৯. ইভনিং ক্লাবের ওপর

০৯.

ইভনিং ক্লাবের ওপর দিন দুই নজর রাখার চেষ্টা করল তারাপদরা। পার্কের গায়েই বাড়ি। পুরনো আমলের। ভাঙা ফটক, বিশ-ত্রিশ হাত মাঠ, দু-চারটে মামুলি ফুলগাছ, সিঁড়ি–তারই এপাশে-ওপাশে নানান কারবার। কোথাও ফ্রিজ মেরামতি হয়, কোথাও বাঁধাইখানা, একপাশে এক ছোট ছাপাখানা, মায় সাইনবোর্ড লেখার দোকানও। ছাপোষা ভাড়াটেও আছে। ওই বাড়ির ভেতরে কোথায় কী আছে বোঝা অসম্ভব। বাড়িও বড়। দোতলা। দোতলার একপাশে হলঘরের মতন ঘরে ইভনিং ক্লাবের আসর। অন্যপাশে এক সিনেমা কোম্পানির অফিস। পেছন দিকে হয়ত ভাড়াটে, গুদাম সবই আছে।

তারাপদ দোতলায় যায়নি, নিচে ছিল। চন্দন গিয়ে দেখে এল ওপরটা। এসে বলল, “এ বাড়িতে কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন। হরদম লোক আসছে-যাচ্ছে।”

কথাটা মিথ্যে নয়। তবে সন্ধের পর লোকের আসা-যাওয়া কম। কাজ কারবারের জায়গাগুলো তখন বন্ধ হয়ে যায়। প্রেসটা খোলা থাকে রাত সাতটা-আটটা পর্যন্ত।

বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি না করে বাড়িটার মুখোমুখি পার্কে বসেই প্রথম দিন নজর রাখল তারাপদরা। কোনো লাভ হল না। বোঝাই যায় না, কারা ইভনিং ক্লাবে রিহার্সাল দিতে আসছে। তবে দোতলা থেকে ক্লাব ঘরের হল্লা মাঝে-মাঝে পার্ক পর্যন্ত ভেসে আসছিল।

প্রথম দিন মিহিরবাবু বেরোলেন পৌনে ন’টা নাগাদ। সঙ্গে আরও তিন-চারজন লোক। মিহিরবাবুর শাগরেদ। ক্লাবের লোক। খানিকটা গল্পগুজব সেরে মিহিরবাবু রিকশায় উঠলেন। দ্বিতীয় দিনে মিহিরবাবুর বেরোতে-বেরোতে নটা।

চন্দন বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। বলল, “দুর, এ হয় নাকি? রোজ এ ভাবে পার্কে এসে বসে থাকা যায়?”।

তারাপদ গা এলিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। ঠাট্টা করে বলল, “পার্কে লোকে হাওয়া খেতেই আসে। কত লোক বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বসে আছে দেখছিস না! আমরা তো লেটে আসি।”

চন্দন বলল, “পার্কে বসে হাওয়া খায় বুড়োরা, আর নিষ্কর্মারা। আমি নিষ্কর্মা নই। “

তারাপদ বলল, “কী করবি বল। কিকিরার খেয়াল। আর-একটা দিন দেখে নিই; তারপর আর নয়।”

তৃতীয় দিনে অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল।

মিহিরবাবু যথারীতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে দু’জন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। ঘড়িতে তখন ন’টা বাজতে চলেছে। হঠাৎ একটা মোটরবাইক এসে থামল। থামামাত্র বিকট এক শব্দ। তারপর চোখের পলকে মোটর বাইক হাওয়া। খানিকটা ধোঁয়া। কেমন এক গন্ধ।

চন্দন আর তারাপদ ছুটল।

মিহিরবাবু তাঁর দুই সঙ্গী নিয়ে দাঁড়িয়ে। খানিকটা সরে গিয়েছেন।

তারাপদ দেখল, মিহিরবাবু আর তাঁর সঙ্গীরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ধর্মতলা স্ট্রিটের দিকে তাকিয়ে আছেন। মোটরবাইকটা ওদিকেই পালিয়েছে।

মিহিরবাবু চোখ ফেরাতেই তারাপদকে দেখতে পেলেন।

 তারাপদ বলল, “ব্যাপার কী? আপনার কোথাও লাগেনি তো?”

মিহিরবাবু তারাপদকে দেখলেন। চিনতে পারলেন। অবাকও হলেন, “তুমি এখানে?”

তারাপদ বলল, “আমরা এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। আমার বন্ধু চন্দন। ডাক্তার।”

“ও!” বলে মিহিরবাবু তাঁর সঙ্গীদের দিকে তাকালেন, “তাপস, কাল তুমি কোঠারিবাবুকে বলে দেবে, তাদের ঝগড়া তারা হয় ঘরে বসে, না হয় মাঠে গিয়ে মিটিয়ে আসুক। এভাবে বোমা ছোঁড়াছুঁড়ি করে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল করলে ভাল হবে না। এটা পাঁচজনের রুজি-রোজগারের জায়গা। যখন-তখন দুমদাম এখানে চলবে না। আমি কিন্তু থানায় খবর দিয়ে দুটোকেই ধরিয়ে দেব।”

তারাপদ কিছুই বুঝল না।

মিহিরবাবুর এক সঙ্গী রিকশা ডাকতে কয়েক পা এগিয়ে গেল। অন্য সঙ্গী বলল, “মিহিরদা, কাল আমি আসতে পারব না। বাগনান যেতে হবে। মাকে নিয়ে। ছোট মামার অসুখ।”

“ঠিক আছে। কাল তোমার জায়গায় প্রক্সি চালিয়ে দেব। কী হয়েছে মামার?”

“হার্ট প্রবলেম?”

“কত বয়েস?”

“সিক্সটি ফাইভ।”।

“ঠিক আছে, তুমি দু-একদিন না আসতে পারো। তুমি না হয় এখন যাও।”

“সুকুমার আসুক।”

“রিকশা ওই তো একটা আসছে। ডাকো সুকুমারকে।” উলটো দিক থেকে একটা রিকশা আসছিল।

সুকুমারকে ডাকতে হল না, অন্য একটা রিকশা নিয়েই সে আসছিল।

মিহিরবাবু সামান্য অপেক্ষা করলেন।

সুকুমার সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, “তোমরা তবে যাও। আমি এদের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।”

সুকুমার চলে গেল।

রিকশা থাকল দাঁড়িয়ে, চেনা রিকশা বোধ হয়। অন্য রিকশাটা হাত সাত-দশ দূরে।

মিহিরবাবু তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমি এদিকে?”

“আমার বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছিলাম। ও ডাক্তার। আমরা তালতলা থেকে ফিরছি। …ব্যাপারটা কী হল বলুন তো?”

“ও কিছু নয়। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা। এই বাড়িটায় কোঠারির একটা ছেলে থাকে–জলসা করে বেড়ায়। আর ওই মোটরবাইকের ছেলেটা হল মলঙ্গা লেনের। ওটা বাপের পয়সায় খায় আর ষাঁড় হয়ে ঘুরে বেড়ায়। দুজনের মধ্যে কোনো ঝগড়া আছে পুরনো। মাঝে-সাঝে পটকা ফাটিয়ে একে অন্যকে শাসিয়ে যায়।”

“পটকা?”

“ওই বোমা-পটকা!”

“তা বলে আপনাদের গায়ের সামনে বোমা ফাটিয়ে যাবে?”

“ফটকের কাছেই ফাটাতে গিয়েছিল। আমাদের বোধ হয় নজর করতে পারেনি।”

“আমরা ভাবলাম…”

“তা ভাবতেই পারে। যা দিনকাল! তবে কী জানো ভাই, আমার গায়ে হাত ভোলার মতন মানুষ এ-পাড়াতে নেই। বউবাজার পাড়ার পুরনো লোক হে, মাস্টার। দু-একজন ইয়ে আমাদেরও আছে।” বলে হাসতে লাগলেন।

চন্দন কৌতূহলের সঙ্গে মানুষটিকে দেখছিল। পান চিবোতে-চিবোতে দিব্যি খোশগল্প করে যাচ্ছেন ভদ্রলোক।

“তোমার সেই ম্যাজিশিয়ানের খবর কী?”

তারাপদ সতর্ক হয়ে বলল, “এমনিতে ভালই। তবে পা নিয়ে..”

“পা! পায়েও খেলা আছে নাকি হে। হাতের খেলাটা তো ভালই তোমার গুরুদেবের।” মিহিরবাবু ঠোঁট চেপে হাসলেন, “ওঁকে বললো, আমার লাইটারটা ফেরত দিয়ে যেতে।”

তারাপদ অপ্রস্তুত। সামলে নিয়ে চালাকি করে বলল, “উনি নিজেই বলছিলেন সেদিন একটা ইয়ে হয়ে গেছে…”

“ম্যাজিক?”

“না, মানে… ঠিক যে-কোনো পারপাস ছিল তা নয়! ভুলো মনে..”

“বুঝেছি। …তা ওঁকে আসতে বলো।”

“উনি আসবেন। বলেছেন আসলের সঙ্গে সুদ নিয়ে আসবেন।”

“সুদ?”

তারাপদ হাসল। বলল, “কিকিরা বড় ভালমানুষ। সত্যিই উনি বড় ম্যাজিশিয়ান ছিলেন।”

“হুঁ! তা যে কাজ হাতে নিয়েছেন সেটা তো ম্যাজিশিয়ানের কর্ম নয়, ভাই। যার সঙ্গে রণে নামতে চাইছেন, সেই লোকটাও কম নয়।”

চন্দন কিছু বলল না। তারাপদর হাত টিপল আড়ালে।

তারাপদ বলল, “কিকিরা এখন অমলেন্দুর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন।”

“তাই নাকি?”

“স্যার?”

“বলো।

“কিছু যদি মনে করেন একটা কথা বলব?”

“বলে ফেলো।”

“অমলেন্দু আপনার কাছে আসে?”

মিহিরবাবু সামান্য সময় তাকিয়ে থাকলেন তারাপদর দিকে। পরে বললেন, “আমি তো সেদিনই বলে দিয়েছি, সময়মতন তাকে তোমরা দেখলেও দেখতে পারো।”

রিকশাঅলা ঘন্টি বাজাল।

মিহিরবাবু তাকালেন একবার। তারাপদকে বললেন, “চলি ভায়া। ম্যাজিশিয়ানকে তাড়াতাড়ি আসতে বলল।”

চলে গেলেন মিহিরবাবু।

চন্দন কয়েক মুহূর্ত রিকশাটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফেরাল.। তারাপদকে বলল, “চল, আমরা ওই রিকশাটা ধরি। আমি মেসের কাছে নেমে যাব। তুই চলে যাস হোটেল পর্যন্ত।”

অন্য রিকশাটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, মিহিরবাবু চলে যাওয়ার পর সে তার রিকশার হাতল তুলে নিচ্ছিল।

তারাপদ আর চন্দন দু-পাঁচ পা এগিয়ে গিয়ে রিকশাঅলাকে বলল, “এই, রোখ যাও। যানা হ্যায়…।”

রিকশাঅলা রিকশা থামাল না। “দুসরা গাড়ি দেখিয়ে।”

“কাহে?”

মাথা নাড়ল রিকশাঅলা। সে যাবে না।

তারাপদ বলল, “তুমি বাপ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ; এখন বলছ যাবে না। তোমার মরজি।”

“হামকো পেট দুখাতা হ্যায়। নেহি জায়গা।”

তারাপদ চন্দনকে বলল, “কারবার দেখছিস! এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল–আর আমরা যাব বলতেই বেটা পেটব্যথার অজুহাত খাড়া করল! ব্যাটা মহা বদমাশ তো।” বলে তারাপদ রিকশার কাছ থেকে সরে আসছিল।

চন্দন হাত ধরল তারাপদর। “দাঁড়া! ওর পেট ব্যথা আমি দেখাচ্ছি।” বলে সোজা দু পা এগিয়ে রিকশার হাতল ধরে ফেলল। এই, রিকশা উতারো। পেট দুখাতা হ্যায়? ঠিক হ্যায় থামা মে চল…। হাম থানাকা বাবু। আ যাও…”

রিকশাঅলা ভয় পেয়ে গেল। বোধ হয় ক’ মুহূর্ত মাত্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর অদ্ভুত কাণ্ড করল। রিকশার হাতল ফেলে দিয়ে দে দৌড়। ক্রিক রোয়ের গলি দিয়ে ছুট।

চন্দনরাও কম হতভম্ব হল না। এরকম হবে তারা ভাবতেই পারেনি। রিকশাঅলা পালাল।

তারাপদ বলল, “কী হল রে?”

 চন্দন বলল, “আশ্চর্য! ব্যাটা পালাল কেন? ও কে রে?”

তারাপদর কেমন খটকা লাগল চন্দনের কথায়। “লোকটা অমলেন্দু নয় তো?”

“রাবিশ। অমলেন্দু রিকশাঅলা হবে কেন? এব্যাটা রিয়েল-রিয়েল রিকশাঅলা। কিন্তু ব্যাপারটা কী হল? মিহিরবাবুর ফেরার পথে কেউ নজর রাখছে নাকি?