৯. নতুন জেরুসালেম
কনস্টানটাইন মিলভিয়ান ব্রিজে জয়ের পর পশ্চিমাংশের সম্রাট হন। ৩২৩ সালে তিনি পূর্ব দিকের প্রদেশগুলোর সম্রাট লিসিনিয়াসকে হারিয়ে রোমান বিশ্বের একক শাসকে পরিণত হলেন। একেবারে অপরিচিত অবস্থান থেকে বিস্ময়কর উত্থানের জন্য কনস্টানটাইন সবসময় খ্রিস্টানদের ঈশ্বরকে কৃতিত্ব দিতেন। বিশ্বাসটির ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে অতি সামান্য জানলেও এবং তার ব্যাপ্তিজম তার মৃত্যুশয্যার আগে পর্যন্ত না হলেও তিনি চার্চের প্রতি সবসময় অনুগত ছিলেন। তিনি আশাবাদী ছিলেন, একবার খ্রিস্টধর্ম আইনসম্মত হলে এটি তার বিপুল বিস্তৃত সাম্রাজ্যের ঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হবে। ওই সময় ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার অতি সামান্য অংশ ছিল খ্রিস্টান। তবে তৃতীয় শতক নাগাদ খ্রিস্টধর্ম সাম্রাজ্যের অন্যতম ধর্মে পরিণত হয়, বৃহত্তম অংশই এই ধর্মের অনুসারীতে পরিণত হয়। ২৩৫ সাল নাগাদ ধর্মটি বিশ্বাসের একক পরিচালনায় একটি ‘মহা চার্চ’ হিসেবে গর্ব করার মতো অবস্থানে চলে আসে। ধর্মটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোকজনকে আকৃষ্ট করা শুরু করে। এসব লোক এই উৎসগতভাবে সেমিটিক ধর্মটিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেন, যাতে বৃহত্তর গ্রেকো-রোমান বিশ্ব তা বুঝতে পারে। নির্যাতনের সময় চার্চ একটি কার্যকর প্রশাসনে বিবর্তিত হয়েছিল, যা নিজেই ছিল সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র সংস্করণ। এটি ছিল বহু-সাংস্কৃতিক, ক্যাথলিক, আন্তর্জাতিক ও বিশ্ববিস্তৃত এবং আমলাতন্ত্রকে পরিচালনা করতে সক্ষম। এখন কনস্টানটাইন চার্চকে ‘অনুমোদিত ধর্ম’ হিসেবে ঘোষণা করার ফলে খ্রিস্টানরা গোপন অবস্থা থেকে বের হয়ে প্রকাশ্য জীবনে স্বতন্ত্র ভূমিকা রাখতে থাকে। কনস্টানটাইন ধর্মটির ক্ষমতা ও দক্ষতা নিরঙ্কুশ শক্তিতে পরিণত করতে পারবেন বলে আশাবাদী ছিলেন।
তিনি অবশ্য অন্যান্য ধর্মের বিনিময়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেননি। কনস্টানটাইন ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি জানতেন, তার পৌত্তলিক প্রজাদের বিরূপতা প্রতিরোধ করার সামর্থ্য তার নেই। তিনি পন্টিফেস ম্যাক্সিমাস পদবি বজায় রাখেন, সাম্রাজ্যের পুরনো বলি প্রথাও অব্যাহত থাকে। কনস্টানটাইন নতুন খ্রিস্টান রোমের ব্যাপারে তার স্বপ্নাবিভাব প্রকাশ শুরু করতে একটি উপায় উদ্ভাবন করেন। তা হলো বিপুল নির্মাণ কর্মসূচি। সেন্ট পিটার দি অ্যাপসলের জন্য রোমান সম্রাটদের স্মৃতিসৌধের মতো করে রোমে খ্রিস্টান শহিদদের কবরে সমাধি নির্মাণ করেন। এসব নতুন চার্চ ভবন প্রাচীন মন্দিরগুলোর মতো ছিল না। প্রাচীন মন্দিরগুলোতে যেখানে মহাবিশ্বের প্রতীকগুলো ফুটিয়ে তোলা হতো, সেখানে নবনির্মিত মুক্ত চার্চটি উৎসবমুখর গণউপাসনায় বিবর্তিত হয়। তবে এসব অট্টালিকার সূচনা ঘটেছিল রোমের পৌত্তলিক প্রতীকের পাশাপাশি। এতে দেখানো হয়েছিল, খ্রিস্টধর্ম দুনিয়াতে তার স্থান নিতে শুরু করেছে। অবশ্য রোমে কেন্দ্রীয় স্থানগুলো আগেই পৌত্তলিক ভবনরাজিতে দখল হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে কনস্টানটাইনের শহিদি ইমারত প্রান্তিক এলাকাগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে বসফোরাসের তীরে তিনি নিজের জন্য যে নতুন রাজধানী নির্মাণ করেছিলেন, তাতে এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। কনস্টানটিনোপল হয়েছিল পুরোপুরি খ্রিস্টান নগরী। এখানে ক্রস প্রদর্শিত হতো গৌরবে, কেন্দ্রীয়ভাবে ও বাইবেলের বীরদের ভাস্কর্য এর চত্বরগুলোতে শোভা বাড়াত। তবে কনস্টানটিনোপলের কোনো ইতিহাস ছিল না : প্রতীকের শক্তিতে প্রায় জাদুকরি বিশ্বাসী সম্রাট জানতেন খ্রিস্টান সাম্রাজ্যকে তার ধারাবাহিকতা প্রদর্শন করতে হলে প্রাচীন কালের শেষ সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত একটি শ্রদ্ধাভাজন অতীতের সাথে তার শিকড় অবশ্যই দেখাতে হবে।
কনস্টানটাইনের রাজত্বের প্রথম দিকে তার অন্যতম উৎসাহী সমর্থক ছিলেন ক্যাসারিয়ার বিশপ ইউসেবিয়াস। মিলভিয়ান ব্রিজের পর ইউসেবিয়াস সম্রাটকে মুসা হিসেবে সম্বোধন করেন, মুসা যেভাবে মিসরীয়দের ধ্বংস করেছিলেন, একইভাবেই এই সম্রাট শেষ করেছেন ম্যাক্সেনটিয়াসকে। তিনি কনস্টানটাইনকে গোষ্ঠীপতিদের বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারী দ্বিতীয় ইব্রাহিম হিসেবেও অভিহিত করেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কোনো টেম্পল ছিল না, তাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ তাওরাত ছিল না।` ইউসেবিয়াস উল্লেখ করেন, তারা যেখানেই ছিলেন সেখানেই উদ্দীপনা ও সত্যের সাথে ঈশ্বরের উপাসনা করেছেন। ইউসেবিয়াস বিধ্বস্ত টেম্পল মাউন্টের কথা ভাবতে ওই অঞ্চলের অন্যান্য খ্রিস্টানের মতো মাউন্ট অব অলিভেসে দাঁড়াতেন। তিনি ভয়াবহ বিদ্রুপে দেখেন যে আলিয়ার নাগরিকেরা টেম্পলের পাথরগুলো লুণ্ঠন করে তাদের পৌত্তলিক মন্দির ও থিয়েটার তৈরি করেছে। টেম্পলের ভাগ্য সুস্পষ্ট প্রমাণ যে ঈশ্বর আর চটকদার ধরনের কৃত্রিম শাস্ত্রাচার চান না। তিনি তাদের কাছে যিশুর প্রচারিত মন্দির বা পবিত্র স্থানগুলোর ওপর নির্ভরশীলতাহীন আধ্যাত্মিক ধর্ম অনুসরণ করাতে চেয়েছিলেন। অরিজেনের মতো ইউসেবিয়াসেরও ঐশী ভূগোলের জন্য সময় ছিল না। ঈশ্বর তাদের কাছে আসবেন না যারা তাকে ‘প্রাণহীন বস্তু ও বিষণ্ণ গুহায়’ তাকে কামনা করে, বরং যাদের আত্মা পরিশুদ্ধ, পরিষ্কার ও যৌক্তিক মানসিকতা নিয়ে প্রস্তুত’ তাদের কাছে তিনি আসবেন। মুসার বিধানে বিশ্বাসীদের একটি একক পবিত্র স্থানে ছুটে যাওয়া প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ইউসেবিয়াস কল্পনা করেছেন যে যিশু বলেছেন :
আমি, সবাইকে স্বাধীনতা দিচ্ছি, পৃথিবীর কোনো কোণায়, কিংবা পর্বতমালায়, কিংবা হাতে বানানো মন্দিরে ঈশ্বরকে না-খোঁজার স্বাধীনতা দিচ্ছি। বরং প্রত্যেককে বলছি তার ঘরে উপাসনা করতে, তার প্রশংসা করতে। ৬
তিনি লোকজনকে ইব্রাহিমের আদি ধর্ম শেখানোর জন্য এসেছিলেন, যা ছিল অযৌক্তিক পুরানশাস্ত্র ও ইন্দ্রীয়গত কল্পিত মূর্তি থেকে মুক্ত।
পর্যাপ্ত সন্তুষ্টি নিয়ে ইউরেবিয়াস মাউন্ট সায়ন উপকণ্ঠে তাকিয়ে সমসাময়িক অন্য সবার মতো কল্পনা করেছিলেন যে এটি হলো বাইবেলের জায়ন। এখন গবেষণা ও শিক্ষার কেন্দ্র হওয়ার বদলে মাউন্ট সায়ন স্রেফ ‘দেশের বাকি অংশের মতো একটি রোমান খামারে পরিণত হয়ে আছে। সত্যিই সেখানে আমি নিজের চোখে সেখানে বলদ দিয়ে চাষাবাদ ও পবিত্র স্থানে বীজ বপণ করতে দেখেছি।’ বিধ্বস্ত ও জনশূন্য ‘জায়নের বর্তমান অবস্থা প্রমাণ করে যে ঈশ্বর সত্যিই নগরীটি পরিত্যাগ করেছেন। অবশ্য এই তথ্যও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে ইউসেবিয়াস কখনো উল্লেখ করেননি যে মাউন্ট সায়ন আলিয়ার খ্রিস্টান কেন্দ্র। চতুর্থ শতকের শুরুতে স্থানীয় খ্রিস্টানেরা যুক্তি দিতে শুরু করে যে ‘মাদার অব দি চার্চেস’-এর মতো আলিয়ার আধ্যাত্মিক মর্যাদা কোনো ঐশী সত্তার সম্পৃক্ততা না থাকা ক্যাস্যারিয়ার চেয়ে বড় হওয়া উচিত। জেমস দি জাদিকের সিংহাসন প্রদর্শন করার পাশাপাশি তারা মাউন্ট সায়নের উপরে কিছু ধ্বংসাবশেষকে বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে শনাক্ত করতে শুরু করে। এসবের মধ্যে ছিল একটি পুরনো বাড়ি। এটিকে ক্যাইফাসের বাড়ি বলে মনে করা হতে লাগল। আরেকটি ছিল রাজা দাউদের প্রাসাদ। সেখানে থাকা একটি স্তম্ভকে মনে করা হতে লাগল যে এখানে যিশুকে চাবকিয়েছিলেন পিলেত। অবশ্য ইউসেবিয়াস এসব বিষয় অগ্রাহ্য করেছিলেন। বাইবেলের স্থান-নামবিষয়ক তার গাইড ওনোম্যাসতিকনে তিনি উল্লেখ করেছেন, ফিলিস্তিনের ভূগোল গসপেলগুলোর নির্ভুলতা ‘প্রমাণ’ করে : ইভানজেলিস্টরা যেভাবে বলেছেন, শহর ও গ্রামগুলো ঠিক সেভাবেই আছে। কিন্তু ইউসেবিয়াস কখনো বলেননি যে মাউন্ট সায়নের স্থানগুলো খ্রিস্টের জীবনের প্রমাণ বা প্রত্যক্ষদর্শী। ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি হয়তো যথাযথভাবেই এসব স্থানের নির্ভুলতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন। তবে তিনি সচেতন ছিলেন যে আলিয়ার বিশপ মাকারিয়স এসব স্থানকে ইউসেবিয়াসের ক্যাসারিয়ার বদলে ফিলিস্তিনকে আলিয়া দি মেট্রোপলিটান বানানোর অভিযানের সমর্থনে ব্যবহার করছেন।
ক্যাসারিয়া ও আলিয়ার মধ্যকার সঙ্ঘাত ৩১৮ সালে প্রকাশ্যে চলে আসে। এই সময় মতবাদগত বিতর্কে ইউসেবিয়াস ও মাকারিয়স তাদেরকে বিপরীত শিবিরে দেখতে পেয়েছিলেন। এই বিরোধে পুরো চার্চই বিভক্ত হয়ে যাওয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছিল। আলেক্সান্দ্রিয়ার ক্যারিশমেটিক প্রেসবাইটার অ্যারিয়াস বাইবেলের বক্তব্য থেকে যুক্তি তুলে ধরে জোরালোভাবে বলেন যে মূর্তিমান লোগোস যিশু কিন্তু গড় দি ফাদারের মতো ঐশী সত্তা নন, তবে তবে সময়ের সূচনার আগেই ঈশ্বর তাকে সৃষ্টি করেছেন।’ অ্যারিয়াস খ্রিস্টের ঐশিত্ব অস্বীকার করেননি। তিনি তাকে যিশুকে ‘শক্তিশালী ঈশ্বর’ ও ‘সত্যিকার ঈশ্বর’ হিসেবে অভিহিত করলেও তিনি মনে করেননি যে তিনি প্রকৃতিগতভাবে ঐশী। গড দি ফাদার নিখুঁত আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে যিশুর ওপর ঐশিত্ব আরোপ করেছেন। যিশু নিজে বলেছেন, তার পিতা তার চেয়ে বড়। অ্যারিয়াসের আইডিয়াগুলো নতুন না হলেও ওই সময় নিশ্চিতভাবেই ধর্মচ্যুত বলে বিবেচিত হয়েছিল। মহান অরিজেনেরও যিশু সম্পর্কে একই ধারণা ছিল। খ্রিস্টানেরা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বাস করে আসছিল যে যিশু ছিলেন ঈশ্বর। তবে এ দিয়ে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। যিশু যদি ঐশী সত্তা হন, তবে বাস্তবে ঈশ্বর কি দুজন হন না? একজন স্রেফ মানুষকে উপাসনা করা কি পৌত্তলিকতা নয়? অ্যারিয়াস তার পূর্বসূরিদের চেয়ে ধর্মতত্ত্ব চেয়ে পরিষ্কার ও জোরালোভাবে প্রকাশ করতে পারলেও (বিশপদের অনেকেও একই ধারণা পোষণ করতেন) বিরোধের শুরুতে স্পষ্ট ছিল না যে অ্যারিয়াস কেন ও কোথায় ভুল করছেন।
অ্যারিয়াসের বিরোধিতা করেন তার আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ ও বিশপের মেধাবী তরুণ সহকারী অ্যাথানাসিয়াস। তিনি যুক্তি দেন যে লোগোস হলো ঈশ্বর, ঠিক যেভাবে গড দি ফাদার হলেন ঈশ্বর। তিনি ও ঈশ্বর একই প্রকৃতিসম্পন্ন, তাকে জন্ম দেওয়া হয়নি বা সৃষ্টি করা হয়নি। লোগোস স্রেফ সৃষ্টি, আদি বা একেবারে শূন্য থেকে পিতা হিসেবে অভিহিত, হলে কিভাবে তিনি মৃত্যু ও বিলুপ্তি থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেন? একমাত্র একক সত্তা, যিনি বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন, তারাই আছে একে রক্ষা করার শক্তি। ফলে রক্ত-মাংসে গঠিত যিশু অবশ্যই পিতার মতোই অনিবার্যভাবে ঐশী সত্তা। তার মৃত্যু ও পরে আবার বেঁচে ওঠা ছিল পাপ ও মৃত্যু থেকে মানুষকে উদ্ধার করা এবং এখন খ্রিস্টের, ঈশ্বর- মানব, সাথে একীভূত হয়ে নারী ও পুরুষেরাও ঐশী সত্তা হতে পারে।
সঙ্ঘাতের উত্তাপ বাড়তে থাকে, বিশপেরা কোনো না কোনো পক্ষ নিতে বাধ্য হন। ফিলিস্তিনে মাকারিয়সের পক্ষ নেন অ্যাথানাসিয়াস, অ্যারিয়াসের সাথে থাকেন ইউসেবিয়াস। ইউসেবিয়াসের ধর্মতত্ত্বের সাথে অ্যারিয়াস তার নিজের মতের কিছুটা মিল পেয়েছিলেন। তবে মনে রাখতে হবে, এই অবস্থান গ্রহণের সময় ইউসেবিয়াস চার্চের সরকারি মতবাদের সুস্পষ্ট বিরোধী ছিলেন না। তখনো খ্রিস্টের ব্যক্তি ও প্রকৃতি নিয়ে কোনো ধরনের গোঁড়ামিপূর্ণ শিক্ষা ছিল না। ইউসেবিয়াস ছিলেন তার প্রজন্মের অন্যতম খ্রিস্টান বুদ্ধিজীবী। খ্রিস্টের আগমনকে নাটকীয় ও অনন্য হিসেবে দেখেছিলেন অ্যাথানাসিয়াস। তবে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে ইউসেবিয়াসের ব্যাখ্যা ছিল অতীতের ধারাবাহিকতার সাথে সম্পর্কিত। অ্যাথানাসিয়াস লোগোসের অবতারকে বিশ্ব ইতিহাসের সম্পূর্ণ নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে দেখেছেন। তার মতে, একেবারে নজিরবিহীনভাবে ঐশী সত্তা নশ্বর মণ্ডলে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ফলে যিশু ছিলেন একক ও একমাত্র ঈশ্বরের প্রকাশ। ইউসেবিয়াস এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। তার দৃষ্টিতে ঈশ্বর আগেও মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। লোগোস মামরেতে মানুষের অবয়বে ইব্রাহিমের কাছে প্রকাশিত হয়েছিলেন; মুসা ও যশুয়ার কাছেও ঐশী সত্তার একই ধরনের প্রকাশ ঘটেছিল। অর্থাৎ লোগোস নাজারেথের যিশুর মাধ্যমে স্রেফ ধরাধামে ফিরে এসেছিলেন।’ মূর্তপ্রকাশ কোনো অনন্য ঘটনা নয়, বরং অতীতের আত্মপ্রকাশের ধারাবাহিকতা। মানুষের কাছে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে প্রকাশ করা একটি চলমান প্রক্রিয়া।
যিশুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিশ্বের পাপমোচনের বিষয়টিকেই দেখেছিলেন অ্যাথানাসিয়াস। ইউসেবিয়াস বিষয়টিকে এ দৃষ্টিতে দেখেননি; নিশ্চিতভাবেই যিশু আমাদের রক্ষা করেছেন, তবে তার প্রথম কাজ ছিল বিশ্বে ঈশ্বরকে প্রকটিত করা। যিশু ছিলেন দুনিয়াতে ঈশ্বরের প্রকাশ : তার দিকে তাকিয়ে মানবজাতি অদৃশ্য, বর্ণনা-অযোগ্য ঈশ্বর দেখতে কেমন ছিলেন সে সম্পর্কে কছু ধারণা পেতে পারত। যিশুর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ধর্মের অনিবার্য আধ্যাত্মিক প্রকৃতির সম্পর্কে খ্রিস্টানদের মনে করিয়ে দেওয়া। শতাব্দীর পরিক্রমায় নারী ও পুরুষেরা ইব্রাহিমের বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা ভুলে গিয়েছিল, তাওরাত ও টেম্পলের মতো দৃশ্যমান প্রতীকের মতো কিছুতে বিশ্বাস করার কলুষতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এ কারণে আমাদের উচিত হবে খ্রিস্টের মানবিকতার দিকে নজর দেওয়া : ইউসেবিয়াস একবার সম্রাটের বোন কনস্টানটিয়ার, তিনি বোকার মতো তার কাছে যিশুর একটি ছবি চেয়েছিলেন, কাছে কঠোর ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। খ্রিস্টানদের উচিত স্বর্গীয় লোগোসের ঐশী নির্যাসের দিকে চর্মচোখ দিয়ে তাকানো। লোগোসের দুনিয়াতে অবস্থানের পর সে আধ্যাত্মিক জগতে ফিরে গেছে, খ্রিস্টানদের উচিত সেখানে তাকে অনুসরণ করা। যিশুর স্থায়ী মূল্যের সংশ্লিষ্টতা নশ্বর নগরীতে ইহুদিদের মতো করে সংশ্লিষ্ট করা ন্যায়ভ্রষ্টতা ও অযৌক্তিক। খ্রিস্টানেরা অব্যাহতভাবে কাথারসিস বা বিশুদ্ধকরণে নিয়োজিত থাকবে। তারা অবশ্যই আরো আধ্যাত্মিকভাবে কিতাব পাঠ করতে শিখবে, ঐতিহাসিক ঘটনাটির সাথে থাকা সময়হীন সত্যের দিকে তাকাবে। অর্থাৎ যিশুর পুনরুত্থান অ্যাথানাসিয়াসের কথিত নাটকীয়, আকস্মিক কাজ ছিল না; এটি স্রেফ অবিনশ্বরের প্রকাশ ছিল যা মানব প্রকৃতির জন্য স্বাভাবিক ছিল।
এগুলো সুস্পষ্টভাবেই ছিল অনির্ণেয় বিষয়, কোনোভাবেই প্রমাণ করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিরোধ চার্চকে বিভক্ত করার হুমকি সৃষ্টি করেছিল। এটি কনস্টানটাইনকে ক্রুদ্ধ করতে লাগল। তিনি ধর্মতত্ত্ব বুঝতেন না, তবে এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক করে দেশকে সঙ্ঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করতে পারে বলে বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে বিভক্ত করতে দিতে চাইছিলেন না। ৩২৫ সালের শুরুতে অ্যাথানাসিয়াসের দল তার সমর্থন লাভ করে, ‘অ্যারিয়ান’ নেতাদের সমাজচ্যুত করে ঘোষণা ইস্যু করা হয়। কনস্টানটাইন বিষয়টি চিরদিনের তো চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে চার্চের যাজককে তলব করেন। এর ফলে যা ঘটল তা হলো এই যে ওই সময় ৬৫ বছর বয়স্ক ও চার্চের অন্যতম প্রখ্যাত বিশপ ইউসেবিয়াস কাউন্সিলে অংশ নিতে মে মাসে নিক্যাইয়ায় পৌঁছে দেখতে পেলেন যে তাকে ধর্মচ্যুত করা হয়েছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী মাকারিয়স অবশ্য জয়ী পক্ষে থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন তার অবস্থান খুবই শক্তিশালী। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তার সহকর্মীদের কাছে অসহনীয় ছিল যে মাদার অব চার্চেস, আলিয়ার বিশপকে ক্যাসারিয়ার ধর্মচ্যুত বিশপের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করা হবে।
নিক্যাইয়া কাউন্সিল অ্যাথানাসিয়াসের ধারণা অনুযায়ী একটি ধর্মবিশ্বাস ইস্যু করে। তবে তা চার্চে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। বেশির ভাগ বিশপই অ্যাথানাসিয়াস ও অ্যারিয়াসের মতবাদের মাঝামাঝি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তারা সম্ভবত উভয়ের ধারণাকেই চরম ও খামখেয়ালিপূর্ণ মনে করতেন। সম্রাটের চাপে অ্যারিয়ানের দুই সাহসী সমর্থক ছাড়া সব বিশপই শান্তির স্বার্থে মতবাদে সই করেন। তবে এরপর তারা আগের মতোই তাদের নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস প্রচার করতে থাকেন। অধিকন্তু তারা একগুঁয়েভাবে ধর্মভ্রষ্টতা গ্রহণ করেননি। নিক্যাইয়া ছিল চার্চের প্রথম খ্রিস্টজগতের ঐক্য প্রতিষ্ঠার সম্মেলন। অবশ্য এর অধ্যাদেশগুলোকে ‘অভ্রান্ত’ হিসেবে অভিহিত করেনি। বিশপেরা বোধগম্যভাবেই অনুভব করেছিলেন, তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি শ্রুত হয়নি। এর ফলে অ্যারিয়ানের বিতর্ক আরো ৬০ বছর ধরে অব্যাহত থাকে। মতবাদে সই করা যাজকদের একজন ছিলেন ইউসেবিয়াস। তবে কাউন্সিলের পর তিনি সাথে সাথেই অ্যাথানাসিয়ানের ‘অনুমোদিত বিশ্বাসের’ বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন। তিনি থিওফ্যানি নামের গবেষণা গ্রন্থের মাধ্যমে, এতে যিশু সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন এবং তিনি সবসময় কনস্টানটাইনকে সমর্থন করতেন বলে, সম্রাটের আস্থাভাজন হতে সমর্থ্য হন। নিক্যাইয়ার দুই বছর পর ৩২৭ সালে ইউসেবিয়াসের মধ্যপন্থী দলটি সমানে চলে আসে, অ্যারিয়াসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
নিক্যাইয়া কাউন্সিল ধর্মতাত্ত্বিক বাস্তবনীতির ওপর সামান্য প্রভাব ফেললেও তা জেরুসালেমের ইতিহাসের ওপর প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। প্রথমত, মাকারিয়স তার অবস্থানগত সুযোগটি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন : কাউন্সিলের সপ্তম অনুশাসনে বলা হয়েছিল যে ‘প্রথা ও প্রাচীন ঐতিহ্য’ ঘোষণা করছে যে আলিয়ার বিশপ চার্চের সম্মানজনক অবস্থান ধারণ করবেন, যদিও তিনি এখনো ক্যাসারিয়া মেট্রোপালিটান বিশপের অধীনস্ত। মাকারিয়স যা কিছু চেয়েছিলেন, তার সব না পেলেও সম্ভবত নিক্যাইয়াতেই তিনি এমন একটি পরিকল্পনার প্রস্তাব করেছিলেন যা কাউন্সিলের সতর্কভাবে গৃহীত বক্তব্যগুলোর চেয়ে আলিয়ার মর্যাদার ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছিল এবং অনীহ বিশপদের সই করা মতবাদের চেয়ে অ্যাথানাসিয়াসের ধর্মতত্ত্বের চূড়ান্ত জয় নিশ্চিত করতে অনেক বেশি সহায়ক হয়েছিল। আফ্রিদিতির মন্দির ভেঙ্গে ফেলে তার নিচে চাপা পড়া খ্রিস্টের সমাধি খুঁড়ে বের করার জন্য কনস্টানটাইনের অনুমতি চেয়েছিলেন মাকারিয়স।
এই প্রস্তাব কনস্টানটাইনের কাছে সাথে সাথে আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন পৌত্তলিক, পবিত্র স্থানগুলোর প্রতি ইউসেবিয়াসের প্রবল তাচ্ছিল্যের সাথে একমত হচ্ছিলেন না। তিনি নিজে ফিলিস্তিন সফর করতে চেয়েছিলেন। তার শাশুড়ি ইউক্রোপিয়া ইতোমধ্যেই বাইবেল-ভূমিতে সফর শুরু করে দিয়েছেন। কনস্টানটাইন আরো জানতেন, ঐতিহাসিক অনুরণন দিতে হলে তার খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের প্রয়োজন প্রতীক ও স্মৃতিসৌধ। তবে মাকারিয়সের এই বিশেষ পরিকল্পনাটিতে বড় ধরনের ঝুঁকিও ছিল। আলিয়ার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা ছিল পৌত্তলিক। তারা তাদের বিশিষ্ট মন্দিরগুলোর ধ্বংস হওয়ার বিষয়টি সহজে মেনে নেবে না। কেবল রাজকীয় সমর্থন পেলেই তারা খননকাজে সম্মতি দিতে পারে। অবশ্য হ্যাড্রিয়ানের ঠিকাদারেরা আফ্রিদিতির মন্দির বানানোর কাজটি করেছিলেন দুই শ’ বছর আগে। খ্রিস্টানেরা কিভাবে নিশ্চিত হলো যে গলগাথা ও কবরটি ওই মন্দিরের নিচেই আছে? অকারণে কারণে মন্দির ধ্বংস হলে পৌত্তলিকরা বোধগম্য কারণেই ক্ষুব্ধ হবে। সম্রাট ও চার্চ উভয়েই অগ্রহণযোগ্য লজ্জায় পড়বে। খননকাজে যদি কিছুই পাওয়া না যায়, তবে তা রাজকীয় খ্রিস্টধর্মের মর্মমূলে উদ্বেগজনক শূন্যতা সৃষ্টি করবে।
তা সত্ত্বেও কনস্টানটাইন অনুমতি দিলেন, মাকারিয়সের তদারকিতে কাউন্সিলের পরপরই খননকাজ শুরু হলো। একইসাথে দুটি স্থানে খননকাজ শুরু হলো। প্রথমত কনস্টানটাইন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে আলিয়ার প্রধান রাস্তা কারডো ম্যাক্সিমাসের পাশে একটি প্রার্থনা ভবন নির্মাণ করতে হবে। এটি ছিল প্রস্তাবিত গলগোথার কয়েক গজ পূর্ব দিকে। এটি ছিল সহজবোধ্য প্রকল্প। কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই দ্রুতগতিতে নির্মাণকাজ এগিয়ে চলল। দ্বিতীয় কাজটি ছিল অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। আফ্রিদিতির মন্দির ভেঙ্গে ফেলতে হবে, সহায়ক প্লাটফর্মটি গুঁড়িয়ে দিতে হবে, ভূমি সমান করতে হবে। এই বিপুল নির্মাণযজ্ঞে দ্বিগুণ ধর্মীয় মাত্রা ছিল। প্রথমত, খ্রিস্টানেরা পৌত্তলিক নগরীর নিচে খুঁড়ছে তাদের বিশ্বাসের ঐতিহাসিক শিকড়ের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য। যন্ত্রণাভোগের সময় পৌত্তলিক এস্টাবলিশমেন্টের তীব্র ঘৃণায় খ্রিস্টানদের মধ্যে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল, বিশ্ব তাদের বিরুদ্ধে। ফলে তারা পরাবাস্তব ধর্মতত্ত্ব সৃষ্টি করেছিল। তারা নিশ্চিত ছিল যে মাটির নিচে তাদের স্থায়ী কোনো নগরী নেই। কিন্তু কনস্টানটাইন সিংহাসন লাভ করায় তারা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখতে পেয়েছিল। তারা অনুভব করতে শুরু করেছিল যে যাই হোক না কেন, এই দুনিয়ায় তাদের কিছু আছে। পবিত্র প্রত্নতত্ত্বের এই কাজ তাদের বিশ্বাসের অবয়বগত শিকড় উন্মোচন করবে, তাদেরকে এসব প্রাচীন ভিত্তির ওপর আক্ষরিক অর্থেই নির্মাণে সক্ষমতা দেবে। এই প্রক্রিয়ায় একটি নতুন খ্রিস্টান পরিচিতিও নির্মিত হচ্ছিল। এই ভবন নির্মাণ প্রকল্পের দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল তুলনামূলক কম ইতিবাচক। নতুন খ্রিস্টধর্মের সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত ছিল পৌত্তলিকতাবাদের ধ্বংস। আফ্রিদিতির মন্দির ধ্বংসের সাথে তা সহজেই ফুটে ওঠেছে। গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজটি শাস্ত্রীয় শুদ্ধিকরণের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনের ভিত্তিতে হয়েছিল। পৌত্তলিকতা ছিল ‘নোংরা’ : মন্দিরটির প্রতিটি শেষ চিহ্ন একেবারে বিলীন করা হয়েছিল, সব আবর্জনা নগরীর বাইরে ফেলা হয়েছিল, এমনকি নিচের মাটি পর্যন্ত ‘অনেক দূরের স্থানে ফেলা হয়েছিল। কারণ ‘এটি নোংরা পৌত্তলিক উপাসনার ফলে দূষিত হয়ে পড়েছে।১২ খ্রিস্টধর্মের নতুন জন্ম পৌত্তলিক ধর্মের নির্মূল ও ক্ষতি করার সাথে জড়িত ছিল। পৌত্তলিকদের ধর্মীয় স্থানে নিচ থেকেই এর জন্ম হয়েছে।
খননকাজ চলতে থাকার সময় মাকারিয়স ও তার সহকর্মীরা নিশ্চিতভাবেই কিছু খারাপ সময় কাটিয়েছিলেন : তারা জানতেন যে তাদেরকে কিছু খুঁজে বের করতেই হবে। বিশাল আবিষ্কারের আগে তাদের দুটি বছর পার করতে হয়েছে। পুরনো মন্দির প্লাটফর্মের নিচ থেকে একটি পাথরের কবর আবিষ্কার করা হলো। সাথে সাথে একে খ্রিস্টের সেপালচার হিসেবে ঘোষিত হলো। এমনকি ইউসেবিয়াসের এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার নিশ্চিত যুক্তি থাকলেও তিনি এই ধ্বংসাবশেষের প্রামাণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন না। আবিষ্কারটি প্রবলভাবে অনুমিত হলেও এটি খ্রিস্টবিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। ইউসেবিয়াস ঘটনাটিকে ‘সকল প্রত্যাশার বিপরীত’ হিসেবে অভিহিত করলেন, কনস্টানটাইনের মনে হলো, এটি ‘সব বিস্ময়কে ছাপিয়ে গেছে। এই আশ্চর্য গ্রহণযোগ্যতার একটি কারণ হতে পারে এই যে কল্পলোক পর্যায়ের কিছু ঘটার জন্য অভ্যন্তরীণ মাত্রার সাথে এটি ব্যাপকভাবে সম্পর্কিত ছিল। তিন শ’ বছর আগে যিশু কবর থেকে ওঠেছিলেন। এখন কবরটি নিজেই ওঠেছে তার সময়োত্তীর্ণ সমাধি থেকে, ঠিক যেভাবে খ্রিস্টানেরা তাদের বিশ্বাসের অপ্রত্যাশিত পুনর্জাগরণ প্রত্যক্ষ করছে।
পাথুরে কবরটি পাওয়া গিয়েছিল একটি প্রাচীন ভাগাড় থেকে। হ্যাড্রিয়ানের নির্মাতারা এটি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। এখন আশপাশের পাহাড়ি এলাকা থেকে এটিকে এমনভাবে আলাদা করা হবে যাতে গুহাটিকে ঘিরে রাখা পাথরের বস্তুটি অটুট থাকে। তারপর সম্রাটের বৃত্তাকার শহিদগাহ নির্মাণের স্থান হিসেবে পরিষ্কার করার জন্য প্রায় ৩৮ গজ ব্যাসের একটি বৃত্তাকার স্থান কেটে নেওয়া হলো। এর মানে হলো, হাতকুঠারের সাহায্যে প্রায় ১৬,৫০০ কিউবিক ফুট পাথর তুলতে হয়েছিল ভবনটির ব্লক তৈরির জন্য। এটি ছিল বিশাল কর্মযজ্ঞ। এটির নাম হয়েছিল অ্যানাসতাসিস বা রিসারেকশন। তবে কনস্টানটাইনের মৃত্যুর অনেক বছর পর এর কাজ শেষ হয়েছিল। ভূমি প্রস্তুতির সময় কয়েক বছর পর্যন্ত কবরটি খোলা স্থানে খাড়া পাহাড়ে রাখা হয়েছিল। তারা কবরটি বের করার সময় শ্রমিকেরা আরেকটি আবিষ্কার করে, যেটিকে গলগোথার পাথুরে ঢিবি হিসেবে চিহ্নিত হয়। বর্তমানে এ পাহাড়টির প্রায় পুরোপরি হলি সেচালচার চার্চের গলগোথা চ্যাপেলের আবদ্ধ থাকায় এটি ওই সময় কেমন ছিল, তা কল্পনা করা কঠিন। ১৯৬১ সালের খননকাজে দেখা যায়, ‘গলগোথা’ ছিল প্রায় ১০ মিটার উঁচু পাথরের খাড়া ব্লক। এটি সম্ভবত আবর্জনা ফেলার জায়গার কোণায় দাঁড়িয়েছিল। এর ভিত্তিতে ছিল একটি গুহা, যা সম্ভবত যিশুর আমলের অনেক আগেই একটি কবর ছিল। এই পাথরের স্তম্ভটি কি কিদরন ভ্যালিতে পাওয়া স্মারক পাথরের মতোই? যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার সময় আশপাশের মাটি জড়ো করে ঢিবি তৈরি করা হয়েছিল। এতে করে পাথরটিকে মাথার খুলির উপরিভাগের মতো দেখাত। এ কারণেই পাহাড়টির নাম হয়েছিল গলগোথা : প্লেস অব দি স্কাল (খুলির স্থান)।
খননকাজের ফলে একটি নয়, বরং দুটি পবিত্র স্থান সামনে এসেছিল : যে পাহাড়টিতে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং যে কবরে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। এদিকে কনস্টানটাইনের গির্জা (ব্যাসিলিকা) প্রায় সমাপ্ত হয়ে আসছিল। কনস্টানটাইন চেয়েছিলেন, এ চার্চটি যেন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর হয়। শ্রেষ্ঠ স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সম্ভব সব খরচ করা হয়েছে। এর ব্যয়ভার বহন করেছেন পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর গভর্নরেরা। অবশ্য জায়গা কম থাকায় ব্যাসিলিকাটি ছিল বেশ ছোট : এটি ৪৪ বাই ৩০ গজের চেয়ে বড় করা যায়নি। এর মূল অংশ পাঁচটি। একটি গলগোথা পাহাড়সহ, কবরের সবচেয়ে কাছে পশ্চিম প্রান্তে অর্ধবৃত্তকার কোণে এর সমাপ্তি ঘটেছে। এসব ঘটনা চমকপ্রদ বিবেচনা করে লিখে রেখেছিলেন কেবল ইউসেবিয়াস। তার কাছে ব্যাসিলিকাটি ছিল অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান। বর্ণিল মার্বেলের স্ল্যাবে ও মসৃণ পাথরে এর ভেতর ও বাইরে ছিল সুসজ্জিত। অভ্যন্তরভাগ ‘কাঠামোবদ্ধ কারুকাজ, সীমাহীন এক মহাসাগর। পুরো ব্যাসিলিকা সোনার মোড়া থাকায় তা আলোতে চমকাত।১৪ সেন্ট কনস্টানটাইন ব্যাসিলিকা সাধারণভাবে ম্যারটিরিয়াম নামে পরিচিত চিল। কারণ এটি খ্রিস্টের পুনরুত্থান ও স্মারকের ‘সাক্ষী’ ছিল।
বর্তমানে বিশাল ধর্মীয় স্থানটি হলি সেপালচার চার্চেল মধ্যে গলগোথার পাহাড়ের বাকি অংশ ঢেকে ফেলেছে। এই স্মৃতিসামগ্রী আবিষ্কারের ফলে খ্রিস্টানেরা সম্পূর্ণ নতুন পথে খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধকরণের দিকে মনোনিবেশন করতে সক্ষম হয়।
এর ফলে এটি জটিল স্থানও ছিল। নতুন হলি অব হলিসে পরিণত হওয়া এ নতুন কবরটিক পুরনো ইহুদি টেম্পলের মতো করেই ধাপে ধাপে উপাসনাকারীদের সামনে উপস্থাপন করা হতো। (দেখুন ডায়াগ্রাম।) আগত লোকজন পৌত্তলিক আলিয়ার কেন্দ্রস্থল কারডো ম্যাক্সিমাস থেকে ম্যারটিরিয়ামে প্রবেশ করতে পারত। এর তিনটি দরজা সামান্য খোলা থাকত, যাতে আগন্তুকেরা চার্চের জাঁকজমকের আভাস পেয়ে ভেতরে প্রবেশের তাগিদ অনুভব করতে পারে। ব্যাসিলিকায় প্রবেশের আগে তাদেরকে একটি আঙিনা দিয়ে হাঁটতে হতো। এটি ছিল এক ধাপ অগ্রসর হওয়া। ব্যাসিলিকার সব পশ্চিম দিকের দরজাটি কবরের সামনে থাকা বিশাল আঙিনার দিকে নিয়ে যেত। তীর্থযাত্রীদের সঙ্কুলানের ব্যবস্থা ছিল এখানে। খ্রিস্টকে এক নারী প্রথম যেখানে জেগে ওঠতে দেখেছিলেন, সেখানে ওই ঘটনার স্মরণে একটি উদ্যান গড়া হয়। কনস্টানটাইন রোমান আলিয়ার প্রধান কেন্দ্রের অবস্থান গ্রহণ করে একে খ্রিস্টান পবিত্র স্থানে রূপান্তরিত করেন। তিনি আলিয়া ফোরামের পাশে নতুন এক জেরুসালেম নির্মাণ করেন। এই সময়ের আগে পর্যন্ত বেশির ভাগ অ-ইহুদি খ্রিস্টানের আধ্যাত্মিক মানচিত্রে ছিল না, নগরীতেও চার্চটি ছিল প্রাচীরের বাইরে মাউন্ট সায়নের বসতিহীন উপকণ্ঠে প্রান্তিক অবস্থানে। এখন কনস্টানটাইন তার সাম্রাজ্যের নতুন বিশ্বাসের কেন্দ্রিতা প্রদর্শন করলেন। এটি যে ইঙ্গিত দিচ্ছিল তা সাথে সাথেই খ্রিস্টান মানসচোখে ধরা পড়েছিল। কবরটি আবিষ্কৃত হওয়া ও প্রাণবন্ত ব্যাসিলিকা সম্পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে খ্রিস্টানেরা স্থানটির ব্যাপারে তাদের নিজস্ব পুরানকাহিনী বিবর্তিত করতে থাকে। এই কাহিনী তাদের আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রে স্থান পায়। তারা পুরনো ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে বলতে থাকে, আদম সমাহিত হয়েছিলেন গলগোথায়। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা এই বিশ্বাসে উপনীত হয় যে ইব্রাহিম এখানেই ইসহাককে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন। পুরনো ইহুদি টেম্পল যে ধরনের বিশ্বাস ও কিংবদন্তি উদ্দীপ্ত করেছিল, নতুন খ্রিস্টান পবিত্র স্থানটিও একই কাজ করতে শুরু করে। এটি পরিণত হয় প্রতীকী ‘কেন্দ্র।’ এখানে ঐশী শক্তি অনন্য উপায়ে মানুষের নাজুক দুনিয়াকে স্পর্শ করে যায়। এটি মানুষের নতুন সূচনার, ইব্রাহিমি ধর্মের পূর্ণাঙ্গতা ও খ্রিস্টান ইতিহাসের নতুন যুগের প্রতিনিধিত্ব করছিল।
খ্রিস্টানেরা তারপরও ভেবেছিল যে তারা এ ধরনের ধর্মানুরাগের ঊর্ধ্বে। তারা গর্ব করে ঘোষণা করত যে তাদের ধর্মটি পুরোপুরি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, এটি উপাসনালয় বা পবিত্র স্থানের ওপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু কবর আবিষ্কারের প্রতি তাদের চমকিত প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হয় যে ঐশী ভূগোলের মিথ মানব-মনে গভীরভাবে গেঁথে রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ কোনো প্রতীকের সাথে একটি আকস্মিক প্রচণ্ড ধাক্কা বা অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলন, বিশেষ করে যখন লোকজন প্রবল নির্যাতনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সময়টি অতিবাহিত হওয়ার পর, পবিত্র স্থানের প্রতি উদ্দীপনাকে নতুন করে সঞ্চারিত করতে পারে। এটি মনে করা কখনো নিরাপদ নয় যে আমরা এই আদি মিথ থেকে বের হয়ে এসেছি : এমনকি ২০ শতকের সেক্যুলার, বৈজ্ঞানিক বিশ্বেও আমরা তাদের আবেদন থেকে সুরক্ষিত নই, যেমন আজকের জেরুসালেমে আমরা দেখতে পাই। নতুন করে সামনে আসা কবরের দিকে তাকিয়ে খ্রিস্টানেরা তাদের শিকড় অনুভব করতে পারল, তারা প্রথমবারের মতো কোনো একটি ভৌগোলিক স্থানে তাদের শিকড় নিহিত রয়েছে বলে বুঝতে পারল, নশ্বর দুনিয়ায় একটি বাড়ি নির্মাণ করল এবং এই পবিত্র স্থানের সাথে সেটিকে সম্পৃক্ত করল। অতীতের সাথে এই উপশম প্রদানকারী সংযোগ তাদেরকে রোমান আলিয়ার কেন্দ্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করল। তারা এখন তাদের প্রান্তিক অবস্থান ত্যাগ করে দুনিয়াতে সম্পূর্ণ নতুন স্থান গ্রহণ করল।
ইউসেবিয়াসের চেয়ে অন্য কেউই পবিত্র জায়গার পূর্ণাঙ্গ ধারণার প্রতি বেশি বিরোধিতা করেনি। কিন্তু কবরটি আবিষ্কার সম্ভবত তার সত্তাকেও স্পর্শ করে গিয়েছিল। ফলে তিনি তার সাবেক বিশ্বাসের কিছু কিছু অংশ বদলে ফেলতে বাধ্য হলেন। এখন তিনি আবার কনস্টানটাইনের আনুকূল্য ফিরে পেয়েছেন। তার দায়িত্ব হলো এসব অবাক করা ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি দেখতে পেলেন, এই পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের প্রভাব নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে এমনসব পুরাণতত্ত্বের আশ্রয় তাকে নিতে হচ্ছে যেগুলো তিনি এত দিন অগ্রাহ্য করে আসছিলেন। এর তাৎপর্য তিনি যুক্তি দিতে ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না। তবে কেবল পুরনো কল্পকথার মাধ্যমেই হৃদয়-মনের গভীরতর অবস্থান তুলে ধরা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল। কবরটি ছিল মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের প্রকাশ : একটি অবয়ব, যা আগে গোপন ও অপ্রবেশযোগ্য ছিল, সেটিই প্রকাশ্যে এসেছে। এটি খ্রিস্টের পুনরুত্থানের অলৌকিক ঘটনাটি আবার সামনে নিয়ে আসে। ইউসেবিয়াসের কাছে এ ঘটনাটি অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে ধরা দিয়েছে। আর তা পুরনো যুদ্ধ মিথ নিয়ে প্রচলিত ধারণা থেকে ভিন্নও ছিল না। লাইফ অব কনস্টানটাইনে তিনি লিখেছেন, ‘সবচেয়ে পবিত্র গুহাটি আবার তার প্রাণবন্ততার সত্যিকারের যথার্থ প্রতীকটি লাভ করেছে। কারণ অন্ধকারে নেমে আবার আলোতে এসে আড়ালে থাকা আশ্চর্য ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে আসা লোকদের অজ্ঞানতা দূর করেছে। ১৫ আফ্রিদিতির মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া ছিল শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে দুর্দান্ত জয়। কারণ এটি ‘আফ্রিদিতি নামে পরিচিত একটি অশুদ্ধ দানবের আস্তানা, প্রাণহীন মূর্তিদের অন্ধকার স্থান ছিল।’ এখানে ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড হতো, ‘অপবিত্র ও অভিশপ্ত বেদীগুলোতে পাপাচারপূর্ণ নৈবদ্য দেওয়া হতো।’ তবে এই নোংরা পরিশুদ্ধ করার লক্ষ্যে মানুষের অন্তরে আলোকস্ফূরণ ঘটানো আলোর ঈশ্বর কনস্টানটাইনকে উদ্দীপ্ত করেছেন। ‘তার আদেশ দেওয়ামাত্র প্রতারণার কৌশল উচ্চ স্থান থেকে ভূপতিত হয়, ভুল স্থানে বাস করতে থাকা মূর্তি ও দানবেরা সবাই নিক্ষিপ্ত ও বিধ্বস্ত হয়।’৬ কবরটি পুরো খ্রিস্টান অভিজ্ঞতা নতুন করে সাজিয়ে দেয়। কারণ এর আবিষ্কার একইভাবে ছিল ঐশী বার্তা, পুনরুত্থান, আলোর শক্তির বিজয়। এখন থেকে ইউসেবিয়াস পুনরুত্থানকে আরো শান্ত পরিভাষায় দেখেছেন। এখন তিনি অ্যাথানাসিয়াসের ধর্মতত্ত্ব থেকে কিছু নাটক এখানে প্রয়োগ করতে শুরু করেন।
সম্ভবত রক অব গলগোথার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না ইউসেবিয়াস। তিনি কখনো এর উল্লেখ করেননি। তবে অতি সম্প্রতি পাথুরে পাহাড়ি এলাকা থেকে খুঁড়ে বের করা গুহাটি দেখে তিনি প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন। তিনি এর নিঃসঙ্গতায় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন- সমতল মাটিতে একাকী দাঁড়িয়ে আছে এবং সত্য কথা হলো, সেখানে কখনো অন্য কোনো দেহ রাখা হয়নি।১৭ এটি খ্রিস্টের জয়ের অনন্য প্রতীক। কবরটির দিকে তাকানোর সময় ইউসেবিয়াসের কাছে সম্পূর্ণ নতুনভাবে খ্রিস্টের জীবনের ঘটনাবলী প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। যদি আমাদের সামনে ঘটমান স্থানের ছবি মনে মনে না আঁকতাম, তবে কোনো বিস্তারিত বিবরণ স্মরণ করা কঠিন হতো। এই স্থানকে এমনভাবে অতীত ও বর্তমানের মধ্যকার শূন্যতা পূরণকারী হিসেবে বিবেচনা করেন যা কেবল লোকশ্রুতিতে সম্ভব ছিল না। ইউসেবিয়াস স্বীকার করেন যে কবরটির দেখা সব কথার চেয়ে বেশি জোরে কথা বলে।’১৮ অন্যান্য খ্রিস্টান এর মাধ্যমে অ্যাথানাসিয়াসের অবতারভিত্তিক ধর্মতত্ত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ঐশী সত্তাকে যিশুর মনুষ্য চরিত্রের মাধ্যমে দেখার বদলে, যেভাবে ইউসেবিয়াস পরামর্শ দিয়েছিলেন, তারা তার মানব-প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত স্থান দেখতে ও স্পর্শ করতে চেয়েছিল এবং দেখেছিল যে মানুষ যিশু বিশ্বের সাথে ঈশ্বরের সংযোগের শক্তিশালী প্ৰতীক।
ইউসেবিয়াস অবশ্য তার অভিমতগুলো পুরোপুরি বদলে ফেলেননি। তিনি অব্যাহতভাবে নগরীকে আলিয়া হিসেবেই অভিহিত করতে থাকেন : এই পৌত্তলিক মেট্রোপলিশের কিছুই পবিত্র নয়। এটি চিন্তা করা কেবল ‘নীচতাই নয়, বরং অধার্মিকতাও যে ‘অত্যাধিক নীচতা ও সংকীর্ণতার সীমা ছিল’ ছিল।’ ‘জেরুসালেম’ নামটি কেবল কবর ও ওয়েস্টার্ন হিলের ওপর কনস্টানটাইনের নতুন ভবনরাজির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। বাকি নগরী আগের মতোই ঈশ্বরবিদ্বেষী ও অপরাধী ছিল। ইউসেবিয়াস কনস্টানটাইন কমপ্লেক্সকে যথাযথভাবে নতুন জেরুসালেম হিসেবে অভিহিত করতেন, কারণ এটি ‘নির্মিত হয়েছিল পুরনোটির বিপরীতে। ২০ এটি খ্রিস্টের অভিশপ্ত পুরনো ইহুদি নগরী থেকে চরমভাবে ভিন্ন ছিল। বস্তুত, নতুন জেরুসালেম খ্রিস্টানদের সামনে ইহুদি ধর্মের পরাজয় চিন্তা করার আরেকটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এনে দেয়। ওয়েস্টার্ন হিলের অন্যতম সর্বোচ্চ বিন্দুতে অবস্থিত ম্যারটিরিয়ামটি অপবিত্র হয়ে পড়া টেম্পল মাউন্টকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এটি নতুন ধর্মটির জনপ্রিয়তাকেই ফুটিয়ে তুলছিল। এই ধর্মটি এখন রাজকীয় সমর্থন পাচ্ছিল, আর ইহুদি ধর্ম পুরো আলিয়ার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এই দিক থেকে নতুন জেরুসালেমের প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইউসেবিয়াসের সাবেক বিশ্বাসগুলোই জোরদার করছিলেন। খ্রিস্টধর্ম এখন গোপন স্থান থেকে বের হয়ে নশ্বর দুনিয়ায় তার শিকড় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এটি এখন সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্থান করে নিতে সক্ষম, সম্পূর্ণ নতুন পরিচিতি লাভ করতে সমর্থ। এই প্রক্রিয়ায় নতুন জেরুসালেম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এই নতুন খ্রিস্টান বিশ্বাস ছিল পুরনো ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলোর বিধ্বংসী প্রত্যাখ্যান, এটি আলিয়ায় অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়। নতুন জেরুসালেম এর পূর্বসূরিদের ‘বিপরীতে নির্মিত’ হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠা ছিল পৌত্তলিক ধর্মের সহিংস উচ্ছেদ, অপেক্ষাকৃত পুরনো ঐতিহ্যগুলোর গুঁড়িয়ে দেওয়া ও ইহুদি ধর্মের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অবজ্ঞা প্রদর্শন। খ্রিস্টানেরা নিশ্চিত করেছিল যে তারা সেখানে ক্ষমতায় থাকাকালে জেরুসালেমে আর কখনো ইহুদিদের বসবাসের অনুমতি দেওয়া হবে না। রাজকীয় আইন গ্রন্থে পুরনো নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। খ্রিস্ট ধর্ম নির্যাতন থেকে মুক্ত হলেও এটি তখনো ছিল যুদ্ধংদেহী ও আত্মরক্ষামূলক। তারা তখনো তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা ও বিধ্বংসী বিরোধিতামূলক মনোভাব গ্রহণ করে আছে। নির্যাতন সবসময় এর শিকারদেরকে সহানুভূতিশীল করে না। একেবারে শুরু থেকে নতুন জেরুসালেম যেভাবে অন্যদের বাদ দেওয়া ও কালিমালেপন করছিল, তা ছিল যিশুর সহানুভূতিশীল মূল্যবোধ থেকে অনেক দূরে।
ইউসেবিয়াস অব্যাহতভাবে আলিয়াকে ইহুদি ও পৌত্তলিকদের হাতে চূড়ান্ত মাত্রায় দূষিত বিবেচনা করছিলেন। তিনি মাউন্ট সায়নের নতুন ‘পবিত্র স্থানগুলোকেও’ অগ্রাহ্য করছিলেন। তিনি সম্ভবত কনস্টানটাইনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এসব স্থাপনায় রাজকীয় তহবিল মঞ্জুর না করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব স্থাপনা ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী মাকারিয়সের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ : আলিয়ার বিশপ কবরটি আবিষ্কার করার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে একটি ক্যু করে ফেলেছিলেন। কিন্তু পরের বছরগুলোতে ইউসেবিয়াস নিশ্চিত করতে সক্ষম হন যে তার ধর্মতত্ত্বও ফিলিস্তিনের খ্রিস্টকরণ প্রতিফলিত করে। ফলে কনস্টানটাইনের শাশুড়ি ইউক্রোপিয়া যখন দেশটি সফর করেন, তখন নগরবাসী হিসেবে ইউসেবিয়াসই প্রায় নিশ্চিতভাবে তাকে নগরীটি পরিদর্শন করানোর সম্মান লাভ করেছিলেন। হেবরনের কছে মামরেতে তিনি ইব্রাহিম যেখানে প্রত্যাদেশ পেয়েছিলেন, ঠিক সেখানেই সন্দেহজনক উপাসনার দিকে রাজকীয় অতিথির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইউসেবিয়াসের কাছে ইব্রাহিম ছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার পবিত্র ওক কাছের স্থানটিতে ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের উৎসবের দৃশ্যে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। প্রতি বছর ফিলিস্তিন, ফোনেশিয়া ও আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন বার্ষিক মেলা ও জৌলুষময় ভোজে অংশ নিতে আসত। এতে সবাই ভূমিকা রাখত : ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকেরা ঈশ্বর বা সবার ঈশ্বর জিওস অলিম্পিয়সের কাছে প্রার্থনা করত। তারা অ্যাঞ্জেলদের আহ্বান করত, মদের তর্পণ করত, ধূপ জ্বালাত, পৌত্তলিকেরা ষাঁড় বা ভেড়া বলি দিত। এটি ছিল শোভনীয় বিষয়। লোকজন উৎসবের জন্য তাদের সেরা পোশাক পরত। কোনো ধরনের লাম্পট্য বা মাতলামি ছিল না। তবে সমগ্র খ্রিস্ট জগতের ঐক্যমূলক এই সমাবেশের প্রতি নজর দেওয়ার সময় ছিল না ইউসেবিয়াসের। তার কাছে একে মনে হয়েছিল মিথ্যা ধর্মের সাথে অপবিত্র সামঞ্জস্যতা বিধান করা। তিনি নিশ্চিত করতে চাইছিলেন যে ইউড্রোপিয়া যেন এই উৎসব সম্পর্কে কনস্টানটাইনকে এমনভাবে অবগত করেন যাতে মাকারিয়স ঝামেলায় পড়েন। মামরের অবস্থান মাকারিয়সের বিশপীয় এলাকার মধ্যে থাকায় কনস্টানটাইন তাকে কড়া চিঠি লিখে এসব ‘অপবিত্র নোংরা’ অনুমোদন করার জন্য তাকে তিরষ্কার করেন। চিঠিটি প্রমাণ করে যে ইউসেবিয়াসের ধর্মতত্ত্বে ইতোমধ্যেই কনস্টানটাইন প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। এই মামরেতেই লোগোসের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; ‘এখানে পবিত্র আইন এর সূচনাতেই পালিত হয়েছিল; এখানে ত্রাতা দুই অ্যাঞ্জেলকে নিয়ে ইব্রাহিমের কাছে প্রথম সাক্ষাত করেছিলেন।১ ইউসেবিয়াসের উল্লেখ করা দ্বিতীয় ইব্রাহিম এই সম্রাট ইব্রাহিমের বেদী, কূপ ও ওক বৃক্ষের পাশে একটি নতুন ব্যাসিলা প্রতিষ্ঠা করা হলো।
কনস্টানটাইন নিজে ফিলিস্তিন সফর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অ্যারিয়ানের সঙ্ঘাত উচ্চ শব্দে অব্যাহতভাবে কনস্টানটিনোপলে বিরাজ করতে থাকায় তিনি তা পারেননি। এর বদলে তিনি তার মা, বিধবা সম্রাজ্ঞী হেলেনা আগাস্তাকে পাঠান। পবিত্র ভূমিতে হেলেনার ‘তীর্থযাত্রা’ খ্রিস্টান কিংবদন্তিকে উজ্জ্বল করে তার ব্যক্তিগত ধর্মানুরাগে। তবে ৩২৬ সালে সম্রাজ্ঞীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সফর ছিল একটি রাষ্ট্রীয় শোভাযাত্রা, যা শেষ হয়েছিল জেরুসালেমের বিপুল সমৃদ্ধি দিয়ে। হ্যাড্রিয়ানের মতো কনস্টানটাইনও রোমান সাম্রাজ্য নিয়ে তার বিশেষ ধারণা প্রচার করার জন্য সফরকে ব্যবহার করেছিলেন। বৃদ্ধা সম্রাজ্ঞী ও তার বিশাল সহযাত্রীদের খ্রিস্টান পবিত্র স্থানগুলো পরিদর্শন ছিল কনস্টানটাইনের খ্রিস্টান রোমের শক্তিশালী প্রতীক। হ্যাড্রিয়ান তার সফরকালে মন্দির, স্টেডিয়া, জলাধার নির্মাণ করেছিলেন : আলিয়া ক্যাপিটোলিনা ছিল ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি তার উপহার। এখন হেলেনা নতুন নতুন চার্চ দান করতে লাগলেন। ম্যারটিরিয়াম পরিকল্পনা ও কবর খনন করার সময় তিনি পৌঁছেছিলেন। ৩২৭ সালে কবরটি আবিষ্কার করার সময়ও তিনি হয়তো সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আবারো বলা যায়, ইউসেবিয়াসের চাকরি সম্ভবত ছিল হেলেনাকে ফিলিস্তিন দেখানো। তিনি সম্ভবত সম্রাজ্ঞীর নির্মিত চার্চ দুটির স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। দুটি গুহার ব্যাপারে তিনি সবসময়ই উৎসাহী ছিলেন। একটি হলো খ্রিস্টের জন্মস্থান বেথলেহেমে এবং অপরটি মূর্তিমান লোগোসের আত্মপ্রকাশের স্থান মাউন্ট অলিভেসে। গুহা দুটি যিশুর মিশনের রহস্য উদ্ঘাটনের প্রকৃতি বিবেচিত হতো তার কাছে। হেলেনা নিজে অ্যারিয়ানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি হয়তো ইউসেবিয়াসের মতবাদের প্রতি সাড়া দিয়ে থাকতে পারেন। যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, বিধবা সম্রাজ্ঞী এ দুটি গুহাকে পবিত্র করতে দুটি নতুন ব্যাসিলিক উদ্বোধন করেছিলেন। ইউসেবিয়াস সম্ভবত বেথলেহেমে একটি পবিত্র স্থান প্রতিষ্ঠা করতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। ন্যাটিভিটিতে নতুন ব্যাসিলিকা আলিয়া ও নতুন জেরুসালেম থেকে খ্রিস্টানদের দৃষ্টি সরিয়ে নেবে। মাউন্ট অলিভসের ব্যাসিলিকাটি নগরীর জঁমকালো দৃশ্যপট এনে দেয়। কনস্টানটাইনের ভবন কমপ্লেক্সের মতো ইলেয়না ও বেথলেহেম- উভয় স্থানের ব্যাসিলিকা প্ৰকৃত ‘পবিত্র স্থান থেকে আলাদা ছিল। মাউন্ট অলিভেসে সিঁড়িটি ব্যাসিলিকা থেকে পবিত্র গুহায় নেমে এসেছিল যাতে তীর্থযাত্রীরা গির্জার অনুষ্ঠানে কোনো বিঘ্ন ঘটানো ছাড়াই পবিত্র স্থানটি পরিদর্শন করতে পারে। অন্য দিকে স্থাপত্যটি নিশ্চিত করেছিল যে উপাসনাকারীরা ধাপে ধাপে অভ্যন্তরের পবিত্র স্থানের দিকে যাবে যাতে তারা তাদের হৃদয়-মনে পরিবর্তন আনার জন্য সময় পায়।
হেলেনার সফর অল্প সময়ের মধ্যেই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে খ্রিস্টানেরা বিশ্বাস করতে চাইত যে কনস্টানটাইন ও মাকারিয়স নয়, বরং তিনিই গলগোথার খননকাজের তদারকিতে ছিলেন। আরো বলা হয়ে থাকে, যিশু যে ক্রুশে মারা গিয়েছিলেন, সেটি তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। হেলেনার ফিলস্তিন সফর নিয়ে ইউসেবিয়াস যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে তার ‘ট্রু ক্রস’ পাওয়ার কথা উল্লেখ নেই। সমসাময়িক অন্য কোনো বিবরণীতেও আমরা এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের কথা দেখি না। তবে ৩৯০ সাল নাগাদ ক্রুশটি জেরুসালেম দৃশ্যপটের অংশে পরিণত হয়েছিল, প্রাচীন সামগ্রীটির অংশবিশেষ খ্রিস্টান বিশ্বজুড়ে বিতরণ করা হয়েছিল। এটি ৩২৫-২৭ সময়কালের খননকাজের কোনো একপর্যায়ে পাওয়া গিয়েছিল। আর এই আবিষ্কারে হেলেনার সম্পৃক্ত থাকাও অসম্ভব নয়। চতুর্থ শতকের প্রথম দিকে খ্রিস্টানেরা ক্রুশবিদ্ধকরণের ঘটনাকে আলাদা বিষয় হিসেবে খুব বেশি আলোচনায় আনত না। এটি পুনরুত্থানের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টের মৃত্যু ও তার কবর থেকে উত্থান একক রহস্যের দুটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে জেরুসালেমে উপাসনার অভিজ্ঞতা খ্রিস্টানদেরকে ক্রুশবিদ্ধকরণের ওপর গুরুত্ব দিতে খ্রিস্টানদের শিক্ষা দিয়েছিল। এছাড়া আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখব যে খ্রিস্টের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু খ্রিস্টান কল্পনাশক্তির পুরোভাগে চলে আসে। চূড়ান্ত পর্যায়ে লোকজন কবর আবিষ্কারের কথা মনে রাখবে না। অথচ হেলেনার ট্রু ক্রস আবিষ্কারের কিংবদন্তির চেয়ে এটি হবে আরো বেশি বিখ্যাত ঘটনা।
গলগোথা খননকাজের আগে জেরুসালেমে কোনো তীর্থযাত্রা হতো না। অথচ কবরটি আবিষ্কার হওয়ামাত্র সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য থেকে, এমনকি সুদূর পাশ্চাত্য থেকে তীর্থযাত্রীরা আসতে শুরু করে। এ-বিষয়ক প্রথম ভাষ্যটি আসে বদুর এক পর্যটকের কাছ থেকে। তার বিশাল সফর কিছুটা সহজ হয়েছিল এখন রাজকীয় রাজধানী কনস্টানটিনোপলের সাথে সংযোগকারী সামরিক রাস্তাগুলোর মাধ্যমে। তীর্থযাত্রা নিশ্চিতভাবেই ছিল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। তবে ওই তীর্থযাত্রীর পথ- পরিক্রমণ সম্পর্কে সংযম অবলম্বন করার ফলে তার অনুভূতি সম্পর্কে কু পাওয়া যায় সামান্য : এটি স্রেফ বাইবেলের স্থানগুলোর ক্যাটালগ ও এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোর বর্ণনা। তীর্থযাত্রী চরমভাবে একমনা ছিলেন। তিনি প্রাচীন কালের কালজয়ী নিদের্শনগুলো দেখার জন্য বিরতি নেননি, পুরোপুরি বাইবেলে উল্লেখিত স্থানগুলোতে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন। তার গাইডরা ছিল সম্ভবত ইহুদি। কারণ তার পরিদর্শন করা অনেক স্থান খ্রিস্টানদের বর্তমানে অভিহিত ‘ওল্ড টেস্টমেন্টে পাওয়া যায়। তিনি যেসব লোক-কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলো কেবল ইহুদি ঐতিহ্যেই পরিচিত। তীর্থযাত্রা তখনো আদর্শ খ্রিস্টান ধর্মভক্তি হিসেবে পরিচিত। প্রাথমিক কালের তীর্থযাত্রা সম্ভবত ফিলিস্তিনের ইহুদি বাসিন্দাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পরে খ্রিস্টানেরা তাদের অবস্থান মজবুত করেছিল। ওই তীর্থযাত্রী যিশুর জাগতিক জীবনের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তিনি অবশ্যই গ্যালিলি অতিক্রম করেছিলেন। কিন্তু নাজারেথ বা ক্যাপোরনাম সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেননি। এর বদলে তিনি সরাসরি জেরুসালেমে গিয়ে প্রথমেই টেম্পল মাউন্টের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। তবে পুল অব বেথ-হেসদায় তখনো বিকশিত হতে থাকা পৌত্তলিক আরোগ্য ধর্মমত উল্লেখ করার জন্য কিছু বিরতি দিয়েছেন।
দি পিলগ্রিমস হলো ৭০ সালের পর টেম্পল মাউন্টের প্রথম ভাষ্য। সময়ের পরিক্রমায় এটি আরো ভুতুরে, ভয়ঙ্কর স্থানে পরিণত হয়েছিল। ওই তীর্থযাত্রী আমাদের জানাচ্ছেন যে এখানে থাকা একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে শয়তানদের শাস্তি দিতেন রাজা সোলায়মান। আর খোদ টেম্পলের স্থানে নবী জাকারিয়ার রক্তের দাগ ছিল। তিনি রাজা যেহোয়াশের নির্যাতনের সময় নিহত হয়েছিলেন।২২ ইহুদি সৈনিকদের পেরেকের চিহ্ন তখনো দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। বিধ্বস্ত প্লাটফর্মটি ইহুদি লোকজনের সহিংসতা ও ধর্মত্যাগের সাথে সম্পর্কিত বলে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ছিল। ওই তীর্থযাত্রা ইহুদি শোকের আনুষ্ঠানিকতার বর্ণনা দিয়েছেন। তা তখনো অ্যাভের নবম দিনে পালিত হতো। তিনি বলেছেন, হ্যাড্রিয়ানের দুটি মূর্তি থেকে খুব বেশি দূরে এমন স্থানে ‘একটি ছিদ্রযুক্ত পাথর’ [ল্যাপিস পারফুসাস] ছিল। এখানে ইহুদিরা প্রতি বছর আসত, এতে তেলসিক্ত করত, নিজেরা বিলাপ করত, পোশাক ছিঁড়ত, তারপর চলে যেত।২৩ এই পাথরের কথা কেবল ওই তীর্থযাত্রীই উল্লেখ করেছেন। তিনি কি হেরডের প্লাটফর্মের ওপরে থাকা টিলার উপরিভাগের কথা উল্লেখ করেছেন, যা এখন মুসলিম ডোম অব দি রককে উজ্জ্বল করেছে? এটি কি বাইবেলে উল্লেখ না থাকা কোনো পাথর, যা রাব্বিদের উল্লেখ করা ডেভিরের ফাউন্ডেশন পাথরের (ইভেন শেটিয়াহ) সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে শুরু হয়েছিল? নাকি এ পাথরটি স্রেফ বিধ্বস্ত ইট-সুরকির নাটকীয় কোনো অংশবিশেষ? এটি অসম্ভব নয় যে ওই তীর্থযাত্রী নিজে তার বর্ণিত ইহুদি অনুষ্ঠানগুলো না দেখেই সে সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছেন।
তবে খ্রিস্টানেরা তাদের বলে কল্পনা করা স্থানটিতে উপনিবেশ স্থাপন করা শুরু করে দিয়েছিল। ওই তীর্থযাত্রী একটি ভবনশৃঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন। এটি প্লাটফর্মের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে তখনো দাঁড়িয়েছিল। এটিকে তিনি ‘টেম্পলের চূড়া’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এখানেই যিশুকে প্রলুব্ধ করেছিল শয়তান।২৪ এই টাওয়ারের একটি কক্ষে বসেই সোলায়মান বুক অব উইজডম লিখেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। তবে তীর্থযাত্রীর সময় সেটি জেমস দি জাদিকের শহিদ হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। টেম্পল মাউন্ট থেকে ওই তীর্থযাত্রী সিলম পুল দিয়ে আলিয়ার খ্রিস্টান এলাকায় যান। মাউন্ট সায়নে তাকে ক্যাইফাসের বাড়ি, যিশুকে যেখানে প্রহার করা হয়েছিল, সেই স্তম্ভ ও ‘দাউদের প্রাসাদ’ দেখানো হয়। তিনি একটি ‘সিনাগগ’ দেখার কথাও জানিয়েছেন। এটি এই এলাকায় ইহুদিদের বাস করার সময় থেকে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। কিন্তু ওই তীর্থযাত্রী আপার রুমের বাড়িটির কথা উল্লেখ করে থাকতে পারেন। ২৫ নগরকেন্দ্রে প্রবেশ করা মাত্র তিনি টাইরোপোয়েন ভ্যালিতে ধ্বংসাবশেষ দেখেন। তার মনে হয়েছিল এটি প্রায়েটোরিয়াম, যেখানে যিশুর বিচার করেছিলেন পিলেত। তারপর তিনি গলগোথার দিকে অগ্রসর হন। কনস্টানটাইনের ব্যাসিলিকার নির্মাণকাজ তখনো চলছিল : ‘গলগোথার ছোট্ট পাহাড়ে প্রভুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল’ এবং কবরটি (ক্রিপতা) এখনো উন্মুক্ত দাঁড়িয়ে আছে।২৬ ওই তীর্থযাত্রী নতুন জেরুসালেম দেখতে পেয়ে আবেগ লুকাতে পারেননি। পবিত্র ভূমির নাগাল পাওয়ার জন্য যে বিপুল প্রয়াস তিনি চালিয়েছেন তা মুগ্ধ হওয়ার মতো। স্থানটি পরিচিত বিশ্বের অন্যান্য স্থানের খ্রিস্টানদের আকৃষ্ট করতে চম্বুকের মতো কাজ করতে শুরু করেছিল।
গলগোথায় কনস্টানটাইনের ব্যাসিলিকার কাজ চূড়ান্তভাবে শেষ হয় ৩৩৫ সালের সেপ্টেম্বরে। পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর সব বিশপীয় এলাকার বিশপদেরকে গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় কর্মকর্তাদের সাথে একত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে উৎসর্গ অনুষ্ঠানে আলিয়ায় তলব করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর কনস্টানটাইন নতুন জেরুসালেম আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র বলে ঘোষণার মাধ্যমে সিজার পদে তার অভিষেকের ত্রয়োদশ বার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ নেন। প্রথমবারের মতো ম্যারটিরিয়ামে বিশিষ্ট তীর্থযাত্রীরা সমবেত হয়। আলিয়ায় তখনো খ্রিস্টানরা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। নতুন জেরুসালেম স্রেফ পৌত্তলিক নগরীতে একটি ছোট ছিটমহল মাত্র, অন্য সব নতুন পবিত্র স্থান সত্যিকার অর্থে নগরীপ্রাচীরের বাইরে ছিল। তবে উৎসর্গ অনুষ্ঠানটি রাজকীয় অনুষ্ঠান হিসেবে ঘোষিত হয়, পরিষ্কার হয়ে যায় যে রোমের আসন্ন ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম।
ইউসেবিয়াস ছিলেন ওই দিনটি প্রচারকারী অনেক বিশপের একজন। তিনি তার ধর্মতত্ত্ব প্রচারের জন্য দিনটিকে ব্যবহার করেছিলেন। খুবই চতুরভঅবে তিনি অনুষ্ঠানে হাজির হতে অসমর্থ্য অনুপস্থিত সম্রাটকে সংশয়মুক্ত করেন যে আলিয়ায় না আসার কারণেই তার খ্রিস্টান বিশ্বাস অসম্পূর্ণ, বিষয়টি এমন নয়। লোগোস নতুন জেরুসালেমের মতো করে খুব সহজেই কনস্টানটিনোপলে তার কাছে যেতে পারে। তিনি তার ধর্মীয় বক্তৃতার পুরোটায় জোর দিয়ে বলেন যে লোগোস দুনিয়াতে নেমে আসে বস্তুগত বিশ্ব থেকে মানুষকে সরিয়ে নিতে। অ্যাথানেসিয়াসকে স্রেফ বরখাস্ত করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইউসেবিয়াস বিশ্বাস করতেন, তার উদার দলটি বিজয়ী হয়েছে। কবরটি সন্দেহাতীতভাবে পবিত্র স্থান ছিল, এর ছিল প্রবল আবেগময় শক্তি। তবে খ্রিস্টানদের কোনোভাবেই এই দেহাবশেষকে পূজা করা বা এটিকে মূর্তি হিসেবে গণ্য করতে পারবে না। তাদেরকে অবশ্যই সবসময় আধ্যাত্মিক বাস্তবতার বাইরে যাওয়ার জন্য নশ্বর প্রতীকগুলোর মাধ্যমে তাকাতে হবে।
তবে ইউসেবিয়াস এখন বুড়ো মানুষ। ৩১৩ সালে তিনি যখন ক্যাসারিয়ার বিশপ হয়েছিলেন তখনই খ্রিস্টান ধর্ম ও জেরুসালেম সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি মানদণ্ডে পরিণত হলেও তারপর থেকে খ্রিস্টানদের জীবনযাত্রা চরমভাবে বদলে গিয়েছিল। একটি পুরো প্রজন্ম এমন এক বিশ্বে বেড়ে ওঠেছিল যেখানে খ্রিস্টানেরা আর নির্যাতিত হচ্ছিল না, সবসময় খ্রিস্টের দ্বিতীয় আবির্ভাবের প্রত্যাশায় থাকত না। তারা রোমান সাম্রাজ্যকে নিজেদের দেশ মনে করত। এটি অনিবার্যভাবে তাদের ধর্মীয় উপলব্ধি বদলে ফেলেছিল। তারা আসমান থেকে নেমে আসা কিছুর জন্য সীমাহীন চাপে থাকার বদলে দুনিয়াতেই ঈশ্বরকে খুঁজতে চাইত। তারা ইউসেবিয়াসের পুরোপুরি আধ্যাত্মিক মতবাদের চেয়ে অ্যাথানেসিয়াসের মূর্তিমান ধর্মতত্ত্বকে অনেক বেশি উপযোগী বিবেচনা করত। তখনো অনেকে অ্যারিয়াস ও ইউসেবিয়াসের খ্রিস্টধর্মকে অগ্রাধিকার দিলেও নিক্যাইয়ার মতবাদগুলোর প্রতি
সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন হয়েছিল। ইউসেবিয়াস ৩৪০ সালে পরলোকগমন করেন। ক্যাসারিয়ার বিশপ হিসেবে তার উত্তরসূরি হন অ্যারিয়ানের অনুসারী। তবে অ্যাথানেসিয়ানের ভক্ত ম্যাক্সিমাস আলিয়ার বিশপ হিসেবে মাকারিয়াসকে স্থলাভিষিক্ত করেন। তার প্রথম কাজ ছিল মাউন্ট সায়নের উপর আপার রুমের পাশে একটি চার্চ নির্মাণ। তিনি কোনো রাজকীয় মঞ্জুরি পাননি, তাকে নিজেই তহবিল যোগার করতে হয়েছিল। ফলে কনস্টানটাইনের জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপনার তুলনায় তারটি ছিল খুবই সাদামাটা। তবে সায়নের ব্যাসিলিকা ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশ্বাস করা হতো যে যিশু এখানেই তার শিষ্যদের কাছে লাস্ট সাপার (শেষ নৈশভোজ) সেরেছিলেন, আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছিলেন এবং পুনরুত্থানের পর আবির্ভূত হয়েছিলেন। অধিকন্তু এখানেই পবিত্র আত্মা (হলি স্পিরিট) আদি প্রচারকদের ওপর নেমে এসেছিল। ফলে আপার রুম ছিল চার্চের জন্মস্থান, অন্য সব চার্চের ‘মা’।
এটি নিশ্চিতভাবেই ছিল সিরিলের দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি ৩৪৯ সালে আলিয়ার বিশপ হয়েছিলেন। তিনি তার ধর্মীয় বক্তৃতায় সাবলীলভাবে জেরুসালেমের প্রতি তার ভক্তি বর্ণনা করতেন। তিনি দাবি করতেন যে পেন্টেকস্টের উৎসবে পবিত্র আত্মা ‘জেরুসালেমের এই নগরীর এখানে নেমে আসে। ফলে চার্চটিকে ‘অন্য সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।’ আলিয়ার বিশপেরা অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনের চার্চটির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে প্রচার চালাতেন। সাইরিল ছিলেন নতুন প্রজন্মের খ্রিস্টানদের একজন। কবরটি যখন খুঁড়ে বের করা হয়, তখন তার বয়স হিল পাঁচ বছর। ফলে জেরুসালেমকে ‘পবিত্র নগরী’ হিসেবে অভিহিত করতে তার কোনো সমস্যা ছিল না। খ্রিস্টের পৃথিবীতে নেমে বেথলেহেমে রক্ত-মাংসের রূপ নিয়েছিলেন, তিনি গলগোথার উপর বিশ্বকে উদ্ধার করেন, মাউন্ট অলিভেস থেকে স্বর্গে আরোহণ করেন, আপার রুমে শিষ্যদের প্রতি পবিত্র আত্মা অবতরণ করান। এই নগরী যখন বিশ্বের পাপমুক্তি প্রত্যক্ষ করেছে, তখন কিভাবে তা পবিত্র না হয়ে থাকতে পারে। ক্রুশবিদ্ধকরণের কারণে নগরীটি অপরাধী নয় : ক্রশ কোনো লজ্জা বা অপমান নয়, বরং জেরুসালেমের ‘গৌরব’ ও ‘মুকুট’।২৮ ইউসেবিয়াস চাইতেন ক্রসকে অগ্রাহ্য করতে। কিন্তু সাইরিল যিশুর দৈহিক মৃত্যুকে এর নিজ অধিকারবলেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখেছিলেন। ক্রসটি ছিল পাপমুক্তির ভিত্তি, আমাদের বিশ্বাসের নির্যাস, পাপের অবসান। টেম্পলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ঈশ্বর, নগরীকে নয়। তিনি জেরুসালেমকে নয়, কেবল ইহুদিদের নিন্দা করতেন। এই নতুন ইতিবাচক ধর্মতত্ত্ব এখনো পুরনো প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকারকে ধারণ করে একে নতুন জটিলতায় ফেলেছিল। সাইরিলের কাছে জেরুসালেম কোনো অপরাধী নগরী ছিল না : তিনি নগরী থেকে অপরাধের বোঝা দূর করে তা পুরোপুরি ইহুদিদের কাঁধে চাপিয়ে দেন।
ইউসেবিয়াসের বিপরীতে সাইরিল বিশ্বাস করতেন যে খ্রিস্টের মানবতার ধর্মীয় মূল্য রয়েছে। এটি অবজ্ঞা করার কিংবা লোগোসের আধ্যাত্মিক নির্যাস কামনা করার কোনো প্রয়োজন নেই। কায়া ধারণ করে ঈশ্বর স্বেচ্ছায় ও স্থায়ীভাবে নিজেকে মানবজাতির সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। মানুষ হিসেবে যিশুর ভাবমূর্তি আমাদের প্রতি ঈশ্বরের শ্বাশত অবস্থান প্রকাশ করেছে। বস্তুগত দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করার কোনো প্রয়োজন নেই; আপনি ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য সত্যিই একে ব্যবহার করতে পারেন। অর্থাৎ সাইরাল বিশ্বাস করতেন যে জেরুসালেমের পবিত্র স্থানগুলো, তিনি কখনো একে আলিয়া বলেননি, খ্রিস্টানদেরকে ঐশী সত্তার সংস্পর্শে নিয়ে আসতে পারে। অনেক স্থানে ঈশ্বর আমাদের দুনিয়াকে স্পর্শ করতে পারে। ফলে এগুলোর আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে। এগুলো তাদের ও যিশুর জীবনের মধ্যকার সময়ের প্রতিবন্ধকতা না হলেও স্থানের বাধা ভেঙে খ্রিস্টানদেরকে ঈশ্বরের সাথে যোগসূত্র সৃষ্টি করেছিল। সাইরিল ‘আমরা এখন যে নগরীতে বাস করছিল সেখানেই ঘটা ঘটনাগুলোর ওপর জোর দিতে পছন্দ করতেন। ২৯ পেন্টেকস্টোকে আত্মার নেমে আসার ঘটনা ঘটেছিল তিন শ’ বছর আগে। তবে অন্য দিক থেকে বলা যায়, এটি জেরুসালেমে ‘আমাদের মধ্যে’ ঘটেছিল।
৩০ খ্রিস্টানেরা যখন যিশুর স্পর্শযুক্ত বস্তুগুলোর- ক্রুশ, কবর, তারা ঠিক যে স্থানে দাঁড়াত- সংস্পর্শে আসত, তারা অনুপস্থিত খ্রিস্টের বছরগুলো অতিক্রম করে যেতে পারত। সাইরিল বলতেন, ‘অন্যরা কেবল শোনে, কিন্তু আমরা দেখি ও স্পর্শ করি। ৩১ যিশুর পদাঙ্ক আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করে, তিনি যেসব স্থানে হাঁটাহাটি করতেন, সেসব স্থানে চলাফেরা করে তীর্থযাত্রীদের কাছে যিশুর জীবনের সুদূর অতীতের ঘটনাগুলো বর্তমান বাস্তবতায় পরিণত হতো। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, খ্রিস্ট একক স্থানে সীমিত ছিলেন না; খ্রিস্টানেরা বিশ্বের যেকোনো স্থানে তার উপস্থিতি অনুভব করত। তবে পবিত্র স্থানগুলো সফর তাদেরকে এমন এক স্থানে দাঁড়ানোর সক্ষমতা দিত যা ঐশী উপস্থিতি তখনো ধারণ করে ছিল
নতুন জেরুসালেম নিশ্চিতভাবেই ইহুদিদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক ছিল। উগ্র একটি ছোট গ্রুপ হয়তো পবিত্র ভূমিতে এই খ্রিস্টান ভবন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল।৩২ সম্ভবত অবিশ্বাস্য ছিল যে ইহুদি ধর্মের একটি অকূলীন ও ধর্মচ্যুত রূপ এখন রাজকীয় সমর্থন পাবে। তারা আলিয়া ক্যাপিটোলিনায় নির্মাণ প্রতিরোধে মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সম্রাটদের কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করার পর থেকে এবং কনস্টানটাইনের আগে পর্যন্ত এমন হওয়া অসম্ভব ছিল না যে রোমানরা একদিন তাদেরকে টেম্পলটি পুনঃনির্মাণের অনুমতি দেবে। তবে এসব নতুন খ্রিস্টান ভবনগুলো জেরুসালেমের ভেতরে ও আশপাশে হওয়ায় এই বাস্তবতা সৃষ্টি করেছিল যে অসম্ভব না হলেও ভবিষ্যতের সম্রাট জেরুসালেমকে ইহুদি জনগণের কাছে ফেরত দেবেন। কনস্টানটাইন এমনকি ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠতাপূর্ণ গ্যালিলিতে একটি নির্মাণ প্রকল্প সূচনা করেছিলেন। এছাড়া সেফোরিস, তাইবেরিয়াস, ক্যাপারনাম ও নাজারেথে মিশনারি আগ্রাসন চালানো হয়েছিল। অনেক ইহুদি চরম হতাশায় ভুগত; অন্যরা মেসাইয়ার অপেক্ষায় থাকত। অবশ্য বেশির ভাগ রাব্বি মধ্যপন্থার প্রচার অব্যাহত রেখেছিলেন। তারা অতীতে রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেষ্টার সময় ইহুদি জাতির ওপর নেমে আসা বিপর্যয়ের বিষয়টি লোকজনকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। খ্রিস্টধর্মের প্রতি এই অদ্ভূত রাজকীয় অগ্রাধিকার স্রেফ সাময়িক উৎসাহ হতে পারে।
সাইরিলের খ্রিস্টান-সম্পর্কিত ধর্মতত্ত্ব জেরুসালেমে অর্থোডক্স ভক্তি প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানেও তা অটুট রয়েছে। জেরুসালেম আর অপরাধী নগরী হিসেবে থাকল না : ক্রুশ এখন খ্রিস্টান পবিত্র নগরীর ‘গৌরব’ ও ‘মুকুট’ বিবেচিত হতে লাগল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও খ্রিস্টান সম্রাটদের অধীনে ইহুদিদের অবস্থান অব্যাহতভাবে খারাপ হতে থাকে। কনস্টানটাইন নিজে ইহুদি লোকজনকে নির্যাতন করার জন্য নতুন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তবে ৩৩৭ সালে তার মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে আন্তঃবিবাহ নিষিদ্ধ করে নতুন আইন জারি করেন, ইহুদিদের দাসের মালিক হওয়া নিষিদ্ধ করেন। ইহুদিদের বিচ্ছিন্ন করা ও ইহুদি শিল্পকে পঙ্গু করার লক্ষ্যে এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। ৩৫১ সালে সেফোরিস, তাইবেরিয়াস ও লিড্ডার ইহুদিরা বিদ্রোহ করে। তবে রোমানরা তাদের মানবিকভাবে দমন করে। ৩৫৩ সালে দ্বিতীয় কনস্টানটিয়াস নতুন আইন করে খ্রিস্টানদের ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত হওয়া নিষিদ্ধ করেন, ইহুদিদের ‘বর্বর’, ‘ঘৃণ্য’ ও ‘ঈশ্বর অবমাননা’ হিসেবে অভিহিত করে সম্রাটের সরকারি আইন গ্রন্থের সূচনা করেন।৩৪ যিশু ভালোবাসা ও ক্ষমার ধর্ম প্রচার করেছিলেন। কিন্তু এখন খ্রিস্টানেরা ক্ষমতায় এসে ইহুদিদেরকে সমাজের শত্রু হিসেবে কলঙ্কিত করে উপস্থাপন করে, তাদেরকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়, একসময় খ্রিস্টানেরা যেমন অচ্ছ্যুত ছিল, তেমন অবস্থায় পরিণত করে।
ইহুদিদের অবস্থান নিরাশায় ভরা বলে মনে হলো। খ্রিস্টানেরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের আলোকে নিজেদের উপযুক্ত করে নিলো, নিজদেরকে নতুন ইসরাইল হিসেবে অভিহিত করল, রাজকীয় তহবিলপুষ্ট নির্মাণ কর্মসূচির মাধ্যমে ইহুদি পবিত্র নগরী নিজেদের করে নিতে থাকল। খ্রিস্টানদের সাথে বিতর্ককালে এক ইহুদি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমাদের সবকিছু তোমরা নিয়ে সেগুলোকে তোমাদের করছ কেন?’৩৫ তারপর হঠাৎ করেই পরিত্রাণ হাতের মুঠোয় বলে মনে হলো। ৩৬১ সালে দ্বিতীয় কনস্টানটিয়াস মারা যান, তার উত্তরসূরি হন তার ভাতিজা জুলিয়ান।
জুলিয়ান খ্রিস্টান হিসেবে বেড়ে ওঠেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত নতুন ধর্মটির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন। তার মতে নতুন ধর্মটি রোমের সবচেয়ে পবিত্র ঐতিহ্যগুলোর প্রতি অনিষ্টকর। সাম্রাজ্যকে সঙ্ঘবদ্ধ করার শক্তি হিসেবে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপারে কনস্টানটাইনের দর্শনটির প্রতি চরমভাবে বৈরী হয়ে তিনি এখন আবেগপূর্ণভাবে পুরনো পৌত্তলিক ধর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। তিনি একা ছিলেন না। পৌত্তলিকতাবাদ তখনো সজীব ছিল, শক্তিশালী ছিল, পঞ্চম শতক পর্যন্ত সাম্রাজ্যজুড়ে বিকশিত হওয়া অব্যাহত রেখেছিল। পুরনো দেবদেবী ও প্রাচীন শাস্ত্রাচারের প্রতি ভালোবাসায় থাকা অনেকের কাছে জুলিয়ানের মতোই মনে হয়েছে যে পবিত্র ঐতিহ্যগুলোর প্রতি খ্রিস্টধর্ম প্রকাশ্যভাবে দূষণ সৃষ্টিকারী। পুরনো ঈশ্বরেরা যথাযথ সম্মান না পেলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলেও ব্যাপকভাবে উদ্বেগ ছিল। তাই পুরনো বলি প্রথা ও পবিত্র বিধিবিধান অবশ্যই পালন করা উচিত বলে তারা মনে করত। অধিকন্তু, পৌত্তলিকেরা যিশুর প্রতি খ্রিস্টান বিশ্বাসে মনোকষ্ট পেত। যে লোকটি লজ্জাজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে তাকে ঐশী সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা পবিত্রতা-সম্পর্কিত তাদের নিজস্ব ধারণার সাথে চূড়ান্ত রকমের সাংঘর্ষিক ছিল। ফলে নতুন সম্রাট যখন তাদের পিতৃপুরুষদের প্রাচীন ধর্মটি রোমান বিশ্বে এর যথাযথ স্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করলেন, তখন তিনি তার প্রজাদের মধ্যে থাকা বিপুল আগ্রহী সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে পেরেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ইহুদিরা প্রথমে মনে করেছিল, এই পৌত্তলিক শাসকের কাছ থেকে তাদের সামান্যই পাওয়ার আছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে জেরুসালেমের ব্যাপারে জুলিয়ানের বিপ্লবী পরিকল্পনা রয়েছে।