নাহিদদের বাড়ির উত্তর দিকটায় শাল মহুয়ার নিবিড় একখানা বন। হাঁটতে হাঁটতে বনের দিকটায় চলে এসেছে শুভ এবং বর্ষা। হঠাৎ বর্ষা বলল, আপনাকে একটা কথা বলব?
বর্ষার চোখের দিকে তাকাল শুভ। দুঃখ কষ্ট কিংবা মন খারাপের কথা হলে বলল না। শুনতে আমার ভাল লাগবে না। আমি নিজে এত দুঃখ বেদনার মধ্যে আছি…।
কথা শেষ করল না শুভ।
বর্ষা বলল, কী দুঃখ আপনার?
শুভ হাসল। যা বলতে চাইছ, বলো।
জানতাম প্রশ্নটা আপনি এড়িয়ে যাবেন।
সব কথা কি বলা যায়?
কাউকে কাউকে বলা যায়।
আমি কথা এড়াই কেন জান? মিথ্যে বলতে লজ্জা করে বলে।
তাহলে সত্য কথা বলুন।
সব সময় তাই বলি, কিন্তু এটা বলব না।
আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। আপনার মনের সব কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করে আমার।
কেন?
জানি না।
শুভ এবং বর্ষা যখন বনের দিকটায় হাঁটছে নাহিদ তখন বাড়ি ঢুকে শুভকে খুঁজছিল। পারুকে পেয়ে বলল, এই পারু, শুভকে দেখেছিস?
পারু বলল, না তো!
বর্ষাকে জিজ্ঞেস করে আয় তো শুভ কোথায় গেছে ও জানে কী না।
বর্ষাও বাড়ি নেই।
দুজনে তাহলে এক সঙ্গেই কোথাও গেছে। ঠিক আছে আমি দেখছি।
দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল নাহিদ, বনের দিকে হাঁটতে লাগল।
বর্ষা আর শুভ তখন বনের মাঝামাঝি সুন্দর একটা মাঠের ধারে এসেছে। চারদিকে নিবিড় গাছপালার বন তার মাঝামধ্যিখানে ঘন সবুজ ঘাসের একটুখানি একটা মাঠ। হঠাৎ করে তাকালে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
এই মাঠ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল শুভ। বাহ, সুন্দর জায়গা।
বর্ষা বলল, জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এখানে এলে আমার মন অন্যরকম হয়ে যায়। আজ আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আমার প্রিয় জায়গাটা আপনাকে দেখাই।
কিন্তু এখানে এসে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে আমার মনের সবকথা তোমাকে বলে দিই। এভাবে কেন হঠাৎ করে তোমাদের এখানে এলাম, কেন এতদিন ধরে আছি।
শুভর কথা শুনে বর্ষার কী রকম অভিমান হল। মাঠের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি শুনব না।
কেন?
জোর করে কারও মনের কথা আমি শুনতে চাই না।
বর্ষার অভিমানটা বুঝল শুভ। বর্ষার দিকে তাকিয়ে দুহাতে বর্ষার মুখটা প্রার্থনার ভঙ্গিতে তুলে ধরল সে। বর্ষার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, মন খারাপ করো না। আমি অবশ্যই একদিন তোমাকে সব বলব। আমার মনের সব কথা তোমাকে বলব।
এই দৃশ্যটা দেখে ফেলল নাহিদ।
শুভ এবং বর্ষাকে খুঁজতে এদিকেই আসছিল সে। বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই দৃশ্যটা তার চোখে পড়ল। নিজের অজান্তে পা আটকে গেল তার। নাহিদ যেন বনের বৃক্ষ হয়ে গেল। হাঁটা চলার ক্ষমতা রইল না তার।
.
শাহিন অফিসে চলে যাওয়ার পর নিজের রুম গুছাচ্ছে সুরমা।
মা এসে ঢুকলেন। তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে চাই বউমা।
সুরমা কাজ বন্ধ করল, কী পরামর্শ?
তার আগে বলি, সেদিন শাহিনকে আমি বলেছিলাম সেতুর ভাইদের কাছে যেতে, ও যেতে রাজি হল না।
কিন্তু থানায় গিয়েছিল।
ওখানে না গেলেও কোনও অসুবিধা ছিল না। এ ব্যাপারে থানা পুলিশ না করাই। ভাল। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করা উচিত। কারণ দুদিন আগে বা পরে সম্পর্ক ওদের সঙ্গে আমাদের ঠিক হবেই। সেতুর ভাইদের কাছে না গিয়ে ভুল করেছে শাহিন। আমি ওর ওপর বিরক্ত হয়েছি।
মায়ের কথা শুনে স্বামীর পক্ষ নিল সুরমা। না মা, ওতো বলেছিল সেতুর ভাইরা যদি বোস কোনও কথাটথা বলে ফেলে সেটা খুব অপমানকর…
কথা শেষ করতে পারল না সুরমা। মা গম্ভীর গলায় বললেন, স্বামীর সাফাই গাইবার দরকার নেই। এসব ক্ষেত্রে এতকিছু ভাবা ঠিক নয়। ছোটভাইর জন্য না হয় একটু অপমান হতোই।
এবার কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল সুরমা, আপনি যেন কী পরামর্শের কথা বললেন?
আমি নিজেই সেতুর ভাইদের কাছে যেতে চাই।
জ্বি?।
হ্যাঁ। সরাসরি ওদের সঙ্গে কথা বলব। দেখি ওরা কী বলে!
সেতুর ছোট ভাইটা খুব রাগী।
হোক, তাতে আমার কী?
মানে সে যদি আপনাকে কোনও অপমানকর কথা বলে ফেলে?
ও রকম পরিবারের ছেলের এতটা অদ্র হওয়ার কথা না।
কিন্তু সেতুর বন্ধু দোলনকে সে খুব অপমান করেছে।
মা এসব কেয়ারই করলেন না। বললেন, দোলন আর আমি এক নই। আমি আজই যাব।
দুপুরবেলা সত্যি সত্যি মামুন-স্বপনের অফিসে এলেন তিনি। স্বপনের নয়, মামুনের রুমে ঢুকলেন।
উদাস হয়ে নিজের চেয়ারে বসেছিল মামুন। আচমকা বয়স্ক এবং বনেদি ধরনের মহিলাকে তার রুমে দেখে থতমত খেল। নিজের অজান্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিল। স্লামালেকুম বসুন, বসুন।
মা সালামের জবাব দিলেন। তারপর বসলেন।
মামুন বলল, আমি আপনাকে ঠিক, মানে চিনতে পারিনি আর কি!
মা সরল গলায় বললেন, আমি শুভর মা।
শুভ নামটা শুনে যেন নিভে গেল মামুন। জ্বি?
হ্যাঁ বাধ্য হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলা। দরকার।
মামুন গম্ভীর গলায় বলল, বলুন।
আমার ছেলে কী এমন অন্যায় করেছে যে তাকে আপনারা মেরে ফেলতে চাইছেন?
কথাটা বুঝতে পারল না মামুন। ভুরু কুঁচকে বলল, মেরে ফেলতে চাইছি?
হ্যাঁ। মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছেন তার পেছনে।
মামুন অবাক। কী বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি।
না এমন কিছু তো আমরা করিনি।
করেছেন।
আমরা কোনও অভদ্রলোক নই যে এ ধরনের আচরণ করব!
আমিও তই মনে করতাম। অভদ্র বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের কোনও সম্পর্ক হওয়ার কথা নয়। আমার ছেলের রুচি খারাপ হতে পারে না।
মামুন গম্ভীর গলায় বলল, মাস্তানদের ব্যাপারে যা বলছিলেন, বলুন।
আমাদের বাড়ির সামনে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকছে দুজন মাস্তান। শুভ কোথায় আছে জানার জন্য আমার মেয়েকে ভয় দেখিয়েছে। ওদের ভয়ে গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে আছে আমার ছেলে।
এসব যে আমরাই করাচ্ছি তা আপনার মনে হল কেন? হতে পারে আপনার ছেলেও ওদের দলেরই। চাদা টাদার শেয়ার নিয়ে কোনও বিরোধ ইত্যাদির কারণে বন্ধু মাস্তানরাই তাকে খুঁজছে।
মামুনের কথা শুনে রেগে গেলেন মা। বাজে কথা বলবেন না। ওরকম ছেলের মা আমি নই। নিজের ছেলের সততা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা আছে বলেই এই পরিস্থিতিতে আপনার কাছে আমি আসতে পেরেছি। কখনো ভাববেন না আপনাদের টাকা পয়সা কিংবা জায়গা সম্পত্তির লোভে পড়ে আপনার বোনের সঙ্গে আমার ছেলের সম্পর্ক হয়েছে। বড়ছেলের শ্বশুর বাড়ির এক পয়সার জিনিস আমার বাড়িতে ঢোকে নি। ওসব আমরা ঘৃণা করি। টাকা পয়সা আমাদের নেই কিন্তু সতোর অহঙ্কার আছে।
এসব আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?
ব্যাপারটা আপনারা মেনে নিন আর ওসব মাস্তানদের ফেরান।
মামুন একটু সামনের দিকে ঝুঁকল। আমরা কী মেনে নেব না নেব সেটা আমাদের ব্যাপার। এই নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলবো না। তবে মাস্তান ইত্যাদি নিয়ে যে নোংরামোর কথা বললেন সেটা আমি অবশ্যই দেখব। আপনি কি চা খাবেন?
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন মা। না।
এদিকে মাকে নিয়ে খুবই টেনশান করছে মালা। সুরমার রুমে এসে বলল, আমার খুব ভয় করছে ভাবী।
সুরমা অবাক হল। কেন?
মা এখনও আসছে না কেন?
তাতে কী হয়েছে?
মানে সেতুর ভাইরা কী রকম ব্যবহার করে…
মালার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুরমা বলল, তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।
তুমি বুঝতে পারছ না ভাবী। ওরা যে রকম গুণ্ডাপাণ্ডা লাগিয়েছে, মাকে এভাবে যেতে দেয়া তোমার ঠিক হয়নি। আমি জানলে কিছুতেই যেতে দিতাম না।
তোমাকেও যেতে হবে।
কোথায়?
সেতুদের বাড়ি।
মানে?
হ্যাঁ।
কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। মা গেছেন সেতুর ভাইদের কাছে, তুমি আর আমি যাব ওর ভাবীদের কাছে। দেখি এভাবে ব্যাপারটা আমরা ম্যানেজ করতে পারি কী না!
মালার মুখ শুকিয়ে গেল। আমার ভয় করছে।
সুরমা বলল, ভয় করলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি একাই যাব।
সুরমার চোখের দিকে তাকিয়ে কী ভাবল মালা, তারপর বলল, না, সবাই শুভর জন্য এত করছে আমি করব না কেন? আমিও তোমার সঙ্গে যাব। যা হবার হবে। এক্ষুণি রেডি হয়ে আসছি।
দ্রুত হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে গেল মালা।
.
শুভর মা চলে যাওয়ার পর স্বপনকে নিজের রুমে ডেকে পাঠাল মামুন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এল স্বপন। রাগী ভঙ্গিতে মামুন বলল, মিথ্যে বলার দরকার নেই। ছোকরাটির মা আমার কাছে এসেছিলেন। তুই কি ওর পেছনে মাস্তান লাগিয়েছিস?
ভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বপন পরিষ্কার গলায় বলল, হ্যাঁ। ওর ওপর আমার খুব রাগ।
রাগ তো আমারও। সেজন্য এই ধরনের নোংরামো করতে হবে নাকি! ওরা যদি পুলিশের কাছে যায়! মাস্তানরা যদি ধরা পড়ে এবং পুলিশের কাছে যদি তোর নাম বলে দেয়, কেঁচো খুড়তে গিয়ে তো তখন সাপ বেরিয়ে পড়বে। সেতুর কেলেঙ্কারির কথা তখন চাপা থাকবে না।
ঠিক আছে আমি ওসব ম্যানেজ করছি। মাস্তান উইথড্র করব।
হ্যাঁ তাই কর।
সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল হল স্বপন। ভাইয়া, ফ্যান্টাসটিক একটা আইডিয়া পাওয়া গেছে। সেতুকে আমরা বলি, তুই যদি ডিভোর্স না করিস তাহলে শুভকে আমরা মেরে ফেলব। মাস্তান রেডি করেছি। দেখবে সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়ে যাবে।
স্বপনের কথা শুনে মামুনও খুশি হল। আইডিয়াটা ভাল।
কিন্তু আমি বললে কাজ হবে না বলতে হবে তোমাকে। সেতু জানে তুমি কখনও ফালতু কথা বল না।
চিন্তিত চোখে স্বপনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মামুন।
.
শিলা বলল, আপনারা এভাবে আমাদের বাড়িতে আসবেন আমরা কল্পনাই করিনি।
সুরমা বলল, আমরাও ভাবিনি এভাবে আসতে হবে। পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছি।
রেখা বলল, চা খান।
সেতুদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে ওরা। শিলা রেখা, সুরমা মালা। খানিক আগে ট্রলিতে করে প্রচুর খাবার নিয়ে এসেছে রানি। ট্রলিটা এখন সেন্টার টেবিলের একপাশে দাঁড় করানো। সেই ট্রলি থেকে চায়ের সরঞ্জাম নামাতে নামাতে কথাটা বলল রেখা। শুনে মালা বলল, না না, চা খাব না। আপনি অযথা কষ্ট করবেন না।
তারপর সুরমার দিকে তাকাল সে। ভাবী, কথা শুরু কর।
শিলা এবং রেখার দিকে তাকাল সুরমা। কথা যা বলতে চাই তা বোধহয় আপনারা বুঝতে পেরেছেন।
চায়ের সরঞ্জাম রেখে শিলার পাশে বসল রেখা। সুরমার মুখের দিকে তাকাল।
সুরমা বলল, ব্যাপারটা এত জটিল করা ঠিক হচ্ছে না। দুটো পরিবারেই বেশ বড় রকমের অশান্তি চলছে। সবমিলে পরিস্থিতিটা খুব বাজে হয়ে গেছে।
রেখা বলল, আমরাও তা বুঝি। কিন্তু আমরা হচ্ছি বাড়ির বউ। এক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে?
শিলা বলল, ওর কথা ঠিক। ফ্যামিলির যে কোনও ব্যাপারে সেতুর ভাইদের ডিসিশানই সব। আমাদের মতামতে তেমন কিছু হয় না।
কথাটা আমি বিশ্বাস করলাম না।
কেন?
বাড়ির বউরা চাইলে অবশ্যই স্বামীদেরকে কনভিন্স করতে পারে। আপনারা আপনাদের স্বামীদেরকে বোঝান যে দুটো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছে তাদেরকে এভাবে টর্চার করা ঠিক না। ব্যাপারটা তারা মেনে নিক।
রেখা বলল, আপনারা কিন্তু চা খেলেন না।
মালা হঠাৎত্র উঠে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক অবস্থায় যখন আসব তখন খাব।
তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, আমরা কি সেতুর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?
এক পলক মালার দিকে তাকিয়ে সুরমার দিকে তাকাল শিলা। আমার জায়গায় আপনি হলে কী করতেন?
কথাটা বুঝতে পারল না সুরমা। বলল, কী করতাম মানে?
এই অবস্থায়, মানে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সেতুর সঙ্গে কি আমি আপনাদেরকে দেখা করতে দিতে পারি?
না তা পারেন না। মালা ইমোশনালি বলে ফেলেছে। সেতুর সঙ্গে দেখা আমরা আজ করবও না।
সুরমাও উঠল। তবে আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনারা দুজনে মিলে সেতুর ভাইদেরকে বোঝাবেন। ব্যাপারটা দয়া করে আপনারা মেনে নিন।
রাতেরবেলা স্বপনকে রেখা বলল, তোমার জায়গায় যদি শুভ হতো আর আমার জায়গায় সেতু তখন আমাদের মনের অবস্থা কী রকম হতো একবার ভেবে দেখ।
স্বপন বলল, এসব আমি ভেবে দেখব না। কারণ আমাদের ক্ষেত্রে এরকম হয়নি।
কিন্তু শিক্ষিত এবং বিবেকবান মানুষের উচিত অন্যের সমস্যা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা।
রেখার চোখের দিকে তাকাল স্বপন। পরিষ্কার করে বল কী বলতে চাও তুমি?
আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছ।
না পারিনি।
তাহলে পরিষ্কার করে বলি। শুভকে তোমরা মেনে নাও।
কী?
আপন বোনকে এরকম কষ্ট দিচ্ছ, ব্যাপারটা খুবই অমানবিক।
হঠাৎ এভাবে সেতুর পক্ষে চলে গেলে?
অনেক ভেবেই গিয়েছি।
নিজেকে দিয়ে, আমাকে দিয়ে তো উদাহরণ দিলে, এবার আমি একটা উদাহরণ দিই? তোমার নিজের মেয়েটি যদি সেতুর মতো করে তুমি মেনে নেবে?
রেখা সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই নেব। আমার মেয়ে যদি কাউকে ভালবেসে বিয়ে করে সুখী হয়, কেন আমি তা মেনে নেব না? যার জীবন সে যাপন করবে, আমার কী? আমি কেন তাকে বাধা দেব।
খানিক কী ভাবল স্বপন তারপর বলল, সবকিছুর পরও সেতুর ব্যাপারে আমি কিছুই বলব না। ডিসিশান যা নেয়ার ভাইয়া নেবে।
.
তার মানে ওরা প্ল্যান করেই এসেছে। দুজন বাড়িতে, একজন আমার অফিসে।
মামুনের কথা শুনে শিলা একটু গম্ভীর হল। ওদের জায়গায় আমরা হলেও তাই করতাম। আমাদের কাছে এসে ওরা কোনও অন্যায় করেনি। অন্যায় আসলে করছি আমরা। সেতুকে নিয়ে আমরা যা করছি এরচে’ বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে এটা অপরাধ। তাছাড়া মানুষের মনের ওপর জোর করা আল্লাহ খুবই ঘৃণা করেন।
এসব কি ওরা বলে গেল?
ওরা বলবে কেন? আমি কি অশিক্ষিত মানুষ? আমি এসব বুঝি না?
মামুন কথা বলল না।
শিলা বলল, শোন, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, সেতু যা চাইছে তা মেনে নাও।
ওর জীবন ওরই। শুভকে নিয়ে ও যদি সুখী হয় তাতে তোমার অসুবিধা কী? ওর জীবন ওকে কাটাতে দাও।
মামুন কঠিন গলায় বলল, তোমার কথা আমি শুনব না। শুভকে ওর ডিভোর্স করতে হবে। এটাই ফাইনাল।
গ্রীবা বাঁকিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল শিলা। কেন?
কোনও ব্যাখাও তোমাকে আমি করব না।
ব্যাখ্যা তোমাকে করতে হবে। আমার স্বামী হয়ে অন্যায়ভাবে তুমি একটা কাজ করবে আর আমি তা মেনে নেব, তেমন স্ত্রী আমি নই। সেতুর ব্যাপারে কোনও রকমের বাড়াবাড়ি তুমি আর করবে না।
মামুন উঠে দাঁড়াল। আমার যা ডিসিশান তাই হবে। ডিভোর্স ছোকরাটিকে ওর। করতেই হবে।
শিলার দিকে আর তাকাল না মামুন। গটগট করে বেরিয়ে সেতুর রুমে এসে ঢুকল।
সেতু শুয়েছিল। মামুনকে দেখে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে উঠে বসল।
টেবিলের ওপর ডিভোর্স ফর্মটা পড়ে আছে। পাশে একটা কলম। ফর্ম এবং কলম হাতে নিয়ে মামুন বলল, আমি আজ শেষবারের মতো তোর কাছে এসেছি। ফাইনাল ডিসিশান নিয়ে এসেছি। সই করে দে, নয়তো পরিণতি খুব খারাপ হবে।
সেতু বলল, কী খারাপ হবে? মেরে ফেলবে আমাকে? মেরে ফেল।
তোকে মারব না। মারব ওই ছোকরাটাকে। ব্যবস্থাও করে ফেলেছি।
একথা শুনে সেতু একেবারে কেঁপে উঠল। ভাইয়া!
মামুন অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, তুই জানিস আমি সহজে কোনও ডিসিশান নিই, কিন্তু একবার যদি নিই তার কোনও নড়চড় হয় না। তোর ওপর ওই ছোরাটার জীবন নির্ভর করছে।
ছটফট করতে করতে সেতু তারপর বিছানা থেকে নামল। না ভাইয়া না। ওর কোনও ক্ষতি তুমি করো না। মারতে হয় আমাকে মার, আমাকে মেরে ফেল। শুভর। কোনও দোষ নেই।
আমি কোনও কথা শুনব না। সই করলে ছোকরাটাকে আমি কনসিডার করব, নয়তো লোক ঠিক করা আছে, শুধু একটা ফোন করব। চাইলে ওর লাশও তোকে দেখাব।
সেতু পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। না না, না। দাও, আমি সই করে দিচ্ছি। যত সই চাও আমি করে দিচ্ছি। তবু, তবু শুভ বেঁচে থাক। ওকে তোমরা মেরো না। ওর কোনও দোষ নেই। সব দোষ আমার, আমার।
ডিভোর্স ফর্ম আর কলম হাতে নিয়ে করুণ ভঙ্গিতে কাঁদতে লাগল সেতু। প্রথমে সেতুর কান্নাটা পাত্তা দিল না মামুন। কিন্তু একটা সময়ে তার মনে হল মায়ের মৃত্যুর পর, বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের লাশের সামনে গড়াগড়ি খেয়ে যেমন করুণ স্বরে কেঁদেছিল সেতু, কান্নাটা যেন তেমন। জীবনের গভীর, গভীরতর দুঃখ ছাড়া এমন কান্না মানুষ কাঁদতে পারে না।
সেতুর এই কান্না মন বদলে দিল মামুনের। বহুকাল আগে একদিন মায়ের লাশের সামনে থেকে যেভাবে আদরের বোনটিকে নিজের বুকে টেনে এনেছিল সে, তারপর আরেকদিন বাবার লাশের সামনে থেকে যেভাবে টেনে এনেছিল নিজের অজান্তে ঠিক সেইভাবে সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল সে, আয়, আমার কাছে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্স ফর্ম আর কলম ছুঁড়ে ফেলে দুহাতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরল সেতু। আগের মতোই করুণ স্বরে কাঁদতে লাগল।
মামুনেরও ততোক্ষণে জলে চোখ ভরে গেছে। বোনের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে, কাঁদতে কাঁদতে মামুন বলল, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। খুব অন্যায় হয়ে গেছে আমার। তোর মনের ওপর এতটা জোর করা আমার ঠিক হয়নি। শুভকে আমি মেনে নিলাম। কাদিস না। তুই যা চাস তাই হবে। তাই হবে।
স্বামীর পিছু পিছু সেতুর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল শিলা। এখন দুইভাই বোনের এই অবস্থা দেখে তার চোখও জলে ভরে এল।
.
বিকেলের মুখে নিজের ঘরে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে বর্ষা। ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।
বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিল শুভ, বর্ষার গান শুনে বেরুল না, তার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। কিন্তু বর্ষা তাকে দেখতে পেল না। চোখ বুজে গান গাইছে সে। বর্ষাকে এভাবে দেখে আর তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল শুভ।
গান গাইতে গাইতে একসময় চোখ খুলল বর্ষা। শুভকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে গান থামাল। আপনি কখন এলেন?
শুভ হাসল। অনেকক্ষণ।
আমাকে ডাকেননি কেন?
তুমি গান গাইছিলে, শুনছিলাম। এত ভাল লাগছিল!
তুমি বলেছিলে আমাকে একদিন গান শোনাবে, শোনালে না তো, এজন্য নিজে নিজেই। চুরি করে শুনে নিচ্ছি।
বর্ষা হাসল। ভালই করেছেন। গানটা আমি আপনার জন্যই গাইছিলাম।
তাহলে আবার গাও।
কেন?
শুনলে মনটা ভাল হবে।
তার মানে আজও আপনার মন খারাপ। আপনার মন এত খারাপ হয় কেন? কী কারণে হয়? কার জন্য হয়?
গভীর করে বর্ষার চোখের দিকে তাকাল শুভ। যার জন্য খারাপ হয় খুব শীঘ্রই তার কথা তোমাকে আমি বলব।
বর্ষা আবদারের গলায় বলল, আজই বলুন না! এক্ষুণি বলুন না!
মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করল শুভ। না।
তারপর উঠোনে নামল। নেমেই নাহিদকে দেখতে পেল উদাস হয়ে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে!
শুভ তারপর নাহিদের সামনে এসে দাঁড়াল। কী হয়েছে রে তোর?
নাহিদ বলল, কী হবে?
বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি তুই কেমন উদাস, চিন্তিত হয়ে আছিস। কী হয়েছে?
নাহিদ হাসার চেষ্টা করল। কিছু না।
চিন্তিত থাকার কথা আমার, থাকছিস তুই। আবার বলছিস কিছু হয়নি।
সত্যি কিছু হয়নি।
কিছু না হলে বাড়ি বসে আছিস কেন? ঢাকায় যা। ওদিককার খোঁজ খবর নিয়ে আয়। অনেকদিন হয়ে গেল।
যদি সব ঠিক হয়ে যায় তাহলে তুই ফিরে যাবি?
একথা শুনে শুভ খুবই অবাক হল। কী রকম কথা বলছিস? চিরকাল তোদের এখানে থাকব নাকি! ঠিক হোক না হোক ফিরে তো যাবই।
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাই তো! ঠিক আছে দুতিন দিনের মধ্যেই আমি ঢাকায় যাব।
যা। আমার খুব অস্থির লাগছে।
নাহিদ আর কথা বলল না।
.
বর্ষার হাতে গীতবিতান।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে গীতবিতানের পাতা উল্টাচ্ছে সে। কিন্তু কিছুই যেন দেখছে না।
পারু আছে এই ঘরে। ব্যাপারটা সে খেয়াল করল। বলল, কী হয়েছে তোমার?
বর্ষা একটু চমকাল। কই কিছু না।
পারু হাসল, আমি তোমার চে’ বয়সে বড়।
তাতে কী হয়েছে?
এসব বুঝি।
কী সব বুঝিস?
পরে বলব, তার আগে আমার একটা কথার জবাব দাও।
কী কথা? শুভ ভাইকে তোমার কেমন লাগে?
বর্ষা থতমত খেল। কেমন লাগে মানে? ভাল লাগে। খুব ভাল লাগে।
সে যখন এখান থেকে চলে যাবে তখন কেমন লাগবে?
বর্ষা গম্ভীর হল। পারু, কী বলতে চাচ্ছিস তুই?
পারু আবার হাসল। তুমি যা বুঝেছ তাই বলতে চেয়েছি। শুভ ভাইর সঙ্গে তোমার ব্যবহার দেখে, তোমার মুখ দেখে আমি সব বুঝে গেছি।
বর্ষা কথা বলল না।
পারু বলল, তবে শুভ ভাইকে তুমি বোধহয় তোমার মনের কথা এখনও বলতে পারনি।
একথা শুনে বর্ষা কাতর হল। না পারিনি।
কেন?
কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। তুই আমাকে বলে দে।
তার আগে আরেকটা কথা আছে।
কী?
শুভ ভাইর মন কি তুমি বুঝতে পারছ? তুমি যা ভাবছ সেও তা ভাবছে কি না, জানো?
আমার তো মনে হচ্ছে।
কীভাবে?
কথায়, ব্যবহারে।
তাহলে অপেক্ষা করো। আমার মনে হয় সে-ই আগে বলবে। তারটা শোনার পর তুমি বলো।
পারুর কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা।
.
সন্ধের মুখে বাড়ি ফেরার সময় মাঠের ধারে বর্ষা এবং শুভকে দেখতে পেলেন হাদি সাহেব। আস্তেধীরে হেঁটে বাড়ির দিকে ফিরছে তারা। এতটাই মগ্ন নিজেদের মধ্যে দুজনের কেউ হাদি সাহেবকে দেখতে পেল না। শুভর কী কথায় খিলখিল করে হাসতে। লাগল বর্ষা। হাসতে হাসতে শুভর গায়ে ঢলে পড়ল।
দৃশ্যটা খারাপ লাগল না হাদি সাহেবের। বাড়ি ফিরে শুভকে নিয়ে স্ত্রীকে কিছু প্রশ্ন করলেন।
মিনু বললেন, হঠাৎ শুভকে নিয়ে এতকিছু জানতে চাইছ?
আসলে ওদের ফ্যামিলি নিয়ে আমি কিছুই জানি না।
জানবার দরকার কী? নাহিদের বন্ধু এই যথেষ্ট। আর ছেলেটি খুব ভাল।
বর্ষার সঙ্গে বেশ মানায়, না?
মানে?
বোঝনি?
এবার উচ্ছ্বসিত হলেন মিনু। বুঝেছি, বুঝেছি।
হাদি সাহেব বললেন, আমার কেন যেন মনে হয় শুভর কারণেই বাদলকে ভোলার চেষ্টা করছে বর্ষা। স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
হতে পারে।
শুভকে নিয়ে কি তাহলে ভাববে?
হলে খুব ভাল হয়।
আমি তাই মনে করি। ঠিক আছে নাহিদকে ডাক, ওর সঙ্গে কথা বলি।
নাহিদ আসার পর মিনু বললেন, তোর বাবার মাথায় একটা চিন্তা এসেছে।
নাহিদ উদাস গলায় বলল, কীসের চিন্তা?
বর্ষার বিয়ের।
চমকে মায়ের মুখের দিকে তাকাল নাহিদ। কোথায় বিয়ে? কার সঙ্গে?
হাদি সাহেব স্নিগ্ধ গলায় বললেন, ছেলে আমাদের হাতের কাছেই আছে। বর্ষার ব্যাপারে ওর বোধহয় আগ্রহ আছে। আচার আচরণে মনে হল বর্ষারও আছে।
মিনু বললেন, এত ভণিতা করছ কেন? নামটা সরাসরি ওকে বল।
হাদি সাহেব বললেন, ওর বোঝা উচিত যে আমি শুভর কথা বলছি।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে খুবই শীতল গলায় নাহিদ বলল, না, এটা হবে না।
কেন?
শুভ বিবাহিত।
কথাটা শুনে দুজন মানুষ একেবারে বোবা হয়ে গেলেন।
মিনু বললেন, কী?
হ্যাঁ। এরচে’ বেশি কিছু আমি বলতে পারছি না। শুভর কাছে আমি প্রমিজ করেছি। প্রমিজ না করলে আগেই তোমাদেরকে সব বলতাম।
হাদি সাহেব বড় করে শ্বাস ফেললেন। কী ভাবলাম, কী হল! আমাদের সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। ভাবি এক, হয় আর এক।
নাহিদ বলল, আমার ধারণা বর্ষাও তোমাদের মতো ভাবছে। যখন সব শুনবে, খুব কষ্ট পাবে। ওকে তোমরা সামলে রেখ।
নাহিদ মন খারাপ করে উঠল।
.
দুপুরের মুখে মুখে শুভ আজ একাকী সেই মাঠে চলে এসেছে।
মাঠের চারদিকে বনের গাছে হা হা করছিল হাওয়া। তীব্র গন্ধের বুনোফুল ফুটেছিল কোথাও। হাওয়ায় ভাসছিল সেই গন্ধ। দূরে কোথায় ডাকছিল অচেনা এক পাখি। বনের নির্জনতায় মিলেমিশে যাচ্ছিল সেই ডাক।
এই নির্জনতায় শুভর শুধু মনে পড়ছিল সেতুর কথা।
কদিন সেতুর সঙ্গে কথা বলা হয় না, সেতুকে ছোঁয়া হয় না। আরও কতদিন এভাবে কাটবে, কে জানে।
সেতুর কথা ভেবে বুকটা তোলপাড় করছিল শুভর। কান্না পাচ্ছিল।
ঠিক এসময় গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বর্ষা। মাঠের দিকে শুভকে দেখে অপূর্ব এক হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। যেন বহুকাল ধরে হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে হঠাৎ করেই খুঁজে পেয়েছে সে এমন করে শুভর দিকে ছুটতে লাগল।
বর্ষাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে নিজেকে সামলাল শুভ। দ্রুত হেঁটে নিজেও এগুলো বর্ষার দিকে।
বর্ষা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনি এখানে, আর আমি আপনাকে কোথায় না খুঁজেছি। শেষ পর্যন্ত এখানে এলাম।
শুভ হাসল। বুঝলে কী করে আমি যে এখানে?
মনে হল। আমার মন কখনও কখনও কিছু কথা বলে জানেন? এবং তার প্রতিটা কথা সত্য হয়। এই তো আপনাকে যখন আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি, কোথাও পাচ্ছি না, আমার মন হঠাৎ বলল আপনি এই মাঠের দিকে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটতে শুরু করলাম।
কিন্তু আমাকে হঠাৎ এভাবে খুঁজতে শুরু করলে কেন তুমি?
নিশ্চয় কারণ আছে।
কী কারণ?
আপনার একটা জিনিস আমার হাতে এসে পড়েছে।
কী?
অনুমান করুন তো!
আমার অনুমান শক্তি খুব কম।
আপনার অনেক কিছুই খুব কম।
যেমন?
বলব না।
তারপর গলার কাছ দিয়ে কামিজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দুভাঁজ করা হলুদ খামের একটা চিঠি বের করল বর্ষা। ঢাকা থেকে আপনার একটা চিঠি এসেছে। পিয়ন এসে চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছে আসার একটা অজুহাত পেলাম আমি। চিঠিটা যাতে অন্য কেউ দেখতে না পায় এজন্য ভাঁজ করে বুকের কাছে রেখেছি।
কিন্তু ঢাকা থেকে চিঠি এসেছে শুনে এমনই দিশেহারা হল শুভ, বর্ষার কথা বেশির ভাগই সে শুনতে পেল না। প্রায় থাবা দিয়ে চিঠিটা সে নিল। চিঠি এসেছে এতক্ষণ বলনি কেন?
পাগলের মতো খামটা ছিঁড়ল শুভ। কোনওদিকে না তাকিয়ে দ্রুত চিঠি পড়তে লাগল।
সুরমা চিঠি লিখেছে।
কিন্তু চিঠি পড়ে শুভ যেন সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল। প্রথমে শিশুর মতো দুতিনটে লাফ দিল তারপর আচমকা কোমরের কাছটায় জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল বর্ষাকে। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, কী যে আনন্দ হচ্ছে তোমাকে তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সংবাদ নিয়ে যে চিঠি এসেছে, বর্ষা, বর্ষা তুমি সেই চিঠি নিয়ে এসেছ আমার কাছে। তোমাকে যে আমি কেমন করে কৃতজ্ঞতা জানাব! কোন ভাষায় যে জানাব! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি বর্ষা। খুশিতে আনন্দে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মরে যাচ্ছি।
চিঠি পড়ে মানুষ যে এমন করতে পারে জানা ছিল না বর্ষার। কী লেখা আছে এই চিঠিতে! শুভ এমন করছে কেন?
তারপর গোপন এক ভাল লাগায় শরীর মন ভরে গেল বর্ষার।
এই প্রথম কোনও পুরুষমানুষ তাকে স্পর্শ করল। তাও সেই পুরুষ যাকে সম্পূর্ণ করে চায় বর্ষা। সারাজীবনের জন্য নিজের করে চায়। সেই পুরুষ তাকে কোলে নিয়েছে। দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে তার শরীর। তার স্পর্শে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ষার কাঁটা নয় যেন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। নদীর চোরাস্রোতের মতো শরীর অভ্যন্তরে প্রবল বেগে বইতে শুরু করেছে রক্তস্রোত। নিজের কাছে নিজেই যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা। গভীর আবেশে বাকরুদ্ধ হচ্ছে। শ্বাস ফেলতে ভুলে যাচ্ছে।
তখুনি সেই আনন্দলোক থেকে মাটির দুঃখময় পৃথিবীতে তাকে নামিয়ে আনল শুভ। সব ঠিক হয়ে গেছে বর্ষা, সব ঠিক হয়ে গেছে। কালই ঢাকায় ফিরে যাব আমি।
শুভর কথায় মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না বর্ষা। শরীর জুড়ে তার তখনও সেই আবেশ। মন জুড়ে আশ্চর্য এক ভাল লাগা। চোখে লেগে আছে স্বপ্নের মতো ঘোরলাগা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে শুভর মুখের দিকে তাকাল সে। কী ঠিক হয়ে গেছে? কেন ঢাকায় ফিরে যাবেন আপনি?
তোমাকে তো বলা হয়নি। তুমি তো কিছুই জানো না। এখন আমি তোমাকে সব বলব। সেতুর কথা সব তোমাকে বলব। কেমন করে আমরা দুজন দুজনার জন্য পাগল হয়েছিলাম, কেমন করে আমাদের বিয়ে হল, কেন আমি তোমাদের এখানে এসে এভাবে বসে আছি, সব, সব তোমাকে আমি এখন বলব।
শুভর কথা শুনে বর্ষার মনে হল বহুদূরের আকাশ থেকে নিঃশব্দে এক বজ্রপাত হয়েছে আচমকাই। পৃথিবীর অন্য কোথাও নয়, সেই বজ্রপাতে ঝাঁঝরা হয়েছে শুধু তার। হৃদয়। বনের মাটিতে চিরকালের তরে যেন আটকে গেছে তার দুখানা পা, স্বরনালি চেপে ধরেছে মৃত্যুর মতো অদৃশ্য এক ঘাতক, চোখের দৃষ্টি থেকে কে যেন কেড়ে নিয়েছে। দেখার শক্তি। বর্ষা যেন এখন আর কোনও মানুষ নয়, বর্ষা যেন বনভূমির এক নির্বাক বৃক্ষ।
শুভর মুখে তখন কথার ফুলঝুরি ফুটেছে। সেতুকে নিয়ে মনের ভেতর জমে থাকা সব কথা বর্ষাকে সে বলে যাচ্ছে। বর্ষা শুনছে কী শুনছে না বুঝতে পারছে না।
অনেকক্ষণ পর যেন বুঝতে পারল। অনেকক্ষণ পর যেন নিজের মধ্যে ফিরে এল সে। তীক্ষ্ণচোখে বর্ষার মুখের দিকে তাকাল। তুমি যে কোনও কথা বলছ না?
এই প্রথম চোখে পলক পড়ল বর্ষার। এই প্রথম বর্ষা একটু কেঁপে উঠল। নিজের অজান্তে চোখের কোল ভরে গেল জলে। নিজেকে সামলাবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফেরাল সে।
ব্যাপারটা খেয়াল করল শুভ। আনন্দে ফেটে পড়া মুখ ম্লান হল তার। আলতো করে বর্ষার একটা হাত ধরল সে। কী হয়েছে?
একথার জবাব দিল না বর্ষা। আকাশের দিকে তাকিয়ে শূন্য গলায় বলল, চলুন, ফিরি।
কিন্তু কয়েক পা গিয়েই থমকে দাঁড়াল সে। শুভ দেখতে পেল চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে বর্ষার। নিঃশব্দে আকূল হয়ে কাঁদছে সে।
শুভ দিশেহারা হল। কী হয়েছে, এমন করে কাঁদছ কেন তুমি?
কান্না জড়ানো গলায় কোনও রকমে বর্ষা বলল, আমার আবার বাদলের কথা মনে পড়ছে। বাদলের জন্য আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে।
দুহাতে বুক চেপে বনের মাটিতে বসে পড়ল বর্ষা। শিশুর মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগল। বাদল, বাদল, আমাকে ছেড়ে তুই কোথায় চলে গেলি? কেন চলে গেলি? এখন আমার কষ্টের কথা আমি কাকে বলি? আমার যে কেউ রইল না, কিছু রইল না।
বর্ষার কান্না দেখে বনের গাছপালার মতো স্তব্ধ হল শুভ। মানুষের এমন কষ্টের কান্না সে কখনও দেখেনি।
রচনাকাল : মে-জুন ১৯৯৯