৯. উপসংহার
কী হবে সামনের পদক্ষেপ? সংক্ষিপ্ত এই ইতিহাস স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে বাইবেল সম্পর্কে বহু আধুনিক অনুমান ভ্রান্ত। বাইবেল দাসত্বমূলক সমরূপতা উৎসাহিত করেনি। বিশেষ করে ইহুহি ট্র্যাডিশনে, আর. এলিয়েযারের গল্পের ক্ষেত্রে যেমন দেখেছি আমরা। এমনকি ঈশ্বরের কণ্ঠস্বরও একজন ব্যাখ্যাকারকে অন্যের ব্যাখ্যা মেনে নিতে বাধ্য করতে পারেনি। প্রথম থেকেই বাইবেলিয় লেখকগণ পরস্পরের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্ত টেক্সটের সম্পাদকগণ সংযুক্ত করেছেন। তালমুদ ছিল একটি মিথষ্ক্রিয়ামূলক টেক্সট, সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হলে একজন ছাত্রকে তা নিজস্ব উত্তর খুঁজে পেতে বাধ্য করত। হান্স ফ্রেই ঠিকই বলেছেন: বাইবেল ছিল বিদ্রোহী দলিল, আমোস ও হোসিয়ার আমল থেকেই অর্থডক্সিকে সন্দেহের চোখে দেখেছে।
নীতি ও সিদ্ধান্তকে বৈধ করার লক্ষ্যে প্রুফ টেক্সট উদ্ধৃত করার আধুনিক অভ্যাস ব্যাখ্যামূলক ঐতিহ্যর পরিপন্থী। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, ঐশীগ্রন্থসমূহ আসলে কোনও টেক্সট নয়, এগুলো কর্মকাণ্ড, এক আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া যা হাজার হাজার লোককে দুয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বাইবেলকে বিভিন্ন মতবাদ ও বিশ্বাসের পক্ষে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তবে এটা এর প্রধান কাজ নয়। আক্ষরিক অর্থের উপর মৌলবাদীদের জোর আধুনিক চেতনা তুলে ধরে, কিন্তু এটা ট্র্যাডিশনের লঙ্ঘন, যা সাধারণত কোনও কোনও সংখ্যাতাত্ত্বিক বা তথ্যমূলক ব্যাখ্যা পছন্দ করে। উদাহরণ স্বরূপ, বাইবেলে কোনও একক সৃষ্টিতত্ত্ব নেই, জেনেসিসের প্রথম অধ্যায় বিরল ক্ষেত্রে বিশ্বসৃষ্টির বাস্তব বর্ণনা হিসাবে পাঠ করা হয়ে থাকে। ডারউইনবাদের বিরোধী অনেক ক্রিশ্চানই আজ কালভিনিস্ট, কিন্তু কালভিন জোর দিয়ে বলেছিলেন যে বাইবেল বৈজ্ঞানিক দলিল নয়, যার জ্যোতির্বিজ্ঞান বা সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে শিখতে চায় তাদের অন্যত্র সন্ধান করা উচিত।
আমরা দেখেছি, বিভিন্ন টেক্সট সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী কর্মসূচি সমর্থনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আথানাসিয়াস ও আরিয়াস ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতা সম্পর্কে তাঁদের বিশ্বাস প্রমাণ করতে উদ্ধৃতি বের করতে পারতেন। এই বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো কোনও সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা না পাওয়ায় ফাদাররা ধর্মতাত্ত্বিক সমাধান সন্ধান করেছেন যার সাথে বাইবেলের মিল সামান্যই। দাস মালিকরা একভাবে বাইবেল ব্যাখ্যা করেছে, দাসরা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। নারীদের পুরোহিত পেশায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে এখন যে বিতর্ক চলছে তার বেলায়ও একই কথা খাটে। সকল আদি প্রাক-আধুনিক দলিলের মতো বাইবেল একটি পুরুষতান্ত্রিক টেক্সট। নারীবাদও নারী পৌরহিত্যের বিরোধীরা তাদের যুক্তি প্রমাণের লক্ষ্যে অসংখ্য বাইবেলিয় টেক্সট খুঁজে বের করতে পারবে, কিন্তু নিউ টেস্টামেন্টের কোনও কোনও লেখকের সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ক্রাইস্টে নারী বা পুরুষ কিছুই ছিল না প্রমাণ করার মতো উদ্ধৃতিও দেওয়া যাবে এবং দেখানো যাবে যে নারীরা ‘সহকর্মী’ ও ‘সহ- সহচর’ হিসাবে আদি চার্চে কাজ করেছেন। যুক্তি হিসাবে টেক্সট ছোঁড়াছুঁড়ি একটি অর্থহীন কাজ। ঐশীগ্রন্থ এই ধরনের প্রশ্নের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা যোগাতে পারে না।
ঐশীগ্রন্থীয় সহিংসতার বেলায়ও একই কথা। বাইবেলে সত্যিই বহু সহিংসতার ঘটনা রয়েছে-কুর’আনের চেয়ে ঢের বেশি। এবং সন্দেহাতীতভাবে সত্যি যে, গোটা ইতিহাস জুড়ে মানুষ নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডকে ন্যায্য প্রমাণ করতে বাইবেল ব্যবহার করেছে। ক্যান্টওয়েল স্মিথ যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন, বাইবেল ও এর ব্যাখ্যাসমূহকে অবশ্যই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। পৃথিবী বরাবরই সহিংস স্থান ছিল, ঐশীগ্রন্থ ও এর ব্যাখ্যা প্রায়শই সমসাময়িক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। ডিউটেরোনমিস্টদের তুলে ধরা জোশুয়া একজন অসিরিয় জেনারেলের মহাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ক্রুসেডাররা জেসাসের শান্তিবাদী শিক্ষা বিস্মৃত হয়ে পবিত্র ভূমিতে অভিযানের জন্যে চুক্তিতে নিয়োজিত হয়েছে, কারণ তারা ছিল সৈনিক, একটা উগ্র ধর্ম পেতে চেয়েছে এবং তাদের সম্পূর্ণ সামন্ত রেওয়াজ বাইবেলের প্রয়োগ করেছে। আমাদের নিজস্ব কালেও একথা সত্যি। আধুনিক কাল এক নজীরবিহীন মাত্রায় সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছে; এটা বিস্ময়কর নয় যে, কোনও কোনও মানুষের বাইবেল পাঠের ধারাকে তা প্রভাবিত করেছে।
কিন্তু ঐশীগ্রন্থ যেহেতু এমনি যাচ্ছেতাইভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে, সুতরাং ইহুদি, মুসলিম ও ক্রিশ্চানদের দায়িত্ব রয়েছে একটা পাল্টা বয়ান প্রতিষ্ঠা করা যা তাদের ব্যাখ্যামূলক ঐতিহ্যের উদার বৈশিষ্ট্যগুলোকে গুরুত্ব দেবে। আন্তধর্ম সমঝোতা ও সহযোগিতা এখন আমাদের টিকে থাকার পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছে: তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের সদস্যদের সম্ভবত একটি সাধারণ হারমেনেউটিক্স গড়ে তুলতে একসাথে কাজ করা উচিত। এটা খোদ সমস্যাসঙ্কুল টেক্সসমূহের স্থিতিশীল সমালোচনামূলক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নিরীক্ষা ধারণ করবে, যেভাবে ইতিহাস জুড়ে এগুলোকে ব্যাখ্যা করে আসা হয়েছে, এবং সেইসব লোকের ব্যাখ্যার গভীর পরীক্ষা যারা আজ সেগুলোকে ব্যবহার করছে। ট্র্যাডিশনে তাদের সামগ্রিক গুরুত্বও স্পষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।
মাইকেল ফিশবেন-এর পরামর্শ হচ্ছে, আমাদের ‘অনুশাসনের ভেতরে অনুশাসন’ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে ধর্মীয়ভাবে বিরোধী প্রকাশিত ঘৃণাকে কোমল করা যেতে পারে। বাইবেল আসলেই ক্রুদ্ধ অর্থডক্সির বিপদের প্রমাণ-এবং আমাদের নিজস্ব কালে এসব অর্থডক্সিই ধর্মীয় নয়। এক ধরনের ‘সেক্যুলার মৌলবাদ’ রয়েছে, যা সেক্যুলারিজমের বাইবেল ভিত্তিক যেকোনও মৌলবাদী ধারণার মতোই উগ্র, পক্ষপাতদুষ্ট ও ভ্রান্ত। কাব্বালিস্টরা তোরাহর ভ্রান্তি সম্পর্কে তীব্রভাবে সজাগ ছিল, তারা দিনের কর্কশ প্রাধান্য হ্রাস করতে উদ্ভাবনী উপায় বের করেছে। খোদ বাইবেলেও একই রকম বিতর্ক রয়েছে। পেন্টাটিউকে ‘P’র সমন্বয়ের বাণী ডিউটেরোনমির কঠোরতার বিরোধিতা করেছে। নিউ টেস্টামেন্টে রেভেলেশনের যুদ্ধসমূহ সারমন অন দ্য মাউন্টের শান্তিবাদের পাশাপাশি স্থাপিত হয়েছে। পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ার দিকে জেরোমে ধর্মতাত্ত্বিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে অগাস্তিন বাইবেলিয় বিতর্কে দয়া ও বিনয়ের আবেদন জানিয়েছেন, ঠিক পরবর্তী সময়ের কালভিন যেমন লুথার ও যিউইংলির যুক্তিমূলক আক্রমণে ভীত বোধ করেছেন। বাইবেলিয় আগ্রাসনের পক্ষে উৎসাহকে ঠেকাতে বেছে নেওয়া অনুশাসনকে, ফিশবেন যেমন পরামর্শ দিয়েছেন, এই বিকল্প বাণীকে আমাদের বিভাজিত বিশ্বে আরও শ্রবণযোগ্য করে তুলতে হবে। বুবের, রোজেনভিগ ও ফ্রেই যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বাইবেলের পাঠ পণ্ডিতদের আইভরি টাওয়ারে সীমিত থাকা উচিত হবে না, বরং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে প্রবলভাবে প্রয়োগ করতে হবে। মিদ্রাশ ও ব্যাখ্যাসমূহ সবসময়ই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের সাথে সম্পর্কিত হবে ধরে নেওয়া হয়েছে। মৌলবাদীদের কেবল এই প্রয়াস পাওয়া একমাত্র গোষ্ঠী হতে দেওয়া যাবে না।
বুবের ও রোজেনভিগ, দুজনই বাইবেল শ্রবণের গুরুত্বের প্রতি জোর দিয়েছেন। গোটা জীবনী জুড়ে আমরা ইহুদি-ক্রিশ্চানরা ঐশীগ্রন্থ উপলব্ধি করার লক্ষ্যে যে গ্রাহী, স্বজ্ঞা প্রক্রিয়া চর্চা করার প্রয়াস পেয়ে এসেছে তার বিভিন্ন পথ বিবেচনা করেছি। আজকের দিনে এটা কঠিন। আমাদের সমাজ মুখর ও মতামতমুখী, সব সময় শুনতে আগ্রহী নয়। রাজনীতি, প্রচারমাধ্যম ও একাঁদেমের ডিসকোর্স আবিশ্যিকভাবেই বৈরী। গণতন্ত্রের বেলায় এটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা বোঝাতে পারে যে, সাধারণ মানুষ আসলে বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে ইচ্ছুক নয়। পার্লামেন্টারি বিতর্ক বা টেলিভিশনে প্যানেল আলোচনার সময় এটা প্রায়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রতিপক্ষ কথা বলার সময় অংশগ্রহণকারীরা স্রেফ তারা এরপরে যে চতুর কথাটি বলতে যাচ্ছে সেটাই ভাবতে থাকে। বাইবেলিয় ডিসকোর্স প্রায়শই ঠিক একই সংঘাতময় চেতনায় পরিচালিত হয়ে থাকে, হাসিদিক নেতা দোভ বারের প্রস্তাবিত ‘শ্রোতা কান’ থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমরা জটিল জিজ্ঞাসার চট জলদি জবাবও আশা করি। শোরগোলই সব। বাইবেলিয় আমলে কোনও কোনও লোক লিখিত ঐশীগ্রন্থ চালাক, উপরিতলের ‘জ্ঞান’ উৎসাহিত করবে বলে ভয় পেত। ইলেক্ট্রনিক যুগে এটা আরও বড় ধরনের বিপদে পরিণত হয়েছে, লোকে যখন মাউস ক্লিক করেই সত্য আবিষ্কারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
এতে করে বাইবেলের সত্যিকারের আধ্যাত্মিক পাঠ কঠিন হয়ে গেছে। ঐতিহাসিক সমালোচনামূলক পদ্ধতির সাফল্য ছিল অসাধারণ, এটা আমাদের বাইবেল সম্পর্কে নজীরবিহীন জ্ঞান যুগিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আধ্যাত্মিকতার যোগান দেয়নি। ফিশবেন ঠিকই বলেছিলেন: অতীতের হোরোয ও পেশার ব্যাখ্যাসমূহ এখন আর কোনও পছন্দ নয়। কিংবা অরিগেনের বিস্তারিত অ্যালেগোরিও নয়, যিনি হিব্রু ঐশীগ্রন্থের প্রত্যেক শব্দে একটা না একটা গস্পেল মিকরার দেখা পেতেন। এই ধরনের সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আদি টেক্সটের অখণ্ডতা লঙ্ঘন করে বলে আধুনিক একাডেমিক অনুভূতিকে আহত করে। তবে অ্যালেগোরিয়ায় এক ধরনের ঔদার্য ছিল আধুনিক ডিসকোর্সে যার অভাব রয়েছে। ফিলো ও অরিগেন বিতৃষ্ণার সাথে বাইবেলিয় টেক্সটসমূহকে বাতিল করে দেননি, বরং সেগুলোকে সন্দেহাবসর দিয়ছেন। ভাষার আধুনিক দার্শনিকগণ যুক্তি দেখিয়েছেন যে যে কোনও ধরনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘দয়ার নীতি’ খুবই জরুরি। আমরা যদি সত্যিই একে অপরকে বুঝতে চাই, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, বক্তা সত্যি কথাই বলছেন। অ্যালেগোরিয়া ছিল বর্বরোচিত ও অস্পষ্ট বোধ হওয়া টেক্সটে সত্যি খুঁজে নিয়ে তাকে অধিকতর আন্তরিক পরিভাষায় প্রকাশ করার প্রয়াস।’ যুক্তিবাদী এন. এল. উইলসন যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, কোনও অচেনা টেক্সটের মুখোমুখি হওয়া একজন সমালোচককে অবশ্যই ‘দয়ার নীতিমালা’ প্রয়োগ করতে হবে। তাকে অবশ্যই একে ‘সেটা সত্যি সম্পর্কে কতখানি জানে, তাকে সংকলনের বিভিন্ন বাক্যের ভেতর সত্যিকে সর্বোচ্চ করবে।” ভাষাতাত্ত্বিক ডোনাল্ড ডেভিডসন বলেছেন, ‘অন্যের উচ্চারণ ও আচরণের ভেতর অর্থ খুঁজে পাওয়া, এমনকি সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আচরণের অর্থ বের করার জন্যে আপনার প্রয়োজন হবে সেগুলোর ভেতর বিপুল পরিমাণ সত্যি ও যুক্তি খুঁজে পাওয়া।” এমনকি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আপনার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও, ‘আপনাকে ধরে নিতে হবে যে আগন্তুক আপনার মতোই একই প্রকৃতির,’ নইলে আপনি তাদের মানবিকতা অস্বীকার করার বিপদে পড়ে যাবেন। ‘দয়া আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘ উপসংহার টেনেছেন ডেভিডসন, ‘আমরা পছন্দ করি বা না করি, অন্যদের বুঝতে চাইলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের ধরে নিতে হবে যে তারা সঠিক।” অবশ্য জনগণের এলাকায় লোকজনকে প্রায়শই তাদের কথা সত্যি প্রমাণিত হওয়ার আগেই ভুল ধরে নেওয়া হয়, এটাই শেষ পর্যন্ত বাইবেলের উপলব্ধির ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে।
‘দয়ার নীতি’ অন্যের সাথে ‘একাত্ম’ বোধ করার দায়িত্ব ‘সহানুভূতির’ ধর্মীয় আদর্শের সাথে মিলে যায়। অতীতের কোনও কোনও মহান ব্যাখ্যাকার-হিল্লেল, জেসাস, পল, ইয়োহানান বেন যাক্কাই, আকিবা ও অগাস্তিন- জোর দিয়ে বলে গেছেন, দয়া ও প্রেমময় ভালোবাসা বাইবেলিয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আবশ্যিক। আমাদের এই বিপজ্জনক রকম মেরুকৃত বিশ্বে ধার্মিকদের একটি সাধারণ হারমেনিউটিক্স নিশ্চিতভাবে এই ট্র্যাডিশনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের অবশ্যই তাদের নিজস্ব ঐশীগ্রন্থের ঘাটতিগুলোকে আগে যাচাই করতে হবে, কেবল তারপরেই বিনয়, ঔদার্য ও দয়ার মানসিকতা নিয়ে অন্যদের ব্যাখ্যা শুনতে হবে।
গোটা বাইবেলকে স্বর্ণবিধির ‘ধারাভাষ্য’ হিসাবে ব্যাখ্যা করার কী মানে দাঁড়াবে? এর জন্যে সবার আগে অন্যদের ঐশীগ্রন্থ উপলব্ধির দাবি করবে। আর. মেয়ার বলেছেন, ঘৃণার সঞ্চার করে ও অন্যদের অপদস্থ করতে পারে এমন যেকোনও ব্যাখ্যাই বেআইনী। আজকের দিনে ‘অন্য’ এই ‘সাধু’দের ভেতর মুহাম্মদ, বুদ্ধ ও ঋগবেদের ঋষিদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মিকা’র কোডা পাঠ করার ক্ষেত্রে মাইকেল ফিশবেনের চেতনানুসারে ক্রিশ্চানদের অবশ্যই তানাখকে কেবল ক্রিশ্চান ধর্মের সামান্য উপক্রমনিকা বিবেচনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে ও র্যাবাইদের অন্তর্দৃষ্টিকে মূল্য দিতে শিখতে হবে। ইহুদিদের জেসাস ও পলের ইহুদিসত্তা স্বীকার করে নিতে হবে এবং ফাদারস অভ দ্য চার্চ-কে বুঝতে হবে।
অগাস্তিন দাবি করেছেন, ঐশীগ্রন্থ দায়া ছাড়া ভিন্ন কিছুই শেখায় না। তাহলে আমরা কেমন করে জোশুয়ার হত্যাকাণ্ড, ফারিজিদের উপর গস্পেলের খিস্তিখেউড় আর রেভেলেশনের যুদ্ধগুলোকে ব্যাখ্যা করব? অগাস্তিন যেমন পরামর্শ দিয়েছেন, এইসব ঘটনাকে আগে তাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করতে হবে, তারপর আমরা ইতিমধ্যে যেমনটি উল্লেখ করেছি সেভাবে পাঠ করতে হবে। অতীতে কীভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল? এগুলো কি আধুনিক কালের রাজনৈতিক দৃশ্যপট ও সমসাময়িক ডিসকোর্সের দয়ার ঘাটতির উপর কোনও আলোকপাত করে?
আজকের দিনে আমরা ধর্মীয় ও সেক্যুলার উভয় এলাকাতেই বড় বেশি কঠোর নিশ্চয়তা লক্ষ করি। সমকামী, উদারপন্থী বা নারী যাজকদের অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দানের বদলে আমরা অগাস্তিনের বিশ্বাসের বিধির কথা স্মরণ করতে পারি: একজন ব্যাখ্যাকারকে অবশ্যই সব সময়ই কোনও টেক্সটের সবচেয়ে উদার ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে হবে। অতীতের অর্থডক্সিকে সমর্থন করার জন্যে কোনও বাইবেলিয় টেক্সট ব্যবহার না করে আধুনিক হারমেনেউটিক্সদের মিদ্রাশের মূল অর্থ মনে রাখা উচিত হবে : ‘অনুসন্ধানের অগ্রসর হওয়া।’ নতুন কিছুর সন্ধান করাই ব্যাখ্যা। বুবের বলেছেন, প্রত্যেক পাঠককে এমনভাবে বাইবেলের সামনে দাঁড়াতে হবে যেভাবে মোজেস জ্বলন্ত ঝোঁপের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, মনোযোগের সাথে ঐশী বাণীর অপেক্ষায় থাকতে হবে যা তাকে সাবেক ধারণা একপাশে সরিয়ে রাখতে বাধ্য করবে। এটা যদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আঘাত দেয়, আমরা বালতাসারের সাথে তাদের মনে করিয়ে দিতে পারি, কর্তৃপক্ষও ঐশীগ্রন্থের মিকরার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।
সব প্রধান ধর্মই জোর দিয়ে বলে যে, দৈনিক, ঘণ্টাপ্রতি সহানুভূতির অনুশীলন আমাদের ঈশ্বর, নির্বানা ও দাও-এর কাছে পৌঁছে দেবে। ‘দয়ার নীতি’ ভিত্তিক ব্যাখ্যা হবে এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন, আমাদের এই বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন বিশ্বে যার খুবই প্রয়োজন। বাইবেল মৃত অপ্রাসঙ্গিক কতগুলো বর্ণমালায় পরিণত হওয়ার বিপদে রয়েছে। এর আক্ষরিক অভ্রান্ততার দাবির কারণে বিকৃত হয়েছে, সেকুল্যার মৌলবাদীদের হাতে-প্রায়শই অন্যায়ভাবে- পরিহাসের শিকার হয়েছে। এটা ঘৃণা ও বন্ধ্যা যুক্তির ভাণ্ডারকে ইন্ধন যোগানো বিষাক্ত অস্ত্রে পরিণত হতে চলেছে। অধিকতর সহানুভূতিশীল হারমেনেউটিক্স আমাদের এই ছন্দহীন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ পাল্টা বিবরণের যোগান দিতে পারে।