৯. যুদ্ধকালীন সময়ে লুটপাট এবং দুর্নীতির ইতিহাস

নবম অধ্যায় – যুদ্ধকালীন সময়ে লুটপাট এবং দুর্নীতির ইতিহাস

  • আওয়ামী লীগারদের লুটপাটের ইতিহাস শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেই।
  • ব্যাংক ও ট্রেজারী লুটের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে হোমরা-চোমরারা সব ‘জয় বাংলার শেঠ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
  • ঐ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিদের আচরণ মুক্তিযুদ্ধকে কলংকিত করছিল বিধায় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।
  • পূর্ব পাকিস্তান থেকে আনা বিপুল অঙ্কের টাকার কোন হিসাব দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার, লুটপাটেরও কোন বিচার হয়নি।
  • প্রবাসী সরকারের ব্যর্থতা, লুটপাট সমিতির কার্যক্রম এবং নেতাদের বিলাসবহুল জীবন নিয়ে জনাব জহির রায়হান একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এটাও তার রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
  • মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল ভারত সরকার।
  • স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল বামপন্থীরা। ভারত সরকারের মনোভাবও তাদের প্রতি ছিল বিরূপ।
  • নির্বাচিত সাংসদদের মুক্তাঞ্চলে প্রশাসক এবং সেক্টরগুলিতে পলিটিক্যাল কমিসার হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত কার্যকারী করতে ব্যর্থ হয় প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার।

তারা কোলকাতায় বেশ আরাম-আয়েশেই সময় কাটাচ্ছিলেন কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের অসৎ উপায়ে লুটপাট করার কথা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল। এতে তাদের সম্মানেরই শুধু হানি হচ্ছিল তা নয় তাদের অনেকের প্রতিই বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা যেখানে অনাহারে, অস্ত্রহীন-বস্ত্রহীন অবস্থায় দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনবাজী রেখে রণাঙ্গনে লড়ছেন তখন এ সমস্ত অসৎ রাজনীতিবিদ ও লুটেরার দল লুটপাটের বেশুমার টাকায় বিলাসী জীবন যাপন করে বাঙ্গালীদের বদনাম করছিলেন অভি নির্লজ্জভাবে। এ অপমান মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে লুটে আনা হয়েছিল। শুধুমাত্র বগুড়ার ষ্টেট ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছিল ৫৬ কোটি টাকার উপর। এ সমস্ত লুটপাটের সাথে জড়িত ছিলেন রাজনৈতিক নেতারা এবং আমলাদের একটা অংশ। কোটি কোটি টাকা নিয়ে বিদেশের মাটিতে বসে ছিনিমিনি খেলার ন্যাক্কারজনক ইতিহাসের কোন জবাব আওয়ামী লীগ সরকার প্রবাসে কিংবা স্বাধীনতার পর জনগণের কাছে দেয়ার কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি। মনগড়া হিসাবের ফিরিস্তি দিয়ে লুটপাটের কলঙ্ক মোছা যায় না। সংগ্রামকালের লুটপাটের সম্পদে রাতারাতি রাজনৈতিক নেতারা, তাদের পরিবার-পরিজনরা এবং চিহ্নিত কিছু আমলা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলেন। বাড়ি, গাড়ি, সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন ঐ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিরা। সেই সমস্ত রহস্য সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে জনগণের সম্মুখে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। সংগ্রামকালের এক পর্যায়ে ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা একবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার জন্য সর্বপ্রথম এ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার। এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীর সাথে কথাও হয়েছিল। তাকে বোঝানো হয়েছিল এ সমস্ত অসৎ নেতৃত্বের অধিনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হওয়ায় বিশ্ব পরিসরে সংগ্রামের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। শুধু তাই নয় তাদের পার্থিব লোভ-লালসা এবং চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে প্রয়োজনে সম্পূর্ণ জাতিকেই ব্ল্যাকমেইল করা সম্ভব হবে অতি সহজেই। সব শুনে তিনি বলেছিলেন, “অভিযোগ যুক্তি সম্পন্ন কিন্তু তবুও বিদেশের মাটিতে নিজেদের মাঝে কাটাকাটি শুরু করলে মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা দূরে সরে যাব। অবশ্যই এ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে হবে, কিন্তু সেটা দেয়া হবে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে গণআদালতে।” “তার কথা মেনে নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে গণআদালত তো দূরের কথা কোন কোর্ট-আদালতেও ঐ সমস্ত অপরাধিদের বিচার হয়নি। কারণ এ সমস্ত অসৎ কার্যক্রমের সাথে প্রশাসনের প্রায় সব রুই-কাতলাই জড়িত ছিলেন। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে উঠে তখন অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অবস্থাও হয়েছিল ঠিক তাই। লুটপাট, চুরি-চামারির বিচারের পরিবর্তে এ সমস্ত জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের মাত্রা গিয়েছিল অনেক বেড়ে। কর্নেল ওসমানীর কথা শুধু কথা হয়েই থেকে যায়। স্বাধীনতার লগ্ন থেকেই কোন ব্যাপারেই ন্যায়সঙ্গত কোন বিচার পায়নি জাতি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠির কাছ থেকে, শুধু পেয়েছে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, প্রতারণা ও বঞ্চনা।

লুটপাট সমিতির কার্যকলাপে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথা সমস্ত বাঙ্গালী জাতির ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল তার কয়েকটি বিবরণ নিচে দেয়া হল:-

লুটপাট সমিতির সদস্যরা তখন কোলকাতার অভিজাত পাড়াগুলোতে এবং বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিটের হোটেল, বার এবং রেস্তোরাগুলোতে তাদের বেহিসাবী খরচার জন্য ‘জয় বাংলার শেঠ’ বলে পরিচিত। যেখানেই তারা যান মুক্তহস্তে বেশুমার খরচ করেন। থাকেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিংবা হোটেলে। সন্ধ্যার পর হোটেল গ্র্যান্ড, প্রিন্সেস, ম্যাগস, ট্রিংকাস, ব্লু ফক্স, মলিন রু্য, হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি বার রেষ্টুরেন্টগুলো জয়বাংলার শেঠদের ভীড়ে জমে উঠে। দামী পানীয় ও খাবারের সাথে সাথে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আমেজে রঙ্গীন হয়ে উঠে তাদের আয়েশী জীবন বয়-বাবুর্চিরাও তাদের আগমনে ভীষণ খুশি হন। এমনই একজন নেতা তার দলবল নিয়ে প্রত্যেক দিন হোটেল গ্র্যান্ডের বারে মদ্যপান করতেন। তিনি বগুড়া ব্যাংক লুটের টাকার একটা বিরাট অংশ কব্জা করেছেন কোনভাবে। তার কাছে রয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। একদিন মধ্যরাতে তিনি হোটেল বারে গিয়ে মদ পরিবেশন করার জন্য

বারম্যানদের হুকুম দেন। বারম্যানরা কাচুমাচু হয়ে তাকে জবাব দেয় সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জবাব শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন বাঙ্গালী শেঠ I টলমল অবস্থায় চিৎকার করে বলতে থাকেন, তিনি হোটেলটাই পুরো কিনে নিতে চান। বেসামাল কিন্তু শাসালো খদ্দের, তাই বারম্যানরা চুপ করে সবকিছু হজম করে যাচ্ছিল। শেঠ আবোল-তাবোল বকে পরে একজন বারম্যানকে হুকুম দেন, “কাল বার খোলার সময় থেকে বন্ধ করার আগ পর্যন্ত তিনি ও তার সঙ্গীগণ ছাড়া অন্য কাউকে মদ পরিবেশন করা যাবে না। তারাই শুধু থাকবেন বারে।” তার হুকুম শুনে বারম্যান ম্যানেজারকে ডেকে পাঠায়। ম্যানেজার এলে শেঠ তাকে প্রশ্ন করেন, “রোজ আপনাদের বারের সেল কত টাকা?” ম্যানেজার একটা অংক তাকে জানায়। শেঠ তখন তাকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেন পুরোদিনের সেলের টাকাই তিনি পরিশোধ করবেন। পুরো টাকার মদ ওরা খেয়ে শেষ করতে না পারলে বাকি মদ যেন তার বাথরুমের টাবে ভরে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি তাতে গোসল করবেন। ম্যানেজার তার কথা শুনে ‘থ হয়ে গিয়ে মাতালের প্রলাপ মনে করে কোন রকমে সেখান থেকে কেটে পড়েন।

আর একদিন আর একজন জয়বাংলার শেঠ তার পুত্রের প্রথমবারের মত জুতো পরার দিনটি উৎযাপন করার জন্য ব্লু ফক্স রেষ্টুরেন্টে প্রায় ১০০ জনের একটি শানদার পার্টি দেন। এছাড়া অনেক শেঠরা দিল্লী এবং বোম্বেতে গিয়ে বাড়িঘর কিনতে থাকেন। অনেকে আবার ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তাদের এ সমস্ত কির্তিকলাপের ওপর শহীদ জহির রায়হান একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এ অভিপ্রায়ে অনেকেই ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন তার উপর। অনেকে তার এ ঔদ্ধত্ত্বে ক্ষেপেও গিয়েছিলেন। তার রহস্যজনক মৃত্যুর পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে। কোন এক নায়িকার জন্মদিনে তখনকার দিনে তার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত তাকে ৯ লক্ষ টাকা দামের হীরের নেকলেস উপহার দিয়েছিলেন।

দরগা রোডের বিশু বাবুর বাড়িতে থাকতেন মন্ত্রী পরিষদের পরিবারবর্গ। প্রবাসী সরকারের টাকার প্রায় সবটাই কালো কালো ট্রাঙ্কে ভরে রাখা হয়েছিল বিশু বাবুর বাড়িতে এবং ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ এর তিন তলার ছাদের দু’টো কামরায়। সেখানে থাকতেন অর্থসচিব জনাব সামসুজ্জামান এবং তার পরিবার ও রাফি আক্তার ডলি। এ টাকার কোন হিসাব ছিল না। কোলকাতার বড় বাজারের মারোয়াড়ীদের সাহায্যে এগুলোর এক্সচেঞ্জ করা হত। এ কাজের দালালী করেও অনেকে কোটিপতি হয়ে উঠেন রাতারাতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগ নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হলেও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা লোভ সংবরণ করতে না পেরে অসৎ হয়ে উঠেন।

কোন এক সেক্টর কমান্ডার এক পাকিস্তানী সিএসপি অফিসারের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বেয়োনেটের আঘাতে মেরে তার গা থেকে সোনার অলংকার খুলে নিয়েছিলেন; এমন ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরণের কিছু ব্যক্তি নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেছেন আজ অব্দি। কিন্তু তারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কলংক। তাদের অপকর্মের জন্য সাধারণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কলংকের ভাগী হতে হয়েছে।

যুব শিবির, শরনার্থী শিবিরগুলোতে বরাদ্দকৃত রিলিফ সামগ্রী নিয়েও কেলেংকারী হয়েছে অনেক। ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল প্রায় ১ কোটি শরনার্থী। তাদের জন্য সারাবিশ্ব থেকে রিলিফ সামগ্রী, যানবাহন ভারতীয় সরকারের প্রযত্নে প্রচুর এসেছিল। কিন্তু তার কতটুকুইবা দেয়া হয়েছিল শরনার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে। এ সমস্ত রিলিফ সামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব ছিল যৌথভাবে ভারত ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের। বগুড়ার ষ্টেট ব্যাংক ছাড়াও মোটা অংকের টাকা নিয়ে আসা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাবনার ট্রেজারি থেকে। সে টাকারও কোন সুষ্ঠ হিসাব পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল, তাদের নেতৃবর্গ এবং কর্মীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে যা দেখেছিলাম তার কিছুটা বিবরণ দেয়া উচিত।

মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশ থেকে আসামে পালিয়ে আসার পর থেকেই ভারতীয় সরকারের প্রটেকটিভ কাষ্টডিতে আটক হয়ে থাকেন। মজলুম নেতাকে নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত ছিল ভারত সরকার। প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে তিনি যাতে কোন প্রকার নেতৃত্ব দিতে না পারেন তার জন্য অতি সতর্কতার সাথে এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারত সরকার এবং আওয়ামী লীগ কখন মাওলানাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তার সাথে তার দলীয় নেতা ও কর্মীদেরকেও কোন প্রকার যোগাযোগ রক্ষা করতে দেয়া হয়নি পুরো নয়টি মাস। ভাসানী, ন্যাপের কর্মী ও যুবনেতারা অল্পদিনেই বুঝতে পেরেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের কাছে তারা খুব একটা গ্রহণযোগ্য নন। মাওলানা ভাসানী এবং প্রগতিশীল যুব নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগ নেতাদের দলীয় সরকারের পরিবর্তে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের আবেদন জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের সে আবেদনে আওয়ামী লীগ কিংবা ভারতীয় সরকার কেউই সাড়া দেয়নি বরং আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার যুদ্ধকালীন অবস্থায় প্রয়োজনমত মাওলানাকে ব্যবহার করার চেষ্টাই করেছে। কিন্তু মাওলানা ভাসানী সে ফাদে পা দেননি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জনাব মশিউর রহমান যাদুমিয়া একবার কোলকাতায় এসেছিলেন। কোলকাতায় তিনি তার দলীয় প্রধান মাওলানা ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে ব্যর্থ হন। তবে তিনি তার দলীয় যুব ও ছাত্রনেতাদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে মত বিনিময়কালে তিনি বুঝতে পারেন ভারতের মাটিতে বসে তিনি কিংবা তার দলীয় কর্মীরা স্বাধীনতার যুদ্ধে তেমন বিশেষ কোন ভূমিকা

রাখতে পারবেন না। তারা ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনরূপ সাহায্যও পাবেন না, তাই তিনি দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে গেরিলাযুদ্ধ সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সেরূপ নির্দেশ কর্মীদের দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান। কোলকাতায় অবস্থানকালে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ সর্বক্ষণ তাকে নজরে রাখে। আওয়ামী সরকারও তার আগমনকে সন্দেহের চোখে দেখেছিল। তার চলে যাবার পর মেনন, জাফর, রনোরা সম্মিলিতভাবে স্বীয় উদ্যোগে তাদের কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। বামপন্থী দলগুলোর বেশিরভাগ নেতারা বিশেষ করে চীনপন্থী দলগুলোর নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামের যথার্থ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন। তারা এ সংগ্রামকে ‘কুকুরে কুকুরে লড়াই’ বলে ভুলভাবে আক্ষায়িত করে জাতীয় সংগ্রামকে উপেক্ষা করে শ্রেণী সংগ্রামের লাইন চলিয়ে যাবার প্রচেষ্টা করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তবে তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নেতা তাদের ভুল বুঝতে পেরে পরবর্তিকালে স্বাধীনতার জন্য পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের ভেতরে থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার ভুল মূল্যায়নের জন্য প্রগতিশীল এবং বামপন্থীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। তাদের এই দুর্বলতা এবং ভূল পরবর্তিকালে অনেকেই স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আজো অনেক পিছিয়ে আছে। তার জন্য আমাদের প্রগতিশীল ও বামপন্থী রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা অনেকাংশে দায়ী। ভারতের মস্কোপন্থীরা যেভাবে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করে আসছিল ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের তথাকথিত মস্কোপন্থীরা সংগ্রামের সময় পুরোপুরিভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছিল। প্রভুদের ইঙ্গিতে তাদের নিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখাবার জন্য তথাকথিত পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ৮ সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করেছিল প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার। প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহু মিটিং এবং আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এবং মুজিবনগরে অবস্থিত আমলাদের নিতে হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা মুক্ত এলাকায় এমএনএ, এমপিএ এবং কোলকাতাবাসী আমলাদের অধিকাংশই যেতে রাজি হননি। ফলে তাদের সব দায়িত্বই বহন করতে হয়েছিল সেক্টর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডারদের। মাঝেমধ্যে কোলকাতার মুজিবনগর থেকে নামি-দামী নেতারা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেন মুক্তিযোদ্ধাদের মটিভেশন লেকচার দেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ ধরণের মিশনে এসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ভীষণ বেকায়দায় পড়তে হত। মুক্তিযোদ্ধাদের ফেস করতে পারতেন না তারা। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বলতেন, “গালভরা কথার ফুলঝুড়ি শোনানোর দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা যুদ্ধ করছি জানবাজী রেখে। আমাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদপত্রের কি ব্যবস্থা করে এসেছেন সেটাই আমরা জানতে চাই। আমাদের সমস্যার অন্তঃ নেই। সমস্যার সমাধান যদি করতে না পারেন তবে অন্ততঃপক্ষে আমাদের সাথে থেকে সে সমস্ত সমস্যার ভাগীদার তো হতে পারেন। আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে শুধু ছবি তোলার জন্য আর বক্তৃতা দেয়ার জন্য এসে আমাদের সময় নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। আপনারাও এ বৃথা কষ্ট না করে মুজিবনগরে বসে থাকুন। দেশ স্বাধীন হলে দেখা হবে।”

মুক্তিযোদ্ধাদের এ ধরণের বক্তব্য শুনে মুজিবনগরের আওয়ামী সরকার এবং ভারত সরকার একইভাবে শংকিত হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডারদের আনুগত্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে তারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *