নয়
তারাপদ কান্নার আবেগে হাত ছেড়ে দিচ্ছিল প্রায়, আচমকা তার খেয়াল হল, হাত ছেড়ে দিলেই পরী চলে যাবে। কালকের মতন অবস্থা হবে তা হলে, পরীর আত্মা আর এই ঘরে থাকবে না। ওই মেয়েটি–যার মধ্যে দিয়ে পরীর আত্মা এসেছে-টেবিলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়বে, অজ্ঞান হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতি জ্বলে উঠবে। ভুজঙ্গভূষণ আজ আর ক্ষমা করবে না। ভীষণ রেগে যাবে।
কথাটা খেয়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে তারাপদ মেয়েটির হাত আরও জোরে চেপে ধরল। চন্দনের হাতও ছাড়ল না।
ভুজঙ্গভূষণ সামান্য অপেক্ষা করলেন। তারাপদর কান্না শুনতে-শুনতে তাকে যেন সময় দিলেন সামলে নেবার।
তারাপদ নিজেকে খানিকটা সামলে নিল।
ভুজঙ্গভূষণ পরীকে উদ্দেশ করেই বললেন, “তোমার নামটা আমার মনে পড়ছে না। বেণুর মেয়ে বলেই তোমায় আমি জানি।”
তারাপদ জড়ানো গলায় বলল, যেন ভুজঙ্গভূষণের ওপর রাগ করেই, “ওর নাম পরী । পরী আমার বোন। একটি মাত্র বোন।”
ভূজঙ্গভূষণ কান দিলেন না তারাপদর কথায়। পরীকেই বললেন, “তুমি একলা এসেছ? যদি একা এসে থাকো, চুপ করে থেকো যদি সঙ্গে কেউ এসে থাকে–ঘণ্টা বাজিয়ে। একবার ।…তুমি একলা এসেছ?”
ক’ মুহূর্ত কোনো শব্দ হল না। তারপর ঘণ্টা বাজল। একবার ।
ভূজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার সঙ্গে কে এসেছে? বেণু, না বিষ্ণু? শোনো, মন দিয়ে শোনো, আমার কথার জবাবে যদি হ্যাঁ হয়–তবেই একবার ঘণ্টা বাজাবে; যদি না হয় তবে চুপ করে থাকবে–ঘণ্টা বাজাবে না। বুঝলে? এখন বলল, তোমার সঙ্গে কে এসেছে? বেণু?”
একবার ঘণ্টা বাজল।
তারাপদ বুঝতে পারল, মা এসেছে।
চন্দন অন্ধকারে চোখের পাতা খুলল। তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না। এত অন্ধকার চন্দন আর কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না, অন্ধ হয়ে গেলে কি মানুষ চোখে এই রকম অন্ধকার দেখে সর্বক্ষণ? চন্দনের মনে হচ্ছিল খুব ঘন কালো কোনো কালিতে ব্লটিং পেপার চুবিয়ে কেউ যেন তার চোখে চাপা দিয়ে কাপড়ে চোখ বেঁধে দিয়েছে। না, তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করা বৃথা তাতে চোখের মণি টনটন করে ওঠে। চোখ বন্ধ করল চন্দন। মেয়েটির হাত ঠিক আছে, নড়েনি। পায়ের আঙুলও ঠিক রয়েছে, আঙুলে-আঙুলে ছোঁয়ানো আছে। চন্দন ঠিক বুঝতে পারল না, মেয়েটির আঙুল এরকম শক্ত শক্ত লাগছে কেন? হাড় ছাড়া আঙুলে কিছু নেই নাকি?
ভুজঙ্গভূষণের গম্ভীর গলা শোনা গেল। স্পষ্ট করে টেনে টেনে কথা বললেন, “বেণু, তুমি আজ আবার এসেছ, আমরা খুশি হয়েছি। কাল তোমার ছেলে একটু ভুল করে ফেলেছিল। ও ছেলেমানুষ, অত বোঝেনি। তা ছাড়া তারাপদ ভয় পেয়েছিল। ওর কোনো দোষ নেই। ও কেমন করে জানলে তোমরা আত্মা হয়ে সূক্ষ্ম শরীরে অন্য লোকে বাস করছ? ওকে তুমি ক্ষমা করো।”
তারাপদও মনে মনে মা-র কাছে ক্ষমা চাইল । মা, আমায় ক্ষমা করো। “বেণু, তুমি জানো কেন আমি তোমার ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছি?” ভুজঙ্গভূষণ বললেন।
সঙ্গে-সঙ্গে না হলেও ঘণ্টা বাজল।
“তুমি তা হলে জানো!…আমারই ভুল। তোমায় কেন বোকার মতন কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। তোমাদের কিছুই অজানা থাকে না । ভূত-ভবিষ্যৎ সবই তোমরা জানো। তবু, দু-একটা কথা বলি। তোমার ছেলেও শুনুক।” বলে ভুজঙ্গভূষণ একটু চুপ করে থাকলেন তারপর বললেন, “বেণু, তুমি জানো আমার তিনকুলে কেউ নেই। আমার এই ঘরবাড়ি ছাড়াও অনেক সম্পদ আছে। আমার যা কিছু আছে–স্থাবর অস্থাবর সব আমি তোমার ছেলেকে দিয়ে যাব স্থির করেই তাকে ডেকে আনিয়েছি। কিন্তু আমার দুটি শর্ত আছে। এই শর্ত তাকে পালন করতে হবে। যদি শর্ত মানে, এ-সবই তার যদি না মানে, সে একটা পাই পয়সাও পাবে না। যেমন এসেছে সেই ভাবে তাকে ফিরে যেতে হবে।”
আচমকা ঘণ্টাটা বেয়াড়া ভাবে বেজে উঠল, না থেমে, কোনো রকম ছন্দ না মেনে। শব্দটা এমনই যে কানে লাগে। মনে হয়, কেউ বুঝি প্রবল কোনো আপত্তি জানাচ্ছে।
ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টার শব্দটা শুনে কী বুঝলেন কে জানে, বললেন, “বেণু, তুমি অমন করছ কেন? কী হয়েছে?”
আবার সেই একইভাবে একটানা ঘণ্টা বেজে গেল। তারপর থামল।
ভুজঙ্গভূষণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “বেণু, তোমার সঙ্গে কি অন্য কেউ এসেছে? কে এসেছে? বিষ্ণু?”
এবার আর ঘণ্টা বেয়াড়াভাবে বাজল না। একবার মাত্র বাজল।
তারাপদ বুঝতে পারল, তার বাবাও এসেছে। বাবা, মা, পরী–সবাই এসে হাজির হয়েছে। চোখ বুজেই ছিল তারাপদ। তার মনে হল, যদি এমন হত–চোখ খুললেই তিনজনকে দেখতে পেত,তা হলে তার কী আনন্দই না হত, কিন্তু তা তো দেখতে পাবে না। তা ছাড়া সে-সাহসই বা তার কোথায়? তবু সকলে এসেছে জেনে তারাপদর মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
“বিষ্ণু, তুমি এসে ভাল করেছ,” ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমরা যে সবাই আসবে আজ–আমি ভাবতেও পারিনি। এসে ভাল করেছ। তোমাদের ছেলেকে আমি আমার যথাসর্বস্ব দিয়ে যেতে চাই। আমার যাবার দিন হয়ে এসেছে। আগামী অমাবস্যার পর ইহজগতে আমি আর থাকব না। তোমাদের কাছে চলে যাব ।..যাক, কাজের কথাটা আগে বলে নিই। তারাপদকে আমি সব দিয়ে যাব–কিন্তু দুটো শর্ত রয়েছে। আমার প্রথম শর্ত হল তারাপদকে তার আগের জীবনের কথা ভুলতে হবে। আমি জানি, মানুষ তার অতীত ভুলতে পারে না। সে-ভাবে আমি তাকে কিছুই ভুলতে বলছি না। আমি বলছি–সে আর কলকাতায় ফিরে যেতে পারবে না। পুরনো কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। এই বাড়িতে এখানে তাকে থাকতে হবে, বরাবরের মতন।”
তারাপদ চমকে উঠল তাই কি সম্ভব নাকি? কী বলছে ভুজঙ্গভূষণ? তারাপদ কলকাতায় ফিরে যাবে না? কলকাতার কথা, বন্ধুবান্ধবের কথা, চন্দনের কথা–সব ভুলে যাবে? অসম্ভব। তারাপদ বাঁচবে কী করে?
“আমার দ্বিতীয় শর্ত, ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমার মৃত্যুর পর তারাপদকে আমার জায়গায় বসতে হবে। আমি জানি তার কোনো সাধনা নেই, শিক্ষা নেই, আমাদের তন্ত্র-মন্ত্র সে জানে না। তবে সবই ধীরে ধীরে সে জেনে নেবে। তার মন যদি বশ করতে পারে, এই সাধনার কিছু কিছু সে জেনে নিতে পারবে। তারপর ধ্যান আর সাধনার মধ্যে দিয়ে একদিন সবই তার আয়ত্ত হবে।…এই আমার শর্ত।”
তারাপদ স্তব্ধ। তার বুকের অস্বস্তি হচ্ছিল। উত্তেজনা, ভয়, প্রতিবাদ, অসম্মতি সব যেন একসঙ্গে তার বুকের মধ্যে জমে যাচ্ছিল, গলায় এসে উঠছিল। তারাপদ বলতে যাচ্ছিল–না না,–সে এ-সব শর্ত মানতে রাজি নয়। তারাপদ ভুজঙ্গভূষণের মতন কাপালিক হতে চায় না। বটুকবাবুর মেস তার পক্ষে অনেক ভাল। সেখানে সে স্বাধীন। এই পরাধীনতা সে চায় না।
তারাপদ কিছু বলতে যাচ্ছি, তার আগেই ভুজঙ্গভূষণ কথা বললেন। “বিষ্ণু, তুমি কি চাও না, তোমার ছেলে আমার শর্তে রাজি হয়? যদি তোমার আপত্তি থাকে তুমি ঘণ্টাটা একবার বাজাও, যদি তুমি রাজি থাকো দু’বার বাজাবে। মনে রেখো, তুমি রাজি থাকলে দু’বার বাজাবে।”
তারাপদ উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বুক এত জোরে ধকধক করছে যে, নিজের কানেই সে শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল।
সেই অন্ধকার স্তব্ধ ঘরে দু’বার ঘণ্টা বেজে উঠল। তার মানে তারাপদর বাবা বিষ্ণুপদ রাজি।
তারাপদ কিছুই বুঝল না, চেঁচিয়ে উঠে বলল, “না, না।”
ভুজঙ্গভূষণ গম্ভীর গলায় বললেন, “চুপ করো, তুমি এখন কথা বলো না। তোমার মা বাবা কী বলছেন আগে সেটা শোনো। তারপর তোমার যা বলার বলো।” বলে ভুজঙ্গভূষণ গলার স্বর পালটে তারাপদর মাকে যেন জিজ্ঞেস করছেন, বললেন, “বেণু, তোমার কী ইচ্ছে বলো? তুমি কী চাও–তোমার ছেলে এই ঘরবাড়ি, সম্পত্তি, সুখ সমস্ত ফেলে দিয়ে কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াক? কোনো মানুষ যা স্বপ্নেও ভাবে না-তোমার ছেলেকে আমি নিজের হাতে তা দিয়ে যেতে চাই। বলো, তুমি কী চাও? কী তোমার ইচ্ছে?”
ঘর একেবারে স্তব্ধ। তারাপদ ঘেমে উঠছিল। মা-ও কি সম্মতি জানাবে?
খুবই আশ্চর্য, সামান্য পরে ধীরে ধীরে ঘন্টাটা বেজে উঠল। একবার নয়, দু’বার ।
তারাপদ নির্বাক। তার সমস্ত কথা হারিয়ে গেছে। চন্দনের হাতটা জোরে চেপে রাখল তারাপদ। তার হাত ভিজে গিয়েছে।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বিষ্ণু, বেণু–তোমরা বাবা-মা হিসেব তোমাদের ছেলেকে যা ভাল, যাতে তার ভাল হবে–তাই করতে বলেছ। তোমাদের ওপর আমি খুশি হয়েছি। তবু তোমরা আর-একটু কি থাকতে পারো না? আমি তোমাদের সামনে তোমাদের ছেলের সঙ্গে দুটো কথা বলে নিতে চাই।”
ঘণ্টা বাজল না। তারাপদ বুঝতে পারল না, বাবা-মা আছে না চলে গেল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ তোমার মা বাবার ইচ্ছে তুমি শুনলে। এখন বলো, কী তুমি বলতে চাও।”
তারাপদ ভাবছিল কী জবাব দেবে। সে এখানে থাকবে না। কিছুতেই নয়। কিন্তু মা বাবা যদি চান তারাপদ এখানে থাকুক, তা হলে সে কী করবে? ঠিক এই মুহূর্তে তার মাথায় যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ঘণ্টাটা আস্তে আস্তে বেজে উঠল, বেজে বেজে যেন দুরে কোথাও মিলিয়ে গেল।
ভুজঙ্গভূষণ কথা বললেন, “তোমার মা বাবা-বোন চলে গেল তারাপদ। ওরা চলে গেল।” বলার পর গম্ভীর মৃদুস্বরে তিনি একটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, মনে হল, আত্মাদের বিদায় জানালেন।
ঘরের বাতি জ্বলল। মাথার ওপরকার ফিকে আলো ।
তারাপদ চোখ খুলল । চন্দনও তাকাল। চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝাপসা। ধীরে ধীরে দৃষ্টি পরিষ্কার হল সামান্য।
মেয়েটি হাত টেনে নিল, পা সরিয়ে নিল। কোনো দিকে তাকাল না। মুখ মাথা নিচু করে থাকল। তবু তার ফরসা মুখ আরও সাদা ভিজে ভিজে দেখাচ্ছিল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারাপদ একবার মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। কেমন যেন ঘুম-জড়ানো চোখ, আচ্ছন্নের মতন লাগছে।
ঘুমের মধ্যে যেন হেঁটে যাচ্ছে এইভাবে চলে গেল মেয়েটি।
মেয়েটি চলে যাবার পর ভুজঙ্গভূষণ আবার কথা বললেন। তাঁর দিকের সেই লাল আলো এখন আর জ্বলছে না। ঝাপসা অন্ধকারে ভৌতিক চেহারা নিয়ে তিনি বসে আছেন। ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ, তোমার যা বলার আছে বলো।”
তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনকে খানিকটা অন্যমনস্ক দেখাল। চোখাচোখি হওয়া সত্ত্বেও সে কোনো রকম ইশারা করল না।
তারাপদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমি এখানে কেমন করে থাকব?”
“কেন?”
“কলকাতা ছেড়ে আমি কখনো থাকিনি। আমার বন্ধুবান্ধব, চেনা-জানা যারা, তারা সবাই কলকাতায় থাকে। তাদের ছেড়ে আমি এখানে একা একা কেমন করে থাকব?”
“একা একা কেন থাকবে, এই বাড়িতে লোকজন কম নেই, এরা থাকবে।” তারাপদ শুকনো গলায় ঢোক গিলল। “আমার মন টিকবে না।”
“প্রথম প্রথম টিকবে না, তারপর টিকে যাবে। আমার কেমন করে টেকে?”
“আপনি কতকাল ধরে এখানে আছেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা রয়েছে–আপনি সাধনা করেন, কত বছর ধরে তন্ত্র-টন্ত্রর সাধনা করে আসছেন। আমি কিছু জানি না। আমার ওসব জিনিস পছন্দও হয় না। আমি কেমন করে আপনার মতন সাধক হব?”
ভুজঙ্গভূষণ শান্ত গলায় বললেন, “সে-চিন্তা আমার। তোমায় যে অনেক কিছু শেখাতে হবে–তা আমি জানি। তার ব্যবস্থাও আমি করেছি।”
তারাপদ আবার চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনও তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলল না তারাপদ; পরে বলল, ধরুন যদি এমন হয়, আজ আমি আপনার শর্তে রাজি হলাম, তারপর আপনি যখন থাকবেন না–তখন শর্ত ভাঙলাম–তখন কী হবে?”
ভুজঙ্গভূষণ স্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি তোমার মা বাবার মনের ইচ্ছে জেনেছ। কাল আবার আমি ওদের ডাকব। ওই আত্মাদের কাছে তোমায় শপথ করতে হবে।…তারাপদ, মৃত পিতা-মাতার আত্মার সামনে শপথ করে সেই শপথ যদি তুমি ভাঙো, তার পরিণতি যে কী হবে–তুমি কল্পনাও করতে পারছ না। তোমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।..তা ছাড়া, আমার নির্দেশ আছে, অন্তত তিন বছর তুমি পুরনো সমস্ত সংসর্গ থেকে দূরে থাকবে। এই বাড়িতে তোমায় থাকতে হবে। কোথাও যাবে না। এখানে সাধনা করবে। যদি তিন বছর তুমি আমার নির্দেশ-মতন থাকতে পারো, তবেই তুমি আমার সমস্ত কিছুর একমাত্র উত্তরাধিকারী হবে। নয়ত নয়। আর এই তিন বছর তোমার থাকা, খাওয়া-পরার কোনো কষ্ট হবে না, দরকার পড়লে কিছু কিছু টাকা তুমি খরচ করতে পারবে। তিন বছর পরে তুমি বিষয়সম্পত্তি পেয়ে যা খুশি করতে পারো। কিন্তু মনে রেখো, তোমার মাথার ওপর আত্মারা থাকবে–তোমার মা-র, বাবার, আমার ।…তিন বছর পরে আমার বিশ্বাস, তুমি আজ যা ভাবছ তা আর ভাবতে পারবে না।”
তারাপদ কোনো কালেই অঙ্ক জিনিসটা বোঝে না; তার মাথায় ফন্দি ফিকিরও খেলে না। তবু ভুজঙ্গভূষণের কথা থেকে বুঝতে পারল, লোকটি ভীষণ চতুর, সবদিক দিয়েই পথ আগলে রেখেছে।
তারাপদ চুপ। কী বলবে? সরাসরি না করে দেবে? কী দরকার তার এত সম্পত্তিতে? কোন দুঃখে সে তান্ত্রিক-টান্ত্রিক হতে যাবে? কেনই বা সে ভুজঙ্গভূষণের মতন আত্মা-টাত্মা নামাতে যাবে? সে যা আছে–এই কি যথেষ্ট নয়? সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল সাধুমামার কথা, কিকিরার কথা। সবাই তাকে বলেছেন, ভুজঙ্গ শয়তান, ভুজঙ্গ পাপী। সাধুমামা মিনতি করে বলেছেন, বাবা
তুমি আমাদের এই নরক থেকে উদ্ধার করো। কেমন করে উদ্ধার করবে। তারাপদ? তিন বছর এই পুরীতে নিজে বন্দী থেকে সমস্ত কিছু নিজের আওতায় আনার পর? কিন্তু আত্মা? মা-বাবার মৃত আত্মার সামনে শপথ নেবার পর সে কি অমন কাজ করতে পারবে? . তারাপদ কথা বলছে না দেখে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তুমি মন স্থির করতে পারছ না?”
বিড়বিড় করে তারাপদ বলল, “আমায় ভাববার একটু সময় দিন।”
“বেশি সময় তোমায় কেমন করে দেব। আমার সামনেও যে সময় নেই। তুমি কি কোনো সন্দেহ করছ তারাপদ? তোমার মা-বাবার আত্মার ইচ্ছে কি পূরণ করতে মন চাইছে না?”
তারাপদ কিছু খেয়াল না করেই বলল, “আত্মা কি কথা বলে না?”
“না। কখনো-সখনো এক-আধটা কথা কেউ বলেছেন। আমি কাউকে কথা বলতে দিতে চাই না।”
“আমার মা-বাবা যদি একটা কথা বলতেন।”
‘তারাপদ, আত্মারা তোমারা আমার মতন স্কুল দেহ নিয়ে থাকেন না। সূক্ষ্ম আত্মা, সে প্রায় বাতাসের মতন। তাঁদের দিয়ে কথা বলাবার চেষ্টা না করাই উচিত। যিনি বাতাসের আকার নিয়ে থাকেন, তাঁকে সবাক করা উচিত নয়। তাতে তাঁদের বড় কষ্ট হয়।…তবে আমি একটা কাজ করতে পারি। আত্মারা
যে কখনো কখনো নিজেদের আসা-যাওয়ার চিহ্ন রেখে যান, সে-প্রমাণ আমি তোমায় দেখাতে পারি? দেখবে?”
তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনের চোখে কৌতূহল।
তারাপদ বলল, “দেখব। “
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেশ। তুমি দেখতে চেয়েছ যখন আমি দেখাব। ওই ঘন্টাটা আমার কাছে দিয়ে যাও।”
তারাপদ উঠল। ঘন্টাটা চন্দনের পায়ের দিকে, যেদিকে চন্দন আর মেয়েটি পায়ে পা ছুঁইয়ে বসেছিল। চন্দন মাটিতে হাত নামিয়ে ঘণ্টাটা তুলে দিল। তারাপদ ঘন্টা হাতে করে ভুজঙ্গর সামনে গিয়ে হাত বাড়াল ।
ভুজঙ্গভূষণ ইশারা করে ঘন্টাটা নিচে নামিয়ে রাখতে বললেন।
তারাপদ ঘণ্টা নামিয়ে রাখল। রেখে নিজের জায়গায় ফিরে আসার সময় শুনল ভুজঙ্গ ঘণ্টা বাজালেন। তাঁর মাথার দিকে টকটকে লাল আলো জ্বলে উঠল আবার। তারাপদদের ওপরকার আলো নিবে গেল। আর কী আশ্চর্য, ভুজঙ্গভূষণের পেছন দিক থেকেই পরদার আড়াল সরিয়ে সাধুমামা এলেন। তারাপদদের দিকে তাকালেন না সাধুমামা, বাধ্য অনুগত চাকরের মতন ভুজঙ্গর সামনে মাথা নিচু করে আদেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ভুজঙ্গভূষণ হাতের ইশারায় তাঁর সামনের নিচু টেবিলটার দিকে দেখালেন। নিচু গলায় কী যেন বললেন, শুধু ‘মোম’ শব্দটা কানে গেল তারাপদর। সাধুমামা টেবিলের ওপর থেকে সামান্য লম্বা গোল মতন অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রটা নিয়ে চলে গেলেন। কাঁচের গোল বয়ামটা পড়ে থাকল। তার মধ্যে যেন জল, অর্ধেকের বেশি বয়ামটা ভরতি।
ভুজঙ্গভূষণ তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমি কতটা সাহসী?” কথার মধ্যে যেন একটু ঠাট্টার ভাব ছিল।
তারাপদ কথার জবাব দিল না। সে সাহসী নয়। ঘরের মধ্যে যা ঘটছে, তা সহ্য করার মতন মনের জোরও তার থাকার কথা নয়। তবু, দু দিনের পর–আজ তৃতীয় দিনে কেমন করে সে সাহস দেখাতে পারছে–সে নিজেই জানে না।
“তোমার বন্ধুর সাহস বোধ হয় বেশি।”–ভুজঙ্গ চন্দনকে লক্ষ করে বললেন। “ডাক্তার লোক..আমার এখানে ভয় পাবার মতন কিছু নেই, তবু লোকে ভয় পায়। ভয় পায় কেন জানো? যারা ইহলোকের মানুষ, তারা পরলোকের কথা বোঝে না। পরলোক থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদেরও বুঝতে পারে না। যা অজ্ঞেয়, তাকে মানুষ ভয় করে। তবে আত্মারা সচরাচর কারও ক্ষতি করেন না, যদি না আমরা তাঁদের বিরক্ত করি, অশ্রদ্ধা করি। কখনো কখনো কোনো দুষ্ট আত্মা হঠাৎ এসে যান। তাঁরাই বড় ভয়ংকর। তাঁরা কাউকে ভর করলে বিপদে পড়তে হয়। যাক, আবার একবার আমি চেষ্টা। করে দেখি তারাপদ–যদি কাউকে আনতে পারি। একটা কথা মনে রেখো, আত্মারা আমাদের ইচ্ছাধীন নন, আমরাই তাঁদের ইচ্ছাধীন। তোমার মা বাবাকে আজ অনেকক্ষণ আমরা ডেকে এনে কাছে রেখেছিলাম। এভাবে থাকতে ওদের বড় কষ্ট হয় । জানি না ওরা আর আসবে কিনা! তুমি কাকে আনাতে চাও আমি জানি না। “
তারাপদর মনে হল, মা-বাবার হয়ত কষ্ট হবে আসবে। হতেও তো পারে।
তারাপদ আচমকা বলল, “পরী আসবে না?”
“পরী?”
“পরীকে দেখতে আমার বড় ইচ্ছে করে। সে যদি একবার আসত.” বলতে বলতে আবেগে গলা ধরে গেল তারাপদর।
ভুজঙ্গভূষণ অল্প নীরব থেকে বললেন, “তুমি যে-পরীকে দেখেছ সেই পরী–তোমার সেই ছোট্ট পরী কি এখনও অতটুকু আছে! আত্মা অমর, তার কোনো পরিবর্তন থাকে না–তবু নিজেদের মতন করে তারা কিছুটা বদলে যায়।…ঠিক আছে, আমরা পরীকেই ডাকব। যদি সে আসে–এই ঘরে তার আসার চিহ্ন রেখে যাবে। তোমাদের আমি সাবধান করে দি, এবার যে আসবে–সে সরাসরি আসবে, মিডিয়ামের মধ্যে দিয়ে নয়, তোমরা কোনো রকম নড়াচড়া করবে না, কথা বলবে না, কিছু ধরবার চেষ্টা করবে না–আত্মাকে ধরার চেষ্টা করা মুখ । শান্ত, ধীর-স্থির হয়ে বসে থাকবে–। দেখো কী। হয়! পরী আসে কি আসে না।”
সাধুমামা আবার ফিরে এলেন। সেই পাত্রটা ভুজঙ্গভূষণের টেবিলের সামনে নামিয়ে রাখলেন। ভুজঙ্গ ঘরে আরও কিছুটা ধুনো-গুগগুল দিয়ে দিতে বললেন। ঘরের কোণে কোণে ধূপের বাটি ছিল ঢাকা, ধূপ দিতে বললেন।
সবাই যেন তৈরি ছিল। সাধুমামা চলে যেতেই মৃত্যুঞ্জয় এল। তার দু হাতে ধোঁয়া-ওঠা ধুনোর পাত্র। গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ঘরে ধোঁয়া দিয়ে সে পাত্র দুটো আড়ালে রেখে দিল। একটুও আগুন বা আভা দেখা গেল না। বাটিতে ধূপ এনে সাধুমামা ঘরের কোণে আড়াল করা জায়গায় রেখে গেলেন। ধূপের আগুনও চোখে পড়ল না।
ঘরের সমস্ত বাতি নিভে গেল। ঘোর অন্ধকার । কোথাও এক বিন্দু আলো নেই। ভুজঙ্গভূষণ তাঁর জলদগম্ভীর গলায় আশ্চর্য সুরে দীর্ঘ এক সংস্কৃত মন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন। গানের সুরের মতন লাগছিল। ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, ধুনোর গন্ধ, গুগগুলের গন্ধ, ধূপের তীব্র এক গন্ধেও ঘর ভরে উঠল।
ভুজঙ্গভূষণ মন্ত্রের মতন করে সেই শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে শেষ পর্যন্ত থেমে গেলেন কিছুক্ষণ পরে বললেন, “যাকে আনতে চাইছ, তাকে চোখ বন্ধ করে একমনে ডাকো, তারাপদ। কোনো কথা বলো না। তোমরা কেউ কাউকে স্পর্শ করো না।”
তারাপদ পরীকে মনে মনে ভাবতে লাগল। ডাকতে লাগল। পরী-পরী সেই ছোট্ট পরী।
চন্দন চোখ খোলার চেষ্টা করল বার কয়েক। পারল না। যেন পাতালের তলায় তারা কোথাও নেমে গেছে, ঘটুঘুট করছে অন্ধকার।
কোনো শব্দ নেই, আলোর একটি ফোঁটাও কোথাও নেই। সময় বয়ে যাচ্ছে। এর যেন শেষ নেই। তারাপদ কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পরীকে ভাবতে লাগল।
কতক্ষণ যে কেটে গেল খেয়াল নেই। হঠাৎ ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমি ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। কে একজন এসেছে! কে?”
তারাপদ সচেতন হল। চন্দনও।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “পরী, তুমি যদি এসে থাকো, তোমার দাদার কাছে যাও। তাকে ওই গন্ধ, তোমার বয়ে আনা গন্ধ তাকে জানতে দাও মা।”
তারাপদ একেবারে ধীরস্থির হয়ে বসে থাকল। বুক কাঁপছে। তবু সে অধৈর্য।
পরী আসছে না। কেন আসছে না? তার দাদা তাকে ডাকছে–তবু কেন আসছে না?
একেবারে আচমকা তারাপদর নাকে এক গন্ধ ভেসে এল। কোন ফুলের গন্ধ সে বুঝতে পারল না। চাঁপা ফুলের মতনই অনেকটা।
পরী এসেছে। তারাপদ থরথর করে কাঁপতে লাগল। পরী এসেছে। পরী, পরী, সোনা বোন আমার।
আবেগে তারাপদ যখন কেঁদে ফেলেছে, হঠাৎ তার গালের পাশে পরীর চুলের ছোঁয়া পেল। তারপর আর নয়। ছোঁয়া নয়। গন্ধটাও ফিকে হয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “পরী, তুমি যে এই ঘরে এসেছিলে তার কিছু চিহ্ন রেখে যাও। তোমার দাদা সামান্য কিছু চিহ্ন চায়। আমার সামনে মোমের পাত্র আছে। তোমার হাতের কিছু চিহ্ন রেখে যাও মা। অন্তত একটা-দুটো আঙুলের।”
আবার সব নিস্তব্ধ।
অনেকক্ষণ পরে জঙ্গভূষণ বললেন, “পরী চলে গেছে। আমি আর কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।”
আরও সামান্য সময় গেল । ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা নাড়লেন। তারাপদদের মাথার ওপরকার বাতি জ্বলে উঠল।
তারাপদ আর চন্দন অন্ধের মতন বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে তাদের চোখ ফুটল।
ভুজঙ্গভূষণ সামনের টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “তারাপদ, তোমার বোন পরী এসেছিল। ওই দেখো সে তোমার জন্যে তার আঙুলের ওই চিহ্ন রেখে গেছে।”
তারাপদ প্রায় পাগলের মতন সামনে ছুটে গেল। ভুজঙ্গভূষণের সামনের টেবিলে মোমের একটা আঙুল পড়ে আছে।
আঙুলটা নেবার জন্যে তারাপদ হাত বাড়াল।