আসলাম গুলের সঙ্গে কথা বলে শোয়েব এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলো যে ওকে আর দড়ি দিয়ে বাঁধা হবে না। বদমাশ বিহারীটা এত শক্ত করে বেঁধেছিলো যে তখনও ব্যথা যায়নি। ভেবেছিলো মাটির নিচে আগে যে ঘরে এনে রেখেছিলো সেখানেই বুঝি ঢোকাবে। শোয়েবকে অবাক করে দিয়ে বিহারীটা ওকে এমন এক ঘরে এনে ঢোকালো দেখে মনে হলো কোনও অভিজাত হোটেলের কামরা। বেশ বড় ঘর, দুদিকের দেয়াল ঘেঁষে দুটো ডবল খাট, বড় ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবিল, রাইটিং টেবিল, চারটা গদি মোড়া নরম চেয়ার–আরামের সব উপরকণ পরিপাটি করে সাজানো। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমের দরজা খোলা ছিলো। শোয়েবের চোখে পড়লো বাথরুমে বেদিং টাবও আছে। কক্সবাজারের জঙ্গলের ভেতর এমন রাজসিক আয়োজন দেখে শোয়েবের বার বার মনে হচ্ছিলো ও বুঝি স্বপ্ন দেখছে।
বিহারীটা ওকে ঘর দেখিয়ে বললো, কামরা পসন্দ হুয়া?
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে গম্ভীর গলায় শোয়েব বললো, আমার সঙ্গে যারা ছিলো তারা কোথায়?
আপ বায়ঠিয়ে। উনলোগকো অভি লাতা হুঁ। এই বলে বিহারী ঘরের দরজা টেনে দিয়ে চলে গেলো। শোয়েব দরজার নব ঘুরিয়ে দেখলো ওটা খোলাই আছে। তার মানে ওরা ধরে নিয়েছে এখন থেকে শোয়েব ওদের একজন। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ও আসলাম গুলের সঙ্গে পুরো আলোচনাটা প্রথম থেকে মনে করার চেষ্টা করলো। ঘন্টা খানেক আগে যেখানে আশঙ্কা করছিলো ওরা ওকে কত নৃশংসভাবে খুন করতে পারে, একঘন্টা পর ওদের রাজকীয় আতিথেয়তায় ওর বিচার বুদ্ধি সব গুলিয়ে গেলো। আসলাম গুলের সঙ্গে বৈঠকের কথা ভাবতে গিয়ে ওর মনে পড়লো এতক্ষণ কথা বলার পরও লোকটার নাম জানা হয়নি। পাকিস্তানী হয়ে ও হঠাৎ এত বাংলাদেশ দরদী কেন হলো তাও জানা যায়নি। জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিলো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী যে তিরিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে সে সম্পর্কে ওর বক্তব্য কী।
মিনিট পনেরো পর দরজা খোলার শব্দ হলো। শোয়েবকে এমন রাজকীয় বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে সুমন, ঝন্টু আর রবির চোখগুলো মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেলো, চোয়াল ঝুলে গেলো, বিষ্ময়ের ধাক্কায় কিছুক্ষণের জন্য সবাই হতবাক হয়ে গেলো।
বিহারীটা সুমনদের ঘরে রেখে দরজা টেনে বন্ধ করে চলে গেছে। বিছানার শোয়া থেকে উঠে বসলো শোয়েব। মৃদু হেসে বললো, কী হলো, খুব অবাক লাগছে তাই না?
সুমন নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, মনে হচ্ছে আলাউদ্দিনের প্রদীপ হাতে পেয়েছো শোয়েব ভাই।
অনেকটা তাই। তোমাদের মতো আমারও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মৃদু হেসে জবাব দিলো শোয়েব।
ঝন্টু অধীর আগ্রহে জানতে চাইলো–কী হয়েছে সব খুলে বলল।
বলছি। আগে বস তো।
সুমনদের সোফায় বসিয়ে শোয়েব দরজা খুলে গলা বাড়িয়ে ডাকলো–রহমত।
প্রথম ডাকে কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না। করিডোরে অন্য কোনও লোক নেই, সবগুলো ঘরের দরজা বন্ধ। গলাটা এক ধাপ উঁচু করে শোয়েব আবার ডাকলো–রহমত।
এবার দূর থেকে বিহারীর গলা শোনা গেলো আয়া সরকার।
একটু পরে, কোত্থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে রহমত বললো, ফরমাইয়ে সরকার।
শোয়েব সামান্য কর্তৃত্ব মেশানো গলায় বললো, চার কাপ কফি দিতে পারবে?
জরুর সরকার। বলে ও ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো।
এসব কী হচ্ছে শোয়েব ভাই? আল্লার কসম, আমাদের আর সাসপেন্সে রেখো না।
শোয়েব আসলে ভাবছিলো আসলাম গুলের সঙ্গে চাকরির ব্যাপারে যে কথা হয়েছে সেটা এদের বলা ঠিক হবে কি না। রাজনীতির এত মারপ্যাঁচ বোঝার বয়স এদের কারোই হয়নি। ঠিক করলো চাকরির প্রসঙ্গটি আপাতত গোপন রাখবে। আসলাম গুলও বলেছে চাকরির কথা কাউকে না বলতে।
সোফায় বসে শোয়েব চাকরির প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ইকবাল স্যারকে চিঠি লিখে কিভাবে ওদের সহানুভূতি আদায় করেছে সেটুকু পুরোটাই বললো।
সব শুনে সুমন বললো, ইকবাল স্যারের কাছ থেকে তোমার কাগজ ওরা কিভাবে পাবে? তুমি তো নিয়ে এসেছে।
জানি পাবে না। তবু কয়েকটা ঘন্টা তো হাতে পাচ্ছি।
ভোর হওয়ার আগেই ওরা জানতে পারবে তুমি সত্যি কথা বলোনি।
ইকবাল স্যারও তো মিথ্যে বলতে পারেন।
তুমি কী এটা ওদের বোঝাতে পারবে?
মনে হয় পারবো।
তবু কাগজ না পাওয়া পর্যন্ত ওরা তোমাকে ছাড়বে না।
তা ছাড়বে না। তবে ওদের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছি–তোমাদের ওরা কাল সকালে ছেড়ে দেবে। যেখানে যেতে চাও পৌঁছে দেবে।
রবি একটু বিরক্ত হয়ে বললো, সামান্য কটা কাগজের জন্য তুমি কেন নিজের ওপর এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছো শোয়েব ভাই। ওগুলো দিয়ে দাও না শোয়েব ভাই।
যতক্ষণ না দিচ্ছি ততক্ষণই ওরা আমাকে পাত্তা দেবে। কাগজ হাতে পেলে ওদের প্রথম কাজ হবে আমাকে মেরে ফেলা। আমি কাগজ খুঁজে বের করার জন্য সময় নেবো।
তাতে লাভ কী হচ্ছে? জানতে চাইলো ঝন্টু–তুমি কি মনে করো ততদিন এসব কাগজের কথা কোথাও ফাস করতে পারবে?
তা হয়তো পারবো না। তবে ততদিন বেঁচে থাকবো–এটাই বা কম কী।
একটা বড় ট্রেতে রহমত কফি, বিস্কিট আর পাপড় ভাজা এনে ওদের সামনের সেন্টার টেবিলে রাখলো। রবি আহ্লাদী গলায় বললো, থ্যাঙ্ক ইউ রহমত ভাই, বহুৎ শুকরিয়া।
রহমত হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রবি বললো, কাল যখন ওরা কাগজ পাবে না মনে হয় আমাদেরও যেতে দেবে না।
না দিক দড়ি দিয়ে যখন আমাদের বেঁধে রাখেনি তখন পালাতে আর কী লাগে। বললো ঝন্টু।
শোয়েব নিজেও খুব সিরিয়াসলি ভাবছিলো, কাগজ না পেয়ে রুহুল আমীনের লোক ফিরে আসবে তখন ও কী জবাব দেবে? কাগজ নিয়ে যদি ওদের ঘোরায় তাহলে আসলাম গুলও ওকে চাকরির নামে ঘোরাবে। মনে মনে ঠিক করলো। কাগজগুলো কোনও অবস্থায় ওদের দেবে না। আসলাম গুল চাকরি না দিলে নিজের কষ্টের পরিমাণ একটু বেশি হবে। তাই বলে যারা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জেনেও মুখ বুজে থাকবে–এটা কখনও হতে পারে না।
কক্সবাজারের ডিসি হাবিবুল বাশার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। গত বছর ওকে যখন কক্সবাজারে বদলি করা হয় তখনই ঠিক করেছেন সুযোগ পেলেই জামাতীদের ঘাঁটিতে হামলা করবেন। নতুন এসপি যিনি এসেছেন তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর কাছেই খবর পেয়েছেন বার্মা থেকে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান কক্সবাজার এসে আশ্রয় নিয়েছে জামাতীরা ওদের সাহায্য করার নাম করে পাকিস্তান আর সৌদি আরব থেকে অনেক টাকা আর অস্ত্র এনেছে। এসপি নওশের আলীকে তিনি বলেছেন জামাতের নেতাদের ওপর কড়া নজর রাখতে।
সুমনের বাবা তার ছেলেবেলার বন্ধু। ওর ছেলেকে উদ্ধার করার জন্য জামাতীদের কয়েকটা ঘাটি যদি রেইড করা যায়–এ নিয়ে সন্ধ্যের পরই তিনি এসপির সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। রাত নটা নাগাদ ওঁদের ইনফর্মার খবর আনলো শহর থেকে তিন মাইল দূরে জামাতীদের একটা শক্ত ঘাঁটি আছে। সুমনদের সেখানেই আটকে রাখা হয়েছে। পাশের গ্রামের লোকেরা দেখেছে ওদের সঙ্গে আরেকটা ছেলে ছিলো, যাকে প্রায়ই এ তল্লাটে দেখা যায়। ইনফর্মারের কথা শুনে মনে হলো সেখানে বন্দুক রাইফেল, মেশিনগান ছাড়াও রকেট লাঞ্চার আছে।
এসপি নওশের আলী কথা বললেন বিডিআরের এরিয়া কমান্ডারের সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিডিআর কমান্ডারও খুব উত্যক্ত ছিলেন। বললেন, তিনিও ফোর্স পাঠাবেন।
মাঝ রাতে পুলিশ আর বিডিআররা আসলাম গুল আর রুহুল আমীনদের ঘিরে ফেললো। শোয়েবরা তখন পোলাও, রোস্ট আর রেজালা দিয়ে নৈশভোজ সেরে গভীর ঘুমে অচেতন। ডিসি আর এসপি মিলে ঠিক করেছেন হামলা চালাবেন গেরিলা কায়দায়। পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি বয়স হলেও দুজনেই সেই রাতে একাত্তরের দিনগুলোয় ফিরে গিয়েছিলেন। দুজনেই অনুভব করছিলেন সেই একই রকম উদ্দীপনা। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ খবর পেয়েছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ আইএস আইর লোকজনও নাকি গোপনে রোহিঙ্গাদের ভেতর কাজ করছে। শোয়েব বুঝতে পারেনি আসলাম গুল যে আই এস আইর একজন বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ। আইএসআইর রাজনৈতিক ডেস্কে কাজ করে পাকিস্তানে আর্মির রিটায়ার্ড মেজর আসলাম গুল। একাত্তরে নিজ হাতে কত বাঙালিকে যে সে নিজে মেরেছে এখনও বন্ধু মহলে জাক করে বলে বেড়ায়।
দু বছর ধরে কোন এক জাহানারা ইমাম জামাতের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। ইসলামাবাদে আসলাম গুলের অফিস সব খবরই রাখে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বামপন্থী দলগুলোও জাহানারা ইমামের পেছনে গিয়ে জুটেছে।
প্ল্যানটা অতি যতের সঙ্গে বানিয়েছিলো আসলাম গুল। সবার আগে আওয়ামী লীগকে জাহানারা ইমামদের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে। এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে হবে আওয়ামী লীগ যেন জামাতের বিরুদ্ধে না গিয়ে ওদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করে। আওয়ামী লীগের নেতাদের বোঝাতে হবে একমাত্র এই কৌশলেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার আগে কি একাত্তরের খুনীদের বিচার সম্ভনাকি যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের বিচার সম্ভব।
শোয়েবকে যখন থেকে জামাতীরা টার্গেট করেছে তখনই ওর সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েছে আসলাম গুল। ওর লক্ষ্য হচ্ছে একটু অভাবী পরিবারের উচ্চাকাঙ্খী ছেলেরা। শোয়েবদের পরিবারের পুরো অবস্থা জেনে ঠিক করেছে এই ছেলেকে দলে টানতে হবে। সারা দেশে শোয়েবের মতো অন্ততপক্ষে শ পাঁচেক ছেলে দরকার আসলাম গুলের। শোয়েবের কাছে কী গোপন কাগজ আছে এ নিয়ে ওর মাথা ব্যথা নেই। জামাতের নেতা রুহুল আমীনকে বলে দিয়েছে কাগজ পাক নাই পাক শোয়েবকে যেন কিছু না বলে। এই ছেলেকে হাতে রাখার জন্য বাকি তিনটাকে ছেড়ে দিতে বলেছে আসলাম গুল। রুহুল আমীন অবশ্য প্রথমে আপত্তি করেছিলো। আসলাম গুল পাত্তা দেয়নি। দুদিন পর এই জায়গাটা এমনিতেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। জানাজানি হলে অসুবিধে নেই। আসলাম গুল এখানে এসেই ঠিক করেছে ওদের ঘাঁটি পুব দিকে পাহাড়ের ওপাশে আরও দুর্গম এলাকায় সরিয়ে নিতে হবে। গত সাত দিন ধরে অস্ত্রপাতি সব সেই ঘাঁটিতে গোপনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কালকের মধ্যে কাগজপত্রও সব চলে যাবে। শোয়েবকে পটাতে পেরে সেই রাতে আসলাম গুলও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলো।
.
ডিসি হাবিবুল বাশার আর এসপি নওশের আলী কক্সবাজারে জামাতীদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটিতে হামলা করতে এসে যে ধরনের প্রতিরোধের আশঙ্কা করেছিলেন সে রকম কিছুই হলো না। ওরা প্রথমে গেরিলা কায়দায় অতর্কিতে আক্রমণ করে পাহারাদারদের কাবু করে ফেলেছিলেন। শুধু শেষ পাহারাদারটা টের পাওয়াতে ঝামেলা বেঁধেছিলো। লোকটা জেগেই ছিলো। দূরে অন্ধকারে কয়েকটা কালো ছায়াকে সন্দেহজনকভাবে ছুটোছুটি করতে দেখে ও কটকট করে মেশিনগান চালিয়েছে। তিরিশ রাউন্ড গুলি হওয়ার পর ও পেছন থেকে নওশের আলীর পিস্তলের গুলি খেয়ে পড়ে গেলো।
পাহারাদারদের কাবু করে এসপি হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিলেন, সারা এলাকা পুলিশ আর বিডিআর ঘিরে ফেলেছে। ভেতরে যারা আছো মাথার ওপর দুই হাত তুলে বেরিয়ে এসো। নইলে সবাই বেঘোরে মারা পড়বে।
নওশের আলী ভেবেছিলেন তাঁর কথার মাঝখানেই বুঝি চারদিক থেকে মেশিনগানের গুলি ছুটে আসবে। বেশ কয়েকবার ঘোষণাটার পুনরাবৃত্তি করার পরও কোথাও থেকে মেশিন গান বা রাইফেল দূরে থাক পিস্তলের গুলির শব্দ পর্যন্ত হলো না। শেষে ভাবলেন শত্রুপক্ষ হয়তো চাইছে তারা ভেতরে যান। ঘুট ঘুঁটে অন্ধকারে ঘরের ভেতর থেকে গুলি ছুঁড়ে ওরা নিজেদের অবস্থান জানাতে চায় না। এসপি ঠিক করলেন ভোর হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবেন।
অপেক্ষা করার অবশ্য কোনও প্রয়োজন ছিলো না। মেশিনগানের গুলির শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া আর মাইকের ঘোষণাই আসলাম গুলদের বুঝিয়ে দিয়েছিলো ওরা যে বেকায়দায় পড়েছে। এরকম সম্ভাবনার কথা মনে রেখেই এই ঘাঁটি বানানো হয়েছিলো। পালাবার জন্য মাটির নিচে সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে পুব দিকে। মাইকের প্রথম ঘোষণার সঙ্গেই আসালাম গুল ওর সঙ্গীদের নিয়ে সুড়ঙ্গ পথে কেটে পড়েছে। শোয়েবরা আলাদা বাড়িতে ছিলো বলে বেঁচে গিয়েছিলো।
মেশিনগানের গুলির শব্দে শোয়েবদেরও ঘুম ভেঙেছে। মাইকের ঘোষণা শোনামাত্র রবি লাফিয়ে উঠে–আমাদের রেসকিউ টিম এসে গেছে, বলে বাইরে ছুটে যাচ্ছিলো।
সঙ্গে সঙ্গে শোয়েব ওকে থামিয়েছে–তুমি ক্ষেপেছো নাকি রবি? এক্ষুণি গোলাগুলি শুরু হবে। চুপচাপ ঘরে বসে অপেক্ষা করো। এই বলে ও ঘরের দরজা বন্ধ করে রিডিং টেবিলটা সরিয়ে এনে দরজার গায়ে লাগিয়ে রাখলো। যাতে সহজে ধাক্কা দিয়ে কেউ যেন খুলতে না পারে।
পর পর কয়েকবার মাইকে ঘোষণা হওয়ার পরও যখন এদিক থেকে সাড়া শব্দ হলো তখন সুমন বললো, মনে হয় এরা সবাই ভেগেছে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শোয়েব দরজা খুললো। বেশ কয়েকবার রহমত, রহমত, বলে ডাকলো। রহমতরা ততক্ষণে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে পুবের পাহাড়ের দিকে ছুটছিলো। পাহাড়ের ওপাশে গেলেই ওরা নিরাপদ।
রহমত বা অন্য কারও সাড়া শব্দ না পেয়ে শোয়েব করিডোর আর ঘরের সব আলো জ্বেলে দিলো। তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার সময় রহমতরা জেনারেটর বন্ধ করার সুযোগ পায়নি।
বাইরে থেকে এসপি নওশের আলী আর ডিসি হাবিবুল বাশার দুজনই অবাক হয়ে দেখলেন ছড়ানো ছিটানো অনেকগুলো বাড়ির একটাতে একে একে আলো জ্বলছে। ভাবলেন নিজেদের অবস্থান জানাবার জন্য শত্রুপক্ষ নিশ্চয় বোকার মতো এমন কাঁচা কাজ করবে না। তবে কি শোয়েবরা আলো জ্বেলে সংকেত পাঠাচ্ছে? ভাবতে গিয়ে ওঁরা মনে মনে প্রমাদ গুণলেন। শত্রুপক্ষ টের পেলে শোয়েবদের আস্ত রাখবে না।
মিনিট দশেক অপেক্ষা করে শোয়েবরা বুঝে ফেললো এখানকার সবাই পালিয়েছে। তারপর মাথার ওপর হাত তুলে ফ্রেন্ডস, ফ্রেন্ডস, বলে বেরিয়ে এলো।
ডিসি হাবিবুল বাশার ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, সুমন কে?
সুমন এগিয়ে যেতেই তিনি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমার বাশার চাচা। তোমার বাবা অস্থির হয়ে পড়েছেন তোমাদের সবার জন্য।
বাবা কোথায়? জানতে চাইলো সুমন।
কক্সবাজারে, আমার বাসায়। আসতে চেয়েছিলো, বারণ করেছি। আমরা তো ভেবেছিলাম জামাতীদের সঙ্গে একাত্তরের মতো একটা যুদ্ধ হবে। ওরা এভাবে পালাবে। ভাবিনি।
শোয়েব বললো, শুধু জামাতী নয়। পাকিস্তানীও আছে ওদের সঙ্গে।
ডিসি হেসে বললেন, কক্সবাজার গিয়ে সব শুনবো। এখন গাড়িতে ওঠো। ওপাশে আমার জিপ আছে।
এসপি এসে শোয়েবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন সুমনদের গাড়িতে রাখা আপনার কাগজগুলো পেয়েছি। দারুণ কাজ করেছেন।
এরই জন্য বেচারার জানটা যেতে বসেছিলো। এই বলে ডিসি হাবিবুল বাশার ছেলেদের তাড়া লাগালেন, আমাদের আর দেরি করা চলবে না। বাকি কাজ পুলিশ করবে। চলল, আমরা কক্সবাজারে গিয়ে সানরাইজটা বীচে বসে দেখি।
সুমনরা সবাই ডিসির জিপের পেছনে উঠে বসলো। এসপি বললেন আপনারা যান, এদের ঘাটিটা ভালো করে সার্চ করতে হবে। দেখি কোনও সূত্রটুত্র ফেলে রেখে গেছে কি না।
ডিসির জিপ কক্সবাজারের পথে রওনা দিলো। সুমন বললো, আমাদের কক্সবাজার পৌঁছানোর কথা ছিলো কাল সন্ধ্যায়, মাত্র তেত্রিশ ঘণ্টা দেরি হয়েছে, অথচ মনে হচ্ছে এর ভেতর তেত্রিশ দিন কেটে গেছে।
হাবিবুল বাশার মৃদু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা হয়েছে তোমাদের?
রবি বললো, এ্যাডভেঞ্চারই বটে। অল্পের জন্য পৈত্রিক প্রাণটা খোয়াতে হয়নি
ঝন্টু বললো, আসলেই এ্যাডভেঞ্চার। ভেবে দেখ প্রতিটা মুহূর্তে আমরা কিভাবে মৃত্যুর তাড়া খেয়ে ছুটছিলাম।
হাবিবুল বাশার মৃদু হেসে বললেন, কক্সবাজার চলো, তোমাদের সব কষ্ট পুষিয়ে দেবো।
কিভাবে আঙ্কল? জানতে চাইলে সুমন।
তোমরা আসছো শুনে আমার দুই মেয়ে মিনি আর নিনি চমৎকার একটা হলিডে প্ল্যান তৈরি করে রেখেছে। না, এর বেশি বলতে পারবো না। তাহলে ওরা আর আমার সঙ্গে কথাই বলবে না।
ওঁর কথা শুনে সুমন, ঝন্টু আর রবি এক সঙ্গে হেসে উঠলো।