দালালদের বজ্জাতি
সনাতন পুণ্যতীর্থ কাশী শহরের নাম সবাই শুনেছেন কিন্তু যা শোনেননি তা হল এখানকার এক কিসমের১ লোকেদের কথা। শহরের লোকজন আর তীর্থযাত্রীদের লুট করাটাই যাদের পেশা। বেলাগাম লুচ্চামি যাতে চালানো যায় তার জন্য চলত বেশি বেশি করে চুরি ছিনতাই। গরিব হোক বা দৌলতমন্দ, রেহাই মিলত না কারও। এমন কোনও হুদ্দা২ ছিল না যেখানে তাদের দাপট নেই। ছোটখাটো সরকারি কর্মচারীদের মিলত বখরা। কখনও কাঁচা টাকায় কখনও আবার অন্য কোনও রকমে। মালদার বাবু, নেওয়াপাতি মহাজন, উকিল, আমলা, মুনসেফ মায় সদর আমিনেও ছিল তাদের রবরবা। কাজ আদায় করতে যখন যেমন তখন তেমন—কখনও হুমকি কখনও বা দস্তুরি। আমার ইশারা হল সেইসব পান্ডা, গঙ্গাপুত্র, ঘাটিয়া, ভড়ুয়া (Bhurureahs) আর দালালদের দিকে যারা শহরে দাপিয়ে বেড়াত। কাশী শহরকে এরা বানিয়ে তুলেছিল দোজখ। এদের নকাব খোলার পাশাপাশি আমি চাই সেইসব খাস আদমিরও পহেচান হোক যাদের স্রেফ কানুনই পারে শায়েস্তা করতে। কানুনের চোখে যারা ধুলো দিচ্ছে তাদের কাঠগড়ায় হাজির করতে পারলেই আমি ধরে নেব আমার কাম খতম।
আপনি গেছেন চৌক। চাইছেন মামুলি কোনও সামান খরিদ করতে। আপনার মনে ধরল হয়তো একটা শাল কিংবা এক জোড়া জুতো। দেখবেন গায়ের সঙ্গে লেপটে গেছে এক ব্যাটা দালাল। কোনও মালের তারিফ করছে আবার কোনও মালকে বলছে ফালতু। হাঁক ডাক আর দরদস্তুর করে কমিয়ে ফেলেছে দাম। আপনি হয়তো ভাবছেন কে এই আনজান মুসাফির আপনার মদতে লেগে পড়েছে। খুব ঠান্ডা মেজাজে সে আপনাকে বলবে কিছু খরিদ করতে চাইলে বান্দা হাজির। আপনি খরিদ্দারি করে ঘরে ফিরবেন। ভাবতে বসবেন কেন এই মেহেরবানি। এবার নকাব হটালেই মালুম হবে ওই মেহেরবান আর দোকানির একটা সমঝোতা আছে। লোকটা আসলে দালাল। দরাদরি করে ততটাই দাম কমিয়েছে যাতে নিজের দস্তুরিটা ঠিক থাকে। মালটার আসল দাম আর যে দামে বেচা হল সেই ফারাকটাই হচ্ছে দালালের হক। সওয়াল করাই যায় দোকানি কেন পুরো মুনাফাটা রাখল না। আমি বলব তেমনটা সম্ভব নয়। বখরা দিতে না চাইলে দালালরা এক জোট হয়ে কারবার বরবাদ করে ছাড়বে। খরিদ্দারদের জবরদস্তি ঠেকিয়ে রাখা হবে। কার হিম্মত আছে দিনের পর দিন জুলুম বরদাস্ত করে। সরকার কেন কোনও কানুনি কারর্বাই করছে না। যারা ফেরেব্বাজির শিকার তারাই বা কেন যাচ্ছে না হাকিমের কাছে। কেউ কেউ কোশিশ করেছে। দু’-একটা মামলায় জিত যে হয়নি তাও না। কিন্তু বেশির ভাগ মামলাতেই ঠোস সাবুদ দাখিল করা যায়নি তখন সবটাই বরবাদ। ইনসাফ এক কথা আর কানুনি সাবুদ-ইশাদি আর এক কথা। ইনসাফের দোহাই দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পারেন কাউকে সাজা শোনাতে। কিন্তু গুনাহগারের সুযোগ থেকেই যায় আরও উঁচু আদালতে আর্জি জানানোর। সেখানে জজ সাহেব কী রায় দেবেন তা ঠিক হয় সাক্ষী সাবুদের উপর। চলুন এই দালালদের আরও কিছু কারবারের নমুনা পেশ করা যাক।
সব থেকে বড় না হলেও বেনারসের পাইকারি বাজারের ভিতর ত্রিলোচন বাজারের মরতবা (martaba) কিছু কম নয়। বাজারটা বরুণাসঙ্গম ঘাট আর শহরের মাঝামাঝি। এখানেও চলে দালালদের দাপাদাপি। দালালদের মুরুব্বি হল বিশ্বেশ্বর সিং। ঘাটে এসে ভিড়ল নাও। নাওয়ের সওদা নিয়ে দরদামও হল, বিশ্বেশ্বর এবার হেঁকে বসবে তার বখরা। গঞ্জের মালিক হয়তো ঠিক করেছে সে সরাসরি সওদাটা করবে। কিন্তু তার সে হক নেই। বিশ্বেশ্বর তার লোকেদের নিয়ে জুড়বে ফ্যাসাদ। তারপর নিজেই ছুটবে থানায় নালিশ করতে। গঞ্জের মালিক শেখ চাইলা (Seikh Chailah) বহুত সেয়ানা আর হুঁশিয়ার। সেও ঠিক মওকা মাফিক দায় এড়াবে। তখন বিশ্বেশ্বর ঘাপটি মেরে থাকবে কবে সেই হুকুমত পালটায়। নতুন কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বহাল হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে লম্বা পিটিশন নিয়ে। তার কথায়, গঞ্জ হল আম-আদমির আমানত। আগের হাকিম তাই মকুব করেছিল সব রকমের মাশুল। তাঁর হুকুমে নিজেদের মর্জিমাফিক লোকরা মাল বেচাকেনা করত। ব্যাপারীরা বড় বড় নাও বোঝাই করে সওদা নিয়ে আসে শহরে বেচবে বলে। শেখ চাইলার জবরদস্তিতে তারা মাল খালাস করতে পারে না। ব্যাপারীর কাছে সে এত বেশি দস্তুরি হাঁকে যে মাল ত্রিলোচনের গঞ্জে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকে। এর উপর আবার শেখকে মনপিছু মালে একটা বাঁধা পড়তা দিতে হয়। ব্যাপারীদের নাম করে এইরকম হাজার হাজার আর্জি জমা পড়ে।
এইসব ফরিয়াদের পালটা হিসাবে শেখ চাইলা জানায়, সে তো ত্রিলোচন বাজারে একজন গঞ্জ মালিক মাত্র। দূর-দূর জেলার ব্যাপারীদের সে আগাম দাদন দেয় যাতে বাজারে তারা সওদা পাঠায়। তাদের নাওগুলো পাহারার জন্য সেই ঠিক করে চৌকিদার। তারই গঞ্জে জমা থাকে ব্যাপারীদের সওদা। মালের জামিন বাবদ সেই লগ্নি করে টাকা। এক কথায় শেখই হল একজন বড় দালাল। তাই ব্যাপারীদের কাছ থেকে মেলে তার দালালি। এই কারবার আপসে হয় আর বহুদিন ধরেই হয়ে আসছে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চাইলেন পুরো মামলটা তজবিজ (tajviz) করে দেখা হোক।
তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট-র উপর হুকুম হল সরেজমিনে যাও। আর্দালি হিসাবে আমিও চললাম তাঁর সঙ্গে। বাজারে পা দিতে না দিতেই একপাল লোক এসে ছেঁকে ধরল। “কোম্পানি কা দোহাই! সাহেব সিস্টেন্ট কা দোহাই।” ছোট সাহেব হকচকিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন, এরা কী চায়? “দোহাই! দোহাই! লুট গয়ে হাম, শেখ চাইলা আমাদের বরবাদ করেছে।” হট্টগোলে শুধু এটুকুই শোনা গেল। আমার কাছে জানতে চাইলে বুঝলাম সাহেব কত সেয়ানা। “পাঁচকড়ি এই লোকগুলোর কি বিমার হয়েছে যে দাওয়াই চাইছে? আমার কাছে না চেয়ে তা হলে হেকিমের কাছে যাক!” আমি খুব আদবের সঙ্গে জবাব দিলাম, “হুজুর এদের বিমার হয়নি আপনার কাছে এরা বিচার চাইছে তাই বলছে দোহাই।” সাহেব বললেন, “আরে! দোহাই আর দাওয়াই তো একই হল। গরিবের তো দুটোরই দরকার পড়ে। মুনশি আর্জি পড়।” কম বেশি পঞ্চাশটা আর্জি পড়া হল, তাদের নাম ডাকা হলে তারা এগিয়ে এল সামনে। সাহেব সিস্টেন্ট এদিক ওদিক তাকিয়ে কতটা হয়রান হবেন সেই কথা ভেবে লম্বা লম্বা হাই তুলতে শুরু করলেন। আমি চুপিচুপি তাঁকে বললাম, “জনাব-ই-আলি একবার দয়া করে জানতে চাইবেন এই লোকগুলোই আসল ব্যাপারী তো? এই খাদিমের শক বদমাশগুলো আসলে দালাল।” সাহেব ইশারাটা বুঝলেন। তারপর শুরু করলেন নিজেই সওয়াল করতে। তুম কোন হ্যায়? দালাল হ্যায় খোদাবন্দ। তাজ্জব কী বাত। যে ব্যাপারীদের উপর জুলুম হয়েছে তারা কোথায়? দারোগা হটাও এই বদমাশগুলোকে। তলব কর আসল ব্যাপারীদের। খোদ ব্যাপারীরাই অনেকে এবার এগিয়ে এল। সাফ জানাল শেখ চাইলার খিলাফ কোনও নালিশ তারা রুজু করেনি। রেওয়াজ মাফিক যে দালালি তাকে দেওয়ার কথা সেটাই শুধু দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ বজ্জাতি করে থাকে সে হল বিশ্বেশ্বর সিং আর তার দালালরা। সাহেব সিস্টেন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হকিকত১ বয়ান করলেন। আর হুজুর দাখিল দফতর করলেন মামলা।
আপনারা জানতে চাইবেন আসল বদমাশ বিশ্বেশ্বর সিং-এর কেন সাজা হল না? কারণটা খুবই সোজা। তাকে সাজা শোনালে সে গিয়ে হাজির হত সাহেব আলি জা (Saheeb Allee Jah) জজের দরবারে। পঞ্চাশ জন ইশাদিকে খাড়া করে সাবিত করত তার দাদা-পরদাদার আমল থেকেই নাও প্রতি দস্তুরি নেওয়ার রেওয়াজ চালু। আসল বজ্জাত হচ্ছে গঞ্জের মালিক, আরও কত কী। তখনই পালটে যেত ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম। বেশক ইনসাফ চাই কিন্তু ইনসাফ পেতে হলে দিতে হবে কানুনি সাবুদ, তাই না?
কোম্পানি বাহাদুরের আদালতে একটা হাদসা হয় যেটার কথা এই বাহানায় বলে ফেলি। মোরাদাবাদে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আজ থেকে ২৫ বছর আগে হাজির হল এক আফগান সঙ্গে তার হিন্দুস্তানি নোকর। এই নোকর যখন তার পয়সা চুরি করছিল তখন সে তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। রেওয়াজ মাফিক নোকর সে কথা কবুল করতে নারাজ। ম্যাজিস্ট্রেট আফগানকে বললেন, তুমি নালিশ করেছ ঠিকই কিন্তু তোমার সাবুদ কোথায়। মুঘল এই কথা শুনে একটু থমকে গেল। তারপর নোকরকে আচ্ছা করে পেটাতে পেটাতে বলতে লাগল, “তুই যখন আমার লুঠছিলি তখন কেন তার সাক্ষী রাখিসনি” ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর এই ইশারাটা ধরতে পেরেছিলেন কি না আমি জানি না।
১. কিসম: রকম, প্রকার
২. হুদ্দা: এলাকা
১. হকিকত: আসল ঘটনা