৯. প্যাকিং বাক্সের ওপর

০৯.

প্যাকিং বাক্সের ওপর কষ্টকর বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিল না রাতে। গ্রিলের চৌখুপি দিয়ে নীলাভ আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ। জ্যোৎস্নার অনেক টুকরো এসে পড়েছে আমার গায়ে, বিছানায় উঠে বসে আমি দুহাতের শূন্য আঁজলা পাতলাম। হাত ভরে গেল জ্যোৎস্নায়। কী অনায়াস, অযাচিত জ্যোৎস্না। ঠিক এইরকমভাবে আমি বরাবর পয়সা চেয়েছি। ঠিক এইরকমভাবে আঁজলা পেতে। অনায়াসে।

ঠিক এই সময়ে আমার বিছানার পায়ের দিকটায় আমার বিবেককে বসে থাকতে দেখলাম। হুবহু যাত্রাদলের বিবেকের মত কালো আলখাল্লা পরা, গালে দাড়ি, মাথায় টুপি, হাতে একটা বাদ্যযন্ত্র। সে গান গাইছিল না, কিন্তু কাশছিল। কাশতে কাশতেই একটু ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, কাজটা কি ঠিক হবে উপলচন্দ্র?

একটু রেগে গিয়ে বলি, কেন, ঠিক হবে না কেন? আমি কাজটা করি বা না করি, সুবিনয় ডিভোর্স করবেই। ডিভোর্স না পেলে হয়তো খুনই করবে ক্ষণাকে। ভেবে দেখো বিবেকবাবা, খুন হওয়ার চেয়ে ডিভোর্সই ভাল হবে কি না ক্ষণার পক্ষে।

উপলচন্দ্র, বড্ড বেশি অমঙ্গলের সঙ্গে জড়াচ্ছ নিজেকে। খারাপ হয়ে যাচ্ছ। ওই হাজার টাকা হাতে না-পেলে তুমি ঠিকই বুঝতে পারতে যে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

আমি আমার বিবেকের কাছ ঘেঁষে বসে বললাম, শোনো বিবেকবাবা, তোমাকে বৈকুণ্ঠ ফোটোগ্রাফারের গল্পটা বলি। তেঠেঙে একটা পুরনো ক্যামেরা নিয়ে ফোটো তুলে বেড়াত সে। ছেলেবেলায় সে অনেক বার আমাদের গ্রুপ ফোটো তুলেছে। ক্যামেরার পিছনে কালো কাপড় মুড়ি দিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে তাক করত। এত সময় নিত যে আমাদের ধৈর্য থাকত না। বৈকুণ্ঠ তার খদ্দেরদের ধৈর্য নিয়ে মাথা ঘামাত না, সে চাইত একেবারে নিখুঁত ফোটোগ্রাফ তুলতে। শতবার সে এসে একে বাঁ দিকে সরাত, ওকে ডান দিকে হেলাত, কারও ঘাড় বেঁকিয়ে দিত, কারও হাত সোজা করত, কাউকে বলত মুখটা ওপরে তুলুন, ‘আঃ হাঃ আপনাকে নয়, আপনি মাথাটা একটু নামান।‘ এইভাবে ছবি তোলার আগে বিস্তর রিহার্সাল দিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন সে ক্যামেরায় ফিল্মের প্লেট ভরে লেন্সের ঠুলি খুলবার জন্য হাত বাড়াত তখন খুব আশা নিয়ে দম বন্ধ করে বসে আছি, এইবার ছবি উঠবে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে বৈকুণ্ঠ হঠাৎ বলে উঠত, উহুঃ! ঠুলি থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সে আবার এসে হয়তো কোনও বাচ্চার বুকের বোতাম এঁটে দিয়ে যেত। আবার সব ঠিকঠাক, আবার তুলিতে হাত, ফোটো উঠবে, আমার শরীর নিশপিশ করছে উত্তেজনায়। উঠবে উঠল বলে। কিন্তু ঠিক শেষ সময়ে বৈকুণ্ঠ আবার অমোঘভাবে বলে উঠত, উহুঃ! হতাশায় ভরে যেত ভিতরটা। বৈকুণ্ঠ এসে কাউকে হয়তো একটু পিছনে সরে যেতে বলল। আবার সব রেডি। ঠুলিতে হাত। ছবি উঠল বলে! কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে আবার সেই—উহুঃ! শোনো বিবেকবাবা, আমার ভাগ্যটা হচ্ছে ঠিক ওই বৈকুণ্ঠ ফোটোওয়ালার মতো। যখনই কোনও একটা দাও জোটে, যখনই কোনও পয়সাকড়ির সন্ধান পাই, যখন সব অভাব ঘুচে একটু আশার আলো দেখতে পাই, ঠিক তখনই বেশ। আড়াল থেকে কে বলে ওঠে, উহুঃ!

আমার বিবেক ঘন ঘন মাথা নাড়ছিল।

আমি বললাম, নইলে বলল, কন্ডাক্টারি করতে গিয়ে কেন নির্দোষ মানুষ সেই হাটুরে মারটা খেলাম? গোবিন্দর বাড়িতে না হোক চোর-তাড়া করে খেদালে। ডাকাতি করতে গিয়ে প্রথম চোটেই কেন কাজ ঢিলা হয়ে গেল! কোথাও কিছু না, মানিক সাহার ঘাড়ে যখন নিশ্চিন্তে চেপে বসেছি তখনই হঠাৎ তাকেই বা ভাবের ভূতে পেল কেন? সারাদিন আমার পেটে এক নাছোড় খিদের বাস। মাথায় চৌপর দিন খিদের চিন্তা। বিবেকবাবা, একটু ভেবে দেখো, এই প্রথম আমি এক থোকে এত টাকা হাতে পেলাম। বোমা ফাটবার মতো টাকা, জলপ্রপাতের মতো টাকা। এ কাজটা আমাকে করতে দাও। বাগড়া দিয়ো না বিবেকবাবা, পায়ে পড়ি।

আমার বিবেক একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, উপলচন্দ্র, টাকাটা তোমাকে বড় কাহিল করে ফেলেছে হে। শোনো বলি, টাকা থাকলেই যে মানুষ গরিব হয় না তা কিন্তু নয়। দুনিয়ায় দেখবে, যার যত টাকা সে তত গরিব।

আমি আমার বিবেককে হাত ধরে তুলে বললাম, শোনো বিবেকবাবা, এই যে প্যাকিং বাক্স সব দেখছ, এতে করে নানা দেশ থেকে হাজার রকমের কেমিকাল আসে। তার সবটুকু তো আর কোম্পানিতে যায় না। বেশির ভাগই চড়া দামে চোরাবাজারে বিক্রি হয়ে যায়। সুবিনয়ের পয়সার ঢলাঢলি। সেই পয়সার কিছু যদি আমার ভোগে লাগে তো লাগতে দাও। তাতে ওর পূণ্য হবে। দোহাই বিবেকবাবা, আজ তুমি যাও। আজ যাও বিবেকবাবা। আমি একটু নিজের মত থাকি।

বিবেক গ্রিলের বন্ধ দরজা ভেদ করে চলে গেল। জ্যোৎস্নায় আর তার চিহ্নও দেখা গেল না।

আর রবিবার। ডি-ডে।

আজ ক্ষণাকে নিয়ে সুবিনয়ের দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্ল্যান মাফিক আজ সকালেই সুবিনয়ের জরুরি কাজ পড়ে গেল। আমাকে ডেকে বলল, উপল, তুই ক্ষণাকে দক্ষিণেশ্বর থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয় তো! আমার একটা মিটিং পড়ে গেল আজ। স্টেটস থেকে একটা ডেলিগেশন এসেছে।

ক্ষণা বলল, থাক গে, আমারও তা হলে যাওয়ার দরকার নেই। পরের রবিবার গেলেও হবে।

সুবিনয় আঁতকে উঠে বলল, না না, তুমি যাও। পুজো দেবে মনে করেছ যাবে না কেন? উপল, তুই বরং দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে রেডি হয়ে নে।

ক্ষণা খুব বেজার মুখ করে বলল, কাজের লোকদের যে কেন বিয়ে করা। সপ্তাহে একটা মাত্র ছুটির দিন তাও তোমার ফি রবিবার মিটিং।

সুবিনয়ের দামি রেজারে যখন দাড়ি কামাচ্ছিলাম তখন নার্ভাসনেসের দরুন দু জায়গায় গাল কেটে গেল।

শুনলাম ঘরে ক্ষণা সুবিনয়কে বলছে, তোমার সেফটি রেজার উপলবাবুকে ইউজ করতে দিলে কেন?

তাতে কী? খুব উদার স্বরে সুবিনয় বলল, উপলের কোনও ডিজিজ নেই। তা ছাড়া ও আমার ভীষণ রেভিয়ারড ফ্রেন্ড। জানো না তো স্কুল কলেজে ও কী সাংঘাতিক ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। এ জিনিয়াস ইন ডিসগাইজ।

ক্ষণা বিরক্ত হয়ে বলল, কে কী ছিল তা জেনে কী হবে। এখন কে কীরকম সেইটেই বিচার করা উচিত। আর কখনও তোমার সেফটি রেজার ওকে দিয়ো না।

সুবিনয় খুব ব্যগ্র গলায় বলে, এ রকম বলতে নেই ক্ষণা। উপল একটু চেষ্টা করলেই মস্ত আর্টিস্ট হতে পারত, কিংবা খুব বড় গায়ক কিংবা শিশির ভাদুড়ির মতো অভিনেতা। ও যে সিনেমায় নেমেছিল তা জানো? তারপর ফিল্ম লাইনে ওকে নিয়ে টানাটানি। কিন্তু চিরকালের বোহেমিয়ান বলে ও বাঁধা জীবনে থাকতে রাজি হল না। এখনও ইচ্ছে করলে ও কত কী করতে পারে।

দাড়ি কামানোর পর আমি জীবনে এই প্রথম সুবিনয়ের দামি আফটারশেভ লোশন গালে লাগানোর সুযোগ পেলাম। গন্ধে প্রাণ আনচান করে ওঠে। এ রকম একটা আফটারশেভ লোশন কিনতে হবে। আরও কত কী কেনার কথা মনে পড়ছে সারা দিন! অবশ্যই একটা সেফটি রেজার। কিছু খুব নতুন ডিজাইনের জামা-কাপড়, একটা ঘড়ি, একটা রেডিয়ো…

ক্ষণা স্নান করতে গেল। সেই ফাঁকে যথাসাধ্য সাজপোশাক পরে নিয়েছি। সুবিনয় আমাকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, নট ব্যাড। কিন্তু, তুই একটু রোগা। ইউ নিড মাচ প্রোটিন অ্যান্ড এনাফ কারবোহাইড্রেট। কাল সকালেই ডাক্তার দত্তকে দিয়ে একটা থরো চেক আপ করিয়ে নিবি। গুড ফুড অ্যান্ড গুড মেডিসিন উইল মেক ইউ এ হ্যান্ডসাম ম্যান। মনে রাখবি ফিজিকাল অ্যাট্রাকশনে আমাকে বিট করা চাই।

আমি একটু ম্লান হেসে বললাম, টারজান, তোমার হাইট আর বিশাল স্বাস্থ্য কিছুতেই আমার হওয়ার নয়।

সুবিনয় ভ্রু কুঁচকে একটু ভেবে বলল, দেন ট্রাই টু ইমপ্রেস হার বাই আর্ট অর লিটারেচার অর বাই এনি ড্যাম থিং। আই ডোন্ট কেয়ার। আই ওয়ান্ট কুইক অ্যাকশন।

মাথা নাড়লাম।

সুবিনয় একটা সেলফ-টাইমারওলা ক্যামেরা আর একটা সুপারসেনসিটিভ খুদে টেপ-রেকর্ডার এয়ার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল। সেইটে কাঁধে ঝুলিয়ে ক্ষণাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। বাচ্চারা ঠাকুমার কাছে রয়ে গেল। সুবিনয়ের সাত বছরের মেয়ে দোলনা তেমন ঝামেলা করেনি, কিন্তু পাঁচ বছরের ছেলে ঘুপটু সঙ্গে যাওয়ার জন্য ভীষণ বায়না ধরছিল। ক্ষণার খুব ইচ্ছে ছিল সঙ্গে নেয়, কিন্তু সুবিনয় দেয়নি।

ট্যাক্সি ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষণা আর আমি একা। আমার বুকের মধ্যে ঢিবঢিব ভয়ের শব্দ। গলা শুকনো। শরীর কাঠের মতো পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিন্তু ক্ষণার কোনও ভয়ডর নেই, স্নায়ুর চাপ নেই। সে আমাকে বাড়ির ফাইফরমাশ করার লোক ভিন্ন অন্যকিছু মনে করে না।

ট্যাক্সির জানালা দিয়ে আসা বাতাসে ক্ষণার আঁচল উড়ে এসে একবার আমার কাঁধে পড়ল। ক্ষণা আঁচল টেনে নিয়ে বলল, আপনার পোশাক-আশাকে কিছু বাসি নেই তো৷ পুজো দেব ছোঁয়া-টোঁয়া লাগলে বিশ্রী।

এই ক্ষণার সঙ্গে প্রেম! ভারী হতাশ লাগল। বললাম, না, কিছু বাসি নয়।

 নিশ্চিন্ত হয়ে ক্ষণা তার হাতের সন্দেশের বাক্স আর শালপাতায় মোড়া ফুল আর ভ্যানিটি ব্যাগ দুজনের মাঝখানে সিটের ফাঁকা জায়গায় রাখল।

ধাঁ ধাঁ করে ট্যাক্সি এগিয়ে যাচ্ছে। পথ তো অফুরান নয়। এখন আমার কিছুটা সহজ হওয়া দরকার। দুটো-চারটে করে কথা এক্ষুনি বলতে শুরু না করলে সময়ের টানাটানিতে পড়ে যাব।

একবার সন্তর্পণে ক্ষণার দিকে তাকালাম। না-সুন্দর, না কুৎসিত ক্ষণা পিছনে হেলে বসে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। আমাকে গ্রাহ্যের মধ্যেও আনছে না। আমি তার চলনদার মাত্র, তার বেশি কিছু নই। কিন্তু এ ভাবটা ভেঙে দেওয়া দরকার।

কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই হঠাৎ ক্ষণা আমার দিকে চেয়ে বলল, ও এল না কেন বলুন তো!

আচমকা ক্ষণার কণ্ঠস্বরে একটু চমকে গিয়েছিলাম। এমনিতে চমকানোর কথা নয়, প্রতি দিনই ক্ষণার সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হয়। কিন্তু এখন আমার মনটা এত বেশি ক্ষণাকনশাস হয়ে আছে যে, ও নড়লেও আমার হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা লাগছে।

বললাম, মিটিং-এর কথা বলছিল।

নিজের গলাটা কেমন মিয়োনো শোনাল।

ক্ষণা এক-দুই পলক আমার দিকে চেয়ে বলল, রোজই যে কেন মিটিং থাকে বুঝি না। লোকেরা এত মিটিং করে কেন?

বুঝতে পারলাম ক্ষণা একটা ক্যাচ তুলেছে। লুফতে পারলে আউট।

ব্যাগে হাত ভরে টেপ-রেকর্ডারটা চালিয়ে দিয়ে বললাম, এই একটা ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমার ভীষণ মিল। আমিও মিটিং পছন্দ করি না।

ক্ষণা মিলটা পছন্দ করল কি না জানি না, বলল, অবশ্য ইম্পর্ট্যান্ট লোকদের প্রায় সময়েই মিটিং করতে হয়। ইম্পর্ট্যান্ট হওয়ার অনেক ঝামেলা।

দক্ষিণ কলকাতা পার হয়ে গাড়ি চৌরঙ্গি অঞ্চলে পড়ল। টেপ-রেকর্ডার চলছে।

 আমি বললাম, আপনি গান ভালবাসেন?

গান কে না ভালবাসে! কেন বলুন তো?

 আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, আমি একসময় গাইতাম।

হ্যাঁ শুনেছি, আপনি নাকি ভালই গাইতেন!

 ছবি আঁকতাম।

ক্ষণা ভ্রু কুঁচকে বলল, এ সব তো আমি জানি। আপনি খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনার কিছু হয়নি।

দুঃসাহস ভরে বললাম, আমার বুকের মধ্যে অনেক কথা জমা আছে বুঝলেন! তেমন মানুষ পাই না যাকে শোনাব।

তেমন মানুষ ক্ষণাও নয়। সে শুনতে চাইল না। শুধু বলল, শুনিয়ে কী হবে? সকলের বুকেই কিছু না কিছু কথা জমা থাকে। আমারও কি নেই?

আশান্বিত হয়ে বলি, আছে?

থাকতেই পারে।

বলবেন আমাকে?

ক্ষণা একটু অবাক হয়ে বলল, আপনার আজ কী হয়েছে বলুন তো!

রাস্তার একটা বিধবা বুড়িকে বাঁচাতে গিয়ে ট্যাক্সিটা জোর একটা টাল খেল। আমার মাথাটা বেটাল হয়ে দরজায় ঠুকে গেল একটু। যত না লেগেছে তার চেয়ে কিছু বেশি মাত্রা যোগ করে বললাম, উঃ!

ব্যথা পেলেন?

 ভীষণ।

দেখি! বলে ক্ষণা একটু ব্যর্থ হয়ে মুখ এগিয়ে আনে।

 আমি মাথাটা এগিয়ে আঙুলে ব্যথার জায়গাটা দেখিয়ে বলি, এইখানে।

ক্ষণার মনে কোনও দুর্বলতা নেই। সে দিব্যি ব্যথার জায়গাটা আঙুল বুলিয়ে পরীক্ষা করছিল। কিন্তু সেই স্পর্শে আমার ভিতরে বিদ্যুৎ খেলছে। সেটা প্রেমের অনুভূতি নয়। ভয়ের।

ক্ষণা নিজের জায়গায় সরে গিয়ে বলল, তেমন কিছু হয়নি। মন্দিরে গিয়ে একটু ঠান্ডা জল দেবেন ঠিক হয়ে যাবে।

এই ব্যথার প্রসঙ্গ থেকে অনায়াসেই আমি হৃদয়ের কথায় সরে গিয়ে বলতে পারতাম, ব্যথা কি শুধু ওইখানেই ক্ষণা? হৃদয়েও। কিন্তু প্রথমেই অতটা বাড়াবাড়ি কতে সাহস হল না।

দক্ষিণেশ্বরে ক্ষণা জুতো জমা রেখে পুজো দিতে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, পরস্ত্রী নিয়ে আমার এই কর্মতৎপরতা কবে নাগাদ শেষ হবে।

বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে পুজো দিল ক্ষণা। যখন বেরিয়ে এল তখন বেশ বেলা হয়েছে। বেরিয়ে এসেই বলল, উপলবাবু, ট্যাক্সি ডাকুন।

আমি উদাস স্বরে বললাম, গঙ্গার ধার ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন?

এখন গঙ্গা দেখবার সময় নেই। দোলন আর ঘুপটুর জন্য মন কেমন করছে। ওরাও মা ছাড়া বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।

অন্তত পঞ্চবটীটা ঘুরে যান। হনুমানকে খাওয়াবেন না?

নিতান্ত অনিচ্ছায় ক্ষণা রাজি হল। রবিবারের ভিড়ে পঞ্চবটী এলাকা থিকথিক করছে। হাজারটা বাচ্চার চেঁচানি, লোকজনের চিৎকার। এর মধ্যে কোনও সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা বৃথা। তবু সহজ হওয়ার জন্য আমি ক্ষণার পাশাপাশি হেঁটে ঘুরতে লাগলাম। কী বলি? কী বললে ক্ষণার হৃদয়কম্পাসের কাঁটা কেঁপে উঠবে তা আকাশ-পাতাল ভেবেও ঠিক করতে পারছিলাম না।

হঠাৎ বললাম, একটা জিনিস দেখবেন?

 কী?

আমি অবিকল হনুমানের নকল করতে পারি।

 যাঃ!

 সত্যি।

বলে আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। ক্ষণার হাতখানা হঠাৎ ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলাম গঙ্গার আঘাটায় একটু ফাঁকা মতো জায়গায়। আমার আচরণে ক্ষণা অবাক হয়েছে ভীষণ।

একটু হেসে বললাম, আমার সব আচরণকে মানুষের যুক্তি দিয়ে বিচার করবেন না। আমার মধ্যে হনুমানের ইনস্টিংক্ট আছে।

ক্ষণা হাসল না। তবে রাগও করল না। কেবল বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল।

আমি ওর পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে প্রথমে চমৎকার কুক কুক ধ্বনি দিয়ে হনুমানের ডাক নকল করে শোনালাম। তারপর দেখাতে লাগলাম হনুমানের পেট চুলকোনো, চোখের পিটির পিটির, উকুন বাছা, বানর নাচ, মুখ ভ্যাঙাননা।

দু-চারজন করে আমার চারধারে লোক জমে যেতে লাগল। বাচ্চারা হাতে তালি বাজাচ্ছে, লোকজন চেঁচিয়ে বলছে, ঘুরে-ফিরে দাদা। একদম ন্যাচারাল হচ্ছে।

অনেক দিন বাদে পাবলিকের সিমপ্যাথি পেয়ে আমার বেশ ভাল লাগছিল। শেষে গাছ থেকে হনুমানগুলো পর্যন্ত হুপ হুপ করে সাবাস জানাতে থাকে। একটা ছোকরা বলল, দাদা, ওরা আপনার আসল চেহারা চিনতে পেরে গেছে। ডাকছে।

ঘেমে-নেয়ে যখন খেলা শেষ করেছি তখন ভিড়ের মধ্যে ক্ষণা নেই। ভিড় ঠেলে চার দিকে খুঁজতে লাগলাম ওকে। নেই। মাথাটা কেমন ঘোলাটে লাগছিল। খুব কি বোকামি হয়ে গেল। কিন্তু একটা কিছু বাঁধভাঙা কাজ তো আমাকে করতেই হবে। নইলে ও আমাকে আলাদা করে লক্ষ করবে কেন?

হতাশ এবং শ্লথ পায়ে নতমুখে আমি বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। মনের মধ্যে নানা রকম টানা-পোড়েন।

বাসরাস্তার দিকে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম, একটা থেমে থাকা ট্যাক্সির দরজা একটু খুলে ডাকল, উপলবাবু।

কেঁপে উঠি। কোনও কথা বলতে পারি না। তাকাতেও পারি না ক্ষণার দিকে। শুধু, বাধ্য চাকরের মতো সিটে ওর পাশে উঠে বসি।

কথাহীন নৈঃশব্দ্যে গাড়ির ভিতরটা ভারাক্রান্ত। শুধু মোটরের একটানা আওয়াজ।

শ্যামবাজার পার হয়ে গাড়ি সার্কুলার রোডে পড়ল। ক্ষণা বাইরের দিকে ফেরানো মুখখানা ধীরে আমার দিকে ঘুরিয়ে এনে বলল, আপনার অডিয়েন্স খুশি হল?

আমি লজ্জায় মরে গিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, আমার অডিয়েন্স কেউ তো ছিল না।

 ওমা! সে কী! অনেক লোককে তো জুটিয়ে ফেললেন দেখলাম!

 ম্লান হেসে বললাম, আমার একজন মাত্র অডিয়েন্স ছিল। সে তো দেখল না!

সে কে?

আপনি।— বলে আমি চতুর হাতে টেপ-রেকর্ডার চালিয়ে দিই।

আমি! আমি কেন আপনার অডিয়েন্স হতে যাব? ও রকম ভাঁড়ামো করছিলেন কেন বলুন তো? ভারী বিশ্রী।

আমি মৃদুস্বরে বললাম, আপনি সেই বাজিকরের গল্পটা কি জানেন! যে কেবল নানা রকম খেলা দেখিয়ে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়! তার আর-কিছু জানা ছিল না। সে একদিন মাতা মেরির মন্দিরে গিয়ে দেবীকে ভক্তিভরে তার সেই বাজির খেলা নিবেদন করেছিল। দেবী সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আমিও ওই বাজিকরের মতো আমার যা আছে তাই দিয়ে আপনাকে খুশি করতে চেয়েছিলাম।

আমাকে খুশি করতে এত চেষ্টা কেন?

 উদাস স্বরে বললাম, কী জানি!

ক্ষণা একটু হাসল, হঠাৎ বলল, আর কখনও ওরকম করবেন না। ঠিক তো?

 আচ্ছা।