৯. মাঝরাত

মাঝরাত হতে তখনো দশ মিনিট বাকি। মিটিং শেষে ফ্রিম্যাসন হল থেকে বেরিয়ে এলেন মি. পিটার কার্টরাইট। তিনি এই লজের প্রেসিডেন্টও। সব সময়কার মত হলের পিছনে পার্ক করে রাখা মরিসে উঠে চাবি ঘুরাতেই ঘাড়ের পেছনে ঠাণ্ডা আর শক্ত কিছুর উপস্থিতির সাথে সাথে শুনলেন, “এটা একটা পিস্তল মি. কার্টরাইট। যা বলা হবে তা না করলে মাথায় গুলি ঢুকে যাবে। ব্যাঙ্কে চলুন প্লিজ।”

পেছনের সিটে মাস্ক পরে বসে থাকা দু’জনের ভয়ে আতঙ্কিত কার্টরাইট ব্যাংকের কাছে এসে পেছনের দরজায় পার্ক করলেন মরিস। গত কয়েক মাসেই না হলেও চারটা ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। আর একটাতে ব্যাংকের গার্ড গুলি খেয়ে মারা গেছে। তাই কার্টরাইটেরও বুঝতে কষ্ট হল না যে কী ঘটছে।

মরিস থেকে নামার সাথে সাথে দু’পাশ থেকে দুজন মিলে তাকে ধরে নিয়ে এল ব্যাঙ্কের দরজার কাছে। একজন পিস্তলের হাতল দিয়ে বাইরে থেকে নক করতেই বিস্মিত কার্টরাইটের চোখের সামনে ভেতর থেকে খুলে গেল দরজা। আর তখনই বুঝতে পারলেন যে ডাকাতেরা কীভাবে এতটা এগোতে পেরেছে। মাথা ভর্তি এলোমেলো চুল আর ভয়ে ছাই হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে পাজামা আর ড্রেসিং গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছেন তার সিনিয়র অ্যাকাউনট্যান্ট উইলেম ডি কক। নিশ্চয় তাকেও বিছানা থেকে টেনে আনা হয়েছে।

“আয়্যাম, সরি, মিঃ কার্টরাইট” তোতলাতে লাগলেন ডি কক, “ওরা আমাকে জোর করে বাধ্য করেছে।”

“নিজেকে সামলাও, ম্যান।” ডি ককের উদ্দেশে খেঁকিয়ে উঠলেন কার্টরাইট, কিন্তু আচমকা দুই নারীকে দেখে সম্পূর্ণ বদলে গেল তার অভিব্যক্তি : ডি ককের ছোটখাট মোটাসোটা পত্নী আর তার নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মেরি।

“পিটার” কেঁদে উঠল মেরি, “ওহ, পিটার ওদেরকে মানা করো যেন কিছু করে।”

“স্টপ দ্যাট মেরি। ওদের সামনে এতটা দুর্বল হয়ো না।”

ডাকাতদের দিকে তাকালেন কার্টরাইট। তার দুপাশের দু’জনসহ মোট ছয়জন। তবে লিডারকে চিনে নিতে মোটেও ভুল করলেন না প্রাজ্ঞ কার্টরাইট। লম্বা, শক্তিশালী গড়নের লোকটার মাস্ক ভেদ করেও দেখা যাচ্ছে শিকারি পশুর মত অদ্ভুত ধূসর একজোড়া চোখ; যার মাঝে সহানুভূতির লেশমাত্র নেই।

“ভল্ট খুলুন।” ভারি কণ্ঠে আদেশ দিল লিডার।

“আমার কাছে চাবি নেই” কার্টরাইটের উত্তর শুনেই মেরির কব্জি ধরে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিল হলুদ চোখের লিডার।

“খবরদার বলছি।” চিৎকার দিয়ে উঠলেন কার্টরাইট; কিন্তু মেরির মাথায় সহজভাবেই পিস্তলের নল ঠেকাল লিডার।

“আমার স্ত্রী সন্তান-সম্ভবা।” আবার বলে উঠলেন কার্টরাইট। “তাহলে তো আপনি তাকে আর কষ্ট না দিলেই ভালো করবেন।

“খুলে দাও পিটার। এগুলো তো আমাদের টাকা নয়। ওরা নিয়ে যাক।” আর্তচিৎকার জুড়ে দিলেন মেরি আর তারপরই প্রস্রাব করে দেয়াতে ভিজে গেল ড্রেসিং গাউনের স্কার্ট।

ভল্টের সবুজ রঙা স্টিলের দরজার কাছে গিয়ে পকেট থেকে চেইন লাগানো ঘড়ি বের করলেন কার্টরাইট। যেখানে চাবিও আছে। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হলেও কিছু করার নেই। খুলে দিলেন লক। তারপর সবাই যখন মনোযোগ দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে তখন নিজের ডেস্কের দিকে তাকালেন কার্টরাইট। ডান পাশের ড্রয়ারে সবসময় একটা ওয়েবলি পিস্তল থাকে।

“টাকা বের করে নাও!” লিডারের আদেশ পেয়ে কিট ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এল তিন আততায়ী।

“আমার স্ত্রী, আমি ওর কাছে যেতে চাই।” কেউ কোনো বাধা দিল না দেখে মেরিকে আস্তে করে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন কার্টরাইট। তারপর আলতো করে ড্রয়ারটা খুলে ফেললেন।

পিস্তল তুলে ঢুকিয়ে ফেললেন অ্যাপ্রনের পকেটে।

এরপর ডি ককের পাশে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। অপেক্ষা করছেন কখন বেরিয়ে আসবে তিন ডাকাত। একটু পরে সবাই যখন আবার মনোযোগ দিয়ে ক্যানভাসের ব্যাগগুলো দেখছে, গুলি ছুড়লেন কার্টরাইট। রুমের ওপাশের দেয়ালে লাগল বুলেট। কিন্তু এর প্রায় সাথে সাথে লুগার বুলেটের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল তার শরীর। নিজের রক্তের পুকুরে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়লেন কার্টরাইট।

***

র‍্যান্ড ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে দু’জন মৃত।

 ওবির সাথে পাওয়া গেছে সম্পর্ক। ওবি শব্দটাতে আটকে গেল সারাহ স্ট্যান্ডারের চোখ। ছেলেমেয়ের জন্য চকোলেট কিনে দোকানের বাইরে এসে এক কপি নিউজ পেপারও কিনে নিল সারাহ।

 রাস্তা পেরিয়ে এসে পার্কের বেঞ্চিতে বসে চোখের সামনে মেলে ধরল নিউজ পেপার।

গত রাতের সম্পূর্ণ ঘটনাসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লেইন ম্যালকমসের অনুরোধও ছাপা হয়েছে আজকের পত্রিকায়। যেখানে জোহানেসবার্গ আর কেপটাউনের নির্দিষ্ট দুটি নাম্বার দিয়ে অপরাধী সম্পর্কে তথ্য জানানোর জন্য বলা হয়েছে। তাছাড়া তথ্যদাতার পরিচয় গোপনের ব্যাপারেও সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।

প্রায় এক ঘণ্টা অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল সারাহ। পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ততা আর দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের মাঝে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতেও দোটানায় পড়ে গেল। স্বাধীনতা আর ন্যায়বিচারের নামে ট্রেন বা ব্যাংক উড়িয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা করাটা কি ঠিক হচ্ছে? নিজের স্বামী-সন্তানকে বাঁচাতে চাওয়াটা কি বিশ্বাসঘাতকতা? ম্যানফ্রেড ডি লা রে কে না থামালে আরো যে কতো মানুষ মারা যাবে তা কে না জানে? গৃহযুদ্ধ শুরু হলে দেশে কত অরাজক অবস্থা নেমে আসবে তাও বেশ বুঝতে পারছে সারাহ। পেপার দেখে নাম্বার দুটো মুখস্থ করে নিল তাড়াতাড়ি।

তারপর ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাস্তা ধরে পোস্ট অফিসের দিকে হাঁটা ধরল। অফিসের জানালা দিয়ে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন পোস্টমাস্টার। এ লোকটাকেও ওবি’র ইউনিফর্মে দেখেছে সারাহ।

 সাথে সাথে কেপে উঠল কী করতে যাচ্ছে ভেবে। কারণ সব টেলিফোন কলই পোস্ট অফিসের এক্সচেঞ্জ হয়ে যায়। দ্রুত মোড় নিয়ে তাই কসাইয়ের দোকানের দিকে হাঁটা ধরল। যেন এটাই তার পরিকল্পনা ছিলো। পর্কের চপ কিনে বাসায় চলে এল।

রান্নাঘরে ঢুকতেই শুনতে পেল রুলফের স্টাডিতে বেশ কয়েকজনের উত্তেজিত আলোচনা চলছে। ম্যানফ্রেডের কণ্ঠ শুনে বেড়ে গেল সারাহর হার্টবিট। প্রায় তিন সপ্তাহ পর এখানে এল ম্যানি।

যাই হোক, রুলফ আর বাচ্চাদের জন্য ডিনার বানাতে বসে গেল সারাহ। তবে সামনের স্টাডি থেকে ভেসে আসা কথাগুলোও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। একবার ম্যানি বলল যে, “আমি যখন জোহানেসবার্গে ছিলাম” তার মানে ম্যানিও জোহানেসবার্গে ছিল। পেপারে পড়েছে মৃত ব্যাংক ম্যানেজারের নাকি গর্ভবতী স্ত্রী আর দুইটা ছোট ছোট ছেলেমেয়েও আছে। না জানি সেই নারীর মনের অবস্থা এখন কী হয়েছে।

“ওহ, খোদা এসব কখন শেষ হবে?” আপন মনেই ভাবছে সারাহ, “ম্যানি কেন আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে না”

***

উইটওয়াটারস্রান্ড থেকে একাই র‍্যাপিড চালিয়ে চলে এল শাসা। অন্ধকার নামার পরে ল্যান্ড করলেও তৎক্ষণাৎ গাড়ি চালিয়ে নিউল্যান্ডে ব্লেইনের দরজায় এসে কড়া নাড়ল।

 তারাই দরজা খুলল। আর শাসাকে দেখে সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেয়েটার চেহারা। “ওহ ডার্লিং, তোমাকে যে কত মিস্ করেছি!” পরস্পরের উপর হামলে পড়ে কি করল দু’জনে। অবশেষে ব্লেইন এসে দুই ছেলেমেয়েকে আলাদা করলেন।

“লুক শাসা, আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না; কিন্তু যদি খানিকটা সময় পাও তো আমাকে রিপোর্টটা জানিয়ে যেও।”

লজ্জা পেলেও লাল হয়ে খেঁকিয়ে উঠল তারা, “ড্যাডি, তুমি আমাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করছিলে?”

 “সারা দুনিয়াকে জানিয়েই তো তুমি সব করছ ডিয়ার। যাই হোক, শাসা চলল।”

স্টাডিতে ঢুকে শাসাকে চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন ব্লেইন। জানতে চাইলেন।

“ড্রিংক?”

 “কেবল জিঞ্জার বিয়ার।”

“এখন বলো কী এমন ঘটেছে যা তুমি টেলিফোনে বলতে চাওনি?” নিজের জন্য হুইস্কি নিয়ে শাসাকে জিঞ্জার বিয়ার দিলেন ব্লেইন।

“ভাগ্য অবশেষে আমাদের উপর মুখ তুলে তাকিয়েছে, স্যার।” ব্লেইনের নির্দেশেই জোহানেসবার্গ গিয়ে ব্যাংক ডাকাতির তদন্ত করে এসেছে শাসা। সেখানে আটককৃত ডাকাতকেও জেরা করেছে। আপনি তো জানেনই যে লোকটা ক্রাউন মাইনে কাজ করে। নাম লরেন। আমাদের ওবি লিস্টেও তার নাম আছে। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টরকে বলেছি যে আপনি উত্তর।

“কোনো অত্যাচার নয়।” ঐ কুঁচকে তাকালেন ব্লেইন।

“না, স্যার, তার প্রয়োজনও হয়নি। লরেন মোটেও শক্ত ধাচের নয়। আমরা কেবল বলেছি যে, এই অপরাধের শাস্তি ফাঁসি হলেও যদি সে সহযোগিতা করে তাহলে আপোস করা হবে। আর সাথে সাথে গড়গড় করে সব বলে দিয়েছে। তবে লিডারের সাথে ডাকাতির মাত্র তিনদিন আগে দেখা হওয়ায় তার নাম কিংবা ঠিকানা জানতে পারেনি।”

“কোনো বর্ণনাও দেয়নি?”

“ইয়েস। লিডার দেখতে নাকি বেশ বড়সড়, কালো চুল আর দাড়ি, বাকানো নাক, এক চোখের উপর ক্ষতচিহ্নের দাগ, তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছে।”

“কী?”

একটা কোর্ড নেইম। লিডার নাকি হোয়াইট সোর্ড নামে পরিচিত। আর একেবারে টপ লেবেল থেকেই তাকে সাহায্য করার আদেশ দেয়া হয়েছে।”

“হোয়াইট সোর্ড!” গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন ব্লেইন।

“আমি ইন্সপেক্টরকে বলে এসেছি যে, আপনি আদেশ না দেয়া পর্যন্ত যেন এ কোড় নেইম আর বর্ণনা কাউকে না দেয়া হয়।

“গুড।” হুইস্কিতে চুমুক দিলেন তৃপ্ত ব্লেইন। যাক শাসার ওপর ভরসা করে তিনি ঠকবেন না। বললেন, “হোয়াইট সোর্ড”, এই ট্রিগারটাই আমাদের প্রয়োজন ছিল যে কিনা অবশেষে ওবিকে অ্যাকশনে নামিয়েছে।

“সেটাই স্যার। কারণ যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা সবাই তাকে বেশ ভয় পায়। পুরো ব্যাপারটা ঘটিয়েই আবার হাওয়া হয়ে গেছে সেই লিডার। ডাকাতির অর্থেরও কোনো হদিস মেলেনি, একশ’ সাতাশ হাজার পাউন্ড।”

“বেশ বড় একটা অংক।” বিড়বিড় করে উঠলেন ব্লেইন, “আর এটা স্পষ্ট যে, এর পুরোটাই ওবির যুদ্ধ ফান্ডে চলে গেছে। এর সাথে হয়ত সেই জেলিগনাইটগুলোও।”

“কোড় নেইম সম্পর্কে আমার পরামর্শ হল প্রেস আর জনসাধারণ থেকে এ নাম আপাতত লুকিয়ে রাখাটাই শ্রেয়।”

“আমি তাতে একমত। তবুও তোমার কারণগুলোও শুনি। দেখা যাক আমার সাথে মেলে কিনা।”

“প্রথমত, আমরা চাই না যে হোয়াইট সোর্ড এখনি সতর্ক হয়ে যাক যে আমরা তার সম্পর্কে জানি।”

মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “গুড।” “আরেকটা কারণ হল, আপনি পাবলিকের কাছে সাহায্যে চাওয়ায় যত ফোন এসেছে তার বেশিরভাগই ছিল বোগাস। এখন যদি কোড নেইমটাও প্রচার পায় তাহলে এটা নিয়ে সবাই তামাশা বানাবে।”

“অল রাইট। তাহলে কয়েকদিনের জন্য এটা আড়ালেই থাক। আর কিছু?”

“না। আপাতত না।”

“তাহলে শোনো, এখানে তোমার অনুপস্থিতিতে কী কী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পর আমরা ঠিক করেছি যে, ওবিকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিব। ফলে পুলিশ, আর্মিসহ সমস্ত সরকারি চাকরিজীবী এখান থেকে তাদের সদস্যপদ তুলে নিতে বাধ্য হবে।”

 “কিন্তু তাতে তো তাদের সমর্থন পরিবর্তিত হবে না।”

“হ্যাঁ তা হবে না। এদেশে এখনো চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ আমাদের বিরুদ্ধে নাজি জার্মানিকেই পছন্দ করে।”

“এভাবে তো চলতে দেয়া যাবে না স্যার। আপনি আর ওড বাস মিলে অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে।”

“ইয়েস, সেটা আমরাও জানি। তাই তদন্ত শেষ হোক, রিং লিডারদের নাম বের হোক তারপর আমরাও নাড়া দেব।”

“গ্রেফতার করবেন?” বিস্মিত হয়ে গেল শাসা।

 “ইয়েস। দেশের শত্রু হিসেবে তাদেরকে আটক করা হবে।”

 শিস দিয়ে উঠল শাসা, “সত্যিকারের ঝামেলা বেঁধে যাবে স্যার।”

“এই কারণেই তাদেরকে একসাথে জালে তুলে নিতে হবে। একটাকেও মিস্ করা যাবে না।” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন। “তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে শাসা। তাছাড়া মাদমোয়াজেল তারাও নিশ্চয় কিছু বলতে চায়। তাহলে কাল সকাল সাড়ে আটটায় আমার অফিসে দেখা হচ্ছে।” দুজনে একসাথেই স্টাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। যাওয়ার আগে মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে ব্লেইন জানালেন, “ও আচ্ছা তোমার দাদু স্যার গ্যারি আজ সকালে ওয়েল্টেভ্রেদেনে এসেছেন।”

“উনি জন্মদিনের পার্টির জন্য এসেছেন।” হেসে ফেলল শাসা।

“আপনি আর ফিল্ড মার্শাল স্মুটসও নিশ্চয় আসছেন।”

স্টাডি দরজা মেলে ধরলেন ব্লেইন, “তা কি আর মিস করার উপায় আছে!” বাইরে দেখা গেল সরল মুখ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা।

 অট্টহাসি দিলেন ব্লেইন, “তারা, শাসাকে আজ রাতে একটু ঘুমাতে দিও। আমি কাল কোনো জম্বির সাথে কাজ করতে চাই না।”

***

পরদিন সকালে বহুক্ষণ লাগিয়ে মিটিং করলেন ব্লেইন আর শাসা। তারপর প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যেতেই স্মুটস নিজেও শাসাকে একগাদা প্রশ্ন করলেন। অবশেষে বললেন, “হোয়াইট সোর্ড নামের এই বান্দাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পেতে হবে আর তা আবার কোনো কিছু ঘটাবার আগেই। তদন্তের সাথে জড়িত সবাইকে এ ব্যাপারে আদেশ দিয়ে দাও।”

 “ইয়েস স্যার।”

“আর উইকেন্ডের ছুটির আগেই আমার ডেস্কে পূর্ণ তালিকাটা চাই।”

সকালের মাঝামাঝি সময়ে সিআইডি হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে জাগুয়ার পার্ক করল শাসা।

বেজমেন্টের একাংশে বানানো হয়েছে অপারেশন রুম। পুলিশ বাহিনির অনেকেও ওবির সদস্য জানার পরে অনেক যাচাই-বাছাই করে নিজের টিম সাজিয়েছেন ইন্সপেক্টর লুইস নেল।

 টেকো মাথার লুইসের বয়স আর দায়িত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে তাকে ওভারসিজ মিলিটারিতে যেতে দেয়া হয়নি বলে তার ক্ষোভের সীমা নেই। আর শাসার মতে লুইসকে সন্তুষ্ট করা অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। তারপরেও দুজনের দাপ্তরিক সম্পর্কটা বেশ ভালোই বলা চলে।

ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে টেলিফোনে কথা বলছিলেন নেল; এমন সময় ভেতরে ঢুকল শাসা। মাউথপিস হাত দিয়ে ঢেকেই খেঁকিয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর, “কোন চুলায় গিয়েছিলে শুনি? আমি তো আরো সার্চ পার্টি পাঠাতে যাচ্ছিলাম। তারপর বললেন, “বসো। তোমার সাথে কথা আছে।”

ডেস্কে বসে চারপাশে চোখ বোলালো শাসা। সিগারেটের ধোঁয়া আর টাইপরাইটের খটখট শব্দ তুলে কাজ করছে গোয়েন্দারা। এমন সময়ে ডেস্কের আরেকটা টেলিফোন বেজে উঠতেই নেল বললেন, “ফোনটা ধরো তো। যাই পাবে সুইচ বোর্ড সোজা আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।” রিসিভার কানে দিল শাসা, “গুড মর্নিং, সি আই ডি হেড কোয়ার্টারস। মে আই হেল্প ইউ?” ওপাশে নীরবতা টের পেয়ে আবার আফ্রিকান ভাষায়ও একই কথা জানাল।

“হ্যালো, আমি কারো সাথে কথা বলতে চাই” এবার শোনা গেল এক উত্তেজিত নারী কণ্ঠ, “সংবাদপত্রে লিখেছে যে আপনারা ওশেয়া ব্রান্ডওয়ানা সম্পর্কে জানতে চান। আমি সে ব্যাপারেই কথা বলতে চাই।”

“আমার নাম কোর্টনি।” আফ্রিকানে উত্তর দিল শাসা, “স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি, আপনি পুলিশকে সাহায্য করতে চান শুনে বেশ খুশি হলাম। আমাকে নির্দ্বিধায় সব বলতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই।” মেয়েটা বেশ ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল শাসা; “আমি শুনছি। আপনি সময় নিয়ে বলুন।”

“আপনি কী পুলিশ?”

“ইয়েস ম্যাডাম। আপনার নামটা কী বলবেন?”

 “না! আমি তো আপনাকে

নিজের ভুলটা বুঝতে পারল শাসা। তাড়াতাড়ি বলল, “ঠিক আছে। আপনার নাম বলতে হবে না। কী বলতে চাইছেন তা বলুন।”

দীর্ঘক্ষণ নীরবতার পর প্রায় ফিসফিস করে কথা বলে উঠল ওপাশের কণ্ঠ, “ওরা অস্ত্র চুরি করছে।”

“আপনি কী বলতে পারবেন কোন অস্ত্র?” সাবধানে জানতে চাইল শাসা।

“প্রিটোরিয়ার অস্ত্রের ফ্যাক্টরি থেকে, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ।”

সিধে হয়ে বসে দু’হাতে রিসিভার চেপে ধরল শাসা। সামরিকবাহিনির সমস্ত অস্ত্র গোলাবারুদ আসে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ থেকে।

“আপনি আমাকে যা বলছেন তা সত্যিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ” আবারও সন্তর্পণে বলে উঠল শাসা, “কীভাবে এগুলো চুরি করছে সেটা কি বলতে পারবেন?”

“ওরা কেসের ভেতরে লোথার টুকরা রেখেই অস্ত্রগুলো চুরি করছে।” ফিসফিস করে জানাল নারীকণ্ঠ।

“এসব কে করছে বলতে পারবেন প্লিজ? আপনি কী জানেন কে দায়ী?”

“আমি ওয়ার্কশপের কারো নাম জানি না। তবে কে ইনচার্জে আছে সেটা জানি।”

“আমাদের ওর নামটাই দরকার। কিন্তু আবার চুপ করে গেল সেই অচেনা নারী। শাসা বুঝতে পারল যে সে নিজের সাথেই যুদ্ধ করছে যে নামটা কি বলবে নাকি বলবে না। তাই জোর করার ঝুঁকি নিল না শাসা। কেবল বলল, “আপনি কি বলতে চান সে কে?”

“ওর নাম-” খানিকক্ষণ দ্বিধা করেই যেন উগরে দিল কোনোমতে, “সবাই তাকে হোয়াইট সোর্ড ডাকে।”

“কী”

“হোয়াইট সোর্ড, ওর নাম হোয়াইট সোর্ড।” আর এর সাথে সাথে ক্লিক করে কেটে গেল কানেকশন।

“হ্যালো! হ্যালো!” রিসিভারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার শুরু করে দিল শাসা; কিন্তু সুনসান যন্ত্রটা আর কোনো উত্তর দিল না।

***

শাসা ব্লেইন ম্যালকমসের ডেস্কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। জোহানেসবার্গের মার্শাল স্কয়ারের পুলিশ কমিশনারকে ফোন করলেন ব্লেইন, “মার্চ ওয়ারেন্ট তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দিন। আমি ট্রান্সভ্যালের মিলিটারি কমান্ডারের সাথেও কথা বলেছি। তিনি আপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিবেন। তাই এক্ষুণি কাজ শুরু করুন। কেস খুলে খুলে সমস্ত আইটেম লিস্টের সাথে মিলিয়ে দেখুন। আমিও এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি। আমার জন্য রবার্টস হাইটস এয়ারফিল্ডে কার পাঠিয়ে দিন সময় জানার জন্য শাসার দিকে তাকালেন; তারপর বললেন, “বিকেল পাঁচটা। তার আগে গোপনীয়তা যেন কিছুতেই ভঙ্গ না হয়। আরেকটা ব্যাপার কমিশনার, আপনি নিজে সার্চ পার্টির মেম্বার খুঁজে নিন। ওবি কিংবা কোনো গ্রুপের সদস্য যেন না হয়।”

শাসা র‍্যাপিড নিয়ে রবার্টস হাইটস এয়ারফিল্ডে নামতেই এগিয়ে এলেন এক পুলিশ ইন্সপেক্টর।

 “তদন্তের কাজ কেমন এগুচ্ছে?” তৎক্ষণাৎ জানতে চাইলেন ব্লেইন, “কতটা কী করতে পেরেছেন?” সবাই পরস্পরের সাথে এরই ফাঁকে হ্যান্ড শেক সেরে নিল।

“কিছুই পাইনি, মিনিস্টার।” মাথা নেড়ে জানালেন ইন্সপেক্টর, “আমরা এ পর্যন্ত ছয়শ’ কেস রাইফেল চেক করেছি। কাজটা সময়সাপেক্ষ হলেও সবকিছু জায়গামতই আছে।”

“স্টোরে কতকগুলো কেস আছে?”

“নয়শ আশি।”

“তার মানে অর্ধেক চেক্ করা শেষ।” মাথা নেড়ে জানালেন ব্লেইন, “চলুন তারপরেও একবার দেখি।”

টুপি মাথায় দিয়ে গলা পর্যন্ত টেনে দিলেন ওভারকোট। এয়ারস্ট্রিপ জুড়ে বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া। প্রিটোরিয়ার মাঝখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শাসা কিংবা ব্লেইন কেউই আর গাড়িতে কোনো কথা বললেন না।

ওয়ার্কশপের গেইটে পাহারা দিচ্ছে সামরিকবাহিনির গার্ড। ব্লেইনকে দেখেও তারা দৃশ্যত তেমন কোনো আগ্রহ দেখাল না।

 ওয়ার্কশপ ম্যানেজারের অফিসে কাজ করছেন তদন্তকারী ইন্সপেক্টর। তার রিপোর্টেও তেমন নতুন কোনো খবর পাওয়া গেল না।

“চলুন ভেতরে গিয়ে ঘুরে আসি।” চিন্তিত ভঙ্গিতে আদেশ দিলেন ব্লেইন; তারপর শাসা, চিফ ইন্সপেক্টর আর ওয়ার্কশপ ম্যানেজারসহ একত্রে ভেতরে ঢুকলেন।

এত বিশাল একটা ফ্যাক্টরিকে ওয়ার্কশপ বলাটা আসলে যুক্তিযুক্ত হয়নি। একেবারে শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত রেলওয়ে সার্ভিস করার জন্য প্রস্তুত করা হলেও আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এখন এখানে লোকোমোটিভও বানানো সম্ভব। আর বর্তমানে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে যুদ্ধ করার জন্য আর্মারড কারই তৈরি হচ্ছে এ ওয়ার্কশপে। এতটাই ব্যস্ত সবাই যে পুলিশি তদন্তের জন্যও বন্ধ হয়নি কাজ।

“আপনাদের এখানে কর্মীর সংখ্যা কত?” বিভিন্ন যন্ত্র আর কাজের শব্দে চিৎকার করে প্রশ্ন করতে হল ব্লেইনকে। উত্তরে শুনলেন, “একসাথে প্রায় তিন হাজার। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র বানাতে এখন তিন শিফট কাজ করতে হয়।”

 পুরো দল নিয়ে একেবারে কোনার বিল্ডিংয়ে চলে এল ম্যানেজার, “ছোট ছোট অস্ত্রগুলো অর্থাৎ ব্যারেল আর ব্লকস নিয়ে এখানেই কাজ হয়। কাঠের কাজ বাইরের ঠিকাদার করে।”

 “আমাদেরকে যেগুলোর কাজ শেষ হয়ে গেছে সেগুলো আর প্যাকিং দেখান। যদি কোনো ঝামেলা থাকে সেখানেই থাকবে।” আদেশ দিলেন ব্লেইন।

 পুরোপুরি চেক করার পর ব্রিটিশ লং সার্ভিস পয়েন্ট থ্রি জিরো থ্রি ক্যালিবারের রাইফেল হলুদ গ্রিজ-প্রুফ পেপারে মুড়িয়ে কাঠের বাক্সে ভরে ফেলা হয়। প্রতিটা কেসে দশটা করে রাইফেল থাকে।

 ডেসপ্যাচ স্টোরে ঢুকে দেখা গেল ডজনখানেক ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ নীল ওভার অল পরা অন্তত পঞ্চাশজন ফ্যাক্টরি কর্মচারীর সাথে কাজ করছে। প্রতিটি কেস নামিয়ে র‍্যাপিং পেপার খুলে চেক করে আবার কেসে রিলোড় করা হচ্ছে। শাসা রুমে ঢোকার সাথে সাথেই শুনে দেখল যে আর মাত্র পঞ্চাশটা কেস খুলে দেখা বাকি আছে।

 ওদেরকে দেখেই ব্যস্তপায়ে এগিয়ে এল স্টোরকীপার। সরাসরি ব্লেইনকে বলল, “আমি জানি না যে আপনারা কারা, তবে এই বেকুবি করার আগে দু’বার ভাবা উচিৎ ছিল। পুরো একদিনের কাজ নষ্ট হল। ডারবান বন্দরে কনভয় অপেক্ষা করছে এসব অস্ত্র কখন আমাদের ছেলেদের হাতে পৌঁছাবে তার প্রতীক্ষায়।”

 খানিকটা হেঁটে কনস্টেবলের কাছে এগিয়ে গেল শাসা। জানতে চাইল, “কিছু পাওয়া যায়নি না?”

 “আমরা কেবল সময় বরবাদ করছি।” চোখ তুলে তাকাবারও প্রয়োজন মনে করল না লোকটা। মনে মনে খানিকটা দমে গেল শাসা। ওর জন্যই সবার কাজের ব্যাঘাত ঘটল। অপরাধবোধ আরো বেড়ে গেল যখন বাকি কেসগুলোও একে একে সিল করে দেয়া হল।

 কাজ সেরে চলে গেল কনস্টেবল আর কর্মীদের দল। তাদেরকে বিদায় দিয়ে এগিয়ে এলেন ইন্সপেক্টর, “কিছুই ঘটেনি মিনিস্টার, আয়্যাম সরি।”

 “আমাদের এটা করতে হয়েছে আসলে।” আড়চোখে শাসার দিকে তাকালেন ব্লেইন, “এর জন্য কাউকে দোষারোপ করার নেই।”

 “কিন্তু কাউকে না কাউকে তো দোষ দিতেই হবে।” খানিকটা উন্মা প্রকাশ পেলো চিফ স্টোরম্যানের কণ্ঠে। “আপনাদের তামাশা যদি শেষ হয় তো আমি বাকি কেসগুলোও তুলে ফেলব ট্রাকে?”

একদৃষ্টে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে শাসা। কিছু একটা কেন যেন ওকে মনে মনে খোঁচাচ্ছে, লোকটার চাহনিতে কেমন যেন একটা ভাব।

“তাই তো। যদি কোনো সুইচ থাকে তো তা এই লোকটার কাছেই আছে।” মনে মনে ভাবল শাসা।

 “অল রাইট” ওদিকে একমত হয়ে গেলেন ব্লেইন, “ব্যাপারটা সোনার ডিম দেয়া হাঁসের পেছনে হোটার মতন হয়ে গেল। যাই হোক, আপনারা আপনাদের কাজ করুন।”

“একটু দাঁড়ান স্যার।” তাড়াতাড়ি বলে উঠল শাসা “তারপর স্টোরম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এরই মাঝে কয়টা ট্রাক লোড হয়েছে?”

সাথে সাথে খানিকটা দ্বিধা দেখা গেল লোকটার চোখে। তার মানে মিথ্যে বলছে। অবচেতনেই ডেস্কের ক্লিপবোর্ডে আটকানো কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে ওদেরকে নিয়ে লোডিং ডেকে চলে এল।

 দ্রুতপায়ে ডেস্কের কাছে গিয়ে কাগজগুলো চেক করল শাসা; “তিনটা ট্রাক। ওগুলো কোথায়?”

“ওই বগিগুলো এরই মাঝে অন্য লাইনে পাঠানো হয়ে গেছে।” বিড়বিড় করে উঠল স্টোরম্যান।

“এক্ষণি তাহলে আবার আনিয়ে নিন।” কর্কশ কণ্ঠে আদেশ দিলেন ব্লেইন।

একসাথে দাঁড়িয়ে আছেন ব্লেইন আর শাসা। প্রথম রেলওয়ে গুড ট্রাকটার তালা খুলে সাইড ডোর মেলে দেয়া হল। ভেতরটাতে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ভর্তি হয়ে আছে সবুজ রাইফেলের কেস।

“যদি ওগুলো এখানে থাকে তাহলে নিচের সারির কেসগুলোই হবে।” বলে উঠল শাসা। কারণ প্রমাণ সরাবার জন্য প্রথমেই ওগুলো লোড করা হবে।”

“নিচের কেসগুলো নামিয়ে আনো।” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দিলেন ব্লেইন।

শব্দ করে করে ঢাকনাগুলোকে কংক্রিটের মেঝেতে ফেলতে লাগল কনস্টেবল।

“স্যার!” আচমকাই চিৎকার করে উঠল লোকটা, “দেখুন!”

কনস্টেবলের পাশে চলে এলেন ব্লেইন। খোলা বাক্সটাতে নজর বুলিয়েই চোখ তুলে তাকালেন।

তাড়াহুড়া করে শেডের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে স্টোরকিপার।

“ওকে গ্রেফতার করো।” ব্লেইনের আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে স্টোরকিপারকে ধরে ফেলল দুই কনস্টেবল।

শাসার দিকে তাকালেন ব্লেইন, “ওয়েল মাই বয়, এবার নিশ্চয় তুমি সন্তুষ্ট হয়েছে। সামনে এখন তাহলে নিঘুম রাত আর মাথার ওপর কাজের পাহাড় ভেঙে পড়ল।”

***

কেবিনেট অফিসের পলিশ করা লম্বা টেবিলটার চারপাশে বসে ব্লেইন ম্যালকমসের রিপোর্ট শুনছেন পনেরোজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।

“কী পরিমাণ অস্ত্র খোয়া গেছে তার সঠিক সংখ্যা জানার কোনো উপায় নেই। মাসের শুরুতেই আরো বড়সড় দুটো শিপমেন্ট পাঠানো হলেও একটা চালানও এখনো কায়রোতে পৌঁছেনি। আমার হিসাব মতে দেড় মিলিয়ন রাউন্ড গুলিসহ প্রায় দুই হাজার রাইফেল হবে।”

অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন সবাই। তবে কেউ কোনো কথা বললেন না।

“ব্যাপারটা যে ভয়ংকর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার চেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হল ত্রিশ থেকে পঞ্চাশটা ভিকার মেশিনগানও উধাও হয়ে গেছে।”

 “অবিশ্বাস্য।” বিড়বিড় করে উঠলেন ডেনিস রিটাজ; “এর মাধ্যমে চাইলে পুরো দেশে বিদ্রোহ শুরু করা যাবে। এসব কথা যেন বাইরে না ছড়ায়। তাহলে সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে।”

 “এর সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে কারুতে যেসব বিস্ফোরক হাইজ্যাকড হয়েছে তার মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে ফেলা কোনো ব্যাপারই না। যদি সত্যিই বিদ্রোহের আশংকা-_”।

“প্লিজ ব্লেইন আমাদেরকে বলুন যে আঙুল তুললেন প্রধানমন্ত্রী, “ওরা কখন খোলা ময়দানে হাজির হতে পারে তার কি কোনো ধারণা আছে?”

“না, প্রাইম মিনিস্টার। আমি শুধু অস্ত্র চুরির ঘটনা থেকে এটুকু বলতে পারি যে, ওরা ভেবেছিল হয়ত কায়রো প্রথম চালান পৌঁছাবার পরই চুরিটা ফাঁস হবে। নিশ্চয় তারা তার আগেই কার্যসিদ্ধির পরিকল্পনা করে রেখেছে।”

“কায়রোতে কখন পৌঁছাবে সেই চালান?”

“এখন থেকে বড়জোর দুই সপ্তাহ।”

 “তার মানে সপ্তাহ নয় কয়েকদিনের ভেতরেই ওরা কিছু করবে?”

 “আমিও সে ভয়ই পাচ্ছি, প্রাইম মিনিস্টার।”

“আমার পরের প্রশ্ন হল ক্লেইন, তোমার তদন্ত কতদূর এগোল?” তোমার কাছে কী ওবির রিং লিডারদের পুরো তালিকা আছে?”

“পুরো তালিকা বলা যাবে না। কারণ মাত্র ছয়শ’ নাম পাওয়া গেছে। তবে এতে তাদের হোতারা সবাই আছে, যদিও নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।”

“ধন্যবাদ ব্লেইন।” চুপচাপ নিচের রুপালি দাড়িতে হাত বোলালেন চিন্তিত প্রধানমন্ত্রী। অথচ নীল চোখ দুটো একেবারে শান্ত আর কোনোরকম দুশ্চিন্তার ছায়া পর্যন্তও নেই। সবাই অপেক্ষা করছে উনি আবার কিছু বলবেন; জানতে চাইলেন, “লিস্টের নামগুলো কতটা স্পর্শকাতর?”

“ওরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের প্রশাসক আছেন।

 “ইয়েস, উনার সম্পর্কে আমরাও জানি।”

 “সংসদের বারোজন সদস্য যার মাঝে প্রাক্তন কেবিনেট মিনিস্টারও আছেন।”

“সংসদীয় ক্ষমতাবলে ওরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।” বিড়বিড়। করে উঠলেন ফিল্ড মার্শাল স্মুটস।

“আরো আছে চার্চ লিডারস। উচ্চ পর্যায়ের চারজন আর্মি অফিসার, অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনারসহ সরকারি চাকরীজীবী।”

ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; বললেন, “আমরা আসলে অপেক্ষা করতে পারব না। সংসদ সদস্য ছাড়া তালিকার বাকি সবাইকে সন্দেহবাদী হিসেবে বিচারের আওতায় নিয়ে আসুন। ড্রাফট রেডি হলেই আমি সাইন করে দিব। এই ফাঁকে কীভাবে গ্রেফতার করা হবে আপনি তার পরিকল্পনা করুন।”

“ইটালিয়ান যুদ্ধ বন্দিদের জন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্প আছে।”

মনে করিয়ে দিলেন ব্লেইন। “গুড।” একমত হলেন স্মুটস “তাহলে যত দ্রুত সম্ভব এদেরকে কারাগারে পাঠানো আর চুরি যাওয়া অস্ত্র আর বিস্ফোরক উদ্ধারের ব্যবস্থা নিন।”

***

“আমরা আসলে আর অপেক্ষা করতে পারব না।” সাবধানে বলে উঠল ম্যানফ্রেড ডি লা রে, “প্রতিটি ঘণ্টাই এখন বিপজ্জনক।”

“কিন্তু আমরা তো প্রস্তুত নই। আরো সময় দরকার।”

বলে উঠল ফার্স্ট ক্লাস রেলওয়ে কম্পার্টমেন্টের আরেক যাত্রী। গত দুইশ মাইলের মধ্যে আলাদা আলাদা করে সবাই ট্রেনে উঠেছে। বাইরের করিডোরে পাহারা দিচ্ছে ওদেরই লোক। তাই আড়িপাতার সুযোগ পাবে না কেউ।

“আপনি তো আরো দশদিন দিবেন বলেছিলেন।”

“আমাদের হাতে আর দশ দিন নেই ম্যান। যা বলছি বুঝতে পারছে না?”

“হবে না। এত অল্প সময়ে কিছুতেই হবে না।” একগুয়ের মত বলে উঠল লোকটা।

“হতেই হবে!” গলা চড়ালো ম্যানফ্রেড।

তীরে এবারে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানালেন, “জেন্টলম্যান যুদ্ধ নিজেদের সাথে নয় শত্রুর সাথে করবেন।”

প্রচণ্ড কষ্টে রাগ সামলাল ম্যানফ্রেড, “আমি ক্ষমা চাইছি। তবে আবারও বলছি, হাতে একদম সময় নেই। ওয়ার্কশপ থেকে অস্ত্র চুরির কথা ফাঁস হয়ে গেছে। মার্শাল স্কয়ার থেকে একজন এও জানিয়েছে যে, সিনিয়র মেম্বারদের মধ্যে দুইশজনকে কারাগারে প্রেরণের অর্ডার দেয়া হয়েছে। যা রবিবারেই ঘটবে। মানে আর মাত্র চারদিন।”

“এসব আমরাও জানি। যেটা ভাবতে হবে তা হল পুরো পরিকল্পনাটা বাস্তবে রূপ দেয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে কী নেই? আমি সবার রায় শুনতে চাই। তারপর ভোট হবে। সবার আগে বিগ্রেডিয়ার কুপম্যানের কথা শুনি।” বলে উঠলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।

সবাই এবার আর্মি জেনারেলের দিকে তাকাল; সাদা পোশাকে থাকলেও অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে তিনি কতটা প্রভাবশালী। টেবিলের ওপর বিশাল একটা মানচিত্র বিছিয়ে পেশাদার কণ্ঠে কুপম্যান প্রথমেই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনির অবস্থান, দেশে থাকা এয়ারক্রাফট আর আমর্ড কারের সংখ্যা জানিয়ে বললেন, “তো আপনারা এতক্ষণ দেখলেন যে রবাটস হাইটস আর • ডারবানের প্রধান দুটি ব্যারাকে সৈন্যদেরকে বাইরের দায়িত্ব পালন করার জন্য ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে আর বলা যায় প্রস্তুতিও শেষপর্যায়ে। তবে সংখ্যায় পাঁচ হাজারের বেশি হবে না। তাদের কোনো আধুনিক এয়ারক্রাফটও নেই। তাই সমস্ত বড় বড় রাস্তা আর রেলওয়ে ব্রিজ বিশেষ করে ভাল, অরেঞ্জ আর উমজিনদুসি নদীর উপরের সেতু উড়িয়ে দিতে পারলেই সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেয়া যাবে।”

এভাবে আরো দশ মিনিট বর্ণনা দেয়ার পর অবশেষে জানালেন, “সেনাবাহিনির একেবারে সাধারণ কর্মীদের থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ সর্বত্র আমাদের লোক থাকায় যে কোনো অ্যাকশনের খবর আগেই পাওয়া যাবে। এরপর স্যুটসকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনিকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসব। যারা নতুন রিপাবলিকান সরকারকেই সমর্থন করবে।”

একের পর এক বাকিরাও তাদের নিজ নিজ রির্পোট পড়ে শোনাবার পর ম্যানফ্রেড বলল, “জেন্টলমেন, গত বারো ঘণ্টায় পর্তুগিজ অ্যাঙ্গোলার প্রতিনিধির মাধ্যমে আমি জামান আবওয়ের সাথে সরাসরি রেডিওতে কয়েকবার কথা বলেছি। তিনি আমাকে জার্মান হাই কমান্ড আর স্বয়ং ফুয়েরারের সমর্থন সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে আশ্বস্ত করেছেন। কেপটাউনের তিনশ’ নটিক্যাল মাইলের ভেতরেই পাঁচশ টন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে জার্মান সাবমেরিন। সিগন্যাল পেলেই আমাদের সাহায্যে ছুটে আসবে।” ধীরে ধীরে জোর দিয়ে শব্দগুলো উচ্চারণ করল ম্যানফ্রেড। বেশ বুঝতে পারছে যে সবাই তার প্রতি কতটা মনোযোগী।

ওর কথা শেষ হওয়ার পর সবাই বেশ নীরব আর গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানালেন, “সমস্ত তথ্য-প্রমাণই এখন আমাদের সামনে আছে। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার আমাদেরকে কারাগারে পাঠাবার আগেই পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে।”

বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে জাতিকে মুক্তি আর ন্যায়ের পথে চালিত করতে হবে। এবার আপনারা একে একে হ্যাঁ’ কিংবা না বলুন।”

“ইয়েস”

“ইয়েস”

 “ইয়েস”

তিনজনের রায় নিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানালেন, তাহলে আমরা সবাই এ ব্যাপারে রাজি।” এবারে ম্যানফ্রেড ডি লা রের দিকে তাকালেন, “আপনি আমাদেরকে একটা সিগন্যাল দেয়ার কথা বলেছিলেন যার মাধ্যমে পুরো জাতি সক্রিয় হয়ে উঠবে। এবারে কি বলবেন কী সেই সিগন্যাল?”

“সেই সিগন্যাল হল বিশ্বাসঘাতক জ্যান ক্রিশ্চিয়ান স্মুটসকে মেরে ফেলা।” শান্ত গলায় ম্যানফ্রেড জানাতেই সবাই হাঁ করে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল। স্পষ্ট বোঝা গেল যে সবাই মনে মনে বিশেষ কিছু আশা করলেও এতটা ঔদ্ধত্বের জন্য প্রস্তুত ছিল না।

“রাজনৈতিক এই হত্যার সমস্ত খুঁটিনাটি বেশ সাবধানে প্ল্যান করা হয়েছে। বিভিন্ন তারিখে, ঘটনার ওপর নির্ভর করে বাস্তবায়নের জন্যে বার্লিনে পৃথক তিনটা প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। তবে, প্রথম প্ল্যানটাই আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে চমৎকারভাবে সাহায্য করবে। আসছে শনিবারেই স্মুটসকে হত্যা করা হবে। আর মাত্র তিনদিন বাকি, আমাদের নেতাদেরকে গ্রেফতার করার আগের দিন।”

আরো কিছুক্ষণ মৌন থাকার পরে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানতে চাইলেন, “কোথায়? কীভাবে করা হবে এ কাজ?”

“আপনার এটা জানার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি একাই সবকিছু করব। তবে সুটের মৃত্যুসংবাদ বের হওয়ার পর দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব হল আপনার। তার শূন্যস্থান পূরণ করে ক্ষমতার রাশ আপনাকেই ধরে রাখতে হবে।”

 “তবে তাই হোক।” আস্তে করে জানালেন অ্যাডমিনিট্রেটর। “আমরা সেই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকব আর ঈশ্বর আমাদের লড়াইকে আশীর্বাদ করুন।”

কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে গেল আটজন। কেবল ম্যানফ্রেড একাই ট্রেনে চেপে চলে এল কেপটাউন।

***

“এস্টেটে বন্দুক রাখার জন্য আমার অনুমতি নেয়া আছে।” ম্যানফ্রেডাকে জানাল সাকি ভ্যান, “পর্বত থেকে আঙুর ক্ষেত আর ফলের বাগানে নেমে আসা বেবুনদেরকে গুলি করার জন্যই এ বন্দুক ব্যবহার করা হয়।”

ম্যানফ্রেডকে ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে সেলারে নিয়ে এল ওয়াইন ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। “তাই যদি কেউ গুলির আওয়াজ শোনেও, ক্ৰক্ষেপ করে না। তবে যদি আপনাকে কেউ কিছু বলে তাহলে নিজেকে এস্টেটের কর্মী পরিচয় দিয়ে শুধু আমার নাম বলবেন।” ওয়াইনের পিপার ঢাকনা খুলে দিল ম্যানেজার।

 প্রথমেই রেডিও ট্রান্সমিটার আর ব্যাটারি ক্যানভাসের ব্যাগে ভরে নিল ম্যানফ্রেড। তারপর ৯৮ মসার স্নাইপার রাইফেল, টেলিস্কোপিক সাইট লাগিয়ে ম্যাগাজিন ভরতেই তৈরি হয়ে গেল রাইফেল। বাকি গোলা-বারুদ আবার ক্যানিস্টারে ভরে ওয়াইনের পিপায় রেখে দিল।

ভাঙাচোরা হাফটনী একটা পুরনো ফোর্ডে চড়িয়ে ম্যানফ্রেডকে হটেনটস হল্যান্ট মাউন্টেনের এক উপত্যকায় নামিয়ে দিল ভ্যান।

ম্যানেজার চোখের আড়াল হতেই ব্যাগ আর রাইফেল নিয়ে উপরে উঠে গেল ম্যানফ্রেড। হাতে এখনো বেশ সময় আছে। তাড়াহুড়া করার কোনো দরকার নেই। তারপরেও শারীরিক পরিশ্রম তাকে আনন্দ দেয়। ঘাম ঝরিয়ে উপরে উঠে এল ম্যানি।

প্রধান পর্বত চূড়াগুলোর একটাতে পৌঁছেই গাছের মাথায় রেডিও সেট করে সাবধানে উত্তরদিকে ঘুরিয়ে দিল অ্যান্টেনার মাথা।

তারপর বড়সড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে সারাহর দেয়া স্যান্ডউইচও খেয়ে নিল। অ্যাঙ্গোলা আরো ঘন্টাখানেক পর যোগাযোগ করবে তাই কোলের উপর রাইফেল নিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেখল এর প্রতিটি অংশ। জার্মানিতে এ রাইফেল নিয়েই অনেকবার প্যাকটিস করলেও আরেকবার অভ্যাসটা ঝালাই করে নেয়া দরকার। কিন্তু আশপাশে মানব সদৃশ কোনো নিশানা নেই। রাইফেল একপাশে নামিয়ে তাই রেডিওর দিকেই মনোযোগ ঢেলে দিল।

মোর্স কী সেট করে নোটবুক দেখে দ্রুতহাতে টাইপ করে চলল ম্যানফ্রেন্ড। আশা করছে লুয়ান্ডার অপারেটর পরিচয় না বললেও ওর স্টাইল দেখেই ওকে চিনে নিবে।

“ঈগল বেস, হোয়াইট সোর্ড বলছি।” চারবারের বার পরিষ্কার উত্তর পেল ম্যানফ্রেড।

“গো অ্যাহেড, হোয়াইট সোর্ড।”

 “প্ল্যান ওয়ানকেই বাস্তবায়নের স্বীকৃতি চাইছি, আবারো বলছি প্ল্যান ওয়ান।”

এর বেশি আর লম্বা মেসেজের প্রয়োজন নেই। কারণ বার্লিন ছাড়ার আগেই সমস্ত প্ল্যান হয়ে গেছে।

“বুঝতে পেরেছি প্ল্যান ওয়ান গুড লাক। ওভার অ্যান্ড আউট ঈগল বেস।”

“ওভার অ্যান্ড আউট, হোয়াইট সোর্ড।”

এরপর অ্যান্টেনা ভাজ করে ট্রান্সমিটার ব্যাগে ভরে যেই না ম্যানফেড় কাধ ঘোরাতে যাবে পেছনে আচমকা শোনা গেল ভয়ংকর পশুর গর্জন। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল সেই আওয়াজ। তাই মসার নিয়ে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি।

এভাবে প্রায় আধঘণ্টা মরার মত পড়ে থাকার পর দেখতে পেল বেবুনদের দলটাকে। বাচ্চারা মা বেবুনদের পেটের নিচে খেলা করছে। দলের মাঝখানে তিনটা মদ্দা বেবুন। রাইফেলের পেরিস্কোপিক সাইট দিয়ে সবচেয়ে বড় বেবুনটাকে টার্গেট করল ম্যানফ্রেড। অপেক্ষা করল তিনশ’ মিটার রেঞ্জের ভেতরে আসবে পশুটা।

হঠাৎ করেই ছোটখাট কুঁড়েঘরের সমান বড়সড় একটা পাথরের ওপর উঠে বসল বেবুনটা। ঠিক মানুষের মতই হাঁটুর ওপর কনুই রেখে বসল। হাঁ করতেই স্পষ্ট দেখা গেল হলুদ রঙা বিষদাঁতের সারি।

আস্তে আস্তে রাইফেল তুলে বেবুনের কপাল বরাবর ট্রিগার টিপে দিল ম্যানফ্রেড। মেঘের মত গুরগুর শব্দ করে উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সেই আওয়াজ।

পাথরের উপর থেকে ডিগবাজি খেয়ে ওপাড়ে পড়ে গেল বেবুনটা, বাকি দল আতঙ্কে কিচকিচ করতে করতে ঢালু পেরিয়ে পালিয়ে গেল।

কাঁধে ব্যাগ তুলে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। কাছে গিয়ে দেখে যে তুলোর প্রলেপের মত দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে মৃত বেবুন। অসহায় জানোয়ারটার মাথার উপরের অংশ পুরো নাই হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ এক কোপে আলাদা করে দিয়েছে। পা দিয়ে গড়িয়ে বেবুনটাকে ফেলে দিল ম্যানি। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল। বিশেষ করে বানানো এই বুলেট পরিষ্কারভাবে মানুষের মাথা কেটে দিতে সক্ষম। এবার আমি পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত।” বিড়বিড় করতে করতে লোকালয়ে ফিরে এল ম্যানফ্রেড।

***

ব্লেইনের সাথে প্রিটোরিয়া থেকে ফেরার পর শাসা নিজের বাড়িতেও আসেনি। কিংবা তারার সাথেও দেখা করেনি। এমনকি সি আই ডি হেড কোয়ার্টারের বাইরেও যায়নি। ক্যান্টিনে খেয়ে অপারেশনরুমের উপরকার ডরমেটরিতে ঘুমিয়েছে। বাকি সময়টা পুলিশি রেইডের প্ল্যান নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে।

 রবিবারে ইচ্ছে করেই সবাইকে গ্রেফতারের দিন ধার্য হয়েছে যেন রিফমর্ড চার্চের অনুসারী হিসেবে গির্জায় প্রার্থনাকালে সবাইকে পাওয়া যায় আর অ্যারেস্ট করতে গেলে পুলিশদেরকেও তেমন বাধা না দেয়।

শুক্রবার দুপুরবেলা, পরদিন দাদুর জন্মদিনের কথা মনে পড়তেই সেনটেইনকে ফোন দিল শাসা;

 “ওহ, সোনা, স্যার গ্যারি শুনলে বেশ মন খারাপ করে ফেলবেন। আসার পর থেকে প্রতিদিনই কেবল তোমার কথা জিজ্ঞেস করছেন।”

“অ্যায়াম সরি, মা।”

“এক ঘণ্টার জন্যও আসতে পারবে না?”

“না, মা। বিশ্বাস করো কিছুতেই সম্ভব না। আমারও খুব খারাপ লাগছে।”

 “পাহাড়ে উঠতে হবে না শাসা। শুধু আমরা যাওয়ার আগে একসাথে এক গ্লাস শ্যাম্পেন খেয়ে যেও। আমার দোহাই সোনা, একবার চেষ্টা করে দেখো না বাবু?”

ছেলে দ্বিধায় ভুগছে বুঝতে পেরে সেনটেইন বললেন, “ব্লেইন আর স্মুটস সাহেবও আসবেন। তুমি যদি আটটায় এসে দাদুকে উইশ করো, কথা দিচ্ছি সাড়ে আটটায় আবার তোমার কাজে পৌঁছে যেতে পারবে।”

“ওহ! অল রাইট মা” তারপর ফোন কানে রেখেই হেসে ফেলল শাসা, “সবাই সবসময় তোমার কথা শুনে ব্যাপারটা মাঝে মাঝে তোমার বোরিং লাগে না?

“আমার সহ্য হয়ে গেছে বাবু।” পাল্টা হাসি দিলেন সেনটেইন।

মাকে কথা দিলেও মনে মনে অপরাধবোধে ভুগতে লাগল শাসা, এমন সময় সার্জেন্টদের একজন এসে ওকে ডাক দিল।

“স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি, আপনার একটা ফোন এসেছে।”

 “কে?”

“নাম বলেনি তবে এক মেয়ে।” হাসিমুখে ফোন ধরতে গেল শাসা। নিশ্চয় তারা!

“হ্যালো, তারা?” মাউথপিসে কেবল কারো নার্ভাস নিঃশ্বাসের নরম আওয়াজ পেল শাসা। সাথে সাথে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল এক শীতল স্রোত। আফ্রিকান ভাষায় পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সহজ করার জন্য বলল,

“স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি বলছি, আমি কি আগেও আপনার সাথে কথা বলেছি?”

“হ্যাঁ।” কম বয়সী নারীকণ্ঠের ভয়ার্ত ভাব ঠিকই টের পেল শাসা। “আমি আপনার কাছে অসম্ভব কৃতজ্ঞ। অসংখ্য সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন আপনি।”

 “সংবাদপত্রে তো অস্ত্রগুলো সম্পর্কে কিছু পেলাম না।” ফিসফিস করে বলে উঠল সেই অচেনা নারী। “যা করেছেন সেটাও অনেক গর্বের ব্যাপার।” উৎসাহ দেয়ার জন্য শাসা যোগ করল, “নয়ত অনেক নারী আর ছোট শিশুদের প্রাণ যেতে পারত।”

“ছোট শিশু” শব্দটা শুনেই নাকি কে জানে তাড়াতাড়ি মেয়েটা বলে উঠল, “এখনো আরো বড় বিপদ রয়ে গেছে। ওরা অনেক ভয়ংকর কিছু একটার প্ল্যান করছে। আমি হোয়াইট সোর্ডকে বলতে শুনেছি যে এই সিগনালে নাকি সারা দেশ নড়ে উঠবে

“এটা কী তা বলতে পারবেন? মেয়েটা যাতে ভয় পায় এমনভাবে আস্তে আস্তে শাসা জানতে চাইল, ওর প্ল্যানটা কী?

“আমি জানি না। শুধু জানি শিঘ্ন ঘটবে।”

 “খুঁজে বের করতে পারবেন?”

 “জানি না, চেষ্টা করতে পারি।”

“সকলের মঙ্গলের জন্য, নারী আর ছোট ছোট শিশুদের জন্য চেষ্টা। করবেন না?”

“ইয়েস। আই উইল ট্রাই।”

“আমাকে এই নাম্বারেই পাবেন” তারপর হঠাৎ করে মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞার কথা মনে হতেই “অথবা এই নাম্বারে—” ওয়েল্টেজেদেনের নাম্বার দিল শাসা।

“ঠিক আছে।”

“হোয়াইট সোর্ড কে, তা কি আমাকে বলতে পারবেন?” খানিকটা ঝুঁকি নিল শাসা, বলল, “ওর সত্যিকারের নাম?” সাথে সাথে কেটে গেল লাইন। শেষ প্রশ্নটা যে কেন করল তা ভেবে আফসোসে মরে যেতে মন চাইলেও মাথার ভেতর ঘুরছে মেয়েটার সেই লাইন, “সারা দেশ নড়ে উঠবে” অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল শাসা।

***

নেশাগ্রস্তের মত ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং পেরিয়ে ডি ওয়াল ড্রাইভ ধরে গাড়ি চালাচ্ছে ম্যানফ্রেড। মাঝরাতও পেরিয়ে যাওয়ায় রাস্তা প্রায় জনশূন্য। বৈশিষ্ট্যহীন মরিস গাড়িটার বুটে তেরপল দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে ওর রাইফেল। রেলওয়ে কর্মীদের নীল ওভারগুলোর উপর নাবিকদের জার্সি আর ভারি ওভারকোট গায়ে দিয়েছে ম্যানি।

কনস্টানশিয়া নেক পৌঁছে গাড়ির গতি কমিয়ে রিয়ারভিউ মিরর দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল যে কেউ তার পিছু নেয়নি। তারপর হেডলাইট নিভিয়ে আবার তীক্ষ্ণ একটা মোড় নিয়ে চলে এল ফরেস্ট্রি ট্র্যাকে।

হাঁটার গতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে এল গেইটের কাছে। ইঞ্জিন চালু রেখেই গাড়ি থেকে নেমে চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করল। চাবিটা দিয়েছে রুলফ। বলেছে বনকর্মী নাকি তার বন্ধু। তাই গেইটও সহজেই খুলে গেল। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেইট আবার আটকে দিল ম্যানফ্রেড। কিন্তু তালা লাগাল না।

 খানিক বাদে চট করে যাতে চোখে না পড়ে এমনভাবে মরিস গাড়ি লুকিয়ে রাইফেল আর ফ্লাশ লাইট নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বিশ মিনিটের ভেতরেই পেয়ে গেল স্কেলিটন গর্জে ওঠার রাস্তা। ফ্লাশ লাইটের আলোতে কংক্রিটের চারকোনা সাইনপোসটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

*

স্মুটস ট্যাক একটুও না থেমে দ্রুতপায়ে ১২০০ ফুট উপরে ঠিক ব্রেকফাস্ট রকে এসে থামল ম্যানফ্রেড। এবার পেছন ফিরে তাকাবার ফুরসত পেল। অনেক নিচে তারার আলোয় দেখা যাচ্ছে কনস্ট্যানশিয়া উপত্যকা। তাই ফাইনাল প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। দুদিন আগে এসেই কোথায় দাঁড়ালে রাইফেলের কাঙ্ক্ষিত একজ্যাক্ট রেঞ্জ পাওয়া যাবে তা দেখেও গেছে।

এখন সরাসরি নিজের সেই গোপন জায়গায় চলে এল। দুইটা বড় বড় পাথরের মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তেরপল বিছিয়ে শুয়ে পড়তেই আরাম দিল ঘাসের ম্যাট্রেস।

যেকোনো মুহূর্তে চাইলেই ব্যবহার করা যাবে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে রাখল রাইফেল। সময় কাটাবার জন্যে মনে মনে ঝালাই করে নিল পুরো প্ল্যান। কাল সকাল সাড়ে দশটার আগে কিংবা একটু পরেই এসে যাবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

জ্যান ক্রিশ্চিয়ান স্মুটের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ঘেঁটে দেখেছে বার্লিন। গত দশ বছরে প্রতি বছর এই তারিখে এই পর্বতে এসে বন্ধুর জন্মদিন পালন করেছে ফিল্ড মার্শাল। আর এ বছর পুরো জাতির ভাগ্যই নির্ভর করছে তার। এখানে আসার ওপর।

***

ওয়েল্টেভ্রেদেনের দুর্গের বাইরে ডজনখানেক মোটরগাড়ির ভিড়ে ব্লেইনের বেন্টলিও দেখতে পেল শাসা। ঘড়িতে আটটা দশ বাজছে। তার মানে ক্ষেপে যাবে মা।

কিন্তু ডাইনিং টেবিল থেকে দৌড়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অবাক করে দিলেন সেনটেইন। ওয়েল্টেভ্রেদেনের সবচেয়ে চটকদার নাশতা করতে বসেছেন বিশজন অতিথি। শাসাকে দেখে সবাই বেশ খুশি হল। পরিচারকেরাও স্নেহের হাসি দিল। কেবল ডেভিড বাদে আজ তার একান্ত আপনজনদের প্রায় সবাই এখানে উপস্থিত হয়েছে। দাদু, অ্যানা, ব্লেইন, তারা, ম্যাটি, ওড় বাস্ আর অবশ্যই মা।

সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে হাসিমুখে কুশল বিনিময় সেরে নিল শাসা। তারপর দাদুকে তার জন্মদিনের উপহার দিয়ে নাশতা করতে বসল। টেবিলের নিচে পা দিয়ে তারার সাথে খুনসুটিও চলল সমান তালে।

যাই হোক, ব্রেকফাস্ট শেষে মেয়েরা গেল কোট আনতে আর ছেলেরা গাড়ির কাছে। এমন সময় শাসাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন স্যার গ্যারি, “অ্যায়াম সরি, শাসা, ইচ্ছে ছিল তোমার সাথে অনেক গল্প করব; কিন্তু ব্লেইন বলল যে তুমি কত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছে।”

“আমি কাল রাতেই এখানে চলে আসার চেষ্টা করব। ততক্ষণে কাজের চাপও অনেক কমে যাবে।”

“আমরা একসাথে একটু সময় না কাটানো পর্যন্ত আমি ন্যাটাল ফিরে যাব না। তোমাকেই তো আমার কোর্টনি নামটাকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে, নাকি?

দাদুর প্রতি স্নেহে আর্দ্র হয়ে উঠল শাসার মন। একদিক থেকে দেখলে তারা দুজনেই অনেক বড় আত্মত্যাগ দিয়েছে; স্যার গ্যারি পা আর শাসা চোখ।

“কতদিন আমি থিউনিসক্রালে তোমার আর অ্যানার কাছে যাই না। কয়েক সপ্তাহ তোমাদের কাছে কাটানো যাবে না?” ছোট বাচ্চাদের মত জেদ ধরল শাসা।

“এর চেয়ে আর কোন কিছুই আমাদেরকে আনন্দ দিতে পারবে না।” নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন সার গ্যারি। ঠিক সে সময় এগিয়ে এলেন ফিল্ড মার্শাল স্যুটস।

“তুমি এখনো কথা বলছো গ্যারি? এবার চল। আমাদেরকে পাহাড়ে চড়তে হবে। যে পরে চূড়ায় পৌঁছাবে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হবে।”

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল দুই বন্ধু।

“ফরোয়ার্ড!” নিজের হাতের লাঠি ঠুকে বন্ধুর হাত ধরে সেনটেইনের হলুদ ডেইমলারের দিকে এগোলেন স্যার গ্যারি।

তাদের পিছু নিল ব্লেইনের বেন্টলি। সবাই চলে যেতেই ওয়েল্টেভ্রেদেনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় একা বোধ করল শাসা।

 যাই হোক, আবার বাড়িতে ঢুকে নিজের রুমে এসে কয়েকটা পরিষ্কার শার্ট প্যান্ট তুলে নিল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় কি মনে করে সেনটেইনের স্টাডিতে যে টেলিফোন আছে সেখান থেকে সি আই ডি হেড কোয়ার্টারে ফোন দিল।

“হ্যালো, সার্জেন্ট, আমার জন্য কোনো মেসেজ আছে?”

“হোল্ড অন স্যার। দেখছি।” কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ফিরে এল লোকটা, বলল, “দশ মিনিট আগে স্যার একটা মেয়ে ফোন বলেছিল, নাম বলেনি।”

 ধন্যবাদ, সার্জেন্ট” তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিল শাসা! টের পাচ্ছে ওর হাত দুটো কাঁপছে। নিশ্চয়ই সেই মেয়েটা। তাহলে এখানে কেন ফোন দেয়নি?

সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে রইল শাসা। মন চাইছে ফোনটা বাজুক। কিন্তু কিছুই ঘটল না। পাঁচ মিনিট পর পায়চারি শুরু করল। তারপরেও নীরব হয়ে রইল ফোন। একবার ভাবল হেড কোয়ার্টারে ফিরে যাবে নাকি? অখবা সার্জেন্টকে আবারো ফোন দিবে, কিন্তু তাতে শুধু শুধু লাইন এনগেজ হয়ে যাবে।

“কাম অন!” মনে মনে অনুনয় করে উঠল শাসা; হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এমনিই পঁয়ত্রিশ মিনিট নষ্ট হয়ে গেছে।

“যাই, এগুলো প্যাক করতে হবে। এখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।”

 কী ভেবে ডেস্কের কাছে গিয়ে ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই বেজে উঠল যন্ত্রটা। আচমকা শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলেও সাথে সাথে ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার।

“স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি” আফ্রিকান ভাষায় জানতে চাইল, শাসা, “আপনিই ম্যাডাম?”

“আমি আসলে নাম্বার ভুলে গিয়েছিলাম। আবার বাসায় গিয়ে নিয়ে আসতে হল।” দৌড়ে আসাতে যেন অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে এমন ভাবে হাঁপাচ্ছে মেয়েটা। বলল, “আগে ফোন করতে পারিনি। অনেক লোক ছিল, আমার হাজব্যান্ড” আবার থেমে দম নিল। “ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই।”

“না। ওরা যা করতে চলেছে তা অনেক অনেক ভয়ংকর।” বলে উঠল অচেনা নারীকণ্ঠ।

“আমাকে কি বলবেন?”

“উড বাস, ফিল্ড মার্শাল স্মুটস। ওরা তাকে খুন করবে।” এক মুহূর্তের জন্য যেন জমে গেল শাসা। সম্বিৎ ফিরতেই জানতে চাইল, “কখন তা কি জানেন?”

“আজ। ওরা তাকে আজই গুলি করবে।”

“সেটা অসম্ভব কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না শাসা। “উড বাস তো টেবিল মাউন্টেনে পিকনিক”।

“ইয়েস! ইয়েস!” ফোঁপাতে লাগল মেয়েটা, “পাহাড়ে। হোয়াইট সোর্ডও পাহাড়ে অপেক্ষা করছে।”

 “ওহ মাই গড! ফিসফিস করে উঠল শাসা। মনে হচ্ছে চলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। পা দুটো সীসার মত ভারি হয়ে আটকে গেছে মেঝের সঙ্গে। কোনোরকমে ঢোক গিলে কেবল বলল।

“আপনি অনেক সাহসী একজন মানুষ। যা করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”

এরপর ঠাস করে ক্রেডলে ফোন রেখেই সেনটেইনের ডেস্কের ড্রয়ার খুলে ফেলল। বেরেটা পিস্তল বের করে চেক করে দেখল লোড করা আছে কিনা। ম্যাগাজিনে ছয়টা গুলি; সাথে আরেকটা এক্সট্রা ম্যাগাজিন। পিস্তলটাকে বেল্টের সাথে ঝুলিয়েই দরজার দিকে দৌড় দিল শাসা।

যদিও পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ না হলে এ পিস্তল কোনো কাজেই আসবে না, তারপরেও গানরুমের কেবিনেটের তালা খুলে রাইফেল আনতে গেলে মূল্যবান সময়ই নষ্ট হবে শুধু। ওদিকে পিকনিক পার্টি চল্লিশ মিনিট এগিয়ে গেছে।

লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে জাগুয়ারে উঠে বসল শাসা। গুপ্তঘাতকের হাত থেকে ওর ভালোবাসার মানুষগুলোকে বাঁচাতেই হবে। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আশি মাইল বেগে গাড়ি ছোটাল। পিছনের টায়ার থেকে ছিটকে বেরোল নুড়ি পাথরের ফোয়ারা। তারপরেও পনেরো মিনিট লেগে গেল। কিউরেটরের অফিসের পেছনে পার্কিং এরিয়াতে দেখা গেল ডেইমলার, বেন্টলি আর ডেনিসের প্যাকের্ড। কিন্তু জনমানুষের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

চোখ তুলতেই দেখল মাথার ওপর টাওয়ারের মত ২০০০ ফুট উঁচু পাহাড়। চোখের উপর হাত নিয়ে তাকাতেই দেখা গেল চলন্ত কয়েকটা ফুটকি। উড বাস, দাদু সবার সামনে। অনেক পেছনে মা, তারা।

দৌড় দিল শাসা। প্রথম ৩০০ মিটার উঠে মাইনেপোস্টের কাছে থেমে খানিক নিঃশ্বাস ফেলার জন্য বিশ্রাম নিল। সেখান থেকেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে খাড়া পথ। কিন্তু পায়ে পাতলা চামড়ার সোলের জুতা থাকায় সুবিধে করতে পারছে না তেমন। ভয়ংকরভাবে হাঁপাচ্ছে শাসা। ঘামে ভিজে গেছে শার্ট। আরও এক হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। তবে বন থেকে বের হতেই দেখল পিকনিক পার্টিও সামনেই।

দাদু আর উড বাসের কয়েক কদম পেছনে ব্লেইন। ইচ্ছে করেই আস্তে হাঁটছে যেন তার পাল্লা দিতে গিয়ে অসুস্থ না হয়ে যায় দুই বুড়ো। বাকি দল আরো পেছনে।

বুক ভরে লম্বা একটা দম নিয়ে চিৎকার করে উঠল শাসা। সাথে সাথে পিছু ফিরে তাকাল মেয়েরা।

“স্টপ!” সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল শাসা, “স্টপ।”

মেয়েদের একজন হয়ত ম্যাটি হাত নাড়ল। কিন্তু না থেমেই আবার হাঁটতে শুরু করল পুরো দল। হয়ত শাসাকে চিনতে পারেনি। কিংবা স্টপ কথাটা শোনেনি।

সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে আবার দৌড় দিল শাসা। জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। ধপধপ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। পা দুটো আর ছুটতে চাইছে না। তারপরেও কেবল ইচ্ছেশক্তির জোরেই ছুটল সামনের দিকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে দশ কদম দূরে থাকতেই পিছন ফিরে তাকাল তারা।

“শাসা!” বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা, “তুমি এখানে?”

ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল শাসা। অ্যানা আর মাকেও ছাড়িয়ে চলে গেল।

 “কী হয়েছে শাসা?”।

“পরে!” আর কোনো শব্দ খুঁজে পেল না বেচারা। অবশ পা দুটো টেনে কেবল ছুটছে।

কিন্তু ততক্ষণে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে দুই বুড়ো। ওদের বিশ কদম পেছনে ব্লেইন। আবার চিৎকার দিল শাসা।

অনেক দূরে হলেও স্পষ্ট কানে এল মসারের তীক্ষ্ণ শিষ। শোনার সাথে সাথে কোথা থেকে নব উদ্যম এসে ভর করল ওর শরীরে। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাগিয়ে লাফিয়ে সামনে যেতেই মনে হল কেউ যেন চিৎকার করছে। নাকি কানে বাজছে। তার নিজেরই বুকে হাতুড়ির বাড়ি কে জানে।

***

সারারাত নিজের গোপন আস্তানায় শুয়েছিল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উঠে খানিক এক্সারসাইজ করে কাটিয়ে নিল হাত-পায়ের জড়তা। তারপর ব্লাডারও খালি করে ফেলল।

আবার জায়গামত এসে ওভারকোট আর জার্সি খুলে পুঁটুলি বানিয়ে রেখে দিল পাথরের নিচে। প্যারেডের সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়অলার কাছ থেকে কেনায়। এগুলো দিয়ে কেউ তাকে খুঁজে বের করতে পারবে না। তেরপলের ওপর সোজা হয়ে গান সাইটে চোখ রাখতেই দেখা গেল বাধা দিচ্ছে কয়েকটা ঘাসের ডগা। সেগুলোও মুচড়ে ভেঙে ফেলে দিল। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারপাশ।

একেবারে স্থির, পাথরের মত পড়ে আছে ম্যানফ্রেড। ঠিক যেন একটা শিকারি চিতা। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন এগিয়ে আসবে শিকার। সতর্ক হয়ে আছে কেবল হলুদ একজোড়া চোখ।

তারপর আচমকাই ঘটে গেল সবকিছু। কোনো রকম ওয়ার্নিং গলার আওয়াজ কিংবা পদশব্দ ছাড়াই রাস্তার উপর দেখা গেল এক মানব শরীর। নীল আকাশের পটভূমিতে মনে হচ্ছে একটা ছায়াছবি।

ম্যানফ্রেড তো তৈরি হয়েই ছিল। সাথে সাথে কাঁধের ওপর তুলে নিল বন্দুক। টেলিস্কোপিক সাইটে চোখ দিতেই ফুটে উঠল লোকটার চেহারা।

 সাদা শার্ট আর হলুদ হয়ে যাওয়া পানামা হ্যাট পরনে বৃদ্ধ এক লোক। বসন্তের উজ্জ্বল রৌদ্রে চমকাচ্ছে তার রুপালি দাড়ি। এবার আর মাথায় নয়, সোজা লোকটার বুকেই গুলি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল ম্যানফ্রেড।

 আলতো করে মসারের ট্রিগারে চাপ দিল। সাথে সাথে কান যেন ফেটে যাবার জোগাড়। কাঁধে লাগল হাতলের গুতো।

এতদূর থেকেও হাড় জিরজিরে বুকটা ভেদ করে বুলেটটাকে বেরিয়েও যেতে দেখল ম্যানফ্রেড। ঘাসের ওপর রক্তের পুকুরে মুখ ডুবিয়ে পড়ে গেল বুড়ো। পেছনেও লম্বা একটা রক্তের রেখা।

 উঠে দাঁড়িয়েই দৌড় দিল ম্যানফ্রেড। কীভাবে মরিসে পৌঁছাবে সেটা নিয়েও প্ল্যান করা আছে। আর মনে সন্তুষ্টির আনন্দ থাকায় পায়ের শক্তিও হয়ে গেল দ্বিগুণ।

পেছনে কে যেন প্রচণ্ড বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু পিছু ফিরে তাকাবারও প্রয়োজন মনে করল না ম্যানফ্রেড।

***

এক দৌড় দিয়ে চূড়ায় উঠে এল শাসা। পথের পাশেই ঘাসের উপরে পড়ে থাকা দেহটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে বাকি দু’জনে। আতঙ্ক ভরা চোখ নিয়ে দুজনেই তাকাল শাসার দিকে।

একবার শুধু মৃতদেহটার দিকে চেয়ে দেখল শাসা। বুকের উপরে দুই হাতের মুঠো ঢুকিয়ে দেয়ার মত বড়সড় একটা গর্ত।

আর কোনো আশা নেই। গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই মারা গেছেন। নিজেকে শক্ত করে ফেলল শাসা। দুঃখ করার জন্য পরেও সময় পাওয়া যাবে। এখন প্রতিশোধ নিতে হবে।

“কে করেছে দেখেছেন?” এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নটা করে ফেলল। “ইয়েস” লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “একঝলক দেখেছি। শর্টকাটে দৌড়ে ওডিক্রাল কপের দিকে গেছে। নীল ড্রেস।”

এই পর্বতের প্রতিটি চূড়া আর বাক শাসার মুখস্থ। তাই বুঝে গেল যে খুনি মাত্র দুই মিনিট আগে ভেগে গেছে।

“তার মানে যেদিক দিয়ে ঘোড়া যায় সেদিকে গেছে। আমি তাকে নার্সারি র‍্যাঙিনে গিয়ে ধরতে পারব।” আবারো ব্রেকফাস্ট রকের দিকে দৌড় দিল শাসা।

 “সাবধানে! ওর কাছে রাইফেল আছে, আমি দেখেছি।” একমাত্র এ রাস্তা দিয়েই পাহাড়ে কোনো বাহন উঠানো সম্ভব। তার মানে খুনি কতটা সাবধানে পালাবার পথও প্ল্যান করে রেখেছে। কাপে যাওয়ার আরেকটা সহজ রাস্তা আছে আর তাতে অনেকখানি সময়ও বেঁচে যাবে। কিন্তু পথের মাথাটা পেতে ভুল হলেই সব গন্ডগোল হয়ে যাবে।

যাই হোক, খুঁজে পেল শাসা। কিন্তু রাস্তার একাংশ ভেঙে যাওয়াতে পুরো ৫০০ ফুট খোলা মুখ লাফ দিয়ে এপাড়ে হাঁটু গেড়ে ল্যান্ড করেই আবার উঠে দিল দৌড়।

এরপর আচমকাই মেইন ফুটপাতে এসে পড়ায় বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসা খুনির সাথে ঠোক্কর খেলো শাসা।

মুহূর্তের জন্য লোকটার বিশাল দেহ আর চওড়া কাঁধের ছোঁয়া পেলেও একসাথে গড়াগড়ি করে পড়ে গেল দু’জনেই। ফলে খুনির হাত থেকে রাইফেলটা ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু তার পেশি শক্তির সক্ষমতা অনুভব করে চমকে গেল শাসা। সাথে সাথে বুঝে গেল এর সাথে পারবে না। খানিক বাদেই দেখা গেল ওর বুকের উপর শুয়ে আছে খুনি।

মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরত্বে দু’জনের মুখ। লোকটার মুখে ঘামে ভেজা ঘন আর কোঁকড়ানো কালো দাড়ি, বাঁকানো নাক কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর হল হলুদ জোড়া চোখ। কেন যেন বেশ পরিচিত মনে হল। যাই হোক, তাতেই খানিকটা শক্তি পেল শাসা।

কোনোমতে এক হাত মুক্ত করেই বেল্ট থেকে বেরেটা নিয়ে খুনির মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে দিল বাড়ি। খুলির হাড় ফাটার স্পষ্ট শব্দও কানে এল।

 শাসাকে ছেড়ে ওপাশে পড়ে গেল লোকটা। হাঁচোড়-পঁচোড় করে উঠে বেরেটা লোড করতে বসল শাসা। কিন্তু নিশানা করার আগেই হঠাৎ দুই পা তুলে ওর বুকে আঘাত করল খুনি।

পিছনে গড়িয়ে গেল শাসা। বোটা থেকে গুলি বেরিয়ে গেলেও কারো গায়ে লাগল না। একই সাথে কিনার দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল শাসা। একঝলক দেখেই বুঝল একশ’ ফুটের আগে নিচে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তার আগেই পাথরের কিনার দিয়ে বের হওয়া পাইনের একটা মাথা আঁকড়ে ধরে কোনমতে সামলাল ওই পতন।

সেইভাবে ঝুলন্ত অবস্থাতেই উপরে তাকাতেই খুনি লোকটাকে একপলকের জন্য ওর দিকে নিচে তাকাতে দেখল শাসা। কিন্তু সাথে সাথেই আবার উধাও হয়ে গেল সেই অদ্ভুত হলুদ চোখের মালিক। কানে এল দৌড়ে গিয়ে কারো রাইফেল লোড করার আওয়াজ।

 “এখন নিশ্চয়ই আমাকে শেষ করতে আসবে।” আপন মনে ভাবতেই মনে পড়ল ডান হাতে থাকা বেরেটার কথা।

 মরিয়া হয়ে বাম কনুই পাইনের মাথায় জড়িয়ে উপরের দিকে বেরেটা তা করল শাসা।

আরো একবার আকাশের গায়ে ভেসে উঠল খুনির মাথা আর কাঁধ। নিচের দিকে তাক্‌ করছে মসারের ব্যারেল। ঠিক সেই মুহূর্তে বেরেটা দিয়ে গুলি করল শাসা। হালকা বুলেটটা ছুটে গিয়ে লোকটার মাংসে লাগতেই সরে গেল খুনি। খানিক বাদে দূর থেকে শোনা গেল আরেকটা গলার আওয়াজ। ব্লেইনের কণ্ঠ।

 দ্রুতপায়ে দৌড়ে সরে গেল খুনি। মিনিটখানেক বাদেই নিচে শাসার দিকে তাকালেন ব্লেইন।

“দাঁড়াও!” হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রাউজার থেকে মোটা চামড়ার বেল্ট খুলে শাসার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন ব্লেইন।

তারপর পেট পেতে শুয়ে পড়লেন খাদের কিনারে। পোলো প্র্যাকটিস থাকাতে এই বয়সেও যথেষ্ট ফিট ব্লেইন। তারপরেও শাসাকে তুলতে বেশ কয়েক মিনিট ব্যয় করতে হল।

পাশাপাশি কিছুক্ষণ শুয়ে দম নিল দু’জনে। তারপর টলতে টলতে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াল শাসা। ধাতস্থ হতেই আবার দৌড় দিল। একটু পরেই ওকে ধরে ফেললেন ব্লেইন। তাঁকে দেখে আরো প্রত্যয়ী হয়ে উঠল শাসা। দৌড়ানোর মাঝখানেই ব্লেইন বললেন, 

“রক্ত” পথের উপরে পড়ে থাকা পাথরের গায়ে ছোট ছোট ছিটে দেখে জানালেন, “তুমি ওকে গুলিটা লাগাতে পেরেছো!”

 ঘোড়া চলার উপযুক্ত চওড়া রাস্তাটাতে পৌঁছে গেল দুজনে। কিন্তু মোড়ের মাথায় পৌঁছাবার আগেই কানে এল নিচে ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ।

“ওর কাছে গাড়ি আছে!” হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো মতে বললেন ব্লেইন। দ্রুত হয়ে উঠল ইঞ্জিনের গর্জন, অন্যদিকে শাসার পা দুটোও আর শরীরের ভার বইতে পারছে না। রাস্তার মাঝখানেই ভেঙেচুরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শাসা।

খানিক বাদে সিসিলিয়া ফরেস্ট্রি স্টেশনের টেলিফোন থেকে সিআইডি হেড কোয়ার্টারে নেলকে ফোন দিল শাসা। খুনির বর্ণনা দিয়ে জানাল,

 “আপনাকে অনেক তাড়াতাড়ি করতে হবে। নিশ্চয়ই ওর পালানোর পুরো প্ল্যান করা আছে।”

প্রতি বছর এ পাহাড়ে বেশ কিছু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাই ফরেস্ট্রি স্টেশনে লাইটওয়েট স্ট্রেচার থাকে। ছয়জন কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারী ব্লেইনদের সাথে চলে এল স্কোলিটন গর্জে।

মেয়েরা সবাই ওখানেই অপেক্ষা করেছে এতক্ষণ। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন সেনটেইন আর অ্যানা পাতলা একটা কার্পেট দিয়ে ঢেকে রেখেছেন মৃতদেহ।

হাঁটু গেড়ে বসে কার্পেটের এক কোনা তুলে স্যার গ্যারি কোর্টনির শবদেহ দেখল শাসা। পড়ে যাওয়াতে নাক ভেঙে গেলেও সারা মুখে অত্যন্ত প্রশান্তির এক ছাপ থাকায় মনে হচ্ছে যেন কোনো মৃত সিজারের মুখ।

দাদুর ঠাণ্ডা, ভেলভেটের মত মসৃণ কপালে চুমু দিল, তারপর উঠে দাঁড়াতেই ওর কাঁধে হাত রাখলেন ফিল্ড মার্শাল স্যুটস। “আয়্যাম সরি, মাই বয়” বলে উঠলেন বর্ষীয়ান প্রধানমন্ত্রী, “এই বুলেটটা আমার দিকে লাগার কথা ছিল।”

***

এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাচ্ছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। মরিসের ইঞ্জিন চালু অবস্থাতেই খুলে ফেলল ওভারঅলের সামনের বোতাম। বাহুমূলের ঠিক নিচে ঢুকে গেছে বুলেট। অন্য কোন ক্ষত না থাকায় বোঝা গেল গুলি এখনো ভেতরেই আছে। আস্তে করে হাত পেছনে নিয়ে কাঁধ ছুঁতেই ফোলা জায়গাটায় : ব্যথা পেয়ে আর্তচিৎকার করে উঠল ম্যানি।

চামড়ার ঠিক নিচে আঘাত করলেও মনে হচ্ছে বুকের কোথাও কোনো ক্ষতি করেনি বুলেট। তাই রুমাল চেপে বাহুমূলের, ক্ষত ঢেকে ওভারঅলের বোতামগুলো আবার লাগিয়ে নিল। ঘড়িতে এখনো এগারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি আছে। মাত্র তেইশ মিনিট আগেই ওর ছোঁড়া গুলিতে এবার মুক্তির স্বাদ পাবে তার দেশবাসী।

বিজয়ের আনন্দে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠায় ব্যথা ভুলে গেল ম্যানফ্রেড। উডস্টকের ভেতর দিয়ে মরিস চালিয়ে সোজা রেলওয়ে ইয়ার্ডে চলে এল।

সিটের নিচে রেখে দিল মসার। অন্যরা সরিয়ে নিবে গাড়ি আর রাইফেল। তাড়াতাড়ি রেস্টরুমে গিয়ে ঢুকতেই দেখল বাকিরাও অপেক্ষা করছে।

নীল ওভারঅলে রক্ত দেখেই উদ্বিগ্ন মুখে ছুটে এল রুলফ।

 “তুমি ঠিক আছে তো? কী হয়েছিল?”

“স্মুটস মারা গেছে।” জানাল ম্যানফ্রেড আর সাথে সাথে যেন তার আনন্দও অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না কিংবা নড়েওনি। তারপরেও বোঝা গেল যেন বদলে গেছে ইতিহাস; কয়েক সেকেন্ড বাদে নীরবতা ভাঙল রুলফ।

“তুমি আহত হয়েছে।”

দলের একজন গিয়ে মরিসটাকে দূরে সরিয়ে রেখে এল। রুলফ ম্যানফ্রেডকে নোংরা ওভারঅল খুলে ফেলতে সাহায্য করল তারপর ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

ম্যানফ্রেড যেহেতু বাম হাত নড়াচড়াই করতে পারছে না তাই ওর কালো দাড়ি কেটে শেভ করে দিল রুলফ। আবারো নিজের সুদর্শন চেহারা ফিরে পেল তরুণ ম্যানি। তবে রক্ত যাওয়াতে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

 “আমরা শীঘ্রই আবার দেখা করব আর তোমার বন্ধু হতে পেরে সত্যিই খুব গর্ব বোধ হচ্ছে। খন থেকে সবাই কেবল তোমার প্রশংসা করবে।”

এগিয়ে এল ইঞ্জিন ড্রাইভার, “আমাদের যাওয়া উচিত।” রুলফের সাথে হাত মিলিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ লোকোমাটিভের উদ্দেশে পা বাড়াল ম্যানফ্রেড।

ওরচেস্টার স্টেশনে উত্তরগামী ট্রেনটাকে থামিয়ে জোর তল্লাশি চালাল পুলিশ। ক্যাবে ঢুকতেই তাই ইঞ্জিন ড্রাইভার জানতে চাইল,

“কী হয়েছে?”

“আজ সকালেই টেবিল মাউন্টেনে অত্যন্ত গণ্যমান্য এক ব্যক্তি খুন হয়েছেন। আমাদের কাছে খুনির বর্ণনাও আছে। প্রতিটা রাস্তায় পুলিশ সতর্ক পাহারা বসিয়েছে; জাহাজ আর ট্রেনও চেক করা হচ্ছে”।

“কে মারা গেছে?” ম্যানফ্রেড জানতে চাইলে কাঁধ ঝাঁকাল কনস্টেশন, “জানি না বন্ধু, তবে নিশ্চয়ই বেশ গুরুত্বপূর্ণ কেউ।” ক্যাবে থেকে নেমে গেল পুলিশ। সবুজ সিগন্যাল পেয়ে উত্তরে ছুটল ট্রেন।

কিন্তু ব্লুয়েফন্টেনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ম্যানফ্রেডের কাধ ফুলে গোল হয়ে গেল; প্রচণ্ড ব্যথাও করছে। ক্যাবের এক কোনায় গুটি গুটি হয়ে ব্যথায় কাতরাতে লাগল প্রায় অচেতন ম্যানি।

রুলফ আগেই ফোন করে রাখায় বন্ধুরা এসে ওকে রেলওয়ে ইয়ার্ডে নিয়ে গেল।

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“ডাক্তারের কাছে।” উত্তরটা শোনার পরপরই জ্ঞান হারাল ম্যানফ্রেড।

আবার যখন জ্ঞান ফিরল দেখা গেল অত্যন্ত আলোকিত আর সুসজ্জিত একটা রুমে শুয়ে আছে সে। কাঁধে সাদা ব্যান্ডেজ আর চেতনানাশকের ঘোর সত্ত্বেও তেমন খারাপ লাগছে না।

ম্যানফ্রেড জেগে গেছে বুঝতে পেরেই জানালার পাশের চেয়ার থেকে এগিয়ে এল এক লোক।

“এখন কেমন লাগছে?”

 “খারাপ না। বিপ্লব ঘটে গেছে?”

কিন্তু অবাক হয়ে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো না?”

“আমি শুধু জানি যে আমরা সফল হয়েছি” ম্যানফ্রেডের কথা শেষ হওয়ার আগেই সংবাদপত্র বাড়িয়ে দিল লোকটা। হেড লাইনে লেখা :

টেবিল মাউন্টেনে নৃশংস গুপ্তহত্যা বিখ্যাত ইতিহাসবিদকে হত্যার জন্য ওবি’কে দায়ী করা হয়েছে, ৬০০ জনকে গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছেন সুটস্।

ম্যানফ্রেডের হতবিহ্বল চেহারা দেখে লোকটা এবারে জানাল, “তুমি ভুল লোককে খুন করেছে। তবে স্মুটস তার অজুহাত পেয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লিভারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন তোমাকে খুঁজছে। হয়ত এখানেও যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়বে পুলিশ। তুমি এখানে আর নিরাপদ নও।”

ট্রাকের পিঠে চড়ে শহর থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড। ওবির বাকি নেতারাও আত্মগোপনে গেছেন। কেউই তাকে রাখতে রাজি হচ্ছে না।

সফল এক বিদ্রোহের হিরো হওয়ার বদলে দুর্বল শরীরে পালিয়ে বেড়াতে হল এ ডেরা থেকে ও ডেরায়। গ্রেফতারকৃতদের তালিকায় রুলফ আর ট্রম্প বিয়ারম্যানের নাম দেখে মুষড়ে পড়ল ম্যানফ্রেড। সারাহ, ট্রুডি আন্টির কথা চিন্তা করে আহত পশুর মত গুঙ্গিয়ে উঠল। কিন্তু ওকে রাখার ঝুঁকি আর কেউ নিতে চাইছে না।

আটদিন বাদে জোহানেসবার্গ এল ম্যানি। ঘটনাক্রমে এসে পড়ল উইটওয়াটারস্রান্তে। ব্রাদার্স হুডের সবশেষ এক আস্তানার ঠিকানা পেয়ে ট্রামে চড়ে সেদিকেই ছুটল। এখন দরকার ৩৬ নম্বর রাস্তা। কিন্তু নীল ইউনিফর্মের পুলিশ দেখে ৩৬ নং পেয়েও নামার সাহস করল না ম্যানডে।

অগত্যা টার্মিনালে নেমে বসল গিয়ে এক কফি শপে। শেষ কয়েকটা কয়েন দিয়ে বিল মিটিয়ে ভাবতে লাগল যে এরপর কী করা যায়। ভাগ্য বুঝি এখন তাকে আর সহায়তা করবে না।

 ঠিক তখনই ক্যাফের তেলতেলে কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই রাস্তার ওপাশের স্ট্রিট সাইনটা চোখে পড়ল। সাথে সাথে কেঁপে উঠল স্মৃতি। কী যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। আর সেই মুহূর্তেই খুঁজে পেল নতুন আশার ঝলক।

ক্যাফে থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা ধরে হাঁটা শুরু করল ম্যানি। খানিক বাদেই ভাঙাচোরা একটা গলিতে পৌঁছে গেল যেখানে কোনো শ্বেতাঙ্গ নজরে আসছে না। যা খুঁজছে তা পেয়েও গেল।

ছোট্ট একটা জেনারেল ডিলারস্ স্টোর। কৃষ্ণাঙ্গ কাস্ট্রোমাররা হাসি-ঠাট্টা আর কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকলেও ওকে দেখেই পথ ছেড়ে দিল।

ওয়েস্টার্ন স্টাইলের সুট পরিহিত মালিক এক বয়স্ক জুলু। মুখে সাদা দাড়ি। ম্যানফ্রেডের অনুরোধ শুনে বলল, “আমার সাথে এসো নাকোমি।”

তারপর দোকানের পিছনের স্টোররুমে নিয়ে গিয়ে বলল, “তোমাকে হয়ত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।”

একগাদা চিনির বস্তার ওপর বসে পড়ল ম্যানফ্রেড। ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া কাধও ব্যথা করছে। তাই সেভাবে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল। বহুক্ষণ বাদে ঘুম ভাঙ্গল কাঁধে কারো স্পর্শ আর গম্ভীর এক কণ্ঠ শুনে।

“আমাকে কোথায় খুঁজতে হবে সেটা কীভাবে জানলে?”

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড, “বাবা বলেছে। হ্যালো সোয়ার্ট হেনড্রিক।”

 “কত বছর পার হয়ে গেছে। ম্যানি।” ফোকলা দাঁত দেখিয়ে হেসে ফেলল ওভাষো, “অনেক বছর। কিন্তু কেন যেন সব সময় মনে হত যে আমাদের আবার দেখা হবে। মরুভূমির দেবতা আমাদেরকে একসাথে বেঁধে রেখেছে। লিটল ম্যানি, আমি জানতাম তুমি আসবে।”

***

ড্রেকস ফার্মের অল্প কয়েকটা ইটের বাড়ির একটা সোয়াট হেনড্রিকের ঘরে একত্রে বসে আছে দু’জন। বিয়ার খেতে খেতে সিরিয়াস আলোচনা চললেও ছোট্ট শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েও সমান তালে আদর করছেন হেনড্রিক। বললেন, “তো লিটল ম্যানি, দু’জন তো দুজনের সব কথা শুনলাম। কিন্তু সমস্যা আসলে সেই একটাই।” বিয়ারের পাত্র তুলে মুখভর্তি সাদা ফেনা গিলে ফেললেন হেনড্রিক, “আর তা হল, প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশন আর প্রতিটি রাস্তায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। তোমার মাথার দামও ঘোষণা করেছে লিটল ম্যানি। পুরো পাঁচ হাজার পাউন্ড। এই টাকা দিয়ে কতগুলো স্ত্রী আর বাছুর কেনা যাবে?” আপন মনেই প্রশ্নের উত্তরটা ভেবে বিস্মিত হয়ে গেলেন ওভাষ্যে, “তুমি চাইছো যেন তোমাকে উত্তরের নদী পেরোতে সাহায্য করি কিন্তু শ্বেতাঙ্গ পুলিশ যদি জানতে পারে দুজনকে একই গাছে ফাঁসিতে লটকে দিবে অথবা স্মাটসের কারাগারে পাথর ভাঙতে পাঠিয়ে দিবে” দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাটকীয়ভাবে দুঃখের ভান করলেন হেনড্রিক, “ভাবো তো লিটল ম্যানি, এর উত্তর কী হবে?”

“তুমি আমার কাছে বাবার মতই ছিলে হেনি” আস্তে করে বলে উঠল ম্যানফ্রেড, “কোনো বাবা কি হায়েনা আর শকুনের ভয়ে নিজ সন্তানকে ফেলে দেয়?”

“আমিই যদি তোমার বাবা হই তাহলে তোমার চেহারা সাদা আর আমার কালো কেন?” হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “আমাদের মাঝে কোনো দেনা নেই আর, সব বহু আগেই চুকেবুকে গেছে।”

 “আমার বাবা আর তুমি ভাই ছিলে।”

“তারপরে আরো যে কতশত গ্রীষ্ম চলে গেছে। বদলে গেছে পুরো দুনিয়া।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হেনড্রিক।

“একটা জিনিস কিন্তু এতগুলো বছরেও একটুও বদলায়নি হেনি?”

“সেটা কী বাছা?”

হিরে, আমার কালো বাবা! হিরে কখনোই বদলায়নি।”

 মাথা নাড়লেন হেনড্রিক, “তবে তাই হোক। চলো হিরে নিয়েই কথা বলি।”

“একটা নয়। অনেক অনেক হিরে। এমন এক জায়গায় এক ব্যাগ ভর্তি হিরে পড়ে আছে যা কেবল তুমি আর আমিই জানি।”

***

“মস্ত বড় ঝুঁকি নিতে হবে।” ভাইকে জানালেন হেনড্রিক, “কিন্তু ঝোঁপের ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা মানুষখেকো সিংহের মত সন্দেহ আমার পিছু ছাড়ছে মা। বাবাটা যেরকম ভয়ংকর নির্দয় ছিল আমার মনে হয় ছেলেও সেরকম হয়েছে। যদিও আমাদের ভেতরে বন্ধুত্ব স্থাপনের কথা বলছে, তবে আমার খটকা কিন্তু রয়েই গেছে।”

একদৃষ্টে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন মোজেস গামা। “ও স্মাটসকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল।” স্বশব্দে উচ্চারণ করলেন মনের চিন্তা, “ও ঠিক প্রাচীন আমলের শক্তিশালী বোরাদের মতন। যারা মহান গোত্র প্রধানদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রক্তনদীতে সবাইকে গলা কেটে মেরে ফেলেছিল। তারপর ১৯১৪ তে’ও হয়ত পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি।

শ্বেতাঙ্গদের নীতি হচ্ছে, ওর ইতিহাসও আমি দেখেছি, শান্তি আসার পরে যারা যুদ্ধে লড়েছিল ওদেরকে ভুলে যায়। আমার ধারণা পরের লড়াইয়ে শ্বেতাঙ্গরা সুটকে ঝেড়ে ফেলবে আর বোয়ারা জিতে যাবে। আর এই ছেলেটাও ওদেরই একজন।”

 “তুমি ঠিক বলেছ ভাই মাথা নাড়লেন হেনড্রিক, “আমি তো ততদূর পর্যন্ত ভাবিইনি। ও আমাদের শত্রু। ওর জাত ক্ষমতায় এলে আবার আমাদেরকে কচুকাটা করবে। তাই ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেই ভালো হবে।”

এবার চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকালেন মোজেস গামা। এটাই তো সবার সমস্যা। পেট কিংবা বিছানা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ভাই তুমিও তা নিজ মুখে স্বীকার করলে। কেন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো না?”

“বুঝি না যে।”

“আমাদের লোকেদের ধৈর্যই হল তাদের প্রধান সমস্যা। ধূর্ত এক মেষপালকের ভেড়া হয়েই আমাদের দিন কেটে যাচ্ছে। অথচ মন চাইলেও মেষপালক আমাদের মাংসে ছুরিও বসায়।”

“যদি তাই হয় তাহলে তুমি যাদেরকে বোয়া ডাকো তারা কি আরো ভয়ংকর নয়?”

“ওদের উপরই আমাদের লোকদের পরিপূর্ণ মুক্তি নির্ভর করছে। ওদের মনের মাঝে অনেক ঘৃণা আর রাগ। ওরা ইংরেজ আর ইন্ডিয়ানকে যতটা ঘৃণা করে তার চেয়েও বেশি করে আমাদেরকে। কারণ ওরা আমাদেরই প্রাপ্য ভূমি ভোগ করছে। এরা ক্ষমতায় এলে আমাদেরকে সত্যিকারের দাস মানে কি সেই শিক্ষা দিবে। তখনই কেবল আমরা শান্ত ভাব ছেড়ে হয়ে উঠব বুনো ষাড়। তাই তোমার এই শ্বেতাঙ্গ ছেলেটা আর ওর সবকিছুর জন্য প্রার্থনা করতে হবে। আমাদের জনগণের ভবিষ্যতও ওর উপরেই নির্ভর করছে।”

 বহুক্ষণ ধরে আগুনটাকে দেখলেন হেনড্রিক। তারপর কামানের গোলার মত বিশাল টাক মাথা উঠিয়ে সবিস্ময়ে ভাইকে বললেন, “মঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো, তুমিই হলে আমাদের সব গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।”

***

গোত্রের এক চিকিৎসকের কাছে খবর পাঠালেন হেনড্রিক। সেই কবিরাজ এমন এক পুলটিশ দিল যা লাগাবার পর গরম লাগলেও আর বদ গন্ধ ছড়ালেও দ্রুত সেরে উঠল ম্যানফ্রেড। দশ দিনের ভেতরেই ভ্রমণ করার মত ফিটও হয়ে উঠল।

সেই একই কবিরাজ আবার এমন এক ভেষজ রং পাঠাল যা গায়ে মাখার পর ম্যানফ্রেডের চামড়া হয়ে গেল উত্তরে বসবাসকারী গোত্রগুলোর মতন।

ই আর পি এস থেকে ওর ট্রাভেল পেপারস ঠিক করে দিল হেনড্রিকের এক চর। এমনই এক দলের সঙ্গে চোখে সানগ্লাস পরে ওয়েনেলা ট্রেনে চড়ে বসল ম্যানফ্রেড।

অদ্ভুত লাগলেও স্বস্তি পেল যখন দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকাতে যাওয়ার জন্য ধীরগতির এই ভ্রমণে কোনো শ্বেতাঙ্গ অফিসারই ওর দিকে তেমন মনোযোগ দিল না।

 ওকাহানজাতে ট্রেন থেকে নেমে বাসে চড়ে হেনড্রিকের দেশে রওনা দিল ম্যানফ্রেঙ। দুদিন পরে হেনড্রিকসহ আবার রাস্তায় নেমে এল। তবে এবারে পায়ে হেঁটে তপ্ত মরুভূমি পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে উত্তরে। এর ঠিক দুই সপ্তাহ বাদে নীল দিগন্তে দেখা গেল উটের ক্যারাঙানের মত কোপজে।

ছোটবেলা থেকে শহর নগরে বেড়ে ওঠা ম্যানফ্রেড উপলব্ধি করল যে আজ সাথে হেনড্রিক না থাকলে এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা তো দূরের কথা ফেরার রাস্তাই চিনতে পারত না।

আর তাই হেনড্রিক ওকে যে কোজেতে নিয়ে এল প্রথমে তা দেখতে বাকিগুলোর মতন মনে হলেও খাড়া গ্রানাইটের পাহাড় পেরিয়ে চূড়ায় উঠতেই মনে পড়ে গেল যেন গত জনের স্মৃতি। চোখের সামনে যেন জ্বরতপ্ত বাবার শরীরটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ম্যানফ্রেড। কতটা কর্কশ ভাষায় বাবা ওকে নিরাপদে চলে যাওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছিল সেটাও মনে পড়ে গেল। তবে জোর করে মাথা থেকে সেসব চিন্তা দূর করে দিল ম্যানি।

নির্ভুলভাবে এগিয়ে গেল গ্রানাইটের সেই ফাটলের দিকে। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসতেই কেঁপে উঠল বুক। কারণ ভেতরে এত অন্ধকার যে আলাদা করে কিছুই চোখে পড়ছে না।

“তো, বিখ্যাত সেই হিরেগুলো আর নেই, তাই না।” ম্যানফ্রেডের হতাশ মুখ দেখে মিটিমিটি হাসলেন হেনড্রিক, “হয়ত শেয়াল খেয়ে ফেলেছে।”

তাঁর কথায় পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ থেকে ফিশিং লাইনের বান্ডেল বের করল ম্যানি। মাছ ধরার হুক লাগিয়ে নিচে ফেলে দিল বঁড়শি। এরপর ধৈর্য সহকারে লাইনটাকে গভীর অন্ধকারে এদিক-সেদিক ঘোরাতে লাগল।

অন্যদিকে ছায়ার মাঝে বড়সড় একটা পাথর বেছে নিয়ে উবু হয়ে বসে ওর কাজ দেখতে লাগল হেনড্রিক। যদিও কোনো সাহায্য কিংবা উৎসাহও দিচ্ছে না।

ফাটলের ভেতরে বহু নিচে কিছু একটাতে হুক আটকে গেছে বুঝতে পেরে আস্তে করে লাইন টানা শুরু করল ম্যানি। বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা ভারি। ফলে একটু পরেই খুলে এল বঁড়শি। কিন্তু সাথে করে পচা ক্যানভাসের টুকরাও নিয়ে এসেছে।

তাই আবার বঁড়শিটাকে ফাটলের মধ্যে ফেলে দিল। প্রতিটি পাশে ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুঁজছে ম্যানফ্রেড। ফলে আধঘণ্টা পরিশ্রমের শেষে আবারও কিছু একটাতে বিধে গেল বঁড়শি।

এবার সাথে সাথে টান না দিয়ে একটু একটু করে লাইন ঢিলে করে করে টানল। গ্রানাইটে ঘষা খাচ্ছে কিছু একটা খানিক বাদে উঠে এল আকারহীন একটা পোটলা। শেষ কয়েক ফুট তত উত্তেজনায় প্রায় নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেল ম্যানি। অবশেষে উপরে উঠে এল ক্যানভাসের পুরনো একটা ব্যাগ। খুলতেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল অত্যুজ্জ্বল হীরে।

আগেই প্ল্যান করা ছিল যে হিরেগুলোকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা হবে। তারপর প্রথম চয়েস জিতে হেনড্রিক নিজের পছন্দের ভাগটা নিয়ে নিতেই খালি তামাকের প্যাকেটে নিজের হিরেগুলোকে ভরে নিল ম্যানফ্রেড।

 “তুমি সত্যি কথাই বলেছিলে লিটল ম্যানি, আমিই বিনা কারণে তোমাকে সন্দেহ করেছি।” স্বীকার করলেন হেনড্রিক।

পরের দিন সন্ধ্যায় দুজনে একসাথে নদীতীরে আগুন জ্বেলে পাশাপাশি ঘুমালেন। তারপর সকাল হতেই পরস্পরের বিদায় জানাবার সময় ম্যানি বলল, “গুডবাই হেনি, হয়ত কখনো আবার দেখা হয়ে যাবে।”

“আমি তো তোমাকে বলেছিই লিটন ম্যানি, মরুভূমির দেবতা আমাদেরকে একত্রে বেঁধে রেখেছেন। তাই আমি নিশ্চিত যে আমাদের আবার দেখা হবে।”

“আমিও তাহলে অপেক্ষা করব।”

“ঈশ্বরই কেবল সিদ্ধান্ত নিবেন যে আমরা কি পিতা-পুত্র নাকি ভাই অথবা পরস্পরের শত্রু হিসেবে উদয় হব।” কাঁধের ওপর নিজের ঝোলা নিয়ে সোজা দক্ষিণের মরুভূমির দিকে হাঁটা ধরলেন হেনড্রিক। একবারও পিছন ফিরে তাকালেন না।

হেনড্রিক চোখের আড়ালে যেতেই উত্তর-পশ্চিমের দিকে পা বাড়াল ম্যানি। সন্ধ্যার দিকে ক্যানুতে করে পর্তুগিজেও চলে এল। এর তিনদিন পরে পৌঁছে গেল লুয়ান্ডা। সোজা এসে বেল বাজাল জার্মান কনস্যালেটের গেইটে।

বার্লিন থেকে আদেশ আসার জন্য এখানেই পড়ে থাকল তিন সপ্তাহ। পরে বুঝতে পারল যে এই বিলম্ব আসলে ইচ্ছেকৃত। কারণ ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। যা নাজি জার্মানিতে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

নিজের অংশ থেকে একেবারে পানির দরে বেঁচে দিল ছোট্ট একটা হিরে। আর অপেক্ষা করল কখন ডাক আসে।

দিনের বেশিরভাগ সময় ওয়ার্টার ফ্রন্ট ক্যাফেতে বসে কাটিয়ে দেয় ম্যানফ্রেড, রাতটা কোনো স্বস্তাদরের হোটেলে। বারবার ভাবতে চেষ্টা করে কোথায় ওর ভুল ছিল। মনে পড়ে আংকেল ট্রম্প, রুলফ, হেইডি আর বার্লিনে বাচ্চাদের কথা।

অবশেষে এল সেই অর্ডার। ওকে একটা জার্মান ডিপ্লেম্যাটিক পাসপোর্ট দিয়ে পর্তুগিজ জাহাজে উঠিয়ে দেয়া হল। যার মাধ্যমে ক্যানারি আইল্যান্ড পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সেখান থেকে লিসবন।

লিসবনে পৌঁছেও একই রকম অবহেলা পেল ম্যানফ্রেড। ওকে বলা হল নিজের আশ্রয় খুঁজে নিয়ে অপেক্ষা করার জন্য। তাই হেইডি আর কর্নেল সিগমন্ড বোল্ডকে ব্যক্তিগতভাবে চিঠিও লিখল। কিন্তু কনস্যুলেট অ্যাটাশে চিঠিগুলো বার্লিনে পাঠানোর আশ্বাস দিলেও কোনো উত্তর পেল না ম্যানফ্রেড।

আরেকটা ছোট হিরেও তাই বিক্রি করে দিল। তাগাস নদীর তীরে সুন্দর একটা হোটেলে ঘর ভাড়া করে কাটাতে লাগল অলস সময়। দুটো বই লেখার কাজেও হাত দিল। একটা দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক ইতিহাস আর আরেকটা আত্মজীবনী। একই সাথে বসবাসরত এক রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টারের কাছ থেকে শিখে নিল পর্তুগিজ ভাষা। পাশাপাশি বক্সিং প্র্যাকটিসটাও চালু রাখল। তারপরেও দুনিয়া জোড়া লড়াইয়ের অংশ নিতে পারছে না ভেবে আক্ষেপ কিছুতেই কাটাতে পারল না।

এদিকে জিততে চলেছে অক্ষশক্তি। কোলনে বোমা ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে ইউ এস। আবারো হেইডিকে চিঠি লিখল ম্যানফ্রেড।

এর তিন সপ্তাহ পরে জার্মান কনস্যুলেটে ঢু মারতেই মিলিটারি অ্যাটাশে ওকে একটা খাম ধরিয়ে দিল। হেইডির হাতের লেখা দেখে তো যেন খুশিতে আকাশে উড়ে গেল ম্যানি। কিন্তু মেয়েটা লিখেছে যে ওর আগের একটাও চিঠি না পেয়ে ধরেই নিয়েছিল যে ম্যানফ্রেড মারা গেছে। যাই হোক, ছোট্ট লোথারকে নিয়ে ভোলা নিজের একটা ছবিও পাঠিয়েছে হেইডি। পুত্র স্নেহে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড। সাথে সাথে লম্বা এক আবেগঘন চিঠিতে হেইডিকে জানিয়ে দিল যেন ট্রাভেল পাস জোগাড় করে লিসবন চলে আসে। ম্যানফ্রেড এখন যে সচ্ছল আর স্ত্রী-পুত্রকে চালাতে সক্ষম সেটাও লিখে দিল। আরো জানাল ভবিষ্যৎ নিয়ে সুন্দর সব পরিকল্পনার কথা।

***

জেগে জেগে বোমারুবিমানের গর্জন শুনছে হেইডি ডি লা রে। তারপর তিন রাত ধরে চলছে এই গোলাবর্ষণ। ধ্বংস হয়ে গেছে শহরের কেন্দ্রস্থল। এটাও কানে এসেছে যে ফ্রান্স আর রাশিয়াতে জিতে গেছে মিত্রবাহিনি। আরেকটা নির্দয় সত্য হল মিনস্কে রাশানদের হাতে ধরা পড়েছে হাজার হাজার জার্মান সেনা।

হেইডির পাশেই শুয়ে অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছেন কর্নেল সিগমন্ড বোন্ড। কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি ধসে পড়বে তার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি। তখন ছোট্ট লোথার আর তার ফুড রেশনের কী হবে ভেবে হেইডিও চিন্তায় পড়ে গেল।

আবারো কান পেতে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনল। রেইড শেষ হয়ে যাওয়ায় মশার পিনপিন গুঞ্জনের মত করে দূরে সরে যাচ্ছে বোমারুবিমান। কিন্তু ও জানে যে ওরা ঠিক আবার ফিরে আসবে। অন্ধকারে শুয়ে ম্যানফ্রেডের কথাও ভাবল হেইডি। মনে পড়ল সেসব চিঠির কথা যেগুলোর জবাব ও দেয়নি। ছেলেটা এখন লিসবনে আছে আর পর্তুগালে কোনো বোমারুবিমান নেই।

পরদিন সকালবেলা নাশতা খাওয়ার সময়ে কনেকে কথাটা জানাল; বলল, “আমি শুধু ছোট্ট লোথারের কথা চিন্তা করছিলাম।” সাথে সাথে কর্নেলের চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। এক বছর ধরে হেইডিকে মিসট্রেস হিসেবে ব্যবহার করলেও এখন যেন ছাড়তে পারলেই বাঁচেন। সেই সন্ধ্যাতেই ম্যানফ্রেডের কাছে ছবি আর চিঠি পাঠাল হেইডি।

দ্রুত কাজ সারলেন কর্নেল। নিজের প্রভাব খাটিয়ে এক সপ্তাহের ভেতরেই ট্রাভেল পাস্ জোগাড় করে জাঙ্কারস ট্রান্সপোর্ট এয়ার ক্রাফটে তুলে দিলেন হেইডি আর লোথারকে।

 তিনদিন বাদে গ্রুয়েনে ওয়ার্ল্ডে নিজ বাড়িতে বন্দি হলেন কর্নেল। এক সপ্তাহ পরে গেস্টাপো হেড কোয়ার্টারে মারা গেলেন ফুয়েরারকে হত্যা করার পরিকল্পনায় শামিল থাকার অপরাধে। যদিও নিজের নির্দোষিতার পক্ষে জোর দিয়ে গেছেন কর্নেল।

***

ধোয়া ছেড়ে টেবিল বে’তে যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জাহাজের রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে আফ্রিকাকে প্রথম দেখল ছোট্ট লোথার ডি লা রে। বাবা-মায়ের হাত ধরে আনন্দে চিৎকার করছে লোথার।

দুই বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে যুদ্ধ। তারপরেও পরিবার নিয়ে আফ্রিকাতে ফেরার আগে বিস্তর সাবধানতা অবলম্বন করেছে ম্যানফ্রেড। যুদ্ধ শেষে মুক্তি পেয়েছেন আংকেল ট্রম্প আর রুলফ। তাই পারিবারিক সব খবর ভালো।

রাজনৈতিক সংবাদও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। ডা, ডেনিয়েল মালানের অধীনে গঠিত ন্যাশনাল পার্টিতে প্রাক্তন ওবি সদস্যরা সবাই যোগ দিয়েছে।

 স্মুটস আর তার ইউনাইটেড পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষও ঘোট পাকাচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে স্মাটস দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও বেশি ব্রিটিশদের স্বার্থ নিয়ে ভাবেন।

তার উপরে ব্রিটিশ রয়্যাল ফ্যামিলিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণের নিমন্ত্রণ জানানোতেই সকলে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। ডা. ডেনিয়েলের সদস্যরা তো সংসদে, রাজকীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিতই হননি।

সবশেষে আংকেল চিঠি শেষ করলেন এই লিখে যে, “বহু ঝড়-ঝা পেরিয়ে আজ আমরা আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর শক্তিশালী ম্যানি। ঘরে ফিরে এসো। এখন তোমার মত লোকই প্রয়োজন।”

তারপরেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে ম্যানফ্রেড { আংকেলের কাছে চিঠি লিখে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে যে, দেশে হোয়াইট সোর্ডের কথা কেউ জানে না। পুলিশ বাহিনির বন্ধুদের কাছ থেকেও খবর পেল যে তদন্ত এখন একেবারই বন্ধ। যদিও ফাইলটা ঠিকই ওপেন আছে। কিন্তু হোয়াইট সোর্ড সম্পর্কে মিইয়ে গেছে সকলের আগ্রহ।

এরপর স্ত্রী-পুত্রকে লিসবনে রেখে জুরিখে গিয়ে বাকি হিরে বিক্রি করে দিল ম্যানফ্রেড। প্রায় দুই লাখ পাউন্ডও জমা করে দিল সুইস এক অ্যাকাউন্টে।

কেপটাউনে পৌঁছাবার পরেও তেমন একটা শোরগোলের মধ্যে গেল না ওর পরিবার। সন্তর্পণে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, ওবি সদস্যদের সাথে দেখা করে নিশ্চিত হয়ে নিল যে কেউই তার প্রতি তেমন নাখোশ নয়। পরে বার্গার সংবাদপত্রে ছাপা হল অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী মানফ্রেড ডি লা রের প্রথম ইন্টারভিউ। যুদ্ধে নিরপেক্ষ পর্তুগালে থাকলেও এবার দেশের জন্য কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করল ম্যানি।

সুদর্শন ম্যানফ্রেড অত্যন্ত বুদ্ধিমানও বটে। উচ্চ পর্যায়ে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। স্টিলেবশ ল’ ফার্মের অংশীদারিত্ব কিনতেও তাই কোনো ঝামেলা হল না। সিনিয়র পার্টনার অ্যাটর্নি ভ্যান স্কুর মাধ্যমে ন্যাশনালিস্ট পার্টিতেও জায়গা করে নিল।

একাগ্রচিত্তে কেপ ন্যাশনালিস্ট পার্টির হয়ে কাজকর্ম শুরু করে দিল ম্যানফ্রেড। সংগঠক আর তহবিল সংগ্রাহক হিসেবেও খ্যাতি জুটে গেল। ফলে ১৯৪৭ সালে পেল ব্রাদারহুড নামক আরেক গোপন আফ্রিকান সংগঠনের সদস্যপদ।

কেবলমাত্র অত্যন্ত মেধাবী আর চৌকষ ব্যক্তিরাই হতে পারে এটার সদস্য। একই সাথে সেই সদস্যের শরীরে থাকতে হবে বিশুদ্ধ আফ্রিকান রক্ত। তাছাড়া মানুষের মাঝে তার জনপ্রিয়তাও থাকতে হবে।

১৯৪৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের ক্যাম্পেইনেই এ সুযোগ পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড। তৃণমূল পর্যায়ে ইটেনটটস হল্যান্ডের ক্যান্ডিডেট হয়ে গেল ম্যানফ্রেড ডি লা রে।

দুই বছর আগে এই আসন পেয়েছিল ধনী আর ইংরেজি ভাষী কেপ ফ্যামিলি থেকে আসা এক ওয়্যার হিরো। ইউনাইটেড পার্টি সেই শাসা কোর্টনিকে সাধারণ নির্বাচনে তাদের দলের মনোনয়ন প্রদান করেছে।

ম্যানফ্রেডকে আরেকটা সিট দেয়ার কথা উঠলেও সে নিজেই এ আসন বেছে নিয়েছে শাসা কোর্টনিকে আরেকবার মোকাবিলা করার জন্য। ওয়ালবিস বে’তে তাদের প্রথম সাক্ষাতের কথা তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তারপর থেকেই যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাধা পড়েছে তাদের ভাগ্য।

নির্বাচনের ক্যাম্পেইন শুরু করার আগে তাই কোর্টনি পরিবার বিশেষ করে শাসা ও সেনটেইন কোর্টনির ওপর তদন্তে নামল ম্যানফ্রেড। এই নারীর অতীত নিয়ে আবিষ্কার করল এক রহস্যময় অধ্যায়। ব্যাপারটা নিয়ে ও এতই বিচলিত হয়ে উঠল যে প্যারিসে থেকে আগত এক প্রাইভেট গোয়েন্দাও নিযুক্ত করল এই রহস্য উদঘাটনের জন্য।

 প্রিটোরিয়া সেন্ট্রাল কারাগারে প্রতি মাসে বাবাকে দেখতে যায়। তাই পিতার কাছেও জানতে চাইল কোর্টনিদের আদ্যোপান্ত।

প্রচারাভিযানের শুরুতেই তাই নিজের তদন্তের সুফল পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড { জানে গুরুত্বপূর্ণ এই সুযোগ তার পক্ষেই যাবে।

***

টেবিল মাউন্টেনের উপরে বাকি দলটা থেকে খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন কোর্টনি। স্যার গ্যারি মারা যাওয়ার পর থেকেই পাহাড়টা তাকে বিষণ্ণ করে তোলে। কেবলমাত্র অফিসিয়াল পার্টনার হওয়ার অভিনয় করার জন্য ব্লেইনের অনুরোধ ফেলতে না পেরেই আজ এখানে আবার আসতে বাধ্য হয়েছেন।

রাজা জর্জের সাথে কথা বলছেন ওড বাস; রাজকুমারীদের ছোট্ট দলটার সাথে দাঁড়িয়ে আছেন ব্লেইন। আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মানুষকে পরীক্ষা করে দেখছেন সেনটেইন। কানের কাছে চকচক করছে রুপালি আভা। রোদে পোড়া চেহারাতেও গভীর কয়েকটা আঁচড়। কিন্তু দৌড় আর ঘোড়া চালানোর অভ্যাস থাকাতে পেট এখনো মেদহীন আর শরীরটাও শক্তপোক্ত। তারপরেও বয়স যে হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

“ওহ গড” মনে মনে আঁতকে উঠলেন সেনটেইন, কয়েক মাসের ভেতরে আমার নিজের বয়সও আটচল্লিশ হয়ে যাবে।” হাত বাড়িয়ে নিজের মাথাও স্পর্শ করলেন; কয়েকটা রুপালি চুল থাকলেও রোদে পুড়ে লালচে দেখায়।

 “হাতে না জানি আর কতটুকু সময় আছে ডালিং” আপন মনেই ভাবতে গিয়ে বিষণও হয়ে উঠলেন, “গতকালও নিজেকে তরুণী আর অবিনশ্বর ভাবতাম। কিন্তু এখন মনে হয়, না সবকিছুই ক্ষয় হয়।”

ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ তুলে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন। আবার অন্যদের কাছ থেকে জামা চেয়ে নিয়ে এদিকে এলেন, “অত সুন্দর একটা দিনে এত সিরিয়াস চেহারা করে আছো কেন?” হেসে ফেললেন ব্লেইন।

 “ভাবছি তুমি কীভাবে এতটা বেশরম হলে ব্লেইন ম্যালকম?”

“মানে?” মুছে গেল তার হাসি। “রাজা-রানির সামনে নিজের মিসট্রেস নিয়ে হাঁটছো! জানো এটা কতবড় অপরাধ। টাওয়ার গ্রিনের সাথে তোমাকে ফাঁসিতে লটকে রাখার কথা।”

 খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকেই কিশোরদের মত উচ্ছল হয়ে উঠলেন আনন্দিত ব্লেইন, “মাই ডিয়ার লেডি, এ ভাগ্য বদলানো আমার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। তোমার পদমর্যাদা বদলে দিলে কেমন হয়?”

 খিকখিক করে হেসে ফেললেন সেনটেইন, “বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার জন্য কত অদ্ভুত এক সময় আর পরিবেশ, তাই না।”

“তোমার কি মনে হয়, এখন যদি ওদের সামনেই তোমাকে কিস্ করি তাহলে রাজা-রানির দল কী ভাববেন?”

“পাগল কোথাকার, রাখো! আজকে বাসায় গিয়ে তোমাকে কী করি দেখো!”

সব শুনে সেনটেইনের হাত ধরে সামনে নিয়ে গেলেন ব্লেইন।

***

“কেপের সবচেয়ে সুন্দর বাড়িগুলোর একটা হল ওয়েস্টেভেদেন, নিজের মতামত দিলেন ব্লেইন, “কিন্তু এটা তো আমার নয়। আমি আমার বধূকে নিজের কুটিরেই নিয়ে যেতে চাই।”

“আমরা নিউল্যান্ডের বাড়িতে একসাথে থাকতে পারব না।” আর কিছু বললেন না সেনটেইন। ক্ষণিকের তরে যেন তাদের মাঝে দিয়ে হেঁটে গেল ইসাবেলার ছায়া।

“তাহলে সেই কটেজ?” ইসাবেলার স্মৃতিকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে হেসে ফেললেন ব্লেইন?” বিশাল রাজকীয় একটা বেড আছে, আর কী চাই বলো?”

“সেটাও থাকবে। মন চাইলেই আমরা সেখানে যাবো।”

 “ডার্টি উইকেন্ডস, ওহ!”

“তুমি একটা কামুক জানো তো?”

 “তাহলে আমরা কোথায় থাকব?”

“আরেকটা জায়গা খুঁজে নিব। আমাদের জন্যে বিশেষ একটা জায়গা।”

সবশেষে বিস্তৃত জায়গা নিয়ে গত শতকের শেষ দিকে তৈরি এক ভিক্টোরিয়া ম্যানসন খুঁজে নিলেন সেনটেইন, যেখান থেকে দেখা যায় পাঁচশ একর পাহাড়, সৈকত আর শান্ত সবুজ আটলান্টিকের জল। নাম দিলেন রোড হিল। এখান থেকে মাত্র বিশ মিনিট গাড়ি চালালেই ওয়েল্টোত্রেদেনেও পৌঁছে যাওয়া যাবে।

যুদ্ধ শেষে কোর্টনী মাইনিং অ্যান্ড ফিন্যান্সের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেল শাসা। এবার ওয়েল্টেভ্রদেনে উঠে যাবে শাসা আর তারা। কিন্তু তার ফেলে আসা ফার্নিচার বদলে বাগান আর লটাকেও নতুন করে সাজিয়েছে মেয়েটা; যা দেখে বহুকষ্টে নিজেকে সামলালেন সেনটেইন।

উইন্ডহকের ডেভিড আব্রাহামসকে নিয়ে কোর্টনি মাইনিং কোম্পানির অ্যাডভেঞ্চারে ঝাঁপ দিল শাসা। যদিও ওর অতীব সাহসী কোনো প্রজেক্টে বাদ সাধার জন্যে পুরাতন অ্যাবি আর টুয়েন্টিম্যান জোনস্ও আছেন। তারপরেও বলা চলে দিনকে দিন উন্নতির শিখরে উঠে যাচ্ছে সেনটেইনের পরিশ্রমের ফসল। এমনকি সর্বদা সংশয়বাদী টুয়েন্টিম্যানও বিড়বিড় করে প্রায়ই বলেন যে, “নাহ ছেলেটার কাঁধের উপর একটা মাথা আছে বটে।”

এরপর বাই ইলেকশনেও ন্যাশনালিস্ট প্রতিপক্ষকে অল্পের জন্য হারিয়ে ইউনাইটেড পার্টির ক্যান্ডিডেট হিসেবে জিতে গেল শাসা। আর এদিকে খুশিতে আত্মহারা হলেন সেনটেইন। ছেলেকে নিয়ে তার সকল স্বপ্ন বুঝি সত্যি হতে চলেছে। সাধারণ নির্বাচনে নিশ্চয় আরো বড় কোনো পদ পাবে শাসা। তারপর কেবিনেট সিট আর তারপর, ওহ! তিনি আর ভাবতে পারছেন না।

শাসার চোখে পট্টি থাকলেও চমৎকার ব্যক্তিত্ব, স্পষ্ট ভাষা আর মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষমতা আছে। এছাড়া বুদ্ধিমান আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও। ফলে ওর দ্বারা সবই সম্ভব।

আর অন্যদিকে তারা ওয়েল্টেভ্রেদেনের চাকচিক্য বজায় রাখার পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় কেপটাউনের ক্লিনিক আর দারিদ্রপীরিত অঞ্চলে; সাথে থাকে বিপুল অংকের ডোনেশন।

একই সাথে কোর্টনি পরিবারকে দিয়েছে স্বাস্থ্যবান তিন পুত্র সন্তান আর চতুর্থবার প্রসব বেদনায় খানিকটা বেশি কষ্ট ভোগ করলেও পৃথিবীতে এসেছে ইসাবেলা। বড় তিনজন হল শন, গ্যারিক, মাইকেল।

খুব সতর্ক আর যত্ন সহকারে তারা শাসার নারী আসক্তিকে ঠেকিয়ে রাখলেও এবারে ইসাবেলা ডি থাইরি ম্যালকমস কোর্টনির আগমনে যেন পুরোপুরি বদলে গেল শাসা। আর তার মাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

 ওয়েল্টেভ্রেদেনের পোলো প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডের পাশে ওক গাছের নিচে বসে আছেন সেনটেইন। বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে কৃষ্ণাঙ্গ ন্যানির দল।

মাঠে খেলা করছে শন। বাবার সাথে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ারনায় খুশি। উত্তেজনায় চিৎকার করছে সমানে।

অন্যদিকে সেনটেইনের হাঁটু জড়িয়ে ধরে বায়না জুড়ে দিল গ্যারিক, “এবার আমি!”

 ঘোড়া নিয়ে শনকে রেখে গেল শাসা। দাদীর কাছ থেকে নেমে গেল গ্যারিক। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার আমি ড্যাডি, আমার পালা।

 ঘোড়ার উপর বসেই খানিকটা ঝুঁকে বড় ছেলেকে তুলে নিল শাসা। পিতা পুত্র কারোরই যেন কোনো ক্লান্তি নেই এ খেলায়। অথচ লাঞ্চের আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল দুইটা ঘোড়া।

দূর থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ শুনতেই আনমনে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। বেন্টলির গর্জন ঠিকই চিনেছেন। যাই হোক, নিজের উদ্বেগকে সংযত করে আস্তে আস্তে ব্লেইনের দিকে এগিয়ে গেলেও স্বামীর চেহারা দেখে দমে গেল তার মন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন, “কী হয়েছে ব্লেইন?” স্বামীর গালে কিস্ করে বললেন, “কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“না, না, তা না।” স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন ব্লেইন। “ন্যাশনালিস্ট পার্টি তাদের ক্যান্ডিডেটের নাম প্রকাশ করেছে।”

 “তোমার বিরুদ্ধে কে দাঁড়াচ্ছে?” অখন্ড মনোযোগে তাকালেন সেনটেইন, “বুড়ো ভ্যান স্কুর?”

|“না, ডিয়ার, একেবারে নতুন। তুমি হয়ত তার নামও কখনো শোননি, দাঈদ ভ্যান নির্বাক।”

“হটেনটটস হল্যান্ডের জন্য কাকে নামিনেশন দিয়েছে?” ব্লেইন ইতস্তত করছেন দেখে ক্ষেপে গেলেন সেনটেইন, “বলো না কাকে?”।

স্ত্রীর হাত ধরে আস্তে আস্তে ওক গাছের নিচে টি টেবিলের ধারে নিয়ে আসলেন ব্লেইন, “জীবন বড় অদ্ভুত, বুঝলে!”

 “ব্লেইন ম্যালকম্স, আমি তোমার কাছে একটা উত্তর জানতে চাইছি। দর্শনের কচকচানি না। বলল, ওর নাম কী?”

“অ্যায়াম সরি, মাই ডিয়ার” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে উঠলেন ব্লেইন, “ওরা আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যানফ্রেড ডি লা রে’কে নামিনেশন দিয়েছে।”

সাথে সাথে সেনটেইনের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যেন একটা লাশ। কেঁপে উঠতেই তাকে ধরে ফেললেন ব্লেইন। সেই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দ্বিতীয় পুত্রের আর কোনো খবরই পাননি সেনটেইন।

***

সমারসেট ওয়েস্টের বয় স্কাউৰ্টস হলের মিটিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করল শাসা। কেপ টাউন থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল ভ্রমণ করে এখানে পৌঁছেছে সে আর তারা। পুরনো প্যাকার্ড নিয়েই পাড়ি দিয়েছে এতদূর। কারণ শাসার নতুন রোলস রয়েস নিয়ে আসতে চায়নি তারা বলেছে, “শ’খানেক কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর সারা জীবনের খাবার, শিক্ষা আর পোশাকের ব্যয় বহনের জন্য যথেষ্ট, এতটা দামি একটা গাড়ি নিয়ে তুমি কীভাবে ঘুরে বেড়াবে?”

এই প্রথমবারের মত সমর্থকদের চোখে নিজের বিত্তের হিসাব না দেয়ার পক্ষে রায় দিল শাসা। মনে মনে স্ত্রীর রূপ আর মেধার প্রশংসা না করেও পারল না। যাই হোক স্ত্রীর সামনে বক্তৃতার রিহার্সালও করতে হল। নিখুঁত না হলেই এটা-ওটা শিখিয়ে দিল তারা। যেমন : শাসাকে বলল “আমি হয়ত এখানে আরেকটু লম্বা বিরতি দিতাম”, “চোখে-মুখে আরও আত্মপ্রত্যয়ীর ভাব আনো” কিংবা “সাম্রাজ্য নিয়ে এখন আর কেউ এত কথা বলে না” ইত্যাদি।

হলের প্রবেশমুখেই শাসার বিশাল বড় একটা পোস্টার। ভেতরেও প্রতিটা আসন কানায় কানায় পূর্ণ। এমনকি পেছন দিকেও প্রায় ডজনখানেকের মত তরুণ দাঁড়িয়ে আছে।

স্থানীয় ইউনাইটেড পার্টির সংগঠিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলল, “গত শর্ট টার্মে শাসা যা করেছে দেশের জন্যে; সেটাই তার পরিচয় দেয়ার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ এবারে ওকে উঠে দাঁড়াতে হবে।

লম্বা আর সদানন্দ শাসার পরনে গাঢ় নীল রঙা স্যুট, সাদা শার্ট আর এয়ারফোর্সের টাই। যা দর্শককে তার রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দেবে আর চোখের পট্টিটাই তো দেশের জন্য তার আত্মদানের জ্বলজ্বল প্রমাণ।

“মাই ফ্রেন্ডস” শুরু করলেও এগোতে পারল না শাসা; হাততালি দিয়ে উঠল পুরো হল। থামাতে না পেরে বাধ্য হয়ে উঁচু গলায় শুরু করল নিজের বক্তৃতা।

হলের পেছন দিকে বসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে শ তিনেক লোক। ওরা যে ন্যাশনালিস্ট পার্টির সমর্থক তা হাতের ব্যানার আর ম্যানফ্রেড ডি লা রে’র পোস্টার দেখেই স্পষ্ট বোঝা গেল।

প্রথম কয়েক মিনিট কাটতে না কাটতেই ঝামেলা হবে বুঝতে পেরে স্ত্রীদেরকে নিয়ে পাশের দরজা দিয়ে একে একে বেরিয়ে গেলেন বয়স্ক আর মধ্যবয়সী ভোটারগণ।

হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল তারা। ভয়ংকর রেগেমেগে দাঁড়াল শাসার সামনে। ওর সৌন্দর্য দেখে চুপ করে গেল পিছনের সারির দাঙ্গাবাজেরা।

কিন্তু ওদেরকে আবার উত্তেজিত করে উঠল স্থানীয় এক ন্যাশনাল পার্টির কর্মী। এ লোকটাকে শাসা চেনে। ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক টিমে থাকলেও যুদ্ধে কারাগারে কাটিয়েছে। এখন স্টিলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’র লেকচারার।

 “রুলফ স্ট্যান্ডার কি আইনের শাসন আর বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না? সরাসরি লোকটাকে উদ্দেশে করে বলে উঠল শাসা।

আর সাথে সাথে হলের পেছন থেকে ঠিক তারার সামনের টেবিলে পড়ল কুকুরের মলভর্তি প্যাকেট। একের পর এক এরপর এল পচা ফল, টয়লেটের রোল, মরা মাছ আর মুরগি।

নরক শুরু হয়ে গেল চারপাশে। দুই পক্ষের সমর্থকরা লেগে গেছে, চেয়ার উল্টে যে যেভাবে পারছে ছুটছে, মেয়েরা চিৎকার করছে; সব মিলিয়ে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থা।

 “আমার পেছন পেছন আসো” বলেই তারাকে নিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল শাসা। সামনে যেই পড়েছে ওর ঘুষি খেয়েছে। তারপর সোজা প্যাকাডে চড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। মেইন রোডে ওঠা পর্যন্ত আর কেউই কোনো কথা বলল না।

১৯৪৮ সালের নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে দক্ষিণ আফ্রিকা রাষ্ট্রে কতটা বিভাজন দেখা দিয়েছিল।

আফ্রিকানদের মাঝে ন্যাশনালিস্ট পার্টি কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে তা বুঝতে দেরি করে ফেলল স্যুটসের পার্টি।

 শেষতক ইংরেজিভাষী শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকান আর কিছু কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারকে পেলেও নির্বাচনের দিন যত কাছে এগিয়ে এল ততই বাড়ল ন্যাশনাল পার্টির প্রতি মানুষের উন্মাদনা। ফলে ইউনাইটেড পার্টিরও ভরাডুবি হল।

***

নির্বাচনের ঠিক তিনদিন আগে নতুন বাগানে দাঁড়িয়ে আরো শ’খানেক বাড়তি হলুদ গোলাপের ঝড় তদারক করছেন সেনটেইন, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল তাঁর সেক্রেটারি।

“মি. ডুগান এসেছেন ম্যাম।” সম্পাদক এডু ডুগান সেনটেইনের ভালো বন্ধু হিসেবে সবসময় এ বাড়িতে যাতায়াত করতেন; কিন্তু উস্কুখুস্কু চুল আর ঘামে ভেজা মেকআপহীন চেহারার কথা ভেবে সেনটেইন তার সাথে দেখা করতে চাইলেন না। আদেশ দিলেন,– “বলো আমি বাসায় নেই।”

“মি. ডুগান আগেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন এরকম হঠাৎ আসার জন্য। কিন্তু বলেছেন ব্যাপারটা নাকি এতই জরুরি যে জীবন আর মৃত্যুর ব্যাপার।

“ওহ! ঠিক আছে। বলো আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।”

সোয়েটার বদলে মুখে হালকা পাউডার দিয়ে মিটিংরুমে এলেন সেনটেইন। ডুগান তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “আসলে আপনাকে যা বলতে চাইছি তা ফোনে বলা সম্ভব নয়। তাই হুট করে চলে এলাম।”

হেসে ফেললেন সেনটেইন, “ঠিক আছে। এত ক্ষমা চাইতে হবে না। বসুন চায়ের কথা বলছি।” তারপর চা দিয়ে জানতে চাইলেন, “জীবন আর মৃত্যু?”

“তারচেয়েও শুদ্ধভাবে বললেন, জীবন আর জন্ম।

 “মানে?”

“আমার হাতে এমন কিছু ডকুমেন্টস এসেছে যা পুরোপুরি জেনুইন। আর যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে আমাকে গল্পটা ছাপতেই হবে। অভিযোগটা আপনার আর বিশেষ করে শাসার উপর অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া করবে।” থেমে গেলেন এডু।

“বলে যান প্লিজ।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালেন সেনটেইন।

“কোনো রকম বাহুল্যভাবে যদি বলতে হয় তো আমাকে জানানো হয়েছে। যে, ব্লেইনের সাথেই আপনার প্রথম এবং একমাত্র বিয়ে হয়েছে-” সাথে সাথে চমকে উঠলেন সেনটেইন, “যার মানে শাসা অবৈধ সন্তান।”

হাত তুলে সম্পাদককে থামালেন সেনটেইন, “তার আগে আমাকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিন, এই খবরের সংবাদদাতা হল ন্যাশনালিস্ট পার্টির হটেনটট ক্যান্ডিডেট তাই না?”

মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে অ্যান্ড্রু বললেন, “আমরা আমাদের সোর্সের নাম কখনো বলি না।”

এরপর দুজনেই চুপ করে গেলেন। সেনটেইনের চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলেন ডুগান। এও ভাবতে খারাপ লাগল যে, এই মহাশক্তিধর রমণীর স্বপ্ন তার হাতেই চুরমার হয়ে যাবে। তাছাড়া শাসা কোর্টনি নিজেও জাতিকে সুযোগ্য নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

“আপনার কাছে ডকুমেন্টস আছে নিশ্চয়ই?” সেনটেইনের প্রশ্নটা শুনে আলতো করে কেবল মাথা নাড়লেন অ্যাণ্ডু। “নির্বাচনের আগের দিন ছাপা হবে যদি না এর বিরুদ্ধে আপনি কোনো প্রমাণ দিতে পারেন। কারণ জনগণ এতে সত্যিই আগ্রহ দেখাবে।”

“আমাকে কাল সকাল পর্যন্ত সময় দিন।” সেনটেইনের কথা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেল অ্যান্ড্রু। তারপর দোনোমোনো করেও মত দিল, “ঠিক আছে। এটুকু আপনার জন্য করতেই পারি। আর অ্যায়াম সরি সেনটেইন। আপনার অনেকটুকু সময় নষ্ট করলাম।”

***

অ্যান্ড্রু ডুগান চলে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়ির উপরের তলাতে গিয়ে স্নান সেরে কাপড় বদলে নিলেন সেনটেইন। আধা ঘন্টার মধ্যে ডেইমলার ছুটল স্টিলেনবশের দিকে।

পাঁচটারও অনেক সময় বাদে ভ্যান স্কুর আর ম্যানফ্রেড ডি লা রে’র ল’ অফিসের সামনে পৌঁছে গেলেন। সদর দরজা স্পর্শ করতেই দেখা গেল একজন এখনো কাজ করছেন। লোকটা জানাল,

 “ডি লা রে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরে গেছেন। কারণ নিরিবিলিতে কাজ করতে চান।”

“আমার প্রয়োজনটাও খুব জরুরি, প্লিজ তার বাসার ঠিকানা?”

লানজেরাকে এস্টেটের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নদীর তীরে এক একর নিয়ে তৈরি বাড়িটা। বোঝা যাচ্ছে, বাড়ির মালিক বাগান সম্পর্কেও বেশ যত্নশীল।

সোনালি চুলের বড়সড় এক নারী দরজাটা খানিক ফাঁক করে খুলে দিতেই সেনটেইন জানালেন, “আমি মঁসিয়ে ডি লা রে’র সাথে কথা বলতে চাই। উনাকে কি গিয়ে বলবেন যে মিসেস ম্যালকমস্ এসেছেন?”

“আমার হাজব্যান্ড তো কাজ করছেন। আমি যদিও তাকে বিরক্ত করতে চাই না, তারপরেও ভেতরে আসুন। দেখা যাক আপনার সাথে কথা বলতে রাজি হয় কিনা।”

সামনের রুমে ঢুকে দাঁড়িয়েই রইলেন সেনটেইন। অন্যমনস্ক হয়ে তাকালেন ফায়াপ্লেসের উপরকার পেইন্টিংসগুলোর দিকে। আচমকা কী মনে হতেই ঘুরে দাঁড়ালেন।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে অপলক চোখে দেখছে একটা ছোট্ট শিশু। সাত আট বছরের ছেলেটা দেখতেও বেশ সুদর্শন, মাথাভর্তি সোনালি চুল; কিন্তু চোখ দুটো তার।

সাথে সাথে বুঝে গেলেন যে বাচ্চাটা তারই দৌহিত্র। এতটাই চমকে গেলেন সেনটেইন যে, কেবল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

খানিক বাদে সম্বিত ফিরতেই আস্তে আস্তে ওর কাছে গেলেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, “হ্যালো। তোমার নাম কী?”

“আমি লোথার ডি লা রে।” বেশ গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়ে ছোট্ট মানুষটা বলে উঠল, “আর আমার বয়স প্রায় আট।”

“লোথার!” নামটা শোনার সাথে সাথে হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল গত জনমের সব স্মৃতি। তারপরেও হাসি মুখে সেনটেইন বললেন, “তাই নাকি বাহ তুমি তো বেশ বড় কথা বলার সময় আলতো করে লোথারের গাল স্পর্শ করতে যাবেন আর সে সময়েই পেছনের দরজায় দেখা দিল ওর মা।

“তুমি এখানে কী করছে লোথার? ডিনার কে শেষ করবে শুনি, এক্ষুণি টেবিলে যাও বলছি।”

ত্রস্তপায়ে ভেতর দিকে দৌড় দিল লোথার। সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে হাসল ওর মা।

“ও আপনাকে বিরক্ত করছিল নিশ্চয়। অ্যায়াম সরি। আমার সাথে আসুন। আমার হাজব্যান্ড আপনার সাথে দেখা করবেন।”

একটু আগেই লোথারকে দেখে আবেগআপ্লুত সেনটেইন বিস্মিতভাবে এগোলেন ম্যানফ্রেডের সাথে দেখা করার জন্য।

 কাজগপত্রে বোঝাই একটা ডেস্ক থেকে হলুদ দুখানা চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড।

“আপনাকে এ বাড়িতে স্বাগত জানাতে পারছি না মিসেস ম্যালকমস,” ইংরেজিতে বলে উঠল, “আপনি আমার আর আমার পরিবারের এক জাতশত্রু।”

“এ কথা সত্য নয়।” সেনটেইনের মনে হল যেন দম বন্ধ হয়ে মরে যাবেন। কোনোরকম হাঁপাতে হাঁপাতে চাইছেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।

বিরক্তির ভঙ্গি করে ম্যানফ্রেড বলল, “আপনি আমার বাবার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাকে ধোকা দিয়েছেন, পঙ্গু বানিয়ে ফেলেছেন আর আপনার জন্যই আজ এত বছর ধরে সে জেলে। তাকে আজ এ অবস্থায় দেখলে আমার কাছ থেকে কোনো দাক্ষিণ্য নিতে আর আসতেন না আপনি।”

“তুমি নিশ্চিত যে, আমি তোমার দাক্ষিণ্য চাইতে এসেছি?”

ঘর কাঁপিয়ে হেসে ফেলল ম্যানফ্রেড, “আর কোন কারণ আছে নাকি? আপনি আমাকে সব সময় সব জায়গায় তাড়া করে এসেছেন, বাবার বিচারের দিন প্রথম যেদিন কোর্টরুমে আপনাকে দেখেছি সেদিন থেকে সর্বদা আমার পিছু নিয়েছেন এক ক্ষুধার্ত সিংহীর মত; যেন বাবার মত আমাকেও শেষ করে দিতে পারেন, তাই না?”

“না!” তীব্রভাবে মাথা নাড়লেন সেনটেইন। কিন্তু ম্যানফ্রেড আজ নির্দয়ের সীমা পার হয়ে গেল, “আর এখন আবার এসেছেন আমার কাছে দয়া চাইতে। জানি আপনি কী চান।” ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা ফাইল বের করে রাখতেই ডেস্কের উপরে ছড়িয়ে পড়ল একগাদা কাগজ আর ছবি। এগুলোর মধ্যে ফরাসি বার্থ সার্টিফিকেট আর পুরনো নিউজ পেপারের ক্লিপিংও দেখতে পেলেন সেনটেইন।

“এগুলো আপনাকে পড়ে শোনাবো নাকি আপনি নিজেই পড়বেন? দুনিয়াকে দেখানোর জন্য আমার আর কী প্রমাণ চাই যে আপনি একটা বেশ্যা আর আপনার ছেলেও অবৈধ?” শব্দটা শুনেই কুঁকড়ে উঠলেন সেনটেইন।

“তুমি তো বেশ ভালোই হোমওয়ার্ক করেছো।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন।

“ইয়েস। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে “

“না।” বাধা দিলেন সেনটেইন, “সব প্রমাণ নেই। তুমি শুধু আমার একটা অবৈধ সন্তানের কথা জানোনা, কিন্তু আরেকজনও আছে। চলো তোমাকে দ্বিতীয় অবৈধজনের গল্প বলি।”

প্রথমবারের মত খেই হারিয়ে একদৃষ্টে সেনটেইনের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আপনি এত বেহায়া। দুনিয়ার সামনে নিজের কুকীর্তি বলতেও পিছপা হন না।”

 “দুনিয়ার সামনে নয়, যার প্রয়োজন কেবল তার সামনে। তোমার সামনে ম্যানফ্রেড ডি লা রে।”

“মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“তাহলে শোন আমি কেন তোমাকে অনুসরণ করেছি, যেমনটা তুমি বললে ক্ষুধার্ত সিংহীর মত তোমার পিছু নিয়েছি; শিকারের জন্য নয়, সন্তানের দেখা পাওয়ার জন্য। তুমিই, ম্যানফ্রেড, আমার আরেক সন্তান। মরুভূমিতে তোমাকে জন্ম দেয়ার পরপরই লোথার তোমাকে নিয়ে গেছেন। শাসা তোমারই সৎভাই। ও যদি অবৈধ হয়, তুমিও তাই। আর এই কারণে যদি ওকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে নিজেকেও ধ্বংস করবে।”

“আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না!” খানিকটা দমে গেল ম্যানফ্রেড। “মিথ্যা! মিথ্যা! এসব কিছুই মিথ্যা। আমার মা এক জার্মান অভিজাত নারী। আমার কাছে ওর ছবিও আছে। দেখুন, দেয়ালের দিকে তাকান!”

ছবিটার উপর চোখ বোলালেন সেনটেইন; তারপর সম্মতি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ও লোথারের স্ত্রী ছিল। কিন্তু তোমার জন্মেরও প্রায় দুই বছর আগে মারা গেছে।”

“না, এটা সত্যি না।”

“তাহলে তোমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করো ম্যানফেড” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন; “উইন্ডহকে যাও সেখানকার রেজিস্টার কপি এবং ওর মৃত্যু তারিখ পাবে।”

কথাটা সত্য বুঝতে পেরে চেয়ারে বসে দুহাতে মুখ ঢাকল ম্যানফ্রেড।

 “আপনি আমার মা হলে আমি কেন এত ঘৃণা করতাম আপনাকে?”

ম্যানফ্রেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন, “ততটা নয় যতটা তোমাকে ফেলে আসার জন্য আমি নিজেই নিজেকে করতাম।”

মুখ নামিয়ে পুত্রের মাথায় চুমু খেলেন সেনটেইন, “কেবল যদি ফিসফিস করে বললেন, “কিন্তু এখন যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার কথাই ঠিক। আমরা এতটাই দূরে সরে শত্রু বনে গেছি যে এ দূরত্ব কখনো পার হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমি কখনোই তোমাকে ঘৃণা করিনি ম্যানফ্রেড, কখনো না মাই সান।”

ম্যানফ্রেডকে সে অবস্থায় রেখেই আস্তে আস্তে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন সেনটেইন।

***

পরদিন দুপুরবেলা অ্যান্ডু ডুগান তাঁকে ফোন দিল, “আমার সংবাদদাতা তার অভিযোগ তুলে নিয়েছে সেনটেইন। এও জানিয়েছে যে কেসের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত পেপার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন ওর উপর ভর করেছে, সেটা যে কে তাই মাথায় আসছে না।”

***

১৯৪৮ সালের পঁচিশে মে, সাধারণ নির্বাচনের আগের দিন স্টিলেনবশের ডাচ রিফর্মড চার্চের হলে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিল ম্যানফ্রেড; রুলফ স্ট্যান্ডার আর তার স্কোয়াড খেয়াল রাখল যেন সেখানে কোনো প্রতিপক্ষ ঢুকতে না পারে।

তবে ম্যানফ্রেড নিজেও কিন্তু বক্তৃতা দিতে উঠে শান্তি পেল না। উত্তেজিত আর উৎফুল্ল দর্শকের সারি পুরো পাঁচ মিনিট হাততালি দিল। তারপর অবশ্য শান্ত হয়ে বসে গেল। ম্যানফ্রেডের মুখে শুনল তাদের সোনালি ভবিষ্যতের কথা।

 “আপনারা সবাই জানেন যে, স্যুটস আমাদের এই ভূমিকে কফি দেহরঙা সংকরদের চিড়িয়াখানায় পরিণত করে তড়িঘড়ি আবার ইস্রায়েলকেও সমর্থন দেয়ার পায়তারা করছে।”

দর্শকরা আবার চিৎকার করে উঠতেই খানিক থেমে ম্যানফ্রেড বলল, “তাই এর বিপরীতে আমি একটা পরিকল্পনার প্রস্তাব করছি, এমন এক মহতী দৃষ্টিভঙ্গি যা আমাদের বিশুদ্ধ আফ্রিকান রক্তধারাকে দীর্ঘজীবী করে তুলবে। একই সাথে এই কেপে বসবাসরত অন্যান্য জাতিকেও রক্ষা করবে। আর এর রচয়িতা নিঃস্বার্থ আর দেশপ্রেমিক মেধাবী ড. থিওফিলিয়াস, ড. নিকোলস আর ড, হেনিড্রিক ভারউড।”

উল্লাসে চিৎকার করে নিজেদের সম্মতি দিল সবাই।

“আদর্শগতভাবে অত্যন্ত সাবধানে তৈরি করা এই পরিকল্পনা সমস্ত জাতিকে নিজ নিজ মর্যাদা আর শান্তি বজায় রেখে বসবাস করার পাশাপাশি স্বপরিচয় আর সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতেও সাহায্য করবে। তাই এই নীতির নাম হল “পৃথকাবস্থা।” তাই একে আমরা বলব অ্যাপার্টহেইড কিংবা বর্ণবাদ বা ইউরোপীয় ও বাকিদের পৃথকাবস্থা।”

 সবাই মিলে আবার এত জোরে হাততালি শুরু করে দিল যে, চুপ করে গেল ম্যানফ্রেড। খানিক বাদে শান্ত হল পুরো মিলনায়তন।

“তাই সবার আগে আমাদের প্রয়োজন কৃষ্ণাঙ্গদের যারা ইতিমধ্যেই ভোট দেয়ার অধিকার পেয়েছে তাদের সেই সুবিধা কেড়ে নেয়া–”

 এক ঘণ্টা পরে মনফ্রেড যখন বক্তব্য শেষ করল দেখা গেল সবাই তাকে কাঁধে নিয়ে নাচছে।

***

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার জন্য ভোট গুনছেন নির্বাচনী অফিসার। শাসার সাথেই দাঁড়িয়ে তাই অপেক্ষা করছে উদ্বিগ্ন তারা।

হলের মাঝে উপস্থিত দর্শকেরাও বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে। হলের আরেক কোনায় লম্বা-চওড়া সোনালি চুলঅলা স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ন্যাশনালিস্ট ক্যান্ডিডেট। পাশে তার সমর্থকরা।

ইউনাইটেড পার্টি অর্গানাইজারদের একজন ভিড়ের মধ্যে শাসাকে ডেকে কি যেন বলল। কিন্তু শাসা এক নারী সমর্থকের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত থাকায় এগিয়ে গেল তারা। কয়েক সেকেন্ড বাদেই আবার ফিরে এল। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এল শাসা।

“কী হয়েছে ডার্লিং? মনে হচ্ছে তুমি ভূত দেখেছ?”

“উড বাস ফোন করেছিলেন” ফিসফিস করে জানাল তারা, “স্মটস স্ট্যান্ডারটনে হেরে গেছে। ন্যাশনালিস্টরা জিতে গেছে।”

“ওহ গড, না! গত পঁচিশ বছর ধরে এই সিট ওনারই ছিল।”

“ব্রিটিশরাও তো উইনস্টন চার্চিলকে নামিয়ে দিয়েছে। ওরাও আর কোনো হিরো চায় না।”

“তার মানে এটা একটা সংকেত।” বিড়বিড় করে উঠল শাসা, “স্যুট যাওয়া মানে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে গেছি।”

দশ মিনিট পরে আরেকটা খবর এল। এক হাজার ভোটে গার্ডেন হেরে গেছেন ব্লেইন ম্যালকম।

“এক হাজার ভোট–” নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না শাসা, “এখন কী হবে তাহলে?”

হলের শেষ মাথায় মঞ্চে উঠে দাঁড়াল নির্বাচনী অফিসার। তার হাতে রেজাল্ট আছে জেনেই পুরোপুরি চুপ করে গেল উত্তেজিত জনতা। সাগ্রহে সবাই সামনে তাকিয়ে রইল।

 লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, হটেনটটস হলান্ড নির্বাচনের ফলাফল হল, ম্যানফ্রেড ডি লা রে ন্যাশনালিস্ট প্রার্থী পেয়েছেন ৩,১২৬ ভোট আর শাসা কোর্টনি, ইউনাইটেড পার্টি পেয়েছেন ২,০১২ ভোট।”

শাসার হাত ধরে পার্কিং লটে চলে এল তারা। দু’জনে পাশাপাশি বসলেও সাথে সাথেই ইঞ্জিন স্টার্ট করতে পারল না তারা। দুজনেই এত অবাক হয়ে গেছে যেন বোধবুদ্ধি কিছুই কাজ করছে না।

“আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।” ফিসফিস করে করে উঠল তারা।

“আমার মনে হচ্ছে আমি একটা লাইনচ্যুত ট্রেনে বসে আছি। অন্ধকার এক টানেলে ছুটে চলেছে ট্রেন যেখান থেকে ফেরার কোনো রাস্তা নেই।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাসা বলল, “আহারে বেচারা সাউথ আফ্রিকা; ঈশ্বরই জানেন এর ভাগ্যে কী আছে।”

***

মোজেস গামার চারপাশেও বেশ ভিড় জমে গেছে। সোয়ার্ট হেনড্রিকও আছে।

রুমে ধোয়া ওঠা একটা মাত্র প্যারাফিন ল্যাম্পের হলুদ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে মোজেসের চেহারা।

“ও আসলেই একটা সিংহ” আপন মনেই প্রাচীন রাজাদের স্মরণ করলেন হেনড্রিক; উনারাও নিশ্চয় এভাবেই যুদ্ধের আদেশ দিতেন।

“বোয়ারা এখন নিজেদের বিজয়ে নাচছে” বলে উঠলেন মোজেস, “কিন্তু আমার সন্তানেরা, তোমরা জেনে রাখো যে তাদের এই আত্মগরিমা আর লালসাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। হয়ত কাজটা তেমন সহজ হবে না। অনেক পরিশ্রম এমনকি রক্তও ঝরাতে হতে পারে কিন্তু আগামীকালের ভবিষ্যৎ হবে আমাদের।”

***

ইউনিয়ন বিল্ডিংয়ে তার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন নতুন ডেপুটি মিনিস্টার অব জাস্টিস।

বাইরে রাত নেমেছে। তাই বেশিরভাগ অফিসেই জ্বলে উঠেছে আলো। সবাইকেই অনেক রাত অব্দি কাজ করতে হয়। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে লাগাম ধরে রাখা সোজা কথা নয়। কিন্তু ক্লান্তি বলতে কিছু জানে না ম্যানফ্রেড ডি লা রে। তাকে কেন নির্বাচন করা হয়েছে তা সে ভালোভাবেই জানে। যদিও অনেকেই ডেপুটি মিনিস্টার পদের জন্য তার বয়স একটু বেশিই তরুণ বলে মনে করে। যাই হোক, ম্যানফ্রেড ওদেরকে ভুল প্রমাণ করেই ছাড়বে।

মিনিস্টারের দরজায় নক করতেই ভেতরে থেকে আদেশ এল, “এসো।”

চার্লস রবার্টস এমনভাবে হাসলেন যেন গ্রানাইটের স্ল্যাবে ফাটল দেখা দিল, “ম্যানফ্রেড, তোমাকে যে ছোট্ট উপহারটা দিব বলে প্রমিজ করেছিলাম সেটা নাও।” ডেস্কের উপর দিয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন “ব্ল্যাকি” সোয়ার্ট।

“আমি যে কতটা কৃতজ্ঞ আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না মিনিস্টার।” খামটা হাতে নিল ম্যানফ্রেড। “আশা করছি এর বিনিময়ে সামনের বছরগুলোতে বিশ্বস্ততা বজায় রেখে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের আনুগত্য তুলে ধরতে পারব।”

নিজের অফিসে চলে এল ম্যানফ্রেড। তারপর সাবধানে খামটা খুলে বের করল ভেতরের সব কাগজ। আস্তে আস্তে সযত্নে পড়ল প্রতিটি পৃষ্ঠা।

শুরুতেই পড়ল বিভিন্ন অপরাধে যাবজ্জীবন সাজা ভোগকারী কোনো একজন লোথার ডি লা রে’র মুক্তির আদেশনামা।

কাগজটাকে ভাজ করে আবার খামে ভরে রেখে দিল ম্যানফ্রেড। আগামীকাল নিজ হাতে কারাগারের গভর্নরের হাতে দিবে এই দলিল আর তারপর বাবার হাত ধরে নিয়ে আসবে বাইরে, খোলা আকাশের নিচে।

এরপর আবার ডেস্ক থেকে উঠে সেইফের কাছে গিয়ে খুলে ফেলল কম্বিনেশন লক লাগানো ভারি স্টিলের দরজা। একেবারে উপরের তাকে পড়ে আছে তিনটা ফাইল। সবগুলো ফাইল এনে ডেস্কের উপর রাখল ম্যানফ্রেড। এর একটা পেয়েছে সামরিক গোয়েন্দাবাহিনির কাছ থেকে আরেকটা সিআই ডি হেড কোয়ার্টারস আর বাকিটা তার নিজের আইন মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে। তবে এই তিনটা ফাইলকেই একসাথে ওর ডেস্কে পাওয়ার জন্যে ব্যয় হয়েছে দীর্ঘ সময় আর অত্যন্ত সতর্ক এক পরিকল্পনা। আর্কাইভ রেজিস্টার থেকেও মুছে দিতে হয়েছে এগুলোর অস্তিত্ব। একমাত্র এগুলোর মাঝেই এখনো টিকে আছে হোয়াইট সোর্ড।

বহু সময় লাগিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি ফাইল পড়ল ম্যানফ্রেড। শেষ করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। কিন্তু স্বস্তি পেল এটা জেনে যে, “হোয়াইট সোর্ড” আর অলিম্পিক গোল্ড মেডালিস্ট ও বর্তমান ডেপুটি মিনিস্টার অব জাস্টিসের মাঝে কেউ কোনো যোগসূত্র খুঁজে পায়নি।

 তিনটা ফাইল তুলে নিয়ে বাইরের আরেকটা অফিসে এসে স্রেডিং মেশিন চালু করল ম্যানফ্রেড। প্রতিটি পাতা আলাদা আলাদা করে মেশিনে দিতেই কুচি কুচি হয়ে গেল সবকটা ফাইল। নুডলসের মত চিকন দলা পাকানো কাগজের স্তূপ দেখে মনে পড়ে গেল ফাইলের একটা অংশ;

“তার মানে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল ম্যানফ্রেড, “আফ্রিকান ভাষায় কথা বলা তরুণী এক মেয়ে প্রিটোরিয়ার অস্ত্র থেকে শুরু করে পর্বতের অ্যাম্বুশ পর্যন্ত সবকিছু জানত। আর এরকম একজন তরুণীই আছে যে সবকিছু জানে।” কোনো এক সময় তাহলে তাকেও উচিত শাস্তি দিতে হবে, কিন্তু ঠিক আছে; ম্যানফ্রেডের কোনো তাড়াহুড়া নেই, আরো অনেক কিছুর সমাধান করতে হবে; অনেক ঋণ শোধ করতে হবে।

 একেবারে শেষ পাতাটাকেও বিনষ্ট করে অফিস থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড। পার্কিং লটে অপেক্ষা করছে নতুন কালো ফোর্ড সেডান।

 গাড়ি চালিয়ে চলে এল ওয়াটার কুফের অভিজাত সরকারি বাসভবনে। উপরে যাওয়ার সময় অবশ্য সতর্ক থাকতে হল যেন হেইডির ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। কারণ ম্যানফ্রেড আবারো বাবা হতে চলেছে।

অন্ধকার বিছানায় শুয়ে পড়লেও ঘুমাতে পারল না ম্যানফ্রেউ। সামনে শত শত কাজ; কাজের পরিকল্পনা। এরই ফাঁকে একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় আবার হেসেও ফেলল; ভাবল, “তো, অবশেষে আমাদের হাতেই এল ক্ষমতা, এবার দেখা যাবে প্রতিপক্ষ কী করে।”

2 Comments
Collapse Comments

Unable to read after cahapter 9.pls inform how to get remaining chapters?

Bangla Library (Administrator) February 10, 2022 at 11:28 pm

এই বইটি এখানেই সমাপ্ত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *