০৯.
ঘোলাটে মেঘলা-মেঘলা আকাশ দেখে বোঝা যায়নি ঝপ করে অমন বৃষ্টি নামতে পারে। একটা দিন সন্ধে থেকে ঘণ্টা-দুই মোটামুটি বৃষ্টি হয়ে গেল। কলকাতার রাস্তাঘাটে কোথাও-কোথাও যদিবা জল দাঁড়িয়ে থাকে, পরের দিন আবার সব শুকনো।
বিকেলবেলা তারাপদ এল অফিস ফেরত। কিকিরা বাড়ি নেই।
সামান্য পরে এল জগন্নাথ। কথা ছিল আমার। তারাপদর সঙ্গেই আসতে পারত সে, পারেনি অন্য একটা কাজে আটকে গিয়ে।
তারাপদ আর জগন্নাথ বসেবসে গল্পগুজব করছে, চা খাচ্ছে, এমন সময় কিকিরা এলেন। হাতে একটা মোটা প্যাকেট।
“গিয়েছিলেন কোথায়?” তারাপদ বলল।
“আজ একটু শীত শীত লাগছে! ম্যালারু হবে নাকি হে?” প্যাকেটটা রাখতে রাখতে কিকিরা বললেন, “ছেলেবেলায় যদি মাকে বলতাম, মা আমার শীতশীত করছে, সঙ্গে-সঙ্গে মা বলতেন, তোর কম্পজ্বর হবে। আমাদের ওদিকে কম্পজ্বরটা ভালই হত। কত যে কুইনিন মিকশচার খেয়েছি তারাপদ, খেয়ে-খেয়ে লিভারটাই নষ্ট হয়ে গেছে।”
তারাপদ ঠাট্টার গলায় বলল, “আপনাকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়। যা বলছিলুম, গিয়েছিলেন কোথায়?”
নিজের জায়গায় বসতে বসতে কিকিরা বললেন, “দরজির কাছে।”
“দরজি?”
“আফজল খলিফা। আমার পেয়ারের দরজি।…তা জগন্নাথবাবু, তুমি কেমন আছ?”
“একরকম।“
“যা যা বলেছিলাম করেছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার কথা মতন পরের দিনই চিঠি লিখে দিয়েছি।”
“জবাব পাওনি?”
“না।”
“পেয়ে যাবে। আজ মাত্র বৃহস্পতিবার। এখনও দু’দিন আছে। শনিবারের মধ্যে জবাব পেয়ে যাবে। রবিবার আমাদের যাত্রা।”
“যদি না পাই?”
“পাবে। আমি আন্দাজ করছি পাবে। তোমার কাছে তো আগের চিঠিও রয়েছে।”
কিকিরার জন্যে চা এল। বোধ হয় তৈরি করাই ছিল আগে থেকে।
চা খেতে-খেতে কিকিরা তারাপদকে বললেন, “এই প্যাকেটটা খোলো হে। তারাপদ।”
তারাপদ উঠে গিয়ে প্যাকেটটা নিল। খুলল। ভেতরের জিনিসগুলো বার করতে করতে বলল, “এ-সব কী?”।
“কালো আলখাল্লা। তিনটে আছে।”
“কী হবে এগুলো দিয়ে?”
“আমরা পরব। ওয়ান ফর মি, ওয়ান ফর ইউ, তিন নম্বরটা স্যান্ডেল উডের জন্যে।…তুমি একটা ট্রাই করো।”
তারাপদ বলল, “প্রেতসিদ্ধর কালো আলখাল্লা!”
“ইয়েস।”
তারাপদ আলখাল্লা গায়ে গলাল। মাথা ঢাকল। বলল, “কিকিরা এ যে ভূতের মতন দেখাচ্ছে।”
“তাই দেখাবে। ভূতের নাচ নাচতে হলে কি ঝলমলে পোশাক পরতে হবে। “
তারাপদ ঘরের মধ্যে ঘুরেফিরে নিজের পোশাক দেখতে দেখতে বলল, “কিন্তু স্যার, প্রেতসিদ্ধ যদি..”
কিকিরা বুড়ো আঙুল দেখালেন। বললেন, “ছাঁটকাট কোথাও কোনো অদলবদল নেই। যেমনটি চুরি করে এনেছিলাম–অবিকল তেমনটি। দেখো না তুমি, অরিজিনালটাও রয়েছে। শেষেরটা।”
তারাপদ বলল, “স্যার, ওদের যদি হিসেব থাকে! ধরুন গুনতি করে রেখে দিয়েছে। একটা শর্ট দেখে যদি…”
“না রে বাবা না, অত হিসেব না ওদের। আর থাকলেও আমার কী! আমি কি চোর? বিভুপদ হাঁস। ষষ্ঠীপদ হাঁসের ছেলে। টাকা-পয়সায় আমার ছাতা পড়ছে।”
তারাপদ বলল, “ ঠিক।”
কিকিরা জগন্নাথের দিকে তাকালেন। বললেন, “রবিবার তুমি অবশ্যই যাবে। তারাপদ তোমাকে নিয়ে যাবে বাড়ি থেকে। গলির মুখে ছেড়ে দেবে। তারপর তুমি একলা।”
“আমি কী করব?”
“কিছুই করবে না। ওরা যা-যা করতে বলবে করবে। ওরা তোমাকে এইরকম কালো আলখাল্লা পরতে বলবে। পরবে। হাত ধুতে বলবে গঙ্গাজলে। ধোবে। তোমাকে আত্মা-নামানোর ঘরে নিয়ে বসিয়ে রাখবে। বসবে। ভয় পাবে না। ঘাবড়াবে না। বরং প্রেতসিদ্ধর গায়ে লুটিয়ে পড়তে পারো এমন ভাব করবে।”
তারাপদ বলল, “কিন্তু কিকিরা, আপনাকে আর জগুদাকে যদি একসঙ্গে না। ডাকে। আলাদা-আলাদা করে তলব করে?”
“করতে পারে। আবার না-ও করতে পারে। জোয়ারদারসাহেব যা। বললেন, তাতে তো শুনলাম, সব মক্কেলই একসঙ্গে ডাক পায়। স্পেশ্যাল। কেস হলে আলাদা। জেনারেল কেস হলে একই সঙ্গে সিটিং। তাতে জমে ভাল। একই খেলা দুবার খেলতে হয় না। যারা থাকে তারা একেবারে স্পিক্-টি-নট, চক্ষু ছানাবড়া। প্রেতসিদ্ধর নাম ছড়িয়ে যায়।…তবে হ্যাঁ, অনেকে তো ঘরের কথা অন্যকে শোনাতে চায় না। সেগুলো স্পেশ্যাল কেস। ভিজিটও বেশি।”
“জগুদার তো স্পেশ্যাল কেস হবে।”
“মনে হয় তাই।..আমিও স্পেশ্যাল চেয়েছি।…তবে শুদ্ধানন্দর কথা থেকে মনে হল, রবিবার উনি এক মতলব ভেঁজে রেখেছেন। জানি না, জগন্নাথের চিঠি পেয়ে ব্যবস্থা করে রাখছেন কি না। আমি একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে ওই দিনটাই নিলাম।”
জগন্নাথ বলল, “আমায় যদি কিছু করে?”
“কী করবে! ওর ক্ষমতা কী!…আমি তো থাকব।… তারাপদরাও থাকবে কাছাকাছি। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?”
তারাপদ আলখাল্লা খুলে ফেলল। “স্যার!”
“বলো?”
“চাঁদু বলছিল দু-চারটা হাড় ও সাপ্লাই করতে পারে। হাড় দিয়ে পেটালে যা লাগে।”
“একটা খুলি থাকলে ভাল হত। দরকার নেই।”
“আমাদের আরও একটু লোকবল হলে ভাল হত না?”
“যা আছি এতেই হবে।”
চা খাওয়া শেষ হল।
জগন্নাথ যেন কী বলব বলব করছিল, বলতে পারছিল না। শেষে অনেক কষ্টে বলল, “আমি কি সত্যি আমার মায়ের গলা শুনতে পাব?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। “না’। ওটা অসম্ভব জগন্নাথ!”
“তবে যে লোকে বলে…।”
“লোকে অনেক কথাই বলে।…তবে কী জানো, অনেক সময় আমাদের মনের ভুল হয়, কানের ভুল হয়। কেউ আমাকে ডাকল না, হঠাৎ মনে হল, আমায় কেউ ডাকছে। দরজায় কড়া নড়ল না, অথচ মনে হল, কেউ যেন কড়া নাড়ছে। এগুলো হয় মনের ভুলে।”
“আমাদের বাড়িতে আমরা মাত্র দুটো ঘর পেয়েছিলাম,” জগন্নাথ বলল, “বারান্দার একপাশে আমাদের রান্নাঘর। কলঘর নিচে। মায়ের ঘরেই মা ঠাকুর পুজো করতেন। আমার মা সকাল-সন্ধে পুজোআচা করতেন। একটা ঠাকুর ঘরও ছিল না আমাদের। আমি সব তন্নতন্ন করে দেখেছি। কোথাও কিছু পাইনি। আপনি বিশ্বাস করুন।”
কিকিরা বললেন, “তোমার কথা অবিশ্বাস করব কেন জগন্নাথ! …আমি দু’-চারটে দোকানেও খোঁজ করেছি, তোমার বাবা যেখানে আসা-যাওয়া করতেন। আমায় তো কেউ মন্দ কথা বলেনি। শুধু একজন, তাকে আমার ভাল লাগেনি।”।
“কে?”
“ত্রিদিবেশবাবু! ওরিয়েন্টাল জুয়েলারি।”
জগন্নাথ অবাক হয়ে বলল, “ত্রিদিবেশবাবু! এ নাম আমি কখনও শুনিনি।”
কিকিরা বললেন, “ভালই করেছ। …যাকগে, আর মাত্র দুটো দিন, তারপর বোঝা যাবে কল্পবৃক্ষ তোমাকে কী দেন।”