৯. কুমারহট্ট
গঙ্গার ওপারে, কাঞ্চনপল্লীর দক্ষিণে কুমারহট্ট। ইদানীং নাম হয়েছে : হালিশহর। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ (রচনাকাল আঃ 1598-1606) হালিশহর নামটি আছে। অর্থাৎ আকবরের জমানাতেই নামটি প্রচলিত। কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেব যে গ্রামের ধুলিমুষ্টি তাঁর উত্তরীয়প্রান্তে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন, বৈষ্ণব সাহিত্যে দেখছি তার নাম : কুমারহট্ট।
অবাক হয়ে যাচ্ছ, তাই নয়? যে প্রেমের ঠাকুরের চরণধূলি লাভের জন্য পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের মহারাজ প্রতাপরুদ্র থেকে জ্ঞানসাগর বাসুদেব সার্বভৌম পর্যন্ত লালায়িত, তিনি কেন হঠাৎ এ গাঁয়ের একমুঠি ধুলি কুড়িয়ে নেবেন? কারণ আছে।
হালিশহরে যদি যাও তাহলে জিজ্ঞেস্ কর : ‘হ্যাঁ গো, চৈতন্য ডোবাটা কোন বাগে?’
না, না, রিকশা-আলা বা ডেলি-প্যাসেঞ্জার নয়, তারা কিছু জানে না—ঐ যে পড়ো দাওয়ায় তিন-মাথাওয়ালা থুত্থুরে বুড়োটা বসে বসে কাশছে—নাকে রসকলি, গলায় কণ্ঠী, ওরে শুধিয়ে দেখ। শুকনো আমসির মতো আঙুলটা তুলে লোকটা বলবে : ঐ হোথা।
পুরাতন পুষ্করিণী। বাস্তবে ডোবা। সর্বাঙ্গে কচুরিপানার নামাবলী। সেটা আছে তো? প্রভু নিত্যানন্দই জানেন! অন্তত আমাদের বাল্যকালে ছিল। এখন হয়তো ডোবাটার বিক্রি-কোবালা হয়ে গেছে। ডোবা ভরিয়ে, পিন পুঁতে, কেউ নয়া-মোকাম বানিয়েছে। সেকালে একটা মঠ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা শুনেছিলাম, মনে হচ্ছে মঠে গৌর-নিতাই-এর যুগল-মূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও ছিল। সেটা বাস্তবায়িত হয়েছিল কিনা জানা হয়নি। হালিশহরবাসী কোন পাঠিকা-পাঠক যদি, ৺গোবিন্দের ইচ্ছেয়, আমাকে জানান, কৃতার্থ হব।
ঐ ডোবাটা পড়েছিল একটা খড়ো-ঘরের চরণ আঁকড়ে। সেই পর্ণকুটীরে এককালে বাস করতেন মহাত্মা ঈশ্বর পুরী। শ্রীচৈতন্যদেবের দীক্ষাগুরু। আর তাতেই ঐ উত্তরীয় প্রান্তে পদরেণু-সংগ্রহের আকূতি!
শ্রীচৈতন্যের আশীর্বাদধন্য শ্রীবাস পণ্ডিতের ভদ্রাসনও এই কুমারহট্ট।
আরও তিনজন ভক্ত কীর্তনীয়ার নাম সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি : বাসুদেব ঘোষ আর তাঁর দুই ভ্রাতা—মাধব ও গোবিন্দানন্দ।
আমাদের কাহিনীর কালে—অষ্টাদশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে—হালিশহরবাসী দুই প্রখ্যাত ব্যক্তি—রামপ্রসাদ সেন ও আজু গোঁসাই। দুজনেই পদকর্তা, একজন শ্যামাভক্ত, একজন শ্যামভক্ত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রায়ই হালিশহরের অস্থায়ী আবাসে এসে দুই পাগলকে নাচিয়ে মজা দেখতেন—‘চাপান-উতোরের’ গান শুনতেন।
রামপ্রসাদ সেন (আঃ 1720-81) :
গল্পটা শুরু করি খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল-মশায়ের দফতরখানায়।
কী বললে? ‘গোকুল ঘোষাল, না দুগ্গা মিত্তির?
এই তোমাদের দোষ! গপ্পো শুনতে চেয়েছ, শোন না বাপু। সব কথায় টিক্টিক্ করা কেন? ক্রমাগত খালি : ‘দক্ষিণরায়? দক্ষিণরায়?’
বেশ, ফস্ করে যখন প্রশ্নটা পেশ করেই বসেছ তখন বলি—
ঈশ্বর গুপ্তের মতে (সংবাদ প্রভাকর, ১২৬০ বঃ) ঘটনাটা ঘটে খিদিরপুরের গোকুল ঘোষাল অথবা কলকাতার দুর্গাচরণ মিত্রের ভদ্রাসনে। হরিমোহন সেনের বিশ্বাস (বিবিধার্থ সংগ্রহ, ১৭৭৩ শক, ফাল্গুন) ঘটনাটা কৃষ্ণনগরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দফতরখানায়। আবার কেউ কেউ বলেন, ঘটনাস্থল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ঠিকেদার কেষ্টমল্লিকের ডেরা। অন্য এক মতে : চুঁচুড়ায় শীলেদের বাড়ি। তা সঠিক তথ্য জানতে হলে আমার কাছে কেন বাপু? অসিত বাঁড়ুজ্জে-মশায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ ঘাঁটতে থাক। তথ্যের লক্ষ্মণগণ্ডীর তো চারটি চৌহদ্দী—ধনাঢ্যব্যক্তি যেই হন তিনি ছিলেন সহৃদয়, গুণগ্রাহী, ঈশ্বরভক্ত আর সমঝদার। নাম যাই হোক না, দেখ, আমি সেই লক্ষ্মণের গণ্ডীর বাইরে পা দেব না।
যাক, যে-কথা বলছিলাম :
হরিহর আঢ্য-মশাই দফতরে এসেই সুসংবাদটি পেলেন—জীবন কুণ্ডু ফৌত হয়েছে। সুসংবাদ, তা বলে প্রকাশ্যে তো উৎফুল্ল হতে পারেন না। জিহ্বা ও তালু সহযোগে একটা শব্দ করলেন—শুনতে মনে হল ‘স্তু-স্তু’। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, জীবন কুণ্ডুও তাহলে দুনিয়ার মায়া কাটালো। আহা, ভালই গেছে। বহুদিন ভুগছিল।
আঢ্য-মশাই হচ্ছেন গোকুল ঘোষালের তহবিলদার, আজকাল তোমরা যাকে বল ‘কেশিয়ার’। নগদ লেনদেনটা তাঁর হাত দিয়ে। তাতেই দু-কপর্দক আটকে যায় আঙুলের ফাঁকে। জীবন কুণ্ডু ছিল তাঁর অধীনে মুহুরী। মাস-তিনেক সান্নিপাতিক জ্বরে ভুগছিল। বড়ই অসুবিধা চলছিল এ কয়মাস। শুধু নগদ জমা নয়, তার হিসাবও রাখতে হচ্ছিল ওঁকেই। ইতিমধ্যে বার-কয়েক নায়েব শ্রীহরি গাঙ্গুলীর কাছে দরবার করেছেন; কিন্তু গাঙ্গুলী-মশাই সম্মত হননি। লোকটাকে তো অসুখে-ভোগার অপরাধে বরখাস্ত করা যায় না। হরি আঢ্যের গরজটা অন্যজাতের। বৃদ্ধ বয়সে তৃতীয়পক্ষ করেছেন, নববধূর দাদা বেকার বসে আসে। বালিকাবধূর কাছে তিনি প্রতিশ্রুত, তার একটা হিল্লে করে দেবেন। এতদিনে সেই পথের কাঁটাটা দূর হয়েছে। কিন্তু আজই নায়েব-মশায়ের কাছে আবার প্রস্তাবটা তোলা কি ভাল দেখাবে? মৃত্যু-সংবাদ মাত্র আজই এসেছে। তা বলে দেরী করাও সুবুদ্ধির হবে না। দফতরের সব কটা হাড়-হাবাতে মুকিয়ে আছে—কারও ছেলে, কারও ভাইপো-ভাগনে। ইতস্তত করতে করতেই ডাক এসে গেল। কালী পেয়াদা এসে সসম্ভ্রম নমস্কার করে বললে, নায়েব-মশাই সেলাম দিয়েছেন।
‘সেলাম দেওয়া’ একটা দফতরী লব্জ—সৌজন্যব্যঞ্জক। আসলে ‘তলব করেছেন’। আঢ্য-মশাই কাছাটা ঠিকমতো সেঁটে নিয়ে নায়েব-মশায়ের দফতরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকে যুক্তকরে নমস্কার করে বলেন, ডাকছিলেন?
—হ্যাঁ, বসুন, কথা আছে।
নায়েব-মশাই কোনদিন ওঁকে বসতে বলেন না। এই পরম সৌভাগ্যলাভে একটু হকচকিয়ে যান। বসে পড়েন চৌকির একান্তে। নায়েব-মশাই বলেন, শুনেছেন নিশ্চয়, জীবন কুণ্ডু ফৌত হয়েছে। আপনার এ কয় মাস খুবই আতান্তরি যাচ্ছিল। আপনি বার-তিনেক তাগাদাও দিয়ে রেখেছেন। যা হোক, আপনার আর অসুবিধা নেই। বড়কর্তাকে বলে ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এই ছোকরা আপনার নতুন মুহুরী। কী নাম যেন তোমার?
এতক্ষণে নজর হল দেওয়াল-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি শ্যামবর্ণ কিশোর।
এগিয়ে এসে যুক্তকরে আঢ্য-মশাইকে নমস্কার করে বললে, শ্রীরামপ্রসাদ আজ্ঞে, ঠাকুরের নাম “ রামরাম সেন। নিবাস নদীয়ার কুমারহট্ট, ইদানীং লোকে বলে—হালিশহর।
হরিহর ওকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে নায়েব-মশাইকে বলেন, এ কি পারবে? এর তো গোঁফই ওঠেনি এখনো।
নায়েব-মশাই তাঁর মোম-দিয়ে-পাকানো সূচালো গোঁফের প্রান্ত চুমড়িয়ে বললেন, মুহুরির পক্ষে গোফটা তো আবশ্যিক অনুসঙ্গ নয়, আঢ্যি-মশাই। আর গোঁফ-জোড়াও তো অনিত্য বস্তু। গজালেও কি তা সকলের বরাতে টেকে?
নিদারুণ লজ্জা পেলেন হরিহর। দুরন্ত ক্রোধও হল। রাগটা গিয়ে পড়ল ঐ ছোকরার উপর এর পশ্চাতে একটি করুণ ইতিহাস ছিল! আঢ্যি-মশায়ের আকৈশোরের পুরুষ্টু কাঁচাপাকা গোঁফ-জোড়া অন্তর্হিত হয়েছিল তৃতীয় পক্ষ করার পরে। ভিতরের কথাটা অবশ্য কেউ জানে না—বালিকাবধূর সুড়সুড়ি লাগার গোপনবার্তাটা; কিন্তু তৃতীয়পক্ষ করা আর তার এক সপ্তাহের ভিতর গুল্ফমুণ্ডন ব্যাপারটাকে দফতরের ঐ ‘সুম্বুদ্ধির-পো’গুলো ঠিক কাকতালীয় ঘটনা বলেও মেনে নেয়নি। হরিহর সামলে নিয়ে বলেন, তা নয়, ইয়ে হয়েছে, হিসাবপত্রের ব্যাপার! লেখাপড়া কদ্দূর?
শেষ প্রশ্নটা ঐ ছোকরাকে। কিন্তু জবাব দিলেন নায়েব-মশাই স্বয়ং, বাঙলা, হিন্দি, সংস্কৃতই শুধু নয়, ও ফার্সিও শিখেছে।
বোঝ কাণ্ড। ছোকরা কটা ভাষা শিখেছে তা পর্যন্ত জানা, অথচ নায়েব মশাই সিক্ত-মার্জারের ভূমিকায় মুখপাত করেছিলেন, ‘কী নাম যেন হে তোমার?” হরিহর বুঝতে পারেন, নায়েবমশাই-এর শ্যালক না হলেও, ছোকরা তাঁরই সুপারিশে জীবন কুণ্ডুর চিতা নেবার আগেই টুলটা দখল করেছে। বেজার হয়ে বলেন, ভাষা নিয়ে কি ধুয়ে খাব? আঁক-টাক জানে তো? গাঁয়ের ছেলে, কলকাতার পথঘাটই হয় তো চেনে না।
—নায়েব বলেন, আপনার হেপাজতে দিচ্ছি। শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন। ও তো আর ডাকহরকরার কাজ করবে না। পথঘাট বেশি না চেনাই ভাল। এ হল গিয়ে শহর কলকাতা।
আঢ্যি-মশায়ের পিছন-পিছন ছোকরা দক্তরখানায় এল। জীবন কুণ্ডুর টুলটায় গিয়ে বসল। দফতরের সব কটা চোখ এখন তার দিকে। বুঝতে আর কারও বাকি নেই। শিরোমণিমশাই বলেন, এ-ছোকরাই বুঝি কুণ্ডু-মশায়ের পদে বহাল হল?
শিরোমণি ঘোষাল-বাড়ির নিত্যপূজা করে যান। পূজান্তে ক্যাশবাক্সে কিছু ফুল বেলপাতা ফেলে যাওয়া তাঁর নিত্যকর্মপদ্ধতি। সে কাজেই এসেছিলেন দপ্তরে। বাহুল্য বোধে আঢ্য-মশাই জবাব দিলেন না। শিরোমণি কাঠের ক্যাশবাক্সে রক্তচন্দনের ফোঁটা দিয়ে, আঢ্য-মশায়ের মাথায় শান্তির জল ছিটিয়ে এগিয়ে এলেন ছেলেটির দিকে। বললেন, আজ তোমার শুভ কর্মারম্ভ। তোমার কপালেও একটা ফোঁটা দিয়ে যাই। এই নাও।
রামপ্রসাদ লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে যুক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। শিরোমণি সহাস্যে বললেন, আক-টাক জান তো, বাবা? বল তো, সাত আর পাঁচে কত হয়?
রামপ্রসাদ বুদ্ধিমান। বোঝে, এটা নিতান্তই কৌতুক। সতের বছরের ছেলেকে কেউ এ-জাতীয় অঙ্ক কষতে দেয় না। তাই সহাস্যে বললে, আপনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, ঁমায়ের পূজারী। এসব আঁকের সাতে-পাঁচে তো আপনার জড়িয়ে পড়ার কথা নয়, ঠাকুরমশাই।
শিরোমণি উৎফুল্ল, বাঃ বাঃ। ‘সাত-পাঁচ’ শব্দটার উপর শেষটা তো বড় জবর ছেড়েছ হে! বলি পদ্য-টদ্য লেখ না কি?
কিশোরের উজ্জ্বল চোখজোড়া উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। মাথা নিচু করে সলজ্জে বলে, আজ্ঞে পদ্য নয়, গান! মায়ের নামে!
—মায়ের নামে গান! সে আবার কী? কেত্তনের ঢঙে?
—আজ্ঞে না। এ গান অন্য সুরে…
কথাটা শেষ হল না আঢ্যের ধমকে। তিনি শিরোমণিকে বলেন, আপনি এবার আসুন ঠাকুর মশাই! জাবদা-খাতার অনেক কাজ বাকি।
শিরোমণি রাগ করলেন না। প্রশান্ত হেসে ছেলেটিকেই পুনরায় প্রশ্ন করেন, তা বাবা মায়ের নামে গান লেখার দিকে ঝোঁক, তুমি এই আঁকের সাতে-পাঁচে জড়িয়ে পড়লে কেন? রামপ্রসাদ ঐ শিরোমণিকে ইতিমধ্যে ভালবেসে ফেলেছে। হেসে স্বরচিত গানের দুটি কলি শুনিয়ে দিল। সুর দিয়ে গাইতে সাহস হল না, আবৃত্তি :
“সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।
তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।।”
শিরোমণি ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। স্থান-কাল-পাত্র এবং স্পর্শদোষের কথা বিস্মৃত হয়ে ঐ কিশোরটিকে বুকে টেনে নিলেন।
আঢ্য-মশাই একটা স্বগতোক্তি করলেন, এ তো ভ্যালা ঝামেলা হল!
.
রামরাম সেনের ছিল দুইটি বিবাহ। প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তান নিধিরাম। দ্বিতীয় পক্ষের তৃতীয় সন্তান রামপ্রসাদ। জাতে বৈদ্য। মধ্যবিত্ত নয়, নিম্নবিত্তের সংসারী মানুষ। বিঘেকয়েক নিষ্কর ভূমি ছিল, সম্বৎসরের চাউল উৎপন্ন হত তাতেই। এ ছাড়া ছিল পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত এক কালীমূর্তি—দেবী শঙ্করী। তাঁর প্রণামীও কিছু জুটত। চারপুত্র, তিনটি কন্যা, দুই গৃহিণী একটি গাইগরু—সংসার চলাই দায়। জ্যেষ্ঠপুত্র মায়ের পূজার ব্যবস্থাপনা করত। জমিজমা ও দেখা-শোনা করত রামের দুই সহোদর দাদা। রামরাম কনিষ্ঠ পুত্রটিকে কৃতবিদ্য করতে চেয়েছিলেন। ভর্তি করে দিয়েছিলেন চতুষ্পাঠীতে। ফার্সিও শেখাতে শুরু করেন। বাসনা ছিল ঐ কনিষ্ঠ পুত্র রামপ্রসাদ কোনও জমিদারী সেরেস্তায় কর্মসংস্থান করে নেবে। দুর্ভাগ্যবশত সেকাজ সম্পূর্ণ হল না। তার পূর্বেই ওপারের ডাক এসে গেল। নিধিরাম বাধ্য হয়ে বৈমাত্রেয় ভ্রাতাকে টোল থেকে ছাড়িয়ে আনলেন। তাকে পাঠিয়ে দিলেন শহর কলকাতায়। রামপ্রসাদের মাতুল—তাঁর নামটা জানা যায় না—জোড়াসাঁকোর কাছে দয়েহাটায় বসবাস করতেন। ঐ মামার সঙ্গে চেনাজানা ছিল ঘোষাল-মশায়ের নায়েব শ্রীহরি গাঙ্গুলীর। এই সূত্রেই ঐ চাকুরি-লাভ।
রামপ্রসাদ বাল্যকাল থেকেই ভাবুক প্রকৃতির। কবি-কবি ভাব। স্বভাবভক্তও বটে। সমবয়সী বালকদের সঙ্গে হুটোপুটি করার পরিবর্তে দেখা যেত সে ঐ দেবী শঙ্করী মন্দিরে চুপচাপ বসে আছে! একটু বড় হয়ে সে মা-কালীর সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলত। লোকজন দেখলেই সলজ্জে চুপ করে যেত। এমন ভাবুক প্রকৃতির মানুষটিকে সংসারের প্যাচে এসে যোগদান করতে হল বৈষয়িক ভূস্বামীর দফতরে। সাত-পাঁচের বন্ধনে পড়ল জড়িয়ে।
ভূস্বামী বৈষয়িক হলেও গোকুল ঘোষাল পাষণ্ড ছিলেন না। তিনিও শ্যামাভক্ত। স্বগৃহে প্রতিষ্ঠা করেছেন ঁতারা-মায়ের মূর্তি। ব্রাহ্মণ সন্তান—দৈনিক কয়েক ঘণ্টা ঐ মন্দিরে কাটিয়ে যেতেন। ধ্যান করতেন। সেকালের ভূস্বামীদের যেসব দোষ প্রত্যাশিত, তার কিছু ছিল, কিছু ছিল না। মদ্যপান করতেন, বাইজীর গানও শুনতেন—বস্তুত গানবাজনার দিকে তাঁর দারুণ ঝোঁক; কিন্তু ম-কারান্ত মারাত্মক কু-অভ্যাসটি ছিল না। দুই পত্নীতেই সন্তুষ্ট, উপপত্নীর বালাই নেই। নিজেও সঙ্গীতজ্ঞ। মাহিনা-করা ওস্তাদ ছিল তাঁর।
রামপ্রসাদ অবশ্য তাঁকে চোখেও দেখেনি কোনদিন।
আঢ্যি-মশাই দিনদিনই কেমন যেন সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ছেন। ঐ ছোকরা ঠিক স্বাভাবিক নয়। কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করে না। টুলে বসে নিরন্তর জাবদা-খাতায় যোগ অঙ্ক করে যায় আর কাজ না থাকলে আপন মনে কী-যেন বিড়বিড় করে। লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজে কী সব গোপন পত্র লেখে। কেউ নজর করছে দেখলেই লুকিয়ে ফেলে।
তুমি-আমি এক্ষেত্রে যে-জাতের সন্দেহ করতাম হরিহরের মনে সে জাতীয় প্রশ্ন আদৌ জাগল না। হেতু—কালের দোষ। স্থানঃ শহর কলকাতা,পাত্র : সতের বছরের উঠতি জোয়ান; কিন্তু কালটা যে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখন ছোকরার দল না লিখত প্রেমের কবিতা, না প্রেমপত্র। বাংলা ভাষাটা তখনো কবিতা লেখার মতো পোক্ত নয়, আর প্রেমপত্র পাঠ করার পাঠিকা কোথায় সেই ‘সেইতর-সময়ে’? শহর কলকাতায় হাজার করা একটি যুবতীর ও অক্ষরজ্ঞান নেই; গোটা গৌড়মণ্ডলে লাখে একজন আছে কিনা সন্দেহ!
অক্ষর-পরিচয় আর অকালবৈধব্য যে পরস্পরের হাতে রাখী বেঁধেছে।
তাহলে ও ছোকরা কী লেখে লুকিয়ে লুকিয়ে?
আরও একটা কথা। দফতরে ছুটি হয়ে যাবার পর রোজ সাঁঝের ঝোঁকে ও ছোকরা খাল ধারের দিকে কোথায় যায়? ‘খাল’ বলতে ‘মারহাট্টা ডিচ’। ইংরেজ বেনিয়ার দল গোটা কলকাতা শহরকে বেষ্টন করে খুঁড়েছে ঐ খাল–বর্গী-আক্রমণ ঠেকাতে। ঘোষাল-মশায়ের ভদ্রাসনটা যেখানে ছিল, বর্তমানে তার নাম ধর্মতলা। তার পুবে ঐ খাল। সেখানে ভদ্রপল্লী নেই—বস্তুত মনুষ্যবাসই নেই। সেটা শেয়াল আর শকুনের রাজত্ব। আছে একটা শ্মশান—খালের কিনার ঘেঁষে। ভদ্রলোকের নয়, ছোট জাতের—ঐ যাদের নিমতলা বা গঙ্গা কিনারে আর কোন শ্মশানে যাবার সঙ্গতি নেই। পরপর কদিনই লক্ষ্য করলেন—দফতর ছুটি হয়ে যাবার পর রামপ্রসাদ ঐ জনহীন খালপারের দিকে রওনা দিল। ব্যাপার কী? জানতে হবে।
সন্ধান দিল কালী বেয়ারা। না, খাল-ধারটা একেবারে জনহীন নয়। শ্মশানের রশি কয়েক দূরে একটা নুড়িয়া-খোলার বস্তি আছে। ঘননিবদ্ধ গুটি আট-দশ পর্ণকুটীর। সেখানে বাস করে কিছু অন্ত্যজ রূপোপজীবিনী। বাঙালী মেয়ে নয়, ওড়িয়া, তৈলঙ্গী, কিছু পশ্চিমা। ভদ্রঘরের বাঙালী বাবুরা সে পাড়ায় যায় না। তাদের খরিদ্দারও ভিনদেশী মেহনতী মানুষ—ঐ যারা এসেছে জরু-গরু দেশে ফেলে রেখে, রুজি-রোজগারের ধান্দায়, এই কলকাতা শহরে। বেশির ভাগ পাল্কি-বাহক।
হরিহরের নাক কুঁচকে ওঠে। বলেন, বলিস কী রে! ঐ যমের অরুচি রণ্ডি বস্তিতে যায় রামপ্রসাদ। ভদ্র বৈদ্যবংশের সন্তান?
কালী নখ দিয়ে মেঝে খুঁটতে খুঁটতে বলে, আর কোন্ নরকে যাবে বলুন বড়বাবু? ও দিগড়ে তো কোন ভদ্রলোকের বাস নেই।
চকিতে একটা সম্ভাবনা ঝিলিক দিয়ে উঠল। কর্তা-মশাই সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ। ও ছোকরার এই কলঙ্কের কথাটা তাঁর কানে তুলে দিতে পারলে কি ওর চাকুরিটা ভক্ষণ করা যায় না? ঝুঁকে পড়ে বলেন, সঠিক পাত্তা নিয়ে আসতে পারবি কালী? তোকে খুশী করে দেব।
—সঠিক পাত্তা মানে? কী খবর চাইছেন?
—ও কার ঘরে রাত কাটায়। কার সঙ্গে আনাই?
সামাজিক বিধানে ফারাকটা আশমান-জমিন; কিন্তু নিজের গরজে বড়বাবু স্বয়ং ওর সমতলে নেমে এসেছেন। কালী বেয়ারা একগাল হেসে বললে, এ একটা কথা হল? রণ্ডি বাজারে কেউ কি আশনাইয়ের টানে যায় বড়বাবু? আজ গুলাবী, তো কাল মতিয়া, পশু রুক্মিণী—একটা হলেই হল।
তা বটে। তবু একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর যে প্রয়োজন। মা-কালীর নামে শপথ করে যে বলতে পারবে—সে স্বচক্ষে ব্যাপারটা দেখেছে। অনেক পীড়াপীড়িতে কালী সম্মত হল সরেজমিনে তদন্তটা করে দেখতে। নগদ বিদায়ও পেল কিছু।
কিন্তু পরের সপ্তাহেই সে এসে যা বলল তাতে পিলে চমকে যাবার জোগাড়! ছোকরা রণ্ডি বস্তিতে আদৌ যায় না। মাগীগুলো ন্যাকামি করে, হাতছানি দিয়ে ডাকে কিন্তু রামপ্রসাদ ভূক্ষেপও করে না। নিষিদ্ধ পল্লীটি অতিক্রম করে সোজা চলে যায় ঐ অন্ত্যজ-পরিবারের শ্মশানঘাটে। নির্জন শ্মশানকালীর ছাপরায়। চমকি ঠুকে প্রদীপ জ্বালে। তারপর ধ্যানে বসে। কালী বললে, ছোট মুখে বড় কতা হয়ে যাচ্ছে বড়বাবু, কিন্তু আপনার ভালোর জুন্যিই বলছি—অর পিছনে লাগবেননি। ছোকরা পিচাশসিদ্ধ!
—পিচাশসিদ্ধ! তুই কেমন করে জানলি?
কালী বিস্তারিত জানায়। একদিন সে মুহুরীবাবুর মুখোমুখি পড়ে গেছিল। মুহুরীবাবু অবাক হয়ে বলে, কালী! তুই এখানে?
কালী বুদ্ধি করে বলে, এ বাগে আসি ছিলাম। দূর থেকে ঠাওর হল আপনি মন্দিরে বসি আছেন। তাই আগায়ে এলাম। মায়ের ঠাঞে কী করছিলেন?
—মন্দিরে মানুষে আবার কী করে? মায়ের পূজা।
—ভয়-ডর লাগে না? জনমানবশূন্যি শ্মশান, ‘শ্যাল-শকুনের পাড়া—
রামপ্রসাদ নাকি হেসে বলেছিল, দূর ভীতুর ডিম! ভয় কিসের রে? আমি যে ঁমায়ের আদরের ছেলে! আমি যা চাইব, মা তাই দেবেন আমাকে।
—যা চাইবেন? তাইলে মরতে মুহুরীগিরি করেন কেন? সোনাদানা চাইলেই পারেন?
—সোনাদানা যারা চায় তারা মায়ের আশীর্বাদ পায় না। বুঝলি?
সব বৃত্তান্ত শুনে হাত-পা পেটের ভিতর সেঁদিয়ে যাবার দাখিল। নায়েবাবু এ কী আতান্তরিতে ফেললেন ওঁকে! ‘পিচাশসিদ্ধ’ মুহুরী! বোঝ বখেড়া!
তার কিছুদিন পরেই একটা মারাত্মক আবিষ্কার করে বসলেন হরিহর আঢ্যি। জাবদা খাতায় রামপ্রসাদ তার মনোবাসনার কথা লিপিবদ্ধ করেছে। না, সে সোনাদানা চাইনি ঁমায়ের ঠাঞে। সরাসরি মৃত্যুকামনা করেছে আঢ্যি-মশায়ের! জীবন কুণ্ডুকে ফৌত করে হয়েছিল মুহুরী, এখন ভবিলদার হরিহর আঢ্যের মারণ-উচাটনে লেগেছে! তহবিলদার ফৌত হলে সে ঘোষাল-মশায়ের তহবিলদার হয়ে বসতে পারে! দু-ছত্র কবিতা পড়ে হাত-পা থরথর করে কাঁপতে থাকে :
“আমায় দে মা তবিলদারি,
আমি নিমকহারাম নই শঙ্করি।”
‘নিমকহারাম’ কেন লিখেছে? ও ছোকরা কোন্ সূত্রে টের পেল যে, উনি শতকরা পাঁচকড়া-হারে দস্তুরী নিয়ে থাকেন? সেটাই প্রথা! শহর কলকাতার যাবতীয় তহবিলদার ঐ হারে উৎকোচ গ্রহণ করে। সেটা উৎকোচ নয়, বাঁধা-রেট দস্তুরী। তাহলে নিমকহারামীর কথাটা উঠছে কোন সূত্রে?
প্রথামাফিক আর্জিটা পেশ করার কথা নায়েবাবুর এজলাসে। আঢ্যি সে-পথে গেলেন না। নায়েববাবু স্বয়ং ঐ ছোকরার মুরুব্বি। তিনি ঘোড়া ডিঙিয়ে তৃণভক্ষণে প্রয়াসী হয়ে পড়েন। জাবদা খাতাখানি বগলদাবা করে হাজির হলেন স্বয়ং বড়কর্তার বৈঠকখানায়।
বড়কর্তা ধৈর্য ধরে সব কিছু শুনলেন। কী মর্মান্তিক হেতুতে নায়েবাবুর কাছে সংবাদটি গোপন করে তহবিলদার একেবারে বড়কর্তার খাস কামরায় আসতে বাধ্য হয়েছে, সে-কথাও। বড়কর্তা বললেন, খাতাখানা রেখে যাও। সেই মুহুরীটিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
ছেলেটির বিষয়ে দু-চার কথা ইতিপূর্বেই কানাঘুষা শুনেছেন। নায়েব গাঙ্গুলী-মশায়ের মতে ছোকরা কিছু অস্বাভাবিক; শিরোমণি-মশায়ের মতে সে কবি, পদকর্তা! সে নাকি মা কালীর নামে গান লেখে! মা কালীর নামে গান? সে আবার কী? গোকুল ঘোষাল ঐ দু-ছত্র পড়ে অনায়াসে বুঝতে পেরেছেন কিশোর কবির আকুলতা। এ কোন মারণ-উচাটন মন্ত্র নয়। কিশোর কবিযশোপ্রার্থী ঁমায়ের কাছে ভক্তি-সিন্দুকের চাবিকাঠি চেয়েছে! এ কোনও পার্থিব কামনা নয়।
ছেলেটি এল। গরুড়পক্ষীর মতো যুক্তকরে দাঁড়িয়ে রইল সম্মুখে। গোকুল ওকে বসতে বললেন। জানতে চাইলেন, জাবদা-খাতায় এ পদ্য তুমি লিখেছ?
যুক্তকরে ছেলেটি বললে, এবারকার মতো মাপ করে দিন হুজুর। আর কখনো হবে না।
—বাজে কথা বল না! এ পদ্য তোমার রচনা?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে ওটা পদ্য নয়, গানের পদ।
—গান। কী ঢঙে গাইতে হবে? কীর্তন, বাউল না ভাটিয়ালী?
কিশোর-কবি তখন মরিয়া। ফস্ করে বলে বসে, আজ্ঞে তিনটার একটাও নয়, ‘রামপ্রসাদী’ ঢঙে!
গোকুল ঘোষাল স্তম্ভিত। সঙ্গীতে তাঁর যথেষ্ট অধিকার। ধ্রুপদ-ধামার এবং যাবতীয় লোকায়ত সঙ্গীত। ‘রামপ্রসাদী’-ঢঙ শব্দটা ইতিপূর্বে কখনো শোনেননি। চকিতে মনে পড়ে গেল ঐ ছোকরার নাম ‘রামপ্রসাদ’। তবে কি নিজের নামটাই বলছে? সোজা হয়ে বসে বলেন, ‘রামপ্রসাদী ঢঙে’ কাউকে গাইতে শুনেছ?
সতেজ শালচারার মতো সোজা হয়ে বসল রামপ্রসাদ। বললে, আজ্ঞে না হুজুর। শুনিনি, কিন্তু গাইতে পারি।
ছোকরার এই অপরিসীম দার্ঢ্যে ক্রোধান্বিত হলেন না বড়কর্তা। বললেন, তাহলে শোনাও দেখি রামপ্রসাদী ঢঙে মায়ের নামে একখানা গান!
রামপ্রসাদ ইতস্তত করল না। অনেক অনেক পদ রচনা করেছে সে। সুর দিয়েছে, গেয়েছে। শ্রোতা একমাত্র মা কালী। কেউ কোন দিন তাকে ডেকে বলেনি, মায়ের নামে একখানা গান গেয়ে শোনাও তো ভাই। এই তার জীবনের প্রথম শ্রোতা : মা আজ চোখ তুলে চেয়েছেন। তার গানের প্রথম শ্রোতা দশজনের দশমজন—লক্ষ্মী-সরস্বতীর যুগ্ম-বরপুত্র। চাকরি যায় যাক। আজ সে তার জীবনের প্রথম শ্রোতাকে গান শোনাবে। আবেশে মুদ্রিত হয়ে গেল কিশোর কবির ডাগর দুটি চোখ। বর্তমান অবলুপ্ত হয়ে গেল। এই বিলাসকক্ষ, ঐ ঝাড়লণ্ঠন দেয়ালগিরি, খাট-পালঙ্ক তার মালিক বিলীন হয়ে গেল ক্রমে। মগ্নচৈতন্য সাধক স্বরচিত গান ধরল তার নিজস্ব ঢঙে :
“হৃৎকমল মঞ্চে দোলে করালবদনী শ্যামা।
মনপবনে দুলাইছে দিবসরজনী ও মা।।
ইড়া-পিঙ্গলা নামা সুষুম্না মনোরমা
তার মধ্যে গাঁথা শ্যামা ব্রহ্মসনাতনী ওমা।।”
গান যখন শেষ হল তখন গায়ক ও শ্রোতার চোখের জলে কার্পেট ভিজেছে।
.
রামপ্রসাদের চাকরিটা থাকল না!
কর্মচ্যুত রামপ্রসাদ ফিরে এল কুমারহট্টে। ঘোষাল-মশাই গুণগ্রাহী, সমঝদার ব্যক্তি। গানটি শুনে এক কথায় ওর চাকরি খেলেন। নিদান হাঁকলেন, কিশোর-কবিকে আজীবন মাস-মাহিনার ত্রিশটাকাই বৃত্তি হিসাবে দেওয়া হবে। সে স্বগ্রামে বসে যথেচ্ছা মায়ের নামে গান বাঁধবে, সুর দেবে, গাইবে, গাওয়াবে—গৌড়মণ্ডলে শ্যামা মায়ের নামের বন্যা বইয়ে দেবে।
তাই দিয়েছিলেন রামপ্রসাদ।
ঠিকই বলেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র—কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন অমর হয়ে আছেন বাস্তবিক পক্ষে এই আড়াইশ’ বছর পরে বঙ্গদেশে সমকালীন মহাকবি ভারতচন্দ্রের নাম দৈনি যতবার উচ্চারিত হয়. তার তিনগুণ উচ্চারিত হয় রামপ্রসাদের নাম—বিশেষ্য-পদ হিসাবে নয় বিশেষণ হিসাবে : ‘রামপ্রসাদী’ গান।
রামপ্রসাদ ছিলেন বীরাচারী তন্ত্র সাধক। ‘পঞ্চ মকার’ সাধনা ও ‘পঞ্চমুণ্ডির আসন’ প্রতিষ্ঠা কথা তাঁর পদে বারে বারে পাওয়া যায়। সারাটা জীবন তিনি সেই অধরাকে খুঁজে বেড়িয়েছিলেন—মা কখনো রণরঙ্গিনী মহাকালিকা—ঢলিয়ে ঢলিয়ে কে আসে, গলিত চিকু আসব আবেশে; আবার কখনো বা মা তাঁর মেয়ে, আদরের বেটি। দুঃখের কথা, দারিদ্র্যে কথা মন খুলে মাকে বলেছেন,
“দুঃখের কথা কই গো তারা, মনের কথা কই।
কে বলে তোমারে তারা দীন দয়াময়ী।।
**
কারও অঙ্গে শাল দো-শালা ভাতে চিনি-দই।
(আবার) কারও ভাগ্যে শাকে বালি ধানে ভরা খই।।”
দারিদ্র্যের বন্ধনমুক্ত হতে পারেননি কবি। তার অর্থ এই নয় যে, এতবড় ভক্তের কথা মায়ের কানে প্রবেশ করেনি। মা তাঁকে দিয়েছেন যথেষ্ট; কিন্তু কবির অর্থকৃচ্ছ্রতা যে তাঁর নিজের সৃষ্ট। এ বিষয়ে প্রামাণিক ইতিহাস শোনাই বরং, “কবির কিছু উপার্জন ছিল। ভক্তগণ প্রণামী দিত; তাহা ছাড়াও অনেক ধনাঢ্য ভূস্বামীর নিকট তিনি ভূমিদান লাভ করিয়াছিলেন। স্বয়ং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কবির গ্রামের নিকটে চৌদ্দ বিঘা নিষ্কর ভূমি দান করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রদত্ত জমির মোট পরিমাণ পঞ্চাশ বিঘারও অধিক। সুতরাং কবি নিতান্ত নিঃস্ব ছিলেন না। কিন্তু অধিকাংশ অর্থ দানধ্যানেই ব্যয় হইয়া যাইত বলিয়া কবির দারিদ্র্য দুঃখ কোনদিনই ঘুচে নাই।”[১]
[‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ -অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃতীয় খণ্ড: দ্বিতীয় পর্ব 1981, : 310-11]
এর পরে কবি যখন তান ধরেন
“কেন আসার আশা ভবে ভাসা আসা মাত্র হলো।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে ভ্রমর ভুলে রইল।।
মা, নিম খাওয়ালে চিনি বলে কথায় করে ছলো।
ওমা, মিঠার লোভে তিত মুখে সারাটা দিন গেল।।”
তখন পার্থিব-জননী হলে হয় তো বলতেন : ন্যাকামি।
জগজ্জননী তা বলেননি। তিনি জানতেন ঐ ‘মিঠা’ আর ‘তিত’ শব্দের ভিন্ন ব্যঞ্জনা। মিঠা অর্থে সোনা-দানা, জমি-জেরাৎ নয়, বিশুদ্ধ ভক্তি!
বয়সে রামপ্রসাদ ভারতচন্দ্রের চেয়ে কিছু ছোট। তিনিও একখানি ‘বিদ্যাসুন্দর’ রচনা করেছিলেন। গবেষকদের মতে সেটি ভারতচন্দ্রের রচিত ‘বিদ্যাসুন্দরের পরে। একই বিষয়বস্তু নিয়ে কবি কেন ঐ কাব্য লিখেছেন সে বিষয়ে নানামুনির নানামত। কাব্য বিচারে পূর্ববর্তীকালের রুনা হলেও ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ উৎকৃষ্টতর। আমাদের মনে হয়, রামপ্রসাদের ধারণা হয়েছিল ভারতচন্দ্র ঐ কাব্যে মহাকালীর মহিমা যথোচিতভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। সেই ত্রুটি পূরণের জন্যই হয়তো রামপ্রসাদের প্রয়াস। কিন্তু তিনি কুত্রাপি ভারতচন্দ্রের প্রতি অসূয়া প্রকাশ করেননি।
কবি ভণিতায় নিজ নামের পূর্বে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি ব্যবহার করেছেন। এ উপাধি তাঁকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দিয়েছেন বলে মনে করা স্বাভাবিক; কিন্তু 1759 খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্ৰ রামপ্রসাদকে জমিদান করে যে দলিল সম্পাদন করেন, তাতে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি দেখা যায় না। অনেকের বিশ্বাস এ উপাধি কৃষ্ণচন্দ্র প্রদত্ত নয়। ‘মহাত্মাজী, দেশবন্ধু, নেতাজী’ প্রভৃতি উপাধির মতো সেটিও স্বদেশবাসীর স্বতঃপ্রদত্ত সম্মানের দ্যোতক। অপরপক্ষে রামপ্রসাদও সমকালীন পদকর্তার পদাঙ্ক-অনুসরণে ‘পৃষ্ঠপোষক মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রে’র নাম তাঁর কাব্যে লিপিবদ্ধ করেননি।
এই সাধক-কবির সম্বন্ধে নানাপ্রকার অলৌকিক গালগল্প, প্রবাদ ও জনশ্রুতি গড়ে উঠেছে। মা অন্নপূর্ণা নাকি কাশী থেকে হালিশহরে এসে তাঁর গান শুনে যেতেন, মা-কালী তাঁর বাগানে বেড়া-বাঁধার কাজে দড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন অথবা তাঁর মৃত্যুসংক্রান্ত। সেসব কাহিনী সত্য বলে গ্রহণ করেন বিশ্বাসপ্রবণ ভক্তরা; কিন্তু না করলেও তাতে রামপ্রসাদের মহিমা খর্ব হয় না। সে সব কাহিনীর লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, লেখক অবিশ্বাসী, পাষণ্ড!
এর পর যে গল্পটা শোনাব তার জন্যে এই সাফাইটুকু আগাম গেয়ে রাখলাম।
রামপ্রসাদের দুই পুত্র—রামদুলাল ও রামমোহন এবং দুই কন্যা পরমেশ্বরী ও জগদীশ্বরী। আর প্রতিবেশী অচ্যুত গোস্বামী বা সংক্ষেপে আজু গোঁসাই। তিনি বৈষ্ণব এবং উপস্থিত কবি। কোন পুঁথি তিনি লিখে যাননি, কিন্তু শাক্ত প্রতিবেশী রামপ্রসাদকে আক্রমণ করে কয়েকটি পদ রচনা করে বিখ্যাত হয়েছেন। কবি ঈশ্বর গুপ্তের ভাষায় “রাজা (অর্থাৎ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র) যখন কুমারহট্টে আসিতেন তখন রামপ্রসাদ সেন এবং আজু গোসাইকে একত্র করিয়া উভয়ের সঙ্গীত যুদ্ধের কৌতুক দেখিতেন। রামপ্রসাদ সেন কবীন্দ্র ছিলেন, আজু গোঁসাই আধ-পাগ্লা ছিলেন, কিন্তু মুখে মুখে রহস্যকবিতা রচনা করিতে পারিতেন। রামপ্রসাদ সেন যখন জ্ঞানভক্তির বিষয়ে পদবিন্যাস করিতেন, ইনি তখন রহস্য ছলে তাহার উত্তর করিতেন।”
অসিতকুমারের মতে, “ঈশ্বর গুপ্ত ইঁহার (আজু গোঁসাই) সম্বন্ধে যেটুকু সংবাদ দিয়াছেন, তাহার অধিক বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। …ইনি বৈষ্ণব মতাবলম্বী ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। ঈশ্বর গুপ্ত তাঁহাকে আধ-পাগলা বলিয়াছেন; তাহা বোধহয় ঠিক নহে। শুনা যায়, ইনি বৈষ্ণব সাধনমার্গের পথিক ছিলেন, অপরদিকে বেশ পরিহাসপটুও ছিলেন। রামপ্রসাদের কোন কোন শ্যামাসঙ্গীতকে তিনি বেশ রঙ্গরহস্যের দ্বারা তীক্ষ্ণভাবে আক্রমণ করিতেন। বৈষ্ণবসম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন বলিয়া স্বভাবতঃই তিনি শাক্ত রামপ্রসাদকে ততটা পছন্দ করিতেন না।”
ঐতিহাসিক তথ্য ঐটুকু। এবার গল্প ফাঁদা যাক। কিন্তু তার আগে আজু গোসাই কী-জাতের ‘উতোর’ গাইতেন, তার দু-একটা নমুনা শোনাই :
রামপ্রসাদ হয়তো গাইলেন,
“আয় মন বেড়াতে যাবি।
কালীকল্পতরুতলে রে মন চারি ফল কুড়ায়ে খাবি।।”
নির্দোষ দুটি পংক্তি। কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়া হয়নি। কিন্তু আজু গোসাই প্রতিবাদ করে ওঠেন :
“কেন রে মন বেড়াতে যাবি?
কারও কথায় কোথাও যাস্ নে, রে মন,
মাঠের মাঝে মারা যাবি।।”
ভক্তকবি রামপ্রসাদ হয়তো তান ধরলেন,
“ডুব দে রে মন কালী বলে।
হৃদিরত্নাকরের অগাধ জলে।।”
বিশুদ্ধ ভক্তিরসের পদ। গান হচ্ছে হালিশহরে, মহারাজার কাছারিবাড়ি সংলগ্ন বিশ্রামগৃহে—মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আগমন উপলক্ষ্যে। গণ্ডগ্রামের ভদ্রলোকেরা ফরাসে বসে আছেন আসনপিড়ি হয়ে। মহারাজ কিঞ্চিৎ উচ্চাসনে তাকিয়া ঠেশান দিয়ে। গানটি নিঃসন্দেহে তাঁর ভাল লেগেছে। তবু আজু গোঁসাইকে খোঁচা দিয়ে বলেন, গোঁসাই-কবি এবার একখানা শোনাও।
উপস্থিত-কবি আজু-গোসাই—তাঁরও অদ্ভুত প্রতিভা—মুখে মুখে ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করে ঐ রামপ্রসাদী সুরেই গেয়ে ওঠেন
“ডুবিস নে মন ঘড়ি ঘড়ি।
দম আটকে যাবে তাড়াতাড়ি।।
একে তোমার কফোনাড়ী
ডুব দিও না বাড়াবাড়ি
তোমার হলে পরে জ্বরজ্বারি
মন, যেতে হবে যমের বাড়ি।।”
তোমরা তুলনামূলক বিচার করে দেখ। রামপ্রসাদের ঐ দুটি ছত্রে কাব্যমাধুর্য নিঃসন্দেহে অধিক; বোঝা যায় যে, ভক্তকবির আকুলতা মিশে আছে তাতে। কিন্তু ভুললে চলবে না—রামপ্রসাদ পদটি লিখে এনে গাইছেন, আজু-গোসাই শ্রবণমাত্র তার ‘প্যারডি’ রচনা করেছেন। মুখে মুখে ছয়-পংক্তির অন্ত-মিল সমেত ‘উতোর’ রচনাও কম কৃতিত্বের কথা নয়!
আজু গোসাই যে শুধু লঘুভঙ্গিতে ‘উতোর’ গেয়েছেন তাও বলতে পারি না। এক এক সময় তীব্র শ্লেষের মাধ্যমে তিনি রামপ্রসাদের রচনার দোষত্রুটির সম্যক বিচারও করেছেন। যেমন উল্লেখ করা যায়, রামপ্রসাদ একবার গৌরীর বাল্যলীলার বর্ণনার মধ্যে কৃষ্ণলীলার অবতারণা করে বসলেন! পদাবলীর গোষ্ঠলীলার অনুপ্রেরণার একটি চিত্র অঙ্কিত করলেন—গৌরী গোধন নিয়ে গোচারণে এসেছেন, বাঁশী বাজিয়ে ধেনুদের ডাকছেন! আজু গোঁসাই-এর মতে এটি ‘রসাভাস’। লিখলেন,
“না জানে পরমতত্ত্ব কাঁঠালের আমসত্ত্ব
মেয়ে হয়ে ধেনু কি চরায় রে?
তা যদি হইত যশোদা যাইত
গোপালে কি পাঠায় রে?”
অসিতকুমারের মতে, “এই বিদ্রূপের খোঁচা অতিশয় বুদ্ধিদীপ্ত হইয়াছে।”
আর একবার রামপ্রসাদ গাইলেন তাঁর বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত
“এবার কালী তোমায় খাব।
(খাব খাব গো দীন দয়াময়ী)
এবার তুমি খাও কি আমি খাই, মা দুটোর একটা করে যাব।
হাতে কালী, মুখে কালী সর্বাঙ্গে কালী মাখিব।”
রামপ্রসাদের এই ভাবোন্মাদে আজু গোঁসাই ‘উতোর’ গাইলেন :
“সাধ্য কি তোর কালী খাবি?
ওযে রক্তবীজের বংশ খেলে তার মুণ্ডমালা কেড়ে নিবি!
সর্বাঙ্গে নয়, উভয় গালে ভুষো কালি মেখে যাবি।”
অসিতকুমার এই দুটি উদ্ধৃতি শুনিয়ে বলেছেন, “আজু গোঁসাইয়ের ধর্মবিশ্বাসে রামপ্রসাদের যে গান অসঙ্গত মনে হইয়াছিল, তিনি শাণিত ব্যঙ্গোক্তি নিক্ষেপ করিয়া তাহার যথোপযুক্ত উত্তর দিতেন। দুঃখের বিষয় জনশ্রুতি ছাড়া এবিষয়ে আর কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের এক অভিনব দৃষ্টান্ত মিলিত!”
পাওয়া যখন নেহাৎ গেলই না, তখন কথাসাহিত্যের বাজারে কিছু আনন্দলাভে আপত্তি কিসের? এস, গপ্পো শোন :
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যখন হালিশহরে আসতেন তখন উভয়-কবির জন্যই কিছু কিছু উপঢৌকন নিয়ে আসতেন। শাল দো-শালা থেকে ধুতি-চাদর, কবিপত্নীর জন্য মুর্শিদাবাদী শাড়ি থেকে ঘূর্ণীর মৃত্তিকাশিল্প। একবার তিনি দুই কবিকেই উপহার দিলেন কিছু ফুলগাছের বীজ। বললেন, এই বীজ থেকে ফুলের চারা হবে, ফুল ফুটবে, তাতে কবিদ্বয় তাঁদের ইষ্টপূজার ব্যবস্থা সহজেই করতে পারবেন। রামপ্রসাদকে দিলেন জবা আর অপরাজিতার বীজ; আর আজু গোঁসাইকে নয়নতারা আর শ্যামসোহাগী। দুই কবিই খুশি। নিজ নিজ বাগিচায় প্রয়োজনীয় ফুল ফুটলে কত সুবিধা।
দু-বাগানেই চারাগাছ জন্মালো। পাতা বার হল, ক্রমে ফুলও ফুটল।
কিন্তু কী বিড়ম্বনা! মহারাজের ভ্রমে বীজের পুলিন্দা ওলট-পালট হয়ে গেছে। গোঁসাইজীর বাগিচায় ফুটল রাঙা জবা আর নীল অপরাজিতা, ওদিকে শাক্তকবির বাগানে শ্যামসোহাগী! কোন মানে হয়! রাজার উপহার দেওয়া ফুলগাছের চারা, না যায় উপড়ে ফেলা, না ছাগল দিয়ে খাওয়ানো। মহারাজা পরের বার পরিদর্শনে এসে সে-বার্তা শুনে বললেন, কবিরঞ্জন, এজন্যই চণ্ডী বলেছেন, “যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা!” দেখুন দেখি কাণ্ড! তা সে যাই হোক, ভুল জায়গায় ফুটেছে বলে তো ওদের প্রাণদণ্ড হতে পারে না? আপনারা প্রতিদিন ফুল ও-বাড়ি দিয়ে আসবেন, এ-বাড়ি নিয়ে আসবেন।
দুজনের কেউই বুঝতে পারেননি, এটি মহারাজের ভ্রান্তি নয় আদৌ। তিনি চেয়েছিলেন দুটি পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হোক। দুজনে বলতে গেলে প্রতিবেশীই। দুই ভদ্রাসনের মাঝখানে একটি মাত্র দিঘির ব্যবধান। একটি মাত্র পুষ্করিণী, কিন্তু তারও নাম দু-দুটো। রামপ্রসাদ তার নাম রেখেছেন “কালী দহ”, শুনে আজু গোঁসাই তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন, না, ওটার নাম “কালীয়দমন দহ”!
রাজা-মশাই বললেন, আপনাদের দুজনেরই কন্যাসন্তান আছে। একদিন তুলসী কবিরঞ্জনের বাড়িতে পৌঁছে দেবে জবা, অপরাজিতা; পরদিন জগদীশ্বরী গোঁসাইজীর বাড়িতে পৌঁছে দেবে নয়নতারা আর শ্যামসোহাগী।
রাজাদেশ। লঙ্ঘন করা যায় না। আজু তবু আপত্তি তোলেন, ছোটখুকি বালিকা মাত্র, কিন্তু তুলসী ত্রয়োদশে পড়েছে, ঘরের বার হয় না যে মহারাজ।
ছোটখুকি অর্থে জগদীশ্বরী, রামপ্রসাদের কনিষ্ঠা কন্যা।
মহারাজ সহাস্যে বলেন, তা তুলসী যদি পথে বার না হয় তবে তার মা নিজেই সে কাজটা করে দিতে পারেন, একগলা ঘোমটা টেনে। এ তো বলতে গেলে পাশের বাড়ি! অবশ্য কবিরঞ্জনের বাড়িতে খাঁড়া আছে, সেই ভয়ে যদি গৃহিণীকে ও বাড়ি না পাঠান…
গোঁসাইজী সলজ্জে বাধা দিয়ে বলেন, না না, খাঁড়াকে আমি থোড়াই ডরাই!
মহারাজও সহাস্যে বলে ওঠেন, এই তো বীরের মতো কথা! ওঁর খাঁড়া আছে তো আপনারও বাঁশি আছে! আর বাঁশির ধর্মই হচ্ছে পরস্ত্রীকে মোহিত করা! কবিরঞ্জনকেও নিজের ঘর সামলাতে হবে!
আলোচনাটা গৃহিণী-ঘেঁষা হয়ে যাচ্ছে দেখে দু-পক্ষই প্রসঙ্গান্তরে আসেন।
—এবার একটু গান-বাজনার আসর শুরু করা যাক মহারাজ!
যে তথ্যটা মহারাজ ছাড়া দুই কবিও জানতেন না তা এই—বাঁশি শাক্ত-ঘরের ছেলে ও বাজায়, আর তাতে পরস্ত্রী নয়, পরের ঘরের অনূঢ়া ত্রয়োদশীও মোহিত হয়ে যেতে পারে।
তাই গিয়েছিল। কবিরঞ্জনের কনিষ্ঠপুত্রটি—রামমোহন, আজু গোঁসাই-এর দাদার টোলে পড়তে যেত। বয়সে সে তুলসীর চেয়ে বছর তিন-চারের বড়। আলাপ না হওয়ার হেতু নেই, আর বয়সটা এমন যে, মুগ্ধ না হওয়ারও!
মহারাজের ইচ্ছা কিছুটা সফল হয়েছিল। ছোটখুকি বা তার মা সকালে শ্যামসোহাগী ফুলগুলি তুলে গোঁসাই বাড়ি দিয়ে আসতেন আর সাজি ভরে নিয়ে আসতেন জবা আর অপরাজিতা। পরদিন গোঁসাই গৃহিণী তার প্রতিদান দিতেন। ফলে সহজেই দুটি পরিবারের মধ্যে দেখা দিল সম্প্রীতি। কিন্তু দু-পক্ষই সজাগ—ঘি আর আগুন যেন পরস্পরের সন্নিকটে না আসে। শাক্তবাড়ির ছেলে আর গোঁসাই-বাড়ির মেয়ে। তারা যে কোথায় লুকিয়েচুরিয়ে সাক্ষাৎ করত তা কাকপক্ষীতে টের গেলেও অভিভাবকেরা টের পেতেন না।
এর মধ্যে আরও কিছু জটিলতা দেখা দিল। শ্যামচাদের পূজা হয় সকালে, মা শঙ্করীর পূজা রাত্রে। সুতরাং ফুল দিয়ে ফুল নিয়ে আসা চলে না। তাহলে সারা দিনে জবা-অপরাজিতা ফুলগুলি শুকিয়ে যায়। ফলে দান-প্রতিদানটা দৈনিক নয়, এ-বেলা ও-বেলার ব্যাপার। কখনো বা রামমোহন নিজেই গিয়ে তুলসীর তোলা ফুল সাজি ভরে নিয়ে আসত। তাতে দোষের কিছু নেই।
তারপর একদিন। ছোটখুকি যে সান্নিপাতিক জ্বরে শয্যাশায়ী সে খবরটাও জানা নেই কবিরঞ্জনের। সংসার বিষয়ে তিনি উদাসীন। সারাদিন আছেন ভাবের ঘোরে। পদরচনা করা, তাতে সুর দেওয়া আর মাকে শোনানো।
সেদিন অপরাহুকালে উনি বাগানের বেড়া বাঁধছিলেন। তলতা বাঁশের পিঠা-মুলি চাটাই। এপার-ওপার স্পষ্ট দেখা যায় না। ভরাট বাঁশের খুঁটি পুঁতেছেন চার হাত তফাৎ-তফাৎ। তলতা-বাঁশগুলি চেরাই করে বাঁধা হয়ে গেছে। এখন কাজ হচ্ছে সেটাকে খাড়া করা। এ-কাজে বেড়ার দু-পাশে দুজন লোক থাকলে বাঁধন দিতে সুবিধা হয়। রামমোহনের খোঁজ করেছিলেন, সে নাপাত্তা। গিন্নিকে যে এ-কাজে ডাকবেন তার সাহস নেই। সংসারের পাঁচকাজ সারতে সারতেই তাঁর নাকি হাড়-মাস কালি। হঠাৎ মনে হল, বেড়ার ওপাশ দিয়ে পা টিপে-টিপে ছোটখুকি কোথায় সটকে পড়ার তালে আছে। রামপ্রসাদ বুঝতে পারেন—ছোটখুকিটা বিচ্ছু। ঠিক বুঝে ফেলেছে এখনি হয়তো বাবামশাই ওকে ডাকবেন বেড়া-বাঁধার কাজে ফেরতা দিতে। না হলে চোরের মতো পা টিপে টিপে সটকে পড়ার কী হেতু?
রামপ্রসাদ বজ্রগম্ভীর স্বর্ হাঁকাড় পাড়েন : ছোটখুকি!
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ন’ যযৌ, ন তস্থৌ!
—কোথায় পালাচ্ছিলি?
ও-প্রান্তে তুলসী ততক্ষণে পাষাণ প্রতিমা। ছোটখুকির জ্বর হয়েছে সে জানে। তার মায়েরও ‘হাত-অপ্সর’ নেই। সামনে মাধব পঞ্চমী—মা আনন্দনাড়ু পাকাচ্ছে। মা-ই বললে, তুলসী, যা, চট করে ও-বাড়ি ফুলকটা পৌঁছে দিয়ে আয়। যাবি আর আসবি। ছোটখুকির সঙ্গে আড্ডা দিতে বসবি না।
তুলসী বলেছিল, ছোটখুকির জ্বর হয়েছে মা। তবে দেরি করব না। যাব আর আসব। তা ঠিক হয়নি। বনপথেই দেখা হয়ে গেছিল ওর রামদার সঙ্গে। ফুলের সাজিটা তার হাতে ধরিয়ে দিলেই হত। প্রাণে ধরে তা পারেনি। কথাবার্তা বলতে বলতে অপরাহ্ণ গড়িয়ে গেছিল সন্ধ্যার দিকে। শাঁখে ফুঁ-পড়তেই চমকে উঠে বলেছিল, আজ যাই রাম দা, না হলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না।
রাম খপ করে ওর হাতখানা চেপে ধরে বলেছিল, তাহলে কথা দাও, কাল আবার ঠিক এই সময়ে আসবে।
–কাল তো তোমার যাওয়ার কথা।
ঠিক তখনই বেড়ার ওপাশ থেকে ভেসে এসেছিল বজ্রগম্ভীর আহ্বান : ‘ছোটখুকি! রামমোহন তার ওষ্ঠাধরে দক্ষিণ তর্জনীটা ছুঁইয়েছে। তুলসীর ছুটে পালানোর মতো সাহস নেই। বেড়ার ওপাশ থেকে রামপ্রসাদ ধমক দেন, দিনরাত শুধু পাড়া-বেড়ানো। মায়ের হাতে-হাতে কোন্ কাজটা করিস্ সারাদিনে?
এবারও তুলসী নিশ্চুপ।
—স্থির হয়ে ওখানে দাঁড়া। আমি এদিক থেকে গুণ-সূচের ফোড় দেব, তুই ফের্তা দিয়ে সূচ এ বাগে ফিরিয়ে দিবি। বুঝলি?
তুলসী শুধু বললে, হুঁ।
তারপর মুলিবাঁশের চাটাই শুধু এ-ফোড় ও-ফোড় হতে থাকে তুলসীর হৃৎপিণ্ডের মতো! অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে রামমোহন পা-টিপে এগিয়ে আসে। মক্ষিকাবিতাড়ন মুদ্রায় তুলসীকে কেটে পড়তে বলে। তুলসী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নিঃশব্দে পালিয়ে যায়। রামমোহন অতঃপর ছোটখুকির ভূমিকায় বেড়ায় ফের্তা দিয়ে চলে, আর বাবা-মশায়ের হিতোপদেশ শুনতে থাকে। রামপ্রসাদ এক-তরফা বক্ করে চলেন বেড়ার এপাড় থেকে—দুদিন পরেই তো পরের ঘরে চলে যাবি, মা। তখন কি আর মাকে পাবি? যেটুকু পারিস মায়ের হাতে-হাতে সাহায্য করিস্। সে বেচারি একাহাতে আর কতটা পারে, বল? তুই ছাড়া আর তার কে আছে? আমি তো ভাবের ঘোরে পড়ে আছি, তোর দাদাটা তো দিন দিন একটা বাঁদর হচ্ছে…
রামমোহন কোন প্রতিবাদ করে না। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে রামপ্রসাদ বলেন, আজ থাক, মা। আর দেখা যাচ্ছে না। তুই ইদিকে আয়।
এতক্ষণ সব আদেশ পালন করেছে। এইবারে পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘন করল মেয়েটি। বাস্তবে ছেলেটি।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হাঁকাড় পাড়েন, কী হল? ছোট খুকি? আয়!
কোন সাড়া নেই।
কাটারিখানা হাতে তুলে নিয়ে বেড়ার ফটক পার হয়ে এপারে এসে দেখেন ভোঁ-ভোঁ। কী-হল? মেয়েটা বাড়িতেই ঢুকল তো? কই নজরে পড়েনি তো। কিন্তু বাড়ি না ঢুকলে এই আঁধারে সে যাবেই বা কোন চুলোয়? ব্যস্ত-সমস্তভাবে ফিরে আসতে থাকেন ভদ্রাসনের দিকে লক্ষ্য হল গৃহিণী শঙ্খ হাতে বার হয়ে এসেছেন দাওয়ায়। তাঁকেই প্রশ্ন করেন, ছোটখুকি ফিরে এসেছে বাড়িতে?
গৃহিণী শাঁখ বাজাতে ভুলে গেলেন। কপালে করাঘাত করে বলেন, হা আমার পোড়া কপাল! কী মানুষ নিয়েই ঘর করছি। ছোটখুকি আজ দু-দিন জ্বরে বেহুঁস, সে খবরটাও ঘরের মানুষটা জানে না।
—জ্বরে বেহুস্! কে? ছোটখুকি?
গৃহিণী রামপ্রসাদের রাম-দা সমেত হাতখানি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলেন ঘরের ভিতর। দেখিয়ে দিলেন, ঐ দেখ’ সে নিজের চোখে!
বজ্রাহত হয়ে গেলেন রামপ্রসাদ। তাহলে কে ওঁর হাতে-হাতে দড়ি ফিরিয়ে দিল এতক্ষণ? আহা মুখখানি দেখা যায়নি। ডুরে শাড়ির আভাসটুকু দেখেছেন। বেড়ার ফাঁক দিয়ে চরণদুটি—তাতে আলতাপরা! বেহুস ছোটখুকির পায়ে আলতার চিহ্নমাত্র নাই।
রামপ্রসাদ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েন অসুস্থ কন্যার শয্যাপার্শ্বে। তাঁর দু-চোখে অশ্রুর বন্যা। মুখে বোল, এ তুই আমাকে কী ছলনা করলি দয়াময়ী পাষাণী!
বসে পড়েছেন কবিপত্নীও। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে। আধপাগ্লা নিয়ে ঘর করা যায়; এ যে বদ্ধ উন্মাদ!
.
যে-কথা আগে বলেছি, আবার তাই বলি : কালিকা দেবী স্বহস্তে রামপ্রসাদের বেড়া ফিরিয়ে দিয়েছেন কি দেননি তার উপর নির্ভর করে না সেই মহা-সাধকের মহিমা। তাঁর নামে সুপ্রচলিত অলৌকিক কাহিনীর এই লৌকিক-ব্যাখ্যা স্বজ্ঞানে দিতে বাধ্য হচ্ছি তাঁকে তুচ্ছ করতে নয়, তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে। রজ্জুতে যে ব্যক্তির সর্পভ্রম হয়, তার ‘সর্পজনিতভীতি’তে তিলমাত্র পার্থক্য হয় না। রামপ্রসাদ যে মা কালীকে কন্যারূপে লাভ করে ফোটা কদমফুলের মত রোমাঞ্চিতত হয়েছিলেন সেই আনন্দ অনুভূতি, সেই পরমপ্রাপ্তির তৃরীয়ভাব তো তিলমাত্র খাটো হচ্ছে না। ভক্ত রামপ্রসাদ তবু ভক্ত রামপ্রসাদই থাকছেন।
রামপ্রসাদের মৃত্যুর সম্বন্ধও এক অলৌকিক কাহিনী। এটাকে ‘অলৌকিক’ বলা ঠিক নয়। অনেক সাধক নিজের লীলা সম্বরণের বিষয়ে পূর্বাহ্নেই ইঙ্গিত পান। এ নিয়ে উনবিংশ শতকের অনেক ভারতীয় সাধকের নানান কাহিনী প্রচলিত। বিংশ শতাব্দীতেও তা আছে, আমাদের জমানায়। স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রীঅরবিন্দ নিজেদের তিরোভাবের ইঙ্গিত পূর্বেই জানিয়েছিলেন।
ফলে রামপ্রসাদের সম্বন্ধে ঐ প্রচলিত কাহিনীটি অসাধারণ হলেও অলৌকিক নয়।
রামপ্রসাদের তখন পরিণত বয়স—একষট্টি। সেটা 1781 সালের কার্তিক মাস। ভক্তকবির জীবনের শেষ কালীপূজা। সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন তিনি। সারাদিন উপবাস করে কালীপূজা সম্পন্ন করলেন।
তারপর মায়ের সামনে স্বরচিত একটি গান গাইলেন কবি। এটাই তাঁর শেষ রচনা :
“তারা! তোমার আর কি মনে আছে?
ওমা, এখন যেমন রাখলে সুখে, তেমনি সুখ কি পাছে?
শিব যদি হন সত্যবাদী, তবে কি তোমায় সাধি, মা গো?
ওমা ফাঁকির উপরে ফাঁকি, ডান চক্ষু নাচে।।
আর যদি থাকিত ঠাঁই, তোমাকে সাধিতাম নাই, মাগো।
ওমা, দিয়ে আশা, কাটলে পাশা, তুলে দিয়ে গাছে।।
প্রসাদ বলে মন দড়, দক্ষিণার জোর বড়, মা গো।
ওমা, আমার দফা হল রফা, দক্ষিণা হয়েছে।।”
গানের মধ্যে কেমন যেন অমঙ্গলের সুর। রামমোহন এগিয়ে এসে বাবা-মশায়ের হাতখানি ধরে বললে, এবার উঠে আসুন। সারা দিন-রাত উপবাসে আছেন, আর গান নয়।
কবি হেসে বলেন, হ্যাঁ রে রাম, ঠিক বলেছিস্! আর গান নয়। গানের পালা সাঙ্গ হয়েছে আমার। ‘দক্ষিণা’ যে হয়ে গেল।
—আসুন, উঠে আসুন। এবার বিসর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে।
হঠাৎ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, হ্যাঁ, বিসর্জন! চল ঘাটে যাই।
—না! আপনার যাওয়া হবে না। আমরাই বিসর্জন দিয়ে আসব।
কবি মাথা নেড়ে বলেন, কী পাগলের মতো কথা বলিস্। আজ যে বিসর্জন! মায়ের সঙ্গে ছাঁ-ও যাবে। তোরা আয়, মা কে নিয়ে আয়। আমি ঘাটের দিকে চললাম!
হঠাৎ গৃহিণীর দিকে ফিরে বললেন, পেন্নাম করবে তো করে নাও। আমি কিন্তু আর ফিরছি না!
শিউরে উঠলেন কবিপত্নী। বলেন, ওমা! সে আবার কি কথা?
শুনলে না, আজ বিসর্জন! দক্ষিণা হয়ে গেছে যে! ‘আমার দফা, হল রফা, দক্ষিণা হয়েছে।’
কারও নিষেধ কোনদিন মানেননি। যা মন চেয়েছে চিরটাকাল তাই করেছেন। কালীপ্রতিমার সঙ্গে নাচতে নাচতে চললেন গঙ্গার দিকে। দরাজ গলায় গান গাইতে গাইতে। এ গান তিনি নাকি কালি-কলমে রচনা করেননি। শেষ বিসর্জনের যাত্রাকালে উপস্থিত-কবির মতো রচনা করে গাইতে গাইতে গিয়েছিলেন :
“কালীগুণ গেয়ে
বগল বাজায়ে
এ তনু তরণী ত্বরা করি চল ধেয়ে
ভবের ভাবনা কিবা মনকে কর নেয়ে।।”
বিসর্জনের পর গঙ্গাস্নান করে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরে। সবাই তাই ফিরল। শুধু কবি আর ফরলেন না তাঁর খেলা-ঘরে। ফিরে গেলেন মায়ের কোলে। চিরশান্তির রাজ্যে।