৯. কথিত ত্রুটি-বিচ্যুতির পরও স্তালিন বিশ্ব বিপ্লবের নেতা
“যোসেফ স্তালিন হলেন বিশ্ব-বিপ্লবের নেতা, এটাই আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে মানবজাতি স্তালিনের আবির্ভাবে ধন্য। আমরা যখন তাকে পেয়েছি তখন সবই সুচারুরূপে সম্পন্ন হবে। মার্কস আজ জীবিত নেই, তেমনই জীবিত নেই এঙ্গেলস ও লেনিন। যদি স্তালিন না থাকতেন তাহলে কে আমাদের পরিচালনা করতেন? কিন্তু তাকে পাওয়া হলো প্রকৃতই আশীর্বাদস্বরূপ। এখন বিশ্বে বিরাজ করছে এক সোভিয়েত ইউনিয়ন, একটি কমিউনিস্ট পার্টি এবং একজন স্তালিন। অতএব বিশ্বের ঘটনাবলি সঠিক পথেই চলবে।”
(মাও সে তুঙ, ১৯৩৯ সালে চীনের ইয়েনানের একটি সভায় স্তালিনের ৬০তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে।
চেন পো-তা’র “স্তালিন এবং চীন বিপ্লব, পিকিং ১৯৫২, গ্রন্থে উদ্ধৃত)
“হিংস্রতা স্তালিনকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করত না, কারণ তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি ইতিহাসের রায় কার্যকরী করছেন।”
(মিলোভান জিলাস/ “স্তালিনের সঙ্গে কথোপকথন”, ১৯৫২)
“একনিষ্ঠতা, সংগঠন, কঠিন পরিশ্রম যা গত ৬০ বছরে রাশিয়াকে পরিবর্তন করেছে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান নিয়মকে বর্জন করে এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে এক সুসংহত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মারফত, এমনকি স্তালিনবাদী আখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও একজন রাজি নয় কোনো আদর্শগত ব্যাকমেইলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হাজার হোক, একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক অষ্টম হেনরির শাসনকালের প্রশংসা করতে পারেন তার দ্বারা তাঁর পত্নীদের শিরচ্ছেদ করার অপরাধকে খণ্ডন না করেও।”
(এ এইচ কার / নিউ লেফট রিভিয়ু পত্রিকার কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকার, লন্ডন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ২৫-৩৬)
স্তালিনের মতো ইতিহাসে খুব কম ব্যক্তিত্বই দেখা গেছে যার প্রতি একইসঙ্গে মাত্রাহীন তোষামোদ ও কুৎসিত আক্রমণ, উচ্চ প্রশংসা ও হীনতম নিন্দা, ঠিক যেন একদিকে দেবত্ব আরোপ এবং আর একদিকে দৈব অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে।
১৯৫৬ সালের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিংশতিতম কংগ্রেস শুরু হয়েছিল যাকে বলা হয় “নি-স্তালিনীকরণ’ দিয়ে, স্তালিনের এবং তাঁর তিরিশ বছরের সময়কালের (১৯২৩-৫৩), যখন তিনি ছিলেন সোভিয়েত রাষ্ট্রের কষ্টভোগ ও বিজয়ের মূর্ত প্রতীক, সব সাফল্যকে নির্মমভাবে বাতিল করার মধ্য দিয়ে। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের শত্রুরা একে ঈশ্বর প্রেরিত হাতিয়ার হিসেবে লুফে নিয়েছিল এবং তীব্রভাবে ব্যবহার করেছিল, বিশেষত হাঙ্গেরি (১৯৫৬) এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার (১৯৬৮) ঘটনাবলিজনিত সংকটকালে।
বোধহয় কিছুটা নিশ্চলতা’ যা সোভিয়েত জনগণের দীর্ঘকালীন দুঃখ-কষ্টের প্রেক্ষাপটে কোনোমতেই ব্যাখ্যা করা যায় না, গ্রাস করেছিল যখন লিওনিদ ব্রেজনেভ ছিলেন সোভিয়েতের শীর্ষ নেতা। এটাই ছিল একটা কারণ সোভিয়েত জনগণের মতাদর্শগত সতর্কতা শিথিল হয়ে যাওয়ার, যার ফলে নানা রকম অর্থলিপ্সা ও দুর্নীতি এবং অপরাধ প্রবণতা সোভিয়েতের জীবনে, এমনকি কঠোরভাবে সংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও অনুপ্রবেশ করেছিল। সাধারণ সম্পাদক আন্দ্রোপভ-এর মৃত্যুর পর, যিনি পচনশীলতাকে রোধ করতে কিছুটা সচেষ্ট হয়েছিলেন, দেখা দিয়েছিল সোভিয়েত নেতৃত্বের এক নতুন চেহারা গর্বাচভ, ইয়াকভলেভ, এমনকি ইয়েলেৎসিন, শেভারনাদজে, যাদের মার্কসবাদ লেনিনবাদ সম্পর্কে পরিচিতি ও সম্পর্ক ছিল অপরিণত এবং পলকা। স্বদেশে এক দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক নৈতিকতা ও মতাদর্শগত অধঃপতন এবং বিদেশে কয়েক দশকব্যাপী সমাজতন্ত্র-বিরোধী শক্তির অবিরত আক্রমণ মিলে মিশে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যেখানে বাহ্যত বিশ্বাসযোগ্য ও রুচিশীল তরুণ নেতা। গর্বাচভ সোভিয়েত রাষ্ট্রের হাল ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বিশ্বপটে প্রযুক্তির অগ্রগতি বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নতুন অপরিচিত মাত্রা যুক্ত করেছিল এবং এই সম্পের্কে সোভিয়েতের এক অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ এক জটিল সমস্যা সৃষ্টি করেছিল, যা কেবলমাত্র নতুনভাবে স্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত মার্কসবাদ-লেনিনবাদেই সমাধান করতে সক্ষম ছিল। শুরুতে মার্কসবাদী সতোর এক আকর্ষণীয় আবরণে ‘পেরেস্ত্রৈকা’ (পুনর্গঠন)-র আহ্বান জানানো হয়েছিল যাতে প্রধান পরিবর্তনগুলো সমাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে এবং তার বিশ্বব্যাপী অগ্রগতি সুনিশ্চিত করতে পারে।
তারপরে যা ঘটেছিল তা হলো ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে (১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সালে চুপচাপ কিন্তু আপাতদৃষ্টে প্রতীয়মান তারপর ১৯৮৮-৮৯ সালে প্রায় নির্লজ্জভাবে) মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে কার্যত পরিহার করে কিছু ধূর্ত ও মনোরঞ্জনকর ভেট দিয়েছিল পেরেস্ত্রৈকা। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে খানিকটা আশ্চর্যজনক যা ঘটেছিল তার প্রতি নিদ্রাচ্ছন্ন ছিল, এমনকি কয়েকটি পার্টি মৌন থেকে সম্মতিও জানিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ১৯৮৯-৯১ ঘটনাবলির বিস্ফোরণে প্রতিবিপ্লবের চেহারাকে ঢেকে রাখা যায়নি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দেয়া ও ‘প্রকৃত বিদ্যমান সমাজতন্ত্র’ রূঢ় বাস্তবতা হিসেবে দেখা দেয়। স্তালিন যুগের সমস্ত ঐতিহাসিক সাফল্যকে নির্মমভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে স্তালিনকে কলঙ্কিত করা ছিল খুব সূক্ষ্ম ও হীনভাবে লেনিনের স্তুতিকে হেয় করার (১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত ২৮তম সোভিয়েত পার্টি কংগ্রেসে লেনিনের “অত্যধিক প্রশংসা”-র বিরুদ্ধে জোর দেওয়া) পথে প্রথম পদক্ষেপ। এটা আন্তর্জাতিক স্তরে নিরন্তর সমাজতন্ত্র-বিরোধী প্রচারের লাইন অনুসারী যার প্রধান প্রবক্তা ফ্রান্সের এলেইনস্টাইন এবং পোল্যান্ডের কোর্লাকৌস্কি স্তালিনকে তীব্রভাবে আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে লেনিনের বিরুদ্ধেও বলতে শুরু করেছিলেন। কে জানে কোনো সৎ গবেষণা অদূর ভবিষ্যতে এই হীন চক্রান্ত উন্মোচিত করতে সাহায্য করবে কিনা যদি না বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটে। ইতোমধ্যে গর্বাচেভ অ্যান্ড কোং স্তালিনকে নিন্দা মন্দ করার সাথে সাথে একই তুলি দিয়ে সতর্ক অথচ ধূর্তভাবে লেনিনকে কালিমাযুক্ত করে তাদের অভীষ্টে এগিয়ে চলেছে। তারা গামলার ময়লা জলের সঙ্গে শিশুটিকেও বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। “আরো খোলামেলা, আরও গণতন্ত্র, আরও সমাজতন্ত্র”-র নামে সমাজতন্ত্রকেই পরিত্যাগ করছে। লেনিনের দেশকে ইতোপূর্বে ঘৃণিত মুনাফাবৃত্তির ক্রীতদাসত্বে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে এবং বাজার অর্থনীতি’-র সুখভোগের জন্য অপেক্ষা করছে। দুর্ভাগ্যের কথা, কাস্ত্রোর কিউবার মতো সাহসী ব্যতিক্রম ছাড়া বহু দেশে কমিউনিস্ট ও সোস্যালিস্ট পার্টিগুলোকে গণতন্ত্রের ঢাকের বাদ্যি এতই হতবুদ্ধ করে দিয়েছে অথবা এতই মতাদর্শ বিমুখ করে দিয়েছে যে, কার্যত প্রতিবিপ্লবের বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়াকে ঠেকাতে কিছুই করেনি।
অনেককাল আগে এইচ জি ওয়েলস লেনিন সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারের পর (১৯১৯) বলেছিলেন। “ক্রেমলিনের ছোট্ট মানুষটা” যার একটা স্বপ্ন ছিল এবং লিখেছিলেন একটি সংক্ষিপ্ত, অপরিচিত পুস্তিকা”! লেনিনের বিশ্ববীক্ষা আরও সঠিকভাবে উপস্থিত করেছিলেন যখন টমাস মান তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “নতুন গণতান্ত্রিক অতিকায় মাত্রার মানব অবয়ব, Wille aur Machth এবং কঠোর তপশ্চর্যার শক্তিশালী মিলন, চিন্তা-ভাবনার মহান পোপ।” অথবা আরও সহজভাবে রম্যা বঁল্যার ভাষায় আমাদের শতাব্দীর কর্মকাণ্ডের মহত্তম পুরুষ এবং একইসঙ্গে নিঃস্বার্থবাদী।’ উইনস্টন চার্চিল একদা লেনিনকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘এক মহান ত্যাগী।
সেই লেনিন ও তার উত্তরাধিকারকে ত্যাগ করার গর্বাচেভ কর্মসূচি প্রদর্শন করেছে ফন্দি আঁটার এক ধূর্ত কায়দা (প্রসঙ্গক্রমে, এক্ষেত্রে ফন্দি-আঁটা কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন কাস্ত্রো) শুরু হয়েছিল স্তালিনকে দিয়ে, তাঁকে চূড়ান্ত ভাবে কুৎসা করা হয়েছিল এবং শেষে সূক্ষ্ম কিন্তু নিশ্চিতভাবে লেনিনের মর্যাদাকেও আঘাত করা হয়েছিল । এটাই স্বাভাবিক, কারণ স্তালিন ইতিহাসের এক চরিত্র হিসেবে লেনিনের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারতেন না এবং কখনো স্বপ্নেও তাঁর উত্তরাধিকারী হতে পারতেন না, কিন্তু লেনিনের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বন্ধনে তিনি এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে স্তালিনকে কলঙ্কিত করা ছিল সহজেই লেনিনকে কলঙ্কিত করার প্রথম ধাপ ।
.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল রবিনস-এর সঙ্গে স্তালিনের কথোপকথন
এটা হতে পারে, মনুষ্য চরিত্র যেমন হয়, এবং ক্ষমতা, এক নাগাড়ে অবাধ ব্যক্তিগত ক্ষমতা সাধারণভাবে সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষেরও মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে, পারে স্তালিনেরও। কখনো কখনো মহত্ত্বের ক্ষতিকর মোহ চেপে বসেছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক, তাঁর পারিষদবর্গ ‘রাজার চেয়েও বেশি রাজভক্ত’ হওয়ার বাসনায় অতি উচ্ছ্বাসভরে স্তালিনকে মহিমান্বিত করেছিল। ১৯৫৬ সালে বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসে ক্রশ্চভ নিন্দা করেছিলেন স্তালিনের স্ব-আরোপিত ‘আজকের লেনিন’ বলে নিজেকে উল্লেখ করার। এটা স্পষ্ট স্তালিনের পার্শ্বচর মিকোইয়ানই, যিনি পরে সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন (১৯৪৯) ওই শব্দ সমষ্টি চয়ন করেছিলেন, যা তার পুরো ভাষণ সম্বলিত পুস্তিকার (১৯৪৯) শিরোনামে এই শব্দ সমষ্টি ব্যবহার করা হয়েছিল। জানা যায় যখন সরকারিভাবে স্তালিনের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশ করা হয় তখন স্তালিন ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জোরের সাথে বলেছিলেন- তিনি যা দাবি করেন তা হলো তিনি ছিলেন লেনিনের শিক্ষার বিশ্বস্ত অনুগামী ও অনুলেখক’ যে কারণেই ( তিনি তার একান্ত অনুগামীদের কাছে স্বীকার করেছিলেন) তাঁর গুণমুগ্ধরা তাকে প্রায়শই আজকের লেনিন’ বলে আখ্যাত করতেন। আবার সম্ভবত স্তালিন এই ব্যক্তি প্রশংসার মধ্যে প্রায়শই মহত্ত্বের ক্ষতিকর মোহে আবিষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু কখনই তার অবিশ্রান্ত বিপ্লবী জীবনকালে স্তালিন লেনিন সম্পর্কে তাঁর প্রথম ধারণা থেকে কখনো একবিন্দুও সরে আসেননি যে, লেনিন এক পর্বতারোহী ঈগল পাখি, যে অনায়াসে মাটি ছুঁতে পারে আবার সকলকে ছাড়িয়ে আকাশে উঠে যেতে পারে ।
সোভিয়েত ইতিহাসকে মুছে ফেলার এবং তার মর্মবস্তুকে বিকৃত করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একটু সামান্য প্রয়াস চালানো যেতে পারে ১৯৩৩ সালের ১৩ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল রবিনস-এর সঙ্গে স্তালিনের কথোপকথনকে স্মরণ করার :
“রবিনস : আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার এই সুযোগ লাভে নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি।
স্তালিন : এটা এমন কিছু নয়। আপনি একটু বাড়িয়েই বলছেন।
“রবিনস (হেসে) : আমার কাছে যা কৌতূহলোদ্দীপক বলে মনে হয়েছে তা হলো রাশিয়ার সর্বত্র আমি দেখছি লেনিন-স্তালিন, লেনিন-স্তালিন, লেনিন-স্তালিন বলে পরস্পরকে যুক্ত করা ।
“স্তালিন : ওটা একটু বাড়াবাড়ি। লেনিনের সঙ্গে আমার কী করে তুলনা হয়?’ (স্তালিন রচনাবলি, ত্রয়োদশ খণ্ড, মস্কো ১৯৫৫, পৃষ্ঠা ২৬৭)।
ইতোপূর্বে ১৯৩১ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন বিখ্যাত জার্মান লেখক এমিল লুডভিক স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাঁদের সাক্ষাৎকারে লিখেছিলেন :
‘স্তালিন : আমাকে ‘মহান পিটার-এর কাজের অনুলেখক’ বলার কোনো মানে হয় না। এর মধ্যে কোনো ঐতিহাসিক সমান্তরালও নেই। লেনিন এবং মহান পিটার প্রসঙ্গে বলতে গেলে শেষোক্ত ছিলেন সমুদ্রে একটি জলবিন্দু, আর লেনিন। ছিলেন মহাসমুদ্র”। “আর আমার সম্পর্কে বলতে গেলে, স্তালিন বলেন, “আমি লেনিনের একজন ছাত্র মাত্র এবং আমার জীবনের লক্ষ্য হলো লেনিনের যোগ্য ছাত্র হয়ে যাওয়া” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৬)। এই হলো স্তালিনের অবস্থান, তাঁর কথিত ব্যর্থতা সত্ত্বেও এ থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। লেনিনও হয়তো আপত্তি করতেন যখন স্তালিন রুডভিককে বলেছিলেন : “যারা সোভিয়েতের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের কেবল ভয় দেখানোর মধ্যে আমরা নিজেদের আবদ্ধ রাখি না, আর একটু এগিয়ে যাই, বুর্জোয়াদের সামাজিক স্তরকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে।” যুক্তির বিচারে শিক্ষক হয়তো দ্বিমত পোষণ করতেন, কারণ লেনিনের গভীর করুণার মূলে ছিল, প্রত্যক্ষভাবে সোভিয়েত বিরোধিতায় লিপ্ত কোনো শ্রেণি-শত্রু তাঁর ছিল না। সোভিয়েতের অভিজ্ঞতা বার বার প্রমাণ করেছে যখনই বিপ্লবের সামনে হয় হাতুড়ি না হয় কামারের নেহাই’-এর মধ্যে একটাকে বেছে নেয়ার প্রশ্ন উপস্থিত হয়েছে, তখন শ্রেণিস্বার্থের যুদ্ধে হাতুড়িকে বেছে নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
লেনিন কখনো জোরের সঙ্গে জানাতে ভোলেননি যে, জীবনের সব চেয়ে। কর্তৃত্ববাদী বস্তু হলো বিপ্লব এবং স্তালিন সেই শিক্ষা অনুসরণ করেছেন, বোধহয় লেনিন যা করতেন তার চেয়ে কঠোরতার সঙ্গে, কিন্তু সেটা ভিন্ন কাহিনি।
লেনিন ও স্তালিনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে স্মরণ করতে হয় ১৯১১ সালে লেনিন কেন “জুড্যাস ট্রটস্কি” বাগ-বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করেছিলেন (কথাটা অবাঞ্ছিতদের বহিষ্কার করা সম্পর্কিত মামলায় স্তালিনের আবিষ্কার ছিল না) এবং বলেছিলেন, ট্রটস্কির মতো বাগাড়ম্বরপূর্ণ মানুষরা হলো আমাদের যুগের ব্যাধি। ১৯১৩ সালে ট্রটস্কি লেনিনের চিন্তাধারাকে বলেছিলেন, “অসৎ ও নৈতিকতার বিরোধী” এবং পার্টির কাছে “নৈতিক ও মতাদর্শগত অবক্ষয়পূর্ণ ।” তবুও লেনিনের মৌলিক বদান্যতায় নির্দ্বিধায় ট্রটস্কিকে বিপ্লবে তার ভূমিকা, কিছুকালের জন্য হলেও যা ছিল চমৎকার ও অসাধারণ, পালন করতে স্বাগত জানিয়েছিলেন। মনে হয় স্তালিনের কিছুটা সঙ্কীর্ণ মন, প্রখর স্মৃতিশক্তি, ঝোড়ো জীবনের নিষ্ঠুর পরীক্ষা তাঁকে কিছুটা অবিশ্বাসী হতে বাধ্য করেছিল। যদিও প্রায়শই অভিযোগ করা হয় তার ক্ষতি করতে পারে এমন অসুস্থ মনোবিকারে তিনি দফায় দফায় আক্রান্ত হতেন, তাহলেও একজন ব্যক্তির সমগ্র জীবন ও তার কর্মকাণ্ডের বাস্তবতার মূল্যায়নের ভিত্তিতেই ইতিহাস বিচার করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃত মাত্রাজ্ঞান ও ঐতিহাসিক শোভনতাও থাকা প্রয়োজন। বস্তুত, মহান অক্টোবর বিপ্লবের কিছুকাল পরেই লেনিনের জীবনাবসান ঘটে এবং স্তালিনকে হতবুদ্ধিকর ও মানসিক বিপর্যয়কর দায়িত্বের বোঝা বহন করতে হয়, যা ছিল কল্পনাতীত এমনকি মহান লেনিনও যদি অন্যভাবে তার সম্মুখীন হতেন।
.
স্তালিনের বিরুদ্ধে জাতি-বিদ্বেষ
উন্নাসিক ‘মাকর্সবাদীরা’ অবশ্য বহুকাল যাবৎ স্তালিন ও তাঁর সোভিয়েত ইউনিয়নকে “অপরিপক্ক বাইজানটাইন রূপ” হিসেবে অবজ্ঞা করেছেন, কিন্তু কেন যে এইসব সুযোগ্য ব্যক্তি সর্বদাই পশ্চিমা দুনিয়ায়’ ‘খাঁটি সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি ঘটাতে পারেননি তার কোনো সদুত্তর মেলে না। মিনারবাসী হয়ে মর্ত্যের লড়াইয়ে ক্ষত বিক্ষত ও জর্জরিত মরণশীল মানুষদের সম্পর্কে রায় দেয়া খুবই সহজ। সোভিয়েত ইতিহাসের যুক্তিগ্রাহ্য নিয়মে, আইজাক ডয়েটশার-এর প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘স্তালিন (১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সংস্করণ) অনুসারে লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিনের উত্তরণ এবং আরও ক্রমবিকাশ, যা একসময় অসম্ভব মনে হয়েছিল, আদৌ আকস্মিক ছিল না। যদিও একটি সমষ্টিগত নেতৃত্ব অপরিহার্য বলে ধরা হয়েছিল, কিন্তু পরস্পর দ্বন্দ্বরত ব্যক্তিত্ব ও তাদের ইচ্ছা থেকে, তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে মতাদর্শই বৈচিত্র্যের জননী হওয়ায়, বেরিয়ে আসা যায়নি (প্রয়োজনীয় যদিও শত্রুতামূলক রচনা ‘ডাইভারসিটি ইন ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিজম’- এ ডালিন সম্পাদিত, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৩, দ্রষ্টব্য)। এখানে এটা আলোচনা করার বিষয় নয়, তবুও ব্যক্তিত্বজনিত কিছু সমস্যা উল্লেখ করা হলো। জিনোভিয়েত, যিনিই সম্ভবত প্রথম লেনিনবাদ’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন, তার কিছু চারিত্রিক অস্থিরতা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের এক শ্রদ্ধেয় নেতা এবং এক দুর্দান্ত বিপ্লবী জনপ্রিয় রাজনৈতিক বক্তা। কামেনেভ একজন সুশিক্ষিত চিন্তাশীল ব্যক্তি ও যোগ্য প্রশাসক, যার প্রবণতা ছিল রাষ্ট্রনেতার জায়গায় গুপ্ত চক্রান্তের ভ্রান্ত ধারণা করার! লিও ট্রটস্কির দ্বারা এই ত্রয়ী দর্শনীয়ভাবে পূর্ণতা লাভ করেছিল এবং (পরে প্রায়শই ভাঙনও ধরেছিল) যার প্রকৃতই প্রচণ্ড প্রতি___ আত্ম-অহঙ্কারী গতিবেগ (যা তিনি খানিকটা বিয়োগান্তক মহিমায় টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন) তার নিজের এবং বিপ্লবের পক্ষে অত্যধিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল ।
তারপর ছিলেন নিকোলাই বুখারিন, যার মহান শিক্ষা ক্রমশ এমনভাবে এসেছিল যাকে বলা যায় সোভিয়েতের দেবদত্ত দায়িত্বের বোঝা বহনের এক মেরুদণ্ডহীন অক্ষমতার সঙ্গে। যুদ্ধের সময়কার উইনস্টন চার্চিলের একটা ঠাট্টার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তেহরান ও ইয়াল্টায় রুশ ভল্লুক ও মার্কিন মোষের মধ্যে তিনি (চার্চিল) ছিলেন হতভাগা এক ছোট্ট ইংরেজ গাধা যে নিজেই কেবলমাত্র বাড়ি ফেরার সঠিক পথটা জানত। স্তালিনকে তাঁর পার্টির সহকর্মীদের মধ্যে হয়তো ভাবা হতো এশিয়া ও ইয়োরোপের সন্ধিস্থলের এক ককেশীয় অজ্ঞাতকুলশীল- অবিচলিত কিন্তু প্রায়শই অনুচ্চারিত, তাঁর প্রতিভা (যা নিয়ে ট্রটস্কি হাসাহাসি করতেন) ধূসর বিন্দুর চেয়ে একটু বেশি বলশেভিক মেধার আলোকচ্ছটার মধ্যে কুহেলির মতো উবে গেছে। ঐতিহাসিক ইয়োরোপীয় ক্ষয় ক্ষতির জন্য স্তালিনকে এক ধরনের এশীয় প্রতিহিংসার চক্রান্তকারী হিসেবে সন্দেহ করা হতো (যে মানুষটা সবসময়েই এশীয় বেশভুষায় সজ্জিত থাকতেন!), যদিও লেনিনের প্রতি তাঁর আনুগত্যের প্রশ্নে অন্য কেউই সমকক্ষ হতে পারেনি। এক অসাধারণ ভঙ্গিমায় ও ধৈর্যের সঙ্গে তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন সীমাহীন ও কঠোর বৈপ্লবিক দায়িত্ব পালনের উপযোগী হতে, যা আরও সংবেদনশীল অন্য ব্যক্তিদের অবসন্ন করে দিয়েছিল। এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নিরন্তর শত্রুমনোভাবাপন্ন বিশ্বে সমাজতন্ত্র গঠনের জন্য স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টিকারী এক বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রধান নিখুঁত ছাঁচ।
এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না, লেনিনের অকাল জীবনাবসানের পর (জানুয়ারি, ১৯২৪) উল্লেখিত শত্রুমনোভাবাপন্ন বিশ্বের সমস্ত বিদ্বেষ ও ক্রোধ স্তালিনের ওপরে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, একমাত্র একজন ব্যক্তির ওপর, যেহেতু তিনি পৃথিবীর একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছিলেন। সমস্ত প্রচার মাধ্যম, সঙ্গত ও অসঙ্গত, প্রধানত স্তালিনের উদ্দেশ্যেই চালিত হয়েছিল, যেমন এক সময় হয়েছিল লেনিনের বিরুদ্ধে (কখনো কিছুকাল, ট্রটস্কির সঙ্গে), আক্রমণ প্রায়শই ছিল নোংরা ও অমার্জিত।
(Jay Gould? এর) অশ্লীল ছড়া : “There was a great revolutionary called Lenin/Who did one or two million men in/That was a lot to have done in/But where we did one or two million in/The Great Revolutionary Stalin, did ten in!” তার নিজের! গরবাচভের “ঐতিহাসিক সহকারী এ মেদভেদভকে অত পরিশ্রম করে স্তালিনের ‘অপরাধ’ ও তার ‘প্রতিহিংসার বলী’-র স্ফীতকায় তৈরির কোনো প্রয়োজন ছিল না। বিপ্লবের মূল্য বস্তুতপক্ষে সর্বদাই খুব বেশি এবং কোনো বিপ্লবই মহান অক্টোবর বিপ্লবের মতো এত গভীর ও ব্যাপক হয়ে দেখা দেয়নি। লাল সন্ত্রাস’ সম্পর্কে লেখালিখির অন্ত নেই, কিন্তু সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েভের প্রকৃতই চমৎকার রচনার মতো সর্বোৎকৃষ্ট বুর্জোয়া পাণ্ডিত্য যে সত্যকে প্রকাশ করে দিয়েছে তাকে কোনো নব্য গর্বাচভীয় বিজ্ঞতা দিয়ে বিকৃত করা যাবে না।
ইতিহাস রচনায় কণামাত্র সততা যতদিন থাকবে ততদিন ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধে (১৯৪১-৪৫) সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার লাল ফৌজের বিজয়ের গৌরব ম্লান হবে না। অবশ্য ইতিহাসের মানদণ্ডে তাকে হেয় করতে, এমনকি কার্যত নস্যাৎ করার প্রয়াসের অন্ত নেই। কিন্তু সুখের কথা, বুর্জোয়া ইতিহাস রচনায় সততা একেবারে মুছে যায়নি এবং ভবিষ্যতেও হয়তো যাবে না, যদি না সেই ভবিষ্যৎকে আজকের তথাকথিত এক-মেরু বিশ্বের প্রতিবিপ্লবী শক্তিরা হাইজ্যাক করে নিয়ে যাওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের মহাকাব্য ম্লান হয়ে না যায়।
লালফৌজের ‘জেনারেলিশিমো’ (সেনা-মহাধ্যক্ষ) হিসেবে (১৯৪৩-এর মার্চে তিনি ‘মার্শাল’ খেতাব নেন) স্তালিনকে কলঙ্কিত করা সহজ এবং নিকিতা শুভ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, যিনি হীন বিদ্বেষ ও অমার্জিত শঠতার সঙ্গে তার নজির স্থাপন করে বলেছিলেন যে, স্তালিন তার নিজের ঘরে বসে ‘গ্লোব’ ঘুরিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন এবং রণনীতি ও কৌশলের নির্দেশ দিতেন! অবশ্য ক্রুশ্চভের মুখ রক্ষা করে স্তালিনকে তীব্রভাবে আক্রমণ করার মধ্যেও তার স্বীকরোক্তি, ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় আমরা এখনও সকলেই স্তালিনবাদী।” কিন্তু পেরেস্ত্রৈকার’ ফেরিওয়ালা ও নীচতা মিথ্যা প্রচার করে চলেছে, কিন্তু ভুলে গেছে কীভাবে সেনাবাহিনীর ভিতরে ও বাইরে হাজারে হাজারে সোভিয়েতবাসী স্তালিনের নাম উচ্চারণ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে গেছেন।
এই অসতোর একটি দৃষ্টান্ত হলো, যদিও স্থূল বুদ্ধির, একটি রিপোর্ট যা ‘আরগুমেন্টি আই ফ্যাকটি’ (আরগুমেন্টস অ্যান্ড ফ্যাকটস) নামক এক পাঁচ লক্ষাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিকীতে ‘সত্য বলে দাবি করে প্রকাশ করা হয়েছিল (সংখ্যা ৫-১৯৯০, একই বছরের মে মাসে বিশ্ব জুড়ে সোভিয়েত মিডিয়া প্রচার করেছিল) যে তথাকথিত এক অ্যাকাডেমিশিয়ান’ এ সামলোনভ-এর ভাষ্য অনুসারে উইনস্টন চার্চিল নাকি সামরিক বাহিনীর নেতা হিসেবে স্তালিনের প্রতিভার কখনো প্রশংসা করেননি। এটা হীন এবং ঘৃণার অযোগ্য, কিন্তু তবু এটাই স্তালিন বিরোধিতার তূণে একটি অস্ত্র! কী যায় আসে যদি চার্চিল স্তালিনের প্রশংসা না করতেন (বস্তুত ঐ রকম এক মহল থেকে প্রশংসাকে বিপজ্জনক বলেই ভাবা উচিত!)? যাই হোক, বাস্তবিকপক্ষে, যুদ্ধের বছরগুলো সম্পর্কে চার্চিলের স্মৃতিকথায় (তার “ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্রাজেডি” গ্রন্থে চার্চিলের দৃষ্টিতে সোভিয়েতের বিজয় ছিল এক ট্রাজেডি’) বহুবার স্তালিন প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে, পাঠকরা সহজেই তা ঝালিয়ে নিতে পারেন। এতদসত্ত্বেও, এটা সকলেরই জানা যে, পরিস্থিতির চাপে সমাজতন্ত্রের এক নিরলস আজীবন শত্রু স্বরূপ চার্চিলকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গালভরা প্রশংসা করতে হয়েছিল। এ সম্পর্কে ডয়েটাের উল্লিখিত (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১৭৮) একটি উদাহরণ: “এই বিশিষ্ট রূঢ় সমর-অধ্যক্ষ (স্তালিন), এক বিশাল অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, নিরানন্দ ও ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমরে জীবনের পক্ষে উপযোগী ছিলেন।”
যুদ্ধ প্রসঙ্গে (১৯৪১-৪৫) গ্রন্থ ও রচনা অনেক আছে।তার মধ্যে বিশেষ উৎসাহব্যঞ্জক হলো বিশিষ্ট সোভিয়েত সেনানায়ক, জুকভ, রকসোভস্কি, ভেসিলেভস্কি, ইয়েরামেনকো, কোনেভ প্রভৃতি, যাদের মধ্যে একাধিক কারণে জুকভের স্মৃতিকথা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এমনকি কুখ্যাত সোভিয়েত বিরোধী লেখক হ্যাঁলিম্যান সেলিসবেরির গ্রন্থটিও জুকভের বর্ণনামূলক বিষয়কে চাপা দিতে পারেনি। এই লেখকের ‘এপিক ভিকটরি’ (অ্যালায়েড পাবলিশার্স, দিল্লি ১৯৮৫-) গ্রন্থেও সোভিয়েত সেনানায়কদের স্মৃতিচারণার অনেক প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে, যা
অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব এবং সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থার প্রয়োজনীয় বাধ্যকতা সত্ত্বেও যুদ্ধ প্রসঙ্গে একটি মূল্যবান জ্ঞানের সূত্র। সামরিক বাহিনীর নেতা হিসেবে স্তালিনের ভূমিকা সম্পর্কে খুবই সযত্ন ও একটু দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ভারত সরকারের জনৈক অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব ডিপি দাস, কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা প্রকাশ করার জন্য কোনো প্রকাশক এগিয়ে না আসায় টাইপ করা অবস্থাতেই পড়ে আছে। অবশ্য সোভিয়েত লেখকদের পক্ষেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপযুক্ত ও প্রকৃত পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ রচনা উচিত, কিন্তু ক্রুশ্চভ থেকে গর্বাচভ পর্যন্ত ঘটনাবলি সেদিনের সোভিয়েত ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক অথচ সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক বছরগুলোর ঐকান্তিক ও নীতিনিষ্ঠ বিশদ বর্ণনা করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
১৯৪১ সালের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনগুলো
১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলারের ফ্যাসিস্ট সৈন্য বাহিনীর আকস্মিক তীব্র আক্রমণ ঠেকাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অপ্রস্তুত অবস্থার জন্য স্তালিনকে প্রায়শই নিন্দা করা হয়। প্রায় এক পক্ষকাল এমনকি স্তালিনের ইস্পাত-কঠিন স্নায়ুর পতন ঘটেছিল বলে মনে হয়। স্তালিন কখনো আক্রমণ সম্পর্কিত বিপদকে লঘু করে দেখেননি এবং ১৯৩৯ সালেই বলেছিলেন কার্যত ফ্যাসিস্টরা প্রাচ্যে ও পশ্চিমে বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসে (মার্চ, ১৯৩৯) তিনি বলেছিলেন, “এক নতুন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সাংহাই থেকে জিব্রাল্টার পর্যন্ত পঞ্চাশ কোটি মানুষকে জড়িয়ে দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করেছে।” তাঁর ঐ ভাষণে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন “বুর্জোয়া বাবুগণ” (স্তালিনের প্রিয় ব্যঙ্গ) হিটলার মুসোলিনি এবং জাপানি সামরিক-ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে যোগসাজসে তাদের ‘অক্ষশক্তি গড়ে তুলে কমিনটার্ন বিরোধী চুক্তি করেছে। ফ্যাসিস্টদের আক্রমণ রুখতে সমষ্টিগত নিরাপত্তা চুক্তির জন্য সর্বপ্রকার সোভিয়েত উদ্যোগকে (দীর্ঘকাল আপত্তি জানানোর পর সোভিয়েত ইউনিয়নকে কিছুকালের জন্য লীগ অব নেশনস এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং পরেই আবার দ্রুত বহিষ্কৃত’ও করা হয়েছিল!) অন্যায়ভাবে বাধা দেয়া হয়েছিল। আবিসিনিয়া, চীন, স্পেন, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করেছিল ফ্যাসিস্ট বর্বরতা কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্র তাদের পবিত্র হাত কলঙ্কিত করেনি সোভিয়েতের সঙ্গে কোনো ধরনের মৈত্রী গড়ে তুলতে। পশ্চিমা দুনিয়ার দ্বারা উৎসাহিত হয়ে এমনকি পোলান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়ার মতো দুর্বল রাষ্ট্রগুলোও তাদের মাটিতে পশ্চিমা সহযাত্রীর সঙ্গে লালফৌজের সাময়িক উপস্থিতিতে গণতন্ত্র সংরক্ষণের চেয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির পদানত হওয়াটাই পছন্দ করেছিল। তিরিশের দশকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের গা ঘিনঘিন-করা ভূমিকা, যখন এইসব আত্ম-প্রশংসিত ‘গণতন্ত্রগুলো ফ্যাসিবাদের দুষ্কর্মের সাথি ছিল এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির তৎকালীন নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে আলোচনা এই গ্রন্থের উপজীব্য নয়, কিন্তু তবুও তাদের ভূমিকা স্মরণ করা দারুণভাবে প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদ বিরোধী উদ্যোগে তাদের বিশ্বাসঘাকতা, মানুষের কাছে জনপ্রিয় হলেও শাসকদের পক্ষে অনুপযোগী, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেলে দিয়েছিল আত্মরক্ষার স্বার্থে জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি (১৯৩৯) সম্পাদিত করার দিকে। নিরাপদ দূরত্বে বসে সেই চুক্তিকে নিন্দা করা খুবই সহজ কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়া যাদের অন্ত্যজ করে রেখেছিল। এবং ফ্যাসিবাদ রুখতে যাদের সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকার করেছিল সেই সোভিয়েতের প্রয়োজন হয়েছিল সমস্ত শত্রুতামূলক শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার কিছু সময় অর্জন, তবুও উল্লিখিত ১৯৩৯ সালের ভাষণে স্তালিন কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যারাই সোভিয়েতের উদ্যানে ‘শুয়োরের নাক ঘসার সাহস দেখাবে তারাই উপযুক্ত শিক্ষা পাবে। রাজনৈতিক, সামরিক, ভৌগোলিক, মানসিক এবং সমস্ত অন্যসব শত্রুতামূলক ক্ষেত্রে সুরক্ষা বজায় রাখা ছিল খুবই মাথা ঝিমঝিম করা দায়িত্ব। এটা আশ্চর্যজনক ছিল না, সামরিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব হিটলারের বিশ্বাসঘাতক আক্রমণের মুখে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ধরা পড়েছিল।
অন্য সব বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের মতো স্তালিনও ত্রুটিমুক্ত ছিলেন না। এবং এটা হতে পারে যে তিনি ফ্যাসিস্ট শক্তির হিংস্রতা ও প্রতারণার যথাযথ গুরুত্ব দেননি। এটাও হতে পারে যে সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির প্রতি, বিশেষত তার জার্মান সংস্করণের প্রতি, তাঁর বিরাগ তাঁকে পশ্চিমা দুনিয়ায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির গুরুত্বকে লঘু করে দেখার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। “মুষ্টিমেয় শয়তানি-ভরা পাজি ও ইতর ব্যক্তি যারা নিজেদের পুঁজিপতিদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে শ্রমিকশ্রেণির বাহিনী থেকে ভেঙে বেরিয়ে এসে প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়াদের (যেমন সাইডেম্যান, নোস্কে প্রভৃতি) সেবায় এক নিদারুণ বিরক্তিকর কার্যনির্বাহী হিসেবে জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হতে দেখা দিয়েছিল, যা সারা বিশ্বের কাছে একটা মডেল হয়ে উঠেছিল”- লেনিনের এই নিন্দাসূচক কথাগুলো (১৯১৮) স্তালিনের মনের মধ্যে তাদের দগ্ধ করেছিল এবং এমন এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল যা সারা জীবন বিদ্যমান ছিল এবং সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি ঘটলেও শ্রেণিসংগ্রমের প্রকোপতা বৃদ্ধির মতাদর্শ জাগিয়ে তুলেছিল। তাছাড়াও সব প্রাথমিক তথ্যই ইঙ্গিত বহন করে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর হিটলারের আক্রমণের দশ বা আরও কিছু বেশিদিন পরেও স্তালিন হতবুদ্ধিকর অবস্থায় ছিলেন, যদিও অবশ্য দ্রুততার সঙ্গে সংগঠিত সেনাবাহিনী অবাক করা সাহস ও মনোবলের প্রদর্শন ঘটিয়েছিল।
যুদ্ধ যেদিন শুরু হয় সেই দিনই স্তালিন, পাঁচ-সদস্যকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কমিটির প্রধান হিসেবে সর্বোচ্চ সেনাধক্ষ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্যুদেয়িনি, ভরোশিলভ ও টিমোশিঙ্কোকে তিনটি ক্ষেত্রের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বহু বছর যাবৎ স্তালিনের খুব ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দুজন প্রবীণ যোদ্ধাকে ও কিছুদিন পরে শেষোক্তজনকেও তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তুলনামূলকভাবে লঘু কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। লালফৌজ পুরোপুরি অপ্রস্তুত হতো না কিংবা পরে এরকম অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত তাড়াতাড়ি পাল্টা আঘাত হানা যেত না, কিন্তু ফ্যাসিস্ট আক্রমণের আকস্মিকতা দাবি করেছিল গভীরে গিয়ে সুরক্ষা গড়ার এবং শত্রুর অগ্রগতি বিলম্বিত করার। নিঃসন্দেহে কিছুদিনের জন্যে হতোদ্যম অবস্থা বিরাজ করছিল এবং এমনকি আতঙ্কজনক বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট বের হচ্ছিল যা থেকে সারা বিশ্ব জুড়ে ধারণা জন্মেছিল যে লালফৌজ শেষ হয়ে গেছে। নাৎসি জেনারেল হ্যান্ডর এমনকি তার ডায়েরিতে (৩ জুলাই ১৯৪১) লিখেছিলেন যে, “রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচার চোদ্দ দিনেই জয়ী হয়েছে!” সর্বত্রই শুরু হয়ে যায় আনন্দসূচক আগাম অনুমান। মার্কিন জেনারেল মার্শাল ছ’মাসের বেশি সময় দেননি সোভিয়েত ইউনিয়নকে এবং ব্রিটিশ জেনারেল স্টাফ ভেবেছিলেন “খুব বেশি হলে তিন মাস।” ডি এফ ফ্লেমিং তার ‘দ্য কোল্ড ওয়ার অ্যান্ড ইটস অরিজিনস’ (লন্ডন, ১৯৬১, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৭) গ্রন্থে উপসংহার টেনে লিখেছিলেন : “তারা সকলেই একমত যে জার্মানরা মাখনে ছুরি চালানোর মতো রাশিয়াকে ফালি ফালি করে দেবে।”
না, তা হয়নি। ১৯৪১-এর ২ জুলাইয়ের স্তালিনের বেতার ভাষণ সমাজতান্ত্রিক দেশপ্রেমের রক্তিম ঔজ্জ্বল্য জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি বলেছিলেন ‘শত্রু হিংস্র ও অপ্রশস্য, এবং আহ্বান জানিয়েছিলেন, চূড়ান্ত প্রয়াস ও চরম আত্মত্যাগের জন্য লড়াই করতে ও জয়ী হতে, ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতোই যাকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন জাতীয় দেশপ্রেমিক যুদ্ধ। বিশেষত স্মরণীয় ছিল জনগণের প্রতি তার আবেদন লেনিন ও স্তালিনের পার্টি’-র সপক্ষে সমবেত হওয়ার। এই অপ্রত্যাশিত এবং আর-কখনো-পুনরুচ্চারণ না করা “ভাববাচ্যে নিজের প্রতি উল্লেখ্য বোধহয় ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টির সঙ্গে তার নিজেকে একাত্ম করা এবং যে কোনো মূল্যে অসীম ক্ষমতার ও অনৈতিক হিংস্র শত্রুকে পরাজিত করার মৃত্যুহীন দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা।
যুদ্ধে জয়লাভের পর ১৯৪৫ সালের ২৪ মে ভাষণ দিতে গিয়ে স্তালিন বলেছিলেন : “আমাদের সরকার কিছু ভুল করেছিল। ১৯৪১-৪২ সালে আমরা একটা বেপরোয়া পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম যখন আমাদের সেনাবাহিনী পশ্চাদপসরণ করছিল, কারণ তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না।” তিনি বিশেষত ধন্যবাদ দেন রাশিয়ার জনগণকে পার্টি ও তার সরকারের উপর এই আস্থা জ্ঞাপনের জন্য যা অন্য ধরনের মানুষরা দেখাতে পারত না। রুশদের আলাদাভাবে বিশেষ প্রশংসা করার কিছুটা সমালোচনা হয়েছিল তখন, কিন্তু তাদের সব দোষত্রুটি সত্ত্বেও (আজকের ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে সোভিয়েত মূল্যবোধ রুশ এবং অন্য জাতিবাদকে অতিক্রম করতে পারেনি), এটা অনস্বীকার্য ‘সোভিয়েত জনগণের বিপুল আত্মিক শক্তিতে রুশদের ভূমিকা যুদ্ধজয়ের পেছনে প্রধান উপাদান ছিল। প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ বিশেষ মর্যাদা ও পদক দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের সময় ও পরে এবং সর্বোচ্চ বিশেষ-সামরিক মর্যাদা ছিল ‘হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ খেতাব। তা দেওয়া হয়েছিল ৮,১৬০ রুশ, ২,৬০৯ ইউক্রেনীয়, ৩২২ বাইলো-রুশ, ১৬১ তাতার, ১০৮ ইহুদি, ৯৬ কাজাক, ৯০ জর্জীয়, ৯০ আর্মেনীয়, ৬০ উজবেক, ৬১ মদভেনীয়, ৪৪ চুভাশ, ৪৩ আজারবাইজানীয়, ৩৯ বাস্কিরস, ৩৯ ওশেশীয়, ১৮ মারি, ১৮ তুর্কমেনীয়, ১৮ লিথুয়ানীয়, ১৪ তাজিক, ১৩ লাটভীয়, ১২ কিরখিজ, ১০ কোমি, ১০ উডমোরি, ৯ এস্তনিয়ো, ৯ কারেলীয়, ৮ কালমিক, ৭ কাবার্ভিলিয়, ৬ এডিজিও, ৫ আপখাজিয়ন, ৩ ইদাকুদ- প্রকৃতই এক উজ্জ্বল মোজাইক পাথর (আক্রাম শার্বপভ-এর ‘ওয়ার হিরোজ’, মস্কো, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ৪৯ দ্রষ্টব্য)।
১৯৪১-৪২ এর শরৎ ও শীতকালে সোভিয়েত জনগণ চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হন। মস্কোর জন্য লড়াই, যা সোভিয়েত জনগণ জয় করার পর, এমনকি মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থার (যাকে ‘আমেরিকান সিজার’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর জীবনীকার উইলিয়াম ম্যানচেস্টার) বলেছিলেন, “সমগ্র ইতিহাসে মহত্তম সামরিক বিজয়”। হীরেন মুখার্জির ‘এপিক ভিকটরি, দিল্লি ১৯৮৪, দ্রষ্টব্য)! হতাশার দৈবজ্ঞ সর্বত্রই আছে, কিন্তু ১৯৪১-এর অক্টোবরের মাঝামাঝি বিদেশি দূতাবাস ও বহু সরকারি অফিস পূর্ব দিকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্তালিন যেন নিজে ভোলগা তীরে কুইবাইশেভ-এ চলে যান। তারপর যা ঘটেছিল সেই দৃশ্য রেকর্ড করে রাখার মতো! ১৯ অক্টোবর ভোরবেলায় মস্কো সাবার্বান স্টেশনে একটি বিশেষ ট্রেন অপেক্ষা করছিল স্তালিন ও তার ঘনিষ্ঠ সহকারীদের নিয়ে যাবার জন্য, একটা ছোট্ট গ্রুপ স্তালিনের কাছে দাঁড়িয়েছিল এবং প্রত্যক্ষদর্শী অনুযায়ী স্তালিন সাধারণের চেয়ে একটু বেশি কুঁজো হয়ে প্ল্যাটফরমে হাঁটাচলা করছিলেন এবং তার পরেই দৃঢ়ভাবে মনস্থির করে ফেললেন তাঁর গাড়িতে উঠে ক্রেমলিনে ফিরে যেতে। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যসূচক আচরণ মস্কোর (যার পতনের প্রথম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল ৪ আগস্ট, তারপর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল) আত্মবিশ্বাস কতটা উদ্ভাসিত করেছিল তা সহজেই অনুমেয়। জুকভ নিজেই বর্ণনা করেছেন কেমন করে স্তালিন, তার সঙ্গে পরামর্শ করে, স্থির করেছিলেন নভেম্বর বিপ্লবকে সম্মান প্রদর্শন করা হবে পাতাল রেলের মায়োশ্লোভস্কি স্টেশনে এবং প্রতি বছরের মতো ৭ নভেম্বর কুচকাওয়াজ হবে রেড স্কোয়ারে ।
যখন ক্ষতিকারক কিছু তুচ্ছ বাজে লোক প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন শুনতে আশ্চর্য ঠেকতে পারে যে ১৯৪১’র ৭ নভেম্বর রেড স্কোয়ারে প্যারেড সেরে লালফৌজ সোজা চলে গিয়েছিল রণাঙ্গনে শত্রুকে মোকাবিলা করতে। এক নির্বোধ উন্মত্ততায় হিটলার রাগে গরগর করে অক্টোবর মাসে বলেছিলেন, মস্কো দখলের পর “তাকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে এবং ভাসিয়ে দেওয়া হবে যাতে তার সমস্ত চিহ্ন হারিয়ে যায়।”
এমনকি ডয়েটশারও তাঁর ইয়োরোপীয়’ পক্ষপাত প্রকাশ করেছিলেন যখন তিনি উল্লেখ করেছিলেন প্রাচীন পার্থিয়াবাসীদের এবং নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে কুতুজভ-এর দৃষ্টান্তের (স্তালিন কথিত) ভিত্তিতে স্তালিনের রণকৌশল প্রথমে পশ্চাদপসরণের কৌশল মারফৎ এমনকি বহু ক্ষয়-ক্ষতির বিনিময়ে, শত্রুবাহিনীকে নিজের এলাকায় টেনে আনার পর প্রলোভন দেখিয়ে পরে তাকে ঘিরে ফেলে খতম করা।
“এক আদিম প্রাচ্য দেশীয় কিন্তু অব্যর্থ বিচক্ষণতার সঙ্গে”, বলা হয়, স্তালিন “হিটলারের ঔদ্ধত্যের ওপর বাজি ধরেছিলেন তাকে প্রলুব্ধ করে নিজের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যেতে ও তার মূল্য দিতে। তবে এর মধ্যে প্রাচ্যদেশীয় কোনো বিশেষ কিছু ছিল না, কিন্তু ধরা পড়ে যে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে উৎকৃষ্টরাও প্রায়শই তাদের ইয়োরো-কেন্দ্রিক পূর্ব ভাবনা ত্যাগ করতে অক্ষম।
এক যুদ্ধের ‘মহাকাব্য’র উপসংহার টানতে গিয়ে এতই অস্দশ ছোট ছোট ‘নাটক’ উন্মোচিত হয়েছে, যেমন, যখন গর্বিত ফ্রান্স ফ্যাসিস্ট দখলদারদের কাছে ভীতু ভেড়ার মতো আত্মসমর্পণ করেছিল, যখন বহু সেনানায়ক তাদের চকচকে তরবারি পরিত্যাগ করে বাস্তুহারাদের মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছিলেন নিরাপদ স্থানে, তখন কেউ হয়তো দেখতে পেতেন যেন কোনো জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে সুসজ্জিত মহিলা কোলে কুকুর নিয়ে নগ্নপদে হেঁটে চলেছেন!- তা নিয়ে এখানে চর্চা করা অপরিহার্য নয় এবং প্রয়োজনীয়ও নয়, অবশ্যই স্থান সঙ্কুলানের কারণে। কতকগুলো প্রধান উপাদান, যেমন, দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলতে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব এবং মস্কোকে বাইরে রেখে আলাদাভাবে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করা সম্পর্কে সোভিয়েতের ভয়– যা ছিল সবসময়ই এবং এমনকি যখন যুদ্ধ প্রায় শেষ হতে চলেছে। যুদ্ধ পরবর্তী ইয়োরোপ অনেকটাই সোভিয়েত প্রভাবিত হয়ে পড়বে বলে ‘পশ্চিমা’, বিশেষত ব্রিটিশদের আশঙ্কা হেতু কাজে লাগানো শুরু হয়েছে পোলিশ জেনারেল সিকোরস্কি এবং রাজনৈতিক কাজে লিপ্ত মিকোলোযেজক এর মতো যারা পোল্যান্ডকে ভালোবাসতেন কিন্তু তার চেয়েও বেশি পছন্দ করতেন পুঁজিবাদী পদানত পোল্যান্ডকে, তখন সেইসব ব্রিটিশ সমর্থিত কমিউনিস্ট বিরোধীদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল স্তালিনকে। আবার অন্যত্র আচরণের কী লক্ষণীয়। প্রভেদ, সখের চিত্রশিল্পী চার্চিলের বিমান বাহিনী জার্মানির শিল্পকলা-কেন্দ্র ড্রেসডেনকে বোমা মেরে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি স্তালিনের ‘আদিম’ লালফৌজকে র্যাফায়েল-এর অমূল্য সৃষ্টির সম্পদকে রক্ষা করতে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ প্রয়াস নিতে দেখা গেছে। এমনকি কূটনৈতিক আচরণেও স্তালিন, প্রাক্তন সার্ফ-এর অভাবি সন্তান নিজের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে ছাপিয়ে গেছেন ডিউক বংশধর যিনি কখনো সাধারণ বাসে চড়েননি সেই চার্চিলকে। সব কিছুর ওপরে নিজের দেশকে প্রাধান্য দেওয়ার স্বার্থপর রাজনৈতিতে কৃতজ্ঞতার কোনো স্থান নেই, তাহলে বোধহয় ইতিহাসের বই সবার সামনে তুলে ধরত স্তালিনের মহৎ হৃদয়ের প্রকাশ, যখন তিনি ১৯৪৫-এর গোড়ার দিকে আর্ডেনেস-এ ব্রিটিশদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে সশস্ত্র বাহিনী পাঠানোর জন্য চার্চিলের জরুরি সাহায্য বার্তার উত্তরে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, যদিও তখন নিজেদের সামরিক স্বার্থে সোভিয়েতের পক্ষে উদারতা প্রদর্শন করা ছিল খুবই কঠিন। যে যার বৈশিষ্ট্যের প্রতীকস্বরূপ, স্তালিনের মতো বড় মাপের মানুষের উদারতার প্রত্যুত্তরে চার্চিল, সাম্রাজ্যবাদের ডাইনোসার, ১৯৪৫-এর বসন্তকালে বলেছিলেন “আমার দৃষ্টিতে সোভিয়েত জুজু নাৎসি শত্রুর জায়গা নিয়েছে এবং তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু হ্যারি ট্রুম্যান, যিনি রুজভেল্টের মৃত্যুর পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন “রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার, যদি ভবিষ্যৎ আলোচনায় সমস্যা দেখা দেয়।” চার্চিলের চিন্তা চেতনায় সোভিয়েত বিরোধী মনস্তত্ত্বের সাক্ষ্য বহন করেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক লর্ড ডসন। এটা কোনো আশ্চর্যের ছিল না যে আণবিক বোমা আবিষ্কার হওয়ায় পশ্চিমাদের শয়তানি হর্ষের প্রকাশ ঘটেছিল, তারা মনে করেছিল, এবার সোভিয়েতকে কার্যত বশ্যতা স্বীকারে ব্ল্যাকমেইল করা যাবে।
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনের অমিততেজ নেতৃত্ব
এই পর্যালোচনায় অনেক কিছুই বাদ দিয়ে যেতে হবে, কিন্তু যুদ্ধের সময়কার সামরিক স্মৃতি স্তালিনের নেতৃত্বের যে স্পষ্ট রূপ তুলে ধরে তা আলোচনা করাটা। খুবই সঙ্গত হবে। চার্চিলের মতো জোর করে ঢোকানো নয়, স্তালিন কখনো ফ্রন্টে কোনো সময় সম্পূর্ণ পরিদর্শনে যাননি, কখনো যুদ্ধরত সৈনিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে তোলার কথা ভাবেননি, কিন্তু সবসময়ই সেখানে কী ঘটছে তার ওপর সযত্ন নজর রেখেছেন। সেনানায়কদের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য হয়েছে, কখনো-সখনো রূঢ়, কিন্তু রকসোভস্কি ও জুকভ-এর মতো ব্যক্তিরা (সাময়িক রণকুশলী হিসেবে নিজস্ব ধারণার কোনো অভাব ছিল না) সাক্ষ্য দেন যে স্তালিন দৃঢ়চেতা ও ধৈর্যশীল ছিলেন, যে মত তিনি এর আগে মেনে নেননি কিন্তু যুক্তিতর্কের পর তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন এবং যোগ্য কাজের জন্য যোগ্য ব্যক্তির পছন্দ সুনিশ্চিত করতে অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। যদিও কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বোনাপার্টবাদের বিপদসূচক কয়েকজন তারকাখচিত সামরিক কর্তাব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ ছিল, জুকভের সঙ্গে (তাঁর স্মৃতিকথায় বর্ণিত) তাঁর সম্পর্ক তুলে ধরে যে তার অন্য সদগুণ (ত্রুটি-বিচ্যুতিও) ছাড়াও তিনি জানতেন। সামরিক নেতারা, চিকিৎসকদের মতোই, মতানৈক্য হলেও শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তাদের সাহায্য করতে হবে (যদিও স্তালিন তার দীর্ঘকালব্যাপী নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে জেনেছিলেন তখন তার সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করতে হবে) লাল ফৌজের সামনে কঠিন পরিস্থিতিতে এক কার্যকরী টিম হিসেবে কাজ করতে। এটা পরিতাপের বিষয় যে, ১৯৪১-৪৫ সালে যুদ্ধের সময় স্তালিনের ভূমিকার এই দিকটি উপেক্ষিত থেকে গেছে এবং কেবল বিক্ষিপ্তভাবে পক্ষপাতমূলক কিছু আলোচনা হয়েছে।
সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন যে দৃঢ়মূল শ্রেণি শত্রুতার (এবং তার কারণ, বিশ্বব্যাপী) সম্মুখীন হয়েছিল সে সম্পর্কে স্তালিনের পূর্বেকার ধারণা আরো দৃঢ়ভিত্তিক হয়েছিল তার চার্চিল ও রুজভেল্টের সঙ্গে মুখোমুখি হবার পর। রুজভেল্ট সম্পর্কে মনে হয় তার কিছুটা অনুরাগ জন্মেছিল। তার দিক থেকে রুজভেল্টও প্রকৃতপক্ষে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে অরাজি ছিলেন না। উইনস্টন চার্চিলের বদ্ধমূল ও সংশোধনের অতীত শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ঠিক তার বিপরীত। কূটনৈতিক সদাচার ছাড়া স্তালিন ও চার্চিলের মধ্যে কখনই কোনো প্রীতির সম্পর্ক ছিল না। এমনও ঘটেছে যখন ত্রিপক্ষীয় আলোচনা ভেঙে যাবার উপক্রম হয়েছে, তখন রুজভেল্ট হস্তক্ষেপ করে ঠাট্টার সঙ্গে বা হেসে বলেছেন তিনি একটু ক্ষুধার্ত বোধ করছেন এবং তাই আলোচনায় বিরতি চাইছেন।
স্তালিন বিশ্বের শীর্ষ চিন্তাবিদদের সঙ্গে সমকক্ষের মতো আলোচনা করার উপযুক্ত ছিলেন না বলে যে ধারণা প্রচার করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে, যখন তাদের কারো কারোর সাথে তিনি মিলিত হয়েছিলেন তখন তারা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছেন তিনি কী অসাধারণ প্রশান্তমনা ও জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। এর দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে ১৯৩৪ সালে এইচ জি ওয়েলসের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে, যা তখনকার ‘নিউ স্টেটসম্যান অ্যান্ড নেশনস’ সাপ্তাহিকীতে ও পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকদিন যাবৎ প্রচার করা হয়েছে যে স্বল্পবাক, কথা বলতে অনিচ্ছুক সূক্ষ্ম বিতর্কে অপারগ, স্তালিন কখনো পেরে উঠতেন না চার্চিল ও তার মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে রাজনৈতিক-বৌদ্ধিক আলোচনায়। এই ক্ষুদ্র বিষয়টি পৃথক আলোচনার যোগ্য নয়, কিন্তু উল্লিখিত ধারণা কাটানো জরুরি। কারণ এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। অন্যান্য সভা ছাড়াও তেহরান, ইয়াল্টা, পটাশডাম মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে ঐ প্রচার যে স্তালিন ছিলেন এক অপটু শিক্ষানবিশ অথবা এক মাঝারি মাপের ব্যক্তিত্ব।
একটা ছোট্ট উদাহরণই যথেষ্ট যখন বৃহৎ ত্রি-শক্তির একটি সভায় স্তালিন অন্যদের স্বাস্থ্য ও সুখ কামনা করে পানীয় পাত্র তুলে ধরেছিলেন ও বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে। ইয়াল্টায় মিত্ৰতা সম্পর্কে চার্চিলের বিশ্লেষণ শোনার পর স্তালিন উচ্চারণ করেছিলেন কিছু দ্বিধাহীন কিন্তু চূর্ণ-বিচূর্ণ করার মতো বাক্য: “আমি আমাদের মৈত্রীর সুখ ও স্বাস্থ্য কামনা করতে চাই। মিত্রজোটের শরিকদের একে অপরকে প্রতারণা করা উচিত নয়। মনে হয় এটা কি হবে খুবই সরল? অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা হয়তো বললেন : “কেন আমি আমার শরিককে প্রতারণা করব না? কিন্তু আমি, একজন সাদাসিধে মানুষ হিসেবে মনে করি কোনো মিত্রকেই, যদি সে নির্বোধও হয়, তবু তাকে প্রতারণা করা উচিত নয়। সম্ভবত আমাদের মিত্রতা এত দৃঢ় তার কারণ আমরা একে অপরকে প্রতারণা করি না। অথবা এর কারণ কি একে অপরকে প্রতারণা করা অত সহজ নয়?… যতদূর সম্ভব আমরা যেন অকপট হই!”
চার্চিল কখনো, এমনকি তাঁর দিলখোলা মনোভাবের মুহূর্তেও ব্রিটিশ শ্রমিক দলের সমাজতত্ত্ববিদ জে এল হ্যামন্ড-এর মতো বলতে পারতেন না (ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯৪৩) যে স্তালিন “এমন এক সৈন্যবাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন যা আমাদের সকলকে বাঁচিয়েছে!” এমনকি যুদ্ধ শেষ হবার আগেই চার্চিল নির্দেশ দিয়েছিলেন জেনারেল মন্টোগোমারিকে ‘বাজেয়াপ্ত করা জার্মান অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিমা শিবিরে ‘জড়ো’ করতে, যাতে সেগুলো আবার জার্মান সৈনিকদের সহজেই দেওয়া যায় যখন একসঙ্গে তাদের সাথে কাজ করতে হবে যদি ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রগতি চলতে থাকে। এটা ছিল মিত্রশক্তির স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ফ্যাসিস্ট শক্তির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ ছিল ঘোষিত অভিন্ন লক্ষ্য। কিন্তু স্তালিনের এবং লালফৌজের বাহ্যিক প্রশংসার উদগীরণ তার শ্রেণি-পক্ষপাতিত্ব ঢাকতে পারেনি। “এই পরম আনন্দদায়ক বৃদ্ধ টোরিকে আমাদের পাশে পাওয়া কি মস্ত লাভ না?” বলে রুজভেল্ট একদা ঠাট্টা করেছিলেন, কিন্তু এটা হাসির বিষয় ছিল না।
চার্চিলের ব্যক্তিগত চিকিৎসক লর্ড মোরান লিখে গেছেন যে, ১৯৪৬-এর ৮ আগস্ট চার্চিল তাঁর নিজের, যাকে তিনি বলেছিলেন “ইয়োরোপীয় পরিবার, সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে (পরে “আমাদেরই অভিন্ন ইয়োরোপীয় দেশ সম্পর্কে গর্বাচভ নিগলিত উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে!) এবং “আণবিক বোমা তার করায়ত্ত হবার আগেই”, বিজয়ী সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করার আগ্রহে লর্ড মোরানকে বলেছিলেন, দু-তিন বছরের মধ্যেই সোভিয়েতকে মুছে ফেলার যুদ্ধ সম্পর্কে কম লোকই এই বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন, যদিও তারা সমাজতন্ত্র। এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের লক্ষণীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক শ্রেণিসংগ্রামের নিরবচ্ছিন্ন প্রকোপতা বৃদ্ধি সম্পর্কে স্তালিনের উপর্যুপরি সতর্কবাণীর বিরুদ্ধে উচ্চাসন থেকে চিৎকার জুড়তে ছাড়েনি।
যখন, বার্লিনের কাছে পটাশডামে মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান স্তালিনকে জানিয়েছিলেন (১৯৪৫) আমেরিকার আণবিক বোমা পরীক্ষা শেষ করে করায়ত্ত করার কথা, তখন স্তালিন এত শান্তভাবে এবং বাহ্যিক কোনো উৎকণ্ঠা প্রকাশ না করে খবরটা শুনেছিলেন যে তাতে টুম্যান ভেবেছিলেন সোভিয়েত নেতা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। তার এই ধারণা তার ঘনিষ্ঠতম ‘সহকারীদের জানিয়েছিলেন, তখন চার্চিল অবশ্য আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যদি স্তালিন খারাপ ব্যবহার করে তবে তাকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া হবে । বস্তুতপক্ষে স্তালিন এর বিপজ্জনক পরিণাম সম্পূর্ণতই উপলব্ধি করেছিলেন এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর আশু বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই আণবিক শক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। সোভিয়েত সরকার এর সামরিক ব্যবহার চায়নি কিন্তু এখন আর সম্ভাব্য শত্রুর আক্রমণের মুখে অপ্রস্তুত থাকা সম্ভব ছিল না। সমাজতন্ত্রের শত্রুরা যে কী রকম শয়তানি আচরণ করতে পারে তা জানা যায় ১৯৫০ সালে আমেরিকার সুপরিচিত কোলিয়ার্স ম্যাগাজিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কল্পিত কাহিনিকে কেন্দ্র করে এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সেই রচনাটি লিখেছিলেন বিখ্যাত লেখক এবং প্রাক্তন কমিউনিস্ট আর্থার কোয়েসলার।
“দ্য লাস্ট নিউক্লিয়ার একসপ্লোসান” (মস্কো ১৯৮৯)-এর মতো গ্রন্থে বহু কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার কথা জানা যায়। কিন্তু এখানে কেবল এটা বলাই যথেষ্ট হবে যে ১৯৪৭ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘প্যান ড্রডশট রচনা করেছিল ১৯৫৭-র ১ জানুয়ারির মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আণবিক আক্রমণ হানার এবং ইতোমধ্যে (১৯৫২) আমেরিকা হাইড্রোজেন বোমা করায়ত্ত করে ফেলবে। এই লজ্জাকর ও অমানবিক পরিকল্পিত ব্যাকমেইল অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৪৯ সালের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যায় এবং ১৯৫৩ সালেই সোভিয়েত অস্ত্রাগারে হাইড্রোজেন বোমা এসে যায়। ক্ষমতার জন্য মানুষের সব আশা প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে শুরু করে পশ্চিমা দুনিয়া এক হীন কাপুরুষোচিত প্রতিযোগিতা যা বিপন্ন করে তোলে আমাদের গ্রহকে এবং বাধ্য করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নিজেদের অস্তিত্ব ও মানব সভ্যতা রক্ষা করতে। এই প্রতিযোগিতা এবং পবিত্রতার ভণ্ডামিতে ভরা গণতান্ত্রিক অর্থহীন কথাবার্তার কাহিনি প্রচার করা হয়েছে তার অপরাধ ঢাকতে, যা এতই সুপরিকল্পিত তা এখানে আর বিবৃত করার প্রয়োজন নেই।
বিশ্বের মানুষের দৃষ্টিতে যুদ্ধে যে সোভিয়েতই বিজয়ী হয়েছিল এবং ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পশ্চিমা সেনানায়কদের কাছে আত্মসমর্পণ করানোর (বার্লিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্বকারী মার্শাল জুকভের কাছে আত্মসমর্পণের বদলে) সুকৌশলে অনুসৃত প্রতিটি প্রয়াস যে ব্যর্থ হয়েছিল তা চার্চিল ও তার বংশ সদৃশদের কাছে অসহ্য ঠেকেছিল। এইজন্যই যে জঘন্য অপরাধ কোনো সভ্য দেশ করতে পারে না তা করতেও পশ্চিমা দুনিয়া’ ইতস্তত করেনি। ১৯৪৫-এর আগস্ট মাসে জঘন্য শয়তান রূপে আকাশে আবির্ভূত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমার ওপর আণবিক বোমা বর্ষণ করে যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ধ্বংসলীলা সংঘটিত করেছিল। এই দুই শহরের নিরস্ত্র, নির্দোষ অসামরিক নাগরিকদের, যাদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে কোনোরকম অংশগ্রহণ ছিল না, এমন অমানুষোচিতভাবে সবংশে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ঘটনা সমগ্র বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। আণবিক উত্তাপ এতই ভয়ংকর ছিল যে সামান্য সংখ্যক নাগরিক কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচেছিলেন তারাও গভীরভাবে ভেবেছিলেন অন্যদের সঙ্গে তাঁদেরও তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটলে বোধহয় সৌভাগ্যবান হতেন।
কেবল ভয়ংকরই নয়, এই অকারণ, অমানবিক আক্রমণ ইঙ্গ-মার্কিনরা সংগঠিত করেছিল যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো জার্মানির নাৎসি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ঘটিয়ে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং সামরিক পরিভাষায় জাপানকে হাঁটু গেড়ে বসানো কেবল সময়ের অপেক্ষায় ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণ মাঞ্চুরিয়াকে জাপানের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করেছিল এবং জাপানের পার্লামেন্টে স্বীকার করা হয়েছিল, লাল ফৌজ এত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে যে খুব শিগগিরই জাপানকে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। পশ্চিমারা হিসাব কষেছিল, ইতোমধ্যেই জার্মানি বিজয়ের কৃতিত্বে ভূষিত সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি জাপানিদেরও আত্মসমর্পণের কৃতিত্ব অর্জন করে তাহলে তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি শীর্ষে উঠে যাবে এবং একইভাবে নেমে যাবে ‘পশ্চিমা’দের মান। অতএব, আণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তড়িঘড়ি যুদ্ধ শেষ করার শয়তানি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বিশ্বের কাছে, নৈতিকভাবে যতই অন্যায় হোক না কেন, অস্ত্রসজ্জায় পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করার প্রয়াস ছিল এর পিছনে। এটা পশ্চিমা ঔদ্ধত্বেরও প্রকাশ যে আজ পর্যন্ত আণবিক, জীবাণু ও রাসায়নিক (সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বৈদ্যুতিক) অস্ত্র পশ্চিমা দুনিয়া প্রয়োগ করেছে কেবল জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাকের মতো অপশ্চিমা দেশে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে যদি কোথাও কেউ দেখেন যাকে বলে ‘ডিসগ্রেস অ্যাবাউন্ডিং’ (ছেয়ে যাওয়া মর্যাদাহানি), তাহলে তা এখানেই পাওয়া যাবে।
প্রত্যক্ষ দৃঢ়, কখনো অসহনীয়, কিন্তু একই সঙ্গে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে আত্মোৎসর্গিত জনগণ কর্তৃক বিপ্লবকে রক্ষা করার এক মহান দৃষ্টান্ত স্বরূপ এই যুদ্ধের (১৯৪১-৪৫) অভিজ্ঞতা আরও দৃঢ়মূল করেছিল স্তালিনের চিন্তাধারাকে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও দেশের অভ্যন্তরে শ্রেণিশত্রুরা তাদের হিংস্র নখ আরও শাণিত করবে যতই সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি ঘটবে। হয়তো যখন কিছু ক্লান্ত ব্যক্তি ‘সমকেন্দ্রিকতা নিয়ে চিন্তা করছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান সম্পর্কিত মূলত বিপ্লবী ভাবধারাকে ‘গণতান্ত্রিক-কোমলতায় প্রয়োগ করার কথা ভাবছিলেন, তখন স্তালিন তার নিজের ও সমসাময়িক বিশ্বের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন এবং আশা করেছিলেন বিপ্লবের মিত্ররা যেন ঐকান্তিক ও সক্রিয়ভাবে সতর্ক থাকেন। এই দায়িত্ব পালন করতেই তাঁর ঝাক্ষুব্ধ, কখনো যন্ত্রণাক্লিষ্ট কিন্তু সদা-সংগ্রামরত জীবনের শেষের দিনগুলো নিয়োজিত হয়েছিল। তার গড়ে তোলা ভিতকে তার উত্তরসূরিরা আরও দৃঢ়, না আলগা করে দিয়েছে তা বিচার করবে ভবিষ্যৎ।
.
স্তালিন ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্র
“কেবল বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বদল করতেই নয়; নিজেদেরও বদল করতে এবং নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের যোগ্য করে তুলতে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৫, ২০ অথবা ৫০ বছর আপনাদের যেতে হবে।”– কার্ল মার্কস
“(নিউ ইকনমিক পলিসি) রাশিয়াকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় রূপান্তরিত করবে।” – ভ, ই. লেনিন
“আগে চলো/এবং নেপ-এর এই জল-কাদা হবে/অতীত।” – মায়াকোভস্কি
“আমি জানি পার্টির বিরুদ্ধে একজন সঠিক হবে না। একজন সঠিক হতে পারে কেবল পার্টির সঙ্গে এবং পার্টির মধ্যে দিয়ে, কারণ ইতিহাস সঠিকতা উপলব্ধির অন্য কোনো পথ সৃষ্টি করেনি।” – ট্রটস্কি
“অন্য বিপ্লবের চেয়ে আরও সত্য যে, স্তালিনবাদী রাশিয়া ২০টা প্রজন্মের কাজ ২০ বছরে করেছে। – আইজাক ডয়েটশার
প্রিয়ব্রাজেনস্কি, যিনি বুখারিন-এর সঙ্গে লিখেছিলেন ‘দ্য এ বি সি অব কমিউনিজম এবং যা গোপন স্টাডি সার্কেলে বাধ্যতামূলক পাঠ্য ছিল, একসময়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন (ডয়েটশার, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-২১৯, দ্রষ্টব্য), স্তালিনকে অনেক বেশি দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। লেনিন তার জবাব দিয়েছিলেন : “ঐ রকম আর একজন ব্যক্তি কোথায় পাবো? কাজটা বিপুল, তা সমাধা করতে এমন একজন ব্যক্তি চাই যার মধ্যে কর্তৃত্ব আছে।” বোধহয় স্তালিন কালক্রমে অত্যধিক কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের জ্ঞান যাদের আছে তারা ভুলতে পারেন না এঙ্গেলস-এর চেতাবনী যে, জীবনে বিপ্লবই হলো সবচেয়ে কর্তৃত্ববাদী। অক্টোবর বিপ্লব এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলি কখনই মসৃণ ছিল না, বরং এত সমস্যাসঙ্কুল ছিল (বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদ্যমান অবস্থায়) যে কিছুটা কতত্ত্ববাদ এড়ানো যেত না। তার সাধারণ সামাজিক উৎস এবং দক্ষতা সম্পর্কে বৌদ্ধিকভাবে উদ্ধত সহকর্মীদরে অবজ্ঞার প্রেক্ষাপটে স্তালিন নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন এবং লেনিনের আস্থা অর্জন করেছিলেন। অবশ্য লেনিনের জীবনের শেষকালে এই অবস্থায় কিছুটা চিড় ধরেছিল, যা হয়তো লেনিন বেঁচে থাকলে ঠিক হয়ে যেত! এটা ঘটেছিল মূখ্যত স্তালিন যেহেতু অন্যের চেয়ে একটু বেশি সর্বদাই অনুসরণ করতেন এবং তার চিন্তা-ভাবনাকে শব্দালঙ্কার এড়িয়ে প্রাঞ্জলভাবে, কখনো এমনকি নিরলসভাবে, শব্দান্তরিত করে লিখতেন ও বলতেন, যাতে অন্যদের চেয়ে ট্রটস্কিই বেশি আনন্দ পেতেন। তাই ট্রটস্কি মনে করতেন এবং বলতেনও, রাশিয়ায় বিপ্লবের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং বিপন্ন ভবিতব্যের জন্য সোভিয়েতের জনগণ নিজেরাই দায়ী হবেন, যদি না বিশ্ব বিপ্লব, অন্তত জার্মানিতে শুরু হয়ে পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রসারিত না হয়। স্তালিন তখন লেনিনের উক্তি আঁকড়ে ধরে বলতেন: “যা পারি এখন তা-ই করা যাক, পরে কী করা যাবে তা দেখব!” লেনিনের শিক্ষার সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতি রেখে স্তালিন মনে করতেন, মহান “অক্টোবর বিপ্লব বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মহাসমুদ্রে সমাজতন্ত্রের প্রথম কেন্দ্র এবং তার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছে বিশ্ব বিপ্লবের প্রথম স্তর ও তার ভবিষ্যৎ অগ্রগতির জন্য এক শক্তিশালী ভিত।”
“পশ্চিমা দেশগুলোর বিপ্লবী সততা সম্পর্কে সর্বদাই সন্দিহান (কারণ সম্ভবত স্তালিনের মধ্যে বিরাজিত এশীয় গৌরব এবং পশ্চিমা সমাজতন্ত্রীদের নিজেদের দেশের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়া করা ও বারংবার বিপ্লবী সুযোগ হাতছাড়া করার দরুন) স্তালিন লেনিনের বিপ্লবী স্পর্ধা ও বিচক্ষণতার অনুসারী হয়ে একটি দেশে সমাজতন্ত্র”-র চিন্তাধারা ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। অশেষ সম্পদের অধিকারী বিশ্বের এক-ষষ্ঠাংশ আয়তনের প্রাক্তন জার সাম্রাজ্য বিশ্ব বিপ্লবের কাণ্ডারীর ভূমিকা পালনের জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছিল। লেনিনের মৃত্যুর পর, সমষ্টিগত নেতৃত্বের সন্ধান করার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, বিশেষ প্রতিভাধরদের উচ্চাশা (অত্যধিক আত্মগৌরবসহ) পরস্পরের মধ্যে খাপ খাওয়ানো যায়নি। তাই ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিন এবং অন্যান্যরা একরকম ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এতে, বলতে গেলে, স্ত লিন জিতে যান, কারণ তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বলতা ও খানিকটা আত্মশ্লাঘাকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদকের প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সংযোগ গড়ে তুলে সারা দেশকে তার লেনিনবাদ’-এর চিন্তাধারার পক্ষে সমবেত করতে পেরেছিলেন।
এই লক্ষ্যে, তাঁকে বাম ও দক্ষিণ উভয় বিচ্যুতির বিরুদ্ধে, যথা একদিকে ‘বিপ্লবী রেমান্টিকতা’র এবং আর একদিকে যদিও খানিকটা গোপনভাবে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য থেকে সরে আসার প্রবণতার বিরুদ্ধে, দ্বিমুখী মতাদর্শগত রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল। ক্ষমতার লড়াইয়ে আঁকাবাঁকা পথ এবং পরে আর্থ-সামাজিক কাঠামোর আমূল সংস্কার সাধনে বিপ্লবের পদক্ষেপের পরিণতিতে বিপুল মানবিক ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াও পার্টি কর্মীদের ব্যাপক হারে ‘বহিষ্কার’ কাহিনি ছিল খুবই আকর্ষণীয়, কিন্তু নিরানন্দময়।
শক্রশক্তি-বেষ্টিত একটি পশ্চাৎপদ দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে কঠোর সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যতিরেকে দ্রুত রূপান্তরিত করা যাবে না, অথচ দ্রুত করতে হবে নতুবা কিছুই হবে না। যাই হোক সমাজতন্ত্রের জন্য বিষয়ীগত শক্তির সীমাবদ্ধতা আছে, কারণ এক নতুন, সকলের জন্য শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের পিছনে তার স্বাভাবিক প্রেরণার বিস্ময়কর ফল পাওয়া গেলেও তা বিপুল দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ্য করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। রেজিমেন্টেশন বা কঠোর নিয়ন্ত্রণ কথাটা কারোর পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু এক তীব্র, লাগাতার মানবিক কষ্ট স্বীকারের সময় কঠোর শ্রমের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ও সামাজিক শৃঙ্খলা আয়ত্ত করার, এ ছিল এক উচ্চতর রূপ। ১৯১৭ সালের আগে থেকেই সোভিয়েত জনগণ এই দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে এসেছেন এবং তাদের এই যন্ত্রণা আরও দীর্ঘায়িত হতো যদি না বিপ্লব, তার পুঁজিবাদী শত্রুর দ্বারা অবরুদ্ধ, কলঙ্কিত ও ক্রমাগত উত্ত্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও বিজয়ী না হতো।
.
যুদ্ধের ভেতরকার আর এক যুদ্ধের বিভীষিকা
ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, খুবই ক্লেশকর, প্রায়শই যন্ত্রণাবিদ্ধ কিন্তু প্রকৃতই দুনিয়া-কাঁপানো ঘটনাবলি স্তালিনের ভূমিকার কিছুটা বিস্তৃত ধারাবাহিক ধারণা পেতে গেলে বাছ বিচার করে পড়তে হবে স্তালিন প্রসঙ্গে আইজাক ডয়েটশারের মতো জীবনীগ্রন্থগুলো এবং সাধারণভাবে পরশ্রীকাতর ও তীব্র শত্রুতামূলক সব রচনা ও গ্রন্থ। এই গ্রন্থ তার কেবল রেখাচিত্রের ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, সমাজতান্ত্রিক শিল্পের ম্যানেজারদের এক সম্মেলনে (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১) স্তালিন শিল্পের সমস্যা ও আসন্ন প্রেক্ষিত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তখন সর্বপ্রথম রূপায়িত করা হচ্ছে যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তা সফল করার পথে উৎপাদন ও তার অগ্রগতির সঙ্গে সংশিষ্ট খুবই বাস্তব কয়েকটি সমস্যা সম্পর্কে বলার পর স্তালিন বাম ও দক্ষিণ উভয় ক্ষেত্রেই পরাজিত মনোভাবাপন্নদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে বর্তমান গতিবেগ কিছুতেই স্তিমিত করা যাবে না, বরং বাড়াতে হবে। এটা সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক-কৃষকদের প্রতি আমাদের কর্তব্যের নির্দেশ। এটা হলো সারা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার নির্দেশ।
অতীতে প্রায়শই পশ্চাৎপদ রাশিয়াকে বিভিন্ন শক্তি পর্যদস্ত করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্তালিন, “না, আমরা আর পর্যুদস্ত হবো না” বলে রুশীয় গৌরব নিষিক্ত করতে কখনও ইতস্তত করেননি। রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করেছে মোগলরা, খাঁ-রা। তুর্কি বাহিনীর দ্বারা সে পর্দুদস্ত হয়েছে। সুইডিশ সামন্ত প্রভুরা তাকে পর্যুদস্ত করেছে। পোলিশ ও লিথুয়ানীয় অভিজাত শ্রেণি পর্যুদস্ত করেছে। রাশিয়াকে। ইংরেজ ও ফরাসি পুঁজিপতিরা পর্যুদস্ত করেছে তাকে। জাপানি ব্যারনরাও তাদের পর্যদস্ত করেছে। সকলেই রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছে। তার পশ্চাৎপদতার দরুন : সামরিক পশ্চাৎপদতা, সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা, রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতার দরুন: সামরিক পশ্চাৎপদতা, সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা, রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতা, শিল্পে পশ্চাৎপদতা, কৃষিক্ষেত্রে তার পশ্চাৎপদতার জন্য। তাকে পর্যুদস্ত করা হয়েছে, কারণ তা ছিল লাভজনক এবং তার জন্যনবিনিময়ে কোনো শাস্তি পেতে হবে না…।” একটা নির্দিষ্ট বক্তব্যকে সোজা ভাষায় বারবার উচ্চারণ করাটাই ছিল স্তালিনের বৈশিষ্ট্য।
“পুঁজিবাদের জঙ্গলের নিয়ম” যা “পশ্চাৎপদ ও দুর্বল”-কে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম করে তোলে, এখন যা চলছে, তিনি বলতেন, তাকে বদল করতে হবে। “অতীতে আমাদের কোনো পিতৃভূমি ছিল না, আমরা তা পেতেও সমর্থ ছিলাম না। কিন্তু এখন আমরা পুঁজিবাদকে উৎখাত করেছি, ক্ষমতা এখন শ্রমিকশ্রেণির করায়ত্ত, আমরা এখন পিতৃভূমি পেয়েছি এবং আমরা তার স্বাধীনতা রক্ষা করব। আমরা অতি শিগগির তার পশ্চাৎপদতা দূর করব এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রকৃত বলশেভিক গতিবেগ সৃষ্টি করব। এছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। সেজন্যই অক্টোবর বিপ্লবের সময় লেনিন বলেছিলেন: “হয় উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাও, না হয় ধ্বংস হও!”
বিপুল চ্যালেঞ্জকে যে মোকাবিলা করতে হবে তা স্তালিন তখন জোরের সঙ্গে বলেছিলেন: “উন্নত দেশগুলো থেকে আমরা ৫০ বা ১০০ বছর পিছিয়ে আছি। এই দূরত্ব আমাদের দশ বছরে অতিক্রম করতে হবে। আমরা এটা করব, নচেৎ তারা আমাদের ধ্বংস করে দেবে।”
এই ভাষণের দশ বছরের মধ্যে নেমে এসেছিল এক জঘন্য ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট আক্রমণ যা অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে ঠেকানো গিয়েছিল একমাত্র স্তালিনের পূর্ব-হুঁশিয়ারি অনুসারে উদ্যোগ নেওয়ায়।
স্তালিন তার উল্লিখিত ভাষণে কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক কৃষকদের প্রতি দায়বদ্ধতার কথাই বলেননি, বলেছেন বিশ্ব প্রলেতারিয়েতের প্রতি দায়বদ্ধতার কথাও। “বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির সমর্থন ব্যতিরেকে আমরা (সোভিয়েতের জনগণ) অনেক আগেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতাম।” সোভিয়েত জনগণ “সকল দেশের প্রলেতারিয়েতের কঠিন দায়িত্ব সম্পাদন করার কর্মীবাহিনী” হবার সুবাদে অর্পণ করেছে প্রথমে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের নিয়োজিত একটি শ্ৰকিমশ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার এবং “সমাজতন্ত্র গঠন শুরু করার।” সোভিয়েত জনগণ নিজেদের কাছে এবং বিশ্বের কাছে পশ্চাৎপদতা দূর করে সমাজতন্ত্র নির্মাণে বলশেভিক গতিবেগ সঞ্চার করতে দায়বদ্ধ। স্তালিন বলেছিলেন, যা ভোলা যায় না- “আমরা এগিয়ে চলব এমনভাবে যাতে সমগ্র বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে : “এই হলো আমার অগ্রগামী বাহিনী, আমার কাজ সম্পাদন করার কর্মীবাহিনী, এই হলো আমার শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র, আমার পিতৃভূমি; তারা যে কাজ করছেন তা আমার কাজ এবং তারা তা ভালোই করছেন; আসুন, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আমরা এদের সমর্থন করি এবং বিশ্ববিপ্লবের স্বার্থ সর্বত্র প্রসারিত করি। বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির প্রত্যাশা কি আমরা পূরণ করব না, তাদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আমরা পালন করব না? হ্যাঁ, আমরা করব যদি না আমরা নিজেদের মর্যাদাহানি করতে না চাই।”
এ হলো এক সরল সাদাসিধে কথা, ট্রটস্কির মতো অসাধারণ বাগ্মী ও জিনোভিয়েভের মতো প্রতিভাধর জনপ্রিয় রাজনৈতিক বক্তা হয়তো একে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন, কিন্তু এমনকি স্তালিনের জর্জীয় বাচনভঙ্গিতে বলা এই কথাগুলো সকলের হৃদয় ছুঁয়েছিল। সোভিয়েতের শিল্প-মানেজারদের এই নীরস বস্তুগত সভায় এই ভাষণে স্তালিন বলেছিলেন, “এমন কোনো নগর-দুর্গ নেই যা বলশেভিকরা দখল করতে পারে না।” এবং তার সর্বশেষ শান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় কথা ছিল : “আমরা এক বিশাল সমাজতান্ত্রিক শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। আমরা মাঝারি কৃষকদের সমাজতন্ত্রের পথে চালিত করেছি। ইতোমধ্যেই আমরা নির্মাণকাজের জন্য যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা সম্পন্ন করেছি। কিন্তু এখনও বাকি আছে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে চর্চা ও আয়ত্ত করা। এবং এটাই যখন আমরা সম্পন্ন করতে পারব তখন আমরা এখন যা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না, সেই গতিবেগ সৃষ্টি করতে পারব। এবং এটা আমরা করতে পারি যদি তা আমরা সত্য সত্যই চাই।” (জে ভি স্তালিন/প্রবলেমস অব লেনিনিজম’, মস্কো, ১৯৪৩, পৃষ্ঠা-৩৫৯/৬৭, দ্রষ্টব্য)।
.
কঠোর হাতে রাষ্ট্র নির্মাণ
ভয়ংকর রকম অসুবিধার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাহিনি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা খুবই কঠিন। কিছু মোটা দাগের রূপরেখা দেওয়া যেতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিনিময় ও সমন্বয় ছাড়া প্রধানত ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ (একত্রে বা আলদাভাবে) প্রভৃতির বাম চিন্তাধারা প্রসূত প্রভাব পড়েছিল যে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরের বিশ্বে পুঁজিবাদ সর্বোচ্চ অবস্থায় চলতে থাকবে তখন দেশের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্র নির্মাণের সমস্ত প্রয়াস অসার ও ব্যর্থ হতে বাধ্য। বুখারিন, রাইক ও ট্রটস্কি পরিচালিত দক্ষিণপন্থীদের, তাদের কিছু বিপ্লবী বুলি সত্ত্বেও, শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে যে, পুঁজিবাদকে যখন আপাতদৃষ্টে উৎখাত করা যাচ্ছে না তখন তাদের সঙ্গে আপস করে নেওয়াই ভালো। এটা একটা সরলীকৃত বিবরণী হবে যদি না মনে রাখা হয় প্রাক্তন জার সাম্রাজ্যর একটা বিশাল বিভিন্ন প্রকৃতির অসমর অঞ্চলের সমষ্টির মানুষের জীবনকে রূপান্তরিত করার কঠিন বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার অকল্পনীয় দুঃসাধ্যতা। এখন আর সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব-এর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সোভিয়েত কমিউনিজম’- কে স্মরণ করার প্রচলন নেই, কিন্তু ঘটনায় পরিপূর্ণ এর পৃষ্ঠাগুলো, সোভিয়েতের শত্রুভাবাপন্ন পর্যবেক্ষকদের উল্লেখ এবং সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা রিপোর্ট ও প্রকাশনা, সোভিয়েতের মতাদর্শ থেকে লেখকদ্বয়ের পার্থক্য তুলে ধরার সাথে সাথে আশ্চর্য রকম পক্ষপাতহীন বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি যদি কোনো সৎ গবেষক চর্চা করেন তাহলে দেখতে পাবেন তাদের আলোচনার ব্যাপ্তি ও সময়কালের ঘটনার এক অকাট্য বিবরণী।
কেউ হয়তো স্মরণ করতে পারেন ১৯২০ সালের কাছাকাছি যখন বার্ট্রান্ড রাসেল ঝটিকা সফর সেরে “দ্য থিয়োরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব বলশেভিজম” নামে একটি সমালোচনামূলক বই লিখেছিলেন, তখন সেই বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে সুপরিচিত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক কার্ল র্যাডেক লিখেছিলেন, যখন সোভিয়েত জনগণ ও তাদের নেতৃবৃন্দ সমস্ত অসুবিধাকে জয় করে কঠিন কাজ করে চলেছেন তখন রাসেলের পক্ষে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক, দেশে ফিরে গিয়ে নিজের বাড়ির ঘরের মধ্যে চুল্লির উত্তাপের সামনে আরামে বসে হাতে তৈরি পানীয়র পাত্র নিয়ে পাইপ টানতে টানতে বলশেভিকদের দুষ্কর্মের রোমন্থন করা। এমনকি যদি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাবেক আমলের ইট দিয়ে সাহসী নতুন বিশ্বকে গড়ে তুলতে হয় সেখানে বলশেভিকদের কাছে পরিপাটি করে কাজ করা সম্ভব ছিল না। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন যিনি ট্রটস্কি ও জিনোভিয়েভের মতো নন, লেনিন ও তার শিক্ষার প্রতি সর্বদাই বিশ্বস্ত ছিলেন, খুব দ্রুতই সমকক্ষদের মধ্যে প্রথম স্থানে উঠে যান। এর কারণ, ট্রটস্কির মতে, স্তালিন ছিলেন “নিঃসঙ্গ নেকড়ে”, আশপাশের মধ্যে সবসময়ই উদ্ধত, “মাঝারি ধরনের ব্যবস্থা”। কিন্তু সেটাই যখন ছিল হাতের কাছে একমাত্র ব্যবস্থা তখন আর কোনো উপায় ছিল না। এটা এই নয় যাকে বলা হয় “ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা”, অর্থাৎ যাই ঘটকু না কেন তাই যথার্থ বলার প্রয়াস। এটা সেই রকমই হতো যদি মহান অক্টোবর বিপ্লব হতো একটা দুর্ভাগ্যজনক ভ্রান্তি, যদি মানব ইতিহাসে সোভিয়েত হতো একটি নেতিবাচক ঘটনা। তবে যে চরম ক্ষতিকর প্রচার বছরের পর বছর ধরে চলছে তা ইতিহাসের রায় নয়, হতেও পারে না। এমনকি আইজাক ডয়েটর কখনো কখনো স্তালিনকে ভেবেছেন ‘প্রাচ্য জাতীয়’ ধূর্ততায় (এমনকি তার মতো সংবেদনশীল লেখককেও পশ্চিমা পক্ষপাতমূলক মনোভাব ত্যাগ করা কঠিন হয়েছে) সজ্জিত এক গভীর প্রতারণাপূর্ণ রাজনৈতিক চালক, যিনি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন এবং অবশেষে শীর্ষ অবস্থানে উঠে গেছেন। হয়তো তিনি মনে মনে নিজের কোনো উচ্চাশা পোষণ করতেন, কিন্তু অন্ততপক্ষে এমনকি তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের দৃষ্টিতেও, তিনি ছিলেন একজন ধীর, স্থির ও শান্ত স্বভাবের দক্ষ সহকর্মী যার কোনো দর্শনীয় গুণ ছিল না এবং বাহ্যত নিজেকে সাধারণ হিসেবেই তুলে ধরতে চাইতেন। এটা যদি তার কোনো মুখোশ হয়ে থাকে তাহলে এতো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি তা করেছেন যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও হার মেনে গেছে। এটাও ধরা পড়ে স্তালিনের সময়-জ্ঞান ছিল প্রায় অতি প্রাকৃত। নিঃসন্দেহে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন ট্রটস্কির কাছ থেকে যাঁর ছিল প্রকৃতই এক অতি তৎপর মানসিকতা এবং কৃষির যৌথ-খামারিকরণ ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচনার (শিল্পায়নের প্রয়োজনে) চিন্তাধারা, যার মূল নির্যাস তালিন আয়ত্ত করে যথাসময়ে যতদূর সম্ভব কঠিন অবস্থাতেও কার্যকরী করেছেন। বাস্তব ক্ষেত্রে তাকে সুসজ্জিত করেছিল তাঁর তৃণমূল সংযোগ ও পার্টি সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। একসময়ে লেনিনের পরেই অবস্থিত ট্রটস্কি নিজেরই সৃষ্ট সমস্যার শিকার হয়েছিলেন, যা বিভিন্ন সময়ে আরও প্রকট হয়েছে সুবিধাবাদী জননেতাসুলভ ব্যক্তি শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন ট্রটস্কির সঙ্গে (সেটা কী স্তালিনের চতুরতা?) এবং জিনোভিয়েভদের উদ্যোগেই ট্রটস্কির অবনমন শুরু হয়েছিল। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে তাঁকে পলিটব্যুরো থেকে অপসারিত করা হয়; ১৯২৭ এর অক্টোবরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন; ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে মহান বিপ্লবের ঠিক দশ বছর পরে, ট্রটস্কি পার্টি বিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন; ১৯২৮-এর জানুয়ারিতে কাজাখস্তানের আলমা আটায় নির্বাসিত করা হয়; ১৯২৯ সালে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হন, চলে যান তুরস্ক ও নরওয়ে হয়ে মেক্সিকোতে (জানুয়ারি ১৯৩৭)। তাঁর মতো আগুন ঝরানো বিপ্লবী অভিমানহত হয়ে বসে থাকতে পারেন ভাবা যায় না, কিন্তু তিনি সবসময়েই রাগে গরগর করেছেন নিঃসঙ্গভাবেই, কারণ তিনি পরিবেষ্টিত ছিলেন বিভিন্ন ধরনের সোভিয়েত-বিরোধী শক্তির দ্বারা, এবং চেষ্টা করছিলেন তার নিজের চতুর্থ আন্তর্জাতিককে পুনরুজ্জীবিত করতে, যা ১৯৩৫ সালে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দখল করে নিতে নিজেকে প্রস্তুত ও সক্ষম বলে ভেবেছিলেন! ১৯৪০-এর এপ্রিলে ট্রটস্কি “সোভিয়েত শ্রমিক ও কৃষকদের কাছে আবেদন করেন “Cain * who is Stalin”-কে ধ্বংস করতে [কেইন ছিল আদম-পুত্র, যে তার ভাই আবেলকে হত্যা করেছিল]। একটি দীর্ঘ রোমাঞ্চকর কাহিনির সমাপ্তি ঘটে ট্রটস্কির “নিজের গলায় ফাঁস লাগানোর মতো যখন জনৈক গুপ্তঘাতক, যে নিজেই ছিল একজন ট্রটস্কিপন্থী (অভিযোগ করা হয়। স্তালিনের উদ্যোগে), ১৯৪০-এর ২০ আগস্ট মেক্সিকোতে তাকে হত্যা করে। সত্য, পূর্ণ সত্য এবং একমাত্র সত্য বোধহয় কখনই জানা যাবে না।
ইতোমধ্যে, লেনিনের মৃত্যুর পর, স্তালিন তার দোষ-গুণসহ দৃঢ়ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিচালিত করেছেন বিরামহীন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুতার বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রকে যতটা সম্ভব গড়ে তুলতে ও সংহত করতে। স্তালিনই সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়ন ও কৃষির খামারিকরণের লাইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে সোভিয়েত পার্টি ও জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার, স্তালিনই (যদি একজনের নাম উচ্চারণ করতে হয় যদিও তিনি বলতেন “একজন ব্যক্তি কখনই স্থির করতে পারেন না।”) পরে পার্টি ও জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যখন সোভিয়েত লাল ফৌজ এক অকল্পনীয় কঠিন লড়াইয়ে (১৯৪১-৪৫) জয়ী হয়েছেন এবং ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট অক্ষশক্তিকে পরাজিত করে এক বিশ্বব্যাপী ঐতিহাসিক বিজয় সংগঠিত হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনের মধ্যবর্তী সময়ে স্তালিনই পার্টিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যখন পার্টি সর্বপ্রকার সুবিধাবাদ ও বিকৃতিবাদ-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও কামেনে এবং পরে বুখারিন ও রাইকভ পরিচালিত গোষ্ঠীর কার্যত পরাজিত মনোভাব ও বিভেদকামী কার্যকলাপকে উচ্ছেদ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে রক্ষা ও বিকশিত করেছে। সাফল্যের এই প্রেক্ষাপটে (কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের বিজয়ের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে এবং তাঁর নাম হৃদয়ে ও ঠোঁটে নিয়ে যোদ্ধারা স্তালিনগ্রাদে, বার্লিনের মুখে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত ফ্রন্টে ইতোপূর্বে অজেয় বলে কথিত ফ্যাসিস্টদের কণ্ঠনালি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে।
.
সমাজতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য বিজয়রথ
এই গ্রন্থে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র নির্মাণ অথবা যদি কেউ বলতে চান, প্রাক-সমাজতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের বিস্তৃত বিবরণী দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ভালো বা মন্দ যাই হোক, এই নির্মাণ কাজ সংঘটিত হয়েছে স্তালিনের উত্তরণ পর্বেই। এটা বলার প্রয়োজন আছে যে, এই কৃতিত্বপূর্ণ কাজে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল- ছিল ভ্রান্তি এবং এমনকি (মনুষ্যচরিত্র যা হয়) অপরাধও। বহুকাল আগে প্যারিসে (১৯৯২) যখন বিপ্লব তার অনেক ‘সন্তানদের হত্যা করেছিল, তখন মাদাম বঁল্যা, যিনি নিজেই একজন বিপ্লবী ছিলেন কিন্তু জীবনের নিষ্ঠুর পরিহাসবশত ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলার অপেক্ষায় ছিলেন, শোনা যায়, নিকটবর্তী ‘লিবার্ট স্ট্যাচু’-র (স্বাধীনতার স্মারক মূর্তি) দিকে আঙুল দেখিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন: “হে স্বাধীনতা! তোমার নাম নিয়ে কী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে!” নিজের ন্যায়পরায়ণতার যুক্তিতে তার নিজস্ব ‘সন্ত্রাস’ পদ্ধতি (এটা ভুলে গেলে চলবে না প্রতিক্রিয়াশীল “শ্বেত সন্ত্রাস” ইতিহাসে অনেক বেশি হিংস্র গণ্য হয়েছে)। গ্রহণ করার জন্য বিপ্লবের নৈতিকতা নিয়ে বিরামহীন বিতর্ক চলবে, কিন্তু বস্তুতপক্ষে এটা বলা অন্যায় নয়, যেমন ঐতিহাসিক মায়ার্স বলেছিলেন যে, “যা কিছু সুন্দর তার নামে স্বাধীনতা, ন্যায় ও ধর্মের নামে এমন সব বড় বড় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে যা ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে!” এই বিষয়ে একাধিক গ্রন্থ লেখা যায় এবং হয়েছে, কিন্তু এখন আসল কথাটা হলো ফরাসি (১৭৮৯), রুশ (১৯১৭) এবং চীনা (১৯৪৯) বিপ্লবে কিছু ভয়ংকর বাড়াবাড়ি হওয়া সত্ত্বেও এই বিপ্লবগুলো ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করেছে ভালোর দিকে। কেউ পছন্দ করুন বা না করুন, পুরাতনের ভস্ম থেকেই নতুন পৃথিবীর উদয় হয়।
স্তালিনের কাছে মনে হয়, লেনিনের সর্বোত্তম গুণ ছিল বিপ্লবের সপক্ষে তার অপ্রশম্যতা। স্পষ্টই প্রতীয়মান, লেনিন ছিলেন এক অসীম ক্ষমতাশীল যিনি কিছু কাজকর্ম থেকে (সেই সঙ্গে বৈপ্লবিক কর্মসূচির বিরোধীদের হিংস্র দমন কাজে নীরবে সম্মতিদান থেকে) নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবুও ম্যাকসিম গোর্কির (সেই সঙ্গে লেনিনের স্ত্রী ক্রুপস্কায়ারও) স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে কেমন করে। লেনিন তাঁর প্রিয় বাজনা শুনতে শুনতে মন্তব্য করতেন, একটা সময়ে যখন বৈপ্লবিক দায়িত্ব দাবি করে শত্রুর মাথা ভেঙে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে, তখন যেন কেউ মানুষের মাথায় সস্নেহ হাত বুলিয়ে দেবার প্রেরণাদায়ক বাজনার সুরে প্রভাবিত না হয়। অবশ্য এসবই অলঙ্কারপূর্ণ কথা, যদিও এমনকি খুবই বুর্জোয়া শ্রদ্ধাশীল চিন্তাবিদরা এই কথাগুলো উদ্ধৃত করেছেন লেনিনের অনুভূতিহীনতা’-র দৃষ্টান্ত হিসেবে। তবে যাই হোক স্তালিন নিঃসন্দেহে ভিন্ন ধাতুতে তৈরি মানুষ। ছিলেন। তিনি একজন কঠিন কঠোর ব্যক্তি হিসেবে লক্ষ্য সাধিত করতে জীবনের আবেগের বশবর্তী না হয়ে নির্দয় ব্যবস্থা নেবার জন্য তৈরি ছিলেন।
এই দুই চরিত্রের মধ্যে বিভিন্ন বহু বিষয়ে বিপুল পার্থক্য ছিল। যখন তার ৫০ বছর বয়স (১৯২০) লেনিন জাতীয় স্তরে তাঁর জন্মদিবস পালন করার অনুমতি দেননি। যদি তার কোনো সুযোগ থাকত তাহলে তার শবদেহকে মমিতে পরিণত করে তার তোষামোদী প্রশংসায় মিউজিয়ামে রাখার অনুমতি দিতেন না। যাই হোক, স্তালিন মনে করেছিলেন লেনিনকে বস্তুত দেবতুল্য করে দেখা সোভিয়েত দেশের তৎকালীন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে লক্ষ্যসাধনে সাহায্য করবে এবং যে কারণে এ সম্পর্ক তিনি তাঁর নেতার ইচ্ছাকে অমান্য করতে ইতস্তত করেননি। অবশ্য জনগণের ইচ্ছার সম্ভাব্য অজুহাত সত্ত্বেও স্তালিনের ব্যক্তিপূজার আগ্রহকে। উৎসাহিত করার যথার্থতা প্রতিপাদন করা যায় না; যেমন, উদাহরণস্বরূপ, খুবই আঁকজকমভাবে স্তালিনের ৭০তম জন্মবার্ষিকী পালন (২১ ডিসেম্বর ১৯৪৯), যদিও অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় স্তালিনের ভাবমূর্তিতে এক নতুন উজ্জ্বল মাত্রা যুক্ত করেছিল। বিশিষ্ট স্তালিন-’ভক্ত’ জর্জ বার্নাড শ ফ্যাবিয়ান সোসাইটির বক্তৃতায় (১৯৩৪) যা বলেছিলেন : “বিপ্লবের জন্য আমি অধৈর্য হয়ে পড়েছি। আমি খুবই আনন্দিত হব যদি বিপ্লব আগামীকালই ঘটে। কিন্তু একজন সাধারণ মাপের ভীতু মানুষ হিসেবে আমি চাই যতটা সম্ভব ভদ্রজনোচিতভাবে বিপ্লব হোক।”
.
সেই সব রাষ্ট্রদ্রোহীরা
৩০-এর দশকের শেষভাগে তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতা সংক্রান্ত মামলা সম্পর্কে আরও আলোচনার আয়োজন আছে। ওয়েব দম্পতি কথিত ‘গোঁড়ামিতার রোগ এবং কিছুটা বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও দেশের ভিতরের এবং বাইরের শত্রুদের ক্রিয়াকলাপে রাষ্ট্রের বিপদ সম্পর্কে প্রকৃত ভীতি থেকে জন্ম নেওয়া কুখ্যাত বহিষ্কার’-এর ঘটনাবলি স্তালিন যুগের এক চরম কলঙ্ক। তবে যাই হোক, ঐতিহাসিক মাত্রাজ্ঞান থাকতে হবে এবং স্মরণে রাখতে হবে, উদাহরণস্বরূপ, যে “গ্রেট ব্রিটেনে ১৬৮৯ সালের সীমাবদ্ধ বিপ্লব, যার দ্বারা চার্চ অনুমোদিত ক্যাথলিক রাজাকে হটিয়ে সংসদীয় আইন বলে প্রোটেস্টান্ট রাজাকে ক্ষমতাসীন করা হয়েছিল, চলেছিল প্রায় একশো বছর ধরে চক্রান্তকারীদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের দ্বারা, যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিদ্রোহ, গুপ্তচরবৃত্তি ও প্রতারণা করে, বিদেশি শক্তির সরাসরি সহায়তায় বা ব্যতিরেকে, মনে করতেন ধ্বংস করার জন্য বিদ্রোহী না হয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চূড়ান্ত অব্যবস্থাকে বদলে দেবার ন্যায় সঙ্গত প্রয়াস” (সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৭)। গোলমালের মূলে ছিল “একটি দেশে সমাজতন্ত্র” সম্পর্কে লেনিন-স্তালিনের লাইনের মার্কসবাদী ভিত্তিতে চ্যালেঞ্জ করে “ট্রটস্কির আন্দোলন” (কথাটা ওয়েব দম্পতি ব্যবহার করেছেন)। ক্ষমতার লড়াইয়ে একে অপররের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে দক্ষ, স্তালিন হয়তো নিন্দার ঊর্ধ্বে ছিলেন না, কিন্তু তিনি খুব একটা উচ্চকিতও ছিলেন না এবং কখনো ট্রটস্কিকে আক্রমণ করার ব্যাপারে জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ-এর পর্যায়ে নিচে নামতে পারেননি, যারা ১৯২৪-এর শেষে বলেছিলেন: “এই মৃত কুকুরটাকে (ট্রটস্কি) কেন পলিটব্যুরোতে রাখা হয়েছে; সে এত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে যে কাজ করাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে!”
স্মরণ করতে বিরক্তির উদ্রেক হয় যে একসময়ে যখন প্রাক্তন বিপ্লবীরা বিপ্লব বিরোধী দুষ্কর্মের অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সে সম্পর্কে রেকর্ড তুলে ধরা হয়েছিল, যেমন বুখারিন, যিনি তাঁর বিশিষ্ট গুণ সত্ত্বেও একবার নয় বারবার স্তালিনের সামনে নত মস্তকে তার পূর্ব-বিশ্বাস প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কেবল বুখারিনই নন, আরও অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতারা বিচার চলাকালে অবিশ্বাস্যরকমের আত্ম-দোষারোপমূলক ‘স্বীকারোক্তি করেছিলেন যা কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে যোগ্য নয়। এটা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপুল ক্ষমতার প্রয়োগের কারণে হয়ে থাকে তবুও একজন স্মরণ করতে পারেন জনৈক সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী মারিয়া স্পিরিডোভনা একদা স্তালিনকে যা বলেছিলেন : “যাদের কোনো মেরুদণ্ড নেই তাদের আপনি মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারেন!” তুলনা টানা প্রতারণামূলক, কিন্তু কী বৈপরীত্য, ৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে জর্জি ডিভি, বুলগেরীয় কমিউনিস্ট, হিটলারের জেলের অভ্যন্তর থেকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে কমিউনিস্ট মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, যার সামনে হার মেনে কুদ্ধ গ্যোয়েরিং তাঁকে তাঁর ভাষায় শাসিয়েছিলেন এবং ডিমিট্রভ ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে বীর সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেসে (১৯৩৫) ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পপুলার ফ্রন্টের প্রধান মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। ট্রটস্কির মতো : ‘হীনতর মানুষ স্বভাবজ অবজ্ঞার সাথে ডিমিট্ৰভের দৃঢ়তার প্রশংসা না করে তাকে তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন : ‘বিয়ার পাত্র হতে গতানুগতিক এক দোকানদারের মতো!’
রাষ্ট্রদ্রোহিতা সম্পর্কিত মামলার বিচারে নিহিত হিংস্রতার গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। ১৯৬৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইজাক ডয়েটশার বলেছিলেন, নভেম্বর বিপ্লব ছিল ‘বিষয়গত বাস্তবতার এক মহান স্পন্দনকারী ঘটনা’, বলশেভিকরা এক অবরুদ্ধ দুর্গ’-কে কোনোক্রমে রক্ষা করেছেন এবং ‘অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা তাদের চিন্তাধারা ও নৈতিকতাকে পদদলিত করেছিল। এর সমস্ত চাপটা বহন করেছিলেন লেনিনের উত্তাধিকার হিসেবে স্তালিন, যা তিনি সমর্থ হয়েছিলেন, ডয়েটশারের ভাষায়, “সার্বভৌম স্বেচ্ছাচারিতার চরিত্র ও নৈতিকতাহীনতার সঙ্গে যুক্ত অসাধারণ ক্ষমতার সুবাদে।”
স্তালিনের চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্যস্বরূপ তাঁর বিখ্যাত প্রাভদা’ রচনা (২ মার্চ ১৯৩০) “সাফল্যে বিল” পুনরায় আলোচনার যোগ্য। ধনী কৃষকদের (কুলাক) তিনি “অত্যন্ত বর্বর, নির্মম এবং নিষ্ঠুর শোষক” আখ্যা দিতে ইতস্তত করেননি এবং বলেছিলেন এইসব “রক্তচোষাদের সঙ্গে কোনো আপস নেই। মাঝারি কৃষকরা আমাদের বন্ধু’ যাদের ‘ববাঝাতে হবে, যুক্তি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে নয়। এবং গরিব কৃষকরা আমাদের মিত্র। কৃষির খামারিকরণ কর্মসূচিতে নিহিত ছিল ‘সক্রিয় ধ্বংসকারীদের চূর্ণ বিচূর্ণ করা, নিরপেক্ষদের আলাদা করে দেওয়া এবং অনুগতদের সমর্থন সমবেত করা।” তাই স্তালিন বিদ্রূপ করেছিলেন ‘সমাজবদ্ধ করার এক অতি উৎসাহী নির্দেশকে’, যাতে বলা হয়েছিল, প্রতিটি পরিবারের পোলট্রির কর্তাকে তিনদিনের মধ্যে নথিভুক্ত করতে বিশেষ কমান্ডার হিসেবে নিয়োগের জন্য, যারা সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে সেনানায়কের কাজ করবে!’ তিনি বলেছিলেন: “এর মানেটা কী? এটা কী যৌথ খামারকে পরিচালনা করার নীতি, না তাকে খণ্ড-বিখণ্ড করা ও সুনামহানি করার নীতি?… এবং ঐ বিপ্লবীরা কোথায় গেলেন, যারা গির্জার ঘণ্টা সরিয়ে খামার সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলেন?- গির্জার ঘণ্টা হটাও’– সত্যই কি বিপ্লবী!” স্তালিন কি একজন ‘ব্যারাক ঘরের’ সমাজতান্ত্রিক নেতা মাত্র ছিলেন, তথাপি তার সব বিশিষ্ট প্রতিপক্ষদের, যারা তাকে মাঝারি ধরনের লোক ছাড়া কিছু বলতেন না, বছরের পর বছর শত্রুতা থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন? তার গুণের মধ্যে নিশ্চিতভাবে ছিল নিজের সম্পর্কে বিষয়গত বাস্তবতাবোধ এবং আয়ত্তসাধ্য তৃণমূল সমস্যার এবং পার্টি সংগঠনের অপরিহার্যতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা, যা তিনি সার্বভৌম ক্ষমতায় অমান্য করার মতো সর্বশক্তিমান ছিলেন না।
কোনো কোনো সময়ে বহিঃপ্রকাশের গভীরতায় খুবই ভয়াল ও প্রকট ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার’, যার সামনে এমনকি পরীক্ষিত বিপ্লবীরাও ভেঙে পড়েছেন, সম্পর্কে বলা যেতে পার যে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রকাশ্যে, দর্শকদের এমনকি বিদেশি দর্শকদের উপস্থিতিতে এবং যার হুবহু বিবরণী বহু বিপুলাকার গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে, যা আমাদের অনেকেই দেখেছেন যা পড়েছেন। যদি কখনো কখনো প্রধান অভিশংসক (চিফ প্রসিকিউটর) ভিশিনিস্কির দ্বারা অভিযুক্তদের জেরার মধ্যে ভয় দেখিয়ে বশে আনার বা তার চেয়েও খারাপ কিছু প্রৰ পেয়ে থাকে, কিন্তু সেটাই তো ছিল সর্বত্র অনুরূপ বিচারের বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া নীতির উপরে দাঁড়িয়ে জিনোভিয়েভ কামেনেভ-বুখারিনদের পাল্টা জবাব দিতে বাধা কোথায় ছিল, যদি না তার কারণ হতো ক্ষমতার এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাদের নিজস্ব ধ্যানধারণার লক্ষ্য সাধনে বোধহয় তারা আশঙ্কা করেছিলেন তাদের খেল খতম হয়ে গেছে এবং কেবলমাত্র নিজেদের মর্যাদাহানি করে অপরাধ স্বীকার’-ই তাদের একমাত্র সাহায্য করতে পারে। আজকের গবেষকদের পক্ষে এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারের হুবহু বিবরণী সংগ্রহ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তাছাড়া রেকর্ডে এও পাওয়া যায় যে ডি এন প্রিট-এর মতো বিশিষ্ট আইনজ্ঞ (তাকে যদি বা কমিউনিস্ট সমর্থক হিসেবে বাদ দেওয়া হয়), কিন্তু মস্কোস্থ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জে জে ডেভিসের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তরা নিয়মিতভাবে এই মামলার সওয়ালের সময় উপস্থিত ছিলেন এবং পরে তাদের অভিমত প্রকাশ করে তারা বলেছেন, এই প্রকাশ্য বিচার অভিযুক্তদের প্রতি যুক্তিযুক্তভাবেই ন্যায্য ছিল। জিনোভিয়েভ অ্যান্ড কোং এমনই মর্যাদাহানিকর রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন যে তাদের প্রতি সহানুভূতি সাধারণ পর্যবেক্ষকের কাছেও উবে গিয়েছিল। বলতে বাধা নেই যে আর্থার কোয়েসলার-এর ‘ডার্কনেস অ্যাট নুন’ (মধ্যাহ্নে অন্ধকার) গ্রন্থ, যাতে এই বিচার পরিস্থিতি এবং তার প্রাক-ঘটনাবলি রূপ পেয়েছে, ইঙ্গিত দেয় যে কমবেশি মতাদর্শগত পার্থক্য যা নিঃসন্দেহে ধ্বংসাত্মক প্রতিবিপ্লবী রূপ পরিগ্রহ করেছিল, যদিও শুরুতে তা অভিপ্রেত ছিল না!
পরবর্তী পর্যায়ে মার্শাল টুখাচেভস্কির মতো সামরিক ‘বীর’-দের অন্যান্য কয়েকজন কমরেড সেনানায়কদের সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি পেতে হয়েছিল, কিন্তু কখনই মুহূর্তের জন্যও তারা ভেঙে পড়েননি এবং হীন স্বীকারোক্তি করেননি। তাদের অসামরিক পরিপূরক অংশ- এটা বলতে নিষ্ঠুর শোনাতে পারে- অনুরূপ সাহস দেখাতে পারেননি। প্রসঙ্গক্রমে, টুখাচেভস্কি মামলায় গৃহীত কঠোর পদক্ষেপ, যা বর্তমানে স্তালিনের নিষ্ঠুরতার নজির হিসেবে বর্ণিত হয়, নেওয়া হয়েছিল নৈতিক সতোর খ্যাতিসম্পন্ন চেকোশ্লোভাক উদারবাদী এডুয়ার্ড বেনেস (কমিউনিজমের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি যাঁকে ছুঁতে পারেনি) প্রেরিত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে, যা স্তালিন উপেক্ষা করতে পারেননি, বিশেষত ১৯৩৯ সালে বিদ্যমান বিশ্বপরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। এই বিষয়টার প্রকৃত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, মহাফেজখানায় ভাসাভাসাভাবে চোখ বোলানোর ভিত্তিতে গর্বাচভীয় সিদ্ধান্ত কখনই শেষ কথা হতে পারে না।
.
বহিষ্কার- পাল্টা বহিষ্কার
১৯৩৭ সালে যখন পুরোদমে চলছে ‘বহিষ্কার’, তখন বিশিষ্ট উদারনৈতিক চিন্ত বিদ এডমনড উইলসন কিছুদিনের জন্য মস্কোয় ছিলেন এবং লিখেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল তিনি যেন বিশ্বের নৈতিক শিখরে অধিষ্ঠান করছেন। স্তালিনের কঠোর নেতৃত্বে রেকর্ড গতিতে শিল্পায়ন এবং ‘মুঝিক’ বা কৃষকদের (যারা বংশানুক্রমিক দুর্গতি মেনে নিয়েছিলেন) দেশে কৃষির যৌথ খামারিকরণ পর্বে সোভিয়েত জনগণ যে যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন তা ছিল ঐতিহাসিক অগ্রগতির। মূল্য। বাড়াবাড়ি হয়তো হয়েছে, কিন্তু এটা লক্ষ করার মতো যে প্রবীণ মেনশেভিক ড্যান, অভিজাত দেশান্তরী প্রিন্স মিরস্কি (যিনি পরে দেশে ফিরে এসেছিলেন এবং লেনিনের জীবনীগ্রন্থ লিখেছিলেন), স্যর বার্নাড প্যারেস ও স্যর জন মেইনার্ড-এর মতো বিশিষ্ট ব্রিটিশ উদারনৈতিক কৃষি-বিশেষজ্ঞ প্রমুখ বিভিন্ন মতবাদের ব্যক্তিরাও মনে করেছিলেন স্তালিনের নীতি ছিল সঠিক বিপ্লব হওয়ার মূল্যের বিরুদ্ধে যদি বিপ্লব না হওয়ার মূল্য হিসাব করা হয়, তাহলেই ইতিহাসের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের সময়কার বাড়াবাড়ি প্রসঙ্গে তার নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে এডমন্ড বার্কের ঐতিহাসিক নিন্দা-বাক্যের জবাবে টম পেইন-এর উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে: “আপনি পাখির পালকের জন্য দরদ দেখাচ্ছেন, মরোণোন্মুখ পাখির জন্য নয়!” সর্বত্র অনন্তকাল দুর্গত আপামর জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবল জন-যন্ত্রণা (কখনো কখনো পরিহার যোগ্য) সত্ত্বেও বিপ্লবের ন্যায্যতা যুক্তি দিয়ে প্রতিপাদন করা যেতে পারে।
সোভিয়েতের জনগণ লৌহজালে নিজেদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে বলে বলা হয়েছে, কিন্তু আদতে পুঁজিবাদী দুনিয়া বছরের পর বছর সমাজতান্ত্রিক সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সোভিয়েতের চারপাশে বেষ্টনী দিয়ে রেখেছিল । বহু বছর যাবৎ লন্ডনের ‘টাইমস পত্রিকায় মস্কোস্থ কোনো সংবাদদাতা ছিল না, তারা নির্ভর করত সোভিয়েত বিরোধী বিদ্বেষ প্রচার করতে রিগা থেকে পাওয়া রিপোর্টের ওপর। শোভনতার দাবিতে মার্কিন উদারনৈতিক সাপ্তাহিক ‘নিউ রিপাবলিক ১৯২০ সালে প্রকাশ করেছিল পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য রাশিয়া থেকে পাঠানো ‘সাজানো’ সংবাদের ওপর ওয়াল্টার লিপম্যান ও চার্লস সার্জ-এর বিশ্লেষণ । বহু বছর ধরে আমেরিকার স্কুল বা বিদ্যালয়গুলোতে ভূগোলের ক্লাসে যে বিশ্বমানের মানচিত্র দেখানো হতো তাতে সোভিয়েত দেশের কোনো চিহ্ন ছিল না। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেয়নি; ক্রমশ অনিচ্ছাভরে ব্রিটেন ও অন্যান্য অনেক দেশ তাকে স্বীকৃতি দেয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লীগ অব নেশনস-এর বাইরে তাকে রাখা হয়েছিল। কিছুকালের জন্য তাকে যোগদান করতে দেওয়া হলেও ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আবার বের করে দেওয়া হয়েছিল। উদীয়মান সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে মিত্রতার জন্য বেশিরভাগ জনগণের আগ্রহের কাছে মাঝে মাঝে নতিস্বীকার করা ছাড়া সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃবৃন্দ সাধারণত সোভিয়েত ইউনিয়নকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। কারণ স্ত লিনের মনে এদের সম্পর্কে এক গভীর বিতৃষ্ণা জন্মেছিল এবং তিনি এদের ‘পশ্চিমা মার্কসবাদ’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন এরা বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতায় বিভেদ সৃষ্টিতে সাহায্য করছে। ১৯১৯ সালে লেনিন প্রতিষ্ঠিত তৃতীয় (কমিউনিস্ট) আন্তর্জাতিক-এর কাজকর্মে স্তালিন অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করতেন না। কমিনটার্ন-এর নেতৃত্ব ছিল জিনোভিয়েভ, বুখারিন, ম্যানুয়িলস্কি এবং বুলগেরিয়ার ডিমিট্রভদের মতো নেতাদের হাতে। কিন্তু স্তালিন এমন এক উচ্চতায় উঠে গিয়েছিলেন যে তাকে সমস্ত ‘লাল’ শক্তির অগ্রগতির পর্বতসম রক্ষক, বাহক ও তদারককারী বলে মনে করা হতো। এত বড় বোঝা বহন করা কেবল অতি-মানবীয় গুণসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব। অতি-মানবের সংখ্যা কখনই প্রচুর নয় এবং স্তালিনকে, তার সমস্ত যোগ্যতাসহ, বলা যাবে না তিনি ছিলেন একমাত্র অতি-মানব। এতদসত্ত্বেও এই পর্বত-সমান বোঝা তিনি এমন অদম্য দৃঢ়তার সঙ্গে বহন করেছেন যে তাঁর নামে অবিরাম নিন্দা-কটুক্তি সত্ত্বেও ইতিহাস স্রষ্টাদের মধ্যে তার স্থান দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। তার মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর যদি সোভিয়েত রাষ্ট্রের সুদৃঢ় ঐক্য ভেঙে পড়তে দেখা যায় (অথবা বিভিন্ন বৈরী শক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে) তার জন্য একমাত্র স্তালিনকে দায়ী করা যায় না। একজন ব্যক্তি কেমন করে সর্বদর্শী, সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান হতে পারেন?
একটা ঘটনা রেকর্ডে পাওয়া যায় যখন স্তালিনের স্নায়ু বিপর্যয় ঘটেছিল এবং ডয়েটশার (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা : ৩৩৩ দ্রষ্টব্য) একজন প্রাক্তন কমিউনিস্ট, ভিকটর সার্জে-র জবানীতে কাহিনিটি বর্ণনা করেছেন। যখন কৃষির যৌথ খামারিকরণ পুরোদমে চলছে এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে তখন নাদেঝদা অ্যালিলুয়েভা, স্তালিনের দ্বিতীয় স্ত্রী যিনি তার দুই সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন এবং সুখেই ছিলেন (যদিও সেই কৃচ্ছসাধনতার যুগে তাঁকে ভিড়ে ঠাসা মস্কোর ট্রামে-বাসে। চেপে কাজে যেতে হতো), এক সন্ধ্যায় প্রাইভেট ডিনার পার্টিতে রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন চারদিককার অশেষ দুর্গতি দেখে । তখন স্তালিন তার সংযম হারিয়ে ফেলে বকাঝকা করেছিলেন তাঁকে, যার ফলে নাদেঝদা খাবার টেবিল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং পরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। যদি সার্জে-র বিবৃতি সঠিক হয় তাহলে স্তালিন এই ঘটনায় এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে তার ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন (সার্জে-র ভাষায়, ভীত হয়েছিলেন) মলোটভ কিছুক্ষণ পরে বলেছিলেন, এটা অবাস্তব চিন্তা, এবং পরে সমস্ত উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে যায়।
জনগণের দুর্গতিকে “ছিঁড়ে-ফুঁড়ে” (যেমন কেউ কেউ বলতেন) কোনো অগ্রগতি ঘটতে পারে না এবং স্তালিনের নেতৃত্ব ভুল করতে পারে, একজনকে মনে রাখতে হবে সেই সময়কার উভয় সংকটকে। মহান অক্টোবর বিপ্লবের সুফল এক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছিল। যদি কাউকে পছন্দ করে নিতে হয়, যেমন বহুকাল আগে গ্যয়টে লিখেছিলেন, হাতুড়ি এবং কামারের নেহাই-এর মধ্যে (কেউ পছন্দ করুক বা নাই করুক), তার জবাবটা পরিষ্কার। স্তালিনের মার্কর্সবাদী বিশ্বাস থেকে পার্টির সঙ্গে, যাকে তিনি তার যৌবনকালের শুরু থেকেই নিজের ঘরবাড়ি বলে মনে করে নিয়েছেন, তিনি নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন ইতিহাসের দ্বারা তৈরি যন্ত্রটার সঙ্গে শুরুতে রাশিয়া এবং পরে সারা বিশ্বব্যাপী বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে। এই বিশ্বাসকে, যেমন ফরাসি দার্শনিক রেমন্ড অরো বলেছিলেন, কেউ মনে করতে পারেন শতাব্দীর মহান ‘মোহ’! কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এইরকম মোহ মানুষ ও তার আন্দোলনকে, প্রায়শই অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ, সাহায্য করে শিখরে উঠতে। যদি স্তালিন তার নিজের রূঢ়, জেদি ও অদম্য কায়দায় এই মোহকে আঁকড়ে ধরে থাকেন তাহলে তিনি মানব-ইতিহাসকে উজ্জ্বল করে তোলা। বিপ্লবের বীরদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন।
ঠিক মতো বলতে গেলে এই গ্রন্থ স্তালিনের জীবনচরিত্র নয়, যা লিখতে গেলে কয়েক খণ্ড লেগে যাবে। এ তার নম্র সাদামাটা সূচনা। এ হলো এক অসাধারণ জীবন, বিরামহীন নিরহঙ্কার কিন্তু আলো-আঁধার দিয়ে রচিত ইতিহাসের মহাকাব্য- বোধহয় একটি ক্ষুদ্র মহাকাব্য, কারণ খুব সচেতনভাবে এবং খুবই বেশি লেনিনের ছায়ায় এই জীবন অতিবাহিত হয়েছে। ককেশাসে প্রথম মে দিবস (১৮৯০) সংগঠিত করে, এবং Brdzola-তে প্রবন্ধ লিখে টিফলিস (টিবলিসি)-এর পার্টি কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে, ‘কোবা’ ছদ্মনামে বাটুমে কাজ করে, ককেশিয়ার একজিকিউটিভ কাউন্সিলে উন্নীত হয়ে, শ্রমিক আন্দোলনের তদারকি করে এবং গোপন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার আন্দোলনে সাহায্য করে তরুণ জুগাশভিলি বিপুল তৃণমূল অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, অচিরেই যার মূল্যও দিতে হয়েছিল ১৯০২ সালে গ্রেপ্তার ও পূর্ব সাইবেরিয়ায় দেশান্তর করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে, যেখান থেকে কিছুকাল পরে তিনি টিফলিসে ফিরে এসেছিলেন। তাঁকে বারবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে, সেখান থেকে বারবার পালিয়ে এসে আত্মগোপন করে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে গেছেন। ১৯০০ থেকে ১৯১৭ সালের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি জারের জেলে কাটিয়েছেন এবং এর মধ্যেই এই জর্জিয়াবাসী বিশেষ খ্যাতিও অর্জন করেছেন। তিনি বলশেভিক কংগ্রেসগুলোতেও উপস্থিত থেকেছেন, যেমন ট্যামারফর্সে (ফিনল্যান্ড) যেখানে তিনি প্রথম লেনিনকে দেখেছিলেন এবং গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণ (যা তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে খুবই বিরল ছিল)। তিনি স্টকহোম (১৯০৬) এবং লন্ডন কংগ্রেসেও (১৯০৭)-এ উপস্থিত ছিলেন, পরে যখন ‘কোবা’, ‘ক্যাটো’, ‘চিঝিকভ’ প্রভৃতি ছদ্মনাম ঝেড়ে ফেলে তিনি স্তালিন নামে পরিচিত হয়েছিলেন এবং লেনিনের নিজের উদ্যোগে বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটিতে (১৯১২) অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ক্র্যাকাউ এবং ভিয়েনায় পার্টির শীর্ষ সভাগুলোতে হাজির হয়েছেন। কিন্তু বিদেশ ভ্রমণ সহজাত ছিল না তাঁর মতো কঠিন সদা-পরিশ্রমী মানুষের কাছে, যিনি তার হাতের তালুর মতো ককেশীয় অঞ্চলকে চিনতে এবং রুশ বলশেভিকদের সঙ্গে তার ভাগ্য জুড়ে দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যেই লেনিন তুলনাহীন আদর্শস্বরূপ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিলেন, যদিও সর্বদাই দৈনন্দিন ব্যবহারিক কাজে (গ্রেপ্তার ও নির্বাসনের অন্ত বর্তী সময়ে) নিমগ্ন স্তালিন দেশান্তরী রুশ বিপ্লবীদের প্রতি কিছুটা বিরাগ পোষণ করতেন (অবশ্য লেনিন ব্যতিরেকে, যাকে তিনি দেবতুল্য মনে করতেন)।
স্তালিন একসময়ে ট্রটস্কি কথিত ‘সুন্দর অপদার্থতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, যাতে লেনিন আনন্দিত হয়েছিলেন, কারণ ভঁড়ামি প্রায়শই তাঁর সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যেত। বিশ্ব প্রলেতারিয়েত আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নেতা (যা স্তালিন প্রায় তিন দশক জুড়ে ছিলেন) এসেছিলেন রাশিয়ার এশীয় এলাকা থেকে। স্মরণ করা যেতে পারে, কবি আলেকজান্ডার ব্লক-এর পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জের কথা যখন চৌদ্দটা দেশ একত্রিত হয়েছিল সোভিয়েত দেশকে ধ্বংস করে দিতে: “তোমরা সেনাবাহিনী/ আমরা বিশাল দল, আর দল, আর দল / হ্যাঁ, আমরা সিদিয়ার অধিবাসী/ হ্যাঁ, আমরা এশিয়াবাসী/ আমাদের আছে বিশেষ দৃষ্টিকোণ ও চোখে আকুল আকাঙ্ক্ষা!” মার্কস্-এর মতাদর্শে উদ্দীপ্ত এক শ্রমজীবী এশিয়া ও ইয়োরোপে কর্তব্য সাধনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন এবং দুই মহাদেশের সীমান্ত থেকে স্তালিন কঠোর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হচ্ছিলেন যথাসময়ে লেনিনের দায়ত্ব বহন করতে। অবশ্য কেউই লেনিনের স্থান নিতে পারেন না, “যার রাজদণ্ড ছিল ইউলিসিস-এর ধনুকের মতো যা কোনো দুর্বল হাত তুলতে পারত না।” তবু নশ্বরতার নিয়ম অপ্রতিরোধ্য এবং লক্ষণীয়, কিছুটা অদ্ভুতও, সঙ্কীর্ণ প্রেক্ষাপট ও কিছু ব্যক্তিগত খেয়ালিপনা সত্ত্বেও স্তালিন হয়ে উঠেছিলেন প্রথমে ‘সমষ্টিগত নেতৃত্বের একজন এবং পরে অনেক দুঃখ-কষ্ট ও ট্রজেডির মধ্য দিয়ে বাস্তবিকপক্ষে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। আন্তর্জাতিক প্রলেতারীয় নেতা স্তালিন জন্মেছিলেন বাকুর মতো এশিয়া ও ইয়োরোপের সীমান্ত এলাকায়, যা ছিল লগ্নিপুঁজির অক্টোপাস- নোবেল, রথসচাইল্ড, ডেফার্ডিং ও উকুহার্ট-দের মৃগয়াক্ষেত্র যাকে বিপ্লব অবশ্যই ধ্বংস করবে।
.
লেনিনের স্তালিন আবিষ্কার’!
সর্বদাই প্রাচ্য থেকে বিপ্লবীদের সন্ধান-রত লেনিন যখন স্তালিন সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন, তখন তিনি তাঁর লেখক বন্ধু ম্যাকসিম গোর্কিকে লিখেছিলেন এক বিস্ময়কর জর্জিয়াবাসী’-কে আবিষ্কারের কথা। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারে যাই বলা হোক না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, লেনিনই স্তালিনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে এসেছিলেন এবং পার্টি পত্রিকা প্রাভদা’ পরিচালনার মতো এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ট্রটস্কি খুবই প্রতিভাবান কিন্তু অদ্ভুত রকমের নিষ্ঠুর, তিনি সবসময়েই লেনিনের খুঁত ধরতেন, তাঁর ভাষায় ‘পরশ্রীকাতরতা সম্পর্কে, এবং যখন লেনিনকে উত্ত্যক্ত করছিলেন তখন লেনিনের সম্মতিক্রমেই স্তালিন ১৯১৩ সালের ১২ই জানুয়ারি ট্রটস্কিকে “এক ভুয়ো পেশাদারি মামুলি হামবড়া চ্যাম্পিয়ন” আখ্যা দিয়ে এক তীব্র ভাষায় চিঠি লিখেছিলেন। এই আক্রমণ ট্রটস্কি কখনো ভোলেননি। সেটাই ছিল, বলা যেতে পারে, সোভিয়েত ইতিহাসে বিখ্যাত মতাদর্শগত বিরোধের (ভালো বা মন্দ যাই হোক) সঙ্কেত। অবশ্য ট্রটস্কি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। তিনি বিদ্রূপ করে বলতেন “কীরকম সব কুঁড়ে, স্কুল-বুদ্ধির লোকদের সঙ্গে রয়েছেন লেনিন”। এটা স্মরণ করিয়ে দেয় তার একসময়কার (১৯০২) অনুভব যে ‘ওস্তাদ কলহপরায়ণ” লেনিন ছিলেন “রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনে পশ্চাৎপদতা”-র এক উদাহরণ (আইজাক ডয়েটশার, স্তালিন, পৃষ্ঠা : ১৩০/১৩১ দ্রষ্টব্য)।
পরবর্তী জীবনে স্তালিনকে “পলিটব্যুরোর চেঙ্গিস খা”, এশিয়াবাসী, নয়া ভয়ংকর আইভ্যান প্রভৃতি যন্ত্রণাদায়ক অভিযোগ শুনতে হয়েছে। ইতোপূর্বে, এমনকি যখন লেনিনের অসাধারণত্ব অন্য নেতাদের রাশ টেনে ধরে রাখতে পারত তখনও ইয়োরোপীয় ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটেছে, যেমন কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় স্তালিনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে বিজ্ঞ রিয়াজনভ বলতেন : “ওহে, কোবা, থামো তো, মতাদর্শ তোমার পছন্দের জিনিস নয়” (ডয়েটশার, পূর্বোক্ত গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। এটা বলার প্রয়োজন নেই যে সর্ব অর্থেই লেনিন যখন সবার উপরে ছিলেন, তখন আকর্ষণীয় ও জমকালো প্রতিভা এবং কথার উপর দারুণ দখল ট্রটস্কির ব্যক্তিত্বে। একরকম ক্ষণিকের উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছিল এবং স্তালিন সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই ওঠে না- “সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর আকর্ষণীয়তা ছিল একেবারেই আকর্ষণহীন!”- কোননাক্রমেই কারুর সঙ্গে তুলনীয় না। তবু, যাই হোক, তার নিজের উচ্চতর সহকর্মীদের কাছ থেকে উন্নাসিক, হীন বিদ্বেষপূর্ণ অবজ্ঞা স্তালিনকে নিশ্চয়ই ব্যথিত করত, কিন্তু স্তালিনের শক্তি নিহিত ছিল তাঁর অবিচল দৃঢ়তা এবং কাজ আঁকড়ে থেকে অসাধারণ যোগ্যতার সাথে তা সুসম্পন্ন করার মধ্যে। এবং এই কারণেই বলশেভিক রাজনীতির ভারসাম্য তার পক্ষে গিয়েছিল, যিনি কখনই মতাদর্শগতভাবে বড় মাপের ব্যক্তি ছিলেন না।
১৯১৭ সালে মহান অক্টোবর বিপ্লবের সূচনায় স্তালিন সবে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন থেকে ফিরেছিলেন (যদি না ‘সামরিক বাহিনীর জন্য অনুপযুক্ত’ বিবেচিত না হতেন তাকে বাধ্যতামূলকভাবে জারের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হতো) এবং তার সদা-আকাঙ্ক্ষিত নেতার লাইনের সঙ্গে (এপ্রিল থিসিস) একমত হয়ে তিনি সহজে স্বাভাবিকভাবেই লেনিনের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলেন। বিশ্বস্ততার রেকর্ডে লেনিনের নিকটতম অন্য কেউ তার সমতুল্য হতে পারেননি। অন্য কেউ তাঁর চেয়ে বেশি লেনিনের অনুগত থাকতে পারেননি। বৈপরীত্য লক্ষণীয় যে জিনিবোভিয়েভ ও কামেনেভ তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বিপ্লবী পরবর্তী পরিসেবায় ডেকে নিতেন না)। সেই জটিল কাহিনি এখানে বিবৃত করার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু স্তালিনের সব চেয়ে রূঢ় সমালোচকরাও “দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন (অক্টোবর)” এবং তার পরে তার সম্পর্কে মন্দ কিছু বলতে পারেননি (একমাত্র গর্বাচভীয় কাহিনি ছাড়া)।
.
লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব
বিপ্লবের অব্যবহিত পরে বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটি লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি (বাউণ্ডুলে সন্তান’ সবে কানাডা থেকে ফিরে এসেছেন) ও সেভার্দলভ-কে নিয়ে একটি চার জনের কর্মসমিতি গঠন করেছিল। বলশেভিক বাম সোস্যাল রেভলুশনারি জোট গঠিত হবার পর পাঁচজন কমিশারকে নিয়ে একটি নিকটতম বিশ্বাসভাজন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এতে তিনজন বলশেভিক (লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি) ও দুজন সোস্যাল রেভল্যুশনারি ছিলেন। মোটামুটিভাবে স্তালিন নিজেকে পার্টির সব-কাজের-যোগ্য ব্যক্তি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন, কেবল পার্টি পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখাই নয়, অ্যালিলুয়েভের বাড়িতে (পরে যাঁর মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছেন) লেনিনের আত্মগোপনের (৮ জুলাই ১৯১৭) জায়গার ব্যবস্থা করতেও। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যদিও ইয়োরোপে বিপ্লব পার্টির বিশ্ব লক্ষ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, রাশিয়া তার বিশাল ইয়োরো-এশীয় অঞ্চল এবং সীমাহীন সম্ভাবনাপূর্ণ সম্পদ নিয়ে “সমাজতন্ত্রের পথ সুগম করতে পরিপূর্ণভাবে তৈরি। বিখ্যাত বিতর্কে (জুলাই ১৯১৭) তার এশীয় সত্ত্বা, বলতে কী, জেগে উঠেছিল এবং তিনি আহ্বান করেছিলেন পার্টিকে “কেবল ইয়োরোপই পথ দেখাবে বলে প্রচলিত সেকেলে ধারণা বাতিল করতে।” তিনি বলেছিলেন, “একটা গোড়া ও আর একটা সৃজনশীল মার্কসবাদ আছে- আমি শেষোক্তের পক্ষে।” বাক্যবিন্যাসে হয়তো তাঁর পারদর্শিতা ছিল না, কিন্তু তার নিজের নীরস কায়দায় লেনিনের চিন্তাভাবনায় সিক্ত ছিলেন।
আশ্চর্যের ছিল না যে প্রথম সোভিয়েত সরকারে স্তালিন ছিলেন প্রথম কমিশারিয়েট অব ন্যাশনালাটিজ এবং যখন কিছুকাল পরে কমিশারিয়েট অব ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস ইনসপেকশান গঠিত হয় তখন তিনি ছিলেন তাঁর প্রথম পদাধিকারী। পরবর্তী পদটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সব মন্ত্রীদের কাজকর্মের তদারকি করার দায়িত্ব ছিল এর উপর। স্বাভাবিকভাবেই এই পথ খুব মসৃণ ছিল না এবং এর ত্রুটি-বিচ্যুতি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল লেনিনের “বেটার ফিউয়ার বাট বেটার” শীর্ষক প্রায় শেষ রচনায়।
ইতোমধ্যে স্তালিনের দায়িত্বের পরিধি প্রসারিত হয়। ১৯২২-এর ৩ এপ্রিল পার্টির একাদশ কংগ্রেস থেকে একটি বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় এবং সাধারণ সম্পাদকের একটা নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়, যাতে লেনিনের উদ্যোগে স্তালিনকে নিযুক্ত করা হয়। সাধারণভাবে হইচই করা রিপোর্টের প্রেক্ষাপটে এটা আশ্চর্য ঠেকে, ডয়েটশারের ভাষায়, “লেনিন, কামেনেভ, জিনোভিয়েভ এবং কিছুটা ট্রটস্কি ছিলেন স্তালিনের সব পদের প্রস্তাবক” (পূর্বোক্ত গ্রন্থ ২৮০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে, ডয়েটার লিখেছেন, এটা তাঁর প্রতিভা’-র জন্য নয়, তাঁর কঠিন ও অনুপ্রেরণাহীন পরিশ্রম করার বিপুল ক্ষমতা এবং সংগঠনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে ধৈর্য ও সহনশীল অনুরাগের কারণে। তাছাড়া তার বিরোধীরাও তাঁকে ‘লেনিনের সহকারী হিসেবে দেখতেন। বৌদ্ধিক উৎকর্ষে দৃষ্টিকটুভাবে আত্মতৃপ্ত তারা অবশ্য এই কৃষ্ণকায় জর্জিয়াবাসীর ক্ষমতার কোনো মূল্যই দিতেন না- কখনো ভাবেননি ভবিষ্যৎ কী উঘাটন করবে।
অক্টোবর অভ্যুত্থান (১৯১৭), তুলনামূলকভাবে একটি খুব শান্ত, রক্তপাতহীন ঘটনা” (জন রিড-এর ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) হলেও তার পরের তিন বছর দীর্ঘ নির্মম গৃহযুদ্ধ ও বিদেশি হস্তক্ষেপ অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছিল। এই সময়ে লাল ফৌজের স্থপতি হিসেবে ট্রটস্কি খ্যাতির এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হন, যদিও ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তি নিয়ে সঙ্কটের সময় ট্রটস্কির “কল্পনাপ্রবণ বিপ্লববাদ” উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ট্রটস্কি সবসময়েই ইয়োরোপে বিপ্লবের প্রত্যাশা পোষণ করতেন (১৯২৩ সালে তিনি জিনোভিয়েভ-এর সঙ্গে এমনকি সোভিয়েতের পদ ছেড়ে দিয়ে জার্মানিতে বিপ্লব সংগঠিত করার কাজে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন!) পরবর্তীকালের ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে স্তালিনের ব্যক্তিত্বপূর্ণ উক্তি, এই ধরনের বিশিষ্ট কমরেডদের ছাড়া যাবে না- যা সবাই মেনে নিয়েছিল। পশ্চিমা দুনিয়ায় বিপ্লবের বিশেষ গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন, স্তালিন নিজের দেশের সন্নিকটে করণীয় কাজের ওপর আস্থা রাখাটাই বেশি পছন্দ করতেন। আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের হস্ত ক্ষেপের ঘটনার সময় “রাশিয়া থেকে হাত ওঠাও” দাবিতে ব্রিটিশ শ্রমিকদের প্রচার সম্পর্কে তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাননি। এমনকি চমকপ্রদভাবে সংগঠিত জার্মান শ্রমিকশ্রেণিও প্রকৃত বিপ্লবী কার্যকলাপের লক্ষ্যে মতাদর্শ ও রাজনীতিগতভাবে পরিপক্ব নয় বলে তার কাছে মনে হয়েছে। বহুকাল পরে, ১৯৪৪ সালের কাছাকাছি সময়ে ব্রিটিশ সমর্থিত দেশান্তরী পোলিশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিকোলাসঝিক বলেছিলেন স্তালিনের ধারণা ছিল নাকি “গোরুর পিঠে ঘোড়ার জিন চাপানোর মতো হবে জার্মানিতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা।” এটা হয়তো ছিল এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসত্য কথা, কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। যে স্তালিনের, বিশেষত ১৯১৭’র পরবর্তীকালে জার্মানিতে বিপ্লবের কোনো প্রত্যাশা ছিল না।
গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ যা ‘ওয়ার কমিউনিজম’-এর যুগে (এবং তারপরে নিউ ইকনমিক পলিসি পর্যায়ে) সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছিল, তখন নিজের দেশেই আরও অনেক কিছু করার দরকার ছিল। অনিবার্যভাবেই ‘জনগণের অবস্থা ছিল অন্যতম অবিশ্বাস্যরকমের বঞ্চিত অবস্থা, কিন্তু লেনিনের দৃঢ় অথচ নমনীয় ও সর্বদাই নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব আশ্চর্যজনকভাবে জনগণের বিপ্লবী মেজাজকে চাঙ্গা রেখেছিল। বহুবছর যাবৎ তীব্র খাদ্যাভাব এবং জ্বালানিসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের অভাব সোভিয়েত জনগণকে পীড়িত করে রেখেছিল যখন তারা ঘরোয়া ও বিদেশি শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে নেমেছিলেন। লেনিন থেকে শুরু করে নিচের স্তরের সর্বত্র সবাইয়ের ক্ষেত্রে একইরকম শোচনীয়ভাবে সামান্য রেশন বরাদ্দ ছিল- একমাত্র বিজ্ঞানী পাভলভ-এর মতো দেশের পরম সম্পদের ক্ষেত্রে লেনিনের নির্দেশ মতো কিছুটা ব্যতিক্রমী সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি লাল ফৌজও দুর্গতি ভোগ করেছে, তবু দেশ অটল থেকেছে।
মস্কোস্থ ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার প্রধান সংবাদদাতা ওয়াল্টার অ্যারান্টি-র লেখা “রাশিয়া রিপোর্টেড, ১৯২৩-৩৪”-শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে একটা কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। হয়তো প্রতীকী, খুঁটিনাটি বিষয়ে বোধহয় নির্ভুল নয়, যা প্রকাশ করে তৎকালীন অবস্থা এবং সেই সঙ্গে গড়ে ওঠা স্তালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সব নেতৃস্থানীয় কমরেডদেরই অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছিল এবং স্তালিন তাতে একটু বেশি ভাগ নিয়েছিলেন, বিশেষত দক্ষিণ রাশিয়ার জারিৎসিন এ, যেখানে শত্রুদের পরাস্ত করে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাকে কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। ডুরান্টির কাহিনি থেকে জানা যায়, স্তালিন যখন সেখানে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করছিলেন তখন একজন সৈনিক তার দিকে ক্রুদ্ধ। দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল এবং তার এই ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে সৈনিকটি স্তালিনের পায়ে ঝকঝকে উঁচু বুট জুতো আর তার নিজের পায়ে জুতোর মতো করে কাপড় জড়ানো অবস্থার প্রতি স্তালিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুহূর্তের মধ্যে। স্তালিন নিজের বুট জুতো খুলে ফেলেন এবং সৈনিকটির জুতোর মতো কাপড় জড়ানো বস্তুটির সঙ্গে বদলাবদলি করে নেন। এটা ছিল এক তাৎক্ষণিক আবেগতাড়িত অভিব্যক্তি, কিন্তু একইসঙ্গে ‘ওয়ার কমিশনার’ (যুদ্ধ অধিকর্তা) ট্রটস্কির ব্যবস্থাপনারও নিন্দা। ঘটনাটা চাপা দেওয়া যেত, কিন্তু নাটুকে চালচলনে প্রিয় ট্রটস্কি সেই সৈনিকটিকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কোর্ট মার্শলের জন্য নির্দেশ দেন এবং তারপরে তাকে গুলি করে মারার সাজা হলে তিনি স্তালিনের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।
বিপ্লব যত একের পর এক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে লেনিন নজর রেখেছিলেন যাতে পার্টি কখনো কল্পবাদী মোহে না ভোগে। যখন পার্টি লাইন ‘ওয়ার কমিউনিজম’ থেকে ‘নিউ ইকনমিক পলিসি’-তে পরিবর্তিত হয়, তখন বিপ্লবে বিশ্বাসঘাতকতা করে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রবর্তনের দায়ে লেনিনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু লেনিন সেই বিতর্কে অভিযোগকারীদের কশাঘাত করেছিলেন। এবং তাদের বাক-সর্বস্বতার দাস, সর্বদাই মেলোড্রামার আলোয় বসবাসে ইচ্ছুক কল্পনাবিলাসী বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। স্তালিন নেতার পাশেই অটল ছিলেন, যা তখনকার শীর্ষস্থানীয় সহকর্মীদের মধ্যে দেখা যায়নি। স্তালিন উপলব্ধি করেছিলেন, যা অন্যরা করতে পারেননি, তার নেতার চেতাবনী যে অন্য সময়ের মতো বিপ্লবের সময়েও নির্বোধের মতো কাজ করা হয় এবং কেউ যেন “বিপ্লব কথাটা সর্বদা মোটা হরফে না লেখেন”, কিন্তু যেন প্রস্তুত থাকেন বিষয়গত অবস্থা ও তার অপরিহার্য পরিবর্তনের সঙ্গে সৃজনশীলভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার। এ থেকে আবার কেউ যেন ভেবে না বসেন এটা ছিল পরবর্তীকালের গর্বাচভীয় চিন্তাধারার অনুসারী। গর্বাচভ কোনো যুক্তি-তর্কের ধার না ধরে এক অবাস্তব ধারণা জন্মানোর চেষ্টা করেছিলেন যে লেনিন চেয়েছিলেন নেপ’ স্তরেই অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থার মধ্যে সোভিয়েতকে আটকে রাখতে। লেনিন বলেছিলেন, “অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই পিছু-হটা বন্ধ করতে পারব”। তিনি দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেছিলেন যে, “যত শিগগির এটা (পিছু-হটা) বন্ধ করতে পারব, ততই আমাদের পরবর্তী সাফল্যের অগ্রগতি দ্রুত, ব্যাপক ও স্থায়ী হবে” (নির্বাচিত গ্রন্থাবলি, খণ্ড-৩৩, পৃষ্ঠা : ১০৯-১১৬ দ্রষ্টব্য)। সেই ‘অগ্রগতি’ (নেপ’: লেনিন লিখেছিলেন “রাশিয়া রূপান্তরিত হবে, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায়”) স্তালিনের নেতৃত্বে চড়াই-উত্রাই পার হয়ে অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাকে চরম হেয় ও অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছে গর্বাচভ লাইন।
বোঝা যায়, হেয় করার এই দৃঢ়-সংকল্প প্রয়াস শুরু হয়েছিল, লেনিনের জীবনকালেই, জাতিসমূহ প্রসঙ্গে লেনিন-স্তালিন নীতি সম্পর্কে, যা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে প্রশংসিত হয়েছিল। অবশ্য একথা বলার অর্থ এই নয় যে, ককেশাসের মতো অঞ্চল সম্পর্কে (যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে দাঘেস্তান– ৫০ হাজার বর্গমিটারব্যাপী ও ৩২টি জাতিসমূহের ১৮ লক্ষ মানুষের এক পর্বতসঙ্কুল অঞ্চল) প্রত্যক্ষ ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন স্তালিনের জাতিসমূহ প্রসঙ্গে ধ্যানধারণা ও নীতি সবসময়ে সঠিক ছিল। বস্তুতপক্ষে জাতিসমূহ সম্পর্কিত বিষয়টি একদিকে রোজা লুকসেমবার্গ ও অপরদিকে অটো বাওয়ার-এর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টি এতই জটিল যে তার খুব সহজ, সরল, স্থায়ী সমাধান নেই; এবং সবার ওপরে, লেনিনকে প্রায়শই অভিমতের পার্থক্য মীমাংসা করতে ও জাতিয়তাবাদী মানসিকতার সূক্ষ্ম ব্যতিক্রমী দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজনে সালিশির ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। সর্বদাই লেনিনের পথ অনুসরণ করতে সচেষ্ট স্তালিনের সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সহযোদ্ধা ও লেনিনের সুহৃদ, বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সোভিয়েত জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখাইল টাখাকোয়ার সান্নিধ্য লাভের, কিন্তু জাতি সমস্যা’-র বহু পার্শ্ববস্তু ছিল (নব্বই দশকের বিশ্ব পরিস্থিতি যার ইঙ্গিত বহন করে) যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সহজসাধ্য ছিল না। তাছাড়া স্তালিনের মানসিকতায় কেন্দ্রমুখিনতাও ছিল (লেনিনের ক্ষেত্রেও তা দেখা যায়, যেমন বিশাল দেশে রাজ্যগুলোর সংগঠন বহুমুখী হওয়া সত্ত্বেও পার্টিকে এক ও অখণ্ড রাখার উপর তার গুরুত্ব আরোপ।)
এতদসত্ত্বেও অস্বীকার করা যায় না জাতি সমস্যা, বিশেষত ককেশাসে, সমাধানের উদ্দেশ্যে স্তালিনের প্রয়াস তার এবং তার শিষ্যদের মধ্যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি করেছিল। লেনিনের কঠিন অসুস্থতা (১৯২২ সাল থেকে) এবং সবকিছু তদারকি করার অক্ষমতা, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কিছু বাড়াবাড়ি যার জন্য বাহ্যত দায়ী ছিলেন স্তালিন ও অর্দজনিকিদজে, অসুস্থ নেতার কাছে সুবিধা মতো গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়া এই সবকিছু মিলেমিশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ঐক্য, খানিকটা বিষিয়ে দিয়েছিল যখন (ডিসেম্বর, ১৯২২) ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোলালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএস আর) গঠন এক অসাধারণ উপলক্ষে পরিণত হতে পারত।
তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে ককেশাসে বিশেষত স্তালিনকে, কার্যত লেনিনের অনুপস্থিতিতে, এক খুব কঠিন এবং দুঃসাধ্য কর্তব্য পালন করতে হয়েছিল। বহু জাতিসমূহের অস্তিত্ব, সংঘর্ষের (ধর্মীয়, জাতি-উপজাতিগত বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির) ঐতিহাসিক স্মৃতি, তুর্কি সম্পর্কিত সমস্যা (যদি প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির কামাল পাশার ভূমিকা আর একটু দীর্ঘকাল স্থায়ী হতো তাহলে সমস্যার সুরাহা ভালোভাবে করা যেত), নীতি গ্রহণের বিহ্বলতা ও মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের সময় অপরিহার্য জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চনা, বিপ্লবী চেতনায় তুলনামূলক আঞ্চলিক পশ্চাৎপদতা- এই সবকিছু ও অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে ইতোপূর্বের জটিল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। যদি স্তালিন মুসলিম “নিঃস্ব প্রলেতারিয়েতদের” এবং কিছুটা পশ্চাৎপদ রুশ ও আর্মেনীয়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রেখে বাকুতে (টিবলিসির পর দ্বিতীয় বিপ্লবী দীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্র) কাজ না করতেন এবং শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামে সাংগঠনিক ঐক্য গড়ে তুলে গুপ্ত বিপদ এড়াতে মার্কসবাদের মধ্যে পথ না খুঁজতেন? জাতি সমস্যা একমাত্র সমাজতন্ত্রের প্রেক্ষাপটেই প্রকৃত সমাধান করা যেতে পারত, কিন্তু তা ছিল খুবই ভয়ংকর পীড়াদায়ক পরীক্ষা।
তাহলেও, গুরুত্বপূর্ণ হলো, লেনিন সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছিলেন যাতে ভুল কম হয় তা দেখতে। তিনি সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন পোল্যান্ডবাসী দিজেরঝিনস্কির মতো ‘রুশীকৃত অ-রুশদের বলশেভিক হওয়ার তাগিদে ‘বিপ্লবী মাত্রা লঙ্ঘনের প্রবণতা ছিল। স্তালিন সম্পর্কেও, তার কঠোর কর্তৃত্বপূর্ণ কাজ সম্পর্কে রিপোর্ট পাওয়ার পর লেনিনও একসময় অনুরূপ আশঙ্কা করতেন! হয় তিনি ছিলেন খুব অসুস্থ, না হয় ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠার মুখে, তবুও লেনিন তাঁর অতি-মানবীয় বৌদ্ধিক শক্তি প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু যাই হোক যেহেতু তিনি ছিলেন অসুস্থ সেহেতু যেকোনো সময়ে সহজেই দৈহিক বিপর্যয় ঘটতে পারত। তাঁকে এক প্রতিবিপ্লবী কর্তৃক হত্যা করার অপচেষ্টার হাত থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু নশ্বরতার নিয়ম এমনই অলঙ্ঘনীয় যে একের পর এক হৃদরোগে আক্রমণ সহ্য করেও এই মহান পুরুষ- শতাব্দীর মহত্তমদের মধ্যে অন্যতম- ১৯২৪ সালের ২১ জুন প্রয়াত হন।
এই প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে তথাকথিত লেনিনের ইচ্ছাপত্র সম্পর্কে যা বহু বছর ধরে এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে তাতে স্তালিনকে তীব্রভাবে নিন্দা করা হয়েছে। তা খুবই মর্মান্তিভাবে করা হয়েছে। গ্লাসনস্ত-এর নামে স্তালিনের রেকর্ডকে চূড়ান্তভাবে কালিমালিপ্ত করার (এবং অনিবার্যভাবে লেনিনের ভাবমূর্তিকেও) লক্ষ্যে। ১৯৮৭-র নভেম্বর থেকে সংশিষ্ট বিষয়ে প্রচার-পুস্তিকার লক্ষ লক্ষ কপি বিভিন্ন ভাষায় মস্কো থেকে বিলি করা হয়েছে (মস্কো নিউজ’ ও ‘নিউ টাইমস’ পত্রিকায় অবিরাম কুৎসা প্রচার ছাড়াও) এক বীভৎসরূপে স্তালিনকে চিত্রিত করতে এবং এই প্রসঙ্গে লেনিনেরও নজির টানা হয়েছে। তাই এ সম্পর্কে এই গ্রন্থে কিছু মন্তব্য করা আবশ্যক।
হৃদরোগের দ্বিতীয় আঘাত সামলিয়ে, লেনিন পার্টির কাজকর্ম নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে এবং মৃত্যু আসন্ন বুঝে ১৯২২-এর ২৫ ডিসেম্বর তার একান্ত সচিবকে দিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত নোট (করণীয় কাজ সম্পর্কে) লিপিবদ্ধ করান। দু’জন বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সুযোগ্য সদস্য স্তালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন পার্টিতে “অদূরভবিষ্যতে এক ভাঙনের”, যদিও মনে হয়েছিল তা ‘সুদূর ও অসম্ভব। প্রসঙ্গক্রমে, এটাই ট্রটস্কিকে আহত করেছিল যিনি কখনো স্তালিনকে এক নীরস মাঝারি মাপের মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবেননি এবং অন্য নেতৃস্থানীয় নেতারা নিজেদের অসীম উচ্চস্তরের মানুষ বলে ভাবতেন। ট্রটস্কি ছিলেন একটু ভিন্ন পথের মানুষ । ১৯১৭-র পর কিছুকাল তিনি লেনিনের সঙ্গে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন, যাঁকে লেনিন একসময় আখ্যা দিয়েছিলেন অন্য সহকর্মীদের মধ্যে ‘সবচেয়ে উজ্জ্বল’ । যাই হোক স্তালিনের প্রশংসাতেও লেনিন আগে কখনো কার্পণ্য করেননি, স্তালিন ও ট্রটস্কি উভয়কেই “সবচেয়ে যোগ্য” বলে লেনিনের উল্লেখ গর্বাচভ-এর সময়ে স্তালিনকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াসকে নস্যাৎ করে দেয়।
১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর জর্জিয়ার সমস্যা সমাধান করার ব্যাপারে স্তালিন ও দিজেরঝিনস্কির “বিশাল রুশ” উগ্র-স্বাদেশিকতার প্রশ্নে লেনিন অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অনেক অভিযোগ পেয়েছিলেন এবং এমনকি, খুবই অস্বাভাবিক হলেও, সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তাঁর এক অপ্রীতিকর বিরোধ দেখা দিয়েছিল। মনে হয়, তার ব্যক্তিগত সহকারীরাই অভিযোগগুলো আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং “প্রিয় সহকর্মীর দ্বারা প্রতারিত হওয়ায় খুবই ক্রুদ্ধ” লেনিন ১৯২৩-এর ৪ জানুয়ারি এক কঠোর সংযোজনীতে লিখেছিলেন : “স্তালিন খুবই রূঢ় এবং সাধারণ সম্পাদক পদে তার এই দোষ খুবই অসহনীয় হয়ে পড়েছে। তাই আমি কমরেডদের প্রস্তাব করছি তাকে ঐ পদ থেকে সরিয়ে দেবার উপায় উদ্ভাবন করতে।” এটা দোষের হবে না যদি বলা হয় লেনিন যখন ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিন ও পিয়াটাকভ (শেষোক্ত ব্যক্তিটি ছিলেন খুবই যোগ্য কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে নির্ভরযোগ্য নয়”) সম্পর্কে রাজনৈতিক মতাদর্শগত ত্রুটি লিপিবদ্ধ করেছেন, তখন স্তালিনের ক্ষেত্রে উল্লিখিত হয়েছে কেবল তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ খামতি । তথাপি স্তালিন সম্পর্কে এটা ছিল পার্টির সর্বোচ্চ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতার প্রতিক্রিয়া।
ক্রোধবশত বা অন্য কোনো কারণেই হোক, অস্বাভাবিকভাবেই, লেনিন পার্টির কাছে সুস্পষ্ট সুপারিশ করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে স্তালিনের “অপসারণ” এবং “অন্য এক কমরেডকে নিয়োগের, যিনি হবেন আরও ধৈর্যশীল, আরও অনুগত, আরও নম্র এবং কমরেডদের প্রতি আরও মনোযোগী, একটু কম খেয়ালি, ইত্যাদি।” ১৯২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রাভদা’ লেনিনের ‘বেটার ফিউয়ার বাট বেটার’ রচনাটির প্রথম অংশ প্রকাশ করে। তাতে প্রচ্ছন্ন কিন্তু তীব্র আক্রমণ করা হয়েছিল ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস ইনসপেকটরেট-কে, যার শীর্ষে ছিলেন স্তালিন। জানা যায়, মার্চ মাসের গোড়ার দিকে স্তালিনের সঙ্গে তার এক সাক্ষাৎকারে কী ঘটেছিল তা কেউ জানেন না, কিন্তু স্তালিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে ছেদ করে লেনিন একটি সংক্ষিপ্ত নোট লিখে পাঠিয়েছিলেন। ১৯২৩-এর এপ্রিলে যখন পার্টির দ্বাদশ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতে চলেছে তখন এই ঘটনা স্তালিনের কাছে এক অশুভ লক্ষণ হয়ে দেখা দেয় ।
বোধগম্য কারণেই এই বিরোধের পুরো কাহিনি কখনই সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়নি। কিছু পরিস্থিতিগত সাক্ষ্যপ্রমাণ ইঙ্গিত দেয় লেনিনের স্ত্রী ও কমিউনিস্ট জীবনসাথি ক্রুপস্কায়ার, বোধহয়, এক অনিচ্ছাকৃত ভূমিকা ছিল এই কাহিনিতে। ক্রুপস্কায়া ও স্তালিনের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয় বলে শোনা যায়। স্তালিন, সংবেদনশীলতার যথেষ্ট অভাব ঘটিয়ে জানিয়েছিলেন, পার্টি লেনিনের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টা দেখাশোনা করছে এবং তা করবে তার হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই। এটা অবশ্য অনুমানভিত্তিক, কিন্তু সেই সময়কার পরিস্থিতিতে, অবিশ্বাস্য নয়! তাঁর সহকর্মীর এই অসংবেদী মনোভাব তাঁকে পীড়িত করেছিল। এর জন্যই বোধহয় লেনিনকে “সভ্য ব্যবহার সম্পর্কে লিখতে হয়েছিল তার বেটার ফিউয়ার বাট বেটার’ রচনায় : “মানুষ প্রলেতারীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে বাঁচালের মতো সবিস্তারে বলে। আমরা সন্তুষ্ট হব শুরুতে খাঁটি বুর্জোয়া সংস্কৃতিতে যা প্রাক বুর্জোয়া সংস্কৃতির অমার্জিত রূপ, যেমন আমলাতান্ত্রিক বা দাস (সার্ক) সংস্কৃতি ইত্যাদি পরিহার করতে সক্ষম হবে।” এমনকি দেবতাদেরও ভুল হয় এবং এমনকি, ডয়েটশার বলেন, এটা হয়তো সার্ফ পরিবারে জন্ম নেওয়া স্তালিনকেই লক্ষ্য করে বলা হয়েছিল। কে জানে মানুষের মনে, এমনকি তাঁদের মধ্যে মহত্তমেরও মনে কী আছে?
.
দ্বাদশ কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি
তবে কোনো সন্দেহ ছিল না যে স্তালিনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খুবই বিপদের মধ্যে পড়ত যদি লেনিন পার্টির দ্বাদশ কংগ্রেসে অংশগ্রহণের মতো যথেষ্ট সুস্থ থাকতেন; কিন্তু ১৯২৩-এর ৯ মার্চ লেনিনের তৃতীয় স্ট্রোক হয় যা তিনি আর সামলিয়ে উঠতে পারেননি। এ থেকেই এক অবিশ্বাস্য কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে যে স্তালিন হয়তো তাঁকে বিষ প্রয়োগ করেছেন! যাই হোক, এটা লক্ষণীয় যে ট্রটস্কি যিনি এই কুৎসা ছড়িয়েছিলেন ১৯৩৯-৪০ সালে, এর আগেও কখনো এই অপবাদের কোনো ইঙ্গিত ফিসফিস করেও বলেননি যখন স্তালিনের সঙ্গে তার বিরোধ এক বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছিল। ডয়েটশার, যার কাছে ট্রটস্কি ছিলেন প্রায় ‘হিরো’, এই কুখ্যাত অপবাদকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।
লক্ষ করার মতো, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় স্তালিন নিজেই পলিটব্যুরোর সভায় প্রস্তাব করেছিলেন দ্বাদশ কংগ্রেসে মূল রিপোর্ট পেশ করতে লেনিন অসুস্থতা হেতু অক্ষম হওয়ায়, পার্টির ইতিহাসে যা এর আগে কখনো ঘটেনি, ট্রটস্কি, নেতৃত্বের উত্তরাধিকারে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে কংগ্রেসে যেন মূল ভাষণ দেন। পাছে লোকে ভাবেন লেনিনের মৃত্যুর আগেই তিনি নেতৃত্বের দাবিদার হয়েছেন, তাই ট্রটস্কি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আরও তাৎপর্যপূর্ণ যে ট্রটস্কি নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সবকিছু সত্ত্বেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্তালিনেরই প্রধান রিপোর্ট পেশ করা উচিত। নিজের পক্ষে স্তালিন যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে এই সম্মান গ্রহণে রাজি হননি এবং অবশেষে জিনোভিয়েভ সেই দায়িত্ব পালনে সম্মত হন।
ইতোমধ্যে, স্তালিনের আচরণ এত সঠিক ও নম্র ছিল যে পলিটব্যুরো কংগ্রেসের সামনে সবকিছু বিস্তারিতভাবে পেশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কেননা লেনিন প্রকৃতপক্ষে কী চেয়েছিলেন তা স্পষ্ট ছিল না। যদি ট্রটস্কি রিপোর্ট পেশ করতেন তাহলে হয়তো জর্জিয়ার সমস্যা নিয়ে স্তালিনের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু তীব্র মন্তব্য শোনা যেত। একে যদি বলা হয় কৌশলে কাজ হাসিল, তাহলে স্তালিন জিতেছিলেন এবং ট্রটস্কি হেরে গিয়েছিলেন, যখন কংগ্রেস থেকে লেনিনের ঘোষিত অভিমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে “পশ্চাৎপদ জাতিসমূহের প্রয়োজন ও দাবি পূরণের জন্য প্রকৃতই প্রলেতারীয় ও ভ্রাতৃত্বমূলক বিবেচনার” আহ্বান জানানো হয়েছিল; স্তালিন অবশ্য তার নিজের নীতির ফাঁক ঢাকতে ‘স্থানীয় জাতিবাদ’-কে নিন্দা করতে কংগ্রেসকে রাজি করিয়েছিলেন। লেনিন ছাড়া অন্য সকলের চেয়ে তার নিজের অসীম শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অতি সচেতন ট্রটস্কি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন যত বেশি জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ, উভয়েই প্রতিভাধর কিন্তু ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদ, স্তালিনের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। বিপ্লবের প্রতি আনুগত্য অথবা তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক কুশলতায় যোগ্যতার দরুনই হোক, স্তালিন সেইসময়ে লক্ষণীয়ভাবে সংযত আচরণ করেছেন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। সুবিধাজনক অবস্থান থেকে সংকটকালে নেতার ভূমিকাকে শক্তিশালী করেছেন। সংকট কঠিনের দিকে মোড় নেয় যখন লেনিনের জীবনাবসান ঘটে (২১ জানুয়ারি, ১৯২৪) এবং পরিস্থিতি মিলেমিশে এমন রূপ নেয় তখন স্তালিন এগিয়ে আসেন কোনোরকম বাধা বা আপত্তি ছাড়াই, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে শবানুগমনকারীর দায়িত্ব পালন করতে এবং শোকজ্ঞাপনের দীর্ঘকালব্যাপী কর্মসূচির, বলতে কী, তিনিই ছিলেন ‘সব অনুষ্ঠানের প্রধান। ঘটনাচক্রে ট্রটস্কি তখন ছিলেন অনেক দূরে দক্ষিণে স্বাস্থ্য উদ্ধারের প্রয়োজনে এবং স্বাভাবিকভাবেই লেনিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মানুষ তার উপস্থিতি খুঁজছিলেন এবং তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। পরে ট্রটস্কি অভিযোগ করেছিলেন যে, স্তালিন তারিখ সম্পর্কে ভুল সংবাদ দিয়ে তাঁকে বিপথে চালিত করেছিলেন; কিন্তু স্তালিনকে সর্বশক্তিমান হিসেবে ধরে নেওয়া ছাড়া এই যুক্তি ধোপে টেকে না। লেনিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছিল খুবই ভাবগম্ভীর, কিন্তু সাধারণের চেয়ে একটু বেশি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান এবং যাতে স্তালিনের ভূমিকা সহজেই চোখে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, এটা দেখা যায় পার্টিতে সদস্যভুক্তির ‘লেনিন রিক্রুটমেন্ট’ ও বিখ্যাত শপথ গ্রহণ সংক্রান্ত ধারণা থেকে যা প্রয়াত নেতার সম্মানার্থে স্তালিন ভাবনা হিসেবে প্রতিভাত করতে পরিচিত হয়েছিল।
শপথ বাক্যে ঘোষণা করা হতো “কমরেডগণ, আমরা কমিউনিস্টরা একটা বিশেষ ধাঁচে বিশেষ উপাদান থেকে তৈরি হয়েছি। তারপর প্রায় ধর্মীয় মন্ত্রোচ্চারণের মতো হলফ করতে হতো “যে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা কমরেড লেনিন, সেই পার্টির সদস্যপদের চেয়ে আরও কোনো বড় উপাধি নেই; আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে কমরেড লেনিন চোখের মণির মতো আমাদের পার্টির ঐক্যকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পণ করে গেছেন।” তারপরেও উল্লেখ করা হয়েছে লেনিনের নির্দেশ: প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী, ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিককে রক্ষা ও শক্তিশালী করা এবং সেইসঙ্গে “সমগ্র বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির জোট কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে প্রসারিত ও শক্তিবৃদ্ধি করা।”
লেনিনের জীবনাবসানে শোকের প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত পরিস্থিতিতে একপ্রকার লেনিন-পূজার অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং খুব শিগগিরই লেনিনের শবদেহকে মমিতে পরিণত করে মিউজিয়ামে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটি এমন ধরনের ছিল যা লেনিন মেনে নিতে পারতেন না, কারণ তাঁর জন্মদিন পালনের ব্যাপারে তাঁর অনীহার কথা সকলের জানা ছিল। তবুও এটা ভাবা হয়েছিল যে প্রয়াত নেতার ওপর প্রায়-মাহাত্ম্য আরোপ সোভিয়েত জনগণের ইচ্ছার অনুসারী ছিল। এটা স্তালিন ও অন্য সব নেতাদের চিন্তা-ভাবনার উপযোগী হয়েছিল, কারণ তারা হয়তো ভেবেছিলেন এই সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে জনপ্রিয় সমর্থন সংগঠিত করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে স্তালিন, যাঁর লেনিনের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনাকে “একটা বিশ্রি কাহিনি মনে করে নেতৃস্থানীয় মহলে প্রায় ভুলে যাওয়া হয়েছিল, আবার তার পুরনো কর্তৃত্বের অবস্থানে ফিরে আসেন। লেনিন-পরবর্তীকালে “সমষ্টিগত নেতৃত্ব” গড়ার প্রয়াস শেষপর্যন্ত কর্তৃত্বের শীর্ষে স্তালিনের অবস্থান সংহত করতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি। তাঁর নামকে ঘিরে প্রায় পূজ্য করে তোলার প্রয়াসকে লেনিন কখনই উপভোগ করতেন না, কিন্তু প্রতিটি যুক্তির পক্ষে মার্কসের চেয়েও বেশি লেনিনকে উদ্ধৃত করে লেনিনের ঘোষণার সূত্র ধরে স্তালিন তাঁর প্রতিটি বিবৃতি দিতেন। তাই খুব বেমানান নয়, ডয়েটশার ঠাট্টা করে লিখেছেন (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ২৭৪) যে স্তালিন হয়তো আর্কিমিডিসের কথা পাল্টিয়ে বলতেন : “লেনিন থেকে আমাকে একটা উদ্ধৃতি দাও, আমি সারা বিশ্বকে নড়িয়ে দেব!”
লেনিনের জীবনাবসানের চার মাস পরে ১৯২৪ সালের মে মাসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বর্ধিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে স্থির হয় লেনিনের ইচ্ছাপত্রকে একটি গোপনীয় দলিল হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু নির্বাচিত সদস্যকে দেখানো হবে, অন্য কারোর কাছে নয়। জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ প্রস্তাব করেন যদিও লেনিনের প্রতিটি নির্দেশই অলঙ্ঘনীয় ও বাধ্যতামূলক, তবু যেহেতু স্তালিনের আচরণ তাঁর “সমতামূলক সহযোগিতা”-র মানসিকতা ছিল আদর্শস্বরূপ, সেহেতু তাঁকে সাধারণ সম্পাদকের পদে আসীন থাকার অনুমতি লেনিনের নির্দেশের পরিপন্থী হবে না। আপাতদৃষ্টি ট্রটস্কি অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ তিনি লক্ষ করছিলেন স্তালিন, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভকে নিয়ে ত্রি-শক্তি ক্রমশ প্রবল হচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা করায়ত্ত করছে, তথাপি তিনি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে এতই গর্বিত ছিলেন যে তিনি কোনো হস্তক্ষেপ করেননি এবং নিরপেক্ষ ছিলেন। জিনোভিয়েভের প্রস্তাবটি পক্ষে ৪০ ও বিপক্ষে ১০ ভোটে গৃহীত হয়।
এর একটা কারণ, উচ্চ নেতৃত্ব মহলের ধারণা যে সাদাসিধে ব্যক্তিত্বের স্তালিনকে পার্টির কর্তৃত্বের অধিষ্ঠানে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আত্ম-সচেতন ও প্রকাশ্যতই সমুজ্জ্বল প্রতিভার অধিকারী ট্রটস্কি ক্ষমতার শীর্ষে থাকলে রাষ্ট্রের কাছে বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিল, যেমন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফরাসি বিপ্লবের কাছে বিপদ দেখা দিয়েছিলেন। মহান দার্শনিক হেগেল একসময় নেপোলিয়নের ক্যারিজমায় এতই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তাঁকে এক ঝলক দেখেই লিখেছিলেন, তিনি “অশ্বপৃষ্ঠে ইতিহাস-কে অবলোকন” করেছেন! পরম সুখের কথা তার সম্পর্কে স্তালিনের কোনো ক্যারিশমা ছিল না; অননুকরণীয় ব্যক্তি-জীবন, পার্টি কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা, তার ধৈর্য এবং নির্দিষ্টভাবে তাঁর সাধারণত্ব ও বাহ্যত উচ্চাশাহীন হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ট্রটস্কির গুণমুগ্ধদের সংখ্যা বেশি ছিল, কিন্তু নিজের দেশে তিনি ছিলেন সন্দেহভাজন। স্তালিনের মতো নয়, ট্রটস্কি তাঁর “যুক্তসিদ্ধ মনন ও ইয়োরোপীয় রুচি” (ডয়েটশার) নিয়ে ‘লেনিনবাদী ধাঁচের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি এমন এক সময়ে যখন সারা সোভিয়েত দেশ জুড়ে লেনিনের ‘নিগূঢ় শক্তি’ ছড়িয়ে পড়েছে এবং ট্রটস্কি তার অতীত লেনিন-নিন্দার বোঝা ঝেড়ে ফেলতে পারেননি, আবার তাঁর সহকর্মীদের সাথেও সমানভাবে মিশতে পারেননি, যাঁদের প্রায়শই তিনি বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে হেয় করেছিলেন। হয়তো তখন যদি বিদ্যমান দীর্ঘ বিরোধের মীমাংসা হতো তাহলে ট্রটস্কি-স্তালিনের বিরোধ সম্পর্কে কিছুটা সময়োপযোগী মূল্যায়ন করা সম্ভব হতো। ইতোমধ্যে লেনিন পরবর্তীকালের সোভিয়েত জনগণ প্রায় অনিবার্যভাবে স্তালিনকেই তাদের নেতৃত্ব দেবার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
তখন সুদূরে ছিল বিশ্ব-রাজনীতিতে বৃহৎ শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মপ্রকাশ। স্তালিনের সামনে ছিল আরও দীর্ঘপথ অতিক্রমের সোভিয়েত নেতা হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল-রুজভেল্টদের সমকক্ষের অবস্থানে নিজেকে তুলে ধরার কিংবা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রম্যান অ্যান্ড কোং-এর পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলকে উপেক্ষা করার দৃঢ়তা প্রদর্শনের। ১৯২৫-২৯ সময়কালে রাজনৈতিক-মতাদর্শগত সংগ্রাম স্তালিনকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিজের হাতে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার এবং যতটা সম্ভব সমাজতন্ত্রের অভিমুখে চালিত করার যোগ্য করে তুলেছিল। ইতিহাসের মল্লভূমিতে এক কর্মজীবনের, উচ্চ প্রশংসিত আবার কলঙ্কিতও, সূচনা ঘটে যার অপেক্ষমাণ প্রকৃত সুসমঞ্জস বিচার সময়ের পরিপূর্ণতাতেই একমাত্র হতে পারে ।
.
পার্টি অভ্যন্তরে অভিযোগ
স্তালিনের বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ ছিল যে সোস্যাল ডেমোক্রাসি সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত বিতৃষ্ণা ও অশ্রদ্ধার দরুন তিনি সমাজতন্ত্রের অভিন্ন স্বার্থে ঐ শক্তির সমর্থন সংগঠিত করার কখনো কোনো প্রয়াস নেননি। যদিও সোস্যাল ডেমোক্রাসি সম্পর্কে স্তালিনের গভীর বিতৃষ্ণা ছিল, যাদের তিনি একবার ক্রুদ্ধ হয়ে আখ্যা দিয়েছিলেন (১৯২৪) ফ্যাসিবাদের বিপরীত মেরুর নয়, আসলে যমজ” এবং “বস্তুত ফ্যাসিবাদের এক মননীয় শাখা”, একই বৃন্তে দুটি মটরশুটির দানার মতো সম্পর্ক, তবু তিনি নিশ্চিতভাবে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর সপ্তম কংগ্রেস (১৯৩৫) থেকে গৃহীত ‘যুক্তফ্রন্ট লাইনের পক্ষে তার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সমস্ত দিক দিয়েই তার প্রভাব ছিল ব্যাপক এবং যদি ডিমিট্রভের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ, হিলফারডিঙ প্রমুখদের সম্পর্কে তার প্রায়শই অভিব্যক্ত বিতৃষ্ণার কথা সকলেরই জানা আছে এবং লেনিন যেমন কাউটস্কি-কে “দলত্যাগী” বলে নির্মম নিন্দা করেছিলেন, সেই লাইনেরই অনুসারী ছিল স্তালিনের এই মনোভাব। জার্মান কমিউনিস্টদের সম্পর্কে, মনে হয়, তার সবসময়ই গভীর তৃষ্ণাভাব ছিল (এটা কী কাকতালীয় ছিল যখন ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ফুলটনে চার্চিল, যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই, কমিউনিজমের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ ঘোষণা করে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ‘জার্মান জাতি’কে, সংগঠিত করার শ্লোগান তুলেছিলেন?)।
অবশ্য সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা, দৃষ্টান্তস্বরূপ, প্রাক্তন সোভিয়েত পলিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান জর্জি শাখনাজারভ যিনি অক্লেশে নিজের বলা পুরনো কথা গিলে ফেলে এমন কথাও লিখেছিলেন (সোসাল সায়েন্সের কোয়াটারলি, পৃষ্ঠা-১৮, মস্কো সংখ্যা : ২, ১৯৯১) যে “শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক প্রবণতার মধ্যে নিহিত ছিল এক সুনিশ্চিত পরিমিতিবোধ এবং বিমুক্ত তাত্ত্বিক ছক ও অনুমানের ওপর নির্ভর না করে পরিবর্তনশীল সামাজিক বাস্তবতা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রণকৌশল নির্ধারণের চিন্তা-ভাবনার অনুসারী। এই সব নয়া সোভিয়েত’ ‘বিশেষজ্ঞরা কেবল ‘মস্কো নিউজ’, ‘নিউ টাইমস’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকাতেই নয়, অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর ম্যাগাজিনেও যা লিখেছেন তা গলার কাঁটা হয়ে আছে। বিস্ময়ের কিছু নেই, তারা সুযোগ নিতেই যে গরবাচভের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন যিনি সমাজতন্ত্রকে আবর্জনামুক্ত করার নামে সমাজতন্ত্রকেই বাতিল করে দিয়েছিলেন। যার জন্য ১৯৯১-এর আগস্ট মাসে গরবাচভ যখন গভীর অনুভূতির সঙ্গে বলেছিলেন “আমার লক্ষ্য (মিশন) সমাধা হয়েছে”, তখন ইয়েলৎসিন তার প্রশংসায় করতালি দিয়েছিলেন।
এই বিষয় আলোচনা করা নেহাতই অলস, প্রায়শই ঘৃণ্য প্রয়াস, কিন্তু এটা হতে পারে সোস্যাল ডেমোক্র্যাসি সম্পর্কে স্তালিনের ধারণা সবসময়ই ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না এবং কোনো সময়ে ব্যাপকতর আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে, তবুও এ বিষয়ে খুব জোরের সঙ্গে তাঁকে দোষারোপ করা সমীচীন নয়। এমনকি এখনও বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে সমাজনৈতিক মঞ্চে সমাজতন্ত্র বিরোধী হেলমুট কোহল বোধ হয় ‘সমাজতন্ত্রী মিতের-র চেয়ে রাজনৈতিক কর্মসাধন হিসেবে বেশি গ্রহণীয়। কিন্তু যাই হোক, ঘটনা হলো বছরের পর বছর ইয়োরোপে ফ্রান্সে, ব্রিটেনে, স্ক্যানডিনেভিয়ার দেশগুলোতে, অস্ট্রিয়ায়, স্পেনে, পর্তুগালে ‘সমাজতন্ত্রী শাসন বজায় থাকতেও এখনও পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণীয় প্রভাব দেখা যায়নি। তারা এক ধরনের ‘শ্রেণি’ শাসনের প্রতিনিধি যা শ্রেণিহীন সমাজের দিকে (যতটা বর্তমানে সম্ভব) অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয় না তাদের ‘গণতন্ত্র সম্পর্কে ঘোষণা এবং অন্য আরও কিছু বিদ্রূপ করে দুর্গত বিশ্বকে যেখানে অসহায় বঞ্চিত মানুষের এমনই দুর্বিসহ অবস্থা যে ক্ষুধার কারণে প্রতি মিনিটে পঁচিশ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এরা গ্রুপ-৭’-এর অন্তর্ভুক্ত দেশ যারা প্রভুত্ব করে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ ও জনগণকে যারা এখনও যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি সংগঠিত করতে পারেনি এবং “খাঁটি বিদ্যমান সমাজতন্ত্র”-র পরিকল্পিত বিপর্যয়ের দরুন, অন্ততপক্ষে ইয়োরোপে, খুবই দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে। বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন করার, তথাকথিত স্তালিন মডেল’-এর ভূত তাড়ানোর নামে কেবল সমাজতন্ত্রই নয়, সেই সঙ্গে জাতীয় মুক্তি এবং দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনেও এক চরম আঘাত হানা হয়েছে।
স্তালিনের উত্তরসূরি সোভিয়েত নেতৃত্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক, যারা শুরু করেছিলেন “পেরেস্ত্রৈকার প্রথম অধ্যায়”, “দ্বিতীয় অধ্যায়” লেখা হয়েছিল, স্টিফেন এফ কোহেন-এর ভাষায় (জুন, ১৯৯০), গরবাচভ অ্যান্ড কোম্পানির দ্বারা এবং পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল এটা যেন “অপরিবর্তনীয় থাকে। মতাদর্শ ও রাজনীতিগতভাবে যে ধৃষ্টতার সঙ্গে নিকিতা ক্রুশ্চভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেস (১৯৫৬) পরিচালিত করেছিলেন তা, ঘটনার পরে দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করতে হয়, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মেনে নিয়েছিল অনাবশ্যক আবেগভরে, সম্ভবত মস্কো তখন মার্কসবাদের তীর্থক্ষেত্র হিসেবে প্রভূত সম্মানের অধিকারী হওয়ার কারণে। যাই হোক, পরবর্তীকালে ঘটনাবলি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে যায় যে তৎকালীন সোভিয়েত নেতৃত্ব অমান্য করেছিলেন কাল মার্কস-এর চেতনা (যা স্তালিন সর্বদাই মনে রেখেছিলেন) : “যে অবস্থান ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে তা পরিত্যাগ করা, বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করার মতো দোষে যেন কেউ দুষ্ট না হয়, কারণ শ্রেণিশত্রুর তৎপরতা কখনই শিথিল হয় না। এই ভীরুতা ১৯৮৫-৮৭ সালে এবং পরবর্তীকালে এক চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মিখাইল গরবাচভের দ্বারা যিনি জানতেন না অথবা জানার চেষ্টাও করেনি যে, যেমন ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৯০ সালে বলেছিলেন, “সমাজতন্ত্রকে নিন্দা করে, তার মূল্যবোধকে ধ্বংস করে, পার্টিকে হেয় করে অগ্রণী বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করে, তার নেতৃত্বদায়ী ভূমিকাকে অস্বীকার করে, সামাজিক শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করে এবং সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের বীজ বপন করে” সমাজের শুদ্ধিকরণ অসম্ভব। কী শোচনীয় দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা, “পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ” যে ছিল সমাজতন্ত্রের অগ্রদূত তাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে, কিন্তু সেই কাজ করতে কতদিন লাগবে এবং কত মূল্য দিতে হবে তার হিসাব এখনও হয়নি। কুশ্চভ সম্পর্কে তারা বিদ্রূপ করে বলতেন “কী এক রুশ কৃষক!” যখন তার ভাঁড়ামি ও প্রলেতারীয় কাণ্ডজ্ঞানের মিলিত প্রকাশ ঘটত, কিন্তু সেটা কোনো হাসির ব্যাপার ছিল না।
সে এক লম্বা কাহিনি- প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন তার রাজনৈতিক মতাদর্শগত প্রহরা শিথিল করে দিয়েছিল। এমনকি যখন শ্রেণিশত্রু (যা এখন আর ভাবা হয় না) সর্বদাই সতর্ক ছিল, শুরু করা হয়েছিল যথার্থই ঠান্ডা যুদ্ধ নয়, মনে রাখা উচিত, স্তালিনের দ্বারা নয়, বরং অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ফুলটন থেকে (১৯৪৬) চার্চিল-টুম্যান অ্যান্ড কোং দ্বারা চলেছিল ক্ষিপ্র গতিতে সমাজতন্ত্রকে বাধা দিতে ও আঘাত হানতে যা কিছু প্রয়োজন তার বিভিন্ন রকম সাহায্য-সমর্থন দিয়ে। রুমানিয়া ও যুগোশ্লাভিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বী প্রবণতাকে উস্কে দিয়ে, পোল্যান্ড (১৯৫৩), হাঙ্গেরি (১৯৫৬), চেকোশ্লোভাকিয়া (১৯৬৮) প্রভৃতি দেশে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং সর্বোপরি, ন্যাটোর মতো সংস্থা গড়ে, সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা শক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে সোভিয়েতকেও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রস্তুতি গড়ে তুলতে হয়েছিল, যা প্রতিরোধে ও বিপুল ব্যাপক বৈদ্যুতিক প্রচার মাধ্যম মারফত গোলমাল পাকানো হয়েছিল, জন ফস্টার ডালেসের (যার কাছে একমাত্র ভালো কমিউনিস্ট ছিল মৃত কমিউনিস্ট”) অধীনেই হোক কিংবা নিকসন-কিসিঙ্গারের (কমিউনিস্ট ঐক্যের পথ থেকে যারা চীনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছিল) পরিচালনাতেই হোক, মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি যে কোনো মূল্যে কমিউনিজমকে নিশ্চিহ্ন করার একনিষ্ঠ সঙ্কল্প প্রদর্শিত করেছিল, যা কখনই যথাযথভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা হয়নি। যদিও সারা বিশ্বের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর নতুন গোষ্ঠীর গৌরবজনক বিষয় তুলে ধরার ছিল, যখন ভিয়েতনাম, কিউবা, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক প্রভৃতি দেশ সমাজতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তির ঐক্যের মহত্ত্ব প্রমাণ করছে (১৯৬৫ সাল নাগাদ ভিয়েতনামের নেতা লে দুয়ান বলেছিলেন তাদের সঙ্গে সোভিয়েতরা তাদের “চাল ও জল” ভাগ করে নিয়েছে), তখন চুপিসারে মতাদর্শগত পক্ষাঘাতের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে। এমন এক সময় যখন বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্য খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখন কুশ্চভ কমিউনিস্ট পার্টির ২২তম কংগ্রেসে (১৯৬২) কোনো কথা নেই, বার্তা নেই হঠাই দাবি করেন যে শিগগিরই কমিউনিজমের স্তরে সেভিয়েত ইউনিয়ন পৌঁছে যাবে- যে কোনো মার্কসবাদী সূত্র বিচারে একটা অবাস্তব দাবি- এবং সমাজতান্ত্রিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্পর্কে অতি গর্বিত হয়ে আত্মগরিমায় বোকার মতো বড়াই করে বলেছিলেন আর এক দশকের মধ্যে “আমরা (সোভিয়েত ইউনিয়ন) তোমাদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কবরস্থ করব!”
খুবই বিপজ্জনক ধরনের আত্মতুষ্টি সোভিয়েত ইউনিয়নকে গ্রাস করছিল এবং যখন বিপ্লবের সুফল তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে নির্ভরযোগ্য সম্পদ ছিল, এই আত্মতুষ্টি, সবদিক দিয়ে বিচার করলে, ব্রেজনেভ নেতৃত্বের সময়কার (১৯৬৪-৭৮) মন্দা’-র প্রধান কারণ ছিল। একমাত্র দেশের প্রতিরক্ষা’-র প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারে নজর দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাহ্যত ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে মতাদর্শগত অস্ত্রসজ্জাই সমাজতন্ত্রের নিরাপত্তার সবচেয়ে শক্তিশালী গ্যারান্টি। চীনের পার্টি কর্তৃক উত্থাপিত বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গিয়েছিল; মতাদর্শ থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে গতিশীলতার গুণ হারিয়ে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি কার্যত অনড় পূর্বাবস্থার এক নীরস রূপ ধারণ করেছিল । খুব দ্রুত এমন একটা সময় এসে হাজির হয়েছিল যখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সংগ্রামের বিভিন্ন মঞ্চ থেকে বীরত্বের দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও কমিউনিজমের উৎসাহদায়ী গুণ নীরস হয়ে দেখা দিয়েছিল (কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নেই নয় যেখানে, কিছু প্রচারের ক্যাপসুল ছাড়া, কমিউনিস্ট বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে মার্কসবাদের গভীর অধ্যয়ন কদাচিৎ হতো, কিন্তু একই সঙ্গে নতুন উদীয়মান দেশগুলোতে যে যুবসম্প্রদায় সমাজতন্ত্রের সম্পর্কে জানবার, বুঝবার জন্যে আগ্রহী ছিল তাদের সেই ক্ষুধা মেটানো হয়নি)। এটা লেনিন-স্তালিন উত্তরাধিকারকে মুছে দেবার ‘গণতান্ত্রিক’ ঘৃণ্য চক্রান্তের পেছনে আছে এক দীর্ঘ, জটিল ও হৃদয়বিদারক কাহিনি, যা এই গ্রন্থের পরিসরে যথার্থভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
.
ঘরের শত্রুদের অবিরাম শত্রুতা
অপরাজিত বুর্জোয়া বিশ্ব- শক্তি এই পরিণাম ঘটাতে পারত না, যদি না ‘ভেতরের শত্রু’ অবিরাম সক্রিয় না থাকত এটা কমিউনিস্টদের ভাগ্যদোষ নয়, বরং নিজেদের মধ্যকার দোষেই তাদের লক্ষ্যপূরণ এখনও বহুদূর পিছনে পড়ে আছে। এটা খুব বেশি নিরুৎসাহিত হওয়ার বিষয় নয়। যদিও আমাদের কারোর কারোর সমাজতন্ত্রের সন্নিকটে পৌঁছানোর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, কিন্তু আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য ইতিহাসের কোনো দায়বদ্ধতা নেই! তাছাড়া, মাও কি একদা বলেননি যে তার সমাজতন্ত্রের জন্য প্রত্যাশা পূরণ হতে এক থেকে বহু শতাব্দী লেগে যেতে পারে? আমাদের ক্ষোভ প্রকাশের কোনো অধিকার আছে কি যদি কোনো মহান লক্ষ্যপূরণ ঘটে ধীর গতিতে, যদি সময় হয় দীর্ঘ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪৪-এর কাছাকাছি, তৎকালীন মার্কিন কমিউনিস্ট নেতা আর্ল ব্রাউডার ‘সৃজনশীল’ মার্কসবাদের নামে সর্বত্র পার্টিকে অবলুপ্ত করে দিয়ে তার পরিবর্তে আলোচনা চক্র গড়ার প্রস্তাব করেছিলেন। ফরাসি পার্টি এর তীব্র বিরোধিতা করে এবং এই দৃষ্টতাপূর্ণ ধারণা শিগগিরই উবে যায়। মার্কসবাদের সত্ত্বাকে ধ্বংস করার অনুরূপ প্রয়াসের ধারাবাহিক উদ্যোগের ইতিবৃত্ত বিধৃত করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ব্রাউডার-চিন্তা প্রভাবিত করেছিল যখন পরে ১৯৭০-এর প্রধান প্রবক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সোভিয়েতের বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেস থেকে (১৯৫৬) স্তালিন-নিন্দা উৎসাহিত করেছিল ‘উৎকৃষ্ট’ ‘পশ্চিমা ধারণাকে যে আফ্রো-এশীয়’ প্রবণতা (এর অর্থ যাই হোক না কেন) সোভিয়েত জীবনকে দূষিত করে দিয়েছিল। এই ধরনের পচা-গলা চিন্তাশক্তি সঞ্চয় করেছিল যখন কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ বিরোধ নীতির ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয়নি। যার ফলে কৃতী তরুণদের একা অংশ ‘চরমপন্থী। হয়ে গিয়েছিল, ইতালির কমিউনিস্ট পার্টিকে সহজেই বাগে আনা সম্ভব, তবে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির এখনও কিছুটা বিরূপ মনোভাব আছে! এই ‘ইয়োরো’ কেন্দ্রিকতাই গরবাচভের “আমাদের অভিন্ন ইয়োরোপীয় স্বদেশ” সম্পর্কিত নির্লজ্জ ঘোষণাকে মদদ জুগিয়েছিল। যখন প্যারিসে বুদ্ধিজীবীদের এক সভায় (জুলাই, ১৯৮৯) রেজিস দেরে গরবাচভকে প্রশ্ন করেছিলেন যে তাঁর এই ‘স্বদেশ’-এর সীমানাটা কী, তখন জবাব এসেছিল ‘উরাল থেকে আতলান্তিক পর্যন্ত। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে একটি ইয়োরো-এশীয় রাষ্ট্র সে সম্পর্কে রেজিস দেরে নিজেও একদা চে গুয়েভারার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অনুগামী হয়ে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তারই মতানুসারী অন্যান্যদের মতো রেজিস দেরে ফরাসি রাষ্ট্রপতি মিতের’র ব্যক্তিগত সচিব হয়ে সুখে দিন কাটিয়েছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুণমুগ্ধে পরিণত হয়েছিলেন, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি হিটলারের চতুর্থ রাইখ’ ব্যর্থ হওয়ার পর ‘পঞ্চম রাইখ’ গড়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে বলে নিন্দা করেছিলেন।
বোধহয় এই ‘ইয়োরো’- মুখিনতা অ-রুশ সোভিয়েত জনগণের মধ্যে কাজাখস্তানে দিনমুহাম্মদ কুনায়েভ-এর হয়রানি ও উজবেক নেতা রশিদভ-এর অপসারণের ঘটনা থেকে এক প্রকার বৈরী মনোভাবের সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল এবং ভীত করে তুলেছিল যে ঐতিহাসিক কারণে যে রুশরা অনেকদিন ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নে মাতব্বরি করছিলেন তারা গরবাচভীয় ব্যবস্থায় আরও বেশি সুযোগ নেবে। তখন আর কোনো শক্তিশালী, ও দৃঢ়-প্রত্যয়ী, স্তালিন ধাঁচের কথা না তুললেও, নেতৃত্বে ছিল না এবং ফলে বহু প্রশংসিত ও জনমুখী বিভিন্ন জাতি ও জাতীয়তার সম্মিলিত সোভিয়েত ইউনিয়ন এতকাল শক্ত সুতোয় বাঁধা বস্তা হঠাই ছিঁড়ে পড়ার মতো দ্রুত ভেঙে পড়েছিল।
ব্রেজনেভ-এর পর, যাঁর আমলে (১৯৬৪-৭৮) আত্মতুষ্ট মতাদর্শগত আলস্য ও ব্যাপক ঢিলেঢালাভাবে দেখা দিয়েছিল, চেরেনেনকো বেশিদিন স্থায়ী হননি এবং আঁদ্রোপভ সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে বাহ্যত নীতি-পুনরুজ্জীবনের কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে উদ্ভূত ‘ভোগবাদের দিকে বিপজ্জনক প্রবণতাকে তিনি নিন্দা করেছিলেন এবং প্রেরণা দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, মার্কস-এর উক্তি থেকে যে পুঁজিবাদ “অত্যাধিক, অমানবিক, অস্বাভাবিক ভোগবৃত্তির জন্ম দেয় জনগণের “প্রকৃত ও যুক্তিযুক্ত প্রয়োজন মেটাতে নয়, আরও “লোভের” খোরাক জোগাতে। যাই হোক, আঁদ্রোপভও বেশিদিন বাঁচেননি এবং গরবচেভ তার স্থান গ্রহণ করে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের কাছে ভোগবাদী বিপদ প্রশমিত করতে তিনি বিন্দুমাত্র শক্তিক্ষয় করেননি।
.
পশ্চিম ইয়োরোপের চাপান-উতোর
এই ‘ইয়োরো’ রোগের একটা নমুনা হলো ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী নেতা জঁ এলেইনস্টাইন-এর লেখা গ্রন্থ “দ্য স্তালিন ফিনমিন্যান”, যাতে তিনি লিখেছিলেন স্তালিন ও মাও-এর মতো ব্যক্তিরা মাকর্সবাদকে বিকৃত ও প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছেন। এই কথা লিখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সমাজতন্ত্রের মূল্যবান সম্পদ সম্পর্কে এবং “যে নির্দিষ্ট স্থান-কালগত পরিস্থিতিতে” “ইতিহাসে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা” হিসেবে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকশিত হয়েছিল সেই সম্পর্কেও, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন যা কিছু করেছিল তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এক ক্লান্তিকর বিজয়ের মানসিকতায় উপসংহার টেনেছিলেন (পৃ: ২১৮) : “এখন আমাদের সকলকে সমাজতন্ত্র গড়তে হবে উন্নত পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে ভিত্তি করে।”
এমনকি আইজাক ডয়েটশারও ১৯১৭-র বিপ্লব প্রসঙ্গে তার কেমব্রিজ বক্তৃতামালায় (১৯৬৭) প্রায় একইকম কথা বলেছিলেন এবং খানিকটা উচ্চকণ্ঠে শেলী’র প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ (শৃঙ্খলমুক্ত প্রমিথিউস) কবিতা থেকে mücyfecoa : “To hope till Hope creates/From its own wreck the thing it contemplates!” (আশা করা যতক্ষণ আশা সৃষ্টি হয়/ নিজের বিনাশ থেকে যা অভিপ্রায় করা যায়)। করুণা হয়, এইসব যোগ্য ইয়োরাপীয়রা লেনিন-স্তালিনের সৃষ্টি নির্বোধ, দুর্ভাগা ইতিহাস-প্রণেতাদের কাঁধে কাজটা ছেড়ে দিয়ে তাদের ‘বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্রের দিকে বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি! করুণার বিষয়, আমাদের আমোদিত করতে পারেনি তাদের সংস্করণের সমাজতান্ত্রিক সমাজ যার পরিকল্পনা এখন প্রায় ভেস্তে দিয়েছে গরবাচভ-ইয়েলৎসিন ও সদৃশ ব্যক্তিরা। আশ্চর্য হওয়ার মতো নয়, ফ্রান্সের খুব একটা অতীতে নয় যেখানে কোনো তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনায় মার্কসবাদ ছিল প্রায় ‘কথ্য ভাষা’, সেখানেই রেমন্ড অ্যাক্টের মতো সোভিয়েত বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা জাঁকিয়ে বসেছিল এবং পরে সুযোগ করে দিয়েছিল গী লারড্রো’র মতো নয়া দার্শনিকদের। যিনি আক্ষেপ করেছিলেন “কোনো ব্যবস্থাই রক্ষাকর্তা হতে পারে না।” ব্যার্নার অঁরি-লেভি, যিনি মাকর্সবাদের বিরুদ্ধে “বারবারিজম উহথ অ্যা হিউম্যান ফেস” (মানুষের অবয়বে বর্বরতা) নামে বই লিখেছিলেন যা বেশ বাজার পেয়েছিল এবং সবার উপরে, মিশেল ল্য ব্রি’র ‘গড ইজ ডেড, মার্কস ইজ ডেড, অ্যান্ড আই অ্যাম নট টু ওয়েল। মাইসেলফ (ঈশ্বর মৃত, মার্কস মৃত এবং আমি নিজেও খুব একটা ভালো নেই) শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। এইভাবে প্রচুর রসিকতার সৌরভে ইয়োরোপ থেকে, বলতে কী, কমিউনিজমকে বিদায় দেওয়া হচ্ছিল, এবং “আমাদের অভিন্ন ইয়োরোপীয় স্বদেশ”-এর নামে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে অন্য মূর্তিতে পরিবর্তিত করা হচ্ছিল।
যতদিন না পশ্চিমা দুনিয়া লোভনীয় ও আকর্ষণীয় কংক্রিট ও কাঁচের তৈরি নিজস্ব সমাজতন্ত্রের প্রাসাদ গড়তে না পারছে, সোভিয়েত জনগণ এবং লেনিন ও স্তালিনের পার্টির কাছে পুরনো ব্যবস্থার ভগ্নাংশ থেকে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এখনও প্রবল শ্রেণিশত্রুর কাছ থেকে নিরন্তর আদম্য শত্রুতার সম্মুখীন তাদের হতে হবে। পণ্ডিতি উন্নাসিকতা এবং আক্রমণ নেমে এসেছে তাদের কাছ থেকে যারা প্রকৃত সদিচ্ছা থাকলে সাধারণ স্বার্থে সাহায্যকারী হতে পারতেন! এঁরা হলেন সব যোগ্য নয়া-বামপন্থী, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি, স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন ও বিপ্লবের প্রতি আবেগপূর্ণভাবে আত্মনিবেদিত, কিন্তু প্রকৃত লড়াইয়ের ময়দানে থেকে অনেক দূরে বৈঠকখানার ঘেরাটোপে তর্ক-বিতর্কে প্রায়শই ঘাম ঝরান। তাদের কাছে সমাজতন্ত্র হলো কথার পাহাড় আর মোটা মোটা বই লেখা। কিন্তু একবিন্দুও কাজের কাজ নয়। এই অবস্থায় কেমন করে মার্কসবাদের অভিযান পুনরুজ্জীবিত করা হবে তা সকলকে একান্তভাবে ভাবতে হবে, যারা অদূর ভবিষ্যতে, যদিও হায়, আমাদের জীবিতকালে নয়, সমাজতন্ত্রের জন্য চিন্তা করেন। স্তালিন উত্তরাধিকার, তার স্মৃতিচারণা ও পর্যালোচনা (এবং তার তাচ্ছিল্য ও উন্নাসিক উপেক্ষা করা নয়) আজকের দিনের অবশ্য করণীয় কর্তব্য। “সমাজতন্ত্রের বিশুদ্ধকরণের দাবি করে পেরেস্ত্ৰৈকা ইতোমধ্যে তার চূড়ান্ত ক্ষতি করেছে।
নিজের এবং অন্যান্য বলশেভিকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে স্তালিন কখনো চিন্তা-ভাবনা করেননি। ক্রেমলিনের একটা সাধারণ কোয়ার্টারে তিনি প্রায় একরকম যোগীর মতো জীবনযাপন করতেন, তার স্ত্রী কাজে যেতে-আসতে ভিড়ে ঠাসা সাধারণের ব্যবহার্য (৩০-এর দশকের) বাসে যাতায়াত করতেন (এমিল লুডভিক ও জন গুর-এর মতো লেখক-সাংবাদিক যা লিখে গেছেন), তার দুই শিশু সন্তান যে বিদ্যালয়ে পড়ত সেখানে নির্দেশ দেওয়া ছিল তাদের পরিচয় যেন পরিদর্শকদের কাছে দেওয়া না হয়। কেবল সাংবাদিকরাই নন, এইচ জি ওয়েলস এর মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরাও তাঁর মানসিক গুণ ও মৌলিক বিষয়ের ওপর দখল আবিষ্কার করেছিলেন। নিউ স্টেটসম্যান অ্যান্ড নেশন’ পত্রিকায় (১৯৩৪) প্রকাশিত স্তালিন-ওয়েলস কথোপকথন খুবই আনন্দবর্ধক ছিল যা একদা জর্জ বার্নার্ড শ’ও আন্তরিকভাবে প্রশংসা করেছিলেন। জর্জীয় সার্ফ-এর বংশধর, কার্যত বছরের পর বছর ক্রেমলিনের মধ্যে আবদ্ধ এবং বিদেশ ভ্রমণ ও বুর্জোয়া আচার আচরণের প্রতি অনীহাগ্রস্ত স্তালিন যুদ্ধকালীন উদ্বেগের শিখরে থেকে দক্ষতার সাথে চার্চিল ও রুজভেল্টের সঙ্গে আচার-ব্যবহার করেছিলেন, প্রথমোক্তকে সম্পূর্ণভাবে অপ্রত্যাশিত কুশলতায় হতবুদ্ধ করে দিয়েছেন এবং শেষোক্তের কাছ । থেকে খানিকটা প্রীতিপূর্ণ সমীহ আদায় করে নিতে যে সক্ষম হয়েছিলেন তা বিস্ময়কর হলেও বাস্তব ঘটনা ছিল। তার হিংস্রতার জন্য নির্মমভাবে নিন্দিত স্তালিন বিপ্লবের ভবিষ্যতের স্বার্থে গণ-মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা জারি করতে পিছপা হননি এই বিশ্বাসে (শান্তির সময়কার বিচার-ব্যবস্থার নিয়মের বিরুদ্ধে) যে, কোনো দোষী ব্যক্তিই যাতে শাস্তি এড়াতে না পারে তার জন্য কিছু নির্দোষ ব্যক্তির শাস্তিবিধান ঘটতে পারে। কিন্তু এই স্তালিনই নিজে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বার্লিনে যুদ্ধ স্মারক স্তম্ভে তার মূর্তির বদলে জনৈক লালফৌজের কোলে উদ্ধার করা জার্মান শিশুর মূর্তি স্থাপন করার। জার্মানির জন্য তার কোনো দয়া মায়া ছিল না, কিন্তু যখন সোভিয়েত জনগণের হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে” যুদ্ধকালীন হিংস্রতার দরুন, এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনী নাৎসি অত্যাচার-নিপীড়নের বদলা নেওয়ার জন্য আর্জি জানিয়েছিলেন, ইলিয়া এরেনবুর্গ-এর বিবরণী অনুযায়ী, তখন স্তালিন আদেশ দিয়েছিলেন “না!” একদা, জানা যায়, যখন মার্শাল জুকভ নাৎসি কারাগার থেকে তাঁর (স্তালিনের) ছেলের মুক্তির জন্য তিনি কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে স্তালিন কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থেকে ছিলেন এবং পরে বলেছিলেন, “না”, এবং জানিয়েছিলেন, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে তার ছেলের মুক্তির চেয়ে মৃত্যুই তার কাছে কাম্য! এই হলো এক প্রকৃত ইস্পাতে গড়া মানুষ, যে সম্পর্কে ইতোপূর্বে লেখা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব-রাজনীতির এই নিঃসঙ্গ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বের চোখেও জল এসে গিয়েছিল যখন ভারতের রাষ্ট্রদূত রাধাকৃষ্ণন তার সঙ্গে সাক্ষাক্তারের পর বিদায় নেবার সময় তার পিঠ চাপড়ে- যে বন্ধুত্বমূলক আচরণ থেকে বহু বছর তিনি বঞ্চিত ছিলেন- বলেছিলেন, সাধারণভাবেই, “মার্শাল, নিজের দিকে নজর রেখো, ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুক!”
যে জীবন তিনি অতিবাহিত করেছেন এবং যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন তার সুবাদে, বোধ হয়, মানবজাতির ইতিহাসে একই সঙ্গে মহৎ ও শ্রেষ্ঠ যে সব খুবই সামান্য ব্যক্তিত্ব দেখা গেছে স্তালিন তাঁদের সমপর্যায়ভুক্ত হবেন না। কিন্তু দার্শনিক হেগেল যেমন নেপোলিয়নকে এক ঝলক দেখে হর্ষ প্রকাশ করে বলেছিলেন তিনি “অশ্বপৃষ্ঠে ইতিহাস”-কে দেখেছেন, তেমনই আমাদের যুগ দেখেছে ক্রেমলিনে এই অপ্রশম্য ব্যক্তির মধ্যে ইতিহাস নিজেই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
.
জে. ভি. স্তালিন
সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, অমর লেনিনের মহান সহযোদ্ধা জে ভি স্তালিন জন্মেছিলেন ২১ ডিসেম্বর, ১৮৭৯।
মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিন-এর শিক্ষাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ও বিকশিত করে স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র গঠনে এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশে এক বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন।
জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং অক্টোবর বিপ্লবের সময় ও গৃহযুদ্ধকালে প্রতিবিপ্লবী শক্তিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
লেনিনের জীবনাবসানের পর যখন তরুণ সোভিয়েত রাষ্ট্র চারদিক থেকে ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল, যখন দক্ষিণপন্থী ও বামমার্গী গোষ্ঠীরা লেনিনবাদের পথ থেকে পার্টিকে বিচ্যুত করার প্রয়াস চালাচ্ছিল, তখন স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টি-ঐক্য সুরক্ষিত করে লেনিনের ঐতিহ্যকে রক্ষা করে সমাজতন্ত্র নির্মাণের লড়াইয়ে জনগণকে সমবেত করে উল্লিখিত শক্তিগুলোর বিপজ্জনক তত্ত্ব, প্রবণতা ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
.
স্তালিনের মমিকেও বিতাড়িত হতে হলো!
১৯৫৩ সালের মার্চ থেকে বিশেষ সমাধিক্ষেত্রে সংরক্ষিত স্তালিনের মমিকৃত দেহকে অপসারিত করার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২২তম কংগ্রেস (১৯৬১) তথাকথিত স্তালিনবাদকে সম্পূর্ণ পরিহার করে। তখন আবার বিশ্বজুড়ে স্তালিনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রে (হাসিয়ান রাজত, ২১ ডিসেম্বর ১৯৬১) একটি উল্লেখযোগ্য সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিল : “হাতির দাঁতে খুঁত, তবুও হাতির দাঁত”! ত্রুটি সত্ত্বেও স্তালিনের ঐতিহ্যের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার প্রয়োজনে এই প্রাচীন ইন্দোনেশীয় প্রবচনকে ব্যবহার করা হয়েছিল।
অনেকেরই হয়তো মনে নেই। ইন্দোনেশিয়ার পার্টি তখন চীনা পার্টির পরেই এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টি ছিল। খুব কম ব্যক্তিই হয়তো মনে করতে পারবেন ১৯৬৫-৬৬ সালে, বিশ্বশক্তির ভারসাম্য বুর্জোয়াদের অনুকূলে থাকায় ইন্দোনেশিয়ার এই বিশাল পার্টির উপর হিংস্রভাবে আঘাত হানা হয়েছিল এ হিংস্র মনুষ্য শিকারে পাঁচ লক্ষেরও বেশি কমিউনিস্ট ও তাদের সমর্থকদের খুন করা হয়েছিল, প্রদর্শিত হয়েছিল এক ভয়ানক বুর্জোয়া মানবতার নগ্ন রূপ। এমনকি এখনও সেই ভয়ংকর কাহিনি সচেতনভাবে গোপন রাখা হয়, যাতে নৈতিক উৎকর্ষসম্পন্ন গর্বাচভ অনুপ্রাণিত ‘সর্বজনীন মূল্যবোধ’ এর প্রচার সর্বত্র ‘গণতান্ত্রিক’ বিজয় উদযাপন করতে পারে ।
ইন্দোনেশিয়ার পার্টি কর্তৃক স্তালিনের এই মূল্যায়ন বোধহয় আজও স্মরণ করা যেতে পারে, বিশেষত কারণ এর সঙ্গে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়নের মূলগত মিল ছিল। ক্রুশ্চেভের পুরনো অভিযোগের সঙ্গে নতুন বিষয়বস্তুগতভাবে প্রকৃতই গ্রহণযোগ্য এবং মতাদর্শগতভাবে প্রাসঙ্গিক কোনো কিছু যুক্ত করতে পারেনি গর্বাচভ অ্যান্ড কোং, যদিও স্পষ্ট, বিশ্বাসঘাতক কথাবার্তা, বক্রোক্তি এবং সেই ডাহা মিথ্যাচার শেষোক্তদের স্তালিনবিরোধী আক্রমণের লক্ষণ হয়ে দেখা দিয়েছে। যাই হোক, যেহেতু প্রতিবিপ্লব গ্রাস করেছে বেশিরভাগ প্রাক্তন ‘সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে এবং তার ফলে যেহেতু তৃতীয় বিশ্ব ছন্নছাড়া হয়ে গেছে, সেহেতু কমিউনিস্ট ও তার মিত্রশক্তির পুনরায় জোটবদ্ধ হওয়ার কাজ সর্বত্রই দীর্ঘ ও কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকেরই একটা অপরিহার্য দায়িত্ব আছে, আর তা হলো ইতিহাস রচনায় মাকর্সবাদ-লেনিনবাদের ক্ষমতার উপর আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং প্রসঙ্গক্রমে লেনিন ও সেই সঙ্গে স্তালিনের সৃজনশীল উত্তরাধিকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। উভয়েই স্মৃতি, বিশেষত গাসনস্তের নামে স্তালিনকে নিন্দিত ও খণ্ডিত করার দরুন, আজ পালন করার দাবি রাখে।
জে বি এস হলডেন-এর জীবনীকার রোনাল্ড ক্লার্ক (‘দ্য লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্কস অব জে বি এস হলডেন, লন্ডন, ১৯৬১), হলডেনের নিজের কথা উদ্ধৃত করে বলেছেন, স্তালিনের প্রতি তার রূঢ় নির্মমতাকে তিনি তখনকার ঘটনাবলির স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখলেও তাঁর (হরডেনের) নরম মনোভাব ছিল।” একসময় তিনি তার এক বন্ধুকে লিখেছিলেন; “স্তালিনের জীবনকালে তাঁর কিছু কাজের আমি বিরোধিতা করেছি, কিন্তু আমি ভেবেছি এবং মনেও করি তিনি এক মহান পুরুষ ছিলেন যিনি খুব ভালো কাজ করেছেন। এবং তখন যেমন আমি তার নিন্দা করিনি, তেমনি এখনও আমি তা করছি না। কেউ হয়তো তার যুক্তির মধ্যে সহজেই খুঁত ধরতে পারেন, কিন্তু আধুনিক সময়ের ইতিহাস রচয়িতাদের একজন সম্পর্কে এটাই ছিল এক মার্জিত বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মনোভাবের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। স্তালিন ছিলেন সন্দেহাতীতভাবে সেইরকম, তাঁর নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে অবিরাম প্রচার সত্ত্বেও।”
.
স্তালিন তো রক্ত-মাংসের মানুষই ছিলেন!
সর্বজ্ঞ নন, আবার সর্বশক্তিমানও নন, স্তালিনের, অন্য সব মানুষের মতোই যেমন কেবল শক্তিমত্তাই ছিল না, তেমনই ছিল তার সীমাবদ্ধতা। যাই হোক না কেন বিংশতিতম কংগ্রেসে উঘাটিত অধঃপতন প্রতিক্রিয়ার তিনি, “তিনি একাই এবং একমাত্র রচয়িতা ও অভিনেতা ছিলেন না। সর্বদাই নাকাল ও বিধ্বস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে কেবল সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সম্পর্কেই নয়, সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী বিশ্বে অর্থনৈতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ এবং সমাজতন্ত্রের অভিমুখে নতুন ও প্রকৃত পথের সম্ভাবনা সম্পর্কেও (কিছু ক্ষতি অবশ্য হয়েছিল, জ্ঞানত বা অন্যভাবে, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গাণিতিক যুক্তি-বিদ্যা পঠন-পাঠন ‘মার্কসবাদের সঙ্গে পরস্পর বিরোধী বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল) যে যথেষ্ট সৃজনশীল গবেষণা হয়নি তা কেবল একজন ব্যক্তি অথবা তার নিয়ন্ত্রিত একমাত্র একটি চক্রের জন্য অথবা একজন ব্যক্তির বিচ্যুতি ও বিকৃতির দরুন নয়। ঐতিহাসিকভাবে অবরুদ্ধ ও বিধ্বস্ত সোভিয়েতের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের ঘটনাবলির যোগ্য সামাজিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন যা ১৯৮৭-৮৮ সালে পেরেস্ত্রৈইকার সাহসিক ঘোষণা সত্ত্বেও যথাযথভাবে করা হয়নি। ইতোমধ্যে স্তালিন নিন্দা শুরু হয়ে যায় এমন কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে যা স্মরণ করিয় দেয়, স্পেনের দ্বিতীয় ফিলিপের বিরুদ্ধে প্রাচীন ঐতিহাসিক মোটলে’র অভিযোগ : “এমন অনৈতিকতা যদি থাকে যা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন তাহলে তার কারণ অনৈতিকতায় উৎকর্ষলাভ মনুষ্যচরিত্র অনুমোদন করে না!” যাই হোক, ই এইচ কার তার ইতিহাস কী’ শীর্ষক ধ্রুপদী গ্রন্থে সহযাত্রী পণ্ডিত সি এম নোয়েলস-এর অনুমোদনক্রমে উদ্ধৃত করেছেন তার অনুশাসন বাক্য যে ঐতিহাসিকরা বিচারক নন আনতশির বিচারক তো নয়ই। যেখানে এক অসম পরিস্থিতিতে একটি পশ্চাৎপদ দেশে সদ্যজাত সমাজতন্ত্র এবং দৃঢ়মূল শক্তিশালী পুঁজিবাদের মধ্যে নিবদ্ধ প্রতিযোগিতার মতো বিশালাকায় ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর পর্যালোচনায় দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রয়োজন কিছু বিনম্রতা এবং সুষম ও সঙ্গতিপূর্ণ প্রকৃত উপলব্ধির ।
.
সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ : তার বিশ্ব ঐতিহাসিক তাৎপর্য
ভেতরের ও বাইরের শত্রুদের যাদের সাফল্য পুঁজিবাদ পুনরুজ্জীবনের পথ সুগম করত, তাদের নির্মূল করে সমাজতান্ত্রিক সমাজের শক্তিশালী কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল- যা পুঁজিবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত শ্রমিকশ্রেণির সৃজনী শক্তি সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল। এমন এক সাফল্য যার পূর্ব নজির লিখিত ইতিহাসে নেই ।
এই সাফল্য বর্তমান যুগের ঘটনাবলিকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। এ সারা বিশ্বের মানুষের মনকেও প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে?
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসে পেশ করা রিপোর্টে স্তালিন বলেছেন, “সব দেশেরই বুর্জোয়ারা জোরের সঙ্গে দাবি করে যে পুঁজিপতি ও জমিদারদের ব্যতিরেকে, ব্যবসায়ী ও কুলাকদের (ধনী কৃষক) ছাড়া জনগণ এক পাও এগোতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকশ্রেণি কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন যে শোষকদের বাদ দিয়ে জনগণ যথার্থভাবেই এগিয়ে যেতে পারেন।
“সব দেশের বুর্জোয়ারা দাবি করে যে পুরনো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে শ্রমিকশ্রেণি পুরাতনের জায়গায় নতুন কিছু গড়তে পারে না। আমাদের দেশের শ্রমিকশ্রেণি তাদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে তারা কেবল পুরনো ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতেই সক্ষম নয়, সেইসঙ্গে গড়তে সক্ষম একটি নতুন ও আরও ভালো ব্যবস্থা, একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় বেকারি ও সঙ্কট বলতে কিছু নেই।
“সব দেশের বুর্জোয়ারা জোরের সঙ্গে বলে থাকে যে কৃষক সমাজ সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণ করতে অসমর্থ। আমাদের দেশের কৃষকদের যৌথ খামার বাস্তবে প্রমাণ দিয়েছে যে তারা সফলভাবেই সেই কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।
“সব দেশের বুর্জোয়া ও তাদের সংস্কারপন্থী লেজুড়দের প্রধান লক্ষ্য হলো শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে তাদের আস্থাকে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও অনিবার্যতা সম্পর্কে বিশ্বাসকে ধ্বংস করা… যদিও আমাদের দেশের শ্রমিকশ্রেণির সাফল্য, যদি তার লড়াই ও বিজয় পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমিকশ্রেণির প্রেরণাকে উদ্দীপ্ত করে এবং তাদের নিজেদের ক্ষমতা ও জয়লাভের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে, তাহলে আমাদের পার্টি বলতে পারে যে তাদের কাজ ব্যর্থ হয়নি। এবং সন্দেহ নেই সেটাই দাঁড়াবে।”
স্তালিনের উল্লিখিত উক্তির সুসংবদ্ধতা ও স্বচ্ছতাতেই প্রতিফলিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের ও সব দেশের মানুষের চেতনায় তার প্রভাবে বিশ্ব ঐতিহাসিক গুরুত্ব। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসের দু’দশকের কিছু কম সময় পরে সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারা ইয়োরোপ ও এশিয়ার বহু দেশে সাফল্য অর্জন করেছে, যার মধ্যে দিয়ে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে শ্রমজীবী জনগণ সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতার শিক্ষা গ্রহণ করেছে। সমাজতন্ত্র নির্মাণের বিপুল দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ভুল ত্রুটি হয়েছে। তা স্নান করতে পারবে না এই মহান সাফল্যকে, যা সাম্যবাদের আকাঙিক্ষত লক্ষ্যে মানবসমাজের অভিযানের পথে কীর্তির এক ফলক।
.
স্তালিনের মৃত্যু নিয়ে গুজব। আসলে কী ঘটেছিল?
৬০ বছর আগে ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ মস্কোর উপকণ্ঠে রাষ্ট্রীয় খামার বাড়িতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দণ্ডমুণ্ড বিধাতা জোসেফ স্তালিন মারা যান। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, ৭৪ বছর বয়সী স্তালিনের মৃত্যুর কারণ ছিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, কিন্তু খুব শিগগিরই তার মৃত্যুর সাথে সোভিয়েত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের জড়িত থাকার গুজব ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর পরবর্তীকালে নবনিযুক্ত শাসক কর্তৃপক্ষ খোলাখুলি ঘোষণা করে, যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইনটেলিজেন্স দফতরের তৎকালীন মুখ্য পদাধিকারী লাভ্রেন্তি বেরিয়ার চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন স্তালিন, আসলে কী ঘটেছিল?
২৮ ফেব্রুয়ারি স্তালিন তার খামার বাড়িতে বেরিয়া ও নিকিতা ক্রুশ্চভ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর কয়েকজন সদস্যকে জড়ো করেছিলেন। কী নিয়ে সেখানে কথাবার্তা হয়েছিল জানা না গেলেও, এটুকু জানা আছে যে বাক্যালাপ চলেছিল ভোর ৪টা পর্যন্ত, তারপরে যে যার গন্তব্যে রওনা দেন আর স্তালিন যান শয্যাকক্ষে, ১ মার্চ মধ্যাহ্নের পর স্তালিনের প্রহরীরা উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে। স্তালিন তার মহল থেকে বেরোননি বা কাউকে ডেকেও পাঠাননি। নির্দেশ মতো, না ডাকলে প্রহরীদের স্ত লিনের কাছে যাওয়ার অধিকার ছিল না। অবশেষে রাত ১১টার সময় একজন দেহরক্ষী সাহস করে স্তালিনের কাছে গিয়ে তাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। তখনো তার দেহে প্রাণ ছিল কিন্তু বাকশক্তি লোপ পেয়েছিল, সন্ত্রস্ত প্রহরীরা তাকে ডিভানে শুইয়ে বেরিয়াকে ফোন করতে শুরু করল, বেরিয়ার অনুমতি ছাড়া স্তালিনের জন্য ডাক্তারদের কল করা ছিল নিষিদ্ধ । বেরিয়াকে দীর্ঘক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না (প্রসঙ্গত, যেটা বেশ আশ্চৰ্যজনক) অবশেষে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা দফতরের প্রধানকে অতি কষ্টে খুঁজে পাওয়া গেল, তিনি এলেন ও গটগট করে ঢুকলেন সেই ঘরে, যেখানে অচৈতন্য অবস্থায় শায়িত ছিলেন স্তালিন।
স্তালিনের বাসভবনে ঘটা পরবর্তী ঘটনাস্রোত সম্পর্কে জানা গেছে শুধু প্রত্যক্ষদর্শীদের খুচখাচ ও অসম্পূর্ণ সাক্ষ্য থেকে, যেগুলো প্রায়শই পরস্পরবিরোধী. পরবর্তীকালে কয়েকজন সাক্ষ্য দিয়েছিল, যে স্তালিনকে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বেরিয়া ডাক্তারকে কল করতে একদম নিষেধ করেছিলেন। “কী আপনারা সোরগোল তুলছেন, দেখছেন না, যে কমরেড স্তালিন ঘুমিয়ে আছেন? সবাই এখান থেকে ভাগুন।” সে যাই হোক না কেন, সেই সারারাত সবার দ্বারা পরিত্যক্ত, আধাপ স্তালিন পড়ে ছিলেন কোনো ডাক্তারি সাহায্য ছাড়া! শুধুমাত্র ২ মার্চ বেরিয়া ডাক্তারদের কল করার নির্দেশ দেন। পলিটব্যুরোর সদস্যরা এসে ভাবলেশহীন, কিন্তু তখনও জীবিত স্তালিনের দেহের চারপাশে সমবেত হলেন, ডাক্তাররা তাড়াহুড়ো করতে লাগলেন। বেরিয়া মাঝেমধ্যেই এসে উচ্চস্বরে ডাক্তারদের উদ্দেশে প্রশ্ন করছিলেন, আপনারা কমরেড স্তালিনের জীবনের গ্যারান্টি দিচ্ছেন? আপনারা ওর শারীরিক অবস্থার জন্য আপনাদের দায়িত্বের মাত্রা উপলব্ধি করতে পারছেন? ক্ষুব্ধ প্রত্যক্ষদর্শীরা পরবর্তীকালে স্মরণ করেছিলেন, যে সে দিন বেরিয়া এমন আচরণ করছিলেন, যে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিনি মালিকের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী। তিনি ঘনঘন মুমূর্ষ স্তালিনের কাছে এসে দীর্ঘক্ষণ ধরে তার মুখের দিকে একাগ্র মনে চেয়ে থাকছিলেন, যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন স্তালিনের শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার মুহূর্তটিকে ধরার. মৃতপ্রায় স্তালিনের শেষশয্যার পাশে ঠিক উত্তরাধিকার প্রাপ্ত রাজকুমারের মতো বেরিয়া বারবার বলছিলেন : “কমরেড স্তালিন, আপনি আমাদের। কিছু অন্তত বলুন!” কিন্তু স্তালিনের আর কিছু বলার মতো অবস্থা ছিল না, স্তালিনের কন্যা ভেতলানা আলুলায়েভা তার পিতার জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণা করেছেন। মৃত্যুর ঠিক পূর্বক্ষণে স্তালিন হঠাৎ চোখ মেললেন, তাকালেন তাকে ঘিরে থাকা মুখগুলোর দিকে, তারপর বাঁ হাতটা তুললেন, উপরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন, নাকি কোনো সঙ্কেত দিলেন! যাই হোক, তার কয়েক মুহূর্ত পরেই স্তালিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বেরিয়ার পক্ষে ক্ষমতা জবরদখল করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৩ সালেরই ২৬ জুন তাকে গ্রেফতার করা হয় ও অনতিবিলম্বে গুলি করে হত্যা করা হয়। কে-জি-বিতে তার ঘনিষ্ঠ সহকারীদেরও খতম করা হয়, দেশের শাসন ক্ষমতায় জোসেফ স্তালিনের উত্তরসূরি হন নিকিতা ক্রুশ্চভ । তিনিই বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমূলে উৎপাটিত করার পরে বেরিয়া ও তার ঘনিষ্ঠদের স্তালিনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করার জন্য দোষারোপ করেছিলেন, ততদিনে কে-জি-বির শিখণ্ডী ও তার সাকরেদরা কেউ আর জীবিত ছিল না, সুতরাং তাদের যে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা যেতে পারত।
খুব সম্ভবত আজ আমরা সুনিশ্চিত করে বলতে পারব না, যে স্তালিন গত হয়েছিলেন বেরিয়ার চক্রান্তের ফলে নাকি তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। অথবা হয়তো বা চক্রান্ত হয়েছিল, কিন্তু তার সংগঠক আদৌ বেরিয়া ছিলেন না? আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি, যে স্তালিনের মৃত্যু সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ের চাপা আগুন উস্কে দিয়েছিল, যে লড়াইয়ে বেরিয়াকে কুপোকাত করে জয়ী হয়েছিলেন কুশ্চভ, আর সকলেই বোধহয় জানেন, যে ইতিহাস সর্বদাই রচনা করেন বিজয়ীরা।
।
নির্দেশিকা
http://bengali.ruvr.ru/2013_05_30/114666593/
.
.
স্তালিনের অবদান
সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নে লেনিনের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শিল্প-সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করেছিল; এমন এক শিল্প-শক্তি অর্জন করেছিল যার দ্বারা নিঃস্বার্থ সাহায্য দেওয়া সম্ভব হয়েছিল ইয়োরোপের জনগণতান্ত্রিক দেশগুলো ও চীনের অর্থনীতি পুনর্গঠিত করতে; এমন এক শিল্প-শক্তি যা ভারত ও অন্যান্য প্রাচ্য দেশকে পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দ্বারা চাপানো ঔপনিবেশিক পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছড়িয়ে থাকা কৃষকদের একক জমিজমাকে বৃহৎ যন্ত্রচালিত সমাজতান্ত্রিক খামারে ঐক্যবদ্ধ করার লেনিনের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। এইসব পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সেগুলোকে নির্দিষ্ট রূপ। দেওয়ার ও আরও ব্যাপ্ত করার কার্যকরী নেতৃত্বদানে জে ভি স্তালিন এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকাশে স্তালিনের অনেকগুলো তাত্ত্বিক রচনা খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল। এইসব রচনায় তাঁর চিন্তার-পাণ্ডিত্যের তুলনাহীন সহজ সরল প্রকাশ, অগ্রণী শ্রমিকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চারে এবং সমগ্র কমিউনিস্ট প্রজন্মকে গড়ে তোলার কাজে বিপুল অবদান রেখেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবসমাজের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল সমস্যার অন্যতম, জাতি সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানকল্পে অবিচ্ছেদ্যভাবে স্তালিনের নাম জড়িয়ে আছে।
বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের প্রতিটি রূপের দৃঢ় বিরোধী লেনিন একই সময়ে বারবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে শ্রমিকশ্রেণির পার্টি অবশ্যই জাতি-সম্পর্কিত সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেবে যাতে জাতিগত অসাম্য-বৈষম্য দূর হয় এবং সকল জাতিসমূহ বিকাশের জন্য পূর্ণ সুযোগ পায় ।
জাতি-সম্পর্কিত সমস্যা প্রসঙ্গে লেনিনের শিক্ষাকে স্তালিন আরও ব্যাপক ও উন্নত করেছিলেন। জার শাসনে নিপীড়িত জাতিসমূহ নবজীবনে জেগে উঠেছে; প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটিয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে জাতিসমূহের একটি পরিবারে পরিণত করেছে।
স্তালিন ইয়োরোপের শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন প্রাচ্যের দেশগুলোর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি, যে আন্দোলনগুলো ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রামে এক বিপুল বিপ্লবী তাৎপর্যপূর্ণ। সেই ১৯১৮ সালেই এক বিশেষ তত্ত্ব সূত্রায়িত করেছিলেন যার যথার্থতা বিগত ৩৮ বছরের ইতিহাস বহন করে যে অক্টোবর বিপ্লব “সৃষ্টি করেছে সমাজতান্ত্রিক পশ্চিম ও পদানত পূর্বের মধ্যে সেতু, যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক নতুন লাইন, পশ্চিমা দুনিয়ার প্রলেতারিয়েতদের প্রসারিত করেছে। রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের নিপীড়িত জাতিসমূহের দিকে।”
.
অমর হয়ে থাকবে তাঁর নাম
আজ যখন বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্রের অভ্যুদয় ও প্রাচ্যের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের চাপে সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, যখন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও প্রাচ্যের স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ মৈত্রী ও সহযোগিতার বন্ধন গড়ে উঠেছে, যখন এই বন্ধন মিশরের স্বাধীনতার সপক্ষে ইঙ্গ-ফরাসি আগ্রাসন বন্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ামক ভূমিকার মধ্য দিয়ে আরও দৃঢ়ভিত্তিক হয়েছে, তখন এই সময়ে স্তালিনের উল্লিখিত কথাগুলো এক নতুন ও গভীর মাত্রা অর্জন করেছে ।
স্তালিনের শিক্ষা বলে, শান্তি তখনই সুরক্ষিত হতে পারে যদি বিশ্বের জনগণ শান্তির স্বার্থ নিজেদের হাতে তুলে নেয় ও তার জন্য লড়াই করে এবং সারা বিশ্বজোড়া লক্ষ লক্ষ শান্তিকর্মীদের এক নতুন যুদ্ধের প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চালিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নই হলো আজ শান্তি ও জনগণের মধ্যে মৈত্রীর দৃঢ় রক্ষক।
খুবই কঠিন এক ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় স্তালিন কিছু ভুল করেছিলেন- তথাপি, এই ভুল-ভ্রান্তি সত্ত্বেও, সমগ্র মানবজাতির কাছে স্তালিনের নাম অমর হয়ে থাকবে সর্বকালের এক মহান মার্কসবাদী হিসেবে, চিন্তা ও প্রয়োগের এক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, সমাজতন্ত্রের স্বার্থে সমগ্র শ্রমজীবী জনগণের সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ এক মানুষ হিসেবে। মানবজাতির মুক্তির স্বার্থে তাঁর অবদান সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রেরণা জোগাবে।
১ মে, ১৯৪৫ কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনের রাইখৃস্ট্যাগে রক্তপতাকা উড়িয়ে মানবজাতির চরমতম শত্রু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন।
ফ্যাসি-বিরোধী যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রথম স্থানে। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ২ কোটি সোভিয়েতবাসী। যুদ্ধের সময় শিশুসহ ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে জার্মানিতে দাস শ্রমিক হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতে ৫৩ লক্ষ যুদ্ধবন্দির মধ্যে যুদ্ধের শেষে মাত্র ১০ লক্ষকে জীবিত পাওয়া গিয়েছিল। ফ্যাসিস্টদের আক্রমণে চরম ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল সোভিয়েতের ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজারেরও বেশি শহরকে, ৭০ হাজার গ্রামকে, ৩২ হাজার শিল্প সংস্থাকে এবং ৯৮ হাজার যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামারকে। যুদ্ধ যখন চলছে, মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন রুজভেল্ট ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টে’র জীবনাবসানের পর টুম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েই সেই প্রতিশ্রুতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। অবশ্য কমরেড স্তালিন তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে সমস্ত যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমাজতান্ত্রিক দৃঢ়তা। শুধু তাই নয়, পূর্ব ইয়োরোপের সদ্য মুক্ত হওয়া দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যেও সোভিয়েত তার সমগ্র শক্তিকে ব্যবহার করেছিল । এইভাবে যুদ্ধে বীভৎসতা কাটিয়ে কমরেড স্তালিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দুনিয়ার তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল।
এর পরের ইতিহাস পৃথিবীকে বারে বারে চমকে দেয়ার ইতিহাস। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখল এক অকুতোভয় যোদ্ধা জাতি কী বিপুল বিক্রমে পৃথিবীকে রক্ষা করল। গোটা পৃথিবীকে এক রক্তপিপাসু জাতির দাসত্ব করা থেকে বাঁচাল রেড আর্মি, বিশেষত কমরেড স্তালিনের তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধি, অকপট দেশপ্রেম আর জনগণের ওপর অগাধ বিশ্বাস।
জানা যায় যুদ্ধে তার প্রিয় পুত্রকে বন্দী করে জার্মানরা। বন্দী বিনিময় করতে চায় তাদের ফিল্ড মার্শাল ফ্রেডরিখ পউলাসের সাথে ।
তিনি রাজি হননি! এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে দেয় স্তালিনের কাছে দেশ আর নিজের সন্তানের মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ? লাল ফৌজের সর্বাধিনায়ক স্তালিন 401699 : I will not trade a Marshal for a Lieutenant!
যারা গড় চিন্তাধারায় তার স্বজনপোষণ’ নিয়ে কুৎসা করে তারা অবশ্য কল্পনাও করতে পারেননি যে দেশের জন্য স্তালিন উৎসর্গ করে দেবেন নিজের ছেলেকেই!
দুনিয়ায় শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের সংগ্রাম যতদিন ধরে চলবে, নিপীড়িত হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে অনুপ্রেরণার স্ফুলিঙ্গ হয়ে রইবেন কমরেড স্তালিন।
.
গ্রন্থপঞ্জি
১। স্তালিন উত্তরাধিকার ‘হাতির দাঁতে খুঁত, তবু হাতির দাঁত’– হীরেন মুখার্জি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। জানুয়ারি, ২০০৫।
২। স্তালিন ফিনমিন্যান- আইজ্যাক ডয়েটশার (লন্ডন-১৯৭৬)।
৩। সোভিয়েত সাম্যবাদ এক নতুন সভ্যতা- সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব। (১৯৩৫ সংস্করণ)
৪. Long Live the Universal Contributions of Comrade Joseph Stalin. Posted on December 20, 2009
৫. The Ukrainian famine-genocide myth –John Puntis, July 2002
৬. Making Sense of Stalin N Peter Myers, October 2000
৭. Conquest, Robert: The Great Terror –Stalin’s Purge of the Thirties, New York 1968.
৮. Origins of the Great Purges– The Soviet Communist Party Reconsidered Ñ J. Arch Getty, 1933-1938. New York 1985, p3.
৯. L. Trotsky. The Third InternationalAfter Lenin, New York, 1973.
.
ইউআরএল
১. http://www.geocities.com/redcomrades/mo-trial.html
২. http://www.mariosousa.se/LiesconcerningthehistoryoftheSoviet Union.html
৩. http://www.frontpagemag.com/fpm/169546/oliver-stones-untrue-history stalin-great-hero-matthew-vadum