৯. এই মহাবিশ্বে আমরা কি একা?

নবম অধ্যায় – এই মহাবিশ্বে আমরা কি একা? 

অন্তত আমি যতটুকু জানি, যদি আদৌ থেকে থাকে, মহাবিশ্বের অন্য কোথাও অর্থাৎ ভিনগ্রহে জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে খুব সামান্যই প্রাচীন পুরাণ আছে। হয়তো এর কারণ আমাদের নিজেদের পৃথিবীর চেয়ে মহাবিশ্ব যে অনেক বেশি বড় সেই ধারণাটি প্রচলিত হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে আর অন্য আরো গ্রহ আছে যারা একই কাজ করছে, সেটি স্পষ্টভাবে বুঝতে বিজ্ঞানীদের ষোড়শ শতাব্দী অবধি সময় লেগেছে, কিন্তু মহাশূন্যে মহাজাগতিক বস্তুগুলোর দূরত্ব ও নক্ষত্রের সংখ্যা, অন্য গ্যালাক্সি তো বহু দূরের কথা, অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ের আগে সম্পূর্ণ অজানা আর অকল্পনীয় একটি বিষয় ছিল। আর খুব বেশিদিনও হয়নি যে মানুষ প্রথম অনুধাবন করেছে, পৃথিবীর কোনো একটি জায়গায় যে দিকটিকে আমরা সরাসরি উপর বলি [যেমন ধরুণ, বোর্নিও], সেই জায়গাটি পৃথিবীর আরেকটি জায়গার সরাসরি নিচে [এই ক্ষেত্রে ব্রাজিল]। এর আগে মানুষ ভাবত ‘উপর’ সব দিকে সবসময়ই উপরে, সেই জায়গা বরাবর, যেখানে দেবতারা বাস করেন, আকাশের ‘উপরে। 

বহুদিন ধরেই অসংখ্য পুরাণ-কাহিনি আর বিশ্বাস আছে অদ্ভুত অচেনা প্রাণীদের নিয়ে যারা আমাদের ধারে কাছেই থাকে : দানব, আত্মা, জিন আর ভূত… এই তালিকা চলতে থাকবে, কিন্তু এই অধ্যায়ে যখন আমি বলেছি আমরা কি একা, আমি বোঝাতে চেয়েছি, মহাবিশ্বের অন্য কোথাও কি এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসী জীবন আছে? যেমনটি আমি বলেছি, আদিম গোত্রগুলোর মধ্যে এলিয়েনদের নিয়ে পুরাণ এই অর্থে খুব দুর্লভ। তবে আধুনিক শহরবাসীদের মধ্যে সেগুলোর প্রচলন খুব বেশি। এই ‘আধুনিক পুরাণগুলো আকর্ষণীয় কারণ, প্রাচীন পুরাণগুলোর তুলনায়, যখন সেগুলোর সূচনা হয় আমরা আসলেই সেটি লক্ষ করতে পারি। আমাদের চোখের সামনেই নানা পুরাণ কল্পিত হতে দেখি। সুতরাং এই অধ্যায়ে পুরাণ হবে আধুনিক। 

ক্যালিফোর্নিয়ায়, ১৯৯৭ সালের মার্চে, ‘হেভেনস গেট’ নামের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর করুণ পরিণতি ঘটেছিল, যখন এর ৩৯ জন সদস্য বিষপান করে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাঁরা আত্মহত্যা করেছিলেন কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন, মহাশূন্য থেকে একটি ইউএফও [UFO, আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট] এসে তাদের আত্মাগুলোকে অন্য জগতে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সেই সময়, অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের মার্চে, একটি উজ্জ্বল ধূমকেতু, হেল-বপ [Hale-Bopp], আকাশে খুবই উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান, আর এই গোষ্ঠীর সদস্যরা বিশ্বাস করেছিলেন, কারণ তাঁদের আধ্যাত্মিক গুরু সেটাই বলেছিলেন, এলিয়েন একটি মহাকাশযান এই ধূমকেতুর সাথে এর যাত্রাপথে সঙ্গী হিসেবে আছে। তাঁরা একটি টেলিস্কোপও কিনেছিলেন ভালোভাবে দেখার জন্য, কিন্তু যন্ত্রটি ‘কাজ করছে না’ এমন কারণ প্রদর্শন করে তাঁরা সেটি দোকানে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিভাবে তাঁরা জেনেছিলেন যে এটি কাজ করছে না? কারণ, এটি ব্যবহার করে তাঁরা কোনো মহাশূন্যযানকে দেখতে পাননি। 

এই গোষ্ঠীর নেতা, মার্শাল অ্যাপলহোয়াইট নামে পরিচিত একজন ব্যক্তি, আজগুবি এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করতেন, যা তিনি তাঁর শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন, কারণ যাঁরা বিষপান করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে এই বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি আন্তরিক ছিলেন! এই ব্যবসায় বহু গোষ্ঠী-নেতা আছেন, যাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাঁরা যেন তাঁদের মহিলা অনুসারীদের ভোগ-দখল করতে পারেন। তবে মার্শাল অ্যাপলহোয়াইট অল্প কিছু গোষ্ঠী-নেতারদের একজন, যাঁরা আগেই তাঁদের অণ্ডকোষ কেটে বাদ দিয়েছিলেন, সুতরাং তাঁর মনে যৌনতা সম্ভবত প্রধান বিষয় ছিল না। 

আরেকটি জিনিস সাধারণত যা এই মানুষগুলোর অধিকাংশের মধ্যেই দেখা যায়, সেটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির প্রতি তাঁদের বিশেষ ভালোবাসা। ‘হেভেনস গেট’-এর সব সদস্যই ‘স্টার ট্রেক’, সেই জনপ্ৰিয় টেলিভিশন ধারাবাহিকের বিশেষ অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন। অবশ্যই, ভিনগ্রহবাসী প্রাণীদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির কোনো কমতি নেই, কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষই এটি আসলেই কী সেটি ভালো করেই জানি : এগুলো হচ্ছে কল্পকাহিনি, কল্পনাপ্রসূত, আবিষ্কৃত গল্প, সত্যিকারভাবে ঘটেছে বা ঘটছে, এমন কোনো ঘটনার বিবরণ নয়, কিন্তু আসলেই বহু মানুষ আছেন যাঁরা দৃঢ় আর আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে, তাঁরা মহাশূন্য থেকে আসা ভিনগ্রহবাসী প্রাণীদের দ্বারা ব্যক্তিগতভাবে অপহরণের শিকার হয়েছেন। আর এমনকিছু বিশ্বাস করতে তাঁরা এত আগ্রহী যে, দুর্বলতম প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে হলেও তাঁরা সেটি বিশ্বাস করবেন। 

যেমন, একজন ব্যক্তি, যিনি বিশ্বাস করতেন যে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল, মাঝে মাঝে নাক দিয়ে রক্ত পড়া ছাড়া তাঁর এমন বিশ্বাসের ভিত্তিতে আর উত্তম কোনো কারণ ছিল না। তাঁর তত্ত্বটি ছিল, বিশেষভাবে নজর রাখতে ভিনগ্রহবাসীরা তাঁর নাকের মধ্যে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার বসিয়ে দিয়েছে। এমনকি ভাবতেন যে, তিনি নিজেও হয়তো আংশিকভাবে সেই একই ভিনগ্রহবাসী, কারণ তাঁর গায়ের রঙ তাঁর বাবা আর মায়ের তুলনায় খানিকটা ভিন্ন ছিল। বিস্ময়কর সংখ্যক আমেরিকাবাসী, যাঁরা অন্য সব ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক, আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে, তাঁদেরকে ফ্লাইং সসারে [ইউএফও] অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সেখানে তাঁদের ওপর ভয়ঙ্কর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পাদন করেছে ধূসর ছোট কিছু প্রাণীদের একটি দল, যাদের বিশাল মাথা আর মাথার চতুর্দিকে প্রায় পুরোটাই আবৃত করা সুবিশাল একজোড়া চোখ আছে। এলিয়েন অ্যাবডাকশন বা অপহরণ নিয়ে সম্পূর্ণ একটি পুরাণ-কাহিনি গড়ে উঠেছে। সেই পুরাণ যেমন সমৃদ্ধ, তেমনই বর্ণিল, প্রাচীন গ্রিক আর মাউন্ট অলিম্পাসের দেবতাদের মতোই জটিল এবং বহু শাখাপ্রশাখায় বিস্তারিত, কিন্তু এইসব ভিনগ্রহবাসীদের দ্বারা সংঘটিত অপহরণের পুরাণের সূচনাকাল বেশ সাম্প্রতিক এবং আসলেই আপনি এমন ব্যক্তিদের সাথে আলাপ করতে পারবেন, যাঁরা আসলেই বিশ্বাস করেন যে তাঁদের অপহরণ করা হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে স্পষ্টতই সাধারণ, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, যাঁরা আপনাকে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলতে পারবেন, ভিনগ্রহবাসী প্রাণীদের তাঁরা চাক্ষুষ দেখেছেন, এই ভিনগ্রহবাসীরা আসলেই কেমন দেখতে ছিল, এছাড়া কী কথা তারা বলছিল, যখন তাঁদের শরীরে সুঁই ঢুকিয়ে এই এলিয়েনগুলো যন্ত্রণাদায়ক সেই পরীক্ষাগুলো সম্পাদন করছিল [ভিনগ্রহবাসীরা অবশ্যই ইংরেজিতে কথা বলেন!]। 

সুসান ক্ল্যান্সি হচ্ছেন বেশকিছু মনোবিজ্ঞানীদের একজন, যিনি সেইসব মানুষদের ওপর বিস্তারিত গবেষণা করেছেন, যাঁরা দাবি করেন তাঁদের অপহরণ করা হয়েছে। তাঁদের সবারই সেই ঘটনাটির খুব স্পষ্ট কোনো স্মৃতি নেই অথবা কোনোই স্মৃতি নেই। এর ব্যাখ্যা হিসেবে তাঁরা বলেছেন যে তাঁদের স্মৃতি পরিষ্কার করে মুছে দিতে সেই ভিনগ্রহবাসীরা অবশ্যই কিছু অশুভ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল, যখন শরীর নিয়ে তাদের পরীক্ষা- নিরীক্ষা শেষ করেছিল। কখনো কখনো তারা সম্মোহন বিশেষজ্ঞ অথবা কোনো এক ধরনের সাইকোথেরাপিস্টদের কাছে যান, তাঁদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য যাঁরা তাঁদের সাহায্য করেন। 

‘হারিয়ে’ যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি পুরোটাই ভিন্ন এক কাহিনি, প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার, সেটি এর নিজস্ব অধিকারে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। যখন আমরা ভাবি, কোনো সত্যিকারের ঘটনাকে আমরা স্মরণ করছি, আমরা হয়তো শুধুমাত্র অন্য কোনো একটি স্মৃতিকে মনে করছি বা অন্য কোনো একটি, যা মূল ঘটনাটি না-ও হতে পারে আর হতেও পারে। স্মৃতির স্মৃতির স্মৃতি ক্রমশ বিকৃত হতে থাকে। খুব ভালো প্রমাণ আছে আমাদের কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি আসলে ‘মিথ্যা’ স্মৃতি এবং ‘মিথ্যা’ স্মৃতি পরিকল্পিতভাবে মনের মধ্যে গেঁথে দিতে পারেন কোনো অসৎ ‘থেরাপিস্ট’। 

‘ফলস মেমোরি সিনড্রোম’ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কেন নিদেনপক্ষে কিছু মানুষ যাঁরা ভাবেন, তাঁদের ভিনগ্রহবাসী প্রাণীরা অপরহণ করেছিল, সেই ঘটনার সুস্পষ্ট স্মৃতি আছে বলে তাঁরা দাবি করে থাকেন। যা সাধারণত ঘটে তা হচ্ছে কেউ অন্য কোনো কথিত অপহরণ সংক্রান্ত কাহিনি খবরের কাগজে পড়ে এলিয়েন সম্বন্ধে বিশেষভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। 

প্রায়শই, যেমন আমি আগে বলেছি, এইসব মানুষগুলো স্টার ট্রেক কিংবা অন্য কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির বিশেষ ভক্ত। বিস্ময়কর একটি বাস্তব তথ্য হল যে, এলিয়েনদের সাথে দেখা হয়েছে বলে যাঁরা ভাবেন, তাদের দেয়া সেই ভিনগ্রহবাসীদের চেহারার বিবরণ অনেকটাই সাম্প্রতিকতম কোনো টেলিভিশন কাহিনিতে প্রদর্শিত ভিনগ্রহবাসী সদৃশ্য এবং সেই প্রাণীরা সাধারণত এই ধরনের ‘পরীক্ষা’ করে, সাম্প্রতিক কোনো টিভি অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়েছে। 

পরবর্তী যে বিষয়টি হয়তো ঘটতে পারে সেটি হচ্ছে, এই ব্যক্তিটি ভীতিকর একটি অসুখে আক্রান্ত হতে পারেন, যাকে বলা হয় ‘স্লিপ প্যারালাইসিস’। এটি খুব দুর্লভ ঘটনা নয়। আপনি নিজেরও হয়তো একই রকম অভিজ্ঞতা থাকতে পারেন; আমি আশা করছি, সেটি খানিকটা কম ভীতিকর মনে হবে যদি আমি এখন আপনাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করি। সাধারণত আপনি যখন ঘুমান ও ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন, আপনার শরীর অসাড় হয়ে যায়, আমি মনে করি এর কারণ হচ্ছে, আপনার স্বপ্নের সাথে তাল মিলিয়ে এটি আপনার মাংসপেশিকে কোনো ধরনের কাজ করা থেকে বিরত রাখে, যা আপনাকে ঘুমের মধ্যে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে [যদিও, এটি অবশ্যই মাঝে মাঝে ঘটে]। আর সাধারণত যখন আপনি জেগে ওঠেন, স্বপ্নও অদৃশ্য হয়ে যায়, প্যারালাইসিসও চলে যায়, আপনি আপনার মাংসপেশিগুলো নাড়াতে পারেন। 

কিন্তু কখনো কখনো আপনার মনের সচেতন স্তরে পৌঁছানো আর আপনার মাংসপেশিতে আবার সাড়া ফিরে পাবার মধ্যে, একটা দীর্ঘ বিরতি থাকে, আর সেটাকেই বলে ‘স্লিপ প্যারালাইসিস’। এটি বেশ ভীতিকর, আপনি যেমন নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছেন পরিস্থিতিটি আসলেই কেমন হতে পারে। আপনি এক ধরনের ‘জেগে’ আছেন এবং আপনি আপনার শোবার ঘর ও সেখানে রাখা সবকিছুই দেখতে পারছেন, কিন্তু আপনি নড়াচড়া করতে পারছেন না। স্লিপ প্যরালাইসিসের সাথে প্রায়শই ভয়ঙ্কর হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রম হতে পারে। মানুষ মনে করে ভয়ঙ্কর বিপদ তাকে ঘিরে আছে, যার কোনো নাম তারা দিতে পারে না। কখনো তাঁরা এমনকিছু দেখেন, সেটি আসলে সেখানে নেই, ঠিক স্বপ্নে কোনোকিছু দেখার মতো এবং স্বপ্নের মতোই যে স্বপ্ন দেখছে তাদের কাছে এটি চূড়ান্তভাবে সত্য হিসেবে অনুভূত হতে পারে। 

এখন, আপনার যদি হ্যালুসিনেশনের কোনো অভিজ্ঞতা হয় যখন আপনি স্লিপ প্যারালাইসিসের শিকার হন, তখন সেই হ্যালুসিনেশনটি কেমন দেখতে হতে পারে? একজন আধুনিক কল্পকাহিনির ভক্ত হয়তো দেখতে পারেন ছোট ধূসর প্রাণীদের একটি দল, যাদের মাথা বড় ও বিশাল চোখ আছে। আগের শতাব্দীতে, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি আসার আগে, যে দৃশ্য মানুষ দেখতেন সেটি ছিল ভিন্ন : হবগ্লোবিন হয়তো, অথবা ওয়্যারউলভস, রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার অথবা [যদি তাঁরা খুব ভাগ্যবান হতেন] ডানাওয়ালা সুন্দর দেবদূতদের দেখতেন। 

বক্তব্যটি হচ্ছে যে ছবিগুলো কেউ দেখেন যখন তাঁরা স্লিপ প্যারালাইসিসের অভিজ্ঞতার শিকার হর, সেটি আসলে সত্যি সেখানে নেই, কিন্তু মনের মধ্যে অতীত ভয়ের অভিজ্ঞতা, কিংবা কোনো কিংবদন্তি অথবা লোক-কাহিনির প্রভাবে সেটি কল্পিত হয়। যদি তারা হ্যালুসিনেশন না-ও দেখে থাকেন, এই অভিজ্ঞতা এত ভীতিকর যে, যখন তাঁরা অবশেষে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন, স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায়শই তাঁদের সাথে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটেছে এমন ধারণায় বিশ্বাস করেন। আপনার যদি ভ্যাম্পায়ার কাহিনি বিশ্বাস করার প্রবণতা থাকে, তাহলে হয়তো ভ্যাম্পায়ার আক্রমণ করেছিল এমন একটি গভীর বিশ্বাস নিয়ে আপনি জেগে উঠতে পারেন। যদি ভিনগ্রহবাসী প্রাণীদের মানব- অপহরণের ঘটনা বিশ্বাস করায় আপনার প্রাকপ্রবণতা থাকে, আপনি হয়তো জেগে উঠতে পারেন এমন বিশ্বাস নিয়ে যে, ভিনগ্রহবাসী প্রাণীরাই আপনাকে অপহরণ করেছিল এবং তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হবার পর, তারা সেই বিশেষ ঘটনাটি সংক্রান্ত আপনার স্মৃতি মুছে দিয়েছে। 

সাধারণত স্লিপ প্যারালাইসিসের আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে এর পরে যা ঘটে সেটি হচ্ছে, যদিও তারা ভিনগ্রহবাসী কোনো প্রাণীকে হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রান্ত কল্পনার মাধ্যমে না-ও দেখে থাকেন এবং সেই সময়ে তাঁদের ওপর সংঘটিত কোনো ভয়ঙ্কর পরীক্ষার কথা না-ও মনে করতে পারেন, তাঁরা যা ঘটেছে বলে সন্দেহ করেছিলেন, সেটি নিয়ে তাঁদের আতঙ্কিত পুনঃনির্মাণ তাদের মিথ্যা স্মৃতিতে স্থায়ী একটি রূপ পেতে পারে। বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরা সাধারণত এই প্রক্রিয়াটিকে ঘটতে সহায়তা করেন। আরো বিস্তারিত বিবরণ শুনতে যাঁরা অতি আগ্রহের সাথে তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা অব্যাহত রাখেন, ইঙ্গিতবহ প্রশ্ন করে তাদের প্ররোচিত করেন যা সুনির্দিষ্ট উত্তরের দিকে তাদের নিয়ে যায়। সেখানে কি ভিনগ্রহবাসী প্রাণীরা ছিল? তাদের গায়ের রঙ কী ছিল? তাদের গায়ের চামড়া কি ধূসর রঙের? তাদের কি মাথার চারিদিকে বিস্তৃত বিশাল চোখ ছিল, সিনেমায় যেমন দেখানো হয়? কোনো মিথ্যা স্মৃতিকে তাঁদের মনের মধ্যে বপন বা স্থিতিশীল করার জন্য এইসব প্রশ্নই যথেষ্ট হতে পারে। আপনি যখন বিষয়টিকে এভাবে দেখেন, বিষয়টি খুব বিস্ময়কর মনে হবে না যে, ১৯৯২ সালের একটি জরিপ করা হয়েছিল, প্রায় চার মিলিয়ন আমেরিকাবাসীরা সেখানে বলেছেন, তাঁরা মনে করেন, ভিনগ্রহবাসী প্রাণীরা তাঁদের অপহরণ করেছিল! 

আমার বন্ধু মনোবিজ্ঞানী স্যু ব্ল্যাকমোর দেখিয়েছিলেন যে, ইতোপূর্বে ঘটেছে এমন কোনো আতঙ্ক কল্পনা করার ক্ষেত্রে ‘স্লিপ প্যারালাইসিস’ হচ্ছে খুব সম্ভাব্য একটি কারণ, ভিনগ্রহবাসীদের ধারণা জনপ্রিয় হবার আগেও এমনটি ঘটত। মধ্যযুগে যেমন দাবি করা হত, মধ্যরাতে ইনকিউবাস [পুরুষ-দৈত্য যারা তাদের নারী-শিকারদের কাছে আসত] অথবা সাককিউবাস [নারী-দৈত্য যে কিনা পুরুষ-শিকারদের কাছে আসত এসেছিল তাদের কাছে। স্লিপ প্যারালাইসিসের প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে যে যদি আপনি নড়াচড়া করার চেষ্টা করেন, মনে হতে পারে যেন কিছু আপনার শরীর জোর করে চেপে ধরে আছে। যৌননির্যাতন রূপে এটিকে খুব সহজে ব্যাখ্যা করতে পারে এমন কোনো ঘটনার আতঙ্কিত শিকার। নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের একটি পুরাণ আছে, ‘ওল্ড হ্যাগের’ গল্প, যে রাতের বেলা তার শিকারের কাছে গিয়ে তাদের বুকের উপর চাপ দিয়ে বসে। ইন্দোচীনে একটি পুরাণ আছে ‘গ্রে ঘোস্ট’, যে অন্ধকারে মানুষের কাছে আসে ও তাদের পক্ষপাতগ্রস্ত করে দেয়। 

সুতরাং আমাদের খুব ভালো বোঝাপড়া আছে কেন বহু মানুষ বিশ্বাস করেন যে তাঁদের ভিনগ্রহবাসী প্রাণীরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল এবং ভিনগ্রহবাসীদের দ্বারা অপহরণের এই আধুনিক পুরাণের সাথে আমরা যোগ করতে পারি আরো আগের পুরাণে, সেই লোভী ইনকিউবাস আর সাককিউবাস অথবা ভ্যাম্পায়াররা, যাদের দীর্ঘ ছেদকদাঁত আছে আর যারা রাতের বেলায় তাদের শিকারের কাছে এসে রক্ত চুষে খায়। এই গ্রহে মহাশূন্য থেকে কোনো ভিনগ্রহবাসী কখনো এসেছিল কিনা তার খুব ভালো কোনো প্রমাণ নেই [এবং সেই একই অর্থে কোনো ইনকুবাস, সাককিউবাস বা কোনো ধরনের দানবও নয়], কিন্তু তারপরও আমাদের কাছে সেই প্রশ্নটি রয়ে যায়, আসলেই কি অন্য গ্রহগুলোয় জীবনের অস্তিত্ব আছে? কখনোই তারা আমাদের সাথে দেখা করতে আসেনি তার মানে কিন্তু এই নয় যে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। একই পদ্ধতির বিবর্তন প্রক্রিয়া, অথবা ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়া, যার সাথে আমাদের বিবর্তনের খুব সামান্য মাত্রায় সদৃশ্যতা আছে, সেটি কি চলতে পারে আমাদের গ্রহের মতো অন্য কোনো গ্রহে? 

আসলেই কি জীবন আছে অন্য গ্রহগুলোয়? 

কেউ সেটি জানে না। যদি আপনি অবশ্যই এ বিষয়ে কোনো একটি মতামত দিতে আমাকে বাধ্য করান, আমি বলব, হ্যাঁ এবং সম্ভবত বহু মিলিয়ন গ্রহে সেটি আছে, কিন্তু কারো মতামতে কার কী এসে-যায়? সরাসরি কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। বিজ্ঞানের অন্যতম ভালো একটি গুণ হচ্ছে বিজ্ঞানীরা জানেন কখন তাঁরা কোনোকিছুর উত্তর জানেন না। তাঁরা আনন্দের সাথে তাঁদের অজ্ঞতাকে স্বীকার করে নেন। আনন্দের সাথে, কারণ উত্তর অজানা মানে সেটি খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা তাঁদের জন্যে উত্তেজনাপূর্ণ একটি চ্যালেঞ্জ। 

অন্য গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব আছে কিনা, হয়তো একদিন আমরা এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাব এবং তখন আমরা নিশ্চিতভাবে জানব, কিন্তু আপাতত, একজন বিজ্ঞানীর জন্যে সবচেয়ে ভালো যে কাজটি করা সম্ভব, সেটি হল সেই তথ্যগুলোকে লিপিবদ্ধ করা যা এই অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাকে খানিকটা হয়তো হ্রাস করতে পারে। যা হয়তো আমাদের অনুমান থেকে একটি সম্ভাবনার পরিমাপের দিকে নিয়ে যাবে এবং সেটাই, এককভাবে, কৌতূহলোদ্দীপক ও চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। 

প্রথম যে বিষয়টি হয়তো আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি সেটি হচ্ছে, এই মহাবিশ্বে গ্রহের সংখ্যা কত? খুব সাম্প্রতিক সময় অবধি, শুধুমাত্র আমাদের সূর্যের চারপাশে ঘোরা গ্রহগুলো ছাড়া আর কোনো গ্রহ নেই এমনকিছু বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল। কারণ সবচেয়ে বড় দূরবীক্ষণ যন্ত্ৰ ব্যবহার করেও গ্রহ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। ইদানীং আমাদের কাছে ভালো প্রমাণ আছে যে, আসলে বহু নক্ষত্রেরই গ্রহ আছে এবং বিজ্ঞানীরা প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন ‘এক্সট্রা-সোলার’ গ্রহগুলো আবিষ্কার করছেন। ‘এক্সট্রা-সোলার’ গ্রহ মানে যে গ্রহটি সূর্য নয় বরং অন্য কোনো একটি নক্ষত্র সিস্টেমের চারিদিকে ঘুরছে [Solar শব্দটি হচ্ছে সূর্যকে চিহ্নিতকারী ল্যাটিন শব্দ এবং Extra হচ্ছে ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ হচ্ছে বাইরে]। 

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন একটি গ্রহকে শনাক্ত করার সুস্পষ্ট উপায় হচ্ছে কোনো টেলিস্কোপ দিয়ে সেটি দেখা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গ্রহরা এতই ম্লান যে বহু দূর থেকে তাদের লক্ষ করা আদৌ সহজ কাজ নয়। কারণ তারা নিজেরা কোনো আলো ছড়ায় না, তারা তাদের নিকটবর্তী নক্ষত্রের আলো প্রতিফলিত করে। সুতরাং আমরা তাদের সরাসরি দেখতে পারি না। পরোক্ষ পদ্ধতির ওপর আমাদের ভরসা করতে হয় এবং সেই পদ্ধতিটি আবার স্পেকট্রোস্কোপ ব্যবহার করে। ইতোমধ্যে অধ্যায় আটে যে যন্ত্রটি সম্বন্ধে আমরা জেনেছি। আর সেই পদ্ধতিটি হচ্ছে এ-রকম : 

যখন কোনো মহাজাগতিক বস্তু মোটামুটিভাবে একই আকারের অন্য একটি মহাজাগতিক বস্তুর চারপাশে প্রদক্ষিণ করে, তারা পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে, কারণ তারা প্রায় একই পরিমাণ মহাকর্ষীয় বল পরস্পরের ওপর প্রয়োগ করে। যখন আকাশের দিকে আমরা তাকাই, বেশকিছু উজ্জ্বল নক্ষত্র আমরা দেখি, সেগুলো আসলে দুটি নক্ষত্রের একটি সিস্টেম, যাদের ‘বাইনারি’ নক্ষত্র বলা হয়; যেখানে নক্ষত্র দুটি পরস্পরের চারদিকে কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত, যেন একটি ডাম্বেলের দুটি প্রান্ত যুক্ত হয়ে আছে একটি অদৃশ্য দণ্ড দিয়ে। যখন কোনো একটি অন্যটির চেয়ে অনেক বেশি ছোট, যে-কোনো নক্ষত্র ও তার গ্রহ, তখন আকারে ছোট বস্তুটি বড় বস্তুটির চারপাশে প্রদক্ষিণ করে, আকারে বড়টিও সামান্য কিছু নড়াচড়া করে ছোট বস্তুর আরোপিত মহাকর্ষ বলের প্রতিক্রিয়ায়। আমরা বলি পৃথিবী সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে, কিন্তু আসলে সূর্য খুব সামান্য নড়াচড়া করছে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ টানের প্রতিক্রিয়ায়। 

এবং জুপিটারের মতো কোনো বিশাল গ্রহের এর নক্ষত্রের অবস্থানের ওপর যথেষ্ট প্রভাব থাকতে পারে। কোনো একটি নক্ষত্রের এই নড়াচড়ার পরিমাণ খুবই সামান্য যে এটি গ্রহের ‘চারপাশে ঘুরছে’ এমনকিছু বলা যাবে না, কিন্তু আমাদের যন্ত্রগুলো দিয়ে শনাক্ত করতে পারার জন্যে এই পরিমাণটি যথেষ্ট বড়, যখন আমরা কোনো গ্রহকে আদৌ চোখে দেখতে পারি না। 

আমরা এইসব অবস্থান পরিবর্তনগুলোকে কিভাবে শনাক্ত করি সেটি এর নিজের খাতিরে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। নক্ষত্রগুলো আসলে নড়ছে কিনা আমাদের পক্ষে সেটি দেখার জন্যে যে-কোনো নক্ষত্রের অবস্থানই আসলেই খুব দূরে, আর সেটি সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করেও আমরা দেখতে পারি না, কিন্তু অদ্ভুতভাবে, যদিও আমরা দেখতে পারব না কিভাবে একটি নক্ষত্র নড়াচড়া করছে, তবে আমরা এটি যে গতিতে নড়াচড়া করছে সেটি পরিমাপ করতে পারব। বেশ অদ্ভুত শোনাচ্ছে বিষয়টি, কারণ এখানে স্পেকট্রোস্কোপের একটি ব্যবহার জড়িত। অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত ডপলার শিফটের কথা মনে আছে? যখন নক্ষত্ররা অবস্থান পরিবর্তন করার সময় আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে, সেখান থেকে আসা আলো বর্ণালির লাল প্রান্তের দিকে সরে যায় বা রেড শিফট হয়। যখন তারারা আমাদের কাছাকাছি আসে তখন সেখান থেকে আসা আলো বর্ণালির নীল প্রান্তের দিকে সরে যায় বা ব্লু শিফট হবে। সুতরাং যদি কোনো নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণরত কোনো গ্ৰহ থাকে, তাহলে স্পেকট্রোস্কোপ আমাদের ছন্দময় স্পন্দিত লাল-নীল-লাল- নীল শিফট প্যাটার্ন দেখাবে। আর এই নিয়মিত শিফটগুলোর সময়কাল আমাদের বলবে সেই গ্রহটিতে একটি বছরের দৈর্ঘ্য কত। অবশ্যই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন একাধিক গ্রহ থাকে, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গণিতে দক্ষ, তাঁরা সেই জটিলতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এই লেখার সময় [মে ২০১২], ৭০১টি গ্রহ এই পদ্ধতিতে আবিষ্কার হয়েছে, যারা ৫৫৯টি নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে এবং আপনি যখন এই লেখা পড়বেন, নিশ্চিতভাবে সেই সময়ে এই সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। 

গ্রহ শনাক্ত করার জন্য অন্য কিছু পদ্ধতি আছে, যেমন—যখন কোনো একটি গ্রহ নক্ষত্রের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, নক্ষত্রের সামনের কিছুটা অংশ অস্পষ্ট হয়ে যায় অথবা ‘গ্রহণ’ হয়, যেমন—যখন আমরা চন্দ্রগ্রহণ হতে দেখি, শুধুমাত্র চাঁদকে দেখতে অনেক বেশি বড় মনে হয় কারণ এটি আমাদের [পৃথিবীর] অনেক কাছে অবস্থান করে। যখন কোনো একটি গ্রহ আমাদের ও এর নক্ষত্রের মাঝখানে অবস্থান করে তারাটি খুব সামান্য পরিমাণে ম্লান হয়ে যায় এবং এই ম্লান হয়ে যাবার প্রক্রিয়াটিকে শনাক্ত করার জন্য কখনো আমাদের যন্ত্রগুলো যথেষ্ট পরিমাণ সংবেদনশীল হয়। এ পর্যন্ত ২৩০টি গ্রহ এভাবে আমরা আবিষ্কার করতে পেরেছি। এছাড়াও আরো কিছু ভিন্ন পদ্ধতিও আছে, যার দ্বারা আমরা আরো ৬২টি গ্রহ আবিষ্কার করেছি। কিছু গ্রহ আবিষ্কার করা হয়েছে একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং বর্তমানে আমাদের জানা সর্বমোট ৭৬৩টি গ্রহ সূর্য ছড়া আমাদের গ্যালাক্সিতে অন্য তারাদের প্রদক্ষিণ করছে। 

আমাদের গ্যালাক্সিতে, অধিকাংশ নক্ষত্রের ক্ষেত্রে, যেখানেই আমরা গ্রহ খোঁজার চেষ্টা করেছি, দেখা গেছে তাদের গ্রহ আছে। সুতরাং, যদি ধরে নেই এটাই গ্যালাক্সির বৈশিষ্ট্যসূচক, আমরা সম্ভবত উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে, মহাবিশ্বের বেশিরভাগ নক্ষত্রদেরই গ্রহ আছে, যারা তাদেরকে প্রদক্ষিণ করছে। আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রায় ১০০ বিলিয়ন তারা আছে, মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংখ্যাও প্রায় একই রকম। এর মানে প্রায় ১০,০০০ বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। প্রায় ১০ শতাংশ তারা যাদের সম্বন্ধে আমরা জানি তাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন ‘সূর্যের মতো’ তারা হিসেবে। সেই তারাগুলো সূর্য থেকে খুব ভিন্ন, যদি তাদের গ্রহ থাকে, সেখানে জীবন-অস্তিত্ব টিকে থাকতে দেয়ার সম্ভাবনা খুব কম, ভিন্ন ভিন্ন কারণে : যেমন—নক্ষত্রগুলো সূর্যের চেয়ে আকারে অপেক্ষাকৃত বড়, তারা বেশিদিন টিকে থাকে পারে বিস্ফোরিত হবার আগে, কিন্তু যদি আমরা আমাদের সীমাবদ্ধ রাখি সেইসব গ্রহগুলোর ক্ষেত্রে, যারা সূর্যের মতো তাদের নিকটবর্তী কোনো নক্ষত্রের চারদিকে প্রদক্ষিণ করছে, তাহলেও আমাদের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহের হিসাব করতে হবে, এমনকি সেটাও পরিমাণে কম ধরা হবে। 

ঠিক আছে, কিন্তু ওই গ্রহগুলোর কয়টি ‘সঠিক’ ধরনের নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে জীবনের অস্তিত্ব প্রতিপালন করার জন্য যাদের সম্ভাবনা আছে? বেশিরভাগই এক্সট্রা-সোলার গ্রহগুলো যা আবিষ্কার করা হয়েছে, তারা জুপিটারের মতো। মানে তারা গ্যাসের দানব, মূলত তীব্র চাপে থাকা গ্যাস দিয়ে তৈরি। বিষয়টি বিস্ময়কর নয়, কারণ গ্রহ শনাক্ত করার জন্য আমাদের পদ্ধতিগুলো জুপিটারের চেয়ে আকারে ছোট গ্রহগুলো শনাক্ত করার জন্য তেমন সংবেদনশীল হয়ে ওঠেনি এখনো। আর জুপিটারগুলো, গ্যাসের দানব, কোনো জীবনের টিকে থাকার জন্যেও উপযুক্ত নয়, যা আমরা জানি। অবশ্যই, তার মানে এই নয় যে আমরা জীবন বলতে যা বোঝাই সেটাই একমাত্র সম্ভাব্য জীবন। জুপিটারেও জীবন থাকতে পারে, যদিও আমি সন্দেহ করছি। আমরা জানি না ঠিক কত শতাংশ সেই বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ পৃথিবীর মতো পাথরের গ্রহ, জুপিটারের মতো গ্যাস- দানব নয় এবং যদি সেই পরিমাণ খুব সামান্যও হয়েও থাকে, তাহলে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে কারণ সর্বমোট সংখ্যাটি সুবিশাল। 

গোল্ডিলকসের খোঁজে 

জীবন আমরা যেভাবে জানি সেটি পানির ওপর নির্ভরশীল। আবারও, জীবন বলতে আমরা যা জানি সেখানে মনোযোগ স্থির করে রাখার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কিন্তু আপাতত এক্সোবায়োলজিস্টরা [যে বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব অনুসন্ধান করেন] মনে করেন পানি আবশ্যিক। তাঁদের এই বিশ্বাস এতটাই যে মহাশূন্যে পানির অনুসন্ধান করার লক্ষ্যে তাঁরা তাঁদের প্রচেষ্টার বিশাল একটি অংশ নিবেদন করেছেন। জীবনের চেয়ে পানি খুব সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। যদি আমরা পানির অস্তিত্বের সন্ধান পাই, অবশ্যই নিশ্চিতভাবে এটি বোঝাচ্ছে না যে সেখানে জীবন থাকতেই হবে, কিন্তু এটি সঠিক দিক বরাবর একটি পদক্ষেপ। 

কারণ যে জীবন আমরা চিনি, সেটির অস্তিত্ব থাকতে হলে অন্ততপক্ষে কিছু পরিমাণ পানি অবশ্যই তরলাবস্থায় থাকতে হবে, বরফ হলে চলবে না, বাষ্পও হলেও হবে না। নিবিড়ভাবে মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করলে তরল পানির অস্তিত্বের প্রমাণ আমরা খুঁজে পাই, যদিও সেই প্রমাণগুলো বর্তমানে পানির অস্তিত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে না, তবে অতীতে সেখানে তরল পানি ছিল এমন একটি ধারণা দেয় এবং অন্য কয়েকটি গ্রহে অন্ততপক্ষে কিছু পরিমাণ পানি আছে, যদিও তা তরল রূপে নয়। ইউরোপা, জুপিটারের একটি উপগ্রহ, পুরোটাই বরফে ঢাকা এবং যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রস্তাব করা হয়েছে যে বরফের নিচে তরল পানির সাগর আছে। বিজ্ঞানীরা একসময় ভাবতেন যে আমাদের এই সৌরজগতের মধ্যে ভিনগ্রহবাসী প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনায় মঙ্গল গ্রহ হচ্ছে সবচেয়ে সেরা প্রার্থী এবং একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লওয়েল এঁকেছিলেন, যা তিনি দাবি করেছিলেন এর পৃষ্ঠ জুড়ে বিস্তৃত পানিপূর্ণ আঁকাবাঁকা খালের বিস্তৃত জাল। আমাদের পাঠানো মহাকাশযান মঙ্গলগ্রহের বিস্তারিত ছবি তুলেছে, এর পৃষ্ঠেও নেমেছে, দেখা গেছে সেই খালগুলো আসলে লওয়েলের কল্পনা মাত্র। এখন আমাদের সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহে সম্ভাব্য জীবনের অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নে ইউরোপা মঙ্গল গ্রহের জায়গা নিয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন আমাদের আরো দূরে অনুসন্ধান করতে হবে। প্রমাণ প্রস্তাব করছে যে সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোতেও পানি আসলে বিশেষভাবে দুর্লভ কোনোকিছু নয়। 

তাহলে তাপমাত্রার বিষয়টি কী? কোনো একটি গ্রহের তাপমাত্রাকে কতটা সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে, যদি সেটিকে জীবন-সহায়ক হতে হয়? বিজ্ঞানীরা তথাকথিত গোল্ডিলকস জোনের কথা বলেন : ঠিক যেটা ‘যথাযথ’ [শিশুতোষ গল্প ‘দ্য স্টোরি অব গোল্ডিলকস এবং থ্রি বিয়ারস’- এর শিশু ভালুকের পরিজের মতো], দুটি ভুল চূড়ান্ত প্রান্ত, খুব বেশি গরম [যেমন—ভালুক-পিতার পরিজ] এবং খুব বেশি ঠাণ্ডার [যেমন—মা-ভালুকের পরিজ] মাঝামাঝি। পৃথিবীর কক্ষপথ হচ্ছে ঠিক সে-রকম, 

জীবন-সহায়ক হবার জন্য যেমন হওয়া উচিত : খুব বেশি সূর্যের কাছাকাছি নয়, যেখানে পানি উত্তপ্ত হয়ে ফুটতে থাকবে আর সূর্য থেকে খুব বেশি দূরেও নয়, যেখানে সব পানি ঠাণ্ডায় জমে কঠিন হয়ে যাবে এবং উদ্ভিদদের খাদ্যের জন্যে সূর্যের আলোও যেখানে যথেষ্ট পরিমাণে থাকবে না। যদিও বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ আছে মহাবিশ্বে, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে খুব কমসংখ্যক গ্রহে জীবন-সহায়ক সেই পরিস্থিতি সঠিক মাত্রায় উপযোগী হতে পারে বলে আমরা আশা করতে পারি, যেগুলো তাদের সংশ্লিষ্ট নক্ষত্র থেকে সঠিক দূরত্বে অবস্থান করছে আর যেখানে সঠিক তাপমাত্রাও বিদ্যমান। 

সম্প্রতি [মে ২০১১] একটি ‘গোল্ডিলকস’ গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা গ্লিয়েসে ৫৮১ নামের একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে, আমাদের থেকে যা প্রায় ২০ আলোকবর্ষ দূরে [নক্ষত্রদের হিসাবে খুব বেশি দূরত্ব নয় এটি, কিন্তু মানুষের হিসাবে এই দূরত্ব অনেক বিশাল]। এই নক্ষত্রটি একটি ‘রেড ডোয়ার্ফ’ বা লোহিত বামন, সূর্যের চেয়ে যা অনেক ছোট, আর সে-কারণে এর গোল্ডিলক জোনও তুলনামূলকভাবে কাছে। এর [কমপক্ষে] ছয়টি গ্রহ আছে, যাদের নাম : গ্লিয়েসে ৫৮১ ই, বি, সি, জি, ডি আর এফ। তাদের কোনো কোনোটি পৃথিবীর মতো খুবই ছোট পাথুরে গ্রহ এবং তাদের একটি গ্লিয়েসে ৫৮১ডি, তরল পানি থাকতে পারে এমন গোল্ডিলকস জোনে অবস্থান করছে মনে করা হয়। যদিও এখনো জানা যায়নি যে, গ্লিয়েসে ৫৮১ডি-তে আসলেই পানি আছে কিনা, তবে যদি থাকে, সেটির বাষ্প বা বরফ রূপে নয় বরং তরল রূপে থাকার সম্ভাবনা আছে। কেউই প্রস্তাব করছে না যে গ্লিয়েসে ৫৮১ডি-তে আসলেই জীবনের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু বাস্তব তথ্য হচ্ছে আমরা খোঁজা শুরু করার পর খুব দ্রুত এর আবিষ্কার আমাদের ধারণা দিয়েছে, মহাবিশ্বে সম্ভবত বহু ‘গোল্ডিলকস’ গ্রহ আছে। 

একটি গ্রহের আকার কেমন হওয়া দরকার হতে পারে? কোনো ‘গোল্ডিলকস’ সাইজ কি আছে? খুব বেশি বড় নয় আবার খুব ছোটও নয়, বরং ঠিক যতটা দরকার ততটুকু? কোনো একটি গ্রহের আকার, খুব নির্দিষ্ট করে যদি বলি তাহলে এর ভর বা মাস—মাধ্যাকর্ষণের কারণে সেখানে থাকা জীবনের ওপর প্রভাব ফেলবে। পৃথিবীর মতো একই ব্যাসের কোনো গ্রহ, কিন্তু যেটি তৈরি পুরোপুরিভাবে ঘন স্বর্ণ দিয়ে, সেটির ভর পৃথিবীর ভরের চেয়ে তিনগুণ বেশি হবে। সেই গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীতে আমরা যতটা অভ্যস্ত তার চেয়ে তিনগুণ বেশি শক্তিশালী হবে। সবকিছুর ওজন তিনগুণ বেশি হবে, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সেই গ্রহের জীবন্ত শরীরও। একটি পা আরেকটি পায়ের সামনে বাড়ানোই খুব কঠিন পরিশ্রমের কাজ হবে। এমনকি ইঁদুরের সমান কোনো প্রাণীরও অনেক মোটা হাড় থাকতে হবে তার শরীরের ভার নেবার জন্য এবং এটিও ছোট আকারের কোনো গণ্ডারের মতো ধীরে হেলে দুলে চলতে হবে, আর গণ্ডারের মতো প্রাণীদের ক্ষেত্রে তাদের নিজের ওজনের চাপে শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। 

ঠিক যেমন সোনা লোহার চেয়ে ভারী, নিকেল ও অন্য যে পদার্থ দিয়ে পৃথিবী মূলত তৈরি, যেমন—কয়লা, অনেক হালকা। পৃথিবীর আকারের কোনো গ্রহ যা শুধু কয়লা দিয়ে তৈরি, তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টান আমরা যে পরিমাণ শক্তির টানের সাথে অভ্যস্থ তার এক-পঞ্চমাংশ হবে মাত্র। গণ্ডারের মতো কোনো প্রাণীর মাকড়শার মতো সরু পায়ের উপর ভর করে দৌড়ে বেড়াতে পারবে এবং সবচেয়ে বড় ডায়নোসরের চেয়ে বড় প্ৰাণীও আনন্দের সাথে বিবর্তিত হতে পারে, যদি সেই গ্রহে অন্য শর্তাবলিগুলো সঠিক মাত্রায় থাকে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বল পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ। সে-কারণে নভোচারীরা অদ্ভুতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন, তাঁদের বিশাল স্পেসস্যুটের কারণে যা দেখতে হাস্যকরই অনুভূত হয়। একটি প্রাণী যারা আসলেই একটি গ্রহে বিবর্তিত হয় যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি খুবই দুর্বল, সেটি আসলেই খুব ভিন্নভাবে তৈরি হবে, প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়টি তদারকি করে নিশ্চিত করবে। 

যদি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টান খুব শক্তিশালী হয়, যেমনটা হবে কোনো একটি নিউট্রন নক্ষত্রে, সেখানে কোনো জীবন থাকার কথা নয়। একটি নিউট্রন নক্ষত্র এক ধরনের ধসে পড়া নক্ষত্র। যেমনটি আমরা শিখেছিলাম অধ্যায় চারে, কোনো পদার্থ মূলত প্রায় পুরোটাই তৈরি শূন্যস্থান দিয়ে। দুটি পারমানবিক নিউক্লিয়াসের মধ্যে দূরত্ব হবে বিশাল যদি নিউক্লিয়াসগুলোর আকারের সাথে তুলনা করা হয়, কিন্তু একটি নিউট্রন নক্ষত্র ধসে পড়ছে মানে এর সব শূন্যস্থানগুলো অপসারিত হয়েছে। একটি নিউট্রন নক্ষত্রের ভর হতে পারে সূর্যের মতো, কিন্তু এর আকার হতে পারে কোনো একটি শহরের মতো, সুতরাং এর মহাকর্ষীয় টান ভয়ঙ্করভাবে শক্তিশালী। আপনি যদি কোনো নিউট্রন তারার উপর নামেন, পৃথিবীতে আপনার যা ওজন ছিল তারচেয়ে প্রায় শত বিলিয়ন গুণ ওজন বেশি হবে। আপনি পুরোপুরিভাবে চ্যাপ্টা হয়ে যাবেন। আপনি নড়তেও পারবেন না। কোনো একটি গ্রহের শুধুমাত্র একটি নিউট্রন তারার যতটা মাধ্যাকর্ষণীয় টান তার খুব সামান্যতম অংশ দরকার এটিকে গোল্ডিলকস জোনের বাইরে রাখার জন্যে—শুধুমাত্র যে জীবন আমরা জানি সেটির জন্য নয়, বরং আমাদের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব এমন জীবনের জন্যেও। 

তোমাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করি 

যদি অন্য কোনো গ্রহে জীবন্ত প্রাণীর অস্তিত্ব থেকে থাকে, তারা কেমন দেখতে হতে পারে? সর্বব্যাপী একটি অনুভূতি আছে যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিকাররা খানিকটা অলস আর সে-কারণে তাঁরা তাঁদের মানুষের মতোই কল্পনা করে থাকেন, শুধুমাত্র সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া- অপেক্ষাকৃত বড় মাথা অথবা অতিরিক্ত চোখ অথবা ডানাসহ কিছু। যখন তারা হিউমানয়েড, সব কাল্পনিক এলিয়েনই স্পষ্টতই পরিচিত প্রাণীদের রূপান্তরিত সংস্করণ, যেমন—মাকড়শা, অক্টোপাস অথবা মাশরুম, কিন্তু হয়তো এটি শুধু অলসতা নয় বা কল্পনাশক্তির অভাব নয়, হয়তো সত্যি কোনো ভালো কারণ আছে এমনকিছু মনে করার যে, এলিয়েনরা, যদি কোথাও থেকে থাকে [আমি মনে করি সম্ভবত তারা আছে], তারা হয়তো আমাদের কাছে খুব অপরিচিত দেখতে মনে হবে না। গল্পের এলিয়েনদের সেই প্রবাদতুল্য চেহারাসহ বর্ণনা করা হয়, যেমন—পোকার মতো চোখযুক্ত দানব, সুতরাং আমি আমার উদাহরণ হিসেবে চোখকে বেছে নিলাম। আমি পা কিংবা ডানা বা কান নিতে পারতাম [অথবা ভাবতাম কেন প্রাণীদের কোনো চাকা থাকে না], কিন্তু আমি চোখেই সীমাবদ্ধ থাকব এবং দেখাতে চেষ্টা করব আসলেই বিষয়টি অলসতার নয় এমন ভাবা যে এলিয়েনরা, যদি কোথাও থেকে থাকে, তাদের চোখ থাকার খুব ভালো সম্ভাবনা আছে। 

চোখ খুব উপকারী একটি অঙ্গ, যার উপস্থিতি কার্যকরী এবং বিষয়টি বেশিরভাগ গ্রহেই সত্য হবে। আলো ভ্রমণ করে, ব্যবহারিক কারণে, সরলরেখায়। যেখানে আলো থাকবে, যেমন কোনো নক্ষত্রের কাছাকাছি, কারিগরিভাবে বিষয়টি সহজ যে আপনি পথ খুঁজবার জন্য, চলাচলের জন্য, কোনোকিছু খুঁজবার জন্য আলো ব্যবহার করবেন। যে-কোনো গ্রহে, যেখানে জীবন আছে সেটিকে অবশ্যই কোনো নক্ষত্রের কাছাকাছি থাকতে হবে, কারণ নক্ষত্র হচ্ছে শক্তির সুস্পষ্ট একটি উৎস যা সব জীবনের দরকার। সুতরাং সম্ভাবনা খুব ভালো যে আলোর উপস্থিতি থাকবে যেখানেই জীবনেরও উপস্থিতি থাকবে। আর যখন আলোর উপস্থিতি থাকবে, খুবই সম্ভাবনা আছে যে চোখেরও বিবর্তন হবে কারণ তারা খুবই উপযোগী অঙ্গ। সুতরাং বিস্ময়ের কিছু নেই যে আমাদের গ্রহে চোখের বিবর্তন স্বতন্ত্রভাবেই ঘটেছে ডজনখানেক সময়। 

চোখ বানাবার জন্য শুধুমাত্র বেশ কতগুলো উপায় আছে আর আমি মনে করি তাদের প্রত্যেকটি বিবর্তিত হয়েছিল আমাদের প্রাণীজগতে। যেমন—ক্যামেরা আই, যা ক্যামেরার মতোই, অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠ যার সামনে একটি ছিদ্র আছে আলো প্রবেশ করার জন্য, একটি লেন্সের মধ্য দিয়ে, যা একটি উল্টো ছবি তৈরি করে পেছনের একটি পর্দা বা রেটিনার উপর। কোনো লেন্সেরও প্রয়োজন নেই শুধুমাত্র একটি ছিদ্রই কাজটি করতে পারবে যদি এটি যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষুদ্র হয়। যার মানে খুব কম পরিমাণ আলো সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারে, সুতরাং সেই ছবিটি খুব অস্পষ্ট হয়, যদি-না গ্রহটি তার তারা থেকে অনেক বেশি আলো পায়, আমরা সূর্য থেকে যতটা পাই তার চেয়েও বেশি। অবশ্যই এটি সম্ভব, সেই ক্ষেত্রে এলিয়েনদের আসলেই পিনহোল চোখ থাকার কথা। মানুষের চোখে একটি লেন্স আছে, রেটিনার উপর বেশি পরিমাণ আলো ফোকাস করে ফেলার জন্য। পেছনের রেটিনায় কার্পেটের মতো বিছানো আছে কোষ দিয়ে, যারা আলোকসংবেদী এবং আমাদের মস্তিষ্কে সেই তথ্যটি জানান দেয় অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে। সব মেরুদণ্ডী প্রাণীদের এই ধরনের চোখ আছে এবং ক্যামেরা-চোখও স্বতন্ত্রভাবে বিবর্তিত হয়েছিল বহু ভিন্ন ধরনের প্রাণীদের মধ্যে, যার মধ্যে আছে অক্টোপাসরাও এবং অবশ্যই মানুষ ডিজাইনারও সেটি আবিষ্কার করেছিল। 

জাম্পিং স্পাইডারদের অদ্ভুত ধরনের স্ক্যানিং চোখ থাকে। এটাও কোনো একটি ক্যামেরা-চোখের মতোই শুধুমাত্র চওড়া আলোকসংবেদী কোষের একটি কার্পেটের বদলে এই ধরনের চোখে সরু এক ফালি আলোকসংবেদী কোষের স্তর থাকে। এই পাতলা ফালির মতো রেটিনার সাথে যুক্ত থাকে মাংসপেশি, যা এটিকে নড়াচড়া করতে পারে সুতরাং মাকড়শা চোখের সামনে পুরো দৃশ্যটিকে স্ক্যান করতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটি অনেকটা সে-রকমভাবেই কাজ করে, যেমন করে টেলিভিশন-ক্যামেরা কাজ করে, কিন্তু টেলিভিশন-ক্যামেরা যেহেতু একটিমাত্র চ্যানেল থাকে পুরো একটি দৃশ্যকে ধারণ করে প্রেরণ করার জন্যে। আর এটি আনুভূমিক ও উল্লম্বভাবে স্ক্যান করে, কিন্তু কাজটি এত দ্রুত করে যে ক্যামেরা যে ছবি গ্রহণ করে, সেটি দেখতে একটিমাত্র ছবি বলেই মনে হয়, কিন্তু টেলিভিশন-ক্যামেরার মতো জাম্পিং মাকড়শার চোখ কিন্তু এত দ্রুত স্ক্যান করতে পারে না, সেগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গার উপর মনোযোগ দেয়, যেমন মাছি, কিন্তু মূল নীতি একই। 

তারপর আছে যৌগিক চোখ, যা কীটপতঙ্গ, চিংড়ি ও নানা ধরনের প্রাণী- গ্রুপের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। একটি যৌগিক চোখ মূলত শত শত টিউব দিয়ে তৈরি হয়, একটি অর্ধগোলকের কেন্দ্র থেকে এটি বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকে, প্রতিটি টিউবই খানিকটা ভিন্ন দিক বরাবর দেখছে। প্রতিটি টিউবের প্রান্ত ঢাকা আছে একটি ছোট লেন্স দিয়ে, সুতরাং আপনি হয়তো এটিকে একটি মিনিয়েচার চোখ হিসেবে ভাবতে পারেন, কিন্তু লেন্স কোনো ব্যবহারযোগ্য ইমেজ তৈরি করে না : এটি শুধু আলোকে ঘনীভূত করে টিউবের মধ্যে। কারণ প্রতিটি টিউব ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে আসা আলো গ্রহণ করে এবং মস্তিষ্ক সেই তথ্যগুলোকে সংযুক্ত করে একটি দৃশ্য পুনঃনির্মাণ করে। যদিও খানিকটা স্থূল ছবি, কিন্তু ড্রাগন ফ্লাইদের জন্য যা যথেষ্ট ভালো, যেমন সেটি তাদের উড়তে থাকা কোনো শিকার ধরতে সাহায্য করে। 

আমাদের সবচেয়ে বড় দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলো একটি বাঁকা আয়না ব্যবহার করে লেন্সের পরিবর্তে, আর প্রাণীদের চোখে এই মূলনীতিটাও ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে স্ক্যালোপদের ক্ষেত্রে। স্ক্যালোপদের চোখ একটি বাঁকা আয়না ব্যবহার করে রেটিনার উপর কোনো ছবিকে ফোকাস করার জন্য যার অবস্থান আয়নাটির সামনে। যা স্পষ্টতই আলো ঢোকার পথে খানিকটা প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করে, একইভাবে যা ঘটে সমরূপী কোনো রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপে, কিন্তু এটি বেশি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না কারণ বেশিরভাগ আলোই আয়না পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। 

চোখ কিভাবে তৈরি হতে পারে বিজ্ঞানীদের সেটি কল্পনা করার তালিকা মোটামুটি এটাই নিঃশেষ করে দিয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকটি এই গ্রহের প্রাণীদের মধ্যে বিবর্তিত হয়েছে, অধিকাংশই একাধিক বার বিবর্তিত হয়েছে। সুতরাং এটি ভালো একটি বাজি যে, যদি অন্য কোনো গ্রহে জীব থাকে তারা দেখতেও পারে, তারা এক ধরনের চোখ ব্যবহার করবে যা আমাদের কাছে পরিচিত মনে হতে পারে। আসুন, আমাদের কল্পনাশক্তির আরো খানিকটা ব্যবহার করি। আমাদের হাইপোথেটিকাল এলিয়েনদের গ্রহে, তাদের তারা থেকে বিচ্ছুরিত শক্তি সম্ভবত বর্ণালির দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রান্তের রেডিওতরঙ্গ থেকে বিপরীত প্রান্তে এক্স-রে অবধি বিস্তৃত। কেন তাহলে এলিয়েনরা শুধুমাত্র সংকীর্ণ একটি ব্যান্ডের কম্পাঙ্কে নিজের সীমাবদ্ধ রাখবে, যাকে আমরা ‘আলো’ বলি? হয়তো, তাদের রেডিও-চোখ আছে? অথবা এক্স-রে চোখ? 

একটি ভালো ইমেজ বা ছবি নির্ভর করে উচ্চ রেজোল্যুশন বা দুটি বিন্দুকে বিভক্তিকরণ করায় এর শক্তির ওপর। কিন্ত তার অর্থ কী? যত বেশি রেজোল্যুশন হবে, ততই দুটি বিন্দু পরস্পরের নিকটবর্তী হতে পারে কিন্তু তাদের তারপরও পরস্পর থেকে পৃথক করা যেতে পারে। বিস্ময়কর নয়, লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব ভালো রেজোল্যুশন তৈরি করে না। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিমাপ করা হয় এক মিলিমিটারের খুব সূক্ষ্মতম ভগ্নাংশে এবং যা খুবই ভালো রেজোল্যুশন তৈরি করে, কিন্তু রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিমাপ করা হয় মিটারে। সুতরাং ছবি তৈরি করার জন্য রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব বেশি ভালো নয়, যদিও যোগাযোগের বাহন হিসেবে এটি খুব ভালো কারণ তাদের মড্যুলেট বা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। মড্যুলেট মানে খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রিত একটি উপায়ে পরিবর্তন করা। যতদূর আমরা জানি, আমাদের এই গ্রহে কোনো জীবন্ত প্রাণী সেই প্রাকৃতিক পদ্ধতিটি বিবর্তিত করেনি যার মাধ্যমে সে বেতারতরঙ্গ প্রচার, মড্যুলেট বা নিয়ন্ত্রণ ও শনাক্ত করতে পারে, কিন্তু হয়তো অন্য কোনো গ্রহে এলিয়েনরা আছে যারা প্রাকৃতিকভাবে বেতার যোগাযোগ করার ক্ষমতা বিবর্তিত করেছে। 

আলোর তরঙ্গের চেয়ে কম দৈর্ঘ্যের তরঙ্গগুলো তাহলে কী করতে পারে, যেমন—এক্স-রে? এক্স-রে ফোকাস করা খুব কঠিন, আর সেই কারণে সত্যিকারের ছবি তৈরি করার বদলে এক্স-রে মেশিনগুলো ছায়া তৈরি করে, কিন্তু অসম্ভব নয় অন্য কোনো গ্রহে হয়তো এমন কোনো জীবন আছে যাদের এক্স-রে-দৃষ্টি আছে। 

যে-কোনো ধরনের দৃষ্টিক্ষমতা, আলোকরশ্মির সরলরেখায় অথবা কমপক্ষে পূর্বধারণা করা সক্ষম এমন রেখায় ভ্রমণ করার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং যদি তারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন কোনো কুয়াশার মধ্যে যা ঘটে, তাহলে সেটি দেখার জন্য খুব কাজে আসবে না। একটি গ্রহ যা কিনা চিরস্থায়ীভাবে ঘন কুয়াশায় আবৃত সেটি চোখের বিবর্তন উৎসাহিত করবে না। বরং এর বদলে, এটি হয়তো সহায়তা করবে কোনো এক ধরনের প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে দিক-নির্দেশনা বিবর্তন করতে; যেমন—বাদুড়, ডলফিন আর মানুষের বানানো ডুবোজাহাজগুলো ‘সোনার’ [সাউন্ড নেভিগেশন অ্যান্ড রেঞ্জিং] ব্যবহার করে। নদীর ডলফিনগুলো তাদের ‘সোনার’ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে খুবই দক্ষ, কারণ নদীর পানি বেশ ঘোলাটে, পানির ক্ষেত্রে সেটি ঘন কুয়াশার সমতুল্য একটি পরিস্থিতি। আমাদের গ্রহে প্রাণীদের মধ্যে ‘সোনার’ বিবর্তিত হয়েছে কমপেক্ষে চারবার [বাদুড়, তিমি, দুটি পৃথক গুহাবাসী পাখি]। সুতরাং খুব বিস্ময়কর হবে না যদি আমরা ভিনগ্রহে ‘সোনার’ বিবর্তিত হতে দেখি, বিশেষ করে স্থায়ীভাবে যেটি কুয়াশাচ্ছন্ন। 

অথবা, যদি এলিয়েনরা এমন কোনো অঙ্গ বিবর্তন করে যা কিনা যোগাযোগের জন্যে বেতারতরঙ্গ ব্যবহার করতে পারে, তারা হয়তো সত্যি রাডার বিবর্তিত করতে পারে তাদের পথচলার জন্য এবং রাডার কুয়াশার মধ্যেও কাজ করে। আমাদের গ্রহে এমন একটি মাছ আছে যারা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের তারতম্য ব্যবহার করে তাদের পথ খুঁজে নেয়, যে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তারা নিজেরাই তৈরি করে। বাস্তবিকভাবেই, এই কৌশলটি বিবর্তিত হয়েছে দুইবার স্বতন্ত্রভাবে, আফ্রিকার এক ধরনের মাছ এবং সম্পুর্ণ ভিন্ন আরেক গ্রুপ দক্ষিণ আমেরিকার মাছের মধ্যে। ডাক-বিলড প্লাটিপাসদের ঠোঁটেও বিদ্যুৎ শনাক্ত করার জন্য সংবেদী অঙ্গ আছে, যা পানির মধ্যে বৈদ্যুতিক তারতম্য শনাক্ত করে, যে তারতম্য সৃষ্টির কারণ তাদের শিকারদের মাংসপেশি সংকোচন-প্রসারণ। সহজ কল্পনা করা যে একটি এলিয়েন জীবন যা মাছ এবং প্লাটিপাসের মতো বৈদ্যুতিক তারতম্য শনাক্ত করার ক্ষমতা বিবর্তিত করেছে, কিন্তু আরো বেশি অগ্রসর একটি পর্যায় অবধি। 

এই অধ্যায়টি বরং খানিকটা ভিন্ন এই বইয়ের অধ্যায়গুলো থেকে কারণ এটি আলোচনায় আমরা যা জানি তার চেয়ে বেশি আমরা কী জানি না সেই বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছে, কিন্তু তারপর যদিও আমরা এখনো অন্য কোনো গ্রহে জীবন আবিষ্কার করতে পারিনি [এবং সত্যি, হয়তো কখনো সেটি না-ও করতে পারি], আমি আশা করি বিজ্ঞান আমাদের মহাবিশ্ব সম্বন্ধে কতটুকু বলতে পারে তা আপনারা অনুধাবন করেছেন ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অন্য কোথায় আমাদের জীবনের উপস্থিতি অনুসন্ধান কখনোই পরিকল্পনাহীন এলোমেলো প্রক্রিয়া নয়। বহু দূরের তারা আর গ্রহ সম্বন্ধে অর্থপূর্ণ তথ্য অনুসন্ধান এবং অন্ততপক্ষে জীবনের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা আছে এমন গ্রহগুলোকে আবিষ্কার করতে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর জীববিজ্ঞানের জ্ঞান আমাদের সহায়তা করে। বহু কিছু এখনো জানা বাকি আছে যা গভীরভাবে রহস্যময় এবং আমরা আমাদের মহাবিশ্বের মতো এমন একটি বিশাল মহাবিশ্বের সব গোপন রহস্য উন্মোচন করতে পারব সেই সম্ভাবনাও খুব কম, কিন্তু বিজ্ঞানের শক্তিতে সশস্ত্র হয়ে, আমরা অন্তত এর সম্বন্ধে বোধগম্য যুক্তিসঙ্গত অৰ্থপূৰ্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি এবং বিশ্বাসযোগ্য উত্তরগুলো আমরা শনাক্ত করতে পারব যখন আমরা সেগুলো খুঁজে পাব। খুব বেশি মাত্রায় অসম্ভাব্য কোনো গল্প আবিষ্কার করার দরকার নেই : সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আর আবিষ্কারের আনন্দ আর উত্তেজনা আছে আমাদের কল্পনার লাগাম ধরে রাখার জন্য এবং পরিশেষে দেখা যায় এটি কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজনাময়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *