৯. মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪১–১০২০ খ্রি:)
পৃথিবীর বুকে বিশ্ব বিখ্যাত যে ক’জন কবির আগমন ঘটেছে ‘মহাকবি ফেরদৌসী’র নাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি। বর্তমান যুগে ঘরে ঘরে যেমন কবির জন্ম হচ্ছে, একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দের মিল দিতে পারলেই কবি হিসেবে পরিচিত হওয়া যায়, পরিচিত হতে না পারলেও জোর করে পরিচিত হবার চেষ্টা চালায়; কিংবা ২/১টি অশ্লীল শব্দ বা বাক্য সংযোজন করে আলোচিত হবার চেষ্টা করে; তখনকার দিনে এমনটি ছিল না। যেমন তেমন লোক কবিতা লিখতেন না। কবির মন, কবির দেখান শক্তি, কবির চিন্তা, কবির দেখার বিষয়বস্তু সাধারণ লোক হতে অনেক ভিন্ন। সাধারণ মানুষ যা দেখে, যা ভাবে সেগুলো কবির চোখে নতুন করে দেখা দেয় এবং বাস্তব জীবনের সত্যগুলো কবির হৃদয়ে জেগে ওঠে। বর্তমান অধিকাংশ কবিদের লেখা কবিতা একবার পড়লেই যেমন দ্বিতীয় বার পড়তে বছর আগে মহাকবি ফেরদৌসী ইন্তেকাল কারলেও আজও প্রায় প্রতিটি মুসলমানের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তাঁর লেখা কবিতা। কি যেন আকর্ষণ ও সত্য লুকিয়ে রয়েছে তাঁর কবিতায়; নেই কোন বিরক্তি, অতৃপ্তি ও তিক্ততা। যতবার পড়া হয় ততবারই যেন ইচ্ছে হয় শুনতে বা পড়তে।
মহাকবি ফেরদৌসী’র জীবন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পরে ইরানের বিখ্যাত কবি নিজামি আরযী তাঁর ‘দিবাচায়, ফেরদৌসী সম্পর্কে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা থেকে জানা যায়, মহাকবি ফেরদৌসী ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ইরানের সমরকন্দের অন্তর্গত তুস নগরের “বাঝ’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ আবুল কাশেম। ‘ফেরদৌসী’ তাঁর উপাধি। গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে এ উপাধি দিয়েছিলেন। সে থেকেই তিনি ফেরদৌসী নামে খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ফেরদৌসী ভাল লেখাপড়া শিখেছিলেন। তাঁর আর্থিক অবস্থাও ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল। জানা যায়, তিনি উত্তারিধকার সূত্রে অনেক জায়গা জমি পেরেছিলেন এবং এ সব জমি থেকে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ আয় হত।
তিনি বাল্য বয়স থেকেই কবিতা লিখতে ভালবাসতেন। কম বয়সেই বিয়ে করেন। যৌবনে তিনি একান্তভাবে কবিতা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন এবং রাজকীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী ছোট্ট নদীর তীরে বসে কাব্য লিখতেন। সুখ ও শান্তিময় জীবনের দিনগুলো এখানেই তিনি কাটাতেন। কিন্তু সুখ তার জীবনে বেশীদিন স্থায়ী হল না। তার পরিবারে তুসের শাসনকর্তার খারাপ দৃষ্টিতে পতিত হল। অবশেষে নিজ গৃহে অবস্থান করাই ছিল তার জন্যে দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাঁর মাত্র একটি কন্যা সন্তান ছিল। কন্যাকে সৎপাত্রে বিবাহ দেয়া ছিল তার জীবনের বড় আশা। এছাড়া নিজ দেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অনটন দেখে তার মন প্রায়ই কেঁদে উঠত। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যেভাবেই হোক তিনি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন। কিন্তু তার মনের এ আকা আর পূরণ হল না। নিজ গৃহে অবস্থান করাই যখন তাঁর অসম্ভব হয়ে উঠল, তখন জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন কিভাবে। তিনি কন্যাকে সাথে নিয়ে নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে পড়লেন অজানা এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তাঁর জীবনের এ দুঃসময়ে সাক্ষাৎ পেলেন গজনীয় সুলতান মাহমুদের।
৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনীয় সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি দেশ বিদেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন এবং তাছাড়া দরবারে দেশ বিদেশের কবিদের কবিতা আবৃত্তির আসর হত। মহাকবি মুহাম্মদ আবুল কাশেম ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের নিকট যথাযথ কদর পাবেন চিন্তা করে গজনীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গজনীর রাজ দরবারে প্রবেশ করা ছিল তখন কঠিন ব্যাপার। তিনি দরবারের অন্যান্য কবিদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। অবশেষে সুলতান মাহমুদের উজির মোহেক বাহাদুরের সহযোগিতায় তিনি রাজদরবারে প্রবেশ করেন। সুলতানের সাথে কবির প্রথম পরিচয় হয় কয়েকটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে। সুলতানের সাথে প্রথম পরিচয় হয় কয়েকটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে। প্রথম সাক্ষাতেই সুলতান কবির আবৃত্তি করা কয়েকটি কবিতা শুনে অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং এ বলে কবিকে সংবর্ধনা করলেন,
“আয় ফেরদৌসী, তু দরবারে মে ফেরদৌস কারদী।
অর্থাৎ হে ফেরদৌসী, তুমি সত্যিই আমার দরবারকে বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছ।
এ থেকেই কবির নাম ফেরদৌসী হল এবং পরবর্তীতে তিনি ফেরদৌসী হিসেবেই খ্যাতি লাভ করেন। সুলতান কবির জন্যে পৃথকভাবে উন্নতমানের বাসস্থান ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং কবিকে রাজকবি হিসেবে মনোনীত করেন। আস্তে আস্তে কবি ফেরদৌসীর সাথে সুলতান মাহমুদের সম্পর্ক গম্ভীর হয়ে যায়। কবির কবিতা ও তার জ্ঞান বুদ্ধিতে সুলতান তার প্রতি মুগ্ধ হন। কিন্তু এখানেও সুলতানের সাথে কবির। গভীর সম্পর্ক আজীবন স্থায়ী হল না।
কবি ফেরদৌসী’র সাথে সুলতানের গভীর সম্পর্ক এবং রাজদরবারে কবির শ্রেষ্ঠ সম্মান দেখে রাজসভার অন্যান্য কবিরা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল এবং কবিকে রাজদরবার থেকে বের করার জন্যে কবির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করল। অন্যদিকে সুলতানের প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দীও কবির সাথে গোপনে শত্রুতা আরম্ভ করলো। ইতিমধ্যে সুলতান মাহমুদ কবিকে ‘মহাকাব্য শাহনামা’ রচনা করার অনুরোধ জানান এবং এর প্রতিটি শ্লোকের জন্যে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যতদূর জানা যায়, কবি সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রম করে শাহনামা’ রচনা করেন। এর মধ্যে শেষের ২০ বছর কবি রাজসভাতে কাটান। শাহনামা’ পৃথিবীর মহাকাব্য সমূহের অন্যতম। ইহা ৭টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত এবং ৬০ হাজার শ্লোক রয়েছে এতে। কাব্যের কোথাও অশ্লীল বাক্য বা ইতর উপমার প্রয়োগ নেই। কবি নিযামীর মতে ‘শাহনামা’ কাব্য রচনা শেষ হয় হিজরী ৩৯৩ সনে। ‘শাহনামা’ কাব্য রচনা শেষে সুলতান রাজদরবারের কতিপয় ঈর্ষাপরায়ণ ও ষড়যন্ত্রকারীর কুমন্ত্রণা শুনে তার প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা মাতন্তরে ৬০ হাজার দিরহাম প্রদান করেন। সুলতান কবির বিরুদ্ধে আমলাদের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পারেননি। এদিকে কবি ফেরদৌসী সুলতানের প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে ক্রোধে, ক্ষোভে ও দুঃখে কিংকর্তবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কবি অর্থের লোভী ছিলেন না। বরং সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রমের বিনিময়ে তাকে যে অর্থ দেয়া হয়েছে তা কবি নিজের জন্যে অপমান মনে করেছেন। ফেরদৌসী দীন হতে পারেন কিন্তু তাঁর আত্মা দীন নয়। এছাড়া এ অর্থ দিয়ে নিজ দেশের অসহায়, গরীব, নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনগণের এবং কন্যা সন্তানের যে উপকার করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন তা যেন সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। সুলতান হয়ে তিনি কিভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারলেন? এসব কথা চিন্তা করেই কবি সুলতানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং কবিকে সুলতানের দেয়া সমুদয় অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। শুধু তাই নয়, সুলতানের দেয় সমুদয় অর্থ ভৃত্য, স্নানাগারের রক্ষক ও নিকটস্থ গরীব লোকদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেন। রাজ পুরস্কারকে অপমান করার ঘটনা সুলতানের কানে পৌঁছল। রাজসভার অন্যান্য কবি ও আমলারা সুলতানকে বিষয়টি ভালভাবে বুঝায়নি বরং তারা সুলতানের নিকট কবির বিরদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন। তাঁরা সুলতানের নিকট কবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা বলে কবির বিরুদ্ধে সুলতানকে ক্ষেপিয়ে তোলেন। সুলতান ক্ষুব্ধ হয়ে কবিকে হাতির পদতলে পিষ্ট করে হত্যা করার আদেশ দেন এবং পরক্ষণে এ আদেশ তুলে নিয়ে কবিকে গজনী ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।
সুদীর্ঘ ২০টি বছর কবি কাটিয়েছেন গজনীতে। তাঁর জীবনের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে এখানে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে এবং রিক্ত হস্তে জীবন সায়াহ্নে গজনী ত্যাগ করে আবার বের হতে হল অজানা অচেনা নিরাপদ এক আশ্রয়ের সন্ধানে। গজনী ত্যাগ করার পূর্বে কবি সুলতান মাহমুদের এ হীনমন্যতার জন্যে তাঁকে গালমন্দ করে একটি ব্যঙ্গ রসাত্মক কবিতা লিখেন এবং তা মসজিদের দেয়ালে টাঙিয়ে রাতের অন্ধকারে গজনী ত্যাগ করেন।
ইতিপূর্বে কবির সুখ্যাতি দেশ বিদেশে যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল; তদ্রূট রাজদরবারে কবির ভাগ্য বিপর্যয়ের কথাও ইতিমধ্যে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ল। গজনী ত্যাগ করে কবি ‘কুহেস্তান’ রাজ্য রাজা নসরুদ্দিন মুহতাসেমের নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। কবি ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের প্রতারণা ও হীনমন্যতার কথা ভুলতে পারলেন না। এখানে অবস্থানকালেই কবি সুলতান মাহমুদকে উপলক্ষ্য করে একটি ব্যাঙ্গরসাত্মক কাব্য প্রণয়ন করেন। সুলতান মাহমুদ ছিলেন রাজা নসরুদ্দিন মহতাসেমের একান্ত বন্ধু মানুষ। তাই রাজা কাব্যটি পাঠ করে খুব দুঃখ পান। কাব্যটি বন্ধুর জন্যে খুবই অবমাননাকর মনে করে রাজা কবিকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে কাব্যটি কিছু অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করেন এবং তা বিনষ্ট করেন। রাজনৈতিক আশ্রয়ে এখানে কবির দিনগুলো খুবই সম্মানজনক ও আনন্দের সাথে কেটেছিল। কবিকে গ্রহণ করার জন্যে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন্ত্রণ আসে; কিন্তু কবি কোন আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে এখান থেকে চলে যান বাগদাদে। বাগদাদের তৎকালীন শাসনকর্তা কবিকে পেয়ে খুবই আনন্দিত হন। বাগদাদ অবস্থান কালে কবি ইউসুফ জ্বলেখার কাহিনী নিয়ে ১৮,০০০ শ্লোকের একটি প্রেমের কাব্য রচনা করেন; কিন্তু কাব্যটি অতীতের গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এছাড়া তিনি আরো বহু কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। বাগদাদে কিছুদিন অবস্থান করে কবি চলে যান নিজ মাতৃভূমি তুস নগরে
ইতিমধ্যে ন্যায় বিচারক হিসেবে পরিচিত সুলতান মাহমুদ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, কবি তাঁর প্রতিশ্রুত স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে দুঃখ পেয়েছেন। রাজসভার অন্যান্য কবি এবং আমলারা কবির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল, এ কথাও সুলতানের নিকট আর গোপন রইল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দীকে রাজপদ থেকে বহিষ্কার করেন এবং অনতিবিলম্বে কবিকে ফিরিয়ে আনার সংকল্প ব্যক্ত করেন। কিন্তু মানব মন স্থায়ী নয়। সুলতানকে হেয় করে কবির পূর্বে লেখা কবিতাটি সুলতানের মনে পড়ে যায়। এতে সুলতান ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে কবিকে গ্রেফতার করে রাজদরবারে নিয়ে আসার জন্যে একটি ওয়ার, আম জুয়ে খোলদাশ বহাঙ্গামে আব
ব’বেখ্ আঙ্গবান রেযী ও শীরে নাব,
ছরঞ্জামে গওহর ব’কার আওরাদ
হোমা মিওয়ায়ে তল্খ বর আওরাদ। বতাটি ছিল নিম্নরূপঃ
“আগর শাহ্রা শাহ্হুদে পেদর,
বছর নেহাদে মা’বা তাজ ও ঘর।
চু আন্দর তাবারেশ বোজরগী না বুদ্,পত্রসহ বাগদাদে দূত প্রেরণ করেন।
আরাস্ত কে নামে বোজরগানস শনুদ।
দরখতে কে তল্খ আস্ত উরা ছেরেশত,
গরশ্ দর নেশানী ব’বাগে বেহেশ,
ওয়ার, আম জুয়ে খোলদাশ বহাঙ্গামে আব
ব’বেখ্ আঙ্গবান রেযী ও শীরে নাব,
ছরঞ্জামে গওহর ব’কার আওরাদ
হোমা মিওয়ায়ে তখ বর আওরাদ।”
অর্থাৎ —
রাজবংশে হত যদি জন্ম তোমার
বখশিতে স্বর্ণমুদ্রা মুকুট সোনার।
উচ্চমান নাহি যার বংশের ভিতর
কেমনে সহিবে সে মানীর আদর?
তিক্তবীজ হতে যে তরুর জন্ম,
নন্দন কাননে তারে কর রোপণ
সিঞ্চন কর মূলে মন্দাকিনী ধারা,
মধু আর দুগ্ধে ভর খাদ্যের পশরা–
তথাপি ফলিবে তার আপন স্বভাব,
সতত সে তিক্ত ফল করবে প্রসব।
কিন্তু বাগদাদ থেকে কবিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বরং বাগদাদের শাসনকর্তা সুলতানের প্রেরিত পত্রের এক কোণে আলিফ, লাম ও মীম এ তিনটি অক্ষর লিখে দেন। সুলতান মাহমুদ পত্রে এ তিনটি অক্ষর দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি কিংবা রাজদরবারে কবি ফেরদৌসী’র অভাব দারুণ ভাবে অনুভব করেন। আজ যদি কবি ফেরদৌসী দরবারে থাকতেন তাহলে এর অর্থ বুঝার জন্যে রাজদরবারের বাইরে যেতে হত না।
সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুয়েস্তানের রাজা নসরুদ্দিন মুহতাসেম কবি ফেরদৌসীর উচ্চ প্রশংসা করে সুলতান মাহমুদের নিকট একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পাঠান্তে সুলতান খুব মর্মাহত হন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, সুলতান কবির প্রতি ন্যায় বিচার করেননি বরং ষড়যন্ত্রকারীদের কুপরামর্শে তিনি কবির প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন। তাই সুলতান নিজেকেই অপরাধী মনে করে কবি ফেরদৌকে ক্ষমা করে দেন এবং কবির প্রতি সুলতানের সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন সরূপ কবির প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রা সহ কবির জন্মভূমি ইরানের তুস নগরীতে কবির নিজ বাড়িতে দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু দূত যখন স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যান তখন কবি পৃথিবীতে বেঁচে নেই।
১০২০ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে কবি এ অশান্তময় পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। কবির ইন্তেকালের হাজার বছর অতিবাহিত হলেও কবি ও কাব্য ও সাহিত্য পৃথিবীতে রেখে গেছেন তাতে মুসলিম জাতি কর্তৃক কবিকে কখনো ভুলার মত নয়।