দূর থেকে শার্লির বাড়িটা দেখতে দারুণ সুন্দর। জন হলওয়েলের যদি এর ওপর নজর পড়েই থাকে ওকে দোষ দেয়া যায় না যদি না, ও ভয় দেখিয়ে শার্লিকে ওঠাতে চায়। আমি ভেবে পেলাম না দুই ভাইবোনের এত ভাব অথচ শার্লি কেন আলফ্রেডের সঙ্গে ওর বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকতে চায় না! এ বাড়িতে এমন কী আছে যার মায়া কাটানো শার্লির পক্ষে সম্ভব নয়?
ফাদার ফার্নান্দোর ওখান থেকে এসে শার্লির বাড়িটার চারপাশ ঘুরেফিরে ভালোমতো দেখলাম। বাড়ির নকশা যে করেছে, তার পছন্দের প্রশংসা করতে হয় । নিচের তলার সামনে ঢাকা বারান্দা, ওপরের তলায় পেছনে খোলা বারান্দা। দোতালায় বারান্দায় ওঠার জন্য ঘোরানো লোহার সিঁড়ি আছে। দোতালার বারান্দাটা বানানো হয়েছে সমুদ্রের শোভা দেখার জন্য। বাড়ির বাঁদিকে অনেক পুরোনো একটা চেস্টনাট গাছ আছে, দেখে যেন মনে হয় বাড়ির ওপর ছাতা ধরেছে।
বাইরে থেকে বাড়ি দেখা শেষ করে ভেতরে গিয়ে দেখি শার্লি কিচেনে রান্না করছে, পাশের টেবিলে বসে আলফ্রেড সালাদ বানাচ্ছে। আমাদের দেখে শার্লি হাসিমুখে বললো, বেড়ানো হলো তোমাদের?
এ বেলার মতো। বললো জেন।
খিদেও নিশ্চয় পেয়েছে?
তা আর বলতে! কার্ডিগানের বাতাস বলে কথা!
বলিনি তোমাদের, ঘন্টায় ঘন্টায় খিদে পাবে?
পাহাড়ি রাস্তায় দুঘন্টা ওঠানামা করলে খিদে লাগারই কথা। শার্লির রান্নাও দেখলাম শেষ হয়ে গেছে। ওর মুখে প্রসন্ন হাসি। মনে হয় না ওর মাথার ওপর ভয়ঙ্কর কোনো বিপদ আছে যার জন্য জীবন বিপন্ন হতে পারে। অথচ কাল ওর চেহারা দেখে মনে হয়েছিলো পৃথিবী ধ্বংসের বুঝি এক দিনও বাকি নেই।
দুপুরে বাড়িতে থাকলে যা খাই–শার্লির ওখানে দ্বিগুণ খাওয়া হলো। শুধু কার্ডিগানের বাতাস নয়, শার্লির রান্নারও গুণ আছে। ভিকি বললো, দারুণ মজার হয়েছে শামুক আর বাঁধাকপির ঝোলটা।
শার্লি হেসে বললো, রাতে তোমাদের জন্য মাংশের গুলাশ করবো।
দুপুরে খাওয়ার পর এঁটো গ্লাস ডিশ ধুতে শার্লিকে সাহায্য করলো শীলা, আর, জেন। ভিকি আর আমিও ওদের সাহায্য করতে রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম। শার্লি চোখ পাকিয়ে বলেছে, ছেলেরা কেন রান্নাঘরে?
আমি, আলফ্রেড আর ভিকি দোতলায় বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আলফ্রেডকে বললাম, তোমার বোনকে দেখে মনে হচ্ছে না ওর কোনো বিপদ আছে।
আলফ্রেড পাইপ ধরাতে ধরাতে বললো, তোমাদের পেয়ে ও দারুণ খুশি হয়েছে।
তুমিও বোনকে পেয়ে কম খুশি হওনি।
ওর সঙ্গে দেড় বছর পর দেখা হলো। পাইপে টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছাড়লো আলফ্রেড। আপন মনে বললো, বুঝি না আমার সঙ্গে শার্লি কেন থাকতে চায় না।
সকালে ফাদার ফার্নান্দোর সঙ্গে কী কথা হয়েছে ভিকি সব খুলে বললো আলফ্রেডকে। শুনে মুখ টিপে হেসে আলফ্রেড বললো, কাল রাতেই টের পেয়েছিলাম আমাকে ফাঁকি দিয়ে তোমরা কিছু করার মতলব এঁটেছে।
তোমাকে ফাঁকি দিতে চাইনি আলফ্রেড। আমি বললাম, এতদিন পর তোমাকে পেয়ে শার্লি এত খুশি হয়েছে দেখে চেয়েছিলাম ওকে তুমি সঙ্গ দাও।
আলফ্রেড নরম গলায় বললো, জানি নিক। এজন্যেই তোমাকে আমি এত ভালোবাসি।
ভিকি গম্ভীর হয়ে বললো, বিকেলে আমরা হলওয়েল ক্যাস-এ যাচ্ছি জনের মতলব বোঝার জন্য। আমার ধারণা ও শার্লিকে ভয় দেখিয়ে বাড়িটা বাগাতে চায়।
আলফ্রেড বললো, ও যদি ভালো দামে বাড়িটা কিনতে চায় আমি তাতে খুশিই হবো।
কেন আলফ্রেড? জানতে চাইলাম আমি।
তা হলে শার্লি আমার কাছে গিয়ে থাকবে। ভালো দাম পেলে শার্লি মনে হয় বাড়ি বেচতে রাজি হবে।
রান্নাঘরের কাজ শেষ করে শীলা আর জেন এসে বসলো আমাদের কাছে। জেন বললো, শার্লি তোমাদের জন্য চা আনছে।
ভিকি বললো, তোমাদের জন্য বলছো কেন? তোমরা বুঝি খাবে না?
আমরা ছেলেদের মতো বেহিসেবি নই। সব সময় ক্যালোরি মেপে খাই।
ছেলেদের শরীরে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।
মেয়েদের প্রয়োজন বুদ্ধি, যাতে করে ছেলেদের ঠিকমতো চরাতে পারে।
শার্লি চায়ের ট্রে এনে হাসতে হাসতে বললো, এরই মধ্যে ভিকি আর জেনের ঠোকাঠুকি বুঝি শুরু হয়ে গেছে।
জেন বললো, শার্লি তুমি আমাদের দলে, ভুলে গেছো বুঝি?
ভিকি বললো, বাহ, এর ভেতর দল পাকানোও শুরু হয়ে গেছে। ঠিক আছে ..আলফ্রেড আমাদের দলে।
আলফ্রেড হেসে বলল, আমি সব দলে।
শার্লি ওর সঙ্গে গলা মেলালো। আমি আর শীলা হো হো করে হেসে উঠলাম। ভিকি বললো, দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে এখন কিছু বলছি না। তবে লন্ডনে ফিরে গিয়ে এর শোধ নেবো।
জেন কোনো কথা না বলে ওকে জিব দেখালো। সঙ্গে সঙ্গে ভিকি লাফিয়ে উঠলো জেনকে ধরার জন্য। চোখের পলকে জেন হাওয়া হয়ে গেলো। ভিকিও ওর পেছনে ছুটলো। শার্লি চেঁচিয়ে বললো, ভিকি তোমার চা ঠান্ডা হচ্ছে। কে কার কথা শোনে!
বিকেলে আমরা আলফ্রেডের গাড়ি নিয়ে বেরোলাম। ও নিজে থেকেই বললো, হলওয়েল ক্যা এখান থেকে কম দূর নয়। গাড়ি নিয়ে যাও।
ভিকির ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিলো না। আমিই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। শীলা আমার পাশের সিটে। ভিকি আর জেন পেছনে। আসার সময় শার্লি বার বার বলে দিয়েছে। সন্ধ্যার আগেই যেন আমরা ফিরে আসি।
হলওয়েল ক্যাসল-এ গাড়িতে যেতে পঁচিশ মিনিট লেগে গেলো। অচেনা সরু পাহাড়ি রাস্তা, খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছিলো। পথে যদিও দুচারটা লোক ছাড়া গাড়ি তেমন ছিলো না–তবু ড্রাইভিং এর ব্যাপারে আমি সব সময় সাবধান। মাত্র চার মাস আগে দিব্যেন্দু আমার লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছে, ওটা খোয়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
লন্ডনের আশেপাশে যে রকম দেখা যায় তার তুলনায় হলওয়েল ক্যাসলকে বেশ গরিব গরিব মনে হলো। এমনকি আলফ্রেডের সঙ্গে কটনউড ক্যাসল্ দেখেছিলাম তার চেয়েও একটা সাদামাঠা। তবু ক্যাসল বলে কথা! বয়সও হয়েছে অনেক। সামনের পাথর বাঁধানো চত্বরে গাড়ি নামতেই ঘেউঘেউ করে ছুটে এলো অতিকায় দুই গ্রে হাউন্ড কুকুর। আমি আর শীলা কুকুর মোটেই পছন্দ করি না। ইংরেজদের কথা আলাদা। অনেকে আছে বিছানায় পোষা কুকুরের পাশে না শুলে ওদের ঘুম আসে না।
হাউন্ড দুটোর হাঁকডাকে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সাড়ে ছফুট লম্বা এক অভিজাত চেহারার বুড়ো। দেখে মনে হলো এই জন হলওয়েল । কুকুর দুটোকে গম্ভীর গলায় শান্ত হতে বলে হলওয়েল এগিয়ে এলো গাড়ির কাছে। প্রশ্ন ভরা চোখে তাকালো আমাদের দিকে। গাড়ি থেকে নেমে বললাম, শুভ অপরাহ্ন। আমাদের ধারণা আপনিই স্যার জন হলওয়েল।
জন হলওয়েল মোটেই নাইটহুড পায়নি। তবু ইচ্ছা করেই স্যার বললাম যাতে খুশি হয়। আমার ধারণা সত্যি প্রমাণ হলো। প্রসন্ন মুখে বুড়ো বললো, আমিই হলওয়েল। তোমরা?
আমরা লন্ডনে থাকি, কার্ডিগানে বেড়াতে এসেছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো।
এসো, ভেতরে এসে বসবে।
হলওয়েলের পেছনে পেছনে আমরা দুর্গের ভেতর ঢুকলাম। কুকুর দুটো আমাদের যে মোটেই পছন্দ করেনি মাঝে মাঝে গরগর করে জানিয়ে দিচ্ছিলো। কুকুররা নাকি বুঝতে পারে কারা ওদের পছন্দ করে, আর কারা অপছন্দ করে।
পুরোনো ভিক্টোরিয়ান যুগের এক ড্রইংরুমে এসে আমাদের সোফায় বসালো জন হলওয়েল। নিজে বসলো সিংহাসনের মতো নকশা করা উঁচু গদি মোড়া চেয়ারে। বললো, বলল, তোমাদের জন্য কী করতে পারি?
আমরা এখানে উঠেছি শার্লি উডওয়ার্ডের বাড়িতে।
কথাটা শুনে জনের কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। আমি বললাম, তাঁর ভাই আলফ্রেডের সঙ্গে এসেছি। শুনলাম আপনি নাকি ওঁর বাড়িটা কিনতে চান?
কার কাছে শুনলে? শার্লি বলেছে?
না, ফাদার ফার্নান্দো। নাকি আপনার কী পরিকল্পনা আছে ওই বাড়িটাকে নিয়ে।
ছিলো, এখন আর নেই। অপ্রসন্ন গলায় জন বললো, ভেবেছিলাম, টাকাগুলো ব্যাংকে পচছে। বুড়ো মানুষের জন্য একটা হোম বানাই। শহরের ভেতর শার্লির বাড়িটাই ছিলো এর জন্য উপযুক্ত জায়গা। বললাম জায়গাটা দাও, বেশি দাম দিতে পারবো না। আরও তো অনেক খরচ আছে। ও এক পা কবরে দিয়ে বসে আছে, বলে কিনা পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের কমে বেচবে না। আমার গোটা প্রজেক্ট হচ্ছে পঞ্চাশ হাজারের। পুরো টাকা ওকে দিয়ে আমি ঘরে বসে আঙ্গুল চুষবো।
আপনি কত দিতে চেয়েছিলেন?
আমি বলেছিলাম দশ হাজার দেবো। বুড়ির এত টাকার লোেভ কেন বুঝি না। ওর স্বামী ভিক্টর উডওয়ার্ড খুবই দরাজদিল মানুষ ছিলো। শার্লির জন্য ব্যাংকে যথেষ্ট টাকাও রেখে গেছে। তা ছাড়া আমার স্ত্রীর সঙ্গে শার্লির চমৎকার বন্ধুত্ব ছিলো। জায়গাটা শার্লি দানও করতে পারতো। সেক্ষেত্রে ভেবেছিলাম ওর নামেই হোমটা করবো। দান করবে কী, বাজারে বড়জোর পনেরো কুড়ি হাজার হবে ওটার দাম। বলে কিনা পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। আমি বিরক্ত হয়ে গোটা পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি। আপনি তা হলে বুড়োদের হোম বানাচ্ছেন না?
না, রুক্ষ গলায় জন বললো, কাদের জন্য করবো? সব তো শার্লির মতো লোভী বুড়ো। কোনো দরকার নেই।
আপনি কি দশ হাজারের কিছু বেশি দিতে পারেন না?
বললে হয়তো দশের জায়গায় তখন পনেরো দিতাম। তাই বলে পঞ্চাশ! এখনও আমি পাগল হইনি।
ঠিক আছে স্যার। এ নিয়ে আমরা শার্লির সঙ্গে কথা বলবো। আপনাকে অনুরোধ করবো এত বড় মহৎ পরিকল্পনা শার্লির একটা কথায় বাতিল করে দেবেন না।
শার্লি চায়ের ট্রে এনে হাসতে হাসতে বললো, এরই মধ্যে ভিকি আর জেনের ঠোকাঠুকি বুঝি শুরু হয়ে গেছে।
জেন বললো, শার্লি তুমি আমাদের দলে, ভুলে গেছো বুঝি?
ভিকি বললো, বাহ, এর ভেতর দল পাকানোও শুরু হয়ে গেছে। ঠিক আছে আলফ্রেড আমাদের দলে।
আলফ্রেড হেসে বললো, আমি সব দলে।
শার্লি ওর সঙ্গে গলা মেলালো। আমি আর শীলা হো হো করে হেসে উঠলাম। ভিকি বললো, দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে এখন কিছু বলছি না। তবে লন্ডনে ফিরে গিয়ে এর শোধ নেবো।
জেন কোনো কথা না বলে ওকে জিব দেখালো। সঙ্গে সঙ্গে ভিকি লাফিয়ে উঠলো জেনকে ধরার জন্য। চোখের পলকে জেন হাওয়া হয়ে গেলো। ভিকিও ওর পেছনে ছুটলো। শার্লি চেঁচিয়ে বললো, ভিকি তোমার চা ঠান্ডা হচ্ছে। কে কার কথা শোনে!
বিকেলে আমরা আলফ্রেডের গাড়ি নিয়ে বেরোলাম। ও নিজে থেকেই বললো, হলওয়েল ক্যা এখান থেকে কম দূর নয়। গাড়ি নিয়ে যাও।
ভিকির ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিলো না। আমিই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। শীলা আমার পাশের সিটে। ভিকি আর জেন পেছনে। আসার সময় শার্লি বার বার বলে দিয়েছে সন্ধ্যার আগেই যেন আমরা ফিরে আসি।
হলওয়েল ক্যাল-এ গাড়িতে যেতে পঁচিশ মিনিট লেগে গেলো। অচেনা সরু পাহাড়ি রাস্তা, খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছিলো। পথে যদিও দুচারটা লোক ছাড়া গাড়ি তেমন ছিলো না–তবু ড্রাইভিং এর ব্যাপারে আমি সব সময় সাবধান। মাত্র চার মাস আগে দিব্যেন্দু আমার লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছে, ওটা খোয়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
লন্ডনের আশেপাশে যে রকম দেখা যায় তার তুলনায় হলওয়েল ক্যাসলকে বেশ গরিব গরিব মনে হলো। এমনকি আলফ্রেডের সঙ্গে কটনউড ক্যাসল দেখেছিলাম তার চেয়েও একটা সাদামাঠা। তবু ক্যাসল বলে কথা! বয়সও হয়েছে অনেক। সামনের পাথর বাঁধানো চত্বরে গাড়ি নামতেই ঘেউঘেউ করে ছুটে এলো অতিকায় দুই গ্রে হাউন্ড কুকুর। আমি আর শীলা কুকুর মোটেই পছন্দ করি না। ইংরেজদের কথা আলাদা। অনেকে আছে বিছানায় পোষা কুকুরের পাশে না শুলে ওদের ঘুম আসে না।
হাউন্ড দুটোর হাঁকডাকে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সাড়ে ছফুট লম্বা এক অভিজাত চেহারার বুড়ো। দেখে মনে হলো এই জন হলওয়েল। কুকুর দুটোকে গম্ভীর গলায় শান্ত হতে বলে হলওয়েল এগিয়ে এলো গাড়ির কাছে। প্রশ্ন ভরা চোখে তাকালো আমাদের দিকে। গাড়ি থেকে নেমে বললাম, শুভ অপরাহ্ন। আমাদের ধারণা আপনিই স্যার জন হলওয়েল।
জন হলওয়েল মোটেই নাইটহুড পায়নি। তবু ইচ্ছা করেই স্যার বললাম যাতে খুশি হয়। আমার ধারণা সত্যি প্রমাণ হলো। প্রসন্ন মুখে বুড়ো বললো, আমিই হলওয়েল। তোমরা?
আমরা লন্ডনে থাকি, কার্ডিগানে বেড়াতে এসেছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো।
এসো, ভেতরে এসে বসবে।
হলওয়েলের পেছনে পেছনে আমরা দুর্গের ভেতর ঢুকলাম। কুকুর দুটো আমাদের যে মোটেই পছন্দ করেনি মাঝে মাঝে গরগর করে জানিয়ে দিচ্ছিলো। কুকুররা নাকি বুঝতে পারে কারা ওদের পছন্দ করে, আর কারা অপছন্দ করে।
পুরোনো ভিক্টোরিয়ান যুগের এক ড্রইংরুমে এসে আমাদের সোফায় বসালো জন হলওয়েল। নিজে বসলো সিংহাসনের মতো নকশা করা উঁচু গদি মোড়া চেয়ারে। বললো, বলল, তোমাদের জন্য কী করতে পারি?
আমরা এখানে উঠেছি শার্লি উডওয়ার্ডের বাড়িতে।
কথাটা শুনে জনের কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। আমি বললাম, তাঁর ভাই আলফ্রেডের সঙ্গে এসেছি। শুনলাম আপনি নাকি ওঁর বাড়িটা কিনতে চান?
কার কাছে শুনলে? শার্লি বলেছে?
না, ফাদার ফার্নান্দো। নাকি আপনার কী পরিকল্পনা আছে ওই বাড়িটাকে নিয়ে। ছিলো, এখন আর নেই। অপ্রসন্ন গলায় জন বললো, ভেবেছিলাম, টাকাগুলো ব্যাংকে পচছে। বুড়ো মানুষের জন্য একটা হোম বানাই। শহরের ভেতর শার্লির বাড়িটাই ছিলো এর জন্য উপযুক্ত জায়গা। বললাম জায়গাটা দাও, বেশি দাম দিতে পারবো না। আরও তো অনেক খরচ আছে। ও এক পা কবরে দিয়ে বসে আছে, বলে কিনা পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের কমে বেচবে না। আমার গোটা প্রজেক্ট হচ্ছে পঞ্চাশ হাজারের। পুরো টাকা ওকে দিয়ে আমি ঘরে বসে আঙ্গুল চুষবো।
আপনি কত দিতে চেয়েছিলেন?
আমি বলেছিলাম দশ হাজার দেবো। বুড়ির এত টাকার লোভ কেন বুঝি না। ওর স্বামী ভিক্টর উডওয়ার্ড খুবই দরাজদিল মানুষ ছিলো। শার্লির জন্য ব্যাংকে যথেষ্ট টাকাও রেখে গেছে। তা ছাড়া আমার স্ত্রীর সঙ্গে শার্লির চমৎকার বন্ধুত্ব ছিলো। জায়গাটা শার্লি দানও করতে পারতো। সেক্ষেত্রে ভেবেছিলাম ওর নামেই হোমটা করবো। দান করবে কী, বাজারে বড়জোর পনেরো কুড়ি হাজার হবে ওটার দাম। বলে কিনা পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড । আমি বিরক্ত হয়ে গোটা পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি।
আপনি তা হলে বুড়োদের হোম বানাচ্ছেন না?
না, রুক্ষ গলায় জন বললো, কাদের জন্য করবো? সব তো শার্লির মতো লোভী বুড়ো। কোনো দরকার নেই।
আপনি কি দশ হাজারের কিছু বেশি দিতে পারেন না?
বললে হয়তো দশের জায়গায় তখন পনেরো দিতাম। তাই বলে পঞ্চাশ! এখনও আমি পাগল হইনি।
ঠিক আছে স্যার। এ নিয়ে আমরা শার্লির সঙ্গে কথা বলবো। আপনাকে অনুরোধ করবো এত বড় মহৎ পরিকল্পনা শার্লির একটা কথায় বাতিল করে দেবেন না।
শার্লিকে তোমরা চেনো না। ভয়ানক লোভী মহিলা।
জন হলওয়েলকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফাদার ফার্নান্দোর সঙ্গে কথা বললাম। কথা আমি একাই বলছিলাম। ভিকি শীলা আর জেন শুনলো শুধু। ওদের অবাক করে দিয়ে ফাদারকে কিছু কথা বললাম আলাদাভাবে, ভেতরে ডেকে নিয়ে। ফাদারের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। গাড়িতে আসার পথে ভিকি বললো, তুই এসব কী করছিস কিছুই তো বুঝতে পারছি না নিক।
রহস্য গলায় বললাম, সময় হলে সব বুঝবি।
আগে একটু হিন্টস দে না দোস্ত। অনুনয় করে বললো ভিকি।
আমার মনে হয় শার্লিকে ভয় দেখানোর পেছনে কোনো খারাপ লোক নেই।
তবে কি অতৃপ্ত প্রেতাত্মা?
ফাদারের ধারণা তো তাই। ফাদারকে আড়ালে ডেকে কী বললি?
কাল এসে ফাদার নিজেই ভূত তাড়াবার ব্যবস্থা করবেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভিকি থমথমে গলায় বললো, আমি হলাম দলের নেতা। আমি কিছু জানবো না, সব তুই একা করবি–এরকম হলে দল করা কেন? আমি দল ভেঙে দিতে চাই।
আমি চাই না। জেন বললো, নিকের ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে।
তা হলে ভোট হোক। হোক ভোট।
তিন-এক ভোটে হেরে গিয়ে ভিকি মুখখানা আরও গোমড়া করে চুপচাপ বসে রইলো। শার্লি ওকে দেখে বললো, ভিকি, তোমার কি হয়েছে, শরীর খারাপ?
না, আমার কিছু হয়নি। শুকনো গলায় বললো ভিকি। শার্লি আলফ্রেডকে বললো, ভিকির নিশ্চয় পেট খারাপ হয়েছে। দুপুরে বলবো ভেবেছিলাম শামুকের ঝোল এতটা খেতে হয় না। পরে ভাবলাম জোয়ান ছোকরা, কিছু হবে না।
আমার ব্যাগে ওষুধ আছে। এই বলে আলফ্রেড ভিকিকে জিজ্ঞেস করলো, কতবার টয়লেটে গেছো ভিকি?
বিরক্ত হয়ে ভিকি বললো, বললাম কিছু হয়নি। আমার শরীর খুবই ভালো আছে। তোমার ওষুধ নিককে খাওয়াও। এই বলে ও ভেতরে চলে গেলো।
আলফ্রেড অবাক হয়ে আমাকে বললো, তোমার কী হয়েছে নিক?
আমি হেসে বললাম, কিছু না। ভিকি আমার ওপর রাগ করেছে।
হায় ঈশ্বর, তাই বলো! এই বলে শার্লি আর আলফ্রেড একসঙ্গে হাঁপ ছাড়লো।
আমি, শীলা আর জেন ভেতরে ঢুকলাম। ভিকি গাল ফুলিয়ে বসে আছে বিছানার ওপর। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওকে বললাম, নিজেকে ছেলে বলে এত বাহাদুরি করিস, মেয়েদের মতো গাল ফুলোনোর স্বভাব কেন তোর?
শীলা হেসে বললো, সব মেয়ের গাল ফুলোনোর স্বভাব নেই নিক। তুমি আবার ওদের মতো ছেলে মেয়ে আলাদা করা শুরু করলে কেন?
আর বলবো না শীলা। শোন ভিকি, তোমরাও শোনো। এই বলে আমার পরিকল্পনার কথা ওদের খুলে বললাম। শুনতে শুনতে ভিকির চোখ গোল হলো, চোয়াল ঝুলে পড়লো। তারপর সব শোনার পর উত্তেজিত হয়ে বললো, দারুণ প্ল্যান করেছিস।
রাতে খাবার টেবিলে কথাটা পাড়লাম–শার্লি, আলফ্রেড যেহেতু আমাদের খুব কাছের বন্ধু, তোমাকেও আমরা বন্ধু ভাবি।
শার্লি গদগদ হয়ে বললো, তোমরা সব হীরের টুকরো ছেলেমেয়েরা। তোমাদের বন্ধু হতে পারলে আমার চেয়ে সুখী আর কে হবে বলো!
আমরা আজ জন হলওয়েলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
শার্লি হাসিমুখে জানতে চাইলো–কী বললো দেমাগী বুড়োটা?
দুঃখ করলো একটা মহৎ কাজের জন্য তোমার বাড়িটা কিনতে চেয়েছিলো, তুমি নাকি তাড়িয়ে দিয়েছে!
কেন তাড়াবো না। ওর হাড়বজ্জাত বউটা সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। মরার পর আমার বাড়িতে ওর নামে বৃদ্ধনিবাস করা হবে–আহ্লাদের আর সীমা নেই!
মিসেস হলওয়েল তোমার বান্ধবী ছিলো।
কিসের বান্ধবী! দেমাগে মাটিতে পা পড়তো না। বয়ে গেছে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে।
হোমটা যদি মিসেস হলওয়েলের নামে না হয়?
শার্লি কতক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, তোমরা এসব বলছো কেন? তোমরা কি ওর দলে যোগ দিয়েছো?
ছি শার্লি, তোমাকে বন্ধু বলে তোমার শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলাবো!
তাই বলো। শার্লি হেসে বললো, এসব বৈষয়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আমার ভালো লাগে না। আশা করি তোমরা কিছু মনে করবে না।
এতে মনে করার কী আছে? বুঝলাম শার্লিকে সহজে কাবু করা যাবে না। মাঝরাতে যথারীতি বাইরে খটখট করে বারান্দায় কারও পায়চারি করার শব্দ হলো। ভিকি বললো, চল গিয়ে দেখি।
আমি বললাম, থাক! গিয়ে দেখবি কিছুই নেই। কাল ফাদার এসে ভূত তাড়াক। তারপর দেখা যাবে।
সকালে নাশতার টেবিলে শার্লি বললো, তোমরা কি রাতে কোনো শব্দ শোননি? আমি তো সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।
বললাম, কাল বিকেলে ফাদার ফার্নান্দোর সঙ্গে কথা হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় তিনি আসবেন। বলেছেন শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখবেন।
আলফ্রেড হাসিমুখে বললো, তা হলে শার্লি, তুমি আমার সঙ্গে পেনার্থে গিয়ে থাকছে।
মুচকি হেসে শার্লি বললো, মনে হচ্ছে ঈশ্বরের অভিপ্রায় তাই। একটু থেমে ও আপন মনে বললো, যে কটা দিন বেঁচে আছি দুই ভাইবোন মিলে ছোটবেলার সোনালি দিনগুলোর কথা বলে কাটিয়ে দেবো।
আলফ্রেড আর শার্লি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের দিকে তাকালো। শার্লি ওকে বললো, মনে হচ্ছে এরা আমার কাছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে এসেছে।
পরদিন আমরা যখন জন হলওয়েলের সঙ্গে কথা বলতে যাবো তখন আলফ্রেডও আমাদের সঙ্গী হলো। সকালে কার্ডিগান বে প্যাকার্সকে ফোন করে বলা হয়েছিলো মালপত্র নেয়ার ব্যবস্থা করতে। পনেরো মিনিটের মধ্যে দুটো বড় লরি এসে গেছে। ওদের লোকেরাই জিনিসপত্র সব বাক্সে বোঝাই করে লরিতে তুলছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে আলফ্রেড বললো, আমি সব শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।
মৃদু হেসে বললাম, আমি প্রথম রাতেই টের পেয়েছিলাম বারান্দায় রাতে যে শব্দ করে এটা শার্লির কাজ।
এভাবে নয়, সব খুলে বলো।
তুমি লক্ষ্য করোনি শার্লির শোয়ার ঘরের মেঝেতে বেশ কয়েকটা ফুটো আছে। যখন আমরা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকি তখন ও সরু একটা লম্বা লাঠি ঢুকিয়ে বাইরে কাঠের বারান্দায় ঠুক ঠুক করে। আমরা ব্যাগ থেকে বেরোবার আগেই লাঠি সরিয়ে ফেলে। খুব ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম। শার্লি নিজে কেন এমন করছে? পরদিন তোমাদের কথা শুনে মনে হলো শার্লি আসলে চাইছে তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে। আগে রাজি হয়নি সেই লজ্জায় মুখ ফুটে আর বলতে পারছে না। তাই এটা যদি একটা ভূতুড়ে বাড়ি প্রমাণ করা যায় তুমি জোর করে ওকে নিয়ে যাবে।
ফাদারের ব্যাপারটা কী?
জন একটা সৎ কাজে বাড়িটা কিনতে চেয়েছে। এ কাজে ফাদারেরও সমর্থন আছে। এটা জানতে পেরে আমি ঠিক করলাম শার্লির তৈরি করা ফাঁদেই ওকে ফেলবো, যাতে ও নিজে থেকেই তোমার সঙ্গে থাকতে রাজি হয়।
আর ওঝা?
কিসের ওঝা? তিনিই তো জন হলওয়েল। জানো না বুঝি এক সময় নাটক করা খুব পছন্দ করতেন? ফাদারকে বলেছি শার্লি যাতে বাড়িটা এ কাজে দান করে তার ব্যবস্থা আমরা করে দেবো, তবে তাঁকে সৎকাজের জন্য দুটো মিছে কথা বলতে হবে।
আলফ্রেড কিছুক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, এসব কিছু তুমি করেছো আমার আর শার্লির জন্য।
আমি সায় জানিয়ে বললাম, তোমরা ভাইবোন একে অপরকে ভালোবাসো অথচ তুচ্ছ অভিমানের কারণে একসঙ্গে থাকতে পারছে না। ভালো করিনি আলফ্রেড?
আমি তোমাকে নিয়ে কী ভেবেছি জানো?
কী ভেবেছো?
কথাটা তোমাকে আগেই বলবো ভেবেছিলাম। আমি ঠিক করেছি আমার পেনার্থে এর বাড়িটা তোমার নামে উইল করে যাবো। যতদিন আমরা বেচেঁ আছি থাকবো। তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে যখন খুশি নিজের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। এক সময় তোমার নিজের আলাদা জগৎ হবে। যখন আমরা থাকবো না তখন তুমি এসে থাকবে তোমার বউ ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
আমার বউ-ছেলে-মেয়ের কথা শুনে ওরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। লজ্জায় আমি কী বলবো কিছু ভেবে পেলাম না। বুড়ো হলে কি মানুষের মুখে কোনো লাগাম থাকে না।