বার্থের সঙ্গে শিল্পোদ্যোগীদের স্বার্থে সামঞ্জস্য ছিল। যেমন মফস্সল শহরের কাপড়ের মিলে কার্পাস জোগাত প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা।
১৭৯৩ সালে যখন কোম্পানির একচেটিয়া চার্টার পুনর্বিবেচিত হয়, প্ৰথম দল প্রবল ও দ্বিতীয় দল বেশ দুর্বল। তাদের ভাগ্যে জোটে ছোটখাটো কিছু সুবিধা, যেমন কোম্পানির জাহাজে এদের জন্যে একটা কোটা বেঁধে দেওয়া হয়। এইসব সুবিধায় দ্বিতীয় দল খুব একটা খুশি হয়নি। কারণ কোম্পানির জাহাজে মাশুল-হার চড়া ও কোম্পানির জাহাজ ব্যবহার করলে কোম্পানির গুদামে মাল রাখার বাধ্যতা ছিল, সেটাও অনেকের অপছন্দ।
১৮১২-১৩ সালে যখন আবার চার্টার নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পোদ্যোগীরা আরও প্রতিষ্ঠিত, আর তাদের বন্ধু মালব্যবসায়ীরাও আরও শক্তিশালী। এদের কাজ খাদ্য ও কাঁচা মাল সরবরাহ করা। নেপোলীয়নিক যুদ্ধে আমেরিকা থেকে আমদানি খাদ্য ও কাঁচা মালের পরিমাণ কমে যায়, তুলনায় এশিয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রুটির দাম বাড়াতে ভারত থেকে আমদানি চালের ব্যবহার বাড়ে। কার্পাসেরও একই ব্যাপার। কোম্পানি লিভারপুলের শিল্পপতিদের খুশি রাখতে ভারতীয় কার্পাস আনতে শুরু করে, তবে সে তুলোর পরিমাণ ও গুণমান নিয়ে শিল্পপতিরা খুশি ছিল না। তাদের বক্তব্য কোম্পানির একচেটিয়া শেষ হলে বিদেশি ব্যবসায়ীরা ভারতের তুলোচাষিদের সঙ্গে মিলে, বা নিজেরাই চা বাগানের মতো এস্টেট করে, নতুন পদ্ধতিতে তুলো চাষ চালু করার চেষ্টা করতে পারবে।
যদিও এরা রাজনীতির মূল স্রোতের থেকে এতদিন দূরে ছিল, মালের ব্যবসায়ী ও মফস্সলের শিল্পপতিরা এবার একজোট হয়ে একচেটিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লাগল। ১৮১৩ সালে, ঠিক যে বছরে চার্টার নিয়ে আলোচনা শেষ হয়, জেন্টলম্যানলি ক্যাপিটালিস্টরা ইউরোপে যুদ্ধ-সমাপ্তির কারণে অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত, এবং একেবারেই একজোট নয়। অ্যান্টনি ওয়েবস্টার দেখিয়েছেন যে এই অবস্থাবিশেষে প্রবল প্রতিবাদের মুখে একচেটিয়া রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
একচেটিয়া ব্যাবসার অবসানে কোম্পানির ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যায়নি। এর পরেও দীর্ঘদিন কোম্পানি কিন্তু রেশম ও নীল ভারত থেকে রপ্তানি করে। চিনের চার্টার তখনও চালু রয়েছে, প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতা ভারতে কোম্পানিরাজের এলাকায় সীমাবদ্ধ। তবে একে একে কোম্পানির গুদামে তালা পড়ছিল।
এজেন্সি হাউস
১৭৮০ নাগাদ কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের ব্যাবসা করার সুবিধা হারায়। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সামনে সুযোগ এল আইন মেনে ভারতে কান্ট্রি ট্রেড বা দেশি ব্যাবসা শুরু করার। কোম্পানির রাজত্বে সাহস পেয়ে এরা অনেকে উপকূল এলাকা ছেড়ে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে ব্যাবসা শুরু করে। ইউরোপিয়ান উদ্যোগে এইসব গ্রামীণ ব্যাবসার মধ্যে সবথেকে বড় ও সুদূরপ্রসারী হয়ে ওঠে নীলচাষ। নীল উৎপাদনের এলাকাগুলি ছিল দক্ষিণ বাংলা ও বিহারের গ্রামাঞ্চলে, কলকাতা থেকে কয়েক দিনের যাত্রা। কিন্তু নীলের বাজার ও ফিন্যান্স ব্যবস্থা সবই কলকাতায় কেন্দ্রীভূত। এইখানে একদল এজেন্সি হাউস নীলকরদের টাকা ধার দিত, তাদের হয়ে নীল (বা অন্যান্য রপ্তানিযোগ্য কাঁচামাল) বিদেশে রপ্তানি করত, ও লাভের অংশ বিদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করত।
১৮১৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানির সঙ্গে এই এজেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলির সম্পর্ক নিবিড় হলেও সুখকর ছিল না। এজেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলি বিদেশে টাকা পাঠাত কোম্পানির বিল অফ এক্সচেঞ্জ ব্যবহার করে। ব্যক্তিগতভাবে অনেক এজেন্সির প্রধান এককালে কোম্পানির কর্মচারী বা কোনও কর্মচারীর আত্মীয়-বন্ধুস্থানীয়। ভারত-বিজয়ের গোড়ার দিকে, যখন কোম্পানির লন্ডন অফিস কলকাতা বা মাদ্রাজ অফিসকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, তখন এই এজেন্সিদের প্রথম জেনারেশন একদল ব্যবসায়ী সাম্রাজ্য বিস্তারের হয়ে লড়েছে। যেমন বম্বের ডেভিড স্কট বা কলকাতার চার্লস ককারেল। দু’জনেই ভারতে এজেন্সি ব্যাবসায় প্রচুর পয়সা করে বেশি বয়সে সঞ্চিত টাকায় সাম্রাজ্যের হয়ে ক্যাম্পেন করেন। কিন্তু এদের সঙ্গেও কোম্পানির খটাখটি লেগেই থাকত। কোম্পানি যে ব্যাবসার ব্যাপারে কোনও-না-কোনও ভাবে নাক গলাতে পারে সেই ধারণাটাই এদের কাছে অস্বস্তিকর ছিল। এরা কোম্পানির সাম্রাজ্য চেয়েছে, আর সেই সঙ্গে চেয়েছে কোম্পানি যেন দ্রুত ব্যাবসার পাট গুটিয়ে ফেলে। স্কট বা ককারেল যদি রাজ্যবিস্তারের হয়ে লড়েন, বম্বের আর এক এজেন্সি ফোর্বস, ফোর্বস অ্যান্ড ক্যাম্বেলের প্রতিষ্ঠাতা চার্লস ফোর্বস তাঁর কর্মজীবনের অনেকটা কাটিয়ে দেন একচেটিয়া চার্টারের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেন করে।
আজকের বহুজাতিক সংস্থার এই পূর্বসূরিদের ইতিহাস লিখতে গেলে কয়েকটা উদাহরণ আবশ্যক। প্যাক্সটন, ককারেল অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম প্যাক্সটন যৌবনে ছিলেন সৈন্য ও নাবিক, পরে কোম্পানির চাকরি নেন। তাঁর কাজ ছিল সোনা ও রুপোর মূল্য যাচাই করা। এই চাকরি করতে করতেই এক সহকর্মীর (ককারেল) সঙ্গে জুটে পার্টনারশিপ শুরু করলেন। দু’জনেই ভারতে আমদানি-রপ্তানির ব্যাবসা করে অর্থোপার্জন করেন ও সেই টাকায় লন্ডনে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ে যোগ দেন। প্যাক্সটনের আর একটা পরিচয় আছে। ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয়দের অন্যতম আর্চিবল্ড ওয়াভেলের প্রপিতামহ ছিলেন উইলিয়াম প্যাক্সটন। পামার অ্যান্ড কোম্পানি ১৮৩০-এর কাছাকাছি সময়ের সবথেকে বড় এজেন্সি হাউস। এর প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম পামারের এক ছেলে। উইলিয়াম হেস্টিংসের আমলের লোক ও কোম্পানির অফিসার। পরবর্তী কালে পামার অ্যান্ড কোম্পানি দুই ভাই জর্জ ও জন হোর্সলে পামারের পার্টনারশিপ হয়ে দাঁড়ায়। কলকাতার এই বিশাল প্রতিষ্ঠান ১৮৩৩ সালের মন্দায় দেউলে হয়ে যায়, কিন্তু লন্ডনে পামারের ব্যাবসা চলতে থাকে। জর্জ পামার পরে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের গভর্নর হয়েছিলেন। ১৮১৩ সালে কার্কম্যান ফিনলে, জেমস ফিনলের ছেলে, গ্ল্যাসগো শহর থেকে পরিবারের বিশাল আমদানি-রপ্তানির ব্যাবসা চালাচ্ছিলেন। এই সময় থেকেই ফিনলেরা ভারতে ব্যাবসার পরিধি বাড়ায়। ১৮৭০ সাল নাগাদ জেমস ফিনলে প্রতিষ্ঠান বম্বের সবথেকে বড় কার্পাস এক্সপোর্টার, আর তার কিছু পরেই দক্ষিণ ভারতের বিপুল এলাকা জুড়ে চা-বাগানের মালিক।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নতুন একদল ব্যবসায়ী এশিয়া-ইউরোপ বাণিজ্যে যোগ দেন। এই দলের প্রমুখ ছিলেন যাঁরা— উদাহরণস্বরূপ নাম করা যায় ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি, জার্ডিন ম্যাথেসন, ও ডেভিড স্যাসুনের- সকলেরই ব্যাবসার কেন্দ্র কোনও বিশেষ দেশ ছিল না। ছিল কতগুলি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার শহর, যেমন বম্বে, কলকাতা, সিঙ্গাপুর ও হংকং। ১৯০০ সালের শেষে এদের বেশির ভাগই নীল ও আফিমের কেনাবেচা (পরে আফিমের আলোচনা আসছে) থেকে বেরিয়ে এসে বাষ্পীয় যানবাহন, চা, মদ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কাপড়ের মিলে বিনিয়োগ করেছে। প্রথম জেনারেশনের সঙ্গে এদের অনেক পার্থক্য ছিল। একটা হল, এই পরের যুগে কোম্পানিরাজ নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের বাজার সৃষ্টি করার যোগসূত্র হয়ে ওঠে। এ যুগে সব বড় প্রতিষ্ঠানই এই বিশ্বের বাজারের সদ্ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছে।
বম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতায় এজেন্সি হাউসগুলি ভারতীয়দের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যাবসা চালাত। বম্বেতে জামসেদজি জিজিভয় চার্লস ফোর্বসের সঙ্গে পার্টনারশিপ তৈরি করেন। কলকাতায়, ১৮৩৩ ও ১৮৪৬ সালের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর পার্টনার ছিলেন উইলিয়াম কার ও উইলিয়াম প্রিন্সেপের। নীল ও আফিমের রপ্তানির কাজে একদল এই ধরনের পার্টনারশিপ লেগে ছিল। শুধু বণিক নয়, অনেক কারিগরও বিদেশ থেকে ভারতে আসে এই সময়ে, এবং কলকাতা ও বম্বে শহরে এদের অনেকে লেগে যায় কারখানা তৈরিতে। এই উদ্যোগের ভাল উদাহরণ হল হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়, হাওড়ার একাংশ, যেখানে পরবর্তী যুগে পাটকল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা বসেছে। ১৮০০ সালের গোড়ার দিকেই কিন্তু এইখানে বেশ কয়েকটি জাহাজ মেরামতের কারখানা ও বড় বড় মালগুদাম তৈরি করা হয়।
আফিম ও ভারত-চিন বাণিজ্য : ১৮১৩-৩৩
এজেন্সি হাউসদের একটা বড় আকর্ষণ ছিল চিনে বিহারের আফিম রপ্তানি করা। আফিম সরকারি লাইসেন্স ছাড়া তৈরি হত না, কিন্তু তা চিনে নিয়ে যাওয়া এবং বিক্রি করা ছিল প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের হাতে, এমন ব্যবসায়ী যারা আফিম পরিবহনের উপযোগী বিশেষ ধরনের ছোট ছোট জাহাজের বা ওপিয়াম রানারের মালিক। প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা আফিমের বিনিময়ে কোম্পানিকে দিত রুপো। অথবা চিনে রুপোর বিনিময়ে আফিম বিক্রি করে সেই রুপো দিয়ে কোম্পানির বিল কিনে দেশে পাঠাত। এতে ব্যাবসার লাভ নিরাপদে পাঠানো যেত, আর কোম্পানি হাতে পেত রুপো যা ব্যবহার করে চিন থেকে চা কেনা হত। এই ভাবে বিহারের আফিম চিন-ভারত-ব্রিটেনের মধ্যে ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট রক্ষা করতে সাহায্য করত।
ব্যাবসার প্রধান কেন্দ্র ক্যান্টনে বিল কেনার মাশুল যথেষ্ট কম ছিল। কোম্পানির মধ্যস্থতার কারণে ইউরোপীয় ও ভারতীয় এজেন্টরা নিশ্চিন্তে হং নামে বণিকদের সঙ্গে লেনদেন করতে পারত। আফিম কেনাবেচা চিনে বেআইনি। হং-দের অসাধারণ নেটওয়ার্ক আমলা ও জলদস্যু দুয়েরই আক্রমণ থেকে কোম্পানির কর্মচারী ও এজেন্টদের রক্ষা করত। নিরাপত্তা জরুরি ছিল আরও একটা কারণে। ওপিয়াম রানারগুলি প্রচুর রুপো নিয়ে যাতায়াত করত।
এজেন্টরা এই ব্যবস্থায় যে খুব সন্তুষ্ট ছিল তা নয়। আক্ষরিক অর্থে এরা ছিল সরকারি এজেন্ট, অর্থাৎ শুধু ভারত ও চিনের মধ্যে যাতায়াতের জন্যে লাইসেন্সধারী, ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে নয়। অন্যদিকে চিনা নিষেধাজ্ঞার কারণে আইন ভাঙার পুরো ঝুঁকিটাই নিতে হত প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের। ফলে বড় প্রতিষ্ঠান যেগুলি আফিমের ব্যাবসায় লেগে ছিল তারা ১৮০০-র প্রথম দিকে চিনের সমুদ্রে কোম্পানির চার্টারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ ক্যাম্পেন চালায়। ১৮৩৩ সালে এই চার্টারের অবসান হয়।
ভারত শাসন
১৮৩৩-এরও অনেক আগে থেকেই কোম্পানির চরিত্র বদলে গেছে। বাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ খুবই কম, কিন্তু পূর্ব এশিয়ায় ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষায় কোম্পানি বড় সহায়। ভারতে কোম্পানি পুরোপুরি প্রশাসক, যদিও শাসন চলত পার্লামেন্টের সঙ্গে পার্টনারশিপে। পার্টনারশিপ ছিল অসম। কোম্পানির নিজের কোর্ট অফ ডিরেকটর্স-এর কিছুটা অধিকার ছিল ঠিকই, তবে আধাসরকারি কমিটি বোর্ড অফ কন্ট্রোল ছিল সর্বেসর্বা। তবু, কোম্পানির প্রতীকী সার্বভৌমত্ব ইংল্যান্ডে মোটামুটি মেনে চলা হত। ব্যাবসা ও রাজনীতির মাথারা মানতেন যে কোম্পানির জন্যেই এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, এমনকী ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব, সম্ভবপর হয়েছে। ১৮৫৩-র পার্লামেন্টারি ভোট, যাতে ভারত শাসনের প্রথাগত অধিকার কোম্পানির হাতেই থাকে, এই মনোভাবেরই পরিচায়ক।
১৭৮৪-র রেগুলেটিং অ্যাক্ট বলবৎ হওয়ার পর থেকেই কী নিয়মে ভারত শাসন করা হবে এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চাগিয়ে ওঠে। কোম্পানিরাজের প্রথম যুগে শাসন পরিচালনার ধ্যানধারণা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক কালের লেখালেখিতে (যথা সুদীপ্ত সেন, ফিলিপ স্টার্ন) অর্থনীতি, বাণিজ্য, নিয়ন্ত্রণ এই বিষয়গুলির উপর তৎকালীন ভাবনা নিয়ে কাজ হয়েছে। অন্যরা, যেমন ডেভিড ওয়াশব্রুক, কাজ করেছেন আইন নিয়ে।
এইসব গবেষণার গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এইটুকু বলা যেতে পারে যে কোম্পানিরাজের শেষ চল্লিশ বছরে— অর্থাৎ মারাঠা যুদ্ধের সমাপ্তি (১৮১৮) ও সিপাহি বিদ্রোহ শুরুর (১৮৫৭) মধ্যবর্তী সময়ে— ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনৈতিক-তথা-অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থার তিনটে প্রধান ফরমুলা গঠিত হয়। এগুলি হল পরোক্ষ শাসন বা ‘ইন্ডিরেক্ট রুল’, সরকারি খাতে বিদেশে অর্থপ্রেরণ বা যাকে পরে জাতীয়তাবাদীরা আখ্যা দিয়েছেন ‘ড্রেন’, আর ভারতীয়দের উন্নতিসাধন নিয়ে চিন্তাভাবনা ও প্রশাসন ব্যবস্থায় তার প্রতিফলন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই ভারতীয় রাজাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে অনেক কূটনীতি শুরু হয়। এতে ফল বিশেষ পাওয়া যায়নি, কারণ দুই তরফেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়েছে বারবার। সামরিক জোট বারবার ভেঙেছে গড়েছে। ১৮১৮ সালের পর কূটনীতির চর্চা হয় কোম্পানির শর্তাধীন। সরকার সব স্বাধীন রাজ্যগুলির সঙ্গে আলাদা আলাদা চুক্তি করে, যার ফলে রাজ্যগুলি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল করে দিতে বাধ্য হয়, তাদের সীমান্ত খোলা রাখে মাল যাতায়াতের জন্যে, স্থানীয় ব্রিটিশ রেসিডেন্ট চোখ রাখে উত্তরাধিকার ঠিকঠাক ভাবে, মানে ব্রিটিশরাজের স্বার্থসংগত ভাবে হচ্ছে কি না সেদিকে। কিন্তু রাজারা অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের সব ব্যাপারে স্বাধীন থাকে। এই চুক্তিগুলির মাধ্যমে পাঁচশোরও বেশি দেশীয় রাজ্য পরোক্ষ শাসনের আওতায় এল।
যে-কোনও চুক্তির ভিত্তি পারস্পরিক বিশ্বাস। কমবেশি আট বছর সময়ের মধ্যে (১৮৪৮-৫৬) এই ভিত্তিতে বড় ধরনের আঘাত লাগে। ব্রিটিশ শাসন ঘোষণা করল যে কোনও দেশীয় রাজ্যে পুরুষ উত্তরাধিকার না থাকলে বা শাসক অযোগ্য বিবেচিত হলে সেই রাজ্য অধিগ্রহণ করা হবে (ডকট্রিন অফ ল্যাপস)। পঞ্চাশের দশকে এই নীতি কুখ্যাত হয়ে ওঠে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে সদ্য অধিগৃহীত ঝাঁসি ও অবধ রাজ্যে। সিপাহি বিদ্রোহের কেন্দ্রে ছিল এই রাজ্যগুলি। বিদ্রোহ যদিও ব্রিটিশ শাসনের দুর্বল দিকগুলি প্রকট করে দেয়, তবু বিদ্রোহের শেষে পরোক্ষ শাসন আবার প্রতিষ্ঠিত হল। বলা যেতে পারে যে এর পরে আর কোনও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটেনি।
পরোক্ষ শাসনের মতো ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস-এর কাঠামোও তৈরি হয় ১৭০০-র শেষ দিকে, যদিও উনিশ শতকের আর্থিক রূপান্তর এই কাঠামো কিছুটা বদলে দিয়েছিল। কোম্পানি নিজে একচেটিয়া ব্যাবসা চালালেও কোম্পানিরাজ নিজের এলাকায় বাণিজ্য মুক্ত রাখতে আগ্রহী ছিল। এই মনোভাবের পেছনে সদিচ্ছা ছাড়াও রাজনীতিক চাপ কাজ করেছে। ভারতে ব্রিটিশ সুতো ও কাপড়ের বাজার যাতে বাধাহীনভাবে বাড়তে পারে তার জন্যে চাপ দিত একাধিক ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী। অন্যরা চেয়েছে ভারত থেকে চিন বা ব্রিটেনে আফিম, নীল ও কার্পাসের রপ্তানি যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। বাণিজ্য শুধু প্রাইভেট ব্যাবসার নয়, সরকারি বাজেটের জন্যেও অপরিহার্য হয়ে ওঠে। টাকার হিসেবে রপ্তানির পরিমাণ আমদানির থেকে অনেক বেশি হত, এই পজ়িটিভ ট্রেড ব্যালেন্স ব্যবহার করে সরকার ও দেশি-বিদেশি ব্যাবসা প্রত্যেক বছর ইংল্যান্ড ও ইউরোপ থেকে কিনত নানারকমের পরিষেবা বা সার্ভিস। উদারহণস্বরূপ, সরকারি খাতের খরচ ছিল ভারতে কাজ করে অবসর নিয়েছে এমন সিভিলিয়ান ও মিলিটারি অফিসারদের পেনশন, আর বেসরকারি খাতে পয়সা যেত দেশি কারখানার বিদেশি ফোরম্যান বা কারিগরদের মাইনে বাবদ। তা ছাড়া লাভের অংশ বিদেশে পাঠানো তো আছেই।
এই যে আর্থব্যবস্থা, যাতে বৈদেশিক বাণিজ্য, দেশীয় বাণিজ্য, শিল্পায়ন, সরকারি বাজেট সবকিছু পরস্পরনির্ভর হয়ে যায়, তারও গোড়াপত্তন কোম্পানির আমলে এবং ১৯২৯-এর বিশ্বজোড়া মন্দার আগে পর্যন্ত এটি মোটামুটি অটুট ছিল। বস্তুত, ১৯৩০-এর দশকে বিশ্ব বাণিজ্য ধসে পড়লে ভারতে যে অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয় সমস্ত দক্ষিণ গোলার্ধে উপনিবেশবাদের অবসান ঘটাতে তার একটা ভূমিকা ছিল (পরের অধ্যায়ে এই বিষয়ে আর একটু আলোচনা হবে)।
কোম্পানিরাজের শেষ প্রধান গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহাউসি বিশ্বাস করতেন যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্য ভারতীয়দের আর্থিক ও চারিত্রিক উন্নতিসাধন এবং এই কাজে তিনটে ‘ইঞ্জিন’ ব্যবহার করতে হবে, রেলগাড়ি, টেলিগ্রাফ ও পোস্ট অফিস। তিনটেই ব্রিটেনের অবদান। ডালহাউসির অনেক আগে থেকেই ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের অনেকে উন্নতির মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। হিতবাদ বা ইউটিলিটেরিয়ানিজমের আদর্শ অনুসরণ করে এঁরা বলেছেন যে ব্রিটিশ শাসনের উদ্দেশ্য ভারতীয়দের হিতসাধন করা। অবশ্য কী করলে ভারতীয়দের হিত হবে সে প্রশ্ন ভারতীয়দের জিজ্ঞেস করার দরকার বলে কেউ মনে করেনি। বরং হিতসাধনের ধ্যানধারণাগুলি সমকালীন পশ্চিম ইউরোপ থেকে আমদানি। তার সঙ্গে এসে মেশে ভারতীয় সমাজ সম্বন্ধে কিছু সত্যি আর কিছু আজগুবি ধ্যানধারণা। হিতসাধনের উপায় নিয়ে আলোচনায় এঁরা ডালহাউসির তিনটে ইঞ্জিনের কথা বলেননি, বলেছেন চরিত্র গঠনের কথা, ব্যাবহারিক জ্ঞান বাড়ানোর কথা। এগুলির জন্যে প্রয়োজন ইংরেজি ভাষার শিক্ষা, সার্বজনিক শিক্ষা, পশ্চিমের আদলে তৈরি আইনিব্যবস্থা, কুৎসিত সামাজিক প্ৰথা যেমন সতী বা শিশুহত্যা বন্ধ করা, জমির আইন বদলে জমিদারের জায়গায় কৃষকদের অধিকার দেওয়া ইত্যাদি। বলাবাহুল্য অনেক প্রমুখ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীও এই মতবাদে বিশ্বাস করতেন। রামমোহন রায় এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
এই বিবরণী থেকে যদি মনে হয় যে নতুন রাষ্ট্র আঠারো শতকের ভারতীয় সমাজে আধুনিকতার জোয়ার নিয়ে এল, ধারণাটা খুবই ভুল হবে। বুদ্ধিজীবীরা যাই বিশ্বাস করুন না কেন, প্রশাসকরা সাবধানী লোক ছিলেন। মাত্র কয়েকশো সাহেব সিভিলিয়ান আর তাদের মুষ্টিমেয় ভারতীয় বন্ধু এই দেড়শো কোটি মানুষের দেশে দ্রুত বদল আনার চেষ্টা করলে ঝড়ের মুখে কুটোর মতো উড়ে যেতে পারে, এই ভয় তাদের মনে কাজ করত। তারা নতুন আইন ও বিচারব্যবস্থা তৈরি করল ঠিকই, কিন্তু আইনের বইয়ে হিন্দু-মুসলমান ধর্ম ও নীতির বই থেকে টুকে গাদাগাদা শ্লোক ঢুকিয়ে দিল। জমির আইন বদলাল, কিন্তু অনেক জায়গাতেই জমির অধিকার রইল স্থানীয় মাতব্বরদের হাতে। টাকার অভাবে সার্বজনিক শিক্ষার প্রসার আদর্শই হয়ে রইল। নতুন যুগের পরিকাঠামো— রেল, তার, ডাক, সেচ ক্যানাল, বিশ্ববিদ্যালয়— শুরু হল অনেক দেরি করে, পঞ্চাশের দশকে।
তবে আধুনিকতার উপকরণগুলি সীমিত পরিধির হলেও এগুলি যে আধুনিকতারই উপকরণ তাতে সন্দেহ নেই। ইংরেজি শিক্ষা শুধু শিক্ষা নয় মানসিকতার বদল এনে দেয়। ডালহাউসির ইঞ্জিন যে কাঠামো তৈরি করে দেয় তার উপর ভিত্তি করে শিল্পায়ন শুরু হল এবং ক্যানালসেচিত অঞ্চলে ছোটখাটো কৃষিবিপ্লব সম্ভবপর হল।
সিপাহি বিদ্রোহ
আঠারো শতকের প্রথম দিকের এই শান্তিপূর্ণ নিষ্ক্রিয়তার পরিবেশে সিপাহি বিদ্রোহ প্রচণ্ড আঘাত হানে। কোম্পানিরাজের উপর ভারতীয় সমাজের একাংশে এমন উন্মত্ত রাগ জমে ছিল তা কারওর কল্পনাতেও আসেনি। ব্রিটেনে অনেক বছর বাদে আবার হঠাৎ কোম্পানিকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হল। যদিও ১৭৮৪-র পরে পার্লামেন্ট কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়েই ভারত শাসন করে এসেছে, কিন্তু তদন্তর জন্যে চাই একটা বড়সড় টার্গেট। বোর্ড অফ কন্ট্রোল তো একটা কমিটি মাত্র। তা ছাড়া সাধারণে তখনও ভারতের রাজা হিসেবে পরিচিত কোম্পানিই।
১৮৫৭-র ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেবে এ রকম একটা ইঙ্গিত দিল। কোম্পানির ডিরেক্টররা ব্যস্ত হয়ে তাদের সবথেকে যোগ্য কর্মচারী, দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিলকে অনুরোধ করল নিজেদের সমর্থনে একটা আর্জি লিখে দিতে। মিল যে রিপোর্ট লিখলেন তার চেয়ে চমৎকার ওবিচুয়ারি কোম্পানির হয়ে আর কেউ লিখতে পারতেন না। মিল বললেন যে ১৮৫৬-র কোম্পানি আঠারো শতকের একচেটিয়া ব্যাবসা আর অপশাসন চালানো কোম্পানি নয়, একটি পরিণত রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটেনকে একটি সাম্রাজ্য উপহার দিয়েছে, ঠিক যখন আটলান্টিকের পাড়ে ব্রিটিশরাজ একটি পুরনো সাম্রাজ্য হারিয়েছে। ভারতীয় সমাজ ও আইন অটুট রেখে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভারতে তৈরি হয়েছে তার থেকে বাস্তববাদী ব্যবস্থা হতে পারে না। যদিও এই রাজত্ব আকস্মিক ঘটনা, কোম্পানির পরিকল্পিত নয়, তবু ঘটনার পরিণতি ঠিক পথেই গিয়েছে, এ রাজত্বের অপসারণ অন্যায্য কাজ হবে। এত সুযুক্তির পরেও প্রশ্ন রয়ে গেল, তা হলে বিদ্রোহ হল কেন? মিল সে প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। ফলে তাঁর ওকালতি সফল হয়নি।
মজার কথা এই যে, এ প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া গেছে এমন বলা যায় না। বিদ্রোহীরা অনেক ধরনের মানুষ দিয়ে তৈরি একটা জোট, তাদের সবাই এক উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্রোহে যোগ দেয়নি। সিপাহি বিদ্রোহের আলোচনায় জাতীয়তাবাদী মনোবৃত্তির প্রভাব এখনও এত উগ্র রকমের যে বিদ্রোহীদের সম্বন্ধে আমরা যতটা জানি, দেশীয় সমাজে বিদ্রোহের বিরুদ্ধতা নিয়ে ততটা জানি না। কাজেই বিদ্রোহের মূল কারণগুলি ও বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ নিয়েও ধারণা সুস্পষ্ট নয়। যারা বিদ্রোহে যোগ দেয়নি, প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের সহায়তা করেছে, তাদের মানসিকতা সম্বন্ধে আমাদের স্পষ্ট ধারণা এখনও তৈরি হয়নি, যেন আমরা তাদের এই বেইমানির জন্যে এত লজ্জিত যে তাদের নিয়ে কথা বলতে চাই না। এই ভারতীয়রাই অবশ্য দলে ভারী, এবং অর্থবলেও ভারী। এদের সঙ্গে উত্তর ভারতের বিদ্রোহীদের আত্মিক যোগ অত্যন্ত ক্ষীণ।
এই আলোচনায় বেশিদূর না গিয়ে বলা যায় যে বিদ্রোহের পেছনে দুটো অসন্তোষ বেশি করে কাজ করেছে। কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর মূল অংশ ছিল ভারতীয় সৈন্য, তাদের মাথায় ছিল ইন্দো-ইউরোপিয়ান ও ব্রিটিশ অফিসাররা। যুদ্ধবিগ্রহ চলাকালীন এই শ্রেণিগুলির মধ্যে বৈষম্য অপেক্ষাকৃত কম ছিল। কিন্তু চল্লিশ বছরের শান্তিপর্বে শ্রেণিবিভেদ বেড়েছে। শুধু বেড়েছে তাই নয়, জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবিদ্বেষের চেহারা নিয়ে বেড়েছে। দ্বিতীয় অসন্তোষ দানা বাঁধছিল উত্তর ভারতের জমিদার-তালুকদার-রাজাদের মধ্যে, যারা পরোক্ষ শাসনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা এটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। বিদ্রোহীরা প্রধানত সেনা-জমিদার আঁতাত।
সাম্রাজ্যের অন্য কোনায়, বম্বে-মাদ্রাজ কলকাতা ও তাদের অর্থনৈতিক পশ্চাদভূমিতে, আর এক শ্রেণির লোকেরা সাম্রাজ্য নিয়ে জোরালো মতামত পোষণ করত। এরা ব্যবসায়ী, কারিগর, শিক্ষিত সম্প্রদায়, যাদের অনেকের কাছে কোম্পানিরাজ ও ডালহাউসির ইঞ্জিন অভূতপূর্ব সুযোগ-সুবিধা এনে দেয়। সিপাহি বিদ্রোহের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ সেনা-জমিদার আঁতাতে ফাটল বা ব্রিটিশ সামরিক শক্তি ও তার নির্মম ব্যবহারই শুধু নয়। আর একটা বড় কারণ ছিল দেশীয় ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে যারা বিদেশি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা বিদ্রোহে শামিল হয়নি ও কোম্পানিরাজ পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে। আঠারো শতকে ভারতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে জমির লড়াই অন্যদিকে বিশ্বায়নের টান। সিপাহি বিদ্রোহ কিছুটা সেই বিভাজনের পরিচায়ক। কোম্পানিকে বিশ্বায়নের এজেন্ট বলা চলে। হয়তো বিশ্বায়ন কথাটা তখন চালু হলে মিল সেই যুক্তি ব্যবহার করতেন, আর কোম্পানির স্বপক্ষে দেশীয় সমর্থন নিয়ে আরও কথা বলতেন।
১৮৫৮ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর কোর্ট অফ ডিরেক্টর্স শেষবারের মতো মিটিং করল লেডেনহল স্ট্রিটে কোম্পানির অফিসে। জন লরেন্স, পাঞ্জাবের লেফটেনান্ট-গভর্নর, যাঁর চেষ্টায় উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্যাপক বিদ্রোহ এড়ানো যায়, তাঁকে একটা সাম্মানিক বৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। সেদিনের মিটিংয়ে এই একটাই অ্যাজেন্ডা। ঠিক দু’মাস বাদে রানির ঘোষণা প্রচারিত হল— ব্রিটিশ ভারত এখন রানির খাস সম্পত্তি। পেনের এক খোঁচায় বিশাল দেশের প্রশাসন ও সৈন্যবাহিনীর মালিকানা বদল হয়ে গেল। এই তারিখের অনেক দিন আগেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানি শেষ হয়ে গেছে।