দাক্ষিণাত্যের উত্থান – আনুমানিক ৯০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ
বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষের এই ধারা চলেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে চোলরা প্রাধান্যলাভ করলেও প্রতিবেশি রাজ্যগুলো সবসময়ই তাদের বিব্রত রেখেছে। পল্লব রাজারা নবম শতাব্দীতে তাদের রাজ্যের দক্ষিণদিকের প্রতিবেশী পাণ্ড্যরাজ্য ও অধীনস্থ চোলদের আক্রমণে শেষপর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে। ৩০০ বছর ধরে পল্লবরা চোলরাজ্যের সামন্তরাজা হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজার রাখার পরে একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়। এই ৩০০ বছর ধরে চোলরা ক্রমাগত যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ-ভারতের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। চোলদের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ক্ষীয়মাণ রাষ্ট্রকূট বংশ এবং তারপর তাদের জায়গায় পুনরুজ্জীবিত চালুক্য বংশ। এই চালুক্যরা ‘পরবর্তী চালুক্য’ হিসেবে পরিচিত ও এদের রাজ্য ছিল পশ্চিম-দাক্ষিণাত্যে। এই যুগের দক্ষিণ-ভারত সমক্ষমতাসম্পন্ন বহু ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এবং একসময়ে এদের সকলের সঙ্গেই চোলরাজ্যের যুদ্ধ চলছিল। চোলদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছিল ‘পরবর্তী চালুক্যরা,’ দেবগিরির (ঔরঙ্গাবাদ অঞ্চল) যাদবরা, ওয়ারঙ্গলের (অন্ধ্র) কাকতীয়রা ও দোরসমুদ্রের (মহীশূর) হোয়সলরা। রাজত্বের শেষদিকে হোয়সল ও পাণ্ড্যদের নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণে চোলরা হৃতশক্তি হয়ে পড়ল।
কেবলমাত্র চোলরাজবংশের পরাক্রমই দাক্ষিণাত্যের উত্থানের একমাত্র কারণ নয়। এই সময়ে তামিল সংস্কৃতি দানা বেঁধে উঠেছিল। সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধর্ম বা শিল্পকলায় এ যুগে যে উন্নতি হলো, তাকে ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই যুগের রীতিনীতি পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যের জীবনরীতিকে প্রভাবিত করেছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তনও এনে দিয়েছিল (তবে পশ্চিম-দাক্ষিণাত্যে এই প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি)। এই যুগেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চোল-সংস্কৃতির প্রসার হয়। এই অঞ্চলের রাজনীতিতে দক্ষিণ-ভারতের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ ও আগের যুগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে তামিলনাদে চোলরা গোষ্ঠীপতি হিসেবে শাসন করা শুরু করেছিল। নবম শতাব্দীর মধ্যভাগ চোল বংশের এক গোষ্ঠীপতি তাঞ্জোর অঞ্চল (তামিলনাড়ুর কেন্দ্রীয় অঞ্চল) অধিকার করে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি আপন মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে নিজেকে সর্যবংশজাত বলে দাবি করলেন। ৯০৭ খ্রিস্টাব্দের চোলবংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা প্রথম পরন্তুক সিংহাসনে বসেন। তিনি পাণ্ড্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে পাণ্ড্যদের রাজধানী মাদুরা অধিকার করে নিজের রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তকে সুরক্ষিত করলেন। পাণ্ড্যদের সঙ্গে সিংহলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং পাণ্ড্যদের পরাজয়ের ফলে সিংহল ও তামিলনাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হলো তা কয়েক দশক ধরে চলেছিল। পরন্তকের রাজত্বকালের শেষদিকে রাষ্ট্রকূটদের হাতে চোলরা পরাস্ত হয় এবং চোলরাজ্যের উত্তরাংশের কয়েকটি জেলা রাষ্ট্রকূটরা দখল করে নেয়। এরপর ৩০ বছর ধরে কয়েকজন দুর্বল রাজার রাজত্বে চোলরা হৃতশক্তি হয়ে পড়ল। কিন্তু ওদিকে রাষ্ট্রকূটরা চালুক্যদের আক্রমণে বিব্রত হয়ে পড়ল এবং এই সুযোগে হৃত অঞ্চলগুলো চোলরা পুনরুদ্ধার করল। রাজা প্রথম রাজরাজ (৯৮৫–১০১৪ খ্রিস্টাব্দ) ও তাঁর ছেলে রাজেন্দ্রর ৫০ বছর যাবৎ রাজত্বকালে চোলরাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠল।
পিতাপুত্রের রাজত্বকালে নানাদিকে বহু যুদ্ধাভিযান ঘটেছিল। রাজরাজ আক্রমণ করলেন কেরল, সিংহল ও পাণ্ড্যরাজ্যের সম্মিলিত শক্তিকে। এই তিনটি রাজ্য পশ্চিমজগতের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। আরবরা ততদিনে পশ্চিম-উপকূলের ব্যবসায়ী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কেরলের রাজারা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে আরবদের প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্যে চোলরা মালাবারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিল। পরে রাজরাজ আরব- বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র মালদ্বীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে নৌ-আক্রমণ চালান। আরব ব্যবসায়ীদের একেবারে উৎখাত করতে না পারলেও সিংহলে চোলরা বিধ্বংসী আক্রমণ চালিয়েছিল। রাজধানী অনুরাধাপুর ধ্বংস করে চোলরা পোলারুবা-য় নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করল। অন্যদিকে দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছিল। বেঙ্গি ছিল একটি সমৃদ্ধ প্রদেশ। আগের যুগে বেঙ্গির দখল নিয়ে পল্লব ও চালুক্যদের যুদ্ধ হয়েছিল। পরের যুগে আবার যুদ্ধ বাধল ‘পরবর্তী’ চালুক্য ও চোলদের মধ্যে।
প্রথম রাজেন্দ্র তাঁর পিতার সঙ্গে যৌথভাবে দুবছর রাজত্ব করার পর ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে নিজেই সিংহাসনে বসেন। তিনি চালুক্যদের রাজ্যের দক্ষিণাংশ (আধুনিক হায়দ্রাবাদ অঞ্চল) দখল করে রাজ্যবিস্তার অভিযান অক্ষুণ্ণ রাখলেন। সিংহল ও কেরলের বিরুদ্ধেও আবার অভিযান শুরু হলো। এরপর রাজেন্দ্র উত্তর-ভারত ও গাঙ্গেয় উপত্যকা জয় করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁর সেনাবাহিনী উড়িষ্যা অতিক্রম করে গঙ্গার তীরে গিয়ে পৌঁছল। গঙ্গার পবিত্র জল রাজধানীতে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু রাজেন্দ্র উত্তর-ভারতীয় অঞ্চলগুলো বেশিদিন অধিকারে রাখতে পারেননি। এদিক দিয়ে প্রায় ৭০০ বছর আগে সমুদ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্য অভিযানের সঙ্গে রাজেন্দ্রর উত্তর-ভারত অভিযান তুলনীয়।
এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রীবিজয় রাজ্যের বিরুদ্ধে তিনি নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। বলা হয়, রাজেন্দ্র বিদেশেও সাম্রাজ্য-বিস্তারের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু একথা সত্যি হলে এই অভিযানের পর সেখানে ভারতীয় উপনিবেশ স্থাপন করা হতো এবং উপকূল থেকে অভ্যন্তরে আরো অঞ্চল জয় করার প্রচেষ্টা হতো। যেহেতু তেমন কিছুই করা হয়নি, সেজন্যে মনে হয় ভারতীয় বাণিজ্যিক স্বার্থকে সুরক্ষিত করার জন্যেই যুদ্ধ চালোনা হয়। দশম শতাব্দীতে দক্ষিণ-ভারত ও চীনের মধ্যে রীতিমতো বাণিজ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজগুলো শ্রীবিজয় রাজ্যের (দক্ষিণ-মালয় উপদ্বীপ ও সুমাত্রা) সংলগ্ন সমুদ্রপথ দিয়ে চীনে যেত। শ্রীবিজয় রাজ্য বুঝতে পারে যে, ভারতীয় জাহাজের পণ্যসামগ্রী তাদের রাজ্যে নামিয়ে নিয়ে যদি শ্রীবিজয়ের ব্যবসায়ীরা ওই পণ্য চীনে নিয়ে যায় তাদের পক্ষে তা খুবই লাভজনক হবে। এরপর শ্রীবিজয়ে ভারতীয় বণিকদের নানাভাবে ভয় দেখানো হতে লাগল। এই অবস্থা দেখে চোল-রাজারা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। এই বাণিজ্যে তাঁদেরও অংশ ছিল বলে মনে হয়। এরপরই চোলরা শ্রীবিজয় আক্রমণ করল। শ্রীবিজয় রাজ্য নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যেই চীন-ভারত বাণিজ্যে হস্তক্ষেপে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সামরিক শক্তি দিয়েই এই বিবাদের শেষ মীমাংসা হয়। চোলদের অভিযানের ফলে মালাক্কা প্রণালীর কয়েকটি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান চোলদের অধিকারে এলো। এইভাবে অন্তত কিছুদিনের জন্যে শ্রীবিজয় রাজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতীয় জাহাজ নিরাপদে চীনে পণ্যসামগ্রী নিয়ে যেতে সমৰ্থ হয়েছিল।
প্রথম রাজেন্দ্রের পরবর্তী রাজারা ভারতীয় উপদ্বীপের মধ্যেই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। বেঙ্গি প্রদেশ নিয়ে চালুক্যদের সঙ্গে আবার যুদ্ধ শুরু হলো। দুই রাজ্য একে অপরের ওপর বিদ্যুৎগতি আক্রমণ করে এলাকা দখল করার চেষ্টা করতে লাগল। এরকম একটি আক্রমণের দ্বারা চোলরা কল্যাণীতে চালুক্য রাজধানী লুন্ঠন করে নিল। আবার, ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে চালুক্যরাজা এর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। চোলরাজা প্রথম কুলোত্তুঙ্গের রাজত্বকালে (১০৭০- ১১১৮ খ্রিস্টাব্দে) দুই রাজ্যের সংঘর্ষ তত তীব্র রইল না। এর কারণ হলো, রাজার মা ছিলেন চালুক্য বংশজাত। এবং এর ফলে দুই রাজ্যের সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। দক্ষিণের পুরনো শত্রু পাণ্ড্য, কেরল ও সিংহলের সঙ্গে যুদ্ধে জারি রইল। শ্রীবিজয় রাজেন্দ্রের হাতে পরাজয়ের আঘাতে তখনো ম্রিয়মান ছিল। সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ফলে দক্ষিণ-ভারতের বাণিজ্যিক উন্নতি ঘটে। চীনের সঙ্গে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হলো। রাজা কুলোত্তুঙ্গ ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে চীনে ৭২ জন ব্যবসায়ীর এক প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে চোলদের গৌরবের দিনের সমাপ্তির সূচনা হলো। প্রতিবেশীরা চোলরাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো দখল করে নিতে লাগল। কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে সামন্তরাজারা শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহে চোল রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ছিল। প্রকৃতপক্ষে চোলরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে নিজেদের স্থায়িত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল। এছাড়া চালুক্যদের শক্তি খর্ব করার ফলে চালুক্যরাজ্যের সামন্তরাজারা শক্তিশালী হয়ে উঠল। তাঁরা এবার নিজস্ব রাজ্য স্থাপন করে চোলদের পাল্টা আক্রমণ করল।
এবার সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল যাদব, হোয়সল ও কাকতীয়রা। যাদবরা ছিল দাক্ষিণাত্যের উত্তরাংশে এবং চোলদের পতনের মূলে এদের ভূমিকা সামান্যই। হোয়সল ও কাকতীয়রা দ্বাদশ শতাব্দীর পর থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কাকতীয়রা চালুক্যদের কাছ থেকে নিজেদের স্বাধীনতা আদায় করেছিল। চোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়া এরা নিজেদের স্বাধীনতা ভোগেই ব্যাপৃত ছিল। হোয়সলরা পশ্চিম দিক থেকে চোলদের আক্রমণ করল। কিন্তু চোলরা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে পেরেছিল। কিন্তু তাদের পুরনো শত্রু পাণ্ড্যরা এই সুযোগে আবার যুদ্ধ শুরু করল। ফলে, চোলরা একই সঙ্গে রাজ্যের দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশে দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।
হোয়সলদের উত্থানের সঙ্গে এই যুগ ও পরবর্তী যুগের দাক্ষিণাত্যের আরো কয়েকটি রাজবংশের উত্থানের মিল আছে। হোয়সল বংশ ছিল পার্বত্য উপজাতিভুক্ত। দস্যুতা করে এরা অর্থপার্জন করত। ওই পার্বত্য অঞ্চলে দস্যুতার যথেষ্ট সুযোগও ছিল। বিভিন্ন রাজবংশের পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্যে উপজাতীয়রা নিজেদের একজন উপযুক্ত নেতার প্রয়োজন অনুভব করছিল। এদের সাহায্যেই হোয়সলরা পাহাড় থেকে সমভূমিতে নেমে আসতে থাকে। এখানে নিয়মিত কর আদায় করেও তাদের ভালো অর্থাগম হচ্ছিল। উপজাতীয়দের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্যে সমভূমির মানুষ তাদের প্রচুর অর্থ দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করল। করপ্রদান থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য সৃষ্টি হলো এবং এইভাবে পার্বত্য উপজাতীয় নেতারা ছোট ছোট রাজ্যের রাজা হয়ে বসল। তবে এরকম সবকটি রাজবংশ বেশিদিন টেকেনি। প্রতিবেশী বৃহৎ রাজ্যগুলো এদের অধিকার করে নেবার চেষ্টা করত। তা সত্ত্বেও যারা টিকে গেল তারা পরে আরো শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হলো।
হোয়সলদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন বিষ্ণুবর্ধন। তিনি দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজত্ব করেন। তখন অবশ্য তত্ত্বগতভাবে হোয়সলরা চালুক্যদের সামন্তরাজা। হোয়সল রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল মহীশূরের কাছে দোরসমুদ্র। বিষ্ণুবর্ধন ধীরে ধীরে শক্তিসঞ্চয় করতে লাগলেন। ইনি আর একটি কারণেও উল্লেখযোগ্য। বৈষ্ণব দার্শনিক রামানুজের প্রভাবে বিষ্ণুবর্ধন জৈনধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। বিষ্ণুবর্ধনের পৌত্র রাজা দ্বিতীয় বল্লালের সময় পর্যন্ত হোয়সল রাজ্যের প্রসারের কাজ চলছিল। এইভাবেই হোয়সলরা দাক্ষিণাত্যে দক্ষিণাংশ নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। কিন্তু উত্তরদিকে রাজ্য সম্প্রসারণ করতে গিয়ে দেবগিরির যাদবদের কাছ থেকে বাধা এলো। যাদবরাও চালুক্যরাজ্যের কিছু অঞ্চল দখল করে নিজেদের রাজ্য সম্প্রসারণ করেছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তারা অল্পকালের জন্যে গুজরাটও অধিকার করেছিল। যাদব ও হোয়সল রাজ্য চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বজায় ছিল। তারপর উত্তর-ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দিল্লির তুর্কী সুলতানরা দাক্ষিণাত্যে হস্তক্ষেপ শুরু করলে এইসব রাজবংশের পতন হয়, নতুন নতুন রাজ্য ও রাজবংশের সূচনা হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ তামিলনাদ অঞ্চলে চোলদের জায়গায় পাণ্ড্যরা বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল। দাক্ষিণাত্যের উত্তরাংশ তখন দিল্লির সুলতানদের দখলে। সুলতানী হস্তক্ষেপ না ঘটলে পাণ্ড্যরা হয়তো আরো অনেকদিন রাজত্ব করে যেতে পারত। তারপর পাণ্ড্যরা এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল শাসকবৃন্দের অধীনে আঞ্চলিক নেতা ও সামন্তরাজায় পরিণত হলো। মার্কোপোলো ১২৮৮ ও ১২৯৩ খ্রিস্টাব্দে পাণ্ড্যরাজ্যে এসে সেখানকার ভূমিসম্পদ ও বাণিজ্যের সমৃদ্ধির কথা লিখে রেখে গেছেন।
বিপরীত উপকূল অঞ্চল, অর্থাৎ কেরলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত ছিল। চেররাজ্যের সঙ্গে চোলদের মাঝে মাঝে সংঘর্ষ এবং মাঝে মাঝে শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হলেও চের রাজাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। একমাত্র রাজা রবিবর্মণ কুলশেখর ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাজ্যবিস্তারের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। মালাবার উপকূলে কৃষি উৎপাদন ভালোই হতো ও পশ্চিমী বাণিজ্য থেকেও যথেষ্ট অর্থাগম হতো। তাই, রাজ্যবিস্তারের কোনো অর্থনৈতিক প্রয়োজনও ছিল না। দশম শতাব্দীতে সেমিটিক জাতীয় আর একদল লোক ভারতে এসেছিল। চের রাজা এক ভূমিদানপত্রের মাধ্যমে জোসেফ রব্বানকে কিছু জমি দান করেন। ভারতে ইহুদিদের বসতি স্থাপনের এটিই প্রথম নজির। তবে বলা হয়, কোচিনে নাকি প্রথম শতাব্দীতেই একদল ইহুদি বসতিস্থাপন করেছিল। ত্রিবাঙ্কুরের ইহুদিরা, অর্থাৎ জোসেফ রব্বনের বংশধররা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল নিজেদের আলাদা রেখে ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষার ব্যাপারে কঠোর নিয়ম মেনে চলল। অন্যদল স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে মিশে গিয়েও নিজেদের ইহুদি বলে দাবি করত।
দাক্ষিণাত্যে অনেক রাজবংশের অস্তিত্বের ফলে এই অঞ্চলে কেন্দ্ৰীয় শাসনের কোনো সুযোগ ছিল না। চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, যাদব বা হোয়সলদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল হতে দেয়নি। একমাত্র চোলরাই সামন্তরাজাদের কিছুটা বশে আনতে পেরেছিল। কেবল চোলদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় ছিল এবং কেন্দ্রীয় শাসনের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যেত। চোল রাজা প্রথম রাজরাজের রাজনৈতিক মর্যাদার সঙ্গে রাষ্ট্রকূট রাজা অমোঘবর্ষ বা হোয়সল রাজা বিষ্ণুবর্ধনের মর্যাদার পার্থক্য ছিল। গোড়ার দিকের চোল রাজারা উপাধি নিয়ে তত মাথা ঘামাতেন না। কিন্তু পরবর্তী রাজারা বড় বড় উপাধি (যেমন— চক্রবর্তীগল অর্থাৎ সম্রাট, উত্তর-ভারতের চক্রবতিন্ উপাধির সঙ্গে সমার্থক) গ্রহণ শুরু করলেন। রাজাদের ওপর দেবত্ব আরোপ করাও শুরু হলো। মৃত রাজাদের স্মরণে মন্দির তৈরি করা হলো। রাজপ্রাসাদে বিলাসের অন্ত ছিল না এবং রাজকীয় দানও ছিল প্রচুর। উত্তর- ভারতে রাজপুরোহিতের যে ভূমিকা ছিল, চোলরাজ্যে তার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছিল। চোলদের রাজগুরু পার্থিব ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে পরামর্শদাতা তো ছিলেনই, তাছাড়াও গোপন ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ নেওয়া হতে লাগল। এছাড়া, কিছু কিছু উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের পরিষদও রাজাকে পরামর্শ দিতেন। তবে স্থায়ী মন্ত্রিসভার কথা শোনা যায়নি।
সুসংহত রাজকর্মচারী-সংগঠনের হাতে শাসনের দায়িত্ব ছিল। কর্মচারীদের নিয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে, উত্তর-ভারতীয় পদ্ধতির সঙ্গে হয়তো কোনো পার্থক্য ছিল না। সেখানে বংশ, বর্ণ, যোগাযোগ ও অন্যান্য গুণের কথা বিবেচনা করা হতো। রাজা প্রথমে মৌখিক আদেশ দিতেন এবং পরে তা লিপিবদ্ধ করা হতো। কোনো চুক্তির ক্ষেত্রে ওই আদেশে কর্মচারীদেরও স্বাক্ষর থাকত। চোলরাজ্য কয়েকটি প্রদেশে (মণ্ডলম্) বিভক্ত ছিল। প্রদেশের সংখ্যা ছিল আট বা নয়। প্রত্যেকটি মণ্ডলম্ জেলা বা বলনাড়ুতে বিভক্ত ছিল। সেগুলোর মধ্যে থাকত কয়েকটি করে গ্রামের সমষ্টি। সেগুলোকে বলা হতো কুরম। নাড়ু বা কোট্টম। অনেক সময় খুব বড় গ্রামকে আলাদা করে শাসন করা হতো। এরকম গ্রামকে বলা হতো তানিয়ুর।
শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম এবং এই ব্যাপারে চোল ও গুপ্ত শাসনপদ্ধতির কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে গ্রামশাসনের ব্যাপারে চোলদের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। গ্রামগুলোকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া হতো। চোল রাজকর্মচারীরা গ্রামের শাসনব্যবস্থায় শাসকের পরিবর্তে পরামর্শদাতার ভূমিকা নিত। এই কারণে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব গ্রামে বেশি পড়ত না এবং গ্রামগুলো অব্যাহত গতিতে উন্নতিলাভ করছিল। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় তামিলনাদে যে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক অবিচ্ছিন্নতা লক্ষ্য করা যায়, তার মূলেও হয়তো রয়েছে চোলদের গ্রামশাসন পদ্ধতি।
গ্রামশাসনে এই স্বাধীনতার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল যে, গ্রামবাসীরাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গ্রামের শাসনকাজ চালাবে। এইজন্যে একটি গ্রামপরিষদ গঠন করা হতো এবং পরিষদের হাতেই শাসনভার থাকত। বড় গ্রামে শাসনব্যবস্থা আর একটু জটিল হতো এবং সেখানে শাসন পরিচালনার জন্যে একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকত। গ্রামবাসীরা প্রয়োজন অনুসারে দুই বা ততোধিক পরিষদের সভ্য হতে পারত। গ্রামগুলো বিভিন্ন পাড়ায় বিভক্ত থাকত এবং পাড়াগুলোর নিজস্ব পরিষদ থাকত। এই পরিষদের সভ্যদের মধ্যে পেশাদার কারিগর, যেমন ছুতোর বা কামারদের প্রতিনিধিও থাকত। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল গ্রামের সমাজজীবনের মূলভিত্তি। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী নিয়েই গ্রামের মূল পরিষদ গঠিত হতো।
সাধারণ পরিষদগুলোতে অধিকাংশ স্থানীয় অধিবাসীই সদস্য হতে পারত। পরিষদ ছিল তিন ধরনের : ক. যেসব গ্রামবাসী কর দিত তাদের সভার নাম ছিল ‘উর’; খ. গ্রামের ব্রাহ্মণদের নিয়ে অথবা ব্রাহ্মণদের জন্যে দানকরা গ্রামগুলোতে যে পরিষদ থাকত, তার নাম ছিল ‘সভা’; গ. এছাড়া ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে যে পরিষদ থাকত, তার নাম ছিল ‘নগরম’। কোনো কোনো গ্রামে উর ও সভা দুইই থাকত। বড় গ্রামে কাজের সুবিধার জন্যে প্রয়োজন মতো দুটি উরও থাকত।
স্থানীয় পরিস্থিতি অনুসারে এই পরিষদগুলোর কাজকর্মও বিভিন্ন রকম হতো। গ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ উর-এর সভ্য ছিল, তবে প্রবীণরাই প্রধানত কাজ চালাতেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের জন্যে প্রবীণরা অনেক সময় কার্যকরী সমিতি গঠন করে নিতেন। সভার ক্ষেত্রেও ওই একই ব্যবস্থা ছিল। তাছাড়া, সভার ক্ষমতা ছিল বিশেষ ধরনের কাজের জন্যে সমিতি গঠন করে দেবার। সভায় সভ্য নির্বাচনের জন্যে উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে লটারি হতো।
সভার কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় উত্তর-মেরুর গ্রামের মন্দিরগাত্রের লেখা থেকে। এই গ্রামটি কেবল ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত ছিল। এই দেওয়াল-লিপিটি দশম শতাব্দীর। লেখা আছে :
“…তিরিশটি পাড়া থাকবে।
এই তিরিশটি পাড়ার অধিবাসীরা মিলিত হয়ে লটারি-দ্বারা নির্বাচনের জন্যে একজন করে প্রার্থী স্থির করবেন। প্রার্থীর গুণাবলী হবে—
তিনি করদায়ী জমির এক-চতুর্থাংশের বেশির অধিকারী হবেন। তিনি নিজের জমির ওপর নির্মিত বাসগৃহের অধিবাসী হবেন। তিনি ৭০-এর কম ও ৩৫-এর বেশি বয়স্ক হবেন। তিনি মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হবেন। প্রার্থীর যদি মাত্র এক-অষ্টমাংশ জমি থাকে, কিন্তু তাঁর যদি অন্তত একটি বেদ ও চারটির একটি ভাষ্যে পাণ্ডিত্য থাকে, তাঁকে নির্বাচনের জন্যে বিবেচনা করা হবে। যাঁদের এইসব গুণাবলী আছে, তাঁদের মধ্যে যাঁরা বাণিজ্য ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও যাঁদের নৈতিক চরিত্র উত্তম, তাঁদের বিবেচনা করা হবে। যাঁরা সৎপথে উপার্জন করেছেন, মন পবিত্র এবং গত তিন বছরে কোনো পরিষদের সদস্য ছিলেন না, তাঁদেরও গ্রহণ করা হবে। যাঁরা পরিষদের সদস্য ছিলেন, কিন্তু আয়ব্যয়ের হিসেব দাখিল করেন নি, তাঁরা এবং তাঁদের নিম্নলিখিত আত্মীয়-স্বজনরা প্রার্থী হতে পারবেন না; মায়ের বড় বোন ও ছোট বোনের পুত্ররা;
বাবার বোন ও মায়ের ভাইয়ের পুত্ররা;
মায়ের সহোদর ভাই;
বাবার সহোদর ভাই;
নিজের সহোদর ভাই;
নিজের শ্বশুর; স্ত্রীর ভাই; সহোদর;
সহোদর বোনের স্বামী;
সহোদর বোনের পুত্র;
নিজের জামাতা;
নিজের পিতা; নিজের পুত্র।
যাঁর বিরুদ্ধে অনাচার বা পাঁচটি প্রধান পাপের প্রথম চারটি পাপের অভিযোগ থাকবে, তারাও প্রার্থী হতে পারবেন না। (পাঁচটি প্রধান পাপ হলো— ব্ৰাহ্মণ হত্যা, মদ্যপান, চুরি, ব্যভিচার ও অপরাধীদের সঙ্গে সংসর্গ)— তাঁর উপরিউক্ত আত্মীয়রাও লটারির জন্যে প্রার্থী হতে পারবেন না। যিনি অস্পৃশ্যদের সংস্পর্শে এসেছেন বা নিম্নবর্ণের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন, প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত তাঁর নামও বিবেচিত হবে না।
এছাড়াও যিনি হঠকারী… যিনি অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন… যিনি নিষিদ্ধ খাদ্য ভক্ষণ করেছেন, যিনি পাপকাজের জন্যে শুদ্ধি অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হয়েছেন…
এই সমস্ত ব্যক্তিরা ব্যতীত আর সকল প্রার্থীর নাম ৩০টি পাড়ায় নির্বাচনের জন্যে লটারির কাগজে লেখা হবে। প্রত্যেক পাড়ার জন্যে প্রার্থীদের নাম ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গুচ্ছ করে নিতে হবে। গুচ্ছগুলো একটি পাত্রে রাখা হবে। লটারির কাগজ তোলার সময় বৃহৎসভার সমস্ত বৃদ্ধ ও তরুণ সদস্যকে ডাকা প্রয়োজন। মন্দিরের যেসব পুরোহিত সেদিন গ্রামে উপস্থিত থাকবেন, তাঁরা সকলেই পরিষদের ভেতরের কক্ষে আসন নেবেন। প্রবীণতম পুরোহিত কাগজভর্তি পাত্রটি তুলে ধরে সকলকে দেখিয়ে দেবেন। এরপর একটি ছোট ছেলেকে বলা হবে এক-একটি কাগজের গুচ্ছ তুলে অন্য একটি শূন্যপাত্রে রাখতে। কাগজের টুকরোগুলো নেড়েচেড়ে মিশিয়ে দেওয়া হবে। এইবার পাত্রটি থেকে একটি কাগজের টুকরো তুলে নিতে হবে। কাগজের টুকরো লেখা নামটি প্রত্যেক পুরোহিত পড়ে শোনাবেন। এই নামটিই গ্রহণ করা হবে। এইভাবেই ৩০টি পাড়ার প্রতিনিধি নির্বাচন চলবে।
নির্বাচিত ৩০ জন সভ্যের মধ্যে যাঁরা ইতিপূর্বে উদ্যান-সমিতি ও পুষ্করিণী-সমিতিতে ছিলেন, যাঁরা বয়সে প্রবীণ ও যাঁরা পণ্ডিত ব্যক্তি, তাঁদের বাৎসরিক সমিতিতে মনোনীত করা হবে। অবশিষ্ট সভ্যদের মধ্যে ১২ জনকে উদ্যানসমিতি ও ৬ জনকে পুষ্করিণী-সমিতিতে নেওয়া হবে। এই ৩টি সমিতির প্রধান ব্যক্তিরা ৩৬০ দিনের জন্যে কার্যভার নেবেন ও তারপরে অবসর গ্রহণ করবেন। কোনো সভ্য কোনো অপরাধ করলে তাঁকে তৎক্ষণাৎ অপসারণ করা হবে। এঁরা অবসরগ্রহণের পর নতুন সমিতি গঠনের জন্যে ১২টি রাস্তার ‘ন্যায়রক্ষা সমিতি’ মধ্যস্থের সাহায্যে আবার সভার অধিবেশন ডাকবেন। সেখানে লটারির সাহায্যে আবার নতুন সমিতি নির্বাচিত হবে।…
স্বর্ণসমিতি ও পঞ্চমুখী সমিতির জন্যে আগের পদ্ধতিতেই ৩০টি পাড়ায় লটারি হবে। যে ব্যক্তিকে গাধার পিঠে চড়ানো হয়েছে (অর্থাৎ শাস্তি দেওয়া হয়েছে), বা যে কখনো জাল জুয়াচুরি করেছে, তাকে নির্বাচন করা হবে না। গ্রামের আয়-ব্যয়ের হিসেব লেখার দায়িত্ব দিতে হবে এমন একজনকে, যিনি সৎপথে উপার্জন করেন। তিনি যতদিন না প্রধান সমিতির কর্মকর্তাদের কাছে হিসেব দাখিল করছেন এবং তাদের হিসেব ত্রুটিহীন বলে গৃহীত হচ্ছে, ততদিন হিসেবের কাজ সম্পূর্ণ করার জন্যে নতুন কোনো হিসাবরক্ষক নিযুক্ত করা হবে না। হিসাবরক্ষক হিসেব মেলানোর আগে অন্য কাউকে হিসেব শেষ করার ভার দিয়ে চলে যেতে পারবেন না। যতদিন চন্দ্রসূর্য আছে, ততদিন এইভাবেই সমিতির নির্বাচন চলতে থাকবে। … আমরা উত্তর-মেরুর সভ্য আমাদের গ্রামের মঙ্গলের জন্যে, অর্থাৎ দুষ্টলোকের শাস্তি ও অন্যান্যদের উন্নতির জন্যে এইসব কথা জানিয়ে দিচ্ছি। আমি, কণ্ডাত্তিপোত্তন শিবাক্কুরি রাজমল্লমঙ্গল-প্রিয়ন পরিষদের কর্মসমিতির আদেশে এই বিবরণী লিপিবদ্ধ করলাম।”[১]
অন্যান্য লিপির মধ্যেও একই ধরনের বিবরণ পাওয়া গেছে। তবে, প্রার্থীর গুণাবলী ইত্যাদি বিষয়ে এবং খরচের বরাদ্দ মঞ্জুর করার নিয়মে পার্থক্য আছে। ঢোল বাজিয়ে অধিবেশন আহ্বান করা হতো মন্দির সংলগ্ন জমিতে। গ্রামসভাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বিরল ছিল না।
সরকারি কর ইত্যাদি নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল গ্রাম-পরিষদের ওপর। তা ছাড়া, কোনো বিশেষ কাজের জন্যে পরিষদ আলাদা খাজনা আদায় করতে পারত : যেমন, পুষ্করিণী খনন। রাজকোষে দেয় করের সঙ্গে এইরকম বিশেষ খাজনার কোনো সম্পর্ক ছিল না। পরিষদের অন্যান্য কাজের মধ্যে ছিল দান ও কর সংক্রান্ত নথিপত্র রাখা ও চাষ ও জলসেচ সম্পর্কিত বিবাদের নিষ্পত্তি করা। বৃহৎ সভাগুলো কর্মচারী নিযুক্ত করত। তবে ছোট গ্রামে গ্রামবাসীরা বিনা বেতনেই সভার কাজ করে দিত।
সভাগুলো থাকা সত্ত্বেও রাজা ও গ্রামের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে রাজকর্মচারী ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমেরও প্রয়োজন হতো। চোল রাজাদের অধীনে সামন্ত রাজা ছিলেন, যেমন পল্লবদের প্রধানরা এবং অন্যান্য ছোটখাটো শাসনকর্তারা। কিন্তু রাজা ও সামন্ত রাজার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে গ্রাম পরিষদ মাথা ঘামাত না। গ্রামগুলোর স্বাধীনতা এত বেশি ছিল যে, শাসনব্যবস্থা বা রাজনৈতিক পরিবর্তন গ্রামের প্রাত্যহিক জীবনে কোনো প্রভাব ফেলত না। গ্রামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। সামন্ত রাজারা কর আদায় করে রাজাকে তাঁর প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়েই নিশ্চন্ত ছিলেন। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করে দিত সভা পরিষদ। চোলরাজ্যেই এই প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। দাক্ষিণাত্যের অন্যত্র বা উত্তর-ভারতে সামন্ত রাজাদের মর্যাদার উন্নতি হয়েছিল। তাঁরা কেবল রাজার কর আদায়ই করতেন না, রাজার সঙ্গে একটা চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কও থাকত, যাতে সামন্তরাজাদের ক্ষমতাও নিতান্ত কম ছিল না। (এ বিষয়ে অন্য এক অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।)
প্রজাস্বত্ব ছিল প্রধানত দুই ধরনের। জমির সমবেত মালিকানার ব্যবস্থা ছিল। সেক্ষেত্রে গ্রামবাসীরা সমবেতভাবে গোটা গ্রামের হিসেবে কর দিত। অথবা, কৃষকরা ব্যক্তিগতভাবে খাজনা দিত। কৃষকরা রাজকর্মচারীদের কাছে বা মন্দিরে কর জমা দিত। খাজনার পরিমাণ পূর্বনির্ধারিত থাকত। উদ্বৃত্ত অংশ কৃষক নিজে ভোগ করত। শ্রমের বিনিময়ে ঋণশোধের প্রথাও চালু ছিল। তবে এ প্রথার প্রচলন ছিল সীমিত— যেমন, করের পরিবর্তে মন্দিরে বিগ্রহ স্নানের জন্যে নিয়মিত জল এনে দেওয়া। পরে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পরিবর্তে কর মকুবের প্রথা শুরু হয়েছিল। যেখানে জমি দখলের অধিকারের প্রশ্ন উঠত, সেখানে ‘ব্রহ্মদেয়’ ও ‘দেবদেয়’ জমির ভূস্বামীকে সাধারণ ভূস্বামীর মতোই ধরা হতো; তাদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হতো না।
পল্লবযুগের সময় থেকে ‘ব্রহ্মদেয়’ দানের রীতি অপরিবর্তিত ছিল। যেমন, চোলদের সময়ে ‘সুন্দর চোল’ ব্রাহ্মণ অনিরুদ্ধ ব্রহ্মাধিরাজকে কিছু জমি দান করতে গিয়ে ‘অনাবিল দানপত্রে’ লিখেছিলেন :
…আমরা জমির সীমানা নির্ধারণের জন্যে মাটি উঁচু করে রেখে তার ওপর নাগফণী গাছ লাগিয়েছিলাম। এই জমির অন্তর্গত ছিল ফলের গাছ, জল, বাগান, উঁচু গাছ, গভীর কুয়ো, খোলাজমি, বাছুর চরানোর জমি, উইঢিবি, গাছের চারিদিকের বেদী, খালার, নদী ও তার জমা পলি, পুকুর, শস্যভাণ্ডার, মাছের পুকুর, মৌচাক; এবং অন্য সময় কিছু যার ওপর গিরগিটি এবং কচ্ছপ চলে; বিচারালয় থেকে পাওয়া অর্থ, পানের ওপর ও তাঁতে বোনা কাপড়ের ওপর কর… সমস্ত কিছু যা রাজা ইচ্ছে করলে ভোগ করতে পারতেন, তা এই ব্যক্তিকে দেওয়া হলো। ইনি স্বেচ্ছায় পোড়া ইটের তৈরি বহুতল বাসগৃহ তৈরি করতে পারবেন। ছোট ও বড় কুয়ো খনন ও নাগফণী ইত্যাদি গাছ বপন করতে পারবেন। সেচের প্রয়োজনমতো খাল খনন করতে পারবেন, জল নষ্ট না করে বাঁধ তৈরি করবেন। এঁর জমি থেকে কেউ সেচের জল পাত্র করে নিয়ে যেতে পারবে না। এইভাবে পুরানো আদেশ পরিবর্তন করে পুরানো নাম ও কর অপসারণ করে করুণাকরমঙ্গলম নামে ‘একভোগ ব্রহ্মদেয়’ (একজন ব্রাহ্মণকে জমিদান) তৈরি করা হলো। [২]
জমির স্বত্বাধিকারী ও করদাতাদের সঙ্গে সাধারণ চাষী, যারা অর্থের বিনিময়ে জমিতে কাজ করত, তাদের প্রচুর পার্থক্য ছিল। সাধারণ চাষী গ্রামসভার সভ্য হতে পারত না এবং স্থানীয় শাসনেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদলাভ করতে পারত না। ভূমিহীন কৃষকের অবস্থা ছিল প্রায় কৃতদাসের মতো এবং তাদের জীবনেও উন্নতিরও কোনো আশা ছিল না। এদের মধ্যে অনেকে নিম্নবর্ণের ছিল। তারা মন্দিরের বাইরের নানাকাজে নিযুক্ত হতো, কিন্তু মন্দিরের ঢোকার অনুমতি ছিল না।
কৃষক শ্রমজীবীদের একটা প্রধান কাজ ছিল পতিতজমি পুনরুদ্ধার ও জঙ্গল পরিষ্কার করা। সরকারও এই কাজে উৎসাহ দিতেন, কারণ বেশি জমিতে চাষ হলে রাজকোষেও অর্থাগম বাড়বে। পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া অন্যান্য জায়গায় গো- পালন তখন নিয়মিত পেশা হয়ে উঠেছিল। বছরে দুই বা তিনবার ধানের উৎপাদন স্বাভাবিক বলে গণ্য হতো। তবে উৎপাদন সব জমিতে একরকম ছিল না। জলসেচের ওপর জমির উৎপাদন ও মূল্য নির্ভর করত। চোলরাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিকর। কখনো টাকায় কখনো দ্রব্যে এই কর আদায় হতো। এছাড়া আরো কর বসানো হতো, খনি, জঙ্গল, নুন ও কারিগরি পেশার ওপর। বিচারের জরিমানা ও বাণিজ্যশুল্ক থেকেও অর্থাগম হতো। কখনো অর্থের পরিবর্তে কায়িকশ্রম (‘ভেত্তি’) দান করতে হতো। ভূমিকর ছিল খুব বেশি— উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশ। বিশেষ কোনো পরিস্থিতি ঘটলে অবশ্য রাজা ভূমিকর মকুব করে দিতেন।
করের হিসেবের জন্যে জমির মূল্যায়ন ও সীমা নির্ধারণ হতো বটে, কিন্তু তা সর্বত্র ঘটত না। ভূমিকর ছাড়াও গ্রামসভা ও মন্দিরগুলো কর আরোপ করত। সমগ্র করভার কৃষকের কাছে রীতিমতো বোঝা হয়ে উঠত বলেই মনে হয়। কর না দিয়ে কোনো অব্যাহতি ছিল না। রাজার কাছে কর মকুবের আবেদন করা, অথবা এই জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া— এছাড়া কৃষকের পক্ষে তৃতীয় গত্যান্তর ছিল না। কিন্তু স্থানত্যাগ করা সহজ ছিল না। করের ব্যাপারে যদি সমগ্র গ্রামকেই একক ধরে দেওয়া হতো, উৎপন্ন শস্যের হিসেব থেকে করমুক্ত জমির উৎপাদন বাদ দেওয়া হতো। করমুক্ত জমির মধ্যে ছিল—বাসগৃহ, মন্দির, পুকুর, খাল, কারিগর ও অস্পৃশ্যদের বাসস্থান ও শ্মশান।
এই যুগে টাকা ও সম্পত্তি জমিয়ে রাখার প্রবণতা ছিল না। কারণ, অধিকাংশ গ্রামবাসীর সঞ্চয়যোগ্য অর্থই ছিল না। জমির ফসলের আয়ে একটি পরিবারের সারা বছরের খাদ্য, বস্ত্র ছাড়া আর কিছুই প্রায় হতো না। খাদ্য ছিল সাধারণ। প্রধানত ভাত ও তরকারি। মাংস ছিল রীতিমতো দামী খাদ্য। গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুর জন্যে বাড়ি তৈরির জন্যেও খরচ বেশি হতো না। তবে ধনী চাষীরা তাদের অর্থ বিনিয়োগ করত। পতিতজমি উদ্ধার বা সেচের খাল কাটার জন্যে অর্থ বিনিয়োগ করলে পরে সুবিধা হতো। এছাড়া মন্দির নির্মাণ বা মঠের সাহায্যের জন্যে অর্থদান করে ধনীরা পুণ্যার্জন করত।
এই যুগের প্রথমদিকে গ্রামগুলো আর্থিকভাবে স্বনির্ভর ছিল। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বস্ত্র উৎপাদিত হতো। কারিগররা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করত। উৎপাদনে উদ্বৃত্ত কমই হতো বলে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিনিময়ের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কিন্তু একাদশ শতাব্দীর পর থেকে দ্রুত নগর গড়ে ওঠার পর এই অবস্থার পরিবর্তন হলো। চোলযুগে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার হলো। শহরের জন্যে বাড়তি খাদ্যোৎপাদন প্রয়োজন হলো এবং এইভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটল। এই কারণেই এ অঞ্চলের প্রাক্তন রাজবংশগুলোর তুলনায় চোলদের আমলে অনেক বেশি মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল।
চোল ব্যবসায়ীরা বহির্বাণিজ্যের ওপর বেশি জোর দিত। পূর্ব-উপকূলের মহাবলীপুরম, কাবেরীপত্তনম, শালিয়ুর এবং কোরকাই বন্দর ও মালাবার উপকূলের কুইলনে বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। পশ্চিমী বাণিজ্যের লক্ষ্য ছিল পারস্য ও আরবদেশ। পারস্য উপসাগরে সিরাফ ছিল আমদানি-রপ্তানির একটি কেন্দ্র। এই যুগে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য খুবই বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে বাণিজ্যে চীন-সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ গড়ে ওঠে, কারণ চীন-সরকার চাইত না যে বাণিজ্য থেকে কোনো আয় তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। মনে হয়, ফরমোজা দ্বীপের উল্টোদিকে মূলচীন ভূখণ্ডে একটি ভারতীয় বসতি ছিল। মধ্য-এশিয়া তখন মঙ্গোলদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় দক্ষিণ-চীন থেকে এশিয়া ও ইউরোপের উদ্দেশ্যে বাণিজ্যদ্রব্য যেত সমুদ্রপথ ধরে। দক্ষিণ-ভারত থেকে বস্ত্র, ওষুধ, দামী পাথর, হাতির দাঁত, শিং, আবলুস কাঠ ও কর্পূর চীনে রপ্তানি হতো। একই ধরনের জিনিস পশ্চিমী জগতে রপ্তানি হতো।
ওইযুগের সমস্ত পরিব্রাজকের মতো মার্কো পোলোও ভারতে প্রচুর ঘোড়া আমদানির কথা লিখেছেন। ঘোড়া বিক্রি করে আরবরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিল। আরবদের কাছ থেকে ঘোড়া কিনে দক্ষিণ-ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও এদেশে ঘোড়া বিক্রি করে প্রচুর অর্থলাভ করত। ভারতে কখনোই ঘোড়ার বংশবৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয়নি এবং অনেক দাম দিয়ে ঘোড়া আমদানি করা হতো। মার্কো পোলো লিখেছেন :
…এই দেশে ঘোড়ার বংশবৃদ্ধির কোনো ব্যবস্থা নেই। সেজন্যে এদেশের সারা বছরের আদায় করা রাজস্বের প্রায় সবটাই, অথবা একটা বড় অংশ ঘোড়া কিনতে ব্যয় হয়ে যায়। ব্যাপারটা কি হয়, আমি খুলে বলছি। হরমুজ, কাইস, ধোফার, শির ও এডেন— যেখানে যুদ্ধের ঘোড়া ও অন্যান্য ঘোড়া বেশি পাওয়া যায়, সেখানার ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে ভালো ঘোড়াগুলো কিনে নিয়ে জাহাজভর্তি করে এই রাজা ও তাঁর আরো চার ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়। কয়েকটি ঘোড়ার দাম ওঠে ৫০০ সোনার ‘সাগি — যার মূল্য হলো ১০০ রৌপ্য ‘মার্কে’রও বেশি। আমি জোর করে বলতে পারি, এই রাজা বছরে ২ হাজার বা আরো বেশি ঘোড়া কেনেন। তাঁর ভাইয়েরাও সমান সংখ্যক ঘোড়া কেনেন। কিন্তু বছরের শেষে একশোর বেশি ঘোড়া টিকে থাকে না। ঘোড়াগুলোর ঠিকমতো যত্ন না করার ফলেই তারা মারা পড়ে। এখানে কোনো পশু চিকিৎসক নেই ও কেউ ঘোড়ার চিকিৎসাও জানে না। আমি নিশ্চিত জানি, যেসব ব্যবসায়ীরা ঘোড়া রপ্তানি করে তারা কোনো পশু-চিকিৎসককে পাঠায়ও না, আসতেও দেয় না। রাজার ঘোড়া যত বেশি মারা পড়ে, ব্যবসায়ীরা ততই খুশি হয়। [৩]
মার্কো পোলোর অতিরঞ্জনের প্রতি ঝোঁক থাকলেও এই বিবরণীতে খানিকটা সত্য অবশ্যই আছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারের ফলে দেশের মধ্যে উৎপাদনে উৎসাহের সৃষ্টি হলো। সাধারণত স্থানীয় বাজারের চাহিদা অনুসারেই দ্রব্য উৎপাদন হতো। বৈদেশিক বাণিজ্যের দ্রব্যসামগ্রীর জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করা হতো। হাতি, ঘোড়া, মশলা, গন্ধদ্রব্য, দামী পাথর, উৎকৃষ্ট বস্ত্র ইত্যাদি সামগ্রী নিয়ে প্রচুর ব্যবসা চলত। ধাতুনির্মিত পাত্র, গহনা, চীনামাটির পাত্র ও নুনের ব্যবসা ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত ব্যবসায়ীদের সমবায় সংঘগুলো। তার মধ্যে ‘মনিগ্রামম’ ও ‘বলনজিয়ার’— এগুলো সুপরিচিত নাম ছিল। ওই যুগের অর্থনৈতিক জীবনে সংঘগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যে সংঘ গঠন করত। এরা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ছিল। উপমহাদেশের যে-কোনো প্রান্তেই এদের অবাধগতি ছিল। রাজনৈতিক সীমানা এদের গতিবিধির পক্ষে বাধা হয়নি।
স্থানীয় অধিবাসীদের সমবায় সংঘগুলোকে ‘নগরম’ নামে অভিহিত করা হতো। অধিকাংশ শহরেই এগুলো দেখা যেত এবং বড় সংঘগুলোর সঙ্গে এরা সভা হিসেবে যুক্ত ছিল। সংঘগুলো উৎপাদন কেন্দ্রের বিভিন্ন দ্রব্য কিনতে ও নানা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্যে ব্যবসায়ীরা সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তবে প্রয়োজন হলে রাজ্যগুলো ব্যবসায়ী স্বার্থরক্ষার সাহায্য করত। এর উদাহরণ হলো— শ্রীবিজয়। কিন্তু রাজকীয় হস্তক্ষেপের পেছনে কাঁচামাল বা উৎপাদিত মালের বাজার দখল করে নেবার কোনো উদ্দেশ্য থাকত না। অন্যদেশ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আঘাত দিলে রাজারা সক্রিয় হয়ে উঠতেন। মনে হয়, রাজা ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা বাণিজ্যে অর্থ বিনিয়োগ করতেন। অথবা, সংঘগুলো প্রয়োজনমতো বিশেষ বিশেষ উপহার সামগ্রী এনে দিত।
ব্যবসায়ীদের সমবায় সংঘগুলো এত ধনী ছিল যে, তারা একটি গোটা গ্রাম কিনে নিয়ে কোনো মন্দিরকে দান করে দিতে পারত। ‘নানা দেশি’ সমবায় সংঘের বহুবিভক্ত কার্যধারার অন্তর্গত ছিল দক্ষিণ-ভারত ও সুমাত্রা উভয় স্থানেই বাণিজ্য। আশ্চর্যের কথা এই যে, এত আর্থিক ক্ষমতা সত্ত্বেও সংঘগুলো আরো রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেনি। সম্ভবত, সংঘ ও রাজার পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠ। অনেক সংঘই বিদেশে বাণিজ্য করত ও চোলরাজাদের নৌবাহিনীর পরাক্রমের ওপর তাদের নির্ভর করতেই হতো। সংঘগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণের সংখ্যা কম ছিল না। রাজার রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগ্রহ ব্রাহ্মণদের ছিল না। কারণ, রাজারা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতেন ও ব্রাহ্মণদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মিটাতে ভূমিদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগের যুগেও বর্ণাশ্রমের ফলে সংঘগুলো কখনো ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা হিসেবে পরিগণিত হয়নি। তাছাড়া, রাজার সার্বভৌম রাজনৈতিক ক্ষমতা প্ৰায় সকলেই এ যুগে স্বীকার করে নিয়েছিল, এবং এই বিশ্বাসের মূল দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। রাজার ক্ষমতাকে আইনের স্বীকৃতি দেবার দায়িত্ব ছিল মন্ত্রীমগুলি ও পুরোহিতদের ওপর। তারাও নিশ্চয়ই সংঘগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করে রাখার চেষ্টা করত। তবে উপকূলবর্তী রাজ্যগুলোতে বণিকদের সমবায় সংঘ আরো ক্ষমতাশালী ছিল, কারণ বাণিজ্যের সাফল্যের ওপরই এধরনের রাজ্যগুলোর অস্তি ত্ব নির্ভর করত।
দুর্ভাগ্যক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের লেন-দেনের বিশদ দলিল এখন আর পাওয়া যায় না। দেশের বিভিন্ন অংশে ব্যবসায়ীদের সমবায় সংঘের কেন্দ্র থাকার ফলে প্রমিসরি নোট প্রচলিত হয়েছিল নিয়মিতভাবেই। মুদ্রারও ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল। স্বর্ণমুদ্রার অবাধ প্রচলন ছিল। তবে একাদশ শতাব্দীর পর থেকে মুদ্রাগুলোর মানের অবনতি ঘটে। তবে এও সত্য যে, মুদ্রার সোনার পরিমাণ দেশের সব জায়গায় এক ছিল না। ওজন ও মানের ব্যাপক পার্থক্যের জন্যে গ্রামে সোনা ও স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার বেড়ে গেল। চোলযুগের শেষদিকে স্থানীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্যে তাম্রমুদ্রার ব্যবহার বেড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিনিময়ের মাধ্যমেই দেওয়া-নেওয়া হতো। কিংবা, ধানের পরিমাণ হিসেব করে বিনিময় চলত। এইসব অঞ্চলে মুদ্রার ব্যবহার ছিল শুধু দূরদেশে বেচাকেনার জন্যে, অথবা মূল্যবান জিনিসের ক্ষেত্রে, যেখানে বিনিময়ের ব্যবস্থা তেমন সুবিধাজনক ছিল না।
এই যুগে গ্রামাঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্র ছিল মন্দির। কখনো রাজাই মন্দির নির্মাণ করে দিতেন। সেক্ষেত্রে মন্দিরগুলো সাধারণত রাজধানীতে অবস্থিত হতো ও রাজসভার সঙ্গে মন্দিরের নিয়মিত যোগাযোগ থাকত। যেমন, তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বরম মন্দির, অথবা ব্যবসায়ী ও সমবায় সংঘের দানেও মন্দির নির্মিত হতো। সেক্ষেত্রে মন্দিরের সঙ্গে শহরের ক্ষমতাশালী নাগরিকদের নিকট সম্পর্ক থাকত। এছাড়া, গ্রামবাসীরা গ্রামে ছোট মন্দির তৈরি করে নিত। গ্রামে মন্দিরই ছিল নানাবিধ কার্যকলাপের কেন্দ্র। এখানেই গ্রামসভার অধিবেশন বসত, বা বিদ্যাভ্যাস চলত। উপরন্তু মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করত গ্রামবাসীরাই। বড় মন্দির নির্মাণের সময় দীর্ঘদিন ধরে কারিগররা কাজ পেত। যেসব জায়গা থেকে নির্মাণের মাল-মশলা আসত, সেইসব অঞ্চলের সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হতো।
আধুনিক যুগে কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে ওই যুগের মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের তুলনা করা যায়। তাঞ্জোরের মন্দিরই ওইযুগের সবচেয়ে সম্পন্ন মন্দির ছিল। সেখানকার বাৎসরিক আয় ছিল— ৫০০ পাউণ্ড ট্রয় (মণিকারদের মাপ) সোনা, ২৫০ পাউণ্ড ট্রয় দামী পাথর, ৬০০ পাউণ্ড ট্রয় রুপো। কয়েকশো গ্রামের রাজস্ব ও ব্যক্তিগত দান থেকে এই বিপুল অর্থ আয় হতো। মন্দিরের কর্মচারী যারা থাকত, যথেষ্ট আরামে ছিল। ৪০০ দেবদাসী, ২১২ জন ভৃত্য, ৫৭ জন সঙ্গীতজ্ঞ ও শাস্ত্রপাঠক; এছাড়া কয়েকশো পুরোহিত মন্দিরের কাছাকাছি বাস করত। মন্দিরের পরিচালকরা এই অর্থ লগ্নী করত বিভিন্ন অর্থকরী ব্যবসায়ে। তাছাড়া, গ্রামসভা গুলোকে টাকা ধার দেওয়া বা টাকা গচ্ছিত রাখার কাজও করত। তখনকার প্রচলিত সুদের হার, শতকরা ১২ টাকা হিসেবেই মন্দির থেকে টাকা ধার দেওয়া হতো। আগের যুগে অবস্থাপন্ন মঠগুলো যা করত, এই সময়ে মন্দিরগুলোও অর্থের ব্যাপারে তাই করত।
চোলযুগের অধিকাংশ মন্দিরে দেবদাসীদের দেখা যেত। এই প্রথার প্রথমদিকে দেবদাসীরা ছিল বিশেষ শ্রদ্ধেয়া পরিচারিকা। রোমের কুমারী কন্যাদের (Vestal Virgin) মতো এখানকার দেবদাসীদেরও খুব অল্পবয়সে মন্দিরের জন্যে উৎসর্গ করে দেওয়া হতো। তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কয়েকজনকে ভরতনাট্যম নৃত্যের শিল্পী হবার জন্যে কঠিন সাধনা করতে হতো। (এমন কি বর্তমান যুগের কোনো কোনো শ্রেষ্ঠ ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পীও দেবদাসীদের বংশধর।) কিন্তু দেবদাসী প্রথার অপব্যবহার শুরু হলো। শেষপর্যন্ত অনেক মন্দিরেই দেবদাসীরা বারবণিতায় রূপান্তরিত হলো। আর্থিকভাবে অত্যাচারিত এই নারীদের অর্জিত অর্থ মন্দির-পরিচালকদের কাছে জমা পড়ত। অন্যদিকে নগরের নটীরা নানা গুণসম্পন্না নারী ছিল এবং তাদের দেবদাসীদের মতো অপব্যবহার করা হয়নি। এই বীরাঙ্গনাদের ও সমাজের উচ্চশ্রেণীর নারীদের চলাফেরার অনেক স্বাধীনতা ছিল, কেননা কেবল তাদের পক্ষেই সামাজিক নিয়মবিধি উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সাধারণ ঘরের মেয়েদের বাড়িতে বা ক্ষেতে কাজ করতে হতো।
সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্ণসচেতনতা বেশ প্রবল হয়ে উঠেছিল। সমাজে অন্যদের চেয়ে ব্রাহ্মণদের সম্মান ছিল বেশি এবং ব্রাহ্মণরা সে সম্পর্কে সচেতনও ছিল। দক্ষিণ-ভারতীয় ব্রাহ্মণরা একই সঙ্গে সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল। তারা প্রায়ই কর থেকে অব্যাহতি পেত; অনেকের জমি ছিল এবং সর্বোপরি তাদের পেছনে ছিল রাজকীয় সমর্থন। আদিতে যা ছিল বিদেশি সংস্কৃতি, ব্রাহ্মণরা ক্রমশ সেই সংস্কৃতিরই প্রতীক হয়ে উঠল। উত্তর-ভারতীয় ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের তুলনায় দক্ষিণ-ভারতীয় ব্রাহ্মণ ভুস্বামীরা ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করত না। তাদের উদ্বৃত্ত উপার্জন ব্যবসায়ে লগ্নী করত। কোনো কোনো জায়গায় ব্রাহ্মণরা ব্যবসায়ীদের সমগোত্রীয় হয়ে উঠেছিল। কেউ কেউ শাস্ত্রীয় নিষেধ অমান্য করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও চলে গিয়েছিল।
বর্ণবিন্যাসে প্রধান জোর দেওয়া হতো সমাজে ব্রাহ্মণ ও শ্রেণিবিভাগের ওপর। দক্ষিণ-ভারতীয় অব্রাহ্মণদের তালিকায় ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যদের উল্লেখ কম। বেশি দেখা যায় শূদ্রদের। শূদ্রদের মধ্যেও দুইভাগ : যে শূদ্রদের স্পর্শ দূষণীয় নয়, আর যারা একেবারেই অস্পৃশ্য। তারা মন্দিরে ঢুকতে পারত না। মনে হয়, ব্রাহ্মণরাই ছিল সব ক্ষমতার অধিকারী এবং অব্রাহ্মণরা তাদের অধীনস্থ কর্মচারী ছিল। স্বভাবতই ব্রাহ্মণরা নিজস্ব বর্ণের প্রতি আনুগত্য ও বর্ণভিত্তিক সভার ওপর গুরুত্ব দিত। উদ্দেশ্য ছিল, অব্রাহ্মণরা যেন ঐক্যবদ্ধ না হয়ে ওঠে।
ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন ছিল। স্ত্রীপুরুষ নিজেরাও নিজেদের বিক্রি করত। অথবা, তৃতীয় কোনো ব্যক্তি তাদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করত। দুর্ভিক্ষের সময় অনেকে মন্দিরের কাজেও নিজেদের বিক্রি করত। তবে ক্রীতদাসের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। গৃহস্থবাড়ি বা মন্দিরেই ক্রীতদাস দেখা যেত। পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের জন্যে ব্যাপকহারে ক্রীতদাস নিয়োগের কথা শোনা যায়নি।
ব্রাহ্মণ ও শূদ্র ভিন্ন অন্যান্য বর্ণগুলোর মধ্যে পার্থক্য তেমন স্পষ্ট ছিল না। আর্থিক মর্যাদা অনুসারে বর্ণমর্যাদার পরিবর্তনও হতো। যারা রাজসভার কাজে নিযুক্ত থাকত, তাদের অনেক সময় বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো। রাজা রাজেন্দ্রের আদেশ সম্বলিত তাম্রপত্রের কারিগররা, কাঞ্চীপুরমের যেসব তাঁতীরা রাজপরিবারের জন্যে কাপড় বুনত বা রাজকীয় মন্দির বা রাজপ্রাসাদের প্রস্তর- শিল্পীরা কিছু কিছু করদানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল। তাছাড়া, এইসব তাঁতীরা অন্যান্য তাঁতীদের চেয়ে বেশি সম্মান পেত। এছাড়া মিশ্রবর্ণের কথাও নানা জায়গায় পাওয়া গেছে। মনে হয়, ব্রাহ্মণরা বর্ণ সম্পর্কে যতই কঠোর নিয়মবিধির উপদেশ দিক-না কেন, বাস্তবে তার যথেষ্ট বিচ্যুতি ঘটত এবং সেগুলো ক্ষমাও করা হতো।
আগের যুগ থেকেই মন্দির ছিল সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র। ছোট গ্রামের মন্দিরে শিক্ষকতার দায়িত্ব ছিল পুরোহিতদেরই। বড় গ্রামে মন্দিরের সঙ্গে পৃথক শিক্ষালয় থাকত। যেসব ব্রাহ্মণ এখানে শিক্ষালাভ করত, তারা মন্দিরের পুরোহিত বা স্থানীয় শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত হতো। বৌদ্ধ ও জৈন মঠে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তার সংখ্যা এত কম ছিল যে, সমাজে তার বিশেষ প্রভাব দেখা যেত না। শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে, নিয়মিত উপস্থিতি ও কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজনীয় ছিল। বিখ্যাত শিক্ষালয়গুলো এন্নায়িরাম, ত্রিভুবনী, তিরুবাদুতুরাই ও তিরুবরিয়ুরে অবস্থিত ছিল। শিক্ষাদানের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। মাতৃভাষা তামিলের ব্যবহার ছিল খুবই সামান্য, ফলে শিক্ষার্থীদের জীবন দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। সাধারণ মানুষের শিক্ষার জন্যে মৌখিক শিক্ষারও একটা ব্যবস্থা ছিল। তামিল সন্ন্যাসীরা শিব ও বিষ্ণু পূজার স্তবরচনা করে গিয়েছিলেন। অশিক্ষিত শ্রোতাদের কাছে স্তবগুলো গেয়ে শোনানো হতো।
সংস্কৃতভাষায় সাহিত্য রচনা করা হতো নির্দিষ্ট ধাঁচে। গ্রন্থ রচনার বিষয় ছিল ব্যাকরণ, অভিধান, অলংকার, প্রাচীন সাহিত্যের ওপর টিপ্পনী, গদ্য কাহিনী ও কাব্য। কাব্য রচনার নিয়মকানুন ক্লাসিক্যাল যুগেই বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সাহিত্যে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিরল ছিল। রচনা ক্রমশই কৃত্রিম হয়ে উঠতে লাগল। সংস্কৃত সাহিত্যে আদর্শে তামিল ভাষাতেও কিছু সাহিত্য রচনা হয়েছিল। কিন্তু সংস্কৃতের প্রভাব সত্ত্বেও এ যুগের তামিল সাহিত্যে যথেষ্ট সজীবতার স্পর্শ ছিল। উল্লেখযোগ্য তামিল সাহিত্যের মধ্যে কম্বনের রামায়ণ এবং কুট্টন, পুগানেভি জয়ানগণ্ডুর ও কাল্লাদানার-এর রচনা। বিভিন্ন শিলালিপির মধ্যে দীর্ঘ রচনার মান দেখেও বোঝা যায়, তামিল সাহিত্য রীতিমতো অগ্রসর ছিল। সংস্কৃত শব্দ তামিলভাষার মধ্যে প্রবেশ করে ভাষার সমৃদ্ধি সাধন করে। উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলোতে যদি তামিলভাষাকে গ্রহণ করা হতো, তাহলে হয়তো সে যুগের শিক্ষা ও বিদ্যাচর্চার মান আরো উন্নত হতো।
উপদ্বীপের সর্বত্র সংস্কৃতভাষা থেকে আঞ্চলিক উপভাষার জন্ম হলো। দাক্ষিণাত্যের এই নতুন ভাষাগুলো সংস্কৃত থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল না। যেমন, মারাঠী-ভাষা এসেছিল স্থানীয় প্রাকৃতভাষা থেকে। এছাড়া অন্য ভাষা, যেমন তামিল, তেলেগু ও কানাড়া ভাষা এসেছিল দ্রাবিড় মূল থেকে। কিন্তু এগুলোর শব্দসম্পদে সংস্কৃত প্রভাব ছিল খুব বেশি। কিন্তু নতুন ভাষাগুলোর যেমন বিবর্তন হচ্ছিল, মূলভাষার প্রভাব ততই কমে আসছিল। নবম শতাব্দীতে অন্ধ্র অঞ্চলে তেলেগুভাষা গড়ে উঠল। সংস্কৃত সাহিত্যে কোনো কোনো রচনা তেলুগুতে অনুবাদ করা হলো পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে। যেমন, রামায়ণ, মহাভারত ও কালিদাসের রচনা; এগুলো লেখা হলো মূলত সাধারণ মানুষের জন্যে। রাজকীয় সমর্থনের অভাব সাহিত্যের ক্ষেত্রে তেলেগুর ব্যবহারের প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছিল।
মহীশূর অঞ্চলের ভাষা কানাড়ার এরকম কোনো অসুবিধা হয়নি। রাজ- পরিবারের সমর্থন ছাড়া এই অঞ্চলের প্রভাবশালী জৈনরাও কানাড়াভাষাকে সমর্থন করল। এই ভাষা ওই অঞ্চলের ‘বীরশৈব’ বা ‘লিঙ্গায়ত’ আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠল। (এই আন্দোলন পরবর্তীকালের এবং আজকের মহীশূরেও ধর্মের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তির সৃষ্টি করেছিল।) এই যুগের প্রথমদিকে কানাড়াভাষা তেলুগুভাষার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু ক্রমশ তেলুগু অন্ধ্র অঞ্চলে প্রচলিত হয়ে গেল। কানাড়া ভাষায়ও প্রথমদিকের রচনা ছিল মূলত সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ।
পশ্চিম-দাক্ষিণাত্যে প্রচলিত মারাঠীভাষার প্রথমদিকে ওই একই ব্যাপার দেখা গিয়েছিল। ওখানকার যাদব-বংশীয় রাজারা মারাঠীভাষার প্রচারে উৎসাহ দেন। তামিল অঞ্চল থেকে এখানেও ভক্তি-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ওই আন্দোলনেও মারাঠীভাষাকে গ্রহণ করা হলো। ফলে মারাঠীভাষায় বহু জনপ্রিয় স্তব রচিত হলো এবং গীতা ও অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ অনূদিত হলো। এর সুফল হিসেবে মারাঠীভাষা শিক্ষিত মানুষের ভাষা হয়ে উঠল।
সংস্কৃতভাষা ও আঞ্চলিক ভাষাগুলোর যে পারস্পরিক দূরত্ব সৃষ্টি হলো, ধর্মের মধ্যেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। ব্রাহ্মণ ও হিন্দু দর্শনের ভাষা রইল সংস্কৃতে। আবার, বৌদ্ধ ও জৈনরাও সংস্কৃতভাষা ব্যবহার করতে লাগল। এই দুই ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা তখন বেশ কমে গেছে। এই যুগের শেষে বৌদ্ধধর্ম প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, বুদ্ধদেবকে বিষ্ণুরই এক অবতার বলে গণ্য করা হলো। কিন্তু জৈনধর্ম মহীশূরে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখল। মনে হয়, ভক্তি মতবাদের প্রসারই এই দুই ধর্মের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। তামিল অঞ্চল থেকে ভক্তি-আন্দোলন অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছিল। আরো ছিল, শিব ও বিষ্ণুর উপাসক সম্প্রদায়ের প্রসার। প্রাচীন স্তবগুলো এসময় একত্র করা হলো। এই জনপ্রিয় স্তবগুলোর ওপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক সাহিত্যে আরো নতুন রচনার সৃষ্টি হলো। স্তবগুলোর দার্শনিক চিন্তার সূত্র ছিল উপনিষদ। এগুলো বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ভক্তিবাদের বিতর্কের মধ্যে কিছুটা সমন্বয় করতে পেরেছিল। আগেকার সন্ন্যাসীদের স্থান নিলেন বৈষ্ণব আচার্যরা, তাঁরা এই সমন্বয়ে আরো সাহায্য করেছিলেন। শৈবধর্ম দক্ষিণ-ভারতে বেশ জনপ্রিয় ছিল। ওই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ আগের যুগের সন্ন্যাসীদের উপদেশ মতোই ওই যুগেও ধর্মাচরণ করছিল। তারাও নতুন সম্প্রদায়কে সমর্থন জানাল।
কিছু কিছু উগ্রসম্প্রদায়ের তুলনায় বলা যায় যে, ভক্তিবাদ প্রচলিত ধর্মের সঙ্গে মানিয়ে চলত। উগ্রসম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ছিল, তান্ত্রিক ও শাক্ত, কাপালিক, কালামুখ ও পাশুপত সম্প্রদায়। এইসব ধর্মগুলোর বেশ কিছু অনুরাগী ছড়িয়ে ছিল দেশের বিভিন্ন অংশে। এদের ধর্মাচরণের মধ্যে রক্তপাত ও যৌন- উচ্ছৃঙ্খলতাসহ নানা অদ্ভুত ধরনের আচার-অনুষ্ঠান ছিল। প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধাচরণ করাই ছিল এসবের মূল উদ্দেশ্য। কোনো কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রীতিমতো সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতারও পরিচয় পাওয়া যেত। আবার একথা বলা হয়েছে যে, এই ধরনের সম্প্রদায়ের অনুরাগী অধিকাংশ মানুষই স্বাভাবিক জীবনযাপন করত। কেবল মাঝে মাঝে এইসব আচার-অনুষ্ঠানে তারা অংশ নিত। বলা যায়, এইসব অনুষ্ঠান অংশগ্রহণকারিদের মনের ওপর একটা বিশোধন ক্রিয়া ঘটাত। এইসব সম্প্রদায়ের কেউ কেউ সামাজিক প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে অসামাজিক কাজকর্ম করত, ফলে তাদের কাম্য খ্যাতি তারা এইভাবে পেত। এইসব কার্যকলাপকে তারা ধর্মাচরণের সঙ্গে সংযুক্ত করত এবং এর মধ্যে ঐন্দ্রজালিক শক্তি আছে বলে দাবি করত।
কালামুখ গোষ্ঠী মানুষের মাথার খুলির মধ্যে খাবার রেখে খেত। নিজেদের সারা শরীরে চিতার ভস্ম মাখত (এই ভস্ম কখনো কখনো তারা খেতও)। এরা প্রায়ই একপাত্র মদ ও লাঠি হাতে করে ঘুরে বেড়াত। কোনো প্রমাণ না থাকলেও মনে হয় এরা নরবলিও দিত। এই ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের কোনো কোনোটি বহু প্রাচীন এবং এরা সেগুলো পুনঃপ্রচলন করে। তখনকার গোঁড়ামির আবহাওয়ায় নতুন চিন্তা বা জ্ঞানের ব্যাপারে বাধানিষেধ ছিল, অনেকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই অন্যরকম জীবনযাপন করত। যাদুবিদ্যায় আগ্রহ কেবল চমক লাগানোর জন্যেই জন্মায়নি। বিভিন্ন বস্তু নিয়ে নতুনভাবে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করার যে আগ্রহ, এটা তার একটা প্ৰমাণ।
তবে, সব প্রতিবাদের মধ্যেই যে প্রচলিত সামাজিক রীতির বিরুদ্ধাচরণ করার ঝোঁক ছিল, এমন নয়। যেমন শৈব উপাসকদের মধ্যে এ যুগে যেন নতুন সম্প্রদায় জন্ম নিয়েছিল, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল সক্রিয়। এদের মধ্যে লিঙ্গায়ত বা বীর শৈব সম্প্রদায় দ্বাদশ শতাব্দীতে সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। তামিল ভক্তিবাদ, জৈন ও বৌদ্ধদর্শন এবং ইসলামিক চিন্তার প্রভাব ছিল এই আন্দোলনের ওপর। এক ধর্মত্যাগী জৈন বাসবরাজ ছিলেন নতুন আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর বক্তব্যকে আরো ক্ষুরধার করে তোলে। তিনি লিখেছেন :
…কসাইখানায় নিয়ে যাবার পথে মেষশাবক তার নিজের গলার পাতার মালা খেয়ে ফেলে… সাপের মুখে আটকে থাকা ব্যাঙ উড়ন্ত মাছি খেতে চায়। আমাদের জীবনও সেইরকম। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও মানুষ দুধ ও ঘি খায়।… পাথরের ওপর সাপের মূর্তি খোদাই করা থাকলে তার ওপর মানুষ দুধ ঢেলে দেয়; আবার জীবন্ত সাপ দেখলে মানুষ বলে ওঠে মারো মারো। ঈশ্বরের সেবক খাবার চাইলে মানুষ বলে ‘চলে যাও’। অথচ ভগবানের প্রাণহীন মূর্তি খেতে পারবে না জেনেও মূর্তির সামনে খাবার সাজিয়ে দেওয়া হয়। [৪]
ভক্তিবাদের সঙ্গে লিঙ্গায়তদের পার্থক্য ছিল এই যে, তারা কেবল ঈশ্বরকে ভক্তি করাই উপদেশ দিত না। ধর্মীয় ভণ্ডামিরও বিরোধিতা করত। বেদ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলল। জন্মান্তরবাদ নিয়েও কথা উঠল। শিবকে উপাসনা করা হতো লিঙ্গপ্রতীকের সাহায্যে। সামাজিক বিবেক জাগ্রত করা ও ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিষিদ্ধ কোনো কোনো সামাজিক রীতিনীতি প্রবর্তনের ব্যাপারে লিঙ্গায়তদের অবদান আছে। এর মধ্যে ছিল যৌবনারম্ভের পর মেয়েদের বিয়ে এবং বিধবা-বিবাহ। স্বভাবতই লিঙ্গায়তরা ব্রাহ্মণদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। আবার, উদার মনোভাবের জন্যে এরা নিম্নবর্ণের মানুষের সমর্থন পেয়েছিল।
যেসব মানুষের মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিল না, তারা উপাসনার জন্যে নিজস্ব প্রতীক ও আচার-অনুষ্ঠান তৈরি করে নিয়েছিল। পরে ভক্তি-আন্দোলন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যেও তার প্রভাব পড়েছিল। ফলে, অনেক সময় দেবতাকে নরমূর্তিধারী হিসেবে পূজো করা হতো। এরকম একটি সম্প্রদায় ছিল পশ্চিম-ভারতের গান্ধারপুরের পাণ্ডুরঙ্গ বা শ্রীবিউল সম্প্রদায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরা একটি মাতৃ-উপাসক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রথমদিকেই পাণ্ডুরঙ্গকে বিষ্ণুর সঙ্গে অভিন্ন করে দেখা হয়েছিল। ক্রমে এটি দাক্ষিণাত্যের ভক্তি-আন্দোলনের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠল। কয়েকজন সন্ন্যাসী ও ধর্মপ্রচারক এই ধর্ম-সম্প্রদায়ের দ্বারা আকৃষ্ট হলো। এঁদের মধ্যে ছিলেন নামদেব, জনাবাই, সেনা ও নরহরি (পেশায় এঁরা ছিলেন যথাক্রমে দর্জি, পরিচারিকা, নাপিত ও স্বর্ণকার)। তাঁরা মারাঠীভাষায় স্তব রচনা করেন ও স্থানীয় অধিবাসীদের এই নতুন আন্দোলনে আকৃষ্ট করে তোলেন। ভক্তি-আন্দোলনের কেন্দ্রগুলো স্থানীয়-বাণিজ্যেরও কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
হিন্দুধর্মের দার্শনিক চিন্তা প্রায় কেবল ব্রাহ্মণদেরই অধিকারে পরিণত হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন মঠ ও শিল্পকেন্দ্রে ধর্ম সম্পর্কে বিতর্কসভা বসত। তাদের পারস্পরিক চিন্তা-বিনিময়ের ভাষা ছিল সংস্কৃত। কিন্তু তাদের চিন্তার প্রভাব ছিল সীমিত। শঙ্করাচার্য্যের দর্শন নিয়ে বেশ চর্চা হতো। আবার তাঁর বিরোধী দার্শনিকদের নিয়েও আলোচনা চলত। বিরোধীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বৈষ্ণব দার্শনিক রামানুজ (তৎকালীন মত অনুযায়ী তাঁর সময় ১০১৭ থেকে ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দ)। এই তামিল ব্রাহ্মণের জন্মস্থান ছিল তিরুপতি। শ্রীরঙ্গমের প্রসিদ্ধ মন্দিরে শিক্ষাদান করে তাঁর জীবনের অনেক বছর কেটেছিল।
মুক্তির প্রধান উপায় হলো জ্ঞান— শঙ্করের এই অভিমতকে রামানুজ মানেননি। রামানুজের মতে জ্ঞান হলো মুক্তির নানা পথের একটিমাত্র পথ। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পথ হলো গভীর ভক্তি— ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমৰ্পণ। ভক্তিমতবাদের মতোই রামানুজের মতবাদেও ঈশ্বরের প্রেম ক্ষমার আধার। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক এবং তার ভিত্তি প্রেম। হিন্দুদর্শন ও ভক্তিবাদের মধ্যে রামানুজ সেতুর ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং দুই পরস্পরবিরোধী দর্শনকে তিনি একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন।
উপমহাদেশের বিভিন্ন হিন্দু ধর্মকেন্দ্র ও শিক্ষাকেন্দ্রে রামানুজের মতবাদ ছড়িয়ে পড়ল। ঈশ্বরের ক্ষমা- যার ওপর রামানুজ জোর দিয়েছিলেন, ক্রমশ তা নিয়ে দ্বিমত দেখা দিল। উত্তরের দল বলল যে, এই ক্ষমা মানুষকে অর্জন করতে হবে। কিন্তু দক্ষিণের ভক্তরা বলল যে, ঈশ্বর নিজেই ক্ষমার পাত্র বেছে নেন। এই ধারণার সঙ্গে ক্যালভিনিস্টদের মতের আশ্চর্য মিল আছে।
ত্রয়োদশ শতকে কানাড়াভাষায় এক ধর্মপ্রচারক ছিলেন মাধব। তিনিও হিন্দু-দর্শন ও ভক্তিবাদের সমন্বয়ের চেষ্টা করছিলেন। মাধবও ছিলেন বৈষ্ণব। তিনি যে বিষ্ণুকেই একমেবাদ্বিতীয়ম, প্রকৃত ঈশ্বর বলে মনে করতেন, এই ধারণা রামানুজের দক্ষিণ-ভারতীয় অনুগামীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। মাধবও বললেন, ঈশ্বর কেবল পবিত্র আত্মাদেরই রক্ষা করেন। এর মধ্যে নিহিত আছে নির্বাচন, তবে দক্ষিণী সম্প্রদায় যেমন মনে করতেন— নির্বাচন সেরকম যথেচ্ছ নয়। মাধবের কিছু কিছু ভাবধারা থেকে মনে হয়, তিনি মালাবারের খ্রিস্টীয় চার্চের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন; সম্ভবত তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বললেন, বিষ্ণু তাঁর পুত্র বায়ুর মাধ্যমে তাঁর ক্ষমা দান করেন। এই ধারণা প্রাচীন হিন্দু ধর্মতত্ত্বে কোথাও নেই। কিন্তু এর সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের ‘হোলি গোস্ট’ ধারণার সাদৃশ্য আছে।
রামানুজ উচ্চবর্ণের জন্যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার সমর্থক হলেও শূদ্রদের মন্দিরে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার বিরোধী ছিলেন। তিনি শূদ্রদের জন্যে মন্দিরের দরজা খুলে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর আহ্বানে বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে, ভক্তি-আন্দোলনের সাফল্য ও ভক্তিবাদ প্রচারকদের সমন্বয়ের চেষ্টার ফলে প্রাচীনপন্থীরা কিছুটা আপস করতে বাধ্য হলো। শূদ্ররা মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি না পেলেও অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের কিছু কিছু দেবতা ও পূজাপদ্ধতি মন্দিরে প্রবেশ করল। এ ছিল অনিবার্য। নইলে সমাজে, বিশেষ উচ্চবর্ণের সমাজে মন্দির আর সামাজিক ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হতে পারত না। এর ফলে মন্দিরের বহিরঙ্গও দেখা দিল। অন্যান্য দেবতাকে স্থান দেবার জন্যে মন্দিরের পাশে নতুন মন্দির তৈরি করা হলো। আরো বেশি শ্রোতাকে শাস্ত্রপাঠ শোনার সময় জায়গা দেবার জন্যে মন্দিরের পাশে আলাদা চত্বর তৈরি করতে হলো। তাছাড়া, জনপ্রিয় ধর্ম-প্রচারকদের মূর্তি ও মন্দির স্থাপন করা হলো। মন্দির সংলগ্ন জমি আরো বিস্তৃত করা হলো। চোলযুগের সমৃদ্ধির সময় মন্দির নির্মাণে প্রচুর অলংকরণ করা হতো। দাক্ষিণাত্যে ক্ষুদ্রতর রাজবংশগুলোও, যেমন হোয়সল রাজবংশ, বিরাট মন্দির নির্মাণ করে প্রজাদের চমৎকৃত করতে চেষ্টা করত।
চোলযুগে পাহাড়কাটা মন্দিরের চেয়ে সমতল জমির ওপর খাড়া মন্দির নির্মাণের ঝোঁক বেশি দেখা দিল। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই যুগের বাড়িঘর এখন আর টিকে নেই, তবে মন্দিরগুলো আছে। মন্দিরের গর্ভগৃহ নির্মাণের ওপর চোলরা বেশি গুরুত্ব দিত। মন্দিরের আয়তন অনুযায়ী এক বা একাধিক হলোঘরের মধ্য দিয়ে গর্ভগৃহে পৌছতে হতো। গর্ভগৃহের বাইরে ওপরের দিকে উঁচু পিরামিড আকৃতির শিখর নির্মাণ করা হতো। শিখরের উচ্চতা হলো মন্দিরের আয়তনের অনুপাতে। মন্দিরের চারদিকে দেওয়াল বেষ্টিত প্রাঙ্গণ থাকত। এই দেওয়ালের ভেতরদিকে নির্দিষ্ট দূরত্বে সারি সারি থাম থাকত। উদাহরণ হলো, তাঞ্জোরের মন্দির ও গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দির। প্রবেশদ্বারগুলোর নির্মাণেও গর্ভগৃহের শিখর নির্মাণের ধাঁচ অনুকরণ করা হতো। প্রবেশদ্বারের ‘শিখরের’ উচ্চতা বাড়ানোর দিকে ক্রমশ ঝোঁক দেখা যায়। মাদুরার মীনাক্ষী মন্দির ও ত্রিচিনাপল্লীর কাছে শ্রীরঙ্গমে প্রবেশদ্বার ও গর্ভগৃহের ‘শিখরের’ উচ্চতা প্রায় একই।
কিছু কিছু ভাস্কর্যের মধ্যেও স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। মূল মন্দিরের মতো ভাস্কর্যও বিরাট আকৃতি নিল। স্তম্ভের শীর্ষদেশ ও স্তম্ভের অলংকরণের জন্য ভাস্কর্যের ব্যবহার হতো। চোলযুগের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের কারিগররা বেশি উৎকর্ষ দেখিয়েছে। এখানকার মূর্তিগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর যেকোনো ভাস্কর্য তুলনীয়। দেবতা, দাতা ও সন্ন্যাসীদের মূর্তি ছিল এগুলো। ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলো তৈরি হতো cire perdu, অর্থাৎ ‘লুপ্ত মোম’ পদ্ধতিতে। মূর্তিগুলো মন্দিরের ভিতরের অংশে রাখা থাকত। দক্ষিণ-ভারতীয় ভাস্করদের প্রতিভার নিদর্শন হিসেবে এই মূর্তিগুলো স্মরণীয়।
দাক্ষিণাত্যের মন্দিরগুলো আগেকার চালুক্যরীতিই অনুকরণ করেছিল। শুধু অলংকরণের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছিল। আগেকার দিনে ব্যবহৃত বালুপ্রস্তরের (sand stone) ব্যবহারের জায়গায় সোপ-স্টোনের (soap-stone) ব্যবহারের ফলে পাথরের চেয়েও সোপ-স্টোন ছিল অনেকে বেশি নরম। পরবর্তী চালুক্য ও হোয়সলদের আমলের মন্দিরের পরিকল্পনার মধ্যে নতুনত্ব ছিল। এর উদাহরণ হলো, হালেবিড়, বেলুড় ও সোমনাথপুরের হোয়সল মন্দিরগুলো। এইসব মন্দিরের ভিত্তিভূমি আগেকার মতো আয়তক্ষেত্রাকার না হয়ে বহুভূজাকৃতি করা হয়েছিল। তার মধ্যেই গর্ভগৃহ, অন্যান্য কক্ষ, হলঘর ইত্যাদি থাকত। পুরো মন্দিরটি উঁচু জায়গার ওপর নির্মাণ করা হতো। বড় মন্দিরগুলোতে আর উঁচুস্তম্ভ ও শিখর থাকত না বলে মন্দিরগুলোর উচ্চতা কম দেখাত। বহির্ভাগের সাজসজ্জার অঙ্গ ছিল মন্দিরের গায়ে সমান্তরাল কয়েকটি অলংকরণ। পশু, ফুল, নর্তক, গায়ক যুদ্ধের দৃশ্য ও ধর্মীয় সাহিত্যের দৃশ্যকে উপজীব্য করে অলংকরণ করা হতো। বহুভূজাকৃতির ফলে দেওয়ালের ক্ষেত্রফল ছিল অনেক বেশি এবং অলংকরণের স্থানও বেশি ছিল। হোয়সল মন্দিরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো চওড়া ও বেঁটে ধরনের স্তম্ভগুলো। এগুলো অত্যন্ত উন্নত নির্মাণ-কৌশলের পরিচায়ক।
ধার্মিক তাৎপর্য ছাড়াও মন্দিরগুলো রাজকীয় প্রতিপত্তি ও মহিমার ধ্বজাস্বরূপ ছিল। বিশেষত চোল রাজবংশের মন্দির সম্পর্কে এই দাবি করা যায়। চোল রাজাদের উত্থান পশ্চিম ও উত্তর-দাক্ষিণাত্যের শক্তিদের পছন্দ না হলেও এর থেকে প্রমাণ হয়ে গেল যে, উপমহাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র কখনো একস্থানে স্থির হয়ে থাকতে পারে না। এই শতাব্দীগুলোতে উন্নতির পথপ্রদর্শক ছিল দক্ষিণ-ভারত। উত্তর-ভারত সন্ত্রস্ত ও রক্ষণশীল হয়ে উঠেছিল। যত নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যত নতুন চিন্তাধারণা সবই এযুগে দক্ষিণ থেকে আরম্ভ হয়। স্বায়ত্তশাসনের বিবর্তন, শঙ্করাচার্য ও রামানুজের দর্শন, তামিল ও মহারাষ্ট্রীয় কারিগরদের সংগঠিত ভক্তিবাদ নামক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন, অথবা আরো প্রাথমিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে আরব বণিকদের স্বাগত জানানো, অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গঠন— এইসব দিক দিয়েই দক্ষিণ-ভারত তখন উন্নত সভ্যতার দিকে অগ্রসর। উত্তর-ভারত যখন স্থাণুবৎ, দক্ষিণের জয়যাত্রা তখন ছিল অব্যাহত।
***
১. উত্তরমেরুর লিপি, আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া রিপোর্ট— (১৯০৪-৫)। পৃ. ১৩৮
২. কে. এ. নীলকান্ত শাস্ত্রী – দি চোলস। পৃ. ৫৭৭
৩. মার্কো পোলো, ট্রাভেলস। পৃ. ২৩৭ (পেলিক্যান সংস্করণ) )
৪. বাসবরাজ। অনুবাদ : সোর্সেস অফ ইন্ডিয়ান ট্রাডিশন (থ. দ্য ব্যারি)। পৃ. ৩৫৭