৯। পারিজাত
এবার বন্যা হল না। একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে অসীমা। অভিজিৎ আজকাল স্কুলের পর রোজ প্রতিমাদের বাড়ি যায়। রুমা আবার বিয়ে করেছে। গন্ধর্বকেই। আকাশে শরতের মেঘের আনাগোনা। ভারী সুন্দর এই ঋতু। যদিও প্রকৃতির দিকে তাকানোর সময় আমার কম। তবু টের পাই। বাইরে শরতের আলো আর ছায়া সাদা ও কালো দুটি শিশুর মতো আপনমনে খেলছে।
হে আমার দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, অজ্ঞ ভারতবাসী, জীবনের কোনও গল্পেরই কোনও শেষ নেই। একটা ঘটনা থেকে জীবন আর একটা ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। এইভাবে অশেষ হয়ে চলে গল্প। এই বুড়ি পৃথিবী অবিরল বলে যাচ্ছে গল্পের পর গল্প। শেষ নেই। এই গল্পে অর্থহীন জয়, নিরানন্দ পরাজয়, ক্ষণস্থায়ী সফলতা, খণ্ডিত বিফলতা, সূক্ষ্ম প্রেম বা স্থূল বিবাহ ফিরে ফিরে আসে। আমার দারিদ্র্যসীমা পেরিয়ে আসার কিংবদন্তীও পুরনো হয়ে এল। আমি জানি, আমার মতো আরও হাজার হাজার লোক দারিদ্রসীমা ডিঙোবে। রচিত হবে আরও কত কিংবদন্তী। একদিন দারিদ্র্যসীমার রেলবাঁধের ওপাশে আর লোকবসতি থাকবে না। আমরা সেদিন সবাই মিলে তুলে দেব ওই রেলবাঁধ। আমি সেই স্বপ্ন দেখি।
শরতের এই রঙিন বিকেলে আজ কিছু নির্জন অবকাশ পেয়ে গেছি। কিছু উন্মন। আমার ক্যালকুলেটর বারবার সংকেত দিচ্ছে। আমার বাগানে শিউলির গন্ধ। পিছনে এক মরুভূমির মতো অতীত। সামনে এক পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা।
আমি নিরালা কুঞ্জবনে একা বসে আছি। একা! অসীমা আজকাল আসার সময় পায় না।
সময় পায় না? না, কথাটা ঠিক নয়। আমি জানি, অসীমা ভয় পায়। বড় ভয় পায়। ক্যালকুলেটর কারই বা নেই! ভিখিরিরও আছে। কারও কারও ক্যালকুলেটর নির্ভুল, কারও ভুলে ভরা। অসীমার ক্যালকুলেটর কেমন তা আমি সঠিক জানি না। কিন্তু তার যন্ত্রটি নিশ্চিত তাকে সাবধান করে দিয়েছে। বলেছে, ও ভাল নয়, ওর কাছে যেয়ো না। অসীমা হয়তো খুব বেশি আসবে না আর। স্কুল তাকে অজস্র কচি হাতে জড়িয়ে ধরবে। নিয়ে নেবে। নিক।
আমি আজ কিছু ভাবছি না। কুঞ্জবনে অদ্ভুত রূপময় আঁধার। বাইরে পাখি ডাকছে। গুনগুন করছে মৌমাছি। শিউলির মাতাল গন্ধে ভরে আছে দশ দিক।
ফটকের বাইরে আজও চেঁচাচ্ছে সেই মাতাল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে লোককে শোনাচ্ছে আমার জীবনকাহিনি। রাজার আলমারির মধ্যে আমি কীভাবে পেয়ে যাই গুপ্তধন। কীভাবে গরিবদের শোষণ করে আমি আস্তে আস্তে উঠে গেছি টাকার পাহাড়ের চূড়ায়। আমার শ্বাসবায়ুতে মিশে আছে কত হতভাগ্যের দীর্ঘশ্বাস।
আমার খারাপ লাগে না। একভাবে না একভাবে নিজের অজান্তে সে পিটিয়ে চলেছে আমারই ঢাক। গড়ে উঠছে কিংবদন্তী। রহস্য। ইন্দ্রজাল।
ফটকের মধ্যে যে চারজন ছায়ামূর্তি ঢুকল তাদের দেখে আমি চমকালাম না। সহজ, সুঠাম তাদের হাঁটার ভঙ্গি। আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ় তাদের শরীর। ক্যালকুলেটর বলল, সাবধান! আমি তাকে চুপ করিয়ে রাখলাম। এরা অধরের লোক। সে নিজে আসেনি। আসতে নেই।
লোকগুলো দারোয়ানকে কী যেন জিজ্ঞেস করল। বোধহয়, আমি কোথায় জেনে নিল। ঘাসজমিতে তাদের পায়ের কোনও শব্দ হচ্ছে না। কিন্তু তারা আসছে। তারা ভাল লোক নয়। খুনি, গুন্ডা, নিষ্ঠুর। আমি জানি।
শিউলির দম বন্ধ করা গন্ধ আমি বুক ভরে নিই। আমি জীবনে অনেক লড়াই জিতেছি। এক-আধটা লড়াই হারলে আর তত ক্ষতি হবে না আমার। বরং কিংবদন্তী সৃষ্টি হবে আবার। ঘন হয়ে উঠবে রূপকথা।
পরাজয়ের শেষ সীমানায় দাঁড়ানো অধর জানে না, উপত্যকায় আমাদের লড়াই শেষ হয়ে গেছে। তার রক্তে রাঙানো তলোয়ার মুছে আমি খাপে ভরে ফেলেছি। আকাশে এখন শকুন উড়ছে।
আমি একটু হাসলাম। নিজের হাতের তেলোর দিকে চেয়ে রইলাম আনমনে। শিউলির গন্ধে বুক ভরে উঠছে।
বাইরের ঘরের দরজাটা খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ছজন লোক। এদেরও হাঁটার ভঙ্গি সহজ, সুঠাম। চমৎকার চটপটে। ঘাসজমির ওপর ছটা বেড়ালের মতো নিঃশব্দে চকিত পায়ে লাফিয়ে নেমে এল তারা।
অধরের লোকেরা কুঞ্জবনের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও দূরত্বটা অতিক্রম করতে পারল না শেষ অবধি। ছজন তাদেরই মতো আত্মবিশ্বাসী নিষ্ঠুর ও জান কবুল লোক তাদের পথ আটকাল।
তারপর যা হয় হচ্ছিল। আমি একটা হাই তুললাম, অধরের পয়সা-খাওয়া চারটে লোকের সঙ্গে আমার বেতনভুক ছজন লোক খুব নিবিষ্ট এক মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ঝিকোচ্ছে ছোরা, রিভলভার, নল, ঘুসি, ব্লেড। বড় একঘেয়ে।
দারিদ্রসীমা ডিঙোতে গিয়ে আমার পথে বহুরকম বাধা পড়েছে। এক-আধটা লাশও কি পড়েনি? কিন্তু এসবই অত্যন্ত মোটা দাগের ব্যাপার। আমার ভাল লাগে না।
শিউলির গন্ধ বড় মাতাল করেছে আজ আমাকে। নিমীলিত চক্ষে সামনের দিকে চেয়ে আমি মাতাল হয়েও যাচ্ছি। পিছনের ঘাসজমিতে লড়াইটা বোধহয় শেষ হল, কে হারল, কে জিতল তা জানার জন্য আমি মোটেই উদগ্রীব হই না। তবে জানি শেষ অবধি আমার কাছে কেউই পৌঁছতে পারবে না।
ক্লান্তিতে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজলাম।