৯. ‘র’-এর ভাগবাটোয়ারা

অধ্যায় : ৯ ‘র’-এর ভাগবাটোয়ারা

The RAW Deal

১৯৭৫ সালের ২৬ জুন ভারতে জরুরি আইন জারি করা হয়। এদিকে জন সংঘ দল, সোশালিস্ট পার্টি, বিরোধী কংগ্রেস ও ভারতীয় লোক দল মিলিত হয়ে ১৯৭৭ সালের ২২ মার্চ ‘ভারতীয় জনতা দল’ গঠন করে, যা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচনে জয়লাভে সক্ষম হয়। এই সব একটির পর একটি ঘটে যাওয়া ঘটনা ভারতীয় বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে নজিরবিহীন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় ও জনতা সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের যাবতীয় ক্রোধ ‘র’-কে লক্ষ্য করে নিঃসরিত হয়। তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘র’-জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ও এই সংস্থাটি ইন্দিরা গান্ধীর অনুগত বাহিনী’ বা “IG’s Strong Trooper” ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সব অভিযোগের পাশাপাশি ‘র’-কে ইন্দিরা গান্ধীর জন্য বিদেশে অর্থ প্রেরণের সংস্থা হিসেবেও সন্দেহ করা হতে থাকে। এভাবেই জনতা সরকার তাদের সকল প্রতিশোধ স্পৃহা ‘র’-এর বিরুদ্ধে সমবেত করে। এই সবের সাথে সাথেই ‘র’-এর ক্ষয়প্রাপ্তি শুরু হয়।

ক। দূর্ভাগ্যজনক মূঠাঘাত ( The Fatal Blow)

এস এন (শংকর নায়ার) : ‘র’-লজ্জিত হবার মতো কোনো সংঠন নয়।

এম ডি (মোরারজী দেশাই) : আমি তাই আশা করি।

এম ডি : আমার বিশ্বাস যে, আপনার সংস্থা প্রচুরসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত লোক নিয়োগ করেছে।

এস এন : জ্বি, স্যার। তবে এ সব ব্যক্তিকে আইনানুযায়ী পুনঃনিয়োগ করা হয়েছে এবং তাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে একেকজন বিশেষজ্ঞ বলে স্বীকৃত।

এম ডি : এদের প্রত্যেককে সংস্থা থেকে বহিষ্কার করতে হবে।

এম ডি : আমি বিশ্বাস করি, ‘র’-দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জড়িত ছিল।

এস এন : না, স্যার, এ সব সত্য নয়, ওগুলোর সব ছিল বৈদেশিক অপারেশন এম ডি : কিন্তু আপনাদের কার্যক্রম অত্যন্ত অমানবিক ও অত্যন্ত অপ্রচলিত।

এস এন : এগুলোর ‘র’-এর বৈদেশিক কার্যক্রম স্যার…

এম ডি : এতে অমানবিকতার কোনো কমতি হয় না- অতিশীঘ্রই আপনাদের গৃহীত সকল অপারেশন স্থগিত ঘোষণা করুন।

এস এন : আমরা যদি সে পদক্ষেপ গ্রহণ করি তবে অনেকেই আমাদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে ও সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।

এম ডি : আমার তাতে কিছু যায় আসে না, আপনি সকল অপারেশন স্থগিত করুন ও ‘র’-এর লোকবল ৫০% কমিয়ে ফেলুন, আমাদের এতো বড় সংস্থা পোষার কোনো প্রয়োজন নেই, আমাকে আপনি যতো তাড়াতাড়ি পারেন এ ব্যাপারে রিপোর্ট করবেন।

উপরোল্লিখিত আলোচনা, জনতা সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই ও নবনিযুক্ত ‘র’ প্রধান কে শংকর নায়ারের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। (নায়ার ‘র’- প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করার পর লেখকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে উপরোক্ত আলোচনার সংগঠনের সত্যতা স্বীকার করেন)। এভাবে যে সংস্থাটিকে বহু বছরের কঠিন পরিশ্রম ও একাগ্রতা দ্বারা গড়ে তোলা হয়েছিল, তা মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে খণ্ড-বিখণ্ড রূপ পরিগ্রহ করে। অতি উচ্চমানের মানবিক সম্পদের ২৫% বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়া হয়, আর বাদবাকি যে ৭৫% বাকি থাকে তা এমনভাবে নষ্ট করা হয় যে ওগুলো মেরামতের বা পুনঃনিয়োগের বাইরে চলে যায়।

খ। কাও-এর পদত্যাগ (KAO Quits )

ইতোমধ্যে ‘র’-এর শেষ ভাগবাটোয়ারা একটি পূর্ণ অবয়ব পেতে শুরু করে। ‘র’-প্রধান আর, এন, কাও-কে জনতা সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পরপর অনানুষ্ঠানিক ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ার উদ্বোধন করা হয়। এরপর যুগ্ম সচিব নায়ারকে ৪ এপ্রিল উক্ত পদ গ্রহণের জন্য আদেশ দেয়া হয়, যিনি এরমাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনায় অত্যন্ত অখুশি ছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে মন্তব্য করেন, “যে কেউ একটি কার্যকর বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারেন। মানব মুখের, নাকের মতো এটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এবং ভারত অতি অবশ্যই পরাশক্তিসমূহের ক্রমবর্ধমান মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।”

দেশের প্রধান নির্বাহীর (প্রধানমন্ত্রী দেশাই) সাথে তাঁর (নায়ার) কথা কাটাকাটির পর নায়ার তাঁর কোনো এক ঘনিষ্ঠ জনকে অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে উল্লেখ করেন, “প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু”। তিনি তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি শব্দকেই রূঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছিলেন।

গ। ‘র’-এর পদাবনতি (RAW Downgraded )

শিকার করার জন্য সময়টা ছিল অত্যন্ত উপযোগী এবং উৎসাহী সুবিধাবাদীরা এ জন্য অনেকদিন যাবৎ অপেক্ষা করছিলেন। মোরারজী দেশাই তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের সময় পর্যন্ত সচিবদের সংখ্যাধিক্যের কথা উল্লেখ করেন ও তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দেন। এ সুযোগ ছিল অত্যন্ত লোভনীয়, যা ছেড়ে দেয়া যায় না। এ সময় জানা যায়, কেবিনেট সচিব এস এন মুখার্জী ‘র’ প্রধানের পদমর্যাদা সচিবের সমপর্যায় থেকে নামিয়ে পরিচালক অর্থাৎ অতিরিক্ত সচিবের সমপর্যায়ে পদাবনতি দেয়ার সুপারিশ করেন। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ সৃষ্টি হয়, কারণ এ পদক্ষেপের দরুন ‘র’-এর ক্ষমতা খর্ব করা সম্ভব হবে ও অন্যদিকে মুখার্জীর আরেকটি উপদেশ অনুযায়ী সিভিল সার্ভিস থেকে কেউ ‘র’-এর তদারকির দায়িত্ব নিয়ে-এর তত্ত্বাবধান করবেন (অন্যকথায় তিনিই এর তত্ত্বাবধায়ক হবেন)। দেশাই এর ফলাফল চিন্তা না করেই সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।

ঘ। নায়ার-এর পদত্যাগ (Nair Resigns )

মুখার্জী একটি দ্বৈত খেলা খেলার ব্যাপারে অত্যন্ত ‘জেদী’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

নায়ারকে না রাগিয়ে ও একইসাথে দেশাইকে সন্তুষ্ট রাখার মানসে মুখার্জী নায়ারের অফিসে দেখা করতে যান ও তাঁকে ব্যাখা করেন যে, প্রধানমন্ত্রী কি চান ও তিনি (মুখার্জী) কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে যুদ্ধ (!) করে নায়ারের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। তিনি আরো ব্যাখ্যা করেন যে, এই পদক্ষেপ একদিকে ভালই, কারণ ‘র’-প্রধানের পদমর্যাদা নামিয়ে দেয়ার পরও নায়ারের বেতন একই থাকবে এবং তিনি (মুখার্জী) দু’পক্ষের মধ্যে একটি ‘বাফার’ বা ভারসাম্য বিধানকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন। তিনি নায়ারকে নিশ্চিয়তা দেন যে, নায়ার তাঁর ইচ্ছামতো যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং শুধু তাঁকে (মুখার্জীকে) এ ব্যাপারে জানালেই চলবে।

নায়ার ইতোমধ্যে মুখার্জীর কার্যকলাপ সম্পর্কে বেশ কিছুটা ধারণা পেয়ে যান এবং মুখার্জী কিসের জন্য এতো জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তা সহজেই বুঝতে পারেন। তিনি মুখার্জীকে জানিয়ে দেন, যদি অন্য কারো মাধ্যমে তাঁর কাছে কোনো আদেশ আসে, তবে তিনি পদত্যাগ করবেন। অন্যদিকে মুখার্জী বেশকিছু সময়ের জন্য ধারণা করেন, নায়ার তাঁর (নায়ার) ‘নীতি অনুসরণে একদম শেষ সীমায় পৌঁছানোর’ এক খেলায় মেতে উঠেছেন। কিন্তু তিনি এ ক্ষেত্রে ভুল অনুমান করেন। নায়ার একজন অত্যন্ত কঠিন বিশ্বাসের মানুষ ছিলেন এবং কদাচিৎ কখনো কাউকে তাঁর মনোভাব বুঝতে দিতেন। তবে যখন তিনি কোনো কিছু বলতেন তখন একজন সাধারণত তাঁকে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনত। যারা তাঁর সাথে কাজ করেছে তাঁদের মাঝে তাঁর সম্পর্ক ওই ধরনের কথা প্রচলিত ছিল।

সব সন্দেহের অবসান ঘটানোর মানসে নায়ার দেশাইয়ের সাথে দ্বিতীয়বারের মতো আলোচনায় মিলিত হন। শোনা যায় যে, ওই আলোচনা চিৎকার চেঁচামেচির প্রতিযেগিতায় পরিণত হয়। নায়ার, মুখার্জীর বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তার ব্যাখ্যা দাবি করে তাঁর ভাষায় ‘তাঁর উপরওয়ালা প্রধানমন্ত্রীর’ সাথে বৈঠকে সবাই শ্রেয় মনে করেছিলেন। আরেকবার মুখোমুখি হওয়ায় দেশাই তাঁর ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন ও কথা বলার পরিবর্তে চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু অল্পকিছুক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারেন যে, নায়ার তর্জন গর্জন করার মতো লোক নন এবং তখনি তিনি তাঁর (নায়ার) ‘র’-প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে তাঁকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। এরপর দু’জন পরস্পর করমর্দন করেন ও বিদায় সম্ভাষণ জানান। ভি শঙ্কর, যিনি দেশাই-নায়ার বাক বিতণ্ডার সময় উপস্থিত ছিলেন, তিনি তাঁর জীবনে প্রথমবারের মতো একজনকে দেখলেন, যিনি দেশাইয়ের সম্মুখে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখেন।

ঙ। ‘র’-প্রধানরূপে সানটুকের দায়িত্ব গ্রহণ (Suntook Becomes RAW Chief)

নায়ারের ‘হঠাৎ পদত্যাগ’ ‘র’-কে ‘আঁতুড়ঘরে’ নিক্ষেপ করে। ধারণা বহির্ভূত ঘটনায় সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে কেবিনেট সচিবালয় হন্যে হয়ে ‘র’-প্রধান পদে একজন উত্তরসূরি খুঁজতে থাকে। ইতোমধ্যে দু’জন প্রতিযোগী তাদের স্বপক্ষে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠাতে থাকেন। এরা হচ্ছেন অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল নারায়ণ রাও ও জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান এন এফ সানটুক।

এদিকে গুজব ছড়িয়ে যায় যে, মুখার্জী একজন পুলিশ অফিসারকে ‘র’-প্রধান পদে নিয়োগ দান করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন (কারণ তাঁর সাথে পুলিশ বিভাগের পূর্ব সখ্য ছিল), অবশ্য এ কারণ ছাড়াও তিনি নারায়ণ রাওকে বাছাই করতে চেয়েছিলেন, কারণ তিনি যখন স্বরাষ্ট্র সচিব ছিলেন তখন রাও তাঁর অধীনে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে কাজ করতেন, যার জন্য তিনি তাঁর অধীনতা সহজেই মেনে নিবেন বলে মুখার্জী ধারণা করেন। অন্যদিকে দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়ার পূর্বে নায়ার সানটুকের নাম ‘র’-প্রধান পদে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেন। এই অবস্থার মধ্যেই সানটুক ‘শূন্যস্থান পূরণ’ করে ফেলেন। উত্তর- পূর্ব সীমান্ত এজেন্সি থেকে ছয় বছর পূর্বে কাও (তদানীন্তন প্রধান) সানটুককে ‘র’-এ এনেছিলেন এবং তিনি ‘র’-এর দর্শনের সাথে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম ছিলেন। কাও-এর মতো, নায়ার তাদের নিজস্ব অবস্থার কথা চিন্তা না করে ‘র’-যাতে অসুবিধায় না পড়ে তাই করতে চেষ্টা চালান। সানটুক এমনি একটি সংস্থার দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন যা “ইতোমধ্যেই অর্ধেক ক্ষমতা ও লোকবল হারিয়েছে”। এমতবস্থায় তিনি ছিলেন শুধু নামমাত্র “বিভাগীয় প্রধান”। তিনি তাঁর প্রাক্তন দুই পূর্বসূরি অপেক্ষা ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন বলে জানা যায়। সানটুকের ক্ষেত্রে বলা হতো যে, “তিনি তাঁর নিজের ছায়াকে পর্যন্ত ভয় পেতেন”।

এদিকে ঘটমান পরিস্থিতি সংস্থাকে শুধু রিপোর্ট পত্রাদি তদারকিতে নিপতিত করে। বিশেষ অপারেশন শাখা সম্পূর্ণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মনোবল কমে যেতে শুরু করে ও সংস্থা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে থাকে। ‘র’ নেতৃবৃন্দের এখানে বিশেষ করণীয় কিছুই ছিল না। ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া সমস্যার মধ্যেও আবার কম পরিচিত শাখা, যেমন এভিয়েশন রিসার্চ সেন্টার ও স্পেশাল সার্ভিস ব্যুরোতে ‘মৃদু অশান্ত অবস্থা’ ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যা ইতোমধ্যে ‘পুরুষত্বহীন’ ‘র’-এর দৈনন্দিন পার্থিব কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

চ। ‘র’-এর চুক্তি ভঙ্গের শাস্তি (The RAW Sanctions )

বৈদেশিক গোয়েন্দা ব্যুরোর মনোবল ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করে। বাইরে থেকে এই পার্থক্য সম্পর্কে আঁচ করা কঠিন ছিল। এই আমলে ‘র’-তে কাজ করেছেন এমন একজনের মতে, “১৯৭৭ সালে আমাদের মনমেজাজ ছিল যন্ত্রণাদায়ক দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।” যারা এই সংস্থাকে বিশ্বাস করেছিল তাঁরা সকলেই প্রতারিত হয়েছিল ও কেন এমন হলো তা বুঝতে পারেননি।

দেশাই-নায়ার সংলাপের পর ‘র’-এর পরিচালনাধীন অনেক বিশেষ অপারেশন, ওগুলোর প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করেই বন্ধ করে দেয়া হয়। মনে করা হয় যে, সরকার অত্যন্ত কঠোর একটি নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। নায়ার ‘র’ ছেড়ে চলে যাবার আগে দেশাইকে বলেন, “বিদেশে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করার কোনো বৈধ পন্থা নেই”, যার উত্তরে দেশাই পাল্টা জবাব দেন, “তাহলে আমার এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কোনোই প্রয়োজন নেই।”

কতগুলো বিশেষ অপারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল তা বলা না গেলেও যেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় সেগুলো তাদের স্ব-স্ব দুঃখের ইতিহাস নিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। এ সব অপারেশন বন্ধ করে দেয়ার পিছনে যতনা ওই সব অপারেশনের প্রকৃতি দায়ী ছিল তারচেয়ে বেশি হচ্ছে ‘র’-এর বিরুদ্ধে লালিত আজন্ম বন্ধ সংস্কার। ‘র’-এর চুক্তিভঙ্গের শাস্তি জনতা সরকরের শেষ পরিণতির একটি কারণ-যার দরুন যারা ‘র’-এ যুক্ত ছিল তারা প্রতারিত হয় এবং আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকে, কেন?

প্রথম চুক্তিভঙ্গ (Sanction One )

মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতারণা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সকাল এগারটা। পূর্ব পাকিস্তানের কোনো এক স্থানে মুক্তিবাহিনীর একজন যুব বিপ্লবী, আড়ম্বরপূর্ণ ও নির্ভীক স্বঘোষিত জেনারেল আব্দুল কাদের সিদ্দিকী (টাইগার) একটি পাকিস্তানী স্টাফ কারের বনেটে ভারতীয় ২য় মাউন্টেন ডিভিশনের পতাকা লাগিয়ে তাতে চড়ে বসেন।

এই অদ্ভূত ঘটনা ঘটে বিকাল ৪:৩১ মিনিটে ঢাকায় লে. জে. নিয়াজীর পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের কিছু পূর্বে। মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল এলাকা, ময়মনসিংহ এবং ঢাকার কিছু নির্দিষ্ট এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পনায় অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করে এবং ‘র’-এর সাথে মিলিত প্রচেষ্টায় ঢাকা মুক্ত করতে সমর্থ হয় ও অবশেষে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিব সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। এরপর নাটকীয়ভাবে বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের নিজে চেয়ারম্যান হয়ে বাকশাল গঠন, ১৪ আগস্টের রাতে শেখ মুজিবের মৃত্যু ও খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতাগ্রহণ এবং ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মোশতাককে হটিয়ে ক্ষমতা দখল (মোশতাককে সরিয়ে ক্ষমতা নিয়েছিলেন খালেদ মোশারফ-অনুবাদক)। এরপর একমাসের ব্যবধানে গণভোট গ্রহণ করা হয়, যাতে ৯৮.৮৭% ভোট পেয়ে জিয়াউর রহমানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ নিশ্চিত হয়। টাইগার সিদ্দিকী যিনি দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেন। (এখানে লেখক আব্দুল কাদের বানানটি ভুল লিখেছেন, Abdel Kader-অনুবাদক)। তিনি তাঁর সাথে তখনকার ‘ক্ষয়প্রাপ্ত’ মুক্তিবাহিনীর ১৬,০০০-২০,০০০ সদস্য নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিম বঙ্গে এসে আশ্রয় নেন।

জ। প্রতিশ্রুতি (The Promise)

টাইগার সিদ্দিকী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে সব ‘র’ সদস্যদের সাথে পরিচিত ছিলেন, তিনি পুনরায় সাহায্য ও নিরাপত্তার আশায় তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশে তিনি ও তাঁর লোকজন তখন কালো তালিকাভুক্ত ছিলেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায় যে, তাড়াহুড়ো করে জড়ো হওয়া মুক্তি ফৌজের উদ্দেশ্য ছিল ‘মুজিববাদকে পুনর্জীবিত’ করা। সিদ্দিকী তাঁর তিনজন সঙ্গীসহ দিল্লীতে যেয়ে ধরনা দিতে থাকেন। তাদের চাহিদা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সরল প্রকৃতির, যেমন পূর্বের মতো বেরসরকারি গোপন সমর্থন প্রদান ও তাদের পুনঃগঠিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দান।

ভারতীয় সরকার তাদের দাবিপূরণে সম্মত হন। কিন্তু এর সাথে একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের সীমানা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং এ পদক্ষেপ শুধু মুজিবের স্বপ্নসাধ পুনর্জীবিত করার জন্য সীমিত সময়ে পরিচালিত হবে। তারা শুধু চরম অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতেই ভারতীয় আশ্রয় স্থান ব্যবহার করতে পারবেন। এ শর্তে মুক্তিফৌজ রাজি হয়ে যায় কারণ বাংলাদেশ রাইফেলস তাদেরকে কচিৎ কখনো আক্রমণ করত এবং প্রায় সময় তারা (বিডিআর) নিষ্ক্রিয় থাকতো বললেই চলে। শেখ মুজিবের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা থাকার পাশাপাশি আরেকটি বিশেষ কারণে তারা মুক্তিফৌজকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন, আর তা হচ্ছে, ভারতীয় কৰ্তৃপক্ষ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, বাংলাদেশ মিজো গেরিলাদের আশ্রয় দিয়ে চীনাদের প্রশিক্ষণ প্রদনের সুযোগ দিয়েছে এবং কাদের বাহিনীর মুক্তিসেনারা তাদের ধারণায় এ ধরনের তৎপরতাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং ‘র’-এর মাধ্যমে সিদ্দীকিকে ভারতীয় সরকারের সাহায্য প্রদান অব্যাহত থাকে। তবে সাথে সাথে, যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা না হয় সেদিকে পুংখানুপুঙ্খ নজর রাখা হয়।

ঝ। বিশ্বাসঘাতকতা (The Betrayal)

দেশাই সরকারের ক্ষমতারোহণের ফলে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। মুক্তি ফৌজ সূত্র দাবি করেন, দেশাই সরকার শুধু সমর্থন প্রত্যাহার করেই ক্ষান্ত হননি (ক্ষমতায় আসার তিন মাস পর) বরং সীমান্তে বি ডি আরের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা ২০০ মুক্তি ফৌজকে বি এস এফের হাতে তুলে দেয়ার পর তাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে বি ডি আরের নিকট হস্তান্তর করা হয় (যদিও তখন মুক্তি ফৌজ ‘র’-এর তত্ত্বাবধানে থাকার কথা)। মুসলিম বাঙালিদের দেখা স্বাধীনতা যুদ্ধের হত্যাযজ্ঞ এভাবে আবার সংগঠিত হয়। এসব মুক্তিসেনা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে তাদের প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন করা হবে’ সে আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ফিরে এসেছিল। কিন্তু বাস্তবে তাদের বেশির ভাগ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অল্পকিছু সেই গল্প বলার জন্য বেঁচেছিল। এদের মধ্যে বাঘা সিদ্দিকীও ছিলেন।

বাঘা সিদ্দিকী তাঁর ‘র’-কন্টাক্ট মেজর মেননের সহযোগিতায় বেঁচে যান। কারণ অন্যান্য অনেকের সাথে তাঁকেও মেজর মেননের অনুরোধক্রমে বি ডি আরের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। বাঘা সিদ্দিকী সিঃসন্দেহে একজন ভাগ্যবান। কিন্তু তিনি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেন না, কেন তাদের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হলো যা তার মতে বিশ্বাসভঙ্গ বই কিছুই নয়।

ঞ। দ্বিতীয় চুক্তিভঙ্গ (Sanction Two)

চাকমা মহিলা ও শিশু হত্যাযজ্ঞ : ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত থাকায় আরেকটি ‘র’-অপারেশন বন্ধ হয়ে যায়।

অপারেশন স্থগিতকরণ : বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের একদম শেষ পর্যায়ে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থিত সেখানকার চাকমা গেরিলারা মুক্তিবাহিনীর মতো ‘র’-অপারেটিভ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সাহায্য করেছিল। চাকমারা ইয়াহিয়া খানের সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই নদীর ওপর একটি বাঁধ তৈরি করে ফলে ওই এলাকার চাকমাদের অন্যস্থানে পুনর্বাসন করা হবে বলে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই পুনর্বাসন কখনো করা হয়নি। বরং এর পরিবর্তে সত্তর দশকে বাঙালি মুসলিম জনগণ দরিদ্র চাকমাদের নিকট হতে সহায় সম্পত্তি ক্রয় আরম্ভ করে এবং এর পর ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়াও একই সাথে চলতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর চাকমাদের কিছু সময়ের জন্য সাহায্য করা হয়। কিন্তু মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর আবার সেই ধর্মান্তকরণ পুরোদমে আরম্ভ হয়ে যায়। তাই তারা বাধ্য হয়ে সাহায্যের আশায় ভারতে আসা শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর মতোই তারা তাদের পুরনো ‘র’ কন্টাক্টদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং অবশেষে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়।

আগরতলা অতিক্রম করে এসে তারা দরকষাকষি শুরু করে। তাদের পরিবার-পরিজন ও শিশুদের নিরাপত্তা বিধানের দাবি ভারত সরকার মেনে নেন। তারা তাদের নিজস্ব যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তারা একটি সংকীর্ণ করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করে যার মাধ্যমে তাদের পরিবার-পরিজন ভারতে অনুপ্রবেশ করতে পারে। এদিকে মিজো সমস্যার আশংকা রয়ে যায় কারণ তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘আশ্রয়স্থান’ হিসেবে ব্যবহার করছিল ও চীনারা তাদের প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিল। চাকমা উপজাতিদের আকার আকৃতি ও চেহারা মিজোদের মতো একই রকম থাকায় ও মিজোরা উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চালাবার জন্য অস্ত্রসজ্জিত হওয়ায় প্রাথমিকভাবে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সুতরাং লালডেঙ্গা, যিনি ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ‘র’-এজেন্টদের সাথে ইউরোপে যেতে সম্মত হন। পরবর্তীতে ‘র’- অপারেটিভদের মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে তাঁকে দিল্লীতে আনা সম্ভব হয়, যদিও তখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করা সম্ভব হয়নি। এ পর্যায়ে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশি মাত্রায় সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে মিজো বিদ্রোহীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় সরকারকে তথ্য সরববাহের প্রস্তাব দেয় যার পবিরর্তে তারা তাদের পরিবারের জন্য ভারতীয় আশ্রয়ের নিশ্চয়তা চায়। ভারত সরকার এই দাবি মেনে নেন।

কিন্তু আবারো কোনো ইঙ্গিত ছাড়াই চাকমাদের পরিবারের ভারতে প্রবেশের করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমিক ঘটনা প্রবাহে হতবুদ্ধি হয়ে তারা ভারতীয় পক্ষ ও যে সমস্ত ‘র’-এজেন্টদের তারা বিশ্বাস করেছিল তাদের পরবর্তী গৃহীত কার্যক্রমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু তারা যে আশ্রয় চেয়েছিল ও যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেয়া হয়েছিল, তা বাস্তবে পরিণত করা হয়নি।

করিডোর বন্ধ করে দেয়ার খবর বাংলাদেশ রাইফেলস্ সদর দফতরে পাঠানো হয় এবং বিডিআর তৎক্ষণাৎ ওই করিডোর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করে। চাকমারা শেষ ‘জুয়ার দানে’ তাদের মহিলা ও শিশুদের ভারতীয় সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু যখন তারা বিপুলভাবে প্রহরারত সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা চালায় তখন তাদের সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বলে খবর পাওয়া যায়। এভাবে বন্ধ করে দেয়া আরেকটি অপারেশনের ভয়ানক মাশুল টানতে হয়েছিল।

ট। তৃতীয় চুক্তি ভঙ্গ (Sanction Three )

মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ও ওয়ালী খানের অস্বীকার : ১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ সমন্বয়ে নতুন পাকিস্তান গঠন করা হয়। যাহোক, ১৯৭৭ সালের মার্চের নির্বাচনে জেড, এ, ভুট্টোর বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। ব্যাপক কারচুপির জন্য ও বিপরীতে ভুট্টোর পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনমনীয় মনোভাবের কারণে পাকিস্তান জুড়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং আরো একবার পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করা হয়। অন্যান্য সকল সামরিক শাসকের মতো জিয়াউল হক সময় সুযোগ মতো পরবর্তীতে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন ও বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে আফগানিস্তানে প্রবাসী এক পাকিস্তানী নাগরিক উল্লেখ করেন, “আমরা ১৯৮০-এর শেষপাদে উপনীত হয়েছি কিন্তু সেই পুরনো খেলা এখনো চলছে।” আফগানিস্তান প্রবাসীর এ মন্তব্য একটি সাময়িক, অনিয়মিত সামান্য ব্যাপার হতে পারে কিন্তু নতুন সংবিধান প্রণয়নের পরপর সামরিক শাসন জারির উদ্দেশ্য বোঝা যায় এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্ত হতে বহু লোক পলায়ন করে। এ দলের সাথে ওয়ালী খান ও তাঁর অনুগত রাজনৈতিক সতীর্থরাও আফগানিস্তানে চলে যান ও সেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।

জেনারেল মোহাম্মদ দাউদ যিনি অল্পকিছুদিন পূর্বে ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে আফগানিস্তানকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন ও এর প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন তিনি পাকিস্তানী শরণার্থী পোষার ও এদের দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তথাপি তিনি এদের আফগানিস্তানে থাকার অনুমতি প্রদান করেন এ শর্তে যে, শরণার্থীরা নিজেরাই নিজেদের খরচ চালাবে। এ অবস্থায় ওয়ালী খান সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুব বেশি সময় নেননি।

ঠ। প্রতিশ্রুতি (The Promise )

‘র’-অপারেটিভরা ইতোমধ্যে কাবুলে ওয়ালি খানের সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয় এবং ওয়ালি খানের আর্থিক সাহায্যের আবেদন তাদের মোটেও আশ্চার্যান্বিত করেনি। আরেকটি ব্যাপার ওয়ালি খানকে ভারতের সাহায্য প্রত্যাশায় উদ্বুদ্ধ করে, আর তা হলো তাঁর সাথে সীমান্ত গান্ধী’ নামে সমধিক পরিচিত বাদশা খানের গভীর আত্মীয়তা এবং তাঁর (বাদশা খান) সাথে ভারত ও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ। সুতরাং আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্তে আসতে বিশেষ সময় লাগেনি বিরাজমান পরিস্থিতিতে ওই সিদ্ধান্ত ভারত ও আফগানিস্তান উভয়েরই অনুকূলে ছিল।

তবে এবারও ভাগ্য ওয়ালি খানের পক্ষে কাজ করেনি। দেশাই সরকার তৃতীয় একটি দেশে কোনো রাজনৈতিক দলকে সাহায্য করাকে অত্যন্ত ভীতিজনক বলে বিবেচনা করে এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে নায়ারকে তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ সাহায্য বন্ধের নির্দেশ প্রদান করেন। এভাবে ‘র’-এর আরেকটি অপারশনের ইতি ঘটে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, এখানে যদি আদৌ কোনো সত্যতা থেকে থাকে তবে ওয়ালি খান সেজন্য আরো অনেকদিন যাবত ভারতকে বিশ্বাস করা হতে বিরত থাকবেন।

ড। চতুর্থ চুক্তি ভঙ্গ (Sanction Four )

প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদান স্থগিত : ‘র’-এর শেষ যে চুক্তিভঙ্গ সম্পর্কে জানা যায়, যা নিয়ে দেশাই জনসমক্ষে পর্যন্ত মন্তব্য করেছিলেন, তা হলো ‘সিকিম অপারেশন’। যদিও অপারেশন তখনো ‘বাতাসে ঝাপটা মারছিল’, আর অপারেশনে সাহায্যের বিনিময়ে তখন পর্যন্ত কিছু সাহায্য প্রদান করার প্রয়োজন ছিল। সে জন্য নতুন করে অর্থ বরাদ্দ জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় আসায় ও অনেকটা আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার কল্যাণে দেশাই-এর নৈতিক’ চিন্তা-চেতনা পূর্বের অপারেশনগুলোর মতো পরিণতি ডেকে আনে। যারা সিকিমে একটি ভয়াবহ রক্তপাত বন্ধ করে সেখানের জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সাহায্য করেছে তাদের অর্থ প্রদান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘র’ অপারেটিভরা অত্যন্ত লজ্জার মধ্যে পড়ে যান। এ ব্যাপারে তাদের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। অবশ্য অন্য কারো বলার মতো কিছু ছিল না।

ঢ। মাঠ পর্যায়ে বিশ্বাস ভঙ্গ (Loss of Faith in the Field)

এই চারটি অপারেশন নিয়ে ‘র’-এর লোকজনের ক্ষোভ ছিল- ছাই চাপা আগুনের মতো। এর সাথে অন্য আরো এই ধরনের ঘটনা ছিল। এটা কোনো সংস্থার নীতি নৈতিকতা বা প্রতিশ্রুতির ব্যাপার নয় বরং মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপার, যখন বিশেষ করে কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা না হয়। যে বিষয়টি এখানে প্রথম সারিতে অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, তা হলো গণতন্ত্রে চাকরির বাধ্য বাধকতা ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তির প্রতি নিবেদিত নয় বরং তাঁর জন্য নির্ধারিত অফিস বা পদের প্রতি অনুগত ও যে কোনো চাকরির উদ্দেশ্যই হলো সরকারি নীতির মধ্যে দেশের স্বার্থে কাজ করে যাওয়া। একজন সরকারি চাকুরে সব সময়ই একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি (অথবা তাকে তা হওয়া উচিত)। তিনি তার সামর্থানুযায়ী অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে সরকারি নীতির অনুসরণে কাজ চালিয়ে যান। তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রদত্ত নীতিমালার ওপর নির্ভর করে তাঁর কাজের দিকনির্দেশ করেন এ বিশ্বাসে যে, তিনি যার জন্য এ কাজ করছেন (বা যার অধীনে) তার পরিবর্তন হলেও ওই কাজের উদ্দেশ্য অপরিবর্তনীয় থাকবে। কোনো চাকরির ক্ষেত্রে কেউ তার ওপরওয়ালা যা শুনতে চান বা তিনি ক্ষমতায় থাকার জন্য যে তথ্য চেয়ে বসেন তা সরবরাহ করতে বাধ্য নন।

কিন্তু দেশাই সরকারের শাসনামলে জনগণের জন্য কাজ ও ব্যক্তিস্বার্থের মধ্যে সীমারেখা উপড়ে ফেলা হয় এবং ব্যাপারটি “দাবা খেলার পরিবর্তে দমন পীড়নমূলক খেলায় পরিণত হয়।”

ণ। ‘র’-এ ধর্মঘট (Strike in RAW)

এরমাঝে বার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ‘র’-কর্মচারীরা একত্রিত হয়ে ‘এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সংগঠন গড়ে তোলে। ১৯৮০ সালের ৫ জুলাই ১৫০ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ধর্মঘট পালন করেন। ট্রেড ইউনিউয়নিজম এভাবে ‘র’-এর সুরক্ষিত আচ্ছাদিত পথে প্রবেশ করে যা কোন ইন্টেলিজেন্স সংস্থার ইতিহাসে কখনো শোনা যায়নি। ‘র’কে নিয়ে ভাঙা গড়ার এ খেলা এভাবেই তার প্রায়শ্চিত্ত করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *