৯
উজির নাজির এসে যমদূতের মতো উপস্থিত হলো।
বাবা, এখানে বসে গাঁজা মারছ ওদিকে রান্না কখন হয়ে গেছে। খেতে হবে না? চল চল। পরান মাস্টার আমাকে ধরে চাপা গলায় বলল, দেখলি ছেলের ব্যবহারটা দেখলি? বাপের সঙ্গে বাক্যালাপ করার ধরনটা দেখলি?
আমিই এবার তাড়া দিলাম। বললাম, চলুন, আগে চা খেয়ে নেই।
ফিরতে ফিরতে পরান মাস্টার হঠাৎ হেসে ফেলে বলল, মাইন্ড করিসনে। ছেলে দুটো ভালো, খুবই ভদ্র, হাজার হোক মাস্টারের ছেলে তো? তবে কিনা, তোর বাজার করে দেবার দরুন ভালো-মন্দ রান্না হয়েছে তো, দেখে গণ্ডে পিণ্ডে গেলবার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। তাই কাকে কী বলছে কোনো খেয়াল নেই। গবর এগুলো আস্ত গবর।
আমি বড় চিন্তিত হয়ে খেতে বসলাম। নানা রকম কারণে চিন্তাটা বেশ পাকিয়ে উঠল। পরান মাস্টার কি সত্যিই পাগল? বীথিপৃর কথাটা কি আগাগোড়াই বানানো? আর সেই যুবতী? শেষ পর্যন্ত কি পরান মাস্টার বীথিতেও সন্তানের পিতা হতে চলেছে? যদি বানানো কাহিনীই হয়, তাহলে রচনার উদ্দেশ্য কী?
যদি হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে, তাহলে এর উৎস কোথায়? অনাহারে? না, এখন এই শেষ ধাপে এসে যেমন ইশারা পেলাম, শরীরের অপর তৃষ্ণার দরুন?
কিন্তু আমি নিজেই এখন কাহিনীটি অবিশ্বাস করবার দিকে ঝুঁকে পড়েছি। কেন? শুধু এই যে, পরান মাস্টার বাংলাদেশের এক প্রাইমারি ইস্কুলের চাকরি হারানো, দারিদ্র্যপীড়িত শিক্ষক? কই ইংরেজি বইতে যখন পড়েছি, ফ্রান্সের এক দরিদ্র কৃষক রমণী তার আলুক্ষেতে অপর গ্রহের জীব ঘোরাফেরা করতে দেখেছে, তখন তো অবিশ্বাস একেবারে করি নি? শুধু আমি কেন খোদ সভ্য দেশের মানুষগুলো তো লাখ লাখ কপি সে সব বই কিনে গোগ্রাসে গিলেছে। যখন পড়েছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উড়ন্ত পিরীচ দেখা গেছে; যখন ঝকঝকে পকেট বুকে পড়েছি ব্রাজিলের এক যুবককে স্পেসশীপ এসে নিয়ে যায়, তাকে এক ভিন্ন গ্রহের রমণীর সঙ্গে তারা মিলিত করে, তখন তো বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করেছি। আর এই জলেশ্বরীতে বসে পরান মাস্টারের কথা গাঁজা বলে উড়িয়ে দিচ্ছি? কেন? নিতান্ত বাংলাদেশের মানুষ বলে? অপর জগতের মানুষের সাক্ষাৎ পাবারও উপযুক্ত আমরা নই? এতই দরিদ্র আমরা যে কল্পনাবিলাস থেকেও বঞ্চিত?
মোটামুটি চাঁদের আলোতেই আহার শেষ হলো। বাজার থেকে দুটো মোমবাতিও কিনে এনেছিলাম। আমার জানাই ছিল যে, এ বাড়িতে আলো জ্বালাবার পাট অনেকদিন আগেই উঠে গেছে। আহার শেষ হতে না হতেই পরান মাস্টার ফুঁ দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল।
চাঁদের আলোয় এঁটো হাত ধুচ্ছি, বড় মেয়ে দুলি আমার হাতে পানি ঢেলে দিচ্ছে। হঠাৎ চোখ তুলে তাকে দেখে বড় মিষ্টি লাগল। মনে পড়ে গেল এই মেয়েটির বিয়ের বাজাব করতে গিয়েই পরান মাস্টার সর্বস্বান্ত হয়ে ফেরে।
আমাকে তাকাতে দেখেই দুলি লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল।
তোমার নামই তো দুলি?
মাথা দুলিয়ে নীরবে হাঁ বলল সে। আর কী বলতে পারি? বললাম, ভালো আছ তো? বলেই বুঝলাম এ সংসারে এর চেয়ে নির্মম প্রশ্ন আর কিছু নয়। অপ্রতিভ গলায় উচ্চারণ করতে শুনলাম নিজেকে, তা দুলি তুমি একবার এসো না আমাদের বাড়িতে, বেড়িয়ে যেও। তোমাকে সেই কত ছোট দেখেছিলাম।
অন্ধকারের ভেতর দুলি আত্মগোপন করল।
ফুলি আমার হাতে পান দিল।
ফুলির মুখের দিকে তাকালাম। বুকের ভেতরে বড় মায়া করে উঠল আমার। বললাম, ফুলি না?
হাঁ!
তোমাকেও অনেক ছোট দেখেছিলাম।
পাশ ফিরে দেখি ছোট মেয়েটি আমার হাতঘড়িটা অবাক হয়ে দেখছে। ডিজিটাল ঘড়ির লেখা পাল্টাচ্ছে টক-টক করে, দেখে হাঁ হয়ে গেছে। মুখখানা দেখেই বোঝা যায় একেবারে ছেলেমানুষ নয়, কিন্তু অপুষ্ট দেহ থেকে শৈশব যায় নি।
পরপর তিনটি মুখ আমার সমুখ দিয়ে পার হয়ে গেল, যেন একটি নীরব আর্তনাদের মিছিল দেখলাম।
পরান মাস্টার বলল, বসবি আবার? কালভার্টে?
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, এখন থাক না? আমার বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, সেটাই বাস্তবে দাঁড় করিয়ে বললাম, শরীরটা ভালো লাগছে না, যাই।
পরদিন সকালে আমি ইস্টিশানের লাগায়ো সেই চায়ের দোকানে গেলাম। এবং সেখানে তরুণদের সঙ্গে ভাব করতে গেলাম। ওদের কেউ কি দুলিকে বিয়ে করবে না? আমি যদি উদ্যোগী হই? ফুলিকে? আমি যদি কিছু সাহায্য করি?
কিন্তু কথাটা তো একদিনেই তোলা যাবে না, সময় লাগবে; তাছাড়া আমাকেও বুঝে দেখতে হবে, এদের ভেতরে কে ভালো ছেলে, কার উপার্জন আছে। ওদের ভেতরে একটি ছেলে আমার বেশ চোখে পড়েছিল, আমি দোকানে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে এখন হাসলাম। না, বেশ ভদ্র আছে। একেবারে উঠে এল আমার কাছে, অপ্রস্তুত একটু হেসে বলল, বসবেন না কি? আসন নেবার সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, আমার খুব লন্ডনের গল্প শুনতে ইচ্ছে করে।
তাই?
আগ্রহের সঙ্গে আরো কয়েকজন আমার কাছে ঘনিয়ে বসল।
একজন প্রশ্ন করল, আচ্ছা লন্ডনে না কি মাটির নিচে সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেন চলে?
মানুষের দম বন্ধ হয়ে যায় না? যদি সুড়ঙ্গ ধসে পড়ে? ভয় করে না?
হাজার রকমের প্রশ্ন।
একে একে উত্তর দিয়ে চললাম, বর্ণনা করে চললাম, ওরা হাঁ করে শুনতে লাগল। হঠাৎ আমার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে এল।
বললাম, তোমাদের এ সব বিশ্বাস হচ্ছে?
ওরা অবাক হয়ে বলল, হাঁ, হবে না কেন?
কেন হবে?
আপনি সেখানে গেছেন যে, দেখে এসেছেন যে, বাহ।
এতক্ষণে বেশ জমে উঠেছিল ওদের সঙ্গে। পরিহাসের সুরে প্রশ্ন করলাম, তাহলে পরান মাস্টারের কথা বিশ্বাস কর না কেন।
হা হা করে হেসে উঠল ওরা, যেন ভারি মজার কথা বলেছি। বললাম, উনিও তো বলছেন, উনি গিয়েছেন।
যে ছেলেটিকে আমার গোড়াতেই পছন্দ হয়েছিল সে বলল, আপনার নিজের কি বিশ্বাস হয় এসব শুনে?
উত্তর দিলাম না।
ছেলেটি আবার বলল, আপনি কি মনে করেন না উনি পাগল?
উত্তর দিলাম, না, আমি মনে করি না, উনি পাগল।
আপনি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।
প্রশ্ন করলাম, তাহলে বল, পাগল তোমার কাকে বলবে?
যে পাগল সে-ই পাগল।
ক পাগল?
পাগলই পাগল।
তরুণেরা উত্তর দিচ্ছে বটে, আমি কিন্তু লক্ষ করছি যে তারা বিহ্বলবোধ করতে শুরু করে দিয়েছে।
বললাম, তোমরা কিন্তু চরকি ঘোরার মতো ঘুরছো। পাগলকে পাগল বলছ, কিন্তু কে পাগল তা বলতে পারছ না, কেন একটা লোককে পাগল বলবে তা বুঝাতে পারছ না।
হঠাৎ তরুণদের একসঙ্গে চোখ তুলতে দেখে আমিও পেছন ফিরে দেখি দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে পরান মাস্টার।
সে ভেতরে এসে বলল, আমার কথা হচ্ছিল বুঝি? আমি ছাড়া তো আপনাদের কোনো কথা নেই। পাগলই বলুন আর যাই বলুন, সবার মাথার মধ্যে বসে আছি তো? বলেই পরান মাস্টার খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগল।
তরুণেরা আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবং প্রায় একই সঙ্গে। চোখে যেন একই প্রশ্ন সবার, এখন বলুন এ লোক পাগল নয় তো কি?
চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।
একজন তরুণ বলল, ও মাস্টার সাব এক কাপ চা খাবেন?
খাওয়াবেন?
চায়ের সঙ্গে টা-ও খেতে পারেন।
পরান মাস্টার ইতস্তত করে উঠল। বুঝতে পারলাম, এই আতিথ্যের প্রস্তাব সে সরল মনে নিতে পারছে না, তার কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছে। পরান মাস্টার বলেই ফেলল, আজ এত খাতির করছেন যে? অন্য দিন তো পাগল বলে হা-হা করে হাসেন।
বারে বা, আপনি ভুলে গেছেন? কতদিন আপনি নিজেই চা খেতে চেয়েছেন, খাওয়াই নি আমরা?
ও হাঁ, তাও তো এক কথা, আচ্ছা, হোক চা। বলে পরান মাস্টার নিজেই উঠে গিয়ে মিষ্টির আলমারির সমুখে দাঁড়াল। দোকানিকে বলল, ভিজে গজা করেন নি, ভাই? বড্ড ভিজে গজার সাধ হচ্ছিল।
পরান মাস্টার আলমারির কাছে উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এক তরুণ আমাকে হাতে ঠেলা দিয়ে বলল, আপনি যে বলেছিলেন, উনি পাগল কী করে বুঝলাম? ওঁর গল্প বোধহয় শোনেন নি। বদ্ধ পাগল না হলে কারো মাথায় ওসব কথা আসে না। আমরা পয়লা পয়লা মনে করেছিলোম, মাস্টার সাব বোধহয় মহাতামাক অভ্যেস করেছেন। পরে দেখি না তা নয়, আরো ওপরে উঠে গেছেন।
সকলে চাপা গলায় হেসে উঠল এ কথা শুনে।
পরান মাস্টার হাতের থাবায় দুখানা বালুসাই এনে, বেঞ্চের ওপর পা তুলে বসে, বড় এক কামড়ে একখানা আস্ত উড়িয়ে দিল। আরেকটাতে কামড় দিতে গিয়েও থেমে গেল সে, হঠাৎ সকলের দিকে লজ্জিত হাসি ছুঁড়ে বালুসাইখানা কোমরে গুঁজে রেখে বলল, চান বড়ুর জন্য।
একজন বলল, মাস্টার সাব একে আপনি সেই যে সেই গল্পটা বলেছেন?
তরুণের চোখের টুসকি দেখেই ধরে ফেলল পরান মাস্টার। বলল, সেইটা তো?
হাঁ, বলেছেন?
পরান মাস্টার চোখে সন্দেহ নিয়ে কিছুক্ষণ সবাইকে দেখল, তারপর বলল, না, আপনারা বিশ্বাস করেন না, এখানে বলব না।
বলুন না, বলুন।
তরুণটি আমার কানে ফিসফিস করে বলল, শুনেই দেখুন যদি আপনি নিজেই পাগল না বলেন তো, কী বলেছি।
বলব? পরান মাস্টার ইতস্তত করে; একবার তরুণদের দিকে চোখ রাখে, একবার আমার দিকে। বলব?
হাঁ বলুন বলুন।
মাইরি বলছি, আজ অবিশ্বাস করলে ফাটাফাটি হয়ে যাবে। রক্তারক্তি হয়ে যাবে। হাঁ। আমি বড় অস্বস্তিবোধ করে উঠলাম। ভাবলাম, পরান মাস্টারকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাই; শেষে একটা গণ্ডগোল না হয়ে যায়।
ঠিক তখনই পরান মাস্টার আমার দিকে হেসে বলল, তাহলে বলি। সেদিন তোকে বলতে গিয়ে ও বলা হলো না; পিণ্ডি গেলবার জন্যে ছুটতে হলো। শালা এই পিণ্ডির ডাক পড়ল ব্ৰহ্মাণ্ড পর্যন্ত হাত ধুয়ে নড়ে চড়ে বসে।