বিষ্ণুপুরের সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ মানুষটির চিরপ্রস্থান হলো সবচেয়ে অনাড়ম্বরভাবে।
দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পরও মাস কয় কেটে গেছে। কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে গঙ্গামহলে কোনো সাড়াশব্দ নেই। যা খানিকটা শোক প্রকাশ ছিল তা ওই রেণুকার বাবার বাড়ির তরফে। তারা প্রভাবশালী কেউ নন। খবর শুনে এসে কেঁদে-কেটে বিদায় নিয়েছেন। আর সকলেই প্রায় যার যার মতোন চুপচাপ। রেণুকা, সর্বজয়া বা আর সবাই। হরিহরণ কোনো খবর পায়নি। তবে সে গঙ্গামহলে এসেছিল হেমাঙ্গিনী দেবীর সিদ্ধান্তের কথা দেবেন্দ্রনারায়ণকে জানাতে। হেমাঙ্গিনী দেবী যে দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে দেখা করতে চায়, কথা বলতে চায় সে কথা জানাতে। এসে দেখে দেবেন্দ্রনারায়ণের শবদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্মশানে। কিন্তু শ্মশানঘাট অবধি আর হরিহরণ যায়নি।
দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু নিয়ে বীণাবালা-দ্বিজেন্দ্র’র তরফে কোনো উচ্চবাচ্যই দেখা যায়নি। এ যেন বাড়ির আনাচে-কানাচে থোক থোক করে ঘুরে বেড়ানো ইঁদুরটির মৃত্যু। মরে পড়ে রয়েছে ঘরে, পচে গন্ধ ছড়াবে, তার আগেই তাড়াতাড়ি বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দাও। দেবেন্দ্রনারায়ণের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানখানাও হলো নামমাত্র। তাতে কাউকে বলা হলো না। কোনো ভোজ হলো না। যেন গঙ্গামহলের কোনো অতিরিক্ত অক্ষম ভৃত্য বা দাসীর মৃত্যু হয়েছে। মরেছে তো জঞ্জাল দূর হয়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণের এমন শেষকৃত্য নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও ভেতরে-ভেতরে যে ছোটখাট কিছু অসন্তোষ দানা বাধেনি তা নয়।
তবে বিভূতিনাথ সাহা একটা বিষয়ে চমকে গিয়েছিলেন। সেটি হলো দেবেন্দ্রনারায়ণের এই হঠাৎ মৃত্যুতেও প্রজাদের ঢল নেমেছিল শ্মশানে। এই মৃত্যুসংবাদ সেভাবে কাউকে জানানো হয়নি। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের এই মৃত্যুতে বীণাবালা আর বিভূতিনাথ সাহার নিকট আরো একটি সত্য প্রতিভাত হলো। সত্যটি হচ্ছে আশেপাশের জমিদার তল্লাট থেকে শুরু করে দূর-দূরান্তের অঞ্চলেও দেবেন্দ্রনারায়ণ সুপরিচিত এক নাম। প্রবল প্রভাবশালী বর্ণাঢ্য এক চরিত্র।
যদিও গঙ্গামহল থেকে কাউকেই কিছু জানানো হলো না। এমনকি দীপেন্দ্রনারায়ণকেও না। প্রজাদেরও না। তারপরও শ্মশানঘাটে লোকের ভিড় দেখে বিভূতিনাথ সাহা ভড়কে গিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণের মতোন এক খামখেয়ালি অত্যাচারী মানুষকেও প্রজারা এত পছন্দ করত!
সে কথা বীণাবালাকে বলেওছিলেন বিভূতিনাথ সাহা। কিন্তু বীণাবালা তাতে খুব একটা গা করেননি। সিন্দুক উধাও হওয়ার পর বহুসময় অতিক্রান্ত হলেও সেই সিন্দুকের কোনো ব্যবস্থা আর করা যায়নি। শুধু তাই-ই নয়, বেণুচন্দের বাজারে লখাই স্যাকরার দোকানে অলঙ্কার বিক্রি করতে আসা অজ্ঞাত সেই মানুষটির খোঁজও এখনও মেলেনি। তার ওপর ভুজঙ্গ দেব হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন। বেশ কিছুদিন কোথাও তার কোনো খবর পাওয়া গেল না। এ নিয়ে বীণাবালা ভারি চিন্তিত ছিলেন। স্বাভাবিক ঘটনা নিয়েই তার নানান সন্দেহ, নানান দুশ্চিন্তা। সেখানে ভুজঙ্গ দেবের এমন উধাও রহস্য নিয়ে তিনি আবারো প্রবল অস্থিরতায় ভুগতে লাগলেন। সারাক্ষণ নানান সন্দেহ, নানান দুশ্চিন্তায় ক্লিষ্ট হয়ে পড়লেন তিনি।
শেষ অবধি অবশ্য ভুজঙ্গ দেবকে পাওয়া গিয়েছিল সুদূর উত্তরে এক নদীর চরে। কিন্তু সেই ভুজঙ্গ দেবকে দেখে আর চেনার উপায় ছিল না। তার চোখের কোটরে চক্ষু ছিল না। কেবল কোটরগুলো হা করে ছিল। চোখগুলো খুটে খেয়ে ফেলেছিল মাছে। হাতে-পায়ে চামড়া নেই, মাংস নেই, পচে গলে মিশে গিয়েছিল জলে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! তার গলার মালা আর হাতের সোনার বালা দেখে তাকে সনাক্ত করা গিয়েছিল। বীণাবালা জানেন না কেন, কিন্তু ভুজঙ্গ দেবের এই অবস্থা দেখার পর তিনি আবারও একটু একটু করে তার আগের সেই অসহ্য অবস্থাটায় ফিরে যেতে শুরু করেছিলেন। রাতে হঠাৎ হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। মাথার ভেতর সেই ভয়ংকর যন্ত্রণাটি আবার টের পাচ্ছিলেন। অজস্র মৌমাছির সেই একসাথে করা অসহ্য গুঞ্জন যেন ফের ফিরে আসছিল। বীণাবালা ভেতরে ভেতরে সর্বক্ষণ এক অজানা তীব্র আতঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছিলেন এমন দীর্ঘদিন চলল। তারপর কিছুদিন আবার সব ঠিকঠাক। কিন্তু ছোটখাট কোনো সমস্যা হলেই মাথার ভেতরটা অশান্ত হয়ে ওঠে। সারাক্ষণ ওই গুঞ্জন আর মাথা যন্ত্রণা। এই নিয়ে তার ভেতর তীব্র আতঙ্ক। এই তীব্র আতঙ্ক ভুলে থাকার উপায় একটিই, নিজেকে ব্যস্ত রাখা। বীণাবালা চেষ্টা করছেন যেকোনো উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ মারা গেছেন মাস তিনেক হলো। এর মাঝে তার অনাড়ম্বর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নিয়ে নানান কথা বীণাবালার কানে এসেছে। তা যে কেবল বিষ্ণুপুরের প্রজারাই বলছে, তাও না। আশেপাশের বা দূরের বহু জমিদার তল্লাট থেকেও এই নিয়ে নানান উল্টাপাল্টা কথা হচ্ছে। সে সকল কথা ডালপাল ছড়াচ্ছে আরো জঘন্যভাবে। তাতে কোথাও কোথাও দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুকে অস্বাভাবিকও বলা হচ্ছে। আর এ সকল কিছুর জন্য আকারে ইঙ্গিতে বীণাবালাকেই দোষী করা হচ্ছে। বীণাবালার সাথে দ্বৈরথে সর্বৈব অর্থেই দেবেন্দ্রনারায়ণের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে। কিন্তু তারপরও বিজয়ীর আনন্দটি ঠিক পাচ্ছেন না বীণাবালা। কোথায় যেন একটা অস্বস্তির কাঁটা সবসময় খচখচ করছে। কারণটিও তিনি বুঝতে পারছেন, মানুষ দেবেন্দ্রনারায়ণকে মনে মনে ভারি পছন্দ করত। তা সে বিষ্ণুপুরের সাধারণ প্রজা হোক আর দূরের কোনো জমিদার বা মান্যগন্য লোকই হোন। আজকাল বীণাবালার প্রায়ই মনে হয়, জীবিত দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে জিতলেও মৃত দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে তার পরাজয় ঘটেছে। চূড়ান্ত পরাজয়।
কিন্তু এই সকল কিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বীণাবালার আবারো মনে হলো, তিনি কোনোভাবেই হেরে যাওয়ার মানুষ নন। যে কোনো উপায়েই হোক, তিনি সকল ক্ষেত্রেই জিততে চান। জিততে না পারলেও অন্তত চেষ্টা করে দেখতে চান। এই ভাবনায়ই তিনি সেদিন বিভূতিনাথ সাহা, গৌরাঙ্গ বাড় জ্জে আর দিবাকর চাটুজ্জেকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। দিবাকর চাটুজ্জেকে নিয়ে বীণাবালার মনে নানান সন্দেহ থাকলেও সেই সন্দেহের স্বপক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ তার হাতে নেই। ফলে আলোচনায় তাকেও ডাকা হলো। সেই আলোচনায় বীণাবালা একখানা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তার সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ তেমন কোনো আপত্তি করল না। বিভূতিনাথ সাহার বরং মনে হলো এর চেয়ে যুতসই কিছু আর এ মুহূর্তে হতে পারে না।
আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত হলেও তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানটি এখন আবার অনেক আড়ম্বর করে পালন করা হবে। সেই অনুষ্ঠানে প্রজাদের নিমন্ত্রণ যেমন থাকবে। থাকবে আশেপাশের এবং দূর-দূরান্তের জমিদার ও গণ্যমান্য লোকদের জন্য বিশেষ নিমন্ত্রণপত্রও। এতে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি বধ করতে চান বীণাবালা। প্রথমত বিষ্ণুনারায়ণ বা দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর বিষ্ণুপুরের জমিদারি যে যোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতেই পড়েছে, সেটি প্রমাণ করা। দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী কার্যকলাপ নিয়ে চারপাশজুড়ে যে অসন্তোষ, যে ফিসফিসানি শুরু হয়েছে তা বন্ধ করা। তবে এর চেয়েও বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে গঙ্গামহলের চুরি। যাওয়া সেই সিন্দুক উদ্ধারে বা খোঁজ বের করতে নতুন পরিকল্পনার জাল বিস্তৃত। করা।
বীণাবালা দীপেন্দ্রনারায়ণের খোঁজ পেয়েছেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ যে সুদূর রাজপাঠিয়াগড়ে মহল কিনে এখন সেখানকার চন্দ্রদীপপুর নামক জমিদারির জমিদার, সে কথাও তিনি জানেন। কিন্তু সেখানে দীপেন্দ্রনারায়ণের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা বীণাবালার নেই। আর নেই বলেই এই বিকল্প চিন্তা। বীণাবালা যে দীপেন্দ্রনারায়ণের এই ঘটনা জানেন, তা তিনি ধরা দেননি। তিনি দীপেন্দ্রনারায়ণের শ্বশুরালয়ে লোক পাঠিয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ করেছেন। সঙ্গে গঙ্গামহলে দীপেন্দ্রনারায়ণের ফিরে আসার জন্য পত্রও পাঠিয়েছেন।
পিতৃভিটা ছেড়ে দীপেন্দ্রনারায়ণ কেন শ্বশুরালয়ে এত দীর্ঘসময় অবস্থান করছেন সে বিষয়ে তার মনোকষ্টের কথাও জানিয়েছেন। পত্রে দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু সংবাদ পাঠানোর পাশাপাশি বীণাবালা তার নিজপুত্র বর্তমান জমিদার দ্বিজেন্দ্রনারায়ণের নানান অপরিপক্কতার কথাও জানিয়েছেন। সম্প্রতি এই জমিদারির গুরুদায়িত্ব পালন করতে রাজি নন বলে দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ তার অপারগতা প্রকাশ করেছে বলেও পত্রে উল্লেখ করেছেন বীণাবালা। পত্রের শেষে তিনি যত্ন করে লিখে দিয়েছেন যে দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বিষ্ণুপুর জমিদারির জন্য যথার্থ লোক নয়। এদিকে দেবেন্দ্রনারায়ণের অকাল প্রয়াণে গঙ্গামহলে প্রবল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। বীণাবালা নিজেও শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন। ফলে প্রজাদের মাথার উপর ছায়া বলতে কেউ নেই। এই মুহূর্তে দীপেন্দ্রনারায়ণ যদি বিষ্ণুপুর জমিদারির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন, তবে তা সর্বৈব অর্থেই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। কারণ দীপেন্দ্রনারায়ণ ব্যতিত বিষ্ণুপুর জমিদারির দায়িত্ব পালনে এই মুহূর্তে যোগ্য ব্যক্তি আর দ্বিতীয়টি নেই।
এই পত্রপাঠমাত্রই যে দীপেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহলে ছুটে আসবে, এমনটিও ভাবছেন না বীণাবালা। এটি তার পুরো পরিকল্পনার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। মাছের সামনে বড়শির টোপ ঝুলিয়ে দেয়ার মতো। তিনি জানেন এতে কাজ হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তার আসল ভাবনা অন্য। তিনি চাইছেন নিমন্ত্রিত অতিথি, অন্যান্য জমিদার, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মুখে গঙ্গামহলের সিন্দুক চুরির কথা প্রকাশ করবেন। সাথে বেণুচন্দের বাজারে লখাই স্যাকরার দোকানে। পাওয়া সেই প্রাচীন স্বর্ণালঙ্কারখানাও সকলকে দেখাবেন। তারপর চুরি যাওয়া সিন্দুকগুলোর খোঁজ পেতে সকলের সহযোগিতা কামনা করবেন। এমন স্বর্ণালঙ্কারের খোঁজ যেখানেই পাওয়া যাক না কেন, সাথে সাথে যেন গঙ্গামহলে জানানো হয়। কেউ যদি এই অলঙ্কারের প্রকৃত সন্ধান দিতে পারে তবে তার সাথে গঙ্গামহলের আজীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূচনা করা হবে। বর্তমান জমিদার দ্বিজেন্দ্রনারায়ণের বিবাহের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। সেক্ষেত্রে গঙ্গামহলের অমন শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুর খোঁজ যদি প্রকৃতই পাওয়া যায়, এবং তার। উপযুক্ত কন্যা বা ভগ্নী থেকে থাকে তবে তার সাথে আনন্দচিত্তে নব সম্পর্কের। সূচনাও হতে পারে।
বীণাবালা নিশ্চিত, দীপেন্দ্রনারায়ণ দূর কোনো শহর, বন্দর বা গঞ্জে সিন্দুকের সেই স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। কারণ এখন তার প্রচুর নগদ অর্থের প্রয়োজন। ফলে এই স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির সাথে তার যুক্ততা প্রমাণ খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই মানুষগুলোর সহায়তা খুব দরকার বীণাবালার। এই ঘটনার সাথে দীপেন্দ্রনারায়ণের সংশ্রব যদি একবার হাতে-নাতে প্রমাণ করা সম্ভব হয় তবে বীণাবালা তার এতদিনের বকেয়াসহ সকল হিসেব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেবেন। বিষ্ণুপুরের কনিষ্ঠ জমিদারপুত্র, চন্দ্রদীপপুরের বর্তমান জমিদার দীপেন্দ্রনারায়ণ যে একজন ঘৃণ্য তস্কর, এটি তখন দূর-দূরান্তের সকলের কাছেও অকাট্য সত্য হিসেবে প্রমাণিত হবে। অতি অল্প সময়েই তুমুল সুনাম অর্জন করা একজন নব্য জমিদারের জন্য এর চেয়ে ভয়ংকর শাস্তি আর কী হতে পারে! বীণাবালার বুদ্ধি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হলো। দেবেন্দ্রনারায়ণের বিলম্বিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পূর্বপ্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল গঙ্গামহলে।
.
ছ’খানা আজদাহা চুলোয় আগুন জ্বলছে। চুলোর উপর টগবগ করে ফুটছে দুধ। এই দুধে ক্ষীর পায়েস হবে। রন্ধনশালায় আরো নানান উপাদেয় খাবারের আয়োজন চলছে। আর সপ্তাহখানেক বাদেই গঙ্গামহলে বিশেষ আতিথেয়তা পাচ্ছেন আশেপাশের এবং দূর-দূরান্তের তল্লাটের জমিদার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। দেবেন্দ্রনারায়ণের বিলম্বিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিসেবে যেটি সকলের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে শেষমুহূর্তে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন সকলেই। গত দশদিন ধরে টানা বর্ষণ। শোনা যাচ্ছে উত্তরে পাহাড়ি ঢলের উজানে জল বাড়ছে হু হু করে। নানান স্থানে দেখা দিয়েছে তুমুল বন্যা। গঙ্গাবতীর জলও বেড়েছে বিপজ্জনকভাবে। নদীর ঘাট উপচে জল প্রায় রাস্তা ছুঁই ছুঁই। গত কয়েকশত বছরে এমন ঘটনার কথা কেউ শোনেনি। বয়স্কদের কেউ দেখেননি এমন অবস্থা। সকলের ভেতরই কেমন চাপা এক আতঙ্ক। বর্ষণ কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বীণাবালা চিন্তিত মুখে বসে রয়েছেন তার ঘরে। সাথে বিভূতিনাথ সাহা।
বীণাবালা হঠাৎ বিভূতিনাথ সাহাকে বললেন, আমায় আপনার কেমন মানুষ। মনে হয়?
বিভূতিনাথ সাহা এই প্রশ্নে থমকে গেলেন। বললেন, আজ এতকাল পর এ কী প্রশ্ন বীণা?
বীণাবালা বলল, আপনি সেই এতটুকু থেকে আমায় চেনেন। আপনার কাছে আমার লুকানোর কিছুই নেই। আমায় আপনিই সবচেয়ে ভালো চিনতে পারবেন।
বিভূতিনাথ সাহা বললেন, ভালো-মন্দের প্রশ্ন এ নয় বীণা। এ নিঃশর্ত পাশে থাকার বিষয়।
বীণাবালা বললেন, নিঃশর্ত আর নিঃস্বার্থ কি এক?
বিভূতিনাথ বললেন, এ বড় শক্ত প্রশ্ন। শর্তের ভেতরেই তো স্বার্থ থাকে।
বীণাবালা বললেন, ঠিক তাই। তাহলে? আপনি কি আসলেই নিঃশর্ত আমার পাশে রয়েছেন? আপনার কি কোনো স্বার্থই নেই?
বিভূতিনাথ সাহা চুপ করে গেলেন। দীর্ঘসময় কেউ কোনো কথা বললেন না। না বীণাবালা, না বিভূতিনাথ সাহা। তারপর বিভূতিনাথ সাহা হঠাৎ তার জায়গা থেকে উঠে বীণাবালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দু’হাতের অঞ্জলি পেতে বীণাবালার মুখ তুলে ধরে বললেন, আমার স্বার্থ তুমি। এই জনমে তুমি ছাড়া আমার আর কোনো স্বার্থ নেই।
বিভূতিনাথের কথায় বীণাবালা কেমন অস্থির হয়ে উঠলেন। তারপর নিজের শরীরটাকে শিথিল করে দিলেন পাশে দাঁড়ানো বিভূতিনাথের শরীরে। তারপর ফিসফিস করে বললেন, আমি আপনাকে নষ্ট করে দিলাম।
বিভূতিনাথ সাহা দু’হাতে বীণাবালাকে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, এ কথা কেন বলছ বীণা?
বীণাবালা বললেন, আমি একটা কথা খুব ভাবি, জানেন? ভগবান আমায় এমন নষ্ট করে কেন বানালেন?
বিভূতিনাথ বললেন, ভগবান কাউকে নষ্ট করে বানান না।
বীণাবালা বললেন, বানান। আমায় বানিয়েছেন। সেই এতটুকুকাল থেকে কখনো হার মেনে নিতে পারিনি। সবসময় জিততে হবে। জিততেই হবে। যে কোনো উপায়ে জিততে হবে। এই জেতার জন্য জীবনজুড়ে এমন কোনো কাজ নেই যা করিনি। কিন্তু আজ কী মনে হচ্ছে জানেন, এই যে এত জিতলাম, এর মূল্য কী? শেষ অবধি সকলই তো ওই শূন্য। আজকাল ঘুমাতে পারি না। জেগে থাকলেও মাথার ভেতরটা কেমন বনবন করে। মনে হচ্ছে শক্ত কিছুতে আঘাতে আঘাতে মাথাটা ফাটিয়ে দিই। তাহলেই বুঝি শান্তি! কিন্তু শান্তি কোথায়? কোথাও তো শান্তি খুঁজে পেলাম না। এই যে জীবনজুড়ে এত জিতলাম। কিসের জন্য? শান্তির জন্যই তো? তাই না? কিন্তু মুহূর্তের জন্য কোথাও শান্তি পেলাম না। তাহলে এই এত এত জিতে কী লাভ হলো? শেষ অবধি অসহ্য যন্ত্রণাময় একটা জীবনই তো পেলাম।
বিভূতিনাথ সাহা বললেন, সকলে কি একরকম হয়? তুমি তোমার মতোন। এখানে ভালো-মন্দের কিছু নেই।
বীণাবালা হাসলেন। সেই হাসিজুড়ে রাজ্যের বিষাদ। তিনি বললেন, গতকাল মানুষটাকে স্বপ্ন দেখেছি। জীবনভর তাকে ঠকিয়েছি। অবশ্য যে জিততেই চায়নি, কিছু পেতেই চায়নি, তাকে ঠকানো যায় না। মানুষটা কেমন অন্যরকম। লোভ নেই, লালসা নেই, অহংকার নেই, জিগীষা নেই। এ কেমন ধারা মানুষ বলুন? অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে একটা জিনিস বুঝেছি, এ সকল নেই বলেই মানুষটার একটা আলাদা জিনিস রয়েছে। যা আমাদের আর কারোরই নেই।
বিভূতিনাথ সাহা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। বীণাবালা বললেন, শান্তি। মানুষটার বুকের ভেতর শান্তির এক নদী যেন বইতে থাকে। গঙ্গামহল ছেড়ে চলে গেলেন। আমায় বলে গেলেন না অবধি। একখানা চিরকুট লিখে গেলেন। তিনি জানতেন, তার থাকা না থাকায় আমার কিছু যায় আসে না। অথচ এই নিয়ে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস অবধি করেননি। রাতের পর রাত আলাদা শয্যায় থেকেছি। কিছুই বলেননি। একদিন কেবল বলেছিলেন, যে মনে আমার জন্য ভালোবাসা নেই, সে শরীর তো আমার কাছে মৃত। শরীরে কেবল প্রাণ থাকলেই শরীর বেঁচে থাকে না। তাতে ভালোবাসাও থাকতে হয়। প্রাণহীন শরীর আসলে মৃত শরীর নয়, মৃত শরীর মূলত ভালোবাসাহীন শরীর।
বীণাবালা খানিক দম নিয়ে বললেন, আমার শরীর তাই তার কাছে ছিল মৃত শরীর।
বীণাবালা থামলেন। বিভূতিনাথ কোনো কথা বললেন না। আবারো সেই নৈঃশব্দ। বিভূতিনাথ সাহা বীণাবালার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। বীণাবালা সেই হাত ছুঁয়ে বললেন, আজকাল আমার কী মনে হয় জানেন?
বিভূতিনাথ সাহা বললেন, কী?
বীণাবালা বললেন, আজকাল আমার মনে হয় মানুষের পাপের সবচেয়ে বড় শাস্তি এই জগতের কেউ তাকে দিতে পারে না। এই জগতের কোনো আইন, কোনো নিয়ম-নীতি, কোনো কিছুই মানুষের পাপের, অপরাধের শাস্তি দিতে পারে না। মানুষ তার নিজের পাপের শাস্তি দিতে পারে কেবল সে নিজে।
বিভূতিনাথ সাহা খানিক অবাক হলেন। কী হয়েছে আজ বীণাবালার?
বীণাবালা বললেন, আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছেন তাই না? আমি নিজেও অবাক হচ্ছি। কী যেন হয়েছে আমার। সারাক্ষণ মাথার ভেতর অদ্ভুত সব ভাবনা আসে। যা বলছিলাম। মানুষের পাপের সবচেয়ে বড় শাস্তি পাপবোধ। মানুষের অপরাধের সবচেয়ে বড় শাস্তি তার অপরাধবোধ। এই বোধ জগতের কারো পক্ষে তার ভেতরে জাগিয়ে তোলা সম্ভব না। যদি সে নিজে না চায়। আর একবার এই অপরাধবোধ, পাপবোধ জেগে উঠলে তা তাকে প্রতিমুহূর্তে কুড়েকুড়ে খাবে। এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু নেই। এর চেয়ে অসহ্য কিছু নেই। জগতের কোনো শাস্তির ক্ষমতা আছে এর চেয়ে বড় শাস্তি তাকে দেয়? নেই। প্রতিমুহূর্তে অপরাধবোধে দংশিত হবার চেয়ে কঠিন কোনো শাস্তি জগতে নেই।
বীণাবালা উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। বাইরে প্রবল বর্ষণ। মেঘলা আকাশ। সেই মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল। তিনি বললেন, মানুষ ভুল করে, অন্যের ক্ষতি করে, অন্যায় করে, অপরাধ করে। এ সকল আসলে প্রকৃত খারাপ মানুষের লক্ষণ নয়। মানুষ রক্তমাংসের তৈরি। তাদের নানান রিপু রয়েছে। তাই তারা অপরাধ করে। যে মানুষ জীবনে বহু খারাপ কাজ করেছে, সেও কখনো না কখনো ভালো কাজ করে। কারণ সে মানুষ। আর এটাই বরং তার জন্য স্বাভাবিক। সে কোনো অপরাধ করার জন্য খারাপ হয়ে যায় না। সে প্রকৃতই খারাপ হয়ে যায়। কখন জানেন? যখন সে সেই সকল কাজের জন্য অনুতপ্ত অনুভব করে না। অপরাধবোধে ভোগে না। তার ভেতর কোনো অনুশোচনা হয় না। তখন সে প্রকৃতই খারাপ মানুষ হয়ে যায়। ঠিক খারাপ মানুষও বলা যায় না। তখন সে আর মানুষই থাকে না। অমানুষ হয়ে যায়। পুরোপুরি অমানুষ। অপরাধের কারণে না, তার এই অপরাধবোধহীনতার কারণে।
বিভূতিনাথ সাহা ধীর পায়ে হেঁটে এসে বীণাবালার পাশে দাঁড়ালেন। তারপর আলতো করে হাত রাখলেন তার কাঁধে। বীণাবালা ধীরে বিভূতিনাথ সাহার দিকে ঘুরে তাকালেন। তারপর বললেন, আমি এই অপরাধবোধহীন মানুষ। আমার ভেতরে কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না। আমার এ সকল কাজ করতে উত্তেজনা হয়, আনন্দ হয়। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমি আসলে একজন অমানুষ।
বীণাবালার মুখোনি মুহূর্তের জন্য কেমন কুঞ্চিত হলো। তিনি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বিভূতিনাথ সাহা দু’হাতে শক্ত করে বীণাবালাকে ধরে পালঙ্কে এনে বসালেন। বীণাবালা মৃদু গলায় বললেন, মাথার ভেতরের অসহ্য গুঞ্জনটা আবার শুরু হচ্ছে। আমি কি একটু আপনার কোলে মাথা রেখে শোব? আপনি একটু শক্ত করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন?
বিভূতিনাথ সাহা কোনো কথা বললেন না। তবে হাত বাড়িয়ে বীণাবালাকে। টেনে নিলেন বুকের ভেতর। তার হঠাৎ মনে হতে লাগল, জগতে অনুভূতির চেয়ে রহস্যময় আর কী আছে! কোন এক অদ্ভুত রহস্যময় কারণে এই মানুষটাকে তিনি কখনো ছেড়ে যেতে পারেননি। মুহূর্তের জন্যও না। অন্ধের মতো অনুসরণ করেছেন সারাটাজীবন। ভালো-মন্দ কিছুই কখনো বিচার করেননি! এই অনুভূতির নাম কী? এই অনুভূতির নামই কি ভালোবাসা? বিভূতিনাথ সাহা জানেন না। তিনি কেবল জানেন, এই মানুষটা যদি তাকে বলে, তবে জগতের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম কাজটিও তিনি হাসিমুখে করে ফেলতে পারেন নির্দ্বিধায়। শুধু এভাবে এই বুকের ভেতর আগলে রাখার এই সামান্যতম মুহূর্তটুকুর জন্য।
বিভূতিনাথ সাহার বুকের ভেতর কতক্ষণ এমন মুখ ডুবিয়ে রইলেন, বীণাবালা তা জানেন না। জানেন না বিভূতিনাথ সাহাও। সময় যেন থমকে আছে এই মুহূর্তে। নিস্তব্ধ নিঃশব্দ সময়। কিন্তু সেই নিস্তব্ধ সময়ের নৈঃশব্দ্য ভেঙে খানখান হয়ে গেল তীব্র চিৎকারে। মহলের নিচ থেকে হৃদপিণ্ড কাঁপিয়ে দেওয়া চিৎকার শোনা গেল কারো। সেই শব্দে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে বীণাবালা। ছিটকে সরে গেলেন বিভূতিনাথের বুকের ভেতর থেকে। কী হয়েছে!
.
রন্ধনশালার মেঝেতে যেন দুধের বান ডেকেছে। সারা মেঝে থই থই করছে আগুন গরম দুধে। সেই দুধ থেকে তপ্ত ধোয়া উঠছে। দুধের ভেতর শুয়ে। কাটা মাছের মতোন তড়পাচ্ছে দাসী কমলা। তার শরীরের উপর কাত হয়ে পড়ে আছে বিশাল দুধের পাত্র। উঁচু চুলা থেকে গরম দুধসহ পাত্রখানা উল্টে পড়েছে কমলার শরীরে। দুধের পাত্রের নিচে চাপা পড়া কমলা দাসীর গলা থেকে জান্তব গোঙানি ভেসে আসছে। কিন্তু তার চারপাশে আর কেউ নেই। উত্তপ্ত দুধের ছোঁয়া বাঁচাতে প্রবল আতঙ্কে রন্ধনশালার আর সকলেই ছুটে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। কিন্তু মেঝেতে দুধের ভেতর ডুবে থাকা কমলাকে উদ্ধার করার যেন কেউ নেই। আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনায় উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে কমলা দাসীর দিকে। কিন্তু তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না কেউ।
গলিত লাভার ন্যায় উত্তপ্ত দুধের ভেতর থেকে দাসী কমলাকে উদ্ধার করা হলো আরো কিছু পর। কিন্তু ততক্ষণে কমলার শরীরের প্রতিটি অংশ ঝলসে গেছে। ভয়াবহ তাপে গলে গিয়ে তার শরীরের চামড়া, মাংস দলা পাকিয়ে আটকে গিয়েছে পরনের শাড়ির সাথে। এ এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। এমন বীভৎস পোড়া মানুষ গঙ্গামহলের কেউ আগে কখনো দেখেনি। দেখেনি এমন কমলা দাসীকেও।
*
দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুসংবাদ শুনে হেমাঙ্গিনী দেবী একটা অবিশ্বাস্য কাজ করেছে। সেই কাজ দেখে চমকে গিয়েছে হরিহরণও। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় হরিহরণ চমকে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। তার ধারণা হয়েছে, জগতে সকল কিছুই সম্ভব। এখানে অসম্ভব বলে আসলে কিছু নেই। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুসংবাদ শুনে হেমাঙ্গিনী দেবী যা করল তাতে হরিহরণ চমকে গেল। একইসাথে ভয়ও পেল।
সকালে হরিহরণকে গঙ্গামহলের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে সারাদিন ঘরের দাওয়ায়। বসে ছিল হেমাঙ্গিনী দেবী। প্রতিটি মুহূর্ত যে কী রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাটাচ্ছিল সে! হেমাঙ্গিনী দেবী তার সাথে দেখা করতে চায় শুনে কি বলবেন দেবেন্দ্রনারায়ণ! হেমাঙ্গিনী দেবী কি এই সকল সত্য নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে? সকলই অকপটে বলতে পারবে? সব শুনে কী বলবেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ? কতটা নোংরা ভাববেন? কতটা রুদ্রমূর্তি ধারণ করবেন? মানুষটা কি সত্যি সত্যি অমন ভেঙে পড়েছেন? এই সকল সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত করে ফেলেছিল হেমাঙ্গিনী দেবী। সারাদিনে এক ফোঁটা জল অবধি খায়নি। এক দানা খাবার অবধি না। সেই ঘরের দাওয়ায় বসেই সে কাটিয়ে দিল প্রতীক্ষার সুদীর্ঘ প্রহর।
গভীর রাতে ফিরল ক্লান্ত হরিহরণ। পুরোটা পথে সে একটা কথাই ভেবেছে, দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুসংবাদ সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে কী করে দেবে? কিন্তু ভেবে কোনো কূল-কিনারা পায়নি। পায়ে হেঁটে অতটা পথ গিয়ে আবার ফিরে এসে ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছিল হরিহরণের শরীর। সেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরল দেখল, যেমন দেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনই বসে রয়েছে হেমাঙ্গিনী দেবী। সে যে সারাদিন কিছু খায়নি, কোথাও যায়নি তা আর বলে দিতে হলো না হরিহরণকে। হরিহরণ এসে হেমাঙ্গিনী দেবীর পাশে বসল। তারপর ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলো মেঝেতে। হেমাঙ্গিনী দেবীর কী হলো কে জানে, সে দীর্ঘসময় হরিহরণের দিকে তাকিয়ে রইল অপলক চোখে। হরিহরণ কোনো কথা বলছিল না। সে চোখ বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে রইল। হেমাঙ্গিনী দেবী হঠাৎ বলল, বড় কোনো দুর্ঘটনা?
হরিহরণ ঝট করে চোখ মেলল। বলল, কী?
হেমাঙ্গিনী বলল, আমার মন বলছিল। জগতে হেমাঙ্গিনী দেবীর জন্য ভালো কিছু থাকতে নেই, এই এতদিনেও তা বুঝিনি ভেবেছ? তোমায় পাঠানোর পর থেকে বারবার মন বলছিল, তোমায় এই পাঠিয়েই বুঝি দেবেন্দ্রনারায়ণের আবার কোনো বড় সর্বনাশ করে ফেললাম। ভগবান চান না তার সাথে আমার দেখা হোক। ভগবান এও চান না, এই জীবনে দু’দণ্ড শান্তি পাক হেমাঙ্গিনী দেবী। সে ভগবান তার জন্মের আগে থেকেই তো করে আসছে। নতুন আর কী করবে? তোমায় পাঠিয়েই মনে হলো তার চেয়ে কোনোভাবে মাঝপথ থেকে তোমায় ফেরাই। তাতে যদি মানুষটা সর্বনাশ থেকে রক্ষা পায়। তুমি অপয়া বিশ্বাস করো না? আজকাল আমি খুব করি। আমার চেয়ে বড় অপয়ার বিশ্বাস না করে উপায় কী বলে?
হরিহরণ কিছু বলল না। সে হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে তাকিয়ে রইল। লণ্ঠনের আলো-আঁধারিতে তার মুখখানা কেমন অপার্থিব আর রহস্যময় লাগছে।
হেমাঙ্গিনী দেবী আবার বলল, সারাদিন ওই সর্বনেশে খবরখানা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছি। একটা পলের জন্য মনটাকে স্থির করতে পারিনি। তা বলো কী হয়েছে উনার?
হরিহরণ সাথে সাথেই বলতে পারল না। তবে সে বলল। সে জানে না কিভাবে বলল। আর বলেই সে ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকাল হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে। আর তখনই সেই অবশ্বিাস্য ঘটনাটি ঘটল। দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুসংবাদ শুনে হেমাঙ্গিনী দেবী হাসল! হা হা করে উন্মত্ত পাগলের অট্টহাসি নয়, কান্না চাপা বিষাদ হাসি নয়। সে হাসলো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতোন। তারপর উঠে ঘরে চলে গেল। হরিহরণকে খাবার দিয়ে শুয়ে পড়ল। পরদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠল। ঘরদোরের কাজ করতে থাকল। হরিহরণ ভয়ে ভয়ে সেই সারাটাদিন নিজ থেকে আর হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে কথা বলল না। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী এটা-সেটা নিয়ে তার সাথে নানান কথা বলল। তবে সেই সকল কথার কোথাও দেবেন্দ্রনারায়ণ রইলেন না।
তার বেশ কিছুদিন পরে এক রাতে ঘরে গিয়ে থমকে দাঁড়াল হরিহরণ। ঘরের কোণে পুজোর জন্য যে দূর্গার মূর্তিখানা ছিল সেখানা নেই। হরিহরণ জিজ্ঞেস করতেই হেমাঙ্গিনী দেবী স্বাভাবিক গলায় বলল, ওখানা সরিয়ে রেখেছি। ওই কোণায় তাকের ওপর দেখো।
হরিহরণ বলল, সরিয়ে রেখেছিস কেন?
হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, আর পূজা-আচ্চা করব না বলে।
হরিহরণ বলল, পূজা-আচ্চা কেন করবি না?
হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, কেন করব? মানুষ ভগবানকে কেন ডাকে? সুখ শান্তির জন্যই তো? ভালো থাকার জন্য, যা চায় তা পাওয়ার জন্য তো? আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়ার বালাই নেই হরিকাকা। ভগবান আমায় দশহাত ভরে দিয়েছেন। এত দিয়েছেন, ওর ওজন আর বইতে পারছি না। দেখছ না, আজকাল কেমন কুঁজো হয়ে হাঁটছি। ভগবানের দান আর কত বইবো বলো! ওই মূর্তিখানা চোখের সামনে থাকলে আবার ভুলে কখন কী চেয়ে ফেলব, তার ঠিক আছে? দেখা গেল সেই চাওয়ায় ভগবান আবার এমন কিছু দিলেন যে আর কুঁজো হয়েও হাঁটতে পারছি না। তার ভারে হামাগুড়ি দিতে হলো। তা কুঁজো মানুষ কি আর শখ করে হামাগুড়ি দিতে চায় বলো? ওখানা তাই সরিয়ে রেখেছি। আমার আর কিছু চাই না।
হরিহরণ বিমূঢ় হয়ে হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলতে পারল না। কী বলবে সে! এই মেয়েটির জন্য কী করবে সে! হরিহরণ ধীর পায়ে হেঁটে হেমাঙ্গিনীর কাছে এলো। তারপর হাত বাড়িয়ে হেমাঙ্গিনী দেবীর মাথা ছুঁলো। কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেমাঙ্গিনী দেবী হরিহরণের হাতখানা সরিয়ে দিয়ে বলল, কাল আমি তোমার বাড়ি থেকে চলে যাবো হরি কাকা।
হরিহরণ আঁৎকে ওঠা গলায় বলল, কী বলছিস তুই? কোথায়?
হেমাঙ্গিনী সেই স্বাভাবিক গলায়ই বলল, এখনো জানি না কোথাও। কাল বাড়ি থেকে বের হবার পর ঠিক করব।
.
সনাতন মিস্ত্রী ভুজঙ্গ দেবের এর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছে অনেক বিলম্বে। কিন্তু সে তার খনন কাজ বন্ধ করেনি। যতদিন ভুজঙ্গ দেবের মৃত্যুসংবাদ সে পায়নি, ততদিন অবধি তার ভয়েই রোজ একটু আধটু খুঁড়েছে। আর ভয়ে ভয়ে তাকিয়েছে মাথার উপরের সেই গাছের ডালে। কিন্তু দিন পনেরো যেতেই সেই অদ্ভুত প্রাণীর ভয় কেটে গেল সনাতন মিস্ত্রীর। তার তখন মনে হচ্ছিল যে সেই রাতে মনের ভয়ে চোখে ভুল দেখেছিল সে। হয়তো বড় কোনো বাদুড় বা পেঁচা জাতীয় কোনো নিশাচর প্রাণী দেখে সে ভয়ে পালিয়েছিল। নিজেকে ভারি বোকা হলো এসব ভেবে। তবে ভুজঙ্গ দেব এর মৃত্যুসংবাদ শুনে সে বড় আনন্দিত হলো। সেই আনন্দ সুড়ঙ্গ আর খুঁড়তে হবে না, বলে নয়। বরং সুড়ঙ্গের ওপারে কী রয়েছে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকার কারণে। তার এখন দৃঢ় বিশ্বাস, সে একাই দেবেন্দ্রনারায়ণের ওই গুপ্তধন সরাতে পারবে। বাদবাকি জীবন আর তাকে পায় কে!
এর মধ্যে দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুসংবাদ যেন তার বিশ্বাস আর সম্ভাবনার পালে আরো হাওয়া লাগাল। সে তারপর থেকে আর শুধু গভীর রাতেই না, পারলে দিনেও সুড়ঙ্গ খোঁড়ে। কারণ এ বাড়িতে এখন যে কজন আছে, তাদের হাতে ধরা পড়া নিয়ে সে তেমন শঙ্কিত নয়। এই দীর্ঘসময়ে সে প্রবল অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়েছে। সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বারোহাটি বাগানবাড়ির পাঁচিলের তলা দিয়ে সে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। ভুজঙ্গ দেবের মৃত্যুতে একটু সমস্যা হয়েছে, তা হচ্ছে সুড়ঙ্গের ভেতরে সেই পাতাল ঘরখানির অবস্থান বুঝে এগোতে তার সমস্যা হয়েছে। এতদিনে তার সেই ঘরে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বারকয় ভুল পথে অনেক দূর গিয়ে আবার ফিরেও আসতে হয়েছে পাঁচিলের তলা অবধি। সেখান থেকে আবার নতুন করে খুঁড়তে হয়েছে। ভুজঙ্গ দেব থাকলে এই সমস্যাটা হতো না। চোখ বন্ধ করেও তিনি ওই পাতাল ঘরের অবস্থান ঠিকই চিনে নিতে পারতেন। কিন্তু অত ধনসম্পদ একাই ভোগ করবার সম্ভাবনায় এই অসম্ভব পরিশ্রম যেন গায়েই লাগছে না সনাতন মিস্ত্রির।
.
সনাতন মিস্ত্রীর ভাগ্য খারাপ। শেষ অবধি সে পাতাল ঘর অবধি পৌঁছাতে পেরেছিল। কিন্তু সমস্যা হয়েছে সে কিভাবে কিভাবে যেন প্রায় দ্বিগুণ পথ খুঁড়ে পাতাল ঘরের সামনের ফটকের দিকে না এসে, এসে পড়েছে পেছনে দিকে। সেখানে দুর্ভেদ্য নিরেট দেয়াল। এই সুড়ঙ্গের ভেতর বসে কোনো ধরনের শব্দ না করে ওই দেয়াল ভাঙা অসম্ভব। এবার সত্যি সত্যি ক্লান্তি আর হতাশা ঘিরে ধরলো সনাতন মিস্ত্রিকে। তবে সে হাল ছাড়ল না। এবার দেয়ালের পাশ ধরে খুঁড়তে থাকলে পাতালঘরের সামনের দিকের ফটকের কাছে পৌঁছাতে আর খুব বেশি বেগ পাবার কথা না। পরদিন থেকে আবার নব উদ্যমে খোঁড়া শুরু করল সনাতন মিস্ত্রি। আর মাত্র কিছু দূরত্বেই এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নের হাতছানি। কিছুতেই যেন আর তর সইছিল না সনাতনের। যতটুকু সময় সে ঘুমায়, সে বিভোর হয়ে থাকে ওই পাতাল ঘরের ধনসম্পদের স্বপ্নে। আর যতটুকু সময় সে জেগে থাকে, পুঁদ হয়ে রয় স্বপ্নময় সব ভাবনা, পরিকল্পনায়।
.
অপলা দাসী অসুস্থ। বারোহাটি বাগানবাড়িতে যে দু’চার জন ভৃত্য দাসী রয়েছে, তারাও অপলার মতোই বয়স্ক। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই। ফলে তারা রয়ে গেছে অপলার সাথেই। যাদের শরীরে জোর আছে তারা যে যার মতো কাজের খোঁজে চলে গেছে। দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর খবর অপলা পেয়েছে। খবর এনেছে রঘু। তারপর থেকে আর কোনো আহার মুখে তুলতে পারেনি অপলা। প্রথম দু’চারদিন বারোহাটি বাগানবাড়ির প্রতিটা ঘরে ঘরে সে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়েছে। ঘরের প্রতিটা আসবাব, প্রতিটা দেয়াল, প্রতিটা ইট অবধি সে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেঁদেছে। এই প্রতিটা জিনিসে দেবেন্দ্রনারায়ণের স্পর্শ লেগে আছে। এই বাড়িখানা যশ্নের ধনের মতোন বুকের ভেতর আগলে রেখেছে। সে। মানুষটা আবার এখানে আসবেন। আবার তার পায়ের স্পর্শ পেয়েই এই বাড়ি ঝলমল করে উঠবে। সেই বাড়িখানা আর কখনো হাসবে না। তিনি আর কখনো এখানে আসবেন না। অপলার এ বিশ্বাস হয় না। বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে। হাহাকারের বিষণ্ণ হাওয়ারা তোলপাড় করে বয়ে বেড়ায় বুকের ভেতর, মানুষটা নেই! নেই! কোথাও নেই।
*
বিভূঁইয়ের ঘরের দেয়ালে ছোট্ট একখানা জানালা। জানালার নিচে বাইরের দিকে দু’খানা ইট বের হয়ে আছে। একখানা নিচে, আরেকখানা উপরে। সেই ইটের ফাঁকে এক চড়ুই দম্পতি বাসা পেতেছে। প্রায় মাস ছয়েকেরও বেশি এ ঘটনা। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিভুঁইয়ের তক্তপোষের নিচে একটা মাদি বেড়ালেরও বাসা। বেশির ভাগ রাতেই বিভূঁইয়ের ঘুম হয় না। সে জেগে থাকে। জেগে জেগে এই মাদি বেড়ালের সাথে কথা বলে। সমস্যা হচ্ছে এতে বেড়ালের সাহস বেড়ে গেছে। বহুদিন হয় বেড়ালটা আর তক্তপোষের নিচে যায় না। বিভূঁইয়ের বিছানাই এখন তার বিছানা। বিভুঁই প্রায় ভোরেই ঘুম ভেঙে টের পায় বেড়ালটা তার কম্বলের ভেতর ঢুকে বুকের কাছে শুয়ে আছে। বিভুঁই কিছু বলে না। তবে মাঝে মাঝে তার ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছে করে, কী? তোরও কি মা নেই? মায়ের গন্ধ খুঁজিস?
বিভুঁই চড়ুই দম্পতির সাথেও কথা বলে। তারা প্রায়ই কিচমিচ করে ঝগড়া করে। বিভুঁই মুগ্ধ হয়ে সেই ঝগড়া শোনে। তার ধারণা এই ঝগড়ার কারণ পুরুষ চড়ই। সে কিছুটা অলস প্রকৃতির। তার কাজ-কর্মে আগ্রহ নেই। সে সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকে। কিন্তু কাজে না গেলে খাবার জুটবে কী করে! এই নিয়ে স্ত্রী চড়ইর সাথে তার খটোমটো লেগেই থাকে। বিভুঁই অবশ্য একটা কাজ করে, প্রায়ই সে তার খাবার থেকে খানিকটা খাবার নিয়ে চড়ুই দম্পতির বাসায় রেখে দেয়। এ ঘটনায় চড়ুই দম্পতিরও ভারি সাহস হয়েছে। তারাও আজকাল বাইরের ওইটুকু বাসায় থাকতে চায় না। যখন তখন বিভুঁইয়ের বিছানায় এসে ছোটাছুটি করে। প্রথম প্রথম বিভুঁই ঘরে না থাকলে করত, আজকাল তারা বিভূঁইকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। বিভূঁইয়ের ঘাড়ে, মাথায়, কাঁধের উপর বসে ঝগড়াঝাটি করে। এই ঘটনায় বিভুঁই বড়ই আনন্দ পায়। তার মনে হয় সে তার অন্ধচোখেও ঝগড়া করার সময় এদের মুখভঙ্গি দেখতে পায়। এই সময়টাতে সে বৃক্ষের ন্যায় স্থির হয়ে থাকে। যাতে চড়ুই দম্পতির ঝগড়ায় কোনো বিঘ্ন না ঘটে।
তবে এই ঘটনায় সবচেয়ে বিরক্ত হয় বেড়ালটা। সে কিছুক্ষণ গড়গড় শব্দ করতে থাকে। তারপর ছুটে গিয়ে চড়ই দুটির গায়ে থাবা বসানোর চেষ্টা করে। বিভুঁই অবশ্য শক্ত হাতে বেড়ালটাকে ধরে রাখে। চড়ুই দম্পতিও কম যায় না। এই ফাঁকে সুযোগ বুঝে বেড়ালের মাথায় বসে আবার সাথে সাথেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। এই খেলা চলতেই থাকে।
বিভূঁইয়ের সময়টাও এই কারণেই আজকাল খুব ভালো কাটে। দেবেন্দ্রনারায়ণ মারা গেলেন। বিভূঁইকে খবরটা দিয়েছিল রতনকান্তি। বিভুঁই কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ শুনেছে কেবল। এই নিয়ে তাকে কেউ আর কিছু বলেনি। বিভুঁইও কারো কাছেই কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে মাঝখানে একদিন তার মনে হয়েছিল গঙ্গামহলে আসার দিনের কথা। সেদিন গঙ্গামহলে প্রবেশের পথে হরিহরণকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি এখন, তাহলে এই বাড়িখানা কাদের?
জবাবে হরিহরণ তাকে বলেছিল, তোমার। এই বাড়িখানা তোমারও।
হরিহরণ হয়তো কিছু ভেবে বলেনি। কিংবা কথাটি বিভুঁইয়ের সামনে বলা ঠিক হচ্ছে কিনা তাও ভাবেনি। কিন্তু বিভুঁই কিছুই ভোলে না। একটা পাতা পড়ার শব্দ অবধিও তার মনে গেঁথে থাকে। হরিহরণের ওই কথাটিও তার মনে গেঁথে রইল। সেই থেকে সে যেখানে যা জেনেছে, যে তাকে যতটুকু বলেছে, যা তাকে বলা হয়নি কিন্তু সে নানান উপায়ে বিক্ষিপ্তভাবে শুনেছে, তার সকল কিছুকেই সে একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করেছে। থরেথরে সাজিয়ে রেখেছে তার মনের ভেতর। তার মনে আছে, সে যখন থেকে একটু আধটু বুঝতে শিখেছে, তখন থেকেই নানান সময়ে বাবার কথা জিজ্ঞেস করেছে মাকে। কিন্তু মা কখনোই তাকে কোনো জবাব দেয়নি। প্রতিবারই না শোনার ভান করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছে।
সেই বিভুঁই দেখেছে মা তাকে কেমন করে বাইরের জগত থেকে সদা আড়াল করে রেখেছে। তারা যে বাড়িখানায় থাকত, সেই বাড়িতেও ছিল ঢের আড়াল আড়াল এক ব্যাপার। নানান লোকজনের আনাগোনা থাকলেও তাদের থেকে বিভুঁইকে একদম অদৃশ্য করে রাখতে চাইত মা। এ সকল কিছুই বিভুঁইর চোখ এড়াত না। কিন্তু সেই মা-ই আবার তাকে দূরে এক শহরে একা রেখে এসেছিল। সকল কিছুতেই প্রবল লুকোছাপা দেখে আসা বিভুঁই বুঝতে পারত কোথাও বড় এক সমস্যা রয়ে গেছে। কোনো এক অস্বাভাবিকতা। বিনয়পুরের স্কুলেও সে দেখেছে তার সাথে কেউ মিশতে চাইত না। কথা বলতে চাইত না। সেই বিভুঁই গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলো বিনয়পুরে, আর প্রায় মৃত্যু থেকে জেগে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করল বারোহাটির ওই জঙ্গলে! তাও অন্ধ এক মানুষ তখন সে। কী অদ্ভুত মানুষের ভাগ্য। বিভুঁই অবশ্য আজকাল আর ভাগ্য নিয়ে ভাবে না। সে ভাবে জীবন নিয়ে। এই ভাবনায় তার ভারি রোমাঞ্চ হয়। এ যেন প্রতিনিয়ত অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা। এই জানায় ভীষণ আনন্দ। সেই আনন্দের জন্যই হোক, আর জানার রোমাঞ্চেই হোক, দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে নিয়ে আসার পর থেকেই বিভুঁই আবিষ্কার করেছিল ওই মানুষটার সাথে তার কোনো একটা সম্পর্ক রয়েছে। আর মানুষটা তাকে খুঁজে পাবার যে গল্প বলেছে, সেই গল্পেরও বিশাল ফাঁক রয়েছে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে যেভাবে আগলে রেখেছেন, যত্ন করেছেন তাতে বিভূঁইয়ের ভেতরে যতটুকু দ্বিধা ছিল, তাও মুছে গিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই মানুষটির সাথে তার মায়েরও কোনো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সম্পর্কটি কী? যেদিন সে জানলো যে মানুষটি বিষ্ণুপুর নামক জমিদারির প্রবল প্রভাবশালী জমিদারপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণ, সেদিন সে আরো থমকে গিয়েছিল। এমন একজন মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই তার জন্য এতকিছু কেন করবেন!
তারপর বারোহাটি বাগানবাড়িতে দাসী অতসী বালার সাথেও তার কম বেশি কথা হয়েছে। কথা হয়েছে রতনকান্তির সাথেও। তবে গঙ্গামহলে ঢোকার সময়ে হরিহণের ওই কথাটিই যেন তার বিক্ষিপ্ত আর সকল ভাবনাকে একীভূত করে দিল যে এই বাড়ি তোমারও। কথাটি হরিহরণ কেন বলেছে, বা বলার আরো নানান কারণ থাকতেই পারে। কিন্তু বিভুঁই দিনের পর দিন এ সকল নিয়ে। ভেবেছে। প্রতিটি কথা, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি শব্দ অবধি। আর সবকিছু মিলিয়েই সে যেন একটি সিদ্ধান্তেও এসে পৌঁছে গিয়েছিল। সে শুনেছে। জমিদারদের বহু নারীসঙ্গ থাকে। তাদের পরিচিয়বিহীন সন্তান থাকার কথাও সে শুনেছে। সে কি তবে এই গঙ্গামহলেরই সন্তান। দেবেন্দ্রনারায়ণই কি তবে তার বাবা! আর এ কারণেই কি দেবেন্দ্রনারায়ণ তার জন্য এত কিছু করছেন! এই বাড়িতে এসেও দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভূঁইকে গোপনে বলে দিয়েছিলেন, বিভুঁই যেন তাকে মেজোকর্তা সম্বোধন না করে। তাহলে?
এর পরের হিসেবটুকু বিভূঁইয়ের জন্য সহজই হবার কথা ছিল। কিন্তু সবকিছু মিলে গিয়েও কী যেন মিলছিল না। সেই মিলটুকু খুঁজতেই বিভুঁই সেদিন দেবেন্দ্রনারায়ণকে বলেছিল যে, এখানে আমি আসলে পরিচয়বিহীন কেউ নই। বরং এই জমিদার বাড়িই আমার সত্যিকারের পরিচয়।
সে শুনতে চেয়েছিল জবাবে দেবেন্দ্রনারায়ণ কী বলেন! কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ সেদিন তাকে কোনো জবাব দেননি। এরপর দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে আর দেখা হয়নি বিভূঁইয়ের। দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর খবরটি শুনে সে খানিক অবাক হয়ে গিয়েছিল। তবে এ নিয়ে সেই মুহূর্তে আলাদা কোনো কষ্টকর অনুভূতি সে অনুভব করেনি। দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য কখনোই কোনো আলাদা অনুভূতি কি ছিল তার!
দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর তৃতীয় দিন মাঝরাতে বিভূঁইয়ের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সেই রাতে বিভুঁই একা একা কাঁদল। ভীষণ কাঁদল। কেন কাঁদল তা সে জানে না। দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য তার কাদার কোনো কারণ নেই। লোকটি তার বাবা হলেও না। না হলেও না।
*
বিভুঁই কি তবে চিরদিনের জন্য গঙ্গামহলে বন্দী হয়ে গেল? দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর এই কথাটি খুব ভেবেছে বিভূঁই। এখানে সে ছাড়া এ বাড়ির কেউ আর তার সত্যিকারের ঘটনা জানে না। সে কারো কাছে তার মায়ের কথা বলতেও পারবে না। রতনকান্তি এ বাড়ির লোক নয়। তার কোনো ক্ষমতাও নেই। যা খানিকটা ছিল হরিহরণের। কিন্তু সে দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর আর এ বাড়িমুখো হয়নি। তবে হরিহরণ লোকটাকে বিভূঁইয়ের ভারি গভীর আর রহস্যময় মনে হয়েছে। গঙ্গামহলে প্রবেশের মুখে হরিহরণের সেই কথাখানিই তাই বিভূঁইয়ের মনে বারবার কেবল উঁকি দিয়ে গেছে, এই বাড়ি তোমারও। বিভূঁইয়ের দৃঢ়বিশ্বাস, এই মানুষটি আরো অনেক কিছুই জানে। সেই জানার কিছুটা হলেও সে নিশ্চয়ই জানতে পারবে। কিন্তু মানুষটি সেই যে গেল, আর তো এলো না।
বিভূঁইয়ের বেড়ালটা সম্ভবত মা হবে। সে আজকাল সারাক্ষণ বিছানায় লেপ্টে থাকে। কোথাও যায় না। বিভুঁই বেড়ালটার পেটে হাত দিয়ে দেখেছে। অনেকটাই স্ফীত। সে মনে মনে ভারি আনন্দিত। কারণ সে জানে, বেড়াল একসাথে একাধিক বাচ্চা দেয়। অনেকগুলো বাচ্চা হলে তার ভারি সুবিধা হয়। সে এদের নিয়ে সময় কাটাতে পারবে। আজকাল চড়ই দম্পতির সাড়াশব্দ তেমন পাওয়া যায় না। তারা জানালা গলে ঘরেও আসে না খুব একটা। এই ঘটনায় বিভুঁই খানিক চিন্তিত। কিন্তু খোঁজ নেব নেব করেও খোঁজ নেওয়া হয় না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে নিচতলায় এত কাছাকাছি থেকেও বিভুঁইয়ের সাথে দীর্ঘদিন খগেনের কোনো কথা হয়নি। তারা থাকেও পাশাপাশি ঘরে। কিন্তু কেন যেন কথা হয়নি। তবে খগেনকে মাঝে মাঝেই এটা সেটা করে চমকে দেয় বিভূঁই। সেদিন বিভুঁই খগেনকে ডাকল। খগেন প্রবল বিরক্তি নিয়ে ঘরেই আসতেই বিভুঁই বলল, জানালার বাইরে ইটের সাথে একখানা চড়ইর বাসা আছে, গতরাতের ঝড়বৃষ্টিতে বাসাখানি উড়ে গেছে, এক মুঠো খড় এনে ওখানে বসিয়ে দেবেন একটু? ওরা বাসা বুনে নেবে!
খগেন অবাক হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। কী বলছে এই ছেলে। সে তো অন্ধ, সে কী করে দেখল বাইরে চড়ইয়ের বাসা! সেই বাসা আবার ঝড়বৃষ্টিতে উড়েও গিয়েছে! সে বিরক্ত গলায় বলল, তুমি কি করে জানলে আঁ? তুমি তো চোখে দেখো না।
বিভুঁই কেমন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর বলল, ওই মেয়ে চড়ইটা এসে কানে কানে বলে গেল। ভারি কষ্ট হচ্ছে ওদের।
খগেন চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে চলে গেল। বিষয়টা একদমই পাত্তা দেয়নি সে। রাগে গজগজ করতে করতে চলে গিয়েছিল। তার মাথাতেই আসেনি যে আগের রাতে তুমুল ঝড়বৃষ্টির কারণে বিভুঁই ভোর হতেই জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বাসাটি খুঁজেছিল। কিন্তু পায়নি। আর পায়নি বলেই সে জেনেছে যে বাসাটি ঝড়ে উড়ে গেছে। খুবই সহজ হিসেব। কিন্তু খগেন তা বুঝল না। সে দিনকয় আগেই বাসাটি নিজের চোখেই দেখেছিল। পরদিন দুপুরে বিভুঁই ঘুমাতেই খগেন পা টিপে টিপে সেই জানালার বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল ঘটনা সত্যি। বিভুঁই যা বলেছে ঘটনা তা-ই। বাসাটি নেই। দু’চারখানা খড় পড়ে রয়েছে কেবল। সে ভারি অবাক হলো।
আরো অবাক হলো পরদিন বিভুঁইয়ের ঘরে গিয়ে। বিভুঁই বসে রয়েছে। আর তার কানের উপর বসে একখানা চড়ই কী করছে! চড়ইর ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে সে বিভূঁইয়ের কানে কানে কথা বলছে! খগেন ভারি চমকে গেল। সেই থেকে সে বিভূঁইকে খানিকটা ভয়ও পায়।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিভুঁই ভেবে দেখল, সে ভালোই আছে। আনন্দে আছে। তার চারপাশের অন্য মানুষেরা কেমন আছে সে জানে না। তবে সে ভালো আছে। তার জীবন কেটে যাচ্ছে আনন্দে। শেষ অবধি আনন্দে জীবন কাটানোটাই আসল। প্রশ্ন হচ্ছে সেই আনন্দ থাকে কোথায়? মানুষ সেই আনন্দের জন্যে কতকিছুর পিছু ছোটে। কিন্তু মানুষ জানে না, সেই আনন্দের উৎস তার বুকের ভেতর। তার বুকের অন্দরমহল। বিভূঁইয়ের মাঝে মাঝে মনে হয় সে সেই অন্দরমহলের খোঁজ পেয়ে গেছে। জগতের সকল কিছুতেই সে আনন্দ খুঁজে পায়। এমনকি দুঃখেও। সেই রাতে সে যে কাঁদল, সেই কান্নায়ও কোথায় যেন এক চাপা আনন্দ লুকিয়ে ছিল। সেই আনন্দ কাঁদতে পারার আনন্দ। জগতে কত মানুষ রয়েছে যারা প্রবল কষ্ট বুকে পুষে রেখেও কাঁদতে পারে না। তারা জানে খানিক কাঁদতে পারলেই তাদের তীব্র কষ্টে পরিপূর্ণ বুকের ভেতরটা নিমেষেই হালকা হয়ে উঠবে। কিন্তু তারা কাঁদতে পারে না।
যারা কাঁদতে পারে না, কেবল তারাই জানে, মানবজন্মে কান্না কী অসাধারণ এক আশীর্বাদ। কিন্তু যারা কাঁদতে পারে, তারা এই সত্যটা জানে না। তারা সারাজীবন এই কান্নার জন্যই তাদের জীবনটাকে শাপ-সাপান্ত করতে থাকে। নিজেদের দুর্ভাগা ভেবে ভেবে প্রবল দুঃখে জীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্ত কান্নাবিহীন জীবনের চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী আছে!
*
দ্বিজেন্দ্র দীর্ঘদিন বিষ্ণুনারায়ণের মহল থেকে বের হয়নি। বীণাবালা কয়েকবার দেখা করতে এসেও ফিরে গেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না দ্বিজেন্দ্র’র এমন করার কারণ কী! কিন্তু তিনি এও জানেন, দ্বিজেন্দ্র তাকে কিছু বলবেও না। সুতরাং তাকে জিজ্ঞেস করার কোনো মানে নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণের বিলম্বিত শ্রদ্ধানুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্তের বিষয়েও দ্বিজেন্দ্রকে ডাকা হয়েছিল, কিন্তু সে যায়নি। ফলে তাকে ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। দ্বিজেন্দ্র’র এই স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্বের কারণ সর্বজয়া। সেই দিন সন্ধ্যায় গঙ্গাবতীর তীরে সর্বজয়ার আচরণ তার মাথার ভেতর বিষমাখা তীরের ফলার মতো গেঁথে রয়েছে। সর্বজয়ার প্রতিটি উত্তর তার কাছে ছিল বিষাক্ত নাগিণীর ছোবলের মতোন। কিন্তু এতদিনেও নিজের করণীয় কিছুই ভেবে পায়নি দ্বিজেন্দ্র। সেই থেকে ভেতরে ভেতরে ফুঁসেছে সে। এমনিতে চাপা স্বভাবের মানুষ দ্বিজেন্দ্র। সহজে নিজের মনের কথা কাউকে খুলে বলে না। এবারও বলল না। বহুদিন বাদে অবশেষে মহল থেকে বের হলো সে। তার বের হবার কারণ অবশ্য দাসী কমলা। দাসী কমলার ভয়াবহ ঘটনা তার কানেও পৌঁছেছে।
.
কমলা দাসী যে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তা কমলা নিজে ছাড়া আর। কারো বোঝার সাধ্য নেই। দ্বিজেন্দ্র দীর্ঘক্ষণ কমলাদাসীর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটবেলা থেকে এই মানুষটি তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। চোখের সামনে সেই মানুষটির এই অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দেখে দ্বিজেন্দ্র’র মতো মানুষেরও বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠল। দুর্ঘটনার আজ চতুর্থ দিন। কমলা দাসী এখন খানিকটা কথা বলার মতো অবস্থায় আছে। কিন্তু তারা সারা শরীর হয়ে আছে কাপড়ের পুঁটলির মতোন। গতকাল আয়নায় নিজের মুখ দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল কমলা। সারা শরীরজুড়েই বীভৎস অবস্থা হলেও, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মুখই। উঁচু চুলোর নিচটা ঝুঁকে পরিষ্কার করছিল সে। উঠতে গিয়ে ভুলে হাত বাড়িয়ে ভর দিয়েছিল সেই পাত্রে। পাত্রখানা কাত হয়ে সরাসরি তার মুখের উপর পড়েছে। এখন সেই মুখ দেখলে কোনো মানব মুখ বলে ভ্রম হয়। আতঙ্কে হাত পা জমে যায়। দ্বিজেন্দ্র নরম গলায় কমলা দাসীকে ডাকল। বারকয়েক ডাকার পরে বহুকষ্টে ঘুরে তাকাল কমলা দাসী। কিন্তু তার মুখ দেখে আতঙ্কে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল দ্বিজেন্দ্রর। তবে তার চেয়েও বেশি কেঁপে উঠল কমলার ওই মুখ থেকে ভেসে আসা হাড় কাঁপানো চিৎকারে। কমলা চিৎকার করে বলল, আমায় ছুঁবি না, তুই নষ্ট। তুই নষ্ট। তুই তোর ওই নষ্ট শরীরে আমায় ছুঁবি না বলে দিচ্ছি।
কমলা দাসীর কথা শুনে দ্বিজেন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে গেল! কী হয়েছে, কমলা দাসীর! সে কি মাথায়ও বড় কোনো আঘাত পেয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ কোনো ডাইনি। দ্বিজেন্দ্র নরম গলায় বলল, আমি দ্বিজেন্দ্র, দ্বিজেন্দ্র।
কমলা দাসী আবার আগের মতো চেঁচিয়ে বলল, তুই দূর হ। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ।
দ্বিজেন্দ্র অবাক হয়ে গেছে। সাথে রাগান্বিতও। তার সাথে এমন করছে কেন কমলা? সে এবার তেতে উঠল। বলল, কী হলো তোমার? শরীরের সাথে কি মাথাখানাও গিয়েছে?
কমলা দাসী তাতে ভয় পেল না। সে সাপের ন্যায় হিসহিস করে বলল, সকলই যাবে। সকলই যাবে। পাপের ফল কিছুই থাকবে না। আমায় দেখে বুঝছিস না? ভগবানের বিচার। ভগবানের বিচার। পাপ করেছি, ভগবান বিচার করে দিলেন। একদম উচিত বিচার করেছেন। দেখেছিস? দেখে শিক্ষা নে। না হলে আমার মতোন করে শিক্ষা পেতে হবে। এই বলে দিলুম, মনে রাখিস।
দ্বিজেন্দ্র আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই পেছন থেকে কথা বলে উঠলেন বীণাবালা। বললেন, তুই যা। আমি দেখছি।
দ্বিজেন্দ্র বীণাবালার কথার কোনো প্রতিবাদ করল না। সে চোখভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে প্রস্থান করল। বীণাবালা কমলা দাসীর পাশে গিয়ে নরম গলায় ডাকল, কমলা, কমলা।
কিন্তু কমলা দাসী সে কথার কোনো উত্তর করল না। নড়লও না। বাকি সময়েও বীণাবালার কোনো কথার জবাব দিল না কমলা দাসী। সেই সারারাত জেগেই কাটল এই দু’জন মানুষের। বীণাবালা আর কমলার। দু’জনেরই জেগে থাকার কারণও এক। শেষরাতের দিকে কমলা দাসী চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। সেই কান্নার বেশিরভাগ জুড়েই থাকল ভগবানের কাছে প্রার্থনা। কমলা দাসীর ধারণা, তার এই ভয়ংকর পরিণতির জন্য দায়ী সে নিজে। জীবনভর সে একের পর এক যে অন্যায় করেছে, পাপ করেছে, তার ফল ভগবান তাকে পৃথিবীতেই দিয়ে দিয়েছেন। বড় নির্মমভাবেই দিয়েছেন। সে তার সারাজীবনের সকল কৃতকর্মের জন্য নানান উপায়ে ভগবানের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে লাগল। কিন্তু তার সেই বিকৃত গলার চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে সে বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার সেই চিৎকারজুড়ে সে অভিশাপ দিতে। লাগল বীণাবালা আর দ্বিজেন্দ্রকেও। সেই রাতে বীণাবালার মহলের কেউ আর ঘুমাতে পারল না। ভৃত্য দাসী থেকে সকলেই জেগে রইল কী এক তীব্র আতঙ্কে! যেন কোনো অশনি সংকেত বেজে চলছে কমলার কণ্ঠে। কী হয়েছে কমলার!
.
কমলার চিৎকারে সেই রাতে বীণাবালাও ঘুমাতে পারলেন না। তবে ভোরের আলো ফোঁটার আগে আগেই বীণাবালা এক ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। যে করেই হোক কমলার মুখ বন্ধ করতে হবে। না হলে বিপদ। ভয়ংকর বিপদ। কিন্তু বীণাবালা ভোর অবধি তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার মতো অবস্থায় রইলেন না। কতক্ষণের জন্য তার চোখ বুজে এসেছিল তা তিনি জানেন না। তার ঘুম ভাঙল ভয়াবহ মাথা যন্ত্রণা নিয়ে। সেই সাথে মাথার ভেতর সেই অসহনীয় অনুভূতি। মনে হচ্ছে হাজার হাজার মৌমাছি একসাথে গুনগুন করছে তার মগজের ভেতর। সেই সারাটিদিন বীণাবালা আর শয্যা। থেকে উঠতে পারলেন না। অবচেতনের মনে পড়ে রইলেন বিছানায়।
.
সেই রাতে ঘুমাতে পারল না আরো একজন। সে দ্বিজেন্দ্র। কমলার ওই বীভৎস মুখের কথা সে একবারের জন্যও ভুলতে পারল না। মানুষের মুখ এমন বীভৎস হতে পারে এ তার কল্পনায়ও ছিল না। কমলা সন্ধ্যায় তাকে কী বলেছে তা একবারের জন্যও আর মনে পড়ল না দ্বিজেন্দ্র’র। তার চিন্তাজুড়ে তখন। কমলার কদর্য বীভৎস মুখখানা। এতদিনকার চেপে রাখা জিঘাংসার আগুন যেন এবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠল দ্বিজেন্দ্র’র। সেই আগুনে রাতের গাঢ় অন্ধকারেও তার চোখজোড়া যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল।
*
শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিন চলে এসেছে। আর মাত্র দুদিন বাকি। কিন্তু টানাবর্ষণ এখনো থামেনি। জল বাড়ছে বিপজ্জনকভাবে। এরইমধ্যে দূর-দূরান্ত থেকে নিমন্ত্রিত কিছু নামী অতিথিও বজরাযোগে চলে এসেছেন। তাদের থাকতে দেয়া হয়েছে। বিষ্ণুনারায়ণ এবং দীপেন্দ্রনারায়ণের মহলে। কমলা দাসীর অমন ঘটনা সত্ত্বেও আয়োজন থেমে থাকেনি। সকল কিছুর দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন বিভূতিনাথ সাহা। বীণাবালা সেই যে শয্যা নিয়েছেন, এ ক’দিনে আর একবারও উঠেননি। কমলা দাসীও সেই রাতের পর আর সাড়া-শব্দ করেনি। মরার মতো পড়ে রয়েছে সেও।
দ্বিজেন্দ্র অবশ্য এ সকল কিছুর কিছুতেই নেই। সে বিষ্ণুনারায়ণের মহলে যেভাবে ঘর বন্ধ করে বসে থাকে, সেভাবেই বসে রইল। বিভূতিনাথও তাকে ডাকতে গেলেন না। তবে আজ ভোরবেলা দ্বিজেন্দ্র আবার তার ঘর থেকে বের হলো। কিন্তু কারো সাথেই তেমন কোনো কথা বলল না। সে যা করল তা হলো ভত্য ব্রজগোপালকে ডেকে নিয়ে গঙ্গামহলের ফটক পেরিয়ে বাইরে বেরুল। বহুদিন পর গঙ্গাবতীর সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিজেন্দ্র অবাক হয়ে গেল। গঙ্গাবতীর জল যেন উপচে পড়ছে। বাইরে ঝড়ো হাওয়া। সেই হাওয়া কনকনে ঠাণ্ডা। গায়ের চামড়া ভেদ করে হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অনেকগুলো অচেনা বজরা ভিড়ে আছে ঘাটে। দ্বিজেন্দ্র খানিকটা হেঁটে গিয়ে গঙ্গাবতীর ঘাটে দাঁড়াল। সেখানে নদী উপচে ওঠা টইটম্বুর শীতল জল দ্বিজেন্দ্রর পা ছুঁয়ে দিলো। কে জানে কেন, জলের সেই সামান্য স্পর্শেই দ্বিজেন্দ্রর শরীর যেন কেঁপে উঠল। সে ব্রজগোপালকে বলল, গঙ্গাবতীতে এত জল থাকতে কষ্ট করে জল বয়ে বেড়ানোর কী দরকার?
ব্রজগোপাল হা করে তাকিয়ে রইল। সে দ্বিজেন্দ্রর কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। দ্বিজেন্দ্র বলল, হা করে রয়েছ কেন? চোখের সামনে এই যে কত জল, তাও আবার রোজ রোজ বাড়ছে, এ চোখে দেখছ না?
ব্রজগোপাল দ্বিজেন্দ্রকে ছোটবেলা থেকে চেনে। সে দ্বিজেন্দ্র’র এমন রূপ থেকে ভড়কে গেল। ভীত গলায় বলল, আজ্ঞে কর্তাবাবু।
দ্বিজেন্দ্র বলল, আজ্ঞে কর্তাবাবু কী? আজ থেকে যার যার জল দরকার হবে সে এই নদী থেকে জল বয়ে নেবে, বুঝলে? না হলে কুয়ো তো রয়েছেই।
ব্রজগোপাল কিছুই বোঝেনি। কিন্তু সে ভয়ে উপর নিচ মাথা দোলালো। দ্বিজেন্দ্র বলল, আজ থেকে আর মাঝের মহলে জল যাবে না। জলের কথা বললে জানিয়ে দেবে জমিদার কর্তার আদেশ। এখন থেকে জল পেতে হলে কুয়ো থেকে তুলে নিতে হবে। কী বলেছি বুঝেছ? আর আজকেই ওই বুড়ো খগেন আর গানের মাস্টারটাকে অন্য কাজে লাগিয়ে দাও। আজ থেকেই। যেন ওই মহলে ওদের আর না দেখি।
ব্রজগোপাল বলল, আজ্ঞে কর্তা বাবু। কিন্তু কর্তা মায়ের অনুমতি…।
ব্রজগোপাল কথা শেষ করতে পারল না। দ্বিজেন্দ্র বলল, বিষ্ণুপুরের জমিদার কে, আমি? না কর্তা মা?
ব্রজগোপাল বলল, আজ্ঞে কর্তাবাবু, আপনি।
দ্বিজেন্দ্র বলল, এই কথা এখুনই মাকে জানানোর প্রয়োজন নেই। মার শরীরটা বোধ হয় ভালো না। তাকে যতটা সম্ভব এর থেকে দূরে রাখাই ভালো।
ব্রজগোপাল মাথা নুইয়ে বলল, আজ্ঞে।
দ্বিজেন্দ্র বলল, এখন যাও তবে। আর এখন থেকেই যা বলেছি তা করা শুরু করো। রাতের মধ্যে আমি যেন মাঝমহলে বাড়তি কাউকে না দেখি।
ব্রজগোপাল আর কথা বলল না। সে অবনত মস্তকে চলে যাচ্ছিল। দ্বিজেন্দ্র তাকে ফের ডাকল। বলল, খগেনকে গিয়ে বলবে এ কর্তাবাবুর নির্দেশ। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য বহু কাজ বাকি রয়েছে। তাই আগামী দু’দিন সকল ভৃত্য দাসীদের এই কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই এই দু’টো দিন মেজোকাকার জন্য হলেও যেন নিজেদের কাজটুকু ওই মহলের সকলে নিজেরাই একটু কষ্ট করে করে নেয়।
ব্রজগোপাল বলল, আজ্ঞে।
দ্বিজেন্দ্র খানিক কী যেন ভাবল। তারপর বলল, এক কাজ করো। তোমার এত কিছু বলার দরকার নেই। তুমি বরং খগেনকে ডেকে নিয়ে এসো যাও। এখুনি।
দ্বিজেন্দ্র গঙ্গাবতীর ঘাটেই দাঁড়িয়ে রইল। ব্রজগোপাল খানিক বাদে খগেনকে নিয়ে ফিরে এলো। দ্বিজেন্দ্র আর কথা বাড়াল। সে সরাসরি খগেনকে বলল, গিয়ে মেজকাকীকে বলো যে আগামী দু’টো দিন ওই মহলে কোনো কাজের মানুষ থাকছে না। এই দুইদিন তাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। তুমি, আর সেই গানের মাস্টার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কাজে লেগে যাও এখন থেকেই। বহু কাজ পড়ে আছে। ব্রজগোপাল তোমাদের কাজ। বুঝিয়ে দেবে। আর আমি যেন এই দুইদিন ওই মহলে আর কাউকে যেতে না দেখি। বুঝেছ?
খগেন মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আজ্ঞে, বুঝেছি।
দ্বিজেন্দ্র বলল, কমলা দাসীর কথা তো জানোই। ওর সেবা-যত্নেই দু’জন দাসী লেগে যাচ্ছে। এক কাজ করো ওই মহল থেকে অতসীবালাকেও পাঠিয়ে দাও। রান্নার কাজেও লোক লাগবে। কী বলেছি বুঝেছ?
খগেন বলল, আজ্ঞে, কিন্তু ও মহলে তো তাহলে আর কেউ রইল না। রাত বিরাতে কোনো প্রয়োজন হলে…।
দ্বিজেন্দ্র বলল, দাসী-বাদী ছাড়াও জগতে লোক বাঁচে। তোমার অত বুঝতে হবে না, যা বলছি করো।
খগেন বলল, আজ্ঞে।
.
দেবেন্দ্রনারায়ণের মহল থেকে সর্বজয়া, রেণুকা, সুদক্ষিণা আর ছোট্ট বীরেন্দ্র ছাড়া অন্যদের সরিয়ে দেয়া হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। বিভুঁই অবশ্য এ সকল কিছুই জানে না। সে আজকাল তার ঘর থেকেও বের হয় না। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর বসে থাকে। ওইটুকু ঘরই যেন এখন তার জগৎ। সে ব্যস্ত সময় কাটায় চড়ইদম্পতি আর বেড়ালটাকে নিয়ে। খগেন এসে যখন দ্বিজেন্দ্র’র নির্দেশটা জানাল, তখন বিষয়টির গুরুত্ব প্রথমে বুঝতে পারলেন না রেণুকা। তিনি বরং হৃষ্টচিত্তেই বললেন, না না, দুটো তো মাত্র দিন, আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।
কিন্তু অসুবিধা হলো। সন্ধ্যে নাগাদ জল ফুরিয়ে এলো মহলের। এ বিষয়টি খেয়াল করেননি রেণুকা। স্নানঘরে জমা জলটুকুও ফুরালো। এখন জলের উপায় কী? রেণুকা শেষ অবধি সর্বজয়াকে বললেন, ও মহল থেকে কাউকে ডেকে আনতে। কিন্তু সর্বজয়া জানাল সে কোথাও যাবে না। এ দ্বিজেন্দ্র’র একটি চাল। সে চাইছে সর্বজয়া নিজে তার কাছে গিয়ে বলুক যে তাদের মহলে একজন ভৃত্য দরকার। আর এই দাবি নিয়ে সে গেলেই দ্বিজেন্দ্র তাকে নানা উপায়ে ছোট করার চেষ্টা করবে। অনেক বুঝিয়েও যখন লাভ হলো না, তখন রেণুকা নিজে যেতে চাইলেন। কিন্তু সর্বজয়া তাকেও যেতে দিলো না। সে যেটি করল, স্নানঘর থেকে জল ধরার একখানা পাত্র নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে গেল। আজ সে নিজেই কুয়ো থেকে জল তুলবে। তাও দ্বিজেন্দ্র’র উদ্দেশ্য সফল হতে দেবে না। কী ভেবেছিল দ্বিজেন্দ্র? সর্বজয়া তার কাছে গিয়ে অনুগ্রহ ভিক্ষা করবে! সর্বজয়া সেটি কখনোই করবে না। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঠোনের গোলা ঘর আর তাদের মহলের মাঝখানের সরুপথ ধরে কুয়োতলার দিকে যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে অন্ধকার থেকে বিভুঁই কথা বলে উঠল। সে বলল, এত রাতে আপনি কই যাচ্ছেন একা?
সর্বজয়া এই ছেলেটিকে ভয় পায়। রতনকান্তির কাছে সে এই ছেলে সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ছেলেটিকে দেখে তার যেন কেন ভালো লাগল। মনে হলো, তাদের এই নিঃসঙ্গ সময়ে অন্ধ হলেও এই ছেলেটি তার কথা ভেবেছে। সে বলল, কুয়োতলায় জল আনতে যাচ্ছি।
সর্বজয়া নিজে জল আনতে যাচ্ছে শুনে বিভুঁই মনে মনে ভারি অবাক হলো। কিন্তু সে সর্বজয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। কোনো গুরুতর ঘটনা যে ঘটেছে, তা সে বুঝতে পেরেছে। সে কেবল বলল, আপনি একা যাচ্ছেন?
সর্বজয়া বলল, হা। মহলে আর কেউ নেই।
বিভুঁই এতক্ষণে কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারল। সে বলল, আমি অন্ধ মানুষ, তাও যদি আপনার জলের ভার কিছুটা নিতে পারি।
সে সর্বজয়ার পিছু পিছু গেল। কুয়ো থেকে জল তুলে ফিরেও আসল। কিন্তু এই দুজনের কেউই খেয়াল করল না, অন্ধকারে সর্বজয়ার সাথে বিভূঁইয়ের ছায়ামূর্তি দেখে কেউ একজন হঠাৎ আড়ালে সরে গেল। সরে যাওয়া মানুষটির হাতে নেভানো একখানা মশাল।
.
ঘটনা ঘটল পরদিন। এতদিনকার মেঘলা আকাশ সকাল থেকেই বিস্ময়করভাবে ঝকঝকে পরিষ্কার। কোথাও বৃষ্টির চিহ্নমাত্র নেই। ঝাঁঝালো রোদে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। আগামীকাল ভোরেই সে বহুল প্রতিক্ষিত আড়ম্বরপূর্ণ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। কিন্তু শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আগামীকাল হলেও গঙ্গামহলের সামনে দরিদ্র উৎসুক প্রজাদের ঢল নামতে শুরু করেছে দুপুর থেকেই। তারা ভিড় করেছে গঙ্গামহলের সামনের রাস্তাজুড়ে। আগামীকাল ভোরে তাদের জন্য গঙ্গামহলের সিংহদরোজা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। আজ রাতখানা তাদের এই বাড়ির বাইরেই থাকতে হবে। তবে তাদের জন্য এই সময়েও খাবার সরবরাহ করা হবে। দুপুরের পর বীণাবালা খানিক সুস্থবোধ করছিলেন। তিনি উঠে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সকল কিছুর তদারকি করলেন। অতিথিদের সাথে দেখা করলেন। একবার গঙ্গামহলের সিংহদরোজার বাইরে অবধি গেলেন। গিয়ে তার মন ভালো হয়ে গেল। কত কত প্রজারা এসেছে! বীণাবালাকে দেখে তারা। সকলেই হর্ষধ্বনি করে উঠল। বহুকাল পর বীণাবালার মন বড় শান্ত হয়ে উঠল। তিনি মহলে ফিরে দ্বিজেন্দ্রকে খুঁজলেন। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রকে কোথাও পেলেন না। বিভূতিনাথ সাহাও ভারি ব্যস্ত। বীণাবালা প্রফুল্লচিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলেন আগামীকালের। আগামীকাল তার জীবনের একখানা বড় ঘটনা। তিনি ভাবতেই পারছেন না, তার নিমন্ত্রণ পেয়ে এত এত মানুষ গঙ্গামহলে এসেছে। বিশেষ করে এরইমধ্যে দীর্ঘ নদীপথ ভ্রমণ শেষ বহু দূর-দূরান্তের জমিদাররা অবধি এসে পৌঁছেও গিয়েছেন। বীণাবালা লক্ষ্য করলেন তার ভেতরে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। তিনি প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আগামীকালের জন্য।
.
সর্বজয়া সন্ধ্যেবেলাই জল নিয়ে রাখতে চেয়েছিল। যাতে রাতে আর জল আনতে না যেতে হয়। একসাথে অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে অনেক জল নিয়ে রাখার শক্তি তার নেই। ফলে দিনে কয়েকবারই তাকে কুয়ো থেকে জল তুলতে আসতে হলো। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা জল তুলতে এসে সর্বজয়া দেখল কুয়ো থেকে জল তুলবার লম্বা দড়ি লাগানো বালতিটি নেই। আশেপাশে খুঁজেও সে কোথাও পেল না। শেষ অবধি উঁকি দিয়ে দেখল বালতিটি দড়িসহ কুয়োর ভেতর পড়ে গেছে। অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। এমন হতেই পারে। কিন্তু সর্বজয়ার হঠাৎ কী হলো। তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে জলের পাত্র সেখানে রেখে ঘরে ফিরে। গেল। ফিরল চারপাশে গাঢ় অন্ধকার নামার পর। আজ রাতে আর এই কুয়ো থেকে জল তোলা যাবে না। জল তুলতে হলে তাদের মহলের পেছনে অনেকটা দূরে সীমানা পাঁচিলের গা ঘেঁষে আরেকখানা কুয়ো রয়েছে। সেখান থেকে জল তুলতে হবে। সর্বজয়া খানিক দাঁড়িয়ে থেকে কী ভাবল। তারপর জলের পাত্র হাতে সেই কুয়োর উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল। বাড়ির এই পেছন দিকটায় কিছু বড় বৃক্ষ রয়েছে। মূল বাড়ি থেকে এই জায়গাটি ভারি সুনসান, স্তব্ধ। আগামীকালের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বাড়ির ওদিকটা ভীষণ সরগরম, সকলেই খুব ব্যস্ত। লোকজনের ব্যস্ত কণ্ঠস্বর, কোলাহল, হৈচৈ ভেসে আসছে। কিন্তু এই জায়গাটি তার ঠিক বিপরীত।
সর্বজয়া কুয়ো থেকে জল তুলল। তবে তার সমগ্র ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে আছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু কি ঘটবে তা সে জানে না। ভারী জলের পাত্র হাতে সর্বজয়া কেবল দু’পা এগিয়েছে। এই মুহূর্তে অন্ধকার থেকে একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এলো। ছায়ামূর্তিটি চোখের পলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সর্বজয়াকে। একহাতে সর্বজয়ার মুখ চেপে ধরল, আরেক হাতে কোমড়। সর্বজয়ার হাত থেকে জলভর্তি পাত্রখানা পড়ে গেল। ছায়ামূর্তি হিসহিস কণ্ঠে বলল, তোর অনেক জেদ তাই না?
সর্বজয়া ছায়ামূর্তিটির কণ্ঠ শুনে অবাক হলো না। দ্বিজেন্দ্র’র কণ্ঠ। সে যেন জানতই এখানে দ্বিজেন্দ্র তার জন্য অপেক্ষা করছে। আর সব জেনেশুনেই যেন সে এখানে এসেছে। সর্বজয়া তার মুখে সাঁড়াশির মতোন আটকে বসা দ্বিজেন্দ্রর হাতখানা সরাতে চেষ্টা করল, তবে পুরোপুরি পারল না। সামান্য যেটুকু সরাতে পারল তার ফাঁক গলেই সে শান্ত কণ্ঠে বলল, জেদ নয়, ঘেন্না। পঁচা ইঁদুর দেখলে যেমন ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসে, অমন ঘেন্না।
দ্বিজেন্দ্র বলল, আজ তোর সকল জেদ আমি পায়ের তলায় পিষে মারব। জীবনে যেন কারো সামনে গিয়ে আর এই মুখ নিয়ে দাঁড়াতে না পারিস। জনমের তরে তোর শিক্ষা হয়ে যাবে।
সর্বজয়া যেন মৃদু হাসল। বলল, আজ্ঞে, তা বিষ্ণুপুরের জমিদার তাহলে পাইক বরকন্দাজের কাজ ছেড়ে আজকাল মাস্টারমশাইও বনে গেলেন। লোকজনকে জনমের তরে শিক্ষা দিয়ে বেড়ান।
দ্বিজেন্দ্র আর মাথা ঠিক রাখতে পারল না। সর্বজয়ার চুলের মুঠি ধরে তাকে ঘোরাল। তারপর তার মুখে বাঁ হাতে সজোরে আঘাত করল। সর্বজয়া ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। দ্বিজেন্দ্র হঠাৎ কুয়োর পাশ থেকে কিছু একটা তুলে নিল। তারপর ফস করে আলো জ্বালল। একখানা ছোট মশাল! মশালখানায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। মশাল দেখে সর্বজয়া হঠাৎ চমকে গেল। দ্বিজেন্দ্র মশাল কেন জ্বালিয়েছে! বরং অন্ধকারেই তো তার সুবিধা হওয়ার কথা! সর্বজয়া। অনুমান করেছিল দ্বিজেন্দ্র এখানে কোথাও থাকবেই। সেটি বুঝে সে প্রস্তুত হয়ে ইচ্ছে করেই এসেছিল। সে বহুদিন থেকেই একা দ্বিজেন্দ্র’র মুখোমুখি হতে চেয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রর সাথে তার জীবনের সবচেয়ে বড় হিসেবটি বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিজেন্দ্র কৌশলে তাকে এখানে এনে কি করতে পারে সে বিষয়ে সর্বজয়ার সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না।
দ্বিজেন্দ্র জ্বলন্ত মশালখানা হাতে সর্বজয়ার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, দাসী কমলাকে দেখেছিস? ওর মুখখানা কী যে সুন্দর হয়েছে! ওই মুখ দেখলে কলিজা হিম হয়ে আসে। রাতে ঘুমের ভেতরও সেই মুখখানা দুঃস্বপ্নে ধাওয়া করে। কমলার ওই মুখ দেখে আমার ভারী শখ হয়েছে। গঙ্গামহলে অমন আরো একখানা মুখ আমি দেখব। তা তুই ছাড়া আর তো কাউকে খুঁজে পেলাম না, যার মুখে অমন করে আগুন দিয়ে ছবি এঁকে দেয়া যায়।
দ্বিজেন্দ্র খানিক থেমে মৃদু হাসলো। শান্ত-স্নিগ্ধ হাসি। সেই হাসিহাসি মুখেই সে বলল, এই মশালখানা আমি অনেকক্ষণ তোর মুখে চেপে ধরে রাখব। আমি তোর চিৎকার শুনতে চাই। তুই কিভাবে কাঁদিস আমি দেখতে চাই। তারপর মশালখানা যখন তোর মুখ থেকে সরাবো, তখন তোর মুখখানা দেখতে কেমন হয়, এ দেখার ভারি ইচ্ছে। আজ সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। তোর চিৎকার ভেতর বাড়ি অবধি পৌঁছাবে না। অত হুল্লোড়ে, চেঁচামেচিতে কে খেয়াল করবে বল?
দ্বিজেন্দ্র মিষ্টি করে হাসল। কথা শেষ হলেও হাসির রেশ তার মুখেই লেগে রইল। সে তার হাতের মশালখানিতে সর্বজয়ার মুখ ঝলসে দিতে চায়। সর্বজয়াকে মাটিতে ফেলে মশালখানি তার মুখে চেপে ধরতে চায়! অমন হাসি হাসি মুখের একজন মানুষ এমন নৃশংস কী করে হয়! ভাবনাটি মাথায় যেতেই সর্বজয়ার শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। সে মশালের আলোয় সেই শান্ত-শিষ্ট চেহারার দ্বিজেন্দ্র’র চোখ দুখানা দেখে আঁৎকে উঠল। এ কোনো সুস্থ মানুষের চোখ নয়। এ এক নৃশংস খুনীর চোখ। তার সামনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে যেন কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ নয়, বিকৃত নেশার এক সাক্ষাৎ উন্মাদ। দ্বিজেন্দ্র এবার সজোরে লাথি বসালো সর্বজয়ার কোমরে। সর্বজয়া আরো খানিক গড়িয়ে সরে গেল বা দিকে। দ্বিজেন্দ্র এবার তার হাতের মশালখানার দিকে তাকাল। রাতের পর রাত না ঘুমানো টকটকে লাল চোখ। সেই চোখে সে গভীর মনোযোগে মশালখানার দিকে তাকিয়েই রইল। তার মুখে ক্রমশই এক ক্রুর হাসি ফুটে উঠছে। সেই হাসি আরো বিস্তৃত, আরো বীভৎস হয়ে উঠছে।
কিন্তু মশালের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা দ্বিজেন্দ্র’র হঠাৎ মনে হলো, কেউ একজন ছুটে আসছে। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। সর্বজয়া চোখের পলকে উঠে এসেছে। তার হাতে ভয়াল দর্শন তীক্ষ্ণ এক ছোরা। দ্বিজেন্দ্র এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তার ভাবনার দূরতম। কল্পনায়ও ছিল না এই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সে মুহূর্তেরও ভগ্নাংশের সময়ের জন্য চমকে গেল। একইসাথে তীব্র আতঙ্কে নিশ্চল হয়ে রইল। ততক্ষণে সর্বজয়ার হাতের সুতীক্ষ ছোরাখানা দ্বিজেন্দ্রর ডান চোখ বরাবর আমূল বিদ্ধ হয়ে গেল। দ্বিজেন্দ্ৰ জগৎ সংসার কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু সেই চিৎকার এই
এতদূর থেকে ওই হৈ-হুঁল্লোড়পূর্ণ ভেতর বাড়িতে আর পৌঁছাল না।
দ্বিজেন্দ্রর হাত থেকে মশালখানা ছিটকে পড়ল দূরে। সে দু’হাতে ডান চোখখানা চেপে ধরেছে। তার সারাশরীর থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু সর্বজয়ার শরীরে তখন যেন অসুর ভর করেছে। সে এবার তার হাতের ছোরাখানা দ্বিজেন্দ্রর বা চোখে ঢুকিয়ে দিল। দ্বিজেন্দ্র কাটা গাছের মতোন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তার দুই চোখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। সর্বজয়া এরপর তার পাশেই পড়ে থাকা মশালখানা তুলে নিয়ে দ্বিজেন্দ্রর মুখের উপর চেপে ধরল। দ্বিজেন্দ্র ডাঙায় তোলা মাছের মতোন ছটফট করতে লাগল। কিন্তু সর্বজয়া মুহূর্তের জন্যও মশালখানা তার মুখ থেকে সরালো না। চেপে ধরেই রাখল। কতক্ষণ চেপে ধরে রেখেছে, সর্বজয়ার খেয়াল নেই। দ্বিজেন্দ্র’র ছটফট করতে থাকা শরীরখানা কতক্ষণ বাদে স্থির হয়ে গেছে তাও সে জানে না। তবে দীর্ঘসময় বাদে সে মশালখানা দ্বিজেন্দ্রর মুখ থেকে সরালো। তারপর জগতের সবচেয়ে ভয়ংকর, সবচেয়ে বীভৎসতম আকৃতির পোড়া, চক্ষুবিহীন মুখখানার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল সর্বজয়া। এক মুহূর্তের জন্যও সে তার চোখ। সরালো না দ্বিজেন্দ্রর ওই অবিশ্বাস্য রকম বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখখানা থেকে। সর্বজয়া জানে, দ্বিজেন্দ্র এখনও বেঁচে আছে। অবশ্য কতক্ষণ বেঁচে থাকবে তা সে জানে না! কিন্তু সে চায় দ্বিজেন্দ্র বেঁচে থাকুক। আরো অনেকদিন এই মুখ নিয়ে সে বেঁচে থাকুক।
সর্বজয়া কুয়ো থেকে আবার জল তুলল। তারপর সেই জলে যতটা সম্ভব হাত মুখ ধুয়ে জল নিয়ে মহলে ফিরল। স্নানঘরে গিয়ে সেই সামান্য জলেই স্নান সারলো সে। তারপর সদ্য পাটভাঙা আনকোড়া একখানা কাপড় পরল। তারপর রেণুকার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাসল। সেই হাসি দেখে রেণুকার মুহূর্তের জন্য মনে হলো এই সর্বজয়া আগের সেই সর্বজয়া। সেই প্রাণবন্ত উজ্জ্বল। সর্বজয়া। সে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, কী হয়েছে মা?
সর্বজয়া সেই হাসি হসি মুখেই বলল, আমি মনে হয় দ্বিজেন্দ্রকে খুন করেছি মা।
রেণুকা মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি প্রবল আতঙ্ক নিয়ে সর্বজয়ার কাছে ছুটে এলেন। তারপর দু’হাতে সর্বজয়ার মুখ চেপে ধরে বললেন, কী হয়েছে মা? কী হয়েছে তোর?
সর্বজয়া তার মুখের সেই হাসি ধরে রেখেই আনন্দময় গলায় বলল, যা যা খুব দরকারি, তার সকলই নিয়ে প্রস্তুত হও। গঙ্গামহলে আর এক মুহূর্তও নয়।
রেণুকা সর্বজয়ার কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি সর্বজয়াকে নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন। কিন্তু সর্বজয়া তার কিছুরই আর উত্তর দিলো না। সে কেবল ওই এক কথাই বলছিল, প্রস্তুত হও। গঙ্গামহলে আর এক মুহূর্ত নয়।
তার কিছু সময় বাদে দেখা গেল দেবেন্দ্রনারায়ণের আড়ম্বরপূর্ণ শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আগের রাত্রিতেই তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা বিষ্ণুপুরের জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলের পেছনের ফটক দিয়ে চুপিচুপি পলায়ন করলেন।
*
দ্বিজেন্দ্রকে বাড়ির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো মহলে না, কোনো ঘরে না। এই নিয়ে বীণাবালা ভারি বিব্রত। অভ্যাগত সকল অতিথিরাই চাইছেন জমিদার বাবুর সাথে দেখা করতে, কথা বলতে। কিন্তু সে আর হচ্ছে না। বিভূতিনাথ সাহাও চিন্তিত। ছেলেটা গেল কই? ভোর হতেই গঙ্গামহলের সিংহদুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে। রাজ্যের মানুষ ঢুকেছে পিলপিল করে। তারা যে শুধু বিষ্ণুপুরেরই, তা নয়। দূর-দূরান্ত থেকেও অনেক মানুষ এখানে এসেছে। দিন যত বাড়তে থাকল, সেই মানুষের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকল। সকলকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে গঙ্গামহলের পাইক পেয়াদারা। সেই সকল মানুষের ভেতর আলাদা দু’জন মানুষ রয়েছেন। একজন দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত বাউলবেশি অবনীন্দ্রনারায়ণ। আরেকজন লম্বা ঘোমটার আড়ালে হেমাঙ্গিনী দেবী। গঙ্গামহলের ভূত্য দাসী থেকে সকলেই মহাব্যস্ত। কারো দিকে আলাদা করে তাকানোর ফুরসত নেই কারো। হেমাঙ্গিনী দেবী উঠোনের এক কোণায় বসে রয়েছেন। ঘোমটার ফাঁকে তার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। বিভুঁই কোথায়?
কতদিন পরে সে এলো এ বাড়িতে? দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলখানা বাইরে থেকে দেখে তো আগের মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু কেমন নীরব-নিস্তব্ধ। যেন জনমানুষের সাড়া অবধি নেই। দীর্ঘসময় ধরে দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলের দিকে তাকিয়ে রইল হেমাঙ্গিনী দেবী। কিন্তু মুহূর্তের জন্য কোথাও কোনো স্পন্দন নেই। অস্বভাবিক রকমের প্রাণহীন এক মহল। হেমাঙ্গিনী দেবীর কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। কী হয়েছে ওখানে!
বিভূঁইকে সে দেখতে পেল আরো খানিক পরে। কেউ একজন তাকে ধরে এনে উঠোনের একপাশে বসিয়ে দিয়েছে। তার মুখভর্তি বড় বড় গুটি বসন্তের দাগ। কিন্তু বিভুঁইকে দেখতে মুহূর্তকাল বিলম্ব হলো না হেমাঙ্গিনী দেবীর। সে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। বিভূঁইয়ের সামনে আহার। কিন্তু সে তার কিছুই ছুঁইছে না। যেন এখানে থেকেও সে এখানে নেই। অন্য কোথাও। হেমাঙ্গিনী দেবী। লোকের ভিড়ের মধ্যে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল বিভূঁইয়ের দিকে। তার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় সে জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়বে উঠানে। কিন্তু মানুষের ভিড় ঠেলে সে ধীরে ধীরে বিভূঁইয়ের একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেল। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বিভূঁইয়ের পাশে। তাদের চারপাশ জুড়ে অজস্র মানুষ। খাবার নিয়ে কোলাহল, হৈচৈ। কেউ যেন কাউকে দেখছে না, শুনছে না। সকলেই কেবল বলছে। চিৎকার করে খাবার চাইছে। ভূত্য-পেয়াদাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। সেই তুমুল কোলাহলে হেমাঙ্গিনী দেবী বিভূঁইয়ের একদম গা ঘেঁষে বসে রইল। বিভুঁই! এই তার বিভুঁই।
হেমাঙ্গিনী দেবীর বুকের ভেতরটা উথাল-পাতাল ঢেউয়ের মতোন কেঁপে উঠতে লাগল। হু হু করা কান্নার প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভিজিয়ে দিতে চাইল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। তার কী যে ইচ্ছে হলো বিভুঁইকে একবার ছুঁয়ে দেখতে, একবার। এই জীবনে এর চেয়ে প্রার্থিত আর কিছু নেই হেমাঙ্গিনী দেবীর। সে বলেছিল সে ভগবানের কিছু আর কিছু চায় না, কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হলো সে চায়। সে ভগবানের কাছে আর একটিমাত্র জিনিস চায়। সে বিভুঁইকে তার বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখতে চায়। চেপে ধরে কাঁদতে চায়। একজনমের সকল কান্না। সেই কান্নায় তার জীবনের সকল দুঃখ, সকল আক্ষেপ, সকলই ধুয়ে মুছে নিঃশেষ হয়ে যাক। কেবল বুকের ভেতর লেগে থাকুক বিভুঁইয়ের ওইটুকু বুকের ওম। বিভূঁই! বিভুঁই!!
হেমাঙ্গিনী দেবীর বুকের ভেতর প্রবল কান্নারা সুতীব্র জলোচ্ছাসের মতোন মুহুর্মুহু ভেঙে পড়তে লাগল। বুকের ভেতরে ওলটপালট করে ডাকতে লাগল বিভূঁইকে। কিন্তু সেই অস্ফুট কান্নার ডাক হেমাঙ্গিনী দেবীর মুখে এসে স্ফুট হলো না। সে বসে রইল নিঃশব্দ। অজস্র মানুষের মাঝেও নিঃসঙ্গ এক মানুষ। অজস্র জনের মাঝেও নির্জন, একা এক মা। চির দুঃখিনী এক নারী। জগতের সবচেয়ে অসহায়তম মা।
বিভুঁই তার অন্ধ চোখ তুলে তাকিয়ে আছে আকাশে। তার মাথার উপর দু’টো চড়ই খানিক বাদে উড়ে উড়ে আসছে। আবার মুহূর্তেই চলে যাচ্ছে। বিভুঁই যেন সেই চড়ুইদের দেখতে পাচ্ছে। তার সকল মনোযোগ সেই চড়ুইদের নিয়ে। এই চারপাশের এত কোলাহল, এত শব্দ তার কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। হেমাঙ্গিনী দেবী বিপুল মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইল বিভূঁইয়ের দিকে। বিভুঁই শেষ কবে তাকে মা বলে ডেকেছিল? কবে? হেমাঙ্গিনী দেবী মনে করতে পারে না। সুতীব্র তেষ্টায় তার বুকের জমিন ফেটে চৌচির হয়ে আছে। এই তেষ্টা আর কিসে মিটবে? কত জলে। জগতের কোনো জলের সাধ্য নেই এই তেষ্টা মেটায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে বিভুঁই মাথা নামিয়ে হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে তাকাল। তার অন্ধ চোখে কি সে কিছু দেখতে পেয়েছে? নাকি দেখতে পেয়েছে তার বুকের ভেতরে ক্রমশই জেগে ওটা অন্য এক চোখে। অন্তদৃষ্টিতে? কে জানে?
যাতেই দেখতে পাক কিংবা না পাক, তাতে হেমাঙ্গিনী দেবীর আর কিছু আসে যায় না। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সকল ভালোবাসা বুকের ভেতর জড়ো করে বিভুঁই স্পষ্ট গলায় ডাকল, মা, মাগো।
.
অবনীন্দ্রনারায়ণও বসে রয়েছেন ভিড়ের মধ্যে। কিন্তু তিনি বীণাবালা বা দ্বিজেন্দ্র কাউকে দেখতে পেলেন না। এমনকী রতনকান্তিকেও না। দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলের খগেন, দাসী অতসীবালাকে অবধি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রতনকান্তি কোথাও নেই! সে কি আর এ বাড়িতে ফিরে আসেনি!
অবনীন্দ্রনারায়ণ তার কন্যা গায়ত্রীকে দেখতে পেলেন। গায়ত্রীও তবে এসেছে! কতদিন পরে গায়ত্রীকে দেখলেন তিনি! অবনীন্দ্রনারায়ণের মনে নেই। তিনি আশেপাশে তাকিয়ে গঙ্গামহলকে দেখছিলেন। সকলই আগের মতো, কিন্তু আবার কিছুই যেন আর আগের মতো নেই। অবশ্য তফাতখানি ধরতে পারলেন না অবনীন্দ্রনারায়ণ। তিনি এখনো জানেন না তিনি এখানে কেন এসেছেন। পথে তিনি লোকমুখে শুনেছিলেন বিষ্ণুপুরের দেবেন্দ্রনারায়ণ মারা গেছেন। বিষ্ণুপুরের বর্তমান জমিদার দ্বিজেন্দ্র তার বিলম্বিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আড়ম্বরপূর্ণ করে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেদিন সকলের জন্য গঙ্গামহলের সিংহদরোজা উন্মোচিত থাকবে। কাঙালিভোজ হবে। এসব শুনে মনের ভেতরটা কেমন করে উঠল। তারপর কেমন কেমন করে যে চলে এলেন, তা অবনীন্দ্রনারায়ণ নিজেও। জানেন না। একখানা বিষয়ে অবশ্য তিনি বেশ আনন্দ পাচ্ছেন, এই বিশাল বাড়ি, যে বাড়িতে তিনি জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন, সেই বাড়ির কেউই তাকে চিনছে না। কিছুদিন আগেও বিষ্ণুপুরের জমিদার ছিলেন তিনি। এই গঙ্গামহলের কর্ণধার। সেই মানুষটিই আজ প্রজাদের সাথে গঙ্গামহলের উঠানের এক কোণে। বসে কাঙালিভোজ খাচ্ছেন। জগৎ কী অদ্ভুত আর রহস্যময়। মানুষও।
অবনীন্দ্রনারায়ণের তীব্র জলতেষ্টা পেল। বারকয়েক তিনি ভৃত্য দাসীদের ডাকলেনও। কিন্তু কেউ তার ডাক শুনল না। তিনি কুঁজোভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। বিষ্ণুমন্দিরের পাশেই একখানা জলের কুঁয়ো রয়েছে। তার পাশেই দাসীদের ঘর। তিনি হেঁটে সেই কুয়োর দিকে গেলেন। কুয়ো থেকে জল তুলে আঁজলা ভরে পানও করলেন। কিন্তু ফিরে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। কেউ একজন নিচুস্বরে গোঙাচ্ছে। আর ক্রমাগত একঘেয়ে সুরে কিছু বলছে। তিনি কৌতূহলবশত শব্দের উৎস লক্ষ্য করে আগালেন। ছোট্ট সংকীর্ণ একখানা ঘর। ঘরের জানালায় উঁকি দিয়ে তিনি দেখলে মেঝেতে কাপড়ের পুঁটলির মতোন কিছু একটা পড়ে রয়েছে। এই কাপড়ের পুঁটলি ভেতর যে একজন মানুষ শুয়ে আছে, তা বুঝতে অবনীন্দ্রনারায়ণের ঢের সময় লাগল। গোঙানির শব্দটা পুঁটলির ভেতর থেকেই আসছিল। তিনি আলত ধাক্কায় ঘরের দরজাখানা খুললেন। দরজার সাথেই শুয়ে আছে কাপড়ে মোড়ানো মানুষটা। তিনি মানুষটার মুখের উপর থেকে কাপড় সরাতেই তীব্র আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন! তার সামনে এ কে? দাসী কমলা তার চামড়াবিহীন, তালগোল পাকানো মাংসপিণ্ডের মুখ তুলে অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকাল। কমলার ভ্রুবিহীন চোখের দৃষ্টিজুড়েও ভয়। সে ফিসফিস করে বলল, কে? বীণাবালা পাঠিয়েছে? আমায় মেরে ফেলতে পাঠিয়েছে তোমায়? ভগবানের দিব্যি বলছি, আমি আর মুখ খুলব না। আমায় মেরো না। মেরো না।
গলার স্বর শুনে কমলা দাসীকে চিনলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। কমলা দাসী পুরোপুরি বোধ হারানো এক আতঙ্কিত পাগলিনী যেন। সে ভীতচোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, সেদিন বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বুঝলে! জীবনজুড়ে পাপ তো আর কম করিনি। ভগবান তাই এমন করে পুড়ল। তা তুমিই বলো বাপু, পাপ কি আমি একা করেছি? আমি তো কেবল হুকুমের দাসী হয়েই ছিলাম। তা যে পাপ করল, সে তো দেখি দিব্যি রাজরানী সেজে বসে রয়েছে। ভগবান দেখেন দাসী-বাদি’দের।
অবনীন্দ্রনারায়ণ কিছুই বুঝলেন না। তিনি কুঞ্চিত কপালে তাকিয়ে রইলেন। কমলা দাসীর শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা বুঝি আবার শুরু হয়েছে। সে মুখ বিকৃত করে বলল, তা গতরাতে এই ঘরে একা একাই এসেছিল সে। এসে বলল, আমি যদি কাউকে কিছু বলি, তাহলে নাকি আমায় মেরেই ফেলবে। তা তুমিই বলো, মরার আর কি বাকি রয়েছে আমার?
খানিক থেমে এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল কমলা দাসী। বলল, না, না। মৃত্যুর ভয় বড় ভয়। আমি কাউকে কিছু বলব না। আমি কিছু জানি নে বুঝলে। কিছু জানি নে। তা তুমি কে হে? সাধু-টাধু নাকি গো? অমন দাড়ি, চুল! একটু দেখো তো বাবা, ভগবানের কাছে বলে কয়ে আমার পাপ যদি কিছু কাটাতে পারো!
অবনীন্দ্রনারায়ণ কমলা দাসীর কথার কিছুই বুঝতে পারলেন না। সকলই কেমন এলোমেলো লাগছে। অবনীন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ বললেন, আমি অবনীন্দ্রনারায়ণ কমলা। তুমি আমায় চিনতে পারছ না?
কমলা দাসী অনেকক্ষণ স্থির তাকিয়ে রইল। তারপর আবার হাউমাউ কেঁদে বলল, মিথ্যে বলো না গো। সে ভারি পাপ। ভগবান মিথ্যে মোটে পছন্দ করেন না। ওই থেকেই তো সকল পাপের শুরু। তুমি অবনীন্দ্রনারায়ণ হতে যাবে কেন সাধু! সে তো এক বোকার হদ্দ। বোকা না হলে কী আর নিজের। ঘরের খবর রাখে না। পাপ! পাপ! ওই সংসারের সকলই ওই বিভূতিনাথ সাহা আর বীণাবালার পাপ বুঝলে? চারদিকে গিজগিজে পাপ! বোকার হদ্দ বলেই অবনীন্দ্রনারায়ণ কিছু ধরতে পারল না। যাও, যাও, দূর হও। আমিও বড় বোকা, নিজের ভালো বুঝিনে, সকলই আবার বলে দেব। শেষে বীণাবালা আমায়… যাও, যাও।
অবনীন্দ্রনারায়ণ আর দাঁড়ালেন না। প্রবল অস্বস্তি নিয়ে তিনি এসে আবার পূর্বের জায়গায় বসে পড়লেন।
বীণাবালাকে অবশেষে দেখা গেল। তিনি তার মহলের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের সকল কিছু দেখছেন। কিন্তু তার মুখ কেমন শুকনো। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ। এতক্ষণে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে গায়ত্রী আর বিভূতিনাথ সাহা। কিন্তু দ্বিজেন্দ্র কই? অবনীন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় অপলক তাকিয়ে রইলেন মানুষ তিনজনের দিকে। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রকে কোথাও দেখতে পেলেন না। কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে রইলেন তা তিনি জানেন না। তবে এই মানুষ তিনজনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার কেমন একটা ঝিমুনির মতো হলো। দীর্ঘপথ হেঁটে এসেছেন। পেটেও কিছু পড়েনি দীর্ঘসময়। শরীরটা ভারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার কেমন ঘোরের মতোন হলো। সেই ঘোর থেকে তিনি যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিল।
সেই অত মানুষের ভিড়ের ভেতর বসেও অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন স্বপ্নে ডুবে গেলেন। সেই স্বপ্ন। সেই ভয়ংকর স্বপ্নখানা। যে স্বপ্নে তিনি একখানা বড় পায়রা হয়ে বসে রয়েছেন গঙ্গামহলের ছাদের কার্নিশে। নিচে দাঁড়িয়ে ছোট্ট গায়ত্রী, দ্বিজেন্দ্র আর তার নিজের মতোই দেখতে অন্য একটি লোক। তারা সকলে মিলে তার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারছে। আর বলছে, দূর হ, শকুন, দূর হ। পাশেই দাঁড়িয়ে সকলই দেখছেন বীণাবালা। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলছেন না। বরং তার পাশে দাঁড়িয়েই পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকা লোকটার হাতে একখানা বড় খাঁচা তুলে দিয়ে বললেন শকুনটাকে বন্দী করতে। ভয়ে অবনীন্দ্রনারায়ণ পাখা ঝাঁপটে উড়ে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না।
এইপর্যায়ে এসে অবনীন্দ্রনারায়ণে তন্দ্রা কেটে গেল। তিনি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন মাটিতে। তিনি তেমন বসেই রইলেন। নড়লেন না। তাকালেন না আর কোন দিকে। যেমন তাকিয়ে ছিলেন ওই দোতলার বারান্দার দিকে, তেমনই তাকিয়ে রইলেন। সেখানে বীণাবালা, বিভূতিনাথ সাহা আর গায়ত্রী। দ্বিজেন্দ্রও হয়তো আশেপাশে কোথাও রয়েছে। তিনি বারান্দার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তা জানেন না অবনীন্দ্রনারায়ণ। তিনি কেবল জানেন, এই এতদিনে একখানা সুগভীর স্বপ্নের তাৎপর্য তিনি ধরতে পেরেছেন। এই এতদিনের এত দুশ্চিন্তা, এত দুর্ভাবনার ক্লান্তিকর সময় শেষে এই এক মুহূর্তেই যেন সকল কিছু তার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল। তার অবচেতন মনে যে ভাবনা বছরের পর বছর আবছা হলেও জেগে জেগে উঠছিল। জেগে উঠেছিল স্বপ্ন অবধিও। যেই স্বপ্ন দেখে তিনি বহুবার ভয়ে কেঁপেও উঠেছেন। সেই স্বপ্নের কারণ তিনি আজ এই মুহূর্তে যেন আবিষ্কার করতে পারলেন।
তার সামনের ওই গায়ত্রী, ওই বীণাবালা কিংবা এই মুহূর্তে গঙ্গামহলের অন্য কোথাও থাকা দ্বিজেন্দ্র, কারো সাথেই কি আসলে তার কোনো সম্পর্ক রয়েছে? না ছিল কখনো? স্বপ্নে বীণাবালার পাশে তার মতোই দেখতে যে মানুষটা দাঁড়িয়েছিলেন, যেই মানুষটার হাতে বীণাবালা মস্ত খাঁচা দিয়ে তাকে বন্দী করতে বলেছিলেন, এই মুহূর্তে সেই মানুষটিকেও যেন চিনতে পারলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। সেই মানুষটি আসলে আর কেউ নন, সেই মানুষটি আসলে বিভূতিনাথ সাহা। খানিক আগেই কমলা দাসী তো সকল স্পষ্ট করেই বলেছে। বীণাবালার সকল কিছুর সাক্ষী সে! এই এতটা কাল অবনীন্দ্রনারায়ণ আসলে বিভূতিনাথের পরিচয়ে বেঁচে ছিলেন!
বিভূতিনাথের সন্তানদের পিতার পরিচয়ে বেঁচেছিলেন!
সেই যে নাম না জানা নদীর পরে যে জেলে পরিবারে তিনি রাত কাটিয়েছিলেন, রাতের আঁধারে সেই জেলে পরিবারে সকল দৃশ্যমানতার আড়ালে যে ফাঁকি তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, সেই ফাঁকি কি তার জীবনেও নেই? সকল মানুষের জীবনেই কি এমন কিছু না কিছু ফাঁকি রয়ে যায়? কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো ফাঁকি! সারাজীবন ধরে সে জেনে, না জেনে তা বয়ে বেড়ায়! এতদিন এই কঠিন সত্যটি এমন সুস্পষ্টরূপে না জানলেও অবনীন্দ্রনারায়ণ এটি তো স্পষ্ট করেই জানতেন যে বীণাবালা তাকে ভালোবাসেন না। অবশ্য তিনি নিজেই জানতেন, ভালোবাসার মতোন কেউ তিনি ননও। তিনি দেখেছেন, কালে-ভদ্রে বীণাবালাকে, শয্যায় স্পর্শ করার সুযোগ তার হলেও, বছরের পর বছর বীণাবালা নানান অজুহাতে তার স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এ কারণে তিনি নিজেও অবশ্য এ সকল নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। তিনি সবসময়ই বিশ্বাস করেন, যে তাকে ভালোবাসে না, তার শরীর তার কাছে মৃত।
বীণাবাবালার সেই মৃত শরীর তাহলে বিভূতিনাথ সাহার ভালোবাসায় প্রাণ পেয়েছিল? সেই ভালোবাসার ফসল হয়েই তাহলে ফুটেছিল দ্বিজেন্দ্র আর গায়ত্রী? সুনিশ্চিত, আবার কোথায় যেন খানিকটা অনিশ্চয়তাও, এমন এক অদ্ভুত দোদুল্যমানতা নিয়ে অবনীন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহল থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি হেঁটে যেতে যেতে ভাবছিলেন, জগতের জাগতিকতা থেকে, মোহ থেকে আসলে মানুষের মুক্তি নেই। তারও নেই। আর নেই বলেই সেই জেলের বাড়ি থেকে বেরিয়েই তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন তার নিজের জীবনের এক অনিবার্য প্রশ্নের, তার জীবনের ফাঁকি কী? সেই ফাঁকি খুঁজতেই কি তার মন তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল গঙ্গামহলে?
অবনীন্দ্রনারায়ণ জানেন না। তবে তার সহসা মনে হলো, মায়া থেকে মানুষের মুক্তি নেই। জীবনজুড়েই মানুষ মোহ আর মায়ায় জড়িয়ে থাকতে বাধ্য। এই তার অনিবার্য নিয়তি। এ জন্যই সে মানুষ। মানুষ তার মনের কাছে বন্দী। কিন্তু মন কি কখনো কোনো মানুষের কাছে বন্দী হয় না? কোনো মানুষই কি পারে না, তার নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে? ইচ্ছেমতো বন্দী করে রাখতে? কিন্তু মন আর মানুষ, এই দুই কি তাহলে আলাদা? কিভাবে? অবনীন্দ্রনারায়ণ গাইলেন
ওরে মানুষ নামের মানুষ বাঁচে, কী পরিচয় তার সংসারে?
ঘরের মানুষ পথের মানুষ, কে দোষী কোন বিচারে!
বিচার বসে কার সালিশে, কার নালিশে কে দোষী হয়?
সকল বিচার আপনা মনে, মনেই সৃষ্টি, মনেই ক্ষয়।
*
দেবেন্দ্রনারায়ণের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নিয়ে বীণাবালার উদ্দেশ্য শেষঅবধি পুরোপুরি পূরণ হলো না। সাধারণ প্রজাদের পর্ব ঠিকঠাকভাবে শেষ হলেও, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, নিমন্ত্রিত জমিদারদের নিয়ে যে আসল পর্বটি ছিল, সেটিই আর হলো না।
দ্বিজেন্দ্রর লাশ পাওয়া গেল দুপুরের পর পর। বীণাবালা সেই লাশ দেখতে পারলেন না। তিনি সাথে সাথেই মূৰ্ছা গেলেন। বিভূতিনাথ সাহা দ্বিজেন্দ্রর মাথা বুকে চেপে পাগলের মতোন বিলাপ করতে শুরু করলেন। গঙ্গামহলের সকলেই অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল বিভূতিনাথ সাহা কাঁদছেন সর্বহারা মানুষের মতোন। এ যেন পুত্রশোকে পাগলপ্রায় পিতা। তার কান্নার নিনাদে ভারি হয়ে উঠেছে গঙ্গামহলের বাতাস।
নিমন্ত্রিত অতিথিরা আর এই সকল কিছুর মধ্যে থাকতে চাইলেন না। বীণাবালা-দ্বিজেন্দ্রনারায়ণের সময় থেকে এমনিতেই গঙ্গামহল নিয়ে নানান কথা চারপাশে ছড়িয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে আবার এমন ভয়াবহ ঘটনা। সকলেই যে যার মতো করে কেটে পড়তে থাকলেন। সমস্যা হচ্ছে অতিথিদের মধ্য থেকে একজনের বজরা নৌকা ঘাটে পাওয়া গেল না। ঘাট থেকে রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে গেছে বজরাখানা। ছোট বজরা। মাঝিমাল্লাও ছিল কম। গঙ্গামহলের ভেতরেই রাত্রিযাপন করেছিল সেই বজরার মাঝিরা। তারা দিনের বেলাও আর গঙ্গামহল থেকে বের হয়নি। অতিথি ভৈরবীপুর থেকে এসেছিলেন। তিনি বজরা না দেখে তার মাঝিদের কিছুক্ষণ ভর্ৎসনা করলেও এ নিয়ে অভিযোগ করতে আর গঙ্গামহলে ফিরলেন না।
দেবেন্দ্রনারায়ণের মহল যে শূন্য, সেই মহলে যে রেণুকা, সর্বজয়া, সুদক্ষিণারা কেউ নেই তাও কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল। রাতের অন্ধকারে তাহলে পালিয়েছে তারা! কোথায় যাবে পালিয়ে? অবাক ব্যাপার হলো, এই সকল প্রশ্ন থাকলেও তাদের নিয়ে তখনই ব্যস্ত হয়ে উঠল না কেউ। তাদের খোঁজে গঙ্গামহল থেকে তৎক্ষণাৎ কোনো লোকও পাঠানো হলো না।
হঠাৎ শোকে, আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে গিয়েছে গঙ্গামহলের সকলেই। খানিক আগের ঝলমলে গঙ্গামহল এখন সাধারণ উৎসুক প্রজাদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। কিন্তু এত মানুষের ভিড়েও সকলই স্তব্ধ, স্তম্ভিত, নির্জীব। প্রজাদের ভেতর যতটা না শোক তার চেয়েও বেশি বয়ে যাচ্ছিল প্রবল ভয়ের চোরাস্রোত। হরিহরণও শেষ অবধি এসেছিল গঙ্গামহলে। সে যেন জানত তার বাড়ি থেকে বের হয়ে হেমাঙ্গিনী দেবী কোথায় যাবে! গঙ্গামহলের উঠানে ভিড়ের মধ্যে বিভূঁইয়ের সাথে সে দেখতে পেয়েছিল হেমাঙ্গিনী দেবীকেও। হরিহরণ চুপচাপ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের পাশে। ততক্ষণে দ্বিজেন্দ্রর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পুরো বাড়ি যেন কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ল সেদিকেই।
বিভুঁই হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী দু’জনকেই নিয়ে এসেছিল তার ছোট্ট ঘরে। এ ঘরে খুব প্রয়োজন না হলে কেউ কখনো আসে না। তাছাড়া দ্বিজেন্দ্র’র মৃত্যু নিয়ে সমগ্র গঙ্গামহলই ওদিকটাতে আটকে রয়েছে। শেষ অবধি এই ছোট্ট ঘরখানাই হয়ে উঠল বিভুঁইয়ের এতদিনকার সকল জিজ্ঞাসার উত্তর প্রাপ্তির জায়গা।
হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী দু’জনে মিলে দীর্ঘসময় ধরে যতটা পেরেছে, সকল ঘটনা একে একে খুলে বলল বিভূঁইকে। তবে হেমাঙ্গিনী দেবীর চেয়েও হরিহরণ জানত আরো বেশি কিছু। সে বিভূঁইয়ের সামনে উন্মুক্ত করে দিলো এতদিন ধরে আটকে রাখা তার মনের সকল আগল। দ্বিজেন্দ্রর এমন বীভত্স মৃত্যুতে হরিহরণের চেয়ে অধিক আনন্দিত বোধ করি আর কেউ হয়নি। সেই গভীর রাতে গঙ্গাবতীর ঘাটে মধুকে কেন, কিভাবে খুন করেছিল দ্বিজেন্দ্র তাও বিশদ বলল হরিহরণ। বলল দীপেন্দ্রনারায়ণের সিন্দুক চুরির ঘটনাও।
সবকিছু শুনেও বিভুঁই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে চুপচাপ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইল। এমনকি শেষ অবধি যখন হেমাঙ্গিনী দেবী আর হরিহরণের যাওয়ার সময় হলো, তখনো সে তার মায়ের সাথে যায়নি। কোথায় যাবে সে মায়ের সাথে! সে কেবল মায়ের কোলের ভেতর মুখ ডুবিয়ে শুয়েছিল। শুয়ে শুয়ে বুক ভরে ঘ্রাণ নিয়ে নিচ্ছিল। কত দিবস রাত্রির প্রার্থনার, কান্নার এই ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণের কী সুতীব্র তেষ্টায়ই না পুড়ে খাক হয়েছিল তার বুকের ভেতর! সে সেই তেষ্টা মেটাতে আকণ্ঠ পান করে নিচ্ছিল জগতের শ্রেষ্ঠতম সুবাস। সেই সুবাস মানেই মমতা-ভালোবাসার থৈথৈ সমুদ্র। অপার্থিব আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল বিভুঁইয়ের। তার বুকের ভেতরের প্রতিমুহূর্তের স্পন্দনে অদ্ভুত শব্দরা ফিসফিস করে ডাকছিল, মা, মা, মাগো!
.
কিন্তু বিভুঁই নিজের মুখে অমন করে আর একবারও ডাকেনি মাকে। হৃদয়। যখন এমন গভীরতায়, এমন তীব্রতায় কাউকে ডেকে যায়, তখন মুখের ভাষার সাধ্য কি তা ছাড়িয়ে যায়? বরং বুকের ভেতর অমন ডাকতেই থাকুক। বিভুঁই জানে তার মা যেখানেই থাকুক না কেন, এই ডাক সে শুনতেই পাবে। বিভুঁই আচমকা উঠে হেমাঙ্গিনী দেবীকে বলেছিল, তুমি হরিহরণ দাদুর সাথে ফিরে যাও।
হেমাঙ্গিনী দেবী আঁৎকে উঠে বলেছিল, কি বলছিস তুই?
বিভুঁই হেসে বলেছিল, ঠিকই বলছি। এ বাড়ি ছেড়ে আমি আর কোথায়। যাবো? এ তো আমারই বাড়ি। এ বাড়ির রক্তই তো আমার শরীরে!
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেনি কেউই। কিছুক্ষণ থেমে বিভুঁই আবার বলেছিল, একখানা জিনিস খেয়াল করেছ মা?
হেমাঙ্গিনী দেবী মুখ তুলে বলেছিল, কী?
বিভুঁই বলল, জগত কী রহস্যময় দেখো? এই তোমরা দু’জন, তুমি আর হরি দাদু, কী নৃশংস উপায়েই না বিষ্ণুপুরে এলে। তারপর থেকে এই বিষ্ণুপুর, এই গঙ্গামহল একটু একটু করে তোমাদের শূন্য করে দিলো। তোমাদের জীবন ছেয়ে গেল দুর্ভাগ্যে, দুর্দশায়। আর আজ সে তোমাদের কল্পনার চেয়েও আশ্চর্য এক ঘটনায় এনে দাঁড় করিয়েছে!
হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী দু’জনই উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল বিভূঁইয়ের দিকে। বিভুঁই বলল, দেবেন্দ্রনারায়ণ নেই, অবনীন্দ্রনারায়ণও গৃহত্যাগী হয়েছেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ আর কখনো এখানে ফিরবেন বলে মনে হয় না। গঙ্গামহলের একমাত্র উত্তরাধিকার ছিল দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ, সে এখন মৃত। নেই দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র বীরেন্দ্রও। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হচ্ছে, গঙ্গামহলে এই মুহূর্তে যদি এ বাড়ির সত্যিকারের রক্ত কেউ থেকে থাকে, তবে সে আমি। এই অন্ধ বিভুঁই। সে ঠিকঠিক রয়ে গেল। এ বাড়িতে এখন কেবল আমার শরীরেই বইছে গঙ্গামহলের রক্ত! কী অদ্ভুত না!
হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী কেউ কোনো কথা বলল না। বিভুঁই হাসল। বলল, এই রক্ত নিয়েই তো সকল গর্ব, পরিচয়, ক্ষমতা। অথচ দেখো সেই রক্ত কি আশ্চর্য উপায়ে গঙ্গামহলের একমাত্র প্রবাহে এনে দাঁড় করিয়েছে সেই খুন। হওয়া শশীচরণ বণিক, আর সেই খুনী যোগেন্দ্রনারায়ণকে!
হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল বিভূঁইয়ের মুখের দিকে। বিশেষ করে হেমাঙ্গিনী দেবী। এই নতুন বিভূঁইকে আগে কখনো দেখেনি সে। নির্বাক নিস্পলক চোখে সে তাকিয়ে রইল বিভূঁইয়ের চোখে। তাকিয়ে রইল হরিহরণও। তাদের বুকের কোথাও কি কোনো দীর্ঘশ্বাসের হাওয়া বয়ে গেল! কিংবা অন্য কিছু?
.
বজরাখানা এগিয়ে চলেছে। ছোট বজরা। বজরায় যাত্রী কম। সর্বজয়া, সুদক্ষিণা, রেণুকা আর বীরেন্দ্র। মাঝি-মাল্লা কেউ না থাকলেও রতনকান্তি মাঝে মাঝেই চেষ্টা করছে বজরার যাত্রাপথ ঠিক করতে। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। একা একা এই বজরার হাল ধরা মুশকিল। তার ওপর গতকাল রাত থেকে আবার আকাশ ভারি হয়েছে। তুমুল বর্ষণ শুরু হয়েছে। নদীতে প্রবল ঢেউ। গত দু’দিন, দু’রাত ধরে তারা এই বজরায়, কিন্তু এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। তার কোথায়! তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে এদিকটাতে গঙ্গাবতী ফুঁসে উঠেছে অবিশ্বাস্যভাবে। যেন উন্মাদ হয়ে গেছে নদী। রাক্ষুসে ঢেউজুড়ে সর্বগ্রাসী খিদে যেন। মুহুর্মুহু পাড় ভেঙে এগুচ্ছে গঙ্গাবতী। তীরজুড়ে যা পাচ্ছে চোখের পলকে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে জলের গর্ভে। এ এক মহাতাণ্ডব!
রতনকান্তি আবারও ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেদিন খগেন এসে যখন রতনকান্তিকে বলল যে দ্বিজেন্দ্র’র নির্দেশানুযায়ী সর্বজয়াদের মহলের সকলকেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কাজে যেতে হবে। সাথে সাথেই রতনকান্তির মনে কুডাক ডেকে উঠেছিল। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটা সম্ভব চোখ রেখেছিল সর্বজয়াদের মহলে। সর্বজয়া যে জলের পাত্র নিয়ে বারকয়েক কুয়ো থেকে জল তুলে নিচ্ছে, তাও তার চোখ এড়ায়নি। পুরো বিষয়টা নিয়েই রতনকান্তির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে। তবে সতর্ক চোখে কান খাড়া করে সকলই খেয়াল করার চেষ্টা করছিল। দ্বিজেন্দ্রর ঘটনার সময় অবশ্য অন্য একটা কাজে তাকে বিশেষ ব্যস্ত করে রেখেছিল ব্রজগোপাল। তবে তাতেও মুহূর্তের জন্যও শিথিল হয়নি তার সতর্ক দৃষ্টি। চারপাশের এত কোলাহলেও সে উৎকর্ণ হয়েছিল। সে কারণেই কিনা কে জানে, দ্বিজেন্দ্র’র চিৎকার সামান্য হলেও তার কানে বেজেছিল। কিন্তু তখনই করণীয় কিছুই সে খুঁজে পায়নি। আর পুরোপুরি নিশ্চিতও ছিল না। ফলে কাজ থেকে খানিক ছাড়া পেয়েই রতনকান্তি ছুটে আসছিল সর্বজয়াদের মহলে।
নিচতলার ঘরে ঢুকতেই রতনকান্তি মুখোমুখি পড়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসতে থাকা সর্বজয়াদের। রতনকান্তিকে খুব বেশি কিছু খুলে বলতে হয়নি সর্বজয়ার। সে কৌশলে পেছনের ফটক দিয়ে সর্বজয়াদের বের করে দিয়ে ছুটে গেল খাবার ঘরে। যতটা সম্ভব বেশি করে খাবার ভরে নিল। দু’খানা মস্ত থলেতে। তারপর খুব জরুরি কাজে ব্যস্ত এমন ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসল গঙ্গামহল থেকে। তার ভাগ্য ভালো, মাঝি-মাল্লাবিহীন একখানা ফাঁকা বজরাও বাঁধা ছিল ঘাটে। এত মানুষের ভিড়ে কেউ খেয়ালও করেনি, কার বজরা কে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! রতনকান্তি ভাবেনি, এমন একখানা সুযোগ সে পেয়ে যাবে। তারপরও সর্বজয়াকে গঙ্গাবতীর তীর ধরে পূবের দিকে এগুতে বলেছিল সে। তা সর্বজয়া করেও ছিল তাই। তাদের খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি রতনকান্তির।
কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে, রতনকান্তির পক্ষে এই বজরাখানা এমন প্রবল স্রোতে একা একা নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব। ফলে সকল কিছুই ভাগ্যের হাতে। সঁপে দিয়ে বসে আছে রতনকান্তি। সর্বজয়া বসে রয়েছে বজরার ভেতরে। সে খানিক আগে বাইরে এসে উঁকি দিয়ে দেখে গেছে। রতনকান্তির একবার মনে হলো সর্বজয়া তাকে দেখতেই বজরার বাইরে এসেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হলো, তার ধারণা ঠিক নয়। সর্বজয়া বজরার বাইরের অবস্থা দেখতে চেয়েছিল। রতনকান্তি কিছুক্ষণের জন্য হলেও সর্বজয়ার চোখে তাকিয়েছিল। কিন্তু তার হঠাৎ মনে হলো, এই ক’দিন আগেও যে সর্বজয়ার চোখের ভাষা সে পাঠ করতে পারত অতি সহজেই, এই সর্বজয়া সে নয়। এই সর্বজয়া সেই ক্ষ্যাপাটে, বেপরোয়া সর্বজয়া। যার ভেতর প্রবলভাবেই স্পষ্ট হয়েছিলেন তার বাবা দেবেন্দ্রনারায়ণ। এই সর্বজয়ার চোখের ভাষা সে পাঠ করতে জানে না। এই সর্বজয়াও এই নদীর মতোন, ইচ্ছে হলে প্রমত্তা হয়ে দু-কূল ভাসিয়ে নেয়, আবার ইচ্ছে হলেই শান্ত-স্নিগ্ধ জলে মৃদু হাওয়ার মতো দুলে ওঠে। এই সর্বজয়াকে ধারণ করবার ক্ষমতা কী তার রয়েছে? রতনকান্তি জানে না। এই জীবনে মানুষ আসলে কিছুই জানে না। আর জানে না বলেই সে বেঁচে থাকে। সেই বেঁচে থাকা জুড়ে থাকে আগামী। সেই আগামীজুড়ে থাকে স্বপ্ন। রতনকান্তি বজরার গলুইয়ে বসে প্রবল বৃষ্টিপাতের ভেতর ভিজে যাচ্ছে। সে জানে না, এই বজরা কোথায় যাচ্ছে, কোথায় গিয়ে থামবে। সেই অনিশ্চিত গন্তব্যের বজরাখানাকে তার হঠাৎ নিজের জীবন বলে মনে হতে লাগল। কিন্তু সেই জীবনে সর্বজয়াও রয়েছে। প্রবল বৃষ্টিপাতে সেই সর্বজয়াকে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। সে হয়ে আছে আবছা। বৃষ্টির তোড় ক্রমশই বাড়ছে। সর্বজয়াও আবছা হয়ে আসছে আরো। রতনকান্তি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে। দূরে ক্রমশই আরো আবছা হতে যাওয়া সর্বজয়াকে দেখে রতনকান্তির মনে হলো, যতই আবছা হয়ে যাচ্ছে সর্বজয়ার অস্তিত্ব, ততই তার উপস্থিতি রতনকান্তির কাছে হয়ে উঠছে আরো তীব্র। আরো স্পষ্ট। জীবনের এ কী অদ্ভুত খেলা!
রতনকান্তি বজরার সামনে চোখ ফেরাল। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল জল আর জল। কোথায় ভেসে যাচ্ছে এই বজরা? নাকি জীবন? জীবন কিংবা বজরা ভেসে চলছে অনিশ্চিত গন্তব্যে।
.
প্রবল বর্ষণ থামার কোনো লক্ষণ নেই। যেন সত্যি সত্যি মহাপ্রলয় নেমে আসছে। যে সকল উঁচু স্থানে কখনো কোনো বড় বন্যায়ও জল উঠেনি। সে সকল জায়গাও জলে ডুবে গেছে। গঙ্গামহলের ভেতরে এখনও জল না উঠলেও সিংহদরজা অবধি পৌঁছে গেছে জল। বীণাবালা মাঝখানে খানিকটা ধাতস্থ হয়েই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিভূতিনাথ সাহা সারাক্ষণ নির্বাক বসে আছেন তার পাশে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, সর্বজয়া রেণুকাদের খুঁজে বের করা নিয়ে কারো ভেতরে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ হতে পারে বীণাবালার এই অবস্থা। আবার এই দুর্যোগপূর্ণ ভয়ংকর আবহাওয়াও একটি কারণ। সর্বজয়া যে এভাবে দ্বিজেন্দ্রকে খুন করেছে, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল বিভূতিনাথের। কিন্তু যখন জানা গেল মাঝমহলে কেউ নেই, নেই সুদক্ষিণার গানের মাস্টারও, তখন আর কোনো সন্দেহ রইল না কারো। বীণাবালা বার দুই জেগে উঠেছিলেন, কিন্তু তিনি জেগে ওঠার চেয়ে আর জেগে না ওঠাই ভালো। তিনি জাগলেই সাথে সাথেই নিজের মাথা চেপে ধরে চিৎকার করতে থাকেন। তারপর সেই মাথা পালঙ্কে বা দেয়ালে ক্রমাগত ঠুকতে থাকেন। মাথা ফেটে রক্ত না বের হওয়া অবধি তিনি থামেন না।
.
এই ভারী বর্ষণের কারণে বারোহাটি বাগানবাড়িতে একজন মানুষ মারা গিয়েছে। কিন্তু সেই মানুষটির মৃত্যুর খবর কেউ জানে না। মানুষটির নাম সনাতন মিস্ত্রি। সে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে খুঁড়তে অবশেষে পাতাল ঘরের দরজা অবধি প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। প্রবল বর্ষণে নরম হয়ে যাওয়া মাটি ধ্বসে গিয়ে তাকে সহ সুড়ঙ্গখানা আটকে দিলো। সনাতন মিস্ত্রির জীবন্ত কবর হলো বারোহাটি বাগানবাড়িতেই।
*
দ্বিজেন্দ্র খুন হবার সতের দিনের মাথায় মারা গেল হেমাঙ্গিনী দেবী। তাকে ঘুমের ঘোরে সাপে কেটেছিল। প্রবল বর্ষণে চারধারে জল উঠে গেলে আর টিকতে না পেরে বিষধর সেই সাপ এসে বাসা বেঁধেছিল হরিহরণের ঘরে। রাতে ঘুমের ঘোরে সেই সাপের উপর পা ফেলেছিল হেমাঙ্গিনী দেবী। হরিহরণ কী কাজে আটকে গিয়েছিল, সেই রাতে আর ঘরে ফিরতে পারেনি সে। ফিরেছিল পরদিন সন্ধ্যায়। ততক্ষণে হেমাঙ্গিনী দেবীর লাশ গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। হরিহরণ তবুও সেই লাশের পাশে সারারাত বসে রইল। তার মনে হচ্ছিল হেমাঙ্গিনী দেবী ঘুমাচ্ছে, সে এক্ষুনি জেগে উঠে বলবে, হরি কাকা, আমায় বিভূঁইর কাছে নিয়ে চলো। আমি বিভূঁইয়ের কাছে যাব।
সেই রাতে সত্যিকারের প্রলয় নেমে এলো যেন পৃথিবীতে। সারারাত নির্মম তাণ্ডব চালাল ঝড়, বৃষ্টি, নদী। বিভূঁইকে তার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দিতে পরদিন ভোরে গঙ্গামহলের দিকে যাত্রা করল হরিহরণ। সে গঙ্গামহলের কাছাকাছি পৌঁছাল সন্ধ্যার খানিক আগে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে হরিহরণের মনে হলো সে পথ ভুল করে অন্য কোথাও চলে এসেছে। প্রবল ঝড়বৃষ্টির রাতে মৃত হেমাঙ্গিনীকে নিয়ে সারারাত নির্ঘম জেগে ছিল সে। তারপর এতটা পথ হেঁটে এসেছে বলেই হয়তো তার কোথাও ভুল হয়েছে। সে হয়তো পথভুল করে অন্য কোথাও চলে এসেছে। কারণ সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে গঙ্গামহল বলতে কিছুই নেই। কোনো দিন ছিল বলেও মনে হচ্ছে না। দিকভ্রান্ত হরিহরণ অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আবার ঘুরে হাঁটা দিল। তার মাথায় কিছু হয়েছে। সে এই দিনে-দুপুরে গঙ্গামহলের পথ ভুলে করে ফেলেছে! এ তো ভারি চিন্তার বিষয়! হরিহরণকে গঙ্গামহলের পথ খুঁজে বের করতেই হবে। হেমাঙ্গিনী দেবী বা বিভুঁই নয়, এটিই এখন তার একমাত্র চিন্তা।
.
হেমাঙ্গিনী দেবী যে রাতে মারা গেল, সে রাতে গঙ্গামহলের পশ্চিমদিকের সীমানা প্রাচীর ভেঙে পড়ল গঙ্গাবতীর বুকে। বিশাল দানবের মতোন হা করে ধেয়ে আসতে লাগল এতদিনের শান্তশিষ্ট গঙ্গাবতী। ভোর অবধি সাক্ষাৎ উন্মাদ হয়ে গেল সে। বড় বড় ঢেউ দৈত্যের মতোন আছড়ে পড়তে লাগল গঙ্গামহলে। সেই রাত আর পরদিন দুপুর অবধি গঙ্গামহলের পশ্চিমদিকের এক তৃতীয়াংশ উধাও হয়ে গেল গঙ্গাবতীর গর্ভে। কিন্তু গঙ্গাবতীর খিদে তাতে কিছু কমেছে বলে মনে হলো না। সে আরো উন্মত্ত হয়ে উঠল। সেইদিন সন্ধ্যার মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল গঙ্গামহল। যে যার মতো উধ্বশ্বাসে পালাতে লাগল গঙ্গামহল ছেড়ে। বিভূতিনাথ সাহা বীণাবালা আর গায়ত্রীকে নিয়ে এক কাপড়ে মহল ছাড়লেন। গঙ্গামহলের যা যেমন ছিল, তার সকলই পড়ে রইল তেমনই।
বীণাবালা মাঝে মাঝে চোখ মেলে চাইছেন, আর গগনবিদারী আর্তচিৎকারে কেঁদে উঠছেন। হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তা দিয়ে মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করছেন। আর চিৎকার করে বলছেন, তোমরা কেউ আমার মাথাখানা ফাটিয়ে দাও। আমি আর কিছু চাই না। কিছু না। আমার মাথাখানা শুধু ফাটিয়ে দাও। আমি কিছু চাই না। কিছু চাই না। আমার মাথাখানা তোমরা ফাটিয়ে দাও।
তার এই কথা কেউ শোনে না। তিনি এখন যাকেই কাছে পান, তার হাত কামড়ে দেন। শরীর কামড়ে দেন। তার হাতের নখ বড় হয়েছে, তিনি সেই নখে খামচে দেন। বীণাবালা আর মানুষ নেই যেন। তিনি যেন হিংস্র কোনো জন্তুতে পরিণত হয়েছেন। আজকাল বিভূতিনাথ সাহাও বীণাবালাকে ভয় পান। ইদানীং তার মনে হয় এই বীণাবালাই আসলে সত্যিকারের বীণাবালা। এতদিন তিনি দেখতে পাননি। তিনি দেখতে পাননি বলেই বীণাবালা তার স্বমূর্তি ধারণ করেছেন। বিভূতিনাথ সাহা বীণাবালাকে রেখে এলেন তার পিত্রালয় দিঘাগড় জমিদার বাড়িতে। সেখানে বীণাবালাকে সারাক্ষণ শেকলবন্দী করে রাখা হয়। তার ওপর ঘরের দরজায় তালা মেরে রাখা হয়। তারপরও ভোর থেকে মাঝরাত অবধি বীণাবালার তীব্র চিৎকারে আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে।
.
যে রাতে বিভূতিনাথ সাহা বীণাবালাকে নিয়ে গঙ্গামহল ছেড়ে গেলেন। সে রাতে পুরো ফাঁকা হয়ে গেল গঙ্গামহল। ভৃত্য দাসীরাও যে যার মতো করে পালাল গঙ্গামহল ছেড়ে। রাতজুড়েও কমলা দাসীর ঘর থেকে মৃদু গোঙানি ভেসে আসছিল। কিন্তু ভোর হতে সেই গোঙানিটুকুও আর শোনা গেল না। অবশ্য তার কি হয়েছে, সে কি বেঁচে আছে না মরে গেছে, এই খবরটুকু নেয়ার আগ্রহও কারো মধ্যে দেখা গেল না। সকলেই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। মহাপ্রলয় যেন সমাগত। অসংখ্য মানুষের পদচারণায় মুখরিত, আলো ঝলমলে সেই গঙ্গামহল মুহূর্তেই হয়ে গেল নিরব নিস্তব্ধ এক মৃত বাড়ি।
কেবল বৃদ্ধ খগেন বসে রইল বিভূঁইয়ের ঘরের সামনে। খগেনের প্রবল জ্বর। নড়ার শক্তি অবধি নেই। কোথায় যাবে সে? এই প্রবল ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছাসের ভেতর কই গিয়ে উঠবে খগেন? জগতে তার আপন বলে তো কেউ নেই। যা ছিল তার সবটাই এই গঙ্গামহল। এ বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার নেই তার। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইল।
তবে বিভুঁই ভীষণ চিন্তিত। তার কোলভর্তি তিনটে বেড়ালের বাচ্চা। দিনকয় আগে বাচ্চাগুলো হয়েছে। কিন্তু বাচ্চারা কোনো এক কারণে প্রচণ্ড ভীত। তাছাড়া তাদের খাবার-দাবারও নেই। তাদের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে ইটের ফাঁকে চড়ই দম্পতিরও ডিম ফুটেছে। সেই ডিম ফোঁটা বাচ্চারাও সারাক্ষণ ট্যাঁও ট্যাঁও করছে। বিভুঁই সেই বাচ্চাদের বাইরে থেকে ঘরে আনতে পারছে না। তার ধারণা বাচ্চাগুলো ঘরে আনার সাথে সাথে বেড়াল ছানাগুলো তাদের উপর হামলে পড়ে তাদের খিদে নিবারণ করবে। এই ভয়ে সে কিছুই করতে পারছে না। সে বারকয় খগেনকে ডেকে বলেছিল আশেপাশে কোনো খাবারের ব্যবস্থা আছে কিনা, তা খুঁজে দেখতে। কিন্তু খগেন বিভূঁইয়ের কথায় কোনো গা করেনি। যদিও আজকাল নানা কারণে বিভূঁইকে খানিকটা ভয় পায় খগেন, সমীহও করে। শুধু তাই-ই নয়, বিভূঁইয়ের প্রতি সামান্য মমতাও অনুভব করা শুরু করেছে সে। তার ধারণা বিভুঁইয়ের আলাদা কোনো ক্ষমতা আছে। সম্ভবত এই কারণেই সে এই ভয়াবহ দুর্যোগেও বিভূঁইয়ের কাছে বসে আছে। সে হয়তো ভাবছে, বিভুঁই তার সেই ক্ষমতাবলে অন্তত দেবেন্দ্রনারায়ণের এই মাঝমহলকে গঙ্গাবতীর রুদ্রমূর্তি থেকে রক্ষা করবে।
কিন্তু খগেনের ধারণা সত্যি হলো না। পরদিন ভোর নাগাদ গঙ্গামহলের প্রায় অর্ধেকটাই গিলে নিল উন্মাতাল গঙ্গাবতী। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে গঙ্গামহলের সামনের শান-বাঁধানো ঘাট থেকে শুরু করে সিংহদরজা আর তার দেয়ালের খানিকটা অংশ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। তবে বেশিক্ষণ যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না তা বোঝা যাচ্ছে। ঢেউ আছড়ে পড়ছে সর্বশক্তিতে। দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো। শেষ অবধি ওই জ্বর শরীর নিয়েই বেরিয়ে গেল খগেন। অবাক ব্যাপার হচ্ছে খানিক বাদে কোথা থেকে একখানা বড়সড় নাও জোগাড় করে নিয়ে এলো সে। উঠোনে হাঁটু অবধি জল জমেছে। সেই জলে ভাসিয়ে নাওখানা টেনে এনেছে খগেন।
বিভুঁই খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, আগে দেখো তো, জানালার বাইরে চড়ই ছানাদের কী অবস্থা?
খগেন কোনো কথা বলল না। তবে চড়ই ছানাদের অবস্থা দেখতে সে জানালার বাইরে উঁকি দিল। তার খানিক বাদে দেখা গেল বিভুঁই আর খগেন নাওখানাতে বসে রয়েছে। বিভূঁইয়ের কোলের ভেতর জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে। তিনটি বেড়াল আর দু’টি চড়ইছানা। চড়ই ছানাগুলো বেড়াল ছানাদের লোমের ভেতর মাথা ডুবিয়ে ওম নিচ্ছে। বিভূঁইয়ের মাথার উপর চক্রাকারে উড়ছে চড়ই দম্পতি। নাওখানা ঢেউয়ের বুকে তুলোর মতো ভেসে যাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় উল্টে যাবে এই নাও। তবে নাও ওল্টানো নিয়ে খগেন বা বিভুঁই যতটা চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে বিভূঁইয়ের মাথার উপর চক্রাকারে উড়তে থাকা চড়ুই দম্পতিকে।
.
প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় উন্মাতাল ঢেউ উঠছে গঙ্গাবতীতে। সেই ঢেউ দেখে খগেনের বুকের ভেতর হিম হয়ে এলো। সে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ঢেউয়ের দিকে। বিশাল দৈত্যের মতো বড় একখানা ঢেউ ছুটে আসল। সেই ঢেউ কাঁপিয়ে দিল গঙ্গামহলের সিংহদরজা। পরের ঢেউটি এসে যেন সাপের মতোন ছোবল মারল। সেই ভয়ঙ্কর ছোবলে সিংহদরজাটি সমূলে উপড়ে পড়ল বিক্ষুব্ধ গঙ্গাবতীর উত্তাল বুকে। তার পাশের দেয়ালটুকুও প্রায় ভেঙে পড়ছে। দীর্ঘদিনের রোদ-বৃষ্টিতে আবছা হয়ে ছিল দেয়ালখানা। এক ভরা পূর্ণিমায় সিদ্ধার্থের মতোন গৃহত্যাগী অবনীন্দ্রনারায়ণ সেই দেয়ালে কী যেন লিখে রেখে গিয়েছিলেন। সেই লেখাটুকুও এতদিনে আবছা হয়ে গিয়েছিল। দেয়ালখানা ঝুপ করে উল্টে পড়ল জলে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, অন্ধ বিভুঁই সেই ডুবে যেতে থাকা দেয়ালখানার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। কে জানে, অন্ধ বিভুঁই কিছু দেখতে পায় কিনা! হয়তো পায়, হয়তো পায় না। তবে সেই ডুবে যেতে থাকা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বিভূঁইয়ের মুখে লেগে রইল অদ্ভুত রহস্যময় একটুকরো হাসি। সেই হাসির অর্থ কী কে জানে!
হয়তো ওই দেয়ালে নয়, হয়তো অন্য কোথাও বিভুঁই ওই লেখাটুকু ঠিকই পড়েছিল। ওই লেখাটুকু যে লেখা রয়েছে জগতের পাঠযোগ্য সকল দেয়ালে। সেই পাঠযোগ্য দেয়ালের নাম হতে পারে জীবন। কিন্তু সেই জীবন পাঠ করতে জানতে হয়। হতে পারে বিভুঁই সেই জীবন পাঠ করতে জেনেছিল, জেনেছিলেন অবনীন্দ্রনারায়ণও। আর জেনেছিলেন বলেই লিখে রেখে গিয়েছিলেন লোভ আর লালসার অমিত আঁধার গঙ্গামহলের দেয়ালে। কিন্তু সেই দেয়ালের লেখা পড়বার মানুষ কই? সেই বোধ ধারণ করবার মানুষ কই? নেই বলেই হয়তো। অবনীন্দ্রনারায়ণের জীবনের অমোঘ সত্যটুকু নিয়ে গঙ্গামহল ডুবে গেল জলে। হয়তো তারপরও ওই সত্যটুকু বোধ হয়ে ভেসে বেড়ায় মানুষের বুকের ভেতর। আর অপেক্ষায় থাকে পঠিত হবার। উপলব্ধি হয়ে ভেসে থাকে বুকের ভেতরের গভীর অন্দরমহলে। আর চায় সেই মানবমনের অন্দরমহল কেউ পাঠ করুক।
যে অন্দরমহলের দেয়ালে দেয়ালে লেখা থাকে শাশ্বত অনির্বাণ এক সত্য, আমাদের কিছুই নেই, অথচ সবটা সময়জুড়ে ভাবি, এই বুঝি নিঃস্ব হলাম!