জামিলার মা
আমার বয়েস তখন পাঁচ কিংবা ছয়। মাঘমাসের ফুটফুটে একটি ভোরবেলা। পদ্মমধুর রঙের ঝোলাগুড় আর নারকেলসহ গরম মুড়ি খেয়ে যথারীতি নিচে নেমে এসেছি। বাসনমাজা, কাপড়কাঁচা, স্নান, রান্নাবান্নার আয়োজন, পড়াশুনো হাঁকডাক-অর্থাৎ বড়ো সংসারের নানারকম কর্মব্যস্ততায় আমাদের বাড়ির নিচতলাটা মুখর। এমনসময়, পাশবালিশের ওয়াড়ের মতো দেখতে, আজানুলম্বিত সাদা খোলে ঢাকা একটি মূর্তি আমাদের বাড়ির প্রবেশপথে দেখা দিল। শুধু পা-দুটি বেরিয়ে আছে। চট্পট বাড়িতে ঢুকেই সেই খোলের ভেতর থেকে শুকনো আখের মতো দেখতে একটি বৃদ্ধা বেরিয়ে এল। আমার ডাকনাম ধরে ডাকল। ডাকটি যেমনই মধুর তেমনই আহ্লাদে ভরপুর। একটু হচকিয়ে গেলেও এক-পা দু-পা ক’রে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার জ্ঞান হবার পর তাকে দেখার এই প্রথম অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি। বৃদ্ধার বয়েস কম ক’রেও পঁয়ষট্টি হবে। শীর্ণ হ’লেও, লম্বা সটান দেহ । তার অস্থিপ্রধান মুখটি যেন ভাস্করের একটি সুখস্বপ্ন–যে ধরনের মুখাবয়ব দেখে শুধু তাদেরই নয়, চিত্রশিল্পীদেরও হাত নিশপিশ্ ক’রে ওঠে। এমন এক বৃদ্ধাকে দেখেই হয়তো এ-যুগের প্রখ্যাত ফরাসী ভাস্কর রদ্যা তাঁর ‘she who was once the helmet maker’s beautiful wife’ মূর্তিটি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার কোটরে-ঢোকা চোখ যেন দুটি ছোট্ট খয়েরি রঙের কড়ি। দৃষ্টি প্রখর কিন্তু কিঞ্চিৎ দুঃখমিশ্রিত। তার বাদামী রঙের চামড়াটি, চর্বির অভাবে এতই পাতলা যে, একটু নজর দিলে তার হাতের কব্জির তলায় নাড়ির স্পন্দনও পরিস্কার দেখা যায়। মলিন সাদা চুল-ক’টি, দেহ এবং চোখের রঙের সঙ্গে মিশে বেশ-একটা একরঙা সমন্বয় সৃষ্টি করেছে। মুখের ভেতর সর্বদাই পান, বাইরে মাতৃসুলভ হাসি। এই হাসিটি তার ভাঙাচোরা মুখটিতে একটি মুক্তোর অলংকারের মতো ঝক্ঝক্ করে। তার স্বাভাবিক দু-পাটি সুশ্রী দাঁত। মিশির ব্যবহারে একটু কাঁচে রঙ ধরলেও হাসির মাধুর্যে ঘাটতি পড়ে না। বরঞ্চ, ফাঁকবিহীন সুগঠিত দাঁতের বাহার যেন আরো বাড়িয়ে দেয়। অসংখ্য বলিরেখা কপালের একপ্রান্ত থেকে ঢেউ খেলে উঠে অপর প্রান্তে নেমে এসেছে। সেগুলো যেমনই সুক্ষ্ম, তেমনই একটির পর আরেকটি সুন্দর ভাঁজে সাজানো। গ্রীষ্মের ঘর্মাক্ত কপালে আলোর স্পর্শে, এই রেখাগুলো, একটি পাহাড়ী স্রোতস্বিনীর মতো ঝিক্মিক্ ক’রে ওঠে। পুষ্টির অভাবে তার স্তনযুগল শুকিয়ে গিয়ে দুটি হাওয়াবিহীন বেলুনের মতো ঝুলে বকের পাঁজরের সঙ্গে এমনই মিশে থাকে যে বিশেষ নজর না-দিলে সে-দুটির অস্তিত্ব টের পাওয়া দায়। একদিকে বার্ধক্য, আরেকদিকে দারিদ্র্য, এ-দুয়ের চাপে, হাড়ের ওপর মাংসের ক্ষয়িষ্ণু আবরণটি প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। এ-দেহটিকে সে অতি সাধারণ একটি আটহাতিধুসর রঙের ডোরাকাটা শাড়ি দিয়ে কোনো প্রকারে ঢেকে রাখে।
আমাদের বাড়িতে তার আনাগোনা নাকি অনেকদিন থেকে। আমার আপন বারোটি ভাইবোনদের শুধু জন্মাতেই দেখেনি, তাদের ডাকনামগুলোও তারই দে”য়া। কী বাহারের সব নাম-হীরা, চিনি, মোতি, সোনা ইত্যাদি। তার আসল কাজ ছিল বাবার যাবতীয় আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করবার জন্য নানারকম ফলমূল, মশলাপাতি এবং ধাতু, কালো পাথরের খোলে কিংবা শিলনোড়া দিয়ে পেষা। তারপর ছোটো-বড়ো ওষুধের গুলি পাকিয়ে শুকিয়ে নেওয়া।
বৃদ্ধা জাতে মুসলমান। বাড়ির সবাই তাকে জামিলার মা ব’লে ডাকে। শুধু জামিলার কেন, আমাদের মা বললেও অত্যুক্তি হয় না। অসুখে-বিসুখে বিপদে- আপদে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, সে আমাদের, বিশেষ করে বাড়ির কনিষ্ঠদের কাছে ছিল খুবই নিকটের লোক। পেন্সিলের শীষ ক’রে চেঁছে দেওয়া, তার কুচ্কোনো শীর্ণ ঊরুর চামড়ায় ঘষে আমাদের লাট্টুর লেত্তি পাকিয়ে দেয়া, হাফপ্যান্টের বোতাম শেলাই ক’রে দেয়া, এমন-কী ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেয়ার জন্যে কাঁচ গুঁড়ো ক’রে দেয়া–এসব আব্দারই জামিলার মা প্রশ্রয়শীলা মা-র মতোই সহাস্যে মেনে নিত। লেত্তির গোড়ায় মোরগফুলের মতো পাটের ঝুমকো বানিয়ে তাকে লাল-নীল-সবুজ রঙে ডুবিয়ে এমনই বাহার আনত যে, সেটি চমৎকার একটি হস্তশিল্পের নিদর্শন বললে একটুকুও বাড়াবাড়ি হয় না। বাড়ির কিশোরীদের বিনুনির ডগায়ও এ-ঝুমকো বেশ শোভা পেত। একেকদিন আমাদের সবার জন্যে লেত্তির পাক দিতে-দিতে এক ঊরুর ছাল উঠে গেলে আরেক ঊরু বাড়িয়ে দিতে জামিলার মা বিন্দুমাত্র ইতস্তত করত না ।
একবার বাবার সঙ্গে রোগীবাড়ির ভিজিট থেকে ফেরবার পথে আমি ঘোড়াগাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের উত্তেজনামূলক নানারকম দৃশ্য দেখছিলাম। এমনসময় হঠাৎ দরজা খুলে রাস্তায় চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাই। আমার ডান-হাতটি গাড়ির চাকার তলায় চ’লে যায়। ঝাঁটার মতো গোঁফওয়ালা স্বজাতি গুরুদাস ডাক্তার আসার অনেক আগেই জামিলার মা হদি-চুন পিষে গরম ক’রে আমার হাতে পট্টি বেঁধে দেয়। তার কোলে শুইয়ে রেখে আমার সর্বাঙ্গে ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে দেয়। এমন সুখস্পর্শে সব কষ্ট সব জ্বালা-যন্ত্রণাই জুড়িয়ে যায়। গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বিড়বিড় ক’রে আল্লাহর নাম ক’রে কী-সব বলে।
এ-ঘটনার বেশ-কিছুদিন পরেকার কথা। একদিন বিকেলে জামিলার মাকে একটি বড়ো কড়াইতে চ্যবনপ্রাশ ঢেকে রাখতে দেখি। সন্ধের অন্ধকারে লুকিয়ে তার ঘরে ঢুকে, সেই কড়াই থেকে বেশ খানিকটা চ্যবনপ্রাশ তুলে মুখে পুরে দিই। ঘণ্টাখানেক বাদে আমার মনে হ’ল যে, আমার সর্বাঙ্গ একটা পালকের মতো হাল্কা হয়ে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। জোর ক’রে মাটিতে পা ফেলে কোনো রকমে বই নিয়ে পড়তে বসলাম। লণ্ঠনের আলো থেকে রামধনুর মতো সাতরঙা রশ্মি কেঁপে-কেঁপে বেরিয়ে আমার বইয়ের পাতাকে রাঙিয়ে দিল। একটি লণ্ঠন দশটি হয়ে ঘরের মধ্যে পাক খেতে-খেতে একটি ঘূর্ণির রূপ ধরল। বেগতিক দেখে, কাউকে কিছু না-বলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার খাটটি আস্তে-আস্তে মেঝে থেকে উঠে,দক্ষিণের জানালা দিয়ে গ’লে বেরিয়ে গেল। আমাদের পাড়ার পর্তুগিজ গির্জের বাগানের মস্ত বড়ো কদম গাছটার মাথার উপর দিয়ে আকাশে উঠে, নবাববাড়ির ফটকের উঁচু মিনার পেরিয়ে শীতের শুকনো পাতার মতো, বুড়িগঙ্গার বালির চরে গিয়ে নামল। চরের ক্ষেতে অতিকায় ফুটবলের মতো অজস্র তরমুজ ফলেছে। দেখতে-দেখতে শুক্লপক্ষের নির্মল চন্দ্রালোক ফুটে উঠল। শুভ্র বালির চরের ওপর অবারিত উচ্ছ্বসিত জ্যোৎস্না আকাশের সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হ’ল। আমার মনে হ’ল আমি এখানে কী করছি! এমনসময় দুটি বৃহদাকার ট্যাংরা মাছ নদী থেকে ছলাৎ ক’রে লাফিয়ে চরে এসে পড়ল। একটির হাতে বেহালা, আরেকটির হাতে ডুগডুগি। তাদের হাবভাব দেখে বুঝতে কোনোই অসুবিধে হ’ল না যে, দুটোই বদ্ধ পাগল। দুটিতে মিলে আবোলতাবোল ছন্দের নৃত্যসংগীত, জনশূন্য, সুষুপ্ত নদীর চরটিকে, সাগরমেলার মতো কোলাহলময় ক’রে তুলল। তারপর হঠাৎ নাচগান থামিয়ে, ক্ষিদে পেয়েছে ব’লে, তরমুজ খেতে ব’সে গেল। রক্তবর্ণ তরমুজের রসে তাদের সারা শরীর টইটুম্বুর হয়ে হিচিক্ গুরুম্, হিচিক্ গুরুম্, আওয়াজে বিশ্রী ঢেকুর তুলতে আরম্ভ করল। এমনসময় বিরাট কালো মেঘের মতো একটি প্যাচার আগমন দেখেই ট্যাংরারা, বেহালা, ডুগডুগি ফেলে, ঝপাৎ করে লাফিয়ে বুড়িগঙ্গার জলের গভীরে মিলিয়ে গেল।
পরদিন ভোরে ঘটনাটি বলার সঙ্গে-সঙ্গেই জামিলার মা আঁতকে ব’লে উঠল, হায় আল্লাহ্, হায় আল্লাহ্। ও-কড়াইতে চ্যবনপ্রাশ নয়, মোদক।’ এ-কথা ব’লেই তাড়াতাড়ি এক হাঁড়ি তেঁতুল জল গুলে তাতে সাদা-কালো খয়েরি বেগুনী, নানারকম গুঁড়ো মিশিয়ে আমাকে খাইয়ে দিল। ঈষৎ তির তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলল, ‘এখানেই চুপ ক’রে বসে থাকো।’ প্রত্যহ ভোরে নটা বাজার সঙ্গে-সঙ্গেই জামিলার মা আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। বাড়ির একপ্রান্তে, নিচতলায়, তার স্যাঁতসেঁতে নির্ধারিত একটি ঘর। দুপুরবেলায় একদণ্ডের জন্যে, এক চিলতে রোদ ঘরটির চৌকাঠে একটি ত্রিকোণের আকারে, উঁকি দিয়েই স’রে পড়ে। পাশেই ছোট্ট একটি উঠোন। সেখানে শীতকালে জামিলার মা রোদে ব’সে ওষুধ পেষে। ঘরে ঢুকে বোরখাঁটি খুলে, সুন্দর পাট ক’রে এক কোণে রেখে দেয়। ছোটো বড়ো লম্বা চৌকো গোল পট্টি সেলাই ক’রে তার এই জীর্ণ আবরণটি বহু কষ্টে এখনো সে ব্যবহারের উপযুক্ত করে রেখেছে। সে-যুগের ঢাকা শহরে, গরীবই হোক, আর আমীরই হোক, যুবতীই হোক্, আর বৃদ্ধাই হোক্, বোরখাহীন মুসলমান স্ত্রীলোকদের সচরাচর রাস্তাঘাটে তেমন দেখা যেত না। তাছাড়া জামিলার মা-র আব্রুজ্ঞান, তার সমবয়েসীদের তুলনায়, একটু বেশিই ছিল। সেজন্যেই হয়তো, সেন-পরিবারের সঙ্গে চল্লিশ বছরের ওপর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বাবার মুখোমুখি হ’লেই আড়াই হাত ঘোমটা টানত।
জামিলার মা-র ঘরটি যেন একটি পশারির দোকান। নানারকম শুকনো, তাজা গাছ-গাছালি, লতাপাতা, গাছের ছাল চারদিকে ছড়ানো। একদিকে এ-সবের একটি মিশ্রিত গন্ধ, অন্যদিকে নানা মশলাপাতির গন্ধ-সব মিলে ঘরের ভেজা হাওয়াটুকুতে অক্সিজেনের কিছু আর অবশিষ্ট থাকত না। ঘরের মধ্যে সর্বদাই একটা গুমোট ভাব। জামিলার মা-কে এ-কথা বললে উত্তরে সে বলত, ‘মাছের আঁষ্টে গন্ধ নাকে না-গেলে মেছুনির প্রাণ যেমন অস্থির অস্থির করে, এ-সবের গন্ধ না-পেলে আমারও ঠিক তেমনই অবস্থা হয়।’ একেকদিন কোনো বিশেষ একটি গন্ধ আমাদের নাকে এমনই জ’মে বসত যে, এমন কী পায়েস খাবার বেলায়ও সে-গন্ধ পেয়ে আমাদের বিরক্তির সীমা থাকত না। বাতরোগের ওষুধ তৈরির সময় সে যখন একসঙ্গে কয়েক সের রসুন বাটতে বসত তখন আমাদের বাড়িছাড়া হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকত না। আর যেদিন হিং রসুন দুই-ই পেষা হ’ত সেদিনকার কথা তো ছেড়েই দিলাম। আবার তেমনি আরেকটি বিশেষ গন্ধ এখনো আমার নাকে লেগে রয়েছে। মৃতপ্রায় রোগীর হৃৎপিণ্ড চালু রাখার জন্মে আয়ুর্বেদের মহৌষধ, ‘বসন্ততিলক’, তৈরি করার সময়, লৌহ, অভ্র, এবং স্বর্ণ-ভস্মের সঙ্গে, জামিলার মা যখন কস্তুরি মেশাত, সে-গন্ধ আমাদের মতো কিশোরদেরও মাতোয়ারা ক’রে তুলত। আর যেদিন গোচোনার মিশ্রণে সে লৌহ কিংবা অভ্র শোধন করতে বসত সেদিন তার ঘরের চতুঃসীমানায় আর তিষ্ঠোনো যেত না ।
নারিন্দা থেকে আমাদের জিন্দাবাহার গলি পর্যন্ত তিন-চার মাইল রাস্তা জামিলার মা রোজ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে বোরখা গায়ে চলন্ত কাক তাড়ুয়ার মতো দেখতে হ’লেও, এমনই ক্ষিপ্র তার পদক্ষেপ যে, অনেক তরতাজা যুবককেই হার মানিয়ে দেয়। একদিন তাকে ক্ষ্যাপাবার উদ্দেশ্যে আমার সঙ্গে হাঁটার প্রতিযোগিতায় নামতে বলি। জামিলার মা হেসেই কুটিপাটি। আমাকে বলল, “তাহলে তুই দৌড়বি, আমি হাঁটব।” তাকে ক্ষ্যাপাতে গিয়ে উল্টে আমি নিজেই ক্ষেপে উঠে এই অন্যায় শর্তের ঘোরতর প্রতিবাদ করি। শেষ পর্যন্ত তার এই নির্দেশ হ’ল যে, আমি পাঁচ মিনিট আগে রওনা দেব। অর্থাৎ কিনা আমার পাঁচ মিনিটের হ্যাঁণ্ডিক্যাপ I
রাস্তায় লোকজনের বেজায় ভিড়। ঘোড়াগাড়িগুলো ধুলোর মেঘ উড়িয়ে এদিক- ওদিক ছুটছে। এই মেঘের ওপর পড়ন্ত নরম আলোর পটভূমিকায় এই যানবাহন, লোকজন, সব-কিছু ছায়ার মতো আবছা দেখাচ্ছে। তারই ভেতর থেকে, মানুষজনের ভিড় ঠেলে একটি হাল্কা ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। যাই হোক্, চিন্তা কিসের। আমাদের গন্তব্যস্থল নবাববাড়ির ফটক তো আর একশো গঞ্জের মধ্যেই। এই মনে ক’রে মহানন্দে হন্হন্ ক’রে এগুচ্ছি। আমার হাতে চিটি কেটে, পাশ-কাটিয়ে লোকজনের সঙ্গে মিলিয়ে গেল।
প্রত্যহ আমাদের বাড়িতে প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গেই জামিলার মা তার ওষুধ-পেষার কাজে লেগে যায়। তারই মাঝে-মাঝে আমাদের ছোটোখাটো ফাইফরমাস খাটতে সে সর্বদাই রাজি। তার হাতে মাখা লংকা আর রসুনকুচি এবং ধনেপাতাসহ তেলমুড়ি, কিংবা ঝালনুন, পুদিনার পাতা, একটু আমলকী ভস্ম মিশিয়ে কদবেলের চাটনির কথা মনে এলে এখনো আমার জিভ জলে টস্টসিয়ে ওঠে। তাছাড়া, তার হাতের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল। হামানদিস্তায় মুড়ির ছাতুতে আখের গুড়, একচিমটি জিরে-নুন্ আর জায়ফল, দু-ফোঁটা লেবুর রসের অনুপাতে দিনের পর দিন খেয়ে একটুও বিস্বাদ কিংবা একঘেয়ে মনে হ’ত না। বলা বাহুল্য, এ-ধরনের জলখাবার তৈরিতে তার অনুপাত জ্ঞান ছিল নিখুঁত।
আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্ততে ফল-মূল পাতা-মশলা ইত্যাদি নানা উপকরণের মধ্যে কয়েকটি আমাদের খুব প্রিয় জিনিস থাকত। জাম, আমলকী, ফলসা, কিশমিশ, মনাক্কা, মিছরি- এ-সবই জামিলার মা-র হেপাজতেই রাখা থাকত। এদিক-ওদিক ভালো ক’রে দেখে নিয়ে, হয় দুটি কিশমিশ, কিংবা মনাক্কা, আমলকী কিংবা কয়েকটি ফলসা, নিদেনপক্ষে ছোট্ট একটুকরো মিছরি আমাদের হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে বলত, ‘যাঃ! যাঃ! শিগগির পালা।’ তাছাড়া, বিশুদ্ধ গাওয়া-ঘি এবং মিছরি-দেয়া চ্যবনপ্রাশও আমাদের ভাগ্যে কখনো-কখনো জুটত। স্বাদে হালুয়ার চাইতে কোনো অংশে কম মনে হ’ত না। আরেকটি অতি উপাদেয় খাবারের কথা তো ছেড়েই দিচ্ছিলাম। যার আয়ুর্বেদিক নামটি শুনে অনেকেই হক্চকিয়ে উঠবে, নামটি হ’ল ‘কুষ্মাণ্ড খণ্ড।’ চালকুমড়োর ছোটো ছোটো টুকরো ঘিয়ে ভেজে, ত্রিফলা, চিনি ইত্যাদিসহ পাক দিয়ে তৈরি এই মিষ্টিটি দিল্লী-আগ্রার বাদশাহী আমলের ‘পেঠা’কেও হার মানিয়ে দেয়। আমাদের প্রতি তার এ-ধরনের গোপন প্রশ্রয়-পুর্ণতার খবর কোনোপ্রকারে বাবার কানে পৌঁছতেই তিনি জামিলার মা-কে একদিন তলব করলেন। তাকে ভর্ৎসনা করতে গিয়ে তিনি থমকে গেলেন। আড়াই হাত ঘোমটার আড়াল থেকে এক-ফোঁটা জল বৃদ্ধার পায়ের কাছে পড়তেই বাবা আর এগুলেন না ।
হাজার হোক্ সেন-পরিবারের সেবায় প্রায় অর্ধশতাব্দী উৎসর্গীকৃত তার জীবন। যে-পরিবারের ছেলেমেয়েদের প্রতি তার মায়ামমতার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না, ঝড়বৃষ্টি, গ্রীষ্ম, শীত, রমজান-ঈদ্, সব উপেক্ষা ক’রে প্রত্যহ ছ-সাত মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে, বিনা কামাইয়ে, হাজিরা দিয়ে এসেছে, এমন মানুষকে, এ-সামান্য অপরাধে কিছু বলা তো নিজেকে ছোটো জাহির করা।
জামিলার মা-র চরিত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। যে-দিকটি তার চাইতে অনেকগুণ বেশি আর্থিক সচ্ছলতা-সম্পন্ন লোকদের মধ্যেও দেখা যায় না। কৈশোর বৈধব্য এবং নিদারুণ দারিদ্র্য সত্ত্বেও তার গর্বকে কোনোদিন সে খর্ব হতে দেয়নি। দুঃখ-কষ্টের ফিরিস্তি জানিয়ে মাসহারা বৃদ্ধির আবেদন ঘুণাক্ষরেও তার কোনোদিন মনে আসেনি। তদুপরি, হিন্দু পরিবারে চাকরি করার সর্ব প্রকার সামাজিক বিধিনিষেধই সে মাথা পেতে নিয়েছিল। জীবনের বহুলাংশ সময় সেন- পরিবারের সেবায় আত্মনিয়োগ করা সত্ত্বেও আমাদের বাড়িতে তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল। আর পুজোর ঘরের কথা তো ছেড়েই দিলাম। ভিন্ন সম্প্রদায়ী ব’লে এ-ধরনের অন্যায় ভেদাভেদের কথা ভেবে আমাদের বিরুদ্ধে সামান্য অভিযোগও সে কোনোদিন মনে পোষেনি।
জামিলার মা-র রোজকার কাজের প্রধান অংশটি তার বয়েস এবং জীর্ণ দেহের পক্ষে বেশ পরিশ্রমসাধ্য ছিল। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাথরের খলে কিংবা বড়ো শিলনোড়া নিয়ে ওষুধ-পেষা যেমনই ছিল একঘেয়ে তেমনই কষ্টসাধ্য। বিশেষ ক’রে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে। তাছাড়াও ওষুধের কিছু উপকরণ পেষার্ আগে হামানদিস্তায় অনেকক্ষণ ধরে গুঁড়ো করে নিতে হত। এখনো মনে পড়ে গন্ধকের সঙ্গে পারদ মিশিয়ে একটি কজ্জলি তৈরি করার কথা। পারদ একটি এমনই ধাতু যা সহজে অন্য কোনো পদার্থের সঙ্গে মেশে না। হপ্তার পর হপ্তা কেটে যেত এ-ধরণের ওষুধ পিষতে। দম দেয়া জাপানী খেলনার মতো তার শীর্ণ হাতদুটি অবিরাম, একঘেয়ে ছন্দে, নড়তে থাকে। মাঝে-মাঝে জ্যেষ্ঠদের চোখের আড়ালে আমরা তার এই কাজে সাহায্য করে তাকে সাময়িক বিশ্রাম দিতাম। বদ্ধপাগলের ন্যাড়া ব্রহ্মতালুতে ঠাণ্ডা পট্টির জন্যে একটি ওষুধ তৈরি করতে জামিলার মা-র মতো কষ্টসহিঞ্চু লোকেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে আর কী! পাথরের বড়ো খলটিতে টাটকা কচি ডাবের জলের মধ্যে সাদা, গোল এবং চ্যাপ্টা আটার পিণ্ডের আকারের একটি পদার্থ। খলটি জামিলার মার প্রসারিত পায়ের মাঝখানে রাখা। ধনুকের মতো মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে সন্তর্পণে নোড়াটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সামনে-পিছনে নাড়াবার দৃশ্যটি এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। উঃ। কী হাড়ভাঙা কাজ। প্রত্যহ দুপুরে রোগী-দেখার পালা শেষ ক’রে, ওপরে যাবার আগে, বাবা ওষুধটির অগ্রগতি একবার পরীক্ষা ক’রে জামিলার মা-কে বলেন, ‘উঁহুঁ! এখনো হয়নি।’ জামিলার-মা-কে তার নিজের কথা–স্বামী, পরিবার, ভাইবোন বাবা-মা-র কথা জিজ্ঞেস করলে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু বলে, ‘হায় আল্লাহ্!’ সঙ্গে-সঙ্গেই চোখ ছলছল ক’রে ওঠে। বাড়ির জ্যেষ্ঠদের কাছে শুনেছি তার বাল্য-বিবাহ হয়েছিল। খুব গরীব ঘরে তার জন্ম। বাবা সামান্য ফেরিওয়ালা ছিল। ভাইবোন সংখ্যায় অনেক। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ পুষ্টির অভাবে অকালেই মারা যায়। স্বামী কোনো মুসলমানী খাবারের দোকানে রুটি বেলত। নিজের একটিমাত্র কন্যা বেঁচে ছিল। আরেকটি মৃতাবস্থায়ই জাত হয়। কন্যা জামিলাকে বিবাহ দিয়েছিল একটি রাজমিস্ত্রির সঙ্গে। মোটামুটি সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যেই তাদের দিন কাটছিল, কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হ’ল না। বাড়ি তৈরির কাজে একদিন তিনতলা প্রমাণ বাঁশের মই ভেঙে গিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে তার অপমৃত্যু ঘটে। এ অনিত্য সংসারে কিছু মানুষ এমনই পোড়াকপাল নিয়ে জন্মায় যে সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য যেন কিছুতেই তাদের ধাতে সয় না। সারা জীবনটাই যেন একটি অবিরাম বিয়োগান্ত নাটক। দুঃখই তাদের স্বাভাবিক সঙ্গী। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, তাদের দুঃখীজীবন শুধু দীর্ঘায়ুই হয় না, দুঃখকে কেন্দ্র ক’রে ঘানির বলদের মতো সারা জীবন তারা পাক খেতে-খেতে নিঃশেষ হয়ে যায়। তাদের চিরন্তন, দুঃখ- জর্জরিত অস্তিত্বে এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন তাদের কাছে সুখ-দুঃখ তারতম্যহীন হয়ে যায়। একমাত্র কন্যা জামিলাও যখন অচিরেই বিদায় নিল, স্বাভাবিক নিয়মে তার বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্যই থাকতে পারে না। তার আপনজনেরা একে- একে বিদায় নিলেও তার জীবনকে সে নিঃস্ব কিংবা নিরর্থক হতে দেয়নি। আমাদের পরিবারের সঙ্গে একাত্ববোধে তার বাকি জীবনকে সার্থক ক’রে তুলতে সে এতটুকু কার্পণ্য করেনি। বিশেষ ক’রে, আমাদের মতো কনিষ্ঠদের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমরাই ছিলাম তার নাড়ীর স্পন্দন। বছরের পর বছর বাজিমাৎ-করা ঘোড়াকেও একদিন ঘোড়দৌড়ের মাঠ থেকে বিদায় নিতে হয়। তেমনি জামিলার মা-কেও একদিন সেন-পরিবারের সেবা থেকে অবসর গ্রহণ করতে হ’ল। তবুও বুড়ির মন আমাদের বাড়িতেই প’ড়ে থাকে। টুকটুক ক’রে হেঁটে এসে মাঝে-মাঝে আমাদের দেখে যায়। এখনো মনে পড়ে গ্রীষ্মের দুপুরের রোদে ডাণ্ডাগুলি খেলে আমার, “হদির লাখান্ সোনার রঙটা পুইড়া গেছে,” দেখে তার কী আপসোস, প্রায় চোঁখে জল আসে আর-কী! নিদারুণ দুঃখ এবং দৈন্য সত্ত্বেও যে মহান প্রাণ আমাদের মানুষ ব’লে গ্রহণ করেছিল, আমাদের কাছে সে চিরকাল একটি মুসলমানই রয়ে গেল।
জীবনে একটির পর একটি মর্মান্তিক আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও খোদাতালার ওপর জামিলার মা-র বিশ্বাস ছিল অটল। তাই শত কাজের মধ্যেও তার করুণ প্রার্থনা করা একদিনও বাদ পড়েনি। পরিষ্কার জলে হাত-পা ধুয়ে পবিত্র শরীরে এবং হৃদয়ে, ভিক্ষাহস্তে, হাঁটু ভাঁজ-করা তার নীরব মুর্তিটি একটি মুঘল শৈলীর উৎকৃষ্ট ছবির মতো এখনো আমার মনে আঁকা আছে। যে-ছবিটি অতি ধুসর তামাটে, নীল-সবুজ এবং ছাই রঙে আঁকা। দক্ষিণের ছোটো জানালাটি দিয়ে একফালি প্রতিক্ষিপ্ত মোলায়েম আলো এসে তার সর্বাঙ্গের বহিঃরেখা, স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘুটির পটভূমিকায় ভোরের আলোয় একটি তৃণখণ্ডের মতো পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। খোদার তারিফে এই মুখটি এক অবর্ণনীয় মাধুর্যে দীপ্ত-যে-দীপ্তি একমাত্র নির্মল হৃদয়ের এবং পরসেবাব্রতী লোকদের মুখেই প্রকাশিত হয়। দুঃখের অতল গহ্বর ভেদ ক’রে যে- মুখে এমন শ্রী ফুটে ওঠে, সে-মুখ কে ভুলতে পারে! এই ভবসাগরে ডুব দিয়ে জামিলার মা কোন্ সত্যকে খুঁজেছিল তাই-বা কে জানে!